১০. চিত্তরঞ্জনের শেষজীবন

দশম অধ্যায় – চিত্তরঞ্জনের শেষজীবন

চৌরীচৌরায় উন্মত্ত জনতার হিংসাত্মক কার্যের প্রতিবাদস্বরূপ গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন বন্ধ করিলেন। ইহার পরেই তাঁহার ছয় বৎসর বিনাশ্রম কারাদণ্ড হয়। গান্ধীর কার্যের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন দাশ স্বরাজ্য দল গঠন করেন, এবং প্রথমে কংগ্রেস ও এই দলের মধ্যে বিরোধ থাকিলেও পরে ১৯২২ সনের ২৭শে মে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বম্বে অধিবেশনে একটা আপসরফা হয়, ইহা পূর্বেই বলা হইয়াছে।

১৯২৪ সনের ১৩ই জানুআরি সংবাদ প্রচারিত হইল, গান্ধী অ্যাপেনডিসাইটিস রোগে আক্রান্ত এবং অস্ত্রোপচারের জন্য তাহাকে যারবাদা জেল হইতে পুণার হাসপাতালে নেওয়া হইয়াছে। স্বরাজ্য দল নোটিশ দিল, তাহারা কেন্দ্রীয় বিধানসভায় গান্ধীকে মুক্তি দিবার জন্য একটি প্রস্তাব আনিবে। স্থির হইল, এই প্রস্তাব ৫ই ফেব্রুআরি (১৯২৪) তারিখে আলোচিত হইবে। ৪ঠা ফেব্রুআরি মধ্যরাত্রে গভর্নমেন্ট ঘোষণা করিল, নষ্ট স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ডাক্তারেরা গান্ধীকে অন্ততঃ ছয়মাস সমুদ্রতীরে রাখা আবশ্যক মনে করেন, এই কারণে গান্ধীকে মুক্তি দেওয়া হইল।

সুস্থ হইয়া গান্ধী মতিলাল নেহেরু ও চিত্তরঞ্জন দাশের সহিত আলোচনা করিয়া বলিলেন, কাউন্সিলে প্রবেশ ও অসহযোগ আন্দোলন-পরস্পর-বিরোধী। ১৯২৪ সনের ২৭শে জুন আহমদাবাদে নিখিল ভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে গান্ধী প্রস্তাব আনিলেন, যাহারা কাউন্সিলে যোগ দিবে তাহারা অসহযোগের বিরোধী, সুতরাং তাহারা কংগ্রেসের কোন কার্যকরী সমিতির (Congress Executive Board) সদস্য হইতে পারিবে না। মতিলাল নেহেরু খুব জোরগলায় গান্ধীর এই প্রস্তাবের প্রতিবাদ করিয়া বলিলেন, চরকা কাটিয়া স্বরাজ লাভ করিতে পারা যাইবে না’ এবং জানিতে চাহিলেন, গান্ধীর কারাবাসের সময় তাঁহার অনুগামীরা গঠনমূলক কার্যে কতদূর অগ্রসর হইয়াছে। মতিলাল তখন পাল্টা প্রস্তাব করিলেন, গান্ধীর প্রস্তাব কংগ্রেসের নিয়মের বিরোধী, সুতরাং ইহা বে-আইনি বলিয়া অগ্রাহ্য করা হউক। কিন্তু তাহার এই প্রস্তাব গৃহীত হইল না। ইহার পক্ষে ৬৮ জন এবং বিপক্ষে ৮২ জন ভোট দিলেন। তখন মতিলাল, চিত্তরঞ্জন ও তাঁহাদের সমর্থকগণ সভাগৃহ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। কিছুকাল পরে কলিকাতায় গান্ধীর সহিত তাঁহার ও চিত্তরঞ্জনের আলোচনার ফলে নিম্নলিখিত মর্মে একটি আপসরফা হইল : “কংগ্রেসের সকল সদস্যই চরকায় সুতাকাটা, কাপড়বোনা, অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ এবং হিন্দু-মুসলমানের মিলন প্রভৃতির সপক্ষে কার্য করিবেন। কংগ্রেসের অন্তর্ভুক্ত স্বরাজ্য দল কংগ্রেসের পক্ষ হইতে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনসভায় কার্য করিবে এবং ইহার জন্য স্বতন্ত্র নিয়মাবলী গঠন করিবে এবং অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয় করিবে।”

আহমদাবাদের এই সভায় নিম্নোক্ত ঘটনাটি লইয়া চিত্তরঞ্জন দাশের সহিত গান্ধীর মতভেদ হয়। এই সময় কলিকাতার পুলিশ কমিশনার ছিলেন সার চার্লস টেগার্ট।

একজন বিপ্লবী লিখিয়াছেন, টেগার্ট ছিলেন “অতি বুদ্ধিমান ও দক্ষ ব্রিটিশ রাজপুরুষ। ইংরেজের অতবড় মিত্র এবং বিপ্লববাদের অতবড় সুদক্ষ শত্রু তেমন একটা দেখা যায় না।” গোপীনাথ সাহা নামে একজন বাঙ্গালী যুবক তাহার প্রাণনাশের সংকল্প করেন। ১৯১৪ সনের ১২ই জানুআরি সকালে চৌরঙ্গীতে তিনি অনুরূপ চেহারার একটি সাহেবকে দেখিয়া টেগার্টভ্রমে গুলি করিয়া হত্যা করেন। নিহত ব্যক্তি ছিলেন কিলবার্ন কোম্পানির কর্মচারী মি. ডে। টেগার্ট হাজতে তাহার সঙ্গে দেখা করিলে গোপীনাথ বলেন, নির্দোষ একজনকে মারার জন্য তিনি দুঃখিত। কিন্তু “বিচারের দিন কাঠগড়া থেকে নিয়ে যাবার সময় চীৎকার করে তিনি বললেন, মি. টেগার্ট মনে করতে পারেন যে তিনি এ যাত্রা বেঁচে গেছেন। কিন্তু আমার অসমাপ্ত কাজ অন্য কেউ সমাপ্ত করবে। ১৯২৪ সনের ১লা মার্চ প্রেসিডেন্সী জেলে তার ফাঁসি হয়। ফাঁসির আগে তাঁর শরীরের ওজন পাঁচ পাউন্ড বেড়েছিল। ফাঁসির সময় বলে গেলেন, আমার প্রতি রক্তবিন্দু ঘরে ঘরে স্বাধীনতার বীজ বপন করবে।”

বীরত্ব ও দেশের জন্য আত্মোৎসর্গের এই উদাহরণ বাংলা দেশে তাঁহার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির উদ্রেক করিয়াছিল। ইহার নিদর্শ স্বরূপ সিরাজগঞ্জে বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের বার্ষিক সম্মেলনে তাঁহার সম্বন্ধে নিম্নলিখিত প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। বিচার বিতর্কের বিষয় বলিয়া মূল প্রস্তাবটি উদ্ধৃত করিতেছি : “ This conference while denouncing and dissociating itself from violence and adhering to the principle of non-viloence, appreciates Gopinath Saha’s ideal of self-sacrifice, misguided though it is, in respect of the country’s best interest and expresses respect for self-sacrifice.”

আহমদাবাদে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির অধিবেশনে গান্ধী গোপীনাথ সাহার হত্যাকাণ্ডের জন্য নিন্দাসূচক একটি প্রস্তাব আনেন। চিত্তরঞ্জন দাশ সংশোধকরূপে সিরাজগঞ্জের উক্ত প্রস্তাবটি উত্থাপিত করেন। সংশোধক প্রস্তাবটির সপক্ষে ৭০ ভোট এবং বিপক্ষে ৭৮ ভোট। গান্ধীর প্রস্তাব গৃহীত হইলেও তিনি অতিশয় দুঃখিত হইয়া তাঁহার পত্রিকা ‘ Young India’তে লিখিলেন : “প্রস্তাব উপলক্ষে বক্তৃতা, ভোট ও পরে যে দৃশ্য দেখিলাম তাহাতে আমার চোখ খুলিয়া গিয়াছে। যদিও চিত্তরঞ্জন দাশ আট ভোটে পরাজিত হইয়াছে তথাপি আমার মতে তাঁহারই জয় হইয়াছে। ১৪৮ জন সদস্যদের মধ্যে ৭০ জন তাঁহাকে সমর্থন করিয়াছিলেন, ইহা আমার চোখ ফুটাইয়া দিল, কিন্তু এখনও পুরাপুরি আলোর সন্ধান পাই নাই।”

গোপীনাথ সাহার সম্বন্ধে চিত্তরঞ্জনের সংশোধক প্রস্তাব গান্ধী প্রত্যাখ্যান করায় বঙ্গদেশে বিষম ক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি হইয়াছিল। বাঙ্গালী আজও ভুলিতে পারে নাই যে, গোপীনাথের ফাসীর ছয়বছর পরে ভগৎ সিংয়ের যখন ফাঁসীর হুকুম হয় তখন গোপীনাথ সাহার সম্বন্ধে যে-প্রস্তাব গান্ধী প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন, ঠিক সেই প্রস্তাবই ভগৎ সিংয়ের সম্বন্ধে তাহার উপস্থিতি ও সমর্থনে কেবল কংগ্রেসে অনুমোদিত হইল তাহা নহে, তিনি ভগৎ সিংয়ের ফাঁসীর হুকুম রহিত করিবার জন্য বড়লাটকে অনুরোধও করিয়াছিলেন। ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত একখানি গ্রন্থে বাঙ্গালী বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিত লিখিয়াছেন : “ইতিহাস জানে যে, এই মহাত্মা গান্ধীই একদিন গোপীনাথ সাহার আত্মত্যাগ ও বীরত্বের প্রশংসামূলক প্রস্ত বি সিরাজগঞ্জের প্রাদেশিক কংগ্রেস সভা গ্রহণ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং কলকাতা কর্পোরেশনকে অনুরূপ গৃহীত প্রস্তাবটি নাকচ করে দিতে বাধ্য করেছিলেন। …আজ জনমতের চাপে সেই মহাত্মাই ভগৎ সিং-দের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের মর্যাদা দিতে বাধ্য হলেন, এবং গান্ধী-আরউইন চুক্তি’র সাফল্যকামনায় এই বীরত্রয়ীর প্রাণরক্ষার সংকল্পে রাজদরবারে বিস্তর হাঁটাহাঁটি করলেন।”

গান্ধীজি যেমন পারিপার্শ্বিক প্রভাবে হিংসাত্মক কার্যের সমর্থন করিয়াছিলেন, চিত্তরঞ্জনের জীবনেও আমরা বিপরীত ভাবের সেইরূপ পরিবর্তন দেখিতে পাই। ১৯২৪ সনের ১লা জুন সিরাজগঞ্জে গোপীনাথ সাহার আত্মত্যাগ সম্বন্ধে প্রশংসাসূচক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং ঐ মাসের শেষেও চিত্তরঞ্জন আহমদাবাদে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটিতে গোপীনাথ সাহার সম্বন্ধে গান্ধীর নিন্দাসূচক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে যে-প্রস্তাব উপস্থিত করেন, তাহা মাত্র আটটি ভোটে (৭৮-৭০) নাকচ হয়। কিন্তু এক বৎসর অতীত না-হইতেই চিত্তরঞ্জন সর্বপ্রকার হিংসাত্মক কার্যের তীব্র নিন্দা করিয়া একটি ইস্তাহার বাহির করিলেন (২৯শে মার্চ, ১৯২৫)। ৩রা এপ্রিল ভারতের ইউরোপীয়ান অ্যাসোসিয়েশন চিত্তরঞ্জনের ইস্তাহারটিতে হিংসাত্মক নীতির সম্পূর্ণ নিন্দা (unequivocal condemnation of the use of violence) বলিয়া গ্রহণ করেন এবং সন্তোষ প্রকাশ করেন। বিলাতে ভারত-সচিব লর্ড বার্কেহেড পার্লিয়ামেন্টে ইহার অনুমোদন করিয়া চিত্তরঞ্জনকে গভর্নমেন্টের সহিত সহযোগিতা করিতে এবং হিংসাত্মক নীতি বন্ধ করিতে অনুরোধ জানাইলেন। ৩১শে মার্চ চিত্তরঞ্জনও তাহাতে তাহার সম্মতি জানাইলেন (৩রা এপ্রিল, ১৯২৫)। ইহাতে তিনি বলিলেন, গভর্নমেন্টও যদি তাহাদের দাবি অন্ততঃ বেশকিছুটা মানিয়া না লন তবে হিংসাত্মক নীতি বন্ধ করা অসম্ভব।

চিত্তরঞ্জনের এই মতপরিবর্তন ও ইংরেজ গভর্নমেন্টের সঙ্গে গোপনে আপোসের কথাবার্তা খুব আকস্মিক ও অস্বাভাবিক বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু চিত্তরঞ্জনের কন্যা তাঁহার পিতৃদেবের জীবনচরিতে এ-বিষয়ে একটু আলোকপাত করিয়াছেন।

২৫শে অক্টোবর (১৯২৪) সন্ত্রাসবাদীদের দমন করিবার জন্য যে জরুরী আইন (ordinance) পাশ হয় তাহা পূর্বেই উল্লেখ করিয়াছি। এই আইনের বলে সুভাষচন্দ্র বসু ও আরও অনেককে গ্রেপ্তার করার প্রসঙ্গে অপর্ণা দেবী লিখিয়াছেন : “বেঙ্গল অর্ডিন্যান্স যেন বাবাকে সম্মুখসমরেই আহ্বান করলো। প্রিয় শিষ্যদের ধৃত হওয়ার সংবাদে পিতৃদেবের সে উত্তেজিত অবস্থা কখনও ভুলবো না। সুভাষকে ধরেছে। এবার গভর্নমেন্টকে কাঁপিয়ে ছাড়ব। (অসুস্থতার জন্য চিত্তরঞ্জন তখন সিমলায় ছিলেন।) সুভাষের গ্রেপ্তারের খবরের সঙ্গে সঙ্গেই সংবাদপত্রে তাঁর বক্তব্য জানিয়ে ২৭শে অক্টোবর কলিকাতা রওনা হলেন। সুভাষদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে কলিকাতা টাউন হলে এক বিরাট সভা আহুত হলো। সে সভায় পিতৃদেব জ্বালাময়ী ভাষায় বললেন, বাংলার যুবক, তোমাদের হৃদয়ে স্বাধীনতার আগুন জ্বলিয়া উঠুক, স্বাধীনতার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে ছুটিয়া এস, আত্মবিসর্জন দিতে দ্বিগুণ তেজে জ্বলিয়া উঠ। এই জরাজীর্ণ দেহ লইয়া সর্বাগ্রে আমি সম্মুখীন হইব। তোমরা অনুসরণ কর। মা, একবার সংহারমূর্তিতে প্রকাশিত হও, মা আমরা সকলে তোমার সম্মুখে আত্মোৎসর্গ করিয়া স্বাধীনতার পথ উন্মুক্ত করিয়া রাখি।…

মেয়রের আসন থেকে তিনি গভর্নমেন্টকে যুদ্ধার্থে আহ্বান করে (challange) 2016a: ‘All that I say is that Mr. Subhas Chandra Bose is no more a revolutionary than I am’.

… … … …

“গভর্নমেন্ট কিন্তু পিতৃদেবের দৃঢ় আহ্বানের (challenge) উত্তর অন্যভাবে দিয়েছিল। তারা পিতৃদেবের সঙ্গে একটি আপোষের প্রস্তাব করে পাঠালো। মহাত্মাজী তখন রাজনৈতিক ক্ষেত্র থেকে একরকম অবসর গ্রহণ করে তাঁর খদ্দর প্রচলন কার্যে ব্যাপৃত ছিলেন। রাজনীতিক্ষেত্রে পরিচালক ছিলেন তখন পিতৃদেব ও স্বরাজ্যদল। স্বরাজ্যদলের প্রভাব তখন বাঙ্গলার শাসনকর্তা লর্ড লিটন খুব ভালভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন এবং পিতৃদেবের উপর তার অগাধ ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাও ছিল। কাজেই তখন কংগ্রেসের সহিত আপোষ মানেই তিনি বুঝেছিলেন পিতৃদেবের সহিত আপোষ করা। তাই বাইরের জগতে এ আপোষের কথা

অজানা থাকলেও লর্ড লিটন ও পিতৃদেবের মধ্যে এ আপোষের কথাবার্তা বহুদিন থেকেই চলছিল।”

অপর্ণা দেবীর শেষ উক্তি–বহুদিন হইতেই লর্ড লিটন ও চিত্তরঞ্জনের মধ্যে যে একটা আপসের কথাবার্তা চলিয়াছিল–এ-সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ প্রমাণ না-থাকিলেও ইহা সত্য বলিয়া মনে হয়, কারণ ইহা ব্যতীত পূর্বোক্ত বার্কেহেড ও চিত্তরঞ্জনের মত-বিনিময়ের আর কোন সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।

কারণ যাহাই হউক চিত্তরঞ্জনের মতপরিবর্তনের স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় ফরিদপুর কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে (১৯২৫, ২রা মে)।

চিত্তরঞ্জন প্রথমেই বলেন, “একটা জাতির ইতিহাসে স্বাধীনতা লাভ করিবার পক্ষে কয়েক বৎসর মাত্র ব্যবধান খুব বেশী সময় নয়।” ইহার সঙ্গে গান্ধীর ‘এক বৎসরের মধ্যে স্বরাজলাভের প্রতিশ্রুতি’ বিশেষভাবে তুলনীয়। ইহার পর চিত্তরঞ্জন ‘ধীরে ও শান্তভাবে’ গভর্নমেন্টের সহিত আপোষের প্রস্তাব সম্বন্ধে কয়েকটি সর্তের উল্লেখ করেন :

“প্রথমতঃ, গভর্নমেন্ট হঠাৎ দমননীতি প্রয়োগের যে কতকগুলি ক্ষমতা ধারণ করিয়া আছেন তাহা একেবারে পরিত্যাগ করিবেন এবং তাহার প্রমাণস্বরূপ রাজনীতিক বন্দীদের সর্বপ্রথমেই ছাড়িয়া দিবেন।

“দ্বিতীয়তঃ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যে থাকিয়াই যাহাতে আমরা নিকটবর্তী ভবিষ্যতে পূর্ণ স্বরাজ লাভ করিতে পারি, তাহার সম্বন্ধে পাকা কথা দিবেন–যে কথার নড়চড় হইতে পারিবে না।

“তৃতীয়তঃ, পূর্ণ স্বরাজ-লাভের পূর্বে ইতিমধ্যে এখনই আমাদের শাসনযন্ত্রকে এমনভাবে পরিবর্তিত করিবেন যাহাতে পূর্ণ স্বরাজলাভের একটা স্থায়ী পাকা ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।

“এখন পূর্ণ স্বরাজলাভের পথে কিভাবে এই বর্তমান শাসনযন্ত্রকে কোন্ দিকে কতটা পরিবর্তন করিতে হইবে তাহা মিটমাট-প্রসঙ্গে কথাবার্তার উপর নির্ভর করে।…

“আমরাও গভর্নমেন্টের সহিত এমন একটি সর্তে আবদ্ধ হইব যে, কি কথায়, কি কার্যে, কি হাবভাবে, আমরা রাজদ্রোহমূলক কোন আন্দোলনে উৎসাহ দিব না–অবশ্য এখনও দিই না–এবং আমরা সর্বতোভাবে এইরূপ আত্মঘাতী আন্দোলন দেশ হইতে দূর করিবার জন্য চেষ্টা করিব।…

“যে শক্তি ও সামর্থ্য ভ্রান্তপথে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে এখন প্রয়োগ করিবার ব্যর্থ চেষ্টা হইতেছে তাহা দেশের প্রকৃত কল্যাণকর কার্যে নিযুক্ত হইয়া সার্থকতা লাভ করিবে।

“যদি আমাদের আপোষের প্রস্তাবে গভর্নমেন্ট কর্ণপাত না করেন…(তবে) সমগ্র ভারতে প্রজাশক্তির মধ্যে একযোগে একটা বিরাট অহিংসামূলক গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে অবাধ্যতার আবহাওয়া সৃষ্টি করা। স্বাধীনতাপ্রয়াসী পর্যুদস্ত আমরা, আমাদের হস্তে স্বাধীনতার যুদ্ধে ইহাই শেষ অস্ত্র। আমি বলি ব্রহ্মাস্ত্র।”[২]

রাজনীতিক ক্ষেত্রে ইহাই চিত্তরঞ্জনের শেষ ভাষণ। উদ্ধৃত অংশের শেষ প্যারাটি বাদ দিলে এই ভাষণটিতে সুরেন্দ্রনাথ কর্তৃক পরিচালিত মধ্যপন্থী রাজনীতিক নেতাগণ কোনই আপত্তির কারণ পাইতেন না, এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না। চিত্তরঞ্জনের অনুবর্তীগণ অনেকেই ইহাতে অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছিলেন। এ সম্বন্ধে অপর্ণা দেবীর নিম্নলিখিত মন্তব্য কিছুমাত্র অত্যুক্তি নহে, বরং তাহার বিপরীত বলা যাইতে পারে।

“পিতৃদেবের এ ভাষণ যুবক-সম্প্রদায়ের মনঃপূত তেমন হয়নি এবং তাঁরা মনে করেছিলেন তিনি গভর্নমেন্টের কাছে একরকম আবেদনই করলেন। তাঁর কর্মীদের মধ্যেও এ অভিভাষণ নিয়ে কেউ কেউ বিদ্রোহ ঘোষণার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাবার বিরাট ব্যক্তিত্বের কাছে তাদের সে প্রচেষ্টা সার্থক হয়নি।”

এই ব্যক্তিত্বের প্রভাব ভারতের রাজনীতির একটি বৈশিষ্ট্য। সুরেন্দ্রনাথ, গান্ধী, চিত্তরঞ্জন, পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু প্রভৃতির ব্যক্তিত্বের প্রভাবে স্বাধীন চিন্তা ও মতগঠন প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছিল। ইহা দেশের পক্ষে শুভ কি আশুভ-সে সমস্যা, এবং অপর্ণা দেবীর নিম্নলিখিত মন্তব্য, বিচার করা এ প্রসঙ্গে অনাবশ্যক। “ফরিদপুরে পিতৃদেবের প্রদর্শিত পথে নেতৃত্বের মোহ ও আত্মম্ভরিতা ত্যাগ করে দেশ যদি অগ্রসর হতো তবে পূর্ণ স্বরাজ আমরা বহু বৎসর পূর্বেই পেতাম। ভারতকে খণ্ডিত করে স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হতো না।”[৩]

ফরিদপুরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক অধিবেশনের পরেই চিত্তরঞ্জন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের জন্য দার্জিলিং যান। তাহার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবার জন্য গান্ধীও সেখানে গেলেন (৪ঠা জুন, ১৯২৫)। সেখানে পাঁচদিন অবস্থানকালে বার্কেহেডের সম্বন্ধে গান্ধীর আলোচনা হইয়াছিল। চিত্তরঞ্জনের “দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে বার্কেহেড একটা কিছু করবেন। কিন্তু গান্ধীর এ-বিষয়ে ততটা আশা ছিল না।” এইটি উল্লেখ করিয়া অপর্ণা দেবী বলিয়াছেন, “ফরিদপুর প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশনের ছয় সপ্তাহ পর চিত্তরঞ্জন দেহত্যাগ করেন। এই ছয় সপ্তাহ ধরে চিত্তরঞ্জন আশা করেছিলেন বার্কেহেড কিছু করবেন এবং আলোচনার জন্য লণ্ডনে তাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। এ আশা করা তাঁর ভুল হয়নি, কেননা লর্ড বার্কেহেড হাউস অব কমন্সে মিটমাটের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন এবং ফরিদপুরে চিত্তরঞ্জনও তাঁর প্রত্যুত্তর দেন। এপ্রিল মাসে, লর্ড লিটন ও চিত্তরঞ্জনের মধ্যে পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমেই এসব আলোচনা হয়েছিল। ১৬ই জুন দেহত্যাগ না করলে সে আমন্ত্রণ তিনি নিশ্চয়ই পেতেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।”[৪]

এইসব মতামতের আলোচনা বর্তমান প্রসঙ্গে অনাবশ্যক। তবে মোটের উপর একথা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে, চিত্তরঞ্জন প্রকাশ্যে হিংসাত্মক নীতির নিন্দা করিয়া কতকগুলি সর্তে গভর্নমেন্টের সহিত আপসের চেষ্টা করিতেছিলেন এবং ভারতস্থ ইংরেজসম্প্রদায় এবং বিলাতের গভর্নমেন্টও এ-বিষয়ে কতকটা অগ্রসর হইয়াছিলেন। ইহার সমর্থক আর একটি প্রমাণ-বড়লাট লর্ড রেডি বিলাতে যাইতেছেন এবং ভারত-সচিব বার্কেহেডের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া ৭ই জুলাই ভারতসম্বন্ধে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি করিবেন, এই মর্মে এক সরকারী ঘোষণা প্রকাশিত হইল। ইতিমধ্যে ১৬ই জুন (১৯২৫) দার্জিলিং শহরে চিত্তরঞ্জনের মৃত্যু হইল। সমগ্র দেশে, বিশেষতঃ কলিকাতায়, যে শোকের দৃশ্য দেখা গিয়াছিল তাহা অভূতপূর্ব বলা যাইতে পারে।

পূর্বেই বলিয়াছি, এই সময় গভর্নমেন্ট চিত্তরঞ্জনকেই নেতা বলিয়া মনে করিতেন। সুতরাং তাঁহার মৃত্যুতে এই মনোবৃত্তি-বশতঃই আপসের কথা আর বেশীদূর অগ্রসর হইল না। সুভাষচন্দ্র বসু বলেন : “যখন ভারতে চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুতে শোকযাত্রা ও স্মৃতিসভার অনুষ্ঠান চলিতেছে তখন ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা তাহাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী স্থির করিতেছিল। প্রধান শত্রু নিপাত হইয়াছে, সুতরাং আপাততঃ কিছুদিনের জন্য কোন ভয় ভাবনার কারণ নাই। তাড়াতাড়ি কোন সিদ্ধান্ত না করিয়া দেখা যাউক ব্যাপার কিরূপ দাঁড়ায়। কিন্তু লর্ড বার্কেহেড ৭ই জুলাই (১৯২৫) একটি বিশেষ ঘোষণা (Pronouncement) করিবেন, ইহা পূর্বেই প্রচারিত হইয়াছিল, সুতরাং অনেক বিচার ও আলোচনার পর যে-ঘোষণাপত্র প্রস্তুত হইয়াছিল তাহা চাপা দিয়া, নির্দিষ্ট তারিখে সাধারণভাবে বার্কেহেড ভারতের শ্রমশিল্পের উন্নতি, রাজস্ব ইত্যাদি সমস্যার আলোচনা করিলেন। পণ্ডিত মতিলাল নেহেরু স্বরাজ্য দলের নেতা হিসাবে আপসের কথাবার্তা চালাইতে চেষ্টা করিলেন, কিন্তু গভর্নমেন্ট এ-বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীনতার ভাব দেখাইলেন। ভারতীয় রাজনীতিক্ষেত্রে একটি স্মরণীয় যুগের অবসান হইল।

তথ্যনির্দেশ

১. অপর্ণাদেবী, “মানুষ চিত্তরঞ্জন”, ২৭৩ পৃ.।

২. অপর্ণাদেবী, “মানুষ চিত্তরঞ্জন”, ২৮৭-৮৯ পৃষ্ঠা।

৩. অপর্ণাদেবী, “মানুষ চিত্তরঞ্জন”, ২৯০-৯১ পৃষ্ঠা।

৪. তদেব, ২৯৪-৯৫ পৃষ্ঠা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *