চাঁদের সেই প্রহরীটি

চাঁদের সেই প্রহরীটি

পূর্ণিমার চাঁদ তো আপনারা সকলে দেখেন, দেখেছেন এবং দেখবেনও। কিন্তু ১৯৯৬ সালের গ্রীষ্মকালের শেষ পূর্ণিমায় আপনারা কেউ চাঁদ দেখেছেন কি! তবে কেউ যদি ওই সময়ে চাঁদের ডান দিকে খাঁজকাটা অংশটা বিশেষভাবে দেখে থাকেন, তাহলে ঠিক রাত সাতটার সময় ওইখানে এক গোলাকার কালো বস্তুকে নিশ্চয়ই দেখেছেন। হ্যাঁ, খালি চোখেই দেখা গিয়েছিল। ওইটাই বিরাট বড় বড় পাহাড় দিয়ে ঘেরা চাঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সমতল ভূমি। মেয়ার ক্রিসিয়াম বা সমস্যার সমুদ্র। এর ব্যাস প্রায় তিনশো মাইল। ১৯৯৬ সালে আমরাই সর্বপ্রথম সমস্যার সমুদ্রে অভিযান চালিয়েছিলাম।

খুবই ব্যাপক ছিল আমাদের এই অভিযানটি। মেম্বার সেরেনিটেটিস্ থেকে দুটি প্রকাণ্ড মহাকাশযানে আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র আনা হয়েছিল এখানে। এই দুই স্থানের মধ্যে দূরত্ব প্রায় পাঁচশো মাইল। খুব কাছাকাছি মালপত্র বওয়ার জন্য আরও তিনটি ছোট ছোট রকেটও এসেছিল। আগেই অবশ্য বলেছি যে এই স্থানের প্রায় সবটাই সমতল। তা ছাড়া এখানকার মতো বড় বড় আগ্নেয়গিরি গহ্বর এবং ফাটল চাঁদের বুকে আর কোথাও নেই।

যাক, এবার আমি আমার পরিচয় দিই। আমি একজন ভূতত্ত্ববিদ। অথবা এখন আমাকে চাঁদতত্ত্ববিদও বলতে পারেন। তবে তখন আমার সত্যিকারের পরিচয় ছিল সমস্যার সমুদ্র অভিযানকারী দলের দলনেতা বলে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সপ্তাহে আমরা একশো মাইলের বেশি যেতে পারতাম না। এককালে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এই জায়গায় ছিল বিশাল সমুদ্রের পাড়। হাজার হাজার বছর আগে বিশাল এক তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সমুদ্র ছিল এখানে। পৃথিবীতে প্রাণের লীলাচাঞ্চল্য শুরু হবার সময় জীবনের মেজাজ ফুরিয়েছিল চাঁদের। তারপর চাঁদ হল মৃত্যুর চেয়েও নিথর, নীরবতার চেয়ে স্তব্ধ। চাঁদের বুকে বড় বড় ফাটলের মধ্যে দিয়ে সমস্ত জলরাশি প্রবেশ করল অন্তঃসারহীন কেন্দ্রস্থলে। সেই বিশাল জলরাশির পরিবর্তে আজ এখানে কেবল খুব সামান্য পরিমাণে জলীয় বাষ্প বর্তমান। চির অন্ধকারময় বিশাল পর্বত-গুহার দিকে তাকালে মনে হয় যেন কুয়াশার এক ক্ষীণ আস্তরণ রয়েছে সেখানে।

আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম চাঁদের এক মন্থরগতি প্রত্যুষকালে। পৃথিবীর হিসাবে পুরো সাত দিনের সময় ছিল আমাদের হাতে। গাড়ি থামিয়ে মাঝে মাঝে চাঁদের ধূলিধূসরিত বুকের উপর স্পেস স্যুট পরে নামছিলাম আমরা। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মূল্যবান খনিজের সন্ধান আর ভবিষ্যৎ অভিযানকারীদের সঠিক পথের নিশানা বাতলানো।

গতানুগতিক একঘেয়ে কাজ। বিপদ বা সমস্যার ছিটেফোঁটাও নেই কোনওখানে। অনায়াসে মাসখানেক থাকা যায় আমাদের বায়ুনিরোধক ক্যাটারপিলার ট্রাক্টরের ভেতরে। আর তা ছাড়া কোনও বিপদ ঘটলে রেডিয়ো মারফত খবর পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকারী মহাকাশযান এসে হাজির হবে।

না, উত্তেজনাহীন গতানুগতিক বলে বোধহয় একটু অসত্য কথা বলা হয়। দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড রুক্ষ এবড়ো-খেবড়ো পাহাড়গুলো দেখতে মোটেই একঘেয়ে লাগে না। তা ছাড়া প্রতি বাঁকের সময় আমাদের রোমাঞ্চ জাগত। হয়তো বা কোনও নতুন বিপদ বা সমস্যা ওত পেতে বসে আছে বাঁকের ওপাশে।

সমস্যা সমুদ্রের দক্ষিণের সমস্ত বাঁকটা এককালে এক বিরাট ব-দ্বীপ ছিল। অনেকগুলো নদী এখানে সমুদ্রে মিশেছিল। চাঁদের যৌবনে ক্রমাগত আগ্নেয়গিরির অগ্নিবর্ষণে এবং প্রবল বর্ষণের ফলেই জন্ম হয়েছিল নদীগুলোর। এখানকার চারপাশে ভালো করে দেখলেই এ-কথাটা বোঝা যায়।

ট্রাক্টরের মধ্যে আমরা পৃথিবীর সময়ানুসারেই সব কাজ করতাম। পৃথিবীর ঠিক রাত বারোটায় আমরা প্রধান ঘাঁটিতে দিনের শেষ খবর পাঠিয়ে দিতাম। ক্যালেন্ডারের পাতাতেও নতুন দিনের সূচনা হত। বাইরে রুক্ষ পাহাড় পর্বতগুলো সরাসরি সূর্যালোকে গনগন করে জ্বলছে। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলে কীরকম যেন নেশা ধরে যায়। আমাদের কাছে এখন কিন্তু রাত। বিশ্রাম নেবার সময়। আবার আমাদের কাজ শুরু হবে ঠিক আট ঘণ্টা পরে। তারপর একজনের কাজ হত প্রাতঃরাশ তৈরি করা। দাড়ি কামাবার বৈদ্যুতিক যন্ত্রের একটানা আওয়াজ উঠত। ওমলেট ভাজার মিষ্টি গন্ধে আমাদের মনে হত যে আমরা যেন পৃথিবীতেই বসে আছি।

সেদিন প্রাতঃরাশ তৈরি করার ভার ছিল আমার ওপর। রেডিয়োতে তখন ভীষণ ভালোলাগা এক রবীন্দ্রসংগীত হচ্ছিল। আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা। ট্রাক্টরের চাকা পরীক্ষার জন্য স্পেস স্যুট পরে ড্রাইভার বাইরে বেরিয়ে গেছে। আমার সহকারী পরিমল দেবগুপ্ত লগবুক আপ-টু-ডেট করতে ব্যস্ত।

ফ্রাইং প্যানের গরম ঘি এর ওপর ডিম ভেঙে দিয়ে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ সামনে দূরের এক পাহাড়ের ওপর আমার নজর পড়ল। মাইল তিরিশেক দূরে পশ্চিম দিকে একট পাহাড় লাটুর মতো ছুঁচলো হয়ে যেন আকাশকে ছুঁড়তে চাইছে। ছুঁচলো মুখের একটু নিচে স্থিরভাবে জ্বলজ্বল করে কোনও কিছু যেন জ্বলছিল সেখানে। মনে হচ্ছিল নিষ্ঠুর পাহাড়টাই বুঝি একটি তারাকে আকাশের বুক থেকে জোর করে ছিনিয়ে এনে নিজের বুকে লাগিয়ে রেখেছে। প্রথমে মনে হয়েছিল বুঝি কোনও মসৃণ পাথরের ওপর সূর্যালোক প্রতিফলিত হচ্ছে। কীরকম যেন কৌতূহলী হয়ে উঠল আমার মন। সঙ্গে সঙ্গে পর্যবেক্ষণ কক্ষে চলে এলাম এবং চার ইঞ্চি টেলিস্কোপটা তুলে নিলাম।

পাহাড়টা যেন আধ মাইলের মধ্যে চলে এল। চকচকে বস্তুটা কিন্তু সেই ছোটই থেকে গেল। একটু ভালো করে লক্ষ করতেই একটা জিনিস চোখে পড়েছিল। চকচকে বস্তুটার চারপাশে পাহাড়টা বিরাট এক সমতল ক্ষেত্র। আরও ভালো করে লক্ষ করতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ ডিম পোড়ার বিশ্রী গন্ধে আমার চমক ভাঙল।

সমস্ত সকালটা আমাদের এই সম্বন্ধে আলোচনায় কাটল। এদিকে পশ্চিমের পাহাড়টা ক্রমেই দৈত্যের মতো প্রকাণ্ড হয়ে উঠছিল। বাইরে খনিজ সম্বন্ধে অনুসন্ধান চালাবার সময়ও রেডিয়ো মারফত আমাদের আলোচনা চলছিল। তবে সকলেই এক বিষয়ে একমত ছিলাম যে চাঁদের বুকে বুদ্ধিমান কোনও জীবের বিকাশ হয়নি। কিছু পুরাকালীয় গাছ গাছড়া ছাড়া আর কোনও জীবনের সন্ধান পাইনি আমরা। কিন্তু তবুও যেন আমার মনে হয়েছিল যে না-জানা এমন অনেক কিছুই তো থাকতে পারে!

বেশ কিছুক্ষণ বাদে আমি বলেছিলাম, বেশ, তাহলে তোমরা এখানে থাকো। একাই আমি যাব ওখানে। পাহাড়টা মনে হচ্ছে বারো হাজার ফুটেরও কম। তাহলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ হিসাবে মাত্র দু-হাজার ফুট। রাত আটটার মধ্যেই ফিরে আসতে পারব।

কেন আপনি এরকম ছেলেমানুষি করছেন বলুন তো! ওখান থেকে পড়ে গিয়ে হয়তো হাত-পা ভাঙবে, আর তাই নিয়ে মূল ঘাঁটিতে হাসাহাসির শেষ থাকবে না। আমাকে বাধা দেবার চেষ্টা করল পরিমল।

হাত-পা ভাঙবে কেন? একটু ছড়েও যাবে না, দেখো। আচ্ছা পিকো আর হেলি কোণে কে আগে উঠেছিল বলো তো?

কিন্তু তখন আপনার বয়স তো আরও অনেক কম ছিল। উত্তর দিয়েছিল রবার্ট চ্যাফি।

আরে বয়সে কি আর সব হয়! মনের জোর আমার ঠিক আগের মতোই আছে। যাক, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওখানে আমি যাবই। একটু জোরের সঙ্গে বলেছিলাম আমি।

সেদিন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম আমরা। আমাদের গাড়ি থেকে ওই পাহাড়ের দূরত্ব এখন মাত্র আধ মাইল। ঠিক হল আমার একলা যাওয়া হবে না। পরিমল যাবে আমার সঙ্গে। পরিমলের অবশ্য পাহাড়ে চড়ার বিশেষ ট্রেনিং আছে। তা ছাড়া এর আগেও অনেক দুঃসাহসিক কাজে ও আমার সঙ্গী ছিল। পাহাড়টা এত খাড়াই যে প্রথমে পাহাড়ে ওঠা একরকম অসম্ভব বলে মনে হছিল। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল পৃথিবীর তুলনায় চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ মাত্র ছ-ভাগ। সুতরাং বিশেষ কোনও অসুবিধা হবে না আমাদের।

একটানা চার হাজার ফুট উঠে আমরা প্রথম বিশ্রাম নিয়েছিলাম। দেখলাম, চাঁদের পাহাড়ে ওঠা খুব শক্ত নয়। কিন্তু কেন জানি না আমি বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন থেকে আমাদের ট্রাক্টরের সঙ্গে আমাদের রেডিয়ো যোগাযোগ বরাবর ছিল।

স্পেস স্যুটের রেফ্রিজারেশন ইউনিট বেশ ভালোভাবে কাজ করার জন্যে আমার বেশ ঠান্ডাই লাগছিল। সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে চতুর্দিক ঝলসে যাচ্ছে।

এবার আমরা পঞ্চাশ ফুট উঁচু এক মসৃণ পাথরের দেওয়ালের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এই দেওয়ালের ওপরেই সেই সমতলভূমি। পাথরের গায়ে পা রাখার মতো সামান্য কোনও খাঁজও নেই কোনওখানে। বাধ্য হয়ে হুক বাঁধা দড়ির সাহায্য নিতে হল। বাঁধা দড়িটা হাতে নেওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গে দু-হাতে যেন এক প্রচণ্ড শক্তি পেলাম। তারপরে সজোরে হুক তিনটেকে ছুঁড়ে দিলাম পাথরের দেওয়ালের ওপারে। প্রথমবার হুকগুলো আটকালো না। দড়ি ধরে টানতেই খুলে এল। কিন্তু তৃতীয়বারে পাথরে খাঁজে সজোরে আটকে গেল হুকগুলো। আমাদের দুজনের টানাটানিতেও একচুলও এদিক ওদিক হল না।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল পরিমল। ভাবটা এই যে, সে-ই প্রথমে ওপরে উঠবে। কোনও কথা না বলে চোখের ইশারায় ওকে বারণ করেছিলাম আমি। তারপর শুধু হাত দিয়ে দড়ি ধরে অনায়াসে ওপরে উঠে এলাম।

সামনেই বেশ প্রশস্ত সমতলভূমি। লম্বায় বোধহয় শ-খানেক গজ হবে। ক্রমাগত উল্কাবর্ষণে এখানে সেখানে ৫টি বড় গর্ত। আর ঠিক মাঝখানে তেরো-চোদ্দো ফুট উঁচু পিরামিডের মতো তেকোনা এক উজ্জ্বল গম্বুজ। সূর্যালোকে হীরকখণ্ডের মতন দ্যুতিমান।

কয়েক মুহূর্ত আমি যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম। তারপরেই যুগপৎ আনন্দে বিস্ময়ে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠেছিল। চাঁদ শুধু মসজাতীয় গুল্মেরই জন্মদাতা নয়। আমাদের সেই প্রথম অভিযাত্রী দলের দুর্বোধ চন্দ্ৰস্বপ্নও যেন বাস্তব হয়ে দেখা দিল। বুঝলাম, চাঁদের বুকে একদিন সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটেছিল। আর আমিই প্রথম আবিষ্কার করলাম সেই সভ্যতার শেষ চিহ্নকে!

আনন্দের উন্মাদনায় কিছুক্ষণ কাটার পর আমার স্বাভাবিক বুদ্ধিবৃত্তি আস্তে আস্তে ফিরে আসছিল। তখন নানারকম প্রশ্ন এসে ভীড় করতে শুরু করল। এটা পবিত্র ধর্মীয় কোনও কিছু না, নাম না-জানা কোনও স্থাপত্য কীর্তি! যদি এটা বাড়ি হয় তবে এই দুর্গম পাহাড়ের ওপরই বা এত সুন্দর করে তৈরি করার উদ্দেশ্য কী! আবার মনে হল, না, এটা মন্দির। চন্দ্র-সভ্যতায় শেষ ভাগে ভগবানের উদ্দেশেই এই সুন্দর মন্দিরটি নির্মাণ করেছিল চন্দ্রবাসীরা।

নিজের অজান্তে পায়ে পায়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর এক অজানা আশংকায় আর এগিয়ে যেতে সাহস হল না। স্থাপত্যকলা সম্বন্ধে আমার জ্ঞান খুবই সামান্য। তা সত্ত্বেও পাহাড়ের এত উঁচুতে এরকম সুন্দর স্থাপত্যকলা দেখে চন্দ্র-সভ্যতার অগ্রগতির পরিমাপ করার চেষ্টা করলাম।

পিরামিডের তুলনায় এর উচ্চতা এতই নগণ্য যে এর নির্মাতাদের আমাদের চেয়েও বেশি উন্নতি বলে ভাবতে পারলাম না। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হল এখানকার সভ্যতার অস্তিত্ব যদি সত্যি হয়, তবে বেশি না হোক কয়েকটি নিদর্শন তো পাওয়া যেত। এই একটা নিদর্শনের ওপর নির্ভর করে কোনও কিছুই সিদ্ধান্তে আসা কি খুবই সঙ্গত?

হঠাৎ একটা নগণ্য দৃশ্য চোখে পড়তেই মাথার চুল সব খাড়া হয়ে উঠল। দৃশ্যটা এতই নগণ্য এবং নির্দোষ যে অনেকের চোখেই হয়তো পড়বে না এটা। আমি তো এর আগে বলেছিলাম যে উল্কাঘাতে এই সমতল ভূমির এখানে-সেখানে নানান আকারে গর্ত হয়েছিল। তা ছাড়া বাতাসের রেশমাত্র না থাকায় মহাজাগতিক ধুলো বেশ কয়েক ইঞ্চি পুরু হয়ে পড়েছিল বহুদিকে। কিন্তু এই ধুলোর আস্তরণ এবং উল্কাঘাতে সৃষ্ট ছোট বড় গর্তগুলো পিরামিডের একটু দূরে এক বৃত্তাকারে এসে শেষ হয়েছে। কোনও অদৃশ্য দেওয়াল যেন বৃত্তাকারে পিরামিডকে ঘিরে রেখেছে।

মনে হল আমার ইয়ারফোনে অনেকক্ষণ ধরে কেউ যেন ডাকছে আমাকে। বুঝলাম এ কণ্ঠস্বর পরিমলের। পিছন ফিরে আমি শিল্পের প্রান্তভাগে এসে দাঁড়ালাম। তারপর কিছুক্ষণের মধ্যে পরিমল উঠে এসেছিল আমার কাছে। আবার আস্তে আস্তে পিরামিডের কাছে এসে দাঁড়ালাম। কী মনে হতে একটা পাথরের টুকরো সজোরে পিরামিডের দিকে ছুঁড়ে দিলাম। কিন্তু কী আশ্চর্য! পাথরটা মনে হল গম্বুজাকৃতি কোনও দেওয়ালে বাধা পেয়ে দেওয়ালের গা বেয়ে আস্তে আস্তে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল।

সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, আমাদের কোনও স্থাপত্যকলার সঙ্গে এর কোনও তুলনাই চলে না। এটা কোনও বাড়ি বা মন্দির নয় –একটা মেশিন মাত্র।

চতুর্দিকে কোনও এক অদৃশ্য শক্তির দুর্ভেদ্য দেওয়ালই পিরামিডটিকে মহাকাশের হাত থেকে রক্ষা করে আসছে। সুদূর অতীতের থেকে একইভাবে কাজ করে চলেছে এই শক্তি। হঠাৎ মনে হল–আচ্ছা, এই অদৃশ্য শক্তির আওতার মধ্যে চলে আসিনি তো আমি। সঙ্গে সঙ্গে এ-যাবৎ মানুষের জানা বিভিন্ন বিকিরণের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল। অনাচ্ছাদিত আণবিক বিকিরণের মধ্যে গিয়ে পড়লে মৃত্যু তো আমার অবধারিত।

ও কথা মনে হতেই পাশ ফিরে তাকিয়ে ছিলাম আমি। চিত্রার্পিতের মতো পরিমলও আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। ওকে কিছু না বলে আবার আমি শিখরপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার ঠিক নিচে সমস্যার সমুদ্র। সমস্ত মানব সমাজের কাছে এক অদ্ভুত আতঙ্কে ভরা এই স্থান। আমি কিন্তু এর নিরাবরণ রুক্ষ করুণ সৌন্দর্যকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এসব যেন খুবই পরিচিত আমার কাছে। মহাশূন্যে অর্ধচন্দ্রাকার পৃথিবীর দিকে তাকালাম। অজস্র নক্ষত্রখচিত দোলনায় যেন পরম আরামে দুলছে আমাদের সুন্দর পৃথিবী। আচ্ছা, মেঘে ঢাকা থাকার জন্যেই কি এই অজানা স্থপতিদের লক্ষ করা যায়নি পৃথিবী থেকে। পৃথিবীতে তখন কোন যুগ চলছিল? দৈত্যাকৃতি জঙ্গলে ঘেরা কার্বোনিফেরাস যুগ? নাকি, যখন সৃষ্টির প্রথম উভচর জীব পদার্পণ করেছিল সমুদ্রের তীরভূমিতে? অথবা জীবনের কী কোনও সূচনাই হয়নি তখন? কেবল সীমাহীন নিঃসঙ্গতায় পৃথিবী যখন অধীর হয়ে উঠেছিল?

এই নির্মম সত্যটাকে এত দেরিতে বুঝতে পারার জন্য আপনারা হয়তো আমাকে দোষী করবেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, উত্তেজনার প্রথম মুহূর্তে মনে হয়েছিল বুঝি কোনও এক চন্দ্র-সভ্যতাকে আবিষ্কার করে ফেলেছি আমি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে অন্তরের অন্তস্থল থেকে কেউ যেন জোর দিয়ে বলে উঠেছিল, না না। এ সত্য নয়। তোমার মতো এই পিরামিডের স্থপতিরাও চাঁদের বুকে আগন্তুক মাত্র।

নানান চিন্তা মাথার মধ্যে ভীড় করে এসেছিল তখন। আবার সেই উজ্জ্বল পিরামিডের দিকে তাকালাম। এবার ভালো লাগার চেয়ে সমস্ত শরীর, যেন অজানা আতঙ্কে শিউরে কঠেছিল। মনে হয়েছিল যেন ফিস ফিস করে কথা বলে উঠল পিরামিডটা। বলল, আশ্চর্য হচ্ছ কেন? আমিও তো তোমার মতো একজন আগন্তুক। কত যুগ ধরে তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছি আমি। ক্রমাগত উত্তেজনায় আমি যেন কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রুগীর মতো আমি নাকি হা হা করে হেসে উঠেছিলাম তখন।

***

এর পর পুরো কুড়ি বছর লেগেছে আমাদের ওই অদৃশ্য দেওয়াল ভেঙে পিরামিডের ভেতরে পৌঁছতে। এমনিতে ভাঙতে পারিনি আমরা। আণবিক শক্তির প্রচণ্ড আঘাতে সুন্দর পিরামিডটাকে টুকরো-টুকরো করে ভেঙে ফেলতে হয়েছিল।

যন্ত্রপাতি দেখে কোনও কিছুই বোঝা যায়নি। এগুলো আদৌ যন্ত্র কি না মনে হয়েছিল আমাদের। তবে এই যন্ত্র-সভ্যতা যে আমাদের জগতের নয় সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। আমার কিন্তু যন্ত্র-কুশলতাকে আধিভৌতিক কোনও শক্তির আধার মনে হয়েছিল।

আমাদের সৌরজগতে অন্যান্য গ্রহেও পদার্পণ করেছি আমরা। দেখেছি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের মধ্যে একমাত্র আমাদের পৃথিবীতেই বুদ্ধিমান জীবের অস্তিত্ব বিদ্যমান। কিন্তু ওই পিরামিডের অজানা রহস্য এখনও আমাদের উতলা করে রাখে। ওহো, একটা কথা আপনাদের বলতে ভুলে গেছি। পিরামিডের চারপাশের মহাজাগতিক ধুলিকণা এবং উল্কাপাতের গভীরতা পরিমাপ করে এর প্রাচীনতা সম্বন্ধে স্থির নিশ্চয় হয়েছিলাম। পৃথিবীর জলভাগের মধ্যে প্রাণের লীলাচাঞ্চল্য শুরু হওয়ার কিছু পরেই তৈরি হয়েছিল ওই পিরামিডটি।

অনেক ভাবনা চিন্তার পর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়েছি আমি। জানি না আপনারা আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না।

আপনারা নিশ্চয় জানেন যে আমাদের ছায়াপথের মধ্যে প্রায় একশো হাজার কোটি নক্ষত্র প্রতিনিয়ত আবর্তিত হচ্ছে। আর এর মধ্যে কোনও কোনও সৌরজগতে কোনও কোনও গ্রহের বাসিন্দা হয়তো বা আমাদের চেয়ে সব বিষয়ে অনেক এগিয়ে গিয়েছিল। এই রকম কোনও এক সভ্যতার কথা ধরা যাক। হয়তো তখন ছায়াপথের মধ্যে বিশেষ কোনও গ্রহে সভ্যতার বিকাশ হয়নি। কোনও এক সময় ভীষণ নিঃসঙ্গতা বোধ করেছিল তারা। তারপরেই তারা প্রাণের স্পন্দন খুঁজতে বেরিয়েছিল অন্যান্য সৌরজগতের মধ্যে।

বিভিন্ন নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে তারা প্রাণের লীলাচাঞ্চল্য খুঁজে বেড়াচ্ছিল। কোনও কোনও গ্রহে হয়তো তখনও প্রাণের আবির্ভাব হয়নি, নয়তো সবেমাত্র মেরুদণ্ডহীন জীবনের বিকাশ হয়েছে মাত্র। আমাদের পৃথিবীও একসময় এরকম ছিল। আকাশ ছোঁয়া আগ্নেয়গিরির মুহুর্মুহু অগ্নি উদগীরণে পৃথিবীর আকাশ তখন ধোঁয়ায় ঢাকা থাকত। ঠিক এমনি এক মুহূর্তে প্লুটোর পাশ দিয়ে এসেছিল অজানা এত উন্নত সভ্যতার এক মহাকাশযান। সৌরজগতের বাইরের বরফ জমা প্রাণহীন গ্রহ দেখে তারা নিশ্চয়ই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। তারপর ভেতরকার উত্তপ্ত গ্রহগুলিতে এসে কিছু বিশ্রাম নিয়েছিল তারা। প্রখর সূর্যরশ্মিতে নিজেদের উত্তপ্তও করে নিয়েছিল তারা।

এমন সময় তাদের দৃষ্টি পড়েছিল আগুনে পোড়া আর বরফে জমা অতি ক্ষীণ সীমারেখার মধ্যে আবর্তিত আমাদের পৃথিবীর দিকে। সঙ্গে সঙ্গে এক অপার সম্ভাবনার ছবি ফুটে উঠেছিল তাদের সামনে। তাদের নির্ভুল সিদ্ধান্ত সফল হয়েছে। আমাদের মতো এক উন্নত সভ্যতার বিকাশ হয়েছে এই পৃখিবীর বুকে। কিন্তু এই সভ্যতার বিকাশ লক্ষ করার মতো সময় হয়তো তাদের ছিল না। তখনও অনেক অনেক নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতে হবে তাদের। আর হয়তো কোনও দিনও এই পৃথিবীর দিকে আসতে পারবে না তারা। সর্বক্ষণ পৃথিবীকে পাহারা দেবার জন্যে কোনও প্রহরীর কথা নিশ্চয়ই চিন্তা করেছিল তারা।

সেই চিন্তার ফল হচ্ছে ওই পিরামিড। হয়তো পৃথিবীর এই প্রহরীর মতো আরও কোটি কোটি প্রহরী তৈরি করেছে তারা। এই পিরামিডের যন্ত্রগুলো প্রহরীর মতো যুগ যুগ ধরে খবর পাঠাচ্ছে যে পিরামিড আবিষ্কার করার মতো এখনও কোনও প্রাণী আসেনি এর চারিধারে।

আচ্ছা, এখনও আপনারা বুঝতে পারছেন না, কেন পৃথিবীর পরিবর্তে চাঁদে তারা পিরামিড করেছিল। আদিম যুগের কোনও সভ্যতার সম্বন্ধে কোনও আগ্রহ ছিল না ওদের। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে মহাকাশে প্রবেশ করতে সমর্থ এমন সভ্যতারই খোঁজ করছিল তারা। কিছুদিন আগে বা কিছুদিন পরে যে কোনও বুদ্ধিমান জাতকেই এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হবে। আর এটা দু-দফা চ্যালেঞ্জ। কারণ একাধারে আণবিক শক্তি জয় করতে হবে এবং জীবন ও মৃত্যু এই দুইয়ের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে হবে।

আমরা এই দুই চ্যালেঞ্জ-এর মোকাবিলা করতে পেরেছি বলেই পিরামিড আবিষ্কার করতে পেরেছি। এটা সত্য কথা যে কিছু সময় লেগেছে আমাদের। পিরামিডের পাঠানো সংকেত এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তার মানে পিরামিডের নির্মাতারা বুঝতে পেরেছে যে এই সৌরজগতে তাদের পূর্ব নির্ধারিত গ্রহে এক সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে। হয়তো এতক্ষণে আমাদের এই শিশু সভ্যতাকে সাহায্য করতে উৎসুক হয়ে উঠেছে তারা। কিন্তু ওদের সভ্যতা তো আমাদের চেয়ে অনেক অনেক যুগের পুরাতন আর পুরাতন মানেই তো সর্ব বিষয়ে অগ্রগামী। ওরা যদি আমাদের সভ্যতাকে ওদের প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করে। আর সে-জন্যে বিশ্বাস করুন আপনারা, এখন আর ছায়াপথের দিকে তাকাতে পারি না আমি। ঘন মেঘের অন্তরাল থেকে জানি না কখন কোনও এক নক্ষত্র জগৎ থেকে নেমে আসবে বহু পুরাতন সভ্যতার প্রথম দূত। কিছু যদি মনে করেন তো একটা উদাহরণ আমার মনে পড়ছে। আমরা যেন অগ্নি নির্বাপণের সংকেত ধ্বনি বাজিয়ে দিয়েছি। শুধু ফায়ার ব্রিগ্রেডের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই আমাদের।

আমি জানি খুব বেশি দিন আর অপেক্ষা করতে হবে না আমাদের। পৃথিবীর দিকেই যাত্রা করেছে তারা।

[The Sentinel রচয়িতা Arthur C. Clarke-এর কাছে ঋণী রইলাম।
 প্রথম প্রকাশ: আশ্চর্য!, জুলাই ১৯৬৯]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *