1 of 3

ব্যক্তিগত শোক

ব্যক্তিগত শোক

আমার ছোড়দার মৃত্যু হলো নিউইয়র্কের বেলভিউ হাসপাতালে। ঠিক যেভাবে মৃত্যু হয়েছিল লেখক হুমায়ুন আহমেদের। ওই একই হাসপাতালে। হুমায়ুন আহমেদের ছিল কোলন ক্যানসারের সঙ্গে লিভার মেটাসটাসিস। আমার ছোড়দারও ছিল লিভার মেটাসটাসিস, তবে মূল ক্যানসার কোলনে ছিল না, ছিল প্যানক্রিয়াসে। ক্যানসারের ভালো চিকিৎসা পাওয়ার পর দুজনের শরীরে ক্যানসার প্রায় ছিল না বললেই চলে। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাদের রক্তে ঢুকে পড়ে হাসপাতালের ভয়ংকর ব্যাকটেরিয়া, কোনও ওষুধেই যার মৃত্যু নেই, যে ব্যাকটেরিয়া দ্রুত খেয়ে ফেলতে থাকে ফুসফুস, কিডনি, মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড। এই ব্যাকটেরিয়াগুলোকে হসপিটাল বাগ বলা হয়। খুব ভয়ংকর এই বাগ। কোনও অ্যান্টিবায়োটিকই এই বাগকে সামান্যও স্পর্শ করতে পারে না, এই বাগের জন্ম হাসপাতালেই। হাসপাতালের নানা অ্যান্টিবায়োটিক পেতে পেতে কিছু ব্যাকটেরিয়া আজরাইলে পরিণত হয়। এই ব্যাকটেরিয়া যাকে ধরে, তার মৃত্যু অনিবার্য। হসপিটাল বাগকে কাবু করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। হুমায়ুনের আহমেদের মৃত্যু দেখিনি, পূরবী বসুর কাছে শুনেছি কী ভাবে মারা গেছেন তিনি। তবে আমার ছোড়দার মৃত্যুটা আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে হয়েছে। যদি ছোড়দা ক্যানসারে মারা যেতো, দুঃখ হতো না। ক্যানসারে মারা যাবে এরকমই জানতাম। ডাক্তারও এরকমই বলেছিলেন। প্রস্তুতিও নেওয়া ছিল। কিন্তু হাসপাতালের ব্যাকটেরিয়া একটা জলজ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলবে, সেটা ভাবা যায় না। বিশেষ করে সে হাসপাতাল যদি পৃথিবীর উন্নত দেশের অন্যতম একটি হাসপাতাল হয়। বেলভিউ হাসপাতালে হসপিটাল বাগ আছে। কারণ হাইজিন সুবিধের নয় এই হাসপাতালে। সাধারণত মেডিক্যালের যন্ত্রপাতির মধ্যেই লেগে থাকে এই ব্যাকটেরিয়া। নার্সরা এক রোগীকে স্পর্শ করে হাত না ধুয়ে আরেক রোগীকে স্পর্শ করলেও এই ব্যাকটেরিয়া ছড়ায়। কী করে ছড়িয়েছে হসপিটাল বাগ এই হাসপাতালে, কী করে আমার ছোড়দার রক্তে ঢুকেছে, তা আমরা জানি না। ডাক্তাররা যখন বুঝতে পারলেন ছোড়দার ফুসফুস চলে গেছে, কিডনি চলে গেছে, তখন আমাদের কাঁচুমাচু মুখে বললেন, কালচার রিপোর্টে দেখছি রেসিসট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া রক্তে, কোনও অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করছে না। হাঁ হয়ে থাকি। তাহলে কি জানিয়ে দেবো, নিউইয়র্কের বড় হাসপাতালটি নোংরা, এখানে চিকিৎসা করতে এলে হসপিটাল বাগআক্রমণ করে, এবং রোগীদের মেরে ফেলে? দুএকজন ডাক্তার মিনমিন করছিল, আসলে কেমোথেরাপি নিতে নিতে ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এত কমে গেছে যে…। ইমিউনিটি কমে যাওয়ার কারণে কি আর হসপিটাল বাগ ধরেছে, কোনও সুস্থ মানুষকেও তো ধরতে পারতো এই বাগ!

ডাক্তাররাও চান হাসপাতালকে দুর্নাম থেকে রক্ষা করতে।

গতবছর আমাকেই তো দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তিরিশের পর সব মেয়েকেই প্রতিবছর ম্যামোগ্রাম করার উপদেশ দেন ডাক্তাররা। স্তনের ক্যানসার শুরুতেই যদি ধরা পড়ে, অনেক বছর বেঁচে থাকা যায়। ম্যামোগ্রামে স্তনের ক্যানসার ধরা পড়ে। আমার ম্যামোগ্রামে কিছু একটা পাওয়া গিয়েছিলো, অবশ্য কোনও ডাক্তারই বুঝতে পারেননি কী পাওয়া গিয়েছিল। বায়োপসি করে বলে দিলেন, ও কিছু না। ছমাস পর আবার ম্যামোগ্রাম করে এক ডাক্তার ভ্রু কুঁচকালেন, বললেন এটি ফেলে দাও, মনে হচ্ছে, টিউমারটা বড় হচ্ছে। আমি তো রীতিমত ভয় পেয়ে গেলাম। সারা শরীর অজ্ঞান করে অতপর টিউমার ফেলতে হয়েছে। টিউমারের বায়োপসি রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। যা রিপোর্ট এলো, তা দেখে তো আমি চমকে উঠলাম। ও কোনও টিউমারই ছিল না। কী ছিল তবে? কিছুই ছিল না। তবে কী পেয়েছিলো ম্যামোগ্রামে? ফ্যাটি টিস্যুগুলো একটু ঘনঘন ছিল, এই যা, তার একটা ছায়া বোধহয় পড়েছিল। কিন্তু এত বড় বড় ডাক্তার বুঝতে পারলো না ওটা কোনও টিউমারই নয়? একটা কিছুই না জিনিসের জন্য আমাকে অজ্ঞান করলো, শরীরে কাটাছেঁড়া করলো! বন্ধুরা উপদেশ দিয়েছিলো মামলা করার জন্য। মামলার ঝামেলায় যেতে ইচ্ছে করে না। তাই করিনি। তবে ডাক্তারদের ভৎসর্না করে একটা ইমেইল পাঠিয়েছিলাম।

আমেরিকার হাসপাতালের ওপর থেকে আমার মন ওঠার কথা আমার মার ওপর যা ঘটেছিল তার পরই। মার ক্যানসার ধরা পড়ার পর আমি মাকে নিউইয়র্কের স্লোন কেটেরিং হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম। ওরা আগে থেকেই সাড়ে তেরো হাজার ডলার নিয়ে রেখেছিল, যেহেতু মা বিদেশি রোগী, ওই টাকাটা এয়ারপোর্ট থেকে মাকে নিয়ে আসার খরচ, সমস্ত চিকিৎসার খরচ, হাসপাতালে থাকার খরচ, ওদের হোটেলে থাকার খরচের অগ্রীম। এই টাকা না দিলে ওরা রোগি দেখবে না। মাকে ওরা নিয়ে আসেনি এয়ারপোর্ট থেকে, মাকে কোনও হোটেলে থাকতে হয়নি, হাসপাতালেও থাকতে হয়নি। মানিউইয়র্কে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ছিল। মাকে শুধু একটা এমআরআই করে ওরা বলে দিলো মা আর তিনমাস বাঁচবে, যেন দেশে ফেরত নিয়ে যাই। ব্যস এইটুকুই। এইটুকুর খরচ রেখে বাকি টাকা ফেরত দাও। না, ওরা টাকা ফেরত দিল না। মেমোরিয়াল স্লোন কেটেরিংএর নাম বিশ্ব জুড়ে। এদের ছোটলোকির কথা কজন জানে? বেলভিউএর হাসপাতাল বাগের খবরই বা কজন রাখে। মানুষ জানে বেলভিউ হাসপাতাল খুব প্রাচীন, খুব বড়, খুব নামী হাসপাতাল। খুব কম লোকই জানে, এটি খুব নোংরা হাসপাতাল। এই নোংরা হাসপাতালে নার্সরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয়, ডাক্তাররা উদাসীন। আজ আমার ছোড়দা বেলভিউ হাসপাতালের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার জন্য জীবন দিলো। এরকম আরও অনেকে জীবন দেবে। কিন্তু আমরা তৃতীয় বিশ্বের গরিব মানুষ ভাববো ধনীর দেশের হাসপাতালগুলো ভালো, নার্সরা হাইজিন মানে, ডাক্তাররা অনেক জানে।

আমার ছোড়দা খুব বাঁচতে চেয়েছিলো। বিদেশের মাটিতে মরতে চায়নি। কিন্তু আমেরিকার হাসপাতাল তা হতে দেয়নি। হাসপাতালের নিজস্ব ব্যাকটেরিয়া তাকে মেরেছে। ক্যানসারের রোগীরা অপঘাতে মারা গেলেও লক্ষ্য করেছি কেউ বিশেষ দুঃখ করে না। ক্যানসার হওয়ার পর মানুষ সম্ভবত মনে মনে চিরবিদায় জানিয়ে দেয়। আমার ছোঁড়া দীর্ঘদিন ক্যানসারের চিকিৎসা নিয়েছিল, অনেক কষ্ট সয়ে সে চিকিৎসা নিয়েছিলো, কিছুদিন বেশি বাঁচার জন্যই নিয়েছিলো চিকিৎসা। শরীরে কেমোথেরাপির বিষ নিয়ে তাকে দুদিনের বেঁচে থাকা ক্রয় করতে হতো, সুতরাং তার বেঁচে থাকাটা খুব মূল্যবান ছিলো। এই মৃত্যুটা সওয়া যায় না। তারপরও সব মৃত্যুকেই আমাদের শেষ অবধি মেনে নিতে হয়।

বিদেশমানেই স্বর্গ। বিদেশের চিকিৎসা মানেই ভালো চিকিৎসা এই ধারণা থেকে মানুষের মুক্ত হওয়া জরুরি। ভারতে থাকাকালীন দেখেছি পেট ব্যথা হলো, কী পায়ে কাঁটা বিঁধলো বাংলাদেশের মানুষ ভারতে চলে যায় চিকিৎসা করাতে। বাংলাদেশের চিকিৎসার ওপর কারও যেন আর আস্থা নেই। এ কবে হলো কী করে হলো জানি না। যখন দেশের মেডিক্যাল কলেজে পড়েছি, হাসপাতালে চাকরি করেছি–নিষ্ঠ, কর্মঠ, দায়িত্বশীল, ডেডিকেটেড ডাক্তারদের কাজ দেখেছি। ভালো ডাক্তারি দেখেছি। আমার পুরো ডাক্তার জীবনে কোনও রোগীর অবহেলা হতে দেখিনি। এই বাংলাদেশ এখন শুনি চিকিৎসা করতে জানে না। আমার বাবার কিডনি ফেইলুরের পর একবার শুধু ডায়ালাইসিস হয়েছিল, দ্বিতীয়বার হতে পারেনি, বারডেমের মতো হাসপাতালে সেপটিসেমিয়ায় মরতে হলো আমার বাবাকে। আমার মার চিকিৎসা ভুল করেছিলো বারডেম। কোলনে যে জায়গায় ক্যানসার হয়েছিল, সেই জায়গাটুকু শুধু অপারেশন না করে একটা বিশাল র‍্যা ডিক্যাল অপারেশন করেছিল, যেটা করতে হয় কোথাও মেটাসটাসিস না থাকলে অর্থাৎ ক্যানসার শরীরের কোথাও ছড়িয়ে না পড়লে। পেটের যা আছে সব ফেলে টেলে ব্যাগ ব্যাগ রক্ত দিয়ে পাঁচ ঘন্টার অপারেশন শেষে ত্বক শেলাই করার আগে লিভারে হাত দিয়ে দেখেছে লিভারে মেটাসটাসিস ক্যানসার। লিভারে হাতটা অপারেশন শুরু করার সময় দিতে পারতো। ডাক্তারদের জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন তারা লিভারটা দেখে নেয়নি। ডাক্তাররা বলেছিলো লিভারের রিপোর্ট নাকি ভালো এসেছিলো। তার মানে বারডেমের ল্যাবরটরিও খারাপ? মার ওই অপারেশনকে ভুল অপারেশন বলার চেয়ে ক্রাইম বলাই ভালো। এত দীর্ঘক্ষণের অপারেশনে ক্যানসার দ্রুত ছড়ায়। রক্তই যেহেতু ক্যানসার ছড়ানোর বড় এক মাধ্যম। এই ক্রাইমটা না হলে মা আরও বেশিদিন বাঁচতে পারতো। দেশ বিদেশের হাসপাতালগুলোয় মানুষ শুধু বাঁচানোই হয় না, মানুষ মারাও হয়। এখন ভাগ্য ভালো কী মন্দ সেটাই দেখার বিষয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *