৩০. শিশুপাল-বধ

৩০
শিশুপাল-বধ

রাজসূয় যজ্ঞের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। ভারতবর্ষের এবং ভারতবর্ষের বাইরের নিমন্ত্রিত রাজারা উপস্থিত হয়েছেন অথবা প্রতিনিধি প্রেরণ করেছেন। যজ্ঞ আরম্ভ প্রায়। যুধিষ্ঠির জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ ভীষ্মকে অনুরোধ করলেন, সমাগত রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পুরুষ নির্বাচন করে দিতে, তাঁকে অর্ঘ্যপ্রদান করা হবে। বলবান শান্তনুনন্দন ভীষ্ম সামান্যক্ষণ চিন্তা করে তৎকালীন ভূমণ্ডলে কৃষ্ণকেই প্রধান পূজনীয় বলে মনে করলেন। ভীষ্ম বললেন, “সূর্য যেমন গ্রহ নক্ষত্রাদির মধ্যে প্রকাশ পেয়ে থাকেন, তেমন এই কৃষ্ণই তেজ, বল, পরাক্রমদ্বারা উত্তপ্ত করেই যেন এই সমস্ত লোকের মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছেন। সূর্য যেমন অন্ধকারময় স্থানকে আলোকিত করেন এবং বায়ু যেমন বায়ুশূন্য স্থানকে আনন্দিত করেন, তেমনই এক কৃষ্ণই আমাদের এই সভাটিকে আলোকিত ও আনন্দিত করেছেন।” তখন প্রতাপশালী সহদেব ভীষ্মের অনুমতিক্রমে কৃষ্ণকেই উত্তম অর্ঘ্য প্রদান করলেন। কৃষ্ণও শাস্ত্রদৃষ্ট কর্ম অনুসারে সেই অর্ঘ্য গ্রহণ করলেন; কিন্তু শিশুপাল কৃষ্ণের সে পূজা সহ্য করতে পারলেন না।

সঃ উপলভ্য ভীষ্মঞ্চ ধর্মরাজঞ্চ সংসদি।

অথাক্ষিপদ্বাসুদেবং চেদিরাজো মহাবলঃ॥ সভা: ৩৫: ৩২॥

—সুতরাং মহাবল শিশুপাল ভীষ্ম ও যুধিষ্ঠিরকে তিরস্কার করে কৃষ্ণকে তিরস্কার করতে লাগলেন।”

শিশুপাল বললেন, “যুধিষ্ঠির এই সভায় উপস্থিত মহাত্মা রাজাদের মধ্যে কৃষ্ণ রাজার যোগ্য পূজা পাবার উপযুক্ত নন। মহাত্মা পাণ্ডবদের পক্ষে কৃষ্ণের পূজা অত্যন্ত অনুচিত কাজ। পাণ্ডবগণ তোমরা বালক, তাই জানো না, ধর্ম অত্যন্ত সূক্ষ্ম পদার্থ। আর ভীষ্ম অতি বৃদ্ধ। তার বুদ্ধির বিনাশ ঘটেছে। ভীষ্ম, তোমার মতো অধার্মিক লোক কেবল আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্যে কাজ করে লোকসমাজে অত্যন্ত অবজ্ঞার পাত্র হয়ে দাঁড়ায়। তোমরা কী করেছ ? কৃষ্ণ রাজা নয়, অথচ সমস্ত রাজাদের মধ্যে তোমরা তাঁকে পূজা করছ ? কুরুকুলাঙ্গার ভীষ্ম, যদি কৃষ্ণকে বৃদ্ধ মনে করো, তবে বৃদ্ধ বসুদেব থাকতে তার পুত্র কী করে পূজা পায় ? আবার যদি মনে কর কৃষ্ণ পাণ্ডবদের হিতৈষী, তা হলে বৃদ্ধ পাণ্ডবহিতৈষী দ্রুপদ রাজা থাকতে কৃষ্ণকে কী করে পূজা দেওয়া হয় ? আবার, কৃষ্ণকে যদি আচার্যই মনে কর, তবে দ্রোণাচার্য থাকতে কৃষ্ণ কী করে পূজা পায় ? কৃষ্ণকে যদি পুরোহিত মনে কর থাক, তা হলে বৃদ্ধ পুরোহিত বেদব্যাস থাকতে তোমরা কী করে কৃষ্ণকে পূজা কর ? পুরুষশ্রেষ্ঠ, ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম উপস্থিত থাকতে কৃষ্ণের পূজা হয় কী করে ? মহাবীর এবং সর্বশাস্ত্রবিদ অশ্বত্থামা থাকতে তুমি কৃষ্ণকে কী করে পূজা করলে ? তা ছাড়াও বাকশ্রেষ্ঠ ও পুরুষপ্রধান দুর্যোধন আছেন, ভরতকুলের গুরু কৃপ আছেন, এই অবস্থায় কষ্ণের পূজা কী করে করলে ? বহু পুরুষের গুরু দ্রুমরাজাকে এবং তোমাদের পিতা পাণ্ডুর তুল্য রাজচিহ্নধারী দুর্ধর্ষ ভীষ্মকরাজাকে অতিক্রম করে তোমাদের কৃষ্ণকে পূজা করার অভিপ্রায় কী ? এ ছাড়াও, রাজশ্রেষ্ঠ রুক্মী, একলব্য এবং মদ্ৰাধিপতি শল্য থাকতে কী করে কৃষ্ণ পূজ্য হন ? যিনি সমস্ত রাজার মধ্যে বলশ্লাঘী, যিনি মহারথ, বিচক্ষণ ও সুব্রাহ্মণ পরশুরামের প্রিয়শিষ্য যিনি আপনার বলের উপর নির্ভর করে অন্য রাজাগণকে জয় করেছেন, সেই কর্ণকে পরিত্যাগ করে তুমি কী কারণে কৃষ্ণকে পূজা করলে ? হে কুরুশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, কৃষ্ণ ঋত্বিক নয়, আচার্য নয়, রাজাও নয়। তবুও তাকে সন্তুষ্ট করতেই তুমি তাকে পূজা করলে ? আর, এই উদ্দেশ্যই যদি তোমার ছিল, এখানে তা হলে রাজাদের অপমানিত করতে ডাকলে কেন ? আমরা সকলে এই যুধিষ্ঠিরের ভয়ে বা কোনও লোভে অথবা তাঁর অনুরোধে কর দিইনি। তিনি ধর্মকার্যে প্রবৃত্ত হয়ে সাম্রাজ্য করার ইচ্ছা করেছেন। এই জন্যই তাঁকে কর দিয়ে সাহায্য করেছি। কিন্তু কী আশ্চর্য ! যিনি আমাদের গ্রাহ্যই না করে সকলকে অপমানিত করার জন্যই অযোগ্য কৃষ্ণকে অর্ঘ্য দিয়ে পূজা করছেন, ধর্মপুত্রের ধর্মাত্মা যশ শেষ হয়েছে। ধার্মিক লোক ধর্মচ্যুত লোকের পূজা করে না। বৃষ্ণিবংশে জন্মগ্রহণকারী এই দুর্বুদ্ধি কৃষ্ণ অন্যায়ভাবে মহাত্মা জরাসন্ধকে বধ করিয়েছে। আজ যুধিষ্ঠিরের ধর্মপরায়ণতা বিচ্যুত হয়েছে। আজ যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে অর্ঘ্যদান করে নিজের ক্ষুদ্রতা দেখিয়েছে।

“কৃষ্ণ ক্ষুদ্র ও নিকৃষ্ট বুদ্ধিদ্বারা পাণ্ডবেরা অন্য শ্রেষ্ঠ রাজাকে অর্ঘ্য দিতে ভীত হয়েছে, কিন্তু তোমার তো বোঝা উচিত ছিল যে, তুমি এই পূজা পাবার যোগ্য নও। ক্ষুদ্র পাণ্ডবেরা পূজা দিলেও তুমি অযোগ্য হয়ে এ পূজা নিলে কী করে ? কুকুর যেমন নির্জনে ঘৃত পেয়ে তা পান করে আত্মগর্ব করে, তুমিও তেমনই নিজের অযোগ্য পূজা পেয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করছ। দেখো কৃষ্ণ, কুরুবংশীয়েরা এই আচরণের দ্বারা রাজশ্রেষ্ঠগণের অপমান করেননি। তোমাকে বিদ্রুপ করেছেন। তুমি রাজা নও; নপুংসক যেমন ভার্যা গ্রহণ করে, অন্ধ যেমন রূপ দেখার চেষ্টা করে, তোমারও তেমন রাজা না হয়েও এই অর্ঘ্যগ্রহণ অত্যন্ত অনুচিত হয়েছে।

“সে যাই হোক, রাজা যুধিষ্ঠির কেমন, ভীষ্ম ও কৃষ্ণ কেমন, সে সমস্তই আমরা যথার্থরূপে দেখতে পেলাম।” এই কথা বলে শিশুপাল স্বপক্ষীয় রাজাদের সঙ্গে সভা ত্যাগ করলেন। তখন রাজা যুধিষ্ঠির তাড়াতাড়ি শিশুপালের পিছনে পিছনে গিয়ে তাঁকে মধুর বাক্যে বললেন, “রাজা আপনি যা বললেন, তা সঙ্গত নয়। কটুকথা বলায় গুরুতর পাপ হয় এবং তা নিরর্থক। রাজা কখনও ধর্ম বুঝবেন না, তা হয় না। ইনি শান্তনুর পুত্র ভীষ্ম। এঁকে আপনি ইতর লোকের মতো অবজ্ঞা করতে পারেন না। এখানে আপনার থেকে অনেক প্রবীণ জ্ঞানী রাজা আছেন তাঁরা সকলেই কৃষ্ণের পূজা সহ্য করছেন। সুতরাং আপনারও তা করা উচিত। চেদিরাজ! ভীষ্ম যথার্থই সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণকে জানেন; তিনি যেমন জানেন আপনি তেমন জানেন না।”

ভীষ্ম বললেন, “যুধিষ্ঠির শিশুপালকে অনুনয় করা তোমার উচিত নয়; আর ভাল ভাল কথা বলারও তিনি যোগ্য নন। কারণ, সমস্ত জগতের পূজ্য, সর্বাপেক্ষা জ্ঞানী কৃষ্ণের পূজা তিনি সঙ্গত বলে মনে করেন না। বীরশ্রেষ্ঠ যে ক্ষত্রিয়, অপর ক্ষত্রিয়কে জয় করে বশে এনে আবার ছেড়ে দেন, তিনি তাঁর গুরু হয়ে থাকেন। এই রাজাদের সভায় আমি একটি রাজাও দেখছি না, যিনি কৃষ্ণের কাছে পরাজিত হননি। কৃষ্ণ কেবল আমাদের পূজ্য নন মহাবাহু কৃষ্ণ ত্রিভুবনের সমস্ত লোকেরই পূজনীয়। তার পরে, কৃষ্ণ যুদ্ধে বহুতর ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠকে জয় করেছেন এবং কৃষ্ণের উপরই সমস্ত জগৎ অবস্থান করছে। এইজন্যই আমি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, শ্রেষ্ঠ পরাক্রমী, বুদ্ধিমান কৃষ্ণকেই অন্য রাজারা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও পূজা করেছি। অতএব চেদিরাজ! কোনও দুর্বুদ্ধিবশত আপনি কৃষ্ণ সম্পর্কে অসম্মানকর কথা বলবেন না। আমি বহুতর জ্ঞানী, বৃদ্ধ ব্যক্তির সেবা করেছি। তাঁরা গুণবান কৃষ্ণের বহুতর উৎকৃষ্ট গুণের কথা বলতেন, আমি মুগ্ধের মতো বসে তা শুনতাম। কৃষ্ণের বাল্যকালীন কার্যক্রম আমি অসংখ্য ব্যক্তির মুখে শুনেছি। অতএব চেদিরাজ! আপনি ভুলেও মনে করবেন না, আমরা সম্পর্ক সূত্র ধরে কৃষ্ণের পূজা করেছি। অথবা শত্রু নিঃশেষ করেছেন বলেও তাঁর পূজা করিনি। জগতের সকল প্রাণীর সুখকর বলেই কৃষ্ণের পূজা করেছি। সেই কারণে সাধুরাও তাঁর পূজা করেন। কৃষ্ণের যশ, বীরত্ব এবং জয় করবার ক্ষমতা আছে জেনেই আমরা তাঁর পূজা করেছি। অর্ঘ্যদান করার সময় আমরা অতি শিশু থেকে অতি বৃদ্ধ—সকলের কথা চিন্তা করেই কৃষ্ণকে পূজা করেছি। ব্রাহ্মণগণের মধ্যে যিনি জ্ঞানবৃদ্ধ, তিনিই বৃদ্ধ। ক্ষত্রিয়দের মধ্যে যিনি অধিক বলশালী, তিনিই বৃদ্ধ। বৈশ্যদের মধ্যে যার ধন এবং ধান্য অধিক, তিনিই বৃদ্ধ। কৃষ্ণকে পূজা করবার দুটি প্রধান কারণ আছে; এক— বেদ ও বেদাঙ্গের জ্ঞান এবং দ্বিতীয় অপরিমিত বল; অতএব ভূমণ্ডলে কৃষ্ণ ভিন্ন অন্য কোন ব্যক্তি প্রধান আছে ? দান, কার্যদক্ষতা, শাস্ত্রজ্ঞান, বীরত্ব, লজ্জা, কীর্তি, উত্তম বুদ্ধি, বিনয়, লক্ষ্মী, ধৈর্য, পুষ্টি ও তুষ্টি— এ সমস্তই কৃষ্ণে বিদ্যমান। অতএব সভ্যগণ! লোকাচারসম্পন্ন কৃষ্ণ আমাদের আচার্য, পিতা, গুরু, অর্ঘ্যদানের যোগ্য এবং জগৎপূজিত; তাই আমরা তাঁকে পূজা করেছি। ঋত্বিক, গুরু, সম্বন্ধী, স্নাতক, রাজা ও সুহৃৎ— এ সমস্তই একা কৃষ্ণ; তাই আমরা তাঁর পূজা করেছি। কৃষ্ণই জগতের উৎপত্তি, স্থিতি ও প্রলয়ের স্থান এবং কৃষ্ণের জন্যই এই স্থাবর-জঙ্গমাত্মক জগৎ জন্মেছে। কৃষ্ণই প্রকৃতি, কৃষ্ণই সনাতন কর্তা এবং কৃষ্ণ সর্বভূত থেকে উৎকৃষ্ট; অতএব কৃষ্ণ সর্বপ্রধান পূজনীয়।

“বুদ্ধি, অহংকার, একাদশ ইন্দ্রিয়, পঞ্চ তন্মাত্র, পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, আকাশ এবং চতুর্বিধ প্রাণী— এ সমস্তই কৃষ্ণে প্রতিষ্ঠিত আছে। চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, অবশিষ্ট গ্রহ, দিক ও বিদিক, এ সমস্তও কৃষ্ণে রয়েছে। বেদের বিধিভাগের মধ্যে অগ্নিহোত্রের বিধি প্রধান, সমস্ত বেদের মধ্যে গায়ত্রী প্রধান, মনুষ্যের মধ্যে রাজা প্রধান, জলাশয়ের মধ্যে সমুদ্র প্রধান, নক্ষত্রের মধ্যে চন্দ্র প্রধান, তেজের মধ্যে সূর্য প্রধান, পর্বতের মধ্যে সুমেরু প্রধান আর পক্ষীর মধ্যে গরুড় প্রধান। আর দেবলোকপ্রভৃতি সমস্ত লোকের উপরে, মধ্যে ও নীচে যত পদার্থ আছে, তার মধ্যে ভগবান কৃষ্ণই প্রধান। কৃষ্ণ যে সর্বদা সর্বত্রই বিদ্যমান আছেন, তা এই বালক শিশুপাল বোঝে না; সেই জন্যই, সে একথা বলছে। মানুষ সর্বদা উৎকৃষ্ট ধর্মকে খোঁজে। শিশুপাল অবোধ, সে উৎকৃষ্ট ধর্মকে দেখতে পায় না। বালক, যুবক এবং বৃদ্ধ মহাত্মা রাজাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি কৃষ্ণকে পূজনীয় বলে মনে না করেন ? এবং কোন ব্যক্তিই বা কৃষ্ণকে পূজা না করেন ? এর পরেও যদি শিশুপাল আমাদের কৃষ্ণপূজাকে অসঙ্গত মনে করে, তা হলে সে নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী, যা ইচ্ছা তাই করতে পারে।”

ভীষ্ম দীর্ঘ বক্তব্য বলে বিরত হলেন, তখন সহদেব বক্তব্য যুক্তিযুক্ত বাক্য বললেন, “হে রাজগণ, অপ্রমেয়-পরাক্রমশালী কেশীদানবহন্তা কেশব কৃষ্ণকে আমি পূজা করছি। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি তা সহ্য করতে না পারেন, আমি তাঁর মস্তকে এই চরণ রাখলাম। আমি এই বলার পরে, কেউ উপযুক্ত উত্তর দিতে আসলে আমি অবশ্যই তাঁকে বধ করব। বুদ্ধিমান যে সকল রাজা আছেন, তাঁরা স্বীকার করুন যে, কৃষ্ণই অর্ঘ্যদানের যোগ্য। কেন না কৃষ্ণ আচার্য, পিতা ও গুরুর তুল্য। জগতের পূজনীয় এবং সাধুজনকর্তৃক পূজিত।”

এই বলে সহদেব চরণ প্রদর্শন করলেও বুদ্ধিমান, সৎপ্রকৃতি, তেজস্বী ও বলবান সেই সকল রাজার মধ্যে কেউই কিছু বললেন না। তারপর, সহদেবের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি পড়তে লাগাল এবং ‘সাধু সাধু’ এই আকাশবাণী শোনা যেতে লাগল। তখন, ভূত ও ভবিষ্যতের বক্তা, সকলের সংশয়দূরকারী, সমস্ত লোকের স্বরূপ-অভিজ্ঞ নারদ, সর্ববিজয়ী কৃষ্ণকে উদ্দেশ করে বললেন, “যে সব মানুষ পদ্মনয়ন কৃষ্ণের পূজা না করবে, তাদের জীবন্মৃত বলে জানবে এবং তাদের সঙ্গে আলোচনাও করা উচিত নয়।” এদিকে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়গণের বিশেষাভিজ্ঞ সেই মানুষদের মধ্যে দেবতুল্য সহদেব, পূজার যোগ্য লোকদের পূজা করে সেই অর্ঘ্যদান কার্য সমাপ্ত করলেন। সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি হিসাবে সহদেব কৃষ্ণের পূজা করলেন।

কৃষ্ণের পূজা হয়ে গেলে, শত্রুহন্তা শিশুপাল ক্রোধে আরক্তনয়ন হয়ে বললেন, “রাজগণ, আমি আপনাদের সেনাপতি হলাম; এখন আপনারা কী অনুমতি করেন ? আমি যুদ্ধের জন্য সজ্জিত হয়ে, সম্মিলিত বৃষ্ণি ও পাণ্ডবগণের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হতে চাই।” শিশুপাল এইভাবে স্বপক্ষীয় রাজগণকে উৎসাহিত করে তখনই যজ্ঞ নষ্ট করার জন্য সেই রাজাদের সঙ্গে পরামর্শ করতে লাগলেন। সেখানে আহূত ও আগত শিশুপাল প্রভৃতি সমস্ত রাজাকেও ক্রুদ্ধ ও বিবর্ণমুখ দেখা যেতে লাগল। তাঁরা সকলেই তখন বলতে লাগলেন, “যাতে যুধিষ্ঠিরের সাম্রাজ্যে অভিষেক বা কৃষ্ণের পূজা শেষ না হয়, তা আমাদের দেখতেই হবে।” সহদেব চরণ প্রদর্শন করে অপমান করেছিলেন এবং নিশ্চয়ই বধ করবেন বলেছিলেন, এই কারণেই সকল রাজা শোকে অধীর হয়েছিলেন। তাঁরা আত্মগর্বে গর্বিত হয়ে ভেবেছিলেন যে অনায়াসে পাণ্ডবদের বধ করা যাবে। মাংসের কাছ থেকে সরিয়ে নিলে গর্জনকারী সিংহের শরীর যেমন শোভা পায়, সেই রাজাদের শরীরও তেমনই ক্রুদ্ধ ও গম্ভীর দেখা দিতে লাগল। অসীম ও অক্ষয় সেই রাজসৈন্য যে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, তা তখনই কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন।

প্রলয়কালীন বায়ু-তাড়িত উদ্বেলিত ভয়ংকর সমুদ্রের ন্যায় বিশাল সৈন্যের অধিপতি সেই অসংখ্য রাজগণকে ক্রোধে বিচলিত দেখে, মহাতেজা ও ইন্দ্রের ন্যায় শত্রুহন্তা যুধিষ্ঠির, বুদ্ধিমানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, বৃহস্পতির ন্যায় নীতিজ্ঞ এবং বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মকে বললেন, “পিতামহ ওই বিশাল নৃপতিসমুদ্র ক্রোধে বিচলিত হয়েছেন, এখন আমার কী করণীয় বলুন। যাতে যজ্ঞের বিঘ্ন না হয়, প্রজাদের ও আমাদের সকলের মঙ্গল হয়, তাই বলুন।”

ধর্মজ্ঞ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির একথা বললে, কুরুপিতামহ ভীষ্ম তাঁকে বললেন, “যুধিষ্ঠির তুমি চিন্তিত হোয়ো না; কুকুর সিংহকে মারতে পারে না। এই শিশুপালের বিষয়ে আমি পূর্বেই মঙ্গলময় পথ ভেবে রেখেছি। বৎস যুধিষ্ঠির, নিদ্রিত সিংহের কাছে কুকুরগুলি যেমন ডাকে, তেমনই নীরবতা অবলম্বনকারী কৃষ্ণের কাছে এই রাজারা গর্জন করছে। কৃষ্ণ নীরবতা না ভাঙা পর্যন্ত এই আত্মগর্বী শিশুপাল নরপুঙ্গব এই রাজাদের সিংহ করে তুলছে। অল্পবুদ্ধি শিশুপাল সমস্ত রাজাকে যমালয়ে পাঠাবার জন্য আয়োজন করছে। নিশ্চয়ই কৃষ্ণ, এই শিশুপালের সকল তেজ হরণ করার জন্য ইচ্ছা করছেন। যুধিষ্ঠির তোমার মঙ্গল হবে, শিশুপাল ও তার পক্ষপাতী রাজাদের বুদ্ধিবিপ্লব ঘটেছে, বিনাশকালে লোকের বুদ্ধিনাশ হয়, শিশুপালের তাই হয়েছে। যুধিষ্ঠির! কৃষ্ণ ত্রিভুবনস্থ সমস্ত চতুর্বিধ প্রাণীরই জন্ম ও মৃত্যুর কারণ।”

ভীষ্মের কথা শুনে ক্ষিপ্ত শিশুপাল স্বপক্ষীয় রাজাদের নিয়ে ভীষ্মকে কর্কশ বাক্য বলতে লাগলেন, “কুলকলঙ্ক ভীষ্ম, তুমি বৃদ্ধ ও নানাবিধ অলীক বাক্যে উপস্থিত রাজাদের মনে বিভীষিকাময় ভয় জন্মাবার চেষ্টা করছ। তোমার লজ্জা নেই, তুমি নপুংসক, তাই এই ধরনের ধর্মহীন কথা বলা তোমার পক্ষেই সম্ভব। আশ্চর্য! তোমাকে কুরুকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনে করা হয়। বদ্ধ নৌকা যেমন জলপ্রবাহচালিত নৌকার পিছনে যায়, একজন অন্ধ যেমন অপর অন্ধের পিছনে যায়, কুরুবংশীয়দেরও তাই হয়েছে, তাঁরা তোমাকে অগ্রগামী করেছে। তুমি কৃষ্ণের পুতনাবধ প্রভৃতি কার্যের উল্লেখ করে আমাদের মনে অত্যন্ত কষ্ট দিয়েছ। তুমি গর্বিত ও মূর্খ; তাই কৃষ্ণের স্তব করার ইচ্ছা করেছ। তোমার জিভ ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে না কেন ? নিতান্ত বালকের যা নিন্দা করা উচিত, তুমি জ্ঞানবৃদ্ধ হয়ে সেই গয়লাটার স্তব করছ। কৃষ্ণ বাল্যকালে পুতনা বধ করে থাকলে, বিস্ময়ের কী আছে ? যারা যুদ্ধবিদ্যা জানত না সেই অশ্বাসুর ও বৃষাসুর বধ করে থাকলেই বা বৈচিত্র্যের কী আছে ? তার পর ভীষ্ম! কৃষ্ণ যদি চরণদ্বারা চৈতন্যহীন কাষ্ঠময় একটি শকট ভেঙে থাকে, তাতেই বা কী অদ্ভুত কাজ করেছে? যা কেবল একটি উইপোকার মাটি ছিল, সেই গোবর্ধন পর্বতটাকে কৃষ্ণ যদি সপ্তাহখানেক ধারণ করে থাকে, তাও আমার মতে আশ্চর্য নয়। একদিন কৃষ্ণ পর্বতের উপর খেলা করতে গিয়ে, প্রচুর অন্নভোজন করেছিল। এ ঘটনায় তোমার বিস্ময় জাগতে পারে, আমার নয়। তবে কৃষ্ণ যাঁর অন্ন ভোজন করত, সেই কংসকে বধ করেছে, এটি গুরুতর আশ্চর্য বটে।

“হে অধার্মিক কুরুকুলাধম ভীষ্ম, তোমাকে আমি এখন যা বলব, তা তুমি সজ্জনের মুখে নিশ্চয়ই শোননি। স্ত্রীলোক, গোরু, ব্রাহ্মণ আর যার অন্ন ভোজন করা হয় ও যার আশ্রয়ে থাকা যায়, তার উপর অস্ত্রাঘাত করবে না—ধার্মিকেরা সর্বদাই এই উপদেশ দিয়ে থাকেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এ সমস্ত উপদেশ মিথ্যা হয়ে গেছে। কৌরবাধম, আমি কিছু জানি না, এই ভেবে তুমি কৃষ্ণের স্তব করছ এবং আমার সামনেই কৃষ্ণকে অধিক জ্ঞানবৃদ্ধ ও বয়োবৃদ্ধ বলছ। ভীষ্ম, কৃষ্ণ গো-হত্যা ও স্ত্রীহত্যা করেছিল। তবু তোমারই উপদেশে পাণ্ডবেরা কৃষ্ণের পূজা করছে। যে লোক এই ধরনের, সে কি সাধুজনের সংসর্গ পেতে পারে? ‘কৃষ্ণ বুদ্ধিমানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, কৃষ্ণ জগদীশ্বর এবং কৃষ্ণময়ই সকল’, তোমার কথাতেই কৃষ্ণ নিজেকে এমন মনে করে। কিন্তু সে সব নিশ্চয়ই মিথ্যা।

“স্তাবক যদি অনেক প্রশংসাও করে, কেউ তাকে শাসন করে না। কারণ, ফিঙা পাখির মতো সমস্ত প্রাণীই নিজের অনুসরণ করে থাকে। ভীষ্ম সজ্জনেরা মনে করেন, তোমার এই স্বভাবটাই জঘন্য। তোমার জন্য পাণ্ডবদের স্বভাবও দূষিত হয়ে পড়ছে। কারণ, কৃষ্ণ তাঁদের প্রধান অর্চনীয় এবং তুমি তাদের উপদেষ্টা। ভীষ্ম তুমি ধর্ম চর্চা করে যা করলে, কোন জ্ঞানী ব্যক্তি ধর্মপথাশ্রয়ী হয়ে তেমন কার্য করেন? তুমি নিজেকে প্রাজ্ঞ বলে মনে কর, অথচ অন্য পুরুষানুরক্তা এবং ধর্মজ্ঞা অম্বা নাম্নী কাশীরাজের কন্যাকে হরণ করেছিলে কেন? তোমারই ভ্রাতা সচ্চরিত্র বিচিত্রবীর্য তোমার অপহৃত সেই কন্যাকে গ্রহণ করতে ইচ্ছা করেননি। তুমি নিজেকে প্রাজ্ঞ বলে মনে কর, অথচ তোমার সামনেই অন্য কোনও সজ্জন তোমার ভ্রাতাদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। তোমার কোন ধর্ম আছে? তোমার ব্রহ্মচর্য বৃথা; তুমি মোহবশত, কিংবা আপন ক্লীবতার জন্যই ব্রহ্মচর্য ধারণ করেছ। তোমার ইহলোকে বা পরলোকে কোনও উন্নতি দেখছিনা, তুমি বৃদ্ধের সেবা করোনি, তা নিজের খারাপ কাজগুলি ধর্ম বলে বিবেচনা করো।

“দান, অধ্যয়ন, সাধারণ যজ্ঞ এবং প্রচুর দক্ষিণাযুক্ত যজ্ঞ— এই সমস্তগুলি এক সন্তানোৎপাদন কর্মের ষোলো ভাগের এক ভাগের তুল্য নয়। যার কোনও সন্তান থাকে না, তার সমস্ত ব্ৰত ও উপবাস ব্যর্থ হয়। নিঃসন্তান, বৃদ্ধ এবং মিথ্যাধর্মের অনুবর্তী সেই তুমিও এখন হংসের মতো জ্ঞাতিগণের দ্বারাই মৃত্যুমুখে পতিত হবে। ভীষ্ম প্রাচীন কাল থেকে জ্ঞানী ব্যক্তিরা যে কাহিনি বলে আসছেন তাই তোমাকে বলছি শোনো।

“পূর্বকালে ধর্মের কথা বলত, অথচ নিজে অধর্মাচারী এক হংস সমুদ্রতীরে বাস করত, সে সর্বদাই অন্য পক্ষীদের উপদেশ দিত— “পক্ষীগণ তোমরা ধর্মাচরণ করো, অধর্মাচরণ কোরো না।” জলচারী অন্য সমস্ত পক্ষিগণ সেই হংসের জন্য সমুদ্র থেকে খাদ্য এনে দিত। অন্য পক্ষীরা সেই হংসের কাছে নিজেদের সমস্ত ডিম রেখে সমুদ্রে বিচরণ করতে যেত। পক্ষীরা দূরে চলে গেলে, সেই পাপিষ্ঠ ও সতর্ক হংস তাদের ডিমগুলি খেয়ে ফেলত। ক্রমশ ডিমগুলি সংখ্যায় কমে এল। একটি সতর্ক হংস সেদিন সমুদ্রে বিচরণ করতে না গিয়ে আড়ালে থেকে হংসকে ডিমগুলি ভক্ষণ করতে দেখল। হংসের সেই পাপকার্য দেখে পক্ষীটি অন্য সকল পক্ষীর কাছে সেই সংবাদ জানাল। পক্ষীরা এসে প্রত্যক্ষভাবে সেই ঘটনা দেখল এবং তখনই সেই মিথ্যাচরিত্র হংসটিকে মেরে ফেলল। অতএব ভীষ্ম, সেই মিথ্যাচরিত্র হংসের ন্যায় তোমাকেও রাজারা ক্রুদ্ধ হয়ে মেরে ফেলবেন। তারপর থেকে এই প্রবাদ জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলে থাকেন, ‘হে হংস! লোভ ও হিংসা তোমার চিত্তকে কলুষিত করেছিল, তবুও তুমি অন্যকে উপদেশ দিতে—ধর্ম আচরণ করো, —তোমার এই অশুভ পরিণাম তোমার বাক্য অনুযায়ীই ঘটেছে।’

“মহাবল জরাসন্ধ রাজা আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার ব্যক্তি ছিলেন, তিনি কৃষ্ণকে দাস মনে করে তার সঙ্গে যুদ্ধ করেননি। কিন্তু কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুন সেই জরাসন্ধ বধের সময় যা করেছিল, তা কোন ব্যক্তি ন্যায্য বলে মনে করে? কৃষ্ণ ছলনাপূর্বক ব্রাহ্মণ সেজে অদ্বার দিয়ে প্রবেশ করেও জরাসন্ধের সৌজন্য দেখেছিল। ধর্মাত্মা জরাসন্ধ ব্রাহ্মণ জেনে এই দুরাত্মা কৃষ্ণকে পাদ্যপ্রভৃতি দিয়েছিলেন। তিনি কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জুনকেও তা গ্রহণ করতে বলেছিলেন, কিন্তু তারা অন্য প্রকার ব্যবহার করেছিল।

“মূর্খ! তুমি কৃষ্ণকে যা মনে করো, কৃষ্ণ যদি তেমনই জগতের কর্তা হত, তবে ও নিজেকে সম্পূর্ণ ব্রাহ্মণ বলে মনে করে না কেন? আমার আশ্চর্য লাগছে এই যে, তুমি পাণ্ডবদের সৎপথভ্রষ্ট করছ, তবু তারা তোমার দেখানো পথকেই ভাল মনে করে। অথবা ভীষ্ম এটা আশ্চর্য নয়, কারণ স্ত্রীলোকের তুল্য এবং বৃদ্ধ তুমি পাণ্ডবদের পরামর্শদাতা হয়েছ।”

বলিশ্রেষ্ঠ ও ভয়ংকর পরাক্রমশালী ভীমসেন শিশুপালের সেই কর্কশ বাক্য শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন। ভীমসেনের নয়নযুগল স্বভাবতই দীর্ঘ ও বিস্তৃত ছিল। কিন্তু তখন প্রচণ্ড ক্রোধবশত তার প্রান্ত দুটি অত্যন্ত তাম্রবর্ণ হওয়ায় সে নয়নযুগল পদ্মতুল্য, রক্তবর্ণ হয়ে পড়ল। রাজারা সকলেই দেখলেন, ভীমসেনের ললাটে তিনটি ভ্রূকুটি রেখা ত্রিকূট পর্বতস্থিত ত্রিপথগামিনী গঙ্গার মতো দেখতে লাগছে। ক্রোধে ভীমসেন ওষ্ঠ দংশন করতে লাগলেন। প্রলয়কালীন সমস্ত জগৎ ভক্ষণকারী কালের মতো তাঁর মুখখানি মনে হতে লাগল। এ-হেন ভীমসেন বেগে গাত্রোত্থান করলেন; তখন মহাদেব যেমন কার্তিককে ধরেন, সেই রকম মহাবাহু ভীষ্ম ভীমকে ধরলেন। পিতামহ ভীষ্ম নানাবিধ বাক্যদ্বারা ভীমসেনের ক্রোধ প্রশমিত করলেন। বর্ষাকাল অতীত হলে উচ্ছলিত সমুদ্র যেমন তীর অতিক্রম করে না, তেমনই শত্রুদমনকারী ভীম ভীষ্মের বাক্য অতিক্রম করলেন না।

ভীম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেও শিশুপাল কিন্তু নিজের পুরুষকারের উপর অকম্পিত রইলেন। ভীম বারবার বেগে উঠতে লাগলেন; কিন্তু ক্রুদ্ধ সিংহ যেমন হরিণকে গ্রাহ্য করে না, তেমনই শত্রুদমনকারী শিশুপালও ভীমকে গ্রাহ্য করলেন না। বরং শিশুপাল ভীমকে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হতে দেখে হাসতে হাসতে বলতে থাকলেন, “ভীষ্ম তুমি ভীমটাকে ছেড়ে দাও; রাজারা সকলেই দেখুন যে পতঙ্গ যেমন আগুনে পুড়ে মরে, ভীমও আমার হাতে তেমন এখনই মারা যাবে।”

তখন কুরুকুলশ্রেষ্ঠ ভীষ্ম শিশুপালের কথা শুনে ভীমসেনকে বললেন, “এই শিশুপালের জন্মের সময় ত্রিনয়ন ও চতুর্ভুজ হয়ে জন্মেছিল এবং জন্মের পরে প্রথমে গর্দভের মতো এবং পরে মানবসন্তানের মতো চিৎকার করেছিল। তার বাবা, মা, বন্ধুগণ এতদূর ভয় পেয়েছিলেন যে, তাঁরা তাকে ত্যাগ করার কথাই ভেবেছিলেন। তখন চিন্তাকুল পরিবারের কাছে দৈববাণী হয়েছিল— ‘রাজা আপনার এই পুত্রটি সুখী এবং মহাবল হয়ে জন্মেছে; অতএব আপনি ভয় পাবেন না, সুস্থচিত্তে শিশুটিকে পালন করুন। কারণ, আপনি এই শিশুর মৃত্যুর কারণ নন, কিংবা এর মৃত্যুর সময় এখনও আসেনি। কিন্তু যিনি একে বধ করবেন, তিনি জন্মেছেন।’ এই দৈববাণী শুনে চেদিরাজের স্ত্রী কৃতাঞ্জলি হয়ে প্রশ্ন করেন, ‘যিনি আমার পুত্রের বিষয়ে এই কথা বললেন, তিনি আমাকে আরও বলুন। আমি যথার্থ জানতে চাই, কোন ব্যক্তি আমার পুত্রের মৃত্যুর কারণ হবে।’ দৈববাণী পুনরায় বলল, ‘যে ব্যক্তি কোলে নিলে পর এই বালকের পাঁচমাথা দীর্ঘ অতিরিক্ত বাহযুগল খসে যাবে এবং যাকে দেখলে এর ললাটের তৃতীয় নয়ন লোপ পাবে, সেই ব্যক্তিই এর মৃত্যুর কারণ হবে।’

“তারপর লোকমুখে এই ত্রিনয়ন ও চতুর্ভুজ শিশুর সংবাদ পৌঁছলে, রাজারা সকলেই সেই শিশুকে দেখতে আসলেন। রাজা আগত অন্য রাজাদের যথাযোগ্য সম্মান দেখিয়ে প্রত্যেকের কোলে শিশুটিকে তুলে দিতে লাগলেন। সহস্র সহস্র রাজার কোলে উঠেও শিশুটির কোনও পরিবর্তন ঘটল না। তারপর একদিন দ্বারকা নগর থেকে বলরাম ও কৃষ্ণ শিশুটিকে দেখতে এলেন। বলরাম ও কৃষ্ণ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের, রাজাকে ও পিসিমাকে (শিশুপালের মাতা) যথাবিধানে অভিবাদন করে, তাঁদের মঙ্গল ও আরোগ্য বিষয়ে প্রশ্ন করলেন। রাজমহিষী তাঁদের অত্যন্ত সমাদর করে নিজে শিশুটিকে কৃষ্ণের কোলে রাখলেন। কৃষ্ণের কোলে রাখামাত্র সেই শিশুটির অতিরিক্ত বাহু দুটি পড়ে গেল এবং ললাটের তৃতীয় নয়নটি লুপ্ত হয়ে গেল। তা দেখে রাজমহিষী অত্যন্ত ভীত হয়ে কৃষ্ণের কাছে বর প্রার্থনা করলেন। তিনি বললেন, “মহাবাহু কৃষ্ণ, আমি অত্যন্ত ভীত হয়ে তোমার কাছে বর চাইছি। কারণ তুমি আর্তের আশ্রয়দাতা এবং ভীতের অভয়দাতা।”

“তিনি এই কথা বললে, যদুনন্দন কৃষ্ণ বললেন, ‘পিসিমা! আপনি ভয় করবেন না, আমার থেকে আপনার কোনও ভয় নেই, কী বর দেব বলুন, অন্য আর কিছু করার থাকলেও বলুন। আমার শক্তির মধ্যে থাক আর না থাক, আমি আপনার অভিপ্রায় অনুযায়ী কাজ করব।’

“কৃষ্ণ এই কথা বললে, শিশুপালের মাতা তাঁর কাছে প্রার্থনা করলেন, ‘হে বলশালী যদুশ্রেষ্ঠ! তুমি আমার জন্যই শিশুপালের অপরাধ ক্ষমা করবে। প্রভু! আমাকে এই বর দাও।’

“কৃষ্ণ বললেন, ‘হে পিতৃভগিনী! আপনার পুত্র বধযোগ্য হলেও, আমি এর একশো অপরাধ ক্ষমা করব। ভীম! পাপাত্মা ও নির্বোধ এই শিশুপাল রাজা কৃষ্ণের সেই বরে দর্পিত হয়েই তোমাকে যুদ্ধে আহ্বান করছে। না হলে, আজ পৃথিবীর কোন রাজা আমাকে নিন্দা করতে পারেন। শিশুপাল কৃষ্ণের তেজেই গর্জন করছে, এবং কৃষ্ণ নিশ্চয়ই এর তেজ অবিলম্বে হরণ করবেন। এই দুর্বুদ্ধি শিশুপাল আমাদের সকলকে অগ্রাহ্য করে অবিশ্রান্ত গর্জন করছে।”

শিশুপাল ভীষ্মের সেই তেজ সহ্য করতে না পেরে বললেন, “ভীষ্ম তুমি স্তুতিপাঠকের মতো যার স্তব গান করছ, সেই কৃষ্ণের সমস্ত তেজ শত্রুপক্ষে মিলিত হোক। তবে তোমার যদি স্তব পাঠ করতে ভাল লাগে তবে উপস্থিত রাজাদের স্তব করো। বাহ্লিক দেশাধিপতি এই দরদের স্তব করো, যিনি জন্মমাত্রই পৃথিবী অবনত হয়ে গিয়েছিল। বলে ইন্দ্রের তুল্য এবং শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধারী এই কর্ণের স্তব করো। যিনি বাহুযুদ্ধে অতি দুর্জয় জরাসন্ধকে পরাজিত করেছিলেন, যিনি সহজাত কবচ, কুণ্ডলের অধিকারী, সেই কর্ণের স্তব করো। ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ এবং মহারথ দ্রোণ এবং অশ্বত্থামার স্তব করো। এঁদের মধ্যে একজনও ক্রুদ্ধ হলে পৃথিবীকে নাশ করতে পারেন। আমি যুদ্ধে দ্রোণ কিংবা অশ্বত্থামার মতো কোনও বীর দেখতে পাই না। অথচ তুমি তাঁদের গুণগান না করে কৃষ্ণের স্তব করছ কেন? রাজশ্রেষ্ঠ মহাবাহু দুর্যোধন, সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত পৃথিবীতে যার তুল্য কেউ নেই, তাঁকে বন্দনা না করে অথবা অস্ত্রে সুশিক্ষিত ও দৃঢ়বিক্রমশালী জয়দ্রথকে অথবা পুরুষদের অস্ত্রশিক্ষক ও জগতে বিখ্যাত বিক্রম মহাবীর দ্রুম রাজাকে বাদ দিয়ে কৃষ্ণের প্রশংসা করছ। তা ছাড়াও, ধনুর্ধরদের মধ্যে প্রধান এবং পুরুষশ্রেষ্ঠ রুক্মীকে পরিত্যাগ করে— মহাবীর ভীষ্মক, রাজা দন্তবক্র, ভগদত্ত, যুপকেতু, মগধরাজ জয়সেন, বিরাট, দ্রুপদ, শকুনি, বৃহদ্বল, অবন্তিদেশীয় বিন্দু ও অনুবিন্দ, পাণ্ড্যরাজ, শ্বেত, উত্তর, শঙ্খ, মহাত্মা ও মানী বৃষসেন, বিক্রমী একলব্য, মহারথ ও মহাবীর কলিঙ্গ রাজকে অতিক্রম করে কৃষ্ণকে প্রশংসা করছ কেন? যদি অপরের প্রশংসা করাতেই তোমার মন উৎসুক থাকে, তবে তুমি শল্য প্রভৃতি রাজার প্রশংসা করছ না কেন?

“ভীষ্ম তোমাকে আমি আর কী বলব? বোঝা যাচ্ছে বৃদ্ধ ধর্মবেত্তাদের উপদেশের সময় তুমি মন দিয়ে তাঁদের কথা শোননি। তুমি শোননি যে, নিজের নিন্দা বা নিজের প্রশংসা, পরের নিন্দা ও পরের প্রশংসা—দুইই আচারসিদ্ধ নয়। তুমি মোহবন্ধন ভক্তিবশত সর্বদাই কৃষ্ণের স্তব করে থাক, অথচ কৃষ্ণ স্তবের অযোগ্য। অতএব কোনও লোকই তোমার সে স্তবের অনুমোদন করে না। দুরাত্মা কৃষ্ণ কংসের দাস এবং কংসেরই গোবৎসক, অথচ তুমি কেবলই কৃষ্ণকে জগৎসভায় প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছ। তোমাকে পূর্বেই বলেছি, তোমার বুদ্ধি কুলিঙ্গপাখির মতো অপ্রকৃতিস্থ। কুলিঙ্গপাখি হিমালয়ের অপর পারে থাকে, সে সর্বদাই বলে ‘মা সাহসম্‌’ (অর্থাৎ সাহস কোরো না), অথচ সে নিজে গুরুতর সাহস করে, যার পরিণাম সে বোঝে না। কারণ, সিংহ মাংস খেতে থাকলে, তার দাঁতের ভিতর মাংস লেগে থাকে, তখন অল্পবুদ্ধি সেই কুলিঙ্গপক্ষিণী সিংহের মুখ থেকে সেই মাংস টেনে বার করে। অর্থাৎ, সেই কুলিঙ্গ পক্ষিণী সিংহের ইচ্ছাক্রমেই বেঁচে থাকে। ভীষ্ম তোমারও সেই অবস্থা। অপ্রিয় কাজ করেও তুমি যে এখনও বেঁচে আছ, তা কেবলমাত্র এই উপস্থিত রাজাদের দাক্ষিণ্যে।”

ভীষ্ম ধৈর্যসহকারে শিশুপালের সমস্ত কটু কথা শুনলেন। তারপর তাঁকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে বললেন, “শিশুপাল আমি এই রাজাদের ইচ্ছাতেই বেঁচে আছি; কিন্তু এই রাজাদের আমি তৃণের তুল্যও গণনা করি না।” ভীষ্ম এই কথা বললে, শিশুপালপক্ষীয় রাজারা ক্রুদ্ধ হলেন এবং তাঁদের কেউ কেউ উপহাস আবার কেউ কেউ ভীষ্মের নিন্দা করতে থাকলেন। মহাধনুর্ধর কোনও রাজা ভীষ্মের সেই কথা শুনে বললেন, “এই ভীষ্ম বৃদ্ধ হয়েও পাপাত্মা এবং গর্বিত; সুতরাং এ আমাদের ক্ষমার অযোগ্য। অতএব ক্রুদ্ধ রাজারা এই ভীষ্মটাকে পশুর মতো বধ করুন অথবা মাদুর জড়িয়ে ওটাকে পুড়িয়ে মারুন।”

বুদ্ধিমান কুরুপিতামহ ভীষ্ম তাঁদের উক্তি শুনে সেই রাজাদের বললেন, “রাজগণ, আমরা একটা কথা বললাম, আবার তোমরা আর একটা বললে, এভাবে চলতে থাকলে উক্তি-প্রত্যুক্তির কোনও শেষ হবে না; অতএব তোমরা আমার কথা শোনো। আমাকে তোমরা পশুর মতো হত্যা করো, অথবা মাদুর জড়িয়ে দগ্ধই করো; আমি কিন্তু তোমাদের মাথায় এই সম্পূর্ণ পদাঘাত করলাম। আমরা কৃষ্ণের পূজা করেছি, তিনিও এখানে আছেন; এখন যার বুদ্ধি মরণের জন্য ব্যস্ত হয়েছে সে চক্র ও গদাধারী কৃষ্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করুক এবং তাঁর হাতে মৃত্যুলাভ করে তার শরীরে প্রবেশ করুক।”

ভীষ্মের কথা শুনে মহাবিক্রমশালী শিশুপাল কৃষ্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছা করে তাঁকে বললেন, “কৃষ্ণ আমি তোমাকে আহ্বান করছি, তুমি আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসো; আজ আমি সমস্ত পাণ্ডবের সঙ্গে তোমাকে বধ করব। কৃষ্ণ! সর্বপ্রকারেই তোমার সঙ্গে পাণ্ডবেরা আমার বধ্য। কারণ তুমি রাজা নও, তবুও পাণ্ডবেরা সমস্ত রাজাকে অতিক্রম করে তোমাকে পূজা করেছে। তুমি রাজা নও, বস্তুত কংসের দাস এবং দুর্মতি; সুতরাং তুমি পূজার অযোগ্য। তবুও যে-পাণ্ডবেরা বাল্যকাল থেকে তোমার পূজা করে আসছে, তারা অবশ্যই আমার বধ্য।” এই কথা বলে শিশুপাল গর্জন করতে করতে সেখানে অবস্থান করতে লাগলেন।

শিশুপাল একথা বললে, তার সামনেই বলবান কৃষ্ণ সকল রাজাকে অত্যন্ত কোমল কন্ঠে বললেন, “রাজগণ, আমরা যাদবেরা এই শিশুপালের কোনও ক্ষতি করিনি, তবুও এই নৃশংস প্রকৃতির শিশুপাল আমাদের গুরুতর শত্রু হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজগণ! আমরা প্ৰাগ্‌জ্যোতিষপুরে গিয়েছি শুনে এই শিশুপাল আমাদের পিসতুতো ভাই হয়েও আমাদের অনুপস্থিতিতে দ্বারকানগরীতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। ভোজরাজ রৈবতকপর্বতে বিশ্রাম করছিলেন, সেই সময়ে এই দুরাত্মা গিয়ে তাঁর সহচরদের হত্যা ও বন্ধন করে নিজের রাজধানীতে চলে গিয়েছিল। আমার পিতৃদেব অশ্বমেধ যজ্ঞ করার জন্য একটি অশ্বকে রক্ষী পরিবেষ্টিত করে ছেড়ে দেন। এই পাপাত্মা, সেই যজ্ঞের বিঘ্ন ঘটানোর জন্য সেই মেধ্য অশ্বটিকে অপহরণ করেছিল। যশস্বী বভ্রুর ভার্যা দ্বারকা থেকে সৌবীরদেশে যাবার পথে এই দুরাত্মা সেই অকামা নারীকে হরণ করেছিল। এই দুরাত্মা ছদ্মবেশ ধারণ করে করূষরাজের জন্য মাতুলের কন্যা এবং বিশাল রাজার মহিষী নিঃসহায় ভদ্রাকে চুরি করেছিল। আমার পিসিমার জন্যই আমি এ যাবৎ শিশুপালের সমস্ত উপদ্রব সহ্য করেছি। আমার আড়ালে ও যা করেছিল, তা আপনারা শুনলেন। আমার সামনেই ও আজ যে ব্যবহার করল, তাও আপনারা দেখলেন এবং শুনলেন। বিশেষত সমবেত রাজাদের সামনে যে কুৎসিত ব্যবহার করল, তা আমি সহ্য করতে পারব না। এই মুমূর্ষু মুর্খটার রুক্মিণীকে লাভ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু শূদ্র যেমন বেদবাক্য শুনতে পারে না— এই মূর্খটা রুক্মিণীকে লাভ করতে পারেনি।”

রাজারা কৃষ্ণের কথা শুনে শিশুপালের নিন্দা করতে লাগলেন কিন্তু শিশুপাল কৃষ্ণের কথা শুনে অট্টহাস্য করে বললেন, “কৃষ্ণ সভার মধ্যে, বিশেষত রাজাদের সামনে ‘রুক্মিণী পূর্বে আমার পরিগৃহীতা ছিলেন’ একথা বলতে তোমার লজ্জা হল না? তুমি ছাড়া অন্য কোন পুরুষ সভার মধ্যে নিজের স্ত্রীকে অন্যপূর্বা জেনে তা প্রচার করে থাকে। কৃষ্ণ তোমার ইচ্ছা হলে ক্ষমা করতেও পার, নাও পার। কারণ তুমি ক্রুদ্ধ হলেই বা আমার কী হবে এবং প্রসন্ন হলেই বা আমার কী হবে ?”

শিশুপাল যখন এই কথা বলছিলেন, সে সময় শক্ৰহন্তা ভগবান কৃষ্ণ চক্র দ্বারা তাঁর দেহ থেকে মস্তক কেটে ফেললেন; বজ্রাহত পর্বতের ন্যায় শিশুপালের দেহ ভূতলে পতিত হল।

ততশ্চেদিপতের্দেহাত্তেজোহগ্র্যং দদৃর্শুনৃপাঃ।

উৎপতন্তং মহারাজ! গগনাদিব ভাস্করম্॥ সভা: ৪৪: ২২।।

—মহারাজ! তারপর সেই স্থানের রাজারা দেখলেন— আকাশ থেকে উদিত সূর্যের মতো একটা উত্তম তেজ শিশুপালের দেহ থেকে বাইরে বেরিয়ে এল।

সেই তেজটা তখনই গিয়ে কমলনয়ন ও জগৎপূজিত কৃষ্ণকে যেন নমস্কার করল এবং তাঁর শরীরে প্রবেশ করল। সেই তেজ কৃষ্ণের শরীরে প্রবেশ করলে রাজারা স্তম্ভিত হয়ে সেই অদ্ভুত ঘটনা দেখলেন। কৃষ্ণ শিশুপালকে বধ করলে, বিনা মেঘে বৃষ্টি হতে লাগল, উজ্জ্বল বজ্রপাত হল এবং পৃথিবী কাঁপতে থাকল। সেই অবর্ণনীয় কৃষ্ণের দিকে রাজারা তাকাতেই পারলেন না। কোনও রাজা আড়ালে গিয়ে কৃষ্ণের প্রশংসা করতে থাকলেন, অন্যেরা হাতে হাত ঘষতে ঘষতে ওষ্ঠদংশন করতে লাগলেন। তখন যুধিষ্ঠির ভীমকে মৃত শিশুপালের দেহ সৎকার করার জন্য আদেশ দিলেন। এবং শিশুপালের পুত্রকে চেদিরাজের সিংহাসনে অভিষিক্ত করলেন।

*

শিশুপালবধ মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত। শিশুপালের মৃত্যুর ফলে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হল। এক অক্ষশক্তি যার নেতা ছিলেন সম্রাট জরাসন্ধ, যাঁর দুই সহায়ক শক্তি ছিলেন কংস ও শিশুপাল—এঁরা তিনজনই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে নিহত হলেন। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যপ্রাপ্তির পথের বাধাগুলিও ক্রমশ অপসারিত হতে থাকল। কারণ, শিশুপাল অবশ্যই দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করতেন।

৩১
দুর্যোধনের দুরবস্থা

রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হল। আগত রাজারা সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেছেন। ভীষ্ম, কৃপ, বিদুর, যুধিষ্ঠিরকে আশীর্বাদ করে হস্তিনাপুরে প্রত্যাগমন করেছেন। অন্য কৌরব ভ্রাতারাও প্রস্থান করেছেন। থেকে গেছেন শুধু মাতুল শকুনি আর দুর্যোধন। কৃষ্ণের প্রত্যাবর্তনেরও সময় উপস্থিত হল। কুন্তীকে প্রণাম, দ্রৌপদী ও সুভদ্রাকে প্রিয় সম্বোধন করে, পাণ্ডব ভ্রাতাদের যথাযোগ্য সম্বোধন করে কৃষ্ণ দারুক আনীত আপন রথে গিয়ে উঠলেন। পাণ্ডবেরা পায়ে হেঁটে সেই রথের অনুসরণ করলেন। কিছু পথ অগ্রসর হবার পর কৃষ্ণ রথ থামিয়ে পাণ্ডবদের ফিরে যেতে বললেন। পরস্পর পরস্পরের প্রতি শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর পাণ্ডবেরা ফিরে এলেন। কৃষ্ণের রথও দ্বারকার দিকে চলতে লাগল।

দুর্যোধন শকুনির সঙ্গে বেশ কিছুদিন ইন্দ্রপ্রস্থে বাস করলেন। তারপর একদিন সমস্ত ইন্দ্রপ্রস্থ ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলেন। হস্তিনাপুরে যেগুলি দেখতে পাননি, এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত বস্তু সেখানে দেখতে পেলেন। বহুতর স্বর্গীয় আকার প্রকার সেই সভায় দেখে দুর্যোধন, মুগ্ধ বিস্মিত ও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কোনও সময়ে দুর্যোধন সেই সভার মধ্যে একটি স্ফটিকময় স্থলে উপস্থিত হয়ে ভ্রমবশত সেই স্থলটিকে জল মনে করে হাঁটু থেকে কাপড় তুলে সন্তর্পণে হাঁটতে গেলেন। তারপর নিজের ভ্ৰম বুঝতে পেরে লজ্জায় বিষন্ন ও বিমুখ হয়ে যেন মরে গেলেন। তারপর আপন নির্ধারিত স্থলে উপস্থিত হয়ে আরও লজ্জিত ও বিষন্ন হলেন। সেই সভার মধ্যে একটি জলাশয় ছিল, তার জল স্ফটিকময় স্থলের মতো স্বচ্ছ ছিল এবং পদ্মগুলিও স্ফটিক নির্মিত পদ্মের মতোই শোভা পাচ্ছিল। দুর্যোধন সোজা হাঁটতে গিয়ে বস্ত্র সমেত সেই জলের মধ্যে পড়ে গেলেন। তখন ভৃত্যেরা দুর্যোধনকে জলে পড়ে যেতে দেখে ভীষণভাবে হাসতে লাগল এবং যুধিষ্ঠিরের আদেশে দামি জামা-কাপড় এনে দুর্যোধনকে দিল!

দুর্যোধন ভিজে কাপড়-জামা ছেড়ে শুষ্ক বস্ত্র পরিধান করে এসেছেন দেখে ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব—এঁরা সকলেই হেসে ফেললেন। কিন্তু কোপন স্বভাব দুর্যোধন তাঁদের উপহাস মনে মনে সহ্য করতে পারলেন না, কিন্তু মনের ভাব গোপন করে তাঁদের দিকে তাকালেন না। কিন্তু আবার ভ্রমবশত জল পার হবেন বলে কাপড় তুললেন কিন্তু তিনি স্থলে যেতে থেকেই হোঁচট খেলেন। তাতেও সকলে তাঁকে উপহাস করল। এরপর দুর্যোধন দরজার মতো করে তৈরি করা একটি স্ফটিকময় ভিত্তিকে দ্বার মনে করে প্রবেশ করতে গিয়ে মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে ঘুরে পড়ে গেলেন। ঠিক তেমনই অন্য একটি উন্মুক্ত দ্বারে মণিকিরণ এসে পড়ায় দুটি স্ফটিকময় বিশাল কপাট বন্ধ আছে— এই ভেবে দু’হাতে তাতে বেগে ধাক্কা দিয়ে খুলতে গিয়ে সামনে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন। আবার তিনি একখানি খোলা দরজা পেলেন; কিন্তু সেটিকেও আগের দরজার মতো মনে করে সেখান থেকে ফিরে গেলেন।

রাজা দুর্যোধন সেই সভাভবনে এই প্রকার নানাবিধ বিড়ম্বনা ভোগ করে এবং রাজসূয় যজ্ঞের সেই অদ্ভুত সমৃদ্ধি দেখে, অপ্রসন্ন মনে যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে হস্তিনাপুরে যাত্রা করলেন। পাণ্ডবদের সমৃদ্ধি দেখে দুর্যোধন অত্যন্ত সন্তপ্ত হয়েছিলেন। তাঁর বুকের মধ্যে তীব্র ঈর্ষার আগুন জ্বলতে লাগল, পাণ্ডবদের প্রসন্নতা, অন্য রাজাদের তাঁদের প্রতি আনুগত্য, অন্য রাজাদের হিতৈষিতা দেখে দুর্যোধনের মুখ ও দেহকান্তি বিবর্ণ হয়ে গেল। এই অবস্থায় তিনি যুধিষ্ঠিরের সভা ও তাঁর অতুলনীয় সম্পদের বিষয় চিন্তা করতে করতে অত্যন্ত অস্থিরচিত্তে পথে যাচ্ছিলেন। শকুনি বারবার তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু অন্যমনস্ক দুর্যোধন তার উত্তর দিলেন না।

শকুনি দুর্যোধনকে অন্যমনস্ক দেখে বললেন, “দুর্যোধন তুমি নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে পথ দিয়ে যাচ্ছ। এর কারণ কী?” দুর্যোধন বললেন, “মাতুল মহাবীর অর্জুনের অস্ত্রপ্রভাবে বিজিত হওয়ায় এই সমগ্র পৃথিবীটাই যুধিষ্ঠিরের বশে এসেছে দেখে এবং দেবগণের মধ্যে দেবরাজের যেমন হয়েছিল, তেমনই মহাতেজা যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ সম্পন্ন হয়ে গেল দেখে, আমি ঈর্ষানলে দগ্ধ হচ্ছি। গ্রীষ্মকালে অল্প জলের মতো শুকিয়ে যাচ্ছি। মাতুল, আপনি দেখুন, কৃষ্ণ শিশুপালকে বধ করল। কিন্তু সেখানে এমন একজনও পুরুষ ছিল না, যে শিশুপাল হত্যার প্রতিশোধ নেয়। কারণ পাণ্ডবদের প্রতাপে সে রাজারা বশীভূত ছিল; এর অন্য কারণ হয় না। পাণ্ডবেরা উপস্থিত ছিল বলেই, অন্য রাজারা কৃষ্ণের সেই গুরুতর অসঙ্গত কার্যে প্রতিবাদহীন হয়ে থাকল। আর করদাতা বৈশ্যদের মতো রাজারা নানাবিধ রত্ন নিয়ে এসে রাজা যুধিষ্ঠিরের পূজা করে গেছেন। যুধিষ্ঠিরের সেই উজ্জ্বল রাজলক্ষ্মী দেখে আমি ঈর্ষানলে দগ্ধ হচ্ছি। কিন্তু আমি তো এইভাবে দগ্ধ হবার যোগ্য নই।” শোকসন্তপ্ত দুর্যোধন আবার শকুনিকে বললেন, “মাতুল আমি আগুনে প্রবেশ করব, কিংবা বিষভক্ষণ করব অথবা জলে ডুবে মরব। এভাবে আমি বেঁচে থাকতে পারব না। জগতে কোন বলবান পুরুষ শত্রুর ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে দেখেও সহ্য করতে পারে? মানসিকভাবে আমি এখন স্ত্রী নই, নপুংসক নই, পুরুষ নই এবং পশুও নই—অথচ আমাকে পাণ্ডবদের শ্রীবৃদ্ধি এইভাবে সহ্য করতে হচ্ছে। আমি একাকী রাজলক্ষ্মীকে লাভ করতে পারব না। অথচ আমার অন্য কোনও সহায় সম্বলও নেই, সেই কারণেই মৃত্যু ছাড়া আমার অন্য গতিও নেই। যুধিষ্ঠিরের নির্মল ও অসাধারণ রাজলক্ষ্মী দেখে আমি বুঝতে পারছি দৈবই প্রবল, পুরুষকার নয়। পাণ্ডবদের বিনাশের জন্য আমি পূর্বে কত চেষ্টা করেছি, অথচ তারা সে সমস্তই অতিক্রম করে জলে পদ্মের মতো বড় হয়ে উঠছে। তাই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা ক্রমাগত অবনতি লাভ করছে আর পাণ্ডবদের ক্রমাগত উন্নতি ঘটছে। মাতুল ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র আমি দুর্যোধন, যুধিষ্ঠিরের সমৃদ্ধি, তাঁর সভা ও তাঁর ভৃত্যগণের উপহাসে দগ্ধ হচ্ছি। সুতরাং মৃত্যুই আমার একমাত্র গতি, আপনি আমাকে মরবার অনুমতি দিন; আর পিতাকে জানাবেন যে আমি অত্যন্ত সন্তপ্ত অবস্থায় ছিলাম।”

শকুনি বললেন, “দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের উপর তোমার ক্রোধ করা উচিত নয়। কারণ পাণ্ডবেরা ভাগ্যবলে বলীয়ান। তুমি বহুবার তাঁদের বিনাশ করার চেষ্টা করেছ কিন্তু ভাগ্যের কৃপায় তারা প্রতিবারই রক্ষা পেয়েছে। দ্রৌপদীকেও তাঁরা আপন ভাগ্যের বলে লাভ করেছে এবং পুত্রগণ দ্রুপদ রাজাকে সহায় পেয়েছেন এবং পৃথিবী লাভের জন্য কৃষ্ণের সহায়তা পেয়েছে। তোমার স্বার্থ ক্ষুন্ন না করেও তাঁরা পৈতৃক অংশ পেয়েছে এবং বাহুবলে তার উন্নতি ঘটিয়েছে। অর্জুন অগ্নিকে সন্তুষ্ট করে গাণ্ডিব ধনু, দুই অক্ষয় তূণ এবং ভয়ংকর অস্ত্রসকল লাভ করেছে। সেই অস্ত্রের সাহায্যেই অর্জুন অন্য রাজাদের বশ করেছে, ময়দানবকে দিয়ে উত্তম সভা নির্মাণ করিয়েছে। ময়দানবের আদেশেই কিঙ্কর নামের রাক্ষসেরা সেই সভাকে রক্ষা করে, তাতেই বা তোমার বিলাপের কারণ কী আছে ? আর দুর্যোধন তুমি তো অসহায় নও। দুঃশাসন প্রভৃতি মহারথ তোমার সহায়, পুত্রের সঙ্গে মহাধনুর্ধর ও বলবান দ্রোণাচার্য, কর্ণ, কৃপাচার্য, ভ্রাতৃগণের সঙ্গে আমি এবং সোমদত্ত রাজা— এদের সঙ্গে মিলিত হয়ে তুমি তো সমগ্র পৃথিবীকেই জয় করতে পারো। তবে রাজা! যে উপায়ে তুমি একাই যুধিষ্ঠিরকে জয় করতে পারো, তা আমি জানি, তুমি তা শোনো, এবং সেই অনুযায়ী কাজ করো।”

দুর্যোধন বললেন, “মাতুল আমার অসতর্কতায় বন্ধুদের বা আমার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের ক্ষতি না হয়, এবং যাতে আমি পাণ্ডবদের জয় করতে পারি, আপনি তা আমাকে বলুন।”

শকুনি বললেন, “দুর্যোধন যুধিষ্ঠির দ্যূত খেলা ভালবাসে। অথচ সে তাতে পটু নয়। কিন্তু তাকে ডাকলে, সে না এসে পারবে না। আমি দ্যূতক্রীড়ায় বিশ্বশ্রেষ্ঠ। অতএব তুমি- যুধিষ্ঠিরকে দ্যূতক্রীড়ায় আহ্বান করো। আমি তোমার জন্যই দ্যূতক্রীড়া করে যুধিষ্ঠিরের রাজ্য এবং রাজলক্ষ্মী সকলই নিয়ে নেব। তুমি ধৃতরাষ্ট্র রাজাকে একথা জানাও। তিনি অনুমতি দিলে আমি যুধিষ্ঠিরকে পরাজিত করব।”

*

বীজ বোনা হয়ে গেল। অতঃপর যুধিষ্ঠিরকে দ্যূতক্রীড়ায় আমন্ত্রণ জানাতে আসবেন মহামন্ত্রী বিদুর। বিদুর অনিচ্ছুক ছিলেন কিন্তু রাজার আদেশ পালনে তিনি বাধ্য হলেন। ইন্দ্রপ্রস্থ ও রাজসভা গ্রাস করা দুর্যোধনের অভিপ্রায় ছিল। অর্থাৎ ভূমি নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটল। শকুনি শঠ পাশা খেলায় পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর অত্যন্ত সাধে গড়া ইন্দ্রপ্রস্থ রাজ্য জয় করল। পঞ্চ পাণ্ডবকে বনে যেতে হল। এর পর অশ্বমেধ যজ্ঞের আগে ইন্দ্রপ্রস্থের আর উল্লেখ পাওয়া যায় না। যুধিষ্ঠির দ্যূতক্রীড়ায় ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল যে, আহ্বান করলে তিনি দ্যূতক্রীড়া অস্বীকার করবেন না। সেই কারণেই তিনি দ্যূতক্রীড়ায় যোগ দিয়েছিলেন।

৩২
সভাকক্ষে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা

(দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা মহাভারতের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এ-ঘটনার সূত্রপাত দ্রোণ-দ্রুপদের বিরোধ থেকে। দ্রোণকে গুরুদক্ষিণা দিতে অর্জুন দ্রুপদকে বন্দি করে আনলেন। লাঞ্ছিত, অপমানিত দ্রুপদ গুরুতর তপস্যা শুরু করলেন। দ্রৌপদীর আবির্ভাব বীজ উপ্ত হল। দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার শেষ হয়েছে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ থেকে অশ্বত্থামার মাথার মণি দান করে নির্বাসন যাত্রায়।

কিন্তু দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার বিবরণ রচনার পূর্বে অন্য কয়েকটি প্রশ্নের মীমাংসা করা প্রয়োজন। প্রথমত এই দ্যূতক্রীড়া অনিবার্য ছিল কি না। বহু মহাভারত-আলোচক এই পাশা খেলার জন্য যুধিষ্ঠিরের প্রচণ্ড সমালোচনা করেছেন। অতি শ্রদ্ধেয় এক ভারতবিখ্যাত পণ্ডিত, আলোচনা প্রসঙ্গে আমাকে বলেছিলেন, এই পাশা খেলার দরকার কী ছিল যুধিষ্ঠিরের? তিনি আমন্ত্রণ অস্বীকার করতে পারতেন। তিনি কি পাশা খেলার আহ্বান স্বীকার করার আগে বিদুর, ভীমার্জুনের পরামর্শ নিয়েছিলেন। অন্য কয়েকজন মহাভারত-আলোচকের মতোই তিনি মন্তব্য করেছেন— যুধিষ্ঠির অত্যন্ত দ্যূতব্যসনপ্রিয় ছিলেন, সহজ ভাষায় তিনি জুয়াড়ি ছিলেন।)

সবিনয়ে নিবেদন করতে চাই, এঁরা যুধিষ্ঠির চরিত্রটির সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। যুধিষ্ঠির নিজে থেকে দ্যূতক্রীড়ায় যাননি। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বিদুর মারফত তাঁকে আহ্বান করেছিলেন। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের আহ্বান কীভাবে অস্বীকার করবেন? ধৃতরাষ্ট্র তাঁর কাছে শুধুমাত্র জ্যেষ্ঠতাত নন, পিতৃহীন যুধিষ্ঠিরের পিতাই। সেই পিতৃ-আজ্ঞা লঙ্ঘন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তা হলে তিনি আর যুধিষ্ঠির থাকতেন না। সারা ভারতে তাঁর অখ্যাতি ঘটত, বদনাম হত। পিতার আমন্ত্রণ যুধিষ্ঠির অস্বীকার করতে পারতেন না। অন্য ভ্রাতাদের কিংবা বিদুরের পরামর্শ যুধিষ্ঠিরের প্রয়োজন ছিল না। যুধিষ্ঠির চিরকালই সংকল্পে অটল ছিলেন। জন্মের পর থেকে তিনি একটিও কাজ করেননি, যা ধর্মকে লঙ্ঘন করে৷ দ্রোণাচার্যকে অস্ত্র ত্যাগ করানোর জন্য যুধিষ্ঠিরের ‘ইতি কুঞ্জর’ এই অর্ধ-সত্য স্মরণ করেও একথা বলছি। ধর্ম ছিল যুধিষ্ঠিরের স্বাভাবিক বর্ম। দ্যূতক্রীড়ার জন্য দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় ক্ষুব্ধ ভীমসেন যুধিষ্ঠিরের হাত দগ্ধ করবেন বলে সহদেবকে অগ্নি আনতে বলেছিলেন। তখন অর্জুন, যিনি যুধিষ্ঠিরের “ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ”— ভীমসেনকে বলেছিলেন— “আর্য ভীমসেন, আপনি পূর্বে কখনও এরূপ বাক্য প্রয়োগ করেননি; সুতরাং নিশ্চয়ই নৃশংস শত্রুরা আপনার ধর্মগৌরবও নষ্ট করে দিচ্ছে। আপনি শত্রুদের অভিলাষ পূর্ণ করবেন না, উত্তম ধর্মাচরণই করুন; ধার্মিক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অপমান করবেন না।”

আহূতো হি পরৈ রাজা ক্ষাত্রং ধৰ্ম্মমনুস্মরণ্‌।

দীব্যতে পরকামেন তন্নঃ কীৰ্ত্তিকরং মহৎ॥ সভা: ৬৫: ৯।।

“আহূত ক্ষত্রিয় রাজা দ্য্যূতক্রীড়ায় প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না। যুধিষ্ঠির সে কর্তব্য পালন করেছেন। তা মহৎ কীর্তিস্বরূপ।”

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয়ের ধর্ম পালন করতেই দ্যূতক্রীড়ায় সম্মত হয়েছিলেন। অন্য কোনও ভ্রাতা বা বিদুরের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন তাঁর হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, যুধিষ্ঠির অত্যন্ত দ্যূতব্যসনপ্রিয় ছিলেন। কেউ কেউ সোজাসুজি বলেছেন যুধিষ্ঠির জুয়াড়ি ছিলেন। যুধিষ্ঠির কখনও জুয়াড়ি ছিলেন না। তৎকালীন অন্য ক্ষত্রিয় রাজার মতো যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে পছন্দ করতেন। কিন্তু হস্তিনাপুর থেকে পাশা খেলার আমন্ত্রণ পেয়ে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—

ন চাকামঃ শকুনিং দেবিতাহং ন চেম্মাং ধৃতরাষ্ট্র আহ্বয়িষ্যৎ।

আহূতোহহং ন নিবৰ্ত্তে কদাচিত্তদাহিতং শাশ্বতং বৈ ব্রতং মে॥ সভা: ৫৫: ১৬॥

“পাশা খেলায় আমার ইচ্ছা নেই; সুতরাং ধৃতরাষ্ট্র যদি আমাকে না ডাকেন, তবে আমি শকুনির সঙ্গে খেলব না। কারণ, আমাকে ডাকলে আমি ফিরি না, এ আমার চিরকালের জন্য অবলম্বিত ব্রত।” যুধিষ্ঠির আরও বললেন, “দ্যূতক্রীড়ায় কলহ অনিবার্য, তাই আমার তা ভাল লাগে না— কো বৈ দ্যূতং রোচয়েদ বুদ্ধিমান যঃ॥” সভা: ৫৫: ১০॥

ধৃতরাষ্ট্রর আদেশে পাশা খেলা হল। চতুর্দশ পণে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ রেখে হারলেন। দ্বিতীয়বার পাশা খেলায় পঞ্চ-পাণ্ডব দ্রৌপদীকে নিয়ে বনবাস গেলেন। বনবাস ভীমের ভাল লাগেনি। তিনি যুধিষ্ঠিরের আচরণ ক্লীবের আচরণ বললেন। তখন যুধিষ্ঠির দৃপ্ত ভাষায় ভীমকে বললেন, “আমি সত্যকে, ধর্মকে, অমৃত বা জীবন হতে বেশি মূল্য দিই। রাজা, পুত্র, যশ, ধন— এরা ধর্মের কণামাত্রেরও সমান মূল্যবান নয়।” যুধিষ্ঠিরের জীবনবেদ এমন স্পষ্টভাবে আর কোথাও ঘোষিত হয়নি।

বনবাসে ভ্রাতাদের ও ভার্যার জীবনযাপনের কষ্ট যুধিষ্ঠির দেখেছিলেন। রাজসভায় দ্রৌপদীর চূড়ান্ত অপমান ও লাঞ্ছনা তিনি প্রাণহীন মুমুর্ষের মতো দেখেছিলেন। মহাভারত চর্চাকারেরা যুধিষ্ঠিরের চূড়ান্ত সমালোচনা এই কারণে করেন। যুধিষ্ঠিরের সমর্থকেরা এমনকী দ্রৌপদী পর্যন্ত মনে করেন— শকুনি যুধিষ্ঠিরকে প্ররোচিত করে দ্রৌপদীকে পণ হিসাবে রাখতে বাধ্য করেছিলেন। বর্তমান লেখক এই মত সমর্থন করেন না। যুধিষ্ঠিরকে প্ররোচিত করা কারও পক্ষেই, কোনও অবস্থাতেই সম্ভব ছিল না। দ্রৌপদীকে পণ না রেখে যুধিষ্ঠির কি নল রাজার মতো (প্রথমবার পুষ্করের সঙ্গে পাশা খেলায়) উঠে যেতেন? তা হলে দ্রৌপদীর কী হত? ক্রীতদাস, পঞ্চস্বামীর স্ত্রী হয়েই তাঁকে সারাজীবন কাটাতে হত। তা কি দ্রৌপদীর পক্ষে মর্যাদার হত? যুধিষ্ঠির জানতেন স্বয়ংবর সভায় ব্যর্থ দুর্যোধনও কর্ণের দ্রৌপদীর প্রতি সংগুপ্ত কামনা। এ-সংবাদ জানতেন শকুনি, এ-সংবাদ জানতেন ধৃতরাষ্ট্র। এই কারণেই শকুনি পাণ্ডবদের অন্য পত্নীদের পণ রাখার কথা উচ্চারণ করেননি। রাজলক্ষ্মী এবং পট্টমহিষী দ্রৌপদীকেই পণ হিসাবে চেয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির তীক্ষবুদ্ধি মানুষ ছিলেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, দুর্যোধন ও তাঁর অনুচরেরা ছলে বলে কৌশলে ইন্দ্রপ্রস্থ গ্রহণ করবেন। তিনি অনুভব করেছিলেন, এঁরা তাঁকে শান্তিতে রাজ্যভোগ করতে দেবেন না। পণ ধরার সময়ে দ্রৌপদীর যে বর্ণনা যুধিষ্ঠির দিয়েছিলেন, তার থেকে বোঝা যায় যুধিষ্ঠির রূপরসিক মানুষ ছিলেন এবং দ্রৌপদী সম্পর্কে তাঁর প্রীতিও প্রকাশিত হয়। হয়তো ভেবেছিলেন, দ্রৌপদীর নামেই পাশার দান তাঁর অনুকূলে পড়বে, তিনি জিতে যাবেন। কিন্তু তা ঘটল না। সৃষ্টিকর্তা দ্রৌপদীর চূড়ান্ত লাঞ্ছনা ঘটাতে ক্ষেত্র প্রস্তুত করলেন। বহু সমালোচক মন্তব্য করেছেন, যুধিষ্ঠিরের জুয়াখেলার নেশায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা ঘটে। এ মন্তব্য সত্য নয়। আসলে সৃষ্টিকর্তা ব্যাসদেব দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। পৃথিবীর তিন মহাকবি আমাদের দেখিয়েছেন মদমত্ত পুরুষ যখনই সহায়সম্বলহীনা নারীর উপর অত্যাচার করেছে, তখন অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের মুখে সে পতিত হয়েছে। হেলেনকে অপহরণের কারণে ট্রয়-নগরী ধ্বংস হল, সীতাহরণের জন্য ভুবনবিখ্যাত স্বর্ণলঙ্কার বিনাশ ঘটল আর পুরুষের রাজসভায় দ্রৌপদীর অসম্মান কুরুবংশের ধ্বংস করে ফেলল। যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলা এর উপলক্ষ্য মাত্র ছিল। দ্রৌপদীর জন্মলগ্নেই দৈববাণী হয়েছিল— “এই কন্যার জন্য কুরুবংশ ধ্বংস হবে।” (সেই ধ্বংসের সূচনা হল দ্যূতক্রীড়াসভায়।)

পাশা খেলার চতুর্দশ চালে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে পণ রাখলেন—

নৈবা হ্রস্বা ন মহতী নাতিকৃষ্ণা ন রোহিণী।

নীলকুঞ্চিতকেশী চ তয়া দীব্যাম্যহং ত্বয়া॥ সভা: ৬২: ২৯॥

“যিনি খর্বা নন, দীর্ঘাও নন, কৃষ্ণবর্ণা নন এবং অত্যন্ত রক্তবর্ণাও নন, আর যাঁর কেশকলাপ কৃষ্ণবর্ণ এবং কুঞ্চিত সেই দ্রৌপদীর দ্বারাই আমি আপনার সঙ্গে খেলা করব।”

বৃদ্ধ সমস্ত সভাসদ ‘ধিক ধিক’ বলতে লাগলেন। সমস্ত সভা বিচলিত হয়ে উঠল। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ প্রভৃতির ঘাম ঝরতে লাগল, বিদুর দু’হাতে মাথা ধরে প্রাণহীনের ন্যায় হয়ে পড়লেন এবং সাপের মতো মুখ নিচু করে নিশ্বাস ত্যাগ করতে লাগলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র আনন্দিত হয়ে বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন, “কী জয় করলে? কী জয় করলে?” তিনি হৃদয়ের আনন্দ গোপন করতে পারলেন না।

কর্ণ দুঃশাসন প্রভৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে অত্যন্ত আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলেন। অন্য সভ্যগণের চোখ থেকে জল পড়তে লাগল। জয়োৎফুল্ল ও মদমত্ত শকুন গুটিগুলি খেলে “এও জিতলাম”— বলে চিৎকার করে উঠলেন।

দুর্যোধন বললেন “বিদুর এই দিকে এসো, তুমি গিয়ে পাণ্ডবদের মনোনীতা প্রিয়তমা ভার্যা দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এসো। সেই পাপশীলা এই ঘর ঝাঁট দিক। সে এক্ষুনি এখানে আসুক, পরে অন্তঃপুরে গিয়ে অন্য দাসীদের সঙ্গে থাকবে।” বিদুর বললেন, “মূর্খ! তোমার মতো লোকই অভাবনীয় বিষয়ে বলতে পারে। তুমি দৈবকর্তৃক পাশবদ্ধ হয়ে কিছু বুঝতে পারছ না। তুমি উচ্চ স্থানে ঝুলছ। অনিবার্য পতন সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা নেই। তুমি হরিণ হয়ে বাঘদের অত্যন্ত ক্রুদ্ধ করছ। হে অতিমূর্খ। তোমার মাথার উপর পূর্ণকোপ মহাবিষ সর্পগণ অবস্থান করছে; তুমি তাদের আর কুপিত কোরো না, যমালয়ে যেয়ো না। দ্রৌপদী দাসী হতে পারেন না। কারণ যুধিষ্ঠির (দ্যূতে হেরে গিয়ে) অস্বামী অবস্থায় তাঁকে পণ রেখেছিলেন। এই আমার অভিমত। হায়, বাঁশ যেমন নিজের মৃত্যুর জন্য ফল ধারণ করে, এই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রও তেমনই নিজের মৃত্যুর জন্য দ্যূতক্রীড়ায় জয়লাভ করে ধনলাভ করছে। মহাভয়জনক শত্রুতার জন্যই দ্যূতক্রীড়া হয়ে থাকে, কিন্তু মৃত্যুকালে এই মদমত্ত নির্বোধ একথা বুঝতে পারছে না। কারওর মর্মবেদনা দেবে না, কাউকে নিষ্ঠুর বাক্য বলবে না, নিকৃষ্ট উপায়ে অন্যকে বশীভূত করবে না। অমঙ্গল ও পাপজনক বাক্য বলবে না। দুর্জনের মুখ থেকে মর্যাদাহানিকর বাক্য নির্গত হয়ে থাকে, যে বাক্যবাণে আহত হয়ে অন্য লোক রাত্রিদিন দুঃখ অনুভব করে। দুর্জনেরা পরের মর্মস্থানেই পতিত হয়, এইজন্য জ্ঞানীরা কখনও দুর্জনের সংসর্গ করেন না। একটা ছাগল ভূতলে স্থাপিত একখানা ছুরি গিলে ফেলেছিল, তারপর সেই ছুরির আগায় তার গলা কেটে গিয়েছিল। অতএব দুর্যোধন, তুমি সেই ছাগলের মতো আচরণ কোরো না। বনচর, গৃহস্থ, দরিদ্র কিংবা বিদ্বান— কারও প্রতি পাণ্ডবেরা এরূপ কোনও কথা বলেন না। কুকুরতুল্য মানুষেরাই সর্বদা এই জাতীয় কথা বলে। দুর্যোধন বুঝতে পারছে না যে দ্যূতক্রীড়া নরকের দ্বার। দ্যূতক্রীড়ায় উন্নতি দেখে দুঃশাসনের সঙ্গে বহু কুরুবংশীয় দুর্যোধনের অনুসরণ করছে। যদি লাউ জলে ডুবে যায়, পাথর জলে ভাসে, নৌকা সর্বদাই জলমগ্ন থাকে— তবু ধৃতরাষ্ট্রের এই পুত্র আমার উপদেশ শুনবে না।”

তখন ‘বিদুরকে ধিক’ এই কথা বলে মদমত্ত দুর্যোধন প্রতিকামীকে ডেকে বললেন, “প্রতিকামী তুমি দ্রৌপদীকে নিয়ে এসো। পাণ্ডবদের থেকে তোমার কোনও ভয় নেই। এই বিদুর সর্বদা পাণ্ডবদের ভয় পায় এবং আমাদের অবনতি কামনা করে।”

দুর্যোধনের আদেশ অনুসারে প্রতিকামী অন্তঃপুরে প্রবেশ করে দ্রৌপদীর কাছে গেল। প্রতিকামী দ্রৌপদীকে বলল, “দ্রুপদনন্দিনী, রাজা যুধিষ্ঠির দ্যূতক্রীড়ায় মত্ত হয়ে আপনাকে দ্যূতে পণ রেখেছিলেন। দুর্যোধন আপনাকে জয় করেছেন। অতএব আপনি রাজসভায় চলুন।”

দ্রৌপদী বললেন, “প্রতিকামী তুমি কেন একথা বলছ। কোন রাজপুত্র আপন ভার্যাকে নিয়ে দ্যূতক্রীড়া করেন? রাজা দ্যূতমদে মত্ত হয়ে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছেন; তাঁর কি পণ ধরবার যোগ্য কোনও বস্তুই ছিল না?”

প্রতিকামী বলল, “রাজনন্দিনী যখন তাঁর পণ ধরার যোগ্য কোনও বস্তুই অবশিষ্ট ছিল না, তখনও তিনি খেলছিলেন। প্রথমে ভ্রাতৃগণকে, পরে নিজেকে এবং তারপরে আপনাকে পণ রেখেছিলেন।”

দ্রৌপদী বললেন, “সুতপুত্র তুমি সভায় গিয়ে সেই দ্যূতকারকে জিজ্ঞাসা করো যে, আপনি কি নিজেকে হারিয়েছেন প্রথমে, না দ্রৌপদীকে হারিয়েছেন। তুমি একথা জেনে এসো, তারপর আমাকে সভায় নিয়ে যেয়ো।”

প্রতিকামী রাজসভায় গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদীর প্রশ্ন জানাল। তখন যুধিষ্ঠির অচৈতন্য এবং প্রাণহীনের মতো হয়েছিলেন। ভাল বা মন্দ কোনও কথাই প্রতিকামীকে বললেন না। তখন দুর্যোধন প্রতিকামীকে বললেন, “দ্রৌপদী এইখানে এসে প্রশ্ন করুক। তার ও যুধিষ্ঠিরের সমস্ত কথা এই সভা শুনবেন।”

দুর্যোধনের বশবর্তী প্রতিকামী দুঃখিত হয়ে পুনরায় অন্তঃপুরে গিয়ে দ্রৌপদীকে বলল, “রাজনন্দিনী সভ্যগণ আপনাকে আহ্বান করছেন। আমি মনে করি— কৌরবদের বিনাশের সময় উপস্থিত হয়েছে। কারণ, ক্ষুদ্র লোক প্রধান লোকের সম্মান রাখছে না। যেহেতু কৌরবেরা আপনাকে সভায় নিয়ে যাবে।”

দ্রৌপদী বললেন, “নিশ্চয়ই বিধাতা এই বিধান করেছেন যে, পণ্ডিত ও মূর্খ দুই শ্রেণির লোকই ধর্ম ও অধর্মকে স্পর্শ করে থাকে; জ্ঞানী ব্যক্তিরা ধর্মকে প্রধান রূপে অবলম্বন করেন। আমরা সেই ধর্ম রক্ষা করতে পারলে, বিধাতা আমাদের মঙ্গল করবেন।

“সেই ধর্ম যেন কৌরবদের পরিত্যাগ না করেন। তুমি গিয়ে সভ্যগণকে আমার এই ধর্মসঙ্গত বাক্য জিজ্ঞাসা করো। সেই ধর্মাত্মা, নীতিজ্ঞ ও শ্রেষ্ঠ সভ্যগণ আমাকে যা বলবেন, আমি নিশ্চয়ই তা করব।”

প্রতিকামী দ্রৌপদীর কথা শুনে সভায় গিয়ে তা বলল। কিন্তু সভ্যেরা বিষয়টিতে দুর্যোধনের যথেষ্ট আগ্রহ বুঝে কোনও উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে রইলেন। তখন যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের মনোগত অভিপ্রায় বুঝে একটি বিশ্বস্ত দূতকে এই বলে দ্রৌপদীর কাছে পাঠিয়ে দিলেন, “দ্রুপদনন্দিনী তুমি রজস্বলা; একখানি মাত্র বস্ত্ৰই তোমার পরিধানে আছে; সেই অবস্থাতেই তুমি রোদন করতে করতে সভায় এসে শ্বশুরের সম্মুখে দাঁড়াও।” দূত দ্রৌপদীকে গিয়ে যুধিষ্ঠিরের বার্তা জানাল। সত্যবদ্ধ পাণ্ডবেরা বিষন্ন দুঃখিত হয়ে মাথা নিচু করে কোনও দিকে না তাকিয়ে বসে রইলেন। দুর্যোধন পাণ্ডবদের সেই দুরবস্থা দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে সূতকে বললেন, “প্রতিকামী দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এসো। তাঁর উপস্থিতিতেই পাণ্ডবগণ বলুন যে, আমি তাঁকে জিতেছি কি না।”

প্রতিকামী দুর্যোধনের বশবর্তী ছিল কিন্তু দ্রৌপদীর ক্রোধের ভয়ও করছিল। সে আত্মসম্মান পরিত্যাগ করে সভ্যগণের কাছে আবার জিজ্ঞাসা করল, “আমি দ্রৌপদীকে কী বলব?”

দুর্যোধন বললেন, “দুঃশাসন এই দুর্বলচিত্ত প্রতিকামী ভীমকে ভয় পাচ্ছে। তুমি নিজে গিয়ে দ্রৌপদীকে ধরে নিয়ে এসো। পরাধীন শত্রুরা তোমার কী করবে?”

ভ্রাতার আদেশ শুনে দুঃশাসন পাণ্ডবদের ঘরে গিয়ে দ্রৌপদীকে বলল, “পাঞ্চালনন্দিনী এসো এসো। কৃষ্ণে তুমি দ্যূতক্রীড়ায় বিজিত হয়েছ। অতএব লজ্জা পরিত্যাগ করো এবং দুর্যোধনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করো। হে সুদীর্ঘপদ্মনয়নে! তুমি কৌরবদের ভজনা করো। তুমি ধর্ম অনুসারেই লব্ধ হয়েছ; অতএব সভায় চলে এসো।”

তখন অত্যন্ত দুঃখিতা দ্রৌপদী উঠে, মলিন হাত দিয়ে মুখ মুছে, আকুল হয়ে যেখানে গান্ধারী ছাড়া ধৃতরাষ্ট্রের অন্য ভার্যারা অবস্থান করছিলেন— দৌড়ে সেখানে গেলেন। তখন দুঃশাসনও অত্যন্ত ভর্ৎসনা করতে করতে দ্রৌপদীর কাছে উপস্থিত হয়ে, তাঁর দীর্ঘ, নীল ও কুঞ্চিত কেশকলাপ ধারণ করলেন। যে কেশকলাপ রাজসূয় মহাযজ্ঞে মন্ত্রপূত জল দ্বারা সিক্ত হয়েছিল, দুঃশাসন পাণ্ডবদের বলকে অবজ্ঞা করে বলপূর্বক সেই কেশকলাপ ধারণ করলেন। দ্রৌপদীর স্বামীরা সেখানে বিদ্যমান ছিলেন, তবুও স্বামীহীনার মতো দুঃশাসন তাঁকে টানতে টানতে সভায় নিয়ে গেল।

দুঃশাসনের আকর্ষণে দ্রৌপদীর দেহটি অবনত হয়ে পড়েছিল। সেই অবস্থায় তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “মন্দবুদ্ধি! আমি রজস্বলা; সুতরাং আমার পরিধানে একখানি মাত্র বস্ত্র, অতএব দুর্জন! এই অবস্থায় আমাকে তুমি সভার মধ্যে নিয়ে যেতে পার না।” তখন দুঃশাসন বলপূর্বক কেশকর্ষণ করেই দ্রৌপদীকে বলল, “দ্রৌপদী তুমি রজস্বলাই হও, কিংবা একবস্ত্রাই হও, অথবা বিবস্ত্রাই হও, তোমাকে জয় করেই দাসী করেছি; সুতরাং এখন যথাসুখে আমাদের ভজনা করো।” দ্রৌপদীও রক্ষা পাবার জন্য মনে মনে নররূপী কৃষ্ণকে স্মরণ করলেন, “কৃষ্ণঞ্চ বিষ্ণুঞ্চ হরিং নরঞ্চ ত্রাণায় বিক্ৰোশতি যাজ্ঞসেনী।”

দ্রৌপদী তখন আলুলায়িতা কেশ ছিলেন, কারণ দুর্যোধন তাঁর কেশ ধরে টানছিল। পরিধানের বস্ত্র অর্ধ পতিত হয়েছিল; তাতে তিনি লজ্জিত এবং ক্রোধে দগ্ধ হচ্ছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি ধীরে ধীরে বললেন, “শাস্ত্রজ্ঞ, সৎক্রিয়াসম্পন্ন এবং ইন্দ্রতুল্য ব্যক্তিরা সভায় আছেন। গুরুস্থানীয় এবং গুরুজনেরাও সভায় উপস্থিত আছেন। তাঁদের সামনে আমি এভাবে যেতে পারি না।

‘নৃশংস! দুর্জন! দুঃশাসন! তুই আমাকে বিবস্ত্রা করিস না, কিংবা আর সভার দিকে আকর্ষণ করিস না। কারণ ইন্দ্রের সঙ্গে, দেবগণ তোর সহায় হলেও ওই রাজপুত্রেরা তোকে ক্ষমা করবেন না। মহাত্মা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির ধর্মের দিকেই চেয়ে আছেন, সে ধর্মও অত্যন্ত সূক্ষ্ম। সুগভীর জ্ঞানী ব্যক্তি ছাড়া সেই ধর্মকে বোঝা যায় না। আমি সেই ধার্মিক স্বামীর গুণ পরিত্যাগ করে অণুমাত্র দোষও বাক্যদ্বারা প্রকাশ করতে পারি না।

“দুঃশাসন আমি রজস্বলা; তবুও তুই যে আমাকে কুরুবংশীয় বীরগণের মধ্যে আকর্ষণ করে নিয়ে যাচ্ছিস, তা গুরুতর অন্যায় হচ্ছে। হায়! এই সভায় কোনও ব্যক্তি এর নিন্দা পর্যন্ত করছে না। নিশ্চয়ই সকলেই দুঃশাসনের কার্যের অনুমোদন করছেন। ধিক ভরতবংশের ধর্ম লোপ পেয়েছে। ক্ষত্রিয় ধর্মজ্ঞদের চরিত্রও নষ্ট হয়ে গেছে। কারণ তাঁরা সকলেই কৌরবধর্মের মর্যাদা লঙ্ঘন অবাধে প্রত্যক্ষ করছেন। মনে হচ্ছে, ভীষ্ম, দ্রোণ, মহামতি বিদুর এবং ধৃতরাষ্ট্র যেন প্রাণহীন হয়ে গেছেন। এই কৌরবশ্রেষ্ঠগণ এই ভয়ংকর অধর্মের কার্য যেন লক্ষই করছেন না।”

দ্রৌপদী করুণ স্বরে ওই কথা বলতে বলতে বক্রনয়নে পতিগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করলেন, সেই বক্রদৃষ্টি পাণ্ডবদের আরও ক্রুদ্ধ করে তুলল। তাঁরা অত্যন্ত দুঃখিত হলেন। রাজ্য, ধন এবং উৎকৃষ্ট রত্ন সকল হারিয়েও তাঁরা সেরূপ দুঃখ লাভ করেননি। দ্রৌপদী কাতরভাবে পরাজিত পতিদের প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন দেখে দুঃশাসন অচেতনপ্রায় দ্রৌপদীকে বেগে ধাক্কা দিয়ে অট্টহাস্য করে বলল, “দাসী।” দুঃশাসনের সেই কথায় কর্ণ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে অট্টহাস্য করে দুঃশাসনের প্রশংসা করলেন এবং শকুনিও দুঃশাসনের কার্য অনুমোদন করলেন। দুর্যোধন, কর্ণ ও শকুনি ছাড়া সভায় উপস্থিত অন্য সভ্যেরা অত্যন্ত দুঃখিত হলেন।

তখন ভীষ্ম বললেন “ভাগ্যবতী, যাঁর যে বস্তুতে অধিকার থাকে না, তিনি সে বস্তু পণ রাখতে পারেন না। আবার স্ত্রীলোকের উপর পতির স্বত্ব থাকে। এই দুই দিক পর্যালোচনা করে ন্যায়ের অতি সূক্ষ্মতার জন্য আমি তোমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে পারছি না। আবার—

ত্যাজেত্তু সর্বাং পৃথিবীং সমৃদ্ধাং যুধিষ্ঠিরঃ সত্যমথো ন জহ্যাৎ।

উক্তং জিতোহস্মীতি চ পাণ্ডবেন তস্মান্ন শক্লোমি বিবেক্তুমেতৎ॥ সভা: ৬৪: ৪৭॥

যুধিষ্ঠির সমৃদ্ধসম্পন্ন সমস্ত রাজ্যও পরিত্যাগ করতে পারেন; কিন্তু সত্য পরিত্যাগ করতে পারেন না; সেই যুধিষ্ঠির জানিয়েছেন যে, আমি পরাজিত হয়েছি। সুতরাং আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না।”

দ্যূতক্রীড়ায় অদ্বিতীয় শকুনি যুধিষ্ঠিরের দ্যূতক্রীড়ার ইচ্ছা জন্মিয়ে দিয়েছেন। তারপর যুধিষ্ঠির এই দ্যূতক্রীড়াকে শঠতাপূর্বক ক্রীড়া বলে মনে করছেন না। তাই ভীষ্মের পক্ষে দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হল না।

দ্রৌপদী বললেন, “দ্যূতনিপুণ, দ্যূতপ্রিয়, দুষ্টচিত্ত, অসভ্য ও শঠতাপরায়ণ লোকেরা রাজাকে সভায় আহ্বান করেছিল। তখন রাজার দ্যূতক্রীড়ার বিশেষ ইচ্ছা ছিল না। সুতরাং কী করে তার দ্যূতক্রীড়ায় ইচ্ছা জন্মাবে? নির্মল স্বভাব রাজা প্রথমে বিপক্ষের শঠতা বুঝতে পারেননি। তারপর সকলে মিলে তাঁকে জয় করেছে। পরে তিনি শঠতা বুঝেছেন। সে যাই হোক, পুত্র ও পুত্রবধুগণের নিয়ন্তা কুরুবংশীয়গণ এখানে উপস্থিত আছেন— তাঁরা সকলে আমার কথা পর্যালোচনা করে বলুন, আমি জিত হয়েছি কি না।”

অসহায় দ্রৌপদী বার বার স্বামীগণের প্রতি দৃষ্টিপাত করছেন দেখে দুঃশাসন তাঁকে নিষ্ঠুর, কটু, অপ্রিয় বাক্যসকল বলতে লাগল। দ্রৌপদী রজস্বলা ছিলেন। তাঁর গায়ের চাদর পড়ে গিয়েছিল। তিনি সে অবস্থার যোগ্য ছিলেন না, তবুও তাঁকে সেই অবস্থায় দেখে যুধিষ্ঠিরের দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে ক্রোধ প্রকাশ করলেন।

ভীম বললেন, “মহারাজা! যুধিষ্ঠির! দেশে দ্যূতকারদের বেশ্যা থাকে। তারাও বেশ্যা দ্বারা দ্যূতক্রীড়া করে না। কারণ বেশ্যাদের উপরেও তাদের দয়া থাকে। আমাদের সকল ধন, রত্ন, বাহন, কবচ ও বস্ত্র, সেই সকল বস্তু, রাজ্য, আত্মা, আমরা— সকলই শত্রুরা ছল করে হরণ করেছে। তাতেও আমার ক্রোধ হয়নি। কারণ, আপনি এ সকল বস্তুরই স্বামী। কিন্তু পাণ্ডবদের লাভ করার পর দ্রৌপদী এরূপ কষ্ট পাবার যোগ্য নন। দ্রৌপদীকে নিয়ে পাশা খেলা আপনার অন্যায় হয়েছে। আপনার জন্যই ক্ষুদ্রস্বভাব, নৃশংসপ্রকৃতি, অশিক্ষিত কৌরবগণ দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা করেছে। এই লাঞ্ছনার মূল কারণ আপনিই, সুতরাং আপনার দুই হাত আমি দগ্ধ করব। সহদেব! অগ্নি আনয়ন করো।”

অর্জুন বললেন, “আর্য ভীমসেন, আপনি তো পূর্বে কোনওদিন এই ধরনের বাক্য ব্যবহার করেননি। নৃশংস শত্রুরা আপনার ধর্মগৌরবও নষ্ট করে দিয়েছে। শত্রুদের অভিলাষ পূর্ণ করবেন না। উত্তম ধর্মাচরণ করুন; ধার্মিক জ্যেষ্ঠভ্রাতার অপমান করবেন না—

আহতো হি পরৈ রাজা ক্ষাত্ৰং ধর্মমনুস্মরণ।

দীব্যতে পরকামেন তন্নঃ কীৰ্ত্তিকরং মহৎ।। সভা: ৬৫: ৯॥

অন্য লোক আহ্বান করলে, রাজা যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয়ধর্ম স্মরণ করে নিষ্কামভাবে খেলা করে থাকেন; তা আমাদের মহাকীৰ্তিজনক।”

ভীম বললেন, “অর্জুন তোমার বাক্যে আমি যদি শাস্ত্রীয় নিয়ম স্মরণ না করতাম, তবে নিশ্চয়ই আমি বলপূর্বক প্রজ্বলিত অগ্নিতে রাজার বাহুযুগল দগ্ধ করে ফেলতাম।”

পাণ্ডবেরা নিরুপায় অবস্থায় ছিলেন, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা দেখে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র বিকর্ণ বলল, “রাজাগণ, দ্রৌপদী যা বললেন, আপনারা তার স্পষ্ট উত্তর দিন। সেই প্রশ্নের উত্তর না দিলে সদ্যই আমরা নরকে পতিত হব। ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র ও মহামতি বিদুর কিছু বলছেন না। আমি বুঝতে পারছি না আচার্য দ্রোণ ও কৃপ— এই দুই ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠই বা নীরব কেন? অন্য যে সকল রাজা সকল দিক থেকে এসেছেন, তাঁরা ক্রোধ ও কাম পরিত্যাগ করে আপন আপন বক্তব্য বলুন।” বিকর্ণ বার বার এই কথা বললেও সভ্যেরা ভাল বা মন্দ কিছুই বললেন না।

তখন বিকর্ণ হাতের উপর হাত নিষ্পেষণ করে, নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে এই কথা বলল, “হে রাজগণ, হে কৌরবগণ, আপনারা দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিন বা না দিন, আমি এ-বিষয়ে আমার বক্তব্য বলব।

“মৃগয়া, মদ্যপান, অক্ষক্রীড়া এবং স্ত্রীসংসর্গে অত্যন্ত আসক্তি— এই চারটিকে মুনিরা রাজাদের ব্যসন বলে থাকেন। ব্যসনাসক্ত মানুষ ধর্ম লঙ্ঘনকারী হয় এবং তার সকল কার্যই অকার্যে পরিণত হয়।

“যুধিষ্ঠির ধূর্তগণ কর্তৃক আহূত হয়ে দ্যূতক্রীড়ায় অত্যন্ত আসক্ত অবস্থায় দ্রৌপদীকে পণ ধরেছিলেন। তারপর, অনিন্দিতা দ্রৌপদীর উপরে সকল পাণ্ডবেরই সমান স্বত্ব আছে। আর যুধিষ্ঠির প্রথমে নিজে পরাজিত হয়ে, পরে দ্রৌপদীকে পণ ধরেছিলেন। এবং শকুনি দ্রৌপদীকে পণ ধরাবার জন্য যুধিষ্ঠিরকে প্ররোচিত করেছিলেন। এই সমস্ত কিছু বিবেচনা করে আমি মনে করি যে, দ্রৌপদী দুর্যোধন কর্তৃক বিজিত হননি।”

বিকর্ণের কথা শুনে সভ্যগণের মধ্যে বহু লোক বিকর্ণের প্রশংসা ও শকুনির নিন্দা করতে লাগলেন। তখন রাধানন্দন কর্ণ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আপনার বিশাল বাহু মর্দন করতে করতে বলতে লাগলেন, “বিকর্ণের মধ্যে বহুতর বিকার দেখা যাচ্ছে। অরুণি কাঠ যেমন বিনাশের জন্য সৃষ্টি হয়, তেমনই বিকর্ণজাত বিকারগুলি তার বিনাশের জন্য সৃষ্টি হয়েছে। দ্রৌপদী নিজের প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য সভাসদদের বার বার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু কোনও সভ্যই কথা বলছেন না। কারণ সকলেই দ্রৌপদীকে ধর্ম অনুসারে বিজিতা বলে মনে করছেন। আর বিকর্ণ, তুমি বালক, সভায় বৃদ্ধদের মধ্যে কথা বলছ। তুমি যথাযথভাবে ধর্ম মান না। তুমি নির্বোধ, তাই তুমি দ্রৌপদীকে অজিত বলে বোধ করছ। অথচ যুধিষ্ঠির সভার মধ্যেই তাঁর সর্বস্ব পণ রেখেছিলেন। দ্রৌপদী সেই সর্বস্বের অন্তর্গত। সুতরাং দ্রৌপদী ধর্ম অনুসারেই বিজিতা হয়েছেন। সুতরাং, তোমার বক্তব্য সঙ্গত নয়। যুধিষ্ঠির স্পষ্ট বাক্যে দ্রৌপদীকে পণ ধরেছিলেন, অন্যান্য পাণ্ডবেরাও তা অনুমোদন করেছিলেন। অথবা কোন বাক্যে তুমি বলতে পারো যে দ্রৌপদী অবিজিত হবেন? তুমি যদি মনে কর, একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে সভার মধ্যে আনা সঙ্গত হয়নি। তা হলে আমার উৎকৃষ্ট বাক্য শোনো। স্ত্রীলোকের একটি স্বামীই বেদ অনুমোদিত। দ্রৌপদী অনেক স্বামীর অধীন। সুতরাং তাঁকে ‘বেশ্যা’ বলে নিশ্চয় করা যায়। আর বেশ্যা একবস্ত্রাই হোক কিংবা বিবস্ত্রাই হোক, তাকে সভায় আনা কোনও অন্যায় ব্যাপার নয়। পাণ্ডবদের সমস্ত কিছুই শকুনি ধর্মানুসারে জয় করেছেন। দুঃশাসন এই পণ্ডিতাভিমানী বিকর্ণ নিতান্ত বালক; অতএব তুমি পাণ্ডবগণের ও দ্রৌপদীর বস্ত্রগুলি হরণ করো!”

পাণ্ডবেরা কর্ণের কথা শুনেই সকলে আপন আপন বস্ত্র পরিত্যাগ করে সভায় উপবেশন করলেন। তারপর দুঃশাসন বলপূর্বক দ্রৌপদীর বস্ত্র ধারণ করে সভার মধ্যেই তা টেনে খুলে নেবার জন্য আকর্ষণ করল।

কৃষ্ণঞ্চ বিষ্ণুঞ্চ হরিং নরঞ্চ ত্রাণায় বিক্রোশতি যাজ্ঞসেনী।

ততস্তু ধর্মোহন্তরিতো মহাত্মা সমাবৃণোদ্বিবিধৈৰ্বস্ত্রপূগৈঃ॥ সভা: ৬৫: ৪১।।

তখন দ্রৌপদী লজ্জানিবারণের জন্য সর্বদুঃখহর্তা নরমূর্তিধারী কৃষ্ণনামক বিষ্ণুকে মনে মনে ডাকতে লাগলেন। তখন (যুধিষ্ঠিরের পিতা) মহাত্মা ধর্ম এসে বস্ত্ররূপ ধারণ করে নানাবিধ বস্ত্ৰসমূহ দ্বারা (পুত্রবধূ) দ্রৌপদীকে আবৃত করলেন। দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র আকর্ষণ করতে থাকলে, সেইরূপ অন্য অনেক বস্ত্র আবির্ভূত হতে থাকল। ধর্ম লজ্জা রক্ষা করতে থাকায় নানা রঙের শত শত বস্ত্র প্রাদুর্ভূত হতে লাগল। রাজারা সেই আশ্চর্য ঘটনা দেখে দ্রৌপদীর প্রশংসা ও দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন।

তখন ভীমসেন হাতে হাত ঘষতে ঘষতে উপস্থিত রাজাগণের মধ্যে বিশাল শব্দে শপথ উচ্চারণ করলেন, “হে জগদ্বাসী ক্ষত্রিয়গণ! আপনারা আমার বাক্য শ্রবণ করুন। যে বাক্য পূর্বে অন্য কোনও লোক বলেনি বা ভবিষ্যতে বলবে না। আমি যদি বলপূর্বক এই পাপাত্মা, দুর্বুদ্ধি ও ভরতকুলকলঙ্ক দুঃশাসনের বক্ষ বিদীর্ণ করে রক্ত পান না করি এবং রাজগণ! এই প্রতিজ্ঞা করে তা যদি সম্পন্ন না করি, তবে যেন আমি পিতৃপুরুষগণের গতি লাভ না করি।

সভায় উপস্থিত রাজারা ভীমসেনের প্রশংসা ও দুঃশাসনের নিন্দা করতে লাগলেন। ওদিকে দ্রৌপদীর বস্ত্ৰসমূহ সভার মধ্যে রাশীকৃত হল, তখন দুঃশাসন পরিশ্রান্ত ও লজ্জিত হয়ে উপবেশন করল। তখন সর্বধর্মজ্ঞ বিদুর বাহুযুগল উত্তোলনপূর্বক সভ্যগণকে কোলাহল করতে নিষেধ করে বললেন, “সভ্যগণ, দ্রৌপদী এই প্রশ্ন করে অনাথার ন্যায় অনবরত রোদন করছেন। অথচ, আপনারা তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না। এতে ধর্মের হানি হচ্ছে। সাধুলোক দুঃখসন্তপ্ত বিচারার্থীর প্রশ্নের সত্যধর্ম অনুসারে উত্তর দিয়ে তাঁকে শান্ত করেন।”

রাজাগণ, বিকর্ণ আপন বুদ্ধি অনুসারে উত্তর দিয়েছেন। আপনারাও আপন-আপন বুদ্ধি-অনুসারে প্রশ্নের উত্তর দান করুন। যে ধর্মজ্ঞ সভ্য প্রশ্নের উত্তর না করেন, তিনি মিথ্যা ব্যবহার অর্ধফল লাভ করেন। আর ধর্মজ্ঞ যে সভ্য মিথ্যা বলেন, তিনি মিথ্যাচারের, সমগ্র ফল লাভ করেন।” রাজারা বিদুরের কথা শুনে কিছু বললেন না। এই সময়ে কর্ণ দুঃশাসনকে বললেন, “দাসী দ্রৌপদীকে ঘরে নিয়ে যাও।”

তখন লজ্জিতা ও দীনা দ্রৌপদী সভার প্রান্তে থেকে কাঁপছিলেন এবং পাণ্ডবদের লক্ষ করে বিলাপ করছিলেন। তখন দুঃশাসন তাঁকে টেনে নিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। দ্রৌপদী বললেন, “স্বয়ংবর সভায় রাজারা আমাকে দেখেছিলেন, অন্যত্র দেখেননি। সেই আমি আজ সভায় এসেছি। পূর্বে বায়ু এবং সূর্য পর্যন্ত আমাকে দেখতে পেতেন না, আজ কুরুবংশীয়েরা উন্মুক্ত সভায় আমাকে দেখছেন। পূর্বে বাতাস আমাকে স্পর্শ করলে পাণ্ডবেরা সহ্য করতেন না, আজ দুরাত্মা দুঃশাসন আমাকে স্পর্শ করছেন, তবুও পাণ্ডবেরা সহ্য করছেন। এই সভায় আমি কারও পুত্রবধূস্থানীয়া, কারও বা কন্যাস্থানীয়া এবং আমি কষ্ট পাওয়ার যোগ্য নই। তথাপি দুঃশাসন আমাকে কষ্ট দিচ্ছে এবং কুরুবংশীয়েরা তা সহ্য করছেন। সুতরাং আমি মনে করি—কালের পরিবর্তন ঘটছে। সবথেকে দৈন্যের বিষয় হল— আমি শুভলক্ষণা স্ত্রী হয়েও সভার মধ্যে আসতে বাধ্য হয়েছি। রাজাদের ধর্ম কোথায় গেল? পূর্ববর্তী রাজারা কোনও ধর্মনিষ্ঠ নারীকে সভার মধ্যে আনতেন না। সনাতন পূর্বধর্ম কুরুবংশে নষ্ট হয়ে গেল। আমি পাণ্ডবগণের ভার্যা, দ্রুপদরাজের কন্যা, কৃষ্ণের সখী হয়ে কী করে রাজসভায় আসতে পারি? আমি ধর্মরাজের সবর্ণা ভার্যা, সেই আমাকে আপনারা দাসী বা অদাসী যা বলবেন, আমি তদনুসারে কাজ করব। কুরুবংশের যশোনাশক এই ক্ষুদ্র দুঃশাসন আমাকে অত্যন্ত কষ্ট দিচ্ছে। আমি এ কষ্ট দীর্ঘকাল সহ্য করতে পারব না।”

ভীষ্ম বললেন, “আমি পূর্বেই বলেছি, জগতে বিজ্ঞ মহাত্মারাও ধর্মের সূক্ষ্মগতি বুঝতে পারেন না। জগতে প্রবল লোক যাকে ধর্ম বলে, ধর্মবিচারের সময় সেটাই ধর্ম হয়। দুর্বল লোক যা বলে, তা ধর্ম হিসাবে গ্রাহ্য হয় না। সূক্ষ্ম, অত্যন্ত দুর্বোধ্য এবং এই কার্যের গুরুত্ববশত আমি বিবেচনাপূর্বক নিশ্চয় করে তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। তবে অচিরকালের মধ্যেই এ বংশের ধ্বংস হবে। কুরুবংশীয়েরা লোভপরায়ণ ও মোহপরায়ণ হয়ে পড়েছে। তুমি যাদের কুলবধূ, তাঁদের কুলোৎপন্ন ব্যক্তিরা অত্যন্ত ব্যসনাসক্ত হয়েও তোমার গুণেই ধর্মপথ থেকে ভ্রষ্ট হচ্ছেন না। পাঞ্চালী তোমার আচরণ অত্যন্ত সঙ্গত। তুমি বিপদে পড়েও ধর্মের অনুসরণ করছ। আমার ধারণা এই যে, তোমার এই প্রশ্নে যুধিষ্ঠিরের কথাই গ্রাহ্য। সুতরাং, তিনি নিজেই বলুন যে, তুমি জিতা, না অজিতা।”

দুর্যোধন বললেন, “দ্রৌপদী তোমার এই প্রশ্ন ভীমার্জুন নকুল সহদেবের উপরেই থাক। এঁরাই তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবেন। এঁরা বলুন যে যুধিষ্ঠির তোমার স্বামী নন এবং তিনি মিথ্যাবাদী। তা হলে তুমি দাস্যভাব থেকে মুক্তি পাবে। অথবা ধার্মিক, মহাত্মা, ইন্দ্রতুল্য যুধিষ্ঠির বলুন যে তিনি তোমার প্রভু না অপ্রভু। এর যে-কোনও একটি পথে তুমি মুক্তি পাবে।”

সমস্ত সভা যুধিষ্ঠিরের উত্তরের জন্য উদগ্রীব ছিল। তখন ভীমসেন চন্দনলিপ্ত গোলাকার বিশাল বাহু উত্তোলন করে বললেন, “আমাদের গুরু ও মহামনা এই ধর্মরাজ যদি আমাদের সকলের প্রভু না হতেন, তা হলে আমরা কখনই ক্ষমা করতাম না। আমাদের পুণ্য, তপস্যা, এমনকী প্রাণ পর্যন্তের অধীশ্বর যদি আপনাকে পরাজিত মনে করেন, তবে আমরাও পরাজিত হয়েছি। নইলে দ্রৌপদীর কেশ আকর্ষণ করে জীবিত প্রাণী আমার হাত থেকে মুক্তি পেত না। বিশাল হস্তীশুণ্ডের মতো আমার এই হাত দেখুন। এই হাতের নাগালে এসে ইন্দ্রও মুক্তি পেতে পারেন না। কিন্তু আমি ধর্মপাশে বদ্ধ, যুধিষ্ঠিরের গৌরবে নিরুদ্ধ এবং অর্জুনের নিবারণে নিবর্তিত, তাই এই কষ্ট ভোগ করছি। এখন ধর্মরাজ যদি আমাকে বিদায় দেন, তবে আমি—সিংহ যেমন ক্ষুদ্র মৃগসমূহকে বধ করে, তেমনই চপেটাঘাত দ্বারাই এই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের মেরে ফেলতাম।” ভীষ্ম, দ্রোণ ও বিদুর এই আস্ফালন সমর্থন করলেন।

কর্ণ বললেন, “দ্রৌপদী, ক্রীতা, পুত্র এবং ভার্যা, এই জনেরা, আপন ধনেও স্বত্বহীন হয়ে থাকেন। আপন ভার্যার উপরে ক্রীতদাসের স্বত্ব থাকে না। অতএব রাজনন্দিনী, তুমি অন্তঃপুরে প্রবেশ করে স্বামীসেবা করো। এখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরাই তোমার প্রভু। পতিদের সঙ্গে কাম ব্যবহার করা নিন্দনীয় নয়। সর্বদা একথা স্মরণ রেখো। এখন পাণ্ডবেরা আর তোমার স্বামী নয়। যুধিষ্ঠিরের আর জন্মগ্রহণের কোনও সার্থকতা নেই। কারণ তিনি দ্রৌপদীকে পণ ধরেছিলেন।”

তখন ভীমসেন বললেন “রাজা, আমি কর্ণের উপরে ক্রুদ্ধ হইনি। কারণ, কর্ণ দাসধর্ম সত্য বলেছে। আপনি যদি দ্রৌপদীকে নিয়ে না খেলতেন, শত্রুরা এ কথা বলতে পারত না।” যুধিষ্ঠির নীরবেই রইলেন। তখন দুর্যোধন ভীমকে শুনিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “রাজা, ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব—সকলেই আপনার আদেশের অধীন। আপনি দ্রৌপদীর প্রশ্নের উত্তর দিন এবং দ্ৰৌপদীকে অজিতা বলে মনে করলেও তা বলুন।”

দুর্যোধন এই কথা বলে বাম উরুদেশ থেকে বস্ত্র সরিয়ে, হাসতে হাসতে দ্রৌপদীর দিকে তাকালেন। কদলীস্তম্ভ ও হস্তীশুণ্ডের তুল্য গোল, বজ্রের মতো দৃঢ় এবং সর্বলক্ষণ প্রশস্ত আপন বাম উরু দ্রৌপদীকে দেখালেন। ভীমসেন তা দেখে আরক্তনয়ন যুগল বিস্ফারিত করে সভ্যগণকে শুনিয়ে দুর্যোধনকে বললেন, “দুর্যোধন! আমি যদি মহাযুদ্ধে তোমার এই উরু ভঙ্গ না করি, তবে যেন আমি পিতৃপুরুষদের সঙ্গে একলোকে বাস না করি।” ভীমসেনের সমস্ত রোমকূপ থেকে আগুন ঠিকরে বেরোচ্ছিল।

তখন বিদুর বললেন, “ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ! তোমাদের বোঝা দরকার ভয়ংকর ভয় উপস্থিত হয়েছে, এবং তা ভীমসেন থেকেই উপস্থিত হয়েছে। তোমার দ্যুতের নিয়ম লঙঘন করে স্ত্রীলোককে সভায় এনে বিবাদ করেছ। এতে তোমাদের সব মঙ্গল নষ্ট হয়ে গিয়েছে। যুধিষ্ঠির যদি আগে দ্রৌপদীকে পণ ধরতেন, তখন তিনি এঁর প্রভু থাকতেন। সুতরাং দ্রৌপদীকে জয় করাটা তোমাদের স্বপ্নে ধন জয় করার মতো হয়েছে। যুধিষ্ঠির আপন পরাজয়বশত অস্বামী হয়েই দ্রৌপদীকে পণ ধরেছিলেন।”

অর্জুন বললেন, “রাজা যুধিষ্ঠির আগে আমাদের প্রভু ছিলেন। কিন্তু নিজেকে হারিয়ে উনি কোন বস্তুর প্রভু থাকতে পারেন?”

তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্রের হোমগৃহে উচ্চ স্বরে শৃগাল ডাকতে লাগল এবং সেই শব্দ লক্ষ্য করে গর্দভ ও ভয়ংকর পক্ষীসকল চারদিকে ডাকতে লাগল। বিদুর, গান্ধারী, ভীষ্ম, দ্রোণ কৃপ সেই শব্দ শুনতে পেলেন এবং উচ্চ স্বরে ‘স্বস্তি স্বস্তি’ বলে উঠলেন। বিদুর ও গান্ধারী সেই, দুর্লক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন। তখন ধৃতরাষ্ট্র দুর্বুদ্ধি দুর্যোধনকে বললেন, “মন্দবুদ্ধি! তুই তো মরেছিস! তুই কৌরব শ্রেষ্ঠগণের সভায় স্ত্রীলোকের সঙ্গে, বিশেষত পাণ্ডবগণের ধর্মপত্নীর সঙ্গে আলাপ করেছিস।”

শাস্ত্রজ্ঞ ও তত্ত্ববুদ্ধি ধৃতরাষ্ট্র এই বলে বিশেষ বিবেচনা করে পাঞ্চালরাজনন্দিনী দ্রৌপদীকে বললেন, “পাঞ্চালি! তুমি যা ইচ্ছা করো, বর গ্রহণ করো। তুমি আমার বধুগণের মধ্যে প্রধানা। ধর্মপরায়ণা ও সতী।”

দ্রৌপদী বললেন, “হে ভরতশ্রেষ্ঠ! যদি আপনি আমাকে বর দেন, তবে আমি এই বর গ্রহণ করছি যে, সর্বধর্মানুসারী শ্ৰীমান যুধিষ্ঠির দাসত্ব থেকে মুক্ত হন। আমার এবং যুধিষ্ঠিরের পুত্র প্রশস্ত হৃদয় প্রতিবিন্ধ্যকে কেউ যেন দাসপুত্র সম্বোধন না করে।”

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “কল্যাণী তুমি যা বললে তাই হোক। তুমি দ্বিতীয় বর গ্রহণ করো। আমার মন বলছে যে তুমি কেবলমাত্র একটি মাত্র বর গ্রহণের যোগ্য নও।”

দ্রৌপদী বললেন, “মহারাজ রথ ও ধনু প্রভৃতির সঙ্গে ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব দাসত্ব থেকে মুক্ত হোন। আমি এই দ্বিতীয় বর গ্রহণ করছি।”

ধৃতরাষ্ট্র দ্বিতীয় বর প্রার্থনা স্বীকার করে তৃতীয় বর গ্রহণের জন্য দ্রৌপদীকে অনুরোধ করলেন। দ্রৌপদী সে অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলেন। দ্রৌপদী তৃতীয় বর গ্রহণ করলেন না। তিনি জানালেন, “ক্ষত্রিয় তিনটি, ক্ষত্রিয়ের স্ত্রী দুটি, বৈশ্য একটি, ব্রাহ্মণ একশত বরগ্রহণের যোগ্য। তা ছাড়াও তাঁর স্বামীরা দাসত্বমুক্ত হয়েছেন, পরবর্তী করণীয় তাঁরাই করবেন।”

*

দ্যূতক্রীড়া সভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা মহাভারতের একটি সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য দুর্লভ মুহূর্ত। পুরুষের দীর্ঘকালীন সঞ্চিত ক্রোধ, নির্লজ্জতার সঙ্গে কতদূর কুৎসিত হতে পারে—কতখানি ঘৃণা মনের মধ্যে জমা থাকলে কয়েকটি কুৎসিত পুরুষ একটি অসহায় নারীর প্রতি এ জাতীয় নির্যাতন করতে পারে— দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা তার প্রমাণ। বিশ্বসাহিত্যে, বিশেষত তিন মহাকাব্যে— ইলিয়াড, ওডিসি, রামায়ণে এ জাতীয় ঘটনা আর একটিও নেই।

কৌরবদের পাণ্ডবদের প্রতি রাগ বাল্যকাল থেকেই। ভীমের শক্তির কাছে প্রায়শই কৌরবদের প্রহার সহ্য করতে হত। ভীমকে বিষ দিয়েও শেষ করা যায়নি। অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব কৌরবদের ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। তারা বারণাবতে কুন্তীসহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় দুর্যোধন ব্যর্থ হলেন, সূতপুত্র হওয়ার কারণে কর্ণ দ্রৌপদীকে পেলেন না। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করায় পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীকে লাভ করলেন। কর্ণ সমেত কৌরবদের ক্রোধ আরও বাড়ল। খাণ্ডবপ্রস্থের অনুর্বর জঙ্গল জমিতে পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থ রচনা করলেন। রাজসূয় যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে সভাগৃহে নির্মাণ কৌশলে দুর্যোধন চূড়ান্ত অপদস্থ হলেন। এই সমস্ত সঞ্চিত রাগ কৌরবেরা দ্রৌপদীর উপরে উগরে দিলেন।

দ্যূতসভায় কৌরবদের চরিত্রের যে কদর্যরূপ ফুটেছে, ততখানি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে পাণ্ডবদের সংযম, শিষ্টতা ও ধর্মপরায়ণতা। ভীমসেন অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছিলেন সত্য, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্ম তাঁকে নিবৃত্ত করতে পেরেছেন। যুধিষ্ঠিরকে অনেকে দুর্বল, ক্লীব বলে আখ্যাত করেছেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির এর কোনওটিই ছিলেন না। যুধিষ্ঠির সমস্ত ঘটনা নীরবে নতমুখে পর্যালোচনা করছিলেন— তিনি বুঝতে পারছিলেন যে কুরুবংশ দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। কোনও কিছুর মূল্যেই তা আর জোড়া লাগবে না।

সব থেকে আশ্চর্য লাগে চন্দ্রভাগা দ্রৌপদীর চরিত্রপাঠে। দ্রৌপদী নারীকুলশ্রেষ্ঠা। যেমন অপরূপ লাবণ্যবতী তিনি, তেমনই অসাধারণ বুদ্ধিমতী। তাঁর মর্যাদা, নারীত্ব ধুলায় লুষ্ঠিত করতে চেয়েছে দুর্যোধন। কিন্তু পারেনি। স্বয়ং ধর্ম আপন পুত্রবধূকে অসম্মান থেকে বাঁচাতে ছুটে এসেছেন। কিন্তু দ্রৌপদী কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষদের ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মকে, মন্ত্রীবর্গকে, দ্রোণ ও কৃপাচার্য এবং সভাস্থ রাজন্যবর্গকে পুরুষত্বহীন, মর্যাদাহীন স্তাবকের দল হিসাবে পরিচিত করাতে পেরেছেন। দুটির বেশি বর গ্রহণ করেননি দ্রৌপদী। অস্ত্র সমেত স্বামীদের দাসত্ব থেকে মুক্ত করেছেন। এরপর যা কিছু করবার, তাঁর স্বামীরা করবেন। রাজসভায় দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে একটিও কটুক্তি করেননি। তিনি জানতেন স্বামী তাঁর ধর্মপরায়ণ। তিনি বুঝেছিলেন তাঁর অসম্মানের প্রতিকার স্বামীরা করবেন। তার জন্য কিছু সময়ের প্রয়োজন।

অধিকাংশ মহাভারত চর্চাকার দ্রৌপদীকে পণ ধরে পাশা খেলার জন্য যুধিষ্ঠিরের নিন্দা করেন। কিন্তু কী করতে পারতেন যুধিষ্ঠির? নিজেকে পণ ধরে পরাজিত হবার পর খেলা ছেড়ে দেওয়া? তা হলে দ্রৌপদীর কী হত? সারাজীবন ক্রীতদাস স্বামীদের সেবা করা? দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণ শকুনি তা করতে দিতেন? প্রতিদিন এর সহস্রগুণ লাঞ্ছনা তাঁরা দ্রৌপদীর করতেন। ক্রীতদাস স্বামীরা কোনও প্রতিবাদ করতে পারতেন না।

না, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রয়োজন ছিল। তাঁকে পণ ধরার প্রয়োজনও ছিল। যুধিষ্ঠির বুঝতে পারছিলেন যে, এই ঘটনার কাহিনি দ্বারকায় পৌঁছবে, ভারতবর্ষের প্রতিটি ঘরে আলোচিত হবে। ভারতবর্ষের বাইরেও এ কাহিনি যাবে, ভবিষ্যতের যে কোনও ঘটনার পিছনে এই লাঞ্ছনার ঘটনার উল্লেখ ঘটবে। সভায় উপস্থিত কোনও পুরুষই এ ঘটনার প্রত্যাঘাত থেকে রক্ষা পাবেন না।

ব্যাসদেব সচেতনভাবেই দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার আয়োজন করেছেন। নারীর অসম্মান ঘটালে— চুড়ান্ত শক্তিশালী পুরুষের যে অনিবার্য ধ্বংস হয়— ব্যাসদেব তা জানতেন। বাল্মীকি সীতাহরণের ক্ষেত্রে তা দেখিয়েছেন। হোমার হেলেন হরণের মধ্যে দেখিয়েছেন।

মহাভারত চর্চাকারেরা মনে রাখেন না অক্ষ-হৃদয় শেখার পর নলও দময়ন্তীকে নিয়ে পণ ধরে ভ্রাতা পুষ্করের সঙ্গে পাশা খেলেছিলেন এবং জিতেছিলেন। কিন্তু নলের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের পার্থক্য আছে। নল দময়ন্তীর একমাত্র স্বামী ছিলেন। তাই প্রথমবার পাশা খেলার সময়েই নল নিজেকে বাজি ধরার আগে উঠে যান। যুধিষ্ঠিরকে তা হলে সহদেবকে বাজি ধরার আগে উঠে যেতে হত! ধন সম্পদ হারিয়ে, ইন্দ্রপ্রস্থ হারিয়ে পাঁচ ভাই দ্রৌপদীকে নিয়ে কোথায় যেতেন? তাঁদের অন্য স্ত্রীরা কোথায় যেতেন। তাঁদের সন্তানরা। তা হলে ন্যায়-অন্যায়ের মীমাংসা হত কী ভাবে? দময়ন্তীকে বাজি ধরতে পুষ্কর বলেছিলেন, নল উঠে গিয়েছিলেন, কারণ তখনও তিনি অজিত ছিলেন। যুধিষ্ঠির আগে নিজেকে বাজি রেখে বিজিত হয়েছেন, তারপর দ্রৌপদীকে বাজি রেখে ভ্রাতাদের ও নিজেকে উদ্ধার করতে চেয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীই স্বামীদের উদ্ধার করেছেন। কর্ণ পাণ্ডবদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেবার জন্য বললেও, দ্রৌপদীকে ব্যঙ্গ করে বললেও একথা সত্য দ্রৌপদীর বুদ্ধিমত্তা, তার মনস্বিতা, ক্ষেত্র উপযোগী আচরণ ধর্মকে পর্যন্ত টেনে আনতে বাধ্য করেছিল। তাই দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রয়োজন ছিল, প্রতিটি লাঞ্ছনাকারীকে স্বামীরা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, এমনকী যারা প্রতিবাদহীন নীরবতা অবলম্বন করেছিলেন, তাঁদেরও। শুধু দুঃখ হয় বিকর্ণের জন্য। তিনি দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করলেও দুর্যোধনকে ত্যাগ করেননি। তাই ভীমের হাতে তাকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল। কর্ণ দ্রৌপদীকে ‘বেশ্যা’ বলেছিলেন। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন, তা হলে তিনিও ‘বেশ্যাপুত্র’— কারণ তাঁর মাতাও পঞ্চ পুরুষের শয্যাসঙ্গিনী হয়েছিলেন।

৩৩
দ্বিতীয় দ্যূতক্রীড়া

ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার উপশম ঘটানোর জন্য বর প্রদান করলেন এবং রত্ন ও ধনসমূহের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুর ত্যাগ করে ইন্দ্রপ্রস্থে যাবার অনুমতি প্রদান করলেন। দুর্যোধনের মন্ত্রণাকক্ষে এই সংবাদ পৌঁছল দুঃশাসনের মাধ্যমে। দুঃশাসন বললেন, “হে মহারথগণ! আপনারা অতিকষ্টে পাণ্ডবদেব যে ধন হস্তগত করেছিলেন, বৃদ্ধ তা নষ্ট করেছেন; তিনি শত্রুদের তা ফিরিয়ে দিয়েছেন।”

তখন দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি, দুঃশাসন মন্ত্রণা করে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কাছে উপস্থিত হলেন। দুর্যোধন বললেন, “মহারাজ, দেব-পুরোহিত বৃহস্পতি ইন্দ্রের কাছে যে নীতি ব্যাখ্যা করেছিলেন, তা কি আপনি শোনেননি? ছলে বলে বা কৌশলে অনিষ্ট করতে পারে, এমন শত্রুদের সমস্ত উপায়ে সংহার করবে। পাণ্ডবদের ধন সম্পত্তি যা আমরা হস্তগত করেছিলাম তার সাহায্যেই রাজাদের পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাতাম। আপনি তাও ফেরত দিলেন। তীক্ষ্ণবিষ সর্প দংশন করার জন্য উপস্থিত হলে, সেগুলি কণ্ঠ এবং মুখ চেপে ধরে বশীভূত অবস্থায় আবার কে ছেড়ে দেয়? এখন পাণ্ডবেরা তীক্ষ্ণবিষ সর্পের মতো রথে চড়ে এসে আমাদের দংশন করবে। অর্জুন যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হয়ে উৎকৃষ্ট তূণ দুটি দেখতে দেখতে বারবার গাণ্ডিব ধারণ করছে এবং ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে চারপাশে দৃষ্টিপাত করছে। ভীম তার বিশাল গদা তুলে, অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে, নিজের রথ প্রস্তুত করে পথে নেমেছে। আর যুধিষ্ঠির, নকুল ও সহদেব ঢাল ও তরবারি ধারণ করে ভঙ্গি দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করতে করতে চলছে। পাণ্ডবেরা সৈন্য সংগ্রহের জন্য চলেছে। আমরা পাণ্ডবদের বঞ্চনা করেছি। তারা আমাদের কখনও ক্ষমা করবে না। বিশেষত পাণ্ডবদের মধ্যে কোনও ব্যক্তিই দ্রৌপদীর সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না।

“ভরতশ্রেষ্ঠ মহারাজ, আপনার মঙ্গল হোক; আমরা বনবাস পণ রেখে আবার পাণ্ডবদের সঙ্গে পাশা খেলব। এইভাবেই আমরা তাদের আয়ত্ত করতে পারব। তারা বা আমরা দ্যূতে পরাজিত হলে মৃগচর্ম পরিধান করে বারো বৎসর মহারণ্যে বাস করব। আর আত্মীয়দের অজ্ঞাতে থেকে ত্রয়োদশতম বৎসর বাস করব। এই পণে অক্ষক্রীড়া আরম্ভ হোক। পাণ্ডবেরা অক্ষনিক্ষেপ করে পুনরায় দ্যূতক্রীড়া করুক। এই এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য। মাতুল শকুনি বিশেষ কৌশলের সঙ্গে অক্ষক্রীড়া জানেন। এই বারো বৎসরে আমরা রাজ্যে দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত হব আর মিত্র সংগ্রহ করে বলবান ও দুর্ধর্ষ বিপুল সৈন্যসমূহকে বিশেষ আদর দেখিয়ে অনুরক্ত করে অবস্থান করব। তারপর যদি পাণ্ডবেরা ত্রয়োদশতম বৎসরে অজ্ঞাতবাস করতে পারে এবং আমাদের জয় করতে আসে তবে আমরা অনায়াসে তাদের জয় করব। অতএব মহারাজ! এই মত আপনি সমর্থন করুন।” ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “পাণ্ডবেরা অনেক দূরে গিয়ে থাকলেও তাদের সত্বর ফিরিয়ে আনো। তারা আসুক এবং এই পণে আবার দ্যূতক্রীড়া করুক।”

মহাপ্রাজ্ঞ গান্ধারী মাতৃস্নেহবশত ভাবী অনিষ্ট আশঙ্কায় রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “মহারাজ দুর্যোধনের জন্মের পর মহামতি বিদুর বলেছিলেন যে, এই কুলকলঙ্ক পুত্রটাকে মেরে ফেলুন। কারণ আপনার পুত্রটি জন্মমাত্রই শৃগালের মতো বিকৃত চিৎকার করেছিল। আপনি একথা নিশ্চয়ই জানবেন যে, এই পুত্র থেকেই এ বংশের ধ্বংস হবে। আপনি নিজের দোষে দুঃখসমুদ্রে মগ্ন হবেন না। আপনার মূর্খ ও অশিষ্ট পুত্রদের মতে অনুমোদন দেবেন না। দারুণ বংশনাশের কারণ হবেন না। যে সেতু দৃঢ়বদ্ধ আছে, কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি তা ভেঙে দেয়? নিভে যাওয়া আগুনকে কে আবার জাগিয়ে তোলে। পাণ্ডবেরা শান্ত হয়েছে। এ অবস্থায় কোন ব্যক্তি তাদের ক্রুদ্ধ করে তোলে? শাস্ত্র দুর্বুদ্ধি লোককে শাসনের দ্বারা মঙ্গলের পথে আনতে পারে না। অমঙ্গল থেকেও তাদের বাঁচাতে পারে না। বুদ্ধিযুক্ত লোক নির্বোধ বালকের দ্বারা পরিচালিত হন না। আপনি ধর্মের পথে চলুন; পুত্রদের আপনি আপনার প্রদর্শিত পথে চলতে বাধ্য করুন। তারা যেন শত্রুর অস্ত্রে বিদীর্ণ হয়ে মৃত্যু লাভ করে আপনাকে পরিত্যাগ না করে। আপনি আমার কথা শুনুন, এই কুলকলঙ্ক দুর্যোধনকে ত্যাগ করুন। জন্মমাত্রই স্নেহবশত আপনি দুর্যোধনকে ত্যাগ করেননি, এখন তার জন্যই বংশনাশ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। মহারাজ আপনার বুদ্ধি শান্তি, ধর্ম ও নীতিযুক্ত ছিল, এখন সেই বুদ্ধিই আপনার জাগ্রত হোক। ক্রূর লোকের হাতে রাজলক্ষ্মীকে সমর্পণ করলে, সে রাজলক্ষ্মীকেই ধ্বংস করে। আর কোমল লোকের উপর স্থাপন করলে, রাজলক্ষ্মী দীর্ঘস্থায়িনী হন।”

গান্ধারীর সমস্ত বক্তব্য শোনার পর ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “এই বংশের সম্পূর্ণ ধ্বংস হোক, আমি বারণ করতে পারছিনা। পুত্রেদের যা ইচ্ছে তাই হোক, পাণ্ডবেরা ফিরে আসুক, আমার পুত্রেরা পুনরায় দ্যূতক্রীড়া করুক।”

তখন যুধিষ্ঠির বহু দূরে চলে গিয়েছিলেন। প্রতিকামী সেইখানে উপস্থিত হয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলল, “মহারাজ যুধিষ্ঠির, আপনার জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র আপনাকে বলেছেন যে, পাণ্ডুনন্দন আমার সভা সভ্যগণে পরিপূর্ণ হয়েছে। অতএব এসো, আবার গুটিকা নিক্ষেপ করে দ্যূতক্রীড়া করো।” যুধিষ্ঠির বললেন—

ধাতুর্নিযোগাদ্‌ভূতানি প্রাপ্নুবন্তি শুভাশুভম্‌।

ন নিবৃত্তিস্তয়োরস্তি দেবিতব্যং পুনর্যদি॥

অক্ষদ্যূতে সমাহ্বানং নিয়োগাৎ স্থবিরস্য চ!

জানন্নপি ক্ষয়করং নাতিক্রমিতুমুৎসহে॥ সভা : ৭৩ : ৩-৪॥

“প্রাণীরা বিধাতার নিয়োগ অনুসারে মঙ্গল ও অমঙ্গল লাভ করে থাকে। সুতরাং সে মঙ্গল ও অমঙ্গলের নিবৃত্তি হয় না। অতএব আমি মনে করি, আবার আমায় খেলতে হবে। বৃদ্ধের আদেশেই অক্ষক্রীড়ায় আবার আহ্বান হয়েছে, এবং তা বিনাশজনক, সে কথা জেনেও আমি সে আদেশ লঙ্ঘন করতে পারব না। শ্রীরামচন্দ্র জানতেন যে, সুবর্ণময় প্রাণী হতে পারে না, তবুও তিনি সুবর্ণময় হরিণের জন্য লোভ করেছিলেন। সুতরাং বলতে হবে, বিপদ নিকটবর্তী হলে, প্রায়ই লোকের বুদ্ধি বিপরীত হয়ে যায়।”

এই কথা বলতে বলতে যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদের সঙ্গে ফিরলেন এবং শকুনির শঠতা জেনেও পুনরায় দ্যূতক্রীড়া করবার জন্য আগমন করলেন। বন্ধুগণ তাঁদের সভায় প্রবেশ করতে দেখে দুঃখিত হলেন। তখন শকুনি বললেন, “হে ভরতনন্দন, বৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র যে তোমাদের ধন ফিরিয়ে দিয়েছেন, আমরা তার প্রশংসাই করেছি। এখন একটি মহামূল্য পণের বিষয় আমার কাছে শোনো। দ্যূতক্রীড়ায় তোমরা আমাদের জয় করতে পারলে আমরা মৃগচর্ম পরিধান করে মহাবনে প্রবেশ করে বারো বৎসর বাস করব। আর আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতভাবে এক বৎসর অন্য যে-কোনও স্থানে বাস করব। তখন যদি আত্মীয়স্বজনেরা আমাদের সংবাদ জানতে পারে, তবে আবার অপর বারো বৎসর বনে বাস করব।

“আবার আমরা তোমাদের জয় করতে পারলে, তোমরাও মৃগচর্ম পরিধান করে দ্রৌপদীর সঙ্গে বনে গিয়ে বারো বৎসর বাস করবে। এবং আত্মীয়স্বজনের অজ্ঞাতভাবে এক বৎসর যে কোনও স্থানে বাস করবে; তখন যদি আত্মীয়স্বজনেরা তোমাদের সংবাদ জানতে পারে, তবে আবার অপর বারো বৎসর বনে বাস করবে।

“তারপর, ত্রয়োদশ বৎসর অতীত হলে, আমরা বা তোমরা পুনরায় উপযুক্তভাবে আপন রাজ্য লাভ করব বা করবে। ভরতনন্দন যুধিষ্ঠির, এসো, এই নিয়মে গুটি নিক্ষেপ করে পুনরায় আমাদের সঙ্গে দ্যূতক্রীড়া করো।”

সভ্যরা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন চিত্তে উঠে দাঁড়ালেন। নিজেদের মধ্যে তাঁরা বলাবলি করতে লাগলেন, “এই ভয়াবহ পণের বিষয় এঁরা বুঝতে পারছেন না। লজ্জায় এবং প্রতিজ্ঞাভঙ্গের ভয়ে যুধিষ্ঠির পুনরায় দ্যূতক্রীড়া করতে গেলেন। অত্যন্ত বিপদের আশঙ্কা আছে জেনেও যুধিষ্ঠির পুনরায় দ্যূতক্রীড়া আরম্ভ করলেন।” তিনি বললেন, “স্বধর্মরক্ষক আমার মতো রাজা দ্যূতক্রীড়ায় আহূত হয়ে কী প্রকারে নিবৃত্তি পেতে পারেন। অতএব শকুনি, আমি তোমার সঙ্গে ওই পণেই খেলা করব।” যুধিষ্ঠির সেই পণই ধরলেন, শকুনি গুটি চালালেন এবং বললেন, “আমি জিতেছি।”

পাণ্ডবগণ পরাজিত হয়ে মৃগচর্ম পরিধান করে বনগমনের জন্য প্রস্তুত হলেন। পাণ্ডবদের সেই পোশাকে দেখে অতি আনন্দিত দুঃশাসন বলতে লাগলেন; “আজ থেকে মহাত্মা দুর্যোধনের রাজত্ব শুরু হল। পাণ্ডবেরা পরাজিত হয়ে মহাবিপদে পড়ল। আজ দেবতারা আমাদের প্রতি প্রসন্ন হলেন। কারণ আমরা সরলপথে শত্ৰুজয় করেছি। আজ আমরা পাণ্ডবদের থেকে গুণজ্যেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ এবং মহিমান্বিত হয়েছি। আমরা পাণ্ডবদের দীর্ঘকালের জন্য নরকে পতিত করেছি। তাদের সুখহীন ও রাজ্যভ্রষ্ট করে দৃষ্টির অগোচরে যেতে বাধ্য করেছি। যে ধনমত্ত পাণ্ডবেরা আমাদের উপহাস করেছিল, তারা আজ পরাজিত ও হৃতসর্বস্ব হয়েছে। ‘জগতে আমাদের মতো পুরুষ নেই’—এই যাদের ধারণা ছিল, তারা আজ অঙ্কুর উৎপাদনশক্তিশূন্য নিষ্ফল তিলের মতো অবস্থায় পতিত হয়েছে। এদের পোশাককে আজ বন্যজাতির চর্মময় বস্ত্রের মতোই মনে হচ্ছে। মহারাজ দ্রুপদ দ্রৌপদীকে পাণ্ডবদের হাতে প্রদান করে সুবিবেচনার কাজ করেননি। কারণ দ্রৌপদীর পতিরা নপুংসক। দ্রৌপদীর এই চর্মময় উত্তরীয় ধারণকারী সর্বস্বহীন, নিরাশ্রয় পতিদের সঙ্গে থাকা উচিত নয়। দ্রৌপদী এই পতিদের সঙ্গে তুমি কি আনন্দলাভ করবে? তুমি এখন যাকে ইচ্ছা, তাকে পতি বরণ করো। ক্ষমাশীল, ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠ কুরুবংশীয়েরা এখানে উপস্থিত আছেন, তুমি এদের মধ্যে যে কোনও একজনকে পতিত্বে বরণ করো। অঙ্কুরজননশক্তিশূন্য তিলের মতো, চর্মময় হরিণের মতো, তণ্ডুলহীন যক্ষের মতো পাণ্ডবেরা আজ নিষ্ফল। তুমি দুঃখসাগরময় পাণ্ডবদের সেবা করবে কেন?”

দুঃশাসনের কথা শুনে, অত্যন্ত ক্রোধে হিমালয়বাসী সিংহ যেমন শৃগালকে বলে তেমনই ভীমসেন দুঃশাসনের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, “খল! দুঃশাসন। শকুনির ক্ষমতার বলেই তুই রাজাদের মধ্যে আত্মশ্লাঘা করছিস। তুই এখন বাক্যবাণদ্বারা যেমন আমাদের মর্মস্থানে আঘাত করছিস, ঠিক তেমনই তোর মর্মস্থান ছেদন করে যুদ্ধে তোকে এই বিষয় স্মরণ করিয়ে দেব। তোর রক্ষকরূপে যারা দাঁড়াবে তাদেরও যমালয়ে পাঠাব।” ভীমসেন তখন ধর্ম কর্তৃক নিরুদ্ধ থাকায় তৎক্ষণাৎ দুঃশাসনকে শাস্তি দিতে পারেননি।

দুঃশাসন তখন সমস্ত লজ্জা ত্যাগ করে ভীমসেনকে লক্ষ্য করে ‘ওরে গোরুটা! ওরে গোরুটা!’এই বলে নাচতে আরম্ভ করল। তখন ভীমসেন আবার বললেন, “নৃশংস দুঃশাসন। তুই নিষ্ঠুর বাক্য বলতে পারিস, কিন্তু শঠতাপূর্বক অপরের ধন হরণ করে তুই ছাড়া অন্য কেউ আত্মশ্লাঘা করে না। সুতরাং পৃথানন্দন ভীমসেন তোর বক্ষ বিদারণ করে যদি রক্তপান না করে, তবে সে যেন পুণ্যলোকে গমন না করে। আমি সত্য বলছি, যুদ্ধে উপস্থিত সমস্ত ধনুধরকে অগ্রাহ্য করে আমি ধৃতরাষ্ট্রের সব পুত্রকেই যমালয়ে পাঠাব।”

পাণ্ডবগণ সভা থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য চলতে আরম্ভ করলেন। ভীমসেন সিংহগতিতে যাচ্ছিলেন। মুর্খ দুর্যোধন অধীর আনন্দে ভীমসেনের গতির অনুকরণ করে তাঁকে ব্যঙ্গ করতে লাগলেন। তখন ভীমসেন আপন শরীরের উপরিভাগ ফিরিয়ে দুর্যোধনকে বললেন, “মূঢ় দুর্যোধন! কেবল দুঃশাসনের রক্তপানেই আমার কর্তব্য শেষ হবে না। অনুচরসহ তোকে নিহত করে তখন আজকের কথা মনে করিয়ে দেব।”

বলবান, অভিমানী ভীমসেন এই অপমান দেখে মনের ভিতরেই ক্রোধ আটকে রেখে যুধিষ্ঠিরের পিছনে পিছনে যেতে যেতে সভাকে শুনিয়ে এই কথা বলে গেলেন, “আমি দুর্যোধনকে বধ করব, অর্জুন কর্ণকে বধ করবে এবং সহদেব অক্ষধূর্ত শকুনিকে বধ করবে। এই সভাকে আমি জানিয়ে যাচ্ছি, দেবতারা আমার বক্তব্য সত্য করবেন যে, আমাদের মধ্যে অবশ্যই যুদ্ধ হবে। সেই যুদ্ধে আমি গদাদ্বারা পাপাত্মা দুর্যোধনকে বধ করব এবং পদাঘাত করে ওর মাথাকে লুণ্ঠিত করব। এবং আমি সিংহের মতো এই বাক্যবীর এবং নিষ্ঠুর প্রকৃতির দুরাত্মা দুঃশাসনের রক্তপান করব।”

অর্জুন বললেন, “আর্য ভীমসেন, কেবল বাক্যদ্বারা মনস্বীগণের উদ্দেশ্য ঠিক বোঝা যায় না। আজ থেকে চোদ্দো বছরের সময়ে যা হবে, তা সকলেই প্রত্যক্ষ দেখতে পাবেন।” ভীম বললেন, “আজ থেকে চোদ্দো বছরের সময়ে সমরভূমি দুরাত্মা দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসনের রক্ত পান করবে।” অৰ্জুন বললেন, “আর্য ভীমসেন, কর্ণ আমাদের দোষ আবিষ্কার করে, আনন্দের সঙ্গে দুঃখ দর্শন করে, অনিষ্টের কথা বলে এবং গর্ব প্রকাশ করে। সুতরাং আমি আপনার আদেশে যুদ্ধে কর্ণকে বধ করব। সভ্যগণ, ভীমসেনের সন্তোষের জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করছি যুদ্ধে তীব্র শরাঘাতে কর্ণ ও তার অনুচরদের বধ করব। এবং অন্য যে সকল লোক বুদ্ধিমোহবশত আমার বিপক্ষে যুদ্ধ করবে, আমি বাণদ্বারা তাদের সকলকেই যমালয়ে প্রেরণ করব। আমার এই প্রতিজ্ঞা যদি রক্ষিত না হয়, তবে হিমালয় স্থানচ্যুত হবে, সূর্য প্রভাশুন্য হবেন এবং চন্দ্রের শৈত্যগুণ নষ্ট হবে।” অর্জুনের এই কথা শুনে প্রতাপশালী মাদ্রীনন্দন শ্রীমান সহদেব ক্রোধে রক্তচক্ষু হয়ে, সর্পের মতো নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে বিশাল বাহুযুগল উত্তোলন করে শকুনির বধের জন্য এই প্রতিজ্ঞা করলেন, “গান্ধার রাজবংশের যশোনাশক মূর্খ শকুনি! তুই যেগুলিকে পাশার গুটি বলে মনে করছিস, ওগুলি গুটি নয়, ওগুলি তোর হাতের তীক্ষ্ণ বাণসমূহ। বন্ধুবর্গের সঙ্গে তোকে লক্ষ্য করে ভীমসেন যা বলেছেন, আমি সে কাজ করব। তুই তার প্রতিকারের সমস্ত চেষ্টা এখন থেকেই করতে আরম্ভ কর। যদি তুই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম স্মরণ করে যুদ্ধে অবস্থান করিস, তবে আমি বলপূর্বক তোর বন্ধুদের সঙ্গে তোকে যুদ্ধে বধ করব।” মানুষের মধ্যে অপূর্ব রূপবান নকুলও সহদেবের কথা শুনে বললেন, “দুর্যোধনের প্রিয় সভাস্থিত যে ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণ এই দ্যূতক্রীড়া প্রসঙ্গে দ্রৌপদীকে কটু কথা শুনিয়েছে, তারা কালকর্তৃক মরণের জন্য প্রণোদিত হয়েছে। সুতরাং এই মুমূর্ষু ধার্তরাষ্ট্রগণের অনেককেই আমি যমালয়ে প্রেরণ করব। ধর্মরাজের আদেশে, দ্রৌপদী কর্তৃক নির্দিষ্ট পথে চলতে থেকে আমি পৃথিবীকে ধার্তরাষ্ট্রশূন্য করব।” দীর্ঘবাহু পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবেরা এই সকল বহুতর প্রতিজ্ঞা করে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে গেলেন।

যুধিষ্ঠির বললেন, “ভরতবংশীয়গণ, বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম, রাজা সোমদত্ত, মহারাজ বাহ্লিক, দ্রোণ, কৃপ, অন্যান্য রাজা, অশ্বত্থামা, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রসকল, যুযুৎসু, সঞ্জয় এবং অন্য সভ্যগণের কাছে আমি বনগমনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছি; সকলের অনুমতি নিয়ে আমি বনে যাচ্ছি; আবার এসে আপনাদের দর্শন করব।” সভ্যগণ লজ্জাবশত কোনও কথাই যুধিষ্ঠিরকে বললেন না, কেবল মনে মনে তাঁর মঙ্গলচিন্তা করতে লাগলেন।

তখন বিদুর বললেন, “মাননীয়া কুন্তী দেবী রাজার কন্যা, কোমলাঙ্গী, বৃদ্ধা এবং চিরকাল সুখভোগে অভ্যস্তা। সুতরাং তিনি তোমাদের সঙ্গে যেতে পারবেন না। তিনি এখন আমার বাড়িতেই সসম্মানে বাস করবেন। পাণ্ডবগণ তোমাদের মঙ্গল হোক।”

পাণ্ডবেরা সকলেই বললেন, “তাই হোক। হে নিস্পাপ বিদুর, আপনি আমাদের যা বলবেন, আমরা তাই করব। আপনি আমাদের পরম গুরু। অতএব আমাদের আরও যা কর্তব্য হয়, সে-সম্বন্ধেও উপদেশ দিন।” বিদুর বললেন, “হে ভরতশ্রেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, তোমরা আমার মত জেনে রাখো, অধর্ম দ্বারা বিজিত কোনও লোকই পরাজয়ের জন্য দুঃখ অনুভব করে না। তুমি ধর্ম জানো, অর্জুন যুদ্ধ জানে, ভীম শত্ৰুহন্তা, নকুল ধনসঞ্চয়ী এবং সহদেব সমস্ত কাজের পরিচালক, ধৌম্য শ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ এবং ধর্মাচারিণী দ্রৌপদী ধর্ম ও অর্থ— উভয়ক্ষেত্রেই নিপুণ। তারপর, তোমরা সকলেই পরস্পরের প্রিয়, প্রিয়ভাষী ও পরস্পরের গুণে সন্তুষ্ট; অন্য কোনও ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে ভেদ জন্মাতে পারবে না। এত গুণের জন্য সকল ব্যক্তিই তোমাদের ভালবাসে। হে ধার্মিক ভরতনন্দন! তোমার এই ক্ষমাশীলতা ধর্মের গুণে সর্বত্রই মঙ্গল হবে। ইন্দ্রতুল্য শত্রুও তোমার ক্ষমাগুণকে পরাভূত করতে পারে না। এখন ইন্দ্রের তুল্য জয়, যমের তুল্য ক্রোধসংবরণ, কুবেরের তুল্য দান এবং বরুণের তুল্য সংযম লাভ করার চেষ্টা করো। তুমি বুদ্ধি দ্বারা ইলাপুত্র পুরুরবাকে, শক্তি দ্বারা অপর রাজাদের এবং ধর্মাচরণ দ্বারা ঋষিদের পরাজিত করেছ। এখন চন্দ্র থেকে সৌন্দর্য, জল থেকে জীবনদাত্রীতা, পৃথিবী থেকে ক্ষমা, সূর্য থেকে সমগ্ৰ তেজ, বায়ু থেকে বল এবং সমস্ত ভূত থেকে সর্বপ্রকার গুণ লাভ করো।

তথা বিসর্গে কৌরবে বারুণে চৈব সংযমে।।

সোমাদাহ্লদকত্বং ত্বমদ্ভ্যশ্চৈবোপ জীবনম্‌।

ভূমে ক্ষমাঞ্চ তেজশ্চ সমগ্রং সূর্যমণ্ডলাৎ।

বায়োর্বলাঞ্চাপ্নুহি ত্বং ভূতেভ্যশ্চাত্মসম্পদঃ॥ সভা: ৭৫: ১৫-১৬॥

তোমাদের যেন কোনও রোগ না হয়, সর্বদাই যেন মঙ্গল হয়। সেইভাবে ফিরে আসলে আবার তোমাদের দর্শন করব। যুধিষ্ঠির! সময়ে সময়ে বিপদ ও ধর্মের বা অর্থের কষ্ট উপস্থিত হলে, সমস্ত কার্যই বিবেচনা করে উপযুক্ত আচরণ কোরো। যাত্রাকালের উপযুক্ত কথা তোমাকে বললাম। তুমি কোনওদিন পাপ করোনি, কৃতকার্য হয়ে ফিরে আসলে আবার তোমাকে দেখব।” তখন যুধিষ্ঠির বিদুর, ভীষ্ম ও দ্রোণকে নমস্কার করে প্রস্থান করলেন।

দ্রৌপদী যাত্রাসময়ে কুন্তীর কাছে গিয়ে বনগমনের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। সমস্ত অন্তঃপুরিকারা দ্রৌপদীকে সেই অবস্থায় দেখে আর্তনাদ করতে লাগলেন। দ্রৌপদী নমস্কার করলে কুন্তী তাঁকে আলিঙ্গন করলেন এবং অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে বললেন, “বৎসে, তুমি এই গুরুতর বিপদে পড়ে শোক কোরো না। তুমি স্ত্রীলোকের সমস্ত ধর্মই জানো, তুমি সৎস্বভাবশালিনী ও সদাচারসম্পন্না। ভর্তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করবে তা তোমাকে বলার কোনও দরকার নেই। কারণ তুমি সমস্ত গুণ দ্বারা পিতৃ-মাতৃ উভয়কুলই অলংকৃত করেছ। কৌরবেরা ভাগ্যবান, তুমি দৃষ্টি দ্বারা তাদের দগ্ধ করনি। আমি প্রতি মুহুর্তে তোমার মঙ্গলচিন্তা করব। তুমি নির্বিঘ্নে পথে গমন করো। অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে সতী স্ত্রীদের বিহ্বলতা সঙ্গত নয়। ধর্ম তোমাকে প্রতিমুহূর্তে রক্ষা করবেন। বনবাসের সময়ে আমার পুত্র সহদেবকে তুমি সর্বদা পর্যবেক্ষণ করবে, যাতে বিপদে পড়ে সে অবসন্ন হয়ে না পড়ে।”

পরিধানে একখানি মাত্র বসন ছিল, তাও রক্তাক্ত ছিল। চুলগুলি খোলা ছিল। সেই অবস্থায় দ্রৌপদী “তাই হবে” বলে বেরিয়ে এলেন। তাঁর চোখ থেকে জল ঝরে পড়ে দুটি গাল ভিজিয়ে দিচ্ছিল। কুন্তী তার পিছনে যেতে যেতে আপন পুত্রদের দেখতে পেলেন। তখন তাঁদের বস্ত্র ও অলংকার হরণ করে নেওয়া হয়েছিল, সমস্ত অঙ্গ মৃগচর্মে আবৃত ছিল, তাঁরা লজ্জায় মুখ নিচু করে যাচ্ছিলেন। বন্ধুরা শোক করছিল, শত্রুরা আনন্দিত হয়ে তাঁদের পরিবেষ্টন করেছিল। কুন্তী প্রত্যেক পুত্রকে আলিঙ্গন করলেন এবং উচ্চ স্বরে বিলাপ করতে থাকলেন, “যাদের চরিত্র ধর্মময়, যারা সদ্ব্যবহারে অলংকৃত, উদারচেতা ও ঈশ্বরে দৃঢ়ভক্ত ও সর্বদা যাগ-যজ্ঞে ব্যাপৃত, তাদেরই বিপদ দেখা দিল। এ কেমন দৈববিপর্যয়! আমি কার অভিসম্পাতে তোমাদের এ দুরবস্থা দেখছি। আমি তোমাদের প্রসব করেছিলাম বলে এটা আমার ভাগ্যেরই দোষ। তোমরা উত্তম গুণসম্পন্ন হয়েও কষ্ট ভোগ করবে কেন? মানসিক বল, দৈহিক বল, উদ্যম, অধ্যবসায় এবং প্রভাবের গুণে তোমরা প্রবল হয়েও ধনের অভাবে কৃশ হতে থেকে কীভাবে দুর্গম অরণ্যে কাল কাটাবে? তোমাদের বনবাস হবে একথা নিশ্চয় জানলে আমি পাণ্ডুর মৃত্যুর পর শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে হস্তিনাপুরে আসতাম না। তোমাদের পিতা ধন্য, পুত্র সম্পর্কে মনঃপীড়া পাবার আগেই তিনি পৃথিবী ত্যাগ করেছিলেন। ভবিষ্যৎ বিষয়ে অভিজ্ঞা স্বর্গগতা ধর্মজ্ঞা মাদ্রীকেও আমি আজ সর্বপ্রকারে ধন্যা ও মঙ্গলবতী বলে মনে করি। আমি জীবনের প্রতি মমতা করেছিলাম, তাই দারুণ ক্লেশ ভোগ করছি; সুতরাং আমাকে ধিক। পুত্রগণ! আমি অতিকষ্টে তোমাদের লাভ করেছিলাম, তাই তোমরা আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং সচ্চরিত্র। সুতরাং আমি তোমাদের ত্যাগ করে থাকতে পারব না; তোমাদের সঙ্গে বনে যাব। হা দ্রৌপদী! তুমি আমাকে ত্যাগ করে যাচ্ছ? জগতে প্রাণের বিনাশ থাকলেও বিধাতা আমার প্রাণের বিনাশ করেননি। তাই আয়ু আমাকে ত্যাগ করছে না।

“হা কৃষ্ণ! হা দ্বারকাবাসী। তুমি কোথায় আছ? হে রামানুজ! তুমি আমাকে এবং এই নরশ্রেষ্ঠদের দুঃখ থেকে কেন রক্ষা করছ না? এরা সকলেই সচ্চরিত্র, ধর্ম, উদারতা, যশ ও বীর্যশালী; এরা দুঃখভোগ করার যোগ্য নয়; সুতরাং এদের প্রতি দয়া করো। ন্যায়জ্ঞ ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ প্রভৃতি থাকতে এই বিপদ কী করে উপস্থিত হল? হা মহারাজ পাণ্ডু! আপনি কোথায় আছেন? দ্যূতে পরাজিত করে আপনার সচ্চরিত্র পুত্রদের শত্রুরা নির্বাসিত করছে? আপনি কেমন করে এমন ঘটনা উপেক্ষা করছেন? সহদেব তুমি যেয়ো না। কারণ, তুমি তো আমার শরীরের থেকেও প্রিয়। হে মাদ্রীনন্দন, কুপুত্রের মতো আমাকে পরিত্যাগ কোরো না।”

কুন্তীর বিলাপরত অবস্থায় পাণ্ডবগণ তাঁকে শান্ত করে প্রণাম করে বনে প্রস্থান করলেন। অত্যন্ত দুঃখিত বিদুরও নানা যুক্তি দিয়ে কুন্তীকে আশ্বস্ত করে অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন।

পথে-ঘাটে লোকেরা দুঃশাসন কর্তৃক দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ ইত্যাদির কারণে কৌরবদের অত্যন্ত নিন্দা করতে লাগলেন। কৌরবভার্যারা স্বামীদের আচরণে লজ্জিত হয়ে সশব্দে রোদন করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের অন্যায়াচরণ চিন্তা করে শান্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি বিদুরকে ডেকে পাঠালেন। বিদুর উপস্থিত হলে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “বিদুর! পঞ্চপাণ্ডব কীভাবে যাচ্ছেন, দ্রৌপদী কীভাবে যাচ্ছেন, ধৌম্য পুরোহিত কীভাবে যাচ্ছেন, আমাকে তা বিশদভাবে বলো, আমি তাদের ভাব ও ভঙ্গি বুঝতে চাই।”

বিদুর বললেন, “মহারাজ, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বস্ত্র দ্বারা মুখ ঢেকে পথে চলেছেন। ভীমসেন দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে হেঁটে চলেছেন। অর্জুন বালি ছড়াতে ছড়াতে রাজার পিছনে যাচ্ছেন; সহদেব দু’হাতে মুখ ঢেকে পথ চলেছেন। পরম সুন্দর নকুল সমস্ত শরীরে ধূলি লিপ্ত করে রাজার পিছনে পিছনে চলেছেন। দীর্ঘনয়না পরমসুন্দরী দ্রৌপদীও উন্মুক্ত কেশরাজি দ্বারা মুখমণ্ডল আবৃত করে রাজার পিছনে গমন করছেন। আর ধৌম্য পুরোহিত হাতে কুশ ধারণ করে যমদৈবত ভয়ংকর সামবেদীয় মন্ত্র পাঠ করতে করতে পথে চলেছেন।”

ধৃতরাষ্ট্র প্রশ্ন করলেন, “বিদুর পাণ্ডবেরা কেন এইভাবে পথে চলেছেন? তা বলো।” বিদুর বললেন, “আপনার পুত্রেরা প্রতারণা করে রাজ্য ও ধন হরণ করে নিলেও বুদ্ধিমান ধর্মরাজের বুদ্ধি ধর্ম থেকে বিচলিত হয়নি। রাজা যুধিষ্ঠির সর্বদাই আপনার পুত্রদের প্রতি দয়াশীল; তাই প্রতারণা করায় ক্রোধসন্তপ্ত হয়েও তিনি নয়ন উন্মোচন করছেন না। “আমি ভয়ংকর নয়ন দ্বারা দর্শন করে লোেকদের দগ্ধ করব না”—এই ভেবেই যুধিষ্ঠির মুখমণ্ডল আবৃত করে পথ চলেছেন। “বাহুবলে আমার তুল্য লোক জগতে নেই” এই ভেবেই বাহুবলদর্পিত ভীমসেন লোকদের দেখাতে দেখাতে শত্রুপক্ষের উপর বাহুবলের প্রয়োগের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিতে দিতে পথে চলেছেন। অর্জুন বালুকারাশি বর্ষণের মধ্যে দিয়ে ভবিষ্যতের বাণ বর্ষণের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। অর্জুন নিক্ষিপ্ত বালিগুলি যেমন পরম্পর অসংলগ্ন হয়ে চলছে, তেমনই অসংলগ্নভাবেই তিনি শত্রুগণের প্রতি বাণবর্ষণ করবেন। “আজ যেন কেউ আমাকে দেখে চিনতে না পারে,” এই চিন্তা করে সহদেব দু’হাতে মুখ ঢেকে চলেছেন। “আমি যেন পথে স্ত্রীলোকদের চিত্ত আকর্ষণ না করি” এই অভিপ্রায়ে নকুল সমস্ত অঙ্গে ধূলি মেখে চলেছেন। একবস্ত্রা, মুক্তকেশী, রজস্বলা এবং রক্তাক্তবসনা দ্রৌপদীও রোদন করতে থেকে যেন মনে মনে বলছেন, “যারা আমার এই অবস্থা করল, তাদের রজস্বলা ভার্যারাও যেন আজ থেকে চোদ্দো বছর পরে পতি, পুত্র, বন্ধু ও প্রিয়জন নিহত হলে রক্তাক্ত কলেবরা, মুক্তকেশী হয়ে তর্পণ করে এইভাবে হস্তিনায় প্রবেশ করে।” আর পুরোহিত ধৌম্য হাতের কুশগুলি নৈর্ঋত কোণে মুখ করে সামবেদীয় মন্ত্র পাঠ করে “কৌরবেরা যুদ্ধে নিহত হলে, তাঁদের পুরোহিতেরাও এইভাবে সামগান করবেন”, এই কথা বলতে বলতে পথে চলেছেন। মহারাজ, পাণ্ডবদের যাত্রাকালে প্রজারা আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, বিনা মেঘে বিদ্যুৎ প্রকাশ পেয়েছিল এবং ভূমিকম্প হয়েছিল। তখন অমাবস্যা ছিল না, কিন্তু রাহু সূর্যকে গ্রাস করেছিল, উল্কা হস্তিনানগরীকে দক্ষিণে রেখে বিলীন হয়েছিল।” এই সময়ে নারদ উপস্থিত হয়ে বিদুর ও ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “দুর্যোধনের অপরাধে এবং ভীম ও অর্জুনের বলে এখন থেকে চোদ্দো বৎসর পরে কৌরবগণ বিনষ্ট হবে।”

*

দ্বিতীয় দ্যূতক্রীড়ায় পাণ্ডবদের বনগমন করতে হল। দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসনের অপরাধে এবং স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন অনুমোদনে বনবাস ঘটলেও মহাভারতে এই ঘটনার সুগভীর তাৎপর্য আছে। প্রথমত, আদি কবিও তাঁর নায়ককে চোদ্দো বছরের জন্য বনে প্রেরণ করেছিলেন। বাল্মীকি ও ব্যাস উভয়েই মনে করেছিলেন যে, ভারতবর্ষের ভাবী রাজাকে চরিত্র পূর্ণ গঠনের জন্য অরণ্য, প্রকৃতি, মুনি ঋষি, মানবেতর প্রাণী সবই জানতে হবে। দ্বিতীয়ত, নগর-জীবনের ঐশ্বর্য ও সুখলালিত রাজপুত্রদের অরণ্যে অনেক বেশি কায়িক শ্রম অভ্যাস করতে হবে। তৃতীয়ত, নগর জীবনের অপর্যাপ্ত ভোগবিলাসের মধ্যে জীবনযাপন করলে ত্যাগের শিক্ষা হবে না, অরণ্যভূমিতে সেই ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষা ঘটবে।

কৌরবসভায় লাঞ্ছনার পর পাণ্ডবদের বনবাস অপরিহার্য ছিল। দ্যূতক্রীড়ার পর পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে রাজত্ব করতে পারতেন না। স্বামী পঞ্চপাণ্ডব এবং পট্টমহিষী দ্রৌপদী কেউই কৌরবসভায় লাঞ্ছনার কথা ভুলতে পারতেন না। সে সভায় বস্তুতপক্ষে কুরুবংশ দ্বি-খণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল। একপক্ষে ন্যায়, সত্য, ধর্ম—আর অন্যপক্ষে অন্যায়, লোভ আর ঈর্ষা। এর মধ্যে একটিকে সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতেই হবে। পাণ্ডবদের প্রতারণা করে বনে পাঠিয়ে এবং পণের সীমা অতিক্রমের পরেও রাজ্য না ফিরিয়ে দিয়ে দুর্যোধন সেই অন্যায়কে সর্বোচ্চ চূড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই চূড়ান্ত অন্যায়ের জন্য আঠারো দিনের যুদ্ধে কুরুবংশ ধ্বংস হল।

বনপর্ব পাণ্ডবদের প্রস্তুতির পর্ব। তখনও পর্যন্ত শক্তিসামর্থ্যে পাণ্ডবেরা দীন। শত্রুপক্ষে আছেন ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম, আছেন গুরু দ্রোণ, যিনি পুত্রের মৃত্যুর সংবাদ না জানলে অস্ত্রত্যাগ করবেন না, অথচ সেই পুত্র অমর, আছেন কুরু-পাণ্ডবের প্রথম অস্ত্রগুরু অমর কৃপাচার্য, আছেন অমর অশ্বত্থামা, আছেন সহজাত কবচ-কুণ্ডলধারী অপরাজেয় কর্ণ, আছেন মহাদেবের বরপ্রাপ্ত জয়দ্ৰথ, যিনি অর্জুন ভিন্ন অন্য পাণ্ডবদের একদিনের জন্য আটকাতে পারবেন এবং যাঁর মাথা কেটে পিতার কোলেই ফেলতে হবে।

পাণ্ডবদের তখনও কিছু নেই। বনবাসে ব্যাসদেবের কাছে যুধিষ্ঠির পেলেন ‘প্রতিস্মৃতি’ মন্ত্র। যে মন্ত্রের তপস্যার ফলে অর্জুন পেলেন পিনাকপাণি মহাদেবের সাক্ষাৎ। পেলেন পাশুপত আর সকল দিব্যাস্ত্র। মহর্ষি বৃহদশ্বের কাছে যুধিষ্ঠির শিখলেন “নিখিল বিশ্ব-অক্ষ-হৃদয়।” হনুমানের সঙ্গে সাক্ষাতের পর ভীমসেন পেলেন অযুত-হস্তীর বল। পিতা ধর্ম দিলেন যুধিষ্ঠিরকে ‘অজ্ঞাতবাস’ বছরে প্রচ্ছন্ন থাকার বর। সূর্যদেব দিলেন অন্নের তাম্রস্থালী—সর্বোপরি কৃষ্ণ এলেন সর্বসহায়ক হয়ে। অজ্ঞাতবাস পর্বে মিত্রপক্ষে পেলেন মহারথ বিরাটরাজকে। অজ্ঞাতবাসের শেষে অর্জুনের থেকে বড় বীর পৃথিবীতে আর ছিল না। ভীম হলেন শ্রেষ্ঠ বলবান, আর যুধিষ্ঠির? দেবতা ধর্ম তাঁকে ‘স্বয়ং ধর্ম’ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই ‘দ্বিতীয় দ্যূতক্রীড়া” মহাভারতের এক শ্রেষ্ঠ দুর্লভ মুহূর্ত।

৩৪
মানিনী যাজ্ঞসেনী

পাণ্ডবেরা তখন বনবাস পালনের শর্ত অনুযায়ী দ্বৈতবনে বাস করছেন। একদিন ভোজ, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশীয়গণ পাণ্ডবগণকে দুঃখসন্তপ্ত ও বনবাসী শুনে, সেই মহাবনে আগমন করলেন। দ্রুপদরাজের পুত্রগণ, চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু এবং লোকবিখ্যাত মহাবীর কেকয়রাজপুত্রগণ ক্রুদ্ধ ও বিলম্বে অসহিষ্ণু হয়ে পাণ্ডবগণের সঙ্গে দেখা করতে এলেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণকে নিন্দা করে, “এখন আমরা কী করতে পারি” এই আলোচনা করতে লাগলেন। ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠরা সকলেই কৃষ্ণকে সামনে রেখে পাণ্ডবদের বেষ্টন করে বনভূমিতে উপবেশন করলেন। তখন পাণ্ডবেরা এই অবস্থায় আছেন দেখে বিষন্ন হৃদয় কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে অভিবাদন করে বললেন, “সমরভূমি—দুরাত্মা দুর্যোধন, কর্ণ, শকুনি ও দুঃশাসনের রক্ত পান করবে। এদের যুদ্ধে নিহত করে, এদের অনুগামীদের এবং ধৃতরাষ্ট্রকে সম্মিলিত অবস্থায় পরাজিত করে, আমরা সকলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে অভিষিক্ত করব। কারণ যে ব্যক্তি শঠতাপূর্বক অপরের অনিষ্ট করে, সে ব্যক্তি বধের যোগ্য হয়; এই-ই সনাতন ধর্ম।”

পাণ্ডবদের এই দুরবস্থা দেখে কৃষ্ণ, দুর্যোধন প্রভৃতির প্রতি এতদূর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি যেন সমস্ত লোককেই দগ্ধ করবেন বলে বোধ হচ্ছিল। তখন অর্জুন ও যুধিষ্ঠির তাঁকে বহু স্তুতি করে শান্ত করলেন। দ্রৌপদী ভ্রাতৃগণবেষ্টিত শরণাগত রক্ষক কৃষ্ণকে গিয়ে বলতে লাগলেন—

বাসুদেব! হৃষীকেশ! বাসবাবরজাচ্যুত!

দেবদেবোহসি লোকাণাং কৃষ্ণদ্বৈপায়নোহব্রবীৎ॥ বন: ১১: ৫০॥

“বাসুদেব! হৃষীকেশ! বামন! অচ্যুত! বেদব্যাস বলেছেন যে, তুমি জগতের মধ্যে দেবতাদেরও দেবতা।”

“অসিতদেবল বলেছেন, সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র তুমিই সর্বলোকস্রষ্টা প্রজাপতি ছিলে। দুর্ধর্ষ। মধুসূদন! পরশুরাম বলেছেন যে, তুমি বিষ্ণু, তুমি যজ্ঞ, তুমি যাজক এবং তুমি যাজনীয়। পুরুষোত্তম। ঋষিরা তোমাকে ক্ষমা ও সত্য বলে থাকেন এবং কশ্যপ বলেছেন যে, তুমি সত্য থেকে যজ্ঞরূপে আবির্ভূত হয়েছ। হে ভূতভাবন! হে ভূতনাথ! নারদ বলেছেন যে, তুমি সাধ্যগণ, দেবগণ এবং রুদ্রগণেরও দেবতা।

“হে নরশ্রেষ্ঠ! বালক যেমন খেলার বস্তু দ্বারা খেলা করে, তুমিও তেমনই শিব, ব্রহ্মা, ইন্দ্র প্রভূতিদের নিয়ে বারবার খেলা করে চলেছ। প্রভু। তোমার মস্তক দ্বারা আকাশ এবং চরণযুগল দ্বারা পৃথিবী ব্যাপ্ত হয়েছে এই প্রাণীগণ তোমার উদর; সুতরাং তুমি সনাতন বিরাট পুরুষ। বিদ্যার্জনের কষ্ট ও তপস্যার কষ্টে সন্তুষ্ট সন্তপ্ত, তপস্যা দ্বারা শোধিতচিত্ত এবং ব্ৰহ্মসাক্ষাৎকার নিবন্ধন পরিতৃপ্ত ঋষিগণের মধ্যে তুমিই প্রধান। পুরুষশ্রেষ্ঠ! পুণ্যবান, যুদ্ধে অপলায়িত এবং সর্বগুণসম্পন্ন রাজর্ষিগণের তুমিই গতি; আর তুমি প্রভু, তুমি জীব এবং তুমি কার্য করে থাকো। ইন্দ্র প্রভৃতি দিকপাল, ত্রিভুবন, নক্ষত্র, দশদিক, আকাশ, চন্দ্র ও সূর্য—এ সমস্তই তোমাতেই আছে। মহাবাহু! প্রাণীগণের মরণশীলতা এবং দেবগণের অমরত্ব—এই দুটি ধর্মই তোমাতে আছে। প্রাণীগণের মধ্যে যারা স্বর্গীয় এবং যারা মর্ত্যভূমির মানুষ— তাদের সকলের ঈশ্বর তুমি; সুতরাং তোমাকে ভালবেসেই তোমার কাছে দুঃখের কথা বলব। কৃষ্ণ! প্রভু! পাণ্ডবগণের ভার্যা, তোমার সখী এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী আমার মতো নারীকে কী করে সভায় টেনে নিয়ে যেতে পারে? আমি লজ্জিতা, কম্পিতা, রজস্বলা এবং একবস্ত্রা এই অবস্থাতে আমাকে কৌরব সভায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই কারণে, আমি মহাবল পাণ্ডবদের নিন্দা করি। আমি রক্তাক্ত অবস্থায় সভায় রাজাদের মধ্যে গিয়েছিলাম— তখন পাপাত্মা ধার্তরাষ্ট্রগণ আমাকে দেখে উপহাস করছিল। মধুসূদন! পাণ্ডবগণ, পাঞ্চালগণ এবং বৃষ্ণিবংশীয়গণ জীবিত থাকতে ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাকে দাসীভাবে ভোগ করতে চেয়েছিল। আমি ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র—ধর্ম অনুসারে দুজনেরই কূলবধূ হই। সেই আমাকেই ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা বলপূর্বক দাসী করবার ইচ্ছা করেছিল। এক্ষেত্রে মহাযোদ্ধা ও মহাবল পাণ্ডবগণকেই আমি নিন্দা করি। যেহেতু, তাঁদেরই ধর্মপত্নীকে কেউ উৎপীড়িত করছিল, এঁরা তা অবাধে দেখছিলেন। অতএব জনার্দন! ভীমের বাহুবলকে ধিক, অর্জুনের গাণ্ডিবকে ধিক। যাঁরা ক্ষুদ্রকর্তৃক আমার উৎপীড়ন অবাধে সহ্য করেছিলেন। সর্বদা সজ্জন প্রচলিত এই ধর্মপথ চিরকাল চলে আসছে যে, স্বামীরা দুর্বল হলেও ভার্যাদের রক্ষা করে থাকেন। কারণ, ভার্যা রক্ষিত হলে, সন্তান রক্ষিত হয় এবং সন্তান রক্ষিত হলে, নিজেও রক্ষিত হয়। তারপরে, যেহেতু ভর্তা নিজের ভার্যার উদরে জন্মে থাকেন, সেহেতু ভার্যার নাম হয়েছে জায়া। ‘আবার ভর্তা কীভাবে আমার উদরে জন্মাবেন’ এই ভেবে ভার্যাও ভর্তাকে রক্ষা করবেন। কৃষ্ণ! এঁরা কখনও শরণাগতকে পরিত্যাগ করেন না; অথচ আমি তখন শরণাগত হয়েছিলাম, তাতেও এঁরা আমাকে রক্ষা করেননি। জনার্দন! পাঁচ পতির ঔরসে আমার উদরে পাঁচটি মহাবল পুত্র জন্মেছে। সুতরাং এদের পর্যবেক্ষণের জন্য আমাকে রক্ষা করাও এঁদের উচিত ছিল। যুধিষ্ঠির থেকে প্রতিবিন্ধ্য; ভীম থেকে সুতসোম, অর্জুন থেকে শ্রুতকীর্তি এবং নকুল থেকে শতানীক ও সহদেব থেকে শ্রুতকর্মা জন্মগ্রহণ করেছে। কৃষ্ণ! এরা সকলেই যথার্থ পরাক্রমশালী এবং প্রদ্যুম্ন যেমন, তেমনই মহারথ হয়েছে। এরা সকলেই ধনুর্বিদ্যায় শ্রেষ্ঠ এবং যুদ্ধে শত্রুগণের অজেয় হয়েছে; তবুও তারাই বা কেন অতিদুর্বল ধার্তরাষ্ট্রগণের অত্যাচার সহ্য করেছিল। শত্রুরা অধর্ম অনুসারে রাজ্য হরণ করে সকলকে দাস করেছিল এবং আমি রজস্বলা ও একবস্ত্রা ছিলাম, সেই অবস্থাতেই আমাকে কেশাকর্ষণ করে সভার মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। মধুসূদন! তুমি, ভীম ও অর্জুন ভিন্ন অন্য কোনও লোক যে ধনুতে গুণ পরাতে পারে না, সেই গাণ্ডিব ধনু ও ভীমের বলকে ধিক এবং অর্জুনের পুরুষকারকে। কারণ সেগুলি থাকতেও দুর্যোধন এখনও জীবিত আছে। মধুসূদন! যে দুর্যোধন পূর্বে বেদপাঠী, ব্রহ্মচারী, বালক ও অহিংসক এই পাণ্ডবদের মায়ের সঙ্গে রাজ্য থেকে বার করে দিয়েছিল। যে পাপাত্মা পূর্বসঞ্চিত, নূতন, তী্‌ক্ষ্ণ ও লোমহর্ষণ কালকূট বিষ ভীমসেনের অন্নে মিশিয়ে দিয়েছিল। ভীমসেনের আয়ু অবশিষ্ট ছিল বলে, কোনও ক্ষতি না করে সে বিষ অন্নের সঙ্গে জীর্ণ হয়ে গেছিল। কৃষ্ণ! ভীমসেন প্রমাণ কোটিতে নিরুদ্বেগে নিদ্রিত হয়েছিলেন, এই অবস্থায় সেই পাপাত্মা দুর্যোধন তাঁকে বন্ধন করে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে নগরে চলে গিয়েছিলেন। তারপর, মহাবাহু ভীমসেন জাগ্রত হয়ে, সেই বন্ধন ছিন্ন করে দাঁড়িয়েছিলেন। তারপর আবার অন্য এক সময়ে ভীমসেন নিদ্রিত হলে, তাঁর সমস্ত অঙ্গে তীক্ষ্ণ বিষধর সর্প দ্বারা দংশন করিয়েছিল; কিন্তু শত্রুহন্তা ভীম তাতেও মৃত্যুমুখে পতিত হননি। বরং তিনি জাগ্রত হয়ে ওই সমস্ত সর্পকেই মাটিতে পুঁতে বিনষ্ট করেছিলেন এবং দুর্যোধনের ওই কার্যকারী প্রিয় সারথিকেও বাঁহাতে বধ করেছিলেন। আবার, বালক পাণ্ডবেরা মায়ের সঙ্গে বারণাবতে শায়িত ও নিদ্রাগত অবস্থায় ছিলেন, সেই অবস্থায় দুর্যোধন তাঁদের পুড়িয়ে মারবার চেষ্টা করেছিলেন। এই কাজ দুর্যোধন ভিন্ন আর কে করতে পারেন?” আর্যা কুন্তী দেবী ভীত হয়ে রোদন করছিলেন এবং পাণ্ডবদের বলেছিলেন, “অগ্নি কর্তৃক পরিবেষ্টিত হয়ে আমি গুরুতর বিপদাপন্ন হলাম। হায়; আমি মরলাম; কী করে আমি এখন এই আগুন নেভাব। অনাথা আমি আজ বালক পুত্রদের সঙ্গে বিনষ্ট হব।” তখন বাযুর ন্যায় বেগ ও পরাক্রমশালী মহাবাহু ভীম এই বলে আর্যা কুন্তীকে সন্তপ্ত অবস্থায় আশ্বস্ত করেছিলেন, “পক্ষীশ্রেষ্ঠ বিনতানন্দন গরুড়ের মতো আমি আপনাদের নিয়ে চলে যাব; আপনাদের কোনও ভয় নেই।” বলবান, উৎসাহশালী ভীমসেন বামক্রোড়ে কুন্তীকে, ডানক্রোড়ে যুধিষ্ঠিরকে, দুই কাঁধে নকুল ও সহদেবকে এবং পিঠে অর্জুনকে নিয়ে বেগে লাফ দিয়ে অগ্নিকে পার হয়ে ভ্রাতৃগণ ও মাতাকে অগ্নি থেকে মুক্ত করেছিলেন। সেখান থেকে তাঁরা হিড়িম্ববন নামক মহারণ্যে প্রবেশ করলেন।

“পরিশ্রান্ত এবং অত্যন্ত দুঃখিত পাণ্ডবেরা মায়ের সঙ্গে সেই বনের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লে হিড়িম্বা রাক্ষসী তাদের কাছে উপস্থিত হল। সেই হিড়িম্বারাক্ষসী মাতার সঙ্গে ভূতলে শায়িত পাণ্ডবদের দেখে, কামার্ত হয়ে ভীমসেনকে কামনা করল। তারপর হিড়িম্বা সুলক্ষণা মানুষীর রূপ ধারণ করে, আপন কোলে ভীমসেনের চরণযুগল তুলে নিয়ে, আনন্দিত মনে ভীমসেনের পা টিপতে লাগল। তখন অসাধারণ ধৈর্যশীল, বলবান ও যথার্থ পরাক্রমশালী ভীমসেন তার মনোবাসনা বুঝতে পেরে তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “সুন্দরী! তুমি আমার কাছে কী চাও?” ভীমসেন এই প্রশ্ন করলে, কামরূপিণী ও অনিন্দ্যসুন্দরী সেই রাক্ষসী ভীমসেনকে বলল, “তোমরা অবিলম্বে এই স্থান থেকে পলায়ন করো। কারণ, আমার বলবান ভ্রাতা এখনই তোমাদের বধ করতে আসবে। চলে যাও, বিলম্ব কোরো না।” তখন ভীমসেন অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে তাকে বললেন, “আমি তোমার ভ্রাতাকে ভয় করি না, সে এখানে এলে আমি তাকে বধ করব।” তাদের আলাপ শুনে ভীমাকৃতি ও ভীমদর্শন সেই রাক্ষসাধম বিশাল গর্জন করতে করতে সেখানে উপস্থিত হয়ে হিড়িম্বাকে বলল, “হিড়িম্বা, তুই কার সঙ্গে আলাপ করছিস, ওকে আমার কাছে নিয়ে আয়, আমি ওকে ভক্ষণ করব, বিলম্ব করিস না।” মনস্বিনী ও অনিন্দ্যসুন্দরী হিড়িম্বা দয়ার্দ্রচিত্তে ভীমকে সে কথা বলতে পারল না।

“তখন নরমাংসভোজী সেই রাক্ষস ভয়ংকর গর্জন করতে করতে বেগে ভীমসেনের সম্মুখে এসে উপস্থিত হল। বলবান সেই রাক্ষস বাম হস্তদ্বারা ভীমের হস্ত ধারণ করল। আর তৎক্ষণাৎ দক্ষিণহস্তে বজ্রের মতো দৃঢ় মুষ্টিবন্ধন করে ভীমকে প্রহার করল। ভীম সেই আঘাত বজ্রের মতো আঘাত বোধ করলেন। রাক্ষস হস্ত দিয়ে হস্ত ধারণ করে রেখেছিল এবং অন্যহস্তে মুষ্টিপ্রহার করছিল; মহাবাহু ভীম তা সহ্য করলেন না, তিনি প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হলেন। তখন সর্বাস্ত্রনিপুণ ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের মতো ভীম ও হিড়িম্বরাক্ষসের ভয়ংকর তুমুল যুদ্ধ হল৷ বলবান ও উৎসাহী ভীমসেন দীর্ঘকাল রাক্ষসের সঙ্গে খেলা করে তারপর সেই দুর্বল রাক্ষসকে বধ করলেন। তারপর ভীম হিড়িম্বকে বধ করে, ভ্রাতাদের সঙ্গে হিড়িম্বাকে নিয়ে প্রস্থান করলেন, যে হিড়িম্বার গর্ভে ঘটোৎকচের জন্ম হয়েছিল। শত্ৰুবিজয়ী পাণ্ডবেরা এরপরে ব্রাহ্মণগণকে সঙ্গে নিয়ে মাতা কুন্তীর সঙ্গে একচক্রাপুরী অভিমুখে যাত্রা করলেন। প্রস্থান করবার পরে বেদব্যাস এঁদের মন্ত্রী, প্রিয়কার্যকারী ও হিতৈষী হয়েছিলেন, তারপর পাণ্ডবেরা ব্রহ্মচারী হয়ে একচক্রাপুরে গমন করলেন। সেখানেও তাঁরা হিড়িম্বরাক্ষসেরই তুল্য ভয়ংকর ও মহাবল বকনামক রাক্ষসের উপদ্রব ভোগ করেছিলেন। বীরশ্রেষ্ঠ ভীমসেন সেই ভয়ংকর বক রাক্ষসকেও বধ করে, ভ্রাতাদের সঙ্গে দ্রুপদরাজার রাজধানীতে গমন করেন।

“কৃষ্ণ, তুমি যেমন ভীষ্মক রাজার কন্যা রুক্মিণীকে জয় করেছ, তেমনই সেখানেই অর্জুন মহাযুদ্ধে অন্যের দুষ্কর গুরুতর কার্য করে স্বয়ংবরে আমাকে লাভ করেন। কৃষ্ণ! এইরূপ অনেক দুঃখ পেয়ে, কুন্তী দেবীকে ছেড়ে পুরোহিত ধৌম্যকে অগ্রবর্তী করে আমরা এখানে বাস করছি। সিংহের মতো বিক্রমী, অন্যদের থেকে অধিক বিক্রমশালী সেই পাণ্ডবেরা নিকৃষ্ট ব্যক্তিদ্বারা আমার অপমান ও অসম্মান দেখেও কেন আমাকে উপেক্ষা করছেন। নিকৃষ্ট, পাপাত্মা ও পাপকর্মা দুর্যোধন প্রভৃতির জন্য আমি এই দুঃখ দীর্ঘকাল ভোগ করতে করতে কী ভয়ংকর সন্তাপ সহ্য করছি। আমি অলৌকিক উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি পাণ্ডবদের প্রিয়তমা ভার্যা এবং মহাত্মা পাণ্ডুর পুত্রবধূ।

“কৃষ্ণ! মধুসূদন! তবুও সেই আমি শ্রেষ্ঠা ও পতিব্রতা হয়েও, পঞ্চপাণ্ডবের সামনেই কেশ-আকর্ষণে লাঞ্ছনা লাভ করেছি।” এই কথা বলে মৃদুভাষিণী দ্রৌপদী কোমল, সুন্দর পদ্মকোষতুল্য দুই হাতে আপন মুখমণ্ডল আবৃত করে রোদন করতে লাগলেন।

স্তনাব-পতিতৌ পীনৌ সুজাতৌ সুভলক্ষণৌ।

অভ্যবৰ্ষত পাঞ্চালী দুঃখজৈরশ্রুবিন্দুভিঃ॥ বন : ১১ : ১২৪ ॥

“এবং তিনি উন্নত, পীবর, সুগোল ও সুলক্ষণ স্তন দুটিকে দুঃখজাত অশ্রুবিন্দু দ্বারা সিক্ত করতে লাগলেন।” আর তিনি নয়নযুগল মার্জনা করে বারবার নিশ্বাস ত্যাগ করতে থেকে, ক্রুদ্ধ হয়ে বাষ্পপূর্ণ কণ্ঠে এই কথা বলতে লাগলেন—

নৈব মে পতয়ঃ সন্তি ন পুত্ৰা ন চ বান্ধবাঃ।

ন ভ্রাতরো ন চ পিতা নৈব ত্বং মধুসূদন!॥ বন : ১১ : ১২৬ ॥

“মধুসুদন! আমার পতিরা নেই, পুত্রেরা নেই, বান্ধবরা নেই, ভ্রাতারা নেই, পিতা নেই এবং তুমিও নেই।”

“ক্ষুদ্ররা আমাকে নির্যাতিত করল, অথচ তোমরা আমাকে সুস্থার মতোই উপেক্ষা করছ। তারপর, কর্ণ তখন আমাকে যে উপহাস করেছিল, তোমরা সেই বিষয়েও কোনও প্রতিকার করছ না। কৃষ্ণ! কেশব! সম্পর্ক, গুরুত্ব, সখিত্ব ও প্রভুত্ব—এই চার কারণেই সর্বদা আমাকে রক্ষা করা তোমার উচিত।”

তখন কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সেই সকল কথা শুনে ক্রুদ্ধ ও অসহিষ্ণু হয়ে বীরসমাজের মধ্যে দাঁড়িয়ে বললেন, “দ্রৌপদী তুমি যাদের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছ, তারা অর্জুনের শরজালে আবৃতদেহ ও নিহত রয়ে রক্তাক্ত কলেবরে ভূতলে শয়ন করবে—সেই দৃশ্য দেখে তাদের ভার্যারাও ঠিক এমনইভাবে রোদন করবে, পাণ্ডবদের জন্য যতদূর করা সম্ভব, তা আমি করব, তুমি রোদন কোরো না। আমি তোমার কাছে সত্য প্রতিজ্ঞা করছি—তুমি রাজমহিষী হবে। যদি স্বর্গ পড়ে যায়, হিমালয় বিশীর্ণ হয়, পৃথিবী খণ্ড খণ্ড হয়ে যায়, সমুদ্র শুষ্ক হয়ে যায়—তা হলেও আমার বাক্য মিথ্যা হবে না।” দ্রৌপদী কৃষ্ণের কথা শুনে আর কোনও কথা বললেন না, অর্জুনের দিকে বক্রভাবে একবার তাকালেন মাত্র। তখন অর্জুন দ্রৌপদীকে বললেন, “দেবি! সুনয়নে! বরবৰ্ণিনি! তুমি রোদন কোরো না; কৃষ্ণ যা বললেন, তা সম্পূর্ণভাবে ঘটবেই, অন্যথা হবে না।” ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন, “আমি দ্রোণকে বধ করব, শিখণ্ডী ভীষ্মকে বধ করবে, ভীম দুর্যোধনকে নিহত করবেন আর অর্জুন কর্ণকে বধ করবেন। ভগিনী! আমরা বলরাম ও কৃষ্ণকে অবলম্বন করে ইন্দ্রের সঙ্গে যুদ্ধেও অজেয় হব। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের সম্পর্কে আর কী বলব?”

*

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। একদিকে হস্তিনাপুরে পাণ্ডবদের শঠতাপূর্ণ দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত করে দুর্যোধন ও তাঁর মিত্রবর্গ আনন্দে আত্মহারা, পরিপূর্ণ ভোগ বিলাসে প্রমত্ত, অন্যদিকে দ্বৈতবনে স্বয়ং ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ঘোষণা করলেন কুরুবংশ ধ্বংস হবে, ধার্তরাষ্ট্রগণ নিহত হবেন, তাঁদের পত্নীরা বিধবা হবে, দ্রৌপদীর কান্নার মূল্য তাঁদের দিতে হবে। কৃষ্ণের এই শপথবাণী সমর্থন করলেন, পাণ্ডবপক্ষীয় অপর দুই অতিরথ—অর্জুন ও ধৃষ্টদ্যুম্ন। তৃতীয় মহারথ ভীমসেন নীরব। কারণ, তাঁর প্রতিজ্ঞা তিনি ঘোষণা করে এসেছেন কৌরব রাজসভায়—বলেছেন দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার জন্য দুঃশাসনের বক্ষোরক্ত পান করবেন। দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করবেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রকে তিনি বধ করবেন। তাঁর প্রতিজ্ঞা কুরুবৃদ্ধদের সামনে, ভারতবর্ষের রাজন্যবর্গের উপস্থিতিতে, তাই নতুন করে ঘোষণার তাঁর আর প্রয়োজন নেই। অভিমানিনী দ্রৌপদীর কৃষ্ণের সম্মুখে কান্না তাই মহাভারতের এক অতি দুর্লভ মুহূর্ত।

৩৫
ধৃতরাষ্ট্রের বিদুর-ত্যাগ

দ্বিতীয়বার পাশাখেলায় পাণ্ডবগণ পরাজিত হয়ে বনে গমন করলেন। অন্ধরাজা ধৃতরাষ্ট্র আপাত নিশ্চিন্ত হয়ে সুখে সিংহাসনে উপবেশন করলেন। কিন্তু এক অশুভ চিন্তা, ভবিষ্যৎ ভাবনা তাঁর মনকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। তিনি জানতেন তেরো বৎসর জীবনের ক্ষেত্রে দীর্ঘকাল নয় আর পাণ্ডবেরাও অমিতবীর্য। সুতরাং তারা ফিরে আসবেই এবং রাজ্য দাবি করবেই। বুদ্ধিমান ব্যক্তি ভবিষ্যতের ভাবনা অনেক পূর্বে করেন। চিন্তাকুল ধৃতরাষ্ট্র তাই বিদুরকে ডেকে পাঠালেন।

বিদুর উপস্থিত হলে ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “বিদুর তুমি শুক্রাচার্যের মতো বুদ্ধিমান। তুমি সূক্ষ্ম ধর্মতত্ত্বও জান আর কৌরবেরাও তোমাকে অপক্ষপাতী বলেই মানে। এখন তুমি পাণ্ডব ও কৌরবদের যাতে হিত হয়, আমাকে তেমন পরামর্শ দাও। ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেছে, পুরবাসীরা কৌরবদের উপর অত্যন্ত অসন্তুষ্ট। সুতরাং কীভাবে তাদের সন্তুষ্ট করা যায় এবং পাণ্ডবেরা ফিরে এসে যাতে আমাদের সমূলে ধ্বংস করতে না পারে তুমি তার উপায় আমাকে বলো। কারণ তুমি কার্য কারণ ও ফলাফল অত্যন্ত অভ্রান্তভাবে নির্ণয় করতে সমর্থ।”

বিদুর বললেন, “মহারাজ ধর্মই অর্থ, কাম ও মোক্ষের মূল এবং নীতি শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তিরা ধর্মকেই রাজ্যের মূল বলে মনে করেন। অতএব আপনার একমাত্র কর্তব্য হওয়া উচিত ধর্মপথে অবিচলিত থেকে শক্তি অনুসারে নিজ পুত্রগণকে ও পাণ্ডুপুত্রগণকে পালন করা। কিন্তু শকুনি প্রভৃতি পাপাত্মারা আপনার উপস্থিতিতেই এই সভামধ্যে সেই ধর্মকে লঙ্ঘন করেছে এবং আপনার পুত্র দুর্যোধন সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে এই সভাতেই এনে দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত করে রাজ্যচ্যুত করেছে। কুরুরাজ যে দুষ্কার্য আপনি করেছেন তা সংশোধন করার কোনও উপায় আমি দেখছি না। আপনার পুত্র পাপমুক্ত হয়ে লোকসমাজে সদাশয় ব্যক্তিরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, এমন কোনও পথ নেই। রাজা আপনি পূর্বে পাণ্ডবদের রাজ্য প্রভৃতি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, আবার আপনি তাই করুন। রাজারা পরধনে লোভ করবেন না, আপন ধনেই সন্তুষ্ট থাকবেন— এই রাজাদের পরম ধর্ম। মহারাজ আপনার এখন প্রধান কর্ম হল পাণ্ডবদের সন্তুষ্ট করা এবং শকুনির অপমান করা। আপনি যদি এই পরামর্শ গ্রহণ করেন, তা হলে আপনার পুত্রদের রাজ্য রক্ষা পাবে। অন্যথায় তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। কারণ, ভীম ও অর্জুন অবশ্যই শত্রুসৈন্য নিঃশেষ করবেন। বাম ও দক্ষিণ, উভয়বস্তু দ্বারা শরসন্ধানকারী ও শিক্ষিতাস্ত্র অর্জুন যাঁদের যোদ্ধা, বাহুবলশালী ভীম যাঁদের যোদ্ধা তাঁদের অপ্রাপ্য পৃথিবীতে কিছুই নেই।

“আপনার পুত্র দুর্যোধন জন্মানোর পরই আমি আপনাকে বলেছিলাম, বংশের অহিতকারী এই পুত্রটিকে ত্যাগ করুন; কিন্তু আপনি আমার সেই হিতকর বাক্য শোনেননি। মহারাজ আবার আপনাকে এই মুহূর্তে আপনার যা হিতকর তা বললাম। আপনি যদি আমার কথা না শোনেন, তবে পরে আপনাকে পরিতাপ করতে হবে। আপনার পুত্র দুর্যোধন যদি সন্তুষ্টচিত্তে পাণ্ডবদের সঙ্গে ভাগ করে রাজত্ব করতে স্বীকার করে, তা হবে অত্যন্ত আনন্দজনক ঘটনা। ফলে আপনারও পরিতাপের কারণ ঘটবে না। না হলে সকলের মঙ্গলের জন্য আপনি দুর্যোধনকে পরিত্যাগ করুন; অহিতকারী দুর্যোধনকে শাস্তি দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে স্থাপন করুন। যুধিষ্ঠির পরের ধন অপহরণ করার ইচ্ছা করেন না, তিনি ধর্ম অনুসারে রাজ্য শাসন করবেন। যুধিষ্ঠির রাজ্যশাসন করলে অন্য রাজারা সকলেই এসে বৈশ্যদের মতো আমাদের সেবা করবেন। আর শকুনি, দুর্যোধন ও কর্ণ পাণ্ডবদের সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ ব্যবহার করুক, আর দুঃশাসন সভার মধ্যে ভীম ও দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুক। আপনিও যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিয়ে সম্মানের সঙ্গে তাঁকে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করুন। আপনি জিজ্ঞাসা করায় আমার যা উচিত বলে মনে হয়, তা বললাম, এই মত অনুযায়ী কাজ করলেই আপনি কৃতকার্য হবেন।”

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “বিদুর তুমি দ্যূতসভায় পাণ্ডবপক্ষ এবং আমার পক্ষ— এই উভয়পক্ষের উপস্থিতিতেই এই কথা বলেছিলে এবং এখন আবার বললে; কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তুমি পাণ্ডবদের হিতকর এবং আমার অহিতকর কথাই বলছ! তুমি পাণ্ডবদের পক্ষে যা বললে, তা এখনই তুমি কীভাবে স্থিরনিশ্চয় হলে? আমার স্পষ্টত বোধ হচ্ছে যে, তুমি আমার হিতৈষী নও। কারণ, আমি কীভাবে পাণ্ডবদের জন্য পুত্রত্যাগ করব? একথা সত্য যে, পাণ্ডবেরাও আমার পুত্র; কিন্তু দুর্যোধন আমার দেহ থেকে উৎপন্ন; সুতরাং ‘পরের জন্য নিজের দেহ ত্যাগ কর’ কোন সাম্যভাব একথা বলতে পারে? অতএব বিদুর! তুমি আমাকে যে সব কথা বলছ, তা দুরভিসন্ধিমূলক। অথচ দেখো, আমি তোমাকে অত্যন্ত গুরুত্ব ও গৌরব দিয়ে দেখি। সে যাই হোক, তুমি এখন ইচ্ছানুসারে চলে যেতে পারো। অসতী স্ত্রীকে মধুর কথায় সান্ত্বনা দিলেও সে স্বামী পরিত্যাগ করে।”

এই বলে ধৃতরাষ্ট্র সিংহাসন ত্যাগ করলেন এবং বিদুরকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অন্তঃপুরে চলে গেলেন। ক্রুদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র এভাবে অনাদর প্রকাশ করে চলে যাওয়ায় বিদুর অত্যন্ত দুঃখিত চিত্তে স্বগতোক্তি করলেন, “এ বংশ ধ্বংস পেয়েছে।” একথা উচ্চারণ করে বিদুর হস্তিনাপুর ত্যাগ করে পাণ্ডবগণের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।

এদিকে পাণ্ডবেরা বনবাস স্থির করে, অনুচরদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, গঙ্গাতীর থেকে কুরুক্ষেত্রের উদ্দেশে গমন করলেন। তাঁরা সরস্বতী, দৃশদ্বতী ও যমুনানদীতে স্নান করে, সমস্ত পথ পশ্চিম দিক লক্ষ্য করে, বনপথে কাম্যক বনের দিকে চলতে লাগলেন। তারপর, তাঁরা সরস্বতী নদীর তীরে পার্বত্য সমতলভূমিতে নানাবিধ তরুলতা ও সুস্বাদু ফলপূর্ণ স্থানে মুনিজনের অত্যন্ত প্রিয় কাম্যক বন দর্শন করলেন। সেই কাম্যক বন বহুতর পশুপাখি সমাকীর্ণ ছিল। কিন্তু সেখানে হিংসা ছিল না। চারপাশে অসংখ্য সৎ-স্বভাব মুনি ঋষি ছিলেন। পাণ্ডবেরা সেখানে কুটির নির্মাণ করে বাস করতে লাগলেন। মুনিরা তাঁদের কাছে প্রত্যহ আসতেন। উপদেশ দিতেন, সান্ত্বনা দিয়ে আশ্বস্ত করতেন।

বিদুর পাণ্ডবদের খবর সব সময়ে রাখতেন। তিনি জানতেন যে, পাণ্ডবেরা কাম্যক বনে বাস করছেন। বিদুর পাণ্ডবদের সর্বদা হিতাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। এখন দর্শনাকাকাঙ্ক্ষী হয়ে একা একটি রথে আরোহণ করে সেই ফলসমৃদ্ধি-সম্পন্ন কাম্যক বনে প্রবেশ করলেন। দ্রুতগামী অশ্বচালিত সেই রথে বিদুর ব্রাহ্মণগণ, ভ্রাতৃগণ ও দ্রৌপদীর সঙ্গে পবিত্রস্থানে উপবিষ্ট যুধিষ্ঠিরকে দেখতে পেলেন।

সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির বিদুরকে দীনভাবে তাঁর দিকে আসতে দেখে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হলেন। তিনি ভীমসেনকে বললেন, “বিদুর এসে আবার আমাদের কী বলবেন? শকুনির প্রস্তাব অনুযায়ী আবার আমাদের দ্যূতক্রীড়ায় আহ্বান করবেন না তো? আমাদের তো এখন সম্বল শুধু আমাদের অস্ত্রগুলি। ক্ষুদ্রপ্রকৃতি শকুনি পুনরায় দ্যূতক্রীড়া করে আমাদের অস্ত্রগুলি হরণ করবে না তো?”

সমাহূতঃ কেনচিদাদ্রবেতি নাহং শক্তো ভীমসেনাপযাতুম্‌।

গাণ্ডীবে চ সংশয়িতে কথং নো রাজ্যপ্রাপ্তিঃ সংশায়িতা ভবেন্নঃ॥ বন : ৬ : ৯ ॥

“ভীম! দ্যূতক্রীড়া বা যুদ্ধ করবার জন্য কেউ আমাকে ‘এসো’ বলে আহ্বান করলে আমি ফিরতে পারি না; সুতরাং গাণ্ডিব ধনু যদি সংশয়াপন্ন হয়, তবে আমাদের রাজ্যলাভ করাও সংশয়াপন্ন হয়ে পড়বে না কেন?”

পাণ্ডবেরা সকলে গাত্রোত্থান করে বিদুরকে সাদরে গ্রহণ করলেন। অজমীরবংশীয় বিদুরও প্রত্যেককে যথাযোগ্য সংবর্ধনা করলেন। বিদুর কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে সুস্থ হলে, নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবেরা তাঁর আগমনের কারণ জিজ্ঞাসা করলেন। বিদুরও বিশদভাবে তাদের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের ব্যবহারের বর্ণনা দিলেন।

বিদুর বললেন, “যুধিষ্ঠির আমি ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রী ছিলাম। তিনি আমাকে ডেকে যথোচিত সম্মান দিয়ে বলেছিলেন, ‘বিদুর! এই ঘটনায় তুমি সাম্যভাব অবলম্বন করে পাণ্ডবদের ও আমার হিতের কথা বলো।’ আমি কৌরবদের যথাযোগ্য হিতের কথা, বিশেষত ধৃতরাষ্ট্রের হিতের কথা বলেছিলাম; কিন্তু সে কথায় তাঁর রুচি হয়নি। আমি যা সঙ্গত বিবেচনা করেছিলাম, তা ভিন্ন অন্য কিছুই বলিনি। আমি অত্যন্ত মঙ্গলের কথাই বলেছিলাম; কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র আমার কথা কিছুই শোনেননি। রোগার্তের যেমন হিতকর খাদ্যে রুচি হয় না, ধৃতরাষ্ট্রেরও তেমনই আমার কথায় রুচি হয়নি। যুধিষ্ঠির! শ্রোত্রিয়ের ঘরের দুষ্ট স্ত্রীকে যেমন ভালর দিকে নেওয়া যায় না, ধৃতরাষ্ট্রকেও তেমনই ভালর দিকে নেওয়া যায়নি। কারণ, কুমারীর যেমন ষাট বছরের পতির প্রতি রুচি হয় না, ধৃতরাষ্ট্রেরও তেমন আমার কথায় রুচি হয়নি। কৌরবদের বিনাশ নিশ্চিত, কারণ ধৃতরাষ্ট্র হিতোপদেশ গ্রহণ করেন না। পদ্মপাতায় যেমন জল থাকে না, তেমনই ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয়ে হিতোপদেশ থাকে না। হে ভরতনন্দন, শেষে ধৃতরাষ্ট্র ক্রুদ্ধ হয়ে আমাকে বলেছেন যে, তোমার যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও, আমি রাজ্য বা রাজধানী রক্ষায় তোমার সহায়তা আর চাই না।”

“অতএব রাজা আমি ধৃতরাষ্ট্র কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়ে তোমাকে উপদেশ দেওয়ার জন্য এসেছি। আমি সেই দ্যূতসভায় তোমাকে যা বলেছিলাম, তা মনে রাখো অথবা আমি তা আবার বলব। শত্রুরা গুরুতর কষ্টের মধ্যে ফেললেও যে-রাজা ক্ষমা করে কাল প্রতীক্ষা করেন, সেই বুদ্ধিমান রাজা তৃণের অল্প অগ্নির দ্বারা আপনাকে বর্ধিত করে ভবিষ্যতে একাকীই পৃথিবী ভোগ করতে পারেন। যে রাজা সহায়দের সঙ্গে অবিভক্তরূপে ধন ভোগ করে থাকেন, সহায়েরাও তাঁর দুঃখকে সমানভাবে ভাগ করে নেয়। সহায় সংগ্রহের এই হল উপায়; সহায় সংগ্রহ হলে রাজ্যলাভও হয়ে থাকে। পাণ্ডুনন্দন, সত্য আশ্রয় করে, অনর্থক বাক্য পরিত্যাগ করে, মাঙ্গলিক দ্রব্য ও অন্ন-সহায়দের সঙ্গে সমানভাবে ভোগ করবে এবং সহায়দের সম্মুখে আত্মপ্রশংসা করবে না; এই চরিত্রের রাজাই উন্নতিলাভ করেন।”

যুধিষ্ঠির বললেন, “আপনি যেমন বললেন, আমি আপনার বুদ্ধি অনুসারে সাবধানে তেমনই করব। দেশ ও কালের উপযুক্ত আরও যা আছে, তাও বলুন। আমি সে সমস্তও করব।”

ওদিকে বিদুর পাণ্ডবদের আশ্রমে চলে গেলে রাজা ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত অনুতপ্ত হলেন। ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত ভীত হয়েও পড়লেন। কারণ সন্ধি ও বিগ্রহের বিষয়ে বিদুরের বুদ্ধিনৈপুণ্য এবং তাঁর পরামর্শ ভাবীকালে পাণ্ডবদের অশেষ উন্নতির সহায়ক হয়ে উঠবে, এই কথা ভেবে ধৃতরাষ্ট্র সভার দ্বারে এসে, বিদুরকে স্মরণ করে শোকাবিষ্ট চিত্তে রাজাদের সমক্ষেই মূর্ছিত হয়ে ভূতলে পতিত হলেন। তিনি পুনরায় চৈতন্য লাভ করে, ভূতল থেকে উঠে, নিকটে উপস্থিত সঞ্জয়কে বললেন, “সঞ্জয়, বিদুর আমার ভাই ও বন্ধু, সুতরাং তাঁকে স্মরণ করে আমার হৃদয় একেবারে বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অতএব, তুমি অবিলম্বে সেই বিদুরকে আমার কাছে নিয়ে এসো।” এই বলে ধৃতরাষ্ট্র দীনভাবে বিলাপ করতে লাগলেন। বিদুরকে স্মরণ করে ধৃতরাষ্ট্র আবার সঞ্জয়কে বলেন, “যাও সঞ্জয় আমার ভ্রাতা বেঁচে আছে কি না জানো। আমি পাপাত্মা, ক্রোধের বশে তাকে বার করে দিয়েছি। জ্ঞানী ও অমিতবুদ্ধি ভ্রাতা বিদুর কোনওদিন আমার কোনও অপ্রিয় কাজ করেনি। অথচ অত্যন্ত বুদ্ধিসম্পন্ন সেই বিদুর আমার কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় ব্যবহার লাভ করেছে। অতএব প্রাজ্ঞ সঞ্জয়, তাকে না পেলে আমি প্রাণত্যাগ করব; সুতরাং তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এসো।”

সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের কথা শুনে, তাঁকে সম্মান জানিয়ে “নিশ্চয় নিয়ে আসব” এই কথা বলে, কাম্যক বনের দিকে দ্রুত গমন করলেন। অচিরকালের মধ্যেই সঞ্জয় কাম্যক বনে উপস্থিত হলেন। তিনি কৃষ্ণমৃগচর্মে আবৃত যুধিষ্ঠিরকে দেখতে পেলেন। সেইখানে যুধিষ্ঠির, বিদুর ও বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণ একত্রে বসে ছিলেন আর দেবতারা যেমন ইন্দ্রকে রক্ষা করেন, তেমনই ভীম তাঁদের রক্ষা করছিলেন। সঞ্জয় কাছে গিয়ে অভিবাদন করে যুধিষ্ঠিরকে সম্মান জানালেন, আবার ভীম অর্জুন নকুল সহদেব তাঁকে অভিবাদন জানালেন। সঞ্জয় সুখে উপবেশন করে বিশ্রাম গ্রহণ করলে, যুধিষ্ঠির তাঁকে কুশল প্রশ্ন করে, আগমনের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। তখন সঞ্জয় বললেন, “বিদুর, অম্বিকানন্দন রাজা ধৃতরাষ্ট্র আপনাকে স্মরণ করেছেন। আপনি সত্বর গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন এবং তাঁকে সঞ্জীবিত করুন। আপনি নরশ্রেষ্ঠ পাণ্ডবগণের অনুমতি নিয়ে, রাজশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ অনুসারে হস্তিনায় চলুন।”

সঞ্জয় একথা বললে, বুদ্ধিমান ও সজ্জন বৎসল বিদুর যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে পুনরায় হস্তিনায় ফিরে এলেন। তখন মহাবল ও প্রতাপশালী ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে বললেন, “হে নিষ্পাপ ধর্মজ্ঞ বিদুর, ভাগ্যবশত তুমি আবার ফিরে এসেছ, ভাগ্যবশতই তুমি আমাকে স্মরণ করেছ। রাত্রি ও দিনে তোমার জন্য আমার নিদ্রা হয়নি, আমার এই দেহটাকেই আমার অদ্ভুত বোধ হচ্ছে।” ধৃতরাষ্ট্র এই বলে, বিদুরকে কোলে তুলে নিলেন এবং তাঁর মস্তক আঘ্রাণ করলেন। ধৃতরাষ্ট্র পূর্বে বিদুরকে কটুবাক্য বলার জন্য তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলেন।

বিদুর বললেন, “মহারাজ আপনি আমার পরমগুরু, সুতরাং আমি পূর্বেই ক্ষমা করেছি। আমিও আপনাকে দেখার জন্য উৎকণ্ঠিত ছিলাম, তাই আপনার আদেশ পাওয়া মাত্রই আমি চলে এসেছি। নরশ্রেষ্ঠ, ধার্মিক লোকেরা দুর্বলের পক্ষপাতী হয়ে থাকেন, সুতরাং এ বিষয়ে আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার কাছে পাণ্ডু পুত্রগণ যেমন, আপনার পুত্রগণও তেমনই। পাণ্ডুপুত্রেরা এখন দৈন্যপীড়িত, তাই আমার মন এখন তাদের পক্ষেই গিয়েছে।”

রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুর পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন এবং সুগভীর আনন্দ লাভ করলেন।

*

আমরা মহাভারতের আর একটি দুর্লভ মুহূর্ত পেরিয়ে এলাম। দুটি চরিত্র আমাদের সামনে উদ্‌ঘাটিত হল। ধৃতরাষ্ট্র আর বিদুর। দুই বৈমাত্রেয় ভ্রাতা। দুজনেই ব্যাসদেবের সন্তান। বিদুর পারশব পুত্র! তাই তিনি সিংহাসনের অধিকারী ছিলেন না। ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে মহামন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছিলেন। বিদুর পরিপূর্ণ ধর্মনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন। মহাভারতে যুধিষ্ঠির ছাড়া তাঁর মতো ধর্মপরায়ণ মানুষ আর ছিলেন না। তিনি রাজধর্ম, ন্যায়ধর্ম জানতেন। অত্যন্ত স্পষ্টবাদী, ঋজু চরিত্রের এই মানুষটি দুর্যোধনের কোনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময়ে কুরুবৃদ্ধেরা যখন নীরব, তখন বিদুর প্রতিবাদে সোচ্চার। কুরুবংশের, কৌরবদের অকল্যাণকর অহিতকর কোনও অবস্থাই বিদুর মেনে নেননি। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা সোচ্চারে উচ্চারণ করতে দ্বিধা করতেন না। ধর্মে তিনি আবৃত ছিলেন, তাই রাজার মনোরঞ্জন প্রধান কর্ম হিসাবে বিবেচনা করেননি।

ধৃতরাষ্ট্র মহাবলশালী রাজা ছিলেন। কিন্তু তিনি ছিলেন পুত্রস্নেহে অন্ধ। ধৃতরাষ্ট্র নির্বোধ ছিলেন না। বিদুরের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাও ছিল। কিন্তু বর্তমান কাহিনিতে ভ্রাতৃস্নেহ যতটা ফুটেছে, তার থেকে বেশি ফুটেছে তাঁর উদ্বেগ, বিদুরের বুদ্ধি ও দুরদর্শিতা পাণ্ডবদের সঙ্গে যুক্ত হলে কৌরবদের পক্ষে তা যে চুড়ান্ত ক্ষতিকর হবে, তা তিনি অনুমান করেছিলেন। ভ্রাতৃস্নেহ, উদ্বেগ ও কিছু পরিমাণে অভিনয় মিশ্রণে বর্তমান মূহূর্তটি অতি উজ্জ্বল।

৩৬
মৈত্রেয় মুনির অভিশাপ

বিদুর আবার ফিরে এসেছেন এবং ধৃতরাষ্ট্র তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁকে শান্ত করেছেন, এই সংবাদে দুর্মতি দুর্যোধন অত্যন্ত পরিতপ্ত হলেন। তখন তিনি কর্ণ, দুঃশাসন ও শকুনিকে ডেকে গোপন মন্ত্রণাসভায় বসলেন। পাণ্ডব বিদ্বেষে দুর্যোধন ভালমন্দ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞান হয়ে বললেন, “পাণ্ডবদের বন্ধু এবং হিতার্থী, কৌরবদের সমস্ত বিষয়ে অবগত বিদুর রাজ-আজ্ঞায় আবার হস্তিনায় ফিরে এসেছেন। বিদুর পাণ্ডবদের পক্ষপাতী, তিনি নিশ্চয়ই চেষ্টা করবেন যাতে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের অনুকূল হিত আচরণ করেন। অতএব বন্ধুগণ, বিদুরের সেই চেষ্টা ফলবতী হওয়ার আগেই আপনারা আমার হিতের জন্য পরামর্শ করুন। আমি যদি পাণ্ডবদের আবার হস্তিনায় দেখি তবে নির্ধন হব, পিতৃ অনুগ্রহে বঞ্চিত হয়ে পুনরায় শুষ্ক পাতার মতো ঝরে পড়ব। তা হলে আমি বিষভক্ষণ করব, গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করব, নিজেকে অস্ত্রাঘাত করব অথবা আগুনে প্রবেশ করব।”

শকুনি বললেন, “রাজা তুমি মূর্খের মতো আচরণ করছ। পাণ্ডবেরা শপথ করে বনবাস গিয়েছে। সুতরাং, শপথ পালন না করে তারা ফিরে আসবে না। পাণ্ডবেরা সকলেই সত্যবাদী, তারা কখনওই তোমার পিতার অনুরোধে সত্য পালনের পূর্বে ফিরবে না। যদি তারা সত্যই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ফিরে আসে, তখন আমরা তাদের সম্বন্ধে ভাবব। তখন আমরা সকলেই রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মতের অনুবর্তী হয়ে, নিজেদের অভিপ্রায় গোপন রেখে, পাণ্ডবদের ছিদ্র অনুসন্ধান করতে থাকব। বর্তমানে আমাদের পক্ষে নিরপেক্ষ থাকাই সঙ্গত।”

দুর্যোধন বললেন, “মহাপ্রাজ্ঞ মাতুল, আপনার কথা অত্যন্ত সঙ্গত। আপনি যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলেন বলেই আপনার কথা এত ভাল লাগে।”

কর্ণ বললেন, “দুর্যোধন তোমার অভীষ্ট বিষয়ে আমরা সর্বদাই পর্যালোচনা করে থাকি, এবং এই কারণেই আমরা একমত হয়ে থাকি। আমার নিজের বিশ্বাস, বুদ্ধিমান পাণ্ডবেরা বারো বছর বনবাস ও এক বছর অজ্ঞাতবাস শেষ না করে ফিরে আসবে না। যদি মোহবশত আসে তখন আবার পাশা খেলেই তাদের জয় করবে।” কর্ণের এ কথা শুনে দুর্যোধন খুব সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। দুর্যোধনের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে কর্ণ তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংশোধন করে উৎসাহের সঙ্গে দুর্যোধন, শকুনি ও দুঃশাসনকে বললেন, “ক্ষত্রিয়গণ আমার যা মত, তা আপনারা শ্রবণ করুন। আমরা সকলেই কৃতাঞ্জলি হয়ে কেবলমাত্র রাজা ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয় অনুষ্ঠান করব অথচ নিজেদের প্রিয় কোনও কাজ করতে পারব না, এ আমি উচিত বোধ করি না। আমরা সকলে মিলে, যুদ্ধসজ্জায় সজ্জিত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে, রথে আরোহণ করে, বনবাসী পাণ্ডবদের বধ করতে যাব। মৃত্যুর পর তারা চির-অজ্ঞাতবাসে চলে যাবে, তখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ ও আমরা সকলেই বিবাদহীন হব। জয় করবার ইচ্ছা যতদিন না তাদের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছে, যতদিন পর্যন্ত তারা শোকার্ত আছে এবং যতদিন পর্যন্ত তারা সহায়হীন থাকছে— তার মধ্যেই তাদের বধ করতে হবে।” কর্ণের একথা শুনে দুর্যোধন প্রভৃতি সকলেই তাঁর অত্যন্ত প্রশংসা করলেন এবং নিজ নিজ রথে আরোহণ করে, পাণ্ডবদের বধ করার উদ্দেশ্যে রাজপ্রাসাদ থেকে বহির্গত হলেন।

তাঁরা প্রাসাদ ত্যাগ করেছেন, এই বিষয়টি দূরদর্শী ও ভবিষ্যদ্‌দ্রষ্টা ব্যাসদেব জানতে পেরে তাঁদের এসে নিষেধ করলেন। জগতের মাননীয়, পরম ঐশ্বর্যশালী সেই ব্যাসদেব অতি দ্রুত ধৃতরাষ্ট্রের নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন, “মহাপ্রাজ্ঞ ধৃতরাষ্ট্র, আমার কথা শ্রবণ করো; আমি সকল কৌরবের বিশেষ হিতের কথা তোমাকে বলব। দুর্যোধন এবং তার মন্ত্রণাদাতারা শঠতাপূর্বক পাণ্ডবদের পরাজিত করেছে, সেই অবস্থায় তারা বনে গিয়েছে, তা আমার প্রীতিকর হয়নি। কারণ, তেরো বছর পূর্ণ হলে, তারা এই সর্বপ্রকার ক্লেশ স্মরণ করে ক্রুদ্ধ হয়ে এসে কৌরবদের উপর বিষ উগরে দেবে, পাপমতি ও অত্যন্ত অল্পবুদ্ধি তোমার এই পুত্র রাজ্যের জন্য সর্বদা ক্রুদ্ধ হয়ে পাণ্ডবদের কেন বিনাশ করতে চাইছে?

“এই মূর্খটাকে ভাল করে বারণ করো, তোমার ওই পুত্র শান্তিলাভ করুক। না হলে এই দুর্যোধন বনবাসী পাণ্ডবদের বধ করতে গিয়ে নিজেই প্রাণত্যাগ করবে। পাণ্ডবদের নির্যাতনের বিষয় বুদ্ধিমান বিদুর, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এবং আমরা যেমন নির্দোষ, তুমিও সেইরকম নির্দোষ। স্বজনের সঙ্গে বিবাদ করা অত্যন্ত নিন্দার কার্য, অতএব তুমি সেই পাপজনক ও নিন্দাজনক কাজ কোরো না। পাণ্ডবদের প্রতি দুর্যোধনের যেমন বিদ্বেষ জন্মেছে, তা যদি তুমি উপেক্ষা করো, তবে সেই বিদ্বেষবুদ্ধি গুরুতর অন্যায়ের সৃষ্টি করবে।

“রাজা তোমার এই দুর্মতি পুত্র সহায়শূন্য হয়ে একাকী বনগমন করুক ও বনে পাণ্ডবদের সঙ্গে বাস করুক। পাণ্ডবদের সঙ্গে বসবাসের ফলে তোমার পুত্রের যদি পাণ্ডবদের বিষয়ে স্নেহ জাগে, তা হলে তুমি কৃতকার্য হবে। তবে মানুষের জন্মজাত স্বভাব, মরলেও পরিবর্তিত হয় না। তুমি, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ ও বিদুর দুর্যোধনের মনের এই শত্রুতাবোধ সংশোধনের কী উপায় চিন্তা করছ? এই বৈরীভাব ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে।”

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “ভগবন্! আমারও ইচ্ছা ছিল না যে, দ্যূতক্রীড়া হয়। সুতরাং আমি মনে করি যে, দৈবই আমাকে টেনে নিয়ে তা করিয়েছে। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুরেরও দ্যূতক্রীড়ায় কোনও ইচ্ছা ছিল না, গান্ধারীও তা অনুমোদন করেননি। তবুও মোহবশতই তা ঘটিয়েছিলাম। আমি দুর্যোধনকে চিনতে পেরেও পুত্রস্নেহবশত সেই নির্বোধকে ত্যাগ করতে পারছি না।”

বেদব্যাস বললেন, “বিচিত্রবীর্যনন্দন রাজা, তুমি সত্য কথাই বলেছ। আমরাও দৃঢ়ভাবে জানি যে পুত্ৰই উত্তম, পুত্র অপেক্ষা উত্তম জগতে আর কোনও বস্তুই নেই। সুরভির অশ্রুপাতও ইন্দ্রকে বুঝিয়ে দিয়েছিল যে, প্রাণীগণও অন্য যে কোনও বস্তু অপেক্ষা পুত্রকে উত্তম বলে মনে করেন। অনেককাল পূর্বে একদিন ইন্দ্র দেখলেন যে স্বর্গস্থিতা গোমাতা সুরভি রোদন করছেন। তাঁকে দেখে ইন্দ্রের দয়া জন্মাল। ইন্দ্র তাঁকে প্রশ্ন করলেন, ‘কল্যাণী তুমি রোদন করছ কেন? দেবতা, মানুষ ও নাগদিগের মঙ্গল তো? সামান্য কারণে তুমি তো রোদন করো না।’

“সুরভি বললেন, ‘দেবরাজ! আপনার প্রজাদের কোনও অমঙ্গল হয়নি। আমি আমার পুত্রের কষ্ট দেখে ব্যথা পাচ্ছি এবং তাতেই রোদন করছি। দেবরাজ! আপনিই দেখুন, আমার ওই দুর্বল পুত্রটি একে লাঙলের ভারে কাতর, তাতে আবার কৃষকটি তাকে বারবার চাবুকের আঘাত করছে। পুত্রটির বিষণ্ণ ও উৎকণ্ঠিত অবস্থা দেখে আমার কৃপা জন্মেছে, আমার মন উদ্বিগ্ন হয়েছে। আমার অন্য পুত্রটি বলবান ও ভারবহনে সমর্থ। দুর্বল পুত্রটির জন্যই আমি কষ্ট পাচ্ছি।’

“ইন্দ্র বললেন, ‘ভদ্রে! তোমার শত শত পুত্রই তো কৃষক কর্তৃক পীড়িত, তবে একটি পুত্রের পীড়িত হওয়ার কারণে দুঃখ পাচ্ছ কেন?’

“সুরভি বললেন, ‘দেবরাজ! আমার সকল পুত্রের প্রতি আমার সমভাব আছে। তবে দুর্বলের উপর আমার অধিক দয়া থাকে।’ ইন্দ্র সুরভির কথা শুনে বুঝতে পারলেন জীব জীবন অপেক্ষাও পুত্রকে অধিক প্রিয় মনে করে। দয়াপরবশ হয়ে ইন্দ্র সেই স্থানেই প্রবলবেগে বারিবর্ষণ শুরু করলেন। কৃষকের কার্যে বিঘ্ন ঘটল। সে তখন কার্য স্থগিত রাখতে বাধ্য হল।”

ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ব্যাসদেব সুরভির কাহিনি বর্ণনা করে বললেন, “রাজা সুরভির বক্তব্য অনুসারে তোমার সকল পুত্রের উপর সমান ভাব থাক এবং দুর্বলের প্রতি অধিক দয়া হোক। আমার কাছে পাণ্ডু যেমন, তুমি এবং বিদুরও তেমনই। কিন্তু তুমি জীবিত এবং তোমার একশত পুত্র বর্তমান, আর পাণ্ডু মৃত এবং তাঁর পাঁচটি মাত্র পুত্র। তাঁরা চিরদিন শঠতায় অনিপুণ এবং বর্তমানে অত্যন্ত দুঃখিত অবস্থায় আছে। পাণ্ডবেরা কীভাবে বাঁচবে, কীভাবে উন্নতি লাভ করবে সেই ভাবনায় আমার মন উদ্বিগ্ন। কৌরবদের জীবন, দুর্যোধনের পাণ্ডবদের প্রতি বৈরীভাব ত্যাগের উপর নির্ভর করছে।”

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “হে মহাপ্রাজ্ঞ ঋষি। আপনি আমার কাছে যা বললেন, তা সত্য। বিদুর, ভীষ্ম এবং দ্ৰোণও কৌরবদের হিতের বিষয়ে আমাকে একই কথা বলেছেন। যদি আমি আপনার অনুগ্রহের পাত্র হই এবং যদি কৌরবদের প্রতি আপনার দয়া থাকে, তবে আপনি আমার দুরাত্মা পুত্র দুর্যোধনকে এই উপদেশ দান করুন।”

বেদব্যাস বললেন, “রাজা ভগবান মৈত্রেয় মুনি পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করে আমার সঙ্গে দেখা করবার জন্য এখানেই আসছেন। এই মহর্ষিই কুরুকুলের শান্তির জন্য তোমার পুত্র দুর্যোধনকে উপদেশ দেবেন। তিনি যা বলবেন, নিঃসন্দেহে তুমি তাই করবে, অন্যথায় তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে তোমার পুত্রকে অভিসম্পাত করবেন।” এই বলে বেদব্যাস চলে গেলেন এবং মৈত্রেয় মুনিকে দেখা গেল। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণের সঙ্গে সম্মানপূর্বক মৈত্রেয় মুনিকে গ্রহণ করলেন। মৈত্রেয় বিশ্রাম করলেন। ধৃতরাষ্ট্র অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে অর্ঘ্য প্রভৃতির দ্বারা তাঁর পূজা করলেন এবং বললেন, “ভগবন্‌, আপনি কুরুজাঙ্গল থেকে সুখে আগমন করেছেন তো? বীর পঞ্চ-পাণ্ডব ভ্রাতারা কুশলে আছে তো? পঞ্চ-পাণ্ডব শপথ অনুসারে কর্তব্য পালন করবে তো? কৌরব-পাণ্ডবের সদ্ভাব বজায় থাকবে তো?”

মৈত্রেয় বললেন, “মহারাজ আমি তীর্থভ্রমণের উপক্রমে কুরুজাঙ্গল থেকে আপনার কাছে এসেছি; আমি যদৃচ্ছাক্রমে কাম্যকবনে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছি। সেখানে জটা ও মৃগচর্মধারী তপোবনবাসী মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য অনেক মুনিও এসেছিলেন। সেখানে শুনলাম যে আপনার পুত্রগণের ভ্রান্ত অন্যায় ব্যবহাররূপ দ্যূতক্রীড়ার ফলে কৌরববংশে মহাভয় উপস্থিত হয়েছে। কৌরববংশকে সেই মহাভয় থেকে মুক্ত করার জন্য ও সেই বংশের মঙ্গল সাধনের জন্য আপনার কাছে এসেছি। মহারাজ! আপনি ও ভীষ্ম জীবিত থাকতেই আপনার পুত্রেরা পরস্পর বিরোধ করছে, এটা কোনওক্রমেই উচিত নয়। কারণ, আমি মনে করি, আপনি কৌরব ও পাণ্ডব প্রভৃতির বিরোধে অথবা মিলনে শস্যমর্দনক্ষেত্রের মধ্যবর্তী স্তম্ভের তুল্য। সুতরাং এই উৎপন্ন ভয়ংকর অন্যায় আপনি কেন উপেক্ষা করছেন? সভার মধ্যে দস্যুদের মতো যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে আপনি আর তপস্বীদের মধ্যে শোভা পেতে পারেন না।” তারপর, ভগবান মৈত্রেয় মুনি ফিরে কোমল বাক্যে কোপন স্বভাব দুর্যোধনকে বললেন, “মহারাজ বাগ্মীশ্রেষ্ঠ! মহাভাগ! দুর্যোধন! আমি তোমার হিতের কথা বলছি শ্রবণ করো। পাণ্ডবদের সঙ্গে বিদ্রোহ কোরো না। নিজের, পাণ্ডবদের, কৌরবদের এবং জগতের প্রিয় কার্য করো। পাণ্ডবেরা সকলেই নরশ্রেষ্ঠ। বীর এবং বিক্রমের সঙ্গে যুদ্ধকারী এবং তাঁরা সকলেই দশসহস্র হস্তীর তুল্য বলশালী ও বজ্রের ন্যায় দৃঢ়শরীর। পাণ্ডবেরা সকলেই সত্যপালনতৎপর, সকলেই পুরুষাভিমানী এবং দেবশত্রু এবং কামরূপী হিড়িম্ব ও বক প্রভৃতি রাক্ষসগণ এবং কির্মীর রাক্ষসের নিধনকর্তা। তাঁদের যাত্রাপথে ভয়ংকরমূর্তি কির্মীর রাক্ষস পথরোধ করে দাঁড়ালে, বাঘ যেমন ক্ষুদ্র হরিণকে বধ করে, বলবান ভীম সেই কির্মীর রাক্ষসকে বধ করেছে। দশ সহস্র হস্তীর তুল্য বলশালী জরাসন্ধও ভীমের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয়েছে। কৃষ্ণ যাঁদের আত্মীয়, ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি যাঁদের শ্যালক, তাদের সঙ্গে যুদ্ধে জরামরণশালী কোন মানুষ অবস্থান করতে পারে? অতএব রাজা ক্রোধ দমন করো, পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করো, আমার কথা অনুযায়ী কাজ করো।”

মৈত্রেয় মুনি এই কথা বললে, দুর্যোধন তাঁকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাতির শুঁড়ের মতো তার আপন ঊরুতে হাতের চাপড় মারতে লাগল এবং মৈত্রেয় মুনির কোনও কথার উত্তর না দিয়ে পায়ের আঙুলের দ্বারা মাটি তুলতে তুলতে মাথা নিচু করে বসে থাকল। দুর্যোধন কথা শুনতে চাইছেন না দেখে মৈত্রেয়ের ভয়ংকর ক্রোধ জন্মাল। ক্রোধে আরক্তনয়ন মৈত্রেয় জল স্পর্শ করে দুরাত্মা দুর্যোধনকে অভিশাপ দিলেন, “যেহেতু তুমি আমাকে অগ্রাহ্য করে, আমার কথা অনুযায়ী কাজ না করে, আমাকে উপেক্ষা করছ, সেইহেতু তুমি এর ফল ভোগ করবে। তোমার এই বিদ্রোহের কারণে ভয়ংকর যুদ্ধ ঘটবে এবং সেই যুদ্ধে বলবান ভীমসেন গদার আঘাতে তোমার ঊরুভঙ্গ করবে।”

রাজা ধৃতরাষ্ট্র মৈত্রেয়ের অভিসম্পাত শুনে অত্যন্ত ভীত হলেন এবং মহর্ষি মৈত্রেয়কে প্রসন্ন করার জন্য শশব্যস্তে উঠে দাঁড়িয়ে মিনতি করতে লাগলেন, “মহর্ষি, আপনি প্রসন্ন হোন, আপনার আদেশ অনুয়াযী ঘটনা যেন না ঘটে।” এই বলে মিনতি করতে লাগলেন। মৈত্রেয় বললেন, “রাজা আজ থেকে যে-কোনও সময়ে আপনার পুত্র যদি পাণ্ডবদের সঙ্গে সৌভ্রাত্র-জনিত শান্তি লাভ করে, তা হলে আমার এ অভিশাপ ফলবে না। না হলে ফলবে।” এই বলে মৈত্রেয় চলে গেলেন।

*

মৈত্রেয়ের অভিশাপ মহাভারতের এক অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। প্রথমত, দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময়ে তাঁকে বাম ঊরুতে বসানোর আমন্ত্রণ জানিয়ে দুর্যোধন দ্রৌপদীকে বাম ঊরু অনাবৃত করে দেখিয়েছিলেন। সেই অশ্লীল ইঙ্গিতের জন্য দ্যূতসভায় ভীমসেন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যুদ্ধে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ করে তার অশ্লীল আচরণের প্রতিফল দেবেন। ভীমসেনের শপথ উচ্চারণের কিছু পরেই মৈত্রেয় দুর্যোধনকে অভিসম্পাত দিলেন যে, বলবান ভীমসেন গদাঘাতে তার ঊরুভঙ্গ করবেন। দুর্যোধনের গদাঘাতে ঊরুভঙ্গ রূপ ঘটনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে দাঁড়াল। মহর্ষি কণ্বের সঙ্গেও দুর্যোধন ঊরু চাপড়ে কথা বলেছিলেন এবং মহর্ষি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত, এই কাহিনিতে কর্ণের চরিত্রের এক চিত্র সম্যকভাবে উদ্‌ঘাটিত হল। কর্ণও শকুনির মতো বিশ্বাস করতেন যে, শপথ ভঙ্গ করে পাণ্ডবেরা কখনও হস্তিনায় ফিরবেন না। কর্ণ সেকথা উচ্চারণও করেছিলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে কর্ণ বুঝলেন যে তাঁর কথা দুর্যোধনের মনঃপূত হয়নি, নীচ চরিত্রের স্তাবকের মতো কর্ণ মুহূর্তমধ্যে আপন ক্ষণপূর্বের বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে পাণ্ডবদের এই অবস্থায় বধ করার পরামর্শ দিলেন। সে পরামর্শ দুর্যোধনের অত্যন্ত অভিরুচিকর হল। এই ঘটনা কর্ণকে স্বাভিমানী, বীর বলে প্রমাণ করে না। পক্ষান্তরে রাজানুগ্রহপুষ্ট ব্যক্তিত্বহীন স্তাবক বলেই প্রতিভাত করায়।

৩৭
ভীমসেনের কির্মীর রাক্ষস-বধ

ভীমসেন কর্তৃক কির্মীর রাক্ষসবধের কাহিনি প্রথম উপস্থাপনা করেছিলেন মৈত্রেয় মুনি। কিন্তু রাজসভাতে দুর্যোধনের গর্বিত, অসহিষ্ণু ও অগ্রাহ্য করার মানসিকতা দেখে তিনি নিজে সে কাহিনির বর্ণনা করেননি। ধৃতরাষ্ট্রের অনুরোধে বিদুর সে-কাহিনি রাজসভায় উপস্থিত সকলকে জানান। বিদুর জানান তিনি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে ভীমের এই অলৌকিক কর্মের কথা শুনেছেন।

বিদুর বললেন, “দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হবার পর তিনদিন তিন রাত্রি হেঁটে পাণ্ডবেরা কাম্যক বনে উপস্থিত হন। রাত্রি অর্ধ-সময়ের অতীত হলে, নরমাংসভোজী রাক্ষসেরা সেখানে বিচরণ করতে আসে। রাক্ষসের ভয়ে তপস্বীরা, গোপালকের দল এবং অন্য বনচর প্রাণীরা দূর থেকেই কাম্যকে বনকে পরিত্যাগ করে থাকেন। অথচ ঠিক সেই সময়েই পাণ্ডবেরা কাম্যকবনে প্রবেশ করেছিলেন। তখন উজ্জ্বল নয়ন ও মশালধারী ভয়ংকর একটি রাক্ষস তাদের পথরোধ করে উপস্থিত হল। সে রাক্ষস বাহুযুগল ও ভয়ংকর মুখখানা প্রসারিত করে পাণ্ডবদের যাত্রাপথকে অবরুদ্ধ করে দাঁড়াল। সেই রাক্ষসের আটটা দাঁত বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। চোখ দুটি ছিল তামাটে। মাথার চুলগুলি ছিল উজ্জ্বল এবং উঁচু উঁচু। সুতরাং নীচ দিয়ে বকপাখির শ্রেণি চলতে থাকলে, সূর্যের কিরণ উপর দিকে উঠতে লাগলে এবং গোলাকার বিদ্যুৎ প্রকাশ পেতে থাকলে জলবর্ষী মেঘের মতো তাকে দেখাতে লাগল এবং সে রাক্ষসী মায়া আবিষ্কার করেছিল ও হস্তীর ন্যায় গর্জন করছিল। অতএব গর্জনকারী ও জলপূর্ণ মেঘের মতো তাকে দেখা যেতে লাগল। জলজাত পাখিরা সেই রাক্ষসের গর্জনে ভীত হয়ে, নানাবিধ রব করে, জলজাত পাখিদের সঙ্গে সকল দিকে পালাতে লাগল। হরিণ, বাঘ, মহিষ, ভল্লুক প্রভৃতি পশুগণও সেই রাক্ষসের গর্জনে পলায়ন করতে লাগল। সমস্ত বনভূমি আকুল হয়ে পড়ল। দূরবর্তী লতাগুলি সেই রাক্ষসের ঊরুযুগলের বায়ুতে আহত হয়ে তাম্রবর্ণ-পল্লবযুক্ত শাখা দ্বারা বৃক্ষসমূহকে আলিঙ্গন করতে লাগল। অতি ভয়ংকর বায়ু বইতে থাকল; আকাশ ধূলি-জালে আবৃত হল; নক্ষত্রগুলি আর দেখা গেল না।

অজ্ঞাত অতুলনীয় শোকাবেগ যেমন পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে বিকল করে তোলে, সেইভাবে সেই রাক্ষস অজ্ঞাতসারে উপস্থিত হয়ে পাণ্ডবদের বনপ্রবেশের বাধা হয়ে দাঁড়াল। কির্মীর রাক্ষস কৃষ্ণাজিনধারী পাণ্ডবদের দূর হতে দেখে মৈনাক পর্বতের মতো সেই বনে প্রবেশের পথ রুদ্ধ করে দিল। কমলনয়না দ্রৌপদী সেই রাক্ষসকে দেখে অত্যন্ত ভীত হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। দুঃশাসনের আকর্ষণে দ্রৌপদীর কেশকলাপ আলুলায়িত হয়েছিল এবং তখনও তা. সেইভাবেই ছিল। পঞ্চপর্বতের মধ্যবর্তিনী নদীর মতো পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে থেকেও দ্রৌপদী ভয়ে আকুল হয়েছিলেন। পাণ্ডবেরা মুগ্ধ দ্রৌপদীকে ধারণ করলেন। ধৌম্য পুরোহিত মন্ত্র আবৃত্তি করতে থাকলে সেই রাক্ষসের মায়া বিনষ্ট হল। মায়া বিনষ্ট হলে, মহাবলশালী, ক্রোধ-বিস্ফারিত নয়ন, কামরূপী ও ক্রূর প্রকৃতি সেই রাক্ষসটাকে যমের মতো দেখা যেতে লাগল।

তারপর নির্ভীক চিত্ত রাজা যুধিষ্ঠির সেই রাক্ষসকে বললেন, “তুমি কে? কার লোক? বল আমরা তোমার কী করতে পারি?” তখন সেই রাক্ষস ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বলল, “আমি বক রাক্ষসের ভ্রাতা, আমার নাম কির্মীর। আমি সর্বদা যুদ্ধে মানুষদের জয় করে ভক্ষণ করে এই শত্রুশূন্য কাম্যকবনে নিরুপদ্রবে বাস করছি। তোমরা কারা আমার খাদ্যরূপে আমার সম্মুখে উপস্থিত হয়েছ? তোমাদের সকলকেও যুদ্ধে পরাজিত করে সুখে ভক্ষণ করব।” যুধিষ্ঠির সেই রাক্ষসের কথা শুনে আপনার নাম গোত্র তাকে জানালেন। যুধিষ্ঠির বললেন, “আমি পাণ্ডুপুত্র ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। হয়তো তুমি আমার নাম শুনে থাকবে! এখন আমি ভীম, অর্জুন প্রভৃতি ভ্রাতাদের সঙ্গে এখানে এসেছি। শত্রুরা আমার রাজ্য হরণ করে নিয়েছে। তাই আমি বনবাস করার ইচ্ছা নিয়ে, তোমার অধিকারভুক্ত এই বনে প্রবেশ করেছি।” তখন কির্মীর রাক্ষস যুধিষ্ঠিরকে বলল, “ভাগ্যবশত দেবতারা আমার অভীষ্ট বহুকালের পর আমার সম্মুখে এনে দিয়েছেন। কারণ, আমি ভীমকে বধের জন্য সর্বদাই অস্ত্র উত্তোলন করে সমস্ত পৃথিবী বিচরণ করছি। কিন্তু তাকে পাচ্ছি না। আজ ভাগ্যবশত সেই ভ্রাতৃহন্তা চিরবাঞ্ছিত ভীমকে পেয়েছি। রাজা এই ভীমই ব্রাহ্মণের রূপ ধারণ করে মন্ত্রশক্তি অবলম্বন করে একচক্রানগরীর বনপ্রান্তে আমার ভ্রাতা বককে বিনাশ করেছিল। কিন্তু এর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই। এবং এই দুরাত্মাই আমার প্রিয়সখা বনবাসী হিড়িম্বকে বধ করে তার ভগিনী হিড়িম্বাকে অপহরণ করেছিল। ঠিক অর্ধরাত্র আমাদের বিচরণকাল। এই সময়েই মূর্খ ভীম আমার এই নিবিড় বনের মধ্যে প্রবেশ করেছে। আজ আমি সেই চিরসঞ্চিত শত্রুতার ফল ওকে দেব এবং সেই মূর্খের প্রচুর রক্তদ্বারা বকের তর্পণ করব। আজ আমি সেই চির রাক্ষসকণ্টক ভীমকে বধ করে ভ্রাতা বক ও প্রিয়সখা হিড়িম্বের ঋণ পরিশোধ করব। যুধিষ্ঠির, সেই বক পূর্বে ভীমকে ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ আমি তোমার সামনেই ভীমকে ভক্ষণ করব। অগস্ত্যমুনি যেমন বাতাপিকে ভক্ষণ করে জীর্ণ করেছিলেন, আজ আমি তেমন করে ভীমকে ভক্ষণ করে জীর্ণ করে ফেলব।” কির্মীর রাক্ষস এই কথা বললে ধর্মাত্মা ও সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির, “এই ঘটনা কখনও ঘটবে না” এই বলে কির্মীর রাক্ষসকে সক্রোধে তিরস্কার করলেন।

তারপর, মহাবাহু ভীমসেন বলপূর্বক একটি দশব্যাসপরিমিত (ছড়ানো দুই হাতের পরিমাণে এক ব্যাস হয়) গাছ উপড়ে ফেলে, সেটি প্রয়োজনীয় অংশে ভেঙে নিয়ে তখনই পত্রশূন্য করে নিলেন। ঠিক এই সময়েই অর্জুন পর্বতের মতো ভারী গাণ্ডিবধনুতে নিমেষের মধ্যেই গুণ পরিয়ে নিলেন। তখন ভীমসেন তাঁকে বারণ করে, মেঘের মতো গর্জনকারী সেই রাক্ষসের দিকে গিয়ে বললেন, “থাক থাক।” এই কথা বলে বলবান ভীমসেন অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে কোমরের কাপড় শক্ত করে বেঁধে, হাতে হাত ঘষতে ঘষতে ওষ্ঠ দংশন করে তখনই সেই বৃক্ষ নিয়ে রাক্ষসের উদ্দেশে ধাবিত হলেন। ইন্দ্র যেমন পর্বতের উপর বজ্রাঘাত করেন, সেইরকম ভীমসেন কির্মীর রাক্ষসের মাথায় যমদণ্ডতুল্য সেই বৃক্ষের আঘাত করল। কিন্তু তাতেও রাক্ষসকে অবিচলিতই দেখা গেল! রাক্ষস নিজের হাতের জ্বলন্ত কাঠখানি প্রজ্বলিত বজ্রের মতো ভীমের উপর ছুড়ে মারল। কিন্তু বীরশ্রেষ্ঠ ভীমসেন, সেই নিক্ষিপ্ত প্রজ্বলিত কাষ্ঠখানি বাম পায়ের আঘাতে রাক্ষসের দিকেই পাঠিয়ে দিলেন। তখন কির্মীর রাক্ষসও অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ একটি বৃহৎ বৃক্ষ উপড়ে নিয়ে দণ্ডপাণি যমের মতো ভীমের দিকে ছুটে গেল।

তদবৃক্ষযুদ্ধম্‌ভবম্মহীরুহ বিনাশনম্।
বালি সুগ্রীবয়োর্ভ্রাত্রোৰ্যথা স্ত্রী কাঙিক্ষণোঃ পুরা॥ বন: ১০:৪৭ ॥

পূর্বকালে তারার জন্য বালি ও সুগ্রীব দুই ভ্রাতার মধ্যে যেমন বৃক্ষযুদ্ধ হয়েছিল, তেমনই ভীম ও কিৰ্মীরের মধ্যে বৃক্ষযুদ্ধ হতে লাগল। তাতে অসংখ্য বৃক্ষ বিনষ্ট হল। দুটি মত্ত হাতির মাথায় পতিত পদ্মের পাতা যেমন বিন্দুমাত্র আঘাত করতে পারে না; তেমন ভীম ও কিৰ্মীরের মাথায় পতিত বৃক্ষগুলিও সামান্য স্থানও বিদীর্ণ করতে পারল না। অনেকগুলি গাছ তাদের মাথায় পড়ে মুঞ্জতৃণের মতো টুকরো টুকরো, ছুড়ে ফেলা কৌপীনের মতো, ইতস্তত কাপড়ের ছেঁড়া টুকরোর মতো চারপাশে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। রাক্ষসশ্রেষ্ঠ কির্মীর ও নরশ্রেষ্ঠ ভীমের সেই বৃক্ষযুদ্ধ সামান্য ক্ষণের জন্যেই হয়েছিল। তারপর রাক্ষস ক্রুদ্ধ হয়ে বিরাট বড় একটা পাথর তুলে নিয়ে, যুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা ভীমের উপরে নিক্ষেপ করল, কিন্তু ভীম তাতে বিচলিত হলেন না। ভীম সেই পাথরের আঘাতে ক্ষণকাল নিষ্পন্দ হয়ে রইলেন। তারপর রাহু যেমন বাহু দ্বারা কিরণ অপসারিত করে সূর্যের দিকে ধাবিত হয়, রাক্ষস তেমনই ভীমের দিকে অগ্রসর হল। তখন দুটি বলবান বৃক্ষের মতো তাঁরা দুজনে পরস্পরকে আলিঙ্গন করে এবং পরস্পরকে আকর্ষণ করে এক অদ্ভুত দৃশ্যের সৃষ্টি করলেন। নখ ও দন্তশালী গর্বিত দুটি ব্যাঘ্রের তুল্য তাঁদের দুজনের মধ্যে ভয়ংকর যুদ্ধ হতে লাগল।

সে সময় ভীম একে দুর্যোধনের কুৎসিত আচরণে ও আপন বাহুবলে অত্যন্ত দর্পিত ছিলেন। তাতে আবার দ্রৌপদীর কটাক্ষের ইঙ্গিতে অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হলেন। তখন মুখ ও গণ্ডদ্বয় থেকে মদস্রাবী একটা হাতি যেমন অপর হাতিকে ধরে, সেইরকম ক্রুদ্ধ হয়ে ভীম দ্রুত গমন করে বাহুযুগল দ্বারা রাক্ষসকে ধারণ করলেন। বলবান সেই রাক্ষসও ভীমকে ধারণ করল। তখন বলিশ্রেষ্ঠ ভীম বলপূর্বক রাক্ষসকে আকর্ষণ করলেন। তখন বলবান সেই দুজনের যুদ্ধে বাহু-নিষ্পেষণের ফলে বাঁশের গিঁট ফাটার শব্দের মতো ভয়ংকর শব্দ হতে লাগল। তারপর ভীমসেন বলপূর্বক রাক্ষসকে আকর্ষণ করে শরীরের মধ্যস্থান ধরে, প্রচণ্ড বায়ু যেমন বৃক্ষকে ঘোরাতে থাকে, সেইরকম ভাবে তাকে ঘোরাতে লাগলেন। তখন কির্মীর রাক্ষসকে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়তে দেখা গেল। সেই অবস্থাতেও সে ভীমকে আকর্ষণ করতে থাকল। তারপর ভীমসেন রাক্ষসকে পরিশ্রান্ত দেখে— পশুকে যেমন দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়, আপন বাহুযুগলের মধ্যে তাকে বন্ধন করে ফেললেন।

এই সময়ে রাক্ষস ভেরির মতো বিশাল শব্দ করতে করতে ক্রমশ স্পন্দিত হতে থাকল। তারপর ক্রমে অচৈতন্য হয়ে পড়ল; তখন বলবাম ভীমসেন তাকে ধরে বহুবার ঘূর্ণিত করতে থাকলেন এবং তাকে অবসন্ন বুঝতে পেরে, সবলে বাহুযুগল দ্বারা ধারণ করে পশুর মতো প্রহার করতে লাগলেন। ভীমসেন জানু দ্বারা সেই রাক্ষসের কোমর চেপে ধরে দু’হাতে গলা টিপে ধরলেন। তখন রাক্ষসের সমস্ত অঙ্গ জর্জরিত হল এবং চোখ দুটি ঘুরতে লাগল; তাতে তাকে আরও উৎকট দেখাতে লাগল। এই অবস্থায় ভীম তাকে মাটিতে ঘোরাতে লাগলেন এবং বললেন, “পাপাত্মা! তুই আর হিড়িম্ব রাক্ষস ও বক রাক্ষসের শোকাশ্রু মার্জন করতে পারবি না। কারণ, তুই নিজেই যমালয়ে চলে যাচ্ছিস।”

এই কথা বলে ক্রুদ্ধচিত্ত ও পুরুষপ্রধান ভীমসেন সেই রাক্ষসকে ছেড়ে দিলেন। কারণ, সে তখন ছটফট করছিল, তার কাপড় ও অলংকার পড়ে গেছিল, ক্রমে চৈতন্য লোপ পেয়ে গেল এবং তার প্রাণ বার হয়ে গিয়েছিল। জলপূর্ণ মেঘের মতো কৃষ্ণবর্ণ সেই রাক্ষস নিহত হলে, পাণ্ডবেরা আনন্দিত হয়ে বহু গুণে ভীমের প্রশংসা করে, দ্রৌপদীকে নিয়ে, সেই কাম্যকবন থেকে দ্বৈতবনের দিকে প্রস্থান করলেন।

*

পঞ্চপাণ্ডব ভ্রাতার মধ্যে ভীমসেন ছিলেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। রাক্ষসেরা ভীমের সামনাসামনি পড়লে জীবিত অবস্থায় ফিরত না। বক, হিড়িম্ব, জটাসুর— সব রাক্ষসই ভীমের হাতে মৃত্যুবরণ করেছে। সেই অসাধারণ বলের আর এক পরিচয় কির্মীর বধ। বনপর্বে পাণ্ডবদের প্রহরী ছিলেন ভীমসেন। একের পর এক রাক্ষসের মৃত্যু ঘটেছে তাঁর হাতে। বিশেষত দ্রৌপদীকে যে স্পর্শ করেছে, কুৎসিত ইঙ্গিত করেছে— ভীম তাকেই যমালয়ে পাঠিয়েছেন। একমাত্র জয়দ্রথ ছাড়া। যুধিষ্ঠিরের আদেশে ভীম তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। দুর্যোধন ও দুঃশাসনকে তিনি কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধে বধ করেছিলেন। এত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও বনপর্বে ভীম দু’বার পরাজিত হয়েছিলেন। একবার অগ্রজ হনুমানের হাতে। অন্যবার সর্পরূপী পূর্বপুরুষ নহুষের হাতে।

৩৮
কিরাতরূপী মহাদেবকে স্পর্শধন্য অর্জুন

[ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা ব্যাসদেবের রক্ত-সম্পর্কিত সন্তান ছিল। কিন্তু পাণ্ডুর পাঁচ পুত্র তা ছিল না। পাণ্ডু প্রজনন-শক্তিহীন ছিলেন। মহর্ষি দুর্বাসা রাজা কুন্তীতভোজের প্রাসাদে সেবাগ্রহণকালে ধ্যানযোগে জেনেছিলেন যে, মানুষের ঔরসে কুন্তীর কোনও সন্তান হবে না। তাই তিনি কুন্তীকে দিয়েছিলেন দেব-অভিকর্ষণ মন্ত্র। যে-মন্ত্রপাঠে কুন্তী যে দেবতাকে আহ্বান করবেন, তিনি আবির্ভূত হবেন। বহু মহাভারত চর্চাকার এই তথ্যটি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে মন্তব্য করেছেন—কর্ণ দুর্বাসার সন্তান, কেউ বা বলেছেন, বিদুর যুধিষ্ঠিরের জনক। দুর্বাসা, বিদুর এঁরা দেবকল্প হলেও রক্তমাংসের মানুষ। সুতরাং দুর্বাসার গণনা অনুযায়ী এরা কেউই কুন্তীর সন্তানের জনক হতে পারেন না।

ব্যাসদেবও জানতেন পঞ্চপাণ্ডব দেবসন্তান এবং মনুর বিধান অনুযায়ী এরা পিতা অর্থাৎ কুন্তীর স্বামী পাণ্ডুর সন্তান হিসাবে পরিচিত। কর্ণও কুন্তীর কুমারী অবস্থার দেবসন্তান। কিন্তু সূর্যের আদেশে কুন্তী কর্ণকে ত্যাগ করেন এবং পুনরায় কুমারী অবস্থায় ফিরে যান। কিন্তু অবিবাহিত অবস্থায় সন্তান হওয়ায় তিনি কুন্তীর স্বামীর সন্তান হিসাবে পরিচিতি পাননি (যদিও ভগবান মনুর বিধানে এরূপ সন্তানের ক্ষেত্রেও পিতৃপরিচয় দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল)। আপন দুই পুত্রের সন্তানদের এই পার্থক্য জানা সত্ত্বেও ব্যাসদেব উভয়পক্ষকেই সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। কিন্তু কুন্তীর পুত্রদের ন্যায়পরায়ণতা, ধৈর্য, বিনয়নম্র ব্যবহার, শিষ্টাচার, বল বিক্রম, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের অসাধারণ ধর্মবোধ, দূরদর্শিতা এবং বিচারবোধ ক্রমশ তাঁর স্নেহকে পাণ্ডবদের পক্ষপাতী করে তুলছিল। কপট দ্যূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যচ্যুত, নিঃস্ব এবং বনবাসী করায় এবং পুরুষের সভায় কুলবধূ দ্রৌপদীর চূড়ান্ত লাঞ্ছনা ব্যাসদেবকে গভীরভাবে দুঃখার্ত করেছিল। দ্বৈতবনে পাণ্ডবেরা এবং দ্ৰৌপদী যখন নিতান্ত দুরবস্থায় তখন ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরের কাছে এলেন। তাঁকে দিলেন ‘প্রতিস্মৃতি’ মন্ত্র। যে মন্ত্র উচ্চারণ করে তপস্যা করলে অর্জুন সকল দিব্যাস্ত্র লাভ করবেন।]

পরদিন প্রভাতে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে নিয়ে নদীতীরে এলেন। তাঁকে ‘প্রতিস্মৃতি’ মন্ত্র শিখিয়ে জানালেন, দিব্যাস্ত্র পেতে গেলে অর্জুনকে উত্তরদিকে গিয়ে নিবিড় জঙ্গলে এই মন্ত্র তপস্যা করতে হবে। যুধিষ্ঠিরের আশীর্বাদ গ্রহণ করে অর্জুন উত্তরদিকে যেতে যেতে এক মহারণ্যে উপস্থিত হলেন এবং কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হলেন। এই স্থানটির নাম ছিল ‘ইন্দ্রকীল পর্বত’। আকস্মিক অর্জন আকাশে দৈববাণী শুনলেন, “থামো।” অৰ্জুন চতুর্দিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলেন এক বৃক্ষমূলে এক তপস্বী বসে আছেন। তিনি ব্রাহ্মণযোগ্য কান্তি দ্বারা প্রকাশিত, পিঙ্গল বর্ণ, আকৃতি কৃশ এবং জটাধারী। জটাধারী তপস্বী অর্জুনকে অস্ত্র পরিত্যাগ করতে বললেন। বললেন, “এই স্থান শমগুণান্বিত। এই স্থানে অস্ত্রের প্রয়োজন নেই।” তপস্বী এই কথা বারবার বললেও অর্জুন অস্ত্র পরিত্যাগ করলেন না। তপস্বী তখন আপন পরিচয় দান করে জানালেন যে, তিনি অর্জুনের পিতা, দেবরাজ ইন্দ্র। তখন অর্জুন প্রণত হয়ে শত্রুবধের জন্য দিব্যাস্ত্র প্রার্থনা করলেন। দেবরাজ কোমল বাক্যে অর্জুনকে বললেন, “বৎস। তুমি যখন ভূতনাথ, ত্রিলোচন ও শূলপাণি মহাদেবের দর্শন পাবে, তখন আমি তোমাকে সমস্ত দিব্য অস্ত্র দান করব। তুমি একাগ্রমনে মহাদেবের দর্শনের জন্য যত্ন করো। তাঁর দর্শনে সিদ্ধ হয়ে তুমি তোমার প্রার্থিত সকল বস্তু লাভ করবে।” এই বলে দেবরাজ ইন্দ্র অন্তর্হিত হলেন।

তখন অর্জুন মহাদেবের দর্শনের জন্য তপস্যায় কৃতনিশ্চয় হয়ে একাকীই কণ্টকাকীর্ণ ভয়ংকর বনের ভিতর প্রবেশ করলেন। সেই বনটি নানাবিধ পুষ্প ও ফলে পরিপূর্ণ ছিল। বহুবিধ পশুসমূহে ব্যাপ্ত ছিল আর তার ভিতরে নানাপ্রকার পক্ষী ও সিদ্ধগণ এবং চারণগণ বিচরণ করত। অর্জুন সেই মনুষ্যবিহীন বনে প্রবেশ করলে, আকাশে শঙ্খধ্বনি ও পটহধ্বনি হতে লাগল। ভূতলে বিশাল পুষ্পবৃষ্টি পতিত হতে থাকল এবং বিস্তৃত মেঘসকল সমস্ত দিক আবৃত করল। অর্জুন হিমালয়ের সন্নিহিত দুর্গম বন অতিক্রম করে, তার উপরেই শোভা পেতে লাগলেন। তিনি সেখানে দেখলেন, নানাবিধ বৃক্ষ আছে, তাতে অনেক ফুল ফুটে আছে। পাখিরা সুন্দর গান গাইছে; অনেক নদী প্রবাহিত হচ্ছে। সেগুলির আবর্ত বিশাল কিন্তু জল বৈদূর্যমণির মতো নির্মল। তার নিকট হংস, কারণ্ডব, সারস, কোকিল, কোঁচবক ও ময়ূরগণ রব করছে, তীরে মনোহর বন আছে। অতিরথ অর্জুন সেই স্থানের পবিত্রতায় আনন্দিত হলেন।

তেজস্বী ও দৃঢ়চেতা অৰ্জুন তখন সেই মনোহর বনের মধ্যে দারুণ তপস্যায় প্রবৃত্ত হলেন। তিনি কুশময় কৌপীন পরে দণ্ড ও মৃগচর্মধারণ করে ভূতলে পতিত শুষ্কপত্র মাত্র ভোজন করতেন। তারপর প্রতি তৃতীয় দিবসে এক একটি ফল ভক্ষণ করে একমাস অতিক্রম করলেন। তারপর প্রতি ষষ্ঠ দিন পরে এক-একটি ফল ভোজন করে দ্বিতীয় মাস অতিক্রম করলেন। তৃতীয় মাসে প্রতি পনেরো দিনে এক-একটি ফল ভোজন করলেন; তারপর চতুর্থ মাস উপস্থিত হলে, ভরতশ্রেষ্ঠ মহাবাহু অর্জুন কেবল বায়ু ভক্ষণ করে, নিরবলম্ব অবস্থায় চরণাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগদ্বারা ভূতলে দাঁড়িয়ে উর্ধ্ববাহু হয়ে তপস্যা করতে লাগলেন। সর্বদা ধ্যান করায় অমিততেজা ও মহাত্মা অর্জুনের জটাসমূহের মধ্যে কিছু বিদ্যুতের মতো পিঙ্গলবর্ণ হয়ে গেল এবং কিছু মেঘের মতো কৃষ্ণবর্ণই থাকল।

অর্জুনের সেই ভয়ংকর তপস্যা দেখে মহর্ষিরা গিয়ে মহাদেবের নিকট উপস্থিত হয়ে, তাঁকে প্রণাম করে জানালেন যে, “মহাতেজা অর্জুন হিমালয়ের উপরে অবস্থান করছেন। দেবদেব! অর্জুন আপন তেজে সমস্ত দিক ধূম্রবর্ণ করে দুষ্কর ভয়ংকর তপস্যায় মগ্ন হয়েছে। আমরা তাঁর উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছি না। কিন্তু তিনি আমাদের সকলকেই সন্তপ্ত করছেন। অতএব আপনি অর্জুনকে বারণ করুন।” ঋষিগণের উদ্বেগপূর্ণ আবেদন শুনে ভূতনাথ মহাদেব বললেন, “ঋষিগণ! আপনারা অর্জুনের বিষয়ে কোনও আশঙ্কা করবেন না। আপনারা আনন্দিত হয়ে নিরুদ্বেগে নিজের নিজের স্থানে চলে যান; আমি অর্জুনের মনের উদ্দেশ্য জানি। তাঁর স্বর্গের প্রতি কোনও বাসনা নেই, সম্পদ বা আয়ুরও কোনও কামনা নেই; তিনি যা কিছু ইচ্ছা করেন, সেই সমস্তই আজ আমি সম্পাদন করব।” সত্যবাদী ঋষিরা মহাদেবের সেই কথা শুনে আনন্দিতচিত্তে আপন আপন আশ্রমে চলে গেলেন।

তপস্বীরা চলে গেলে, সর্বপাপনাশক ও মনোহরমূর্তি ভগবান মহাদেব স্বর্ণবৃক্ষের ন্যায় উজ্জ্বল ব্যাধের বেশ ধারণ করে, দীর্ঘ শরীরে সুমেরু পর্বতের মতো শোভা পেতে লাগলেন। সুন্দর পিনাক নামক ধনুক ও সর্পতুল্য বাণ নিয়ে, মূর্তিমান অগ্নির মতো মহাবেগে আপন ভবন থেকে নির্গত হলেন। তখন সমান নিয়ম ও সমান বেশধারিণী উমাদেবী, অন্যান্য বহুতর স্ত্রী-ও নানাবিধ বেশধারী ও আনন্দিতচিত্ত ভূতগণ মহাদেবের অনুগমন করলেন। তখন সেই স্থানটি অত্যন্ত শোভা পেতে লাগল। সেই মুহূর্তে সমস্ত বনটাই ক্ষণকালের মধ্যে নিঃশব্দ হয়ে গেল এবং নির্ঝরের শব্দ ও পক্ষীর রব বিরত হল। অনায়াস-কার্যকারী মহাদেব মুহূর্তমধ্যে অর্জুনের কাছে পৌঁছে ‘মূক’ নামক অদ্ভুতাকৃতি একটি দানবকে দেখতে পেলেন। ওদিকে অর্জুনও সেই হিংস্র মূকদানবের জিঘাংসার বিষয় মনে মনে আলোচনা করে অস্ত্রপ্রহারই উচিত পথ বিচার করলেন। দুষ্টাত্মা মূকদানব মুহূর্তমধ্যে শূকরের রূপ ধারণ করে অর্জুনকে বধ করার জন্য তার দিকে ধাবিত হল। তখন অর্জুন গাণ্ডিবধনু ও সর্পতুল্য বাণ নিয়ে, সেই শ্রেষ্ঠ ধনুতে গুণারোপণ করে এবং জ্যা-শব্দে সমস্ত দিক শব্দিত করে মূকদানবকে বললেন, “আমি এখানে আগন্তুক এবং আমার কোনও অপরাধ নেই; তবুও তুই যখন আমাকে বধ করবার ইচ্ছা করছিস, তখন আমিই আগে তোকে যমালয়ে পাঠাব।”

এই কথা বলে গাণ্ডিবধম্বা অর্জুন প্রহার করতে প্রবৃত্ত হলেন। তা দেখে কিরাতরূপী মহাদেব এই বলে তাকে বারণ করলেন, “এই নীলমেঘতুল্য শূকরটিকে আমিই আগে বধ করবার ইচ্ছা করেছি।” কিন্তু অর্জুন কিরাতের বাক্য অগ্রাহ্য করে প্রহার করলেন। মহাতেজা কিরাতও একই সময়ে সেই একমাত্র লক্ষ্য মূকদানবের প্রতি বজ্রের তুল্য বেগবান এবং অগ্নিশিখার তুল্য একটি উজ্জ্বল বাণ নিক্ষেপ করলেন। কিরাত ও অর্জুনের নিক্ষিপ্ত সেই বাণ দুটি গিয়ে একই সময়ে পর্বতের ন্যায় দৃঢ় ও বিস্তৃত সেই মূকদানবের গাত্রে আঘাত করল। তখন বৈদ্যুতিক শব্দের মতো এবং পর্বতের উপরে বজ্রপাতের শব্দের মতো দানবদেহে সেই বাণ দুটি পতিত হল। সেই দানব সর্পতুল্য উজ্জ্বল মুখ দুই বাণের আঘাতে অতি ভীষণ রাক্ষসের আকৃতি ধারণ করে মৃত্যুমুখে পতিত হল।

তখন, শত্রুহন্তা অৰ্জুন স্বর্ণকান্তি, ব্যাধবেশধারী এবং স্ত্রীসমূহ সমন্বিত সেই পুরুষকে দেখতে পেলেন। তখন অর্জুন আনন্দিত হয়ে হাসতে হাসতে যেন সেই পুরুষকে বললেন, “কে তুমি নির্জন বনে স্ত্রীবেষ্টিত হয়ে বিচরণ করছ? হে স্বর্ণকান্তি পুরুষ, এই ভয়ংকর বনে তোমার কি ভয় হচ্ছে না? কী জন্যই বা তুমি আমার শূকরটিকে বধ করলে? রাক্ষসের মতো বিকটাকার এই দানব এখানে এলে, আমিই ওকে আগে পেয়েছি; সুতরাং ইচ্ছা করেই হোক বা আমাকে অগ্রাহ্য করার উদ্দেশ্যে হোক, তুমি একে বিদ্ধ করে আমার হাত থেকে জীবিত অবস্থায় মুক্তিলাভ করতে পারবে না। কারণ, তুমি আজ আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করেছ, তা মৃগয়ার নিয়ম নয়; অতএব পার্বত্য, আমি তোমাকে প্রাণচ্যুত করব।” অর্জুন এই কথা বললে ব্যাধ মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে কোমল কণ্ঠে অর্জুনকে বলল, “বীর তুমি এই বনের মধ্যে আমাকে দেখে ভয় পেয়ো না। আমরা এই বনে বাস করি, তাই বনের সমস্ত কিছুই আমাদের অত্যন্ত পরিচিত। কিন্তু তপস্বী তুমি এই বনের মধ্যে কেন বাস করতে এসেছ? আমরা ছাড়া এই জন্তুপূর্ণ বনে কেউ বাস করে না। তুমি অগ্নির তুল্য তেজস্বী, সুকুমার দেহ ও সুখভোগে অভ্যস্ত। সুতরাং তুমি একাকী কী করে এই শূন্যবনে বিচরণ করবে?” অর্জুন উত্তর দিলেন, “গাণ্ডিব ধনু এবং অগ্নিতুল্য নারাচ (তির)গুলি নিয়ে আমি দ্বিতীয় অগ্নির মতো এই মহাবনে বাস করব। এই দারুণ রাক্ষস আমাকে বধ করবার জন্য বরাহরূপ ধারণ করে এসেছিল। তাই আমি ওকে বধ করেছি।” ব্যাধ বলল, “আমিই আগে ওকে ধনু নিক্ষিপ্ত বাণ দিয়ে তাড়ন করেছি, বধ করেছি এবং যমালয়ে পাঠিয়েছি। এই বরাহ প্রথমে আমারই লক্ষ্য হয়েছিল সুতরাং এ আমারই বধ্য হয়েছিল এবং আমার প্রহারেই এর প্রাণচ্যুত হয়েছিল। তুমি নিজের বলে অত্যন্ত দর্পিত, তাই নিজের দোষ স্বীকার করতে পারছ না; সুতরাং মূর্খ! তুমি জীবিত অবস্থায় আমার কাছ থেকে মুক্তি লাভ করবে না। স্থির হয়ে আমার বজ্ৰতুল্য বাণের আঘাতের অপেক্ষা করো এবং তোমার যথাশক্তি বাণক্ষেপ করো।”

অর্জুন সেই ব্যাধের বাক্য শুনে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হলেন এবং তার প্রতি শর নিক্ষেপ করতে লাগলেন। ব্যাধ অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে অর্জুনের বাণগুলি গ্রহণ করল এবং বারবার “স্থির হও, স্থির হও”—এই বলে অর্জুনকে, “মূর্খ! মূর্খ!” বলে সম্বোধন করতে লাগল। আরও বলল, “আরও তীক্ষ্ণ বাণসমূহ নিক্ষেপ করো।” তখন তাঁরা দুজনেই ক্রুদ্ধ, অত্যন্ত পরাক্রমের সঙ্গে সর্পতুল্য বাণদ্বারা বারবার পরস্পরকে আঘাত করতে লাগলেন। অর্জুন ব্যাধের উপর বাণবৃষ্টি করতে লাগলেন। ব্যাধরূপী মহাদেবও প্রসন্নচিত্তে সেগুলি গ্রহণ করতে লাগলেন। ব্যাধরূপী মহাদেব কিছুকাল সেই বাণবৃষ্টি ধারণ করে অক্ষত শরীরেই পর্বতের ন্যায় অবিচল থাকলেন। অর্জুন নিজের বাণবর্ষণ ব্যর্থ হয়েছে দেখে অত্যন্ত বিস্ময়াপন্ন হলেন এবং ‘সাধু সাধু’ এই বলে ব্যাধের প্রশংসা করলেন। আর মনে মনে চিন্তা করলেন, “হিমালয়বাসী এই কোমলাঙ্গ ব্যাধ অবিহ্বল থেকেই গাণ্ডিবনিক্ষিপ্ত আমার বাণগুলি গ্রহণ করছে; কী আশ্চর্য! এই ব্যক্তি কে? ইনি কি স্বয়ং মহাদেব? না কোনও যক্ষ? না দেবতা? না অসুর? কারণ হিমালয়ে দেবতা প্রভৃতি আসেন। আমার নিক্ষিপ্ত বাণসমূহ মহাদেব ভিন্ন কেউই ধারণ করতে পারেন না। এই ব্যক্তি যদি মহাদেব ব্যতীত অন্য কোনও দেবতা হন; অথবা যক্ষ, রক্ষ, দানব হন, তবে আমি এঁকে তীক্ষ্ণ বাণের আঘাতে যমালয়ে পাঠাব।” মনে মনে এই প্রতিজ্ঞা করে, সূর্য যেমন কিরণ ক্ষেপণ করেন, আনন্দিত অর্জুন শত শত তীক্ষ্ণ বাণ কিরাতের উপর নিক্ষেপ করলেন। আবার পর্বত যেমন শিলাবৃষ্টি গ্রহণ করে, তেমনই জগৎ-সৃষ্টিকর্তা কিরাতরূপী ভগবান মহাদেব প্রসন্নচিত্তে অর্জুনের সেই তীক্ষ্ণ বাণবর্ষণ গ্রহণ করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই অর্জুনের দুই অক্ষয় তূণ শেষ হয়ে গেল। অর্জুন অগ্নিদেবকে স্মরণ করলেন। খাণ্ডবদাহের সময়ে অগ্নিদেব অর্জুনকে দুই অক্ষয়-তূণ দিয়েছিলেন। সেই তূণ সব শেষ হয়ে গিয়েছে। শুধু ধনুকদ্বারা অৰ্জুন এই অনির্বচনীয় পুরুষের সঙ্গে কীভাবে সংগ্রাম করবেন?

কিন্তু মোক্ষ্যামি ধনুষা যন্মে বাণাঃ ক্ষয়ং গতাঃ।
অয়ঞ্চ পুরুষঃ কোহপি বাণান্ গ্রসতি সর্বশঃ॥ বন : ৩৫ : ৪৭ ॥

“এখন আমি ধনুদ্বারা কী নিক্ষেপ করব; যেহেতু আমার সমস্ত বাণই নিঃশেষ হয়েছে। এ পুরুষটাও অনির্বচনীয়ই বটে; যেহেতু সে আমার সমস্ত বাণগুলি গ্রাস করছে। সে যাই হোক, শূলের অগ্রভাগ দিয়ে যেমন হস্তীকে বধ করা হয়, তেমন ধনুর অগ্রভাগ দিয়ে আমি একে বধ করে যমালয়ে পাঠাব।”

মহাতেজা অর্জুন, এই চিন্তা করে, ধনুর অগ্রে গুণ সংযোগ করে, তাই ধরে বজ্রতুল্য মুষ্টিদ্বারা কিরাতকে আঘাত করলেন। কিন্তু কিরাত অর্জুনের হাত থেকে সেই ধনুও কেড়ে নিয়ে, তাও গ্রাস করে ফেলল। অর্জুন হাতে তরবারি নিলেন এবং যুদ্ধ-শেষ করার ইচ্ছায় ব্যাধের প্রতি দ্রুত ধাবিত হলেন। পর্বত ছেদনে সমর্থ সে তীক্ষ্ণধার অসি বাহুর সমস্ত শক্তির সঙ্গে ব্যাধের মস্তকে নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ব্যাধের মস্তকে পড়ে সেই তরবারি লাফিয়ে উঠল। তখন অর্জুন বৃক্ষ ও শিলা নিক্ষেপ করতে লাগলেন। কিন্তু বিশালমূর্তি কিরাতরূপী ভগবান মহাদেব সে সমস্ত বৃক্ষ ও শিলা গ্রাস করতে লাগলেন। তখন মহাবল অর্জুন মুখ থেকে ধূম্র নির্গত করতে করতে বজ্রমুষ্টি দ্বারা ব্যাধরূপী মহাদেবের বুকে কিল মারতে লাগলেন। ব্যাধরূপী মহাদেবও বজ্রতুল্য অতি দারুণ মুষ্টিদ্বারা অর্জুনকে আঘাত করতে লাগলেন। তখন যুধ্যমান অর্জুন ও ব্যাধের মুষ্টিপ্রহার হতে থাকায় ভয়ংকর ‘চটাচট’ শব্দ হতে লাগল। কিন্তু বৃত্রাসুর ও ইন্দ্রের মতো ব্যাধ ও অর্জুনের সেই লোমহর্ষণ বাহুযুদ্ধ দীর্ঘকাল স্থায়ী হল না।

তখন অর্জুন ব্যাধরূপী মহাদেবকে আপন বক্ষের মধ্যে গ্রহণ করে তাঁকে বাহুবদ্ধ করে পিষ্ট করতে আরম্ভ করলেন। সেই একইভাবে ব্যাধও অর্জুনকে নিষ্পেষণ করতে লাগলেন। তাঁদের পরস্পর নিষ্পেষণে যেন দুটি কাঠের সংঘর্ষে উৎপন্ন অগ্নির সৃষ্টি হল। তারপর মহাদেব আপন অঙ্গদ্বারা অধিকতেজে অর্জুনকে নিষ্পেষণ করতে আরম্ভ করলেন। অর্জুনের যেন চৈতন্যলোপ হবার উপক্রম হল। তিনি ক্রমশ মহাদেবের অঙ্গের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে ক্রমশ অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে অবশ হয়ে পড়লেন। তাঁর শ্বাসরোধ হয়ে গেল। তিনি নিস্পন্দ হয়ে ভূতলে পড়ে গেলেন এবং তাঁকে বিগতপ্রাণ দেখাতে লাগল। ক্ষণকাল পরে অর্জুন চেতনা ফিরে পেলেন এবং অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে রক্তাক্ত দেহে উঠে দাঁড়ালেন। প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা অসম্ভব বোধ করে, তিনি শরণাগত রক্ষক দেবাদিদেব ভগবান মহাদেবকে প্রসন্ন করার জন্য স্থণ্ডিলের উপরে মহাদেবের মৃন্ময় প্রতিমা নির্মাণ করে মালা দ্বারা তাঁর পূজা করলেন। তখন পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুন সেই মালাটি ব্যাধেরই মস্তকে অবস্থিত দেখলেন। গভীর আনন্দে অর্জুন সম্যক প্রকৃতিস্থ হলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ কিরাতরূপী মহাদেবের চরণযুগলে পতিত হলেন। তখন মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে, অর্জুনকে বিস্ময়াপন্ন দেখে, তাঁর তপঃক্লিষ্ট দেহ দেখে মেঘগম্ভীর বাক্যে তাঁকে বললেন, “অর্জুন, আমি তোমার এই অতুলনীয় বীরত্ব ও ধৈর্যগুণে সন্তুষ্ট হয়েছি। তোমার তুল্য ক্ষত্রিয় নেই। হে নিষ্পাপ মহাবাহু ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি উৎসাহ বলে প্রায় আমার সমান। তুমি আমার স্বরূপ দর্শন করো। তুমি পূর্বজন্মে ‘নর’ ঋষি ছিলে। সুতরাং তোমাকে আমি দিব্যদৃষ্টি প্রদান করছি। তুমি যুদ্ধে সমস্ত শত্রুকে এবং সমস্ত দেবতাকেও জয় করতে পারবে। আমার যে অস্ত্র অন্য কেউই নিবারণ করতে পারে না, আমি প্রীতিবশত সেই অস্ত্র তোমাকে দান করব। তুমি অচিরকালের মধ্যেই আমার সেই অস্ত্র ধারণ করতে পারবে।”

ততো দেবং মহাদেবং গিরিশং শূলপাণিনম্‌।
দদর্শ ফাল্গুনস্তত্র সহ দেব্যা মহাদ্যুতিম্॥ বন : ৩৫ : ৭২ ॥

তারপর, অর্জুন সেই স্থানে দেবী পার্বতীর সঙ্গে অত্যন্ত তেজস্বী, কৈলাসবাসী, ও শূলপাণি মহাদেবকে দর্শন করলেন।

তখন শত্রুনগরবিজয়ী অর্জুন ভূতলে জানু রেখে মাথা পেতে প্রণাম করে, স্তব করে মহাদেবকে প্রসন্ন করতে লাগলেন। অর্জুন বললেন, “মহাদেব! আপনি জটাজুটধারী, সমস্ত প্রাণীর অধীশ্বর, তৃতীয় নয়ন দ্বারা আপনি কামদেবকে ভস্মীভূত করেছেন, আপনি দেবতাদেরও দেবতা এবং নীলকণ্ঠ। দেব, আমি জানি যে আপনি সকল সৃষ্টিকর্তার মধ্যে প্রধান, ত্রিলোচন, সর্বব্যাপক, দেবগণেরও গতি এবং এই জগৎ আপনারই উৎপাদিত। আপনি ত্রিলোক এবং ত্রিভুবনেরই অজেয়, আপনি বিষ্ণুরূপী শিব, আবার শিবরূপী বিষ্ণু এবং আপনি দক্ষযজ্ঞবিনাশকারী বীরভদ্র; সুতরাং আপনাকে প্রণাম করি। আপনি ললাটনেত্র, জগতের সংহারক ও উৎপাদক, শূলপাণি, পিনাকধনুর্ধারী, সূর্যস্বরূপ, মঙ্গলকারক এবং বিধাতা; অতএব আপনাকে প্রণাম করি। ভগবন্! মহেশ্বর! আপনি প্রমথগণের অধিপতি, জগতের মঙ্গলকারক, সৃষ্টিকর্তাদেরও সৃষ্টিকর্তা, প্রকৃতি-পুরুষেরও অতীত, সর্বোৎকৃষ্ট এবং পরম সূক্ষ্ম তূরীয় ব্রহ্ম শিবস্বরূপ, আমি আপনাকে প্রসন্ন করতে চাইছি। ভগবন্‌! শঙ্কর! আমি যে অপরাধ করেছি, তা আপনি ক্ষমা করুন। দেবদেব! আমি আপনারই সাক্ষাৎকারের আকাঙক্ষী হয়ে, তপস্বীদের উত্তম আশ্রয় এবং আপনার প্রীতিকর এই আপনার রক্ষিত মহাপর্বতে এসেছি। আপনি সমগ্র জগতের প্রণম্য। আমার উপর প্রসন্ন হোন, আমার অপরাধ আপনি ক্ষমা করুন। অজ্ঞতাবশত আমি আপনার সঙ্গে সংঘর্ষ করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন।”

তখন মহাতেজা মহাদেব হাস্যমুখে অর্জুনের সুন্দর হাতখানি ধরে তাঁকে বললেন, “আমি পূর্বেই ক্ষমা করেছি।” তখন মহাদেব অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে অর্জুনকে আলিঙ্গন করে আশ্বাসদান করে বললেন, “অর্জুন তুমি পূর্বজন্মে নারায়ণের সহচর হয়ে বহু অযুত বৎসর ধরে ভয়ংকর তপস্যা করেছিলে। তোমাতে বা পুরুষশ্রেষ্ঠ নারায়ণে যে পরম তেজ রয়েছে, সেই তেজ দ্বারাই তোমরা দু’জনে জগৎ রক্ষা করছ। হে প্রভাবসম্পন্ন অর্জুন, ইন্দ্রের রাজ্য অভিষেকের সময় তুমি এবং বিষ্ণু মেঘের ন্যায় গর্জনকারী গম্ভীরধ্বনি যুক্ত বিশাল একখানি ধনুক ধারণপূর্বক দানবগণকে নিবারণ করেছিলে। পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন এই সেই গাণ্ডিব ধনু। এ তোমারই হাতের যোগ্য। আমি মায়ার দ্বারা তোমার ধনু গ্রাস করেছিলাম। আর, এই সেই অক্ষয় তূণ দুটিও পুনরায় তোমার হোক। তোমার শরীরের সব বেদনা দূর হোক। পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুন! তুমি যথার্থ পরাক্রমশালী; সুতরাং তোমার উপর আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। অতএব তুমি আমার নিকট তোমার অভীষ্ট বর প্রার্থনা করো। হে সম্মানকারী অরিন্দম, মর্ত্যলোকে তোমার তুল্য কোনও পুরুষ নেই এবং স্বর্গেও তোমার থেকে অধিক ক্ষাত্রশক্তিশালী লোক নেই।”

অর্জুন বললেন, “প্রভু বৃষধ্বজ! আপনি প্রীতিবশত যদি আমাকে অভীষ্ট বর দান করেন, তবে আমি সেই ভয়ংকর দিব্য পাশুপত অস্ত্র পেতে ইচ্ছা করি। যে অস্ত্রের নাম ‘ব্রহ্মশির’, যা কেবলমাত্র আপনার কাছেই আছে, যার পরাক্রম ভয়ংকর এবং দারুণ প্রলয়কাল উপস্থিত হলে সমগ্র জগৎকেই গ্রাস করে ফেলে। মহাদেব! ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ প্রভৃতি বীরশ্রেষ্ঠদের সঙ্গে আমার মহাযুদ্ধ হবে; সেই যুদ্ধে আপনার অনুগ্রহে আমি যেন জয়ী হতে পারি। সেই অস্ত্র আমাকে দান করুন, যার সাহায্যে আমি যুদ্ধে দানব, রাক্ষস, ভূত, পিশাচ, গর্ন্ধব ও নাগদের দগ্ধ করতে সমর্থ হব। যে অস্ত্র অভিমন্ত্রিত করলে, তা থেকে সহস্র সহস্র শূল, ভয়ংকর গদা এবং সর্পাকৃতি বাণ সকল আবির্ভূত হতে থাকে। সেই অস্ত্রদ্বারা আমি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এবং সর্বদা কটুভাষী কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব। ভগবান! কামনাশক! আমার এই প্রথম কামনা যে, আমি যেন শত্ৰুসংহারে সমর্থ হই।”

মহাদেব বললেন, “প্রভাবশালী পাণ্ডব! আমার প্রিয় পাশুপত অস্ত্র আমি তোমাকে দান করব। কেন না, তুমিই তা ধারণ, প্রয়োগ ও উপসংহারে সমর্থ মহাবীর। ইন্দ্র, যম, কুবের, বরুণ কিংবা বায়ুও এ অস্ত্র জানেন না। মানুষেরা জানবে কী করে? অর্জুন তুমি সহসা কোনও লোকের উপরে এ অস্ত্র নিক্ষেপ কোরো না। কারণ, দুর্বলের উপর ব্যবহার করলে এই অস্ত্র পৃথিবী ধ্বংস করবে। স্থাবর-জঙ্গমাত্মক ত্রিভুবনের মধ্যে এ অস্ত্রের কোনও অবধ্য নেই। বিশেষত এই অস্ত্র মন, নয়ন, বাক্য ও ধনু দ্বারা ব্যবহার করা চলে।” এই কথা শুনে অর্জুন পবিত্র ও একাগ্রচিত্ত হয়ে মহাদেবের সামনে গিয়ে বললেন, “শিক্ষা দিন।” তারপর মহাদেব মন্ত্র, সংকেত ও উপসংহারের সঙ্গে মূর্তিমান যমের তুল্য সেই অস্ত্র অর্জুনকে দিলেন। পাশুপত অস্ত্র শিবের যেমন অনুগত ছিল, তেমনই অর্জুনেরও অনুগত হল। অর্জুন সন্তুষ্ট হয়ে তা গ্রহণ করলেন। তখন পর্বত, বন, বৃক্ষ, সমুদ্র, বনসন্নিহিত স্থান, গ্রাম, নগর ও খনির সঙ্গে সমগ্র পৃথিবী কাঁপতে লাগল। সহস্র সহস্র শঙ্খ, দুন্দুভি ও ভেরির শব্দ ও বিশাল নির্ঘাতের শব্দ শোনা গেল। তখন সেই ভয়ংকর পাশুপত অস্ত্র মূর্তি ধারণ করে অমিততেজা অর্জুনের পাশে থেকে ভয়ংকরভাবে জ্বলতে লাগল। দেব ও দানবগণ তা দেখলেন। মহাদেবের স্পর্শে অর্জুনের শরীরের ক্ষত বা বেদনা তিরোহিত হল। মহাদেব অনুমতি দিয়ে বললেন, “অৰ্জুন তুমি স্বর্গে গমন করো।” অর্জুন তখন মস্তক দ্বারা মহাদেবকে প্রণাম করে কৃতাঞ্জলি হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে রইলেন।

অর্জুন স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, দেবাদিদেব মহেশ্বর দেবী পার্বতীর সঙ্গে চলে যাচ্ছেন। তাঁর তখনও ঘোর কাটেনি। বিমূঢ়চেতনা জড় পদার্থের মতো অৰ্জুন সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বিপক্ষবীরহস্তা বিচিত্রকর্মা অক্লিষ্ট যোদ্ধা অর্জন চেতনা ফিরে পেলেন। কিন্তু তাঁর বিস্ময় তখনও কাটেনি। “আমি মহাদেবকে প্রত্যক্ষ দেখতে পেয়েছি”, এই কথা ভেবে অর্জুনের বিস্ময়ের কোনও সীমা পরিসীমা রইল না। “আমি ধন্য হয়েছি এবং অনুগৃহীত হয়েছি। যেহেতু, ত্রিলোচন, পিনাকধারী ও বরদাতা মূর্তিমান মহাদেবকে আমি দেখতে পেয়েছি এবং আপন হস্তদ্বারা স্পর্শ করতে পেরেছি।

কৃতার্থঞ্চাবগচ্ছামি পঞ্চাত্মানমাহবে।
শত্ৰুশ্চ বিজিতান্‌ সর্বান্ নিবৃত্তাঞ্চ প্রয়োজনম্॥ বন : ৩৬ : ৪ ॥

“আমি নিজেকে কৃতার্থ বলে মনে করছি, যুদ্ধে সকল শত্রুকেই বিজিত বলে আমার বোধ হচ্ছে এবং আমার সমস্ত প্রয়োজন সিদ্ধ হয়েছে বলে আমার ধারণা হচ্ছে।”

অর্জুন যখন এইভাবে চিন্তা করছিলেন তখন সমস্ত দিক আলোকিত করে জলজন্তুসমূহের সঙ্গে বৈদূর্যমণির ন্যায় সুন্দর শ্যামবর্ণ জলাধিপতি বরুণ সেখানে উপস্থিত হলেন। ক্রমে সর্প, নদ, নদী, দৈত্য, সাধ্য ও দেবগণ সেখানে উপস্থিত হলেন। উজ্জ্বল স্বর্ণবর্ণধারী কুবের উপস্থিত হলেন। জগৎসংহারকারী, মনোহর মূর্তি, প্রতাপশালী, দণ্ডধারী, অচিন্তনীয় স্বভাব, সমস্ত প্রাণীবিনাশক সূর্যনন্দন ধর্মরাজ যম মূর্তিমান হয়ে উপস্থিত হলেন। তারপর মুহূর্তকালের মধ্যে ভগবান ইন্দ্র দেবগণ পরিবেষ্টিত হয়ে শচীদেবের সঙ্গে এসে উপস্থিত হলেন। তখন দক্ষিণদিকের অধিপতি, পরমধর্মজ্ঞ ও বুদ্ধিমান যম মেঘগম্ভীর স্বরে অর্জুনকে তাঁর পূর্বজন্মের বৃত্তান্ত জানিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন যে, অর্জুন মহাবল ও পরমধার্মিক ভীষ্মকে, দ্রোণ সমেত তার রক্ষিত ক্ষত্রিয়কুলকে, নিবাতকবচগণকে এবং “সমস্ত জগৎপ্রতাপী আমার পিতৃদেব সূর্যের অংশে মহাবল কর্ণকেও তুমি বধ করবে। …তুমি মহাযুদ্ধে সাক্ষাৎ মহাদেবকে সন্তুষ্ট করেছ এবং কৃষ্ণরূপী বিষ্ণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে পৃথিবীকে ভারশূন্য করবে।” এই বলে ধর্মরাজ যম তাঁর দণ্ড অর্জুনকে প্রদান করলেন। আশীর্বাদ করে জলাধিপতি বরুণ দিলেন তাঁর বারুণপাশ। কুবের দিলেন স্বয়ং মহাদেব যে অস্ত্রে ত্রিপুরাসুরকে বধ করেছিলেন সেই ‘অন্তর্ধান’ নামক অস্ত্র। অর্জুন দেবপ্রদত্ত মন্ত্রগুলি— মন্ত্র, ইতিকর্তব্যতা, প্রয়োগ ও উপসংহার যত্নের সঙ্গে শিক্ষা করে গ্রহণ করলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে আশীর্বাদ করে বললেন, “তুমি সনাতন ঈশ্বরের অংশ। তোমাকে গুরুতর দেবকার্য করতে হবে। আমার সারথি মাতলি এখনই রথ নিয়ে উপস্থিত হবে। তোমাকে স্বর্গে যেতে হবে। সেখানেই আমি সকল দিব্য অস্ত্র তোমাকে প্রদান করব।”

*

কিরাত-অর্জুন সম্মিলন মহাভারতের এক আশ্চর্য দুর্লভ মুহূর্ত। পরবর্তীকালে বনবাস থেকে ফিরে অর্জুন যখন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ও অন্য ভ্রাতাদের এই সম্মিলন-বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন তাঁরা বারবার রোমাঞ্চিত হয়ে ভূমিতে মাথা রেখে প্রণাম করছিলেন। অর্জুন বীরশ্রেষ্ঠ, তিনি মহাদেবের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবেন—এ ঘটনা আমরা ভাবতেই পারি। কিন্তু নিঃশেষিত-অস্ত্র অর্জুন মহাদেবের সঙ্গে মুষ্টিযুদ্ধে লিপ্ত হলেন, বাহুযুদ্ধ করলেন এবং দেবাদিদেব মহাদেবকে আপন বক্ষে পিষ্ট করে বধ করতে চাইলেন—এ দৃশ্য কল্পনা করা আমাদের মতো সাধারণ পাঠক তো দূরের, বোধকরি দেবতাদের পক্ষেও কল্পনা করা অসম্ভব। অর্জুন ভাগ্যবান তো বটেই, তাঁর জনক দেবরাজ ইন্দ্র, জননী কুন্তী দেবীও অসাধারণ ভাগ্য করেই এ সন্তান পেয়েছিলেন। মহাদেবের আশীর্বাদের ফলে অর্জুন ত্রিভুবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অতিরথের স্বীকৃতি পেলেন।

৩৯
অর্জুনের ঊর্বশী প্রত্যাখ্যান

[উর্বশী! ভারতীয় শিক্ষিত সমাজে এই নামটির মতো পরিচিতি অন্য কোনও স্বর্গ-অপ্সরা নেই। রূপে, গুণে অনন্যা এই নারী ভারতীয় কবিসমাজের চিরকালের চিত্তহারিণী। কালিদাস এঁকে নিয়ে কাব্য রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথ এঁর মধ্যে খুঁজে পান চিরকালের প্রিয়া নারীর রূপ; যে নারী স্বতন্ত্র, স্বেচ্ছা-বিহারিণী, কোনও সম্পর্কের বাঁধনে যাঁকে বাঁধা যায় না, যিনি মাতা নন, কন্যা নন, সুন্দরী বধূ নন, যিনি চিরকালের নারী। সেই উর্বশীকে পাণ্ডুনন্দন, ইন্দ্রতনয়, তৃতীয় পার্থ অর্জুন দেখেছিলেন। উৎসুকা উর্বশী আর অর্জুনের সাক্ষাৎ মহাভারতের এক দুর্লভ মুহূর্ত।]

দীর্ঘ তপস্যার শেষে অর্জুন কিরাতরূপী মহাদেবের সাক্ষাৎ পেলেন। লাভ করলেন তাঁর আশীর্বাদসহ পাশুপত অস্ত্র। দেবাদিদেব ঘোষণা করে গেলেন, অর্জুন ত্রিভুবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধারী, ত্রিলোকে তাঁর সমান বীর আর একজনও নেই। পিনাকপাণি অন্তর্হিত হলে দেবরাজ ইন্দ্রের রথ অর্জুনের কাছে উপস্থিত হল। জানাল, দেবরাজ আদেশ করেছেন অর্জুনকে স্বর্গে যেতে, সেখানেই তিনি পাবেন সব দিব্যাস্ত্র। অর্জুন সারথি মাতলির সঙ্গে রথে উঠলেন। মাতলি বিমান চালনা শুরু করার পূর্বে অর্জুন ইষ্টমন্ত্র জপ করে পর্বতরাজ হিমালয়কে প্রণাম করলেন, “পর্বতরাজ! মহাপর্বত! মুনিগণের আশ্রয়! তীর্থসমন্বিত! আমি তোমাকে সম্ভাষণ করছি, আমি তোমার কাছে সুখে বাস করেছি।” সারথি মাতলি দ্রুতবেগে রথচালনা করতে লাগলেন। রথ সিদ্ধলোক, রাজর্ষিলোক অতিক্রম করে দেবরাজ ইন্দ্রের অমরাবতীপুরীতে উপস্থিত হলেন। তখন গন্ধর্বগণ ও অপ্সরাগণ তাঁর স্তব করতে লাগল এবং পুষ্পসৌরভবাহী পবিত্র বায়ু এসে তাঁকে স্পর্শ করল; এই অবস্থায় তিনি দেখলেন, বহুতর কামগামী দেববিমান যথাস্থানে অবস্থান করছে এবং অপর কতকগুলি বিমান নানাদিকে যাতায়াত করছে। তারপর দেবগণ, গন্ধর্বগণ, সিদ্ধগণ ও মহর্ষিগণ এসে হৃষ্টচিত্তে অর্জুনের সংবর্ধনা করলেন।

তারপর, ইন্দ্রের আদেশে তিনি ‘দেবরথ্যা’ নামে প্রসিদ্ধ বিশাল নক্ষত্র-পথে গমন করলেন; তখন সকল দিক থেকেই তাঁর স্তব হতে লাগল। সেখানে সাধ্যগণ, বিশ্বদেবগণ, মরুদ্‌গণ, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, নিষ্পাপ ব্ৰহ্মর্ষিগণ, দিলীপ প্রভৃতি বহুতর রাজা, তম্বুরু, নারদ এবং হাহা ও হুহু নামে দুজন গন্ধর্ব অবস্থান করছিলেন। অর্জুন যথাবিধানে তাঁদের দেখার পর দেবরাজ ইন্দ্রকে দেখতে পেলেন। অর্জুন রথ থেকে অবতরণ করে দেবাধিপতি পিতা ইন্দ্রকে প্রত্যক্ষ দর্শন করলেন। তখন কোনও ভৃত্য শুভ্রবর্ণ, স্বর্ণদণ্ড মনোহর একটি ছত্র দেবরাজের মাথার উপরে ধরেছিল, দু’জন অপ্সরা দিব্য সৌরভবাহী দুটি চামর দোলাচ্ছিল। আর বিশ্বাবসু প্রভৃতি গন্ধর্বেরা স্তুতিগানদ্বারা এবং ব্রাহ্মণেরা ঋক, যজু ও সামবেদের মন্ত্রদ্বারা স্তব করছিলেন।

অর্জুন কাছে গিয়ে মাথা ইন্দ্রের পায়ের উপর রেখে প্রণাম করলেন। ইন্দ্রও স্থূল ও গোল বাহুযুগলদ্বারা অর্জুনকে ধারণ করলেন। তারপর ইন্দ্র অর্জুনের হাত ধরে তাঁকে—দেবতা ও রাজর্ষি দ্বারা পূজিত পবিত্র নিজের আসনেরই অর্ধ-অংশে বসতে দিলেন। অর্জুন তখন বিনয়ে অবনত হয়ে কুণ্ঠায় ও লজ্জায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন, এই অবস্থায় বিপক্ষ-বীরহস্তা ইন্দ্র তাঁর মস্তকাঘ্রাণ করে তাঁকে আপন কোলে তুলে নিলেন। ইন্দ্র স্নেহবশত পবিত্র সৌরভবাহী হাত দিয়ে অর্জুনের সুন্দর মুখখানির চিবুক স্পর্শ করে তাঁকে আশ্বস্ত করলেন।

অর্জুনের বাহুযুগল স্বর্ণময় স্তম্ভযুগলের ন্যায় দীর্ঘ, সুলক্ষণ এবং গুণ ও বাণের ঘর্ষণে কঠিন ছিল; আবার ইন্দ্রের হাতও বজ্র ধারণের চিহ্নে চিহ্নিত ছিল; ইন্দ্র আপন হাত দিয়ে অর্জুনের হাতের উপর বুলিয়ে দিতে লাগলেন, মাঝে মাঝে অর্জুনের হাতের উপর চাপড় মারতে থাকলেন এবং অত্যন্ত আনন্দিত চিত্তে ঈষৎ হাস্য করতে করতে অর্জুনের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে লাগলেন। কিন্তু দেখে দেখেও তাঁর যেন তৃপ্তি হচ্ছিল না। কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে উদিত চন্দ্র ও সূর্য যেমন আকাশকে শোভিত করে, তেমনি একাসনে বসে ইন্দ্র ও অর্জুন যেন ইন্দ্রের সভাটিকেই শোভিত করতে লাগলেন।

তখন সামগানে নিপুণ তম্বুরু প্রভৃতি গন্ধর্বগণ যথানিয়মে সামমন্ত্র সহ মনোহর সংগীত শুরু করলেন। পদ্মের পাপড়ির মতো সুনেত্রা, ক্ষীণ কটি, বিশাল নিতম্বা ঘৃতাচী, মেনকা, রম্ভা পূর্বচিত্তি, স্বয়ম্প্রভা, উর্বশী, মিশ্রকেশী, বপুগৌরী, বরূথিনী, গোপালী, সহজন্যা, কুম্ভযোনি, প্রজাগরা, চিত্রসেনা, চিত্রলেখা, সহা ও মধুরস্বরা প্রভৃতি অপ্সরা—যারা সিদ্ধগণের চিত্তবিনোদন সমর্থা, স্তন আস্ফালিত করে, কটাক্ষ ও হাবভাবের মাধুর্য সহকারে চিত্তবুদ্ধিমনহারিণী নৃত্য আরম্ভ করল।

দেবতারা ইন্দ্রের অভিপ্রায় বুঝে গন্ধর্বদের সঙ্গে মিলিত হয়ে, উত্তম অর্ঘ্য নিয়ে অর্জুনের পূজা করলেন। পাদ্য ও আচমনীয় গ্রহণ করার পর অর্জুনকে তাঁরা ইন্দ্রের ভবনে প্রবেশ করালেন। এইভাবে সম্মানিত হয়ে অর্জুন, ইন্দ্রভবনেই থেকে ইন্দ্রের প্রিয় বজ্র ও অন্যান্য অস্ত্র ইন্দ্রের কাছ থেকে শিক্ষা করতে লাগলেন। অস্ত্রশিক্ষা সমাপ্ত হলে অর্জুন আপন ভ্রাতাদের স্মরণ করলেন, তবুও ইন্দ্রের আদেশে পাঁচ বৎসর ইন্দ্রভবনেই বাস করলেন। তারপর একদিন যথাসময়ে ইন্দ্র অর্জুনকে আদেশ করলেন, “কুন্তীনন্দন, তুমি গন্ধর্ব চিত্রসেনের কাছ থেকে গান-বাজনা শিক্ষা করো। দেবতাদের যে বাজনা নিজস্ব, যা পৃথিবীতে প্রচলিত নেই, তুমি সেই দুর্লভ বাদ্য শিক্ষা করো, তোমার মঙ্গল হবে।” এই কথা বলে ইন্দ্র গন্ধর্ব চিত্রসেনকে অর্জুনের সখা করে দিলেন। চিত্রসেনও মনের সুখে অর্জুনকে নাচ, গান, বাজনা শেখাতে লাগলেন। তবুও বলবান অর্জুন দ্যূতক্রীড়ার বিষয় স্মরণ করে, দুঃশাসন ও সুবলপুত্র শকুনিকে দ্রুত বধ করার চিন্তায় এবং মাতা কুন্তী দেবীকে স্মরণ করে সুখ পাচ্ছিলেন না।

অর্জুনের দৃষ্টি উর্বশীর উপরে সংসক্ত হয়েছে, এই ধারণা করে দেবরাজ ইন্দ্র কোনও এক সময়ে নির্জনে চিত্রসেনকে বললেন, “গন্ধর্বরাজ তুমি দ্রুত গিয়ে অপ্সরাশ্রেষ্ঠ উর্বশীর কাছে গিয়ে বলো যে, সে আজই পুরুষশ্রেষ্ঠ অর্জুনের কাছে উপস্থিত হোক। অস্ত্রে সুশিক্ষিত, অন্যান্য বিষয়ে সুনিপুণ এবং স্ত্রী সংসর্গে বিশারদ যাতে আমার আদেশে উর্বশী কর্তৃক সন্তোষিত হন, তুমি তা করবে।” দেবরাজের আদেশ পালনের জন্য গন্ধর্ব চিত্রসেন উর্বশীর কাছে উপস্থিত হলেন। আনন্দিত চিত্রসেনকে তাঁর কাছে আসতে দেখে উর্বশী স্বাগত সম্ভাষণ করে তাঁকে বসার অনুরোধ জানিয়ে, নিজে সুখে উপবেশন করল। তখন চিত্রসেন মৃদু হাস্য করে বললেন, “সুনিতম্বে! তুমি অবগত হও যে স্বর্গাধিপ ইন্দ্রের আদেশে আমি তোমার কাছে এসেছি। উর্বশী, যিনি দয়াদাক্ষিণ্য প্রভৃতি স্বাভাবিক গুণ, কান্তি, স্বভাব, রূপ, ব্রত ও ইন্দ্রিয় সংযম দ্বারা দেবলোক ও মনুষ্যলোকে বিখ্যাত, যিনি শাস্ত্রজ্ঞান ও দৈহিক বলে বিখ্যাত, লোকপ্রিয়, প্রত্যুৎপন্নমতি, লাবণ্যবান, উৎসাহী, ক্ষমাবান ও পরবিদ্বেষবিহীন যিনি ব্যাকরণ প্রভৃতি অঙ্গশাস্ত্র ও উপনিষদের সঙ্গে চারবেদ ও সমস্ত উপাখ্যান অধ্যয়ন করেছেন, গুরুশুশ্রূষা জানেন এবং অষ্টবিধ গুণসম্পন্ন বুদ্ধি লাভ করেছেন; যিনি ব্রহ্মচর্য, কার্যদক্ষতা, সম্ভ্রান্ত ও যৌবনসম্পন্ন বলে ইন্দ্র যেমন স্বর্গ রক্ষা করেন, তেমনই পৃথিবী রক্ষা করার যোগ্য; যিনি আত্মশ্লাঘা করেন না, গুরুজনের সম্মান করেন, সূক্ষ্মদর্শী, প্রিয়ভাষী এবং নানাবিধ অন্নপানদ্বারা বন্ধুবর্গের সন্তোষবিধান করেন; যিনি সত্যবাদী, তেজস্বী, বক্তা, রূপবান, অহংকারশূন্য, ভক্তের প্রতি দয়ালু, কমনীয়স্বভাব, লোকপ্রিয় এবং সত্যপ্রতিজ্ঞ; আর যিনি স্পৃহণীয় গুণসমূহদ্বারা ইন্দ্র ও বরুণের তুল্য; সেই মহাবীর অর্জুন তোমার পরিচিত; তিনি যেন স্বর্গলোকে আগমনের ফললাভ করেন। সেই অর্জুন আজ দেবরাজের আদেশে তোমার চরণযুগলের আশ্রয় নেবেন; কারণ তিনি তোমার শরণাপন্ন হয়েছেন। চিত্রসেনের বক্তব্য শুনে উর্বশী নিজেকে অত্যন্ত গৌরবের পাত্রী বিবেচনা করে চিত্রসেনকে বলল, “গন্ধর্বরাজ, আপনি আমার কাছে অর্জুনের যে সত্য গুণগ্রামের বর্ণনা দিলেন, তা শুনে কি কোনও রমণী অর্জুন ভিন্ন অন্য পুরুষকে কামনা করে? অতএব দেবরাজের আদেশে, আপনার বন্ধুত্ব এবং অর্জুনের গুণ শুনে আমার অর্জুনের প্রতি কামোদ্রেক হয়েছে; অতএব সখা, আপনি এখন আসুন, আমি অর্জুনের গৃহে যাত্রা করব।”

তারপর নির্মলহাসিনী উর্বশী কৃতকার্য চিত্রসেনকে বিদায় করে অর্জুনদর্শনের অভিলাষিণী হয়ে স্নান করল। অর্জুনের রূপ শুনে উর্বশীর মন মদনবাণে জর্জরিত হয়েছিল, তাই সে স্নানের পর মনোহর অলংকার ও সুন্দর গন্ধমাল্য ধারণ করল; তখন তার মন অন্য পুরুষের দিকে না যাওয়াতে মনের সংকল্প অনুযায়ী সে যেন সতী স্ত্রীর মতো সুচিত্তা ছিল; আর দিব্য আবরণে আবৃত এরং বিস্তৃত শয্যায় যেন অর্জুন এসেছেন, যেন তার সঙ্গে রমণ করছেন, সে এইরূপ মনে মনে ভাবতে থাকল। এই অবস্থায় বিপুল-নিতম্বা উর্বশী চন্দ্রোদয় হলে প্রদোষকালে আপন গৃহের বাইরে এসে অর্জুনের গৃহের দিকে যাত্রা করল। পরমশোভিতা উর্বশীর যাত্রাকালে তার কোমল, কুটিল, দীর্ঘ ও পুষ্পমাল্যধারী কেশকলাপ ঝুলছিল। তার সুন্দর চলার ছন্দে এবং মনে মনে সে যে কথা বলছিল, তাতে তার অপূর্ব মুখচন্দ্র যেন আকাশের চন্দ্রকে আহ্বান করছিল। তার চলার প্রতি পদক্ষেপে তার স্তন দুটি লাফাচ্ছিল; সেই সুন্দরবৃন্ত স্তন দুটি দিব্য অঙ্গরাগে ও দিব্য চন্দনে রঞ্জিত ছিল এরং তার উপর হার ঝুলতে থাকায় তা অতিমনোহর বোধ হচ্ছিল। সেই স্তনযুগলের ভারে সে সমস্ত পথ অবনত হয়ে চলছিল এবং তার শরীরের মাংস তিনটি স্তর সৃষ্টি করে অত্যন্ত শোভা পাচ্ছিল। তার নাভির নিম্নভাগ শুভ্র, পর্বতের ন্যায় বিস্তীর্ণ, নিতম্বযুগলদ্বারা উন্নত ও স্থূল এবং কাঞ্চীদামে অলংকৃত হওয়ায় কামের আয়তন হয়েছিল। তার সূক্ষ্ম বস্ত্রাবৃত পরম সুন্দর জঘনদেশ স্বর্গীয় ঋষিগণেরও চিত্তসংযমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করছিল। তার চরণযুগলের গুলফদেশ অত্যন্ত গভীর, তাম্রবর্ণের আঙ্গুলগুলি পদ্মপাপড়ির মতো এবং উপরিভাগ কূর্মপৃষ্ঠের মতো উন্নত ছিল, তাতে কিঙ্কিণী সংলগ্ন ছিল। সুতরাং সে চরণযুগল অত্যন্ত শোভা পাচ্ছিল।

অল্প মদ্যপান, মনের সন্তোষ, কামের উদ্রেক এবং নানাবিধ বিলাস দ্বারা উর্বশী অতি সুদৃশ্যই হয়েছিল। সিদ্ধ, চারণ ও গন্ধর্বগণের সঙ্গে যাবার সময়ে বিলাসিনী উর্বশীর আকৃতিটি বহুতর আশ্চর্য পদার্থে পরিপূর্ণ স্বর্গেও অত্যন্ত আশ্চর্যের এক বস্তু হয়েছিল। মেঘের ন্যায় নীলবর্ণ, চিত্তহারী, অতিসূক্ষ্ম, মনোহারী একটি উত্তরীয় বস্ত্রে তার উপরিভাগ আবৃত ছিল। আকাশে মেঘাবৃত চন্দ্রলেখা যেমন গমন করে সেইভাবে গমন করছিল। কিছুকালের মধ্যে মন ও বায়ুর মতো গতিশীলা উর্বশী অর্জুনের গৃহপ্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন। দৌবারিকেরা গৃহকর্তা অর্জুনের নিকট সংবাদজ্ঞাপন করল যে, অপ্সরাশ্রেষ্ঠা উর্বশী গৃহদ্বারে অপেক্ষমাণা।

দৃষ্ট্রেব চৌর্বশীং পার্থো লজ্জাসংবৃতলোচনঃ।
তদাভিবাদনং কৃত্বা গুরুপূজাং প্রযুক্তবান্॥ বন : ৩৯ : ৩৬ ॥

উর্বশীকে দেখেই অর্জুন নয়নযুগল সংবৃত করলেন এবং অভিবাদন করে গুরুর ন্যায় সম্মান করলেন।

অর্জুন বললেন, “দেবি। আপনি প্রধান অপ্সরাদের মধ্যেও প্রধানা; সুতরাং আমি মস্তকদ্বারা আপনাকে প্রণাম করছি; আপনি কী আদেশ করেন? আমি আপনার দাস উপস্থিত আছি।” অর্জুনের সেই কথা শুনে উর্বশীর যেন চৈতন্য লোপ পেল; তখন সে চিত্রসেন-সংবাদ অর্জুনকে শোনাল। উর্বশী বললে, মনুষ্যশ্রেষ্ঠ! চিত্রসেন আমার কাছে যা বলেছেন এবং আমি যেজন্য এখানে এসেছি, তা সমস্তই আপনাকে বলব। আপনি স্বর্গলোকে এসেছেন বলে দেবরাজ একটি মনোহর আসর বসিয়েছিলেন এবং স্বর্গলোক জুড়ে মহোৎসব শুরু হয়েছিল।

সেখানে সমস্ত রুদ্র, আদিত্য, অশ্বিনীকুমার ও বসু উপস্থিত ছিলেন এবং অগ্নি, চন্দ্র ও সূর্যের ন্যায় উজ্জ্বলমূর্তি প্রধান প্রধান মহর্ষি, রাজর্ষি, সিদ্ধ, চারণ, যক্ষ ও মহানাগ—এঁরা সকল পদ ও গৌরব অনুসারে উপযুক্ত স্থানে আসন গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের অলংকারগুলি জ্বলজ্বল করছিল। গন্ধর্বগণ বীণা বাজাচ্ছিলেন; অলৌকিক সংগীত গীত হচ্ছিল এবং প্রধান প্রধান সমস্ত অপ্সরা নৃত্যমুখর ছিলেন; কুরুশ্রেষ্ঠ পৃথানন্দন! এমন সময়ে আপনি নাকি কেবলমাত্র আমাকেই অনিমেষ নয়নে দেখছিলেন। আসর সমাপ্ত হলে, দেবরাজের অনুমতিক্রমে সকল দেবতা আপন আপন গৃহে চলে গেলেন এবং আপনার পিতার অনুমোদনক্রমে প্রধান প্রধান অপ্সরাও আপন আপন গৃহে চলে গেল।

তখন দেবরাজ ইন্দ্র নির্দেশ দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন। চিত্রসেনও এসে আমার কাছে বললেন, “বরবৰ্ণিনি! দেবরাজ তোমার কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন। অতএব তুমি দেবরাজের, আমার এবং তোমার নিজের প্রিয় কার্য করো। সুনিতম্বে। অর্জুন যুদ্ধে ইন্দ্রের তুল্য বীর, বিশেষত রূপ ও উদারতা গুণসম্পন্ন; সুতরাং তুমি গিয়ে অর্জুনের কাছে রতি প্রার্থনা করো।” হে অর্জুন, আমি চিত্রসেনের এবং আপনার পিতার অনুমতিক্রমে আপনার সেবা করার জন্যই আপনার কাছে এসেছি। আমার চিত্ত আপনার গুণে আকৃষ্ট হয়েছে; আমি কামের বশীভূত হয়ে পড়েছি। আপনি আমার চিরাভিলষিত; সুতরাং আপনার সঙ্গে মিলন আমারও অভীষ্ট।

উর্বশীর কথা শুনে অর্জুন অত্যন্ত লজ্জিত হলেন এবং সেই স্বর্গলোকেই দু’হাত দিয়ে আপন দুই কর্ণ ঢাকা দিয়ে বললেন, “ভাগ্যবতী আপনি আমাকে যে কথা বললেন, তা আমার শ্রবণ করাই অত্যন্ত অসঙ্গত; কারণ, আপনি আপনার গুরুপত্নীতুল্যা। এ আমার চিরন্তন ধারণা। আমার কাছে দেবী কুন্তী যেমন, মহাভাগা শচী যেমন, আপনিও তেমনই। সুতরাং আপনি যা বলছেন, তা চিন্তা করাই উচিত নয়। একথা সত্য যে, আমি আপনাকে বিশেষভাবে দেখেছিলাম, তার সত্য কারণ আপনি শুনুন। ‘ইনি পুরুবংশের সর্বজনবিদিত জননী’ এই কথা স্মরণ করেই আমি উৎফুল্ল চোখে আপনাকে দেখছিলাম। অতএব কল্যাণী, আপনি আমাকে অন্যরূপে দেখতে পারেন না। আপনি আমার গুরুপত্নী অপেক্ষাও গুরুতরা এবং আমার বংশের বৃদ্ধিকারিণী।”

উর্বশী বললেন, “দেবরাজনন্দন! আমরা অপ্সরারা সকলেই অনিয়ন্ত্রিত। অতএব বীর, আপনি আমাকে গুরুপত্নী স্থানে স্থাপন করতে পারেন না। দেখুন পুরুবংশের যে সকল পুত্র, পৌত্র বা অন্যান্য বংশধর তপোবলে এখানে এসেছেন, তাঁরা সকলেই আমাদের সঙ্গে রমণ করেছেন। তাতে তাঁরা কেউই কোনও অসুবিধা বোধ করেননি। অতএব তুমিও আমার প্রতি প্রসন্ন হও। আমি কামপীড়িত বলে তুমি আমাকে ত্যাগ করতে পারো না। আমি কামসন্তপ্তা এবং তোমার প্রতি অনুরক্তা। অতএব তুমি আমাকে ভজনা করো।”

অর্জুন বললেন, “বরারোহা! আমি আপনার কাছে সত্য বলছি, আপনি শ্রবণ করুন। দেবগণের সঙ্গে দিক ও বিদিকগণও তা শ্রবণ করুন। আমার কাছে কুন্তী, মাদ্রী ও শচী দেবী যেমন, বংশের জননী বলে আপনিও তেমনই। কিংবা আপনি তাঁদের অপেক্ষাও গুরুতরা। আমি আপনার চরণে মস্তক রেখে নিবেদন করছি, আপনি চলে যান। আপনি মাতার মতো আমার পূজনীয়া। আমিও পুত্রের মতোই আপনার রক্ষণীয়া।”

অর্জুনের কথা শুনে, উর্বশী ক্রোধে মূর্ছিতপ্রায় হয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভ্রূকুটি করে অর্জুনকে অভিসম্পাত করল। উর্বশী বললেন, “অর্জুন তোমার পিতা অনুমতি দিয়েছেন। আমিও নিজেই তোমার ঘরে এসেছি এবং কামার্তা; তবুও তুমি যখন নপুংসকের মতো আমার আদর করলে না, তখন তুমি নর্তক রূপে সম্মানহীন ও পুরুষত্বহীন হয়ে স্ত্রীলোকদের মধ্যেই বাস করবে। সমস্ত পৃথিবীতে নপুংসক হিসাবে তুমি পরিচিত হবে।”

অর্জুনকে এই অভিসম্পাত করে, কম্পিত ওষ্ঠে দ্রুত নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে উর্বশী অর্জুনের গৃহ ত্যাগ করল। রাত্রি অবসান হলে নির্মল প্রভাতকালে চিত্রসেন অর্জুনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে অর্জুন পূর্বরাত্রির সমস্ত বৃত্তান্ত যথাযথভাবে জানালেন। চিত্রসেনও সেই সমস্ত বৃত্তান্ত এবং উর্বশীর শাপের বিষয় বিশদভাবে বারবার দেবরাজকে জানালেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র অর্জুনকে নির্জন স্থানে এনে, মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে আশ্বস্ত করে বললেন, “বৎস সাধুশ্রেষ্ঠ! তোমার মতো পুত্রের জন্য আজ কুন্তী দেবী সুপুত্রের জননী হলেন। তুমি আজ ধৈর্যদ্বারা ঋষিগণকেও জয় করেছ। মহাবাহু! উর্বশী তোমাকে যে শাপ দিয়েছে, তা তোমার পক্ষে প্রয়োজনসম্পাদক ও কার্যসাধক হবে। কারণ, এয়োদশ বৎসরের সময়ে ভূতলেই তোমাদের অজ্ঞাতবাস করতে হবে; তখন তুমি এই শাপ ক্ষয় করবে। তুমি নপুংসক নর্তকের বেশে এক বৎসরকাল থেকে পুনরায় পুরুষত্ব লাভ করবে।”

ইন্দ্র এই কথা বললে, শত্রুহন্তা অর্জুন অত্যন্ত আনন্দ লাভ করলেন—

এবমুক্তস্তু শক্রেণ ফাল্গুনঃ পরবীরহা।
মুদং পরমিকাং লেভে ন চ শাপং ব্যচিন্তয়ৎ॥ বন : ৩৯ : ৭৭ ॥

দেবরাজ ইন্দ্র এই কথা বললে অর্জুন সেই শাপের কথা আর বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে গন্ধর্ব চিত্রসেনের সঙ্গে অতি সুখে স্বৰ্গলোকে আনন্দ ভোগ করতে লাগলেন।

*

‘অর্জুন-উর্বশী সাক্ষাৎ’ মহাভারতের এক অত্যন্ত দুর্লভ মুহূর্ত। এই সাক্ষাতের প্রত্যক্ষ ফল হল, অজ্ঞাতবাস বৎসরে অর্জুনের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা। বৃহন্নলারূপে বিরাট রাজ-অন্তঃপুরে রাজকুমারী উত্তরার নৃত্যগীত শিক্ষক হিসাবেই অর্জুন অতিবাহিত করেন। এই আত্মগোপনকাল তাঁর শেষ হয় কৌরববাহিনী বিরাটরাজের গোধন হরণ করতে এলে। তখন অজ্ঞাতবাস কাল পূর্ণ হয়েছে। অর্জুনের আত্মপ্রকাশের অসুবিধা ছিল না। কিন্তু বৃহন্নলারূপেই রাজকুমার উত্তরকে সারথি করে নিয়ে তিনি একাকী ভীষ্ম দ্রোণাদি সমস্ত কৌরবপক্ষকে পরাজিত করেন ও গোধন উদ্ধার করেন।

‘অর্জুন-উর্বশী’ সাক্ষাতের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্রস্নেহ। পুত্রগর্বে গর্বিত, স্নেহব্যাকুল দেবরাজ ইন্দ্র যেন স্বর্গের সমস্ত দৈব আচরণ সরিয়ে রেখে মর্ত্যভূমির পিতার মতো আচরণ করেছেন। মানবদেহে অর্জুনকে স্পর্শ করেছেন, তাঁর মস্তকাঘ্রাণ করেছেন, সর্বদেহে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। পুত্রকে নিজে অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছেন, আপন অর্ধাসনে বসিয়েছেন। বয়ঃপ্রাপ্ত পুত্রকে যেমন বন্ধু নির্বাচন করে দিয়েছেন, তেমনই তাঁর জীবনে নারীর প্রয়োজন স্বীকার করে উর্বশীকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন। সূর্যও কর্ণকে ভালবাসতেন। স্বপ্নে দর্শন দিয়ে তিনি কর্ণের বিপদ সম্ভাবনা জানিয়েছেন, ইন্দ্রের প্রার্থনা অস্বীকার করতে বলেছেন। কর্ণ পিতার আদেশ শোনেননি। কিন্তু সশরীরে কর্ণের কাছে উপস্থিত হননি সূর্যদেব।

এই পর্বেই দেখা যায় দেবরাজ ইন্দ্রের নির্দেশে দেবতারা অর্জুনকে প্রয়োগকৌশল সমেত আপন আপন অস্ত্র দান করছেন। অর্জুন দিব্যাস্ত্র লাভ করছেন। শুধু একজন দেবতা অর্জুনকে কোনও অস্ত্র দান করেননি। তিনি সূর্যদেব। অথচ বনবাসকালে তিনি যুধিষ্ঠিরকে ‘তাম্রস্থালী’ দিয়েছেন৷ অজ্ঞাতবাস পর্বে দ্রৌপদীর অসম্মানে ক্রুদ্ধ হয়ে রাক্ষস প্রেরণ করেছেন কীচকের বক্ষে পদাঘাত করার জন্য। অর্জুনকে অস্ত্রদান বিষয়ে সূর্যদেব যেন অনেকটাই হোমারের মহাকাব্যের দেবতা।

‘অর্জুন-উর্বশী’ সাক্ষাতের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য অর্জুনের ধর্মসংগত আচরণ। অর্জুন রমণীপ্রিয়। যাচিকা উলূপীকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেননি। রূপে আকৃষ্ট চিত্রাঙ্গদা-সুভদ্রার সঙ্গে তাঁর সঙ্গম ঘটেছিল। কিন্তু স্বয়মাগতা উর্বশীর ক্ষেত্রে তাঁর সংযম লক্ষণীয়। উর্বশী তাঁর বংশের আদি জননী। ধর্মপরায়ণ অর্জুনের পক্ষে তিনি চির অগম্যা, গুরুপত্নীগমনের দোষ ঘটবে তাঁর। তা ছাড়া পিতৃদেব যতই বন্ধুত্বের ব্যবহার করুন না কেন, পিতৃভবনে থেকেই নারী সহবাস অর্জুনের পক্ষে অসম্ভব ব্যাপার। তা ছাড়া, অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ‘ভ্রাতাশ্চ শিষ্যশ্চ’। মর্ত্যভূমির সদাচার, শিষ্টতা, তিনি স্বর্গে এসেও বিস্মৃত হতে পারেন না। তাই অপ্সরাশ্রেষ্ঠা অর্জুনের কাছে প্রত্যাখ্যাত হলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *