রিমঝিম – ৭

৬ ভাদ্র।

কয়েকদিন ডায়েরি লেখা হয়নি। কী করব, হয়ে উঠছে না। কাজকর্ম করে তবে তো ডায়েরি লেখা?

জীবনের চাকা আবার বাঁধা-ধরা পথে ঘুরতে আরম্ভ করেছে। রুগীর সেবা করা, খাওয়া ঘুমোনো গল্প করা। হোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়।

জামাইবাবু রাত্রির অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত আসা-যাওয়া করেন; কোনওদিন জানতে পারি, কোনওদিন পারি না। শুক্লার মুখে শুনেছি, মন্মথ কর সম্বন্ধে কোনও খবর পাওয়া যায়নি। ভয়ানক ধূর্ত লোক। একদিন আমাকে ফোন করেছিল, কেমন আছেন? চায়ের নেমন্তন্ন মনে আছে তো?

বলেছিলাম, মনে আছে। কিন্তু ভীষণ ব্যস্ত সময় নেই।

সে বলেছিল, ব্যস্ত? আমার একটা কেসে নার্স দরকার, ভেবেছিলাম আপনাকেই ডাকব।

ধন্যবাদ। কিন্তু এখন তো পারব না।

আচ্ছা, আপনি যাঁর সঙ্গে থাকেন, কী নাম মনে পড়ছে না, তিনিও কি এনগেজড?

হ্যাঁ, শুক্লা অন্য জায়গায় কাজ করছে।

ও! তা আমি অন্য ব্যবস্থা করব। আচ্ছা, আপনি ডক্টর নিরঞ্জন দাসকে চেনেন কি?

একটু চমকে গেলুম, ডক্টর দাসকে চিনি বইকি। তাঁর কাছে পড়েছি।

হ্যাঁ হ্যাঁ। ভারি চমৎকার লোক—না?

তাই তো মনে হয়। কেন বলুন দেখি?

তিনি অমন ভাল লোক, কিন্তু তাঁর স্ত্রী শুনেছি ভীষণ দজ্জাল খাণ্ডার মেয়েমানুষ। আপনি নিশ্চয় জানেন?

ডাক্তারদের ঘরের খবর আমি কোত্থেকে জানব?

তা বটে। আচ্ছা, আজ এই পর্যন্ত। চায়ের কথাটা মনে রাখবেন।

আর সন্দেহ নেই, মন্মথ করই শুক্লা আর ডক্টর দাসের কথা জানতে পেরেছে। কী চালাকির সঙ্গে আমাকে জানিয়ে দিল। ডক্টর দাসের স্ত্রী দজ্জাল খাণ্ডার মেয়েমানুষ; অর্থাৎ তাঁর কানে খবরটা তুলে দিলে কী ব্যাপার হবে তোমরা ভেবে দেখ। উঃ সাংঘাতিক লোক এই মন্মথ কর।

কিন্তু কেন? শুক্লা আমার বন্ধু, তাকে কলঙ্কের হাতে থেকে বাঁচাবার জন্যে আমি মন্মথ করের সঙ্গে চা খেতে যাব, এই জন্যে? কিংবা ও হয়তো ভেবেছে আমাদের দুজনের সঙ্গেই ডক্টর দাসের ঘনিষ্ঠতা। কী নোংরা নিঘিম্নে মন লোটার। কিন্তু আমার ওপরেই বা এত নজর কেন? লম্পটের চোখে আমি কি এতই লোভনীয়?

কী আছে স্ত্রীলোকের শরীরে যার জন্যে পৃথিবী জুড়ে এমন টানাটানি হেঁড়াছিড়ি? খানিকটা রক্ত-মাংস বই তো নয়। এরই জন্যে এত? কিংবা ওরা হয়তো ভাবে শরীরটা পেলে সেই সঙ্গে আরও কিছু পাবে। যা খুঁজছে তা পায় না, তাই বোধহয় ওদের দেহের ক্ষুধা মেটে না; একটা দেহ। ছেড়ে আর একটা দেহের পানে ছুটে যায়। তারপর যখন নেশা কেটে যায় তখন দেখে সব ভাঁড়ই শুকনো, কোনও ভাঁড়েই রস নেই।

যাকগে। এসব অরুচির কথা ভেবে লাভ নেই। আমার জীবনে ও জিনিসকে আমি কাছে ঘেঁষতে দিইনি, কখনও দেবও না। আমি বেশ আছি, শান্তিতে আছি। শুক্লা সেদিন আপন মনে। গাইছিল-সই, কে বলে পীরিতি ভাল, হাসিতে হাসিতে পিরীতি করিয়া কাঁদিয়া জনম। গেলদরকার নেই আমার পিরীতি করিয়া। পিরীতি করার কত সুখ তা তো চোখেই দেখেছি। শুক্লার মনে একদণ্ড শান্তি নেই, স্বস্তি নেই; যেন চোরদায়ে ধরা পড়েছে।

পিউকে অনেকদিন দেখিনি। শঙ্খনাথবাবু বলে গিয়েছিলেন আবার একদিন খেতে আসবেন, কিন্তু আসেননি। কাজের লোক, হয়তো ভুলে গিয়েছেন। সেদিন শুক্লা বলল, ভদ্রলোক আর তো এলেন না। এমন সুন্দর জিনিস উপহার দিয়েছেন, আমাদের উচিত ওঁকে ধন্যবাদ দেওয়া। একবার ফোন কর না।

ফোন করলুম, কিন্তু কেউ ফোন ধরল না। বাড়িতে বোধহয় কেউ নেই। শিউসেবকও যদি ফোন ধরত তাকে পিউয়ের কথা জিগ্যেস করতুম। এতদিনে নিশ্চয় বাড়িময় ছুটোছুটি আর খেলা করে বেড়াচ্ছে।

ভাদ্র মাস পড়ে অবধি বৃষ্টি বন্ধ ছিল, আকাশে মেঘও ছিল না। ভেবেছিলুম বর্ষা বুঝি শেষ হল। কিন্তু আজ সকাল থেকে আবার টিপটিপ আরম্ভ হয়েছে।

আমার জীবনে একটা বিচিত্র ব্যাপার বার বার ঘটতে দেখেছি। এক তো জন্মদিনে বৃষ্টি হবেই। তাছাড়া হঠাৎ যদি অসময়ে বৃষ্টি নামে সেদিন আমার জীবনে একটা কিছু ঘটবে, তা সে ভালই হোক আর মন্দই হোক। বাবা যেদিন মারা যান, সেদিন বৃষ্টি পড়েছিল। তাই ভাবছি, আজ কিছু ঘটবে নাকি? কী ঘটতে পারে? কী ঘটা সম্ভব?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *