০৫. ঈশিতা সাবধানে থাকল না

ঈশিতা অবশ্যি মোটেই সাবধানে থাকল না। সে পরদিন তার ক্যামেরা নিয়ে টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে হাজির হলো। মুখে কাপড়ের একটা মাস্ক লাগিয়ে নিয়েছিল এবং আশা করতে লাগল, এনডেভারের লোকজন যেন তাকে না চেনে।

সেখানে আরও কয়েকজন সাংবাদিক ছিল, তারাও মুখে মাস্ক লাগিয়েছে। তারা লাগিয়েছে অন্য কারণে, ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে। বড় একটা টেলিভিশন ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে একজন গজগজ করতে করতে ঈশিতাকে বলল, ক্যামেরাম্যানের চাকরির খেতা পুড়ি।

ঈশিতা বলল, কেন, কী হয়েছে?

কোনো দিন টেলিভিশনে আমাদের চেহারা দেখায়? দেখায় না।

কেন দেখাবে? দেখানোর কথা না, আর দেখাবে না জেনেই তো চাকরিটা নিয়েছেন।

সেটা সত্যি। কিন্তু তাই বলে জীবনের সিকিউরিটি দেবে না? অজায়গা কুজায়গায় পাঠিয়ে দেয়, একশবার বলে দেয়, তোমার জান গেলে যাক, ক্যামেরার যেন ক্ষতি না হয়।

ঈশিতা কিছু না বলে একটু হাসল, মুখের মাঝে মাস্ক লাগানো, তাই সেই হাসিটা ক্যামেরাম্যান অবশ্যি দেখতে পেল না। ক্যামেরাম্যান বলল, এখানে প্লেগ নাকি এইডস-কী সমাচার কিছু জানি না। পাঠিয়ে দিল, ফুটেজ নিতে হবে। এখন যদি মারা যাই?

ঈশিতা বলল, ভয় নাই, মারা যাবেন না। এটা পানিবাহিত, আপনার মুখের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। কিছু খাবেন না। বাসায় গিয়ে সাবান দিয়ে গোসল করে নেবেন।

ব্যাটা জীবাণু জানে তো যে সে পানিবাহিত? তার শুধু মুখ দিয়ে যাওয়ার কথা? যদি মাইন্ড চেঞ্জ করে বাতাসবাহিত হয়ে নাক দিয়ে ঢুকে যায়?

ঈশিতা আবার একটু হাসল, কিন্তু ক্যামেরাম্যান হাসিটা দেখতে পাবে না বলে মুখে বলল, না, এই ভাইরাস মাইন্ড চেঞ্জ করবে না। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।

কথা বলতে বলতে ঈশিতা একটু দূরে তাকিয়ে ছিল। বস্তির ছোট রাস্তাটার কাছাকাছি অনেক অ্যাম্বুলেন্স দাঁড়িয়ে আছে। অ্যাম্বুলেন্সের ওপর লালবাতি জ্বলছে ও নিভছে। লালবাতি জ্বলা আর নেভার কথাটা কে প্রথম চিন্তা করে বের করেছিল কে জানে, কিন্তু এই জ্বলা ও নেভা বাতিগুলো নিঃসন্দেহে পুরো এলাকায় একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। ঈশিতা দূর থেকে লক্ষ করে, ধবধবে সাদা পোশাক পরা মানুষজন স্ট্রেচারে করে নানা বয়সী মানুষকে আনছে। আত্মীয়স্বজন তাদের ঘিরে থাকার চেষ্টা করছে, কিন্তু কেউ তাদের কাছে আসতে দিচ্ছে না। অ্যাম্বুলেন্সগুলো বিশেষভাবে তৈরি। একসঙ্গে বেশ কয়েকটা স্ট্রেচার সেখানে ঢোকানো যায়। স্ট্রেচারগুলো ঢোকানোর পর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হলো। একটা একটা অ্যাম্বুলেন্স যখন ছেড়ে দিতে শুরু করেছে, তখন হঠাৎ করে খানিকটা উত্তেজনা দেখা গেল। মনে হলো, উত্তপ্ত গলায় কথা-কাটাকাটি হচ্ছে একজন মহিলার কাতর গলার স্বর আর্তনাদের মতো শোনা যেতে থাকে। সাদা কাপড় পরা মানুষগুলোকে বস্তির মানুষেরা ঘিরে ফেলেছে এবং তার ভেতর থেকে একজন মহিলার কান্না শোনা যেতে থাকে।

ক্যামেরাম্যান তার ক্যামেরা নিয়ে সেদিকেই ছুটে যায়। ঈশিতা দেখল, কয়েকজন মানুষ তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। ভিড় একটু বেড়ে যাওয়ার পর ঈশিতাও মানুষজনের সঙ্গে মিশে গিয়ে কাছাকাছি এগিয়ে গেল। অ্যাম্বুলেন্সের কাছাকাছি একজন মাঝবয়সী মহিলা ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে চিঙ্কার করছে এবং কয়েকজন তাকে থামানোর চেষ্টা করছে। মহিলাটি কী বলছে, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল না। ঈশিতা তাই তার পাশের মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে ভাই?

হাজেরার ছেলেরে খুঁজে পাচ্ছে না।

হাজেরা? ঈশিতা জিজ্ঞেস করল, এই মহিলা হচ্ছেন হাজেরা?

হ।

কেন খুঁজে পাচ্ছে না?

গত পরশু অ্যাম্বুলেন্সে করে নিছিল। এখন কুনোখানে নাই।

তাই নাকি?

হ। হাজেরা তো তাই বইলছে।

বিষয়টা শোনার পর ঘটনাটা বোঝা ঈশিতার জন্য সহজ হলো। সে দেখল, হাজেরা নামের মহিলাটা প্রায় বাঘের মতো সাদা পোশাক পরা মানুষগুলোর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে আর চিৎকার করে বলছে, কই? আমার ছেলে কই? তুমরা পরশু দিন নিয়া গেছ।

সাদা পোশাক পরা মাঝবয়সী একজন মানুষ বলল, আমরা কেমন করে বলব তোমার ছেলে কোথায়?

পরশু দিন এই অ্যাম্বুলেন্সে করে নিছ।

নিয়ে থাকলে হাসপাতালে আছে।

নাই। আমি গিয়ে দেখেছি। অন্যরা আছে, কিন্তু আমার ছেলে নাই।

তাহলে অন্য কোথাও আছে।

আমি সব জায়গা খুঁজছি। মেডিকেল গেছি, কোথাও নাই।

না থাকলে আমরা কী করব?

তোমরা নিয়েছ, কোথায় নিয়েছ বলো। হাজেরা নামের মহিলাটা চিৎকার করে উঠল, কোথায় নিয়েছ? কোথায়?

ঠিক এ রকম সময় কয়েকজন পুলিশ এগিয়ে এল। তারা রাইফেলের বাঁট দিয়ে ধাক্কা মেরে সবাইকে সরিয়ে দেয়, চিৎকার করে বলে, সরে যাও। সবাই সরে যাও। অ্যাম্বুলেন্সগুলোকে যেতে দাও।

সাদা পোশাক পরা মানুষগুলো ঝটপট অ্যাম্বুলেন্সে উঠে পড়ে এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সাইরেন বাজাতে বাজাতে সেগুলো চলতে শুরু করে। হাজেরা অ্যাম্বুলেন্সের পেছন পেছন ছুটে যেতে চেষ্টা করল। দুজন পুলিশ তাকে থামাল।

হাজেরা হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো চিৎকার করতে থাকে। তখন একজন পুলিশ প্রচণ্ড জোরে তাকে ধমক দেয়, পেয়েছটা কী? মাতলামির জায়গা পাও না? সরকারি কাজে ডিস্টার্ব করো?

হাজেরা আকুল হয়ে কেঁদে বলল, আমার ছেলে–

তোমার ছেলে? তোমার ছেলের খোঁজ রাখবে তুমি।

আমার ছেলেকে—

মাস্তানি গুন্ডামি করে তোমার ছেলে কী করেছে, সেই খোঁজ রাখতে পারো না।

মাস্তানি গুন্ডামি করে নাই–

খবরদার। আর একটা কথা বলেছ কি সরাসরি চুয়ান্ন ধারায় বুক করে দেব। পুলিশদের একজন তখন উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, কী হচ্ছে? তামাশা দেখছ? যাও, সবাই যাও। নিজের নিজের কাজে যাও।

মানুষগুলো তখন সরে যেতে থাকে।

ঈশিতা একটু দূরে সরে গিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। যখন মানুষগুলো সরে ভিড়টা হালকা হয়ে আসে, তখন সে নিঃশব্দে হাজেরার কাছে গিয়ে বলল, এই যে শুনেন।

হাজেরা ঘুরে তাকাল, চোখের দৃষ্টি শূন্য। ঈশিতা বলল, আমি একজন সাংবাদিক। আপনার কথা শুনেছি আমি। আমাকে কি একেবারে ঠিক করে বলতে পারবেন, কবে, কখন, কোন অ্যাম্বুলেন্সে আপনার ছেলেকে নিয়েছে? সঙ্গে আর কে ছিল? অ্যাম্বুলেন্সের মানুষগুলোর চেহারা কী রকম?

হাজেরা কিছুক্ষণ তীব্র দৃষ্টিতে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর অনেকটা হিংস্র গলায় বলল, পরশু দিন দুপুরবেলা। একটা না হয় দুইটা বাজে। অনেক অ্যাম্বুলেন্স এসেছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে পিছনের অ্যাম্বুলেন্সে তুলেছে। একজন বিদেশি ছিল। সাদা চামড়া নীল চোখ।

আপনার ছেলের নাম কী?

মকবুল।

বয়স?

বারো।

আপনার কাছে মকবুলের ছবি আছে?

বাসায় আছে।

আমাকে একটু দেখাতে পারবেন?

আসেন আমার সাথে।

ঈশিতা হাজেরার সঙ্গে তার বাড়িতে গেল। ঘুপচি গলির পাশে গায়ে গায়ে লাগানো চালাঘর। তার একটার তালা খুলে হাজেরা ভেতরে ঢুকে একটু পর বের হয়ে আসে। স্টুডিওতে তোলা ছবি, দশ-বারো বছরের শুকনো একটা ছেলে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে স্ক্রিনে আঁকা নদীগাছ-পাখি এবং একটি প্রাসাদের দৃশ্য। ঈশিতা বলল, আমি এটার একটা ছবি তুলে নিই?

হাজেরা মাথা নাড়ল। ঈশিতা তার ক্যামেরা দিয়ে মকবুলের ছবিটার একটা ছবি তুলে নেয়। ছবিটা হাজেরাকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আপনার ছেলে অসুস্থ হলো কেমন করে, জানেন?

না। জানি না।

গত এক সপ্তাহে আপনার ছেলে কি অস্বাভাবিক কিছু করেছে?

না। করে নাই।

কিছু খেয়েছে?

না, খায় নাই।

কোনো ওষুধ–

এনজিওর আপারা সব বাচ্চাকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ভাইটামিন খেতে দিল—

ঈশিতা চমকে ওঠে। ভাইটামিন?

হ্যাঁ।

আছে সেই ভাইটামিন?

আছে।

দেখাবেন আমাকে?

কম। হাজেরা আবার ভেতরে ঢুকে একটা ভিটামিনের শিশি নিয়ে ফিরে আসে। ঈশিতা শিশিটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। বিদেশি দামি ভাইটামিন। ক্যামেরা বের করে সে ভাইটামিনের শিশিটার ছবি তুলে ফেরত দিয়ে বলল, এর ভেতর থেকে আমি একটা ভাইটামিনের ট্যাবলেট নিতে পারি?

নেন।

ঈশিতা শিশি খুলে একটা ভাইটামিনের ক্যাপসুল বের করে কাগজে মুড়ে পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করল, এই ক্যাপসুল ছাড়া মকবুল আর কিছু খেয়েছে?

ছোট মানুষ, সব সময়ই তো এইটা সেইটা খায়। বাদাম, আমড়া, আচার—

অন্য কিছু? এনজিওর আপারা কি আর কিছু খেতে দিয়েছিল?

হাজেরা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, দিতে পারে। মনে নাই।

কোন এনজিও, জানেন?

না, জানি না।

ঈশিতা বলল, ঠিক আছে, তাহলে আমি আসি।

হাজেরা ভাঙা গলায় বলল, আমি কি মকবুলরে খুঁজে পামু?

পাবেন। নিশ্চয়ই পাবেন। আস্ত একজন মানুষ তো আর হারিয়ে যেতে পারে না। আমিও খোঁজ নেব। কোনো খোঁজ পেলে আমি আপনাকে জানাব।

আল্লাহ আপনার ভালো করুক।

ঈশিতা চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এল। বলল, আর শোনেন।

জে।

মকবুলের ব্যাপারটা নিয়ে আপনি খুব বেশি মানুষকে কিছু বলবেন না।

কেন?

আমি জানি না। কিন্তু, কিন্তু—

কিন্তু কী?

আমার কেন জানি মনে হয়, এ বিষয়টা নিয়ে আপনি যত হইচই করবেন, আপনার ওপর তত বড় একটা বিপদ আসবে।

হাজেরা তীব্র দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, আপনি কেন এ কথা বলছেন?

ঈশিতা বলল, আমি জানি না। ঠিক করে জানি না। কিন্তু— ঈশিতা তার বাক্যটা শেষ করতে পারল না।

ঈশিতা ঘুপচি গলি দিয়ে বের হতে হতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল, গলির মুখে সাফারি কোট পরা কঠোর চেহারার দুজন মানুষ। এই মানুষগুলোকে সে আগে দেখেছে, এরাই তাদের অফিসে এসেছিল। এরা এখন কাউকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করছে। কী জিজ্ঞেস করছে ঈশিতা বুঝে গেল। এরা হাজেরার বাসাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। ঈশিতা দ্রুত পাশের গলিতে ঢুকে যায়। মানুষ দুজন এখানে তাকে দেখতে পেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, তার আর হাজেরার দুজনেরই।

 

ঈশিতা বাকি দিনটুকু খোঁজখবর নিয়ে কাটাল। হাজেরার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে মকবুলকে এনডেভারের ভেতরেই নেওয়া হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সগুলো সারি বেঁধে এনডেভারে ঢুকেছে, কোনোটা অন্য কোথাও যায়নি। কাজেই মকবুল নিশ্চয়ই এনডেভারের ভেতরই আছে। অন্য সবার মেডিকেল রিপোর্ট দিয়েছে, মকবুলের রিপোর্ট নেই। শুধু যে রিপোর্ট নেই তা নয়, তার কোনো হদিসই নেই।

যাদের রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে, তাদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ বিপদমুক্ত—কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে তাদের শরীরে এই ভাইরাসের প্রতিষেধক আছে, ভাইরাসের আক্রমণের পর প্রথম কয়েক দিন জ্বর, মাথাব্যথা এ রকম খানিকটা উপসর্গ দেখা গেছে। তারপর নিজে নিজেই সেরে উঠতে শুরু করেছে। দ্বিতীয় ভাগের মস্তিষ্কে এক ধরনের প্রদাহ শুরু হয়েছে, সেটা কতটুকু গুরুতর হবে, কেউ জানে না। যারা আক্রান্ত হয়েছে, তারা অমানুষিক যন্ত্রণায় ছটফট করছে। শুধু তা-ই নয়, নানা ধরনের বিভ্রমে ভুগছে। তাদের বেশির ভাগকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে। ভাইরাসের কোনো সহজ চিকিৎসা নেই বলে সবাই অপেক্ষা করছে—শরীর নিজে থেকে যদি সেরে ওঠে তার অপেক্ষায়। তৃতীয় ভাগের অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহতারা সবাই গভীর কোমায়। এই গভীর কোমা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে কী পারবে না, কেউ জানে না।

 

ঈশিতা পরদিন হাজেরার সাথে দেখা করতে গেল। বস্তির ভেতরে ঢোকার আগেই সে অনুমান করে সেখানে কিছু একটা হয়েছে। হাজেরার ঘরের কাছাকাছি এসে বুঝতে, পারল যেটা হয়েছে সেটা হাজেরাকে নিয়ে। তার ঘরের সামনে পুলিশ এবং অনেক মানুষের ভিড়। পুলিশ মানুষগুলোকে সরিয়ে রেখেছে এবং কয়েকজন ধরাধরি করে হাজেরার মৃতদেহটি বের করে আনছে। গত রাতে সে বিষ খেয়ে মারা গেছে।

ঈশিতা কোনো কৌতূহল দেখাল না, কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে তার ভেতরটা আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে আছে। তাকে কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু সে জানে, হাজেরা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেনি, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। ঈশিতা এটিও জানে, হতদরিদ্র হাজেরার ঘর থেকে খোয়া যাওয়ার মতো। মূল্যবান কিছু নেই, কিন্তু তার পরও সেখান থেকে অন্তত একটি জিনিস নিশ্চয়ই খোয়া গেছে। সেটা হচ্ছে হাজেরার ছেলে মকবুলের একটি ফটো।

বেশির ভাগ মানুষই লক্ষ করেনি, পরদিন বেশ কয়েকটি খবরের কাগজে হাজেরার মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়েছিল। তার মাদকাসক্ত ছেলে মকবুলের দৌরাত্ম্যে নিরুপায় হয়ে সে আত্মহত্যা করেছে। মকবুল বাড়ি থেকে পালিয়েছে অনেক দিন, সে কথাটিও খবরে লেখা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সে অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে। কোথাও লেখা নেই, মকবুলের বয়স মাত্র বারো। কোথাও লেখা নেই, সে ছিল হাসিখুশি শিশু, মায়ের আদরের ধন।

 

দেশের প্রায় সব মানুষই লক্ষ করেছিল, সে রকম আরও একটি খবর সেদিন খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিল। আবহাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করার জন্য নতুন একটি এলগরিদম এনডেভার প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করে দেখেছে। তাদের নিউরাল কম্পিউটারে সেই এলগরিদম একটি মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। এনডেভার খুব গর্ব করে বলেছে যে বাংলাদেশের মানুষ শুনে খুব আনন্দ পাবে যে এই মাইলফলকটি স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশে, এই নিউরাল কম্পিউটারটিও তৈরি হয়েছে বাংলাদেশে। এনডেভার বাংলাদেশের জনগণ, তাদের মেধাবী জনগোষ্ঠী এবং সরকারের আন্তরিক সহযোগিতার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।

ঈশিতা খবরের কাগজের দুটি খবরের দিকেই দীর্ঘ সময় তাকিয়ে রইল। সে বুঝতে পারল, তার ভেতর একটা অসহ্য ক্রোধ পাক খেয়ে উঠছে। অসহায় ক্রোধ, তাই সেটি ছিল ভয়ংকর।

 

মানুষটা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ ঈশিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি কী করব?

আপনি আপনার টিমের সঙ্গে আমাকে নিয়ে যাবেন।

মানুষটা কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, আ-আমি, আমার টিমের সঙ্গে আপনাকে নিয়ে যাব?।

হ্যাঁ।

মানুষটা বলল, আমি আপনাকে চিনি না, জানি না, আপনি আমাদের এমপ্লয়ি না, অথচ আপনাকে আমি টিমের সঙ্গে নিয়ে যাব?

হ্যাঁ। আমি সেটাই অনুরোধ করছি। ঈশিতা জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমার অনুরোধ রাখা, না-রাখা আপনার ইচ্ছা।

মানুষটা কিছুক্ষণ ঈশিতার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আপনার

অনুরোধটা যে বেআইনি, আপনি সেটা জানেন?

জানি।

আপনি কি কখনো কাউকে ছিনতাই করতে বলেছেন? চুরি, ডাকাতি কিংবা মার্ডার করতে?

না, বলিনি।

কিন্তু আমাকে একটা বড় ধরনের অপরাধ করতে বলেছেন? এর কারণে আমার চাকরি চলে যেতে পারে। আমার কোম্পানির লাল বাতি জ্বলতে পারে কিংবা— মানুষটি তার বাক্য শেষ না করেই থেমে গেল।

ঈশিতা বলল, কিংবা—

আমি যদি পুলিশ-র্যাবকে খবর দিই, আপনি বড় ধরনের আইনি ঝামেলায় পড়ে যেতে পারেন।

ঈশিতা হাসির ভঙ্গি করল। বলল, আপনি খবর দেবেন না। মানুষটি

অবাক হয়ে বলল, আমি খবর দেব না?

না। আপনি যদি সবকিছু শোনেন, তাহলে আপনি কখনোই পুলিশ আর র্যাবকে খবর দেবেন না।

মানুষটা বলল, শুনি আপনার সবকিছু।

ঈশিতা তার পকেট থেকে মকবুলের ছবিটি বের করে মানুষটির হাতে দিয়ে বলল, এই ছেলেটাকে দেখে আপনার কী মনে হয়?

মানুষটা ছবিটি দেখে বলল, একটা ছেলে। গরিব ঘরের ছেলে। বয়স নয়-দশ বছর।

কারেক্ট। তবে ছেলেটার বয়স বারো। টিঅ্যান্ডটি বস্তিতে ভাইরাস অ্যাটাকে যারা অসুস্থ হয়েছিল, তার মধ্যে এই ছেলেটাও ছিল। এনডেভারের অ্যাম্বুলেন্স তাকে নিয়ে গেছে। কিন্তু–

কিন্তু?

ছেলেটা উধাও হয়ে গেছে। তার মা হাজেরা বেগম সেটা নিয়ে হইচই করেছিল। তার ফল হয়েছে এইটা— ঈশিতা এবার হাজেরার মৃত্যুসংবাদ ছাপা হওয়া খবরের কাগজের কাটিংটা দিল।

মানুষটা খবরের কাগজটা পড়ে মুখ তুলে বলল, আত্মহত্যা করেছে?

না। মহিলাটাকে মেরে ফেলেছে।

আপনি কেমন করে জানেন?

আমি জানি। সন্তানকে নিয়ে ব্যাকুল কোনো মা আত্মহত্যা করে না। তা ছাড়া আমি সেখানে দুজন মানুষকে দেখেছি, যারা অবলীলায় মানুষ খুন করতে পারে বলে নিজে আমাকে জানিয়েছে।

মানুষটাকে এবার কেমন জানি বিভ্রান্ত দেখায়। মাথা নেড়ে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

পারার কথা নয়। আমি অনেক দিন থেকে লেগে আছি, তাই এখন একটু একটু বুঝতে শুরু করেছি। ঈশিতা মুখ শক্ত করে বলল, মকবুল নামের ছেলেটা এনডেভারের ভেতরেই আছে বলে আমার ধারণা। সেখানে কেউ ঢুকতে পারে না, আপনারা ছাড়া। আ আমরা শুধু অক্সিজেন সাপ্লাইটা দেখি। আমাদের কোম্পানির দায়িত্ব অক্সিজেন সাপ্লাই ঠিক রাখা, আর কিছু না।

সেটাই দরকার। অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের শেষে থাকে একজন মানুষ। আমি শুধু জানতে চাই, সেই মানুষগুলোর মধ্যে মকবুল নামের ছেলেটা আছে কি না। আর কিছু না।

মানুষটা নিঃশব্দে মকবুলের ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশিতা বলল, ঠিক আছে, আপনি যদি আমাকে আপনাদের টিমের সঙ্গে নিতে না চান, তাহলে অন্তত আমাকে এটুকু সাহায্য করেন। আপনি ভেতর থেকে এটুকু খবর এনে দেন যে মকবুল ভেতরেই আছে। বেঁচে আছে।

মানুষটা কোনো কথা না বলে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে রইল। ঈশিতা তার পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মানুষটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই যে এটা আমার কার্ড। আমার ফোন নম্বর, ই-মেইল, ওয়েবসাইট সব দেওয়া আছে। যদি আপনি কিছু জানতে পারেন আর যদি আমাকে জানাতে চান, তাহলে জানাতে পারেন।

ঈশিতা উঠে দাঁড়িয়ে যখন চলে যেতে শুরু করেছে, তখন মানুষটি বলল, আমি শুধু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না।

কোন ব্যাপার?

আপনার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এটা অসম্ভব বিপজ্জনক একটা ব্যাপার। খবর চেপে রাখার জন্য মানুষ মানুষকে মেরে ফেলে। অথচ আপনি আমার কাছে এসে সবকিছু বলে দিলেন। কোনো রাখঢাক নেই। আপনি আমাকে বিশ্বাস করে বসে আছেন?

ঈশিতা মাথা নাড়ল, বলল, জি, করেছি।

কেন? এত বড় একটা ব্যাপার নিয়ে আমাকে বিশ্বাস করলেন কেন?

আমি সাংবাদিক মানুষ। আমার কাজই হচ্ছে খোঁজখবর নেওয়া। আমি খোঁজখবর নিয়ে এসেছিলাম। আপনার বাবা ষাটের দশকে বামপন্থী রাজনীতি করতেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আপনি মাজু বাঙালি ছদ্মনামে কবিতা লেখেন। কবিতাগুলো এখনো একটু কাঁচা কিন্তু বিষয়বস্তু খাটি। দেশের জন্য ভালোবাসা, দেশের মানুষের জন্য ভালোবাসা। আমি জানি, আপনি আর যাই করেন, কখনো দেশের মানুষের সঙ্গে বেইমানি করবেন না।

মানুষটা ঈশিতার দিকে তাকিয়ে বলল, আর আমি কেমন করে বুঝতে পারব, আপনি আসলে কারও সঙ্গে বেইমানি করছেন না?

আমার চোখের দিকে তাকাবেন, তাহলেই বুঝবেন। মানুষকে কোথাও কোথাও অন্য মানুষকে বিশ্বাস করতে হয়।

ঈশিতা চলে যেতে যেতে আবার থামল। বলল, মকবুলের ছবিটা আপনার কাছেই থাকুক। কিন্তু এ ছবিটা আপনার কাছে আছে, সেটা জানাজানি হলে আপনার বিপদ হতে পারে।

মাজু বাঙালি ছদ্মনামে কবিতা লেখে যে মানুষটি, সে কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে মকবুলের ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইল।

 

দুদিন পর ঈশিতা একটা টেলিফোন পেল, ভারী গলায় একজন জানতে চাইল, ঈশিতা?

কথা বলছি।

আমি মাজহার। গলার স্বরটা পরিচিত, কিন্তু ঈশিতা ঠিক চিনতে পারল না। তখন মানুষটি তার পরিচয় আরেকটু বিস্তৃত করল। বলল, আপনি আমাকে মাজু বাঙালি হিসেবে জানেন। কবি মাজু বাঙালি। কবি অংশটা দুর্বল, বাঙালি অংশটা শক্ত।

ঈশিতা উত্তেজিত গলায় বলল, আপনি! কি আশ্চর্য! কোনো খবর আছে?

আছে। ছেলেটা বেঁচে আছে।

বেঁচে আছে?

হ্যাঁ। তবে এই বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। যন্ত্রপাতি দিয়ে বেঁচে থাকা।

আপনি নিজের চোখে দেখেছেন?

হ্যাঁ। আমি নিজের চোখে দেখেছি।

ঈশিতা বলল, ব্যাস। এর বেশি টেলিফোনে বলার দরকার নেই। আমার টেলিফোন ট্যাপ করছে বলে মনে হয়। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করে শুনে নেব।

ঠিক আছে।

ঈশিতা টেলিফোন লাইন কেটে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *