১২. এনডেভারের হাসপাতাল

শারমিন এনডেভারের হাসপাতালের সবুজ রঙের একটা গাউন পরে শীতে তিরতির করে কাঁপছিল, সে দুটি হাত তার বুকের কাছে ধরে রেখেছে। চারপাশে অসংখ্য মানুষের ভিড়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কম বয়সী তরুণ-তরুণী। সুহানা নেটওয়ার্কিং ল্যাবের কম্পিউটারের লগ দেখে পুরো ব্যাপারটা আন্দাজ করে ফেসবুকে, টুইটারে খবরটা ছড়িয়ে দিয়েছিল। এনডেভারের ভেতর ঈশিতা, রাফি আর শারমিনকে আটকে রাখা হয়েছে, আর শারমিন হচ্ছে সম্ভাব্য সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গণিতবিদ—এ তথ্যটি জানাজানি হওয়ার পর হাজার হাজার কম বয়সী ছেলেমেয়ে এনডেভারের সামনে ভিড় করেছে। পুলিশ সেই ভিড়ের কাছ থেকে রক্ষা করে ঈশিতা, রাফি আর শারমিনকে একটা অ্যাম্বুলেন্সের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝখানে অনেকগুলো টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান তাদের থামাল। একজন জিজ্ঞেস করল, এই মেয়েটিই কি সেই প্রতিভাবান মেয়ে শারমিন?

রাফি উত্তর দিল, হ্যাঁ।

এটি কি সত্যি, সে মুখে মুখে যেকোনো সংখ্যার সঙ্গে যেকোনো সংখ্যা গুণ করতে পারে?

রাফি বলল, হ্যাঁ। এটা সত্যি।

আমরা কি তার একটা প্রমাণ দেখতে পারি।

ঈশিতা বলল, মেয়েটি অত্যন্ত টায়ার্ড। তার ওপর দিয়ে কী গিয়েছে, আপনারা সেটা কল্পনাও করতে পারবেন না। তাকে হাসপাতালে নিতে দিন। প্লিজ!

একজন সাংবাদিক বলল, অবশ্যই দেব। শুধু ছোট একটা ডেমনস্ট্রেশান, আমাদের দর্শকদের জন্য।

রাফি জিজ্ঞেস করল, কী দেখতে চান?

দুটি সংখ্যা গুণ করে দেখাতে বলেন।

আপনারা বলেন দুটি সংখ্যা।

একজন সাংবাদিক বলল, উনিশ শ বাহান্নর সঙ্গে উনিশ শ একাত্তর গুণ করলে কত হয়?

শারমিনকে কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়। সে কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আটচল্লিশ লাখ—আটচল্লিশ লাখ সাঁইত্রিশ হাজার—পাঁচ শ বারো।

রাফি অবাক হয়ে শারমিনের দিকে তাকিয়ে রইল। সে কখনোই শারমিনকে কোনো সংখ্যাকে গুণ করতে গিয়ে ইতস্তত করতে দেখেনি। সাংবাদিকদের একজন তার মোবাইল টেলিফোনের ক্যালকুলেটর বের করে গুণ করে মাথা নেড়ে বলল, হয়নি!

রাফি গতবাক হয়ে যায়। হয়নি?

না।

কী আশ্চর্য। শারমিন এর চেয়ে অনেক বড় সংখ্যা গুণ করতে পারে।

আরেকবার চেষ্টা করে দেখুক।

ঠিক আছে।

ওই সাংবাদিক বলল, দশমিকের পর পাইয়ের একশতম সংখ্যা কী?

শারমিন কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে তারপর দ্বিধান্বিত গলায় বলে, ছয়?

উঁহু হয়নি। সাংবাদিক মাথা নাড়ে, আমি ইন্টারনেটে দেখেছি, দশমিকের পর একশতম সংখ্যা হচ্ছে নয়।

ঈশিতা এবার এগিয়ে গিয়ে সাংবাদিকদের থামাল, বলল, আপনারা এবার বাচ্চাটিকে যেতে দিন।

কিন্তু সে কেন পারছে না?

রাফি ইতস্তত করে বলল, হয়তো, হয়তো সে খুব ক্লান্ত। কিংবা হয়তো তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

তাহলে কি আর সে কখনোই পারবে না?

আমরা জানি না।

আগে কি সত্যি পারত?

রাফি বিরক্ত হয়ে বলল, আমি সেটা নিয়ে আপনার সঙ্গে তর্ক করতে চাই না।

পুলিশ সাংবাদিকদের সরিয়ে তাদের তিনজনকে সামনে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেয়।

অ্যাম্বুলেন্সের বিছানায় শারমিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। রাফি তার হাতটা ধরে রেখেছে। সাইরেন বাজাতে বাজাতে অ্যাম্বুলেন্সটি ঢাকার রাজপথ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। শারমিন হঠাৎ চোখ খুলে বলল, স্যার।

বলো।

ওই খারাপ মানুষগুলো এখন কোথায়?

সবাইকে পুলিশে ধরেছে।

সবাইকে?

মনে হয় সবাইকে। এক-দুজন হয়তো পালিয়েছে, পুলিশ তাদেরও ধরে ফেলবে।

শারমিন বলল, সত্যি ধরতে পারবে তো?

হ্যাঁ। পারবে। রাফি হাসল। বলল, তুমি চিন্তা করো না।

শারমিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার ডাকল, স্যার।

রাফি শারমিনের হাত ধরে বলল, বলো, শারমিন।

আমি যে আর বড় বড় গুণ করতে পারছি না, সে জন্য কি আপনার মন খারাপ হয়েছে?

রাফি বলল, না, ঠিক অন। খারাপ না। কিন্তু তোমার এত অসাধারণ ক্ষমতাটা ওই বদমাইশগুলো তাদের যন্ত্রপাতি দিয়ে যদি নষ্ট করে থাকে—

শারমিন বলল, না, নষ্ট করেনি।

নষ্ট করেনি?

না। আমি টেলিভিশনের লোকগুলোকে ইচ্ছে করে ভুল উত্তর দিয়েছি। উনিশ শ বাহান্নকে উনিশ শ একাত্তর দিয়ে গুণ করলে হয় আটত্রিশ লাখ সাতচল্লিশ হাজার তিন শ রিরানব্বই!

সত্যি?

হ্যাঁ। আর পাইয়ের এক শ নম্বর সংখ্যা আসলেই নয়। এরপর আট, এরপর দুই, তারপর এক, তারপর চার আট শূন্য আট—আমি যখন খুশি, বের করতে পারি!

ঈশিতা এগিয়ে এসে শারমিনের মাথায় হাত দিয়ে বলল, তুমি টেলিভিশনের লোকগুলোকে কেন ভুল উত্তর দিলে?

তাহলে লোকগুলো আর কোনো দিন আমাকে নিয়ে হইচই করবে না। সারা পৃথিবীতে আমি কাউকে এটা বলতে চাই না। সবাইকে বলব, আমি পারি না। শুধু আপনারা দুজন সত্যি কথাটা জানবেন। ঠিক আছে?

রাফি নরম গলায় বলল, ঠিক আছে শারমিন, এটা হবে আমদের তিনজনের গোপন কথা। আমরা আর কাউকে বলব না।

শুধু—শুধু— শারমিন থেমে গেল।

শুধু কী?

আমার যদি অনেক অঙ্ক করার ইচ্ছে করে তাহলে আমাকে অঙ্ক বই এনে দেবেন।

অবশ্যই। লুকিয়ে লুকিয়ে তোমাকে আমি ভেক্টর, টেনসর শেখাব। কমপ্লেক্স ভেরিয়েবল শেখাব, ক্যালকুলাস শেখাব। তুমি ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশন সলভ করা শিখবে, তুমি নাম্বার থিওরি শিখবে—

ঈশিতা রাফির হাত ধরে থামাল, বলল থাক থাক। বাচ্চা মেয়েটাকে আর উত্তেজিত করো না!

ঠিক আছে, আর উত্তেজিত করব না। শারমিন তুমি এখন ঘুমাও।

ঠিক আছে। শারমিন চোখ বন্ধ করল। তার মুখে শুধু একটা মিষ্টি হাসি লেগে রইল।

 

আবছা অন্ধকারে রাফি আর ঈশিত পাশাপাশি বসে থাকে। রাফি বুঝতে পারে, ঈশিতার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপছে। সে নিচু গলায় ডাকল, ঈশিতা।

বলো, রাফি।

আমি তোমাকে ধরে রাখব?

রাখো।

রাফি তখন হাত দিয়ে ঈশিতাকে শক্ত করে ধরে রাখে। ঈশিতা ফিসফিস করে বলল, রাফি।

বলো।

তুমি সারা জীবন আমাকে এভাবে ধরে রাখবে?

রাখব।

কথা দাও।

কথা দিলাম।

অ্যাম্বুলেন্সটি তখন এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। ঈশিতা খুব সাবধানে তার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের কোণাটি মুছে নিল।

1 Comment
Collapse Comments

অসাধারন বলার ভাষা রাখেনা..আমার খুব ভালো লেগেছে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *