০৫. চন্দ্রশেখর : বঙ্কিমচন্দ্রর সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস

পাঁচ

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোনটি? কেউ বলবেন কৃষ্ণকান্তের উইল, কেউ বিষবৃক্ষ, আবার অন্য কেউ রাজসিংহ। আমি বলবো চন্দ্রশেখর। বঙ্কিম তাঁর উপন্যাসের শিল্পোৎকর্ষের জন্য বাঙালি সমাজের দেবতা হয়ে উঠেননি। দেবী চৌধুরানী এবং আনন্দমঠ রচনা দু’টি লিখেই বঙ্কিম বাঙালি সমাজের মর্মমূল আকর্ষণ করে টান দিয়েছিলেন। বঙ্কিমের রাজনৈতিক ধারণা এই দু’টি উপন্যাসে কেলাসিত হয়ে একটা আকার লাভ করেছিলো। একটি হিন্দু রাষ্ট্রের জন্ম কি করে সম্ভাবিত করা যায়? কারা কোন্ প্রক্রিয়ার এই হিন্দু রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করবে, তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, নৈতিক। শুদ্ধতা এবং শারীরিক যোগ্যতা কি ধরনের হবে, বঙ্কিম মোটামুটি তার একটা ছক এই গ্রন্থে হাজির করার প্রয়াস পেয়েছেন। মূলতঃ দেবী চৌধুরানী এবং আনন্দমঠ উপন্যাস দু’টি একটা আরেকটার পরিপূরক। দেবী চৌধুরানী উপন্যাসটি পড়ে পাঠকের মনে হবে বাঙালি হিন্দুর ক্ষাত্রশক্তির গরিমা তুলে ধরার জন্যই এই উপন্যাসটি রচনা করতে প্রবৃত্ত হয়েছেন। উপন্যাসে বর্ণিত দেবী চৌধুরানী এবং ভবানী পাঠকের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব ছিলো। বঙ্কিম সেই ঐতিহাসিক চরিত্রগুলো তাঁর নিজের আদর্শে ঢালাই করে উপন্যাসে নতুন করে নির্মাণ করেছেন। যদিও দেবী চৌধুরানী কল্পিত কোনো চরিত্র নয়। বঙ্কিম দেবী চৌধুরানীকে যেভাবে সাধারণ লাঞ্ছিতা গৃহবধু থেকে রানীতে পরিণত করেছেন, সেই পদ্ধতিটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। একেবারে অতিসাধারণ গৃহবধুও জপ, তপ, ব্রত ও আচার পালন করে অনুশীলনের মাধ্যমে রানীর ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটি দেখানোই ছিলো বঙ্কিমের উদ্দেশ্য। দেবী চৌধুরানীকে শেষ পর্যন্ত সতীনের সঙ্গে ঘর করতে স্বামীর বাড়ি পাঠাতে বাধ্য হলেন, কারণ বঙ্কিম হিন্দু নারীর। পতিভক্তির আদর্শে পুরোপুরি বিশ্বাস করতেন। পতিই শেষ পর্যন্ত হিন্দু নারীর পরম গতি।

আনন্দমঠ উপন্যাসটিকে দেবী চৌধুরানীর অপর প্রান্ত বললে অধিক বলা হবে না। দেবী চৌধুরানীতে ক্ষাত্র শক্তির যে প্রকাশ ঘটেছে জপ, তপ, ব্রতপালন এবং ক্রমাগত অনুশীলনের মাধ্যমে অসাধ্য সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যায়, তার একটি নমুনা তুলে ধরেছেন। আনন্দমঠ উপন্যাসে তাঁর এই উপলব্ধিসমূহ অধিকতরো সংহত রূপ পরিগ্রহ করেছে। মৌল উপাদানের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। দেবী চৌধুরানীতে যে চিন্তাটি স্ফুলিঙ্গ আকারে নির্গত হয়েছে, আনন্দমঠে দেখা যাবে সেটা একটা অগ্নিগিরিতে পরিণত হয়েছে। দেবী চৌধুরানীতে সাহেব ম্যাজিষ্ট্রেটের সঙ্গে যেটা ছিলো চোরাগোপ্তা হামলা, আনন্দমঠে সেই জিনিশটি পুরো দস্তুর সম্মুখ সমরের রূপ নিয়েছে। আরো দেখা যাবে দেবী চৌধুরানীর ভবানী পাঠক আনন্দমঠে সত্যানন্দ নাম গ্রহণ করেছেন। চরিত্র দু’টির গড়ন ভঙ্গির দিকে দৃষ্টিপাত করলে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে উঠবে, দেবী চৌধুরানীর ভবানী পাঠক এবং আনন্দমঠের সত্যানন্দ একই ধাতুতে গড়া। দু’জন একই ব্যক্তি, শুধু নাম আলাদা।

নবাবী শাসনের অবসানে এবং বৃটিশ শাসন কায়েম হওয়ার প্রাক্কালে বাংলাদেশে দস্যুরা প্রায় সর্বত্রই প্রতাপের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো। দস্যুবৃত্তিকে অপরাধ বলেও গণ্য করা হতো না। বাংলার অনেক জমিদারের পূর্বপুরুষেরা পেশাগতভাবে দস্যুবৃত্তি চালিয়ে যেতো। এই দস্যুদের সাথে ইংরেজের নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাত হরহামেশাই ঘটতো। এগুলো নতুন কথা নয়। পেশাদার দস্যু ছাড়াও ফকির এবং সন্ত্রাসীরা দলবদ্ধভাবে অস্ত্র হাতে ঘুরে বেড়াতো। তাঁদের সঙ্গে ইংরেজের পুলিশ এবং সৈন্যের বার বার সংঘাত হয়েছে। দেবী চৌধুরানীর ঘটনা তার একটা। ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা ইংরেজ সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, এটা কোনো কবি কল্পনা নয়, প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক সত্য। বঙ্কিম দেবী চৌধুরানী উপন্যাসের বাস্তব পটভূমিটি এক রকম বদলে ফেলে উপন্যাসে রূপ দিয়েছেন।

সন্ত্রাসীদের মতো এক রকম ফকিরেরাও বারংবার ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। ফকির মজনু শাহ এবং তাঁর পালক পুত্র চেরাগ আলি ছিলেন ফকিরদের নেতা। সন্ন্যাসী এবং ফকিরদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভাবটি ছিলো চমৎকার। কোনো কোনো সময়ে সন্ন্যাসী এবং ফকিরেরা মিলিতভাবে ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তার ভূরি ভূরি লিখিত প্রমাণ রয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেটি করলেন, ফকিরদের ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে ছেটে বাদ দিয়ে সন্ন্যাসীদের লড়াইকে তাঁর রচনার বিষয়বস্তু করলেন। সত্যানন্দকে বীরের গৌরব দিলেন, কিন্তু মজনু শাহ্র নামটি উল্লেখ করার উদারতা পর্যন্ত দেখাতে পারলেন না। বঙ্কিম তো আসল ঘটনা জানতেন। বঙ্কিমচন্দ্রের অপরাধ তিনি বাস্তবতাকে খুন করেছেন। হ্যাঁ, কথা উঠতে পারে বস্কিম ইতিহাস রচনা করেননি। উপন্যাস লিখেছেন, প্রকৃত ঘটনাকে বাঁকিয়ে চুরিয়ে নিজের মনোমত করে ঢালাই করার অধিকার আছে। বঙ্কিমকে নিছক উপন্যাস লেখক হিসেবে ধরে নিলে তাঁর ওপর এই পর্যালোচনাটি তৈরি করবারও প্রয়োজন দেখা দিতো না। বঙ্কিম তাঁর এই দুটি উপন্যাসে এমন একটি ধারণার বিকাশ ঘটিয়েছেন, বৃটিশ বিরোধী রাজনৈতিক সংগ্রামের অগ্রগতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর। হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত লড়াইকে একক হিন্দুর লড়াই দেখাতে গিয়ে ইতিহাসের এমন একটা বিকলাঙ্গ অগ্রগতির খাত খনন করেছেন, যা বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসকে একটা কানা গলির ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে, তার প্রভাব এতো সুদূরপ্রসারী। হয়েছে ভারতের জাতীয় ইতিহাস অদ্যাবধি স্বাভাবিক পথটির সন্ধান করে নিতে পারেনি।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসের সার্থকতা বিচারে আনন্দমঠের কোনো দাম নেই। কিন্তু আনন্দমঠ সেই ধরনের বিরল একটি গ্রন্থ, যা রাজনৈতিক ঘটনাকে অনেকদিন পর্যন্ত এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে, প্রভাবের কথা চিন্তা করলে ভারতবর্ষে লিখিত অন্য কোনো পুস্তকের সঙ্গে আনন্দমঠের কোনোই তুলনা চলতে পারে না। বন্দেমাতরম’ গানটি হলো আনন্দমঠের আত্মা। এই রচনায় উল্লেখ করা হয়েছে বঙ্কিমের মৃত্যুর সতুর বছর পরে এই গানটি ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দলীয় সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলো। মুসলমান। সম্প্রদায়ের ব্যাপক বিরোধিতার মুখে রবীন্দ্রনাথ যদি না বলতেন গানটির মধ্যে পৌত্তলিকতার উপাদান রয়েছে, তাহলে জনগণ অধিনায়কের বদলে এটি ভারতের জাতীয় সঙ্গীতে পরিণত হতো। তথাপি ভারতবর্ষের জনগণের একটা বিরাট অংশ বন্দেমাতরম গানটিকে ভারতের অন্যতম জাতীয় সঙ্গীত বলে মনে করে থাকেন। বন্দেমাতরম শব্দটি সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবীদের কাছে মন্ত্রের মতো ক্রিয়াশীল হতে পেরেছিলো। বন্দেমাতরম একই সঙ্গে ছিলো স্বদেশাত্মার বাণীমূর্তি এবং স্বদেশ মুক্তির বন্দনাগান। বাঙালির রাজনৈতিক অন্দোলনের ইতিহাসে আনন্দমঠ গ্রন্থটি যে ভূমিকা পালন করেছিলো, জ্যাজাক রুশোর সে সোস্যাল কন্ট্রাক ছাড়া অন্য কোনো রাজনৈতিক গ্রন্থ মানুষের আবেগের ঘরে এতোখানি আগুন জ্বালিয়ে তুলতে পেরেছে কিনা সন্দেহ। আনন্দমঠ থেকে প্রেরণা সঞ্চয় করে একটি নতুন রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। একদল বিপ্লবী তরুণ তাঁদের জীবনাচরণের পদ্ধতিটি এই গ্রন্থের পাতা থেকে শিক্ষা করেছেন। বঙ্কিম যেনো আলাদীনের আশ্চর্য পিদিমের ঘষায় বলতে গেলে একেবারে শূন্য থেকে এই নিস্তেজ বাঙালিদের মধ্যে একটা গণসংগ্রাম জাগিয়ে তুললেন। এই আন্দোলনের পদ্ধতি এবং প্রকরণ সবটাই আনন্দমঠ গ্রন্থের থেকে নেয়া। এই গ্রন্থের সমস্ত অক্ষর জীবন্ত হয়ে বাংলার মাঠ-ঘাট, আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।

আনন্দমঠের মধ্যেই প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূর্ণ দৈর্ঘ মুক্তি পেয়েছিলো। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী যাঁদের কাছে আনন্দমঠের স্থান ছিলো, ঠিক গীতার পাশে তাঁরা বঙ্কিমকে তাঁদের মন্ত্রগুরু হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন। ডেপুটিগিরির ফাঁকে ফাঁকে এই হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নটি সোনালী পদ্মের মতো বঙ্কিমের মনে দল মেলেছিলো। আনন্দমঠের গল্পটি একেবারেই মামুলি। ইংরেজ রাজত্বের সূচনা পর্বে এ ধরনের ঘটনা এন্তার ঘটেছে। আনন্দমঠের যা কিছু দাম, তাহলে সেই স্বপ্নটির কারণে। মাতৃভূমি দশ হস্তে দশ প্রহরণধারিনী দেবী দুর্গার মতো পরিপূর্ণ এক জীবন্ত সত্তা। বন্দেমাতরম গানটির মধ্যে দিয়ে মাতৃভূমির সেই জগতজননী রণজয়ী মূর্তিটিই উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

বঙ্কিম যদি সম্পূর্ণ একটা কাল্পনিক পটভূমির ওপর প্রতিস্থাপন করে আনন্দমঠ উপন্যাসটি রচনা করতেন, পরবর্তীকালে বাঙালি সমাজে যে রাজনৈতিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া জন্ম হয়েছে, সেগুলো আদৌ ঘটতো কিনা সন্দেহ। বঙ্কিম একটা বিশ্বাসযোগ্য এবং সত্য নির্ভর পটভূমি বেছে নিয়েছিলেন, যেখানে সন্ন্যাসী এবং ফকিরেরা মিলিতভাবে ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সেই বাস্তবতা থেকে ঘটনা আহরণ করে দেশের যে উজ্জ্বল চিত্রপট নির্মাণ করলেন যাতে মুসলমান সমাজের তাতে কোনো অংশ নেই। আর চিত্রপট এমনভাবে নির্মাণ করলেন যাতে মুসলমানের সমাজ বঙ্কিমের কাল্পনিক মূর্তিকে আপনার বলে মনে না করতে পারে। হিন্দু মুসলমানের মিলিত সংগ্রাম থেকে মুসলমানের ভূমিকা সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে সমস্ত লড়াইটা হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস বলে চিহ্নিত করলেন। এই বিষয়টি সকলের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং মনোযোগের দাবি রাখে।

বঙ্কিম আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণাটি পেয়েছিলেন ইউরোপীয় দার্শনিকদের কাছ থেকে। তাঁরা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র এবং ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বদলে সেকুলার গণতাত্রিক রাষ্ট্রের রূপরেখাঁটি নানাভাবে বিকশিত করেছিলেন। এই ধারণাগুলো অবশ্যই বঙ্কিমকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। একটা সেকুলার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা বঙ্কিমের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক ছিলো, কিন্তু তিনি একটি ধর্মতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখলেন কেননা? খুবই সহজ জবাব, রাষ্ট্র ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার অংশ তিনি সেটি মানতে রাজি ছিলেন না এবং সেই জিনিশটি সমস্ত গণ্ডগোলের অংশ। মজার ব্যাপার হলো, যে পটভূমিটির ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্কিম হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখছিলেন, তার সমস্ত কুশীলব হিন্দু ছিলেন না। হিন্দু মুসলমান উভয়ে মিলিতভাবেই ছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম তাঁর স্বপ্ন। নির্মাণের সময়ে মুসলমান সমাজকে ইতিহাসের অধিকার থেকেই বঞ্চিত করলেন।

বঙ্কিমের কল্পিত হিন্দু সমাজের একটা বিরাট অংশের মন-মানস অধিকার করে নিয়েছিলো এবং সেখান থেকেই মুসলমান সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার সূচনা। বঙ্কিমের এই একপেশে হিন্দু রাষ্ট্রের সঙ্গে একটি জিনিশের তুলনা করা যায়। বাড়িতে দই পাততে গেলে বাজার থেকে সামান্য পরিমাণ তাজা দইয়ের সাজ বা বীজ এনে দুধের সঙ্গে মেশাতে হয়। দইয়ের সাজে যদি কোনো দোষ থাকে, সেই দোষ সম্পূর্ণভাবে নতুন দইয়ের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্র যে বাস্তবতা মন্থন করে তাঁর স্বপ্নটি রচনা করেছিলেন, তাতে প্রকৃত বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটাননি। সুতরাং তাঁর বপ্নের মধ্যেই দোষ ছিলো। এই বিষাক্ত স্বল্প ইতিহাসের অগ্রযাত্রার সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যেই একটি গরল স্রোত বইয়ে দিয়েছিলো।

হিন্দু সমাজের উথানের উন্মেষ পর্বে রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের মধ্যে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন এতোটা গাঢ়মূল হয়েছিলো যে, তার অভিঘাত মুসলমান সম্প্রদায়কে আরেকটি ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ঠেলে দিয়েছিলো। ইংরেজের সঙ্গে সগ্রামে বিজয়। অর্জন করার প্রয়োজনে হিন্দু মুসলমান এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা খুবই প্রয়োজন, উপযোগবাদের এই দিকটি দু’সম্প্রদায়ের নেত্রীবৃন্দ মেনে নিলেও শেষ পর্যন্ত তাঁরা এক পাটাতনে দাঁড়াতে পারেননি।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুসলমানদের ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্রবোধ যখন প্রখর হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছে, এই পর্যায়ে দেখতে পাবো সৈয়দ ইসমাইল হোসের সিরাজী বঙ্কিমের দুর্গেশ নন্দিনী উপন্যাসের দাঁতভাঙা জবাব দিয়ে রায় নন্দিনী উপন্যাস লিখছেন। বঙ্কিমের শিল্পচাতুর্য এবং জীবনদৃষ্টি সিরাজী কোথায় পাবেন? উপন্যাস হিসাবে রায় নন্দিনী কোনো পর্যায়েই পড়ে না। কিন্তু তাঁর প্রতিবাদটি খুবই প্রাসঙ্গিক। ধর্মান্ধ মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিবাদের ধরনটি যা হওয়া উচিত ছিলো, সিরাজী সাহেব অশোধিত আবেগ দিয়ে সেই কাজটি করেছিলেন। এখানে আসল ব্যাপার হলো পরবর্তী প্রজন্মের একজন ধর্মান্ধ মানুষ প্রজন্মের অরেকজন ধর্মান্ধ মানুষের চিন্তার প্রতিবাদ করছেন। দু’য়ের শিক্ষা সংস্কৃতির মান এক নয় বলেই প্রতিবাদের প্রকাশটাও শোভনতার মাত্রা রক্ষা করতে পারেনি।

আরো পরে বিংশ শতাব্দীর তিরিশের দশকের শেষের দিকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এককালীন কংগ্রেস নেতা মাওলানা আকরাম খানের নেতৃত্বে একদল মুসলিম রাজনীতিবিদ এবং সাংস্কৃতিক কর্মী বঙ্কিম লিখিত আনন্দমঠ পুস্তকের বহনৎসব সম্পন্ন করেছেন। পুস্তক পোড়ানোর ব্যাপারটি একটি বর্বর পদ্ধতি। সেই সময়েই মুসলমান সম্প্রদায়ের কোনো কোনো লেখক সে কথা উল্লেখ করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। একটি মন্দ কাজও কি কারণে ঘটে থাকে, প্রকৃত কারণটি খুঁজে বের না করলে তাৎক্ষণিক নিন্দা প্রশংসায় বিশেষ লাভ হয় না। মাওলানা আকরাম খানেরা যখন আনন্দমঠ পোড়ানোর উৎসব করছিলেন সেই সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের পালে বাতাস লেগেছে। দলে দলে মানুষ জিন্নাহ সাহেবের নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছেন। পাকিস্তান আন্দোলন গতিশীল হয়ে ওঠার পরিস্থিতিতে আনন্দমঠের বহদ্যুৎসব সম্পন্ন হওয়ার একটি ব্যাখ্যা এভাবে দাঁড় করানো যায়। ধর্মতান্ত্রিক মুসলিম রাষ্ট্রের লড়াকু সমর্থকেরা বঙ্কিমচন্দ্রের ধর্মতান্ত্রিক হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শটিকে আঘাত করার মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ আনন্দমঠ উপন্যাসটি উৎসব করে পোড়ানোর মধ্য দিয়ে ঘটিয়েছেন। সেই পুরোনো প্রসঙ্গটিতে আবার ফিরে আসি। বঙ্কিম কি সাম্প্রদায়িক লেখক ছিলেন? সাম্প্রদায়িক লেখক হলেও কতোদূর সাম্প্রদায়িক? আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত হবে না, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সময়ের সবচাইতে শিক্ষিত মানুষ না হলেও সবচাইতে শিক্ষিত মানুষদের একজন ছিলেন। তিনি অনেকাংশেই ছিলেন একজন আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ। সাম্য, বাঙ্গালার কৃষক, বাঙ্গালার ইতিহাস এই সমস্ত রচনা তাঁর কলম থেকেই বেরিয়ে এসেছে। অবশ্য তিনি শেষ বয়সে সাম্য এবং বাঙ্গালার কৃষক রচনা দু’টো ঘোষণা দিয়ে বর্জন করেছিলেন। তা হোক, বঙ্কিম তো আর তাঁর নিজের জীবনের বিশেষ একটা পর্যায়কে জীর্ণ বস্ত্রের মতো শরীর থেকে খুলে বর্জন করতে পারেন না। লেখকের রচনা তো তাঁরই জীবনের একটি অংশ। আধুনিক চিন্তা চেতনার অনেকখানিই তিনি রপ্ত করেছিলেন। তাঁর অনেক রচনাতেই মানববাদী দৃষ্টিভঙ্গির অভিব্যক্তি মূর্ত হয়ে উঠেছে। সাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত একজন লেখকের হাত দিয়ে মানবিক অনুভূতিসমূহ আগুনের ফুলকির মতো ঝরে পড়েছে তা কিছুতেই সম্ভব হতো না। তাঁর রচিত সাহিত্যের একটা বিরাট অংশে আবেগ, অনুভূতি, ত্রুটি-বিচ্যুতিসহ মানুষকে তাঁর পূর্ণ পরিচয় দেখাতে চেষ্টা করেছেন এবং সে রচনাগুলো সম্পূর্ণভাবে সাম্প্রদায়িকতার শর্শ লেশ বর্জিত। কিন্তু বঙ্কিম যেখানে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এবং হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন, সেখানে তিনি ঘোরতররা হিন্দু। হিন্দুত্ব তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, হিন্দুত্বই তাঁর জীবন এবং নির্বাণ হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দুত্বের বাইরে কোনো কিছুই তাঁর বিবেচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। একটি হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পথে যা কিছু অন্তরায় মনে করেছেন, সব কিছুকে ধ্বংস করে দেয়া তাঁর পরম পবিত্র কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো।

হিন্দু রাষ্ট্রের প্রকৃত রূপরেখা কি হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে বঙ্কিমের কোনো সুনির্দিষ্ট ধারণা ছিলো না, শুধু অতীতের কিছু ঝাপসা স্মৃতি, ধোঁয়া ধোঁয়া, ছায়া ছায়া কিছু অনুভবই ছিলো তাঁর পাথেয়। সহজাত প্রবণতা বশে তিনি শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের হিন্দু রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে হলে তার প্রতিশধী হয়ে উঠতে পারে, যে সকল রাষ্ট্রাদর্শ সেগুলো ঝাড়ে বংশে উৎপাটন করে ফেলতে হবে। বঙ্কিম সমস্ত জীবন ধরে মারাত্মক রোগের জীবাণুর মতো সেই ধ্বংসকীট বয়ে বেড়িয়েছেন। অদৃষ্টের কি নির্মম পরিহাস, যে বন্দেমাতরম সঙ্গীতের মাধ্যমে স্বদেশাত্মার মর্ম বাণীটি আবিষ্কার করেছিলেন; সেই একই শক্তিমান মন্ত্র মহাকালের খড়গের রূপ ধারণ করে তাঁর আপন মাতৃভূমিকে দ্বি-খণ্ডিত করে ফেললো। মাতৃমুক্তির মন্ত্রের অপপ্রয়োেগ করে। বঙ্কিম মাতৃ অঙ্গচ্ছেদের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করলেন। ভারতের কথা বলতে পারবো না, কিন্তু বাংলা বিভাগের জন্য যদি কোনো মানুষকে একক দায়ী করতে হয়, বঙ্কিমচন্দ্র ছাড়া আর কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে? যাঁর কাঁধে এই দায়ভার চাপানো যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *