০২. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস

দুই

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সীতারাম, রাজসিংহ, দেবী চৌধুরানী, আনন্দমঠ এই সকল উপন্যাস পাঠ করতে গিয়ে আমি একটা অপ্রত্যাশিত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। এই সকল উপন্যাসের যে সকল জায়গায় মুসলমান সম্পর্কে লেখক নিষ্ঠুর এবং অকরুণ মন্তব্য করেছেন, সে সমস্ত জায়গায় পুস্তকের মার্জিনে শালা বঙ্কিম, মালাউন বঙ্কিম এবং ছাপার অক্ষরে প্রকাশের অযোগ্য এমন সব গালাগাল লিখে রেখেছে, দেখে আমার কান গরম হয়ে গেলো। এই জিনিশটি সেই বয়সেও আমাকে ভীষণ রকম ধাক্কা দিয়েছিলো।

বাংলাদেশের যে অঞ্চলটিতে আমার জন্ম, সেখানে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে কোনো রকম তিক্ততা ছিলো না। যে কারণে হিন্দুতে হিন্দুতে, মুসলমানে মুসলমানে ঝগড়া বিবাদ মনোমালিন্য ঘটে থাকে, একই কারণে হিন্দুতে মুসলমানেও বিরোধ ঘটতো। বোধকরি তার একটা বড়ো কারণ এই যে আমাদের অঞ্চলে হিন্দু কিংবা মুসলমান কোনো বড়ো জমিদারের অস্তিত্ব ছিলো না। পরিবেশের প্রভাবে মুসলমান ছাত্ররা। বঙ্কিমের বইয়ের মার্জিনে এতো সমস্ত খারাপ কথা লিখে রেখেছে একথাও আমার মন বিশ্বাস করতে চায়নি। নিজেকেই আমি বার বার জিগগেস করেছি, কোনো রকমের। উষ্কানি ছাড়াই মুসলমান ছাত্ররা এতোসব অশ্লীল মন্তব্য লিখে রাখলো কেনো? আমার বয়স যতো বেড়েছে, এই ব্যাপারটি নানান দৃষ্টিকোণ থেকে বারংবার খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করেছি। সহজাত সাম্প্রদায়িক অনুভূতির প্রকাশ ঘটাবার জন্যই শুধু আমাদের স্কুলের ছাত্ররা বঙ্কিমের ওপর মানসিক প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য তাঁকে বাপান্ত করতে প্রবৃত্ত হয়েছে, এই জিনিশটি আমি পুরো সত্য বলে মেনে নিতে পারিনি। আমার মনে হয়েছিলো আরো একটা বড়ো কারণ আত্মগোপন করে রয়েছে। আমি দুর্বল মস্তিষ্কের। কারণে সেটা খুঁজে বের করতে পারছিনে। স্কুল থেকে সরাসরি ক্লাশ টপকে টপকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আসিনি। মাঝখানে অনেকগুলি বছর অন্য কাজে ব্যয় করতে হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়ে বঙ্কিম সাহিত্য পড়তে গিয়ে আমাকে স্কুলের মতো একই রকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হলো। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে বঙ্কিমের লেখা বইগুলো ধার করে এনে পড়তে গিয়ে দেখি মার্জিনে একই ধরনের মন্তব্য লিখে রাখা হয়েছে, তবে তফাৎ একটা অবশ্যই আছে। পাড়াগাঁয়ের ছেলেরা যে সকল কথা লিখেছিলো সেগুলো অশ্লীল, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মন্তব্যগুলো অশোভন। যদিও এই জিনিশটি আমাকে একটা ভীষণ রকম নাড়া দিয়েছিলো, এ নিয়ে আমি কারো সঙ্গে মতামত বিনিময় করিনি। বছর তিনেক আগে উপন্যাসিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি রচনা পাঠ করার পর আমার চমক ভাঙ্গে। শরশ্চন্দ্র মুসলমান ছাত্রদের সম্পর্কে আলাপ করতে গিয়ে জোড়হাত করে একটি আবেদন রাখছেন। বাবারা বঙ্কিমের বইয়ের পাতায় তোমরা যেভাবে ‘শালা বঙ্কিম’ ওজাতীয় কথা লিখে রাখো, দোহাই বাবারা আমার বইতে সে রকম কিছু যেনো না লিখো, কথাগুলো অবশ্য আমার নিজের জবানিতেই বললাম। তারপর থেকে আমার মনে একটা ধারণা গাঢ়মূল হয়েছে যে মুসলমান ছাত্ররা বঙ্কিমের বিশেষ বিশেষ বই পাঠ করা মাত্রই স্বতঃস্ফুর্ত আবেগে আজে বাজে কথা লিখে রাখে। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনো ফারাক নেই। বিষয়টা গোপন একটা ব্যাধির মতো নীরবে এমনভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছিলো, শরশ্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন সহৃদয় কথা সাহিত্যিকেরও দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিক্রিয়ার কথা শুধু বয়ান করলাম। বয়স্ক মুসলমান পাঠকদের মর্মে বঙ্কিমচন্দ্রের এই সকল রচনা কি রকম অক্রোশের জন্ম দিয়েছিলো, এই রচনায় একটা পর্যায়ে সেটা উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করা হবে।

কথা হলো, মুসলমান ছাত্রদের একটা অংশ বঙ্কিমের বইয়ের পাতায় অশোভন মন্তব্য লিখে রাখে কেনো? বঙ্কিম সাম্প্রদায়িক লেখক সেটাই কি তার একমাত্র কারণ? তিনি যদি সাম্প্রদায়িক লেখক হয়েও থাকেন, তার মাত্রা এবং ধরনটা কি রকম। কোনো বিশেষ সম্প্রদায়কে উপলক্ষ করে সাহিত্য রচনা করা হলে, সেটা অপর সম্প্রদায়ের মানুষের গাত্র দাহের কারণ হবে, সেটাও সমর্থনযোগ্য ব্যাপার হতে পারে না। মাইকেল এবং বিদ্যাসাগর ছাড়া উনবিংশ শতাব্দীর ঘোট বড়ো লেখকের বেশিরভাগই ছিলেন সাম্প্রদায়িক। এই অর্থে সাম্প্রদায়িক যে উনবিংশ শতাব্দীর সম্পূর্ণ পরিপ্রেক্ষিতটাই ছিলো হিন্দু ধর্ম এবং সমাজ কেন্দ্রিক। মুসলিম সমাজের উপস্থিতি সেখানে একবারেই ক্ষীণ, নেই বললেই চলে। এই পরিপ্রেক্ষিতের বলয় থেকে সে। সকল চিন্তা ভাবনা বিকশিত হয়ে গতিশীলতা অর্জন করেছে, তার সবগুলো নঞর্থক ধরে নিয়ে নাকচ করারও উপায় নেই। যদি তাই হয় বাঙালি জাতির মনন এবং চিন্তা চর্চার বিকাশের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তরকেই অস্বীকার করা হয়। অতীতের প্রতি অবিচার করে কেউ কখনো সুস্থ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারে না।

বঙ্কিম ছাড়া আরো অনেক সাম্প্রদায়িক লেখকের রচনা আমি পাঠ করেছি। তাঁদের কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। যেহেতু হিন্দুদের মধ্যে লেখালেখির চলটা বেশি ছিলো, তাই তাঁদের সংখ্যা অধিক হবে সেটা এক রকম নিশ্চিত। বঙ্কিম রচনা পাঠ করে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুসলমান পাঠকেরা যে ধরনের আজে বাজে কথা লিখে রাখে, অন্য সাম্প্রদায়িক হিন্দু লেখকের বেলায় সেটা অতো ক্রুদ্ধভাবে প্রকাশ পায় না কেনো? এই বিষয়টি আমাকে ভাবিয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একজন সাম্প্রদায়িক লেখক ছিলেন এই মতের সমর্থক অনেক লেখকের রচনা আমি পাঠ করেছি। এই মতের অনুসারীদের একাংশ হিন্দু লেখক। আবার বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সত্যিকারভাবে একজন অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক উদার দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন লেখক এই মতাবলম্বী অনেক লেখকের রচনাও আমাকে পড়তে হয়েছে। এই মতের সমর্থকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ আবার মুসলমান। এই দুই পর পর বিরোধী মতের বাইরে তৃতীয় মতের লেখক যাঁরা বঙ্কিমকে একটা নিরপেক্ষ অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিচার করেছেন এবং সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে বঙ্কিম তাঁর সময়ের সন্তান এবং গোটা সময়টাই ছিলো সাম্প্রদায়িকতার রঙে অনুরঞ্জিত। বঙ্কিমের পক্ষে তাঁর যুগের প্রভাব এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি, তাই তাঁর কোনো কোনো রচনায় অনিবার্যভাবে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ প্রখররূপ ধারণ করতে পেরেছে। এটা বঙ্কিম মানসের মাত্র একটা দিক, কিন্তু বিজ্ঞাননিষ্ঠ, আধুনিক উদার মতাবলম্বী বঙ্কিমের রচনাসমূহ ধর্তব্যের মধ্যে না এনে গ্রহণ লাগা দিকটা বড়ো করে দেখলে আমরা বঙ্কিমের ওপর যেমন অবিচার করবো, তেমনটি অবিচার করবো নিজেদের বিচার বুদ্ধির। আবেগের ভাববাষ্প বর্জিত এই ধরনের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন প্রয়াসী বিশ্লেষণধর্মী আলোচনাও আমি কম পড়িনি।

বঙ্কিমকে কেন্দ্র করে এই যে নানা মুনির নানা মত, তাঁদের মধ্যে কে বা কারা সঠিক, কারা ভ্রান্ত সে বিচারেও আমি প্রবৃত্ত হবো না। গায়ে মশা বসে কামড় দিলে যেমন হাত আপনি চালিত হয়ে মশাটিকে পিশে ফেলে, তেমনি বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলমান পাঠকদের একাংশ ক্ষিপ্ত হয়ে বহুকাল পূর্বে স্বর্গগত বঙ্কিমের উদ্দেশ্যে কুৎসিত গালাগাল বর্ষণ করে বসে কেনো? তার মনস্তাত্বিক কারণ কি? সে জিনিশটিই বর্তমান রচনার অনুধাবনের বিষয়বস্তু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *