নষ্টচন্দ্র

নষ্টচন্দ্র

(ফরাসী হইতে অনূদিত)

তারা মাটী ফুঁড়ে উঠল -এক, দুই, তিন ক’রে ছ’জন— বৃষ্টির ও সাঁঝের বন্যার মধ্যে।

তারা জলের ভিতর থেকে বেরুল বলেই হয়। বাস্তবিক একমাস ধরে এমন অনবরত বৃষ্টি হচ্ছিল, যে ঝোপ জঙ্গল সব ডুবে গেছে। দেবাঞ্জারোস ও আদ্রিয়ানোপলের চারিদিকে যে প্রান্তর, সেটা বৃষ্টিতে সমুদ্রের মতন দেখাচ্ছে।

গোধূলির হলদে ধূলায় তাদের দেখাচ্ছিল যেন এক একজন এক কাঁড়ি ভেড়ার চামড়া। তার ভিতর থেকে ক্ৰিচের ডগাটা চক্ মক্ করে উঠছিল। সকলের মাথায় প্রকাণ্ড অস্ত্রখানী টুপী-তার চাকতিটা সবুজ।

এরা মাসিডোনিয়ার পাহারাদার সৈন্য; এখন বুলগেরিয়ার সৈন্য দলে কাজ করে। তারা লাইনের আগে যাচ্ছিল।

মধ্যে মধ্যে ঘোলাটে জলের ঘূর্ণী। তারা পা টিপে টিপে সাবধানে চলছিল। তাদের প্রকাণ্ড দুখানা হাত বাতাসের যাতা কলের পাখার মত নড়ছিল। মধ্যে মধ্যে তারা ক্রুশের চিহ্ন করছিল। হিংস্র জন্তুর মত তাদের প্রকাণ্ড ঘোলা চোখ চিরে তারা একবার ডাইনে, একবার বাঁয়ে তাদের কালো থোবনা ফিরিয়ে দেখ ছিল। পঞ্চাশ পা দুরে একটা ভাল চকচকে কাদায় পোতা ছিল। সেটা হেলছিল দুলছিল ! মাসিডোনিয়ার সৈন্যরা একটা ট্রেঞ্চের দিকে যাচ্ছিল। এই ডালটী ছিল তার সঙ্কেত চিহ্ন।

এই ট্রেঞ্চের এখন আর কোনও ব্যবহার নেই। সারজেন্ট নারিচ আর তার পাঁচজন লোক তার ভিতর ঢুকে এই সঙ্কেত করছিল। এই ছ’জন বুলগার সেই ছ’জন মাসিডোনিয়ার সৈন্যদের বন্ধু। দিপ্লোভিচ এবং কালুব অনেক দিনের পুরানো সঙ্গী। বুড়ো ডাকাত আলেকসিস এক সময় নরিচের আইনের মাষ্টার ছিল। পোত্রোফ আর রেফ নিকট আত্মীয়। তাদের প্রথম সাক্ষাতে নিজেদের পরিচয় দিতে দিতে তারা হাসতে হাসতে চোখের জল ফেলেছিল। সোলমান আর নাজিফ আত্মীয়ের চেয়েও নিকট সম্পৰ্কীয় ছিল—তারা যাকে ভালবাসত, তার খুনের প্রতিহিংসা নিতে তারা দুজনেই প্রতিজ্ঞা ক’রেছিল।

অবরোধের গোড়া থেকেই এই বার জন সৈন্য রাত্রির অন্ধকারে এসে মিলত। তখন গোল গুলি অন্ধ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে; তাই তাদের সুযোগ ছিল।

তারা সেই পুরানো ট্রেঞ্চে এসে মিলল। সেটা এখন অকেজো ছিল। সেখানে কাদায় দাঁড়িয়ে একজন আর একজনের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াল। হিংস্র অথচ গম্ভীর মুখে তারা ভাই ভাইয়ের মত আলাপ করতে লাগল। একজন বল্লে, “লড়াইটে লম্বা হয়ে চলল।” আর একজন বল্লে, “ভগবান্ করুন যেন তুর্কীদের সর্ব্বনাশ হয়।”

আর কোনও কথাবার্তা নেই। বারজন লোক পাশ পাশি দাড়িয়ে নিঝুম হয়ে চিন্তা করতে লাগল। তাদের মন ভার, মাথা ভারী। তারপর তারা বিদায় হয়ে দুই দল দুই পথ দিয়ে তাদের তাঁবুর দিকে রওনা হল।

সে দিন সন্ধ্যায় এই সৈনিক বন্ধুরা তাদের মিলনের মাঝে কেমন যেন বিষ ছিল! অনবরত বৃষ্টি, কনকনে ঠাণ্ডা, তার উপর এক রকম নতূন বিরক্তি আশ্চর্য রকমে তাদের কাবু করে ফেলেছিল।

“লড়াই আর শেষ হবে না।” কালুব এই কথাগুলি এমন মুখ সিটকে বল্লে, যে তার বারুদের মত কালো মুখখানা একেবারে কুঁচকে গেল।

“কখখনই না, নাজিফ উত্তর করলে। সেই সঙ্গে সঙ্গে সে একটা নেকড়ে বাঘের মতন প্রকাণ্ড হাই তুললে।

তারা সকলে মাথা নীচু করে একটু কালে। যখন মন দুঃখে ভরে যায়, তখন তারা এ রকম করে। তারা একবার নীচে একবার উপরে নানা অদ্ভুত জিনিসের কথা ভাবতে লাগল।

কালুব বলে উঠল, “চাঁদটা-শত্রুর নিশানের নতুন চাঁদের মতন দেখা যাচ্ছে। কেউ যেমন গান করে এমন ভাবে তার গলার স্বরটা বদলে গেল।

“কুলক্ষণ।” বুড়ো ডাকাত আলেসিস বলে উঠল তার জীবন মরণের অভিজ্ঞতা অনেক হয়ে গেছে। “এ যে নষ্টচন্দ্র”।

নষ্টচন্দ্র যাদের উপর নজর দেয়, কেমন করে তাদের সে কলে কৌশলে মারে—তার এক গল্প সে করলে।

তারা সকলেই মাথা তুলে মিট মিট করে শোকের কাল কাপড়ে ঢাকা নতুন চাঁদের দিকে তাকাল।

“চাঁদের সঙ্গে ঠাট্টা করতে নেই,” পোত্রোফ গলা ভার করে বল্লে। যদিও তার চুল সাদা হচ্ছিল, সে অল্প দিন হ’ল বিয়ে করেছে। আমাদের সর্ব্বনাশ !”

“আমার ঘুম পেয়েছে ,” রেফ কচি ছেলের মত কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে।

“চল ফিরে যাই ,” আলেকসিস রুক্ষ গলায় বলে উঠল।

সে তার চামড়ার পোষাকে সঙ্গীনটা পুরলে। মাসিডোনিয়ানদের কোমরবন্ধ ছিল না; তারা এই রকম করে কাঠের ছুরি, কাঁটা আর, সঙ্গীন রাখত।

এক এক করে মাসিডোনিয়ার সৈন্যেরা বিদায় হল। বুলগারেরা তাদের দিকে তাকিয়ে বিদায়ের জন্য দুঃখ করতে লাগল। তারপর তারা সেখান থেকে না গিয়ে সেই খাতের মধ্যে রয়ে গেল। নষ্ট চাঁদ দেখেছে বলে তাদের কেমন একটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল। তারপর শরীরটাও তাদের খুব ক্লান্ত ছিল। মনে কেমন একটা অজানা ভয় তাদের পেয়ে বসেছিল।

প্রত্যেকে যেন স্বপ্ন দেখছিল। সারজেন্ট নারিচ দেখছিল তার ছোট বাড়ীটী। তাতে তার স্ত্রী ফুলের মালঞ্চের মত রঙ বেরঙের জমকালো পোষাকে রয়েছে। সে আরও দেখলে একটী গলির মোড়। সেখানে একটা ছোট হাসি একটা সোনালী মাথার আসার কথা জানিয়ে দিচ্ছে। সে যেন গাছের বেড়ার গন্ধ টের পাচ্ছিল। সে চিনে ফেললে ছোট উইলো গাছগুলিকে যেগুলি ঝরণার পাশে একদল খাট লোকের মত দাঁড়িয়ে ছিল।

সে হঠাৎ মুখখানা ভার করলে, চোখ দুটো রগড়ালে। সে ছায়া ছাড়া আর কিছু দেখতে পেলে না। সেই ছায়ার অপর দিকে নতুন চাঁদের চোখ ডগা তলোয়ারের মতন ঝিক্ মিক্‌ ক’রছে।

সে চমকে উঠল। লোকে কি ভাবছে। তার যে দেরী হয়ে গেছে। ঐ বুঝি তাদের পিছু পিছু কর্ণেল এলেন তাড়াতাড়ি গটমট করে, আগুনের মত লাল সঞ্জাব দেওয়া খাকি পোষাক নাড়তে নাড়তে। খবরদার!

“চল, রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি।” তারা নড়ল। হাই, তুলে তুলে তাদের চোখ ছল ছল করছিল। কিন্তু মুখখানা চিন্তায় কোঁচকান। তারা খাতের ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে চলল।

তারা চলছে; চলছেই। মুখের উপর বৃষ্টির মুখোস। তার ভিতর দিয়ে চোখ চিরে তারা দেখছে আর এক একবার আড়ে আড়ে চাঁদের দিকে তাকাচ্ছে।

ব্যাপার খানা কি ? এখনও কোন শান্ত্রী নেই। তারা থমকে দাড়াল। তারা পথ হারিয়ে ফেলেছে। দোষ চাঁদের, তার আধা আলো, আধা আঁধারের। তাতে তারা ভুল করেছে। তাদের গা শিউরে উঠল। তারা ফিরে চলল। পাকের ভিতর থেকে উচু করে পা বার করতে হচ্ছিল। তারা গর্ত ডোবা সাবধানে এড়িয়ে চলছিল। আধ ঘণ্টা হ’ল অথচ কোনও আগুনই দেখা যায় না, কিছুই না।

তারা সেই প্রান্তরে তাদের গন্তব্য স্থান ভাল করে ঠাওরাতে চেষ্টা করলে। তারা আবার নতুন করে সামনে মাথা হেট করে হনহন ক’রে চল।

হঠাৎ বন্দুকের আওয়াজ। সারজেন্ট দিব্যি করে উঠল। সে এপাশ ওপাশ চাকার মতন ঘুরতে লাগল।

“আমরা তুর্কিদের লাইনে এসেছি !” অন্য সময় হলে এটা অসম্ভব বলে বোধ হত। তারা অল্পক্ষণ হ’ল ট্রেঞ্চ, ছেড়ে এসেছে। চাঁদের শত্রুতাই এই সব ব্যাপারের মূল ! তারা মাথা নাড়তে লাগল। কালুব রুক্ষভাবে ব’লে, “আমাদের সকলের একই সময়ে তাঁবুতে ফেরা দরকার ছিল। মাসিডোনিয়ার লোক নাকে শু’কে ঠিক পথ চিনে।”

তারা থমকে দাঁড়াল।

“আঃ! দিপ্লোভিচ হাঁপাতে হাঁপাতে বল্লে। “শত্রু আমাদের জন্য ওত পেতে রয়েছে”।

মেঘের ফাঁক দিয়ে চাঁদের ঘোলা আলোয় তারা দেখলেসামনে যেখানে গলার আওয়াজ যেতে পারে, এত দূরে একটা জঙ্গলের ধারে সারি দিয়ে দাঁড়িয়ে কতক গুলি সৈনিকের অস্পষ্ট ছায়ার মতন মূর্তি।

একজন বুলগার একটা ভয়ানক দির‍্যি করে উঠল।

এত দিন অপেক্ষা করার পরে লড়াইয়ের গন্ধ পেয়েছে বলে তারা আনন্দে চীৎকার করে উঠত; কিন্তু অতি কষ্টে তারা থেমে গেল। চাঁদ তাদের শত্রুর গুপ্ত স্থানে নিয়ে এসেছে। তাতে আর সন্দেহ কি ?

নারিচ চাপা গলায় গুলি চালাতে হুকুম দিলে। কিন্তু শই প্রথমে গুলি ছোড়া শুরু করলে। তারা যেন নারিচের কথা শুনতে পেয়েছিল।

পোত্ৰোফ উহু করে উঠল। লোকটা সবে বিয়ে করে এসেছে। সে দু’হাতে পেট চেপে ধরে টলতে লাগল। কিন্তু সে মাথা নেড়ে জানালে তার কিছুই হয় নি।

দু দিক থেকে দুড়ুম্ ‘দুড়ুম্ আওয়াজ হতে লাগল। শীগ্গির তারা মাটীতে পড়তে লাগল। সকলের শেষে যে দাঁড়িয়েছিল, সে ঝুঁকতে ঝুঁকতে মাটীতে শুয়ে পড়ল। তার যন্ত্রণায় যোরে বোধ হল যেন কিছু দূরে যারা তাকে খুন করছে তাদের মধ্যে কেউ কাতরাতে কাতরাতে তার নাম নিচ্ছে। মৃত্যুর ঘড়ঘড়ানি দুই পক্ষ থেকে উঠল, তারপর আস্তে আস্তে ক্ষীণ হয়ে এল, পরে গানের মত ধীরে ধীরে মিলে গেল।

একদল সন্ধানকারী সৈন্য লণ্ঠন দোলাতে দোলাতে সেখানে এসে হাজির। তখন সব ঠাণ্ডা, সব বোবা।

বারটী লাস। এখানে দু’জন মাসিডোনিয়ান, সেখানে ছ’জন বুলগার। নষ্ট-চন্দ্রের কুসংস্কারে হতবুদ্ধি হয়ে তারা কেউ তাঁবুতে ফিরতে পারে নি। দুই দলের লোককে ছায়ার মত দেখা গিয়েছিল। তারা অন্ধের মত পরস্পরকে খুন করলে; তার। চিলে না, তারা জানলে না যে তারা বন্ধু। তারা বুঝলে না যে তারা ভাই। লড়াইয়ে এমন হামেশাই হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *