2 of 2

৪.৫ শিক্ষার সমস্যা – ২

৪.৫ শিক্ষার সমস্যা

১৯৮৫ সালে রাজনীতির ক্ষেত্রে চমকপ্রদ কিছু সিদ্ধান্তের পাশে পাশে আরো দুয়েকটি বিষয়ের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিশেষভাবে দৃষ্টি পড়েছে। এর ভিতর আছে শিক্ষানীতি ও অর্থনীতি। শিক্ষার সমস্যা নিয়ে শান্তভাবে বিচার বিবেচনা হওয়া প্রয়োজন, কিছু আলোচনা হচ্ছেও। দেশের সামনে কিছু প্রশ্ন হঠাৎ সময়ে অসময়ে নাটকীয়ভাবে দেখা দেয় যেন অগ্নিকাণ্ডের মতো, যেমন আমরা দেখেছি পঞ্জাবের ক্ষেত্রে। আগুন নেভাবার চেষ্টা করতে হয় অবিলম্বে। আবার অন্য এক রকমের সমস্যা আছে যার দ্রুত কোন সমাধান আশা করা যায় না, অথচ দেশের মঙ্গল অমঙ্গলের সঙ্গে যার যোগ গভীর এবং দীর্ঘকালীন, যেমন শিক্ষা। এ নিয়ে একটু ধীরে, একটু তলিয়ে চিন্তা করলে ভাল হয়।

পরিচিত কয়েকটি কথা দিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক।

শিক্ষার যেমন একটা আদর্শের দিক আছে, অর্থাৎ সে মানুষ তৈরি করে, তেমনি তার একটা প্রয়োগের দিক আছে, অর্থাৎ সে কিছু ইতিহাসনির্দিষ্ট কাজের জন্য মানুষ তৈরি করে। ইংরেজ আমলে যে শিক্ষাব্যবস্থা এ দেশে গড়ে উঠেছিল তারও ঐরকম একটা প্রায়োগিক উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবেই চোখে পড়ে। এ দেশে যে শাসনযন্ত্র সেদিন প্রতিষ্ঠিত হয়। তাতে ছোট বড় মাঝারি নানা স্তরের চাকরিজীবী তৈরি হয়েছে নতুন শিক্ষাব্যবস্থার গুণে। সেই সঙ্গে পাওয়া গেছে আইনজীবী নতুন আইন আদালতের জন্য, ডাক্তার নতুন চিকিৎসাপদ্ধতির সেবায়, অনিবার্যভাবেই শিক্ষক,নতুন শিক্ষাব্যবস্থাকে চালিয়ে যাবার জন্য। যাঁরা অত্যাবশ্যক। আরো পাওয়া গেছে বৈজ্ঞানিক ও যন্ত্রবিদ। তবু প্রধান কথাটা এই যে, নতুন শিক্ষাব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে আধুনিক ভারতের সরকারি শাসনযন্ত্রের জন্য প্রশাসক। প্রথমে নিম্নস্তরে পরে সর্বস্তরে।

আমরা যারা প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাব্যবস্থার সন্তান তারা আজ ঐ ব্যবস্থাকে নিত্য বিদ্রূপ করতে অভ্যস্ত, আবার সেই সঙ্গে ওটাকে আঁকড়ে ধরে থাকতেও ব্যস্ত। দুয়ে মিলে অবস্থাটা। করুণ। অথচ ঐ বিদ্রুপে থাকে অতীতের সত্যের অনাবশ্যক বিকৃতি; আর আঁকড়ে ধরে থাকার আগ্রহে আছে বর্তমানের সত্যের প্রতি অবজ্ঞা। দুটো কথাই একটু বুঝে নেওয়া দরকার।

আমরা ব্যঙ্গ করে বলি, ইংরেজি শিক্ষাব্যবস্থার কাজ ছিল কেরানি তৈরি করা। কথাটা সম্পূর্ণ ঠিক নয়। ইংরেজি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছে প্রশাসক এবং শিক্ষক, আইনজীবী ও চিকিৎসাবিদ। এই নতুন শিক্ষাপ্রাপ্তদের সংখ্যা যখন প্রয়োজনের তুলনায় অতি স্ফীত হয়ে উঠল তখন অবশ্য অনেকের পক্ষে এমনকি কেরানির কাজ পাওয়াও দুষ্কর হ’ল। সে কথায় আমরা পরে ফিরে আসব। তার আগে অন্য একটা কথা স্মরণ করতে চাই।

ভারতকে আধুনিক যুগে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের মধ্যে বাঁধবার যোগ্য একটা শাসনতন্ত্র গড়ে উঠেছিল উনিশ শতকে। ক্রমে ক্রমে সৃষ্টি হয়েছিল ভারতীয়দের মধ্যে থেকেই এমন এক প্রশাসক গোষ্ঠী যাঁদের মধ্যে ছিল সর্বভারতীয় দৃষ্টি এবং নতুন জ্ঞানবিজ্ঞান সম্বন্ধে কিছু সচেতনতা। উনিশ শতকে ইংরেজী শিক্ষাপ্রাপ্ত বাঙালি মধ্যবিত্তকে আমরা পাই এক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকায়। সেই ভূমিকা বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বাংলাদেশের বাইরে আসাম থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বাঙালি ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে, শিক্ষক চিকিৎসাবিদ আইনজীবী হিসেবে। এঁরাই ছিলেন নতুন ইংরেজী শিক্ষার যথার্থ প্রতিনিধি।

কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। ইংরেজী শিক্ষার দিকে প্রথমে আকৃষ্ট হয়েছিল ভারতের কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলের প্রধানত হিন্দু উচ্চবর্ণের কিছু মানুষ। এঁরাই প্রশাসন যন্ত্রে এবং বুদ্ধিজীবীর কয়েকটি পেশায় সে যুগে প্রাধান্য পায় স্বাভাবিকভাবেই। ক্রমে ইংরেজী শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে এক অঞ্চল থেকে অন্যত্র। এক সম্প্রদায় থেকে ভিন্ন সম্প্রদায়ে, উচ্চবর্ণ থেকে নিম্নবর্ণে। এর ফলে নতুন মধ্যবিত্তের একদিকে যেমন আকার এবং সংখ্যা বৃদ্ধি পেল অন্যদিকে তীব্রতর হয়ে উঠল তার অন্তর্দ্বন্দ্ব। সেই দ্বন্দ্বেরই প্রকাশ দেখি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায়, আঞ্চলিক সংঘাতে, জাতিভিত্তিক কলহ ও সংঘর্ষে।

চলতি শিক্ষাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তার ঐতিহাসিক উদ্দেশ্য উত্তীর্ণ হয়ে এখন সে হয়ে উঠেছে এক জটিল সমস্যা। প্রশাসক তৈরি করা ছিল তার আদি উদ্দেশ্য। আজও এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে যাঁরা ডিগ্রী নিয়ে বেরোন তাঁদের প্রধান কাম্য অফিসের কাজ, সরকারি চাকরি। কিন্তু ডিগ্রীধারীদের সংখ্যা যত বাড়ে ততই তাদের সবাইকে অফিসের কাজ অথবা সরকারি চাকরি দেওয়া কঠিন এমনকি অসম্ভব হয়ে ওঠে; সীমাবদ্ধ পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমেই তীব্র এবং তিক্ত হয়ে ওঠে। নিম্নবর্ণের নব্যশিক্ষিতদের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে সংরক্ষিত চাকরির জন্য। যে সব পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে শিক্ষার প্রসার হয়েছে সম্প্রতি সেখান থেকে ভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে তাড়াবার জন্য আন্দোলন গড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা। একটি কেরানি অথবা আরো অধস্তন পদের জন্য অসংখ্য প্রার্থীর লাইন পড়ে। যায়। আজকের শিক্ষার সমস্যার বাইরের প্রকাশ বেকারি এবং সামাজিক দ্বন্দ্বে। তার আন্তরিক অভিব্যক্তি শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাহীনতায়।

কেরানি হবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিষ্প্রয়োজন। তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন টাইপিংটা শিখে নেওয়া। বস্তুত অধিকাংশ কাজের জন্যই কোনো না কোনো বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণ অথবা বৃত্তিমূলক শিক্ষাই বেশি উপযোগী। সরকার সম্প্রতি বলেছেন, ডিগ্রীর সঙ্গে চাকরির সম্পর্ক ছেদ করা হবে। কথাটার যুক্তিসঙ্গত অর্থ এই। ডিগ্রীর সঙ্গে যুক্ত আমাদের যে শিক্ষাক্রম তাতে ছেলেমেয়েদের মনে চাকরির প্রত্যাশা জাগান হয়, অথচ কোনো বিশেষ কর্মের জন্য তাদের প্রস্তুত করা হয় না। এই প্রস্তুতিহীন প্রত্যাশা সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলে।

আমাদের উনিশ শতকী ইংরেজী শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা ছিল এইখানে কারিগরির সঙ্গে তার যোগ ছিল নগণ্য। এ কথাটা যদিও বহুদিন থেকেই নানা রিপোর্টে বলা হয়েছে তবু সমাধানের পথে এখনও যথেষ্ট অগ্রসর হয়নি দেশ। আমরা যেন বস্তুত স্বীকার করে নিতে প্রস্তুত নই যে, দেশের শিক্ষিত মানুষদের ভিতরও অধিকাংশকে তৈরি করে তুলতে হবে অফিসের কাজের জন্য নয়, বরং হাতের কাজের জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর সঙ্গে এই সব কাজের কোন ব্যবহারিক সম্পর্ক নেই।

কর্মে নিয়োগ যদি ডিগ্রী অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলের ওপর নির্ভর না করে তবে যোগ্যতা নির্ধারণ এবং নির্বাচনের জন্য অন্য কোনো সুষ্ঠু ব্যবস্থা আবশ্যক। বিশেষ বিশেষ কর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে যোগ্যতানিধারক বিশেষ বিশেষ পরীক্ষার ব্যবস্থা সম্ভব। পরীক্ষার আগে চাই তার জন্য প্রস্তুতি। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের সুযোগ গ্রাম ও শহর জুড়ে এমনভাবে সংগঠিত হওয়া আবশ্যক যেন স্থানকালের প্রয়োজনের সঙ্গে তার সামঞ্জস্য ঘটে। সেই সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতার ভিতর না হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যেটা স্বধর্ম তার মূল কথা বিশ্ববিদ্যাসংগ্রহ। সেদিকেই তাকে আগ্রহী হতে হবে। বৃত্তিশিক্ষা সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পর্ক হবে প্রতিবেশিসুলভ মিত্রতার।

বলাবাহুল্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীর সঙ্গে কোনো কোনো কর্ম ও বৃত্তির ঘনিষ্ঠ যোগ ছিন্ন করা উচিত হবে না। যেমন শিক্ষকতার কাজ। অথবা গবেষণার কাজ। ডাক্তারি ডিগ্রী নিয়ে যিনি উত্তীর্ণ হবেন, চিকিৎসার কাজের জন্য তিনি যোগ্যতা অর্জন করেছেন এটা ধরে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর আছে কি? অবশ্য পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন হতে পারে। ইঞ্জিনিয়ারের বেলায়ও একই কথা।

এসবই সাধারণভাবে স্বীকার্য। তবু এর পরও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশকে একুশ শতকের জন্য তৈরি করে তুলতে হবে। কথাটা একদিক থেকে স্বতঃসিদ্ধ। একুশ শতক তো এখন আর দূরের জিনিস নয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দী বলতে আমাদের মনে এসে পৌঁছয় অন্য এক দ্যোতনা। তার সঙ্গে যোগ আছে প্রাগ্রসর পশ্চিমী দেশগুলির প্রযুক্তিবিদ্যার। একুশ শতকের জন্য দেশকে প্রস্তুত করতে হবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মুখ ঘুরিয়ে দিতে হবে সেই দিকে, এসব কথা শোনামাত্রই দৃষ্টি চলে যায় ঐ প্রাগ্রসর প্রযুক্তিবিদ্যার দিকে।

সন্দেহ নেই, এটাও প্রয়োজন। তবু দেশের একটা সামগ্রিক চিত্র আমাদের চোখের সামনে ধরে রাখা চাই। একটা কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ কিন্তু একুশ শতকের প্রারম্ভেও গ্রামে বাস করবে। আমরা যে শিল্পনীতিই আজ গ্রহণ করি না কেন, বাস্তব দৃষ্টিতে দেখলে ঐ কথাটা স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

বিজ্ঞান আমাদের চাই, প্রযুক্তিও চাই। কিন্তু প্রযুক্তির মূল্য মানুষেরই জন্য। যে দেশের অধিকাংশ মানুষ গ্রামবাসী এবং দরিদ্র সেখানে সেই অধিকাংশের দুঃখ লাঘব হয় এমনভাবেই বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিকে নিয়োগ করা আবশ্যক। আমাদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাতেও এই কথাটার স্বীকৃতি থাকা জরুরী। তা নইলে আশঙ্কা থাকে, দারিদ্র্য এবং বেকারি দীঘায়ু হবে আর ছোট একটি উচ্চশিক্ষিত গোষ্ঠী দেশের ওপর বোঝার মত চেপে বসে থাকবে। সমস্যাটা এই দিক থেকে দেখে সমাধানের পথ নিয়ে আরো গভীর চিন্তা। প্রয়োজন।

.

মায়ের বুকের দুধ শিশুর পক্ষে উপকারী। অথচ আজকাল শিশুরা অনেক সময় মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এর নানা কারণ আছে। মায়েরা অসুস্থ হতে পারেন। অথবা বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকতে পারেন। শিক্ষিতা ও অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন মায়েদের প্রকাশ্যে স্তন্যদানে সামাজিক সংকোচও যেন বেশি। ভিন্ন ধরনের একটা কারণের কথা। আমাকে বললেন শিশু বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তার। অশিক্ষিতা এবং অসচ্ছল পরিবারের মায়েদের ওপর এসে পড়ছে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত অভ্যাসের প্রভাব। ওঁদের বাড়িতে বাচ্চাকে বোতলে খাওয়ানো হয়, বাজার থেকে কিনে এনে টিনের খাবার দেওয়া হয়। ঐসব খাওয়ালে আমার শিশুটিও হয়তো স্বাস্থ্যবান, বুদ্ধিমান হবে, জীবনে উন্নতিও করবে বেশি।’ এইরকম একটা অস্পষ্ট চিন্তা কাজ করতে শুরু করেছে অভাবের ঘরেও।

এর ফল হয় খারাপ। গরিব মা বাজার থেকে টিনের দুধ হয়তো কিনলেন। অর্থের অনটন, কাজেই তাতে জল মেশালেন বেশি। বুকের শিশু মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হল, আবার বাজারের খাদ্যও ঠিকভাবে পেল না। উচ্চবিত্তদের অনুকরণ করতে গিয়ে। নিম্নবিত্তের মানুষের দুর্দশা আরও বেড়ে যায়। কথাটা এই। প্রয়োজন পড়লে বাজার থেকেও কিনতে হবে। কিন্তু প্রকৃতি তার গূঢ় দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় যে মাতৃস্তন্য সৃষ্টি করেছে, শিশুর দেহ ও মনের স্বাস্থ্যের জন্য সেটা ভালো। তার প্রতি অবজ্ঞায় কোনও গৌরব নেই। গৌরব বোধ করাটা মূর্খ। একটা শিক্ষিত কুসংস্কার অশিক্ষিতদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে।

যাঁরা বিত্তবান তাঁদের জন্য ভোগের নানা উপকরণ আসে দেশ দেশান্তর থেকে। গরিব দেশের গরিব মানুষের জন্য আছে অন্য পথ, হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তারই। সদ্ব্যবহার করা যথাসম্ভব। এর নাম স্বদেশী। স্বদেশী হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, তবু ওটা প্রয়োজন।

চিকিৎসা দিয়েই ব্যাপারটা আরও একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমাদের দেশে একদিন ছিল আয়ুর্বেদ। আধুনিক কালে এসেছে পশ্চিম থেকে ডাক্তারি। হাতের কাছে যেসব গাছ গাছড়া এবং অন্যান্য উপকরণ পাওয়া যেত তাই থেকে যথাসম্ভব ভেষজ তৈরি করবার চেষ্টা করেছেন এদেশের প্রাচীন আয়ুর্বের্দজ্ঞ। আধুনিক চিকিৎসা শাস্ত্র বিজ্ঞানসম্মত, তার পিছনে আছে বহু গবেষণা। কিন্তু তার কিছু অসুবিধাও আছে, বিশেষত আমাদের মতো গরিব দেশের পক্ষে যেটা উপেক্ষা করবার মতো নয়।

এদেশের উচ্চ পর্যায়ের মেডিক্যাল কলেজ থেকে যাঁরা সসম্মানে পাশ করে বেরোন তাঁদের ভিতর অনেকে বিদেশে গিয়েও ভালো পসার জমাতে পেরেছেন, দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। দেশের ভিতরও বড় বড় হাসপাতালে তাঁদের আমরা পাই। কিন্তু এ দেশেরই গ্রামে তাঁরা উল্লেখযোগ্যভাবে অসহায়। যেসব ঔষধের সঙ্গে তাঁরা সবিশেষ পরিচিত সেসব পল্লী গ্রামে পাওয়া কঠিন। এটা তাঁদের অপরাধ নয়, তবে অবস্থাটা এই যে চিকিৎসা পদ্ধতি অথবা অস্ত্রোপচারে তাঁরা দক্ষ, বড় হাসপাতালের বাইরে তার প্রয়োগ কঠিন, প্রায়শ অসম্ভব। গ্রামে গ্রামে বড় হাসপাতাল করা যাবে না। পল্লী অঞ্চলে হাতের কাছে যা পাওয়া যায় সে সব জিনিসের সঙ্গে আমাদের আধুনিক ডাক্তার তেমন পরিচিত নন। পুষ্টিকর খাদ্য সম্বন্ধে পরামর্শ দিতে গেলেও একই সমস্যা। যেসব খাদ্যের কথা মহানগরের শিক্ষিত ডাক্তারেরা বিশেষভাবে বলেন সেসব গ্রামের মানুষের নাগালের বাইরে। গ্রামে যা আছে অথবা সহজে পাওয়া যেতে পারে তারই যথাসম্ভব ব্যবহার করা যাবে কীভাবে সেটাই প্রশ্ন। যে আগ্রহ অথবা যে ধরনের গবেষণায় এই প্রশ্নের উত্তর আশা করা যায়, আমাদের মেডিক্যাল কলেজের পঠনপাঠনের। ঝোঁক সেদিকে নয়। আয়ুর্বেদে সেটা ছিল। বিজ্ঞাপনের জোরে যেসব ওষুধ চলে তাদের অনেক সময় একটা গুরুতর অনিষ্টের দিকও থাকে। দীর্ঘদিন পরীক্ষিত ভেষজে সে সম্ভাবনা কম।

পশ্চিমী চিকিৎসা শাস্ত্র ত্যাগ করবার কথা বলা হচ্ছে না। কিন্তু প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার অন্য একটা ধারাও উন্মুক্ত থাকা চাই যেটা দেশমুখী। সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। চীন দেশে একটা হাসপাতালে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে। দেখেছিলাম, দুটি ধারা পাশাপাশি আছে, একটি পশ্চিমী অন্যটি চীনের নিজস্ব। দ্বিতীয়টির সহায়ক হিসেবে হাসপাতালের সংলগ্ন জমিতে গাছ গাছড়া চাষের ব্যবস্থাও। রয়েছে। এই সেই হাসপাতাল যেটা ওঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন ভারতীয় ডাক্তার কোটনিসের স্মৃতিতে।

চিকিৎসা নিয়ে খানিকটা আলোচনা করা গেল। কিন্তু এটা উদাহরণমাত্র। আসল কথাটা আরও ব্যাপক। দেশকে একুশ শতকের জন্য তৈরি করবার প্রস্তাব হয়েছে। অন্তত ঐরকম একটা ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বলা হচ্ছে, আমরা পিছিয়ে আছি, আমাদের এগিয়ে-যাওয়া দেশগুলির সমান হতে হবে। একথা ঠিক যে প্রাগ্রসর দেশগুলির কাছ থেকে আমাদের কিছু শিখার আছে। কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আমাদের প্রয়োগ করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে, এদেশের অবস্থার সঙ্গে মিলিয়ে।

প্রযুক্তির যোগ প্রয়োজনের সঙ্গে। ওদেশের প্রযুক্তি তার বিশেষ রূপ লাভ করেছে। ওদেশেরই প্রয়োজনের চাপে। আমাদের প্রয়োজন ওদের সঙ্গে অনেকটাই মেলে না। আমাদের প্রয়োজনের সঙ্গে মিলিয়ে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবন যদি ঘটে এদেশে, তবেই বোঝা যাবে যে আমরা নিজ বুদ্ধিতে চলছি, আমরা স্বনির্ভর। এর বিকল্প নেই। প্রযুক্তি এবং ভোগ্য বস্তু উন্নত দেশের বাজার থেকে কিনে তাতে খানিকটা ভেজাল মিশিয়ে যথাসম্ভব গ্রহণ করলেই আমরা উন্নতির পথে দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব এমন নয়। এতে আমাদের। আর্থিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতিরই বরং সম্ভাবনা বেশি। উচ্চবিত্ত সমাজের অনুকরণ নয়, আধুনিকতম প্রযুক্তির মুগ্ধ অনুসরণ নয়, আমাদের চাই স্বদেশের সম্পদ ও প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্যের বিচারে উপযুক্ত প্রযুক্তি। ইংরেজিতে যার নামকরণ হয়েছে। appropriate icchnology তার সদর্থ সম্ভব এই বিচারে।

এ বিষয়টা নিয়ে আমাদের সাবধানে চিন্তা করতে হবে। কারণ ভুল ঘটতে পারে দুদিক থেকেই। আমাদের অর্থনীতির একটা দিক আছে যেখানে শিল্পোন্নত দেশগুলির যন্ত্র এবং যন্ত্রবিদ্যা বিশেষভাবে প্রয়োজন। যেমন ভারী শিল্পে। বিদেশের বাজারের জন্যও আমাদের কাজ করতে হয়। সেই সব দ্রব্যের কিছুটা সাবেকী, কিছু নতুন। এদেশের শ্রমের যদিও অল্পভাগই ভারী অথবা রপ্তানি শিল্পে নিযুক্ত তবু পৃথিবীর দিকে আমাদের জানালাটা খোলা রাখতে হবে। তা নইলে বিপদ দেখা দিতে পারে নানা ভাবেই।

এদেশের অধিকাংশ মানুষ কাজ করছে বড় বড় কারখানায় অথবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে নয়। তারা কাজ করছে গ্রামে গঞ্জে, স্থানীয় উপকরণ নিয়ে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে। এটাই আমাদের অর্থনীতির অন্য দিক, তার বৃহত্তর দিক। সেখানেও উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতি প্রয়োজন। দেশ বিদেশের জ্ঞান সেখানেও কাজে লাগানো সম্ভব। যেমন সবুজ বিপ্লব’ বলে যে ঘটনাকে আমরা চিনেছি তার পিছনে বিদেশী গবেষণার দান অনেকটা। কিন্তু পশ্চিমী কৃষিপদ্ধতি নির্বিচারে এদেশে প্রয়োগ করা সম্ভব নয়, ও পথে গেলে আরো অনেক মানুষকে বেকার হতে হবে। মার্কিন অথবা সোভিয়েত দেশে জমির তুলনায় মানুষ কম; আমাদের দেশে মানুষের তুলনায় জমি কম। আরও নানা পার্থক্য আছে। কাজেই চাষের পদ্ধতি এদেশে আর ওদেশে একরকম করা চলবে না।

ভারী শিল্প আমাদের চাই। কিন্তু এদেশের বেরোজগারের সমস্যা দূর করা যাবে না ভারী শিল্প দিয়ে। যেহেতু স্থানীয় উপকরণ নিয়ে স্থানীয় চাহিদা মেটাতে অধিকাংশ মানুষ নানা কাজে নিযুক্ত অতএব আমাদের বিজ্ঞান অথবা সংগঠিত চিন্তাশক্তিকেও নিয়োগ করতে হবে সেই সব কাজের ভিতর এগিয়ে যাবার গতি সঞ্চার করবার উদ্দেশ্যে। সেই আগ্রহ যেন ছড়িয়ে পড়ে এদেশের শিক্ষায় প্রশিক্ষণব্যবস্থায় গবেষণাগারে।

এদেশের সরকারি এবং আধা সরকারি নানা প্রতিষ্ঠান আছে যাদের ঘোষিত উদ্দেশ্য হল গ্রামোন্নয়নের কাজে সহায়তা করা। কিন্তু শহর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে উন্নয়নের কাজে যাঁরা নিযুক্ত তাঁদের অনেকেরই ঐ কাজের জন্য যথার্থ যোগ্যতা নেই। গ্রামে বাস করতে। তাঁরা আগ্রহী নন। আর যদি আগ্রহ দেখা যায় তবে সন্দেহ হয় যে গ্রামের রাজনীতিতে তাঁরা বড় বেশি জড়িয়ে গেছেন অথবা অন্য কোনও মতলব আছে। অথচ গ্রামোন্নয়ন একটা বড় কাজ। সেজন্য এমন কর্মী চাই যাঁরা গ্রামের ভাষা জানেন, সেখানকার সুবিধা। অসুবিধার কথা ভিতর থেকে বোঝেন, গ্রামবাসীর জন্য যাঁদের মমতা এবং সদিচ্ছা আছে। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতরই কি এই কর্মী তৈরি করবার দায়িত্বটা স্থান পেতে পারে না?

এটা হতে পারে দু’ভাবে। এক, বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার সাহায্যে। দ্বিতীয়, সমস্ত শিক্ষিত সমাজের ভিতরই রবীন্দ্রনাথ যাকে পল্লীসংগঠন এবং পল্লীসঞ্জীবন নামে চিহ্নিত করেছিলেন সেদিকে সচেতনতা সৃষ্টি করে।

গ্রামের জন্য ব্যাঙ্ক দরকার। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের _____ নির্দেশও দেওয়া আছে যে, কৃষি এবং ছোট শিল্পকে লগ্নির ব্যাপারে যেন অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ব্যাঙ্কের কাজকর্মের ধরনটা তৈরি হয়েছে কিন্তু নাগরিক ব্যবসাবাণিজ্যের বিশেষ ধাঁচে। ব্যাঙ্ক সংস্কৃতি’ বলে একটা কথা ইংরেজীতে চালু আছে যার ভাষা এবং রীতিনীতির গড়নটা ঐরকম। গ্রামের মানুষ তার সঙ্গে পরিচিত নয়। কিভাবে তাদের প্রয়োজনের কথাটা সাজিয়ে গুছিয়ে লিখলে সেটা গ্রাহ্য হতে পারে সেটা তারা জানে না। এ অবস্থায় ব্যাঙ্ক কর্মীর কাজ হবে না শুধু গ্রামবাসীর আবেদনপত্রটা পরীক্ষা করে দেখা। পদ্ধতিগতভাবে ব্যাঙ্ক এবং গ্রামবাসীর ভিতর একটা নির্ভরযোগ্য সেতু তৈরি করবার কাজেও অগ্রণী হতে হবে ব্যাঙ্কের কতাদেরই। গ্রাম থেকেই কিছু ছেলেকে বেছে নিয়ে তাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা সম্ভব গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কাজের জন্য।

অন্য অনেক দেশে ছেলেদের একটা বয়সে বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। এদেশে সব ছাত্রছাত্রীদের জন্য ব্যবস্থা করা যেতে পারে যে, ডিগ্রী লাভের আগে কিছুকাল তাদের গ্রামে কাজ করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের সেই সময় গ্রামে পাঠানো যেতে পারে শিক্ষার প্রসারের কাজে সহায়তা করবার জন্য। শহরের ছাত্রছাত্রীরাই যে গ্রামে শিক্ষা দানের পক্ষে সবচেয়ে যোগ্য, এমন মনে করবার কারণ দেখি না। তাদের গ্রামে পাঠানো প্রয়োজন শিক্ষা বিস্তারের কাজের ভিতর দিয়ে শিক্ষা লাভের জন্য, অর্থাৎ নিজেদের শিক্ষাটাকেই আরও সম্পূর্ণ করে নেবার উদ্দেশ্যে। পরবর্তী জীবনে তারা যে। ক্ষেত্রেই কাজ করুক না কেন, গ্রামের জীবনের সঙ্গে এই পরিচয় তাদের চেতনার পিছনে যেন কার্যকর থাকে। সমাজের কাছে ঋণ শোধ করবার জন্য এটাও আবশ্যক।

প্রশাসক তৈরি করা একদিন এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান কাজ ছিল। গ্রামোন্নয়নের জন্য কর্মী এবং দেশের চেতনা তৈরি করা কি আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ঐতিহাসিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে না? অন্তত গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথের মনে এ বিষয়ে কোন সংশয় ছিল না। মহানগরীর শ্রেষ্ঠ সন্তান তাঁর একমাত্র বয়স্ক পুত্রকে উৎসর্গ করেছিলেন শিক্ষা ও পল্লীসংগঠনের উদ্দেশ্যে। তাঁদের কাছে এটাই ছিল স্বদেশী চিন্তার সদর্থ।

.

এই শতাব্দীর মাঝামাঝি আমাদের দেশে গণতান্ত্রিক সংবিধান গৃহীত হয়। সেই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সকলের ভোটাধিকার, জনসংখ্যার বিচারে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশে। পরবর্তী তিরিশ বছরের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, শিক্ষার দ্রুত বিস্তার।

আমাদের অনেক সমস্যা কঠিন হয়ে উঠেছে জনসংখ্যার বিরাট বৃদ্ধির ফলে। ১৯৫০ সালের পর পঁয়ত্রিশ বছরে এদেশের জনসংখ্যা হয়ে গেছে দ্বিগুণেরও বেশি। এই বৃহৎ সংখ্যার তলায় চাপা পড়ে গেছে অনেক সদর্থক প্রয়াস। যেমন ধরা যাক, নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যাপারটা। এদেশে অক্ষরজ্ঞান আছে এমন লোকের সংখ্যা ১৯৫১ সালে ছিল ৬ কোটি, ১৯৮১ সালে সেটা হয়েছে প্রায় ২৫ সোটি। এটাকে কৃতিত্ব বলেই দাবি করা যেত। কিন্তু জনসংখ্যার বৃদ্ধির ফলে সেটা সম্ভব হল না। ১৯৫১ সালে আমাদের জনসংখ্যা ছত্রিশ কোটির কাছাকাছি। এরপর ঐ সংখ্যাটাকে যদি আমরা ধরুন পঁয়তাল্লিশ অথবা পঞ্চাশ কোটির ভিতর বেঁধে ফেলতে পারতাম তাহলে বলা সম্ভব হত দেশে নিরক্ষরদের সংখ্যা কমছে, পাঁচের ওপর যাদের বয়স তাদের অধিকাংশই সাক্ষরতা অর্জন করেছে। কিন্তু আমাদের জনসংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে সত্তর কোটি, সেই সংখ্যার বড় অংশটাই নিরক্ষর। জাপানে জনসংখ্যা বাড়ছে বছরে শতকরা একভাগ, সম্প্রতি আরো কম; ভারতে শতকরা আড়াই ভাগ। চীনে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য জোরালো নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। নানা কারণে সেটা এদেশে সম্ভব হচ্ছে না। যদি সম্ভব হত তবে অনেক সমস্যা অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে যেত। অর্থনীতি, শিক্ষানীতি ও জনসংখ্যা সংক্রান্ত নীতি পরস্পর সম্পৃক্ত। এদের ভিতর কোনো একটিকে এদেশে আলাদাভাবে সফল করে তোলা খুবই কঠিন। সব মিলে ব্যাপারটা জটিল।

যাই হোক, জনসংখ্যার অতিস্ফীতির পাশে পাশে ভারতে শিক্ষার দ্রুত প্রসারও তুচ্ছ করবার মতো নয়। ১৯৫০-৫১ সালের পর তিরিশ বছরে বিদ্যালয়ে মোট ছাত্রসংখ্যা বেড়ে হয়েছে প্রায় চারগুণ। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এই সংখ্যাবৃদ্ধির হার আরো অনেক বেশি। সেখানে বৃদ্ধি ঘটেছে চারগুণ নয়, প্রায় ষোলগুণ।

তবে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঞ্চাশ অথবা ষাটের দশকে ছাত্রের সংখ্যা যত দ্রুত বাড়ছিল পরবর্তী বছরগুলিতে তেমন নয়। সম্প্রতি অনেক কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভর্তি কমে গেছে। তারই ফলে একটা প্রশ্ন গত কয়েক বছরে তীক্ষ্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রশ্নটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রভর্তি নিয়ে।

উচ্চশিক্ষায় কার প্রবেশের অধিকার থাকবে? কোন শর্তে? এসব প্রশ্নের, এককথায় উত্তর হয় না। বিষয়টা নানা দিক থেকে বিচার করে দেখা দরকার। তবে একটা মূল কথা সরল সহজভাবে বলা যায়।

সে কথাটা এই: উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার মান উঁচু রাখা জরুরী। তা নইলে উচ্চশিক্ষার মানে হয় না। এটা শুধু আদর্শের কথা নয়। বাস্তব প্রয়োজনের কথা। উচ্চশিক্ষার ভিতর দিয়ে তৈরি হয় শিক্ষক, চিকিৎসক, দক্ষ বিজ্ঞানী ও যন্ত্রবিজ্ঞানী। আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি বেরিয়ে আসে অপটু ইঞ্জিনিয়ার তবে তাতে সমাজের গুরুতর ক্ষতির আশংকা। যদি তৈরি হয় অযোগ্য ডাক্তার তবে তাতে জনসাধারণের দুর্ভোগ। যদি পাওয়া যায় নিম্নমানের শিক্ষক ও বিজ্ঞানী তবে বিপদ নতুন প্রজন্মের, আগামী কালের মানুষের। উচ্চশিক্ষার মান যদি উঁচু রাখা না যায় তবে তাতে বিপদ সারা সমাজের। বিপন্ন আমাদের ভবিষ্যৎ।

এটাই তা হলে প্রথম শর্ত। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার মান উঁচু রেখে যত অধিক সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী নেওয়া আমাদের সাধ্যায়ত্ত ততটাই নেওয়া উচিত, তার বেশি নয়। সব মানুষের স্বাভাবিক ঝোঁক একদিকে নয়। কারো ঝোঁক যাকে বলে থিওরি বা তাত্ত্বিক অনুসন্ধান সেই দিকে। কারো স্বাভাবিক আগ্রহ এবং দক্ষতা শিল্পেসঙ্গীতে, কারো হাতের কাজে, কারো সমাজসেবায়, কারো বা সাংগঠনিক কাজে। মনুষ্যত্বের বিকাশের বিচারে এর। কোনোটাকেই ছোট বলা যায় না, সব পথেই তৈরি হয়েছে শ্রদ্ধেয় মানুষ। তৈরি হবার পথটা সকলের জন্য এক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সীমাবদ্ধ। সব কাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমান সহায়ক নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রীকে বেশি মান্য করাটা কুসংস্কার। অনেক কুসংস্কারের মতোই এটাও ক্ষতিকর হতে পারে, ডিগ্রীপ্রার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় উভয়ের পক্ষেই।

উচ্চশিক্ষার অনেকগুলি ধাপ আছে। উঁচু ধাপে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক ঝোঁক গবেষণা ও তাত্ত্বিক অনুসন্ধানের দিকে। সেইদিকে যাদের আগ্রহ এবং সম্ভাবনা বেশি, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের ব্যাপারে তাদেরই অগ্রাধিকার থাকা উচিত। তবে আরো দুটি কথা একই সঙ্গে বলে রাখা দরকার।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে অর্থাভাবে যাতে কেউ বঞ্চিত না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। এদেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র, কিন্তু দরিদ্রের ঘরেও যে উচ্চশিক্ষার যোগ্য বহু সন্তান জন্মগ্রহণ করে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। টাকার জোরে ছেলেমেয়েরা কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকতে পারছে আর অনেক সম্ভাবনাপূর্ণ গরিব ছেলেমেয়ের জন্য শিক্ষার পথ বন্ধ। এটা যেমন অন্যায় তেমনি সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর।

এই সঙ্গে আসে ‘একটা দ্বিতীয় কথা। শিক্ষার বিস্তার এবং পুনর্গঠনের সঙ্গে সঙ্গে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের আয়োজন বাড়বে। সেই উদ্দেশ্যে নতুন বহুমুখী সংগঠনের প্রয়োজন সম্বন্ধে আলোচনা হয়েছে। আমাদের কর্মী জনতার একটা বড় অংশ চলে যাবে কর্মক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ লাভের আগেই। জীবনে এবং কর্মক্ষেত্রে আরো কয়েক বছর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর কিন্তু অনেকের আগ্রহ জন্মাতে পারে উচ্চতর শিক্ষার জন্য। তখন যাতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবেশের পথ সেইসব মানুষের জন্য চিরকালের মতো বন্ধ। না হয়ে যায় সেই ব্যবস্থা রাখতে হবে। কর্মক্ষেত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনঃপ্রবেশের প্রশস্ত পথ চাই। সে কথা চিন্তা করেই উদ্ভাবিত হয়েছে মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা।

ইংরেজীতে একে বলা হয়েছে ‘ওপেন য়ুনিভার্সিটি’। সংসারের কর্মক্ষেত্রে একবার যিনি প্রবেশ করেছেন তাঁর পক্ষে সব কাজ ছেড়ে একটানা দু’তিন বছরের জন্য ছাত্রবৃত্তি গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। অতএব মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মকানুন এবং সংগঠন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পৃথক। যাই হোক, সংগঠনের বর্ণনা নয়, মূল উদ্দেশ্যটাই এখানে বিশেষভাবে লক্ষ করবার বস্তু। বিদ্যালয়ে পাঠান্তে ছেলেমেয়েরা নির্বিচারে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলে দেখা দেয় বৃত্তির সঙ্গে যোগ্যতার অনাবশ্যক অসামঞ্জস্য। অতএব প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের জন্য যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশেষ নির্বাচন। কিন্তু সংসারের নানা কর্মে ও বৃত্তিতে যাঁরা ছড়িয়ে পড়বেন জীবনের প্রথম পর্যায়ে, তাঁরাও যাতে উচ্চশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন কোনো পরবর্তী পর্বে, সেই পথ অবারিত করা সরকার ও শিক্ষা সংগঠনের সামনে একটা বড় কর্তব্য।

সরকারি নয়া শিক্ষানীতিতে জেলায় জেলায় ‘মডেল স্কুল’ বা আদর্শ বিদ্যায়তন স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলেছেন, বিরুদ্ধ সমালোচনা। শোনা গেছে অনেকের মুখে। বিরোধীদের প্রধান বক্তব্য এই যে, মডেল স্কুল মানেই বিভিন্ন বিদ্যালয়ের মধ্যে একটা স্তরভেদ, কিছু স্কুল হবে প্রথম শ্রেণীর, কিছু দ্বিতীয় শ্রেণীর।

সরকারি নীতি যাই হোক না কেন, সব স্কুল, সব কলেজ, সব বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু একই মানের হয় না। কোনো দেশেই নয়। আমেরিকার সব বিশ্ববিদ্যালয় হাভার্ড বা প্রিন্সটনের সমপর্যায়ের নয়, বিলেতে সব অক্সফোর্ড ক্যামব্রিজের মতো নয়, সোভিয়েত দেশে সব মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের অথবা ফরাসি দেশে সরবনের সমান নয়। স্কুল কলেজের ক্ষেত্রেও একই কথা। এটাই বাস্তব পরিস্থিতি। উন্নতমানের অধিকাংশ স্কুল এখন বড় বড় শহরে, রাজধানীতে অথবা মহানগরীতে। রামকৃষ্ণ মিশনকে ধন্যবাদ। তাঁরা রাজধানীর বাইরে কিছু ভাল স্কুল চালাচ্ছেন।

প্রশ্নটা তা হলে এই নয় যে, উন্নতমানের কিছু বিশেষ স্কুল থাকবে কি না। প্রশ্নটা এই যে, মহানগরীর বাইরের জেলায় জেলায় কিছু আদর্শ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবার প্রস্তাব সমর্থনযোগ্য কি না। সব বিদ্যালয়কে একসঙ্গে আদর্শ বিদ্যালয় করে তোলা যাবে না। সেটা অবাস্তব কথা। কিন্তু জেলায় জেলায় কিছু মডেল স্কুল ছড়িয়ে দেবার পরিকল্পনা। গ্রহণ করা যায়। সেটা হবে যুক্তিসঙ্গত কথা।

গ্রামাঞ্চলে অনেক উজ্জ্বল ছেলেমেয়ে আছে। ভাল স্কুলের সন্ধানে তাদের মহানগরীতে পাঠাতে হবে কেন? অনেক পরিবারের সেই সামর্থ্য নেই। জেলার ভিতরই ভাল স্কুলের সন্ধান থাকা চাই। জেলায় জেলায় কিছু স্কুল তো আছে, পুরনো সরকারি জিলাস্কুলই হোক বা বেসরকারি বিদ্যালয় হোক, যাদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিলে এটা সম্ভব। সেই সঙ্গে আরো কিছু প্রয়োজন। সম্ভাবনাময় ছাত্রছাত্রীদের খুঁজে বের করতে হবে। যেমন বের করা হয়, বের করা প্রয়োজন, সম্ভাবনাময় তরুণ বিজ্ঞানী অথবা। খেলোয়াড়। যদি অথাভাব এইসব ছেলেমেয়েদের সুশিক্ষার পথে বাধা হয়, তবে বিশেষ অর্থসাহায্য দিয়ে এদের ভাল স্কুলে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

এদেশে উচ্চবর্ণ নিম্নবর্ণের প্রভেদ আছে প্রাচীনকাল থেকেই। অর্থের ভিত্তিতে একটা নতুন অভিজাতশ্রেণী গড়ে উঠেছে আমাদের চোখের সামনেই। এসবের জন্য জেলায় জেলায় মডেল স্কুলের প্রয়োজন হয়নি। যাঁরা বিত্তবান ক্ষমতাবান তাঁরা সুবিধা করে নিয়েছেন।

এখন যে নতুন প্রস্তাব এসেছে তার বিচার করতে হবে খোলা মনে। এই প্রস্তাবে কিছু শর্ত আরোপ করবার কথা হয়তো আমাদের ভাবতে হবে। কিছু সদিচ্ছাকে কার্যকর। করবার উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে সচেষ্ট হতে হবে। স্পষ্ট করে বলতে হবে যে, দরিদ্র পরিবারের প্রতিশ্রুতিময় ছেলেমেয়েদের মডেল স্কুলে আকৃষ্ট করবার জন্য চাই বিশেষ ব্যবস্থা, আর্থিক এবং অন্যান্য সহায়তা। সরকারি প্রস্তাবের কোনো ধারা এমনও থাকতে পারে যা বর্জনীয়। কিন্তু মূল প্রস্তাবের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হতে হবে গঠনমূলক, রচনাত্মক।

স্বাধীন ভারতে শিক্ষার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ঘটেছে বিদ্যালয়ের সংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি। অনিবার্যভাবে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের ভিতর মানের তারতম্যও বেড়ে গেছে। সব বিদ্যালয়েরই উন্নতি কাম্য। কিন্তু অল্প কিছু বিদ্যালয়ই হতে পারে পথপ্রদর্শক। শুধু রাজধানীতে নয়, জেলায় জেলায় তৈরি হচ্ছে একুশ শতকের নেতারা। তাদের জন্য ভালো স্কুল চাই। শিক্ষার প্রসার ছাড়া পথ নেই। কিন্তু শুধু সংখ্যাবৃদ্ধিতে সমস্যা বাড়ে। পথ দেখাবার। জন্য কিছু বিশেষ বিদ্যালয়েরও আবশ্যক আছে।

.

শিক্ষাকে দলীয় রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত রাখা দরকার। কথাটা যদি সবাই স্বীকার করে নিতেন তবে এ নিয়ে বেশি আলোচনার প্রয়োজন হত না। কিন্তু সবাই স্বীকার করছেন না।

গত দশ বছরে শিক্ষার ওপর দলীয় রাজনীতির প্রভুত্ব ক্রমেই বেড়েছে। এটা আমাদের চোখের সামনেই ঘটেছে শিক্ষার সর্বস্তরের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর দলীয় রাজনীতির প্রভাব আগে ছিল না এমন নয়। ছিল; কিন্তু সদর্পে সেটা সমর্থন করা হত না। কিছুটা গোপন এবং কুণ্ঠিত ছিল সেই হস্তক্ষেপ। বলা বাহুল্য, আমি স্বাধীনতার পরবর্তী যুগের কথাই বলছি। দলীয়তার হাত থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মুক্ত রাখাই ছিল স্বীকৃত আদর্শ। এর ব্যতিক্রম ঘটলে বিরোধী দল তার সমালোচনা করেছে। যারা ক্ষমতায় আসীন তারা অভিযোগ অস্বীকার করেছে যথাসাধ্য। শিক্ষাকে দলীয়তার ঊর্ধ্বে রাখাই ছিল তাদেরও ঘোষিত উদ্দেশ্য। আজ তা নয়।

আজ অন্য কথা শুনছি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। যুক্তিটা এইরকম। রাজনীতি সমাজ থেকে বিছিন্ন নয়। বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমাজেরই অংশ। অতএব রাজনীতিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে রাখা সম্ভব নয়। প্রতিটি নাগরিকেরই অধিকার আছে রাজনীতিতে। ছাত্র শিক্ষক কর্মচারী সকলেরই সেই অধিকার আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে সেই অধিকার থাকবে আর ভিতরে থাকবে না, এটা একটা অবাস্তব প্রস্তাব। রাজনীতি মানেই দলীয় রাজনীতি, ব্যক্তি স্বাভাবিকভাবেই দলবিশেষের সমর্থক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতরেও একই কথা। সেখানেও ব্যক্তি তার দলীয় মতামত দিয়েই চালিত হবে। এটাই অনিবার্য। যে দল ক্ষমতায় আসীন তার পিছনে আছে জনতার অধিকাংশের সমর্থন। এই সমর্থন থেকেই আসে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দলের বিশেষ অধিকার। সেই অধিকারের বলেই শাসক দল শিক্ষার ক্ষেত্রেও শাসন চালায়। স্কুলে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কর্তৃত্ব গণতন্ত্রের পূর্ণতার জন্যই প্রয়োজন। এই ধরনের কথা আমরা শুনছি।

কথাটা বিচার করে দেখা দরকার। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকেও কিছু বাধা নিষেধ মেনে চলতে হবে কি না, তারও ক্ষমতার কিছু স্বীকৃত সীমা থাকা প্রয়োজন কি না, এটাই মৌল প্রশ্ন।

যে দল আজ দিল্লিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরেই সেই দল সরকার গঠন করেছে। জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চয়ই সে দাবি করতে পারে। ভারতের রাষ্ট্রপতিও সংবিধানের ধারা অনুযায়ী নিবাচিত হন। বলা বাহুল্য তাঁরও কিছু ব্যক্তিগত মতামত আছে, দলবিশেষের সঙ্গে যোগ আছে। রাষ্ট্রপতি অথবা ভারতের প্রধানমন্ত্রী কি গণতন্ত্রের নামে দলীয় পক্ষপাতিত্ব দিয়েই সর্বক্ষেত্রে চালিত হবার অধিকারী। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে যদি দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় তবে কি সেটা গণতন্ত্রের নামে সমর্থনযোগ্য হয়ে ওঠে? পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সভ্য নির্বাচনের বেলায় যদি দলীয় পক্ষপাতিত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে তখন কি সেটাই শাসক দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে গণতান্ত্রিক এবং ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকার করে নিতে হবে? এইরকম পক্ষপাতিত্ব ঘটে কি না সেটা প্রশ্ন নয়; যদি ঘটে তবে সেটা গণতন্ত্রের নামে সমর্থনযোগ্য কি না বিচার করে দেখতে হবে। অনাচার তো কতই ঘটে, কিন্তু তাকে অনাচার বলেই চিনে নিতে হবে। তা নইলে সঠিক জনমত গঠন করা যাবে না।

একই প্রশ্ন ফিরে আসে শিক্ষার ক্ষেত্রে। দুয়েকটি সহজ উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক।

ছাত্রের পরীক্ষা নেন শিক্ষক, খাতা দেখেন, নম্বর দেন। শিক্ষকের নিজস্ব রাজনীতি আছে, মতামত আছে। হয়তো আছে ছাত্রেরও। কিন্তু পরীক্ষক হিসেবে যদি শিক্ষক দলীয় মতামতকে প্রাধান্য দেন তবে কি তাঁকে আমরা সৎ পরীক্ষক বলব? ছাত্রের মতামত যদি পরীক্ষকের বিপরীত হয় তবু কি তাঁর কর্তব্য নয় যথাসম্ভব নিরপেক্ষতার সঙ্গে বিচার করা? কেউ হয়তো বলবেন, নিরপেক্ষতা সম্ভব নয়। কথাটা কি সত্য?

বিচারকের কাছ থেকে আমরা নিরপেক্ষতা আশা করি; পক্ষপাতিত্ব প্রকট হয়ে উঠলে বলি বিচারের প্রহসন হচ্ছে। ন্যায় বিচারের জন্য কারও খ্যাতি থাকে, কারও থাকে না। এসবের ভিতর দিয়ে এই বিশ্বাসটাই ব্যক্ত হয় যে, নিরপেক্ষতা বিচারকের কর্তব্য। যেটা একেবারেই সম্ভব নয় সেটা কর্তব্য হতে পারে না। সচেতনভাবে চেষ্টা করলে পক্ষপাতিত্বের অনেকটা উর্ধ্বে নিশ্চয়ই ওঠা যায়। আমরা চেষ্টা করব কি না সেটাই প্রশ্ন। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতাই শ্রদ্ধেয়।

শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনাই কি প্রাধান্য পাবে? ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে? ইদানীং দেখা গেছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও দলীয় বিচারটাকেই সুপরিকল্পিতভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতাসীন বলেই কি দলীয় পক্ষপাতিত্ব সমর্থনযোগ্য? উপাচার্য দলের আজ্ঞাবাহী হবেন এটাই কি আমরা চাই? এটাই কি গণতন্ত্রের অনিবার্য বিধান?

এইসব তর্কের পিছনে আছে গণতন্ত্র সম্বন্ধেই দুটি বিপরীত ধারণার দ্বন্দ্ব। যাঁরা সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রতন্ত্রে বিশ্বাসী তাঁদের চোখে গণতন্ত্রের শেষ লক্ষ্য এই সর্বগ্রাসিতায়। সর্বাত্মক রাষ্ট্রে ক্ষমতাসীন দলের শাসন হয় নিরঙ্কুশ। দলীয় রাজনীতি সেখানে সবকিছু গ্রাস করে নেয়, অবশেষে তার সৌধ তৈরি হয় বিরোধী দলের সমস্ত অধিকারের সমাধির ওপর।

গণতন্ত্রের অন্য এক ধারণা আছে। সেখানে ক্ষমতাসীন দল গণতন্ত্রেরই স্বার্থে নিজের অধিকারের ওপর স্বেচ্ছায় কিছু অঙ্কুশ আরোপ করে। স্বীকার করে যে, সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দলকে সীমাহীন ক্ষমতার অধিকার দেয় না। উপলব্ধি করে যে, বিরোধী দলের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের সেই ব্যবহারই কর্তব্য যে ব্যবহার সে নিজে প্রত্যাশা করবে বিরোধী দলের ভূমিকায়।

গণতান্ত্রিক অধিকার মূল্যবান, তার সুরক্ষা আবশ্যক। একথা স্বীকার্য। একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, রাজনীতির সঙ্গে শিক্ষানীতির আছে একটা সূক্ষ্ম প্রভেদ। বিভিন্ন দলের ভিতর ক্ষমতার লড়াই রাজনীতির প্রধান কথা। দলীয় হারজিতের ভাবনায় অস্থির। সেখানে চেতনা, সময়ের ছোট সীমায় আবদ্ধ সেই চিন্তা। শিক্ষানীতিতে এই সব প্রধান কথা নয়। বিচারকে প্রতিষ্ঠিত করা আবশ্যক অন্য এক বাস্তবে, যেখানে সময়ের দিগন্ত আরও বিস্তৃত, দলীয় দ্বন্দ্বের আরও ঊর্ধ্বে। রাজনীতির নানা আক্ষেপ শিক্ষানীতিকে ক্রমাগত বিচলিত করে তুললে রাষ্ট্রনীতির তাতে শেষ অবধি কোন সুবিধা হয় কি না বলা কঠিন, কিন্তু শিক্ষার যে তাতে ক্ষতি হয় একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

শিক্ষাকে তাই দলীয় রাজনীতির কবল থেকে মুক্ত করা আবশ্যক। এ ব্যাপারে। জনমতের একটা ভূমিকা আছে। দলীয় জবরদস্তির বিরুদ্ধে ধিক্কারে সোচ্চার জনমত প্রয়োজন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাঁরা সোজাসুজি যুক্ত আছেন, বিশেষত যাঁরা শিক্ষক, তাঁদেরও এ বিষয়ে একটা বিশেষ দায়িত্ব স্বীকার করে নিতে হবে।

রবীন্দ্রনাথ রাজনীতির প্রতি উদাসীন ছিলেন না। এক্ষেত্রে তাঁর কিছু উক্তি, কিছু প্রতিবাদ, ইতিহাসে বিখ্যাত। অথচ শান্তিনিকেতনের প্রাঙ্গশকে তিনি চেষ্টা করেছেন যথাসম্ভব রাজনীতির আলোড়ন থেকে মুক্ত রাখতে। এটা কি শুধুই স্ববিরোধ? ভীরুতা? অতিসাবধানতা? না কি এরও অস্তরালে আছে সত্যের কোনও গভীরতর উপলব্ধি?

শিক্ষার স্বধর্ম ও রাজনীতির ভিতর একটা বিরোধ আছে। সমাজে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব চলছে। সে দ্বন্দ্ব কখনও জাতিতে জাতিতে, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে, কখনও শ্রেণীর সঙ্গে শ্রেণীর, এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর। রাজনীতি সত্যকে দেখতে চায় এই দ্বন্দ্বের ভিতর থেকে। এরও জীবনে স্থান আছে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট নয়। এই খণ্ডিত সত্য মানুষকে একসঙ্গে ধরে রাখতে পারে না। সত্যের এই খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত অভিব্যক্তির ঊর্ধ্বে আছে একটা বৃহত্তর সত্য, তাকেও প্রয়োজন মানুষের মঙ্গলের জন্য। তারই ভিতর দিয়ে অন্য এক ঐশ্বর্যের সৃষ্টি হয় যাকে বাদ দিলে কলহের সুরটাই অতিশয় প্রবল হয়ে ওঠে।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় কথাটা বলা যাক। “যেমন জ্ঞানের ক্ষেত্রে তেমনি ভাবের ক্ষেত্রে তেমনি কর্মের ক্ষেত্রে সর্বত্রই সত্যের উপলব্ধি ঐক্যবোধে নিয়ে যায় এবং ঐক্যবোধের দ্বারাই সকল প্রকার ঐশ্বর্যের সৃষ্টি হয়।” রবীন্দ্রনাথ যখন পশ্চিমের দিকে তাকালেন তখন তিনি সেখানে পেলেন দুই ভিন্ন ইতিহাস। এক যুদ্ধের ইতিহাস, যার প্রচণ্ড প্রকাশ রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে রক্তক্ষয়ী মহাযুদ্ধে। অন্য এক ইতিহাস, রাষ্ট্রের সীমানা পেরিয়ে বিশ্বজোড়া জ্ঞানের অনুসন্ধানে, সেবার ব্রতে, সমবায়ী সাধনায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ তাকে যুক্ত করেছে বিশ্বজোড়া এই জ্ঞানের সাধনার সঙ্গে। যিনি রাজনীতিতে সম্পূর্ণভাবে লিপ্ত, খণ্ডসত্য তাঁর দলীয় সম্পত্তি; তাই নিয়ে তাঁর লড়াই। যিনি বিজ্ঞানী এবং শিক্ষক, তিনি জানেন যে সম্পূর্ণ সত্য তাঁর আয়ত্তে নেই, খণ্ডসত্যকে অতিক্রম করতে তিনি সদা আগ্রহী। অতিক্রম করবার এই আগ্রহেই তিনি প্রকৃত বিজ্ঞানী এবং শিক্ষক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আমরা যে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকারের কথা বলি, শিক্ষকের স্বাধীনতাকে মূল্যবান বলে জানি, তার মূলে আছে এই কথাটাই। শিক্ষা ও রাজনীতির ভিতর সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে না। কিন্তু এ দুয়ের প্রকৃতি এবং আদর্শের ভিতর একটা অসামঞ্জস্য আছে। আর সেজন্যই শিক্ষাকে রাজনীতির অধীনতা থেকে মুক্তি দেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষক যদি শিক্ষায়তনের ভিতর দলীয় আজ্ঞা অনুযায়ী চলেন, দলের স্বার্থকেই মহত্ত্ব দেন, তবে তিনিও হয়ে ওঠেন শিক্ষার স্বাধীনতার শত্রু। যেখানে তিনি শিক্ষক সেখানে তাঁকে চলতে হবে শিক্ষার স্বধর্ম অনুসারে। এ যদি হয় তবে শিক্ষার সমস্যার সমাধান কঠিন নয়; যদি না হয়, তবে কঠিন।

আমাদের সমাজের কিছু কাজ কিছু উদ্দেশ্য দলীয় রাজনীতির ভিতর দিয়ে সিদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু সব কাজ সব উদ্দেশ্য নয়। অনেক কাজে দলীয় একটা বাধা, একটা বি। যুদ্ধের সময় দেশ তার ঐক্যকে স্থাপন করে, দলীয়তার ঊর্ধ্বে। যুদ্ধ অবশ্য একটা চরম দৃষ্টান্ত। কিন্তু বিপরীত প্রান্তে আছে অন্য উদাহরণ। সমস্ত সুস্থ সমাজেই এমন কিছু আনন্দের অনুষ্ঠান থাকে যখন সবাই বিভেদ ভুলে গিয়ে আলিঙ্গন করে, আনন্দের ভিতর ঐক্যবদ্ধ হয়। অনুষ্ঠানের বাইরেও মানুষের ভিতর মিলনের একটা স্বাভাবিক শক্তি আছে। পরিবারে হোক, পল্লীতে হোক অথবা বৃহত্তর সমাজে হোক, এই শক্তি আছে বলেই মানুষের সমাজ নানা বিরোধের ভিতর আজও একেবারে ভেঙে পড়েনি, জীবন সম্পূর্ণ শ্রীহীন হয়নি। শিল্পে এবং বিজ্ঞানে, মানুষের স্বাভাবিক সহৃদয়তায় এবং শুভবুদ্ধিতে, আমরা শেষ অবধি ব্যক্তির সেই পরিচয়টি পাই যেখানে সে শুধু দলবিশেষের নয়, সে মানুষ।

এই মনুষ্যত্ববোধকে জাগ্রত রাখা শিক্ষার একটি মুখ্য উদ্দেশ্য। যে রাজনীতির ভিত্তিতে আছে দলীয়তা তার সঙ্গেও পরিচয় থাকা হয়তো দরকার। কিন্তু তা দিয়ে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় না। রাজনীতির সীমাহীন আধিপত্য শিক্ষা এবং মনুষ্যত্ব দুয়েরই বিপর্যয় ডেকে আনে। এদেশে বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে গত কয়েক বছরের ইতিহাসের এটাই পরীক্ষিত সত্য।

মানুষের সমাজে একটা অধ্যায় ছিল যখন সংগঠিত অসহিষ্ণু ধর্ম সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করতে উদ্যত হয়েছিল জীবনের সর্বক্ষেত্রে। সেই সর্বগ্রাসিতাকে মানুষ দুভাগ্যজনক বলেই জেনেছে। আজ যদি রাজনীতি হতে চায় এক নতুন অসহিষ্ণু ধর্ম তবে তার সেই অসংযত দাবিকেও বলতে হবে সর্বনাশী। গান্ধী ও রবীন্দ্রনাথ (১৯৮৬)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *