মহাকাল

মহাকাল

ধীরে ধীরে বাড়ির সামনের ডেক চেয়ারে বসলেন প্র. প্রিয়লাল বোস। চিন্তা আনন্দ উত্তেজনা সব মিলিয়ে কেমন যেন উত্তেজিত করে তুলেছে ওঁকে। পড়ন্ত বেলায় লনে এসে বসা প্র. বোসের অনেক দিনের অভ্যাস। অনেক জটিল প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পেয়েছেন এখানেই। চারপাশে তাকালে পরম শান্তিতে মনটা ভরে ওঠে। চতুর্দিকে সবুজ ঘাসের উৎসব। দু-একটা গঙ্গাফড়িং ঘাসের এক শীষ থেকে আরেক শীষে সাঁতার কাটছে। সামনে গন্ধরাজ গাছ। সাদা ফুলে খই ফোঁটা। স্তব্ধ বাতাস কেমন একটা মধুর গন্ধে মাতোয়ারা। অপূর্ব এই বিকেল। পড়ন্ত রোদ শেষবারের মতো গায়ে মেখে বাড়ি ফিরছে উড়ন্ত একঝাঁক পাখি। দুর থেকে ভেসে আসা ওদের কিচমিচ ডাক কেমন জলতরঙ্গের মতো শোনায়। কোন অসীমপানে ছুটে যেতে চায় মন। কিছুক্ষণের মধ্যে মুছে যায় সারাদিনের ক্লান্তি। লনের একদম শেষপ্রান্তে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টার। সাত তলা বিরাট বাড়ি। দিনশেষের রোদটুকু মুকুটের মতো লেপটে আছে বাড়ির মাথায়।

চিনার ধরালেন প্র. বোস। অন্য কোনও সিগারেটে মৌজ হয় না। চিনারই প্রিয়। চিন্তা নেই আর। মনটা পরিষ্কার।

দূর থেকেই সান্ত্বনাকে চিনতে ভুল হল না প্র. বোসের। হাঁটছে না ছুটছে বোঝা মুশকিল। তবে ও যে উত্তেজিত সেটা ওর হাঁটার ভঙ্গি দেখলেই বোঝা যায়। তাড়াতাড়ি ছুটে আসার উত্তেজনায় উন্নত বুকটা হাপরের মতো উঠছে আর নাবছে। শ্যামলা মুখখানা জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাকের পাটাদুটো ফুলে ফুলে উঠছে। দুই ভ্রূর সঙ্গমস্থলে সিঁদুরের মস্ত বড় এক টিপ। বড় সিঁদুরের টিপ পরা সান্ত্বনার এক মস্ত বড় শখ। না, মিথ্যে বলে লাভ নেই।

প্রিয়লালের বড় প্রিয় ওই সিঁদুরের টিপ। লাল ফোঁটার দিকে নজর পড়লেই অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে ওঁর মন। মাঝে মাঝে কাজল কালো বড় বড় চোখদুটোর মতো জ্বলজ্বলে লাল টিপটাকে দেহের একটা স্বাভাবিক রূপ বলে মনে হয় প্রিয়লালের।

হঠাৎ চমকে উঠল। না না–এ অবস্থায় জোরে ছোটা উচিত নয় মোটেই। বারবার বারণ করে দিয়েছেন ড. শীল। তা সত্ত্বেও–তবে কি জানতে পেরেছে–

কোনও কথা না বলে কয়েক মুহূর্ত প্রিয়লাল বোসের দিকে তাকিয়ে রইল সান্ত্বনা। টানা টানা চোখ দিয়ে মনের কথার নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করল।

কী হল, অমন করে কী দেখছ? স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করলেন প্রিয়লাল।

 যা শুনলাম তা কি সত্যি, প্রিয়? সান্ত্বনার স্বরে উদ্বেগের ছাপ।

 প্রিয়লালকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার প্রশ্ন করল সান্ত্বনা, না না, চুপ করে থেকো না, প্রিয়–বলো বলো, এসব কি সত্যি?

একটু শান্ত হও সান্ত্বনা। এখন তোমার উত্তেজিত হওয়া মোটেই উচিত নয়। কথার মোড় ফেরাতে ব্যর্থ চেষ্টা করলেন প্রিয়লাল।

না না, ওসব কথা থাক এখন। শুধু তুমি বলো, এ সত্যি নয়, মিথ্যে… মিথ্যে… প্রিয়লালের দুটি হাত নিজের উত্তেজিত হাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরল সান্ত্বনা। থর থর করে কাঁপছে নরম হাত দুটো।

কে বলল তোমায়? কার কাছ থেকে শুনলে? সুকুমার… সুকুমার বলেছেনা তপন…

 কে বলেছে না-ই বা শুনলে তুমি… আমি যা জানতে চাইছি তা বলো, প্রিয়? যা শুনলাম তা কি সত্যি?

সান্ত্বনা, ঠিক এ অবস্থায় বলতে চাইছিলাম না তোমাকে। আমাদের ভাবী সন্তানের মঙ্গলের জন্য গোপন করতে চেয়েছিলাম সমস্ত ব্যাপারটা।

প্রিয়, কী বলছ তুমি, আমাকে না জানিয়ে–না না, যেতে পারবে না তুমি, কিছুতেই যেতে পারবে না…

সান্ত্বনা, অবুঝ হয়ো না। তুমি তো উৎসাহ দিয়েছ আমাকে, প্রেরণা দিয়েছ। আজকের এত সম্মানের মূলে তো…

থাক থাক ওকথা, প্রিয় শোনো তুমি যেতে পারবে না, এটাই আমার শেষ কথা। আচ্ছা যে আসছে তার কথাটাও কি একবারও ভেবে দেখলে না?

সান্ত্বনা, মিথ্যে বলে লাভ নেই তোমাকে–শোনো যেতে আমাকে হবেই… নিজে যেতে না পারলে অপরের উপর জোর করব কী করে। তা ছাড়া প্রথম টেস্ট তো নিজেরই করা উচিত।

ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন প্রিয়লাল। আর কী বলবে সান্ত্বনা? খুব ভালো করে চেনে সে প্রিয়কে। কতদিনের পরিচয় ওদের? সে কথা আর মনে পড়ে না ওর। কতকগুলো বিশেষ বিশেষ ঘটনা শুধু মনে হয় যেন কাল বা পরশু ঘটেছে। কোনও পরিবর্তন নেই প্রিয়র। একবার ডিসিশন নিলে টলানো কঠিন ওকে। আর এই যুগান্তকারী আবিষ্কারও তো এক ছোট্ট ঘটনার ফলশ্রুতি মাত্র। সেই পুরোনো তর্ক–আমরা কে? কে আমাদের পূর্বপুরুষ? দানিকেন-রবার্ট-কারু-ওটো-বাইন্ডার–আরও কত জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি কেউ কিন্তু সঠিকভাবে প্রমাণ করতে পারেননি গ্রহান্তরের বুদ্ধিমান জীবরাই আমাদের পূর্বপুরুষ। সঠিক নির্ভুল প্রমাণ চাই–আর তখনই এক চায়ের মজলিশে প্রিয় বলে বসল, আচ্ছা, একটা টাইম মেশিন হলে কিন্তু সব প্রশ্নের সমাধান হয়ে যায়।

হেসে উঠল বন্ধুরা।

টাইম মেশিন–সেই গল্প। তবে হ্যাঁ, টাইম মেশিন পাওয়া গেলে দেখা যেত একবার পৃথিবীর জন্ম–আমাদের ইতিহাস, আর ভবিষ্যতেই বা কী হব–কী হবে আমাদের সমাজ রাষ্ট্র দেশের…

গল্প?

গল্প বলছ কেন? চাঁদে নাবা, শুক্রে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র বানো, সাবমেরিন প্রভৃতি সবই প্রথমে গল্প ছিল। তারপর মানুষের নিরলস চেষ্টার ফলেই অবাস্তব অসম্ভব সম্ভব হয়েছে।

কী বলছ প্রিয়? সাবমেরিন হয়েছে বলে কি টাইম মেশিন হবে? সায়েন্স ফিকশন পড়া কি খুব বাড়িয়েছ নাকি? ঠাট্টার ছলে বলে উঠল প্রবাল–প্রবাল গুপ্ত।

না না প্রবাল, যতই হাসি ঠাট্টা করো না কেন, আমি কিন্তু মনে প্রাণে বিশ্বাস করি টাইম মেশিন সম্ভব… আর সম্ভব কেন… আমিই চেষ্টা করলে টাইম মেশিন বানাতে পারি।

ব্যাস! যে কথা সেই কাজ। রাত নেই দিন নেই গত দু-বছর একনাগাড়ে পরিশ্রম করেছেন প্র. প্রিয়লাল বোস। আর তার ফলেই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। তৈরি হয়েছে বিশ্বের প্রথম টাইম মেশিন।

ছায়াছবির মতো দ্রুত সমস্ত ঘটনাই মনে পড়ে গেল সান্ত্বনার। কিন্তু সেদিন যে এত তাড়াতাড়ি আসবে তা কি সে কল্পনা করতে পেরেছিল? তা ছাড়া কতদিনের স্বপ্ন ওদের আর মাস দুয়েকের মধ্যেই বাস্তবে রূপ নেবে। মা হবে সান্ত্বনা। মা… মামণি… উঃ কী সুন্দর মিষ্টি ডাক–আধা আধো গলা–ভাবতেও মধুর আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সান্ত্বনা। ওরা দু-জন আর ছোট্ট একজন–কচি কচি হাত দিয়ে দু-জনের হাত ধরে টালুমালু হাঁটবে –মাথা ভরতি থোকা থোকা ফুরফুরে চুল উড়বে হাওয়ায়… আর ঠিক এই সময়ে অবিশ্বাস্য এক ঝুঁকি নিতে চলেছে ওর প্রিয়…

কী, কী হল সান্ত্বনা… কী ভাবছ চুপ করে… বলো, কিছু বলো?

চমকে উঠল সান্ত্বনা। ভাবতে ভাবতে কোথায় ভেসে গিয়েছিল সে! না, বলার আর কী আছে। ঠিক তো হয়েই আছে। এক দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল বুক চিরে।

না… কী আর ভাবব… শুধু মনে রেখ একেবারে একলা আমি। তুমি তো জানো কেউ নেই আমার, দিনও তো বেশি বাকি নেই–এ অবস্থায়… কথা অসমাপ্ত রেখে বড় বড় চোখ মেলে শুধু তাকিয়ে রইল প্রিয়র দিকে। অসম্পূর্ণ কথা সম্পূর্ণ রূপ পেল ওর জলভরা টলটলে নীরব দৃষ্টিতে।

দীঘির মতো অতল কালো চোখ দুটোর দিকে তাকালে কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন প্রিয়লাল। মনে হয় কী হবে এসব করে… এই তো বেশ। সান্ত্বনাই তো ওর চাওয়া পাওয়ার শেষ… কিন্তু…

তুমি… তুমি অহেতুক চিন্তা করছ সান্ত্বনা। মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের ব্যাপার–তা ছাড়া বর্তমানে তো অতীতে যাওয়া সম্ভব নয়–আরও কিছু অ্যাডজাস্টমেন্টের প্রয়োজন, তাই শুধু ভবিষ্যতেই যাব। যাব আর আসব। না না, কোনও ভয় নেই। এক সঙ্গে খাব দুজনে। কেমন?

নির্বাক বোবা সান্ত্বনা। অবুঝ মনকে মিথ্যাই বোঝ মানাবার চেষ্টায় ব্যস্ত।

 শুধু একটা কথা বলো প্রিয়, সত্যি কোনও বিপদ নেই তো এতে? ফিরে আসার পথে কোনও বাধা পড়বে না তো?

না গো, না। তবে একেবারে যে নেই তা-ই বা বলি কী করে? কেউ তো আগে কোনদিনও যায়নি। আমিই তো বিশ্বের প্রথম মানুষ। তা ছাড়া আমাদের জ্ঞান বুদ্ধি মতো… কথা শেষ করতে পারলেন না প্রিয়লাল। সান্ত্বনার একটা অধীর অশান্ত হাত ওর মুখটাকে চাপা দিয়ে দিল।

ও কথা বলো না প্রিয়। তোমার কিছু হলে কী নিয়ে বাঁচব আমি? সে জীবন চাই না… চাই না আমি… চাই না আমি বাঁচতে। থর থর করে কেঁপে উঠল নরম দেহটা। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সান্ত্বনা।

একটু কাঁদুক। হালকা হোক মনটা। ভাবলেন প্রিয়লাল, যদি সত্যি হয় সান্ত্বনার ভয়টা। তাহলে কী হবে সান্ত্বনার? কী হবে ওঁদের সন্তানের? যদি কিছু করে বসে ও? না না, এসব ভাবনা যেভাবেই হোক দূর করতে হবে মন থেকে। কতকগুলো না সত্যি-না মিথ্যা চিন্তা দুর্বল করে দিচ্ছে মনকে। এত বড় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে হেরে যাবেন প্রিয়লাল?

সান্ত্বনা, শোনো সান্ত্বনা, অবুঝ হয়ো না। এসব বাজে চিন্তা মন থেকে… এখন আর তুমি একলা নও… মা হতে চলেছ তুমি, এটা ভুলে যেও না। শোনো, ঠিক দু-ঘণ্টার মধ্যেই ফিরে আসব আমি। একসঙ্গে খাব রাতে, কেমন? তাকাও, তাকাও মুখের দিকে। এই তো–এ কী, এখনও বর্ষার রেশ কেন কালো দীঘির আনাচে কানাচে… হাসো, একটু হাসো–এই তো… এই তো… সুন্দর হাসি, মিষ্টি হাসি…

এক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। নিজের মতে নিয়ে আসতে এই মোক্ষম অস্ত্রটি বরাবর প্রয়োগ করেন প্রিয়লাল। সান্ত্বনাও জানে, মত তাকে দিতেই হবে।

বেশ, আর বাধা দেব না তোমায়। শুধু বলো, ফিরে আসবে তুমি… বলো… বলো… বড় বড় আয়ত চোখ মেলে তাকাল সান্ত্বনা।

ছেলেমানুষ, একেবারে খুকু। ফিরে আসব… ফিরে আসব… ফিরে আসব…

আলোয় আলোময় ল্যাবরেটরি রুম। ঘরের মাঝে স্ট্যান্ডের উপর চকচকে গোলাকার প্রকাণ্ড এক গোলক। টাইম মেশিন। প্রিয়লাল আদর করে নাম রেখেছেন মহাকাল। মহাকালই বটে… কাল-সমুদ্রে অনায়াস ওর গতিবিধি।

হঠাৎ গুরুগম্ভীর গুঞ্জনে ভরে উঠল ঘর। চালু হল দৈত্যাকৃতি বিশাল ডায়নামোটা।

মহাকালের ঠিক মাঝখানে একটা পুরু গদি আঁটা রিভলভিং চেয়ার। একজনের বসার পক্ষে যথেষ্ট। চারপাশে তাকিয়ে চেয়ারে বসলেন প্রিয়লাল। নরম চামড়ার স্ট্র্যাপ দিয়ে বেশ মজবুত করে বেঁধে ফেললেন নিজেকে। কোনও কিছুতেই ছিটকে পড়বেন না আর। নরম উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠেছে মহাকালের অভ্যন্তর। কেমন যেন অপার্থিব মনে হয়। শক্ত মজবুত গোলাকার দরজাটা খোলা। খোলা দরজা পথে ঘরের অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। ঘরের শেষে বন্ধ কাচের শার্সির বাইরে রাতের কালো আকাশ। এক ঝাঁক তারা যেন উঁকি দিচ্ছে জানালা দিয়ে। অনেক অনেক কথা মনে পড়ছে এখন। কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন প্রিয়লাল। পৃথিবীর আকাশ ঘরবাড়ি লোকজন সব যেন ওঁর নিকটজন… সব ছেড়ে—

শেষবারের মতো যন্ত্রপাতি পরীক্ষায় ব্যস্ত কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার ও টেকনিশিয়ান। যুগান্তকারী যাত্রার শেষপর্ব ত্রুটিহীন করার চেষ্টায় ব্যস্ত সকলে। মাঝে মাঝে একটা বাজার বেজে উঠছে ঘরের মধ্যে।

ঘরের শেষপ্রান্তে অনেকখানি জায়গা জুড়ে কাচের পার্টিশান। পার্টিশানের ওপাশে বিরাট এক কনট্রোল প্যানেল। তিনটে লাল আলো পর্যায়ক্রমে জ্বলছে আর নিবছে। হঠাৎ একটা তীব্র আলোয় ভরে উঠল সমস্ত ঘর। যাত্রার সময় হয়ে এল।

সাদা অ্যাপ্রন পরা মাঝবয়সী একজন দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন মহাকালের কাছে। মহাকালের দরজা এখন খোলা।

প্রিয়লাল, আমায় ডেকেছ তুমি?

 হ্যাঁ ডক্টর, কয়েকটা কথা বলব। আশংকার কোন কারণ না থাকলেও যদি আমি না ফিরি তবে সান্ত্বনার সমস্ত ভার রইল আপনার উপর।

কী বলছ প্রিয়লাল! এতদিন পরে এসব কী বলছ তুমি। তোমারই আবিষ্কার–আর তোমার চেয়ে বেশি কে জানবে যে বিপদের কোনও আশংকাই নেই এতে। তবে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকলে কোনও প্রয়োজন নেই যাবার। বেরিয়ে এস মহাকাল থেকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে না-ই বা করলে মহাকাল অভিযান।

হেসে ফেললেন প্র. প্রিয়লাল বোস। ড. কর ভীষণ ভালোবাসেন ওঁকে। একেবারে শিশুর মতো কথা।

না না, ড, কর… এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। তবে যদির কথা কেউ কি বলতে পারে?

তবে… বেশি সময় নেই আর। নিজেকে ভালো করে বেঁধে ফেল চেয়ারের সঙ্গে। ভাবনা চিন্তা সব দূর করে দাও মন থেকে। হ্যাঁ, আর একটা কথা। ঠিক দু-ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে কিন্তু। সব বেঁধেছ?

হ্যাঁ হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।

বেশ বেশ, তবুও দেখো ভালো করে। নিজের রিস্টওয়াচের দিকে একবার তাকালেন ড. কর।

মাত্র আর দশ মিনিট সময় আছে প্রিয়লাল। চেক?

চেক।

দুর্গা দুর্গা দুর্গা… দ্রুত পায়ে কাচের পার্টিশানের ওপারে চলে গেলেন ড. কর। পৃথিবীর বিস্ময়কর যুগান্তকারী অভিযান শুরু হবে এখনই। সব প্রস্তুতি শেষ।

নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল প্রিয়লালের বুক থেকে। লোভীর মতো তারা ভরা আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে মহাকালের দরজা বন্ধ করে দিলেন। বাইরের জগতের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।

কেমন যেন চাপা মনে হচ্ছে ভিতরটা। কনট্রোল বোর্ডের ঘড়িতে সাতটা বাজতে ন মিনিট। সাতটায় যাত্রা আরম্ভ। পরিকল্পনামতো সব ফললে ঠিক ন-টার মধ্যে ফিরে আসবেন তিনি। কনট্রোল বোর্ডের উপর দ্রুত আর একবার নজর বোলালেন। চকচক করছে ঘড়ির ডায়ালটা। সাত মিনিট। না ছ-মিনিট? না, কিছু যায় আসে না এখন। কিন্তু ভুলই বা দেখবেন কেন? ঝুঁকে পড়লেন ঘড়ির দিকে। না, সব ঠিক আছে। বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে উঠছে সমস্ত মুখমণ্ডল। কপালে হাত দিতেই ঘামে জবজবে হয়ে গেল হাত।

গরম… গরম লাগছে কেন? মহাকাল তো এয়ার কন্ডিশানড করা। নিজের মনে প্রশ্ন করলেন প্রিয়লাল।

পাঁচ মিনিট।

আবার সব কিছু দেখে নিলেন একবার। শুধু এক অস্ফুট গুঞ্জন। কী মনে হতে পেছনের পকেট থেকে একটা ওয়ালেট বার করলেন। তার মধ্য থেকে বের করলেন একটা ছবি। সান্ত্বনার ছবি। হাসছে। মুক্তোর মতো দাঁতগুলো একে একে গোনা যায়। টানা টানা চোখগুলো হাসছে, নাচছে। অপূর্ব! ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখলেও আশ মেটে না। কী করছে সান্ত্বনা এখন? কাঁদছে? সান্ত্বনা কাঁদছে? গভীর ব্যথায় ভরে উঠল মন। একটু অন্যমনস্ক হতেই লোহার মেঝের ওপর হাত ফস্কে পড়ে গেল ওয়ালেটটা। চমকে উঠলেন প্রিয়লাল।

হাত বাড়িয়ে ঝুঁকে ওয়ালেটটা তোলার চেষ্টা করলেন। এক ইঞ্চির জন্য ধরা গেল না। ছবিটা চিৎ হয়ে পড়েছে। কনট্রোল বোর্ডের লাল আলো এসে পড়েছে ছবির হাসি-হাসি চোখ দুটির ওপর। লাল টিপ লাল আলোয় জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল কেন চোখদুটো? আবার চেষ্টা করলেন। টান ধরলো কাঁধের মাংসপেশিতে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠল হাতের আঙুলগুলো। তবুও তোলা গেল না। জ্বলজ্বলে টিপ আর চোখ দুটো গভীর অতলান্ত।

আবার চেষ্টা। দেহের বাঁধনগুলো একটুও শিথিল হল না। শরীরটাকে একটু বেঁকাতে পারলে… মনে মনে অধীর হয়ে উঠলেন প্রিয়লাল। নার্ভাস হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালেন একবার। সাড়ে চার মিনিট… না চার মিনিট! কেমন যেন ঝাপসা ঘড়িটা। তিন মিনিট? সে কী! নিজের রিস্টওয়াচের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। এত তফাত কেন দুটো ঘড়ির মধ্যে? ঠোঁট কামড়ালেন প্রিয়লাল। কী করা যায়। সান্ত্বনা–সান্ত্বনার ছবি কোনওমতেই হাতছাড়া করা যায় না। সামান্য একখানা ছবিই তো ওঁর একমাত্র সম্বল। সেটা চলে গেলে… তা ছাড়া একবার সাকশান ফ্যানের মধ্যে চলে গেলে আর দেখতে হবে না। ছবি তো যাবেই, ওয়ালেটটা মেসিনের মধ্যে চলে গেলে ধ্বংস হয়ে যাবে সমস্ত মহাকাল। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়লাল নিজেও। প্রচণ্ড গতির মুখে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে এত বড় আবিষ্কার।

ওয়ালেটটা তুলে নিয়ে আবার স্ট্র্যাপ বাঁধতে মিনিটখানেক সময় লাগবে মাত্র। তাহলে…

ছবি। অতলান্ত চোখদুটো নির্নিমেষে চেয়ে রইল প্রিয়লালের দিকে। লাল আলোয় আরও জ্বলজ্বলে মনে হল টিপটাকে।

.

আলো। হাওয়া। আমেজ ভরা ঠান্ডা হাওয়ায় জুড়িয়ে গেল সমস্ত দেহ। মস্তিষ্কের কোষে কোষে জড়ানো ক্লান্তিগুলো একে একে বিবর্ণ হয়ে ঝরে যেতে শুরু করল। সতেজ হয়ে উঠল লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি সেলগুলো।

পুনরুজীবিত হয়ে উঠলেন প্রিয়লাল। পরম শান্তিতে জুড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গ। ধীরে ধীরে মেললেন চোখ। উঁচু সিলিংটা ক্রমেই স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল।

প্র. বোস–পি এল বোস।

শব্দ অনুসরণ করে ঘাড় ঘোরানোর চেষ্টা করতেই দারুন ব্যথা অনুভব করলেন প্রিয়লাল।

ব্যস্ত হবেন না প্র. বোস। নড়াচড়া করবেন না এখন। এই অবস্থায় নড়াচড়া করতে নেই। গম্ভীর গলায় বলে উঠল একজন।

কথা বলার চেষ্টা করলেন প্রিয়লাল। কিন্তু আওয়াজ বেরুল না গলা দিয়ে। আবার কতক্ষণ চুপচাপ। এবার ঘাড় ঘোরাতে পারলেন প্রিয়লাল। বিশেষ কোনও ফার্নিচার নেই ঘরে। কতকগুলো বিচিত্ৰদৰ্শন মেশিন বসানো ঘরের এক কোণে।

না, আলো জ্বলছে না। অথচ সমস্ত সিলিংটা জ্বলজ্বল করছে। আর তার ছটায় আলোকিত হচ্ছে ঘর। কী আশ্চর্য! সিলিং এর দিকে কিছুক্ষণ তাকালে আর জ্বলজ্বলে মনে হয় না। সমস্ত ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলেন একবার। ভাসাভাসা মনে পড়ল কিছু। কিন্তু সব ছাপিয়ে শুধু এক অসহ্য যন্ত্রণার স্মৃতি আচ্ছন্ন করে রেখেছে সমস্ত মনকে। তারপর শুধু তাল-তাল অন্ধকার।

একটু কাত হয়ে হিপ-পকেটে হাত ঢোকাতে ওয়ালেটটা বেরিয়ে এল হাতে। কে তুলে রাখল পকেটের মধ্যে? ওয়ালেট খুলতেই হাসতে শুরু করল সান্ত্বনা। কী ভালো লাগছে ওর হাসিটা।

অস্ফুট আওয়াজ। ধীর পায়ে ঢুকল একজন। পরনে বিচিত্র পোশাক। ছোট ছোট করে চুল ছাঁটা।

প্র. বোস।

এবারেও কথা বলতে পারলেন না প্রিয়লাল। জিভ শুধু নড়ে উঠল। চোখের ওপর ভেসে উঠল একটা মুখ। অদ্ভুত যন্ত্র একটা তুলে ধরল ওর মুখের উপর। অদৃশ্য এক রশ্মির স্রোত বয়ে গেল ওর শরীরের উপর দিয়ে। শিরশির করে উঠল সর্বাঙ্গ। কোষে কোষে সঞ্চারিত হল এক সঞ্জীবনী শক্তি। সতেজ সবল হয়ে উঠলেন প্রিয়লাল। টানটান হয়ে উঠল শিথিল মাংসপেশিগুলো।

আঃ! কী আরাম!

 ব্যস্ত হবেন না প্র. বোস। সব বলছি আমি। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন। ভদ্রলোক।

প্র. বোস, আপনি এখন ২৩৭৬ সালে এসে পৌঁছেছেন।

সত্যি! ২৩৭৬ সাল!

কনুইয়ে ভর দিয়ে মাথা তুললেন প্রিয়লাল। চোখে মুখে সাফল্যের উত্তেজনা।

মহাকাল–আমার মহাকাল, মানে টাইম মেশিন? কোথায় সেটা? সব ঠিক আছে তো?

মহাকাল। বাঃ বেশ নাম তো! মনে হয় ঠিক আছে সব। নিচের ল্যাবরেটরি রুমে আছে।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন প্রিয়লাল। দু-হাতে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন সান্ত্বনার কাগজের ছবিটা। তখনও হাসছে ছবিটা।

কী আছে মি. বোস? ছবি? স্ত্রীর ছবি? অপূর্ব সুন্দরী ছিলেন কিন্তু ভদ্রমহিলা।

ছিলেন? মানে… কী বলতে চাইছেন আপনি? মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলেন প্রিয়লাল।

হ্যাঁ, ছিলেনই তো! ৪০০ বছর নিশ্চয়ই কেউ বাঁচতে পারে না–সম্ভব নয়। তাই না প্র. বোস?

আবার সব তালগোল পাকিয়ে গেল। চেষ্টা করেও বুঝতে পারলেন না। কেমন যেন ধূসর বিবর্ণ বক্তব্য। বুঝেও বোঝা যায় না। স্বীকার করতেও অস্বীকার করে মন।

বুঝতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে তো?

 না, তা ঠিক নয়–তবে আমার কাছে সান্ত্বনা, মানে আমার স্ত্রী তো জীবিত। ধীরে ধীরে উঠে বসলেন প্রিয়লাল, কিছু মনে যদি না করেন আপনার পরিচয়…? একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করলেন প্রিয়লাল।

ও হো, পরিচয় দিতেই ভুলে গেছি। আমি সুশান্ত সামন্ত। পেশায় সমাজ বিজ্ঞানী।

 কোথায় আছি আমি? কী নাম এখনকার?

কেন, আপনি তো কলকাতাতেই আছেন। আর এ বাড়িটা হচ্ছে সোশিওলজি রিসার্চ সেন্টার।

কোন ইউনিভার্সিটি?

প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, ভারতবর্ষ মানে চিফ অব দি ইন্ডিয়ান ইউনিভার্সিটি।

 মানে… অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো?

 সবই আছে। আপনাদের কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভারতবর্ষের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। আর সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় এর পরিকল্পনামতো চলে।

কলকাতা… কলকাতার অবস্থা কেমন এখন?

এখন দেখলে চিনতেই পারবেন না আপনাদের কলকাতাকে। অনেক… অনেক বেড়ে গেছে কলকাতার পরিধি। মাটির তলা দিয়ে গেছে অসংখ্য টিউব রেলপথ। কলকাতার রাস্তা কেবল পায়ে চলার জন্য। অ্যান্টিগ্র্যাভিটি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমূল পরিবর্তন হয়েছে সারা পৃথিবীর যানবাহনের। ইচ্ছে মতো নির্দিষ্ট উচ্চতায় অনায়াসে চলাফেরা করে উড়ন্ত মোটর গাড়ি, বাস, মোটর সাইকেল। আর এর ফলেই সমাজ জীবনের…

লেকচারের ভঙ্গিতে বলে চলেছে সামন্ত। প্রিয়লালের জানতে দারুণ ইচ্ছা করছে। কিন্তু সময় যে কম। কত দেরি হয়েছে কে জানে? ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। সান্ত্বনাকে বলে এসেছে…

সামন্তবাবু, আমরা কে–কারা আমাদের পূর্বপুরুষ, এই নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এখন? বলতে পারেন আমাদের উৎপত্তি হয়েছিল কোথায়–এই পৃথিবীতে, না অন্য কোনও গ্রহে…।

প্রচুর রিসার্চ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। তবে সঠিক করে কেউই কিছু বলতে পারছে না। রহস্য এখন আরও অনেক গভীরে। গ্রহান্তর যাত্রার ফলে আরও এমন সব প্রমাণ পাওয়া গেছে যার ফলে আমাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে বিজ্ঞানীদের। মঙ্গলগ্রহের দুর্গম এক পাহাড়ের গুহায় আমাদের বেদের লক্ষ বছর পুরোনো হাতে লেখা বইয়ের সন্ধান মিলেছে। মঙ্গলের অধুনা বিলুপ্ত সভ্যতা সম্বন্ধে এমন অনেক প্রমাণ মিলেছে। যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে পৃথিবীর শৈশব অবস্থায় মঙ্গলবাসীরা উন্নতির চরম শিখরে বিরাজ করছিল। আরও বিস্ময়কর ঘটনা ঘটেছে। কয়েক বছর আগে আলফা সেন্টরি বলে একটি গ্রহের বাসিন্দাদের সঙ্গে রেডিয়ো যোগাযোগ সম্ভব হয়েছে। ওদের ওখানেও বেদের আরও কোটি বছরের পুরোনো গ্রন্থ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এমন অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে যা পৃথিবীর সভ্যতার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। ওরাও সন্ধান করছে ওদের সৃষ্টিকর্তাকে। তাহলে বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা। অনেক বিজ্ঞানী সন্দেহ করছেন যে মঙ্গল, পৃথিবী, আলফা সেন্টরি বা আরও অনেক সৌরজগতের অধিবাসী আমরা সবাই এসেছি একই উৎপত্তিস্থল থেকে। আরও অনেক দূরের নক্ষত্রমণ্ডলীর ভেতর খুঁজতে হবে এর উত্তর। রেডিয়ো যোগাযোগ মারফত আলফা সেন্টরির সঙ্গে আমাদের পৃথিবীর এক যৌথ সার্চ মিশন গঠিত হয়েছে। যার একমাত্র উদ্দেশ্য আমাদের পূর্বপুরুষদের খুঁজে বার করা। আমাদের সঠিক পরিচয় নির্ণয় করা।

স্থান-কাল-পাত্র সব বিস্মৃত হয়ে গেলেন প্রিয়লাল। এত রহস্যের গভীরে আমাদের পরিচয়? কোথায় এর শেষ? কে আমাদের সৃষ্টিকর্তা পূর্বপুরুষ? আরও আরও কত যুগ ভবিষ্যতে এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর মিলবে?

তারপর–তারপর! উত্তেজনায় চকচক করে উঠল প্রিয়লালের চোখ।

অত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন! আপনার এ অবস্থায় দেহের ক্ষতি হবে। আস্তে আস্তে সবই জানতে পারবেন প্র. বোস।

আস্তে আস্তে এই কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে যাবার কথা মনে পড়ে গেল প্রিয়লালের। কতক্ষণ দেরি হয়ে গেছে।

সামন্তবাবু, কতক্ষণ আমি অজ্ঞান ছিলাম?

অজ্ঞান? হেসে ফেললেন সামন্ত, তা আপনার কথামতো প্রায় চার ঘণ্টা অজ্ঞান। ছিলেন।

ধড়মড় করে সোজা দাঁড়িয়ে পড়লেন প্রিয়লাল।

 মাই গড। এক্ষুনি যেতে হবে আমাকে। তাড়াতাড়ি মহাকালের কাছে নিয়ে চলুন আমাকে।

ননসেন্স! বসুন-বসুন প্র. বোস।

 বসব কেন? বললাম তো সময় নেই আমার।

বসুন, বসুন আপনি। আদেশের সুরে বললেন সামন্ত।

 রাগে জ্বলে উঠলেন প্রিয়লাল। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বসে পড়লেন আবার।

বাঃ, এই তো ভালো। এবারে নিশ্চয়ই আপনি জানতে চাইবেন কেন এই ডিপার্টমেন্টে নিয়ে আসা হল আপনাকে?

কেন, কেন আনা হয়েছে এখানে?

অতীতের কোনও কিছু বই থেকে পড়াই না আমরা। তা সে সোশিওলজি, ইতিহাস বা যা-ই হোক না কেন। অতীতের বিভিন্ন যুগের মানুষদের বর্তমানে রক্তমাংসে রূপান্তরিত করে ছাত্রদের চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলি তাদের আচার-আচরণ সমাজ-ব্যবস্থা।

কেমন করে? কিছুই যে বুঝতে পারছি না?

মানে অতীতের বিগত ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্ব নিয়ে যথাযথভাবে এক জটিল উপায়ে রক্তমাংসের মতো কৃত্রিম দেহ পুনর্জীবিত করা হয়। এই শতাব্দীর এটাই সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব।

বিস্ময়ে চোখ কপালে ওঠবার জোগাড় হল প্রিয়লালের।

মানে মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জীবন!

না না, মৃত জীবিত এসব কথার কোনও অর্থ নেই এ শতাব্দীতে। দেহ একটা আধার মাত্র। আধার পালটানো মানে কি মরে যাওয়া? আসল হচ্ছে আত্মা–যে অমর অক্ষয় দেহহীন নিরাকার।

এ আর নতুন কী শোনাচ্ছেন? এ তো হিন্দুধর্মের প্রধান বক্তব্য।

না, নতুন তো কিছু নয়। অনাদি সনাতন বক্তব্যগুলোকেই আমরা বিজ্ঞানের আলোয় নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেছি মাত্র। বৈজ্ঞানিক সূত্রে প্রমাণ করতে পেরেছি আত্মার অস্তিত্ব। একটা দেহকে আশ্রয় করে নিরাকার আত্মা সামাজিক সাংসারিক লীলাখেলা করে। সময়ে দেহরূপ খোলস ত্যাগ করে অমর আত্মা যাত্রা করে মহাশূন্যে। ঘুরে বেড়ায় উপযুক্ত আধারের জন্য। অবশ্য সব আত্মার কিন্তু জন্মলাভ হয় না। ব্যাপারটা আরও জটিল। তাই প্রতিটি মানুষের একটা দেহগত ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য থাকে। আবার প্রতিটি মানুষ একটি নির্দিষ্ট ওয়েভলেন্থে স্বরক্ষেপণ বা কথা বলে থাকে। যা কোনদিনও ধ্বংস হয় না। সুতরাং রি-ইনকারনেশান বা পুনর্জন্ম মেশিনে বহু অতীতের মানুষকেও তার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য শুধু কিছু সময়ের জন্য পুরোনো দেহের অনুকরণে কৃত্রিম রক্ত-মাংসের দেহে স্থাপিত করে পুনর্জীবিত করা কঠিন নয় বর্তমানে। আত্মার দেহত্যাগের সময়ের উপর নির্ভর করে পুনর্জীবিত থাকার সময়। এ বিষয়ে আরও পরীক্ষা চলছে।

অবিশ্বাস্য! অসম্ভব। আমাদের পৃথিবীতে থিওসফিকাল সোসাইটিতে সাইকিকাল রিসার্চ হত বটে। কিন্তু এ যে স্বপ্নেরও অতীত। কিন্তু বললেন না তো আমি এখানে কেন?

আপনার বেলায় ও ঠিক তাই হয়েছে। মহাকাল চড়ে আমাদের যুগে এসে পড়েছেন আপনি মানে আপনার দেহ৷।

আরও-আরও জানতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু সময় যে আর নেই। আমাকে যেতে দিন এবার।

কোথায় যাবেন প্র. বোস! আপনাকে তো…

বাড়ি যাব! অনেক দেরি হয়ে গেছে। শুধু একটি বার দেখিয়ে দিন আমার মহাকালকে… অনুনয় করে বলে উঠলেন প্রিয়লাল।

কোনও কথা না বলেই অদ্ভুত ভাবলেশহীন চোখে প্রিয়লালের দিকে তাকিয়ে রইলেন সামন্তবাবু। সেই চোখের দিকে দৃষ্টি পড়তেই দারুণ অস্বস্তিতে ভরে উঠল প্রিয়লালের মন।

বেশ, দেখতে যখন চাইছেন তখন আসুন আমার সঙ্গে। গলার স্বরে কেমন একটা থমথমে ভাব।

প্রিয়লালকে নিয়ে কয়েকটা ঘর পেরিয়ে লম্বা অন্ধকার একটা হল ঘরে ঢুকলেন সামন্তবাবু।

হ্যাঁ, আর একটা কথা বলার দরকার প্র. বোস। এ অবস্থায় ফিরে যাওয়া যাবে না। গেলেও আধঘণ্টার বেশি থাকতে পারবেন না কিন্তু।

হঠাৎ উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল হলঘর।

 ধাতব প্ল্যাটফর্মের উপর দাঁড় করানো মহাকাল। কয়েকজন যুবক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষা করছে মহাকালকে।

একরকম দৌড়ে প্ল্যাটফর্মের উপর উঠে পরম স্নেহে মহাকালের গায়ে হাত বোলালেন প্রিয়লাল। আঃ কী আরাম। বর্তমান আর অতীতের যোগসূত্র এই টাইম মেশিন। আর অতীত মানে তো সান্ত্বনা। বড় জ্বলজ্বলে টিপ পড়া হাসি মাখানো মুখখানা।

ভেতর থেকে বন্ধ কেন মহাকালের দরজাটা? কে বন্ধ করল? বাইরে থেকে খোলা যে যায় না তা নয়, তবে খুব বিপদজ্জনক। যান্ত্রিক ত্রুটি হবার প্রচুর সম্ভাবনা থাকে।

আপনিই খুলুন প্র. বোস। কেটে খুলতে ইচ্ছা করছে না আমাদের।

আঁতকে উঠলেন প্রিয়লাল। বলে কী! কাটবে নাকি? তাহলে সব শেষ। চিরদিনের মতো হারিয়ে যাবেন ভবিষ্যতের বুকে।

না না কাটতে হবে কেন। খুলছি আমি। তা ছাড়া আমাকে তো যেতে হবে। একটু জোর দিয়েই বললেন কথাগুলো প্রিয়লাল। জোর দিয়ে বলার সঙ্গে সঙ্গে কেমন আত্মিক শক্তি সঞ্চারিত হল ওঁর সর্বাঙ্গে।

আশ্চর্য! পরস্পর পরস্পরের দিকে নির্বাক দৃষ্টি বিনিময় করল একবার। ওদের অস্বাভাবিক আচরণ কেমন যেন সন্দেহজনক। মনে মনে ভাবিয়ে তুলল প্রিয়লালকে।

মনে মনে ছক কেটে ফেললেন প্রিয়লাল। পালাবার পরিকল্পনা পাকা। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে চালু করতে হবে কনট্রোল বোর্ডের সুইচগুলো। ব্যাস। এদের কিছু বোঝার আগেই পৌঁছে যাবেন সান্ত্বনার কাছে।

মনে মনে আউড়ে নিলেন তালা খোলার কম্বিনেশান নাম্বারগুলো। মহাকালের কাছ থেকে সরাতে হবে এদের তিনজনকে।

দেখুন, একটু দূরে যেতে হবে আপনাদের। দরজা খোলার সময় কী হবে তা জানি না। মারাত্মক কোনও গ্যাস বেরুলেও বেরুতে পারে ভিতর থেকে। ওদের সরাবার জন্য ডাহা ডাহা কতকগুলো মিথ্যা কথা বললেন প্রিয়লাল।

সবাইকে নিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন সামন্তবাবু। কিন্তু বেশি দূরে গেলেন না। যাই হোক না কেন, ফিরতে গেলে ঝুঁকি তো নিতেই হবে।

কম্বিনেশান নাম্বার মিলিয়ে জোর এক ঝাঁকানি দিতেই খুলে গেল গোলাকার দরজাটা। কিন্তু লাফিয়ে ঢোকার পরিবর্তে টাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে পড়ে গেলেন প্রিয়লাল। সঙ্গে সঙ্গে দু-জন দু-দিক থেকে টেনে তোলার জন্য হাত শক্ত করে ধরল।

ছেড়ে দাও–ছেড়ে দাও আমাকে। আমাকে যে ফিরতেই হবে।

সর্বশক্তি দিয়ে হাত ছাড়াবার বৃথাই চেষ্টা করলেন কয়েকবার। কাকুতি-মিনতি করতেও দ্বিধা করলেন না। দু-চোখ ছাপিয়ে জল এল। কিন্তু একটুও শিথিল হল না হাতের বাঁধন।

হঠাৎ প্রচন্ড যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলেন প্রিয়লাল। সেই বিদঘুটে যন্ত্র হাতে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সামন্তবাবু। যন্ত্র থেকে এবার বেরোচ্ছে লাল আভা। আর লাল আভার স্পর্শ মাত্র যন্ত্রণায় অবশ হয়ে পড়ছে সর্বাঙ্গ। ধীরে ধীরে পাথরের মতো ভারী হয়ে উঠল সমস্ত শরীর। যন্ত্রণায় দাপাদাপি ক্রমেই বেড়ে চলল। আর কোনও উপায় নেই। নিরুপায় প্রিয়লাল শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন ওদের দিকে।

সান্ত্বনা। সান্ত্বনা। বিড় বিড় করে উঠল ঠোঁট দুটো।

আবার সেই ঘর। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠলেন প্রিয়লাল। পাশে বসে আছেন সামন্তবাবু।

রীতিমতো দুঃখিত প্র. বোস। ফিরে যেতে পারেন না আপনি–কোনওমতেই নয়।

 কথা বলা নিরর্থক। সব জানার পরেও জোর করে আটকে রাখতে চায় এরা। ওঁর সুখ দুঃখের কোন দাম নেই এখানে। শুধুই ওদের কৌতূহল মেটাতে হবে। ভবিষ্যতের চিড়িয়াখানায় অতীতের এক জীবন্ত প্রাণীমাত্র।

রাগ করলেন প্র. বোস? সত্যি উপায় নেই। সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ রূপান্তরিত করা হয়েছে আপনাকে। এখন আপনি এ যুগের, তাও বেশিদিনের জন্য নয়। তাই যতটুকু সময়…

সান্ত্বনা অপেক্ষা করছে। মস্তিষ্কের কোষে কোষে জীবন্ত হয়ে উঠছে অনেক… অনেক ছবি। ঘর আর বারান্দা করছে বারবার। খাবার সাজানো রয়েছে টেবিলের ওপরে। বিবর্ণ হয়ে গেছে জ্বলজ্বলে লাল টিপ। সারা মুখ জুড়ে দুর্ভাবনার ছাপ। জল ভরে উঠছে কাজল কালো চোখে। এ অবস্থায় দারুণ কষ্ট হচ্ছে ওর। না না, যে রকম করেই হোক ফিরতে হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও।

কী হল প্র. বোস, কথা বলুন।

কথা বলুন! লজ্জা হচ্ছে না আপনার! আমাকে বন্দি করে রেখে মজা করছেন আপনারা। আর কি…।

ক্রোধে উত্তেজনায় আগুন হয়ে উঠলেন প্রিয়লাল। নিশপিশ করছে হাতদুটো।

একটু সরে দাঁড়ালেন সামন্তবাবু। পকেট থেকে বিদঘুটে যন্ত্রটা বার করার আগেই বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন প্রিয়লাল। ধাক্কায় ছিটকে পড়ে গেল যন্ত্রটা।

প্র. বোস-কী করছেন আপনি? শান্ত হোন, শুনুন আমার কথা… মৃদু অথচ গম্ভীর গলায় বললেন সামন্তবাবু।

না না, আর কোনও কথা নয়। আর ভুলছি না আপনার মিষ্টি কথায়। ফিরে যাব আমি। কেউ আটকাতে পারবেনা আমায়…

শুনুন শুনুন… প্র. বোস। আপনাকে আটকাচ্ছি না আমি। আপনি নিজেই আপনার ফেরার পথ বন্ধ করেছেন। দাঁড়ান–একবার বোঝবার চেষ্টা করুন…

প্রিয়লালের হাত ধরতেই এক ঝটকা মারলেন প্রিয়লাল। বেকায়দায় চিত হয়ে পড়ে গেলেন সামন্তবাবু। চিৎকার করার সঙ্গে সঙ্গে সর্বশক্তি দিয়ে দু-হাতে সামন্তবাবুর গলা টিপে ধরলেন প্রিয়লাল। অস্ফুট আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে এল বাইরে। ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত গড়িয়ে পড়ল দু-কষ বেয়ে। আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে এল দেহটা।

একটার পর একটা ঘর পেরিয়ে হাওয়ার মতো উড়ে চললেন প্রিয়লাল। কোথায় ল্যাবরেটরি? মহাকালকে খোলা পেয়ে কি নষ্ট করে ফেলেছে ওরা? খুনের কথা একবার জানতে পারলে… তাড়াতাড়ি, আরও তাড়াতাড়ি…।

সামনে সেন্ট্রি। থমকে দাঁড়ালেন প্রিয়লাল। হাতে ওর বিচিত্র এক অস্ত্র।

বসুন, বসুন এখানে।

ধরা পড়ে গেছেন প্রিয়লাল। জোর করা মানে মৃত্যু নিশ্চিত। ধপাস করে বসে পড়লেন পাশের চেয়ারে।

এই শরীর নিয়ে উত্তেজিত হবার কী আছে বলুন তো? নিজের ক্ষতি ডেকে আনছেন কেন এভাবে?

তাড়াতাড়ি ফিরতে চাই আমাদের যুগে। মহাকালে যেতে চাই। দোহাই আপনার, আর আটকাবেন না আমাকে… একবার শুধু…।

কেন? কেন ফিরে যাবেন? সেন্ট্রির গলায় বিস্ময়ের প্রকাশ।

কেন? এ সোজা সরল কথাটি কেন বুঝছেন না আপনারা? আমি তো এ যুগের লোক নই। ১৯৭৬ সালে ফিরতে হবে আমাকে। আমার স্ত্রী অপেক্ষা করছে আমার জন্য। শুধু একটু দেখিয়ে দিন ল্যাবরেটরি ঘরটা।

ল্যাবরেটরি? কী হবে সেখানে?

ওখানেই তো আছে আমার মহাকাল। মহাকাল চড়েই তো ফিরতে হবে আমাকে।

আচ্ছা, কেউ কিছু বলেনি আপনাকে?

কেউ? কী বলবে আমাকে?

কেউ বলেনি? আশ্চর্য! মনে মনে একটু চিন্তিত হল সেন্ট্রি বেশ, আমিই বলছি। আপনার যুগে ফিরে যেতে পাবেন না আর। ফিরে গেলেই আপনার আত্মিক শক্তি ঠিক মৃত্যুর মুহূর্তে ফিরে যাবে। তার ফলে লোপ পাবে আপনার অস্তিত্ব।

নিজের কানকে বিশ্বাস হল না। শুধু একটা বিকৃত স্বর বেরিয়ে এল গলা দিয়ে, কী… কী বলছেন?

আত্মিক শক্তির বলেই আপনি সশরীরে বিরাজ করছেন এখানে। আত্মিক শক্তির লোপ মানে আপনার বিলুপ্তি। আপনার কোনও…

ধাপ্পা। এ যুগের এ আর এক চাল। যে রকম করেই হোক আটকাতে চায় এরা। ছলে বলে কৌশলে যে কোনও উপায়ে। আত্মিক শক্তি, মৃত্যুর মুহূর্ত–কী সব রোমাঞ্চকর অদ্ভুত কথা। জলজ্যান্ত বেঁচে রয়েছি… না না, আর তর্ক নয় এ বিষয়ে। ওদের কথায় সায় দিয়েই যদি ফেরা যায় তাড়াতাড়ি।

হ্যাঁ, এবার সব পরিষ্কার। সব বুঝতে পেরেছি এবং সব বুঝেই নিজের যুগে ফিরতে চাই। এবার দেখিয়ে দিন কোথায় আমার মহাকাল।

সব বুঝতে পেরেও ফিরে যেতে চাইছেন আপনার যুগে৷ কতক্ষণ আর থাকতে পারবেন সেখানে? বড়জোর আধঘণ্টা। তখন কিন্তু মনে মনে দুষবেন না আমাকে।

বুজরুকি! একবার বেরুতে পারলে হয় এখান থেকে। আমার কত ভালো চায় এরা সে তো এদের ব্যবহার দেখলেই বোঝা যায়। একেই বলে দশচক্রে ভগবান ভূত।

মহাকালের সামনে এসে দাঁড়ালেন ওঁরা দু-জন। সম্পূর্ণ অটুট আছে মহাকাল। চকচক করছে ধাতব দেহটা। দরজা খোলা।

এখনও ভেবে দেখুন। এ যুগে আরও অনেকদিন থাকতে পারতেন আপনি।

চিন্তা করার কিছু নেই ভাই। কেন তোমরা বুঝছো না যে এ যুগের কেউ নই আমি। ১৯৭৬ আমার যুগ। সান্ত্বনা বসে আছে আমার জন্য। শুধু সান্ত্বনাই বা কেন, আমাদের সন্তান আসছে। সন্তানের জন্য তো ফিরতে হবে। ফিরতে পারার আবেগে অনেক কথা ঝড়ের বেগে বলে গেলেন প্রিয়লাল।

সাদর বিদায় জানাল সেন্ট্রি৷ মহাকালের মধ্যে চেয়ারে বসলেন প্রিয়লাল। উত্তেজনায় ঢিপ ঢিপ করছে বুক। খুনের কথা যদি কেউ জেনে ফেলে, আবার যদি বন্দি করে।

ডায়ালের কাঁটা এখনও ২৩৭৬ এ ঠেকে আছে। খুব সন্তর্পণে ১৯৭৬ অ্যাডজাস্ট করলেন প্রিয়লাল। দ্রুত হাতে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে ফেললেন নিমেষে। আর ভুল নয়। খোলা নয় কোনওমতেই। যে কোনও মুহূর্তে বিপদ আসতে পারে। দরজা বন্ধ করে দিলেন প্রিয়লাল।

কনট্রোলবোর্ডের বোতাম টিপে ধরলেন সজোরে। এ কী? কই কম্পন তো শুরু হল না। তাহলে… তাহলে কি খারাপ হয়ে গেল মহাকাল? এত চেষ্টার পরেও ফেরা যাবে না সান্ত্বনার কাছে? গলা চীরে এক চাপা আর্তনাদে ভরে গেল মহাকাল। না না, ওই তো… ওই তো প্লাগটা খুলে গেছে। সকেটের মধ্যে সজোরে চেপে ধরলেন প্লাগটাকে। কাঁপতে শুরু করল মহাকাল। আনন্দে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল হৃৎপিণ্ডটা। সান্ত্বনা… আর ভয় নেই সান্ত্বনা… আর ভয় নেই।

কোনও এক সময়ে স্থির নিশ্চল হয়ে গেল মহাকাল। প্রিয়লালকে বুকে নিয়ে নিজের যুগে ফিরে এল টাইম মেশিন। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ফেললেন প্রিয়লাল। বুকভরে টেনে নিলেন ১৯৭৬ এর হাওয়া। কী মিষ্টি মধুর। সান্ত্বনার গায়ের স্পর্শ আছে হাওয়ার প্রতিটি কণায়। উন্মাদনাময় মদির গন্ধ। এ তো সান্ত্বনার প্রতিশ্রুতি।

প্রায় অন্ধকার ঘর। লাল ঘড়িতে রাত ঠিক বারোটা। ঘরের চারপাশ নিতান্ত পরিচিত। পরম স্নেহে প্রতিটি আসবাবে হাত বোলালেন প্রিয়লাল। কে জানত এত মধুর প্রতিটি বস্তু। না আর কোনও সন্দেহ নেই। ১৯৭৬ সাল।

কী আনন্দ! কী আনন্দ! পাখি আলো বাতাস ফুল হতে চাইল মন। দারুণ হালকা মনে হল নিজেকে। পাখির পালকের মতো। কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগছে নিজেকে। চরম উত্তেজনার এটাই বোধহয় ফলশ্রুতি।

ঘরের সামনে করিডর। করিডরের পরেই সিঁড়ি আর সিঁড়ির পরেই লন। আর লনের পর… বাড়িঘর সান্ত্বনা… সব। দ্রুতপায়ে লনে নেমে পড়লেন প্রিয়লাল। ঠান্ডা হাওয়ায় শিরশিরানি ভাব। রাতের তারাদের ভীড় জমেছে আকাশে। বিজয়ী বীরকে দেখতে চায় সবাই।

সান্ত্বনার ঘরে আলো জ্বলছে। আলোর রেশ দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে। ওঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল সান্ত্বনার ছবি। জানালার রড ধরে স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে। দু-গালে শুকনো জলের ধারা। চোখে মুখে উদভ্রান্তের ছাপ। সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে চমকে উঠবে সান্ত্বনা। নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে চাইবে না। পরক্ষণেই দৌড়ে আসবে সিঁড়ির মুখে। আনন্দ উত্তেজনায় নেচে উঠবে চোখদুটো। খুশির জোয়ারে নিমেষের মধ্যে ধুয়ে মুছে যাবে সব।

এইটুকু আসতেই এত হাঁপিয়ে উঠলাম কেন? এই কয় ঘণ্টায় কি খুব দুর্বল হয়ে পড়েছি? ভাবলেন প্রিয়লাল। হাঁ করে নিশ্বাস নিলেন বারবার। অবশ হয়ে আসছে পা দুটো। ঝিনঝিন করছে সর্বাঙ্গ। হাঁটার গতিও গেছে কমে।

কিন্তু এখনও বাকি তিন তলার সিঁড়ি ভাঙতে৷ তিন তলা? কটা সিঁড়ি আছে এক-এক তলাতে? কে জানে? কোনওদিন তো গুনে দেখার প্রয়োজন হয়নি প্রিয়লালের।

ভীষণ… ভীষণ ক্লান্ত। শ্রান্তিতে জড়িয়ে আসছে পা দুটো। কোথায় ছিল এত ক্লান্তি? হাত পা সব কাঁপছে থর থর করে।

সান্ত্বনা! এত ক্লান্তি অবসাদ কেন? আমি কি অসুস্থ হয়ে পড়লাম?

থেমে থেমে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করলেন প্রিয়লাল। এক-দুই-তিন… আর কত… কত বাকি… হে ভগবান…

মাথা খসে পড়ছে। অবশ হাতে সিঁড়ির রেলিং ধরেও ধরা যাচ্ছে না। একবারও তো নিচে আসতে পারত সান্ত্বনা… হাত ধরে তুলে নিতে তো পারত… শুধু একটু সাহায্য… একটু হাত ধরা… কী সব ভাবলেন প্রিয়লাল-সান্ত্বনাই বা জানবে কেমন করে যে প্রিয় এত দুর্বল হয়ে পড়েছে–মাঝ রাতে ফিরে আসছে ভবিষ্যতের বুক বেয়ে…

দরজা ভেজানো। আলো বেরিয়ে আসছে ফাঁক দিয়ে। টলতে টলতে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

দড়াম! সমস্ত শরীর দিয়ে ধাক্কা দিলেন প্রিয়লাল। সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন ঘরের মধ্যে। ঘর থেকে ছুটে এল সান্ত্বনা। শাড়িটা লুটিয়ে পড়েছে মেঝের উপর। দুশ্চিন্তায় উন্মাদপ্রায় সান্ত্বনা। কয়েক মুহূর্ত স্থানুর মতো দাঁড়াল ও। তারপর প্রিয়র অবসন্ন শরীরটা দু-হাতে টেনে হিঁচড়ে বিছানার ওপর নিয়ে ফেলল সান্ত্বনা।

প্রিয়, প্রিয়! কী হয়েছে তোমার? বলো, বলো–কী কষ্ট হচ্ছে…

চোখের পাতা খুলল। জ্বলজ্বলে টিপ সন্ধ্যাতারার মতো উজ্জ্বল। ভাসছে চোখের উপর। অবরুদ্ধ কান্নায় থরো থরো পাতলা ঠোঁট দুটি। কাজল কালো চোখ অব্যক্ত বেদনায় বাঙময়।

সান্ত্বনা… সান্ত্বনা… ফিরে এসেছি আমি। বহুদূর থেকে যেন ভেসে এল প্রিয়লালের স্বর।

সান্ত্বনা… কাছে এস সান্ত্বনা…

ঘাড় ফেরাতেই আতঙ্ক বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়ে গেল সান্ত্বনা। এ কি সম্ভব! স্বপ্ন না মায়া… না না না…

কর্পূরের মতো উবে যাচ্ছে প্রিয়র হাতের আঙুলগুলো। অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। আঙুল… হাতের চেটো.. কব্জি… সব… সব খসে খসে পড়ছে… উবে যাচ্ছে… মিলিয়ে যাচ্ছে..

না না না… এ হতে পারে না… এ হতে পারে না… বিকৃত স্বরে চিৎকার করে উঠলেন প্রিয়লাল। কানের কাছে সামন্তবাবুর সেন্ট্রির কথাগুলো বাজতে লাগল। পুনর্জীবন… আত্মিক শক্তি মৃত্যুর মুহূর্ত… সব-সব পরিষ্কার হয়ে গেল। যাত্রার প্রারম্ভেই ওর মৃত্যু হয়েছিল প্রচণ্ড ধাক্কায়। তারপর… ২৩৭৬ সালে… সামন্তবাবুরাই পুনর্জীবিত করেছেন…

সান্ত্বনা-সান্ত্বনা, চেপে ধরো আমাকে যেতে দিও না আমাকে… যেতে দিও না… হাহাকার করে উঠলেন প্রিয়লাল।

ক্রমেই লোপ পাচ্ছে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে লোপ পাওয়ার গতি। পা আর নেই… কাঁধ থেকে হাতের অস্তিত্ব শূন্য… ভয়ে ভালোবাসায় আতঙ্কে দিশাহারা সান্ত্বনা…

সান্ত্বনা… সান্ত্বনা… আমাকে ছেড়ে যেও না তুমি… আমাকে বাঁচাও… বাঁচাও…

প্রিয়… প্রিয়… এ কী হল?

পেট-বুক-গলা সব মিলিয়ে গেল–গলে উবে শূন্যে উধাও হয়ে গেল…

শুধু মুখখানা সান্ত্বনার অজ্ঞান মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অপলক দৃষ্টিতে।

 চিবুক-ঠোঁট-নাক-চুল-কপাল–না, কিছুই রইল না। শূন্যে মিলিয়ে গেল ধোঁয়ার মতো।

 শুধু চোখ… প্রিয়র সুন্দর চোখ দুটো ভাসতে লাগল শূন্যে। ভালোবাসায় তৃষ্ণায় বায় চোখ দুটি শেষবারের মতো সান্ত্বনাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করল।

টপ টপ করে উষ্ণ দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল প্রিয়র জ্বহীন পাতাহীন চোখদুটি বেয়ে।

 বেদনাময় চোখদুটো নিরুপায়ের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল একসময়।

[প্রথম প্রকাশ: কল্পবিশ্ব, জুলাই ২০১৭]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *