ভর

ভর

০১.

অনেকেই আমাকে জিগ্যেস করে আমি কি সত্যিই বিশ্বাস করি ভূত বলে কিছু আছে?

এ প্রশ্ন শুধু আজকের নয়, বহুকাল আগের। আর সত্যি কথা বলতে কি এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর কেউ দিতে পারেনি। পারবেও না।

ইদানিং ক্লাস টেন-এ পড়া আমার এক প্রতিবেশীর ছেলে বুল্টু আমার ভূতের গল্পের পাঠক ও শ্রোতা হয়ে উঠেছে। তার মনেও অজস্র প্রশ্ন। জিগ্যেস করে, আমি যতগুলি ভূতের গল্প লিখেছি তা কি সবই সত্যি?

কঠিন প্রশ্ন।

তবু উত্তর দিতে হয়। বলিনা, কোনো গল্পই পুরোপুরি সত্য হয় না। সত্যি-মিথ্যে মিলিয়েই গল্প।

বুল্টু জিগ্যেস করে, সত্যি বলো তো কখনও ভূত দেখেছ?

ঢোঁক গিলে বলি, না, তা দেখিনি। তবে

তবে কি? বুল্টু কৌতূহলে ঝুঁকে পড়ে।

বললাম, তবে কিছু অনুভব করি।

সে আবার কী?

 বললাম, সে এখন তোরা বুঝবি না। বড় হ তখন বুঝবি।

খুব বুঝব। তুমি বলো না।

মুশকিল! এ তো পরীক্ষার পড়া বোঝানো নয়, এ হচ্ছে অনুভূতির ব্যাপার। কতবার যে ঘটেছে আমার জীবনে! এই যেমন–এক একটা এমন নির্জন জায়গা আছে সেখানে একা গেলেই মনে হয় আমি আর একা নই, আরও কেউ যেন আছে। তাকে দেখতে পাই না, কিন্তু শব্দ শুনতে পাই। পিছনে শুকনো পাতা মাড়িয়ে কেউ যেন আসছে।

শুধু নির্জন জায়গাতেই নয়, নিজের বাড়িতেও অন্ধকার ঘরে আমি হয়তো উঠে দেশলাইটা আনতে যাচ্ছি, স্পষ্ট টের পেলাম কেউ যেন আমার গা ঘেঁষে সাঁৎ করে সরে গেল। না, পুরো মানুষ নয়, মানুষের একটা ছায়া।

বুল্টু হঠাৎ আমাকে আঁকড়ে ধরল।

কী হল?

ও বলল, ঐ দ্যাখো আলোর জোর কীরকম কমে যাচ্ছে। এখুনি লোডশেডিং হবে। বলে আঙুল তুলে বালা দেখিয়ে দিল।

কী হয়েছে?

দ্যাখো না।

দেখলাম আলোটা আস্তে আস্তে নিভে আসছে। কথা বলতে বলতেই গোটা বাড়ি অন্ধকার হয়ে গেল।

বুল্টু আরও কাছে এসে ভয়ে ভয়ে বলল, কী করে বাড়ি যাব?

পিঠে হাত রেখে বললাম, ভয় পাবার কিছু নেই। একটু পরে যাস।

ও কোনোরকমে বলল, বড্ড অন্ধকার!

 বললাম, লোডশেডিং। অন্ধকার হবে না?

বুল্টু বলল, লোডশেডিং না ছাই! ঐ দ্যাখো সব বাড়িতেই আলো জ্বলছে। শুধু এই বাড়িতেই

তাকিয়ে দেখি, তাই তো। সব বাড়িতে আলো জ্বলছে। শুধু আমাদের বাড়িতেই

অবশ্য এটা কিছু নতুন নয়। এমনটা আজকাল প্রায়ই ঘটছে। সন্ধের পর থেকে শুতে যাবার আগে পর্যন্ত হঠাৎ-হঠাৎ আলো নিভে যায়। অথচ লোডশেডিং নয়। কেননা অন্য সব বাড়িতে তখন দিব্যি আলো জ্বলে।

বারে বারে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডেকেছি। তারা এসে যা হোক ব্যবস্থা করেছে কিন্তু লাইন আর ঠিক হয় না। শেষে ইলেকট্রিক মিস্ত্রি যখন বলল, গোটা বাড়িটায় নতুন করে ওয়্যারিং করতে হবে তখন আমি পিছিয়ে এলাম। কারণ অত টাকা খরচ করার সামর্থ্য আমার নেই।

তা ছাড়া ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম, লাইনই যদি খারাপ হবে তাহলে সারাদিন কারেন্ট থাকে কী করে? আর রাত্তিরে আলো নিভে যায় কিছুক্ষণের জন্য। আলো নেভে, কিন্তু পাখা চলে। এ তো বড়ো তাজ্জব ব্যাপার! কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? তবে কেউ না জানুক আমি বিশ্বাস করি, এ সবই ভৌতিক কাণ্ড। কিন্তু এ কথা কাউকে বলা যাবে না।

বাড়িটা আমার দাদামশাইয়ের। দাদুর ছেলে ছিল না। আমার মা তার একমাত্র মেয়ে, আমি একমাত্র নাতি। দাদু মারা যাবার কিছুকাল আগে মাকে আর আমাকে কাছে এনে রাখলেন। আর আমাকেই উত্তরাধিকারী করে গেলেন।

অনেকখানি ফাঁকা জায়গার ওপর বাড়িটা। আমাদের ছোটো সংসারের পক্ষে যথেষ্ট। অনেকখানি কম্পাউন্ড। মধ্যে ফুলের বাগান। পিছনে কলা বাগান, নারকেল বাগান। বেশ শান্ত পরিবেশ। তবে বাড়ির উত্তর দিকে একটা পরিত্যক্ত মাঠ। সেখানে কোনো ছেলে খেলা করে না। এমনকি গরু-ছাগলও চরে না। ঘাসই হয় না তো গরু চরতে যাবে কোন দুঃখে? আসলে ওটা একটা পুরনো পরিত্যক্ত কবরখানা। ঐ মাঠ দিয়ে চলাফেরা করা বারণ ছিল। কিন্তু ছেলে-ছোকরারা শুনত না। শর্টকাট করতে মাঠের ওপর দিয়ে হাঁটত। মাঝে মাঝে অসাবধানে জলে-ধসে যাওয়া কবরের গর্তে পা ঢুকে যেত। গাটা কেমন করে উঠত। বাড়িতে বলা যেত না। বললেই স্নান করতে হবে। শীত করলেও রেহাই নেই।

দাদামশাই ছিলেন একটু অন্য প্রকৃতির মানুষ। সে বিষয়ে বলার আগে বাড়িটার কথা বলে নিই।

বাড়িটার একতলায় তিনটি ঘর। যে ঘরটিতে দাদু থাকতেন সে ঘরটায় অন্য কেউ আসা যাওয়া করে দাদুর তা পছন্দ ছিল না। কেউ ওখানে ঘোরাঘুরি করলেই দাদু হাঁকতেন–

কী চাই?

না, কিছু না। এমনিই।

যাও! পালাও।

দাদু একটু রাগী মানুষ ছিলেন। আমরা তাই দাদুর ঘরের ত্রিসীমানায় যেতাম না। ভাবতাম কী এমন ও ঘরে আছে যে দাদু কাউকে ও ঘরে ঢুকতে দিতে চাইতেন না!

মাকে জিগ্যেস করলে মা বলত, কী দরকার দাদুর ঘরের কথা ভেবে? আমাদের থাকতে দিয়েছে এতেই আমরা খুশি।

এক-একদিন সকালবেলায় দাদু বেরিয়ে যেতেন। ফিরতেন অনেক রাতে।

.

কিছু বললে জ্যেঠু?

কই না তো!

মনে মনে বিড়বিড় করছিলে যে।

তখনই আমার মাথায় দুর্বুদ্ধি চাপল। নিরীহ ছেলেটাকে ভয় দেখাবার জন্য গলার স্বর বিকৃত করে বললাম, আলো নিভল কেন? ভৌতিক ব্যাপার নয় তো!

সামান্য কথা। কিন্তু বুল্টু আঁৎকে উঠল। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি বাড়ি যাব।

 যাবে তো নিশ্চয়। আলোটা জ্বলুক।

বুল্টু মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না আমি এখুনি যাব। বলেই উঠে পড়ল।

বললাম, দাঁড়াও। একা যেও না। বলে ডাকলাম, শংকর–দু-তিনবার ডাকাডাকির পর শংকর এলো। বললাম, একে বাড়ি দিয়ে এসো। আমার টর্চটা নিয়ে যাও। বলে টর্চটা দিলাম।

শংকর বুল্টুকে নিয়ে নেমে গেল।

ও চলে গেলে ভাবলাম ভয় না দেখালেই হত। ছেলেমানুষ। কিন্তু হঠাৎ ভূতের কথাটা মুখে এসে গেল কেন? আলো নিভে যাওয়া নতুন কিছু নয়। ইদানিং প্রায় প্রতিদিনই তো…। বেশ কিছুক্ষণ ঐ একটা কথাই মনের ভেতর ঘোরাফেরা করতে লাগল–হঠাৎ ভূতের কথা মনে এল কেন?

এমনি সময়ে নীচ থেকে বুল্টুর ডাক শুনতে পেলাম–জ্যেঠু।

চমকে উঠলাম। কী হল বুল্টুর?

যাই। বলে মুহূর্তমাত্র দাঁড়িয়ে না থেকে অন্ধকার ঘরের মধ্যে দিয়ে ছুটে বারান্দায়। তারপর দেওয়াল ধরে ধরে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে একেবারে রাস্তার দরজায়।

অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। আন্দাজেই বুল্টুকে ডাকলাম, তুই কোথায়? টর্চটা জ্বালা।

টর্চ তো জ্বালা হলই না। বুল্টুর কাছ থেকে সাড়াও পাওয়া গেল না। শংকরই বা গেল কোথায়? ডাকলাম, শংকর

সাড়া পাওয়া গেল না। ফের ডাকলাম–শংকর

এবার যেন অনেক দূর থেকে সাড়া পেলাম।

এই যে আমি এখানে।

 কোথায়?

এবার আর সাড়া পাওয়া গেল না। আমি দরজার দিকে যাবার জন্য কানামাছি খেলার মতো নিজেরই বাড়িতে ঘুরপাক খেতে লাগলাম। পথ আর খুঁজে পাই না।

কতক্ষণ এইভাবে ঘুরেছি জানি না। হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল। চোখ কচলে তাকালাম। এ কী! সিমেন্ট বাঁধানো উঠোন থেকে কখন নেমে এসে দাঁড়িয়েছি পাতকুয়োর কাছে। আমার কি মাথার গণ্ডগোল হয়ে গেল নাকি? ডাকলাম, শংকর

শংকর বোধহয় কাছেই কোথাও ছিল। সাড়া দিল–বলুন। তারপর আমার দিকে চোখ পড়তেই বলে উঠল, একী! আপনি কুয়োতলায় কী করছেন?

আমি সলজ্জভাবে উত্তর দিলাম, কী জানি বুঝতে পারছি না। বুল্টুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিস তো?

কখন! এতক্ষণে খেতে বসে গেছে।

এরই মধ্যে খেতে বসেছে!

শংকর বলল, এরই মধ্যে বলছেন কেন? এখন কটা বাজে জানেন?

 জানি না। জানতে চাই না। বুঝতে পারি আমার মাথার মধ্যে কিছু গোলমাল হয়েছে।

দাঁড়াতে পারছিলাম না। পা দুটো কাঁপছিল। আস্তে আস্তে ওপরে উঠে এলাম।

ওপরে এসে অনেকক্ষণ খাটে বসে রইলাম। শরীরটা কেমন দুর্বল লাগছে। মনে হল যেন অনেক দূর থেকে হেঁটে আসছি।…আশ্চর্য! এমন তো কোনোদিন হয়নি। আমি খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে চোখ বুজে রইলাম। গোড়া থেকে সব ব্যাপারটা ভাবতে শুরু করলাম। এমন অদ্ভুত ব্যাপার কেন ঘটল?

বুল্টুকে হঠাৎ আজই ভয় দেখাতে ইচ্ছা করল কেন? এটা হচ্ছে প্রথম প্রশ্ন। দ্বিতীয় প্রশ্ন : বুল্টুকে শংকরের হেপাজতে দেবার পর থেকে আমি একা নীচে কী করছিলাম? কেনই বা সিমেন্ট বাঁধানো উঁচু রক থেকে কুয়োতলার ভিজে মাটিতে নেমে গেলাম–যেখানে বড় একটা নামার দরকার হয় না। কুয়ো থেকে জল তোলার দরকার হলে রক থেকেই কপিকলের সাহায্যে তোলার ব্যবস্থা আছে। তা ছাড়া আমিই বা জল তুলতে যাব কেন? দরকার মতো শংকরই জল তুলে দেয়।

আরও একটা ভাবনা আমায় চিন্তায় ফেলেছিল, বুল্টুকে বাড়ি পৌঁছে দেবার জন্যে শংকর যখন নীচে নেমে গেল, আমিও প্রায় তখনি নীচে নেমেছিলাম। গিয়ে দেখি শংকর অনেক আগেই বুল্টুকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছে।

বেশ। মানলাম শংকর ঠিকই বলছে। কিন্তু শংকরকে যখন আমি জিগ্যেস করলাম বুল্টুকে পৌঁছে দিয়েছে কিনা তখন শংকর বললে–অনেকক্ষণ। এতক্ষণে বোধহয় বুল্টু রাতের খাবার খাচ্ছে।

তাই যদি হয় তা হলে এতক্ষণ আমি কী করছিলাম? কোথায় ছিলাম?

কোনো প্রশ্নেরই উত্তর পেলাম না। দূর ছাই! আর ভাবতে পারি না বলে আলিস্যি ভেঙে উঠে বসলাম। কটা বেজেছে দেখবার জন্যে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে গেলাম। পাঁচটা বেজে দশ মিনিট! ঘড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। আশ্চর্য! আমার ঘড়িটা তো কখনও এমন আলটপকা বন্ধ হয় না। তাহলে কি দম দেওয়া হয়নি? দম দিতে ভুলে গেছি?

না, এমন ভুল আমার হয় না। বেশ মনে পড়ছে নিয়মমতো আজও ব্রেকফাস্ট সেরেই দম দিয়েছি। ঘড়িতে দম দেওয়ার পর শুরু হয় প্রতিদিনের কাজকর্ম। আজও তার যে ব্যতিক্রম হয়নি তার প্রমাণ রয়েছে ঐ যে টুলটা। পাশের ঘর থেকে টুলটা টেনে নিয়ে এসে তার উপর দাঁড়িয়ে আমি পুরোনো দেওয়াল ঘড়িটায় দম দিই।

সবই তো দেখছি ঠিকঠাক হয়েছে। তবু কেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে?

এর কারণ কী?

উত্তর একটাই–জানি না।

একা বসে এই সব ভাবছি, হঠাৎ একটু বেশি মাত্রায় সচেতন হয়ে উঠলাম। সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ! কেউ যেন খালি পায়ে নীচ থেকে ওপরে উঠে আসছে। শব্দটা ২ স্পষ্ট হতে লাগল ততই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যেতে লাগল। কে আসছে? কোথা থেকে আসছে? কেন আসছে? এখন তাহলে আমি কী করব?

দরজাটা ভেজানো ছিল। মনে হল এই মুহূর্তে আমার কর্তব্য হচ্ছে দরজার খিল দিয়ে দেওয়া।

তাড়াতাড়ি উঠে দরজার কাছে গেলাম। চেপে বন্ধ করতে যাচ্ছি, দেখলাম হাঁটু পর্যন্ত তোলা ধুতি পরা একটা পা চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। ভয়ে আমি চিৎকার করতে যাচ্ছি, এবার গোটা মানুষটাকে দেখতে পেলাম। খাবার থালা হাতে শংকর অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দরজা বন্ধ করছেন কেন? খাবেন না?

ও! হ্যাঁ!

নিজের এই দুর্বলতায় খুব লজ্জা পেলাম। সরে এলাম। শংকর টেবিলের ওপর আমার রাতের খাবার রেখে চলে গেল।

.

০২.

জায়গাটার নাম পোড়া মাঠ। লোকবসতি কম। মেন রাস্তা থেকে দক্ষিণে নেমে এলেই দেখা যাবে অনেকখানি জায়গা জুড়ে শুধু মাঠ আর মাঠ। এত জায়গা থাকতে কেন যে দাদামশাই এখানে এই বাড়িটা কিনেছিলেন তা আজ আর জানার উপায় নেই। দাদামশাই মানুষটি খুব খেয়ালি স্বভাবের ছিলেন। টাকাপয়সাও ছিল ভালো রকম। শুনেছি তিনি উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে থাকতে ভালোবাসতেন, তাই হয়তো এই জায়গাটাকে পছন্দ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন পাকাপাকিভাবে বাস করার জন্যে বাড়িটা নেননি। মাঝে মাঝে কলকাতা থেকে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে এসে হৈ-হুঁল্লোড় করতেন। বাড়ির নাম দিয়েছিলেন বিলাস-নিকেতন। থাকতেন মধ্য কলকাতার একটা ভাড়াবাড়িতে। কলকাতাতেই চাকরি। তবে উনি নাকি চাইতেন ছুটি-ছাটায় এখানে এসে থাকতে। পাকাপাকিভাবে থাকার অভিপ্রায় কোনোদিনই ছিল না।

এই যে একসঙ্গে এত বড়ো মাঠ এরকম খুব একটা দেখা যায় না। অবশ্য এখন আর টানা মাঠ নেই। বন্যায়, ঝড়ে, বৃষ্টিতে কিংবা ভূমিকম্পে বিশাল মাঠটা যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে গেছে। আরও অদ্ভুত ব্যাপার মাঠে কোথাও শুধু বালি, কোথাও পাহাড়ি জায়গার মতো শুধু পাথর। আর এখানে-ওখানে বাবলার ঝোপ।

এসব ছিল দাদামশাই যখন এখানে বাড়ি কিনেছিলেন তখন। আমরা যখন এখানে আসি তখন অনেক কিছুরই পরিবর্তন হয়েছে। অনেকখানি মাঠ জুড়ে লোকবসতি গড়ে উঠেছে। ছেলেদের খেলবার মাঠ তৈরি হয়েছে। মাঝে মাঝে সার্কাসপার্টি এসে তাঁবু ফেলে। লাইট, ফোন সবই এখন হয়েছে এখানে।

দাদামশাই যে কেন এখানে মাঝে মাঝে আসতেন তার কারণ জানতে পেরেছিলাম তার মৃত্যুর পর তাঁর কাঠের বাক্স থেকে পাওয়া একটা খাতা বা ডায়েরি থেকে। আসলে তিনি ছিলেন এক ধরনের গবেষক। পুরোনো পরিত্যক্ত কোনো জায়গা দেখলেই সেখানকার ইতিহাসের খোঁজ করতে শুরু করেন। এইভাবেই তিনি পোড়ো মাঠের হারিয়ে যাওয়া কাহিনি খুঁজে বের করেন। কিন্তু কাউকে বলেননি। লিখে রেখে গিয়েছিলেন। মলাটে লাল কালিতে লিখে রেখেছিলেন অতি ভয়ঙ্কর।

কী ভয়ঙ্কর লেখেননি। কিন্তু আমি আমার জীবন দিয়ে তা অনুভব করেছি। এবার সেই কথাই বলি।

মাঠের পূর্বদিকটার জমিদার ছিলেন জয় পাল। আর পশ্চিমদিকের মালিক ছিলেন দশরথ মণ্ডল। ঝগড়া হত আবার মিটেও যেত। দুপক্ষের মধ্যে যত মারামারিই হোক নববর্ষের দিন দুপক্ষই সাদা নিশান উড়িয়ে জানিয়ে দিত এবার সন্ধি। সেদিন একপক্ষ থেকে আর একপক্ষের কাছে যেত আঁকা ঝকা ফল, টিন টিন মিষ্টি। জমিদারের জন্যে পাঠানো হত ফাইন ধুতি, মলমলের পাঞ্জাবি আর পাগড়ি। এমনি পাগড়ি কেউ পরত না, কিন্তু উপহারের পাগড়ি মাথায় একবার দিতেই হত দুই জমিদারকে। ঐ একদিনই পাগড়ি পরা হত। বাকি সময় পাগড়ি তোলা থাকত আলমারির মাথায়।

একদিন ঘটল একটা ঘটনা! এমন ঘটনা, যে তা একরকম ইতিহাস হয়ে উঠল।

জয় পালের ছিল একটি পরমাসুন্দরী কন্যা। নাম আত্রেয়ী। বারো বছর বয়েস। ওই অল্পবয়েসেই নানা জায়গা থেকে বিয়ের ভালো ভালো সম্বন্ধ আসতে লাগল। কিন্তু আত্রেয়ীর বাবা-মা এত অল্প বয়েসে বিয়ে দিতে রাজি নন। আত্রেয়ীও বিয়ের কথা ভাবে না। তার ভালো লাগে একা একা ঘুরে বেড়াতে। দেখতে ইচ্ছে করে দুপা দূরে দশরথ মণ্ডলের রাজ্যপাট। ঐ তো দেখা যাচ্ছে পশ্চিম প্রান্তের সার সার তালগাছ। গাছগুলো যেন সীমান্তের প্রহরী। দুই জমিদারেরই কড়া হুকুম ছিল কেউ যেন অনুমতি ছাড়া ভিন রাজ্যে না ঢোকে। এই আদেশ অমান্য করলেই কয়েদ করে রাখা হবে। ফলে কোনো পক্ষেরই মানুষ সীমান্তের ধারে-কাছে যেত না।

আত্রেয়ীর এই আদেশের কথা জানত, কিন্তু ও নিয়ে মাথা ঘামাত না। সীমান্তের ওপারে যাবার কথা তার বন্ধুদের কাছে বললে তারা আঁৎকে উঠে সাবধান করে দিত, তোর বাবার আদেশের কথা জানিস না?

আত্রেয়ী বলত, জানি। কিন্তু আমি তো গুপ্তচর নই। কাজেই কোনো পক্ষেরই ভয় পাবার কিছু নেই। বরং দুপক্ষেরই লাভ। ভোলা মনে মিশতে পারলে পরস্পরের মধ্যে ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় হয়।

আত্রেয়ী ভালো লাগত গভীর রাতে চুপি চুপি বেরোতে। চারিদিক নিঝুম নিস্তব্ধ। কেউ দেখছে না। আত্রেয়ী মনের আনন্দে চলে যেত সীমানা পেরিয়ে দশরথ মণ্ডলের এলাকায়। আবার ভোর রাতে ফিরে আসত। এ যেন একরকম অ্যাডভেঞ্চার। খুব ভালো লাগত। সারা রাত ঘুরত যেন স্বপ্নের ঘোরে। তারপর সারা দুপুর ঘুমোত। এইভাবে দিন কাটছিল।

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে সে সময়ে এই অঞ্চলের মানুষের দুটি ব্যাপারে ভয় ছিল। এক–বিষধর সাপ, দুই-ভূত। সাবধানে চলাফেরা করলে সাপকে তবু এড়ানো যায়। কিন্তু ভূত খুবই ভয়ংকর। তখন ভূতের আড্ডা নাকি ছিল গোটা পোড়া মাঠ জুড়ে। তবে সহজে তারা দেখা দিত না। বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশেষ বিশেষ ভাবে তাদের অস্তিত্ব টের পাওয়া যেত। কখনও কখনও দেখা যেত গভীর রাতে ঐ পোড়া মাঠে একটা ছায়া ছায়া মূর্তি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আবার কখনও গভীর রাতে হঠাৎ হঠাৎ ঝড় উঠত। তারপর দেখা যেত জলস্তম্ভের মতো বালির স্তম্ভ। প্রায় আকাশ-ছোঁওয়া। পরক্ষণেই বিকট শব্দ করে আছড়ে পড়ত মাঠের ওপর। এসবই যে ভৌতিক ব্যাপার তা সবাই জানত। তাই দরজা-জানলা বন্ধ করে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকত মশারির মধ্যে। আবার কখনও গভীর রাতে হয়তো দেখা গেল বিকট একটা মূর্তি লম্বা লোমশ দুটো হাত দোলাতে দোলাতে মাঠের মধ্যে এদিক ওদিক ঘুরছে। যে কজন দেখেছে তারা কেউই আর সুস্থ স্বাভাবিক নেই।

আত্রেয়ী নিশ্চয়ই একথা জানত। তবু সে বেরোত রাতের বেলা। প্রায় রাত্তিরেই তার মনে হত মাঠের অন্য প্রান্ত থেকে কারা যেন তাকে ডাকে। সে ডাকে সাড়া না দিয়ে পারত না আত্রেয়ী। কিন্তু একদিন সে আর ফিরল না। কোথায় যেন হারিয়ে গেল। যে রাতে সে হারিয়ে গেল সে রাতে না কি ঐ অঞ্চলের সব বাড়িতে আলো নিভে গিয়েছিল।

এসব অনেক দিন আগের কথা। ক্রমে এ অঞ্চলের মানুষ ভুলে গেল জয় পাল আর দশরথ মণ্ডলের কথা। কিন্তু জমিদারকন্যা আত্রেয়ীর কথা আজও মুখে মুখে ফেরে। কী হল মেয়েটার? বাড়ির কাছে অতি পরিচিত মাঠ থেকে উধাও হয়ে গেল কেমন করে?

শোনা যায় জমিদার জয় পাল মেয়ের খোঁজে দেশে দেশে লোক পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সন্ধান পাননি।

শেষে এক গুণিন এসে ছক কেটে হিসেব করে জানিয়ে গেল ঐ পোড়া মাঠ বড়ো অভিশপ্ত। অশরীরী আত্মার কোপ আছে। সাবধান।

অনেকদিন তো আছি এ বাড়িতে, কিন্তু এত সব কথা আমি কিছুই জানতাম না, জেনেছি এই সবে–দাদমশায়ের সেই খাতাখানি পড়ার পর থেকে। আর তারপরেই যে কীসব ঘটে চলেছে চারদিকে! চারদিকে নাকি আমার মনের মধ্যেই? কী জানি, সেটাও তো ভালো বুঝতে পারি না ছাই।

তবে এটাও কিন্তু ঠিক, লোকজনও বেশ সাবধান হয়ে গিয়েছে এখন। অবশ্য সাবধান আর কী হবে? দু অঞ্চলের মানুষজন খুব দরকার না হলে কেউ আর ঐ মাঠে পা দিত না। সূর্য ডোবার পর তো নয়ই।

.

০৩.

হঠাৎ চমক ভাঙল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সাড়ে বারোটা।

কী সর্বনাশ! এত রাত পর্যন্ত জেগে কী করছিলাম?

ক্রমে ক্রমে মনে পড়তে লাগল সব কথাই। ঐ তো টেবিলের ওপর আমার রাতের খাবারের থালাটা পড়ে রয়েছে। শংকর রেখে গিয়েছিল। মুখে দেওয়া হয়নি। আমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?

না। আসলে নানা কথা ভাবতে ভাবতে অনেক দূর পিছিয়ে গিয়েছিলাম।

এবার থালাটা টেনে নিলাম। খাওয়ার ইচ্ছে নেই। খেতে পারলাম না। রুটিগুলো শুকিয়ে চামড়ার মতো হয়ে গেছে।

থালা নামিয়ে রেখে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এল না। কেবলই মনে হতে লাগল আজও হঠাৎ কেন সন্ধ্যেবেলায় আলো নিভল! আর আলো নেভা মাত্রই ব্যাপারটা ভূতুড়ে কাণ্ড বলে মনে হল? কেনই বা সন্ধ্যেবেলা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত একটা ঘোরের মধ্যে রইলাম! কেনই বা এতকাল বাদে পোড়া মাঠ-এর কাহিনিটা মনের মধ্যে জেগে উঠল! আর আত্রেয়ী নামে সেই হতভাগিনী মেয়েটি–যার কথা আজ অনেকেই ভুলে গেছে, তার কথা মনে পড়ল? আমার অস্বস্তি আরও বাড়ছিল সেই ছায়ামূর্তির কথা মনে পড়ায়, যে নাকি গভীর রাতে লম্বা লম্বা পা ফেলে দুহাত দোলাতে দোলাতে পোড়া মাঠের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে আসত। এগিয়ে আসত এই দিকে, মানে–দাদামশাইয়ের বাড়ির দিকে–যে বাড়িতে এখন একা আমি থাকি।

এত দিক থাকতে কেন যে সে এই বাড়িটার দিকেই আসত তা আমি বুঝতে পারি না। যেমন বুঝতে পারি না কত দিনে মাঠ থেকে উঠে এসে সে পৌঁছবে এখানে। তারপর কী করবে তাও অজানা। তবে এটুকু জানি তাকে ঠেকাবার শক্তি আমার নেই। সে কি তাহলে আজই এসে পৌঁছেছে? সন্ধ্যেবেলায় আলো নিভিয়ে দিয়ে কি সে-ই ঢুকেছে এ বাড়িতে?

কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। তাকাতেই দেখলাম একটি মেয়ের ছায়া যেন ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

আশ্চর্য! কে এই মেয়ে? ঘরে ঢুকল কী করে? দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ।

 চমকে উঠে বসলাম। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ভাঙা গলায় বললাম, কে তুমি?

 উত্তর দিল না। পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রইল।

 এবার চেঁচিয়ে বললাম, উত্তর দিচ্ছ না কেন? কে তুমি?

মেয়েটি এবারও উত্তর দিল না। শুধু ধীরে ধীরে ঘাড় ফেরাল।

উঃ কী ভয়ংকর! মাথার সামনের দিকটা জুড়ে বীভৎস একটা গর্ত। যেন হিংস্র কোনো জন্তু ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার মুখের ওপর। মাথা ঘোেরাবার সঙ্গে সঙ্গে একগাদা বালি পড়ল মাথা থেকে। এত বালি এল কোথা থেকে?

এমন সময়ে ভোরের পাখি ডেকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বীভৎস মূর্তিটা যেন সচেতন হল। আমার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে হঠাৎ তার কংকালসার একটা হাত তুলে সামনের মেঝেটা দেখিয়ে দিয়ে কিছু যেন বোঝাতে চাইল। তারপরেই বাতাসের একটা ঝাঁপটা তুলে বেরিয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, ও এখন এখানেই থাকে।

আমি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে রইলাম।

এই কি সেই বহুযুগ আগে পোড়া মাঠে হারিয়ে যাওয়া আত্রেয়ী? ওর মাথা থেকে বালি ঝরে পড়ল কেন? তবে কি সে বালির মধ্যে তলিয়ে গিয়েছিল? তাই যদি হয় তবে এ কথা আজ কাকে বলব?

এই এতক্ষণ ধরে আজ রাতে যা ঘটল তা যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে দাদামশাই-এর এই বাড়ি তৈরি হয়েছিল পোড়া মাঠ-এর সেই জায়গায় যেখানে আত্রেয়ী চোরাবালিতে ডুবে গিয়েছিল।

এতদিন এখানে আছি একদিনের জন্যেও ভয় পাইনি। কিন্তু এখন সর্বত্র এক অশরীরীর অস্তিত্ব অনুভব করছি। দিনের বেলাটা একরকম কাটে। কিন্তু সন্ধে হলেই হয়ে যাই অন্যরকম। তখন একবার মনে হয় এই সময়ে ঘরে থাকা ঠিক নয়। হয়তো অঘটন কিছু ঘটবে। ছটফট করে ঘরের বাইরে চলে আসি। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় এই ভরসন্ধ্যায় বাইরে থাকা ঠিক নয়। বরঞ্চ ঘরটাই নিরাপদ। আর তখনই আবার ঘরের দিকে পা বাড়াই। এ এক অদ্ভুত অবস্থা মনের। মনটা যেন আমার নয়, অন্য কেউ তার লাগাম ধরে আছে। মনের এই অদ্ভুত অবস্থা এমনি-এমনি হয়নি। বিপদ ঘটবার চান্স ছিল। হ্যাঁ ছিল। যেমন–

সে দিন বিকেলে শংকর গুটিগুটি এসে দাঁড়াল। ওকে এই অবস্থায় এসে দাঁড়াতে দেখলেই বুঝতে পারি কোনো মতলব আছে। বললাম, কী রে? কিছু বলবি?

ও সসংকোচে বলল, আমার কাকার ছেলে এসেছে। দেখা করে আসব?

 জিগ্যেস করলাম, কোথায়?

শংকর বলল, টাউনে।

মনে মনে ভাবলাম, ও বাবা! সে তো অনেক দূর। মুখে বললাম, তাড়াতাড়ি ফিরবি তো?

শংকর ভালো করেই জানে ওকে না হলে আমার একবেলাও চলে না। তাই বিনয়ে ভেঙে পড়ে বললে, যাব আর আসব।

আশ্বস্ত হয়ে বললাম, তবে যা। ও খুশি হয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, দরজাটায় খিল দিয়ে দিন।

শংকর চলে গেল। যাবার সময়ে আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলল, কেউ ডাকলেও দরজা খুলবেন না। মনে মনে একটু যেন চমকে উঠলাম। শংকর এরকম কথা তো কোনোদিন বলে না, আজ কি তবে আমার কোনো বিপদের আশঙ্কা করছে ও! হেসে বললাম, আর তুই যখন আসবি তখন?

ও বলল, আমি রাস্তা থেকে ডাকব আপনাকে।

 ঠিক আছে। তুই যা।

একটু পরেই সূয্যিদেব তালগাছগুলোর আড়ালে নেমে পড়লেন। মনে হল যেন আকাশ জননী দুহাত বাড়িয়ে শ্রান্ত-ক্লান্ত সন্তানকে কোলে টেনে নিলেন।

এটা কিছু নতুন ব্যাপার নয়। শংকরের ওপর আমার নির্ভর করে থাকতে হয় ঠিকই, তা বলে ও আমাকে একা রেখে কখনও কোথাও যায় না, এমনও তো নয়। কাছেই একটা পুরোনো কালীবাড়ি আছে। সন্ধেবেলা কাঁসর-ঘণ্টা বাজিয়ে আরতি হয়। শংকর প্রায় দিনই আরতি দেখতে যায়। আরতি শেষ হলে ফিরে আসে। এই সময় আমাকে প্রায় আধঘণ্টা একা থাকতে হয়। তা নিয়ে কোনোদিন কিছু ভাবিনি। কিন্তু এই কিছুদিন আমার যে কী হয়েছে একা থাকলেই ভয় করে। কিসের ভয় তা বুঝতে পারি না।

এই যেমন আজ সন্ধেবেলা ঘরে চুপচাপ বসে আছি। শংকর ফিরলেই একটু ঘুরে আসব বলে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে রেডি হচ্ছি, এমন সময় খিড়কির দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল।

আমার কাছে বড়ো একটা কেউ আসে না। বিশেষ করে সন্ধেবেলা। তাই অবাক হলাম। কিন্তু তখনই সাড়া দিলাম না। মিনিট কয়েক পরেই আবার শব্দ। এবার যেন কেউ অধৈর্য হয়ে কড়া নাড়ছে।

যাচ্ছি। বলে উঠে পড়লাম।

আর তখনই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলাম। যে কড়া নাড়ছিল সে যেন নিজেই উঠে আসছে।

বিরক্ত হলাম। বলা নেই কওয়া নেই একেবারে উপরে উঠে আসছে।

আমি ঘরের মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এরই মধ্যে ভেবে নিলাম যদি তেমন কেউ হয় তা হলে তো এক কাপ চাও খাওয়াতে পারব না। কারণ ওসব দায়িত্ব শংকরের।

তা হলে–এমনিভাবে মিনিট পাঁচেক সময় গেল।

আচ্ছা, কোন ঘরে বসাব?

সে না হয় দেখা যাবে। আগে তো আসুক। কিন্তু জুতোর শব্দে আর পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হল যে আসছিল সে যেন হঠাৎ থেমে গেছে। আমার কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। দেখতে চাইছে আমি গিয়ে রিসিভ করি কি না।

ততক্ষণে চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে। আমি সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিছু একটা হয়েছে মনে হচ্ছে।

কী হল ব্যাপারটা?

বাইরের দরজায় কেউ কড়া নেড়েছিল একটু আগে। একবার নয়, দু-দুবার। কিন্তু সে উপরে উঠে এল কী করে? শংকর বেরিয়ে যাবার পর আমি তো নিজের হাতে ভেতর থেকে খিল নিয়ে এসেছি।

তা হলে?

আমার মাথাটা টলে গেল। দেওয়াল ধরে কোনোরকমে সামলে নিলাম। মনে হল এখনই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়া দরকার। ভাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘরে চলে এলাম। তারপর বিছানা থেকে বালিশটা টেনে নিয়ে তার মধ্যে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম। আমি নিশ্চিত, যে বেশিক্ষণ চোখ বুজে ছিলাম না। একটু পরেই শংকরের হাঁকডাক শুনে উঠে বসলাম। যাক, শংকর এসে গেছে।

কখন এলি?

 এই তো আসছি। বলে আলোটা জ্বেলে দিল সে।

 কোথাও বেরোচ্ছিলেন নাকি?

 বেরোচ্ছিলাম। আমি! কই না তো?

 ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছেন।

মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগে আমি বেরোব বলে তৈরি হয়েছিলাম। তারপর

আচ্ছা, আপনাকে আমি বার বার করে বলে গেলাম বাইরের দরজায় খিল দিতে ভুলবেন না। তবু ভুলে গেলেন। কোন দিন বিপদ ঘটবে দেখবেন।

অবাক হয়ে বললাম, কে বলল আমি দরজা বন্ধ করিনি?

বলবে আবার কে? আমিই তো প্রমাণ। দিব্যি গড় গড় করে ওপরে উঠে এলাম।

তাই তো। আমি হতভম্বের মতো শংকরের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

একটু আগেও সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শুনেছি। ঐ কথাটাই ভাবছিলাম। বাইরের দরজা আমি তো নিজের হাতে বন্ধ করে এসেছি। তাহলে?

রাতে কী খাবেন? ভাত না রুটি?

আমার এখন অন্য চিন্তা–খিল খুলল কে? সিঁড়িতে কার পায়ের শব্দ শুনেছিলাম? কে সে? ওপরে উঠে এল না কেন?

বললাম–যা হোক কর গে।

শংকর চলে গেল। কিন্তু তখনই হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, যা ভেবেছিলাম তাই।

কী?

কেউ একজন কখন বাড়িতে ঢুকে পড়ে সিঁড়িতে লুকিয়ে আছে।

সে কী!

 মনে হল চোর।

চোর! আমি চমকে উঠে বসলাম।

হতে পারে বটে, নীচে নেমেছিলাম একবার। হঠাৎ দেখি সিঁড়িতে কী যেন নড়ছে। ছাগল কুকুর নয়। একটা আস্ত মানুষই। গুঁড়ি মেরে বসেছিল অন্ধকারে। আমার সাড়া পেয়েই কুঁজো হয়ে লাফাতে লাফাতে বাইরের দরজার দিকে চলে গেল। কথাটা শংকরকে বলা চলবে না। ভয় পাবে। তাই বললাম, বলিস কী? চল তো দেখি।

বলতে বলতে টর্চ জ্বেলে নীচে নেমে গেলাম।

 কই রে। কেউ তো নেই।

শংকর মাথা চুলকে বলল, এখন নেই। কিন্তু একটু আগেও ছিল। আমি নিজের চোখে দেখেছি।

তা হলে গেল কোথায়?

তাই তো ভাবছি। বলতে বলতে শংকর এগিয়ে চলল। পেছনে আমি। বাইরের দরজার কাছে গিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠলাম। দেখলাম দরজায় ভেতর থেকে খিল আঁটা।

তার মানে বাইরে থেকে কেউ ঢোকেনি।

শংকর ঢুকেছিল। নিশ্চয়ই তখন দরজা খোলা ছিল। তারপর ঢুকেই ভেতর থেকে খিল লাগিয়ে দিয়েছিল সে।

ইচ্ছে করেই শংকরকে জিগ্যেস করলাম, ঢুকে দরজা বন্ধ করেছিলি তো?

ও মাথা নিচু করে বলল, না। খেয়াল ছিল না।

নাও ঠ্যালা।

সিঁড়িতে জুতো পরে যিনি আসছিলেন–তিনি তো বাড়িতে ঢুকেছেন অনেকক্ষণ আগেই। কী করে ঢুকেছিলেন এর উত্তরও আমার জানা নেই।

.

০৪.

শুধু মনের নয়, বাইরেও পরিবর্তন হতে লাগল। সেটা বুঝতে অবশ্য দেরি হয়েছিল। প্রথম প্রথম বুঝতে পারতাম না। শুধু দেখতাম ইদানিং শংকর হঠাৎ আমার সামনে এসে পড়লে কেমন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার সে সময়ের চোখের ভাষা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও এটুকু বুঝতাম কেমন যেন ভয়-মেশানো অবাক চাউনি।

মাঝে মাঝে আমি বিরক্ত হয়ে ওকে ধমকে উঠতাম, হাঁ করে কী দেখছিস?

শংকর উত্তর দিতে পারত না। কারণ উত্তর দেবার কিছু ছিল না। ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চলে যেত।

.

কয়েকদিন কাটল। তারপর লক্ষ করলাম ও যেন আর আমার সামনে আসতে চায় না। ডাকলে কোনোরকমে দূর থেকে হুঁ-হাঁ করে সাড়া দিয়ে কাছে এসে চোখ নিচু করে দাঁড়াত। যেন আমার মুখ দেখতে চায় না।

কেন এরকম আচরণ? আমার মুখটা কি কদিনের মধ্যে বদলে গেছে? কী বা বদলাতে পারে! ভালো হলে বড়োজোর বোগা মুখটা ভরাট হতে পারে। খারাপ হলে মুখটা আরও শীর্ণ হয়ে যাবে। তার বেশি কিছু নয়। যাক সে কথা ভেবে লাভ নেই। বরঞ্চ একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালেই সঠিক বোঝা যাবে।

এখানেও মুশকিল। একটা ছোটো আয়না আছে বটে কিন্তু তা আমি ব্যবহার করি না। দরকারও হয় না। আয়না ছাড়াই আমার চুল আঁচড়ানো হয়ে যায়। আয়না ছাড়াই দাড়ি কামানো সুসম্পন্ন হয়।

যাই হোক শংকরকে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করতে আর ইচ্ছে করে না। ভাবলাম কাল বুল্টু এলে দেখব ও কী করে।

কিন্তু পরের দিন বুল্টু এল না।

কেন এল না?

নিজেকেই নিজে উত্তর দিই। কেন আবার? রোজ আসা কি কারও পক্ষে সম্ভব?

সাধারণত বুল্টু এলে সঙ্গে দু-তিনটে বন্ধুও আসে। বাড়ির সংলগ্ন বাগানে একটা দোলনা টাঙানো আছে। বুল্টুরা এলে ঐ দোলনায় চড়ে। কোনোদিন ক্যারামবোর্ডটা নিয়ে বসে। আমার ভালো লাগে। এরা না এলে বাড়িটা যেন বড্ড শূন্য লাগে।

পরের দিন দুপুর থেকেই আমি অপেক্ষায় রইলাম কখন বুল্টুরা আসে। এমনভাবে কোনোদিন ওদের জন্য অপেক্ষা করি না। আজ করলাম। তার কারণ মনটা অস্থির হয়ে ছিল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা কিছু বলে কিনা জানার জন্যে। সে দিন ওরা এত দেরি করে এল যে আমি অধৈর্য হয়ে উঠেছিলাম। তাই ওরা আসতেই আমি ধমকে উঠলাম, এত দেরি?

বুল্টু খুবই অবাক হল। কেননা আমি কোনোদিন ওদের আসা-যাওয়া নিয়ে কিছু বলি না। দেখলাম বুল্টু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

ওর অবাক হওয়া দেখে আমি ভয় পেলাম। জিগ্যেস করলাম, কী দেখছিস?

ও মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, কিছু না।

সত্যি করে বল।

বুল্টু থতমত খেয়ে বললে, তোমার ডান দিকের গালে কালো মতো একটা দাগ।

 চমকে উঠলাম-কালো দাগ!

হ্যাঁ। কিছু লেগেছে বোধ হয়।

আমি ভয় পেলাম। আমি তো জানি কিছু লাগার দাগ নয়। ওটা অন্য জিনিস।

দুপুরবেলা টেবিলের ড্রয়ার থেকে আয়নাটা বের করলাম। তারপর জানলার ধারে গিয়ে ভালো করে লক্ষ করলাম।

হ্যাঁ, দাগই। চামড়ার ভেতর থেকে ফুটে উঠেছে। দেখলে মনে হয় কোনো চর্মরোগ। সপ্তাহখানেক পরে লক্ষ করলাম দাগটা অনেকখানি বেড়ে গেছে। থুতনি থেকে চোখের কোণ পর্যন্ত।

কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারি না। নিজের সঙ্গে নানা তর্ক করি। সব যেন গুলিয়ে যায়। যত গুলিয়ে যায় ততই ভয় পাই। কিসের ভয় তা জানি না। শুধু মনে হয় ভয়ংকর কোনো অশুভ ঘটনা ঘটতে চলেছে।

সেদিন বিকেলে বুল্টু এল। যাক, একাই এসেছে। ও এ বাড়ির ছেলের মতোই। ঠিক করলাম ওকে ডেকে নিয়ে জিগ্যেস করব, দাগটা কমেছে না কি এখনও আছে? যদি কমে গিয়ে থাকে তাহলে ভালোই। আর যদি এখনও দাগ থাকে তা হলে কী হবে জানি না। ডাক্তারের কাছেও যেতে ইচ্ছে করে না।

যাই হোক চা খাওয়া শেষ করে অন্য দিনের মতো খুব সহজভাবে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখলাম ও ক্যারামবোর্ডটা নিয়ে একা একা হিট করছে।

কী বুল্টুবাবু, একা যে? আজ তোমার বন্ধুরা কোথায়?

বুল্টু আমার দিকে তাকিয়েই কেমন যেন হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি ক্যারাম ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল।

আশ্চর্য! আমার কথার উত্তর পর্যন্ত দিল না? খুব রাগ হল। কড়া গলায় ডাকলাম– বুল্টু! ডেকেই চমকে উঠলাম। এ কার স্বর? এত কর্কশ! ততক্ষণে বুল্টু নীচে নেমে গেছে। ও সাড়া পর্যন্ত দিল না।

আমি তাড়াতাড়ি শংকরকে ডাকলাম। শংকর ওপরে উঠে এল। কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকাল না। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। জিগ্যেস করলাম, বুল্টু চলে গেল?

হ্যাঁ, গম্ভীর ভাবে উত্তর দিল শংকর।

হঠাৎ চলে গেল কেন?

শংকর খুব সহজভাবে বলল, বোধ হয় ভয় পেয়েছে।

মনে মনে এবার আমিই ভয় পেলাম। তা হলে বুল্টুও আমাকে দেখে ভয় পাচ্ছে! কিন্তু কেন? শংকরকে জিগ্যেস করতে ভরসা পেলাম না। কারণ ও কী বলবে জানি। ও যে সব কিছুই বাড়িয়ে বলতে ভালোবাসে।

কদিন আর আয়না হাতে করলাম না। যা হচ্ছে হোক ভেবে নিয়ে চোখ বুজিয়ে রইলাম। ঘর থেকেও বেরোলাম না। বুল্টুরা নিজেরা খেলা করে বাড়ি চলে যায়। আমার সঙ্গে আর দেখা করে না। গল্প শুনতেও চায় না।

তারপর একদিন বিকেলে বিছানা থেকে জাম্প দিয়ে নেমে পড়লাম। ওরা এসেছিল সেদিন। ছেলেরা হঠাৎ আমার মতো আধবুড়ো একজন মানুষকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসতে দেখে চমকে উঠল। বুঝলাম আমাকে দেখে ওরা ভয় পেয়েছে। খুব মজা লাগল। তারপর আমি, এত বড়ো মানুষটা, ছাদে ছোটাছুটি শুরু করলাম। ছেলেরা আমায় এরকম করতে দেখে চেঁচামেচি করে ছুট লাগলো। আমি খুব জোরে হেসে উঠলাম। জীবনে কখনো বোধহয় এত জোরে হাসিনি।

.

সেদিন দুপুরবেলা

রাস্তায় হঠাৎ হইহল্লা। এর আগে আমার বাড়ির কাছে কোনোদিন হইহল্লা তো দূরের কথা দু-চারজন মানুষকে একসঙ্গে গলা উঁচু করে কথা বলতেও শোনা যায়নি। তো আজ হঠাৎ হল্লা কেন?

উঠে গিয়ে দাঁড়ালাম রাস্তার দিকের জানালায়। দেখলাম বুল্টুর বাবা রমণীবাবু কয়েকজনের সঙ্গে কী নিয়ে আলোচনা করছে। সবার চোখেমুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।

এদের আবার কী হল? কৌতূহল চেপে বিছানায় গিয়ে বসলাম। হয়েছে ভালো। নিজেকেই জিগ্যেস করলাম, বুল্টুর বাবার মতো আমিও কেন রাস্তায় গিয়ে ওদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারি না? এরও কোনো উত্তর নেই।

যাই হোক, কী হয়েছে বিকেলে জানা যাবে। বিকেল পর্যন্ত আমায় অপেক্ষা করতেই হবে।

ঠিক করেছিলাম বিকেলে বুল্টুরা এলে ওদের মুখ থেকেই শোনা যাবে। কিন্তু বুল্টুরা এলই না। তবে শংকর জানাল, গতকাল বুল্টুর এক বন্ধু বিকেলে খেলতে বেরিয়ে আর বাড়ি ফিরে আসেনি। যেখানে যেখানে যাওয়া সম্ভব সর্বত্র খোঁজ করা হয়েছে। কিন্তু কেউই বলতে পারেনি। তা সে তো গতকালের ব্যাপার। আজ আবার ওদের হল কী?

একটু দেরি করেই এল মাত্র দুজন–গোপাল আর কেষ্ট। বেশিক্ষণ থাকল না। জিগ্যেস করলাম, আর সবাই কোথায়?

গোপাল বলল, জানি না।

ওরা ঘরে ঢোকার পর থেকেই পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল। তারপরেই চলে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।

বললাম, তোমরা এখনই চলে যাচ্ছ?

হ্যাঁ। বলেই নীচে নেমে গেল। কেন, কিছুই বুঝলাম না।

কদিন পর।

আমি হঠাৎ আবার এমন একটা কাণ্ড করে বসলাম যে নিজেই আবাক। আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল একটা বাঁশ গাছ। তার একটা ডাল (কঞ্চি) বাড়তে বাড়তে আমাদের ছাদ পর্যন্ত এগিয়ে এসেছিল। একেবারে নাগালের মধ্যে। দেখে খুব ইচ্ছে করল, ডালটা ধরে ঝুলে পড়ি। মারলাম লাফ। অত বড়ো গাছটা কেঁপে উঠল। আমার খুব মজা লাগল। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখি রাস্তায় লোক জমে গেছে। তারা অবাক হয়ে আমার কাণ্ডকারখানা দেখছে।

এবার আমি যখন শূন্যে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে লাফিয়ে পড়লাম তখন যারা দাঁড়িয়ে মজা দেখছিল তারা সবাই ছুট লাগল। আমি হা হা করে হাসতে লাগলাম। একটু পরে নিজের অপকীর্তি দেখে নিজেকেই ধমকে উঠলাম।

আমি কি পাগল হয়ে গেছি!

.

০৫.

পাগল এখনও পুরোপুরি হইনি। তবে হতে বোধহয় দেরি নেই। বুঝতে পারি ক্রমশই আমি যেন কেমন হয়ে যাচ্ছি। কখন কী যে করে ফেলি তা বুঝতে পারি না।

অথচ আমি আগে তো এমন ছিলাম না। এ বাড়িতে এসে দাদামশাই-এর সেই খাতাখানা পড়ার পর থেকেই আমার পরিবর্তন শুরু। প্রথম দিকে বুঝতে পারিনি। তারপর যেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ শুধু আমার বাড়ির আলো নিভে গেল আর বুল্টু ভয় পেল সেদিন থেকেই শুরু হল আমার পরিবর্তন। এত ধীরে ধীরে পরিবর্তন হতে লাগল যে আমি খেয়াল করতেও পারিনি। একেই বোধহয় বলে চিত্তবিকার। কোন একটি ইংরেজি বই-এ পড়েছিলাম যে খারাপ চিন্তা, খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে থাকতে থাকতে সুস্থ মানুষও ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। অবশ্য সাইকিয়াট্রিক ট্রিটমেন্ট আছে। এখানে সেসব চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই।

মনে হয়, একটানা ভৌতিক পরিবেশে থাকার ফলেই আমার এইসব অদ্ভুত পরিবর্তন। আর এর ফলে আমি ক্রমশই যেন অস্বাভাবিক হয়ে উঠছি।

এই যেমন ছুটে ঘরে ঢুকেও নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। দরজায় তো খিল দিয়েছিই। তিনটে জানলার সব কটাই বন্ধ করে দিয়েছি। তবু কেবল যেন শুনতে পাচ্ছি একদল লোক আমায় তাড়া করে আসছে। অথচ এও জানি বুল্টুকে ভয় দেখিয়ে চলে আসবার সময় একটা লোকও তাড়া করে আসেনি। ভাবতে ভাবতে আমার মাথার ভেতরে কেমন করে উঠল। দাঁড়িয়ে ছিলাম, মাটিতে বসে পড়লাম। তারপর একসময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ পর শুনতে পেলাম শংকরের ডাক।

দরজা খুলুন। খেতে দিয়েছি।

উঠলাম। দরজাও খুলে দিলাম। কিন্তু শরীরটা বড়োই দুর্বল। এসবই করছি যেন ঘোরের মধ্যে। লক্ষ করছিলাম বুল্টু যেন ইদানিং আমাকে এড়িয়ে চলছে। ও যেন আমায় কেমন ভয় পাচ্ছে।

আমার সবচেয়ে ক্ষতি হল যখন ও আমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দিল। অন্য কেউ না আসুক তাতে কষ্ট নেই। কিন্তু বুল্টুকে আমি খুব ভালোবাসতাম, রোজ বিকেলে আমি ওর পথ চেয়ে থাকতাম।

কিন্তু যে প্রতিদিন আসত সে যখন আর একদিনও আসে না তখন বুঝলাম, ভুল করে ফেলেছি। বুল্টুকে ঐভাবে ভয় দেখানো উচিত হয়নি। একটা বোবা কান্নায় আমার বুক ফেটে যেতে লাগল।

শেষে আর পারলাম না। একদিন চলে গেলাম বুল্টুদের বাড়ি। অন্তত একটি বার বুকে চোখের দেখা দেখতে চাই। এ বাড়িতে এর আগে অনেকবার এসেছি। কিন্তু এবার আসাটা যেন অন্যরকম। মনে হচ্ছে কোনো অচেনা লোকের বাড়ি যাচ্ছি, এমন একজন যাকে ও বাড়ির লোকেরা এড়িয়ে চলতে চায়। তার জন্য তাদের অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। আমার চেহারাটাই যে বদলে গেছে।

ইচ্ছে করেই সন্ধের পর বেরিয়ে ছিলাম। কারণ লোকের সামনে বড়ো একটা বেবরাতে চাই না। সবাই কেমন যেন অবাক হয়ে আমায় দেখে। ভালো লাগে না। কিন্তু তবু নিস্তার নেই। অন্ধকারে রাস্তায় বেরোতেই গোটাকতক কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এল। এই বুঝি কামড়ে দেয়।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বুল্টুদের বাড়ি পৌঁছলাম। বুল্টু বাইরের ঘরে বসে ওর বাবার কাছে পড়ছিল। একা বুল্টু থাকলেই খুশি হতাম। যাই হোক এসেছি যখন বুল্টুকে দূর থেকেই দেখে যাই।

সেই মতো আমি নিঃশব্দে রকে উঠে জানলা দিয়ে উঁকি মারলাম। বুল্টু আমায় দেখতে পেল না। তখন সাহসে ভর করে ডাকলাম–বুল্টু–

বুল্টু চমকে উঠল। তারপর জানলার দিকে তাকিয়ে যে আঁৎকে উঠল। চিৎকার করে বাবা গো? বলেই ভেতরে চলে গেল। আমি কতবার বুল্টু বুল্টু করে ডাকলাম। কিন্তু ও আর আমার সঙ্গে দেখা করল না। ওর বাবা আমায় রীতিমতো ধমক দিয়ে বললেন, শোনো, তোমায় দেখে বুল্টু যখন এত ভয় পায় তখন এ বাড়িতে আর এসো না। লজ্জায়, দুঃখে আমি মাথা নিচু করে পালিয়ে এলাম। ঠিক করলাম, বুল্টুর সামনে আর কোনদিন যাব না।

কিন্তু সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারলাম না।

.

কদিন পর।

তখন সন্ধে হয়-হয়।

আমি আমার ঘরটিতে বসে আছি, দরজা-জানলা বন্ধ করে।

হঠাৎ রাস্তায় হল্লা, ধর–ধর–ছেলেধরা।

চমকে উঠলাম। ছেলেধরা এল কোথা থেকে?

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শংকর এসে ঘরে ঢুকল। চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, বুল্টুকে ছেলেধরার দল ধরে নিয়ে গেল!

চমকে উঠলাম–অ্যাঁ! বলিস কী? কখন?

এখনই।

ওর বাড়িতে জানে?

হ্যাঁ, কান্নাকাটি করছে।

আমি আর বাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না, যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থাতেই ছুটলাম।

ছোটো তো নয় উড়ে যাওয়া।

শরীরটা অসম্ভব হাল্কা মনে হচ্ছে। মাটিতে যেন পা ঠেকছেই না। দুরন্ত গতি।…..রাস্তার লোক হাঁ করে দেখছে।

কিন্তু আমার এদিক-ওদিক তাকাবার ফুরসৎ নেই। যেমন করে হোক বুল্টুকে উদ্ধার করতেই হবে। আমার পায়ে যেমন ঝড়ের গতি, শরীরে তেমনি অলৌকিক বল। মিনিট পনেরো পর ধরে ফেললাম গাড়িটিকে।

গাড়িতে জনাচারেক লোক ছিল। আমাকে ছুটে আসতে দেখে তারা অবাক হল। তারা তো জানে না যখন আমার এই শরীরে অলৌকিক শক্তি ভর করে তখন আমাকে কেউ আটকাতে পারে না। দেখলাম গাড়ির মধ্যে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে বুল্টু।

একটা অস্বাভাবিক হুংকার দিয়ে রুখে দিলাম গাড়িটা। তারপর চারজন ছেলেধরাকে কাবু করে বুল্টুকে কাঁধে করে বাড়িতে পৌঁছে দিলাম।

.

জীবনে এই একটা ভালো কাজ করতে পারলাম।

কিন্তু

কিন্তু কীভাবে এটা সম্ভব হল একা আমার পক্ষে?

এটা যদি সত্যিই অলৌকিক ব্যাপার হয় তা হলে প্রশ্ন জাগে কোথা থেকে পেলাম এই শক্তি? কে জোগাল?

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একজনের কথা মনে হল–সে আত্রেয়ী।

জানি সে বহুকাল আগে মৃত। মৃত্যু হলেই কি সব শেষ হয়ে যায়?

যায় না। তার বহু প্রমাণ আমি পেয়েছি।

আত্রেয়ী নিজেই তার প্রমাণ দিয়েছে এই সেদিনও।

তার দেহ যে আমার এই বাড়ির নীচেই পোঁতা আছে আমি জানি। সে গত রাত্রে হঠাৎ কেন দেখা দিয়েছিল? কেন দিয়েছিল?

না, আমাকে ভয় দেখাতে নয়। মনে হয় শুধু এই কথা জানাতে চায়, সে আমার কাছেই আছে। এ বাড়িতে তার একটা নতুন আকর্ষণ হয়েছে। সে আকর্ষণ বুল্টু আর তার বন্ধুরা। এও বলেছিল, আমি যেন আমার শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে না ভাবি।

এখন মনে হচ্ছে বিকেলে যখন ওরা খেলা করত তখন মাঝে মধ্যেই কোথাও নূপুরের শব্দ শোনা যেত। মনে হত কেউ যেন নূপুর পরে হালকা পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওদের সঙ্গে খেলছে। কিন্তু তাকে দেখা যায় না।

আত্রেয়ী ছিল ছেলেমানুষ। তাই ছোটো ছেলেমেয়েদের ভালোবাসত। বুল্টুরা যখন ছাদে খেলা করত তখন আত্রেয়ীও যে অলক্ষে সেখানে এসে দাঁড়াত তা আজ বোঝা যাচ্ছে।

কতদিন শোনা গেছে আমার ঘর থেকে নূপুর পায়ে দিয়ে কেউ যেন ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই কি বুল্টুর বিপদে ওকে বাঁচাবার জন্যই আত্রেয়ীর আত্মা আমার ওপর ভর করে ছেলেধরার হাত থেকে বুল্টুকে বাঁচিয়ে দিল?

সঠিক উত্তর জানা না গেলেও এই মুহূর্তে আত্রেয়ীর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আমার মন ভরে উঠল। মনে মনে বললাম, আত্রেয়ী, তুমি যেখানেই থাক যেভাবেই থাক আমার নমস্কার নিও। প্রার্থনা করি, বুল্টুকে রক্ষা করে তুমি যে মহৎ কাজ করলে তার জন্য পরমেশ্বর তোমার। এই অভিশপ্ত জীবন থেকে তোমায় মুক্তি দেবেন।

সেদিনই রাত তখন গভীর।

হঠাৎ ঘরের মেঝে কেঁপে উঠল। তারপর মেঝের একটা অংশ ফেটে গেল। আর সেইখান দিয়ে খানিকটা সাদা ধোঁয়া হুশ করে বেরিয়ে এল। তারপর পাক খেতে খেতে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

.

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। তাকিয়ে দেখি পুবের জানলা দিয়ে আসা ঝলমলে আলোয় ঘর ভরে আছে। একটু পরেই শংকর গরম চা আর টোস্ট নিয়ে ঢুকল। আমি হাসিমুখে উঠে বসলাম।

শংকর আমার হাতে চা তুলে দিয়েও আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। জিগ্যেস করলাম, কী দেখছিস?

ও উত্তর দিল না। শুধু টেবিলের ড্রয়ার থেকে ছোট আয়নাটা এনে আমার হাতে দিল।

কী রে, হঠাৎ আয়না দিচ্ছিস?

দেখুন!

দেখলাম। মুখে আমার সেই বীভৎস দাগ আর নেই। সব মিলিয়ে গেছে। বুল্টুকে আয়েত্রী উদ্ধার করেছিল আমার মধ্যে দিয়ে। আর মুক্তি পাবার পর সে আমায় মুক্ত করে দিয়ে গেল আমার ভয়ঙ্করতম সমস্যা থেকে। আমি আবার আগের মতো হয়ে গেছি। বুল্টুরা আর আমায় দেখে ভয় পায় না। নিয়মিত খেলে। এর পরেও কি আমি বিশ্বাস করব না–ভূত বলে সত্যিই কিছু আছে! আমি তো আমার জীবনেই তা প্রমাণ পেয়েছি। যতদিন আয়েত্রীর আত্মার ভর আমার ওপর ছিল ততদিন আমি অন্য মানুষ ছিলাম। মুখটা হয়ে উঠেছিল কদাকার। এরপর হয়তো চেহারাটাও হত। আমার প্রার্থনায় আয়েত্রী মুক্তি পেল। আমাকেও মুক্তি দিয়ে গেল।

[শারদীয়া ১৪১৬]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *