০২ অধ্যায় – ওয়েজিং ওয়ার

০২ অধ্যায় – ওয়েজিং ওয়ার

সানজু বলেন:

সাধারণত একটা সামরিক অভিযানে এক হাজার দ্রুত গতি সম্পন্ন চার ঘোড়াওয়ালা যুদ্ধ রথ, এক হাজার চার ঘোড়াওয়ালা ওয়াগন, আর এক লক্ষ পদাতিক সৈন্যবাহিনী প্রয়োজন হয়।

তু-মু এর ভাষ্যমতে, প্রাচীন কালের যুদ্ধ গুলোতে চামড়ায় জড়ানো রথগুলোর হালকা আর কতগুলো প্রকান্ড হত। প্রকান্ডগুলোতে অস্ত্র, সামরিক সরঞ্জামাদি, মুল্যবান দ্রব্য সামগ্রী, যুদ্ধ পোষাক রাখা হতো।

সু-মা ফা এর মতে, একটা রথ তিনজন পদাতিক উপদেষ্টা অফিসার বহন করতো; যাদের সাথে থাকতো বাহাত্তর জন পদাতিক সৈন্য। এছাড়াও থাকতো দশজন রাধুনি ও সাহায্যকারী, পাঁচজন থাকতো যুদ্ধ পোষাক দেখাশুনা করার জন্য আর পাঁচজন থাকতো আগুন জ্বালানো আর পানি সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত। বড় একটা রথে মোট পঁচাত্তর জন থাকতো যাদেরকে একটা ছোট পঁচিশ জন ওয়ালা ওয়াগন সহযোগিতা করে একশ জনের একটা দল তৈরি করতো।

যুদ্ধের জিনিসপত্র বাড়ি থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে নেয়া হয়ে গেলে দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা এবং পর্যবেক্ষণকারী সেগুলো ভালোভাবে পরিদর্শন করে নেন যেগুলোর জন্য প্রতি রথ অনুসারে দিনে একহাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রদান করতে হয়। আর এর খরচের অর্থ যদি হাতে থাকে তবে এক লক্ষ সৈন্যও যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।

লি চুয়ানের মতে: যখন সৈন্যবাহিনী বাড়ি থেকে রওয়ানা দিতে দেখবেন তখন তাদের বাড়ির ধন-সম্পদ সব খালি হয়ে গেছে।

তু-মু এর ভাষ্যমতে: সে সময় এক ধরনের প্রথা প্রচলিত ছিল। সৈন্যদেরকে মাঝে মাঝে সামন্ত প্রভুরা দেখতে আসতো। আর তাই সানজু ‘উপদেষ্টা এবং পরিদর্শনকারী’ শব্দ ব্যবহার করেছেন।

.

২.

যুদ্ধে জিততে পারাটাই মুখ্য বিষয়। যদি যুদ্ধ বেশি দিন স্থায়ী হয় তবে অস্ত্রের ধার কমে আসবে এবং সৈন্যদের মনোবল কমতে থাকে। শেষে তারা যখন শহর আক্রমণ করতে যাবে ততক্ষণে তাদের সকল শক্তি নিঃস্বের পর্যায়ে চলে যায়। একদিকে সৈন্যদের মাঝে শহর রক্ষার জন্য বলা হবে ততক্ষণে রাজ্যের সম্পদ একেবারে তলানিতে এসে পৌঁছবে।

চ্যাং ইউ এর মতে: হান রাজ্যের সম্রাট অউ (Wu) যখন প্রচারণা চালাচ্ছিলেন রাজ্য শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য ততক্ষণে যুদ্ধের খরচ বহন করতে গিয়ে তার ভান্ডার খালি হয়ে গেল।

যখন আপনার অস্ত্র ভোলা হয়ে যাবে; সমস্ত শক্তি আর সম্পদ শেষ হয়ে যাবে, এই সুযোগটা প্রতিবেশি রাজ্য কাজে লাগিয়ে ভয়ানক কিছু একটা করে ফেলতে পারে। আর তখন আপনার যতই জ্ঞানী উপদেষ্ট থাকুক না কেন কারও কোন পরামর্শ ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতে পারবে না। আর যখন আমরা যুদ্ধের ময়দানে অসম্ভব সাবলীল যুদ্ধের কথা শুনি, তখন কিন্তু সেখানে যে বড় ধরনের কোন চালাকি লুকিয়ে আছে সেটা কখনও কল্পনাও করতে পারিনা।

তু-ইউ এর ভাষ্যমতে: কোন আক্রমণে হয়তো বুদ্ধির খেল কম থাকতে পারে; তবে সেখানে জয়ী হওয়ার জন্য অতিপ্রাকৃত ক্ষিপ্রতা থাকতে হবে।

এমন কোন দীর্ঘায়িত যুদ্ধ নেই যেই যুদ্ধ থেকে দেশের কোন মঙ্গল হয়েছে।

লি চুয়ানের ভাষ্যমতে: বসন্ত এবং শরৎ ঋতুতে সংঘটিত যুদ্ধগুলো বলছে: ‘যুদ্ধ হল আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মত; যারা অস্ত্রের ভাষায় কথা বলবে তাদেরকেও সেই অস্ত্রের মুখে পড়তে হয়েছে।’

আর এভাবে যারা সৈন্যবাহিনী ব্যবহারের ভয়াবহতা সম্পর্কে অজ্ঞ তারাই এর ব্যবহারের সুবিধাটাও সম্পর্কে অজ্ঞ।

.

৩.

সানজু বলেন, যুদ্ধের ময়দানে দ্বিতীয় সুযোগ বলে কিছু নেই, প্রথম সুযোগেই কুপোকাত করতে হয়। সৈন্যরা তাদের নিজ দেশ থেকে যুদ্ধের সরজ্ঞামাদি বহন করে নিয়ে আসে। তবে ময়দানে থাকার সময়কালে শত্রুর হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া সরজ্ঞামাদি দিয়েই নির্বাহ করে। এভাবেই সৈন্যদের মাঝে পর্যাপ্ত রসদ পৌঁছে দিতে হয়। যদি সামরিক অভিযান করতে গিয়ে দেশ নিঃস্ব হয়ে যায় তবে সেটা হবে পরিবহন ব্যায়ের কারনে; সরঞ্জামাদি দুরে পরিবহন করার পারিশ্রমিক দিতে গিয়েই মানুষ নিঃস্ব হয়ে যায়।

চ্যাং ইউ এর মতে: যদি সৈন্যদের এক হাজার লি দূরে তাদের যুদ্ধ সরঞ্জামাদি পরিবহন করার জন্য মুদ্রা খরচ করতে হয়; তবে তারা যেন প্রচন্ড রাগত চোখে দেখবে সব কিছু।

.

৪.

সানজু বলে, যেখানে সৈন্যদেরকে বেশি খরচ করে নিজের বাগে আনতে হয়; সেখানে সব কিছুরই দাম বেড়ে যায়, জনগণ অতিষ্ট হয়ে ওঠে।

চিয়ান লিন এর ভাষ্যমতে, সৈন্য জোগাড় করা শুরু করলে বাজার দর বেড়ে যায়, কারণ দ্রব্যের যোগান কমে গেলে সকলে তার দ্রব্যের থেকে বেশি মুনাফা আদায় করে নেয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে সকল সম্পদ খরচ করে দেয়ার পর জনগণের হাতে খরচ করার মত কিছু থাকে না। তাদের সকল সম্পত্তি নিঃশ্বেস হয়ে যায়। ভেঙ্গে যাওয়া রথ মেরামত করতে, আহত ঘোড়ার চিকিৎসা করতে, সুরক্ষা শিল্ড আর হেলমেট মেরামত করতে, তীর-ধনুক আর সৈন্যদের হাত এবং বর্মগুলো ঠিক করতে, ওয়াগনের যোগান দিতে গিয়ে রাজ কোষাগারের ষাট ভাগই খরচ হয়ে যায়। আর তাই বিজ্ঞ জেনারেল খেয়াল রাখেন যাতে তার সৈন্যরা আক্রমণ করে ছিনিয়ে আনা রসদ তাৎক্ষণিক যুদ্ধের পুরস্কার হিসেবে বন্টন করে দেয়া হয়েছে কিনা। এতে করে তার সৈন্যরা শত্রু থেকে তাদের খাবার আর অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে উৎসাহ বোধ করবে। কারণ নিজেদের এক ভাগ খাবার শত্রুদের বিশ ভাগ খাবারের সমান।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, সরঞ্জামাদি এক হাজার লি দুরে পরিবহনে বিশ ভাগ সৈন্যদের রসদ শেষ হয়ে যায়। আর যদি যোগাযোগ ব্যবস্থাটা দুর্গম হয় তবে সেক্ষেত্রে ক্ষতি আরও বেশি হয়।

আর সৈন্যদের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখন তারা শত্রুদের সৈন্য আরও বেশি হত্যা শুরু করে।

হো ইয়েন-সি এর মতে, যখন ইয়েন সৈন্য চারিদিক থেকে সি-মো দেরকে চি-তে ঘিরে ফেলল; তারা সকল সি-মো সৈন্যদের আটককৃতদের নাক কেটে দিল। সৈন্যরা শক্তিশালী একটা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। তিয়েন তান গোপনে দুত পাঠালেন: ‘আমরা খুবই ভীত কম্পিত এটা শুনে যে ইয়েনের মানুষ শুনুন শত্রুরা আপনাদের পূর্বপুরুষদের দেহ পর্যন্ত করব খুড়ে তুলে ফেলবে। এই অবস্থায় আমরা কিভাবে শান্ত থাকি?’

ইয়েন সৈন্যরা তাৎক্ষণিক তাদের কবরগুলিকে ধ্বংস করে মৃতদেহগুলি পুড়িয়ে ফেলতে শুরু করল। সেই প্রতিক্ষিরা সেগুলো শহরের সুরক্ষা সীমানা থেকে তা পর্যবেক্ষণ করল। আর চোখের পানি ফেলা ছাড়া তাদের কোন উপায় ছিল না। এর সাথে সাথে তাদের ক্ষোভকে দশগুণ শক্তিতে রুপান্তরিত করল। তিয়েন তান বুঝতে পেরে তার সৈন্যদেরকে তৈরি হতে বলল এবং আক্রমণের নির্দেশ দিলে ইয়েন সৈন্যরা পরাজিত হল।

সানজুর মতে, শত্রু থেকে তাদের ধন-সম্পদ লুট করে আনার কারণ ওগুলো সৈন্যদের প্রাপ্য।

তু-মু এর ভাষ্যমতে: হানদের শেষের দিকে তু সিয়াং সেই পাওদের আক্রমণ করে এবং পান হায় ও আরও কিছু রাজ্য নিজের দখলে করে নেয়। তিনি নান হাই রাজ্যের ভেতরে ঢুকে তাদের তিনটা ক্যাম্প ধ্বংস করে এবং প্রচুর সম্পদ ছিনিয়ে আনে। যাইহোক, পান হাং এবং তার অনুসারিরা তখনও অত্যন্ত ক্ষমতাধর আর সংখ্যায় বহু সৈন্য ছিল আর অন্যদিকে তু সিয়াংদের সৈন্যরা সম্পদশালী আর অহংকারী হয়ে উঠল। একারনে তাদের মধ্যে যুদ্ধ করার সামান্যতম ইচ্ছা ছিল না।

সিয়াং এর ভাষ্যমতে: ‘পু ইয়াং আর পাং হান টানা দশ বছর বিদ্রোহ করে। দুজনই আক্রমণ এবং প্রতিরক্ষায় ছিল অত্যন্ত সুদক্ষ। তাই সকল শক্তি একত্রিত করে তাদেরকে আক্রমণ করি। এর জন্য একটা পরিকল্পনা করা হল। সৈন্যদের মধ্যে চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনার জন্য শিকারের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।’ যেখানে সকল সৈন্যরাই অংশ নেয়ার জন্য শিবির ছেড়ে বেড়িয়ে যায়।

যখনই সৈন্যরা শিবির ছেড়ে গেল তু সিয়াং গোপনে নির্দেশ দিলেন তার সৈন্যদের শিবিরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিতে। আর এতে তাদের সকল সম্পদ পুড়ে ছাই হল। ফিরে এসে অবস্থা দেখে তাদের সকলে কান্না জুড়ে দিল।

তু সিয়াং বলেন: ‘পু ইয়াং আর তার সৈন্যদের যতটা সম্পদ আছে সেগুলো তোমাদের এবং কয়েক প্রজন্মের জন্য যথেষ্ট। তোমরা তোমাদের পুরো শক্তি দিয়ে কখনও আক্রমণ করো নি। শত্রু শিবিরে যা আছে তার সামান্যই তোমরা এখানে হারিয়েছে। এটা নিয়ে এত চিন্তিত কেন তোমরা?’

সৈন্যরা এটা শুনে বিপুল উৎসাহিত হল এবং যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তু সিয়াং তাদের ঘোড়াগুলোকে খাবার খাওয়ানোর নির্দেশ দিলেন এবং সকলকে তাদের বিছানায় যেতে নির্দেশ দিলেন। সকালে সৈন্যরা বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য রওয়ানা দিল। আর হাং তখন প্রস্তুত ছিল না আর তু সিয়াংয়ের সৈন্যরা প্রবল উৎসাহে তাদের আক্রমণ করে পরাস্থ করল।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, এই সার্বভৌম রাজবংশের সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠাতা যখন তার সেনানায়ককে সু রাজ্য আক্রমণের আদেশ দেন তখন তিনি এভাবে ঘোষণা দেন: যে সকল শহর এবং তার অধীনস্ত রাজ্য দখল করা হবে, তোমরা আমার জয়গান ছড়িয়ে দেবে আর তাদের সম্পদগুলি ছিনিয়ে সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দেবে। রাজ্যের নামে আসবে শুধু এর জমিগুলো।

তাছাড়া, আক্রমণের সময় সেখানে যদি দশটাও রথ ছিনিয়ে আনা যায় তবে যারাই প্রথম রথ ছিনিয়ে আনতে পারে তাদেরকে পুরস্কৃত করুন। শত্রুর পতাকার জায়গায় নিজেদের পতাকা প্রতিস্থাপন করুন, রথগুলো নিজেদের রথের সাথে যুক্ত করে সেগুলোকেও কাজে লাগান। যুদ্ধ বন্দিদের সাথে ভালো আচরণ করুন।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, সকল আটকৃত সৈন্যদেরকে সুস্থ করে তুলে তাদেরকে নিজেদের পক্ষে যুদ্ধে কাজে লাগাতে হয়।

একেই বলা হয় একটা যুদ্ধে জয়ী হয়ে নিজেদেরকে আরও শক্তিশালী করে ভোলা। আর তাই যুদ্ধের মুখ্য বিষয় হল জয় লাভ করা, যুদ্ধে লিপ্ত থাকা নয়। আর তারপরই সেনানায়ক বুঝতে পারবেন যুদ্ধ হল জনগণের ভাগ্য আর মিমাংশা হল জাতির নিয়তি।

হো ইয়েন সি এর মতে, বর্তমানে একজন সেনানায়কের নিয়োগ দান যেমন সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং কঠিন ব্যাপার ঠিক তেমনি প্রাচীন কালেও ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *