বুড়ো ঘোড়া

বুড়ো ঘোড়া – মতি নন্দী – কিশোর উপন্যাস

দক্ষিণ কলকতায় রবীন্দ্র সরোবর স্টেডিয়ামের সামনে বাস থেকে নামলেন জহর পাল। সাদার্ন অ্যাভিনিউ পার হয়ে শরৎ বসু রোড ধরে মিনিট দুই হেঁটে বাঁ দিকের একটা রাস্তা নিলেন। তিনটে বাড়ির পর থেমে গেলেন। লোহার ফটকে সাঁটা টিনের পাতে লেখা ‘কুকুর হইতে সাবধান’। তার নীচে হুঁশিয়ারিটা ইংরেজিতেও লেখা।

জহর পাল এই বাড়িতে দু—তিনবার এসেছেন। দুটো ডোবারম্যান কুকুরকে তিনি দেখেছেন। দিনের বেলা সে—দুটো বাঁধা থাকে সদর দরজার পাশে। রাত্রে ওরা সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এখন সকাল এগারোটা, তাই চেন দিয়ে বাঁধা। চেনের দৈর্ঘ্যটা এমনই যে, তেড়ে এসে কামড়াতে পারবে না, তবে খুব কাছে এসে ভয় দেখাতে পারবে।

একতলার দরজায় পৌঁছতে দুটো কুকুরই গম্ভীর স্বরে ডেকে উঠে জহরের দিকে এগিয়ে এল। ভয় আর অস্বস্তি তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিল। ভেতরের ঘর থেকে ধমকে—ওঠা গলার স্বর শোনা গেল, ”বোজো… লিজা… কোয়ায়েট, কোয়ায়েট।”

এই কণ্ঠস্বরের মালিক এবং বোজো ও লিজার প্রভু হল প্রাণকৃষ্ণ পোদ্দার। আত্মীয়স্বজনের কাছে যে পানু, খেলার মাঠের লোকদের কাছে পানুদা বা পানুবাবু। আগে তাকে যারা পেনো বলত, তারা গত চার বছর ডাকছে পানু, এমনকী আড়ালেও আর পেনো বলে না।

বাংলার ক্রিকেটে প্রাণকৃষ্ণ গত চার বছর ধরে প্রতিপত্তি বিস্তারের জন্য কাজ করে চলেছে। ব্রাদার্স ইউনিয়ন কলকাতার নামি ক্রিকেট ক্লাব, ফুটবলও খেলে। এই ক্লাবটির ক্রিকেট দল চালাবার দায়িত্ব সে চার বছর আগে নিয়েছে। বিস্তর টাকাও খরচ করেছে। প্রাণকৃষ্ণর ঠাকুর্দা ছিলেন পাটের আড়তদার; থাকতেন উত্তর কলকাতায় কুমারটুলিতে। পাটের সঙ্গে তিনি যোগ করেন কাঠের ব্যবসা। যথেষ্ট ধনী হয়ে ওঠেন।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় প্রাণকৃষ্ণর বাবা মিলিটারি কন্ট্রাক্টরি ও সিমেন্টে ভেজাল দিয়ে লক্ষ—লক্ষ টাকা কামান। যুদ্ধের পরই পৈতৃক বাসস্থান ছেড়ে তাঁরা দক্ষিণ কলকাতায় এই বাড়িটা তৈরি করে উঠে আসেন। এই বাড়িতেই প্রাণকৃষ্ণ ও তার ভাইবোনেরা জন্মেছে। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তাদের সম্পত্তির সঙ্গে যুক্ত হয় হুগলি জেলার একটা রাইস মিল আর দুটো কোল্ড স্টোরেজ। প্রাণকৃষ্ণ এখন প্রসাধনী সামগ্রী প্রস্তুতের ব্যবসায়ে নামার তোড়জোড় করছে। নিউ মার্কেটে পশম সামগ্রীর বিরাট দোকানটা তো আছেই।

প্রাণকৃষ্ণর প্রচুর টাকা আছে বটে, কিন্তু দেশের লোকের কাছে সে একজন কেউকেটা নয়। কেউ তাকে চেনে না, সম্মানও দেয় না। একবার সে ভেবেছিল রাজনীতিতে নেমে নেতা হবে, তার পর মন্ত্রী। ইচ্ছাটা তার মোসায়েব ও পরামর্শদাতা কানাই ভট্টাচার্যকে জানায়। কানাই অর্থাৎ কানুদা অতঃপর প্রাণকৃষ্ণকে একটা দুর্গাপুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট করে দেয়। তিনটে ফুটবল প্রতিযোগিতার ফাইনালে তাকে দিয়ে পুরস্কার বিতরণ করায়। পরিবেশদূষণ প্রতিরোধ সেমিনারে বক্তৃতা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু প্রাণকৃষ্ণকে লোক চিনল না। সে বক্তৃতা দিতে গেলেই তোতলায়। শ্রোতারা হাসে। সে রাজনীতির লাইন ছেড়ে দেয়। অতঃপর সে স্থির করে কেউকেটা হতে গেলে তাকে খেলার লাইন ধরতে হবে। আর খেলা বলতে তো একটাই, ক্রিকেট। এ—খেলায় গ্ল্যামার আছে, নামডাক আছে, বছর—বছর টেস্টম্যাচ হয়, টিকিটের জন্য লোকে পাগল হয়ে ওঠে। তা ছাড়া ক্রিকেট তার কাছে অপরিচিত নয়। যে ব্রাদার্স ইউনিয়নের সে এখন ক্রিকেট সেক্রেটারি, একদা সেই ক্লাবে ক্রিকেট খেলেছে। তার সেক্রেটারিত্বে ব্রাদার্স ইউনিয়ন, কলকাতা গড়ের মাঠে যে ক্লাবটি শুধুই ব্রাদার্স নামে পরিচিত, দু’বার সি এ বি নক আউটে আর লিগে রানার্স হয়েছে। জে সি মুখার্জি ট্রফি জিতেছে কিন্তু পি সেন ট্রফি এখনও জেতা হয়নি।

প্রাণকৃষ্ণ ঠিক করে ফেলেছে কলকাতার সব ক্রিকেট সম্মান ব্রাদার্স ইউনিয়নকে এনে দেবে, দেবেই। এজন্য দু’লাখ টাকা পর্যন্ত সে খরচ করবে। কেমন টিম হবে, কাকে কত টাকা দিয়ে দলে আনবে, অন্য রাজ্য থেকে বর্তমান ও প্রাক্তন কোন টেস্ট প্লেয়ারকে আনা হবে—এইসব নিয়েই প্রাণকৃষ্ণ বসার ঘরে তার পারিষদদের সঙ্গে আলোচনায় যখন ব্যস্ত, তখনই বাইরে থেকে বোজো, লিজা ঘেউ—ঘেউ করে ওঠে।

”দ্যাখ তো সুবলা, কে এল?” প্রাণকৃষ্ণ সোফায় এলিয়ে সেন্টার টেবিলে পা দুটো ছড়িয়ে দিল।

সুবলা অর্থাৎ সুবল মুখুজ্যে, লম্বা, ছিপছিপে, গলাটি ঈষৎ লম্বা, চোখদুটি সর্বদাই ঢুলুঢুলু, উঠে দরজার দিকে এগোল।

তখন দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন জহর পাল। খয়েরি ট্রাউজার্সে ভাঁজ নেই, একই অবস্থা ফিকে হলুদ রঙের হাওয়াই শার্টের। হাতে একটা বড় খাম। জহর পালের বয়স পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্নর মধ্যে। চোয়ালদুটো ছড়ানো, থুতনিটা চাপা। ফলে একধরনের দৃঢ়তা সবসময়ই ওঁর গালদুটিতে চেপে থাকে। মনে হয় একগুঁয়ে স্বভাবের মানুষ। মাথার সামনের দিকের চুল পাতলা, টাক পড়তে শুরু করেছে। ভুরু ঘন ঝোপের মতো, চোখদুটো তার মধ্যে জ্বলজ্বল করে। গায়ের রং দুধ না দেওয়া চায়ের মতো। শরীরের কোথাও চর্বির আধিক্য নেই। কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত হাত দুটোয় জড়িয়ে আছে তিন—চারটি শিরা। উচ্চতায় নাতিদীর্ঘ। ওঁকে দেখলেই মনে হয়, খাটিয়ে লোক এবং আজীবন খেটেছেন। কথা বলেন মৃদুস্বরে কিন্তু তাতে ফুটে ওঠে চাপা মর্যাদাবোধ ও ব্যক্তিত্ব। তিনি নিজেকে একজন পেশাদার ক্রিকেটার হিসাবে পরিচয় দিতে ভালবাসেন।

বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে জহর পাল গলাখাঁকারি দিয়ে ঘরের লোকেদের ওপর চোখ বোলালেন। সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে, কারও চোখে আমন্ত্রণের আভাস নেই।

”একটা দরকারে এসেছি পানু।”

”কী দরকার?” প্রাণকৃষ্ণ সোফায় দেহটা মোচড়াল।

”আমার ছেলের সাঙ্ঘাতিক একটা রোগ হয়েছে। মাথার ব্রেনের মধ্যে পোকা। সিটি স্ক্যান করিয়েছি, এই যে তার রিপোর্ট আর ছবি।” জহর হাতের খামটা থেকে সেগুলো বের করতে যেতেই প্রাণকৃষ্ণ হাত তুলে বলল, ”থাক, থাক, ওসব ডাক্তারি রিপোর্ট এমন ভাষায় লেখা হয়, পড়ে বুঝতে পারব না।”

”ব্রেনের মধ্যে পোকা!” কানু ভট্টাচার্য বিশালভাবে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ”বাপের জন্মে এমন কখনও শুনিনি।”

”আমিও শুনিনি।” জহর বললেন। ”এখন দু—চারজনের কাছে শুনলাম তাদের আত্মীয়স্বজনের এমন ব্যাপার ঘটেছে। খাওয়ার সঙ্গে বা জলের সঙ্গে রিং ওয়ার্ম, হুক ওয়ার্ম শরীরে ঢুকে ব্রেনেও চলে যায়, ডিম পাড়ে, বংশবৃদ্ধি করে।”

”তা হলে তো দেখেশুনে এবার থেকে খেতে হবে পানুদা। বাইরে যা—তা দোকানের খাবার খাওয়া এবার থেকে তা হলে তো বন্ধ করা দরকার। ছেলের বয়স কত?” সুবল জানতে চাইল।

”আঠারো। হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। প্রথমে আমরা ভেবেছিলাম মৃগি বোধ হয়। নিওরোলজিস্ট করুণা ভটচায সিটি স্ক্যান করাতে বলেন।”

”কত খরচ হল?” কানু ভটচায জানতে চাইল।

‘ষোলো শো টাকা।”

”বাব্বা! আজকাল চিকিচ্ছের কী খরচ! বুঝলে পানু, সেদিন ডাক্তার ব্লাড প্রেশারের একটা ওষুধ লিখে দিল। দোকানে গিয়ে প্রেসক্রিপশনটা দেখাতে বলল, দশটার দাম দুশো কুড়ি টাকা। বললাম, ওষুধের পায়ে দণ্ডবত, দরকার নেই আমার অমন ওষুধে। ব্রাদার্স ইউনিয়ন করে—করেই তো ব্লাড প্রেশার চড়েছে, ঠিক আছে, সামনের বছর থেকে ক্লাব আর করব না। ওতেই প্রেশার কমে যাবে। পানু বললেও করব না।”

প্রাণকৃষ্ণর মুখে মুচকি হাসি খেলে গেল। ”পারবে কানুদা ক্লাব না করে? তোমার রক্তে লেখা আছে ব্রাদার্স ইউনিয়ন। ক্লাব না করলেই রক্ত মাথায় চড়ে যাবে।”

”যায় যাবে।” পঁয়ষট্টি বছর বয়সী কানুদা বাচ্চচাদের মতো অভিমান দেখিয়ে ঠোঁট ফোলাল। তোবড়ানো গাল দুটো ভেতরে বসে গিয়ে মুখটা চুপসে গেল।

সবাই মজা পাওয়ার দৃষ্টি নিয়ে কানুদার দিকে তাকিয়ে। জহরের চোখে মজা নেই। তিনি উদ্বিগ্ন চোখে প্রাণকৃষ্ণর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁকে কেউ বসতে বলেনি।

”ডাক্তার একমাস খাবার জন্য ওষুধ দিয়েছিলেন।” জহর বললেন।

”কত টাকা দামের?” কানুদা কথাটা বলে হাঁ করল। তার সামনের চারটে দাঁত নেই। জিভটা বেরিয়ে এল ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে।

”দিনে কুড়ি টাকা। যাদব ঘোষ খুব বড় ডাক্তার, তিনি নিশ্চিত হওয়ার জন্য বললেন, মাথার এম আর আই স্ক্যান করতে হবে। তার জন্য পড়বে পাঁচ হাজার টাকা। তাই পানুর কাছে এসেছি।” জহরকে কুণ্ঠিত দেখাল।

”আমার কাছে, কেন?” প্রাণকৃষ্ণ টেবিল থেকে পা নামিয়ে সোজা হয়ে বসল।

”চার হাজার এখনও বাকি আছে।” মৃদুস্বরে জহর বললেন।

”কিসের চার হাজার?”

”কথা ছিল পাঁচ হাজার, অ্যাডভান্স পেয়েছি এক হাজার… বাকি টাকাটা এখন পেলে—।”

”টাকাফাকা কিছু বাকি নেই।” প্রাণকৃষ্ণ বিরক্ত স্বরে বলল। ”খেলেছেন তো মোটে তিনটে ম্যাচ। স্কোর কত করেছেন?’

সুবল বলে উঠল, ”জিরো নট আউট, আট নট আউট, আর একুশ রান আউট।”

”তবে?” প্রাণকৃষ্ণ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন জহরের দিকে। ”ওইক’টা রানের জন্য এক হাজার টাকা তো পেয়েই গেছেন, আবার কী?”

”ঊনত্রিশ রান এক হাজার টাকায়! পানু তো দানছত্তর খুলে বসেছে।” কানুদা বলে উঠল। ”রান পিছু তেত্রিশ টাকারও বেশি!”

”তা ছাড়া আপনাকে একটা ব্যাট দিয়েছি, সামান্য পুরনো হলেও ইংলিশ উইলোর ব্যাট। ওটারই দাম এখন চার হাজার টাকা তো হবেই। ওটা বিক্রি করুন।”

”না।” জহরের গলা দিয়ে আতঙ্কিত আর্ত চাপা স্বর বেরিয়ে এল।

”ব্যাট বেচতে পারব না।”

”তা হলে আর আমি কী করতে পারি। আপনার সঙ্গে লিখিত চুক্তি হয়েছিল কি?” প্রাণকৃষ্ণ এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে তির্যক দৃষ্টিতে তাকাল।

”সুবলের সঙ্গে মুখে কথা হয়েছিল।” জহর তাকালেন সুবলের দিকে।

”কী জানি মনে পড়ছে না কত টাকার কথা বলেছিলুম। … পাঁচ হাজার কি?” সুবল ভুরু কুঁচকে মনে করার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

”পানু, শুধু ঊনত্রিশটা রানই দেখলে? কোন সিচুয়েশনে ক’ নম্বরে নেমে রানগুলো করেছি, সেসবও ভাবো। ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে সাতটা উইকেট পড়ে যাওয়ার পর নামি, তখন মাত্র তিন ওভার বাকি। জিততে হলে দরকার সত্তর রান। আদার এন্ডে পর পর দুটো উইকেট পড়ে গেল। বাকি উইকেটটা নিলেই ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ জিতে যায়। দু’দিকে বল করছে টেস্ট বোলার দিল্লির রঞ্জিত শর্মা আর বাংলার রনজি বোলার সুধীর দত্ত। হাবলা ব্যাট করতে এল, দেখি ওর হাত কাঁপছে। এইসময় তুমি কী আশা করো?”

জহর পাল থেমে গিয়ে সবার মুখের দিকে তাকালেন। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে সুবল গাল চুলকোল। প্রাণকৃষ্ণ বুকের কাছে দুই করতল জড়ো করে নিঃশব্দে তালি দিচ্ছে। কানুদা ধুতির কোঁচা পাট করছেন গভীর মনোযোগে। কেউ জহরের প্রশ্নের জবাব দিল না।

”লাকিলি হাবলা ব্যাট করতে আসে ওভারের ফার্স্ট বলে উইকেট পড়তে, ওকে আর একটাও বল ফেস করতে হয়নি। শর্মার ওভারের লাস্ট বলে একটা রান নিয়ে ওধারে যাই। তারপর ম্যাচের লাস্ট ওভার। সবক’টা বল আমিই খেলে দিই। ওই আটটা রানের দাম কি সংখ্যা দিয়ে কষা যায়? ব্রাদার্সের মান তো বেঁচেছিল। তারপর….।”

জহর পাল প্রাণকৃষ্ণর দিকে তাকালেন জিজ্ঞাসু চোখে।

প্রাণকৃষ্ণ বুকের কাছ থেকে হাতদুটো নামিয়ে বলল, ”ব্যাটটা আমি সেদিন আপনাকে দিয়েছিলুম। তবে ম্যাচটা হেরেছি।”

”কিন্তু জহর, এবার পানু যা টিম করছে, তাতে তোর জায়গা নেই। ম্যাচ ড্র করার জন্য প্লেয়ার এবার আর ব্রাদার্সে পানু রাখবে না।” কানু ভটচায ধীর গলায় কথাটা বলে প্রাণকৃষ্ণর দিকে তাকাল। ”তাই কি না?”

প্রাণকৃষ্ণ সম্মতিসূচক মাথা হেলাল।

”যাদের সঙ্গে লিখিত চুক্তি হয়েছিল তাদের সবাইয়ের পাইপয়সা পর্যন্ত মিটিয়ে দিয়েছি। মৌখিক চুক্তি যাদের সঙ্গে তাদেরও যা দেওয়ার দেওয়া হয়ে গেছে। জহরদা আপনি এবার আসতে পারেন।” প্রাণকৃষ্ণ মাপা স্বরে কথাগুলো বলল।

জহর পালের কালো মুখটা শুকিয়ে গেল। আঙুলে ধরা খামটা কেঁপে উঠল।

”তা হলে টাকা পাব না? আমার যে ভীষণ দরকার।”

”জহরদা, অন্য কোথাও থেকে বরং জোগাড় করে নাও।” সুবল বলল।

জহর পালের বুক থেকে উঠে এল হতাশার দীর্ঘশ্বাস। আপন মনেই বললেন, ”কোথায় জোগাড় করব। …. পানু, তোর দুটো হাত ধরে বলছি টাকাটা আমায় দে। চার হাজার টাকা তোর কাছে তো হাতের ময়লা।” কথাটা বলে জহর পাল এগিয়ে এলেন প্রাণকৃষ্ণর দিকে দু’হাত বাড়িয়ে।

”থাক থাক, আর হাত—পা ধরতে হবে না। ব্রাদার্সের জন্য আমি দানছত্তর খুলে বসিনি। আপনি আসুন। আপনার জন্য আমি অনেক করেছি। এখনও যে ময়দানে ব্যাট হাতে নামার সুযোগ পাচ্ছেন সে তো আমারই জন্য। আপনার সময়ের ক্রিকেটাররা কবে মাঠে আসা ছেড়ে দিয়েছে আর আপনি আজও চালিয়ে যাচ্ছেন।” প্রাণকৃষ্ণ তিক্ত স্বরে বলল। ”এখন যা করছেন, সেই দোকান মন দিয়ে করুন, ভজন কেত্তন করুন, ছেলেকে মানুষ করুন।”

”আচ্ছা জহরদা, তুমি তো রনজি ট্রফিতে পাঁচ—ছ’টা ম্যাচ খেলেছ, একটা হান্ড্রেড, দুটো ফিফটিও আছে। তুমি তো ক্রিকেটটা বোঝো?” সুবল সামনে ঝুঁকে সিরিয়াস গলায় বলল। ”কিন্তু এটা কি বোঝো না, ক্রিকেট এখন একদম বদলে গেছে। ঘণ্টা ধরে খেলার বদলে এখন ওভার ধরে খেলা হয়। এখন আর ঠুকুস—ঠুকুস করে ব্যাটা করা চলে না, এখন ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ করে খেলতে হয়? এখন তোমার মতো কপিবুক ক্রিকেটার দিয়ে আর ম্যাচ জেতা যাবে না।”

”সুবল, আমার সময়ের কপিবুক ক্রিকেট দিয়েই সেদিন ইস্টবেঙ্গলের এগেনস্টে ম্যাচটা ড্র করিয়েছিলাম। কিছুমাত্র ক্রিকেট যদি বুঝতিস তা হলে যে বারোটা বল সেদিন খেলেছিলাম সেগুলো মনে করার চেষ্টা কর। ধর তক্তা মার পেরেকরা ওই বারোটার দুটোও সামলাতে পারত না। ব্যাটিংটা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে শিখেছিলাম। আজ দিল্লি—বম্বে থেকে প্লেয়ার ভাড়া করে আনতে হয়, কেন?” জহর পাল উত্তেজিত হয়ে ঘরের সবার মুখের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে প্রাণকৃষ্ণর ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।

”তোরাই বাঙালি ছেলেদের শিখতে দিলি না ক্রিকেট কাকে বলে। … দরকার নেই আমার চার হাজার টাকার, মরুক আমার ছেলে… কিন্তু পেনো তোকে আজ বলে যাচ্ছি, ভুল জায়গায় টাকা ছড়াচ্ছিস। ক’টা ট্রফি জিতলেই কেউকেটা হওয়া যায় না। বাংলার ক্রিকেটের জন্য পাকাপোক্ত কিছু কাজ কর। তোর সম্মান অনেক বাড়বে যদি ব্রাদার্সের দুটো ছেলে ইন্ডিয়া টিমে ঢুকতে পারে।”

উত্তেজনায় থরথরে গলায় কথাগুলো বলে জহর পাল ঘুরে দাঁড়াল বেরিয়ে যাওয়ার জন্য।

”খুব বড়—বড় কথা বললেন।” প্রাণকৃষ্ণ বিদ্রূপের স্বরে বলল।

”হ্যাঁ বললাম।’ জহর পাল ঘুরে দাঁড়ালেন। ”তোর অনেক টাকা, কিন্তু শুধু টাকা দিয়ে ক্রিকেটে সম্মান জেতা যায় না। যদি কখনও দিন আসে তোকে সেটা বুঝিয়ে দেব। মনে রাখিস।”

জহর পাল ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বাইরে কুকুর দুটো ঘেউ—ঘেউ করে উঠে চুপ করে গেল।

”যত্তসব বড়—বড় কথা।” ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে কানু ভটচায বলল, ”হ্যাঁ, যা বলছিলুম, চারটে ম্যাচ খেলে দেবে মাণ্টু সিং, চল্লিশ হাজার চেয়েছে। ওকে কী বলব পানু?”

.

প্রাণকৃষ্ণর বাড়ি থেকে বেরিয়ে জহর পাল শরৎ বসু রোড ধরে হেঁটে এসে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে এলেন। ওপারে দেশপ্রিয় পার্ক। তিনি যখন রাস্তা পার হচ্ছেন তখন একটা মারুতি গাড়ি ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল তাঁর থেকে পাঁচ মিটার দূরে। জহর চমকে তাকালেন।

চোখে সানগ্লাস, ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটা তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছে। জহর পালের চেনা—চেনা মনে হল, কিন্তু পুরোপুরি চিনে উঠতে পারলেন না।

জানলা দিয়ে মুখ বার করে লোকটা বলল, ”জর্দা, আমি ঘুনু, অবনী। এত বেলায় এ—পাড়ায়?”

জহর গাড়ির কাছে এগিয়ে এলেন। ”ওহ, ঘুনু…! …এই একটা কাজে এসেছিলাম। তোকে তো আর চেনাই যাচ্ছে না, কী মোটা হয়ে গেছিস!”

”উঠে এসো। বহু বছর পর…. তুমি কিন্তু একটুও বদলাওনি।”

জহর গাড়ির দরজা খুলে ঘুনুর পাশে বসলেন।

”কোথায় যাচ্ছিস?’

”বাড়ি, মানে ফ্ল্যাটে। চলো একটা ঠাণ্ডা খাবে।”

”এই দুপুরে?”

”তাতে কী হয়েছে, দুটো পুরনো দিনের কথা হবে, ভাতও খাবে।”

”আবার ভাত—টাত কেন!”

”আগে চলো তো। ক্রিকেট তো তোমার হাতেই শিখেছি, তুমিই আমার গুরু। গুরুকে দুটো ভাত খাওয়াব, এ আর এমন কী!”

কথা বলতে—বলতে ঘুনু গড়িয়াহাট মোড়ে পৌঁছে গাড়ি বাঁ দিকে ঘুরিয়ে গড়িয়াহাট রোড ধরল।

”তুই তো থাকতিস হিন্দুস্থান রোডে, এদিকে যাচ্ছিস যে?”

”বাবা মারা গেছেন। ভাইবোনেদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগাভাগি হয়ে গেছে। বাড়ির অংশ না নিয়ে আমি চা—বাগানগুলো আর কিছু শেয়ার নিয়েছি। ফ্ল্যাট কিনেছি দু’বছর হল। এতকাল চা—বাগানেই কাটিয়েছি।”

”চায়ের ব্যবসা করছিস?”

”হ্যাঁ। এক্সপোর্ট করি। মাছের ব্যবসাও ধরেছি, চিংড়ি চালান দিচ্ছি।”

একটা সাততলা বাড়ির গেট দিয়ে ঘুনু গাড়ি ঢোকাল। জহরের মনে হল, এই বাড়ির এক—একটা ফ্ল্যাটের দাম বারো—চোদ্দো লাখ টাকার কম হবে না। পাঁচতলায় উঠে লিফট থেকে বেরিয়েই সামনে দরজা। বেল বাজাতেই দরজা খুলল পরিচ্ছন্ন প্যান্ট ও হাওয়াই শার্ট পরা ভৃত্য। জহরের মনে হল ওর পোশাক তার থেকে দামি কাপড়ের। বিশাল বসার ঘরের আসবাব, ছবি, কার্পেট ইত্যাদি দেখে জহর অবাক। ঘুনু যে রীতিমতো ধনী তাতে কোনও সন্দেহ রইল না তার। অবশ্য ঘুনু যখন ব্রাদার্সে প্রথম খেলতে আসে, তখনই সে ‘বড়লোকের ছেলে’ বলে ক্লাবে পরিচিত ছিল। ওদের বাড়িটা ছিল বাগানওলা একতলা বাংলো ধরনের। বালিগঞ্জের পুরনো বাসিন্দা। দু’খানা মোটরগাড়ি আর জনাচারেক কাজের লোক, মালি।

‘জহরদা, বাড়িতে ভাববে না তো?”

”ভাববে পানু নিশ্চয়ই ভাত খাওয়াচ্ছে, তাই দেরি হচ্ছে। পানু যে কী জিনিস সেটা আর তো বউদিকে জানাইনি।”

”তুমি পানুর বাড়িতে গেছলে? ও তো এখন ক্লাবের ভাইস—প্রেসিডেন্ট।”

”পেছলাম দায়ে পড়ে।”

এর পর জহর পাল সংক্ষেপে তাঁর যাওয়ার কারণটা বললেন। তার মধ্যেই ঠাণ্ডা নরম পানীয় এল, সব শুনে ঘুনু বলল, ”পানুটা আর বদলাল না, সেই নেমকহারামই রয়ে গেল। দু’বছর ব্রাদার্সের ক্যাপ্টেন ছিল। দেখেছি তো, মাঠে আসল ক্যাপ্টেন তো ছিলে তুমিই। কখন কাকে বল দিতে হবে, কীভাবে বল করতে হবে, বোলারকে লাইন—লেংথ বুঝিয়ে দেওয়া, ফিল্ড সাজানো, বদলানো সবই তুমি ওকে বলে—বলে দিতে। আমরা তাই নিয়ে হাসাহাসি করতাম, ওর কিন্তু গায়ে লাগত না। জহরদা, মনে আছে মোহনবাগান ম্যাচটায় ওর হাফসেঞ্চুরি করাটা?”

জহর স্মিত হেসে মাথা নাড়লেন।

”আমি এবার চান করব, তুমি করবে?”

”না, তুই করে আয়। ফ্ল্যাটটা বড় চুপচাপ, ফাঁকা—ফাঁকা লাগছে।”

”তার কারণ, আমি আর কাজের ছেলেটা ছাড়া আর কোনও বাসিন্দা নেই। বিয়ে করিনি।” বলেই ঘুনু ভেতরে চলে গেল।

একা বসে জহর পাল ঘুনুর কথা ভাবতে—ভাবতে বছর তিরিশ আগের একটা দিনে ফিরে গেলেন। ওকে প্রথম দেখেন মাঠের বাইরে চেয়ারে বসে। সঙ্গে ছিলেন ক্রিকেট সেক্রেটারি। বিরু ঘোষ। ব্যাট করছে সুদর্শন এক কিশোর। বল করছে তিনজন। জহর কথা বলায় ব্যস্ত থাকায় নেটের দিকে বিশেষ নজর দেননি। একবার মুখ ফিরিয়ে দেখেই চমকে উঠলেন। বল করল নেপাল চ্যাটার্জি, তখন বাংলার সবথেকে জোরে বোলার। ভাল লেংথে অফস্ট্যাম্পে বল পড়ল। ছেলেটা পলকের মধ্যে এক—পা বেরিয়ে এসে ব্যাট চালাল। আকাশে সোজা তারাবাজির মতো বলটা উঠে গেল। অন্তত আশি—নব্বই মিটার দূরে বলটা নেমে এল। নেপাল কোমরে হাত রেখে অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে।

কী ফুটওয়ার্ক! কী টাইমিং! জহর তাকিয়ে রইলেন। পরের বলটা করল বাঁ হাতি স্পিনার অরুণাভ। ছেলেটা এক—পা, দু’পা এগিয়ে এসে ব্যাট চালাল। আবার তারাবাজি লং অনে। বলটা যে কোথায় গেল সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। এমন একটা ভাব ওর ভঙ্গিতে ফুটে রয়েছে, যেন ব্যাটকে দিয়ে যে কাজ করাতে হয় সেইটাই করিয়েছে এতে বাহাদুরির কিছু নেই। পর—পর ছ’টা বলে ছ’টা তারাবাজি হল। বোলারদের বিভ্রান্ত মুখ, কিছুটা অপমানিতও। বিশেষ করে নেপাল। তার চারটে বল কুড়িয়ে আনতে হয়েছে রেড রোড থেকে।

জহর চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালেন। বিরু ঘোষকে জিজ্ঞেস করলেন, ”ছেলেটা কে?”

”অবনী রায়। আজই এসেছে। খুব বড়লোক, ডুয়ার্সে বাবার চা—বাগান আছে।”

”বোধ হয় বড়লোক বলেই এমন উড়নচণ্ডে, বেহিসেবি। জড়তা নেই। … কিন্তু ক্রিকেটটা তো হিসেবের খেলা, ডিসিপ্লিনের খেলা।” কথা শেষ করে তিনি এগিয়ে গেলেন নেটের দিকে।

”ন্যাপলা বলটা আমায় দে।”

নেপাল তার হাতে বলটা দিয়ে কৃতজ্ঞ চোখে তাকাল। জহর পাল স্লো অফব্রেক বল করেন। ফ্লাইটই তাঁর বলের বিশেষত্ব, স্পিন করে কম। তাঁর বল করা দেখে অনেকেই মুচকে হাসে। এত উঁচুতে লোপ্পাই করে তুলে বল করেন যে, ব্যাটসম্যান মুখ তুলে ফ্লাইটের দিকে তাকিয়ে থাকতে—থাকতে দোনামনা হয়ে যায়। ছয় মারবে না চার মারবে সেটা ঠিক করে ওঠার আগেই আবিষ্কার করে—ক্রিজ থেকে সে এক পা বেরিয়ে এসেছে এবং তার চালানো ব্যাটের কানা ঘেঁষে বলটা পেছনে চলে গিয়ে স্ট্যাম্পে লেগেছে নয়তো উইকেটকিপার তাকে স্টাম্পড করেছে। ময়দানে এই বল ‘জর্দা বল’ নামে খ্যাত। বহু বিখ্যাত ব্যাটসম্যান জর্দা বলে মুখচুন করে ক্রিজ থেকে ফিরে এসেছে।

জহর পাল তাঁর প্রথম জর্দা বলের টোপটা দিলেন থ্রি—কোয়ার্টার লেংথে। ছেলেটি লাফিয়ে দু’পা বেরিয়েই থমকে গিয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। তার চালানো ব্যাটের পাশ দিয়ে অফ স্ট্যাম্প ঘেঁষে বলটা বেরিয়ে গিয়ে জালে লাগল। ছেলেটি জালের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর জহর পালের মুখের দিকে তাকাল।

এগিয়ে এসে জহর পাল বলেন, ”পেছনে উইকেটকিপার থাকলে কী হত জানো?” আঙুল তুলে তিনি টেন্টটা দেখিয়ে দিলেন। কিশোরের গৌরবর্ণ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। এর পর তিনি বারোটা বল করেন। তিনটে তারাবাজি হয়, তিনটে ফরওয়ার্ডে ডিফেন্সিভ খেলে, বাকিগুলি কাল্পনিক সিলি পয়েন্টের, স্লিপ ফিল্ডারের ও উইকেটকিপারের কাজের আওতায় চলে যায়।

আধ ঘণ্টা পর ছেলেটি কিট ব্যাগ হাতে যখন টেন্ট থেকে বেরোচ্ছে জহর পাল মালিকে দিয়ে তাকে ডেকে পাঠান।

”ভাল আই সাইট, ভেরি গুড ফুট ওয়ার্ক অ্যান্ড টাইমিং… কিন্তু শেষপর্যন্ত হলটা কী?”

ছেলেটি বিব্রত অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। মুখে কথা নেই।

”চারবার স্টাম্পড আর কট! রান ছয় কি বারো। … বারো—চোদ্দোর বেশি রান জীবনে হবে না। নেটে ব্যাট করা আর মাঝখানে গিয়ে ব্যাট করায় অনেক তফাত। মাঝখানে এগারোটা লোক তোমাকে খতম করার জন্য অপেক্ষা করবে। … ক্রিকেট হল ধৈর্যের খেলা।”

জহর তীক্ষ্ন চোখে ছেলেটির মুখ লক্ষ করে সুখ বোধ করে ছিলেন। কথাগুলো মনে ভাসছে বলে তাঁর মনে হয়েছিল।

”কাল থেকে নেটে ডিফেন্স করবে। আমি থাকব। ব্যাটিংটা তোমায় শিখতে হবে। কাল ঠিক তিনটেয় এসে মাঠটা আগে দশ পাক দৌড়বে তারপর ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করবে।… মনে থাকবে?”

দিনের পর দিন অবনী তাই করেছিল। আর জহরও আকাঁড়া হীরকখণ্ডটিকে কেটেকুটে পালিশ করে উজ্জ্বল এক রত্নে পরিণত করার জন্য মনপ্রাণ ঢেলে দেন। অবনী চারটে রনজি ম্যাচে দুটো শতরান আর একটা পঞ্চাশ করে। ওকে সম্ভাব্য টেস্ট খেলোয়াড় বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে যখন তখনই আচমকা সে ক্রিকেট ছেড়ে কলকাতা ছেড়ে চলে যায় ডুয়ার্সে তাদের চা—বাগানে। জহর তখন দুঃখে, হতাশায় ভেঙে পড়েছিলেন। ছুটে গেছলেন অবনীর বাবা রজনী রায়ের কাছে।

”এ আপনি কী করলেন সার। শুধু বাংলাকে নয়, ভারতকেও বঞ্চিত করলেন, একটা দারুণ ব্যাটসম্যানকে আমরা হারাব।”

”জহরবাবু, আমাকেও তো ছেলের ভবিষ্যতের দিকটা ভাবতে হবে। আমার হাঁপানির অসুখ, আর আমি ব্যবসা দেখতে পারি না, ছোটাছুটির ধকল নেওয়ার মতো শরীরের অবস্থা নয়, ভাইদের মধ্যে ঘুনুই বড়, ওকেই বিষয়সম্পত্তি, ব্যবসা দেখতে হবে। আমি চাই এখন থেকেই ঘুনু সব বুঝেশুনে নিক। …. আর ক্রিকেট খেলে হবেটাই বা কী? একটু সম্মান, একটু পরিচিতি দু—চার বছর পর লোকে তাও ভুলে যাবে। যদি বুঝতাম অনেক টাকা পাবে, তা হলেও নয় কথা ছিল। টেস্ট খেলে ক’টাকা পায়? ম্যাচ পিছু সাড়ে সাতশো টাকা! তার থেকে ঘুনু একশোগুণ আয় করতে পারবে বছরে, যদি ব্যবসায়ে এখনই ঢোকে। … মাপ করবেন জহরবাবু, আর ক্রিকেট নয়। যা খেলেছে তাই যথেষ্ট। ক্রিকেট থেকে ঘুনুর পাওয়ার কিছু নেই।”

জহর পাল সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে। কানে বাজছে রজনী রায়ের কথাগুলো। ‘ক্রিকেট থেকে পাওয়ার কিছু নেই।’ প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। রজনী রায় বলতেই পারেন, সত্যিই তখন টাকা ছিল না ক্রিকেটে। ক্লাব থেকে একটা পয়সাও পাওয়া যেত না, বাংলার হয়ে খেললেও নয়, টেস্ট আর ক’টা খেলবে, কুড়ি—পঁচিশটা বড়জোর! হাজার দেড়েক রান আর তিন—চারটে সেঞ্চুরি, এমন রেকর্ড তো কত প্লেয়ারেরই আছে, লোকে তাদের মনেও রাখেনি। লোকে কি জহর পাল নামটাও মনে রেখেছে? অথচ এখনও তো তিনি ক্লাব ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। ব্যাটিং অর্ডারে তলার দিকে, রান পান না।

”জহরদা কি ঘুমিয়ে পড়লেন?” তোয়ালে দিয়ে ভিজে চুল ঘষতে—ঘষতে ঘরে ঢুকল ঘুনু।

”ঘুমোইনি। ভাবছি। তোর বাবা যে কথাগুলো বলেছিলেন সেগুলো মনে পড়ে গেল।”

”কী কথা?”

”ক্রিকেট থেকে কিছুই পাওয়ার নেই। এখন হলে তিনি আর ওসব কথা বলতেন না। গাওস্কর, কপিলদেব শুনেছি কোটি টাকার ওপর ব্যবসা করছে।”

”কিন্তু সবাই নয়, শুধু ওরাই। সবাই কি গাওস্কর বা কপিল হতে পারে? তবে ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে পৈতৃক ব্যবসায়ে এসে আমি এখন যত টাকা রোজগার করছি সেটাও কিছু কম নয়। যাকগে ওসব কথা, চলো খেতে বসি।”

ঘণ্টাখানেক পর জহর পাল যাওয়ার জন্য যখন দরজার দিকে এগিয়েছেন, ঘুনু তখন ডাকল, ”জহরদা, তোমার ছেলের জন্য একটা ছোট্ট উপহার…. না বলতে পারবে না।”

ঘুনুর হাতে একটা খাম। বিস্মিত জহর খামটা নিয়ে খুললেন। ভেতরে একটা চেক। তাঁরই নামে। পাঁচ হাজার টাকা।

হতভম্ব জহরের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ”এসব কী!”

”বলেছি, না বলতে পারবে না। … আর এই নাও আমার কার্ড। যখনই যা কিছুর দরকার হবে, আমার ফ্ল্যাটে কি অফিসে ফোন করবে। অফিস এই গড়িয়াহাট রোডেই। বেলা হয়ে গেছে, বাড়িতে ভাবছে। এই দুপুরে খেয়েদেয়ে আর বাসে উঠো না। নীচে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে, পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

জহর পালের দু’চোখ জলে ভরে এল আর সেই জল চোখ থেকে উপচে নামল লিফটে করে নামার সময়।

.

জহর পালের সংসারে আছে স্ত্রী মীরা, এক ছেলে ও এক মেয়ে, মানিক ও মণিকা। অবনীর দেওয়া চেকটা দেখে ওরা অবাক হল, তারপর কৃতজ্ঞতায় মন ভরে গেল। মীরা বললেন, ”এই যুগে এমন মানুষ পাওয়া ভাগ্যের কথা। কত বছর আগে একটু উপকার পেয়েছিল সেটা মনে করে রেখেছে!”

মণিকা বলল, ”আর প্রাণকৃষ্ণর ব্যবহারটার কথা ভাবো? চার হাজার ন্যায্য টাকা, সেটা দিতে অস্বীকার করল! লোকটা চামার।”

”লোকটা উন্নতি করবে।” মানিক বলল। তারপর সে জহরকে বলল, ”বাবা, এটা তো অ্যাকাউন্ট পেয়ি ক্রস চেক, তোমার তো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই!”

শুনেই জহরের মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। তিনি আমতা—আমতা করে বললেন, ”এটা ব্যাঙ্কে দিলে টাকা দেবে না?”

”না, তোমার নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা দিতে হবে। তুমি বরং ঘুনুবাবুকে এটা ফেরত দিয়ে একটা বেয়ারার চেক চেয়ে নাও।”

ব্যাঙ্কে বছর দশেক আগে জহরের অ্যাকাউন্ট ছিল। দোকানের জন্য খুব জরুরি প্রয়োজনে সব টাকা তুলে নিয়ে অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেন। তাঁর যে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, এ—কথা ঘুনুর কাছে বলতে তাঁর মর্যাদায় বাধবে। তিনি জানেন, বাজারের মাছওয়ালারও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে। বাজারের গেটে ফুলের দোকানদারের হাতবাক্সের মধ্যে ব্যাঙ্কের পাশবই দেখেছেন। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই বললে ঘুনুর চোখে হয়তো তিনি ছোট হয়ে যাবেন। নাও ছোট হতে পারেন, ঘুনু তেমন ধরনের মানুষ নয়। জহর পালের মনে একটা খচখচানি শুরু হল।

”দরকার কী আবার ঘুনুকে বিরক্ত করে! তার থেকে একটা নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে ফেললেই হয়।” জহর সবার মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলেন, ”কখন কাজে লাগবে বলা যায় না তো!”

উত্তর কলকাতায় হাতিবাগান বাজারে জহরের হার্ডওয়্যারের দোকান। দোকানে স্ক্রু, পেরেক, কবজা, ছিটকিনি ইত্যাদি ছাড়াও, উনুন, হাতা, খুন্তি, কড়াই অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্রও পাওয়া যায়। খুব চালু দোকান। দোকানের বয়স ষাট, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া। তাঁর বাবাই দোকানে বসতেন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। জহর স্কুল আর মাঠ করে বেড়াতেন সারাদিন। সন্ধ্যায় দোকানে এসে বাবাকে যতটা সম্ভব সাহায্য করতেন। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনিই দোকান চালাচ্ছেন। ক্রিকেট খেলার জন্য তাঁকে যে দিনগুলোয় ময়দানে যেতে হয় সেই দিনগুলোয় সন্ধ্যা পর্যন্ত দোকানে থাকতে পারেন না। অগত্যা তাঁকে একটি লোক রাখতে হয়েছে। পাড়ারই গরিব একটি কিশোর ছেলে নন্দ, অর্থাৎ নাদু। ছেলেটি বুদ্ধিমান, সৎ, বিশ্বস্ত।

সে একাই প্রায় দোকান চালায়, হিসাবপত্তর রাখে।

দোকান থেকেই মোটামুটি সংসার চলে যায়। জহর ভাবলেন, ক্রিকেট আর তিনি খেলবেন না। এখন তাঁর যা বয়স তাতে এবার দোকানে মন দেওয়া উচিত। ব্রাদার্স ইউনিয়ন আর তাঁকে খেলাবে না। সেটা বোঝাই গেছে পানুর কথাবার্তা থেকে। ছোটখাটো ক্লাবে খেললে শরীর আর মনের ওপর ধকল পড়বে। দরকার কী আড়ালে—আবডাল ছেলে—ছোকরাদের টিপ্পনি শুনে। আগের মতো ছুটতে পারেন না। রানিং বিটুইন দ্য উইকেটস যথেষ্ট স্লো। রান আউট করেছেন তাঁর পার্টনারকে গত দু’বছরে চারবার। চোখটা ভাল আছে এই যা রক্ষে!

বিকেলে দোকানে যাওয়ার পথে হাতিবাগান মোড়ে পৌঁছে জহর রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। ভনভন করছে অটো রিকশা, তার সঙ্গে বাস, মিনিবাস আর ট্রাম। রাস্তা পার হওয়ার ফুরসত পাওয়া যায় না। হতাশ হয়ে এধার—ওধার তাকাতেই তাঁর চোখে পড়ল ফুটপাথের তেলেভাজাওলাকে। উনুন, কড়াই, বারকোশ, বেসন গোলা, গামলা ইত্যাদি নিয়ে দোকান দিয়ে বসেছে ফুটপাথের কিছুটা দখল করে, সাঞ্চায় গরম—গরম পেঁয়াজি আর বেগুনি তুলে রাখছে একটা ঝুড়িতে। তারপর সেগুলো ঢেলে রাখছে বারকোশে। কয়েকজন খদ্দের দাঁড়িয়ে, হঠাৎই জহরের চোখ পড়ল একজনের ওপর। আরে, বেজা না?

বেজা—র ভাল নাম ব্রজেন হালদার। জহরের আমলের ক্রিকেটার, বাঁ হাতে স্পিন করাত, চমৎকার ফ্লাইট ছিল, ক্লাব—ক্রিকেটে বছর—বছর প্রচুর উইকেট পেত। মোহনবাগান, স্পোর্টিং ইউনিয়নে খেলেছে। দোহারা গড়ন, লম্বা চেহারা। জহর অনেকবার লিগে ওর বল খেলেছেন। প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা, বেজার সঙ্গে জহরের সখ্যও ছিল। বছর দশেক আগেও এই মোড়ে তাঁদের দেখা হয়েছিল কিন্তু তখন বেজার এমন চেহারা তো ছিল না। লম্বা চেহারাটা দেখাচ্ছে হাড়গিলের মতো। সরু গলা, বুকটা চুপসে গেছে, হাত দুটো পাটকাঠির মতো। গালদুটো তোবড়ানো। অস্বাভাবিক লম্বা নাকটা দেখেই জহর চিনতে পারলেন।

”কী রে বেজা, তেলেভাজা কিনছিস?” জহর এগিয়ে গিয়ে বললেন।

বেজা চমকে ফিরে তাকাল। হাতে ঠোঙা। জহরকে দেখে একগাল হাসল। ”পেঁয়াজি। দারুণ করে। পলতার বড়াও খুব ভাল। নে ধর।”

বেজা ঠোঙাভর্তি পেঁয়াজি এগিয়ে ধরল। জহর হাত তুলে বললেন, ”রাস্তার তেলেভাজা আমি খাই না।”

”অ।” বেজা ঠোঙাধরা হাত টেনে নিল। একটা পেঁয়াজি মুখে দিয়ে চিবোতে—চিবোতে বলল, ‘আমিও আগে খেতুম না। এসব ব্যাপারে খুব স্ট্রিক ছিলুম। শরীরের যত্ন না নিলে কি ক্রিকেটার হওয়া যায়? পরিমিত আহার হচ্ছে ফিটনেসের আসল কথা।”

”তোকে তো পরিমিত আহার করতে দেখিনি। লাঞ্চে তো সবার আগে টেবিলে গিয়ে, প্লেটে আট স্লাইস পাঁউরুটি নিয়ে তোকে বসতে দেখেছি। পাঁচ—ছ’বার মাংসের ঝোল আর আলু চেয়েছিস। সবাই একটা কলা নিয়েছে, তুই নিয়েছিস তিনটে।… আমার মনে আছে।”

”কোন ম্যাচে দেখেছিস?” বেজা ভ্রূ কুঁচকে ঠোঙায় আবার আঙুল ঢোকাল।

”আমাদের সঙ্গে স্পোর্টিং ইউনিয়নের ম্যাচে। পঙ্কজ রায় যেটায় দেড়শো করল। তোকে মেরে পানু এক ওভারে বাউন্ডারি নিল চারটে, ওভার বাউন্ডারি দুটো। এক ওভারে আটাশ রান। ভুলে গেছিস! আমি ছিলাম নন স্ট্রাইকিং এন্ডে।”

বেজার পেঁয়াজি চিবনো বন্ধ হল। খুব বড় একটা মজা পাওয়া হাসি ফুটে উঠল, ”মনে আবার থাকবে না! আসল ব্যাপারটা তো তুই আর জানিস না।”

জহরকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেজা তাড়াতাড়ি পেঁয়াজি গিলে ফেলে ঠোঙা থেকে আর—একটা বার করল, ”দাঁড়া, বলছি।” তেলেভাজাওলার কড়াইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ”বেগুনি ছেড়েছে… ফাস ক্লাস করে… তুই খাবি না?”

”না।”

বেজা তেলেভাজাওলার কাছে গেল। ”আমার জন্য চারটে বেগুনি তুলে রেখো।” জহরের কাছে ফিরে এসে বলল, ”খেয়ে দেখতে পারতিস। একদিন খেলে তোর এমন কিছু হবে না।”

”হবে। … তোর মতো চেহারা।”

বেজার মুখ ম্লান হয়ে গেল, ‘চেহারাটা খারাপ হয়ে গেছে, না?”

জহর জবাব দিলেন না।

”অ্যালোপ্যাথি, কোবরেজি, হোমিওপ্যাথি সব করেছি, কিছুতেই কিচ্ছু হচ্ছে না… তাই শরীর নিয়ে আর মাথা ঘামাই না, যা হওয়ার হবে। … ক’দিনই বা আর বাঁচব!” বেজার স্বর করুণ শোনাল। জহর দুঃখ পেলেন।

”হাল ছেড়ে দিয়েছিস? জীবনকে ভালবাসলে কেউ হাল ছেড়ে দেয় না। একসময় কী বোলার ছিলিস! বিষেণ বেদিকে দেখে তোর কথা মনে পড়ত। তোকে খেলতে সত্যিই ভয় করত। বড় তাড়াতাড়ি তুই মাঠ ছাড়লি।”

”কী করব, পেটের ট্রাবল এত বাড়ল যে…” বেজা কথা শেষ না করে তেলেভাজাওলার দিকে তাকাল। ”দাঁড়া, আসছি।” বলেই সে বেগুনি আনতে চলে গেল। জহর মাথা নাড়লেন। বেজার পেটের রোগ কোনওদিন সারবে না।

ঠোঙা হাতে বেজা ফিরে আসতেই জহর বললেন, ”তুই বাচ্চচাছেলে নোস। ভাল করেই জানিস তোর পেটের ট্রাবলের আসল কারণ।… তোর নোলা না সামলালে কোনওদিনই তোর রোগ সারবে না।”

”ঠিকই বলেছিস, কিন্তু সামলাই কী করে?” বেজা আন্তরিক চোখে জহরের দিকে তাকাল।

”বলব? … যা বলব করবি?”

”আগে শুনি।”

”আগের মতো শরীরটাকে খাটা। … কোনও ছোট ক্লাবে গিয়ে নেটে বল কর। ম্যাচ খেলা তো সম্ভব নয় তোর পক্ষে। আমার বিশ্বাস, ইয়াং ছেলেরা এখনও তোকে খেলতে পারবে না।”

”বলছিস!” বেজার স্বরে প্রচ্ছন্ন গর্ব।

‘হ্যাঁ বলছি। আমি তো এই সিজনেও মাঠে নেমেছি। খেলার মধ্যে থাকলে, ডিসিপ্লিনের মধ্যে থাকা যায়।” কথার শেষে জহর আচমকা বেজার হাত থেকে গরম বেগুনির ঠোঙাটা খপ করে ছিনিয়ে নিলেন।

”এটা কী হল?” বেজা হতভম্ব চোখে বলল।

”এইভাবে তুই উইকেট তুলে নিতিস ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে।” হাসতে—হাসতে জহর ঠোঙাটা ফিরিয়ে দিলেন, ”ভয় নেই, বেগুনি থেকে তোকে বঞ্চিত করব না। কেউ মরতে চাইলে তাকে আটকানো যায় না। কত উপায় রয়েছে… গলায় দড়ি, ট্রেনের সামনে ঝাঁপ, গায়ে আগুন, গলায় কলসি বেঁধে জলে ঝাঁপ, কতরকমের বিষ, তেমনই বেগুনি, পেঁয়াজি।”

”ঠাট্টা করছিস?” বেজা ঠোঙাটা নাকের কাছে এনে জোরে শ্বাস টানল। ”ঠিকই বলেছিস, নোলা আমার একটু বেশিই। ওই যে বললি এক ওভারে আটাশ রান, সেটাও ওই নোলার জন্য।” বলে বেজা মিটিমিটি হাসতে লাগল।

‘ব্যাপারটা কী, বল। হঠাৎ পানু বেধড়ক মারতে শুরু করে দিল তোর লংহপ আর শর্ট পিচ বল পেয়ে, ওভাবে বল ফেলেছিলিস কেন?” জহর জানতে চাইলেন।

”পঙ্কজদা সেঞ্চুরি করল, আমাদের রান হল ২৬০…”

”দুশো ঊনষাট … দুশো ষাট করলে জিততুম।” জহর ভুল ধরিয়ে দিলেন।

”ব্রাদার্স আট উইকেটে ১৭০ … ঠিক বলছি তো?”

”হ্যাঁ। তখন আমি ৭০ ব্যাট করছি ম্যাচ হারছি, তখন নামল পানু, সবে টিমে এসেছে। ওকে তো তুই এক বলেই তুলে নিতে পারতিস!”

”পারতুম। তুলিনি একটা ব্যাপারে। লাঞ্চের সময় যখন খাচ্ছি তখন কানুদা, ওই যে রে গাল তোবড়ানো, পাকা চুল, ধুতি—পাঞ্জাবি পরা কানু ভটচায, পানুর চামচাটা, আমার পেছনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘কী শুকনো পাউরুটি ঝোলে ডুবিয়ে চিবোচ্ছিস, ফিরপোয় খাবি?’ বললুম, ‘কে খাওয়াবে?’ বলল ‘আমি।’ অবাক হয়ে গেলুম। হঠাৎ আমাকে ফিরপোয় খাওয়াবার ইচ্ছে হল কেন এই ধূর্ত লোকটার! নিশ্চয় কোনও মতলব আছে। বলল, ‘খাওয়া শেষ হলে একটু বাইরে আয়।’ কিছুক্ষণ পর টেন্টের বাইরে এসে দেখি কানুদা আর পানু ফেন্সের কাছে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। আমাকে দেখে পানু সরে গেল। কানুদা বলল, ‘বেজা একটা কাজ করে দিতে হবে, কানুকে একটা ফিফটি পাইয়ে দে। নতুন ছেলে, খুব ইচ্ছে পঙ্কজ রায়ের সেঞ্চুরির পালটা একটা ফিফটি করার, কাগজে নাম বেরোবে… কিছুই তোকে করতে হবে না শুধু লেগ স্টাম্পের বাইরে গোটাকতক শর্ট পিচ আর ফুল টস… বাকিটা ও ম্যানেজ করে নেবে। পারবি না? আজ সন্ধেবেলায়ই তা হলে ফিরপোয়… তোর যা প্রাণে চায়।’ শুনে বলব কী, লোভে পড়ে গেলুম। অত বড় হোটেলে খাওয়া, তাও আবার যা প্রাণে চায়। ম্যাচ তো জিতবই, ফিফটিই করুক আর সেঞ্চুরিই করুক। রাজি হয়ে গেলুম। তবে এটাও বলে রাখি, ফিফটি হলেই কিন্তু আর শর্ট পিচ নয়।”

”তারপর ফিরপোয় প্রাণভরে খেলি!”

”না।” বলেই বেজা পেছন ফিরে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল। জহর তার পিছু নিলেন। বেজার প্রাণভরে খাওয়া কেন হল না সেটা জানার জন্য কৌতূহল তাঁর ঘাড়ে ভর করেছে।

”বেজা বেজা, শোন শোন।” জহর ডাকলেন।

বেজা থমকে ঘুরে দাঁড়াল। ঠোঙা থেকে বেগুনি বার করে মুখে ঢুকিয়ে চিবোতে শুরু করল। সেটা শেষ হলে আর—একটা মুখের মধ্যে গুঁজে দিল। চোখ দুটো বড় হয়ে উঠেছে দ্রুত চিবোনোর জন্য। দ্বিতীয়টি শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয়টি বার করে হাতে ধরে রইল। জহর আর সহ্য করতে পারলেন না। বেজার হাত থেকে বেগুনিটা তুলে নিয়ে নিজের মুখে ঢোকালেন। বেজা অবাক হয়ে জহরের বেগুনি খাওয়া দেখতে—দেখতে ঠোঙাটা বাড়িয়ে ধরল, ”নে, এটা তুই শেষ কর।”

”ব্যাপার কী! তোর হল কী!” জহর ঠোঙাটা নিলেন।

”সেদিনের কথা ভাবলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। … আমায় বলেছিল সাতটার সময় ফিরপোর বারান্দার নীচে ফুটপাথে দাঁড়াতে। আমি ঠিক সাতটায় হাজির হয়েছি। কিন্তু কানুদা আর আসে না। দু’ঘণ্টা অপেক্ষা করলুম, তবুও এল না। খিদেয় পেটে তখন ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে।” সেদিনের বোকা বনে যাওয়ার কথা মনে পড়ে বেজার চোখে জল এসে গেল।

”তারপর কানুদার সঙ্গে দেখা হয়নি?”

”হয়েছিল। মনুমেন্টের নীচে ফুচকা খাচ্ছিল। আমায় দেখে বলল, ”খাবি নাকি?” বোঝ কী লোক! কোথায় ফিরপো আর কোথায় ফুচকা! বললাম, ‘কানুদা, এটা কী হল? আমি দু’ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলুম।’ কী বলল জানিস? ‘খুব কষ্ট পেয়েছিস না রে? কী করব, খবর পেলুম ভাইঝিটা পরীক্ষায় ফেল করে দোতলা থেকে উঠোনে ঝাঁপ দিয়েছে, ছুটলুম হাসপাতালে, তোকে খবর দেওয়ার টাইমও পেলুম না। যাক গে, একদিন তোকে গ্র্যান্ড হোটেলে খাইয়ে দেব।”

”খাইয়েছে?”

”আজও নয়। … পানুটা ফাঁকতালে ফিফটি করে গেল।”

জহর ঠোঙাটা বাড়িয়ে ধরলেন, ‘একটা রয়েছে খেয়ে নে।”

বেজা ঠোঙাটা নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে হনহন করে হাঁটা শুরু করল। একটা কুকুর ছুটে গেল ঠোঙাটার দিকে।

জহর মাথা নেড়ে আবার হাতিবাগান মোড়ে ফিরে এলেন, দোকানে যাওয়ার জন্য।

.

অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য জহর ব্যাঙ্কে গেছলেন। সেখানে তাঁকে বলা হয়, এই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে এমন কোনও লোকের সুপারিশ লাগবে। জহর তো ফাঁপরে পড়লেন চেনাশোনা কে আছে যার এই ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট আছে! ভাবতে—ভাবতে মনে পড়ল তাঁর এক খদ্দের, প্রতাপ দাস, তাঁকে একটা চেক দিয়েছিল। এই ব্যাঙ্কেই তার অ্যাকাউন্ট। সে এখান থেকেই চেকটা ভাঙিয়ে টাকা তোলে। প্রতাপ তাঁর খুবই চেনা। টালা পার্কের কাছে নতুন বাড়ি করার সময় জহরের দোকান থেকে সে প্রচুর জিনিস কিনেছিল। প্রতাপ একসময় বছর দুই ব্রাদার্সে ক্রিকেট খেলেছে। পরে খেলা ছেড়ে একটা নার্সিং হোম করে, একটা ছোট হোটেলও খোলে।

জহর ব্যাঙ্ক থেকেই সোজা প্রতাপের বাড়ি গেলেন। প্রতাপ তখন বাড়ি ছিল না, কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। কিছুক্ষণ বসে থেকে ”আমি একটু ঘুরে আসছি,” বলে তিনি প্রতাপের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। কাছেই টালা পার্ক। বিশাল মাঠ। একটা পুকুরও রয়েছে। এই মাঠে বহুবার খেলে গেছেন জহর। চার—পাঁচটা ক্রিকেট ক্লাব এই মাঠে খেলে, যদিও ক্লাবগুলোর কোনও টেন্ট মাঠে নেই। তবে তারা এখানেই নেট প্র্যাকটিস করে। নেট ও প্র্যাকটিসের জন্য দরকারি জিনিসগুলো রাখার জন্য একটা ঘর আছে, মালিও আছে। ক্লাবগুলোই টাকা দেয়, মালিরা পিচ তৈরি আর রক্ষণাবেক্ষণ করে।

এখন মে মাস, ক্রিকেট সিজনের শেষ দিক। সি এ বি লিগ শেষ হয়ে গেছে। নক আউট ফাইনাল এই সপ্তাহেই! জে সি মুখার্জি ট্রফির খেলা শুরু হবে। কোনও ক্লাবেরই আর এখন নেট প্র্যাকটিস হয় না। গত কয়েকদিন ধরে গনগনে গরম আবহাওয়া। ৩৮ থেকে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে কলকাতা ভাজা—ভাজা হচ্ছে। সকাল এগারোটার পর নেহাত দায়ে না পড়লে মানুষজন বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছে না। মাঠের পুব দিকে বড়—বড় গাছ, তাঁদের নীচে ছায়া, কয়েকটা লোক সেই ছায়ায় শুয়ে রয়েছে। প্রচণ্ড গরম সত্ত্বেও ফুরফুরে হাওয়া বইছে। ছায়ার নীচে এই হাওয়াটা খুবই আরামদায়ক, জহর একটা গাছের নীচে বসলেন।

তখন তাঁর মনে এই মাঠে খেলার নানান স্মৃতি জেগে উঠল। তিনি চোখ বন্ধ করলেন। পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে দল বেঁধে তাঁরা প্রায় দু’ মাইল হেঁটে এসে এখানে খেলতেন। খেলার জায়গা নিয়ে অন্য পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঝগড়া হত, মারপিটও হয়েছে। তখন তিনি হাফপ্যান্ট পরতেন। পার্চমেন্ট মোড়া কানাভাঙা একটা ব্যাট, তিনটে স্টাম্প, একজোড়া ব্যাটিং গ্লাভস আর এক জোড়া প্যাড ছিল তাঁদের সম্পত্তি। একপ্রান্তে স্টাম্প পোঁতা হত, অন্যপ্রান্তে জুতোর স্তূপ। একটা করে প্যাড দুই ব্যাটসম্যান বাঁ পায়ে পরত। গ্লাভসও ভাগাভাগি করে বাঁ হাতে পরা হত। ছালচামড়া ওঠা ক্রিকেট বল। কঠিন ছিল উইকেট কিপিং। বিনা গ্লাভসে কিপ করা যে ভয়ঙ্কর কাজ ছিল, পেছনে একটা ব্যাকস্টপার রাখতে হত। একটা রান নিলে ব্যাট দিয়ে আসতে হত স্ট্রাইকারকে। এইভাবে খেলতে গিয়ে একটা উপকার হয়েছিল। গায়ে বা পায়ে বা আঙুলে যাতে বল না লাগে সেজন্য নার্ভগুলোকে প্রখর করে হুঁশিয়ার হয়ে বলের দিকে লক্ষ রাখতে হত। নির্মল খুব ছুটে এসে জোরে বল করত। এলোমেলো বল পড়ত। কোনওটা উইকেটের দু’হাত বাইরে কোনওটা মাথার দু’হাত ওপর দিয়ে যেত, ও নিজেকে ফ্রেডি ট্রুম্যান ভাবত। তখন ট্রুম্যানের খুব নাম। একটা বল সোজা বুক লক্ষ্য করে এসেছিল। ব্যাটটা বুকের সামনে কোনওরকমে ধরতেই বলটা ডান হাতের বুড়ো আঙুলে লাগল।

জহর পাল ডান হাতের বুড়ো আঙুল চোখের সামনে তুলে ধরলেন। কবেকার কথা! বাড়ি ফিরে রাতে চুন—হলুদ গরম করে মা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে ভেঙেছিল হাড়। ব্যথা করত, আঙুলটা মুড়তে পারতেন না। ব্যাটের হ্যান্ডেলে বুড়ো আঙুলটা চেপে ধরতে গেলে লাগত, এখনও লাগে। ডাক্তার দেখিয়ে ছিলেন বহুদিন পর। অপারেশন করে হাড় সেট করতে হবে শুনে আর ডাক্তারের কাছে যাননি। ছুরি—কাঁচিতে তাঁর ভয়। এখন তাঁর মনে হল, অপারেশনটা করে নিলেই ভাল হত। তা হলে আবার আঘাত লাগার দুশ্চিন্তায় ব্যাটিংটা ভয়ে—ভয়ে করতে হত না। স্ট্রোকে জোরটাও দিতে পারতেন, খেলার ধরনটাও বদলে নিতে পারতেন। কে জানে, হয়তো স্লো ব্যাটিংয়ের জন্য রনজি টিম থেকে তা হলে বাদ পড়তেন না। ছোটখাটো ব্যাপারগুলোকে অবহেলা করলে পরে পস্তাতে হবেই।

ঘড়ি দেখলেন জহর। এক ঘণ্টার ওপর পার্কে বসে। এবার গিয়ে দেখা যাক, প্রতাপ ফিরেছে কি না। উঠে পড়লেন।

প্রতাপ কিছুক্ষণ আগেই ফিরেছে। জহরের আসার কারণ শুনে সে হাত বাড়িয়ে বলল, ”ফর্মটা দিন।” যথাস্থানে সই করে বলল, ”ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে আমার খাতির আছে, কোনও অসুবিধে হবে না।” জহর যাওয়ার জন্য উঠতেই প্রতাপ বলল, ”জহরদা, একটা কথা ছিল। আপনাদের ওদিকে রাজনারায়ণ পার্কে ছোটদের জন্য একটা ক্রিকেট কোচিং স্কুল খুলব ঠিক করেছি।”

”বলো কী!” জহর অবাক হলেন। ”ক্রিকেট শেখার স্কুল, এ তো ভাল কথা। শুনেছি কলকাতায় অনেক এরকম স্কুল হয়েছে। গাদা—গাদা ছেলে ভুলভাল টেকনিকে ব্যাট করে যাচ্ছে, ছুড়ে বল করছে ফার্স্ট ডিভিশনে, সেকেন্ড ডিভিশনে। দেখিয়ে দেওয়ার, শুধরে দেওয়ার জন্য তো ক্লাবে কেউ নেই। তোমার স্কুলে যদি … ভাল কথা, তুমি শেখাবে নাকি?”

”পাগল হয়েছেন! আমি ক্রিকেটের বুঝি কী? আমি শুধু ফিনান্স করব, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ দিকটা দেখব, হিসেবটা বুঝে নেব। জানেন তো এখন প্রোমোটিংয়ের যুগ। খরচপত্তর করে, লোকজন রেখে স্কুল চালু করলুম, বিজ্ঞাপন দিলুম। এজন্য রিস্ক নিলুম। লাভ নাও হতে পারে। বাংলার ক্রিকেটের উন্নতির জন্য, মর্যাদা বাড়াবার জন্য, টেস্ট ক্রিকেটার তৈরি করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করা তো দরকার। ভাবুন তো, বোম্বাই, পাঞ্জাব, দিল্লি, কর্ণাটক থেকে টেস্ট খেলছে অথচ বেঙ্গল থেকে, শুধু বেঙ্গল কেন, সারা ইস্টার্ন ইন্ডিয়া থেকে ইন্ডিয়া টিমে যাওয়ার মতো ছেলে পাওয়া যায় না! এটা কি লজ্জার কথা নয়?”

”অবশ্যই লজ্জার কথা।” জহর উৎসাহভরে সমর্থন করলেন।

”এজন্য দরকার বাচ্চচা বয়স থেকে ঠিকমতো ক্রিকেটটা শিখিয়ে দেওয়া, ঠিক কি না?”

”অবশ্যই।”

”কে বলতে পারে এই স্কুল থেকেই একটা গাওস্কর, একটা কপিলদেব বেরিয়ে আসবে না! … জহরদা, আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন।”

জহর বসলেন। তিনি উৎসাহে রীতিমতো ফুটছেন। প্রতাপ ব্যবসায়ী ঠিকই কিন্তু ক্রিকেট কত বছর আগে অল্প খেলেছে, অথচ এখনও ক্রিকেটের জন্য ভেবে যাচ্ছে। বাংলার জন্য কিছু একটা করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। খেলাধুলো তো এদেরই জন্য বেঁচে রয়েছে।

”ঠিক করেছি প্রফেশনাল অ্যাঙ্গেল থেকে একটা স্কুল খুলব। বুঝলেন জহরদা, আমাদের দেশে সবকিছুই ফোকটসে পেতে চায় আর সেইজন্যই সিরিয়াসলি কিছু নেয় না। কোচিং নেবে বিনি পয়সায়, তা হলে সিরিয়াসলি কেউ কি শেখে? বাপ—মা লেখাপড়ার জন্য টিউটর রাখবে তিনশো—চারশো টাকা মাইনে দিয়ে। আপনি খেলার জন্য পঞ্চাশ টাকা মাইনে দিয়ে কোচ রাখতে বলুন, অমনই দেখবেন চোখ কপালে তুলেছে। এখন ক্রিকেটই হচ্ছে মোস্ট গ্ল্যামারাস গেম। সবাই চায় তার ছেলেটি কপিলদেব হোক। টেন্ডুলকর যা দেখাচ্ছে, তার রোজগারের যা সব খবর বেরোচ্ছে, বাচ্চচাদের বাপ—মা’র আক্কেল গুড়ুম। তাতে আমাদেরই লাভ… মানে আমাদের স্কুলে ছেলে আরও বাড়বে। ছেলে তেন্ডুলকর হবে এই আশাটা তো আমাদের জাগিয়ে তুলতে হবে, ঠিক কিনা?”

”আশা জাগাও, কিন্তু টেন্ডুলকর হওয়াটা কোচ—ফোচের দ্বারা সম্ভব নয়। তবে এদের সংখ্যা তো হাতে গোনা! কিন্তু এটাও ঠিক, বাকিদের জন্য একটা প্রাথমিক শিক্ষার দরকার আছে।”

”যা বললেন!” প্রতাপ ঊরুতে চাপড় দিল। ”এই দরকারের কথা ভেবেই স্কুল করছি। কাউন্সিলরের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে।”

”যারা কোচ করবে তাদের টাকা দেবে তো?”

”নিশ্চয় দেব। সেটা ঠিক করব কোচের ওজন বুঝে। নামটাম আছে এমন লোককে কোচ হিসেবে রাখলে তাকে তো বেশি টাকা দিতেই হবে। ছেলেদের কাছ থেকে নেব একশো টাকা।”

”অ্যা অ্যাক….শো!” জহর প্রায় আঁতকে উঠলেন।

”আপনি অবাক হচ্ছেন!” প্রতাপ চোখ সরু করে তাকাল। ”একশো, দেড়শো টাকার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাবার জন্য কী লম্বা লাইন পড়ে জানেন? যদি নামডাকওলা কাউকে পাই তাকে চিফ কোচ করব, দেখবেন তখন ভিড়টা কীরকম হয়।”

”ভিড় হলে এক—একজনকে কোচিং দেওয়ার টাইমই তো থাকবে না!” জহর বিভ্রান্ত বোধ করলেন, ব্যাপারটা তাঁর মাথায় ঢুকছে না।

”থাকবে, থাকবে।” প্রতাপ আশ্বস্ত করার জন্য বলল, ”দেখুন জহরদা, দেড়শো টাকা মাইনের স্কুলে চল্লিশ—পঞ্চাশজন ছাত্রছাত্রী প্রতি ক্লাসেই থাকে, তাদের কি লেখাপড়া হয় না? তারা কি স্টার পেয়ে পাশ করে না?”

এই অকাট্য যুক্তিতে জহর চুপ করে রইলেন। লেখাপড়ার স্কুল আর ক্রিকেটের স্কুল যে কী করে একই রকমের হতে পারে সেটা তাঁর মাথায় ঢুকছে না, স্কুলে তিনি অতি সাধারণ ছাত্র ছিলেন। অঙ্ক আর ইংরেজি গ্রামার কখনওই তাঁর মাথায় ঢোকেনি, ফলে স্কুল—ফাইনালে ব্যাক পেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেটে রনজি ট্রফিতে খেলেছেন, ছ’টা ম্যাচের দশ ইনিংসে আছে সাড়ে তিনশো রান, গড় প্রায় চল্লিশ, আর এই রেজাল্ট তো কোচিং স্কুলে শিক্ষা না নিয়েই!

”বেলা বেড়ে যাচ্ছে, আপনাকে তো এখন ব্যাঙ্কে যেতে হবে।” প্রতাপ উঠে দাঁড়াল, ”যদি কোচিং স্কুল শুরু করি তা হলে আপনাকে আমার দরকার হবে। অন্তত দু’জন ভেটারেন কোচ রাখব। আপনি আসবেন তো?”

”নিশ্চয় আসব। তুমি শুধু দোকানে খবর পাঠিয়ো।”

বেলগাছিয়া ডিপো থেকে ট্রামে উঠলেন জহর। ব্যাঙ্কে এসে শুনলেন, ”দেরি করে ফেলেছেন, কাল বারোটার আগে আসুন।” ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে ঠিক করলেন একটু ঘুরে রাজনারায়ণ পার্কটা দেখে বাড়ি ফিরবেন। এখন সাড়ে বারোটা বাজে।

পার্কটা রাজপথের ওপর নয়, অন্তত একশো মিটার ভেতরে। আকৃতিতে প্রস্থের থেকে দৈর্ঘ্যে বেশি। নাইন—এ—সাইড ফুটবল ম্যাচ খেলা যায়। দু’দিকে বাড়ি আর দু’দিকে রাস্তা। রাস্তার দিকের লোহার রেলিং চুরি হয়ে যাওয়ায় কোমরসমান ইটের পাঁচিল, পাঁচিল ঘেঁষে সাত—আটটা সিমেন্টের বসার জায়গা। দুর্গাপুজো, রাজনৈতিক সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা গানের জলসার ধকলে পার্কে একচিলতে ঘাসও নেই। জমি অসমান, জায়গায়—জায়গায় খোঁড়াখুড়ির চিহ্ন রয়ে গেছে। পার্কের একপ্রান্তে একতলা দুটি লম্বা ঘর, রাজনারায়ণ ইনস্টিটিউট। একদা একটা লাইব্রেরি ছিল, এখনও ছেঁড়া পুরনো কিছু বই আর কয়েকটা আলমারি রয়ে গেছে। ইনস্টিটিউটের ফুটবল আর ক্রিকেট টিমও ছিল। এখন ক্যারম আর তাস খেলা হয়।

জহর একটা বাড়ির ছায়ায় দাঁড়িয়ে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাঁর ছোটবেলায় এই মাঠ ঘাসে ঢাকা ছিল। ইনস্টিটিউটের পরিচালনায় ফুটবল টুর্নামেন্ট হত। মাঠ ঘিরে দর্শকের ভিড়ের মধ্যে তিনিও হাজির থাকতেন। এখন মাঠের কী অবস্থা! হঠাৎ তাঁর চোখে পড়ল খাঁ—খাঁ রোদ্দুরে মাঠের এককোনায় একটি আঠারো—উনিশ বছরের ছেলে আধভাঙা ব্যাট দিয়ে একটা রবারের বল বাড়ির দেওয়ালে মেরে যাচ্ছে, মাঠে তো বটেই, রাস্তাতেও কোনও লোক নেই। ছেলেটি একমনে গভীর অভিনিবেশে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ব্যাকফুটে বলটা এমনভাবে মারছে যে, সেটা দেওয়ালে লেগে একটা ড্রপ পড়ে ঠিক তার ব্যাটেই ফিরে আসছে। শটের ওপর এমনই নিয়ন্ত্রণ যে, একবারের জন্যও তাকে পা দুটো ছ’ ইঞ্চির বেশি এধার—ওধার করতে হচ্ছে না। ব্যাপারটা দেখে জহর মজা পেলেন। একা—একা এই ভরদুপুরে ক্রিকেটপাগল না হলেও কি এমন কাণ্ড করে।

লক্ষ করলেন, শটের তীব্রতা বাড়াচ্ছে। বেশ জোরে—জোরে মেরে যাচ্ছে। বল দেওয়ালে লেগে মিডিয়াম পেসে হাফ ভলিতে ছেলেটির কাছে ফিরে আসছে আর সে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। ”বাঃ,” আপনা থেকেই জহরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল শব্দটা। তিনি মাঠের ভেতরে ঢুকে ছেলেটির পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পা মাথা, কনুই এবং শরীরের ব্যালান্স নিখুঁত না হলে শটের ওপর এমন কন্ট্রোল কি আসে? সবচেয়ে বড় কথা কনসেনট্রেশন! কত শট মারল? সত্তর—আশিটা তো বটেই, একটাও ফসকাল না! জহর যখন এইসব ভাবছেন তখনই ছেলেটি বল ফসকাল। বলটা একটা ইটের কুচির ওপর পড়ে লাফিয়ে উঠেছিল। জহর বলটা ধরে ফেললেন।

পেছন ফিরে তাঁকে দেখে ছেলেটি অবাক! তার পেছনে যে একজন দাঁড়িয়ে থাকবেন রোদ্দুর মাথায় নিয়ে, এটা সে ভাবতে পারেনি, বোকার মতো সে হাসল, শ্যামলা রং, ছিপছিপে দোহারা গড়ন, লম্বায় প্রায় পাঁচ—দশ। খয়েরি স্পোর্টস শার্ট, পায়ে হাওয়াই চটি। হাসার জন্য দেখা গেল নীচের পাটির সামনের একটা দাঁত নেই।

”করছ কী?” জহর হাসলেন।

”এমনিই, একটু পেটাচ্ছি।”

”এভাবে পিটিয়ে লাভ?”

”ভাল লাগে।” লাজুক স্বরে সংক্ষিপ্ত উত্তর।

”কোনও ক্লাবে খেলো নাকি?”

”সবুজ শিবিরে,…. পাড়ার একটা ক্লাব।”

জহর কখনও সবুজ শিবির নামটা শোনেননি, ভাবলেন, পাড়ায় পাড়ায় কত ক্লাবই তো আছে। জিজ্ঞেস করলেন, ”থাকো কোথায়?”

ছেলেটি আঙুল তুলে বলল, ”এই পাশের রাস্তায়।

জহরের ইচ্ছে করল ওর নামটা জানতে। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে তাঁর বাধল। গায়ে পড়ে প্রথম আলাপেই নাম জানতে চাওয়াটা যেন বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলে মনে হল, ”এখান দিয়ে যাচ্ছিলুম। তোমাকে এইভাবে খেলতে দেখে দাঁড়িয়ে গেলুম। এই প্রচণ্ড গরমের মধ্যে, একা একা—ভাবলুম পাগল নাকি?” জহর হাসলেন। ছেলেটি আবার বোকার মতো হাসল। বলটা ছুড়ে ফেরত দিয়ে জহর ঘুরলেন যাওয়ার জন্য।

”আমি কিন্তু আপনাকে চিনি।”

জহর ঘুরে দাঁড়ালেন, কৌতূহলী চোখে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

”চেনো? আমার নাম জানো?”

”জহর পাল, গত বছর দেশবন্ধু পার্কে ভেটারেনদের ম্যাচে আপনি ব্যাট করেছিলেন। চারটে ছক্কা মেরে লং অনে ক্যাচ দিয়ে আউট হন।” ছেলেটির চোখে আলো জ্বলে উঠল। ”বাবার কাছেও আপনার কথা শুনেছি।”

”কী শুনেছ?” জহরের কৌতূহল বেড়ে গেল।

”আপনি একঘণ্টা ক্রিজে থেকে একটাও রান করেননি রনজি ট্রফিতে বিহারের সঙ্গে খেলায়। আবার আসামের এগেনস্টে দু’ঘণ্টায় সেঞ্চুরি করেছিলেন।”

জহরের মুখে হাসি ফুটে উঠল, বললেন, ”কেন রান করিনি তার কারণটা বলেছেন?”

”ম্যাচ ড্র রাখার জন্য। শেষ একঘণ্টা শুধু বল আটকেছিলেন আর ছেড়ে দিয়েছিলেন। দশজন আপনাকে ঘিরে রেখেছিল।”

”তোমার বাবা খেলাটা দেখেছিলেন?”

”হ্যাঁ। বাবা তো আম্পায়ারিং করতেন। রনজি ট্রফির ম্যাচও খেলিয়েছেন—পঞ্জাব—রেলওয়েজ।”

”তাই নাকি? কী নাম তোমার বাবার?”

”অমর দত্ত।”

শুনেই জহরের ভ্রূ বেঁকে উঠল। চোখের চাহনি পলকের জন্য কঠিন হয়েই আগের মতো কৌতূহলী হল, ছেলেটি তা লক্ষ করল না।

”নামটা শোনা—শোনা লাগছে। বেঁটে, ফর্সা, গোলগাল, মাথায় বোধহয় অল্প টাক?”

”হ্যাঁ। তবে এখন সারা মাথাই টাকে ভরা।”

”আচ্ছা, অনেক বেলা হল, চলি।”

জহর দ্রুতপায়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে এলেন। হাঁটতে—হাঁটতে তাঁর মনে পড়ল অনেক বছর আগের একটা ঘটনা। লিগের শেষ ম্যাচ মোহনবাগানের সঙ্গে। ইডেনে ছিল খেলাটা। একদিকের আম্পায়ার ছিল অমর দত্ত। মোহনবাগান দু’শো পাঁচ অল আউট। জহর ব্যাট করতে নেমেছিলেন ফোর ডাউন। ব্রাদার্স তখন পঁচাশি। নেমেই তিনি পেটাতে শুরু করেছিলেন। সাত উইকেটে একশো সত্তর যখন, তিনি তখন একাত্তর রানে, তেরোটা চার মেরেছেন। ব্যাট করেছেন মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট। জেতার জন্য আর দরকার ছত্রিশ রান। যেভাবে খেলছিলেন তাতে ওই ক’টা রান পাঁচ ওভারেই তুলে নিতে পারবেন বলে তিনি ধরে নিয়েছিলেন।

জহরের চোখে ভেসে উঠল সেই সময়ের ছবি। মোহনবাগান ক্যাপ্টেন বিটু ঘোষ মরিয়া হয়ে বল দিল প্রশান্ত চৌধুরীকে, প্রশান্ত শুধু নেটে বল করে, কোনওদিন কোনও ম্যাচে বল করেনি। জহর জানতেন না ও কী ধরনের বোলার। বাউন্ডারির ধারে স্কোয়ার লেগ থেকে লং অফ পর্যন্ত পাঁচজন ফিল্ডার রাখল বিটু বাউন্ডারি বন্ধ করার জন্য। জহর হুঁশিয়ার হয়ে প্রথম বলটা খেলেছিলেন। ফ্লাইট করানো লেগ ব্রেক। লেগস্টাম্পের বাইরে শর্ট পিচ। অনায়াসে পুল করতে পারতেন। হয়তো চারটে রানও পাওয়া যেত। মাত্রাতিরিক্ত সাবধান হয়ে তিনি পা বাড়িয়ে প্যাডে খেলেছিলেন। প্রশান্তর দ্বিতীয় বলটাও একই ধরনের ছিল। পুল করবেন ভেবেও শেষ মুহূর্তে ব্যাক ফুটে এসে ডিফেন্সিভ খেলেছিলেন। তখন নিজের ওপর তাঁর রাগ ধরে। খামোখা সমীহ করছেন প্রশান্তকে, বোলারের জাতই নয়। স্রেফ ভ্যাবাচাকা খাওয়াবার জন্য বিটু ওকে ডাক দিয়েছে। বহুক্ষেত্রে এই রকম বোলাররাই উইকেট পেয়ে যায়।

তৃতীয় বলটা মারবেন ঠিক করে জহর বল ডেলিভারির আগেই এক—পা বেরিয়েছিলেন। ফ্লাইট দেখে শর্ট পিচ হচ্ছে আন্দাজ করে আরও এক—পা বেরিয়ে হাফভলি করে নিয়ে মিড উইকেট দিয়ে ছয় মারার জন্য ব্যাট চালিয়েছিলেন। কিন্তু কী যে হয়ে গেল, বলটা তিনি ফসকালেন, বলটা যে লেগস্টাম্পের সামান্য বাইরে ছিল সে—সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। ফসকানো বল লাগল তাঁর ডান পায়ে। উইকেটের সামনেই ছিল পা। প্রশান্ত লাফিয়ে উঠে ঘুরে নাটকীয়ভাবে দুই মুঠো ঝাঁকিয়ে ডাকাতের মতো গলায় চিৎকার করে অ্যাপিল করেছিল। তার সঙ্গে যোগ দেয় উইকেটকিপার। কভার থেকে বিটু ‘হাউজ্যাট’ বলে চেঁচিয়ে আম্পায়ারের দিকে ছুটে এসেছিল। আম্পায়ার ডান হাতের তর্জনি আকাশের দিকে তুলে দিয়েছিলেন।

জহর হতভম্ব হয়ে প্রায় দশ সেকেন্ড তাকিয়ে থেকেছিলেন। তাঁর চোখের বজ্রাহতের চাহনিটা ধীরে—ধীরে রূপান্তরিত হয়েছিল জ্বলন্ত অঙ্গারে। বিটু চেঁচিয়ে বলেছিল, ”দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে, অনেক খেলেছিস, এবার বাড়ি যা।” মাথা নিচু করে, চোয়াল চেপে জহর মাঠ ছেড়েছিলেন। বাকি দুটো উইকেটে আর পনেরো রান উঠেছিল। ব্রাদার্সের লিগ চ্যাম্পিয়ান হওয়া অপূর্ণ থেকে যায়। ফিরে আসতেই কানু ভটচায বলেছিল, ”শেষকালে প্রশান্তর বলে! ছ্যা ছ্যা ছ্যা … কাছেই গঙ্গা, গিয়ে ডুবে মর। … জেতা ম্যাচ—!” তখন জহর বলেছিলেন, ”বলটা লেগস্টাম্পের অন্তত এক বিঘত বাইরে পড়েছিল। লেগস্টাম্পের বাইরের বলে কি এল বি ডবলু হয়? আজ আমি আম্পায়ারের টুঁটি ছিঁড়ব।” বলেই তিনি ছুটেছিলেন আম্পায়ার্স রুমের দিকে।

টুঁটি ছেঁড়া হয়নি। কয়েকজন তাঁকে জাপটে ধরে রাখে। তিনি চিৎকার করতে থাকেন, ”জোচ্চচুরি, জোচ্চচুরি… টাকা না খেলে অমন ডিসিশান কেউ দেয়?”

কে একজন তখন বলে, ”জহরকে এই প্রথম মাথা গরম করতে দেখছি। খুবই মনে লেগেছে।”

আর—একজন বলে, ”আম্পায়ারও তো মানুষ আর মানুষমাত্রেই ভুল করে। অমর দত্ত যে এখন কলকাতার সেরা আম্পায়ার তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই! জহর পালের এটা স্পোর্টিংলি নেওয়া উচিত।”

কথাটা শুনেই তিনি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলেন। পরে মনে হয়েছিল, এ কী করেছেন? একটা খেলায় আউট হলে কি ভদ্রতা বিসর্জন দিতে হবে? অত লোকের মাঝে কি খারাপ ইঙ্গিত করলেন লোকটির উদ্দেশ্যে! হয়তো সত্যিই ভুল করে আউট দিয়েছে, অথচ বলে দিলেন টাকা খেয়েছে! অমর দত্ত নিশ্চয় শুনেছে তার চিৎকার। কী ভাবল তার সম্পর্কে! খেলা কি আত্মমর্যাদার থেকেও বড় জিনিস? বেশ কিছুদিন তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছিলেন। তারপর ধীরে—ধীরে ঘটনাটা ভুলে যান।

এত বছর পর আজ আবার মনে পড়ে গেল। অমর দত্তের ছেলের সঙ্গে দেখা না হলেই ভাল ছিল। … ছেলেটার নামটা তো জানা হল না!

.

অবনী রায়ের দেওয়া পাঁচ হাজার টাকার চেকটা ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলে জহর জমা দিয়েছিলেন। কয়েকদিন পর টাকাটা তুলে তিনি ছেলেকে এক দুপুরে নিয়ে গেলেন নিউ আলিপুরে এক ক্লিনিকে। সেখানে এম আর আই স্ক্যান করিয়ে বাসে ফিরছিলেন। বাস যখন পার্ক স্ট্রিটের কাছাকাছি তিনি দেখলেন ময়দানে একটা মাঠে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে। তাঁর মন আনচান করে উঠল। অনেকদিন তিনি ঘাসের ওপর হাঁটেননি, ব্যাটের সঙ্গে বলের ধাক্কা লাগার শব্দ শোনেননি, ব্যাটের ঠিক কোথায় বল লাগল, শব্দ শুনে তা বলে দিতে পারেন। ‘হাউজ্যাট’ চিৎকার অনেকদিন শোনেননি, আউট হয়ে ফিরে আসা কোনও তরুণের হতাশ মুখ বা শরীরের নিখুঁত ব্যালান্সে ভর রেখে মারা কভার ড্রাইভ অনেকদিন দেখেননি কিংবা লংঅনে আকাশছোঁয়া বলে ক্যাচ নেওয়া।

”মানিক আমি এখানে নামব, একটু কাজ আছে। তুই বাড়ি চলে যা।”

জহর এই বলে বাস থেকে নেমেই হনহনিয়ে ইডেন মাঠের দিকে রওনা হলেন। তিনি কাগজে দেখেছেন পি সেন ট্রফির খেলা শুরু হয়েছে। আজ ব্রাদার্সের সঙ্গে ফুলবাগানের ফাইনাল। ঘড়ি দেখে আন্দাজ করলেন লাঞ্চ হয়ে আবার খেলা শুরু হয়েছে।

কাঠফাটা রোদ্দুর। দর্শক বড়জোর শ’দুই। ক্লাব হাউসের সিঁড়ি ভেঙে ওপরতলায় উঠে এসে সিমেন্টের চেয়ারে বসলেন জহর। দু’ধারে তাকিয়ে একজন চেনা লোককে দেখলেন। মনোজ, ব্রাদার্স ইউনিয়নের পুরনো সাপোর্টার, জহর তার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। মাঠে ফিল্ড করছে ব্রাদার্স।

”খবর কী?” জহর জিজ্ঞেস করলেন।

”ভালই। চুয়াল্লিশ ওভারে দুশো ছেচল্লিশ। … দারুণ ব্যাট করল মান্টু সিং, এই একটা ভাল প্লেয়ার এনেছে পানু পোদ্দার। সাতাত্তরটা রান করল, কী মার যে মারল কী বলব! ইজিলি সেঞ্চুরিটা করতে পারত।’

”পারল না কেন?”

”বমি করতে শুরু করল। এই গরমে আর দাঁড়াতে পারছিল না।”

”এগারোটা ফিল্ডার কী করে তা হলে দাঁড়াল?”

এমন এক বিদঘুটে কথা শুনে মনোজকে বিব্রত দেখাল। জহর ঠোঁট টিপে হাসলেন। বললেন, ”খুব দামি প্লেয়ার বোধ হয়!”

”চারটে ম্যাচ খেলে চল্লিশ হাজার নেবে। … আজকাল ক্রিকেটেও ফুটবলের মতো টাকা! … জহরদা আপনারা আর কী করলেন? শুধু বুড়ো আঙুল চুষে গেলেন।”

জহর হাসতে গিয়ে থমকে গেলেন। মাঠে একটা উইকেট পড়েছে।

‘থার্ড উইকেট পড়ল।” মনোজ উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ”থ্রি ফর থার্টি, মাত্র সাত ওভার খেলা হল। জহরদা, পি সেন ট্রফি এবার ব্রাদার্সের ঘরে উঠল। … তিনটেই ভাল ব্যাট, মাত্র তিরিশ রানে চলে গেল!”

”হ্যাঁ চলে গেল। গাড়োলের মতো ব্যাট করলে তো চলে যেতেই হবে। ওরা কি ভেবেছে পঁচিশ ওভারেই আড়াই শো রান তুলে নেবে? কীভাবে ছেলেটা ব্যাট চালাল দেখেছ? একটা থার্ড ক্লাস বলে শর্ট লেগের হাতে আলুগপ্পা!” জহর তিক্তবিরক্ত স্বরে বললেন।

”দিক না আলুগপ্পা, তাতে তো ব্রাদার্সেরই লাভ।”

”তা বটে, তবে এরকম ব্যাটিং বসে দেখা যায় না।”

”আপনারা, পুরনো লোকেরা সবসময় কেতাবি ব্যাটিং দেখতে চান।” মনোজের গলায় সামান্য তাচ্ছিল্য। ”রান পেলেই হল, ব্যাটের কোথায় লেগে কোথা দিয়ে রান এল তাই নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?”

জহর চুপ করে মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। নতুন ব্যাটসম্যান প্রথম বলটা ফরওয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলল। বলটা গেল স্লিপের দিকে। জহরের ভুরু কুঁচকে উঠল। মনোজকে জিজ্ঞেস করলেন, ”নুরু ক’টা উইকেট পেয়েছে?”

”এই একটাই, বাকি দুটো অলোক।”

”জয়প্রকাশ ব্যাট করেনি?” জহর খোঁজ নিলেন।

ফুলবাগানের সেরা ব্যাট এবং সবথেকে অভিজ্ঞ জয়প্রকাশ চার বছর আগে বাঙ্গালোর থেকে কলকাতায় চাকরি নিয়ে আসে। তিনটে টেস্ট খেলেছে। রনজি ট্রফিতে কর্নাটক আর বাংলার হয়ে মোট তেরোটা সেঞ্চুরি, দলিপ ট্রফিতে দুটো সেঞ্চুরি আছে। টেকনিক্যালি নিখুঁত এবং বুদ্ধিমান।

”এখনও নামেনি। …. ও আর করবে কী….. আরে, আরে—” মনোজ লাফিয়ে উঠল, ”ফোর্থ উইকেট গন… জহরদা কট অ্যান্ড বোল্ড। ফুলবাগান ফোর ডাউন ফর থার্টি টু!… গেল, ফুলবাগান আজ গেল। দশ ওভারে বত্রিশ … আলোকের থার্ড উইকেট!”

জহর কথা বললেন না। তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে রইলেন উইকেটের দিকে মন্থর পায়ে যাওয়া জয়প্রকাশের দিকে। মাথায় হেলমেট, বছর পঁয়ত্রিশের শীর্ণ লম্বা চেহারা। চার উইকেটে বত্রিশের মতো পরিস্থিতিতে জয়প্রকাশ বহুবার ব্যাট করতে নেমেছে। এটা লিমিটেড ওভারের ম্যাচ, খুটখাট করে ব্যাট করলে চলবে না। উইকেট বাঁচিয়ে দ্রুত রানও তুলতে হবে। পঁয়ত্রিশ ওভার বাকি, হাতে ছ’টা উইকেট, এখন তুলতে হবে আরও দুশো পনেরো রান। জহর নড়েচড়ে বসলেন। কাজটা সহজ নয়।

জয়প্রকাশ তিনটে বল খেলল। সবক’টাই ফিরিয়ে দিল বোলারকে। ওভারশেষে নন স্ট্রাইকার কিঙ্করের সঙ্গে কথা বলল। নুরুর প্রথম বলেই থার্ডম্যান থেকে একটা রান নিয়ে কিঙ্কর স্ট্রাইক দিল জয়প্রকাশকে।

জয়প্রকাশ প্রথম বলটাতেই ব্যাট চালাল। ‘কড়াত’ শব্দ হল। নিমেষে পয়েন্ট বাউন্ডারিতে বল। জহর শিরদাঁড়ায় শিহরন বোধ করলেন। দারুণ স্কোয়্যার কাটটা! পরের বলটা ওভারপিচ। স্ট্রেট ড্রাইভ। চার রান। নুরুর চতুর্থ বল ফুলটস, অফ স্টাম্পের বাইরে, জয়প্রকাশ পুল করল মিড উইকেটে। আবার চার রান। পঞ্চম বলটা দেখে জহরের মনে হল নুরু ঘাবড়ে গেছে। লেগ স্টাম্পের প্রায় এক হাত বাইরে ছিল। জয়প্রকাশ ছেড়ে দিল। আম্পায়ার ওয়াইড সঙ্কেত দেখালেন। পরের বল ডেলিভারির আগেই কিঙ্কর ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এল দ্রুত শর্ট রান নেওয়ার আশায়। নুরু সেটা লক্ষ করেই ডেলিভারি না করে বল হাতে বেল তুলে নিয়ে, ”হাউজ দ্যাট” বলে চিৎকার করল।

আম্পায়ার আঙুল তুলে দিতেই মনোজ লাফিয়ে উঠল। মাঠে প্লেয়াররা দু’হাত তুলে নুরুর দিকে ছুটে এসে হাতে হাত চাপড়াচ্ছে। ”ফিফথ উইকেট….. জহরদা, ভাবা যায়! ছেচল্লিশ রানে পাঁচটা উইকেট! … ওহহ!” মনোজ দু’হাতে মুখ ঢাকল। ”আমরা জিতছি। ফুলবাগান আজ যা ডিফিট খাবে!”

 ”মনোজ, খেলার এখনও অনেক বাকি।” শান্ত স্বরে জহর বললেন, ”উইকেট পাচ্ছে নিজেদের বোলিংয়ের জন্য নয়, ব্যাটসম্যানদের ভুলে। ক্রিজে জয়প্রকাশ রয়েছে। ও কিন্তু ভুল করে না। একটা লোকই ম্যাচ ঘুরিয়ে দিতে পারে।”

”আরে রাখুন আপনার জয়প্রকাশ।” … হাসতে—হাসতে আমরা ম্যাচ তুলে নিয়ে যাব। বাজি ফেলুন, কত টাকা দেবেন যদি ব্রাদার্স ইউনিয়ন ম্যাচ জেতে?”

জহর আড়চোখে মনোজের উত্তেজিত মুখ দেখে নিয়ে বললেন, ”বাজি আমি ধরি না।”

”বেশ আমিই পঞ্চাশ টাকা দেব যদি ফুলবাগান জেতে।… যাই একবার ড্রেসিং রুমটা ঘুরে আসি, মান্টু সিংয়ের যা অবস্থা দেখেছি। …. ফাইভ ফর ফর্টিসিক্স, আর আপনি কিনা বলছেন জয়প্রকাশ ম্যাচ ঘুরিয়ে দেবে?” মনোজ নীচে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির দিকে এগোল। জহর মাঠের মাঝে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।

এক ঘণ্টা পর ফুলবাগানের স্কোর হল পাঁচ উইকেটে একশো একান্ন। গড়ে সাত রান প্রতি ওভারে এবং পনেরো ওভারে জয়প্রকাশ আর নতুন একটি ছেলে (জহর এক ফুলবাগান সাপোর্টারকে পরে জিজ্ঞেস করে জানে ওর নাম শুভ্রজ্যোতি) যোগ করেছে একশো পাঁচ রান। তার মধ্যে জয়প্রকাশেরই বাহাত্তর।

জহর এই সময় মনে—মনে বলেন, ‘একেই বলে গাছাড়া খেলা। পাঁচটা উইকেট ফেলে দিয়েই ভাবল ম্যাচ পকেটে পুরে ফেলেছি। … চাবকানো উচিত গোটা টিমটাকে। … বলের লাইন আর লেংথের মাথামুণ্ডু নেই, ফিল্ডাররা দৌড়চ্ছে যেন আধমনি বস্তা মাথায় নিয়ে। জয়প্রকাশেরই একটা ক্যাচ আর একটা স্টাম্পিং চান্স মিস করেছে, এরা আবার ম্যাচ জিতবে! অফে ছ’টা লোক রেখে বল ফেলছে লেগস্টাম্পে! এ—ম্যাচ ফুলবাগান ঠিক বার করে নিয়ে যাবে।’

এবং ফুলবাগান তাই করল। সাত উইকেটে দুশো সাতচল্লিশ করল যখন, তখনও ম্যাচের দু’ ওভার বাকি, জয়প্রকাশ আশি বলে বিরানব্বই করে লং অনে ধরা পড়ে। আর শুভ্রজ্যোতি একশো আট বলে সত্তর রান করে নট আউট। দু’জনে মিলে তুলেছে একশো পঁয়তাল্লিশ রান। ছেলেটা কঠিন সময়ে চাপের মুখে ভেঙে পড়েনি। টেকনিক ভাল, টেম্পারামেন্ট ভাল, ছেলেটা উঠবে। ওর খেলা জহরকে খুশি করেছে। সাপোর্টারদের কাঁধে চেপে শুভ্রজ্যোতি ফিরছে। গরমে লাল হয়ে যাওয়া মুখের লাজুক হাসিটা জহরের ভাল লাগল। তিনি প্রায় অন্যমনস্কের মতো মৃদু হাততালি দিলেন। হারা ম্যাচ জিতে নেওয়ার মতো ঘটনা খুব বেশি দেখা যায় না। বাস থেকে নেমে পড়ে খেলাটা দেখতে আসার জন্য জহর নিজেকে তারিফ জানালেন।

ক্লাব হাউস থেকে বেরিয়েই দেখলেন অমর দত্তর ছেলে রাস্তা পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে এধার—ওধার তাকাচ্ছে। তাঁর সঙ্গে চোখাচোখি হতে ছেলেটি হাসল।

‘খেলা দেখলে?” জহর জিজ্ঞেস করলেন।

”হ্যাঁ।”

”কীরকম দেখলে?”

”শুভ্র দারুণ ব্যাট করল।” ছেলেটির চোখ—মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। ”দেখলেন একটাও তুলে মারেনি, সব জমির ওপর দিয়ে। অথচ সিক্সার মারতে ওস্তাদ।”

”তুমি ওর খেলা আগে দেখেছ?”

”ও তো দু’বছর আগে আমাদের ক্লাবেই ছিল, একসঙ্গে খেলেছি। ….এ—বছরই শুভ্র ফুলবাগানে এসেছে। যাই, ওকে কনগ্র্যাচুলেট করে আসি। … আপনার ক্লাব যে এভাবে হারবে ভাবিনি।”

আমার ক্লাব! কথাটা জহরের মনে বাজল। ব্রাদার্স ইউনিয়ন কি এখনও আমার ক্লাব! কত বছর ব্রাদার্সে খেলেছি …. আঠারো বছর? আঠারোই হবে, আট বছরই তো ক্যাপ্টেন ছিলাম! তারও আগে দুটো সিজন ফুলবাগানেও খেলেছি।

ছেলেটি রাস্তা পার হতে যাচ্ছে। জহর চেঁচিয়ে বললেন, ”শোনো, শোনো ….. তোমার নামটা কী?”

”সমর।” একটু থেমে নিয়ে জুড়ল, ”সমু।”

”চলো আমিও তোমার সঙ্গে যাব, শুভ্রর সঙ্গে আলাপ করব।”

দু’জনে মিনিট দুয়েক হেঁটে পৌঁছল ফুলবাগান টেন্টে। কলকাতার পুবে নারকেলডাঙ্গা আর বেলেঘাটার মোড়ে ফুলবাগান অঞ্চল। ক্লাবটি সেখানেই। পঁচাশি বছর আগে পাড়ার কয়েকজন ছেলে প্রতিষ্ঠা করে। কালক্রমে সেখান থেকে বড় হতে—হতে এখন ময়দানে জায়গা করে নিয়েছে। ক্রিকেট ছাড়া ফুটবলও খেলে সিনিয়ার ডিভিশনে। নামটাই ফুলবাগান অ্যাথলেটিক, জায়গার সঙ্গে এখন আর সম্পর্ক নেই। ক্লাব প্রাঙ্গণটা বেশ বড়। কাঠের বেঞ্চ আর ছোট—ছোট টেবিল ছড়ানো। বয়স্ক মেম্বাররা এই গরমের জন্য এখনও এসে পৌঁছননি। তবে যেসব সমর্থক ইডেনে খেলা দেখতে গেছল তারাই এখন উল্লাস করছে। টেন্টের মধ্যে প্রচুর লোক। প্লেয়াররা এখনও পোশাক বদলায়নি। সফট ড্রিঙ্কসের বোতল নিয়ে অনেকে খোলা প্রাঙ্গণে বেঞ্চে বসে। গরম, ঘাম আর উত্তেজনা প্রশমনের সঙ্গে চাপা উচ্ছ্বাসে তাদের মুখ গনগন করছে। সমর্থকদের স্তুতি প্রশংসা তারিয়ে—তারিয়ে উপভোগ করার সঙ্গে চুমুক দিচ্ছে বোতলে।

জহর একটা বেঞ্চে বসলেন। সমর টেন্টের ভেতর ঢুকে গেল। একটু পরেই ফিরে এল একটা বোতল হাতে, তার সঙ্গে শুভ্র।

”শুভ্র, ইনি জহর পাল, নাম শুনেছিস তো। আজ তোর ব্যাটিং দেখেছেন, ভাল লেগেছে ওঁর।” সমু পরিচয় করিয়ে দিতেই শুভ্র হাতজোড় করে নমস্কার করল। জহর প্রশংসাভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, ”ভাল খেলেছ। তবে বাসুদেবের ফ্লাইটেড বলে তোমার ইনিশিয়াল মুভমেন্টটা পেছনদিকে হচ্ছিল, এগিয়ে গিয়ে হাফভলিতে মিট করার চেষ্টা দেখলাম না। … অ্যাটাক করবে তো বেরিয়ে এসে! এমন সহজ পিচে তো বোলিংকে তুলোধোনা করবে, দেখলে না জয়প্রকাশ তাই করল। অবশ্য ওর মতো এক্সপিরিয়ান্স তোমার নেই। …. তা হলেও খুব ভাল খেলেছ।”

শুভ্র নম্রস্বরে বলল, ”প্রকাশদাই বারণ করলেন। বললেন, ধরে খেল, তাড়াহুড়ো করিসনি। যা করার আমি করছি।”

”নুরুর বলে দুটো ড্রাইভ উঠে গেছল। শর্ট কভারে লোক থাকলে পেয়ে যেত তোমায়।”

”আমি লোক নেই দেখেই চালিয়েছিলুম।”

”তোমার দরকার টার্নিং পিচে ভাল স্পিনারের বলে খেলা। মুশকিল হচ্ছে এখন তো তেমন স্পিনার নেই।” জহর চিন্তিত মুখে কথা শেষ করলেন। ”এমন বাজে বোলিং তো সব ম্যাচে পাবে না।”

এই সময় ফুলবাগানের ক্রিকেট সচিব হেমন্ত গুহ তাঁদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। বেঁটেখাটো, ধুতি—পাঞ্জাবিপরা, হাসিখুশি মুখ, ষাটের কাছাকাছি বয়সী লোকটি দিলদরিয়া মেজাজের জন্য খেলোয়াড়দের প্রিয়। ব্যবসা করেন, দু’ হাতে খরচও করেন। জহর ওকে চেনেন।

”ভাবতেই পারছি না জহরকে ফুলবাগান টেন্টে আজ দেখব।” দু হাত বাড়িয়ে হেমন্ত বললেন, জহর দাঁড়িয়ে উঠে ওর হাত দুটি ধরলেন।

”যেভাবে ম্যাচটা আপনারা জিতলেন, বিশেষ করে এই ছেলেটি যেরকম ব্যাট করল, তাতে ভাবলাম, যাই, ছেলেটিকে অভিনন্দন জানিয়ে আসি।”

”আপনি কি ব্রাদার্স ইউনিয়ন ছেড়ে দিয়েছেন?… এ—বছরও তো খেলেছেন!” হেমন্তর চোখেমুখে বিস্ময়।

‘বলতে পারেন ছেড়ে দিয়েছি।” একটু থেমে হাসিমুখে ম্লান কণ্ঠে জহর বললেন, ”বুড়ো ঘোড়া আর কত টানব, ওরাই ছাড়িয়ে দিল। … ওয়ানডে ক্রিকেটের সঙ্গে তাল দিয়ে চলা আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বয়স তো কম হল না! এবার সরে যাওয়াই তো উচিত।”

”কত বছর খেললেন?” হেমন্ত জানতে চাইলেন।

”খেলছি তো বাচ্চচা বয়স থেকে। ময়দানেই তো কাটল পঁয়ত্রিশ বছর।”

একটি লোক এসে হেমন্তর কানে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে কী বলতেই হেমন্ত তাকে বললেন, ”আরে বাবা, হবে হবে, কথা দিয়েছি যখন ঠিকই খাওয়াব।” তারপর জহরের দিকে তাকিয়ে হেমন্ত একগাল হেসে বললেন, ”জিতলে ওয়ালডর্ফে ডিনার খাওয়াব বলেছি। যাই টেলিফোন করে টেবিল বুক করে আসি। … শুভ্র বাড়ি চলে যেয়ো না যেন।”

ব্যস্ত হয়ে হেমন্ত টেন্টের দিকে চলে গেলেন। জহর বললেন ”আমিও যাই। সমু, তুমি তো এখন থাকবে।”

”আমি আর এখানে থেকে কী করব, শুভ্র তো আজ ভি আই পি, কত লোক এখন ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইবে।” সমু হাসতে হাসতে হুল ফোটাল।

‘এই একটা লোকাল ট্রফির একটা ম্যাচে ভাল খেলেই ভি আই পি? জয়প্রকাশ না খেললে কী হত অবস্থাটা?” জহর শুভ্রর পিঠে হাত রেখে গাঢ়স্বরে বললেন, ”অনেক শেখার আছে, অনেক পথ যেতে হবে। ধরে নাও এখনও তুমি কিছু জানো না। ক্রিকেটে একটা ভুল মানেই তুমি আর ক্রিজে নেই। ভাবো আর নিজেই একটা—একটা করে ভুল শুধরে নিয়ে নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করো, এভাবেই গাওস্কর অতবড় হয়েছে।”

ওর পিঠে একটা চাপড় দিয়ে জহর গেটের দিকে এগোলেন। তাঁর কানে এল শুভ্র রেগে সমুকে বলছে, ”কেন আমাকে ভি আই পি বলে লজ্জায় ফেলে দিলি!”

জহর মনে—মনে হাসলেন বেজার কথা মনে পড়ায়। কানু ভটচায ওকে বলেছিল ‘আজ সন্ধ্যেবেলায়ই তা হলে ফিরপোয়, …. তোর যা প্রাণে চায়।’ —বেচারা বেজা! ফিরপো হোটেল এখন উঠে গেছে। নিজেকে নিজে নষ্ট করল, স্রেফ খাওয়ার লোভে পড়ে—পড়ে শরীরটা শেষ করে দিল। মন দিয়ে খেলায় যত্ন নিলে অনেকদূর উঠত। বিষেণ বেদির মতো বল করত। বেজার সঙ্গে দেখা হলে বলতে হবে ফুলবাগানের পুরো টিম পার্ক স্ট্রিটের হোটেলে ডিনার খেয়েছে। শুনে এত বছর পরেও কানু ভট্টাচার্যের বাপান্ত করবে আর কষ্ট পাবে, তা পাক। এটাই হবে ওর লোভের শাস্তি।

জহরের থেকে অল্প পেছনে আসছে সমু। গরম এখন সামান্য কমেছে, সূর্য একটু পরেই অস্তে যাবে। পথে লোকের ভিড় শুরু হয়েছে। অধিকাংশই চলেছে গঙ্গার দিকে। ছ’টা বাজলেও সন্ধ্যা নামেনি। ভেজা ছোলা বিক্রি হচ্ছে দেখে জহর দাঁড়িয়ে পড়লেন। ময়দানে এটা তাঁর প্রিয় খাদ্য। পেঁয়াজ কুচি, বিটনুন আর লেবুর রস দেওয়া ভেজানো ছোলা খেতে—খেতে এসপ্ল্যানেডে ট্রাম ধরতে যাওয়ার দরকার আর বোধ হয় হবে না কোন দিন।

সমুকে দেখে জহর বললেন, ”এসো, ছোলা খাওয়া যাক।”

”না, না, আমার খিদে নেই।” সমু এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল।

”আরে, খিদে মেটাবার জন্য কি কেউ ছোলা খায়? এটা সময় কাটাবার জন্য জাবর কাটা। আমার হাতে এখন অঢেল সময়। … দু’পাতা দাও তো।” জহর ছোলাওলাকে বললেন।

”আপনি এত বছর ধরে খেললেন কী করে? আমি তো ভাবতেই পারি না! ফার্স্ট ডিভিশনে আপনার থেকে সিনিয়ার আর কেউ আছে?”

‘না, নেই।” জহর নিশ্চিত গলায় বললেন, ”কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কী আছে? তুমি সি কে নাইডুর নাম শুনেছ? …. বোধহয় শোনোনি।”

”শুনেছি, বাবা একদিন বলেছিল ভারতের প্রথম টেস্ট ক্যাপ্টেন ছিলেন সি কে নাইডু।”

”আমার ছোটবেলার হিরো ছিল মুস্তাক আলি, তোমাদের যেমন গাওস্কর, কপিলদেব … মুস্তাকের গুরু ছিলেন সি কে। কালো রং, ছ’ফুটের ওপর লম্বা, তেমনই স্টাউট ফিগার, চলাফেরার ভঙ্গি ছিল রাজার মতো। দেখলেই মনে হত, হ্যাঁ একটা ক্রিকেটার বটে!”

”আপনি ওঁকে দেখেছেন?”

জহর কথাটার জবাব না দিয়ে বললেন, ‘নাও, পাতাটা ধরো।”

সি কে নাইডুকে তিনি চোখে দেখেননি। সি কে শেষবার যখন ইডেনে খেলেন তখন জহরের বয়স তেরো। বাংলার বিরুদ্ধে রনজি ট্রফির সেই ফাইনাল খেলা দেখা তাঁর হয়ে ওঠেনি। হাম তাঁকে বিছানায় শুইয়ে রেখেছিল। কিন্তু খবরের কাগজ থেকে তিনি খেলাটির বিবরণ পড়ে যে রোমাঞ্চ বোধ করেছিলেন সেই রোমাঞ্চ স্মৃতিতে আজও জ্বলজ্বলে তাজা হয়ে রয়েছে। সতেরো রানের ফার্স্ট ইনিংস লিডের জন্য হোলকার অবধারিত হারা ম্যাচটা জিতে যায়। আজও তিনি একটা হারা ম্যাচ জিততে দেখলেন।

দু’জনে ছোলা চিবোতে—চিবোতে ধীরগতিতে হাঁটতে শুরু করলো। জহর অন্যমনস্ক। তিনি আজকের একদিনের ম্যাচের সঙ্গে পাঁচদিনের সেই রনজি ফাইনালকে একই সারিতে ফেলে ভাবতে পারলেন কী করে যে, ‘আজও একটা হারা ম্যাচ জিততে দেখলেন!’ দুটো ম্যাচের মধ্যে কি তুলনা হয়? বাদল দত্তর সেঞ্চুরি, নির্মল চ্যাটার্জির হাফ সেঞ্চুরি, তার জবাবে নিম্বলকরের ডাবল সেঞ্চুরি, মুস্তাকের নিরানব্বুই। নাইনথ উইকেট যখন পড়ল হোলকার তখনও সতেরো রান পেছনে। কী লড়াই যে তখন! সেই টেনথ উইকেট পার্টনারশিপটা….।

সমু তাঁকে কী যেন জিজ্ঞেস করছে। তিনি ওর দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললেন, ”জানো নিম্বলকর আর ধনওয়াড়ে চল্লিশ রান তুলেছিল টেনথ উইকেটে! ধনওয়াড়ে ছিল বোলার, একদমই ব্যাট করতে পারে না কিন্তু এগারো নম্বরে দুটো ইনিংসেই মাটি কামড়ে ব্যাট করে গেল। … একেই বলে জেতার ইচ্ছে, লড়াই করা…” জহর উত্তেজনায় হাতে ঝাঁকুনি দিতেই কিছু ছোলা পড়ে যাচ্ছিল, সমু বিদ্যুৎগতিতে হাত বাড়িয়ে দিতেই কয়েকটা ছোলা তার তালুতে পড়ল। একটা কঠিন ক্যাচ ধরার সাফল্য তার মুখে ভেসে উঠল।

”গুড।” জহর হাত বাড়িয়ে ছোলাক’টা নিলেন। ”স্লিপে ফিল্ড করো?”

”হ্যাঁ।’

”ক্যারেকটার!…. ধনওয়াড়ে তার ভেতরের জিনিস বার করে এনে ব্যাট করেছিল, সেটা হল ফাইটিং স্পিরিট। এটা না থাকলে প্লেয়ার হওয়া যায় না। দু’জন ঝানু টেস্ট বোলার মন্টু ব্যানার্জি আর পুঁটু চৌধুরী, ভাল অফ স্পিনার গিরিধারী শতচেষ্টা করেও সেকেন্ড ইনিংসে ওকে আউট করতে পারেনি। দেড়ঘণ্টা ধরে ডিফেন্ড করে দু’রানে নট আউট থেকে ম্যাচ বাঁচিয়েছে।…. বাংলাও লড়েছিল সরাসরি জেতার জন্য। ফার্স্ট ইনিংসে পিছিয়ে গিয়ে আবার ব্যাট করতে নামে। হোলকার বোলারদের বেধড়ক পিটিয়ে চারজন হাফ সেঞ্চুরি করে। ফিফথ ডে সকালে উইকেটে রোল করিয়ে ক্যাপ্টেন খোকন সেন বাংলাকে দু’ ওভার ব্যাট করিয়ে, শ’তিনেক রান হাতে নিয়ে ইনিংস ছেড়ে দেয়। সকালে বাংলা দু’ওভারের জন্য ব্যাট করল কেন বলো তো?” জহর দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার এবং রেড রোড পার হওয়ার জন্য।

”জানি না।” সমু অকপটে স্বীকার করল।

”তা না হলে উইকেট রোল করার সুযোগটা বাংলা পেত না। আর এই রোলিংটা নেওয়ার উদ্দেশ্য ছিল, চারদিন খেলে উইকেট তো ভেঙে গেছল, সেটাকে আরও ভেঙে দেওয়া। এর পর ব্যাট করার আগে হোলকার আবার রোল করাল, আরও ভাঙল। তারপর তো বাংলা ঝাঁপিয়ে পড়ল।”

রেড রোডে অবিশ্রান্ত গাড়ির স্রোত। ওরা রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করল না। জহরের ভাল লাগছে একজন মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে। তাঁর ধারণা, অতীতের কথা তরুণদের জানা দরকার। এগুলো উৎসাহ আর প্রেরণা জোগায়। যেমন সি কে নাইডু তাঁকে এই বয়সেও শক্তি জুগিয়ে মাঠে টেনে আনেন।

”পাঁচঘণ্টায় দশটা উইকেট ফেলতে হবে তিনশো রানের মধ্যে। ভাবো ব্যাপারটা! উইকেট পড়তেও লাগল। হার হচ্ছে জেনে লাঞ্চের পর সি কে তো মাঠ থেকেই কালীঘাটে পুজো দিতে গেলেন। কিন্তু বাংলা আটকে গেল ন’টা উইকেট নেওয়ার পর। বাকিটা আপ্রাণ চেষ্টা করেও আর পাওয়া হল না। যদি পেত—” জহর কথা শেষ করলেন না। শুধু হাসলেন। ”কী দারুণ একটা ভিকট্রি দুটো বোলার, হীরালাল গায়কোয়াড় আর ধনওয়াড়ে আটকে দিল ব্যাট দিয়ে। আজ আর ওদের নাম কেউ করে না, জেতার জন্য বাংলার সেই লড়াই কেউ আর আজ মনে রাখেনি। …. সি কে নাইডুর সেটাই ছিল শেষবার রনজি ট্রফি জেতা, বয়স তখন সাতান্ন পেরিয়েছে।” জহর মুচকি হেসে চোখ পিটপট করলেন।

”চলুন এবার পার হই।”

ওরা রাস্তা পার হয়ে নীরবে কিছুক্ষণ হাঁটল। জহরের এতক্ষণে মনে পড়ল মনোজকে, ব্রাদার্স ইউনিয়নের টেন্টটা চোখে পড়ায়। বেচারা নিশ্চয় ভেঙে পড়েছে দুঃখে। দুঃখ তাঁরও হচ্ছে। পানুরা যে ব্যবহারই করুক, ক্লাব তো তাঁরও!

”চলো তো একবার ব্রাদার্সের টেন্টটা ঘুরে যাই। একজন বাজি ধরেছিল ব্রাদার্স না জিতলে পঞ্চাশ টাকা দেবে। একটু লেগপুল করে আসি।”

লোহার ফেন্স ঘেরা ব্রাদার্সের টেন্ট। সামনে খানিকটা জমি। কাঠের পাটার ফটক, তার মাথায় লতাগাছের খিলেন, ক্লাবের নামলেখা বোর্ড। ফোল্ডিং লোহার চেয়ারে কয়েকজন বসে। তার মধ্যে রয়েছে কানু ভটচায, সুবল মুখুজ্যে, পানু পোদ্দার, আরও কয়েকজন। একটা কাঠের টেবিলে খালি চায়ের কাপ। টেন্টের পেছনে লম্বা ফালি জমি। ওখানে নেট প্র্যাকটিস হয়।

জহর ভেতরে না ঢুকে ফেন্সের ধারে দাঁড়ালেন। সুবল মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে বলল, ”খেলা দেখলে?’

”দেখলুম।”

”কী মনে হল?”

”চাবকাতে ইচ্ছে হল। … সবক’টাকে, তোদেরও।”

প্রাণকৃষ্ণ ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ”কী বললে?”

”যা মনে হয়েছে তাই বললুম।” জহরের মুখে হাসি। ”ক্লাবটা যদি ইস্টবেঙ্গল কি মোহনবাগান হত তা হলে এতক্ষণে এই টেন্টটা আর দাঁড়িয়ে থাকত না, আগুন জ্বলত। … আরও দু’চারটে প্লেয়ার ভাড়া করে আন। শুধু মান্টু সিং দিয়ে কী হবে?”

প্রাণকৃষ্ণ থরথর করে কাঁপছে। কানু ভটচায তাকে হাত ধরে টেনে বসাল।

”বোসো, বোসো, ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাবে। …জহর এখন যাও এখান থেকে। মজা দেখার সময় এটা নয়।” কানু ভটচায হাত নেড়ে চলে যেতে বলল।

জহরের চোখে পড়ল নুরু টেন্টের ভেতরে থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। বাসুদেব টেন্টের ভেতর থেকে একবার উঁকি দিল। জানলায় কার যেন মুখ সরে গেল। মনোজকে তিনি কোথাও দেখতে পেলেন না।

”চলো, এবার যাওয়া যাক।” জহর নিচু গলায় সমুকে বললেন। ”কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।”

ওরা এসপ্ল্যানেডে এসে বাসে উঠল। জহর দোকানে যাবেন। হাতিবাগানে বাস থেকে তাঁর সঙ্গে সমুও নামল, সে বাড়ি যাবে।

”আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু জানলুম আজ, আরও জানতে জানতে ইচ্ছে করছে।” সমু বিদায় নেওয়ার আগে বলল।

”জানতে চাও তো আমার বাড়িতে চলে এসো যে—কোনওদিন সকালে। কাগজের পুরনো কাটিং আছে, দেখাব। ভাল কথা, তুমি কী রকম খেলো সেটা আমার জানা নেই। সিজন তো শেষ হয়ে গেল, তোমার সবুজ শিবিরের কোনও ম্যাচ আর আছে কি?”

”না, নেই। এখন তো সব মাঠে ফুটবল নেমে গেছে, সেই পুজোর পর আবার।”

”ঠিক আছে, আমাকে বোলো, দেখব কেমন খেলো।” জহর কথাটা বলে ডান হাতটা তুললেন বিদায় জানাতে। দেখলেন সমু ইতস্তত করছে। জিজ্ঞাসু চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন।

”আপনাকে যদি জহরদা বলি তা হলে কিছু কি মনে করবেন?”

জহর হেসে ফেললেন। সমু তাঁর ছেলে মানিকেরই বয়সী হবে। খেলার দুনিয়ায় বাবার বয়সীদেরও দাদা বলাই রেওয়াজ।

”মনে করব কেন! তবে ঠিকমতো উচ্চচারণটা কোরো। জহ—র—দা বললে ভাল লাগবে, জর্দা বোলো না, অনেকেই বলে। জহর কথাটাও অনেকে ভাল করে উচ্চচারণ করতে পারে না, বলে জর।”

”বাবাকে আপনার কথা বলব।”

জহরের ভেতরটা একবারের জন্য কুঁকড়ে গেল। অমর দত্ত তার ছেলেকে কী বলবে তাঁর সম্পর্কে! জহর পাল লোকটা খুব বাজে টাইপের, অভদ্র, আনস্পোর্টিং?

‘বোলো।”

জহর রাস্তা পার হয়েই দেখলেন ফুটপাথে পাইপের রেলিংয়ে দুই কনুই রেখে বেজা দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টি দূরে কোথায় যেন বিঁধে রয়েছে। জহর বেজার দৃষ্টি অনুসরণ করে আবিষ্কার করলেন প্রায় তিরিশ হাত দূরে তেলেভাজাওলাকে এবং ডালায় সদ্য ভেজে রাখা বেগুনিগুলোকে।

”ওদিকে তাকিয়ে কী দেখছিস বেজা?”

কানের কাছে ফিসফিস করে বলা কথাটা শুনে বেজা চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল।

”ওহ তুই।” বেজা আশ্বস্ত হল। ”ভয় ধরিয়ে দিয়েছিলি।”

”এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে?’

”অফিস থেকে আসছি। বাস থেকে নেমে ভাবলুম এখন বাড়ি গিয়ে কী আর করব, যা গরম! তাই একটু হাওয়া খেতে দাঁড়িয়ে পড়লুম।”

”হাওয়া খেতে, না পেঁয়াজি—বেগুনি খেতে?”

”পেঁয়াজি—বেগুনি!” বেজার আকাশ থেকে পড়ার মতো মুখ হল, ”তুই বলছিস কী? সেই সেদিনের পর থেকে আমি তেলেভাজা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি রোজ এখানে দাঁড়িয়ে মনের জোর পরীক্ষা করি।”

”কীভাবে করিস?”

”আধঘণ্টা ধরে বেগুনিভাজা দেখি। কিনব কি কিনব না, খাব কি খাব না … খালি ফ্লাইটেড টোপ নিজের দিকে ছাড়ি। ক্রিজ ছেড়ে বেরোই কিনা সেটারই পরীক্ষা চালাই।”

”পরীক্ষার রেজাল্ট কী?”

”মেডেনের পর মেডেন। তেলেভাজাওলার দিকে এক—পাও এগোইনি।” বেজার চোখ—মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ”বেজা হালদার স্টাম্পড হয়নি। বুঝলি রে, মনের জোর কারও থেকে আমার কম নেই। এখন মনে হচ্ছে বয়সটা পঁচিশ বছর যেন কমে গেছে, মাঠে নামলে এখনও ব্যাটসম্যানকে ভ্যাবাচাকা করে দিতে পারি। লোভ সংবরণ মানে ডিসিপ্লিন। এবার এটাকে ধরে রাখতে হবে। ফুচকা, ঘুগনি, আলুকাবলি সব ছেড়েছি, এখন একটু পরিশ্রম করা দরকার। তুই কী বলিস, ডাবল সেঞ্চুরি না হোক জীবনে ভাল করে একটা ফিফটি করে যেতে না পারলে আর কী ক্রিকেটার হলুম?” বেজার স্বর মোটেই হালকা নয়। জহর খুশি হলেন। মানুষটাকে এতদিন চিনতে না পারার জন্য অবাকও হলেন।

”তোর মন ভাল লাগছে কিনা বল?”

”খুব ভাল লাগছে। আমি জানতুমই না আমার মনের জোর কতটা। আমার এখন খুব বল করতে ইচ্ছে করছে রে জহর।”

”দাঁড়া, তোর জন্য একটা কিছু করা দরকার। সামনের সিজন তো আর ক’মাস পরেই শুরু হবে। একটা ছোটখাটো ক্লাবের নেটে গিয়ে যাতে বল করতে পারিস সেই ব্যবস্থা করব।”

”শুধু নেটে!” বেজাকে হতাশ দেখাল। ”আমি ম্যাচে খেলব। তুই এখনও খেলছিস, আর আমি পারব না?”

”পারবি, পারবি।” জহর সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ”আগে শরীরটাকে ঠিকঠাক করে তোল, রোজ সকালে দৌড়ো, ফ্রি হ্যান্ড কর, গায়ে একটু জের হোক।” বেজার পিঠে আলতো দুটো চাপড় মেরে জহর দোকানে যাওয়ার জন্য হাতিবাগান বাজারের দিকে এগোলেন।

.

দিন কয়েক পর একদিন সকালে জহরের বাড়িতে এসে হাজির হল সমু। জহর রোজ ভোরে গঙ্গার তীরে স্ট্র্যান্ড রোড ধরে দু’ মাইল মন্থর গতিতে দৌড়ন। এটা তাঁর গত তিরিশ বছরের অভ্যাস। দৌড় শেষে রথতলা ঘাটে গঙ্গাস্নান সেরে বাড়ি ফেরার পথে বাজার করেন।

সেদিন বাজারের থলি হাতে বাড়ি ঢোকার সময় দেখলেন পাশের বাড়ির রকে সমু বসে আছে তাঁর অপেক্ষায়। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ”এই সকালে কী ব্যাপার? এখন তো সবে সাতটা!”

”একটা ব্যাপারে এসেছি। আমাদের সবুজ শিবিরের প্রেসিডেন্ট রামবাবু, রামকৃষ্ণ ঘোষ প্রতি বছর তাঁর গ্রামে একটা এগজিবিশন ক্রিকেট ম্যাচ করান, এবারও—”

”দাঁড়াও, দাঁড়াও, বাড়ির ভেতরে এসো, বসে কথা বলো।”

সমুকে নিয়ে তিনি একতলায় বসার ঘরে এলেন, ঘরে তিনটি কাঠের চেয়ার, একটা টেবিল। একটা কাঠের আলমারি ছাড়া আর কোনও আসবাব নেই। দেওয়ালে দেশি—বিদেশি কয়েকজন ক্রিকেটারের ছবি।

”বোসো। এখন আমি রুটি—তরকারি খাই। দু’খানা খাবে?”

”না, না, আমি খেয়ে বেরিয়েছি …. কথাটা বলেই চলে যাব।” সমু ব্যস্তভাবে বলল, ”আমাদের প্রেসিডেন্ট রামবাবু খুব পয়সাওলা লোক। ওঁর গ্রামের নাম হাবলা, হাওড়া জেলায়, কলকাতা থেকে মাইল দশেক। ধুমধাম করে দুর্গাপুজো করেন, কলকাতা থেকে যাত্রাদল নিয়ে যান, কলকাতার ফুটবল টিম নিয়ে গিয়ে ম্যাচ খেলান। গ্রামের ক্লাবের সঙ্গে। এবার ফুলবাগানকে নিয়ে যাবেন সবুজ শিবিরের সঙ্গে খেলাতে।

”ফুলবাগান যেতে রাজি হয়েছে?”

‘হয়েছে। হেমন্ত গুহ তো রামবাবুর সম্পর্কে শালা, রামবাবু ফুলবাগানকে মোটা টাকা ডোনেশনও দেন। … আর খেলা তো সিরিয়াসলি হয় না, পিকনিকের মতো ব্যাপারটা। খালি খাওয়া আর মাঠে নেমে ছয়, চার মারা। রামবাবুর মাছের আমদানির বিরাট ব্যবসা। ছ’—সাত রকমের মাছ—ই খাওয়ান আর হাবলার বিখ্যাত রাতাবি সন্দেশ। কলকাতা থেকে বাসে নিয়ে যান আর বাড়ি পৌঁছে দেন। গ্রামের লোককে বড় টিমের প্লেয়ার দেখানোর জন্যই ম্যাচ। হাবলার লোক জয়প্রকাশকে দেখতে চায়।”

”তা আমার কাছে কেন?”

”আপনি যদি সবুজ শিবিরের হয়ে খেলেন, রামবাবুকে আপনার কথা বলতেই তো উনি লাফিয়ে উঠলেন। বললেন খুব ভাল হয়। এখনকার ইয়ং প্লেয়ারদের সঙ্গে খেলছে পঞ্চাশের ওপর বয়সী একজন, এটাও একটা দেখার মতো ব্যাপার। উনি আপনাকে একটা চিঠিও দিয়েছেন।”

সমু পকেট থেকে ভাঁজকরা একটা চিঠি বার করে জহরকে দিল। জহর চিঠিটায় চোখ বোলালেন। অল্প কথায় অনুরোধ করেছেন খেলার জন্য। শেষে লেখা, ”যদি অনুগ্রহ করে অধমের গ্রামে আসেন তা হলে কৃতার্থ বোধ করব। আপনার দৃষ্টান্ত আমাদের মতো বুড়োদের প্রেরণা জোগাবে।”

চিঠি পড়ে জহর হাসলেন। মুখ তুলে দেওয়ালে টাঙানো তিন—চারটে ছবির একটির দিকে তাকালেন। গাওস্কর, কপিলদেবের সঙ্গে সি কে নাইডুর ছবি। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে সমুও ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে দেখে জহর বললেন, ”উনিই সি কে। এই ছবিটা ওঁর শেষ রনজি ট্রফি সিজনে তোলা। তখন উনি হোলকার ছেড়ে উত্তরপ্রদেশের ক্যাপ্টেন। রাজস্থানের সঙ্গে খেলায় এক ইনিংস ব্যাট করে চুরাশি রান করেন। কোনও বোলার ওঁকে আউট করতে পারেনি, রান আউট হন। আর বোলার কারা ছিলেন জানো? …. রামচাঁদ, ভিনু মানকাদ, দুরানি, সবাই টেস্ট খেলেছেন। ….. সি কে—র বয়সে তখন একষট্টি পেরিয়ে গেছে।” জহরের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল ছবিটার দিকে তাকিয়ে। ”ভাবতে পারো, একষট্টি বছর—! আমি আর কী খেললুম। একমাস পর বোম্বাইয়ের এগেনস্টে করেন বাইশ আর বাহান্ন, এটাই ওঁর শেষ ম্যাচ।”

”কত সালের কথা?’

”ফিফটিসেভেন। …. খেলব বললে নিশ্চয়ই খেলা যায়। মনের জোর আর ইচ্ছে, শরীর ঠিক রাখা …. ডিসিপ্লিনড লাইফ।”

‘আপনি কতদিন খেলতে চান?”

”একষট্টি বছর তো বটেই।” জহর হেসে উঠলেন, ”তুমি রামবাবুকে বোলো আমি যাব।”

”ঠিক সকাল আটটায় আমরা রওনা হব মিনিবাসে।” সমু উঠে দাঁড়াল।

.

ওরা হাবলায় পৌঁছল সাড়ে আটটায়। খেলা শুরু হবে সাড়ে ন’টায়। দু’দল তিরিশ ওভার করে ব্যাট করবে। তারপর লাঞ্চ এবং অর্থাৎ খেলা শেষ। রামবাবুর দেওয়া লাঞ্চ খেয়ে কেউ আর নড়াচড়ার মতো অবস্থায় থাকে না। হাবলা বর্ধিষ্ণু গ্রাম, প্রায় আধা—শহর। পাকাবাড়ি, টেলিফোন, পিচের রাস্তা, কেবল টিভি যেমন আছে তেমনই আছে বাঁশঝাড়, ফলের বাগান, পুকুর, সর্ষে খেত। বড় ফুটবল মাঠের সঙ্গে ক্লাবের ঘর। তার সামনে শামিয়ানা, চেয়ার, স্কোরারের জন্য টেবিল এবং স্কুল থেকে ব্ল্যাকবোর্ড এনে রাখা হয়েছে স্কোর লিখে জানাবার জন্য। আম্পায়ার দু’জন স্থানীয় লোক। অ্যামপ্লিফায়ারে হিন্দি গান বাজছে। দুটো মিনিবাসে দুটো দল আলাদাভাবে প্রায় একই সময়ে পৌঁছল এবং পৌঁছনোমাত্র ডাব কেটে হাতে—হাতে তুলে দেওয়া হল। প্রত্যেকেই দুটো—তিনটে ডাবের জল খেল। তারপর এল চাকলা করে কাটা গোটা চল্লিশ হিমসাগর আম, সেইসঙ্গে চারটে থালায় সন্দেশ, প্রায় আশিটি। সন্দেশের থালা মিনিট দশেকের মধ্যেই খালি হয়ে যায়, আমগুলোর অর্ধেক পড়ে থাকে। জহর দুটি ডাবের জল আর একটি সন্দেশ খেলেন। খাওয়ার ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সংযত।

ফুলবাগান দলে সেইসব খেলোয়াড়ই বেশি যারা সারা সিজনে দু—তিনটির বেশি ম্যাচে খেলার সুযোগ পায় না। তবে রনজি ট্রফি খেলা দু’জন মিডিয়াম পেসার সৌগত রায় আর অনুপ ভৌমিক এসেছে। তাদের সঙ্গে শুভ্রও। জয়প্রকাশ এল হেমন্ত গুহর মোটরে, খেলা শুরুর দশ মিনিট আগে। সবুজ শিবিরের ছেলেদের কাউকেই জহর চেনেন না, শুধু সমুকে ছাড়া। বাসে আসার সময় সমু তাঁকে বলে, ”আপনি আজ আমাদের ক্যাপ্টেন, রামবাবু বলে দিয়েছেন।” জহর শুনে খুশি হন, তবু বিব্রত মুখে বলেন, ”আবার আমায় কেন, আমি তো কাউকে চিনি না। কে বোলার, কী বল করে, কে কেমন ফিল্ড করে, ব্যাট করে—”। সমু তাঁকে নিশ্চিন্ত করে বলে, ”আমি সব বলে দেব। আমাদের টিমে ওখানকার দুটো লোকাল ছেলে খেলানো হবে। তাদের অবশ্য আমি দেখিনি।”

মাঠ ঘিরে প্রায় শ’পাঁচেক দর্শক। রামবাবু এবং হাবলার গণ্যমান্যরা শামিয়ানার নীচে চেয়ারে বসে। জহরকে হাত ধরে তিনি তাদের সামনে এনে বললেন, ”দু’দলে যারা খেলছে তাদের প্রায় সবাই এঁর ছেলের বয়সী বা তার থেকেও বয়সে বড়। ইনি এখনও ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে যাচ্ছেন। একসময় বেঙ্গল রিপ্রেজেন্ট করেছেন। এমন বুড়ো ঘোড়াকে ধরে এনেছি হাবলায়, দেখা যাক কেমন ছোটেন। বুঝলেন ছকুবাবু, উনি আমাদের অনেকের থেকে বয়সে কিন্তু বড়, দেখে কি বোঝা যায়?’

কয়েক জোড়া বিস্মিত চোখ জহরকে জরিপ করতে শুরু করল। ছকুবাবু জানতে চাইলেন, ”আপনি কোন ক্লাবে খেলেন, মোহনবাগানে, না ইস্টবেঙ্গলে?”

”কোনওটাতেই নয়। শেষ এবার খেলেছি ব্রাদার্স ইউনিয়নে।”

”বল করেন, না ব্যাট করেন?”

‘দুটোই।”

”অ, অলরাউন্ডার, কপিলদেবের মতো।”

জহর কোনওক্রমে হাসি চাপলেন।

জয়প্রকাশই প্রধান আকর্ষণ। নানান বয়সী ছেলেরা তাকে ঘিরে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। হাসিমুখে সে কাউকেই নিরাশ করছে না। জহর লক্ষ করেছেন, একগ্লাস ডাবের জল ছাড়া জয়প্রকাশ আর কিছু মুখে দেয়নি।

”জহর, তোমায় যে এখানে দেখব ভাবিনি।” হেমন্ত গুহ এগিয়ে এলেন হাসিমুখে।

”রামবাবু চাইলেন বুড়োটাকে মাঠে নামাতে, তাই এলুম। ছেলে—ছোকরাদের সঙ্গে খেলতে আমার ভাল লাগে।”

”ব্রাদার্স ছেড়ে এবার তা হলে কোথায় যাবে?”

”ভাবছি তো আপনার ফুলবাগানে সই করব।” জহর মজা করে বললেন।

হেমন্ত গুহ পালটা মজা করেই বললেন, ”তোমায় পেলে তো লুফে নেব। আজ দেখি তুমি কেমন ফর্মে আছ।”

শুনে জহর শুধু হাসলেন। একটু পরেই তিনি টস করতে মাঠের মাঝে পিচের কাছে গেলেন, সঙ্গে ফুলবাগানের অধিনায়ক সৌগত বিশ্বাস। এবার বাংলার রনজি ট্রফি দলে তিনটে ম্যাচ খেলেছে। মিডিয়াম পেসার, আউট—সুইংটা ভালই করায়। হাতে মোক্ষম ইয়র্কারও আছে।

পিচ দেখে জহরের ভ্রূ কুঁচকে গেল। ঘাস নেই। বোধ হয় কাল বিকেলে প্রচুর জল ঢেলে রোলার টানা হয়েছে। পিচ এখনও ভিজে। সৌগত ঝুঁকে বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি টিপে বলল, ”জহরদা আঙুল বসে যাচ্ছে।”

”আট ওভার খেলার পর বলও ডন—বৈঠক দেবে। পরে ব্যাট করলে মুশকিলে পড়তে হবে।” জহর চিন্তিত স্বরে জানালেন।

টসে জহর হেরে গেলেন। সৌগত একগাল হেসে বলল, ”আমি আগে ব্যাট নিচ্ছি দাদা।”

দল নিয়ে মাঠে নামার আগে জহর কানে—কানে সমুকে জিজ্ঞেস করলেন, ”কারা—কারা বল করবে?”

”নিয়ম করা হয়েছে কোনও বোলারই পাঁচ ওভারের বেশি বল করতে পারবে না। তিরিশ ওভারে ক’জনকে কত ওভার বল করাবেন সেটা আপনিই ঠিক করবেন। আমাদের টিমে ওপেন করে ওই যে লম্বা ছেলেটা, কালু ওর নাম। আর ওই ছেলেটা সোমেন। তারপর শুভঙ্কর। তিনজনই মিডিয়াম পেসার। আমি আর সত্যজিৎ অফস্পিন করাই। এখানকার একটা ছেলে, শুনেছি জোরে বল করে, তাকে দিয়েও বল করাতে হবে।”

ফুলবাগানের ব্যাটিং ওপেন করতে নামল যে দু’জন তারা সাধারণত রিজার্ভে থাকে। জহর বল দিলেন কালুকে। ষোলো কদম ছুটে এসে কালু বেশ জোরেই বল ফেলল অফস্টাম্পের একহাত বাইরে, ওভারপিচ বল, উইকেটকিপার ফসকাল। প্রথম বলেই চার বাইরান। দ্বিতীয় বল ফুলটস। পুল করে চার রান নিল। তৃতীয় বল স্টাম্পে ভাল লেংথে, রান হল না। প্রথম ওভারে আট রানই রইল। জহর খুশি হলেন। পরের ওভারে সোমেন রান দিল তিনটি। কালুর তৃতীয় ওভারে পড়ল প্রথম উইকেট। ওভারপিচ বল কভারে ঠেলে দিতে গিয়ে ক্যাচ উঠে যায়। বলটা লাফিয়ে ব্যাটের ওপরদিকে লাগায়। কালুই ক্যাচটা ধরে। প্রথম স্লিপে দাঁড়ানো জহর মাথা নাড়লেন। মনে—মনে বললেন, ‘আট ওভার নয়, পাঁচ ওভার থেকেই দেখছি শুরু হল।’

মাঠ ঘিরে গুঞ্জন আর হাততালি। জয়প্রকাশ খেলতে নামছে। দীর্ঘদেহী, ঘোরকৃষ্ণবর্ণ, মাথায় কালো ক্যাপ। হেলমেট পরেই কলকাতায় ওকে পেসারদের খেলতে দেখা যায়। এখানে তেমন কোনও বোলার নেই বলেই সে বোধ হয় হেলমেট আনেনি। জহরের মনে হল, বোলার নেই ঠিকই, তবে ওর বোঝা উচিত ছিল হাবলার পিচ ইডেনের পিচ নয়।

জয়প্রকাশকে কালুর প্রথম বলটা ছিল মিডল স্টাম্পে একটু শর্ট পিচ। জয়প্রকাশ ডান পা অফস্টাম্পের দিকে নিয়ে গেছে পুল করবে বলে, আচমকা বলটা লাফিয়ে উঠল। চকিতে মাথা নামিয়ে নিল জয়প্রকাশ। উইকেটকিপার তার মাথার ওপর বলটা ধরল। বিস্মিত জয়প্রকাশ বোলারের দিকে একবার তাকিয়ে বলটা যেখানে পড়েছিল সেখানে গিয়ে পিচ দেখল। মাথা নাড়ল, ফিরে এসে পপিং ক্রিজের প্রায় দশ ইঞ্চি বাইরে স্টান্স নিল। ওভারের পঞ্চম বল করল কালু। ভাল লেংথে। জয়প্রকাশ বিদ্যুৎগতিতে এক—পা বেরিয়ে এসে ব্যাট চালাল। … সোজা ছয়। মাঠ ঘিরে দর্শকরা হাততালি দিয়ে উঠল। জয়প্রকাশের ব্যাটিংই তারা দেখতে এসেছে। ওভারে কালুর শেষ বলটিকেও সে একই ভাবে অভ্যর্থনা জানাল। দু’ বলে দুটো ছয়। দর্শকরা উদ্বেল হয়ে উঠল। যা দেখতে এসেছে সেটাই তারা পেয়েছে। জহর বুঝে গেলেন জয়প্রকাশ আজ বোলারদের খুন করবে। তিনি সমুর দিকে তাকালেন। কালুর বদলে অন্য কাকে দিয়ে বল করাবেন সেটাই জানতে চান।

”ওই যে ফর্সা মোটামতন, ওকে দেবেন। রামবাবু অনেক করে বলে দিয়েছেন। ওকে এখানকার লোক কপিলদেব বলে।” সমু জানিয়ে দিল।

সোমেনের প্রথম বলে একটা রান হল মিড উইকেট থেকে। এবার জয়প্রকাশের স্ট্রাইক। পাঁচটা বল থেকে চারটে বাউন্ডারি মেরে সে নিল একটা সিঙ্গল।

দর্শকদের চিৎকার শোনা গেল, ”উই ওয়ান্ট সিক্সার … উই ওয়ান্ট—”

জহর এই ব্যাপারে খুশি হলেন। রামবাবুর এত টাকা খরচ করা সার্থক হয়েছে। হাবলার জনগণের প্রত্যাশা জয়প্রকাশ পূরণ করে দিল। এবার তিনি হাবলার কপিলদেবকে আঙুল নেড়ে ডাকলেন।

হাবলার কপিলদেব প্রথমে না দেখার ভান করে থার্ডম্যান বাউন্ডারির দিকে হাঁটা দিয়েছিল। সমুই তাকে চেঁচিয়ে ডেকে আনল।

”জয়প্রকাশ এমন কিছু ব্যাটসম্যান নয়।” জহর হাবলার কপিলদেবের কাঁধে হাত রেখে তার মনে সাহস আর ভরসা জোগাবার জন্য বললেন। ”লেগের দিকে একদম বল ফেলবে না। অফস্টাম্পের ওপর বল রাখো, ঠিক স্লিপে ক্যাচ তুলে দেবে।” জহর তিন—চারবার চাপড় দিলেন ওর পিঠে।

”কিন্তু যদি ছয় মারে?”

”তা হলে,” জহর ঠোঁট কামড়ে বললেন, ”তুমি ওর মাথা লক্ষ্য করে বল কোরো।”

স্থানীয় কপিলদেব অক্ষরে—অক্ষরে জহরের পরামর্শ মতো বল করল প্রবলবেগে ছুটে এসে। সে লেগের দিকে একটাও বল করেনি। তার ছ’টা ফুলটস বলে জয়প্রকাশ একটাও ছয় মারতে পারেনি, সবক’টাই চার।

চব্বিশ রান দিয়ে ওভার—শেষে সে দর্শকদের দিকে হাত তুলে নাড়ল। দর্শকরা হাততালি দিল। তাদের ছেলের বলে একটা ছয়ও হয়নি। জহর বললেন, ”ওয়েল বোলড।”

”আমাকে কি আবার বল দেবেন?” কপিলদেব আতঙ্কিত গলায় বলল।

”হাবলার লোককে ছ’ বলে ছ’টা ছয় দেখার সুযোগ দেব না?”

”তার মানে আমাকে আবার বল করতে হবে?”

”তুমি একটা কাজ করো, খোঁড়াতে থাকো। কভারে দাঁড়াও, তোমার সাত—আট হাত দূর দিয়ে বল গেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ে আর উঠো না। ধরাধরি করে তারপর মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দেব, কেমন?”

”আমি সার ভেরি গ্রেটফুল থাকব।”

জহর এই ধরনের এগজিবিশন ম্যাচ আগেও বহু খেলেছেন। খেলে মজা পান। আর বোলার রয়েছে সমু আর তিনি নিজে। সমুকে ডেকে বললে, ”এবার তুমি বল করবে।”

উইকেটে এখন বল যথেচ্ছ ব্যবহার করছে। কোনওটা লাফাচ্ছে, কোনওটা গড়াচ্ছে। উইকেটের বাইরের বলেও বিপদ, স্ট্রোক নিতে গিয়ে ব্যাটের ঠিক জায়গায় লাগছে না। তা সত্ত্বেও জয়প্রকাশ সত্তর বলে একশো রান করল। ফুলবাগানের হল তিরিশ ওভারে সাত উইকেটে দুশো দশ রান। এর মধ্যে শুভ্রর রান তিন। মুখের সামনে লাফিয়ে ওঠা বলে ব্যাট তুলে ক্যাচ দেয় শর্ট লেগে। ঠিক একশো রান করে শুভঙ্করের বলে মিডঅফের হাতে ক্যাচ দিয়ে জয়প্রকাশ ফিরে যায়। জহর মনে—মনে তারিফ জানালেন ওকে, পাক্কা পেশাদারই নয় তো এমন বিশ্রী উইকেটে টেকনিক্যালি নিখুঁত ব্যাটও করে গেল।

ইনিংস শুরু করার আগে জহর রোলার চাইলেন। পাওয়া গেল না। চার কিলোমিটার দূরে রাস্তা সমান করার কাজে সেটিকে আজ সকালেই নিয়ে চলে গেছে ঠিকাদারের লোক। জহরের মুখে দুশ্চিন্তা ফুটল। রোল না করিয়ে এই পিচে তো খেলা মুশকিল! একজন বলল, ”দুরমুশ করে দিলে কেমন হয়?” জহর শুনে আঁতকে উঠলেন। তার থেকে পিচ যেমন আছে তেমনই থাক। শুধু জিজ্ঞেস করলেন, ”ফার্স্টএডের ব্যবস্থা আর ডাক্তার আছে তো?”

জয়প্রকাশ মৃদুস্বরে জহরকে বলল, ‘দাদা আপনি ব্যাট না করলেই ভাল হয়। পিচ খুব খারাপ। চোট পেয়ে যেতে পারেন।”

”তুমি তো চোট পেলে না!”

”আমার কথা ছাড়ুন, আপনার বয়স আর আমার বয়স! দু’জনের রিফ্লেক্স কি সমান হবে?”

”দেখা যাক।”

হেমন্ত গুহ আশ্বাস দিলেন জহরকে, ”সৌগতকে বলেছি স্পিড কমিয়ে বল করতে, এটা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ।”

”না, না, ও যেভাবে বল করে সেভাবেই করুক।” জহরের ভাল লাগল না এইসব কথা। তার বয়সকে সবাই যেন কৃপার দৃষ্টিতে দেখছে। ”হেমন্তদা, ব্যাট হাতে যখন নামছি তখন আমাকে ব্যাটসম্যান হিসেবেই ভাবা হোক। কেমন ফর্মে আছি সেটা তো আপনাকে দেখাতে হবে।”

”তা বটে, তোমাকে তো আবার ফুলবাগানে সই করাব বলেছি।” হেমন্ত গুহ হেসে জহরের পিঠে চাপড় মারলেন।

ফুলবাগান—ইনিংস শুরু করতে নামল জহর আর গৌতম। প্রথম স্ট্রাইক নিল গৌতম, বল করবে সৌগত।

”হাঁকপাক কোরো না। প্রথম ওভারটায় উইকেট দেখে নাও, মারতে যেয়ো না।” জহর গৌতমকে ডেকে বলে দিলেন। ওর মুখ দেখেই তিনি বুঝে গেছেন নার্ভাস হয়ে রয়েছে। সৌগতর প্রথম বল আউটসুইং করা ইয়র্কার। গৌতম এমন বল বোধ হয় কখনও খেলেনি। ব্যাটটা একটু বেশিই তুলেছিল। শেষমুহূর্তে তাড়াতাড়ি নামিয়ে সামনে ঝুঁকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। লেগস্টাম্প ছিটকে গেল। জহর আড়চোখে সৌগতকে দেখে নিলেন। ওর ঠোটে বাঁকা হাসি।

খেলতে এল মিহির। অফস্টাম্পের ওপর ভাল লেংথে সৌগত ছাড়ল ছোট আউটসুইঙ্গার। মিহির প্রথমে পিছিয়ে খেলবে ঠিক করে তারপর ব্যাটটা তার সামনে বাড়িয়ে ধরল। ব্যাটের কানায় লেগে প্রথম স্লিপে জয়প্রকাশের হাতে বল গেল। দু’ বলে দুটি উইকেট নিল সৌগত। এখন তার সামনে হ্যাটট্রিকের সুযোগ। নবাগত ব্যাটসম্যান শুভঙ্কর সেটা জানে বলেই মুখ শুকনো, চোখে ভয়। ক্রিজের দিকে যাওয়ার সময় হোঁচট খেল। মাঠের বাইরে দর্শকদের মধ্যে উন্মুখ একটা প্রত্যাশা হ্যাটট্রিক হওয়া দেখার জন্য। সৌগত বল হাতে অপেক্ষা করছে। নিস্তব্ধ মাঠ। এই সময় হঠাৎ এক দর্শক চিৎকার করল, ”হ্যাটট্রিক চাই।”

সৌগত বল হাতে ছুটল। সাধারণ একটা মন্থর সোজা বল। শুভঙ্কর বোধ হয় আগেই ঠিক করে রেখেছিল ব্যাট চালাবে। বলটা যে এত আস্তে আসবে সেটা বোঝেনি। ব্যাট চালাবার পর বলটা এসে তার মাঝের স্টাম্পে লাগল। হ্যাটট্রিক! প্রথম ওভারের প্রথম তিন বলে তিনজন আউট। সেঞ্চুরির পর হ্যাটট্রিক দেখে হাবলার দর্শকরা খুশিতে আত্মহারা।

ব্যাট করতে এল সমু। সৌগত ওভারের বাকি তিনটি বল হেলাভরে ফেলল অফস্টাম্পের বাইরে। সমু ছেড়ে দিল ব্যাট তুলে নিয়ে। জহরের পাশ দিয়ে ফুলবাগানের উইকেটকিপার যাওয়ার সময় বলে গেল, ”একটু দেখে খেলবেন, ফাস্ট বল করে।”

কথাটা মিথ্যা নয়। অনুপ ভৌমিক জোরেই বল করে। তবে ফাস্টবোলার বললে যা বোঝায়, ওয়েস হল, টাইসন বা ডেনিস লিলি, তেমন জোরে নয়। বল দিকভ্রষ্ট হয় বেশিরভাগই। যেমন প্রথম বলটিই জহর পেলেন ফুলটস, বুকের কাছে। পুল করলেন। স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারিতে বল গেল। পরের বলটাও একই রকম এবং একই স্ট্রোকে চার পেলেন। শুরুতেই দুটো বাউন্ডারি মেরে জহরের প্রত্যয় বেড়ে গেল। পরের বলে ফরওয়ার্ড ডিফেন্সিভ খেলে মিড অন থেকে এক রান নিলেন। সমু তিনটে বলের দুটো ছেড়ে দিয়ে একটি পিছিয়ে গিয়ে আটকাল।

জহর এগিয়ে গেলেন সমুর দিকে, ”যেভাবে খেলছ সেইভাবে খেলো। মারতে যেয়ো না … সৌগতকে আমি দেখছি।”

সৌগতকে জহর একটু ভালভাবেই দেখলেন। প্রথম তিনটি বল লং অফ এবং একস্ট্রা কভার বাউন্ডারিতে স্বচ্ছন্দে পাঠালেন, পরেরটি গ্লান্স করে দু’রান, পরের দুটিকে স্কোয়ার ড্রাইভ করে বাউন্ডারিতে। আড়চোখে সৌগতকে একবার তিনি দেখলেন। মুখ থেকে হাসি মুখে গেছে। তার মতো বোলারের সঙ্গে এহেন আচরণ সৌগত যেন বরদাস্ত করতে পারছে না। অনুপের ওভারটা সমু কাটিয়ে দিল শুধু বলগুলো ব্যাট দিয়ে থামিয়ে। জহর তারিফ জানিয়ে মাথা হেলালেন।

সৌগতর প্রথম বলেই জহর লাফিয়ে এক—পা বেরোলেন। বোলারের মাথার ওপর দিয়ে বলটা পেলেন লং অফ বাউন্ডারি টপকে। সৌগত ঠোঁট কামড়াল। পরের বলটা ঠুকে দিল। জহর বিদ্যুৎগতিতে হুক করলেন মুখের সামনে থেকে বলটাকে। তৃতীয় বলটা গুডলেংথে থেকে আচমকা লাফিয়ে উঠে জহরের ডান চোখের ওপর কপালে ছুঁয়ে ছিটকে গেল শর্ট লেগের দিকে। মুহূর্তের জন্য তিনি চোখে অন্ধকার দেখলেন। কপাল কেটে গেছে। ফোঁটা—ফোঁটা রক্ত ঝরল। ছুটে এল ফিল্ডাররা।

”বলেছিলুম দাদা, ব্যাট আপনি করবেন না। পিচ খারাপ।”

কথাটা শোনামাত্র জহরের মাথায় রক্ত উঠে এল। জয়প্রকাশের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে বললেন, ”এই খারাপ পিচেই তো তুমি সেঞ্চুরি করলে।” তাঁর মাথার মধ্যে আগুন জ্বলছে।

মাঠে ছুটে এসেছে ডাক্তার, ফার্স্টএড বক্স নিয়ে। জহরের কপালে তুলো দিয়ে প্লাসটার আটকে দিলেন। মিনিট ছয়—সাত সময় এজন্য খরচ হল। সৌগত আবার শুরু করল বল। চতুর্থ বলটা ঠিক একই জায়গা থেকে আবার লাফিয়ে উঠল। জহর মুখটা দ্রুত পেছনে সরিয়ে নিলেন। বল লাগল বাঁ কাঁধে। সৌগতর ঠোট বেঁকে উঠল। পরের বলে জহর দু’কদম বেরিয়ে এসে বলটাকে হাফভলি করে নিয়ে সোজা ড্রাইভ করলেন। ফলো থ্রুতে ডানহাত নামিয়ে সৌগত বলটা থামাতে গেল। আঙুল লেগে বল গেল মিড অন—এ। হাতটা ঝাঁকিয়ে সে আঙুলগুলো চোখের সামনে ধরল। মুখে যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। হাতটা সে ঝাঁকাচ্ছে। সবাই ছুটে গেল তার দিকে। জহর নিরাসক্তভাবে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। সৌগত মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল বাঁ হাত দিয়ে আঙুলগুলো চেপে ধরে।

জহরের মাথায় খুন চেপে গেছে। পঞ্চাশে পৌঁছলেন এগারো ওভারে। সমু তখন সাত রানে, ওর ধৈর্য আর মনোনিবেশ জহরকে যতটা খুশি করল, ততটাই স্বস্তি দিল। জমি ঘষড়ে আসা দুটো শুটার সমু আটকেছে ব্যাট নামিয়ে। একটা বল কাঁধে লেগেছে। কিন্তু অচঞ্চল রয়ে গেছে। কিন্তু জহর এখন যুবকের মতো চঞ্চল। কপাল টিপটিপ করছে আর সেটাই তাঁকে খুঁচিয়ে বাড়তি একটা সজাগতা দিচ্ছে। পিচের খামখেয়ালিপনা নিয়ে আর তিনি মাথা ঘামাচ্ছেন না। সারাজীবনে বহুরকম পিচে খেলেছেন, সেই অভিজ্ঞতা এখন কাজে লাগালেন। ব্যক্তিগত কত রান হল সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই। একটা কথাই তাঁর মাথায় ঘুরছে, ”বলেছিলুম দাদা, ব্যাট আপনি করবেন না।” দেখাচ্ছি এবার ব্যাট করা কাকে বলে! হেমন্ত গুহ এবার দেখুক তার স্টার ব্যাটসম্যানই শুধু ব্যাট করতে জানে না। ভিনু মানকাদ, দুরানি আর রামচাঁদকে ঠেঙিয়ে বুড়ো সি কে পঁচাশি করে রান আউট হয়েছিলেন। আমি সি কে নই, এরাও কেউ মানকাদ, দুরানি নয়, কিন্তু আমি জহর পাল, আর এটা হাবলার মাঠে তিরিশ ওভারের ম্যাচ তো বটে!

সৌগত আর মাঠে নামেনি। অনুপের বোলিং কোটা শেষ হয়ে গেছে। জয়দেব বাঁ—হাতি স্পিনার। বড় স্পিন, ফ্লাইট করায়। জহর প্রায় তিন গজ বেরিয়ে এসে ওকে ড্রাইভ করলেন। বাউন্ডারির ধারে ফিল্ডার দাঁড়িয়ে। একটা বল কোনওক্রমে থামাল, বাকি দুটো তার মাথার ওপর দিয়ে গেল। জয়দেবের ফ্লাইট করানো বন্ধ হল। নিচু করে জোরে বল দিয়ে যেতে শুরু করল। অন্যদিকে সৌগতর জায়গায় অধিনায়ক জয়প্রকাশ নিজে লেগব্রেক বল করতে এল। এই প্রথম জহরের ব্যাট থেকে ক্যাচ উঠল। বলটা পিচ থেকে একটু বেশিরকম ঘুরে লাফিয়ে ওঠে কোমর সমান। ঝুঁকে ব্যাট পেতেছিলেন। দ্বিতীয় স্লিপ থাকলে সহজ ক্যাচ পেত। সীমায়িত ওভারের খেলায় এইরকম ক্যাচ অনেক ওঠে। বাউন্ডারিও হয়, হাততালিও পড়ে। কিন্তু জহর লজ্জা পেলেন। কেন ক্যাচ উঠবে? বলটা লাফিয়েছিল পিচে খোঁদল থাকায়। ব্যাট সরাতে পারলাম না কেন? জহর কোনও অজুহাত পছন্দ করে না। যে—ধরনেরই ম্যাচ হোক না, টেকনিক নির্ভুল থাকতে হবে।

একটা গলদ ঘটে গেছে। কেউ সেটা লক্ষ করে থাকলে নিশ্চয় ভাবছে বুড়োটা ব্যাট করতে শেখেনি, স্লিপ নেই বলে বেঁচে গেল। আবার মাথা গরম হয়ে উঠল জহরের। আবার তিনি স্টেপ আউট করতে লাগলেন জয়প্রকাশের বলে। শামিয়ানার দিক থেকে হঠাৎ হাততালির শব্দ শোনা গেল। জহর বিস্মিত চোখে তাকালেন উইকেটকিপারের দিকে। ”কী ব্যাপার?”

”আপনার তো সেঞ্চুরি হল।”

”অ।” ব্যাটটা সামান্য তুললেন। ”এখান থেকে বোর্ডটা পড়া যাচ্ছে না, টোটাল কত? দুশো এগারো হতে কত বাকি?”

”হয়ে এল। তাড়াতাড়ি শেষ করে দিন না, খিদেয় চুঁইচুঁই করছে পেট।”

”দাঁড়াও, আগে আউট হই।”

”আর হয়েছেন!” উইকেটকিপারের স্বরে হতাশা।

জহরকে অবাক করেছে সমু। এতক্ষণ খেলে তেরো রান! ব্যাট দিয়ে যত না খেলেছে তার থেকেও বেশি বল ছেড়েছে। শরীরেও লাগিয়েছে অনেক। উইকেট কামড়ে পড়ে থাকা বলতে যা বোঝায় সমু তাই করেছে। শূন্য রানে তিন উইকেট, তখন ক্রিজে এসেছে। তাঁর সেঞ্চুরি হয়ে গেল, আর ছেলেটার মাত্র তেরো! হাতে কোনও স্ট্রোক আছে কিনা বোঝা গেল না। তবে গাওস্করের মতো যে টেম্পারামেন্ট দেখাল এই বয়সী ছেলের কাছ থেকে তা আশা করা যায় না!

সবুজ শিবিরের আর উইকেট পড়ল না। তিন উইকেটে দুশো বারো রান উঠতেই খেলা শেষ। তখন বেলা সওয়া দুটো। নট আউট রইলেন জহর একশো ষাট রানে, সমু কুড়ি রানে, অতিরিক্ত বত্রিশ রান।

”দাদা, আমি ভুল ভেবে কিছু কথা আপনাকে বলেছি, মাপ করে দেবেন”, জয়প্রকাশ হাত ধরল জহরের।

.

জহর ওকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, ”তোমার মতো ব্যাট আমি করতে পারিনি।”

”কী বলছেন দাদা! এই পিচে আপনার এগেনস্টে ছিল দুটো কারেন্ট বেঙ্গল টিমের বোলার! জয়দেব তো এ—বছরই রিজার্ভে ছিল।”

কথা বলতে—বলতে তাঁরা শামিয়ানায় এলেন, রামবাবু দু’হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন, জহরকে জড়িয়ে ধরে উদ্বিগ্নস্বরে বললেন, ‘মাথায় খুব বেশি লাগেনি তো?” জহর ‘ও কিছু নয়’ বলায় তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন, ”আমার মুখ রেখেছেন। কই হে হেমন্ত, এদিকে এসো, খুব তো তখন বললে ফর্ম কেমন আছে দেখি…. দেখলে তো, এবার লুফে নাও।”

হেমন্ত গুহ অপ্রতিভ হাসিতে মুখ ভরিয়ে ফেললেন। রামবাবু ফুলবাগানকে বছর—বছর মোটা টাকা দেন। ক্রিকেট টিমটা বলতে গেলে তাঁর টাকাতেই চলে, হেমন্ত বুঝে ফেলেছেন রামবাবু কী চান।

”লুফে নেব কী…নিয়ে ফেলেছি। জহর ট্রান্সফারের জন্য তৈরি থেকো।” হেমন্ত গুহর স্বরে হালকা রসিকতা নেই। তিনিও আজ জহরের ব্যাটিং দেখে মনে—মনে তারিফ করেছেন।

”তা হলে একটা কথা বলি। আমি আর ক’দিন খেলব! বহুদিন খেলবে এমন সম্ভাবনাময় ছেলেদের এখনই টিমে নিয়ে ফেলুন। আমার সঙ্গে খেলল যে ছেলেটা, তার কথা বলছি, অদ্ভুত ভাল টেম্পারামেন্ট আর ডিফেন্স দেখাল এই পিচে। ওর নাম সমর, আম্পায়ার অমর দত্তর ছেলে।”

”আমি তোমার বলার আগেই ভেবে রেখেছি জহর,” হেমন্ত চারধারে তাকিয়ে সমুকে খুঁজলেন, ”এই যে, শোনো, শোনো”, হাতছানি দিয়ে ডাকলেন সমুকে। ”খেলবে ফুলবাগানে?”

সমু বিহ্বল। ঢোক গিলে শুধু মাথাটা হেলাল।

”ট্রান্সফার শুরু হওয়ার আগে দেখা কোরো আমার সঙ্গে।”

”চলুন, চলুন, আর দেরি নয়, খাওয়ার দেরি হয়ে যাচ্ছে।” রামবাবু তাড়া দিলেন।

খাওয়ার ব্যবস্থা রামবাবুর বাড়ির উঠোনে, চেয়ার টেবিল পেতে। হেঁটে মিনিট চারেকের পথ। জহরের পাশের চেয়ারে বসল সমু। ভেটকি মাছের ফ্রাইয়ে কামড় দিয়ে সে বলল, ”জহরদা আপনি আমার কথা হেমন্ত গুহকে বলেছেন?”

”কে বলল?”

”শুভ্র বলল।”

”মোটেই না। যার হাতে স্ট্রোক নেই তাকে আমি সুপারিশ করতে যাব কেন?’

”স্ট্রোক আছে কি নেই, সময় এলেই দেখিয়ে দেব। … শুধু ফ্রাই দিয়েই পেট ভরাবেন না, এর পর গলদা চিংড়িও আছে।”

.

সকাল থেকে টিপটিপ বৃষ্টি। জহর সকাল আটটায় দোকান খুলেছেন। ঘণ্টাদুয়েক কেটে গেছে, বিক্রিবাটা বিশেষ হয়নি। একশো গ্রাম স্ক্রু, চারটে কবজা, একটা তালা, একটা প্লাস্টিক বালতি। আর কেরোসিন স্টোভের দাম জেনে একজন বলে গেছে সন্ধেবেলায় কিনে নিয়ে যাবে। এসব খদ্দের নাদুই সামলায়। ধরেই নিয়েছেন আজ খদ্দের পাবেন না। এরই মধ্যে জহর মাছের বাজার ঘুরে এসেছেন। প্রতিদিনের অভ্যাস, যদি ভাল সাইজের বাগদা চিংড়ির দেখা পাওয়া যায়! মাস ছয়েক আগে দেখতে পেয়েছিলেন, তিনশো টাকা কিলো! আধ কিলো কিনেছিলেন।

আজও ঘুরে এসে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে কাউন্টারে বসেছেন। এমন সময় ভিজে ছাতা হাতে হাজির হল প্রতাপ দাস।

”জহরদা এলুম, সেই ব্যাপারটা?” ভুরু তুলে জহর তাকালেন এবং সঙ্গে—সঙ্গে মনে পড়ে গেল, ”কোচিং স্কুল?”

”হ্যাঁ।”

”নাদু টুলটা বার করে দে।”

নাদু নিজের টুলটা কাউন্টারের ওপর দিয়ে তুলে আনল। প্রতাপ বসে বলল, ”এই বৃষ্টির জন্যই কংক্রিট পিচ করছি। বাংলার ক্রিকেটকে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছে এই বৃষ্টি। পুজো পর্যন্ত বর্ষার সিজন, তারপর পিচ তৈরি করে মাঠে নামতে—না—নামতেই রনজি ট্রফির খেলা শুরু হয়ে যায়। খেলবে কী বাংলার ছেলেরা! প্র্যাকটিস কোথায়?”

জহর চুপ করে কথাগুলো শুনলেন। বস্তাপচা কথা। সবাই জানে। তাঁর মনে হল, প্রতাপ আর পানু একই পালকের পাখি। তফাত হল, পানুর অনেক টাকা, সে বড় ব্যবসায়ী। সে শুধু নাম চায় আর কেউকেটা হতে চায়। প্রতাপ ছোট ব্যবসায়ী, যেখান থেকে পারবে টাকা কামাবে। নামটামের লোভ নেই, পানুর মতো ধুরন্ধর নয়, বাংলার ক্রিকেটের উপকার করছি, পাঁচজনকে এটাই প্রতাপ দেখাতে চায়। তা দেখাক, ক্ষতি তো করছে না।

”ঠিক বলেছ। বৃষ্টির জন্যই দ্যাখো না জষ্টিমাস পর্যন্ত খেলা গড়িয়ে আসে। প্রচণ্ড গরমে খেলে কি কিছু লাভ হয়? তখন পারফরম্যান্স দেখিয়ে কোনও কাজের কাজ তো হয় না, সবাই দায়সারা খেলা খেলে।” জহর বললেন, অবশ্যই আন্তরিকভাবে। পি সেন ট্রফি ফাইনালে ব্রাদার্সের হারটা তাঁর মনে পড়ল। আর সেইসঙ্গেই মনে পড়ল শুভ্রকে। কাজের কাজ একটা হয়েছে বইকি, ছেলেটা চোখে পড়ে গেল! কিন্তু এই ফর্ম কি সামনের সিজন পর্যন্ত থাকবে?

”আমার সব রেডি হয়ে গেছে। লক্ষ্মীপুজো পর্যন্ত মাঠ তো পাওয়া যাবে না। প্যান্ডেল খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপরই কর্পোরেশন মাঠে রোলার চালাবে। ওখানকার যে ইনস্টিটিউট আছে তাদের ঘরেই নেটফেট, ব্যাটপ্যাড থাকবে। ওদের একটা মালি আছে সে—ই সব করবে। এখন দরকার কোচ।” প্রতাপ তাকাল জহরের মুখের দিকে।

”ঠিক করেছ?”

”চিফ কোচ হতেও রাজি হয়েছে অনীশ সেন। ওকে রাখছি, তিনটে টেস্ট খেলেছে, একবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুরও করেছে। তা ছাড়া কাগজে লেখেটেখে। এখন তো বেঙ্গলের সিলেক্টরও।” প্রতাপ ধূর্ত চোখে তাকিয়ে মিটমিট হাসল। ”রাজি হচ্ছিল না। বেহালায় ওর নিজেরও তো একটা কোচিং সেন্টার আছে। বললুম হপ্তায় দুটো দিন আসবেন শুধু, কিছুক্ষণ থাকবেন, একটু—আধটু ছেলেদের দেখিয়ে—টেখিয়ে দেবেন। জানতে চাইল আর কে কোচ থাকবে। বললুম—” প্রতাপ চুপ করে গেল।

”কী বললে?”

”আপনার নাম বললুম। শুনে বলল, ঠিক আছে, জহরদা থাকলে তো কথাই নেই। বুঝলেন জহরদা, ইচ্ছে ছিল আপনাকেই চিফ কোচ করে রাখব। কিন্তু এখন লোকের মনোভাব বোঝেন তো, সাইনবোর্ড দেখেই পটকে যায়, বিজ্ঞাপনের যুগ তো! ইন্ডিয়া—প্লেয়ার কথাটার তো একটা আকর্ষণ আছে।… বলুন না, আছে কি না?”

জহরের মুখে পাতলা হাসি ভেসে উঠল। ”আছে। তবে আমি তো কোচ হলুম। আর কে—কে থাকবে?”

”জিতু বিশ্বাস, প্রশান্ত চক্রবর্তী আর মৃণাল গুপ্তর সঙ্গে কথা বলেছি। আপনি তো এদের চেনেন। জিতুদা আর প্রশান্তদা রেলের হয়ে রনজি ট্রফি খেলেছেন। ভাল পেস বোলার ছিল। আর মৃণাল তো এখন ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে।”

‘এত কোচ নিয়ে স্কুল, ছাত্র ক’জন হবে?” জহরের কপালে ভাঁজ। এই স্কুল ব্যাপারটা তাঁর মাথায় ঢুকছে না। এতকাল ধরে ক্রিকেট খেলা হচ্ছে, কত দিকপাল ক্রিকেটার বেরিয়েছেন, তাঁরা তো কেউ স্কুলে খেলা শেখেননি! দুখিরামবাবু ছিলেন। কত নামকরা ক্রিকেটার, ফুটবলারকে তিনি তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি তো স্কুল খুলে ছেলেদের কোচ করেননি! ছেলেদের মধ্যে প্রতিভা দেখেছেন, প্রতিভা বিকাশের পথে তাদের চালনা করেছেন। যে ওঠার, সে নিজেই উঠে এসেছে। যার মাথা আছে, পরিশ্রম করে, বড়—বড় প্লেয়ারদের খেলা মন দিয়ে দেখে, নিজেকে সেই ছাঁচে ফেলে তৈরি হয়ে ওঠে। জহরের মনে পড়ল, মাঠে গিয়ে নির্মল চ্যাটার্জির ব্যাটিং গোগ্রাসে গিলতেন, তাঁর ফুটওয়ার্কের ছবি মনের ক্যামেরায় তুলে নিতেন। তখন গোয়াবাগানের সান স্পোর্টিংয়ে খেলছেন, নেটে নকল করতেন সেই ছবিগুলোকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলে, ইনিংসের ভিত গড়ার ধৈর্য আর হুঁশিয়ারিটা শিখেছিলেন পঙ্কজ রায়ের খেলা দেখে দেখে। কেউ তাঁকে কোচ করেনি, কেউ একজন তাঁর গুরু নয়।

”দুটো নেটে খেলা হবে আপাতত শুধু বিকেলে, তবে ছুটির দিনে দু’বেলা। প্রতি ছাত্র হপ্তায় তিনদিন কোচিং নেবে।”

”কতক্ষণ করে নেবে?”

”সেটা ঠিক হবে ছাত্রসংখ্যা দেখে, যদি ছেলে বেশি হয় তা হলে কুড়ি কি চব্বিশ বল খেলবে। এখানে তো কেউ প্র্যাকটিস করতে আসবে না, শিখতে আসবে। খেলা ছাড়াও তো অনেক কিছু শেখার থাকবে। বাচ্চচা—বাচ্চচা ছেলে, আগে ব্যাট ধরা শিখবে, ব্যাট নিয়ে দাঁড়াতে শিখবে, কীভাবে ফরওয়ার্ড খেলতে হবে, পা কোথায় যাবে, ব্যাকলিফট কীভাবে করবে, কনুই কতটা ভাঙবে, এসব আগে শিখে তবে নেটে বল খেলবে, ঠিক কি না?”

জহর চুপ করে রইলেন।

”কোচিং ফি, ভেবে দেখলুম, একটু কমসমই রাখব, মাসে পঁচাত্তর টাকা। এটা এমন কিছু বেশি নয়। মাসে বারোটা কোচিং, প্রতি কোচিং পিছু ছ’টাকা পঁচিশ পয়সা। দেড়শো টাকা মাইনে দিয়ে যদি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়তে পারে, চারশো টাকা দিয়ে যদি প্রাইভেট টিউটর রাখতে পারে, তা হলে পঁচাত্তর টাকা দিয়ে ছেলেকে ক্রিকেটার করাতে কি খুব গায়ে লাগবে? বাঙালি ইলিশ খেতেই দুশো টাকা খরচ করে একবেলায়।”

জহরের মনে পড়ল একদিন দেড়শো টাকা দিয়ে আধ কেজি বাগদা তিনি নিজেই কিনেছেন। এটা শখের ব্যাপার কিন্তু ক্রিকেটকে শৌখিন খেলা ভাবতে তিনি রাজি নন, প্রতাপ ব্যবসার জিনিস হিসেবে ক্রিকেটকে দেখছে। দেখুক। কিছু ছেলে ব্যাট ধরা, বল করাটা তো তবু শিখবে।

”সবই তো বুঝলাম, কোচিং দেব কি বিনি পয়সায়?”

”ছি ছি ছি, এ কী কথা বলছেন জহরদা! আপনাকে প্রণামী দেব না, তা কি হয়?”

”অনীশকে কত দেবে?”

”পাঁচশো।”

জহর তীক্ষ্ন চোখে প্রতাপের মুখের দিকে তাকিয়ে। তাঁর মনে হল প্রতাপ মিথ্যা কথা বলল। নিশ্চয় কমিয়ে বলছে যাতে তাঁকেও কম দিতে হয়। তার নাম ভাঙিয়েই যে স্কুল চলবে এটা না বোঝার মতো কাঁচা লোক অনীশ নয়। হাজার টাকার কমে সে আসবে না।

”আপনাকেও পাঁচশো দেব। তবে অ্যামাউন্টটা কাউকে কিন্তু বলবেন না।” প্রতাপ হাত বাড়িয়ে জহরের হাত স্পর্শ করল অনুরোধ জানাতে।

”ঠিক আছে, আমি রাজি।”

প্রতাপের মুখে স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল।

”অনেক টাকা ঢালতে হচ্ছে। দুটো নেটের একটা কংক্রিট আর—একটা মাটিরই করছি, ওখানে ঘাসের পিচ মেন্টেন করা খুবই শক্ত, তবে চেষ্টা করব। নারকোল ছোবড়ার ম্যাটে খেলাব। বাচ্চচাদের জন্য প্যাড, ব্যাট, গ্লাভস, বলও দিতে হবে… বুঝলেন জহরদা, ঝামেলা আর খরচ অনেক, শেষপর্যন্ত লোকসান খেয়ে না যাই!” মুখটা বিব্রত করে প্রতাপ উঠে দাঁড়াল।

”একটা কথা।” জহর থামিয়ে দিলেন বেরোতে যাওয়া প্রতাপকে। ”কীভাবে শিক্ষা দেওয়া হবে, সেটা কে ঠিক করবে, অনীশ?”

প্রতাপ যেন প্রশ্নটার জন্য তৈরিই ছিল। ”কেন, আপনি ঠিক করবেন! অনীশের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ও বলেছে জহরদার মতো অভিজ্ঞ, ক্রিকেট—গুলে—খাওয়া লোক থাকতে আমি কে? কীভাবে কোচিং হবে সেটা উনিই ঠিক করে দেবেন, আমি মাথা গলাব না।”

জহর বুঝলেন দায়দায়িত্ব এড়াবার জন্য, গায়ে ফুঁ দিয়ে ক’টা টাকা কামাবার জন্য অনীশ প্রশংসা করে তাঁকে গাছে তুলে দিয়েছে। অনীশ অবশ্যই ক্রিকেট বোঝে, নয়তো অতদূর পর্যন্ত যেতে পারত না, ওর ক্রিকেট বোধের প্রতি জহরের শ্রদ্ধাও আছে। তবে অনীশ খুবই পেশাদার। হোক পেশাদার, জহর ভাবলেন, আমার স্বাধীনতায় হাত না দিলেই হল!

”যদি আমি মনে করি কোনও ছেলেকে বাদ দিতে হবে, বা কোনও কোচ ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না, বাদ দিতে হবে, তা হলে বাদ দিতে হবে।”

”নিশ্চয়।”

”শুধু ব্যাটসম্যান তৈরি নয়, বোলারও তৈরি করতে হবে। ফিল্ডিং প্র্যাকটিস চাই। উইকেটকিপার তৈরি করতে হবে, প্রত্যেকটা ছেলেকে ক্রিকেটের আইন শিখতে হবে। একটা অলরাউন্ড শিক্ষা চাই।”

”আপনি যেমন চাইবেন সেইভাবেই করবেন।” প্রতাপ নম্র বিনীত ভঙ্গিতে বলল, ”স্কুলের সুনাম যাতে হয়, ছাত্র যাতে বাড়ে সেটা দেখা তো উচিতই। তা হলে জহরদা, বৃষ্টিটা একটু ধরেছে, আমি আসি। যথাসময়ে আপনাকে খবর দেব।”

প্রতাপ বেরিয়ে যাওয়ার পরই জহরের মনে পড়ল হাবলায় হেমন্ত গুহর বলা কথাগুলো—’লুফে নিয়ে ফেলেছি। জহর ট্রান্সফারের জন্য তৈরি থেকো।’ কথাটা কি আন্তরিক? এরকম প্রতিশ্রুতি তো অনেক শুনেছেন জীবনে। আবেগ—উচ্ছ্বাসের বশে অনেকে অনেককিছুই বলে ফেলে, পরে ভেবেচিন্তে মত বদলে ফেলে। তাঁর বয়সের কথাটা হেমন্ত গুহ নিশ্চয় ভাববে।… কিন্তু তাঁকে নিতেও তো পারে! হয়তো রামবাবুকে খুশি করতে ফুলবাগানে সই করাবে। এইসব ক্লাবে বড় ডোনারদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। সই করিয়ে তারপর বসিয়ে রাখবে। এরকম ঘটনাও তো তাঁর জীবনে ঘটেছে। ফুটবলের মতো ক্রিকেটেও বসিয়ে রাখা আকছার হয়।

জহরের মনে টানাপোড়েন চলল কিছুক্ষণ। খেলাক বা না—খেলাক মাঠে যাওয়ার এত বছরের অভ্যাস তো তিনি ছাড়তে পারবেন না। আবার এদিকে প্রতাপকেও কথা দিয়ে ফেলেছেন। ফুলবাগানে নাম লেখালে ময়দানে ওদের নেটে যেতে হবে, তা হলে রাজনারায়ণ পার্কের কোচিং স্কুলে যাবেন কখন?

দুইয়ের মধ্যে একটা সমঝোতা তাঁকে করতে হবে।

জহর পালের ভয়টা নেহাতই অমূলক ছিল। ক্রিকেট ট্রান্সফারের প্রথমদিনেই হেমন্ত গুহ তাঁকে ফুলবাগানে সই করালেন। সই করে সি এ বি ক্লাব হাউস থেকে তিনি এবং সমু বেরিয়ে আসার সময় হেমন্ত গুহকে প্রশ্ন করলেন, ”ভেবেচিন্তে আমাকে নিলেন তো? একটা—দুটো ম্যাচ খেলতে পাব তো?”

কথাটা শুনে হেমন্ত যেন আহত হলেন। বললেন, ”তোমার মতো ভেটারেনের মুখে এসব কী কথা? তুমি রনজি খেলতে চাও না টেস্ট খেলার স্বপ্ন দেখছ? টিমে কখন যে কার দরকার পড়বে তা কি এখন বলা যায়? দরকার পড়লেই তুমি খেলবে। ফার্স্ট ইলেভেনে ঢোকার জন্য লড়বে এরা।” তিনি সমুর পিঠে হাত রাখলেন।

”তা হলে একটা কথা বলে রাখি।” জহর বললেন, ”আমি কিন্তু রোজ নেট প্র্যাকটিসে যেতে পারব না। একটা নতুন ক্রিকেট কোচিং স্কুল হচ্ছে আমাদের ওদিকে রাজনারায়ণ পার্কে, সেখানে কোচ করব। ওখানেই ক্রিকেটের টাচে থাকব, প্র্যাকটিসও করে নেব। তবে ক্লাবে আমি মাঝেমধ্যে নিশ্চয় যাব।”

”বেশ, তাই হবে। জয়প্রকাশের প্রমোশন নিয়ে বদলি হওয়ার কথা হায়দরাবাদে, সামনের জানুয়ারিতে। চেষ্টা অবশ্য করছে কলকাতায় থেকে যাওয়ার। যদি যায়, টিমে তা হলে সিনিয়ার প্লেয়ার কেউ আর থাকবে না। এবার চারজন নতুন ছেলে নিচ্ছি। তোমাকে তা হলে দরকার হতে পারে সিজনের শেষের দিকে।”

‘দরকার হতে পারে’ কথাটা জহরের ভাল লাগল। তাঁর মনে গভীর একটা তৃপ্তি এনে দিল। শিরদাঁড়া টান করে তিনি বললেন, ”দরকারের সময় দেখে নেবেন ওই বুড়ো ঘোড়া কেমন ছোটে।”

হেমন্ত গুহ চোখ সরু করে হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন, ”এইসব ছেলে—ছোকরারা দেখবে, আমি আর কী দেখব! চলি এখন, সৌগতর ব্যাঙ্কে একবার যেতে হবে। ব্রাদার্স নাকি টোপ ফেলেছে ওকে গাঁথার জন্য।”

হেমন্ত গুহ তার অ্যাম্বাসাডারে উঠে চলে যাওয়ামাত্র যেন মাটি ফুঁড়ে হাজির হল কানু ভটচায।

”এই যে জহর, তা হলে ফুলবাগানে সই করলি! মাঠে নামার শখ এখনও তোর গেল না দেখছি!” কানু হাসল। চারটে না—থাকা দাঁতের ফাঁক দিয়ে জিভটা বেরিয়ে এল।

”তোমারও তো মাঠে চরে বেড়াবার শখ দেখছি এখনও যায়নি, নইলে এই ভরদুপুর বেলায় তুমি কী করতে এখানে?”

”দেখতে, কে কোন ক্লাবে যাচ্ছে তাই দেখতে। সব দেখেশুনে তবেই তো টিম করতে হবে। তা ফুলবাগান আর প্লেয়ার পেল না, শেষে তোর মতো একটা বুড়ো ঘোড়াকে ধরল! হেমন্তর কি মাথাখারাপ হয়েছে! ঘাস খাওয়াবার জন্য আর লোক পেল না?” কানু ভটচায নিজের রসিকতায় হেসে উঠল।

”ঠিকই বলেছ কানুদা, ব্রাদার্সের ঘাস চিবিয়ে—চিবিয়ে তো বুড়ো হয়ে গেলুম, এবার ফুলবাগানের ঘাস খেয়ে দেখি ছোকরা হওয়া যায় কি না।”

”হবি, হবি, আমাদের সঙ্গে খেলা পড়ুক, তোর টগবগানি ছুটে যাবে।” কানু ভটচায তিনটে আঙুল তুলে দেখাল। ”তিনটে আনছি এবার। হরিয়ানার ওমকিশোর, হায়দরাবাদের বরকতউল্লা আর দিল্লির মান্টু সিং। কলকাতার যত ট্রফি আছে সব এবার নেব। পি সেনটা বড় ফসকে গেল, বাগানের ফুল তো জয়প্রকাশ আর সৌগত। জয়প্রকাশের বদলির খবর পেয়ে গেছি। সৌগত ফুল তুলে নিলুম বলে!” কানু একটা কাল্পনিক ফুল নাকের কাছে ধরে গন্ধ শুঁকল।

”যাকগে এসব কথা, তোর ছেলে কেমন আছে?” কানু ভটচায দরদি বন্ধুর মতো জানতে চাইল। ”কীসব ছবিটবি তুলে পরীক্ষা করলি, রেজাল্ট কী?”

”ভালই আছে। ওষুধ খেয়ে যাচ্ছে।”

”ভাল থাকলেই ভাল। আজকাল চিকিচ্ছের যা খরচ!”

”চলো সমু। চলি কানুদা।” জহর সমুর হাত ধরে টান দিলেন।

ফেরার সময় সমু জিজ্ঞেস করল, ”লোকটা করে কী জহরদা?”

”কিছু করে না। বিয়ে করেনি, সংসার নেই, মাঠ আর ক্লাব নিয়ে পড়ে আছে।”

”যাদের আনবে বলল তারা তো সব টেস্ট খেলেছে। ব্রাদার্স এবার সব ট্রফি ঘরে তুলবে।” সমু নিশ্চিত স্বরে বলল।

”তোলে তুলবে। …সকালে দৌড়ও কী?” প্রসঙ্গটা বদলাবার জন্য জহর বললেন।

”হ্যাঁ, দেশবন্ধু পার্কে চার পাক দৌড়ই।”

”কাল থেকে পাঁচ পাক দেবে।”

.

রাজনারায়ণ পার্কে ক্রিকেট কোচিং স্কুলের উদ্বোধন জাঁকজমকের সঙ্গে হল। শামিয়ানা খাটিয়ে সভা হয়। বক্তৃতা দিলেন পুরপিতা যশোদাজীবন ধর, বিধায়ক অরুণ বিশ্বাস। যশোদাজীবন বললেন: ”এই রাজনারায়ণ পার্কের স্কুল থেকে আগামী দিনের বাঙালি টেস্ট প্লেয়ার ঝাঁকে—ঝাঁকে উঠে আসবে, এই ইঙ্গিত আমি এখনই পাচ্ছি, অভিভাবকদের উৎসাহ আর উদ্দীপনা দেখে। ছোট—ছোট ভাইয়েরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে শিক্ষার মাধ্যমে ক্রিকেটের জ্ঞান অর্জন করবে এই স্কুল থেকে, বিখ্যাত টেস্ট খেলোয়াড় অনীশ সেনের তত্ত্বাবধানে তারা শিখতে পারবে গাওস্কর, কপিলদেব হয়ে ওঠার জন্য কীভাবে ব্যাট করতে হবে, বল করতে হবে। আমি আশা করব, একদিন আমার ওয়ার্ডের এই রাজনারায়ণ পার্ক থেকে উঠে আসা এগারোটা বাঙালি ছেলে নিয়েই ইন্ডিয়ার টেস্ট টিম হবে। সেদিন এই পার্কে সাতদিন ধরে সংবর্ধনার ব্যবস্থা আমি করব। আমি দেখতে পাচ্ছি সেই সম্ভাবনার বীজ আজ এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বপন করা হল।”

বিধায়ক অরুণ বিশ্বাস বললেন : ”ক্রিকেট খেলা আর জীবনের খেলা একই জিনিস। দুটো খেলাতেই দরকার মনোনিবেশ। একটু এধার—ওধার হলে, মনোনিবেশে চিড় ধরলেই আউট। আপনাকে মাঠ ছেড়ে চলে যেতে হবে। জনসেবার ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ হারালেই ইলেকশনে হেরে যাবেন। ক্রিকেট থেকে এই শিক্ষাটা, জনসেবায় মনোনিবেশের শিক্ষাটা পেয়েছি বলেই ইলেকশনে জিতে বিধায়ক হতে পেরেছি। প্রত্যেকদিন পাড়ায়—পাড়ায় ঘুরে মন দিয়ে যেভাবে জনসংযোগ করি ঠিক সেইভাবে এই স্কুলের ছেলেদের প্রতিদিন প্র্যাকটিস করতে হবে, তা না হলে ম্যাচ জিততে পারবে না। আশা করব আমার কথাগুলো শিক্ষার্থীরা মনে গেঁথে নেবে। এখন এই স্কুল খোলা মাঠে হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে যাতে এখানে ইন্ডোর হল তৈরি করে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় সেজন্য সামনের বাজেট সেশনে আমি প্রস্তাব দেব। আমার কেন্দ্র থেকে টেস্ট প্লেয়ার তৈরি করার যে—কোনও প্রয়াসকে আমি সাহায্য করবই।”

এর পর আরও তিন—চারজন বক্তৃতা দেয়। বক্তাদের সামনে মাঠের একধারে বসে ছিলেন শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা, তাঁদের উলটোদিকে চারজন কোচ আর তাঁদের পেছনে জনা পঁচিশ নানা বয়সী ছেলে। একদিকে একটা টেবিলে বসে তিনজন খবরের কাগজের লোক। তা ছাড়াও পাড়ার জনাপঞ্চাশ কৌতূহলী লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে। ছবি তুলল কাগজের দু’জন ফোটোগ্রাফার, প্রতাপ কোনও খুঁত রাখেনি উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য। কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে, হ্যান্ডবিল বিলি করে, বড়—বড় রাস্তার মোড়ে ফেস্টুন টাঙিয়ে সে প্রচার চালিয়ে গেছে। উদ্বোধন করলেন ধুতিপরা বিধায়ক, ব্যাট হাতে। নেটের মধ্যে তাঁকে বল করলেন ট্রাউজার্সপরা পুরপিতা। বল করার আগে তিনি বনবন করে ডানহাতটা ঘুরিয়ে বললেন, ”সেই কবে স্কুলে পড়ার সময় বল করেছি আর আজ করছি।”

বিধায়ক হাসি—হাসি মুখে ব্যাটটা খাঁড়ার মতো ধরে দাঁড়ালেন। পুরপিতা দশগজ ছুটে এসে বল করলেন বা ছুড়লেন। বল নেটের ওপর দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে রাজনারায়ণ ইনস্টিটিউটের দেওয়ালে ঠকাস করে লাগল। বিধায়ক হতভম্ব চোখে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বলটার দিকে মুখ তুলে সভয়ে তাকিয়ে, তখনই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠল। চটাপট আওয়াজ উঠল হাততালির। পুরপিতা লাজুক স্বরে বললেন, ”বলটা ঠিকমতো হল না, আর—একবার করি।” এবার তিনি আরও জোরে দৌড়ে এলেন বল করতে। ডেলিভারি দেওয়ার আগে ফাস্ট বোলারদের মতো লাফিয়ে উঠলেন। মাটিতে পা পড়তেই পা হড়কে গেল আর বলটা হাত থেকে বেরিয়ে ফুলটস হয়ে সোজা গিয়ে লাগল বিধায়কের বাঁ হাঁটুর নীচে।

”বাবা রে!” দু’হাতে পা চেপে ধরে বিধায়ক উবু হয়ে বসে পড়লেন।

হইহই করে প্রতাপ ও কয়েকজন ছুটে গেল। বিধায়ককে চ্যাংদোলা করে একটা চেয়ারে বসানো হল। তিনি কাতরাতে—কাতরাতে বললেন, ‘মনোনিবেশটা, ঠিকমতো হয়নি বলেই—একটু বরফ দিন।”

”হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওরে একটু বরফ… মালি, মালি।” প্রতাপ ছুটে গেল।

চেয়ারে বসে জহর চুপচাপ দেখে যাচ্ছিলেন। পাশে বসা অনীশকে বললেন, ”কী বুঝছ?”

”আমাদেরও মনোনিবেশ করতে হবে।” অনীশ গম্ভীর মুখে বলল।

”সাতদিন ধরে সংবর্ধনা নিতে হবে, এখন থেকেই তৈরি হও।”

”জহরদা, তার থেকেও বিপদ, এগারোটা টেস্ট ক্রিকেটার এই কোচিং স্কুল থেকে যখন বেরোবে তখন ইন্ডিয়া টিমের অবস্থাটা কী দাঁড়াবে ভেবে দেখেছেন কী? আপনি বরং সামলান, আমি এখন কেটে পড়ছি।” বলেই অনীশ চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। জহর ফ্যালফ্যাল করে এধার—ওধার তাকাতে লাগলেন।

”আপনিই তো জহর পাল, স্কুলের ডেপুটি ডিরেক্টর অব কোচিং?” ধুতি—পঞ্জাবি পরা সৌম্যদর্শন, বছর চল্লিশ—বিয়াল্লিশ বয়সী লোকটি নমস্কার করলেন।

প্রথমে জহরের ভ্রূ কুঁচকে উঠল। তারপর মনে পড়ল হ্যান্ডবিলে দেখেছেন বটে তাঁর নামের পাশে অমন একটা কথার সঙ্গে ব্র্যাকেটে বেঙ্গল রনজি ট্রফি প্লেয়ার জোড়া আছে। তার আগে আছে ডিরেক্টর অব কোচিং অনীশ সেন, ব্র্যাকেটে ইন্ডিয়া টেস্ট প্লেয়ার। তিনি প্রতিনমস্কার করে বললে, ”হ্যাঁ আমি।”

”আমার ছেলেকে এখানে ভর্তি করিয়েছি। লোকটি গদগদ ভঙ্গিতে যোগ করলেন, ”আপনি একটু দেখবেন, খুব ট্যালেন্টেড।”

”বয়স কত?”

”এই এগারো ছাড়িয়ে—” লোকটি পাশে দাঁড়ানো মহিলার দিকে তাকালেন, ”বারো হয়েছে কি?”

”এগারো বছর এগারো মাস সাতদিন হল বুবাইয়ের। … এই যে বুবাই।” মহিলা তাঁর পেছনে দাঁড়ানো লম্বাচওড়া নধর চেহারার একটি ছেলেকে সামনে টেনে আনলেন। জহর একপলক তাকিয়ে দেখে বললেন, ”ট্যালেন্ট আছে বুঝলেন কী করে?”

”গলিতে খেলে তো, দেখেছি বড়—বড় ছক্কা মারে। এ—বাড়ি ও—বাড়ির ছাদে বল পাঠায়। তিনটে জানলার কাচ ভেঙেছে। তিনশো টাকা দিয়ে কাচ বদলে দিয়েছি।”

”তা হলেই ট্যালেন্ট আছে প্রমাণ হল?”

”জ্যোতিষী ওর কুষ্টিতে বলে দিয়েছেন, খুব বড় প্লেয়ার হবে, শচীন টেন্ডুলকরকেও ছাপিয়ে যাবে। খুব নামী জ্যোতিষী চণ্ডীচরণ শাস্ত্রী।” মহিলার চোখমুখে বিশ্বাস আর ভক্তি উপচে উঠল। জহর লক্ষ করলেন বুবাইয়ের বাবার দু’হাতের আঙুলে মোট চারটি আংটি। মুক্তো, পলা, পোখরাজ, চতুর্থটি চিনতে পারলেন না।

”আপনি কী করেন?” জহর শুকনো গলায় জানতে চাইলেন।

”ফিজিকস পড়াই বাবা নরোত্তম দাস কলেজে, আর বাড়িতে কিছু ছাত্র পড়াই।”

”কিছু বলছ কেন?” মহিলা চাপা ধমক দিলেন স্বামীকে, ‘সতেরোজন সকালে, এগারোজন সন্ধেয়, তবে হপ্তায় দু’দিন করে পড়ে। আপনাদের ছেলেমেয়ে কেউ থাকলে পাঠিয়ে দেবেন, মাইনে লাগবে না। … বুবাইকে একটু আলাদা করে যদি টিপস দেন। মানে ট্যালেন্ট তো আছেই, শাস্ত্রীমশাই বলেছেন, কিন্তু ট্যালেন্টকে তো পথ চিনিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”

”সে তো নিশ্চয়। তবে ট্যালেন্ট নিজেই নিজের পথ করে নেয়, তাকে আর পথ চেনাতে হয় না।” জহর উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর পাশে বসা অন্য তিন কোচ—জিতু বিশ্বাস, প্রশান্ত চক্রবর্তী আর মৃণাল গুপ্তকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ”তোরা দেখে কথা বলে নে ছেলেদের সঙ্গে, কে কেমন খেলে বুঝে নিয়ে তিনটে ব্যাচে ভাগ করে নে। অনীশ তো সটকে পড়ল। কারা অ আ ক্লাসের আর কারা অজ আম, আর কারা ঐক্য বাক্য—এটা বাছাই করে আমাদের শুরু করতে হবে।”

”একটা কথা বলছিলাম।” বুবাইয়ের বাবা জহরের কথার মাঝে বলে উঠলেন, ”বুবাইকে কি হেলমেট আনতে হবে? ওর জন্য ব্যাট প্যাড গ্লাভস সবই কিনেছি, জুতোও, কিন্তু হেলমেটটা কেনা হয়নি।”

”সবই কিনেছেন যখন, ওটাই বা বাদ যায় কেন?” জহর বললেন।

”আমিও তাই বলি।” বুবাইয়ের মা উৎসাহভরে বললেন, ”শচীন তো হেলমেট পরেই খেলে।”

”জিতু, তোরা গিয়ে ছেলেদের সঙ্গে কথা বল। কোন ব্যাচ কোন দিনে আসবে সেটা বলে দিবি।”

”জহরদা, কে কেমন খেলে সেটা আগে দেখে না নিলে ব্যাচ ঠিক করব কী করে?”

”ঠিক বলেছিস। তা হলে অর্ধেক ছেলেকে কাল সকালে আর বাকিদের বিকেলে আসতে বলে দে। এই যে বুবাই তুমি কাল বিকেলে এসো।”

বিধায়ক তখন দু’জনের কাঁধে হাত রেখে খোঁড়াতে—খোঁড়াতে চলেছেন পার্কের বাইরে দাঁড়ানো ট্যাক্সির দিকে। তাঁর সঙ্গে চলেছেন পৌরপিতা। ”অরুণদা আমি বলছি এক্স—রে করানোর দরকার নেই, রাতে গরম চুন—হলুদ লাগাবেন, সকালে দেখবেন ব্যথাট্যথা একদম নেই।”

”বাবা ডিউস বল লাগলে খুব লাগে না?’ বুবাই ভীত কণ্ঠে ফিসফিস করে জানতে চাইল।

”প্যাড পরা থাকলে লাগবে কেন!” বাবা ভরসা জোগালেন।

”যদি মুখে লাগে? মুখে তো প্যাড থাকে না।”

বাবা আর কথা খুঁজে না পেয়ে বললেন, ”চলো, এবার বাড়ি যাই। কাল বিকেলে আসতে হবে।”

প্রতাপ চরকির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। উদ্বোধন অনুষ্ঠান ভালয় ভালয় কাটল বলা যেত, যদি বিধায়ক অরুণ বিশ্বাসের পায়ে বলটা না লাগত। প্রতাপ তাই কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ। প্রথমদিনেই একটা খুঁত থেকে গেল। নেট এবং ম্যাট খুলে পঞ্চা মালি ইনস্টিটিউটের ঘরে তুলে রাখছে। ডেকরেটরের লোক চেয়ার টেবিল তুলছে ঠেলাগাড়িতে, রিকশায় তোলা হচ্ছে মাইক ও স্পিকার। প্রতাপ ব্যস্ত হয়ে এল জহরের কাছে।

”সব ঠিকঠাক চলছে তো জহরদা?”

”চলছে। শুধু একটা কথা, ছাত্র ভর্তির আগে ট্রায়াল দিয়ে টেস্ট করে নেওয়া দরকার ছিল।”

‘তা হলে জহরদা চারটের বেশি ছেলে আপনি পেতেন না। চারটে ছাত্র দিয়ে তো স্কুল চলে না। আপনি বেছেবুছে যে—ক’টা পান তাদের নিয়ে আলাদা কোচ করুন। বাকিদের ওই তিনজনের ঘাড়ে চাপিয়ে দিন। … অনীশ সেন কি চলে গেছে? ওকে সবাই দেখেছে তো?”

”দেখেছে।” জহর ওকে আশ্বস্ত করলেন।

পরদিন সকালে জহর ম্যাট উইকেটে তেরোটি ছেলেকে ব্যাট করিয়ে তিনজনকে বেছে নিলেন নিজে কোচ করাবেন বলে। তাদের বয়স ষোলো—সতেরো। তাঁর মনে হয়েছে এদের ক্রিকেট বোধ আছে, খেলতে জানে, টেকনিকে ত্রুটি রয়েছে, দরকার উঁচু পর্যায়ের বোলিংয়ে প্র্যাকটিস। মৃণাল মোটামুটি সুইং করায়, জিতু এবং প্রশান্ত অফব্রেকটা করে দিতে পারে। এতেই কাজ চলে যাবে। তা ছাড়া অনিন্দ্য নামে বছর তেরো—র একটা ছেলে বাঁ হাতে স্পিন করায়, খারাপ নয়। এর দিকেও নজর দেওয়া দরকার।

নজর দেওয়া দরকার মনে হতেই জহরের মাথায় একটা চিন্তা টোকা দিল। বেজা! জিতুকে হাতছানি দিয়ে তিনি ডাকলেন।

”জিতু, বিকেলে আমি আসতে পারব না, একটা জরুরি কাজ আছে, তুই ম্যানেজ করে নিস। বারো—চোদ্দোটা তো ছেলে, পারবি না?”

”না পারার তো কিছু নেই। তবে জহরদা, ব্যাট ধরা শেখাতে হবে, এমন ছাত্রের কথা তো আমি ভাবিনি। বেশিরভাগই তো গলিতে রবারের বল—খেলা ছেলে!”

”খেলুক না রবারের বল। আস্তে—আস্তে ওদের রবার থেকে আসল ক্রিকেট বল রপ্ত করাতে হবে। করে দেখ, অনেক ভাল ছেলে পেয়ে যাবি। কার মধ্যে কী আছে কে জানে! এরা টাকা খরচ করে শিখতে এসেছে তার মানে আগ্রহ আছে। এই তো তিন—চারটে ছেলেকে আমার ভাল লাগল। অনেক টাকা খরচ করে প্রতাপ নেমেছে, স্কুলটাকে টিকিয়ে রাখা দরকার। অনেক ভূষিমাল আসবে তারমধ্যে একটা মুক্তোও তো পেয়ে যেতে পারি।”

বিকেল পাঁচটা থেকে জহর দাঁড়িয়ে রইলেন হাতিবাগানের মোড়ে। বেজাকে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তেলেভাজার দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলেন সেইখানে তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন। বেজা অফিস ফেরত এখানেই বাস থেকে নামে।

কলকাতা কর্পোরেশন অফিসে চাকরি করে। সেখানে অফিস করতে যাওয়া বা অফিস থেকে বেরনো নিজের মর্জি মতোই বেশিরভাগ লোক করে। জহরের একবার মনে হল বেজা কি নিয়মমতোই অফিস যায় আর বেরোয়? যদি নিয়ম মানে তা হলে সাড়ে পাঁচটায় এখানে বাস থেকে নামার কথা।

জহর ঘড়ি দেখলেন। ঠিক সাড়ে পাঁচটা।

‘কী রে জহর, এখানে দাঁড়িয়ে কী করছিস?”

জহর চমকে উঠে ঘুরে দেখলেন মূর্তিমান ব্রজেন হালদার। মুখে একগাল হাসি।

”তেলেভাজা খাব কিনা ভাবছি।”

”আমাকে ঠাট্টা করছিস!… ছেড়ে দিয়েছি। তুই বলার পর থেকে আর খাই না। এখন আমি সব ব্যাপারে ডিপিপ্লিনড থাকার চেষ্টা করি। গ্যাস্ট্রিকটাকে আর্মার দিয়ে ব্যাকফুটে নিয়ে গেছি। আলসারটাকে এবার স্টাম্পড করবই। জানিস জহর, আমি কাঁটায়—কাঁটায় দশটায় অফিসে চেয়ারে বসি, ঘড়ি ধরে অফিস থেকে বেরোই। ভেবে দেখেছি, ডিসিপ্লিনড হতে হলে এই ব্যাপারটা দিয়েই শুরু করা উচিত। মনে পড়ে তোর, বলেছিলি রোজ সকালে দৌড়তে, ফ্রি হ্যান্ড করতে। রোজ নয়, তবে মাঝে—মাঝে করি, খুব ফ্রেশ লাগে।”

”তোর এখন নিজেকে ভাল লাগছে?”

”খুব ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে, দশ রানে দশটা উইকেট নিয়েছি। জহর, একটা কথা বুঝতে পারছি, শরীর যদি তরতাজা থাকে তা হলে সেই মানুষ কখনও দুঃখী থাকতে পারে না। তার প্রমাণ কী জানিস, আগে খিদে হত না, এখন হয়।” বেজার মুখ নির্মল সুখের হাসিতে ঝকমক করে উঠল, ”বুঝলি রে জহর, দারুণ খিদে হয়। এটা একটা রেয়ার ব্যাপার, দুর্লভ জিনিস। তিরিশ বছর আগে এমনই খিদে হত, তার মানে আমার তিরিশ বছর বয়স কমে গেছে, হাঃ হাঃ হাঃ। ডিসিপ্লিন! লোভ সামলে চলা!” বেজার হাসি আর থামে না।

জহর অবাক হয়ে তাকিয়ে। এই বেজাকে তিনি যেন চিনতে পারছেন না। সেই একই রকম রোগা রয়েছে বটে, কিন্তু মুখচোখে শুকনো বসে যাওয়া ভাবটা আর নেই। ঝকঝকে লাগছে।

‘বেজা, এখন তোর বল করতে ইচ্ছে করছে না?”

”ভীষণ করছে।”

”তা হলে চলে আয় রাজনারায়ণ পার্কে, ওখানে একটা ক্রিকেট কোচিং স্কুল হয়েছে। আমি ওখানে একজন কোচ। একটা—দুটো ভাল ছেলে পেয়েছি, খুবই কাঁচা, তবে ভাল বোলার হতে পারে। ওদের নিয়ে তুই পড়ে যা, তৈরি কর। আসবি?”

বেজা ফ্যালফ্যাল চোখে সাত—আট সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে অবিশ্বাসের সুরে বলল, ”তৈরি করব! বলিস কী?”

”কাল থেকেই চলে আয়। সকাল সাতটায় আমি থাকব। জীবনে ভালভাবে একটা ফিফটি অন্তত করে যা।”

পরদিন সকাল সাতটায় বেজা রাজনারায়ণ পার্কে হাজির। বহুদিন তুলে রাখা, ইস্ত্রিবিহীন, আধময়লা সাদা ট্রাউজার্সটা ঢলঢল করছে। পায়ে ময়লা সাদা কেডস, মোজা নেই। ঊর্ধ্বাঙ্গে পোলোগলা খয়েরি গেঞ্জি। একটু লাজুক সুরে জহরকে সে বলল, ”হঠাৎই তুই বললি কিনা তাই…. আজই প্যান্টের কাপড় কিনে দর্জিকে দিয়ে আসব। কত রোগা হয়ে গেছি দেখেছিস।”

”বেজা তুই যেমনই প্যান্ট পর না কেন, ছেলেরা তা লক্ষ করবে না, তারা দেখবে তোর বল। ওই ছেলেটার নাম অনিন্দ্য লক্ষ কর।” জহর একহাতে বেজার কাঁধ ধরে নেটের ধারে এসে দাঁড়ালেন। দু’জন কোচ এবং অনিন্দ্য বল করছে, ব্যাট করছে একটি কিশোর।

”জহর, একসময় আমি কলকাতার ওয়ান অব দ্য বেস্ট ড্রেসড ক্রিকেটার ছিলুম। পায়ের বুট থেকে মাথার ক্যাপ—সবাই তাকিয়ে দেখত। এখনকার ছেলেদের সামনে ভিখিরির মতো ড্রেস করে থাকলে ওরা আমাকে মানবে কেন?”

”মানে কি না—মানে সেটা আমি বুঝব।” জহর হাত নেড়ে অনিন্দ্যকে ডাকলেন। ”এঁকে তুমি চেনো না।” জহর তাকালেন বেজার দিকে। ”এঁর নাম ব্রজেন হালদার, তোমার জন্মের আগে খেলতেন, লেফট আর্ম আর্থোডক্স স্পিনার। তোমরা বেঙ্কটপতি রাজুকেই শুধু দেখেছ আর বিষেন বেদির নাম শুনেছ। ব্রজেন ওদের মতোই বোলার কিন্তু—” জহর থেমে গেলেন। অনিন্দ্য কৌতূহলী চোখে বেজার দিকে তাকাল।

”ওর কাছে তোমাকে বল—করা শিখতে হবে। রোজা এতক্ষণ তো অনিন্দ্যকে দেখলি, কী মনে হচ্ছে?”

”মন্দ নয়, হবে। ….. দেখি আর—একটু।” বেজা ওকে ইঙ্গিত করল নেটে গিয়ে বল করতে এবং নিজেও ওর সঙ্গে এগিয়ে গেল। নেটের বাইরে জিতু আর প্রশান্ত অল্পবয়সী ক্রিকেটারদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে সঠিকভাবে ব্যাট ধরে স্টান্স নেওয়া, ব্যাট পেছনে তোলা, পা সামনে বাড়িয়ে ডিফেন্সিভ খেলার মহড়া দিয়ে চলেছে। যার ভুল হচ্ছে কোচরা তাকে ঠিক করে দিচ্ছে। এর পর নেটে ওরা বল খেলবে। ওদের বাড়ির লোকেরা দাঁড়িয়ে দেখছে।

”বুবাইকেও কি এইসব করতে হবে নাকি? ও তো খেলতে জানে।”

বুবাইকে নিয়ে তার মা এসে গেছেন। হাতে বড় একটা কিট ব্যাগ আর ব্যাট। সাদা পোশাক আর বুট—পরা বুবাইকে ক্রিকেটারের মতোই দেখাচ্ছে। মায়ের হাতে একটা হেলমেট, সাধারণত যা স্কুটার চালকদের মাথায় দেখা যায়।

”এইসব করে বুবাই সময় নষ্ট করবে নাকি?” মায়ের স্বরে ফুটে উঠেছে বিরক্তি। ”ওকে বরং নেটে খেলতে দিন।”

”তা দেব। কিন্তু এটা কোত্থেকে জোগাড় করলেন?” জহর হেলমেটটা আঙুল দিয়ে দেখলেন।

‘ওর কাকার। … হেলমেট ছাড়া ফাস্ট বল খেলবে কী করে?”

”এখানে ফাস্ট বোলার কোথায়? ওটা আপনার কাছেই থাকুক। তা ছাড়া ওটা পরে স্কুটার চালানো যায়, ক্রিকেট খেলা যায় না। … বুবাই প্যাড পরো।” কথাগুলো বলে জহর নেটের দিকে এগোলেন, বেজা তখন বল করার সময় অনিন্দ্যর হাতটা মাথার ওপর আরও কতটা উঠবে সেটা দেখাচ্ছে।

‘আরও তোলো …. হ্যাঁ, টপ থেকে। আর—একটু শরীরের ভার দিতে হবে বল ছাড়ার সময় … বডি ওয়েটটা না থাকলে উইকেট থেকে বাউন্সটা তুলতে পারবে না … কোমরটা মুচড়ে এইভাবে ঘোরাবে …. দাঁড়াও, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

বেজা বলটা হাতে নিল। জহর নেটের বাইরে থেকে ব্যাটসম্যানকে শুধু বললেন ”মারতে যেয়ো না।”

বহু, বহু বছর পর ব্রজেন হালদার হাতে ক্রিকেট বল নিয়ে বারবার টিপল, হাতের তালু আর আঙুলে ঘষল। পুরনো যে অনুভূতিটা হারিয়ে গেছে সেটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় বলটাকে আঙুলে জড়িয়ে সামনে উইকেটের একটা জায়গার দিকে তাকাল। বার পাঁচেক বলটাকে দু’হাতে লোফালুফি করে আগের মতো দু’কদম দ্রুত হেঁটে এসে ডেলিভারি দিয়েই দু’হাত পাশে ছড়িয়ে কুঁজো হয়ে ওত পেতে রইল। জহর বলের ফ্লাইটে চোখ রাখলেন।

কাঁচা, অনভিজ্ঞ কিশোর ব্যাটসম্যান তোল্লাই বলটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না। বাঁ পা বাড়িয়ে হাঁটু গাড়ল সুইপ করার জন্য। বেজা মুগ্ধ চোখে বনবন ঘোরা বলটার ভেসে যাওয়া দেখছে। বলটা নেমে এল, ছেলেটিও ব্যাট চালাল। ম্যাটের ওপর পড়ে বলটা প্রায় ছ’ইঞ্চি ঢুকে এসে ব্যাটের তলা দিয়ে, কোমর ঘেঁষে লেগ স্টাম্পে আঘাত করল।

”বলেছিলুম মারতে যেয়ো না।” চাপা গলায় জহর ধমক দিলেন।

বেজা অনিন্দ্যর হাতে বল তুলে দিয়ে বলল, ‘নাও এবার তুমি করো।”

”না।” চেঁচিয়ে উঠলেন জহর, ”বেজা তুই বল করে যা, যতক্ষণ পারিস।”

প্যাড পরে বুবাই তৈরি। জহর তাকে পাশের নেটে যেতে বলে নিজেই বল নিলেন। ঠোঁট কামড়ে আড়ষ্টভাবে বুবাই ব্যাট ধরে দাঁড়াল। জহর বল দিলেন অফ ব্রেক করিয়ে অফ স্ট্যাম্পের বাইরে। বুবাই পিছিয়ে গিয়ে চোখ বন্ধ করে ব্যাট চালাল। ব্যাটের বদলে বল লাগল প্যাডে। পরের বলটা লাগল ঊরুতে, তার পরেরটা শর্ট পিচ ছিল, লাগল তার ঘুরে যাওয়া শরীরের কোমরে।

”এ কী বল দিচ্ছেন, বুবাই যে খেলতে পারছে না!” বুবাইয়ের মা বিরক্ত মুখে বললেন, ”সব যে ওর গায়ে লাগছে! হাড়গোড় ভাঙে যদি? আপনি ঠিক করে বল দিন।”

‘কীরকম করে দেব বলুন তো, ইমরান খাঁর মতো করে? টেন্ডুলকর তো শুরু করেছিল ইমরান—আক্রামের বল দিয়ে!” জহর নিরীহ মুখ করে বললেন। মহিলার রকমসকম যে তাঁকে মজা দিচ্ছে সেটা আর তিনি জানাতে চান না।

”বুবাইয়ের ব্যাটের ওপর যাতে বল পড়ে সেইভাবে করুন। ওর ব্যাটিং তো দেখেননি, ছাদের ওপর ফিল্ডার রাখতে হয়! শচীনের মতো ছয় মারে। হ্যাঁ রে বুবাই, ওই যে বাড়িটার জানলায় কাচ রয়েছে, ভাঙতে পারবি? জানেন, ওর বাবাকে কত টাকা গচ্চচা দিতে হয়েছে?” মহিলার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল পুত্রের জানলার কাচ ভাঙার গর্বে।

জহর একবার তাকিয়ে দেখলেন প্রায় দেড়শো মিটার দূরের জানলাটার দিকে। তারপর একতলা সমান উঁচু করে লোপ্পাই একটা বল ছাড়লেন। বুবাই প্রবল বিক্রমে ব্যাট চালাল এবং ফসকাল বলটা, শূন্য থেকে সোজা বুবাইয়ের মাথার ওপর পড়ল। শব্দ হল, ‘খটাস’।

”ও ও ও মা আ আ গো ও ও— আমার ছেলের মাথাটা ফাটিয়ে দিলেন!” মহিলা দৌড়ে গিয়ে ছেলের মাথা দু’হাতে চেপে ধরলেন।

জহর প্রথমে ভয় পেয়ে গেছলেন। কিন্তু যখন দেখলেন রক্ত বেরোয়নি, আশ্বস্ত হলেন। নম্রস্বরে বললেন, ”আমাদের কাছে তো রবারের বল নেই, আপনি যদি ওই মোড়ের দোকান থেকে একটা কিনে এনে দেন!”

”আপনি ঠাট্টা করছেন? বুবাই বাড়ি চল। ক্রিকেট কোচিং স্কুলে না গিয়েই শচীন এত বড় হয়েছে। তুইও হবি।”

মায়ের সঙ্গে বুবাইয়ের চলে যাওয়া দেখে জহর হাঁফ ছাড়লেন। একটা ঝামেলা কমল। অন্য নেটে তখন মনের আনন্দে বল করে যাচ্ছে ব্রজেন হালদার।

”বেজা অফিস যেতে হবে, মনে রাখিস।” জহর চেঁচিয়ে বললেন।

.

সমু এসে খবর দিল সামনের শনিবার ফুলবাগানের প্রথম লিগ ম্যাচ জোড়াসাঁকো স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে।

”তুমি টিমে আছ?”

”পনেরোজনে আছি।”

জহর বুঝে গেলেন তাঁর কথা ভাবা হয়নি। এই নিয়ে আর জিজ্ঞাসা করলেন না। একদিন মাত্র নেটে গেছলেন। কিছুক্ষণ বল করেন। স্লিপ ক্যাচ প্র্যাকটিসে ছেলেদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। যে—কটা বল পেয়েছিলেন, ধরেছিলেন। ব্যাটিং প্র্যাকটিসে তাঁকে ডাকা হয়নি। হেমন্ত গুহর তদারকিতে নেট পরিচালিত হয়।

”কীরকম লাগছে ছেলেদের। অনেকেই নতুন।” হেমন্ত গুহ নেট প্র্যাকটিস শেষে তাঁর কাছে জানতে চান।

”নেটে তো সবাই ভালই ব্যাট করল।” বাকি যে কথাটা বলতে চাইলেন সেটা আর জহর বললেন না—ম্যাচে কী করে সেটাই দেখার! সেইদিনই তিনি বুঝে গেছলেন, তাঁকে শুধু রেখেই দেওয়া হয়েছে, খেলাবার জন্য নয়। এর পর তিনি আর যাননি। রাজনারায়ণ পার্কেই মনপ্রাণ ঢেলে দেন। সেখানে নিয়মিত বেজা বল করতে আসে। জহর তার বল খেলে ছেলেদের বুঝিয়ে দেন স্পিন বল খেলার রহস্য ভেদ করতে হলে কী করতে হবে। মৃণালের মিডিয়াম পেস আর সুইং খেলে দেখিয়ে দেন বিবেচনা আর ধৈর্য কাকে বলে। প্রতিদিন ভোরে দৌড়ন গঙ্গার তীরে।

একদিন তিনি কাগজে দেখলেন, ফুলবাগানের সঙ্গে লিগের খেলা পড়েছে ব্রাদার্স ইউনিয়নের। খেলাটা দেখতে গেলেন। খেলা ছিল ফুলবাগান মাঠে। দু’দলের সমর্থক ছিল হাজার দুই। গত বছর পি সেন ট্রফির ফাইনালের পর এটাই তাদের প্রথম সাক্ষাৎ।

জহর সাইট ক্রিনের পেছনে অল্প লোক রয়েছে দেখে সেখানে গ্যালারিতে গিয়ে বসলেন। চেনা—পরিচিতদের সঙ্গে বসে আজেবাজে মন্তব্য শুনতে—শুনতে খেলা দেখতে চান না। ফুলবাগান টিমটাকে তিনি একটু দূর থেকে দেখতে চান। টস করল জয়প্রকাশ। সৌগত এবার ব্রাদার্সে চলে গেছে আট হাজার টাকা বেশি পেয়ে। ব্রাদার্সের ক্যাপ্টেন হয়েছে নুরু। টস জিতে নুরু ফিল্ড করার সিদ্ধান্ত নিল। বোধ হয় ওর মনে রয়েছে গতবার শেষ ব্যাট করে ফুলবাগানের ট্রফি জেতার কথাটা।

তৃতীয় ওভারে ওমকিশোরের বলে এল বি ডবলু হল সুপ্রকাশ। পরের ছেলেটি ওম—কেই হুক করতে গেল, দ্বিতীয় বলেই উইকেট কিপার ক্যাচ পেল। শুভ্র নামল। ষোলো ওভার কোনও উইকেট পড়ল না। রান তখন বিরাশি। শুভ্র অভিজ্ঞের মতো বল বেছে নিয়ে মারছে। ডিফেন্সও জমাট। জহর ওর কাছ থেকে একটা বড় রান আশা করছেন। সেই সময়ই সে কভার পয়েন্টে বরকতউল্লার একটা ফ্লাইট করানো অফ স্পিন ড্রাইভ করেই তিন চার গজ বেরিয়ে যায়। মান্টু সিং ঝাঁপিয়ে পড়ে। বলটা তার হাতে লেগে ছিটকে সাত—আট গজ দূরে চলে গেল। ননস্ট্রাইকারও খানিকটা বেরিয়ে এসে ইতস্তত করে ফিরে যেতে গিয়ে দেখল শুভ্র মাঝপিচ পর্যন্ত চলে এসেছে। ”গো ব্যাক” বলে চেঁচিয়ে সে শুভ্রকে ফিরে যেতে বলল। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মান্টু সিং জমি থেকে প্যান্থারের মতো লাফিয়ে উঠে তাড়া করে বলটাকে তুলে নিয়ে ছুড়ে দিয়েছে উইকেটকিপারকে।

আটচল্লিশ রানে রান আউট হয়ে শুভ্র ফিরে এল। নামল জয়প্রকাশ। প্রথম বলটাকেই অলসভাবে মিড উইকেটে ঠেলে দিয়ে এক রান। এরপর সৌগতকে বল দিল নুরু। কিন্তু জয়প্রকাশ বা অনুপের ওপর কোনও চাপ না পড়লেও রান ওঠা বন্ধ হল। দশ ওভারে মাত্র আঠারো রান। সীমায়িত ওভারের খেলায় ছাব্বিশ ওভারে একশো রান হওয়ায় রান তোলার গতি একটু বাড়াতেই হয়। হাতে রয়েছে সাতটি উইকেট। জয়প্রকাশ একচল্লিশ বল খেলে তেরো রান। তার কাছ থেকে দ্রুত রান চেয়ে ফুলবাগান সমর্থকরা চিৎকার শুরু করেছে। জহর মনে মনে বললেন, জয়প্রকাশ তো ঠিকই খেলছে। মারতে হয় তো আরও দশ ওভার পর শুরু করা উচিত।

কিন্তু কী একটা পোকা জয়প্রকাশের মাথার মধ্যে নড়ে উঠল, সে বরকতের দশম ওভারের প্রথম বলটাকেই লাফ দিয়ে বেরিয়ে ছয় মারতে গেল। বলটা ব্যাটের কানায় লেগে ঘুরে এসে অফ স্টাম্পের বেল ফেলে দিল। গ্যালারি নিস্তব্ধ। ব্রাদার্সের সমর্থকরা আনন্দে হাত তুলে চিৎকার করে উঠল। ফুলবাগানের শক্ত খুঁটিটাকে তারা উপড়ে দিয়েছে। জয়প্রকাশ বিকারহীন মুখে ফিরে আসতেই সমর্থকরা চেঁচামেচি শুরু করে দিল। দূর থেকে জহরের মনে হল, ওরা জয়প্রকাশের উদ্দেশে কটুকাটব্য করছে।

জহরের পেছনে এক দর্শক বলল, ”এইরকম সময়ে এই খেলা! দরকার কী হাঁকড়াবার?”

”আরে দাদা, টাকার খেলা আছে। জয়প্রকাশ তো কাঁচা নয়, ঝানু প্রফেশনাল। দেখুন কত টাকা পানু পোদ্দারের কাছ থেকে পেয়েছে।”

জহর মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিলেন একবার, কথাটা কে বলল। জবাব একটা দিতেন, কিন্তু মুখ বন্ধ রাখলেন, মাঠের এইসব কথাবার্তা ত্রিশ—পঁয়ত্রিশ বছর ধরে শুনে আসছেন। সুপ্রকাশের সঙ্গে ওপেন করতে দু’নম্বরে নেমেছিল যে ছেলেটি সে এখনও টিকে আছে ত্রিশ রানে। টেকনিক ভাল, স্পিনটা খেলতে পারে, হাতে মার নেই। জহর ভাবলেন এখন তো এই ভরসা।

জহরের ভাবনার সঙ্গে—সঙ্গেই বরকতের বলে ছেলেটি পা বাড়িয়ে ব্যাট পাতল। ব্যাট—প্যাডের ফাঁক দিয়ে বল গলে এসে লাগল স্টাম্পে। একশো রানেই পাঁচটা উইকেট চলে গেল। এবার যে নামল তাকেও জহর চেনেন না। ছেলেটি ছটফটে। সব সময়ই রান খুঁজছে। চারটে বাউন্ডারি নিয়ে কুড়ি রানে পৌঁছে গেল কুড়ি বলে। ওর সঙ্গী যে তার রান আট। এর পরই বরকত চার বলের ব্যবধানে দু’জনকেই ক্যাচ তুলিয়ে মাঠ থেকে ফেরত পাঠিয়ে দিল। জহর অবাক হলেন ওদের স্পিন খেলার অক্ষমতা দেখে। ফুলবাগান এত কাঁচা ছেলেকে নিয়ে টিম করে ভুল করেছে। বরকত খুবই ভাল বোলার, ব্যাটসম্যানের দুর্বলতা চট করে ধরে নিতে পারে, কিন্তু তাই বলে ওকে ভয় পাওয়ার কী আছে? এই ছেলেগুলোর বেজার বলে প্র্যাকটিস নেওয়া উচিত।

সমু এসেছে। জহর সিধে হয়ে বসলেন। ছেলেটাকে শুধু হাবলার সেই ম্যাচটায় দেখেছেন। উইকেট কামড়ে থাকতে পারে। সমু ঠিক তাই করল হাবলায় যা করেছিল। ইনিংসের শেষপর্যন্ত ব্যাট করে পঞ্চান্ন বলে সাতাশ রান করল। বরকত নিল সাতটা উইকেট, ওমকিশোর দুটো, টাকা খরচ করে পানু ভাল বোলারই ভাড়া করে এনেছে। জহর শুধু একটা ব্যাপারে খুশি হলেন, বরকত চেষ্টা করেছিল কিন্তু সমুর উইকেটটা নিতে পারেনি। উইকেট পায়নি সৌগতও। নুরু ওকে চার ওভারের বেশি বল করতে দেয়নি। ফুলবাগান চুয়াল্লিশ ওভারে একশো একাত্তর রান তুলে সবাই আউট।

ওমকিশোর আর বাসুদেব ওপেন করল ব্রাদার্সের ইনিংস। প্রথম ওভার থেকেই ওম ফুলবাগান বোলিংকে সেই যে কচুকাটা শুরু করল থামল একশো চব্বিশ রান করে, মাত্র পঁচাশিটা বল খেলে। তার আগে বাসুদেব পঁচিশ করে এল বি ডাবুল হয় অনুপের বলে। ব্রাদার্সের রান তখন একশো দশ। তিন নম্বরে আসে মান্টু সিং। এসেই ডিপ পয়েন্টে ক্যাচ দেয় জয়প্রকাশকে। শক্ত ছিল না কিন্তু সে ক্যাচটা হাতে পেয়েও ফেলে দেয়। ফুলবাগান সমর্থকরা আর্তনাদ করে ওঠে। অবশ্য ম্যাচ তখন ব্রাদার্স জিতেই নিয়েছে। আর দরকার তখন গোটা পনেরো রান।

”দেখলেন তো …. পানু পোদ্দার তা হলে ভালই দিয়েছে। এই ক্যাচ কখনও ওর হাত থেকে পড়বে? বিশ্বাস করতে হবে?” বলতে বলতে লোকটি গ্যালারি থেকে নেমে গেল। ”আর দেখে কী হবে, ম্যাচ তো খতম। এভাবে যে হারবে—।”

জহর শেষপর্যন্ত বসে রইলেন। ব্রাদার্স আট উইকেটে জিতে বদলা নিল। ফুলবাগান টেন্টের সামনে একটা হইচই হচ্ছে। জহর গ্যালারি থেকে নেমে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। বিক্ষোভ দেখাচ্ছে যারা, তাদের মূল বক্তব্য, এত নতুন ছেলে দিয়ে কেন টিম করা হয়েছে? তারপর তাদের রাগ জয়প্রকাশের ওপর।

”ওর মত ভেটারেন, ওইরকম সময়ে কিনা ওইভাবে মারতে গেল!”

”অনেকদিন তো খেলা হয়ে গেল, আর কেন! এবার বিদেয় হোক।”

”বিদেয় করে কাকে খেলাবেন, নতুনদের? দেখলেন তো, ওই সমর দত্ত ছাড়া আর একজনও তো দাঁড়াতে পারল না।”

জহর যে ফুলবাগানে এই বছর এসেছেন, সমর্থকদের কেউই তা জানে না বা জানলেও খেয়াল রাখেনি। তাঁকে কেউ চিনলও না। তিনি ভিড়ের মধ্যে সবারই কথা শুনছেন। এখন যারা জয়প্রকাশের মুণ্ডু চাইছে, কালই তারা ওকে মাথায় তুলবে যদি একটা সেঞ্চুরি করে। ব্রাদার্স না হয়ে অন্য কোনও টিমের কাছে হারলে এদের দুঃখ এতটা হত না। জহরকে ভাবাল একটা ব্যাপার, ফুলবাগান ভুল করেছে এত নতুন অনভিজ্ঞ ছেলেকে একসঙ্গে নিয়ে। শুভ্র রান আউট না হলে ফুলবাগান এমনভাবে বসে যেত না। সমু তো যথেষ্টই ভাল। কিন্তু বাকিরা? ওমকিশোরের মারের মুখে বোলাররা ছন্নছাড়া হয়ে গেল ভয় পেয়ে। পালাতে গিয়ে আরও এলোমেলো বল ফেলে ওম—কে সুবিধেই করে দিল। জহর দাঁড়িয়ে যখন এইসব ভাবছেন তখন তাঁর পিঠে টোকা পড়ল। চমকে ঘুরে দাঁড়ালেন।

”জহরদা, সেই পঞ্চাশ টাকাটা।” মনোজের হাতে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট।

”ওটা তুমি রেখে দাও, আজ শোধ হয়ে গেল।”

মনোজ একগাল হেসে নোটটা পকেটে রাখল। ”পানুদা বলেছিল কলকাতার সব ট্রফি নেবে। এবার তা হলে নেবেই।”

”না নিয়ে তো উপায় নেই, যা সব প্লেয়ার এনেছে!”

”আপনি ব্রাদার্স ছাড়লেন এই বছরই।” মনোজের স্বরে খেদ ফুটে উঠল। ”থেকে গেলে পারতেন। এতবড় একটা গ্লোরি ক্লাবের জীবনে তো আগে আসেনি।”

”এখনই এসব বলছ কেন, গ্লোরি আগে আসুক।”

”আপনার মতো ঝানু একটা ক্রিকেটার এ—কথা বলছেন! আজ দেখেও বুঝতে পারছেন না? মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে লিগ, নক আউট, জে সি মুখার্জি আর—” মনোজ চোখ পিটপিট করল, ”পি সেন ট্রফি ব্রাদার্সের টেন্টে চলে এল বলে। আর তিনটে মাস।”

”আরে জহরদা আপনি এখানে! টেন্টে চলুন।” ফুলবাগানের এক অল্পবয়সী ক্রিকেট—কর্তা জহরকে দেখে এগিয়ে এল।

”এই তো বেশ আছ … ওখানে তো দেখছি ঝামেলা চলছে।”

”আর বলবেন না, কতকগুলো চ্যাংড়া জয়প্রকাশকে যা—তা বলেছে, তাইতে—”

”কী বলেছে? টাকা খেয়েছে?”

”বলেছে সামনের বছর নাকি ব্রাদার্সে যাবে বলে তাই ওদের এগেনস্টে খেলছে না। শুনে তো জয়প্রকাশ একটার মুখে ঘুসি মেরেছে। তাই নিয়ে আবার ঝামেলা। ওকে ক্ষমা চাইতে হবে। জয়প্রকাশ গোঁ ধরে আছে ক্ষমাটমা চাইবে না।”

জহর শুকনো হাসলেন। ”সাপোর্টারদের চরিত্র আর বদলাল না। আমার এখন আর টেন্টে যাওয়ার ইচ্ছে নেই।” বলেই হনহনিয়ে তিনি ফুলবাগান ক্লাবের গেটের দিকে এগিয়ে গেলেন।

”ব্রাদার্স জিতলেই দেখছি জহরদার মন খারাপ হয়ে যায়।” মনোজ স্বগতোক্তি করল।

দু’দিন পর সমু আর শুভ্র একসঙ্গে এল রাজনারায়ণ পার্কে। জহর তখন বড় ছেলেদের জন্য নেটে একজনকে, পুল করার সময় নীচের হাতের কবজি কীভাবে ঘুরিয়ে জমির দিকে বল রাখবে সেটাই দেখাচ্ছিলেন। বল করছে বেজা এবং আরও তিনজন ছেলে।

”খবর কী তোমাদের?” জহর বললেন, দু’জনকে দেখে তিনি অবাকও হলেন।

”খবর ভাল নয় জহরদা,” সমু বলল।

”একটু মুশকিলে পড়েই আপনার কছে আসা।” শুভ্র বলল, ”ক্লাবে আসেন না কেন, এবার আসুন।”

”গিয়ে কী করব? আড্ডা মেরে, চা খেয়ে বাড়ি চলে আসব। আড্ডা আমি ভালবাসি না।”

”না, না, আড্ডা নয়”, সমু ব্যস্ত হয়ে বলল, ”সিরিয়াস ব্যাপার। আমরা, নতুন ছেলেরা খুব মুশকিলে পড়ে গেছি। শুভ্রর তবু পজিশনটা ভাল রানটান পাচ্ছে বলে, কিন্তু বাকিদের অবস্থা খুব খারাপ, সেই ব্রাদার্সের ম্যাচের পর থেকে প্রকাশদা আর ক্লাবে আসেননি। বলেছেন, যে দুর্নাম তাঁর নামে রটানো হয়েছে তারপর আর ফুলবাগানে থাকা সম্ভব নয়। টিমে হাল ধরার কেউ নেই।”

”আমি ক্লাবে গিয়ে কী করব, হাল ধরব?” জহরের গলায় ঈষৎ বিরক্তি। ”নিজেরা চেষ্টা করো, ব্যাট করাটা ভাল করে শেখো। বরকতের মতো বোলারদের কী করে খেলতে হয়, সে সম্পর্কে তো কোনও ধারণাই তোমাদের নেই। ধারণা হবেই বা কী করে, খেলেছ তো জয়দেব, নুরু, অনুপদের মতো বোলারদের। যাও তো ওই বুড়োটাকে খেলো তো। … যাও, ওই ঘরে প্যাডফ্যাড আছে, পরে এসো।”

দু’জনে অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে একবার তাকাল। তারপর নেটে বল করা বেজার দিকে, তারপর জহরের দিকে। সত্যি—সত্যিই কি বলছেন ব্যাট করতে নাকি শুধু কথার কথা!

”কী হল দাঁড়িয়ে রইলে যে?”

কী ভেবে শুভ্র ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সমু বলল, ”উনি কে?”

”দেখতেই তো পাচ্ছ একজন স্পিন বোলার, ব্রজেন হালদার। তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কোরো কেমন বোলার ছিল।” কথাটা বলে জহর এগিয়ে গেলেন বেজার দিকে। নিচু স্বরে দুটো কথা বলে ফিরে এলেন।

শুভ্র ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ট্রাউজার্সের মধ্যে শার্টটা গুঁজতে—গুঁজতে। দু’পায়ে প্যাড। যে ছেলেটি ব্যাট করছিল সে গ্লাভস খুলে দিল, নেটের ভেতর ঢুকে শুভ্র গার্ড চাইল বেজার কাছে, ”ওয়ান লেগ।”

জহর দাঁড়ালেন নেটের পেছনে। তিনজন বল করছে। বেজার প্রথম বলটা পেয়ে শুভ্র পিছিয়ে এসে আলতো ঠেলে দিল কভারে। পরের বোলারের বলটাকেও তাই করল। তৃতীয় বোলারের বলটা গ্লান্স করল অলসভাবে। বেজার দ্বিতীয় বল শর্ট পিচ, প্রচণ্ডভাবে স্কোয়ার কাট করল সে। নেট ঝাঁকিয়ে উঠল। পেছন থেকে জহর বললেন, ”পারফেক্ট।” বেজার তৃতীয় বলটা হাফ ভলি অফস্টাম্পের বাইরে, পা বাড়িয়ে ড্রাইভ করল শুভ্র। নেটে না আটকালে একস্ট্রা কভার বাউন্ডারিতে যেত। ওর মুখে প্রশান্তি ফুটে উঠল। বেজা পঞ্চম বলটা ফ্লাইট করাল, মন্থরগতিতে ভেসে এল লেগ স্টাম্পের উপর, একটু শর্ট পিচ। শুভ্র এগোতে গিয়েও পিছিয়ে এসে পুল করল। জহর মনে—মনে হাসলেন। বেজার ষষ্ঠ বলটা দৃশ্যত একই রকমের। তবে ফ্লাইট আগেরটার থেকে সামান্য বেশি। শুভ্র এক—পা বেরিয়ে ব্যাট নামাতে গিয়ে থামিয়ে ফেলল। আগের থেকে শর্ট পিচে বল পড়ছে। বেরিয়ে আসার ভুলটার মাসুল দিল বেজার হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে।

ফরসা মুখটা লালচে হয়ে গেল। আড়চোখে শুভ্র পেছনে তাকাল। জহর হাসছেন। থমথমে হয়ে গেল শুভ্রর মুখ। বেজার পরের চারটে বলে হুঁশিয়ার হয়ে সে পা বাড়িয়ে ঠেলে দিয়ে পরপর স্কোয়ার কাট, পুল আর ড্রাইভ করল এবং তারপরের বলটায় বেরিয়ে এসে অন—এ ঠেলে দিতে গিয়ে ক্রিজ থেকে একহাত বাইরে দাঁড়িয়ে চকিতে সে পেছনে তাকিয়ে দেখল লেগস্টাম্প ঘেঁষে বলটা বেরিয়ে গেল।

”স্টাম্পড!” জহর নির্বিকার মুখে বললেন, ”চোদ্দো বলে দু’বার আউট।”

শুভ্র একটা কথাও না বলে নেট থেকে বেরিযে এসে প্যাড খুলতে লাগল। সমু বলল, ”কী হল, আর খেলবি না?”

শুভ্র মুখ তুলে নিচু স্বরে বলল, ”বুড়োটা একটা হাড়বজ্জাত। ঘোল খাওয়াবে বলে আমাকেই কিনা বেছে নিল।”

”সমু এবার তুমি যাও।” জহর কাছে এসে বললেন।

‘না জহরদা, আমার আঙুলে একটা চোট রয়েছে, ভাল করে ব্যাট ধরতে পারছি না।” মুখ কাঁচুমাচু করল সমু।

জহর বুঝলেন। বেজাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী বুঝলি?”

”ভালই তো।”

”হবে?”

”হবে না কেন! প্র্যাকটিস করুক, খেলুক, খাটুক, ঠিক হবে। … তবে ডিসিপ্লিনড থাকতে হবে।”

”যেন তেলেভাজা না খায়।” জহর এক চোখ বন্ধ করে তাকালেন।

”বাচ্চচা ছেলেদের সামনে বেইজ্জত করিসনি। … শোনো তোমরা, আমাকে যদি তোমাদের কাজে লাগে তা হলে বোলো।”

”বলবে মানে? ওরা বলবে? ওরা কে? … আমি বলছি। শুভ্র, সমু আমি নিজে দেখেছি বরকতকে সাতটা উইকেট পেতে। পুরো ফুলবাগান টিম এখানে এই স্কুলে ভর্তি হয়ে শুধু ব্রজেন হালদার, ওই বুড়োটার কাছে প্র্যাকটিস নাও। ওকে টাকা দিতে হবে সেজন্য।”

”না, না, জহর, ও কী কথা বলছিস, টাকা নেব কী!”

”বেজা চুপ কর।” জহর ধমকে উঠলেন, ‘বিনি পয়সার শিক্ষা পেলে কেউ মানুষ হয় না। সব জায়গায় দেখেছি ফোকটসে পাওয়ার ধান্দা, তাই কিছু হল না এ—দেশটার।”

”জহর, আমাকে পয়সা নিতে বলিসনি। আমি অন্য জমানার প্লেয়ার, কোনওদিন টাকা নিয়ে খেলিনি। এইসব ছেলের যদি কোনও উপকারে লাগি, যদি একটা ছেলেও টেস্ট খেলে তা হলেই আমার ফিফটি হবে। … তোমরা ভাই আমাকে যতটা কাজে লাগাতে পারো লাগিয়ো।”

”লাগাব। শুধু আপনাকে নয়, জহরদাকেও। আমাদের জেনারেশনটাকে খুব বোকা ভাববেন না।” শুভ্র সপ্রতিভ সটান গলায় উদ্ধত ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনাকে চোদ্দো বলে দু’বার আউট করতে দেব না।”

”জহরদা, আপনি তা হলে ক্লাবে আসছেন না!” সমু প্রসঙ্গ বদল করে আসল কথায় এল।

”যাওয়ার তো কোনও দরকার মনে করছি না। হেমন্ত গুহ কি তোমাদের পাঠিয়েছে?”

”না, আমরা নিজেরাই এসেছি।”

”আমার বয়স হয়েছে, একটা সম্মানও আছে। সেক্রেটারি নিজে বলুক যেতে, তা হলে ভেবে দেখব,” দৃঢ়স্বরে জহর জানিয়ে দিলেন। ওরা আর অনুরোধ করল না।

ফুলবাগানের চারজন ছেলে রাজনারায়ণ কোচিং স্কুলে ভর্তি হল টাকা দিয়ে। অনুপ, জয়দেব, সমু আর শুভ্র। ভীষণ খুশি বেজা হালদার। এখন সে দু’বেলা আসতে শুরু করেছে। বিকেলে তিনটের সময় অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ে পৌনে চারটের মধ্যে নেটে হাজির হয়ে যায়। সব কোচই টাকা পায়। জহর প্রতাপকে বলেছিলেন বেজাকে টাকা দিয়ে রেখে দিতে। প্রতাপ রাজিও হয়েছিল। অনীশ সেনকে সে ছাড়িয়ে দিয়েছে তাকে দিয়ে কোনও কাজ পাওয়া যায় না বলে। প্রতাপ সেই জায়গায় বেজাকে মাইনে দিয়ে রাখার প্রস্তাব মেনে নেয়। বেজা সানন্দে রাজি হয় শুধু একটি শর্তে—টাকা নেব না।

অনুপ আর জয়দেবকে পেয়ে বেজা খুশি। প্রধানত এই দু’জনকে নিয়েই সে পড়ে থাকে। ওরাও ‘বেজাদা’র অনুগত চেলা হয়ে গেছে। নেটে যাকে পায় তাকেই বল করে যায় আর বেজার নির্দেশ—উপদেশ প্রতি বলে প্রয়োগ করে—করে বোলিংয়ে শান দেয়। সমু আর শুভ্র ব্যাট করার সময় জহর নেটের পেছনে দাঁড়ান। যদি কিছু বলার থাকে, বলেন, দুই উইকেটের মাঝে প্যাড পরে ব্যাট হাতে দৌড়নো, বল ধরে উইকেটে ছোড়া, ক্যাচ ধরা, এইসবও তিনি ওদের করান, সেইসঙ্গে ব্যায়ামও।

সি এ বি নক আউটে ফুলবাগানকে ব্রাদার্সের মুখোমুখি হতে হল না, প্রথম ম্যাচেই এক উইকেটে হেরে যায় মোহনবাগানের কাছে। বলার মতো পারফরম্যান্স—জয়দেব চারটে উইকেট পেয়েছিল, সমু করেছিল তেষট্টি রান। শুভ্র একচল্লিশ রান করে আঙুলে চোট পেয়ে রিটায়ার করে। ম্যাচটা মোহনবাগান কোনওক্রমে জেতে। ফাইনালে ব্রাদার্স মোহনবাগানকে পঁচাত্তর রানে হারিয়ে লিগ ও নকআউট দুটোই পেয়ে যায়। ওমকিশোর, মান্টু আর বরকতরা পানু পোদ্দারের অর্থব্যয় সার্থক করে দেয় দুর্দান্ত ফর্মে থেকে।

জে সি মুখার্জি ট্রফির খেলায়ও ফুলবাগান ব্রাদার্সের সামনে পড়েনি। এরিয়ানের কাছে বাইশ রানে হারে। লো স্কোরিং ম্যাচ, কোনও ব্যাটসম্যানই পঞ্চাশে পৌঁছতে পারেনি, তবে জয়দেব হ্যাটট্রিক করে পাঁচটা উইকেট পায়, অনুপ দুটো। ফুলবাগানের আক্রমণ বলতে এখন শুধু দুই স্পিনার, অনুপ আর জয়দেব। ব্রাদার্স ইউনিয়ন জে সি মুখার্জি ট্রফিও জিতে নিল ইস্টবেঙ্গল এবং এরিয়ানকে হারিয়ে। ট্রফি জেতার হ্যাটট্রিক করে তারা শেষ মুকুটটা মাথায় তোলার জন্য খেলতে নামল পি সেন ট্রফির টুর্নামেন্টে।

মরসুমের একেবারে শেষে ক্রিকেটাররা ক্লান্ত, তার ওপর প্রচণ্ড গরম। কারও মাঠে নামার ইচ্ছা নেই। খেলা দেখিয়ে বাংলা বা পূর্বাঞ্চল দলে ঢোকার তাগিদও উবে গেছে, কেননা জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলোও শেষ হয়ে গেছে। ফুলবাগান দলের পুরনোদের মধ্যেও উৎসাহ নেই। যারা টাকা নিয়ে খেলে তাদের খেলতেই হবে। তবে দু’জন জানিয়েছে তাদের চোট আছে, খেলা অনিশ্চিত। জয়প্রকাশ হায়দরাবাদে বদলি হওয়াটা আটকেছে তদ্বির করে। শোনা যায় পানু পোদ্দার নাকি এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করেছে। জয়প্রকাশ ক্লাবে আসছে না। নতুন ছেলেরা—সমু এবং কৌশিক, সিদ্ধার্থ, অভিরূপ—অবশ্য খেলার জন্য মুখিয়ে আছে।

রাজনারায়ণ পার্ক থেকে জহর সকালে দোকানে চলে আসে। সেদিন পার্ক থেকে বেরিয়ে দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে তখন একটা অ্যাম্বাসাডার তার পাশে এসে থামল।

”জহর… তোমার কাছেই যাচ্ছিলুম।” গাড়ির জানলায় হেমন্ত গুহর মুখ। জহর এগিয়ে এল।

”কী ব্যাপার?”

”গাড়িতে বসে কথা বলব। উঠে এসো।” দরজা খুললেন হেমন্ত গুহ। জহর উঠলেন।

”ক্লাবে আসো না কেন?”

”গিয়ে কী হবে! আমাকে খেলাবার জন্য তো আপনি নেননি। রামবাবুকে খুশি করতে আমায় নিয়েছিলেন।”

”রাগ করেছ। তা করতে পারো। কী জানো, দরকারে পড়লে তোমায় নামাব বলে নিয়েছিলুম। নিয়মিত যারা খেলে তারাই খেলুক, আমি তাই—ই চেয়েছি, তোমার তো আর বেঙ্গল টিমে ঢোকার অ্যাম্বিশন নেই যে পারফরম্যান্স দেখাতে হবে।”

”কে বলল আমার অ্যাম্বিশন নেই? নিশ্চয়ই আছে।” জহরের গলা হঠাৎ চড়ে গেল। ”আমি একষট্টি বছর পর্যন্ত খেলতে চাই।”

হেমন্ত গুহ বিভ্রান্ত মুখে বললেন, ”একষট্টি বছর কেন?”

জহরের উত্তেজনা চুপসে গেল হঠাৎ চড়ে ওঠার মতো। মৃদুস্বরে বললেন, ”সে আপনি বুঝতে পারবেন না।”

”কেন পারব না, একষট্টি বছর কেন?”

”ছোটবেলায় আমার আইডল ছিলেন সি কে নাইডু। তিনি ওই বয়স পর্যন্ত রনজি ট্রফি খেলেছিলেন।”

”অ, এই কথা!” হেমন্ত গুহ হেসে ফেললেন। ”বেশ তো তুমিও খেলবে। এ—বছর তো একটা ম্যাচও খেলোনি। তা হলে একবার মাঠে নামো। পি সেন ট্রফিতে খেলো, খেলবে?”

জহর জানেন তাঁকে খেলাবার জন্য কেন এই লোকটির গরজ। ক্লাবে এখন এগারোজন নামাবার মতো প্লেয়ার হচ্ছে না। তিনি আগ্রহ না দেখিয়ে নিরাসক্ত স্বরে বললেন, ”প্রথম খেলা কার সঙ্গে?”

”শিলিগুড়ি ইলেভেনের সঙ্গে।”

”তারপর কার সঙ্গে পড়বে?”

”আগে জিতি, তারপর তো কার সঙ্গে পড়বে দেখা যাবে!”

”আচ্ছা, যাব।”

.

শিলিগুড়ির সঙ্গে ম্যাচটা ফুলবাগান জিতল ন’ উইকেটে। জহর অধিনায়ক। টস জিতে ফিল্ড করবেন ঠিক করেন। তাঁর দুই ওপেনিং বোলার, অভিরূপ আর সিদ্ধার্থ, প্রথম চার ওভারে ওপেনার দু’জনকে বোল্ড করে ছয় রান দিয়ে। শিলিগুড়ির তিন ও চার নম্বর বেপরোয়া ব্যাট চালিয়ে বত্রিশ রান তোলে। জহর দুই বোলারকেই বদল করে অনুপ ও জয়দেবকে আনেন দশ ওভার পর। উইকেটকিপার কিঙ্কর স্টাম্পড করল তিন নম্বরকে অনুপের বলে। চার ও পাঁচ নম্বর আটত্রিশ থেকে রান টেনে নিয়ে গেল ছিয়াশিতে। জহর অনুপের জায়গায় আনলেন শুভ্রকে। রাজনারায়ণ পার্কে তিনি ওকে নেটে বল করতে দেখেছেন। মিডিয়াম পেসে শুভ্রর বল লেগকাট করে। লেংথে বল রাখে, অবাক হয়ে গেছল যখন জহর তার হাতে বলটা দেন, ”আমি!”

”হ্যাঁ, যে বল নেটে করতে তাই করো।”

সীমায়িত ওভারের খেলায় যা দেখা যায় না এবার তাই দেখা গেল—স্লিপ ফিল্ডার। একজন নয়, দু’জন। শুভ্রর প্রথম দুটো বল শর্ট পিচ। প্রথমটায় চার, পরেরটায় তিন, মিড উইকেট থেকে। তৃতীয় বল লেগ স্টাম্পে ভাল লেংথে। ব্যাটসম্যান ঝুঁকে বলটা আটকাতে গেল। ব্যাটের কানা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল বল। স্লিপ থেকে জহর হাততালি দেন। পরেরটাও একই বল একই জায়গায়, একই ভাবে খেলতে গেল ব্যাটসম্যান। ব্যাট ছুঁয়ে বল এল জহরের ডান কাঁধের দিকে। লুফতে অসুবিধা হল না। চার উইকেটে চুরানব্বই। এর পর শিলিগুড়ির ব্যাটসম্যানরা আস্থা নিয়ে শুভ্রকে আর খেলতে পারল না। তেত্রিশ ওভারের মধ্যেই শিলিগুড়ি একশো পঁয়ত্রিশ রানে ইনিংস শেষ করে ফেলে। শুভ্র ছ’টা উইকেট নেয় বিয়াল্লিশ রানে।

শুভ্র ওপেনার নয় কিন্তু ওকেই জহর ওপেন করতে বললেন নিয়মিত ওপেনার কৌশিকের সঙ্গে।

”আমি! আমি তো কখনও নতুন বল ফেস করিনি!”

”ধরো প্রথম ওভারে তিনজন আউট হয়ে গেল। এবার তোমার নামার কথা। তখন কি তুমি বলবে, আমি তো নতুন বলে খেলতে পারব না!”

শুভ্র আর কথা না বলে প্যাড পরতে শুরু করে।

”কখনও খেলোনি বলেই খেলবে, আমি জীবনে কখনও ওপেন করিনি, কিন্তু ওড়িশার এগেনস্টে প্রথম ওপেন করে সেঞ্চুরি করেছি। সবরকম পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি করে রাখবে। যাও… ধরে খেলো, ওয়ান ডে ম্যাচ বলে প্রথম থেকেই মারতে যেয়ো না।… আর—একটা কথা উইনিং স্ট্রোকটা তোমার কাছ থেকেই আশা করব।” জহর কথাগুলো বলে শুভ্রর কাঁধে চাপড় দিলেন। ড্রেসিংরুমের সবাই জহরের দিকে তাকিয়ে।

”তিন নম্বরে কে যাবে?’ জহর সবার মুখের দিকে তাকালেন।

সমু আর কিঙ্কর একসঙ্গে বলে উঠল, ”আমি।”

‘পঞ্চাশের মধ্যে উইকেট পড়লে সমু, আর পরে পড়লে কিঙ্কর, তারপর এই বুড়ো—প্যাড আপ।”

বুড়োকে আর নামতে হয়নি। উইনিং স্ট্রোকটা ছিল শুভ্ররই—সুইপ করে সে পৌঁছয় আটাত্তরে। সত্তর রানে প্রথম উইকেট পড়ায় কিঙ্কর ব্যাট করতে নেমেছিল। প্যাড খুলতে—খুলতে সমু বলে, ”শুভ্রই দেখছি ম্যান অব দ্য ম্যাচ! জহরদা ওকে বোলারও বানিয়ে দিলেন।”

”পরের ম্যাচে তুমি হওয়ার চেষ্টা কোরো।”

জহরও প্যাড খুলছিলেন। নিচু স্বরে কথাটা বলে আঙুলের ইশারায় অভিরূপ আর সিদ্ধার্থকে ডাকলেন।

”দুজনে দু’ওভার বল করেছ, একটা করে উইকেট পেয়েছ। দু’জনেই একটা করে মেডেনও পেয়েছ। অভিরূপ চার আর সিদ্ধার্থ দুটো রান দিয়েছ সুতরাং দারুণ বল করেছ অথচ তোমাদের আর বল দিলুম না—কেন?”

দু’জনে এমন একটা প্রশ্নে বিভ্রান্ত এবং অবাক চোখে শুধু তাকিয়ে রইল।

”বলগুলো ফেলছিলে কোথায়? বারোটা করে বল করলে তার আদ্ধেকই তো স্টাম্পের দু’হাত বাইরে দিয়ে গেল। অতটা দৌড়ে এসে বল করো কেন? রান—আপ ছোট করো, জোরে বল করার চেষ্টাটা কমাও, বল ডেলিভারি দেওয়ার আগে থমকে যাচ্ছিলে। কপিলদেবের বোলিং অ্যাকশন ভাল করে লক্ষ করোনি?… পরের ম্যাচটা কবে?…. কাল অবশ্যই রাজনারায়ণ পার্কে এদের দু’জনকে নিয়ে আসবে সমু।” জহর নির্দেশ দিলেন।

পরের ম্যাচই ইস্টার্ন রেলকে হারিয়ে সেমিফাইনালে ওঠা গড়িয়া অগ্রগামীর সঙ্গে তিনদিন পরে। অন্য সেমিফাইনালে ব্রাদার্স ইউনিয়ন উঠেছে রাজস্থানকে হারিয়ে। মাণ্টু সিং সেঞ্চুরি করেছে, ওমকিশোর নিয়েছে সাতটা উইকেট। এবার ওরা খেলবে শালিমার স্পোর্টিংয়ের সঙ্গে।

গড়িয়ার সঙ্গে ম্যাচটায় ফুলবাগান স্বচ্ছন্দে জিততে গিয়ে বিপদে পড়ে যায়। একশো তিয়াত্তর রান তুললে জিতবে, এমন অবস্থায় ইনিংস শুরু করে ফুলবাগানের তিন উইকেটে দেড়শো, বত্রিশ ওভার খেলে। শুভ্র ব্যাট করছিল আশি রানে। সেঞ্চুরি প্রায় অবধারিত। একটা ফুলটস বল অবহেলাভরে লং অন বাউন্ডারির ওপর দিয়ে তুলতে গিয়ে ধরা পড়ল বাউন্ডারির কিনারে। তারপর পাঁচজন ব্যাটসম্যান ফিরে এল ষোলো রান যোগ করে। ফুলবাগানের হাতে দুই উইকেট, দরকার তেরো রান। জহর তখন খেলতে নামেন কপালে ভাঁজ তুলে।

”একটা একটা করে রান… ম্যাচ জিতে যাব। আঁকুপাকু কোরো না। কল না করলে শর্ট রান নিয়ো না।” জহর ক্রিজে এসে জয়দেবকে বলে দেন। এই মরসুমে জয়দেবের সর্বোচ্চচ রান আট। ”আর এই অফব্রেক বোলারটাকে ফরওয়ার্ড খেলো না।” বাধ্য ছেলের মতো জয়দেব ঘাড় নাড়ল।

গড়িয়ার পাঁচজন ঘিরে ধরল জহরকে। ওভারের বাকি পাঁচটি বল জহর আটকালেন। এবার উৎকণ্ঠিত হয়ে বোলার প্রান্ত থকে জয়দেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে—মনে ভগবানকে ডাকলেন: ছেলেটাকে ছ’টা বল পার করে দাও।

অফস্পিনারের প্রথম বলটাতেই জয়দেব লাফিয়ে বেরিয়ে এসে ব্যাট চালাল। জহর ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। দর্শকদের হর্ষধ্বনি শেষ হতে চোখ খুললেন। জয়দেবের মুখ হাসিতে ভরা। জহর কড়াচোখে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করতেই, জয়দেবের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। পরের চারটে বল সে পিছিয়ে এসে কোনওরকমে আটকাল। জহর খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলেন, এইভাবে খেলো। ষষ্ঠ বলটায় জয়দেব আবার লাফিয়ে বেরোল। জহর চোখ বন্ধ করলেন। আবার হর্ষধ্বনি তিনি শুনলেন। ওভার শেষ, জিততে দরকার আর—একটা রান। দুটো বল থেকে এসেছে বারো রান।

”এটা কী হল?” জয়দেবকে ডেকে জহর বললেন, ”পই—পই করে বললুম—।”

”কী করব জহরদা, উইকেটকিপারটা অনেকক্ষণ ধরে পেছনে লেগেছে, খালি কানের কাছে বলে যাচ্ছে, ‘এইবার ব্যাটা ক্যাচ দেবে, এইবার স্টাম্প করব। … ব্যাট করতে জানে না, এক বলের খদ্দের’, শুনলে মাথা গরম হবে না? বলুন?”

জহর ঢোক গিলে বললেন, ”তা হলে তো হবেই।”

প্রথম বলটাতেই জহর পা বাড়িয়ে জোরে ঠেলে দিলেন। একস্ট্রা কভারে লোক নেই। ‘রাইট’ বলে চেঁচিয়ে ছুটলেন রান নিতে। ছোটবেলায় তিনি শুনেছিলেন, ব্র্যাডম্যান রান নেবার জন্য কল করেন ‘রাইট’ বলে। অভ্যাসটা তখন থেকেই তৈরি করেন।

ড্রেসিংরুমে ফিরে জহর দেখলেন রামবাবুকে। ”এতক্ষণ ওপরের গ্যালারিতে বসে ছিলুম। ঠিক করেছিলুম না জিতলে চুপচাপ বাড়ি চলে যাব।” রামবাবু খুশিতে জহরের কাঁধ ধরে ঝাঁকালেন। ”যেরকম ঝপঝপ পাঁচটা উইকেট পড়ে গেল, ভাবলুম ম্যাচ বুঝি এইখানেই খতম হয়ে গেল। ছেলেটা যে অমন দু’খানা ছক্কা হাঁকাবে কে জানত! আপনি নিশ্চয় মারতে না বললে কি মারত?”

”এজন্য যাবতীয় ক্রেডিট ওদের উইকেটকিপারের। আমি কিছুই বলিনি।” ধীর গলায় জহর জানিয়ে দিয়ে জয়দেবকে ডেকে বললেন, ”এবার থেকে পকেটে তুলো নিয়ে ব্যাট করতে নামবে, কানে দেওয়ার জন্য।”

”আবার তা হলে আমরা ফাইনালে উঠলুম জহর।” হেমন্ত গুহ বললেন, সন্দেশের বাক্স সামনে ধরে। তাঁর কণ্ঠস্বরে অনিশ্চয়তার আভাস। জহর একটা তুলে নিলেন। ”বোধহয় ব্রাদার্সের সঙ্গেই আবার খেলাটা হবে, শুনছি শালিমার নাকি খেলবে না। কীসব গণ্ডগোল হচ্ছে, পেমেন্ট নিয়ে, ছ’জন খেলবে না বলেছে।”

”আপনি কি ভয় পাচ্ছেন ফাইনাল নিয়ে?” সন্দেশ চিবোতে—চিবোতে জহর বলেন। ”তা হলে একটা গল্প বলি। গল্প হলেও কিন্তু সত্যি ঘটনা… ওহে তোমরা এদিকে এসো, একটা গল্প বলব।” জহরের ডাক শুনে পাঁচ—ছ’টি ছেলে এগিয়ে এল।

”অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন ওয়ারউইক আর্মস্ট্রং, বোধ হয় নাম শোনোনি। সত্তর—বাহাত্তর বছর আগের কথা। ব্র্যাডম্যান তখন বাচ্চচা ছেলে। দেশের মাটিতে ইংল্যান্ডকে টেস্ট সিরিজে ৫—০ দুরমুশ করে পরের বার ইংল্যান্ড ট্যুরে এসে পর—পর তিনটে টেস্টে আবার দুরমুশ করল আর্মস্ট্রংয়ের দল। ইঁদুরকে নিয়ে বেড়াল যেভাবে খেলে, তাই। বাকি দুটো টেস্ট করুণা করে ড্র করল। সারা ট্যুরে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ হারেনি… শুধু একটা ছাড়া। আর সেটার কথাই বলব।” জহর হাত বাড়ালেন সন্দেশের বাক্সের দিকে। হেমন্ত গুহ শশব্যস্তে বাক্সটার ঢাকনা খুলে এগিয়ে ধরলেন। বাক্সে সন্দেশ নেই। জয়দেবের মুঠোয় গোটাকয়েক সন্দেশ, কিঙ্কর হাতটা ধরে জহরের সামনে তুলল। জয়দেব মুঠো খুলে মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ”ছয় মেরেছি তাই ছ’টা নিয়েছি।”

”তোকে আমি আরও ছ’টা কিনে দেব।” হেমন্ত গুহর সস্নেহ প্রতিশ্রুতি।

”আর ওই উইনিং রানটার জন্য আমি একটা।” বলে জহর জয়দেবের মুঠো থেকে একটা সন্দেশ তুলে নিলেন।

”জহরদা, তারপর কী হল?” শুভ্রর অধৈর্য স্বর।

”বলছি, বলছি। ইংল্যান্ডের তখন শোচনীয় অবস্থা চলছে। পর—পর তিনটে সিরিজে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছে বারোটা ম্যাচ, জিতেছে একটা। আর্মস্ট্রংয়ের রথ হুড়মুড়িয়ে চলেছে, সামনে যা পড়ছে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। সেইসময় ইস্টবোর্নে তাদের একটা তিনদিনের ম্যাচ পড়ল, অ্যামেচার তরুণদের নিয়ে গড়া ‘জেন্টলমেন অব ইংল্যান্ড’ নামে একটা দলের সঙ্গে। সবাই অবশ্য তরুণ নয়, দুটো বুড়োও ছিল সেই দলে। ইংল্যান্ডের ক্যাপ্টেন আর্চি ম্যাকলারেন, ল্যাঙ্কশায়ারে খেলতেন, বছর বারো আগে শেষ টেস্ট খেলেন। এর আন্ডারে রনজি টেস্ট খেলেছেন। তিনিই ছিলেন জেন্টলমেন দলের ক্যাপ্টেন। তখন বয়স পঞ্চাশ।

”জহরদা, এই ম্যাকলারেনের হায়েস্ট রানের কাউন্টি রেকর্ড কি গ্রেম হিক সেদিন ভাঙল?”

”হ্যাঁ, ম্যাকলারেনের ছিল চারশো চব্বিশ রান। যাকগে, ওসব কথা… দলে আর একটা বুড়ো ছিল, সাউথ আফ্রিকার অলরাউন্ডার অব্রে ফকনার, এর বয়স তখন চল্লিশ পেরিয়ে গেছে। বাকি ন’জন ইউনিভার্সিটির ছেলে, বাইশ—তেইশ বয়স। মজার কথা কী জানিস, এই ম্যাচ রিপোর্ট করতে লন্ডন থেকে একজন ছাড়া আর কোনও রিপোর্টারই যায়নি। তারা ধরেই নিয়েছিল আর্মস্ট্রংয়ের দল একদিনেই ম্যাচ শেষ করে দেবে, ওখানে গিয়ে কী লাভ!”

”সেই একজন রিপোর্টার কে?” এবার কিঙ্কর জানতে চাইল।

”নেভিল কার্ডাস। তিনি গেছলেন, কেননা ম্যাকলারেন তাঁকে চিঠি দিয়ে ম্যাচটা দেখার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। চিঠিতে সেই বুড়ো পুনশ্চ দিয়ে তলায় লেখেন : ‘আমার মনে হয় আর্মস্ট্রংয়ের দলকে কী করে হারাতে হয় তা আমি জানি।’ … কী আত্মবিশ্বাস!” জহর জ্বলজ্বলে চোখে ছেলেদের মুখের দিকে তাকালেন। ”একদল টাটকা তরুণ আর একটা পাকা মাথা! আর বিরুদ্ধে রয়েছে জয়ের গর্বে উদ্ধত হয়ে—ওঠা একটা ভয়ঙ্কর দল।

”খেলা ঘণ্টাখানেক চলার পরই কার্ডাস বুঝে গেলেন এখানে এসে খুবই ভুল করেছেন। লাঞ্চের মধ্যেই ম্যাকলারেনের দল তেতাল্লিশ অল আউট! নেহাতই লন্ডনে ফেরার ট্রেন তখন আর নেই, নয়তো তিনি ফিরে আসতেন। এর পর অস্ট্রেলিয়ানরা পিকনিকের মেজাজে ব্যাট করে দিনের শেষে দুশো রানেরও কমে সবাই আউট হয়ে গেল। কার্ডাস ধরে নিলেন ম্যাচ ওখানেই শেষ হয়ে গেছে। পরের সকালে অস্ট্রেলিয়া লাঞ্চের আগেই জিতে যাবে ধরে নিয়ে কার্ডাস তো তাঁর ব্যাগ রেলস্টেশনে আগেভাগে পাঠিয়ে দিলেন। মাঠ থেকে সোজা গিয়ে একটার ট্রেন ধরবেন। ম্যাকলারেন প্রথম বলেই বোল্ড হলেন। কার্ডাস মাঠ থেকে বেরোবার উদ্যোগ করলেন। ধীরে—ধীরে হেঁটে গেটের দিকে এগোচ্ছেন আর দাঁড়িয়ে পড়ে মুখ ঘুরিয়ে মাঠের খেলার দিকে তাকাচ্ছেন। দেখলেন ফকনার ব্যাট করছেন, সঙ্গে এক তরুণ। ফাঁকা মাঠে শুধু শোনা যাচ্ছে স্ট্রোকের আওয়াজ। তাঁদের ব্যাটিং দেখতে—দেখতে কার্ডাস আর মাঠ থেকে বেরোতে পারলেন না, ফিরে এলেন। সেদিন আর তাঁর লন্ডন যাওয়া হল না, পরের দিনও নয়। ফকনার তাঁর জীবনের শেষ ইনিংসে দুর্দান্ত ব্যাট করে গেলেন। থার্ড ডে—তে কেমব্রিজের বোলার গিবসন শেষ করে দিল অস্ট্রেলিয়ানদের। আটাশ রানে ম্যাচটা জিতে নেয় ম্যাকলারেনের জেন্টলম্যানরা।” জহর ছেলেদের চোখে অবিশ্বাসের ছায়া আর অবাক হওয়া দেখলেন।

”ক্রিকেটে অনেক কিছুই ঘটে, শুনলে মনে হয় বানানো কথা।….. এমন গল্প ফাইনালে আমরাও তো বানিয়ে দিতে পারি … পারি না? … পারব না? বল তোরা পারবি না?” জহর বাঁ হাতের তালুতে ঘুসি মারলেন। তাঁর চোখ দিয়ে হলকা বেরোচ্ছে। ঠোঁট কেঁপে উঠল। সবাই চুপ।

নিস্তব্ধতা ভেঙে সমুই প্রথম বলল, ”পারব।”

কিঙ্কর বলে উঠল, ”পারব।”

শুভ্র আর অনুপ বলল, ”পারব।”

এবার সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ”জিতব।”

ফুলবাগান টেন্টের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল কানু ভটচায। জহরকে দেখে একগাল হাসতেই জিভটা বেরিয়ে এল।

”খেলা দেখতে এসেছিলে বুঝি?” জহরও একগাল হেসে উৎসাহ দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

”দেখলুম, হেরে তো বসেছিলি। তোর টিমের কোমরে একদম জোর নেই। পাঁচটা উইকেট কীভাবে পড়ে গেল!”

”যেভাবে গত বছর ফুলবাগানের পড়ে গেছল, তবুও তোমরা ম্যাচ জিততে পারোনি।”

”এবার আর ওরকম হবে না রে। বলেছিলিস চাবকাব, মনে আছে?’

”আছে।”

”এবার আমরা চাবকাব তোদের। ম্যাচ কী করে জিততে হয় এবার সেটা দেখাব। ফুলবাগানের এখন এমনই হাল যে, তোর মতো বুড়োকেও খেলতে হচ্ছে। কী করে যে ফাইনালে উঠলি!…. যাকগে, ওসব কথা। পি সেন জেতার পর পানু পার্টি দেবে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে, কার্ড পাঠিয়ে দোব, তুই আসিস কিন্তু। অনেক বছর ব্রাদার্সে ছিলিস তো।”

”নিশ্চয় যাব। অনেকদিন ভালমন্দ খাইনি। তবে ফাইনালে আগে ওঠো তো।”

”ওঠা হয়ে গেছে। শালিমার সেমিফাইনালে খেলছে না, পাকা খবর। এবার তোরা রেডি থাকিস—”

”চাবুক খাওয়ার জন্য?” জহর চওড়া করে হাসলেন।

.

ইডেনে প্রায় চার হাজার দর্শকের সামনে নুরুর সঙ্গে জহর টস করলেন। জিতল নুরু।

”জহরদা, আমরা ব্যাট করব।”

”গত বছরও তোরা ব্যাট করেছিলি।”

”গত বছর তোমাদের জয়প্রকাশ ছিল, এবার নেই।” নুরু মুচকে হাসল। জহরও হাসলেন। মনে—মনে তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন জিতলে ফিল্ড করবেন। সকালে উইকেট কিছুটা তাজা থাকে। তখনই তাড়াতাড়ি প্রথম দিকের উইকেট যদি কয়েকটা পাওয়া যায়। বেলা বাড়লে উইকেট নির্জীব হয়ে পড়বে, ফুলবাগানের যা বোলিং—ক্ষমতা তাতে কচুকাটা হবে মাণ্টু সিংদের হাতে। নুরু ব্যাট করতে চাওয়ায় তিনি হেসে ছিলেন।

সিদ্ধার্থ বল নিয়ে ওপেন করে, তারপর অভিরূপ। সিদ্ধার্থর প্রথম দুটো বল ওয়াইড হল। তৃতীয় বলে ওমকিশোর পয়েন্ট থেকে চার নিল। চতুর্থ বলেও একই জায়গা থেকে আবার চার। প্রবল উৎসাহে সে প্রাণপণ জোরে বল দেওয়া চেষ্টা করছে। তার আউট সুইংগুলো নিয়ন্ত্রণ ছাড়া হয়ে বড় বাঁক নিয়ে ঘুরে যাচ্ছে অফস্টাম্পের বাইরে দিয়ে, তার ওপর বলের লেংথও ওভারপিচ হচ্ছে। প্রথম স্লিপ থেকে জহর এগিয়ে গেলেন সিদ্ধার্থর কাছে।

”অত জোরে নয় সিদ্ধার্থ, আগে লেংথে ফেলো। নতুন বল, অত বড়—বড় সুইং করালে তোর মার খেয়ে মরবে… পেস কমিয়ে আগে লেংথ ঠিক করো।” মাথা নিচু করে সিদ্ধার্থ শুনে গেল জহরের কথা।

সিদ্ধার্থর পিঠ চাপড়ে দিয়ে জহর বল তুলে দিলেন অভিরূপের হাতে। ”অফ স্টাম্পের ওপর রাখবে, দেখে নাও তোমার ফিল্ড।”

দুটো সিঙ্গল আর একটা দুই হল অভিরূপের বলে। চারটে রানের জায়গায় হতে পারত বারো রান। কিন্তু সমু আর কৌশিক শিকারি চিতার মতো বল তাড়া করে কভার আর পয়েন্টে অবধারিত বাউন্ডারিতে যাওয়া বলকে এক আর দুই রানে দাঁড় করায়। ওদের আন্তরিক প্রাণপণ চেষ্টা দেখে ফুলবাগান দলটার নড়াচড়ায় যেন বিদ্যুতের ছোঁয়া লাগল। জহরের মনে হল, জলপোকার মতো ছুটোছুটি করা ছেলেদের মাঝে তিনি যেন একটা বক।

পঞ্চম ওভারের শেষ বলটা সিদ্ধার্থ ঠুকে দিল। ওমকিশোর বোধ হয় ঢিলে দিয়েছিল মনোনিবেশে, বলটাকে হঠাৎ মুখের সামনে দেখে সে হুক করল বলের লাইন থেকে সরে না গিয়ে। লং লেগ বাউন্ডারিতে দাঁড়ানো জয়দেব গজদশেক ছুটে এসে থমকে পিছু হটতে শুরু করল। বলটা ওভার বাউন্ডারি হওয়ার জন্য উড়ে যাচ্ছে। লাইনের এক হাত ভেতরে দাঁড়িয়ে জয়দেব এক হাত তুলে লাফ দিল। বল তার তালুতে জমে গেল।

দু’হাত তুলে পাগলের মতো ছুটে আসছে জয়দেব, আর চারটে ছেলে ছুটে যাচ্ছে তার দিকে। দৃশ্যটা দেখে জহরের বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল একটা ক্ষীণ আশা। এই ওমকিশোরই লিগে সেঞ্চুরি করেছিল। পঁচাশি বলে একশো চব্বিশ! এমন একটা অসম্ভব ক্যাচ নিতে পারলে, ম্যাচটাও তা হলে নেওয়া যেতে পারে। ক্যাচই তো ম্যাচ জেতায়।

মাণ্টু সিং নেমেছে। মুখে সহজ একটা ছেলেমানুষি হাসি। বাসুদেবের স্ট্রাইক। অভিরূপের বল গ্লান্স করে সে দুটো রান নিল। দ্বিতীয় বলটা ড্রাইভ করতেই ব্যাটের ভেতরের কানায় লেগে বলটা লেগের দিকে উড়ে গেল। কিঙ্কর অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় বাঁ হাত বাড়িয়ে বাঁ দিকে ঝাঁপ দিল। বাঁ তালুতে বলটা ধরে জমিতে দু’বার গড়িয়ে সে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠল। আম্পায়ার আঙুল তুলে দিলেন। বত্রিশ বল খেলে দুটো উইকেট হারিয়ে ব্রাদার্সের ছত্রিশ রান। তার মধ্যে ওমকিশোরও আউট! ফুলবাগানের ছেলেদের চোখ জ্বলজ্বল করছে। এখন ওদের চলাফেরা খাঁচার বুনো বাঘের মতো। গরাদ ভেঙে বেরোবার জন্য ছটফটাচ্ছে।

‘জহরদা, এই মাণ্টু সিংটাকে তাড়াতাড়ি নিতে হবে।” কিঙ্কর তার পাশে দাঁড়ানো জহরকে বলল, ”অভিরূপ কী বল করছে দেখেছেন? প্রত্যেকটা বল অফস্টাম্পের ওপর দিয়ে বের করছে।”

তাড়াতাড়ি আর নেওয়া হল না। হুঁশিয়ার হয়ে গোটাদশেক বল খেলে হঠাৎ অভিরূপকে সোজা ড্রাইভ করে চার, পরের বলে লং অনেক ওপর দিয়ে ছয় মারল। জহর তাকে সরিয়ে অনুপকে এবং সিদ্ধার্থর জায়গায় জয়দেবকে আনলেন। তৃতীয় উইকেট পার্টনারশিপে একান্ন রান উঠল আট ওভারে। তার মধ্যে মাণ্টুরই চল্লিশ রান। ছেলেদের মুখে হালকা হতাশার ছায়া, ফিল্ডিংয়ে অবশ্য ঢিলেমি পড়েনি। জহর কিন্তু বিব্রত নন। চোদ্দো ওভারে পঁচাশি রান। অনুপ টেনে বল করে যাচ্ছে, রান বেশি দেয়নি। জয়দেব ফ্লাইটে একবার মাণ্টুকে টেনে বের করেছিল, কিঙ্কর স্টাম্প করার চেষ্টা করেও পারেনি। ডিপ পয়েন্ট থেকে শুভ্র সোজা উইকেটে বল মেরেছিল, রান আউট হয়নি। এছাড়া আর কোনও ঘটনা ঘটেনি।

ঘটনা ঘটল পনেরো ওভারের পর ফিল্ডারদের ছড়িয়ে দিতে। মাণ্টুর পার্টনার রান তোলায় পিছিয়ে পড়েছে, এবার তার খেয়াল হল রান তোলার গতি বাড়াতে হবে। জয়দেবের বলে দুটো পুল করে দুটো চার নেওয়ার পর কভারে বল পাঠিয়ে একটা রান নিয়ে দ্বিতীয় রান নেওয়ার জন্য দৌড়ল। মাণ্টু ”নো, নো” বলে চিৎকার করে উঠতে সে দৌড়ের মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টার আগেই কৌশিক বল ছুড়ে দিয়েছে জয়দেবকে। রান আউট।

কৌশিক দু’হাত তুলে সবার সঙ্গে হাতে হাত চাপড়ে হাই ফাইভ করায় ব্যস্ত যখন তখন জহর বললেন, ”আনন্দ করছ বটে, কিন্তু মাণ্টু সিং যতক্ষণ আছে ততক্ষণ কিন্তু বিপদও রয়ে গেছে। আরও দুটো উইকেট কুড়ি ওভারের আগে চাই।”

দুটো নয়, আর একটা উইকেট পড়ল ঠিক কুড়ি ওভারেই। বরকতউল্লা এসে শর্ট রান নিতে শুরু করল। বল করছে কৌশিক মিডিয়াম পেসে। সাদামাঠা বল, মাঝে—মাঝে অফ কাট করে। বরকত ঝুঁকে একটা বল আস্তে ঠেলতে গেল মিড উইকেটে। প্রথম স্লিপে নিচু হয়ে বলটাকে আসতে দেখে জহর সামনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ডান হাতে ক্যাচটা ধরে তিনি চিত হয়ে। বিশ্বাস করতে পারছেন না এমন একটা ব্যাপার করে ফেলেছেন। দুটো ছেলে দুটো হাতে টেনে তাঁকে দাঁড় করাতেই তিনি প্রথম কথা বললেন, ”তা হলে কি আমরা জিতব?” প্রত্যেকের সঙ্গে হাই ফাইভ করলেন। জীবনে এই প্রথম। একশো দু’রানে চার উইকেট। ওম আর বরকত চলে গেছে।

মাণ্টুও চলে গেল জয়দেবকে স্কোয়ার কাট করে। বলটা একটু উঠে গেছল। পয়েন্টে শুভ্র ঝাঁপিয়ে আগুনে গোলার মতো ক্যাচটাকে ধরল। মাণ্টু সাতাত্তর রান করেছে। শুভ্র ব্যর্থ হল বোলিংয়ে। সাত ওভার বল করে চল্লিশ রান দিয়ে উইকেট পায়নি। ব্রাদার্স পাঁচ উইকেটে একশো পঁয়ষট্টি। সৌগত এসেছে। মুখে উপেক্ষার ভাব। গার্ড নিল আম্পায়ারের কাছ থেকে। ব্যাট দিয়ে সযত্নে ক্রিজে আঁচড় টানল। কোমর বাঁকিয়ে সামনে ঝুঁকল, শরীর ঝাঁকিয়ে জোড়াপায়ে লাফাল তারপর স্টান্স নিল। জয়দেব একটু ওভারপিচ করে সোজা একটা আর্মার দিল। সৌগত পিছিয়ে গিয়ে ব্যাট পাতল। বল লাগল প্যাডে। লাফিয়ে উঠে অ্যাপিল করল জয়দেব, তার সঙ্গে কিঙ্কর এবং জহরও। সিদ্ধান্ত নিতে আম্পায়ার পলক ফেলার সময় নিলেন।

”ব্যাড লাক সৌগতদা।” কিঙ্কর সমবেদনা জানাল।

এর পর ব্রাদার্সের ব্যাটসম্যানরা কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত ব্যাটিং শুরু করল। নুরু এসেই আক্রমণ শুরু করল। সিদ্ধার্থর বলে দুটো চার নিল গ্লান্স আর কভারে তুলে মেরে। অলোকও তুলে তুলে মারতে শুরু করল। একশো নব্বইয়ে নুরুর ক্যাচ নিজের বলেই ধরল সিদ্ধার্থ, দু’রান পরে অলোককে সে বোল্ড করল। জয়দেবের বলে কিঙ্কর শেষ দু’জনকে স্টাম্পড করল। ব্রাদার্স অল আউট ঠিক দুশো রানে।

দুশো এক রান তোলা ফুলবাগানের পক্ষে সম্ভব, আবার অসম্ভবও। ওমকিশোর আর বরকত দুটো ঝানু বোলারের সামনে অনভিজ্ঞ ছেলেরা দাঁড়াতে পারবে কি না সে ব্যাপারে জহর নিশ্চিত নন। লিগ ম্যাচে যা দেখেছেন তাতে ভরসা কমই পাচ্ছেন। হেমন্ত গুহ শুকনো মুখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, জহর বললেন, ”ভয় পাচ্ছেন নাকি? আরে না না, আমরা হারব কি, ছেলেরা সেদিন বলল না—জিতব।”

ড্রেসিংরুমের সবাই জহরের কথা শুনে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। জহরের মনে হল ছেলেরা যেন কুঁকড়ে গেছে। ম্যাচ জেতার জন্য চাপটা এবার পেতে শুরু করেছে। কেউই তার মুখের দিকে তাকাতে চাইছে না।

”হল কী তোমাদের?” গম্ভীর স্বরে জহর প্রায় ধমকে উঠলেন। ”মনে হচ্ছে তোমাদের বাড়ি থেকে কারও মরার খবর এসে পৌঁছেছে! দুশোটা রান, কতক্ষণ লাগবে তুলতে? এই উইকেটে ওম, বরকত, সৌগতকে খেলতে পারবে না? গত বছর এই ফাইনালেই শুভ্র হিরো হয়েছিল, সাপোর্টাররা কাঁধে তুলেছিল, আজও তুমি কাঁধে চেপে মাঠ থেকে ফিরবে… পারবে না ফিরতে?”

শুভ্র ফ্যাকাসে হাসি হেসে বলল, ”আগের বছর ওমকিশোর, বরকত ছিল না জহরদা।”

”এ—বছরও নেই। ধরে নাও নেই। গত বছর সেঞ্চুরি করা হয়নি, আজ সেটা করে এসো। … যাও।” জহর অন্য ছেলেদের দিকে তাকালেন। ”সারা সিজন কিছুই করে দেখাতে পারোনি, বছরের আজই শেষ ম্যাচ, … করে দেখাও।”

ফুলবাগান যা করতে শুরু করল তাতে জহরের মুখ কালো হয়ে গেল। ড্রেসিংরুমের বাইরে চেয়ারে বসে দেখতে পাচ্ছিলেন, স্ক্রিনের ধারে ফেন্সিং ঘেঁষে চেয়ারে বসে পানু পোদ্দার, কানু ভটচায আর সুবল মুখুজ্যেকে। তিনজনে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেছে, হাসছে। ফুলবাগানের তিনটে উইকেট পড়ে গেছে সতেরো রানে, পেয়েছে ওমকিশোর, চার রান দিয়ে। দুটো উইকেট বাউন্সার থেকে আর একটা বোল্ড। জহরকে অবাক করেছে শুভ্র। প্রথম বলেই সে বোল্ড হয়েছে। ওমের বলে সে ফরওয়ার্ড খেলেছিল, ব্যাট আর প্যাডের ফাঁক দিয়ে বল গলে আসে। হেলমেট বগলে নিয়ে শুভ্র জহরের পাশ দিয়ে ড্রেসিংরুমে যায়। চোখে জল, জহর মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকেন।

এর পর কৌশিক। বলটা বাউন্স করিয়েছিল ওম। মাথা নামিয়ে ব্যাটটা তাড়াতাড়ি মাথার ওপর তুলে ধরে সে। গ্লাভসে লেগে দ্বিতীয় স্লিপে ক্যাচ যায়। তারপর কিঙ্কর। বাউন্সারে চোখ বুজে হুক করে। বল উঠে যায় বোলারের মাথার ওপর। সমু আর জয়দেব এখন ক্রিজে। পঞ্চম ওভার শেষ হল।

দু’জনেই গুটিয়ে গেছে। সীমায়িত ওভারের খেলা সিকেয় তুলে ওরা পাঁচদিনের খেলার মতো ব্যাট করে যাচ্ছে। ব্রাদার্সের টাইট বোলিংয়ে রান তোলাও কঠিন হয়ে পড়েছে। সৌগত দুটো মেডেন নিয়ে পাঁচ ওভারে মাত্র সাত রান দিয়েছে। বরকতের বলে জয়দীপ দুটো চার মারলেও সে স্বচ্ছন্দ নয়। একস্ট্রা হয়েছে এগারো, বাই ও লেগবাই থেকে। ব্রাদার্স গত বছরের জেতা ম্যাচ হেরে যাওয়ার কথা ভোলেনি। এবার তারা হুঁশিয়ার।

কানু ভটচায সিঁড়ি দিয়ে উঠে ড্রেসিংরুমে যাচ্ছিল, জহরকে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এল।

‘এ কী রে, এখনও প্যাড পরিসনি?” খুব অবাক দেখাল কানুকে। ”ক’ নম্বরে ব্যাট করবি, এগারোয়?’

”হ্যাঁ।”

”ব্রাদার্সকে কীরকম চাবকাচ্ছে দেখেছিস।”

”দেখছি।”

”পানুকে বললুম তোর বাকি টাকাটা দিয়ে দিতে, ‘জহর বুড়ো হয়ে গেছে আর কদ্দিন মাঠে নামবে। ঘোড়া তো অনেক বছর দৌড়ল এবার জিরোক। চাবুক মারার শখটা মিটোতে গিয়ে নিজেই চাবুক খেল। মানুষের সব আশা কি পূরণ হয়!’ পানু বলল, ‘কাল সকালেই জহরদার বাড়িতে টাকাটা পাঠিয়ে দোব।’ আর শোন, কার্ড পাঠিয়ে দেব, আসিস কিন্তু।”

জহর কোনও জবাব না দিয়ে অপমান হজম করলেন। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ফুলবাগান হারছে। সমু আর জয়দেব চেষ্টা করছে উইকেট যাতে না পড়ে, কিন্তু জিততে হলে রান চাই, রান কোথায়? ছাব্বিশ ওভারে একষট্টি রান উঠেছে। এখনও তুলতে হবে একশো চল্লিশ রান চব্বিশ ওভারে, তোলা কি যায় না? যায়, তবে দুটো শচীন টেন্ডুলকর চাই।

জহর চোখ বুজে ছিলেন। বিকট একটা ‘হাউজদ্যাট’ শুনে চোখ খুললেন। ফিল্ডাররা হাই ফাইভ করছে সৌগতর সঙ্গে। জয়দেব ক্রিজ ছেড়ে আসছে।

”কী হল?” জহর জানতে চাইলেন, ব্যাট করতে নামার জন্য তৈরি পার্থর কাছে।

”এল বি হয়েছে।”

সাতষট্টি রানে চার উইকেট গেল। জহর উঠলেন প্যাড পরার জন্য। জয়দেব ড্রেসিংরুমে এসে বলতে শুরু করল, ”ব্যাকফুটে খেলতে গেলুম, কিন্তু হঠাৎ এমন লো হয়ে বলটা—”

”থাক ওসব কথা।” জহর ওকে থামিয়ে দিলেন, ”অভিরূপ রানের রেটটা এবার বাড়াতে হবে, শর্ট রান নিয়ে ফিল্ডিংটা আলগা করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। … এ ম্যাচ হারা চলবে না। উইকেট অনেক ইজি হয়ে গেছে।”

বাইরে আবার একটা চিৎকার। জহরের বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। কে গেল, সমু নয় তো? এখন ব্যাটসম্যান বলতে ওই একটা ছেলেই, যদি আউট হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে আর আশা নেই। গ্লাভস আর ব্যাট হাতে অভিরূপ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, হেমন্ত গুহ ঢুকলেন, মুখে কথা নেই। করুণ চোখে শুধু তাকিয়ে রইলেন জহরের দিকে। ব্যাটটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরোবার সময় জহর শুকনো হাসি হাসলেন। ভরসা দেওয়ার মতো কথা মুখে জোগাল না।

মাথা নিচু করে ফিরে—আসা অভিরূপের পাশ দিয়ে জহর মাঠে নামলেন। সেই সময় শুনলেন, ”বুড়ো এবার চাবকাতে যাচ্ছে।” শুনেই তাঁর মাথাগরম হয়ে গেল। স্কোরবোর্ডটা দেখে নিলেন। সমু ঊনপঞ্চাশ রানে। টোটাল তিয়াত্তর ছয় উইকেটে। এখনও দরকার একশো আটাশ কুড়ি ওভারে। জহর মন্থর পায়ে ক্রিজের দিকে যেতে যেতে আকাশের দিকে মুখ তুললেন। হাবলার সেই ইনিংসটা কি এখন খেলে দেওয়া যায় না? সমু সেট হয়ে গেছে। ও স্ট্যান্ড দিক, একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক।

সমু এগিয়ে এল, মুখে উত্তেজনা নেই, নির্বিকার।

”হাবলা মনে আছে? একদিকটা ধরে রাখ, আমি দেখছি।” জহর বললেন, ”আগে পঞ্চাশটা করে নাও।”

সমু বাধ্য ছেলের মতো মাথা হেলাল। বরকতের প্রথম বলটা জহর ছেড়ে দিলেন। দ্বিতীয় বলটা ঠেললেন কভারে : ”রাইট।” একটা রান। সমু ব্যাট করবে। প্রথম বলটা সে কভারেই হালকাভাবে ড্রাইভ করল। ফিল্ডার কোথায় দেখে নিয়েই জহর ছুটে বেরোলেন। সমু ছোটার জন্য তৈরি ছিল না। যখন ছুটল তখন ফিল্ডার বল তুলছে। বোলারের গা ঘেঁষে ছোড়া বলটা যখন বেরিয়ে গেল সমু তখন পপিং ক্রিক থেকে তিন গজ দূরে। অবধারিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলে যা হয়, ওর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল, তারপরই রক্ত ছুটে এল। চোখে ফুটে উঠল অতিরিক্ত জীবন পাওয়ার দুর্জয় আত্মপ্রত্যয়। হঠাৎ পাওয়া একটা সাহস তাকে বেপরোয়া হতে উসকে দিল।

তার হাফসেঞ্চুরি হল। কিছু হাততালি উঠল। সমু ব্যাটটা একটু তুলল। ওভার শেষ, এবার তাকে বল করতে এল সৌগত। জহর তৈরি হলেন শর্ট রান নেওয়ার জন্য। এখন তিনি স্ট্রাইক চান, এখন তিনি চালিয়ে খেলবেন। আবার হাবলার ইনিংসটা এখন তাঁকে খেলতে হবে। পারবেন, যদি সমু ওদিকে টিকে থাকতে পারে।

সৌগতর প্রথম বলটা তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে বাউন্ডারির বাইরে পড়ল। চোখ পিটপিট করে ভ্রূ কুঁচকে সমুর দিকে তাকিয়ে সে ঠোঁট মুচড়ে হাসল। ভাবখানা, এইবার তোমাকে পেয়েছি। কতক্ষণ আর নিজেকে সামলে রাখবে! লং অন আর লং অফে নুরু ফিল্ডার রাখল। পরের বলটাও সৌগতর মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে আগের জায়গাতেই পড়ল। সৌগত হাসল, তার তৃতীয় বলটা একইভাবে উড়ে আর একটু দূরে কংক্রিট গ্যালারিতে পড়ে ‘ঠকাস’ শব্দ তুলল। সৌগত আর হাসল না, বরং জহরের মুখে আতঙ্ক ফুটে উঠল। করছে কী সমু! চতুর্থ বলটা শর্ট লেংথে, সমু বিদ্যুৎগতিতে পুল করল, স্কোয়ার লেগ বাউন্ডারিতে বল গেল। চার বলে বাইশ রান!

সৌগতর চোখে বিভ্রান্তি, এবার কোথায় বল ফেলা যায়? অফস্টাম্পের অনেক বাইরে সে বল ফেলল, ছেড়ে দিলে আম্পায়ার নির্ঘাত ওয়াইড দেখাতেন। সমু ছাড়েনি। কাট করা বলটা পয়েন্ট বাউন্ডারির ফেন্সে লেগে মাঠে ফিরে এল। নুরু ছুটে এসে সৌগতর সঙ্গে কথা বলে গেল। জহর শুনলেন উত্তেজিত নুরু বলছে, ”আর কটা লোক বাউন্ডারিতে রাখব?” ষষ্ঠ বলটা সমু ফরওয়ার্ড খেলল অনেকটা ঝুঁকে। বোলারের কাছে বল গেল। রান হল না।

জহর কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলেন। তিনি কিছু বলার আগেই সমু উত্তেজনায় থরথর স্বরে বলল, ”হাবলায় আমি যে খেলাটা খেলেছিলাম, এখন আপনি সেইটে খেলুন। আরও একশো রান দরকার, তুলে নিতে হবে।”

স্তম্ভিত জহর নির্বাক রইলেন।

তারপর যা ঘটতে শুরু করল, পরদিন আনন্দবাজারে হেডিংয়ে সেটাই উঠে এল, ‘নন্দন কাননে দক্ষযজ্ঞ’ ; আজকালের হেডিং হল, ‘ইডেন সমরাঙ্গন’। সমু তাণ্ডব নাচ নাচল ব্যাট হাতে। চোদ্দো ওভারে একশো রান উঠে এল। এই একশোর মধ্যে একস্ট্রা চার রান, জহরের অবদান পাঁচ রান, সমুর একানব্বই। ন’টা ছয় আর সাতটা চার আছে তার একশো একচল্লিশ রানে। জহর যখন ফাইন লেগ থেকে একটা রান নিয়ে ম্যাচ শেষ করে দিলেন তখনও ফুলবাগানের খেলার জন্য একত্রিশ বল রয়েছে। ড্রেসিংরুমে প্যাড পরে অপেক্ষায় রয়েছে তিনজন।

এক রানটা নেওয়ার পরই জহর হাঁটু মুড়ে বসে পড়েন। ব্যাটে ভর রেখে ঝুঁকে পড়ে তাঁর দেহ। বুকের মধ্যে একটা টর্নাডো তাঁর পাঁজরাগুলোকে খুলে ফেলছে মেরুদণ্ড থেকে। পিঠে একটা হাত পড়ল।

”জহরদা, আমরা পেরেছি।”

হইহই করে মাঠের মধ্যে লোক ছুটে আসছে। উন্মত্তের মতো তারা চেঁচাচ্ছে। সমুকে নিয়ে লোফালুফি শুরু হল। হাততালি দিচ্ছে মাণ্টু, ওম, বদর। জহরের দিকে কেউ দৃকপাতও করল না। সবাই ব্যস্ত সমুকে নিয়ে। এই ভাল, জহর ভাবলেন, আমার কাজ আমি করেছি। এইভাবেই একষট্টি বছরে পৌঁছতে পারলে আমার ক্রিকেটজীবন সার্থক হবে। বুড়ো ঘোড়াটাকে আরও কটা বছর কি ছোটাতে পারব না?

ফেন্সিংয়ের ধারে তিনটে চেয়ার খালি। তিনটে লোকের বদলে জহরের সঙ্গে দেখা হল একটা লোকের—বেজা।

”তুই!”

”অফিস কেটে চলে এলুম। জহর রে, আজ পেট ভরে ফিরপোর খাবার খেলুম, কী ভাল যে লাগল?” জহরের দুই মুঠো বেজা নিজের বুকে চেপে ধরল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *