০৭. নেটওয়ার্কিং ল্যাবের এক কোণায়

নেটওয়ার্কিং ল্যাবের এক কোণায় রাফি ঈশিতা আর শারমিনকে নিয়ে বসেছে। এটি একটা রিসার্চ ল্যাব, যেকোনো মুহূর্তে কোনো একজন শিক্ষক বা ছাত্র চলে আসতে পারে। কেউ এলেই তারা সৌজন্য দেখানোর জন্য। তাদের কাছে আসবে, কথা বলবে। ছুটির দিন ভোরবেলায় ঢাকার একজন সাংবাদিক এবং বাচ্চা একটা মেয়েকে নিয়ে রাফি কী করছে, সেটা জানার জন্য হালকা কৌতূহল দেখাবে। তখন তাদের কী বলা হবে, সেটা আগে থেকে ঠিক করে রাখা আছে। ডিসলেক্সিয়া আছে, এ রকম বাচ্চা-কাচ্চাদের লেখাপড়া নিয়ে ঈশিতা একটা রিপোর্টিং করবে এবং তার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা হচ্ছে। তাদের বলা হবে, পদ্ধতিগুলো কাজ করে কি না, সেগুলো সরাসরি শারমিনকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হচ্ছে—বিষয়টা বিশ্বাসযোগ্য করানোর জন্য এ ধরনের বেশ কিছু ওয়েবসাইট খুলে রাখা হয়েছে এবং কিছু কাগজও প্রিন্ট করে রাখা আছে। এই ল্যাবে না বসে তারা দরজা বন্ধ করে রাফির অফিসে বসতে পারত, কিন্তু রাফি বড় ব্যান্ড উইথ নিশ্চিত করার জন্য এই ল্যাবে বসেছে।

ল্যাবের ভেতরে এখনো অন্য কোনো শিক্ষক বা ছাত্র আসেনি, তাই তারা মোটামটি কোনো বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই কাজ করতে পারছে। রাফি এইমাত্র ঈশিতাকে এনডেভারের পুরো সাইটটা দেখিয়েছে, যারা কাজকর্ম করে, তাদের নানা ধরনের তথ্যে চোখ বুলিয়ে তারা এখন হাসপাতালের বিভিন্ন ঘরে রোগীদের প্রোফাইল দেখছিল। দোতলাটি মূল হাসপাতাল, তিন তলার কিছু ঘরে বিশেষ কয়েকজন রোগী। তাদের সারা শরীর নানা ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে ভরে রাখা হয়েছে। মুখে মাস্ক, অক্সিজেন টিউব, মাথার চুল কামানো, সেখানে নানা ধরনের টিউব ও মনিটর। চারপাশে নানা আকারের স্ক্রিনে নানা ধরনের তরঙ্গ এবং সংখ্যা জ্বলজ্বল করছে। ঈশিতা নিঃশ্বাস আটকে বলল, এদের ভেতর একজন নিশ্চয়ই মকবুল নামের হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি।

তোমার ছবির সঙ্গে চেহারা মিলছে?

ঈশিতা হাতের ছবিটার সঙ্গে চেহারা মেলানোর চেষ্টা করে বলল, বলা মুশকিল। ছবিতে বাচ্চাটা হাসিখুশি। মাথা ভরা চুল। এখানে মাথা কামানো। খুলির ভেতর থেকে যন্ত্রপাতি টিউব বের হয়ে আসছে। মুখের ভেতর পাইপ, নাকের ভেতর পাইপ, মুখের বেশির ভাগ মাস্ক দিয়ে ঢাকা। চোখ-মুখ ফুলে আছে—ভয়ংকর দৃশ্য। মেলানো অসম্ভব।

তাহলে কী করবে?

এর নাম-ঠিকানা বের করতে পারবে?

রাফি বলল, নাম-ঠিকানা নেই, শুধু নম্বর দিয়ে রেখেছে। ইচ্ছে করেই নাম-ঠিকানা রাখছে না।

এই রোগীগুলোর ভিডিও নামানো যাবে?

যাবে। কিন্তু একটা ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।

কী?

যেই মুহূর্তে ভিডিওগুলো নামাব, তাদের সিস্টেম কিন্তু সতর্ক হয়ে যাবে। কাজেই নতুন করে প্রোটেকশন দিয়ে আমাদের বের করে দিতে পারে।

তাহলে তো মুশকিল।

রাফি বলল, যখন তুমি একেবারে হানড্রেড পারসেন্ট নিশ্চিত হবে কোনটা নামাতে হবে, তখন আমরা ডাউনলোড শুরু করব।

ঈশিতা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, হানড্রেড পারসেন্ট নিশ্চিত হতে পারছি না। যদি সশরীরে ভেতরে ঢুকতে পারতাম, তাহলে হতো।

শারমিন এতক্ষণ চুপ করে বসে তাদের কথা শুনছিল। এবার ইতস্তত করে বলল, ঈশিতা আপু তো ইচ্ছা করলে ভেতরে ঢুকতে পারে।

রাফি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কেমন করে?

যারা যারা এই বিল্ডিংয়ে ঢুকতে পারে, তাদের সবার ফটো আছে, নামঠিকানা আছে। আমরা সেখানে ঈশিতা আপুর ফটো, নাম-ঠিকানা ঢুকিয়ে দিই। তাহলেই তো আপু ওই কোম্পানির একজন হয়ে যাবে!

ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, এটা সম্ভব?

রাফি মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, সম্ভব।

সত্যি?

সত্যি। তবে এখানে অন্য ঝামেলা আছে। কী ঝামেলা?

এটা তো হাই সিকিউরিটি অফিস, এখানে তো শুধু ছবি আর আইডি কার্ডের ওপর ভরসা করে নেই। এরা নিশ্চয়ই আরও অনেক কিছু চেক করে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট হতে পারে।

ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি চেক করে বের করতে পারবে?

অবশ্যই। রাফি কম্পিউটার মনিটরে ঝুঁকে কি-বোর্ডে দ্রুত টাইপ করতে থাকে। একটু পরে হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, নাহ্! হবে না।

কী হবে না?

তোমাকে ওদের ডেটাবেসে ঢুকিয়ে দিলেও লাভ নেই। ওরা সিকিউরিটির জন্য প্রত্যেক এমপ্লয়ির ফিঙ্গারপ্রিন্ট আর রেটিনা চেক করে।

রেটিনা? ঈশিতা অবাক হয়ে বলল, রেটিনা কীভাবে চেক করে?

ছোট অপটিক্যাল ডিভাইসরাসরিই চোখের ভেতর দেখে রেটিনার একটা স্ক্যান করে। প্রত্যেক মানুষের রেটিনার ছবি আলাদা ফিঙ্গারপ্রিন্টের মতন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তুমি যদি বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকতেও পারো, এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে পারবে না। রেটিনা স্ক্যান করে দরজা খোলাতে হয়।

ঈশিতা হতাশার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, তাহলে ধরা না পড়ে আমার ঢোকার উপায় নেই!

রাফি মাথা নেড়ে বলল, আই এম সরি ঈশিতা, নেই।

শারমিন আবার ইতস্তত করে বলল, স্যার, একটা কাজ করলে কেমন হয়?

কী কাজ?

প্রোগ্রামের যেখানে রেটিনাটা মিলিয়ে দেখে, সেখানে যদি আমরা বদলে দিই?

কী বদলে দেবে, শারমিন?

রেটিনার ছবি না মিললেও প্রোগ্রামটা বলবে, মিলেছে!

রাফি কয়েক মুহূর্ত শারমিনের দিকে তাকিয়ে থেকে তার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, ফ্যান্টাস্টিক, শারমিন! অবশ্যই আমরা এটা করতে পারি। কোডিং লেভেলে মেনিপুলেশন, কিন্তু তুমি থাকতে আমাদের ভয় কিসের।

ঈশিতা একবার রাফির দিকে আরেকবার শারমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াচ্ছে? তোমরা আমাকে সশরীরে এনডেভারের ভেতর ঢোকাতে পারছ?

রাফি বলল, মনে হয় পারছি।

গুড।

কিন্তু শেষবার ভেবে দেখো ঈশিতা, তুমি আসলেই ভেতরে ঢুকতে চাও কি না।

চাই।

যদি কোনো বিপদ হয়?

দেখো রাফি, আমার জীবন এখন মোটামুটি বরবাদ হয়ে গেছে। আমি কিছুই করতে পারছি না—আমার পেছনে ফেউ লেগে আছে। টেলিফোনে কথা বলতে পারি না, ঘর থেকে বের হতে পারি না। আমার ধারণা, আমাকে কোনো একদিন মেরেই ফেলবেছ পত্রিকায় কয়েক দিন লেখালেখি হবে, তারপর সবাই সবকিছু ভুলে যাবে। আমি আর পারছি না—আমি এটার শেষ দেখতে চাই। আমাকে একবার ভেতরে ঢুকতে দাও, বাকি দায়-দায়িত্ব আমার।

রাফি কিছুক্ষণ ঈশিতার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ঠিক আছে ঈশিতা, আমরা তোমাকে এনডেভারের অফিসে ঢুকিয়ে দেব।

এরপর রাফি আর শারমিন কাজে লেগে যায়। দুপুরের ভেতরেই কাজ শেষ হয়ে যেত, কিন্তু বিকেল পর্যন্ত লেগে গেল। কারণ, দুপুরের পরই এই ল্যাবের শিক্ষক-ছাত্রছাত্রীরা আসতে শুরু করল এবং রাফিকে ঈশিতা আর শারমিনের পাশাপাশি বসে থাকতে দেখে তাদের খোঁজখবর নিল। সবাইকে খুশি করার জন্য রাফিকে ডিসলেক্সিয়ার ওপর অনেক তথ্য নামাতে হলো, প্রিন্ট করতে হলো এবং আলোচনা করতে হলো। তার পরও শেষ পর্যন্ত। রাফি আর শারমিন মিলে সিকিউরিটি সফটওয়্যারের কোডিং পাল্টে দিল। এনডেভারের সিকিউরিটি সিস্টেম সত্যি সত্যি সবার রেটিনা স্ক্যান করবে, সেটি মিলিয়েও দেখবে, কিন্তু সেটি না মিললেও কোনো আপত্তি না করে দরজা খুলে দেবে। তিনজন বসে বসে সিকিউরিটির পুরো ব্যাপারটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করে দেখল। ঈশিতাকে ডেটাবেসে ঢোকানোর পর তাকে একটি এমপ্লয়ি নম্বর দেওয়া হলো। রাফি সেই এমপ্লয়ি নম্বর ব্যবহার করে তার ছবি আর এনডেভারের লগো দিয়ে একটি আইডি কার্ড ডিজাইন করে দিল। একটা প্লাষ্টিক আইডি কার্ডের ওপর সেটা ছাপিয়ে নিতে হবে। এই আইডি কার্ডগুলো শুধু সৌন্দর্যের জন্য, এনডেভার তার সিকিউরিটি ব্যবস্থার জন্য এর ওপর নির্ভর করে নেই।

সব কাজ শেষ করে রাফি বিকেলে ঈশিতাকে বাসে তুলে দিয়ে আসে। বাস ছেড়ে দেওয়ার আগে ঈশিতা ফিস ফিস করে বলল, আমার জন্য দোয়া কোরো, রাফি।

রাফি নরম গলায় বলল, আমি সব সময়ই তোমার জন্য দোয়া করি।

 

ঈশিতা এনডেভারে ঢোকার জন্য সকালের দিকের সময়টা বেছে নিল। এফটি টোয়েন্টি সিক্স ভাইরাসের রোগীদের দেখার জন্য তাদের আত্মীয়স্বজনদের সকালবেলা ঢুকতে দেওয়া হয়, তখন খানিকটা ভিড় থাকে। সে ভিড়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেল, মোটামুটি আধুনিক পোশাক পরে এসেছে, চুলগুলো একটু ফঁপিয়ে এনেছে, ঠোঁটে উজ্জ্বল লাল রঙের লিপস্টিক। তার ঘাড় থেকে একটা ব্যাগ ঝুলছে, সেখানে মোবাইল টেলিফোন আর ক্যামেরা। ঈশিতা ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে গিয়ে শেষ মুহূর্তে ডান দিকে সরে গেল—এনডেভারের নিয়মিত কর্মচারীরা এখানে গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকে। গতকাল রাফির নেটওয়ার্কিং ল্যাবে কম্পিউটারের সামনে বসে পুরো প্রক্রিয়াটি অনেকবার দেখে মুখস্থ করে রেখেছে।

ভারী লোহার দরজার সামনে একটা ছোট মডিউল, সেখানে নিউমেরিক কি-প্যাড, সবাই এমপ্লয়ি নম্বরটি প্রবেশ করায়। ঈশিতাকে গতকাল রাফি আর শারমিন মিলে একটি এমপ্লয়ি নম্বর দিয়েছে—এখন প্রথমবার সে এটি প্রবেশ করাবে। সবকিছু যদি ঠিকভাবে করা হয়ে থাকে, সত্যি সত্যি যদি সিকিউরিটির মূল ডেটাবেসে তার এমপ্লয়ি নম্বরটি ঢোকানো হয়ে থাকে, তাহলে সে যখন তার নম্বরটি প্রবেশ করাবে, তখন দরজাটি খুলে যাবে। যদি ব্যাপারটি ঠিকভাবে করা না হয়ে থাকে, তাহলে কী হবে, সে জানে না। সম্ভবত কর্কশ স্বরে অ্যালার্ম বেজে উঠবে এবং গেটের কাছে কাচের ঘরে বসে থাকা সিকিউরিটির মানুষটি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে ছুটে আসবে। ঈশিতা কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করাল। তারপর সাবধানে ছয় সংখ্যার এমপ্লয়ি নম্বরটি প্রবেশ করাল, কোনো অ্যালার্ম বেজে উঠল না এবং খুট করে দরজাটি খুলে গেল। ঈশিতা বুকের ভেতর আটকে থাকা নিঃশ্বাসটি সাবধানে বের করে দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। এখানে একটা ছোট করিডরের মতো রয়েছে, যাদের সর্বোচ্চ সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স রয়েছে, তারা ডান দিকের দরজা দিয়ে ঢুকবে, অন্যরা বাঁ দিকে। ঈশিতা ডান দিকে এগিয়ে গেল, একজন বিদেশি মানুষ তার আগে দাঁড়িয়েছে। প্রথমে আঙুলের ছাপ, তারপর চোখের রেটিনা স্ক্যান করিয়ে মানুষটি দরজা খুলে ঢুকে যাওয়ার পর ঈশিতা এগিয়ে গেল। কাচের প্লেটে তার দুই হাতের দুই বুড়ো আঙুল রাখার পর একটা সবুজ আলো ঝলসে উঠল। এবার তার রেটিনা স্ক্যান করাতে হবে নির্দিষ্ট জায়গায় থুতনি রেখে, ঈশিতা ছোট একটি লেন্সের ভেতর দিয়ে তাকায়। মুহূর্তের জন্য সে একটা লাল আলোর ঝলকানি দেখতে পেল। ঈশিতা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, রাফি আর শারমিন মিলে সবকিছু ঠিকভাবে করে রাখলে এখন দরজাটা খুলে যাওয়ার কথা। দরজা খুলল না এবং হঠাৎ করে ঈশিতার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে ওঠে। যদি সত্যি সত্যি দরজা না খোলে, তার কী অবস্থা হবে, সে চিন্তাও করতে চায় না। খুব সাবধানে সে দরজাটাতে একটু চাপ দিল, দরজাটা খুলল না। ভেতরে কোথায় একটা যান্ত্রিক শব্দ হলো এবং তখন হঠাৎ করে দরজাটা খুলে গেল। ঈশিতা বুক থেকে নিঃশ্বাসটা বের করে ফিস ফিস করে বলল, থ্যাংকু, রাফি। থ্যাংকু শারমিন। তারপর সে হেঁটে ভেতরে ঢুকে গেল।

সামনে লম্বা আলোকোজ্জ্বল করিডর। করিডরের শেষ মাথায় দুজন বিদেশি মানুষ কথা বলছে। ঈশিতা এই মুহূর্তে কারও সামনে পড়তে চায় না, তাই একটু এগিয়ে ডান দিকে ঢুকে গেল। সারি সারি ঘর, একেবারে শেষে বাথরুম। ঈশিতা বাথরুমে ঢুকে যায়। বাথরুমে কেউ নেই, সে ঝকঝকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে, তার মুখে আতঙ্কের একটা ছাপ। ঈশিতা মুখ থেকে আতঙ্কের ছাপটি সরিয়ে নিজের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে ফিস ফিস করে বলল, ভয় নেই ঈশিতা! তুমি পারবে! নিশ্চয়ই পারবে।

গতকাল রাফির ল্যাবে বসে পুরো বিল্ডিংটার কোথায় কী আছে, জানার চেষ্টা করেছিল। যদি ঠিকভাবে বুঝে থাকে, তাহলে সে এখন একতলার উত্তর দিকে আছে। সামনের করিডর ধরে হেঁটে পূর্ব দিকে গেলে সে একটি লিফট পাবে। লিফটের পাশে সিড়ি। সে লিফট কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যেতে পারবে। তিনতলায় সারি সারি ঘরে রোগীদের রাখা আছে, যেখানে বাইরের কেউ যেতে পারে না। ঈশিতার সেখানে যেতে হবে। বুক থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস বের করে সে বাথরুম থেকে বের হয়।

ঈশিতা করিডর ধরে হাঁটতে থাকে, করিডরে একজন বিদেশি মানুষ। আসছিল, তার চোখের দিকে না তাকিয়ে সে পাশ কাটিয়ে হেঁটে যায়। হেঁটে যেতে যেতে সে বুঝতে পারে, মানুষটি তাকে চোখের কোনা দিয়ে দেখছে। কেন দেখছে, কে জানে, কিছু একটা কি সন্দেহ করছে?

ঈশিতার অনুমান সঠিক, সে খানিক দূর হেঁটে লিফট এবং লিফটের পাশে সিঁড়িটি পেয়ে গেল। ঈশিতা লিফটে ওঠার ঝুঁকি নিল না, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে থাকে। তিনতলায় এসে সে করিডর ধরে হাঁটতে থাকে। পাশাপাশি অনেক রুম। প্রতিটি রুমের সামনে ছোট একটা নিউমেরিক কিপ্যাড। সে তার এমপ্লয়ি নম্বর ঢুকিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে পারবে। কোনো একটা ফাঁকা ঘরে সে ঢুকতে চায়, কিন্তু বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়, ভেতরে কী আছে। করিডরের অন্য পাশ থেকে দুজন মানুষ কথা বলতে বলতে আসছে। ঈশিতা তাদের সামনে পড়তে চাইল না। তাই ঠিক কাছাকাছি যে রুমটি ছিল, তার দরজার নিউমেরিক কি-প্যাডে এমপ্লয়ি নম্বরটা ঢুকিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল।

এক পা সামনে এগিয়ে সে নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে যায়। ঘরটিতে অনেক মানুষ, সবাই বিদেশি। ঘরবোঝাই যন্ত্রপাতি। তারা সেই যন্ত্রপাতির সামনে ঝুঁকে কাজ করছে। ঘরের এক কোনায় শুকনো একটি শিশু অচেতন হয়ে আছে। তার মাথা থেকে অনেক টিউব বের হয়ে এসেছে। ঈশিতাকে ঢুকতে দেখে সবাই মাথা তুলে তাকাল, তাদের চোখেমুখে বিস্ময়। একজন মানুষ অবাক হয়ে ইংরেজিতে বলল, তুমি কে? এখানে কেন এসেছ?

ঈশিতা বুঝতে পারল, সে ধরা পড়ে গেছে। কিন্তু সে হাল ছেড়ে দেবে না, চেষ্টা করে যাবে। মুখে সপ্রতিভ ভাবটা ধরে রেখে এক পা এগিয়ে বলল, তুমি আমাকে এটা জিজ্ঞেস করছ কেন? আমি তো তোমাকে এই প্রশ্নটা করছি না!

মানুষটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, না, মানে। এটা হাই সিকিউরিটি রুম, এখানে আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কারও ঢোকার কথা নয়।

ঈশিতা বলল, এত দিন কথা ছিল না। এখন কথা হয়েছে। এবার সে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, আমার নাম রাইসা সুলতানা, আমি সোশ্যাল সাইকোলজিস্ট।

মানুষটা যন্ত্রের মতো বলল, পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।

মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, এ রকম একজন মানুষ বলল, তুমি এখানে কেন?

ঈশিতা দ্রুত চিন্তা করতে থাকে। খুব বিশ্বাসযোগ্য একটা উত্তর দিতে হবে। তাহলে তাদের সন্দেহটা কিছুক্ষণের জন্য হলেও থামিয়ে রাখা যাবে। কোথায় যেন পড়েছিল সে, মিথ্যা কথা বলতে হয় সত্যের খুব কাছাকাছি। তাকে এখন সেটাই করতে হবে। ঈশিতা সেভাবে শুরু করল, তোমরা জানো, এখানে কী হচ্ছে, তার কিছু কিছু বাইরে জানাজানি হয়েছে? কিছু সাংবাদিক সন্দেহ করতে শুরু করেছে?

মানুষগুলো থতমত খেয়ে গেল। একজন বিড়বিড় করে বলল, হ্যাঁ, আমরা শুনেছি। কেউ কেউ নাকি সন্দেহ করেছে।

তোমরা জানো, একটা কেস গোপন রাখার জন্য লোকাল সিকিউরিটি একটা খুব বড় ক্রাইম করেছে।

কী রকম ক্রাইম?

মার্ডার।

নীল চোখের একজন মানুষ শিদেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, বড় একটা কাজে এ রকম কিছু হয়।

ঈশিতা বলল, অবশ্যই হয়। কিন্তু আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে। এ দেশের মিডিয়া খুব ডেঞ্জারাস। কোনো কিছু ধরলে ছাড়ে না।

আমরা ভেবেছিলাম, টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রাখা আছে।

এই পদ্ধতি ভালো না। তখন সবাই আরও বেশি জানতে চায়। মুখ বন্ধ করার রেট দেখতে দেখতে আকাশছোঁয়া হয়ে যায়।

মানুষগুলো নিচু গলায় নিজেদের ভেতর কথা বলতে থাকে। আপাতত কিছুক্ষণের জন্য তাদের থামানো গেছে। ঈশিতা এবার একটু বেশি সাহসী হয়ে উঠল। বলল, আমি তোমাদের কাজে ডিস্টার্ব করব না—যে জন্য এসেছি, সেটা শেষ করে চলে যাই।

কী জন্য এসেছ?

আমি বাচ্চাটার একটা ছবি নিতে এসেছি।

মানুষগুলো চমকে উঠল, ছবি? ছবি নেবে কেন?

দেখব, এটা মিডিয়াকে দেওয়া যায় কি না।

মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি বলল, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে? আমরা একটা বাচ্চার ব্রেনে ইমপ্ল্যান্ট লাগিয়ে স্টিমুলেশান দিচ্ছি, সেই ছবি তুমি মিডিয়াকে দেবে?

ঈশিতা সহৃদয়ভাবে হাসল। বলল, তোমার ভয় নেই। আমি মোটেও বলিনি মিডিয়াকে দেব। আমি বলেছি মিডিয়াকে দেওয়া যায় কি না, সেটা দেখব।

নীল চোখের মানুষটি বলল, এই পুরো প্রজেক্টের গোড়ার কথা হচ্ছে গোপনীয়তা, আর তুমি বলছ, এর ছবি মিডিয়াকে দেওয়া যায় কি না, ভাবছ?

হুবহু এই ছবি দেওয়া হবে না। এটাকে টাচআপ করা হবে—ফটোশপ দিয়ে মাথার টিউব সরানো হবে, মোটেও বলা হবে না যে আমরা তার ব্রেনে ইমপ্ল্যান্ট বসিয়েছি। আমরা বলব, এই ছেলেটিকে আমরা বাঁচানোর চেষ্টা করছি।

একজন মানুষ বলল, না, না। এই আইডিয়াটা ভালো না।

ঈশিতা তার মুখের হাসি বিস্তৃত করে বলল, এই আইডিয়াটা ভালো না খারাপ, সেটা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। তার জন্য প্রফেশনালরা আছে। স্পর্শকাতর বিষয় কীভাবে পাবলিককে খাওয়াতে হয়, তার জন্য সোশ্যাল সাইকোলজি নামে নতুনু ডিসিপ্লিন তৈরি হয়েছে।

মানুষগুলো কোনো কথা না বলে স্থিরদৃষ্টিতে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশিতা তার ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করে বিছানায় শুয়ে থাকা অসহায় শিশুটির কয়েকটা ছবি তোলে। ছবি তোলা শেষ করে সে ক্যামেরাটা বন্ধ না করে ভিডিও মোডে নিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখে। এখন সে যে দিকেই ঘুরবে, ক্যামেরা ভিডিও করে নেবে। এই মানুষগুলোর ভেতরে কোনো সন্দেহ না জাগিয়ে সে যতটুকু সম্ভব তাদের ছবি তুলে নিতে চায়।

ঈশিতা মানুষগুলোর দিকে ঘুরে বলল, তোমরা তোমাদের কাজ করো। কী মনে হয়, তোমরা কি আরেকটা মাইলফলক দিতে পারবে?

এটা কী বলছ, আমরা আরও দুইটা মাইলফলক করে ফেলেছি, সেগুলো কাউকে জানাতে পারছি না।

ছেলেটা বেঁচে থাকবে?

সেটাই তো মুশকিল। শরীরের সব মেজর অর্গান ফেল করতে শুরু করেছে। কোনোভাবে আর চব্বিশ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আরও একটা বড় ব্রেক থ্রু হবে।

ঈশিতার ভেতরটা কেমন যেন শিউরে উঠল, বাইরে সে প্রকাশ করল। সহজ গলায় বলল, আমার সব সময়ই একটা জিনিস নিয়ে কৌতূহল, আমি সাইকোলজি পড়েছি, কিন্তু টেক্সট বুকে এগুলো থাকে না। যখন তোমরা ছেলেটার ব্রেনটাকে হাই স্টিমুলেশান দিয়ে ব্যবহার করো, তখন ছেলেটা কী কিছু অনুভব করে?

নীল চোখের মানুষটি ঘাড় ঝাঁকিয়ে বলল, আমরা জানি না। মনে হয়, তার অনুভূতিটা হয় কোনো একটা স্বপ্ন দেখার মতো।

এতক্ষণ একটা কথাও বলেনি যে মানুষটি, সে মোটা গলায় বলল, স্বপ্ন নয়, বলা উচিত, দুঃস্বপ্ন। বাচ্চাটা কী রকম ছটফট করে, দেখেছ? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ওর কষ্ট হয়।

দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল মানুষটি হাত নাড়িয়ে বলল, আমরা ওসব নিয়ে কথা না বললাম।

ঈশিতা বলল, হ্যাঁ, কথা না বললাম। সে দরজার দিকে এগোতে এগোতে থেমে গিয়ে বলল, তোমাদের যদি আমার কাছে কোনো প্রশ্ন থাকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ কোরো। আমি সিস্টেমে আছি।

দাড়ি-গোঁফওয়ালা মানুষটি বলল, এক সেকেন্ড রাইসা, আমি একটু দেখে নিই। তুমি কিছু মনে কোরো না, এই ঘরে তোমার উপস্থিতি আমাদের জন্য খুব বড় একটা বিস্ময়ের ব্যাপার।

ঈশিতা সহৃদয়ভাবে হাসল। বলল, আমি কিছু মনে করব না। তুমি সিস্টেমে আমার প্রোফাইল দেখে নিশ্চিত হয়ে নাও যে আমি তোমাদের একজন। আমি পুলিশ বাহিনীর একজন সিক্রেট এজেন্ট না।

মানুষটা কম্পিউটারের স্ক্রিনে ঈশিতার ছবি, নাম-পরিচয় বের করে এনে একনজর দেখে মাথা নাড়ল। বলল, থ্যাংকু রাইসা। তুমি তোমার কাজ করো।

ঈশিতা ঘর থেকে বের হয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার ক্যামেরায় যেটুকু তথ্য আছে, সেটা এদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ছেলেটির ছবি থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ওই মানুষগুলোর ভিডিও। ঘরের ভেতর যথেষ্ট আলো ছিল, ভিডিওটা খারাপ হওয়ার কথা নয়। যন্ত্রপাতির একটা শব্দ থাকলেও কথাবার্তা ভালোভাবে রেকর্ড হয়ে যাওয়ার কথা। এখন তাকে এখান থেকে বের হয়ে যেতে হবে। সিড়ি দিয়ে নেমে করিডর ধরে ডান দিকে।

ঈশিতা দ্রুত হাঁটতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে সে করিডর ধরে হেঁটে দরজার কাছে পৌঁছায়। ঢোকার সময় আঙুলের ছাপ, চোখের রেটিনা স্ক্যান করে ঢুকতে হয়েছিল। বের হওয়া খুব সহজ, দরজার নব ঘোরালেই দরজা খুলে যাবে। ঈশিতা নব ঘুরিয়ে দরজাটা খুলতেই চমকে উঠল। দরজার অন্য পাশে বব লাস্কি দাঁড়িয়ে আছে।

ঈশিতা বব লাস্কিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যাচ্ছিল। বব লাস্কি তাকে থামাল, এই যে তুমি, শোনো।

ঈশিতা দাঁড়াল। বব লাস্কি বলল, তুমি কে?

আমি রাইসা সুলতানা। একজন নতুন এমপ্লয়ি।

সেটা অবশ্যি দেখতে পাচ্ছি। এনডেভার থেকে বের হতে চাইলে আগে সেখানে ঢুকতে হয়। আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম এমপ্লয়ি ছাড়া কাউকে ঢুকতে দেবে না। তুমি নিশ্চয়ই আমাদের এমপ্লয়ি।

ঈশিতা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ। আমি কি এখন যেতে পারি? ছোট একটা ইমার্জেন্সি ছিল।

তুমি অবশ্যই যাবে রাইসা সুলতানা। কিন্তু আমাকে এক সেকেন্ড সময় দাও। এখানে যাদের নেওয়া হয়েছে, আমি তাদের সবার ইন্টারভিউ নিয়েছি। সবার চেহারা আমি মনে রেখেছি। তোমার চেহারাও আমার মনে আছে, তোমাকেও আমি দেখেছি। কিন্তু খুব আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানো? ঈশিতার শরীর শীতল হয়ে আসতে থাকে। চেষ্টা করে বলল, কী?

তোমাকে আমি ইন্টারভিউ বোর্ডে দেখিনি। তোমাকে আমি দেখেছি আমার অফিসে। আমি তোমার ইন্টারভিউ নিইনি, তুমি আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলে।

ঈশিতা স্থির চোখে বব লাস্কির দিকে তাকাল। সে ধরা পড়ে গেছে। একেবারে শেষ মুহূর্তে সে ধরা পড়ে গেছে। বব লাস্কি নিচু গলায় বলল, রাইসা সুলতানা কিংবা যেটি তোমার আসল নাম—তুমি কি আমার সঙ্গে একটু ভেতরে আসবে? এটি একটি ভদ্রতার কথা, কারণ তুমি যদি আসতে চাও, তোমাকে জোর করে নেওয়া হবে। ওই দেখো দুজন সিকিউরিটি আমার ইঙ্গিতের জন্য দাঁড়িয়ে আছে।

ঈশিতা খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *