০৭. বাংলা সাহিত্যে রাজপুতনার যুগ

সাত

রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যকে কি অবস্থা থেকে বাঙালির সমাজ জীবনের নিজস্ব আবহের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন, সেই বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি যখন সাহিত্য রচনা করিতে আরম্ভ করিয়াছি, বাংলা সাহিত্যে তখনো রাজপুতনার যুগ চলিতেছে।’ বাস্তবিকই উনবিংশ শতাব্দীতে আধুনিক বাংলা সাহিত্য সৃজনের একটা উৎসব লেগে গিয়েছিলো এবং সেই সাহিত্যের প্রায় আশি ভাগেরই বিষয়বস্তু ছিলো রাজপুতনা থেকে আহরণ করা। বৃটিশ সেনা অফিসার জেমস টড Annals and antiquits of Rajasthan নামাঙ্কিত সুবৃহৎ গ্রন্থটি সঙ্কলন করে বেশ কটি খণ্ডে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন। দেখা গেলো, সেই সংগ্রহ গ্রন্থটিই উনিশ শতকী বাংলার সৃজনশীল সাহিত্যরথীদের কাহিনী আহরণের উৎসভাণ্ডার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এবং অগ্রজা স্বর্ণকুমারী দেবী দু’জনেই তাঁদের অনেক উপন্যাস এবং রচিত নাটকের পুট জেমস টডের রাজস্থান গ্রন্থ থেকে ধার করেছিলেন। খুব সম্ভবতো রবীন্দ্রনাথের কথাটির মধ্যে আপন পরিবারের লোকদের প্রতি একটা কটাক্ষ ছিলো। টডের গ্রন্থটা ইতিহাস নয়। রাজস্থানের চারণ কবিরা তাঁদের জাতীয় জীবনের যে সকল কাহিনী পথে ঘাটে গেয়ে বেড়াতেন, সেগুলো তাঁর লোকদের মাধ্যমে সংগ্রহ করে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন। যে কাহিনী জেমস টড সংকলন করেছিলেন তার মধ্যে ঐতিহাসিক সত্যের পরিমাণ ছিলো খুবই অল্প। কিন্তু কবিদের হাতে পড়ে তুচ্ছ অকিঞ্চিতকর ঘটনাচূর্ণ সত্য মিথ্যে মিলিয়ে এমন হৃদয়গ্রাহী রূপ পেয়েছে একজন ইংরেজ নন্দনও সেগুলোর প্রতি অনুরাগ পোষণ না করে। পারেননি। একটা সূক্ষ্ম রাজনৈতিক কারণ যদি টডের ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে, তাতেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। ইংরেজরা মোগল সাম্রাজ্যের ভগ্নস্থূপের ওপর তাদের আপন সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলো। সুতরাং মোগলদের প্রতি একটা বিদ্বেষ জ্বালিয়ে তোলার বাসনা যদি টডকে তাড়িত করে থাকে তাও অবিশ্বাস্য মনে হবে না। খুব সহজে ওটাকে বৃটিশের ডিভাইড এ্যাণ্ড রুল পলিসির অংশ বলে মেনে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে কাজটা ছিলো মানুষের মনের ওপর।

টডের বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই কাহিনী আহরণ করে কাব্য উপন্যাস নাটক এবং আখ্যায়িকা রচনার একটা হিড়িক পড়ে গেলো। ইউরোপীয় সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটা বিরাট অংশ যখন তাঁদের আত্মাভিমান চরিতার্থ করার জন্য নিজেদের অতীত ইতিহাস থেকে হন্যে হয়ে গৌরবের বিষয় সন্ধান করছিলেন, জেমস টডের সুবৃহৎ রাজস্থান গ্রন্থ তাঁদের সামনে সেই আত্মগৌরব এবং অতীত মহিমার নিদর্শনরাজি তুলে ধরলো। উনবিংশ শতাব্দীর ছোটো বড়ো প্রায় সকল কবি লেখকই রাজপুত বীর বীরাঙ্গনাদের জীবন কাহিনী নিয়ে গ্রন্থ রচনা করতে লেগে গেলেন। রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায়, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, গিরীশ ঘোষ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, স্বর্ণকুমারী দেবী, ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ কেউই বাদ গেলেন না। এ হলো শ্রেষ্ঠ সাহিত্য স্রষ্টাদের নামের ফিরিস্তি। অপেক্ষাকৃত কম খ্যাতিমান কত কবি, লেখক, নাট্যকার যে রাজস্থানের কাহিনী অবলম্বন করে পুস্তক রচনা করেছেন, তার সংখ্যা নিশ্চয়ই অনেকগুণ বেশি।

রাজপুত বীর বীরাঙ্গনাদের জীবন কাহিনী নিয়ে যে সমস্ত কবি লেখক গ্রন্থাদি রচনা করেছেন; তাঁদের প্রায় সকলের মধ্যে একটা প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্য অতি সহজে লক্ষ্য করা যায়। যে সমস্ত রাজপুত মোগল বা অন্যান্য মুসলিম রাজন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, তাঁদেরকে আর্যশক্তির প্রতীক হিসেবে দেখার প্রবণতা প্রায় সকলের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। উনিশ শতকী বাঙালি হিন্দু লেখকদের মধ্যে একটি মনোভাব ভালো। রকমভাবে ক্রিয়াশীল ছিলো, তাহলো এ রকম। যে সুসভ্য বলদর্পী আর্যজাতি ভারতবর্ষে ধর্ম এবং সংস্কৃতি বিস্তার করেছিলো, বিদেশী, বিজাতি এবং বিধর্মীরা শতো শত বছর ধরে নিশেষণ চালানোর পরেও সেই গৌরব সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে পারেনি। রাজপুতনার মরুভূমির পবিত্র বালুকণা সে সকল শহীদ বীর বীরাঙ্গনাদের স্মৃতি অম্লানভাবে রক্ষা করছে। আর্যদের গৌরববোধে উদ্দীপিত বোধ করেই দলে দলে বাঙালি লেখকেরা রাজস্থানের অভিমুখে মানসযাত্রা করতে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর কৃতবিদ্য ব্যক্তিদের মধ্যে এই যে সর্বব্যাপ্ত মানস লক্ষণ তার কোনো জটিল ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়ে না। তাঁরা সকলে হিন্দুর অতীতের মধ্যে গৌরবের বিষয় সন্ধান করছিলেন এবং টডের রাজস্থানের মধ্যে সে বস্তু পেয়ে গিয়েছিলেন। অতএব, ভারতের পুত্রগণ হিন্দু সমুদয় মুক্ত কণ্ঠে বল সবে ব্রিটিশের জয় আর রাজস্থান থেকে গৌরব গাঁথা সংগ্রহ করো।

সৎ, সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস পাঠক এখানে একটি প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন। আচ্ছা রাজস্থানের রাজপুতরা সত্যি সত্যি অতীতের আর্যদের উত্তরসূরী ছিলেন? ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে। রাজপুতদের সঙ্গে আর্যদের সম্পর্ক খুবই ক্ষীণ। দূরতম অসম্ভব কল্পনাতেও আর্যদের সঙ্গে রাজপুতদের কোনো সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়। রাজপুতরা ছিলো হুনদের বংশধর। তারাও সপ্তম অষ্টম শতাব্দীর দিকে মুসলমানদের মতো বাইরে থেকে এসে বার বার হামলা করে ভারতবর্ষে ধ্বংস এবং হত্যাযজ্ঞের প্লাবন বইয়ে দিয়েছিল। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রবহমানতা এবং ভারতীয় চিন্তা ভাবনার স্বাভাবিক অগ্রগতি তারাই রুদ্ধ করে দিয়েছিলো, তা মুসলমানদের ভারত আক্রমণের পূর্বের ঘটনা। কিন্তু এ কথার অর্থ এই নয় যে, মুসলমানরা কোনো রকমই হত্যা, ধ্বংস করেনি। মধ্যযুগের রীতি অনুসারে তারাও হত্যা, লুণ্ঠন, নারীহরণ মন্দির ধ্বংস এসব কাজ অবশ্যই করেছে।

আমার বক্তব্য বিষয়ে ফিরে আসি। রাজপুতরা আর্য নয়। কিন্তু টডের গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরে কোনো রকমের ঐতিহাসিক অনুসন্ধান ব্যতিরেকে উনিশ শতক, এমনকি বিশ শতকের প্রথম দিকেও বাঙালি হিন্দু লেখকেরা রাজপুতদের আর্য হিসেবে শনাক্ত করে, সমস্ত শ্রদ্ধার্ঘ সমস্ত সাধুবাদ নিবেদন করেছেন। এই জিনিশটাকে একটা বিশেষ ধরনের মানসিকতা বলে মেনে নেয়াই সঙ্গত। মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে যারাই প্রতিরোধ এবং প্রতিবন্ধকতা রচনা করতে পারবেন আর্য শিরোপা অবশ্যই তাঁদের প্রাপ্য হয়ে দাঁড়ায়। একই রকম আরেকটি মানসিকতা থেকেই বাইরে থেকে এসে ভারতীয় হিন্দুদের যারা পরাজিত করেছে তারা সকলেই যবন, তাদের অন্য কোনো পরিচয় নেই। প্রথমে গ্রীক, তারপরে মুসলমান এবং তারপরে ইংরেজ। সময়ের ব্যবধানটা কিছুই নয়।

উনিশ শতকী হিন্দু লেখকেরা রাজপুতদের নামসমূহকে বার বার তাঁদের কল্পনাশক্তি বলে জীবন্ত করেছেন এবং এই সব জিনিশকে আর্য নিদর্শন ধরে নিয়ে তাঁদের সৃষ্টিশক্তির প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এ ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা এভাবে দাঁড় করানো যায়। তাঁরা গৌরবের কিছু নিদর্শন সন্ধান করছিলেন, তাঁদের নতুন সামাজিক ভিত্তি এবং নবজাগ্ৰত অনুভূতি গরীয়ান কিছুর দিকে ধাবিত করে। নিয়েছিলো। নতুন একটা যুগের দাঁড় প্রান্তে দাঁড়িয়ে তাঁদের মধ্যে একটি নতুন চিত্তক্ষুধা জন্ম নিয়েছে। কারণ অবচেতনে তাঁরা অনুভব করছিলেন ইতিহাস একটি নতুন যুগ সৃষ্টি করার দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে তুলে দিয়েছে। বৃটিশের এই অনুগ্রহভোগী মধ্যবিত্তের এই চিত্তক্ষুধাটা যেমনি অসার তেমনি ক্ষুধানিবৃত্তির যে খাদ্য সাহেবরা সরবরাহ করলেন, তাতেও পুষ্টিকর উপাদানের কিছু ছিলো না। উনবিংশ শতাব্দীর সমস্ত বাতাবরনটা যখন রাজপুতদের অলীক আর্যদের গৌরবের আচ্ছাদিত সেই পরিবেশে মাইকেল প্রহসন দুটো লিখলেন, ভবানীচরণ হতোম পাচার নকশা, প্যারীচরণের আলালের ঘরের দুলাল, দীনবন্ধুর নীলদর্পন নাটক রচনা করতে পারলেন, এগুলোকে ব্যতিক্রমী ঘটনা বলে চিহ্নিত করা ছাড়া উপায় থাকে না।

রাজস্থানের মরুভূমি ঝিকিমিকি বালুকণার মধ্যে উনবিংশ শতাব্দীর হিন্দু লেখক কবিরা কল্পনার দৃষ্টি দিয়ে হিন্দু সভ্যতার লুপ্ত মহিমার অবলোকন করেছিলেন। এখানে একটি পশ্ন স্বতঃই উদয় হওয়ার কথা। ভারতবর্ষে মোগলদের প্রবল প্রতিপক্ষ হিসেবে কোনো শক্তিকে যদি শনাক্ত করতে হয়, মারাঠিদের নাম অবশ্যই উচ্চারিত হওয়া উচিত। মারাঠা নায়ক ছত্রপতি শিবাজি মোগল শাসনের সমান্তরাল একটি শাসন পদ্ধতি কায়েম করতে চেয়েছিলেন। তিনি হিন্দু পাদপাদশাহী প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হিন্দু জনগোষ্ঠীর একাংশের মনে উত্তমরূপে গেঁথে দিতে পেরেছিলেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সুবিশাল মোগল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হয়, মারাঠি শক্তির উত্থানই তার অন্যতম কারণ। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধে আফগানরাজ আহমদ শাহ আবদালীর হাতে মারাঠা শক্তির যদি শোচনীয় পরাজয় না হতো, হয়তো শিবাজির উত্তরাধিকারীদের কেউ দিল্লীর মসনদ দখল করে হিন্দু পাদপাদশাহী কায়েম করে শিবাজির প্ল সফল করতে পারতেন। হিন্দু শৌর্যবীর্যের এমন জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত থাকা সত্বেও উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকেরা হিন্দু গৌরবের সন্ধানে মহারাষ্ট্রের বদলে রাজস্থানে ছুটলেন কেননা সেটাও ভেবে দেখার ব্যাপার। তার পেছনে নানা রকম কারণ বর্তমান ছিলো। প্রথম কারণ বাঙালি জনগণের মনে আলীবর্দী খানের আমল থেকেই মারাঠাদের প্রতি খারাপ ধারণা শেকড় গেড়ে বসেছিলো। মারাঠি বর্গীদের বাঙলা আক্রমণের স্মৃতিকে উপলক্ষ করেই ছড়া লেখা হয়েছিলো, “ছেলে ঘুমুলো পাড়া জুড়োলো বর্গী এলো দেশে”। পলাশীর যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে ওই সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র লিখেছিলেন “নগর পুড়িলে কি দেবালয় এড়ায়।” মারাঠা সৈন্য কর্তৃক নগর জনপদ পুড়িয়ে দেয়ার তিক্ত স্মৃতি বাঙালি জনগণের মনে এমন গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলো, মারাঠিরা হিন্দু রাজত্বের পুনরুথান ঘটালেও উনিশ শতকের বাঙালি লেখকেরা গল্প উপন্যাস এবং নাটকের নায়ক হিসেবে সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা দেয়ার উপযুক্ত মনে করেননি। দ্বিতীয় কারণটি এও হতে পারে টডের মতো নিবেদিত প্রাণ কোনো সাহেব মারাঠিদের শৌর্য বীর্যের কাহিনী আবেগ অনুভূতি দিয়ে ইংরেজি শিক্ষিত শ্ৰেণীটির সামনে তুলে ধরেননি। ইংরেজদের পক্ষে মারাঠি শৌর্যের গুণকীর্তন করার কাজটি অতো সহজ ছিলো না। কারণ ইংরেজকে আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপী ভারত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে। গুণকীর্তন করে মারাঠা ভাবমূর্তির প্রতিষ্ঠা কখনো কোনো বিদেশী শক্তি করতে পারে না। আর উনবিংশ শতাব্দীর মানস পরিমণ্ডলটাই এমন ছিলো যে, যে কাজ করলে সাহেবদের প্রীতি উৎপাদন করানো সম্ভব নয়; সে সব বিষয় নিষিদ্ধ বস্তু হিসেবে সযত্নে পরিহার করা হতো। এটা কি খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার নয় যে বাংলা সাহিত্যের প্রধান প্রধান লেখক, কবি এবং নাট্যকারদের কেউই শিবাজিসহ অন্যান্য মারাঠা চরিত্র অবলম্বন করে কোনো কিছু লিখলেন না। ভারতে অন্যূন আটশো বছরের মুসলমান শাসনে মারাঠারা যে দক্ষতা এবং যোগ্যতা সহকারে মুসলিম শক্তির প্রতিশধী একটি শক্তি হয়ে উঠেছিলো, তেমন দৃষ্টান্ত তো আর একটিও নেই।

হ্যাঁ কথা উঠতে পারে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারাঠা নায়ক শিবাজিকে বিষয়বস্তু করে শিবাজি উৎসব শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন। সে অনেক পরের ব্যাপার। এই সময়ের মধ্যে কাল প্রবাহের গতি অনেক দূর পরিবর্তিত হয়েছে। রবীন্দ্র জীবনীকার শ্রীপ্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় শিবাজি উৎসব রচনার পটভূমি এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কবি তিলক (মহারাষ্ট্রের নেতা বালগঙ্গাধর তিলক) কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে কবিতা লিখলেন কিন্তু তাঁর মনে একটা সংশয় থেকে গেলো। তিনি কবিতাটা সংকলনগ্রন্থ (খুব সম্ভবত সঞ্চয়িতা) থেকে বাদ দিলেন। মুসলমান সমাজের যে সকল মানুষ যারা স্বতন্ত্র মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন না, তাঁদেরও একাংশ এই শিবাজি উৎসব কবিতাটি সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। হমায়ুন কবির (ভারতের শিক্ষামন্ত্রী) তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আকবরের ওপর একটি দীর্ঘ কবিতা রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ শিবাজি উৎসব কবিতায় যে ছন্দ এবং ভাষা রীতিটি ব্যবহার করেন, হুমায়ুন তাঁর আকবর কবিতায় একই ধরনের ছন্দ এবং ভাষারীতিটি ব্যবহার করেছেন। বালগঙ্গাধর তিলক মহারাষ্ট্রের মারাঠাশৌর্যের পুনরুথান ঘটানোর মানসে। শিবাজি উৎসবটি প্রবর্তন করেছিলেন এবং তিনি রবীন্দ্রনাথের গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। আজকের পশ্চিম ভারতের যে হিন্দু মৌলবাদ সর্বগ্রাসী চেহারা নিয়ে দেখা দিয়েছে, বালগঙ্গাধর তিলক আপন হাতে তাঁর ভিতটি পাকাপোক্তভাবে গড়ে দিয়েছিলেন। শিব সেনা বা শিবাজি সেনা বিজেপি এই সকল সাম্প্রদায়িক সংগঠনের জন্ম এবং বিকাশে তিলকের চিন্তা ভাবনা কারণ বীজ হিসেবে ক্রিয়াশীল হয়েছে। সেগুলোকে কিছুতেই স্বতঃস্ফূর্ত আকস্মিক ব্যাপার বলে মেনে নেয়া যায় না।

বঙ্কিচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় টডের গ্রন্থ থেকে বিষয়বস্তু আহরণ করে একটি মাত্র উপন্যাস লিখেছেন। সেই উপন্যাসটি রাজসিংহ। ঐতিহাসিকতার বিচারে এটি বঙ্কিমে সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস বিবেচিত না হলেও, এটি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাসসমূহের একটি, তাতে সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। রাজসিংহ ছাড়া বঙ্কিম আর যে সকল ঐতিহাসিক কিংবা ইতিহাস আশ্রয়ী উপন্যাস লিখেছেন তার প্রায় সবগুলোর দৃশ্যপট বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ধারাক্রমের মধ্যেই সংস্থাপিত। টডের থেকে কাহিনী ধার করে একমাত্র রাজসিংহ উপন্যাসটিই লিখেছেন। এই রাজসিংহ উপন্যাসের দু’টি প্রান্ত। তার একটি হলো রাজপুত কাহিনী অবলম্বন করে উনিশ শতকের লেখকেরা যে সকল নাটক উপন্যাস রচনা করে আসছিলেন, রাজসিংহ উপন্যাস তাতে একটা মাত্রা সংযোজন করলেন। অন্যদিকে বাংলদেশের সীমিত পরিসরে বঙ্কিম যে সকল কাহিনী তৈরি করে আসছিলেন, সেখান থেকে বের হয়ে তার কল্পনাকে ভারতের বৃহত্তর দিগন্তে প্রসারিত করলেন। বঙ্কিমের লেখাগুলো ইতিহাস নয়, জবরদখলকারী শাসক গোষ্ঠীর স্বৈরশাসনের প্রতি একটা শৈল্পিক প্রতিবাদ। তার অধিক কিছু নয়।

তাঁর মধ্যে নিন্দা, মন্দ এবং ঘৃণার উপাদান ছিলো না, একথা সত্যি নয়। বঙ্কিম জৈবিক অভিব্যক্তির বিষয়সমূহ ইতিহাসের উপাদানে পরিণত করেছেন। বঙ্কিম ভারতবর্ষের হিন্দুর জাতীয় ইতিহাসকে স্বকীয় প্রতিভার মন্ত্রশক্তির বলে একটি নতুন পাটাতনের ওপর স্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন। সেই পাটাতনটা হলো একটি হিন্দু রাষ্ট্র। একটি হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ভারতীয় হিন্দু ইতিহাসে একটা নবতরো অভিযাত্রার সূচনা করতে পারেন। বঙ্কিমের জন্য মুশকিলের ব্যাপার ছিলো, তাঁর মনে একটি হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দল বেধেছে, অথচ তাঁকে বৃটিশের ডেপুটিগিরির চাকুরি কবুল করে নিত্য নিত্য শামলা এটে দপ্তরে হাজির হতে হচ্ছে এবং সাহেবদের কাছে সালাম ঠুকতে হচ্ছে। ইংরেজ শক্তিকে পরাজিত করে আপাতঃ হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা অসম্ভব, একথা গল্প তাড়িত বঙ্কিমও না মেনে নিতে পারেন না। তাই বঙ্কিমকে হিন্দু রাষ্ট্রের টগবগে প্ন বুকে নিয়ে অতীতের দিকে তাকাতে হয়। আটশো বছরের মুসলিম শাসনের গ্লানি আপন রক্তে শুষে নিয়ে তিনি অস্থির এবং উতলা হয়ে উঠেন। তাঁর মানবতাবোধ, সৌন্দর্য চেতনা এবং নিরপেক্ষ ইতিহাস চিন্তা সবকিছু পরাজিত হয়, জেগে থাকে শুধু ঘৃণা। এই ঘৃণাবোধই তাঁর চিন্তার চালিকাশক্তি হয়ে বসে। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনার মধ্যে ঘৃণা একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে, যা মুসলমান পাঠককে পড়া মাত্রই আহত করে। খুব সম্ভবতো মুসলমান পাঠকেরা বঙ্কিমের বইতে খারাপ কথা লেখে কেননা তার একটা জবাব পেয়ে গেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *