০৮. বড় কালো একটা টেবিল

বড় কালো একটা টেবিলের এক মাথায় ঈশিতা বসে আছে। অন্য মাথায় বসেছে বব লাস্কি। ঈশিতার ঠিক পেছনে দুজন পাহাড়ের মতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, একজন ধবধবে সাদা, অন্যজন কুচকুচে কালো। টেবিলের দুই পাশে বেশ কিছু মানুষ, সবাই বিদেশি। ঈশিতা তাদের অনেককেই চিনতে পারল, একটু আগে সে তাদের ধোকা দিয়ে ছবি এবং ভিডিও তুলে এনেছিল। মানুষগুলো এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে আছে।

বব লাস্কি একটু সামনে ঝুঁকে বলল, বলো মেয়ে, তুমি কেমন করে এনডেভারে ঢুকেছ?

ঈশিতা কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে বব লাস্কির দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, বব, সে এখানকার এমপ্লয়ি। তার সর্বোচ্চ সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স আছে। সে সেন্ট্রাল দরজা দিয়ে হেঁটে ঢুকে গেছে।

বব লাস্কি বলল, এটুকু আমিও জানি। কিন্তু সমস্যা হলো, সে এখানকার এমপ্লয়ি না। আমরা তাকে এখানে চাকরি দিইনি, সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স তো দূরের কথা।

দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল বলল, আমি নিজের চোখে দেখেছি, তার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স আছে।

আমি সেটাই জানতে চাচ্ছি, কেমন করে আমাদের সিস্টেম তাকে এত বড় ক্লিয়ারেন্স দিল। কে দিল?

টেবিলের এক কোনায় একজন একটা ল্যাপটপে ঝুঁকে কাজ করছিল। সে বলল, আমাদের কেউ দেয়নি, স্যার। আমি পুরো সিস্টেম চেক করেছি।

বব লাস্কি টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, তাহলে কে দিয়েছে?

মানুষটা ল্যাপটপে আরও ঝুঁকে পড়ে বলল, আমাকে দুই মিনিট সময় দেন, স্যার। আমি সিস্টেমের পুরো লগ বের করে আনছি। ঠিক কীভাবে সে সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স পেয়েছে, আমি বের করে ফেলছি।

বব লাস্কি এবার ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি আমার রেকর্ড থেকে বের করে দেখেছি, তোমার নাম হচ্ছে ঈশিতা। তুমি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলে।

ঈশিতা কোনো কথা বলল না। বব লাস্কি বলল, এনডেভার একটা প্রাইভেট কোম্পানি। এখানে বাইরের কেউ ঢোকার কথা নয়। তুমি এখানে ঢুকে পুরোপুরি বেআইনি কাজ করেছ।

ঈশিতা এই প্রথমবার মুখ খুলল। বব লাস্কির দিকে তাকিয়ে বলল, সত্যিই যদি আমি বেআইনি কাজ করে থাকি, আমাকে পুলিশে দাও। আরও ভালো হয়, যদি পুলিশকে এখানে ডেকে নিয়ে এস।

বব লাস্কি বলল, তুমি খুব ভালো করে জানো, আমরা তোমাকে পুলিশে দেব না। তোমাদের দেশের আইন-কানুনের ওপর ভরসা করে আমরা এখানে এত বড় একটা প্রতিষ্ঠান শুরু করিনি। যেটুকু আইনের সাহায্য দরকার, সেটুকু আমরা ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছি, ক্যাশ ডলার।

ঈশিতা জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমাকে এই তথ্যটুকু দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, মিস্টার লাস্কি।

তোমাকে এই তথ্যটা দিচ্ছি, কারণ এটা কোনো দিন তোমার ভেতর থেকে বের হবে না।

ঈশিতার বুক কেঁপে উঠল, মুখে সেটা সে প্রকাশ হতে দিল না। জিজ্ঞেস করল, কেন বের হবে না?

কারণ, তুমি বলে এই পৃথিবীতে কারও অস্তিত্ব থাকবে না।

তুমি আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছ?

বব লাস্কি বলল, হুমকি নয়, আমি তোমাকে জানাচ্ছি।

ঈশিতা টেবিলের দুই দিকে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই অনেক বড় বিজ্ঞানী কিংবা ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ম্যাথমেটিশিয়ান। পৃথিবীর সেরা সেরা জার্নালে নিশ্চয়ই তোমাদের গবেষণা পেপার ছাপা হয়েছে। অথচ তোমরা চুপচাপ বসে দেখছ, এই মানুষটি আমাকে খুন করে ফেলার কথা বলছে। তোমাদের কারও ভেতর এটা নিয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই?

নীল চোখের মানুষটি শব্দ করে হেসে উঠে বলল, মেয়ে, তুমি ব্যাপারটাকে কেন ড্রামাটিক করার চেষ্টা করছ, কোনো লাভ নেই। হিরোশিমার ওপর যখন এনোলা গে থেকে পৃথিবীর প্রথম নিউক্লিয়ার বোমা ফেলা হয়েছিল, তখন সেই পাইলটদের হাত একটুও কাঁপেনি। তারা এক মুহূর্তে এক লাখ লোক মেরেছিল, কিন্তু তাদের কারও মনে হয়নি, তারা হত্যাকারী। বিশ্বযুদ্ধ শেষ করার জন্য সেই হত্যাকাণ্ডের দরকার ছিল। এখানেও তা-ই।

ঈশিতা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বলল, এখানেও তা-ই?

হ্যাঁ। পৃথিবীর সভ্যতা আর কম্পিউটার এখন সমার্থক। মাইক্রোপ্রসেসরের ক্ষমতা বাড়তে বাড়তে এক জায়গায় থেমে যাচ্ছে, কোয়ান্টাম মেকানিকস বলছে, আর ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব নয়। অথচ আমাদের মানুষের মস্তিষ্ক এসব কম্পিউটার থেকে হাজার-লক্ষ গুণ শক্তিশালী। আমরা সেটাকে যন্ত্রপাতির সঙ্গে জুড়ে দিতে শিখিনি। যখন জুড়ে দিতে পারব, তখন পৃথিবী থেকে কনভেনশনাল কম্পিউটার উঠে যাবে। এই কম্পিউটারের তুলনায় সেটা হয়ে যাবে একটা খেলনা।

বব লাস্কি বলল, জর্জ, তুমি যেন শুধু শুধু এই মেয়েটার সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করছ।

জর্জ নামের নীল চোখের মানুষটি বলল, সময় নষ্ট করছি, কারণ এই মেয়ে আমাদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছি, মানুষের ভবিষ্যৎ সভ্যতার জন্য যে গবেষণার দরকার, আমরা সেই গবেষণা করছি। পৃথিবীর মানুষ সেই গবেষণার কথা শুনতে এখনো প্রস্তুত হয়নি, সে জন্য আমরা থেমে থাকব না।

জর্জ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ল্যাপটপ হাতে মানুষটি একটা আর্তচিৎকারের মতো শব্দ করল। বব লাস্কি বলল, কী হয়েছে?

মানুষটা ভাঙা গলায় বলল, আমি এটা বিশ্বাস করি না।

তুমি কী বিশ্বাস করো না?

এখানে যেটা ঘটেছে।

এখানে কী ঘটেছে?

গতকাল সকাল নয়টা তিরিশ মিনিটে কেউ আমাদের সিস্টেমে ঢুকেছে। ডেটাবেস থেকে এনক্রিপটেড পাসওয়ার্ড ডাউনলোড করেছে নয়টা সাতান্ন মিনিটে। দশটা বিয়াল্লিশ মিনিটে পাসওয়ার্ডকে ডিক্রিস্ট করে সিস্টেম ব্রেক করেছে।

টেবিলের চারপাশের সব মানুষ পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। মনে হলো, ঘরের মধ্যে একটা বজ্রপাত হয়েছে। বব লাস্কি অনেক কষ্ট করে বলল, কী, কী বললে? আমাদের এনক্রিপশান ডিকোড করেছে?

হ্যাঁ।

আ-আ-আমাদের এনক্রিপশন?

হ্যাঁ।

এক ঘণ্টার কম সময়ে?

হ্যাঁ।

কোন পদ্ধতিতে? কোন কম্পিউটার ব্যবহার করেছে?

ল্যাপটপের মানুষটি দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শব্দ করল। তারপর বলল, কোনো পদ্ধতি নয়, সরাসরি। কোনো একজন মানুষ কি-বোর্ডে একটা একটা সংখ্যা টাইপ করেছে।

বব লাস্কি এখনো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারল না। বলল, কোনো একজন মানুষ? এক ঘণ্টার ভেতর আমাদের এনক্রিপশন ভেঙেছে?

হ্যাঁ।

আমরা হাফ বিলিয়ন ডলার দিয়ে যেটা তৈরি করিয়েছি? যেটা সারা পৃথিবীতে ব্যবহার করে?

হ্যাঁ। কোনো একজন মানুষ সেটা ভেঙেছে।

বব লাস্কি একবার ঈশিতার দিকে তাকাল, তারপর টেবিলের চারপাশে বসে থাকা মানুষগুলোকে বলল, আমরা যে নিউরাল কম্পিউটার তৈরি করার চেষ্টা করছি, তার থেকে লক্ষ-কোটি গুণ ক্ষমতার মানুষ আছে?

ল্যাপটপের সামনে বসে থাকা মানুষটি বলল, একবার সিস্টেমে ঢোকার পর তারা এই মেয়েটির পুরো তথ্য ডেটাবেসে ঢুকিয়ে দিয়েছে।

আঙুলের ছাপ আর রেটিনা স্ক্যানিং?

ওভার রাইট করে দিয়েছে।

তার মানে?

তার মানে, আমাদের এনডেভার এখন কারও আঙুলের ছাপ আর রেটিনা চেক করে না। সবাইকেই ঢুকতে দিচ্ছে!

বব লাস্কি নিজের মাথা চেপে ধরে বলল, ও মাই গড!

ল্যাপটপের সামনে বসে থাকা মানুষটি বলল, আমাদের এনডেভার আর একটা ফাস্টফুডের দোকানের সিকিউরিটি এখন একই সমান!

বব লাস্কি তার মাথা চাপড়ে দ্বিতীয়বার বলল, ও মাই গড!

নীল চোখের সুদর্শন মানুষটি বলল, বব, তোমার এত বিচলিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বলতে পার, আমরা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একটা সুযোগ পেয়েছি।

কী সুযোগ?

এ দেশে একজন মানুষ আছে, যার মস্তিষ্ক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুপার কম্পিউটার থেকে বেশি ক্ষমতাশালী। আমরা যে নিউরাল কম্পিউটার তৈরি করতে চাইছি, তার থেকে লক্ষ গুণ বেশি শক্তিশালী। কাজেই আমাদের কাজ এখন পানির মতো সোজা।

কী রকম?

ওই মানুষটাকে ধরে আনো। আমরা তার ব্রেন স্ক্যান করি। তারপর সেটা উপস্থাপন করি।

বব লাস্কি নীল চোখের মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, তার মানে, আমাদের এনডেভারের এই সেটআপের দরকার নেই?

না, আমাদের ওই মানুষটি দরকার। জীবিত হলে সবচেয়ে ভালো। জীবিত পাওয়া না গেলে মৃত মৃত পুরো শরীরটা পাওয়া না গেলেও ক্ষতি নেই। শুধু মস্তিষ্কটা হলেই হবে ৬ লিকুইড নাইট্রোজেনে ফ্রিজ করে হেড অফিসে পাঠিয়ে দাও।

বব লাস্কি ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়ে, তুমি আমাদের বললো, এই মানুষটা কে? কোথায় আছে?

ঈশিতা শব্দ করে হেসে উঠল, তাকে হাসির ভান করতে হলো না, সে সত্যি সত্যি হাসতে পারল। হাসতে হাসতে বলল, মানবসভ্যতার যুগান্তকারী পরিবর্তনের জন্য তুমি মনুষ্যরূপী নিউরাল কম্পিউটার চাইবে, আর সাথে সাথে পেয়ে যাবে? এ দেশের মানুষ এত সহজ?

বব লাস্কি হিংস্র গলায় বলল, বলো, সেই মানুষটা কে?

ঈশিতার হাসি আরও বিস্তৃত হলো। বলল, তুমি সত্যিই বিশ্বাস করো যে তুমি চোখ রাঙিয়ে ধমক দেবে, আর আমি ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলে দেব?

দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, একে দুই সিসি ক্লিপোনাল পুশ করো। সবকিছু বলে দেবে—

নীলচোখের মানুষটি বলল, দুই সিসি নয়, চার সিসি দাও, তাহলে সবকিছু বলে দিয়ে ব্রেন ডেড হয়ে থাকবে।

বব লাস্কি বলল, দাঁড়াও। ক্লিপোনাল দেওয়ার আগে আমি আমাদের লোকাল সিকিউরিটিকে ডাকি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের ভেতর দুজন মানুষ এসে ঢুকল। একজন মধ্যবয়স্ক, অন্যজন একটু কম বয়সী। চুল ছোট করে ছাঁটা এবং পরনে ধূসর সাফারি কোট। ঈশিতা তাদের চিনতে পারে এবং ওই দুজনও তাকে চিনতে পারে। ঈশিতা তাদের প্রথম দেখেছে তার পত্রিকার সম্পাদক নুরুল ইসলামের অফিসে। সমীরকেও এরা হুমকি দিয়ে এসেছে। হাজেরা যেদিন মারা যায়, সেদিন তার বাড়ির কাছে এই দুজনকে দেখেছিল ঈশিতা।

বব লাস্কি বলল, তোমাদের জরুরি কাজে ডেকে এনেছি। আমাদের এনডেভারে মেজর সিস্টেম ফেল করেছে। কোনো একজন মানুষ সিস্টেমে হ্যাক করেছে। এই মেয়েটা জানে, কিন্তু সে বলছে না।

মুখ থেকে কথা বের করতে হবে? মানুষটির মুখে তৈলাক্ত এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, আমাকে আধঘণ্টা সময় দাও, আর এই মেয়েটাকে দাও। নিরিবিলি—

বব লাস্কি বিরক্ত হয়ে বলল, আমি তোমাদের টর্চার করার জন্য ডাকিনি। আমি জানতে চাইছি, তোমরা কি কোনো মানুষের কথা জানো, যে খুব দ্রুত হিসাব করতে পারে কম্পিউটারের মতো?

হ্যাঁ, জানি। সমীর ছোকরাটাকে টাইট দিতে যে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম, সেখানে দেখেছি। ছোট একটা মেয়ে আছে, যে মুখে মুখে গুণ ভাগ করে দেয়।

বব লাস্কি টেবিলে একটা ঘুষি দিয়ে বলে, ইউরেকা! পেয়ে গেছি।

ঈশিতাকে দেখিয়ে বলল, এই সাংবাদিক মেয়েটা সেখানে ছিল। ওই মেয়েটার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছে।

বব লাস্কি উত্তেজিত মুখে বলল, আমাদের ওই মেয়েটা দরকার। যেভাবে সম্ভব।

কত দিনের মধ্যে দরকার?

কত দিন নয়, বলো, কত মিনিট।

কত মিনিট?

হ্যাঁ। এয়ারপোর্টে যাও। আমাদের হেলিকপ্টার নিয়ে ফ্লাই করো, দুই ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে এসো।

গোপনে?

অবশ্যই গোপনে। বব লাস্কি বিরক্ত মুখে বলল, তোমাদের মিডিয়া হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মিডিয়া। একটা কিছু পেলে তার পেছনে লেগে থাকে।

ঠিক আছে।

চেষ্টা কোরো জীবিত আনতে।

সম্ভব না হলে ডেডবডি?

হ্যাঁ, কিন্তু ডেডবডি হলে ডিকম্পোজ করা যাবে না। ফ্রিজ করে আনতে হবে।

ঠিক আছে।

মানুষ দুজন যখন বের হয়ে যাচ্ছিল, তখন ঈশিতা তাদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। নিচু গলায় বলল, আপনারা কি দরকার হলে আপনাদের মায়েদেরও বিক্রি করে দেন?–এ কথা কেন বলছ?

যে নিজের দেশকে বিক্রি করতে পারে, সে নিশ্চয়ই নিজের মাকেও বিক্রি করে দিতে পারে, সে জন্য বলছি।

মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখ যেন ক্রোধে বিকৃত হয়ে গেল। সে ঈশিতার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, আমি আমার দেশ বিক্রি করছি না। আমি তোমার দেশ বিক্রি করছি।

আপনার দেশ কোনটি?

আমার দেশ নাই। একাত্তরে আমি আমার দেশ হারিয়েছি। বুঝেছ?

ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, বুঝেছি। সে আসলেই অনেক কিছু বুঝতে পেরেছে।

 

রাফি ঘড়ির দিতে তাকাল, প্রায় দুইটা বাজে। ঈশিতার সঙ্গে কথা ছিল, সে এনডেভার থেকে বের হয়েই তাকে ফোন করবে। এখনো ফোন করেনি, তার মানে ঈশিতা এখনো এনডেভার থেকে বের হতে পারেনি। সে নিজে থেকে বের না হলে ঠিক আছে, কিন্তু ভেতরে গিয়ে আটকা পড়ে থাকলে বিপদের কথা। রাফি কী করবে, এখনো বুঝতে পারছে না। যদি কোনো খোঁজ না পায়, তাহলে শারমিনকে নিয়ে আবার কম্পিউটারে বসতে হবে। আবার এনডেভারের ভেতর ঢুকতে হবে।

ঠিক তখনই তার ফোনটা বাজল। আশা করছিল, ঈশিতার ফোন হবে, কিন্তু দেখা গেল ফোনটা সমীরের। রাফি ফোন ধরে বলল, হ্যালো, সমীর।

সমীর উত্তেজিত গলায় বলল, রাফি, তোমার মনে আছে, দুজন মোষের মতো মানুষ আমাকে ভয় দেখিয়েছিল?

হ্যাঁ। মনে আছে।

সেই মানুষ দুটিকে ক্যাম্পাসে দেখেছি।

সত্যি?

হ্যাঁ। একটা সাদা রঙের পাজেরো থেকে নেমেছে।

নেমে কী করছে?

আমি দূর থেকে দেখলাম, মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে টংগুলোর দিকে যাচ্ছে।

সর্বনাশ। সমীর বলল, হ্যাঁ, সর্বনাশ। বদমাইশ দুটো কেন এসেছে বলে মনে হয়?

যেহেতু টংগুলোর দিকে এগোচ্ছে, তার মানে, নিশ্চয়ই শারমিনের খোঁজে যাচ্ছে।

কেন? শারমিনের খোঁজে কেন? শারমিন কী করেছে?

রাফি বলল, এখনো বুঝতে পারছি না। দেখি, কী করা যায়।

রাফি ফোন শেষ করে ঘর থেকে বের হলো। ছাত্রছাত্রীদের ভিড় ঠেলে সে টংয়ের দিকে এগিয়ে যায়।

শারমিনের বাবা রাফিকে দেখে এগিয়ে এল। মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আসেন, স্যার। বসেন।

শারমিন কোথায়?

ঢাকা থেকে দুজন স্যার আসছেন। তাঁরা শারমিনের সঙ্গে একটু কথা বলতে নিয়ে গেছেন।

রাফি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কোথায় নিয়ে গেছে?

এই তো এখানে কোনো এক জায়গায়। মনে হয় ক্যানটিনে।

রাফি ছটফট করে বলল, আপনি আপনার মেয়েকে দুজন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে ছেড়ে দিলেন?

রাফির অস্থিরতাটুকু শারমিনের বাবার ভেতরে সঞ্চারিত হলো। মানুষটি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কেন, স্যার? কোনো সমস্যা? দেখলাম, বয়স্ক ভদ্রলোক মানুষ। আমার সঙ্গে খুব ভদ্রলোকের মতো কথা বলল-

রাফি বাধা দিয়ে বলল, শারমিন? শারমিন যেতে চাইল?

না। যেতে চাচ্ছিল না। বলছিল, আগে আপনার সঙ্গে কথা বলবে। তখন ভদ্রলোেক দুজন বলল, ঠিক আছে। আপনার কাছেও নিয়ে যাবে। তখন—

রাফি কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল না, দূরে তাকিয়ে দেখল, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের কাছে একটা সাদা পাজেরো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হয়, ওটাতে করেই এসেছে। যদি কোনোভাবে শারমিনকে টেনে তুলে ফেলে, তাহলেই আর তাকে খুঁজে পাবে না। মানুষগুলোর যে রকম বর্ণনা শুনেছে, তাতে সে নিশ্চিত, তাদের কাছে অস্ত্র আছে, বাধা দিলে গুলি করে বের হয়ে যাবে। রাফি অনুভব করে, তার পিঠ দিয়ে একটা শীতল ঘাম বইতে শুরু করেছে। ঠিক তখন তার ভোটকা হান্নানের কথা মনে পড়ল, সম্ভবত সে-ই এখন তাকে রক্ষা করতে পারবে।

রাফি ফোন বের করে ভোটকা হান্নানের নম্বরে ডায়াল করল। একটা আধুনিক ইংরেজি গান শোনা গেল এবং হঠাৎ করে গানটি থেমে গিয়ে ভোটকা হান্নানের গলার স্বর শোনা গেল, আস্সালামু আলাইকুম, স্যার।

হান্নান, তুমি কোথায়?

মুক্তিযুদ্ধ চত্বরে। কেন, স্যার?

কী করছ?

সংগঠনের একটা ছোট বিষয় নিয়ে একটা ঝামেলা–

রাফি কথার মাঝখানে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, তুমি একটু সাহায্য করতে পারবে? খুব জরুরি—

পারব, স্যার। কী করতে হবে, বলেন।

রাফি বলল, না শুনেই বলে দিলে পারবে?

আপনি তো আর আমাকে এমন কিছু বললেন না, যেটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। করা সম্ভব হলে কেন পারব না? কী করতে হবে, বলেন।

মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যটার কাছে একটা সাদা পাজেরো আছে, দেখেছ?

দেখেছি, স্যার।

ওই পাজেরোয় করে দুজন মানুষ এসেছে শারমিনকে তুলে নিতে। তোমরা শারমিনকে বাঁচাও।

মানুষ দুজন কে?

জানি না। অসম্ভব ক্ষমতাশালী। আর্মড। যেকোনো মানুষকে খুন করার পারমিশন আছে।

মানুষগুলো কই?

শারমিনকে নিয়ে বের হয়েছে। ক্যাম্পাসে কোথাও আছে। মনে হয় ক্যানটিনের দিকে গিয়েছে।

ঠিক আছে, স্যার। আমরা ব্যবস্থা করছি। শারমিনকে আপনার কাছে দিয়ে যাব?

হ্যাঁ, দিয়ে যেতে পারো। আর শোনো, মানুষগুলো কিন্তু আর্মড এবং অসম্ভব ডেঞ্জারাস।

আপনি চিন্তা করবেন না।

টেলিফোন লাইনটা কেটে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাফি দূর থেকে একটা স্লোগান শুনল, জ্বালো জ্বালো—আগুন জ্বালো!

দেখতে দেখতে একটা ছোট জঙ্গি মিছিল বের হয়ে গেল। মিছিলের সামনে শুকনো লিকলিকে হান্নান, পেছন ফিরে গলা উঁচিয়ে স্লোগান ধরছে, অন্যেরা তার উত্তর দিচ্ছে। দূর থেকে সব স্লোগান শোনা যাচ্ছে না, অ্যাকশান অ্যাকশান, ডাইরেক্ট অ্যাকশান এবং প্রশাসনের গদিতে, আগুন জ্বালো একসাথে এই দুটি স্লোগান সে বুঝতে পারল। মিছিলটা খুব বড় নয়। মুক্তিযুদ্ধ চত্বরের আশপাশে ঘুরপাক খেতে থাকে, কখনোই সাদা পাজেরো থেকে বেশি দূরে সরে যাচ্ছে না।

রাফি দূর থেকে লক্ষ করে, হঠাৎ মিছিলটি মুক্তিযুদ্ধ চত্বর থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠে আসে, কারণটাও সে সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারে। রাস্তা ধরে সাফারি কোট পরা দুজন মানুষ হেঁটে আসছে; একজন শারমিনের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, শারমিনের চোখে-মুখে এক ধরনের অসহায় আতঙ্ক। মানুষ দুজন শারমিনকে নিয়ে রাস্তার একপাশে সরে দাঁড়িয়ে মিছিলটিকে চলে যাওয়ার জন্য জায়গা দিল। মিছিলটি কিন্তু চলে না গিয়ে একেবারে হুঁড়মুড় করে মানুষ দুজনের ওপর গিয়ে পড়ল। একটা জটলা, জটলার মাঝে হুঁটোপুটি হচ্ছে, চিৎকার-হইচই-চেঁচামেচি শোনা যাচ্ছে। রাফির মনে হলো, ভেতরে মারপিট শুরু হয়েছে। সে একটু এগিয়ে যাবে কি না ভাবছিল, ঠিক তখন দেখল ভিড়ের মাঝখান থেকে ভোটকা হান্নান শারমিনের হাত ধরে বের হয়ে তাকে নিয়ে ছুটছে।

যেভাবে মারামারি শুরু হয়েছিল, ঠিক সেভাবেই সেটা শেষ হয়ে গেল। ছাত্রদের দলটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর রাফি মানুষ দুটিকে দেখতে পায়, শার্টের বোতাম ছেড়া, বিধ্বস্ত চেহারা। একজন মানুষ অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বারবার তার বগলে, পেটের কাছে হাত দিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। তার কিছু একটা হারিয়ে গেছে।

রাফি অফিসে এসে দেখল, ভোটকা হান্নান একটা চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। কাছাকাছি আরেকটা চেয়ারে শারমিন মুখ কালো করে বসে আছে। রাফিকে দেখে হান্নান উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল, তার মুখে এগাল-ওগাল জোড়া হাসি। হাসিকে আরও বিস্তৃত হতে দিয়ে বলল, স্যার, আপনার শারমিনকে নিয়ে এসেছি।

হ্যাঁ, দেখেছি। থ্যাংকু।

যখন যেটা দরকার হয়, বলবেন স্যার।

হ্যাঁ, বলব।

আপনি তাহলে শারমিনকে দেখবেন, স্যার।

হ্যাঁ, দেখব।

আমি তাহলে যাই?

আমাকে আরেকটু সাহায্য করতে পারবে?

কী সাহায্য, স্যার?

দশ-বারো বছরের ছেলের জন্য একটা প্যান্ট আর শার্ট কিনে দিতে পারবে?

হান্নান বলল, ঠিক আছে, স্যার কম

হান্নান যখন চলে যাচ্ছিল, তখন রাফি তাকে ডাকল। বলল, হান্নান, আরও একটা জিনিস।

কী জিনিস?

ওই লোকগুলোকে দেখে মনে হলো, তাদের কিছু একটা হারিয়ে গেছে।

হান্নানের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল। বলল, আপনাদের ওই সব বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। এগুলো আমাদের ব্যাপার।

তোমাদের ব্যাপার? জি, স্যার। আজকে বিশাল বিজনেস হলো। থ্যাংকু স্যার।

রাফি কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, ইউ আর ওয়েলকাম। কথাটি বলে তার নিজেকে কেমন জানি বোকা বোকা মনে হতে থাকে।

হান্নান চলে যাওয়ার পর শারমিন রাফির কাছে এসে বলল, স্যার, আমার খুব ভয় করছে।

রাফি বলল,  তোমার ভয় পাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু এখন আর ভয় নেই।

কেন ভয় নেই, স্যার? ওরা যদি আবার আসে?

আসলে আসবে। আমি আছি না?

স্যার।

বলো, শারমিন।

ওই লোক দুটি খুব খারাপ।

তুমি কেমন করে জানো?

আমাকে বলেছে, আমাকে নাকি কেটে আমার ব্রেন নিয়ে যাবে। রাফি কিছু বলল না। শারমিন বলল, কেন আমার ব্রেন নিয়ে যেতে চায়? কারা আমার ব্রেন নিয়ে যেতে চায়?

আমি জানি না, শারমিন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে শারমিন নিচু গলায় বলল, স্যার।

বলো। আমার খুব ভয় করছে, স্যার।

রাফির শারমিনের জন্য খুব মায়া হলো। সে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, শোনো, শারমিন। আমি তোমার কাছে আছি। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

সত্যি, স্যার?

হ্যাঁ, সত্যি।

এই প্রথমবার শারমিনের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল। মেয়েটি রাফির কথা বিশ্বাস করেছে।

 

ইউনিভার্সিটির গেটে সাদা পাজেরোটি নিয়ে মানুষ দুটি অপেক্ষা করছিল। রাফি তাদের সামনে দিয়েই শারমিনকে নিয়ে বের হয়ে এল, মানুষ দুটি টেরও পেল না। টের পাওয়ার কথাও না। কারণ রাফি শারমিনের চুল ছোট করে ছেলেদের মতো করে কাটিয়েছে। একটা হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরিয়েছে, পায়ে সাদা টেনিস শু—তাকে দেখাচ্ছে ঠিক একজন বাচ্চা ছেলের মতো। রাফি সরাসরি রেলস্টেশনে চলে এসে ট্রেনের টিকিট কিনে ট্রেনে উঠেছে। আজ রাতেই সে ঢাকা পৌঁছাতে চায়। ঈশিতার ফোন পায়নি সত্যি, কিন্তু মাজু বাঙালি নামের একজন মানুষ তাকে ফোন করে বলেছে, সে তার সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে চায়। রাফি তাই ঢাকা রওনা দিয়েছে। শারমিনকে রেখে যেতে সাহস পায়নি—তার বাবাও খুব ভয় পেয়েছে। নিজের কাছে রাখার চেয়ে শারমিনকে রাফির কাছে রাখাই তার বেশি নিরাপদ মনে হয়েছে। শারমিন তাই রাফির সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছে—তার নাম অবশ্যি এখন শারমিন নয়, আপাতত তাকে শামীম বলে ডাকা হচ্ছে।

গভীর রাতে শারমিন যখন রাফির ঘাড়ে মাথা রেখে ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছে, ঠিক তখন এনডেভারের ভেতর বব লাস্কি সাফারি কোট পরা মানুষ দুজনের সঙ্গে কথা বলছে। মানুষ দুজন হেলিকপ্টারে করে রাতের মধ্যেই ফিরে এসেছে। বব লাস্কি তাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, কী বললে? মেয়েটাকে তোমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল?

মধ্য বয়স্ক মানুষটি মাথা নাড়ে। হ্যাঁ, শুধু মেয়েটাকে না, আমার রিভলবারটাও।

তোমার রিভলবারটাও?

হ্যাঁ। ছাত্রগুলো ভয়ংকর বদ। কীভাবে খবর পেল, বুঝতে পারলাম।

বব লাস্কি হুঙ্কার দিয়ে বলল, কিন্তু তোমরা মেয়েটাকে না নিয়ে ফিরে এসেছে কেন?

মেয়েটা এখন সেখানে নেই।

তাহলে এখন কোথায়?

আমরা খোঁজ নিচ্ছি, পেয়ে যাব।

কেমন করে পাবে?

রাফি নামের ছেলেটাও নাই। নিশ্চয়ই দুজন একসঙ্গে আছে।

তোমাকে আমি চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম।

চব্বিশ ঘণ্টা অনেক সময়। শুধু একটা ব্যাপার—

কী ব্যাপার?

এই চব্বিশ ঘণ্টা ঈশিতাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। রাফিকে ধরার জন্য তার সাহায্য লাগতে পারে।

ঠিক আছে। কিন্তু মনে রেখো, চব্বিশ ঘণ্টার এক মিনিট বেশি নয়।

 

ঈশিতা চব্বিশ ঘণ্টার জন্য আয়ু পেয়ে গেল। একটা ছোট ঘরে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে সে যখন রাত কাটাচ্ছিল, সে তার কিছুই জানতে পারল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *