মেঘে মেঘে টক্কর

মেঘে মেঘে টক্কর

আমাদের এ বাদলার দেশে বোশেখ মাস থেকেই শুরু হয় কালবোশেখির ঝড়। ক্রমে ক্রমে আসে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ-বর্ষা শুরু হয় পুরোদমে।

বর্ষার এই সময়টা এমনি যে, দিন নেই, রাত নেই, টিপ টিপ ঝম ঝম বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছে। তাছাড়া আবার মাঝে মধ্যেই আছে ঝড়। আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমে, শোঁ শোঁ বাতাস বইতে থাকে, কড় কড় করে বিজলি ঝিলিক দিয়ে যায়। তারপর আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ঝড় ওঠে। ভাঙ্গে মানুষের বাড়ি-ঘর, নষ্ট হয় মাঠভরা ফসল-মাতাল ঝড়ের দাপটে দুনিয়া থর থর করে কাঁপতে থাকে।

ঝড়ে অনেক সময় লোকও মারা যায়। ১৩৭৬-এর পয়লা বোশেখ এক আচমকা ঘূর্ণিঝড়ে ঢাকা আর কুমিল্লায় হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল। চাটগাঁয় একবার ঝড়ে মারা পড়েছিল প্রায় তিন হাজার লোক। তাছাড়া কত লোকের বাড়ি-ঘর ভেঙ্গেছে তার তো লেখাজোখাই নেই। ঝড়ের সময় বাজ পড়েও অনেক লোক মারা যায়।

শুধু আমাদের দেশেই নয়- প্রত্যেক বছর সারা দুনিয়ায় বহু লোক এমনি করে প্রাণ হারায়। বিজ্ঞানীরা হিসাব করে দেখেছেন সারা দুনিয়ায় বছরে বজ্রসহ ঝড়বৃষ্টি হয় নব্বই কোটি বারেরও বেশি–গড়পড়তা মিনিটে ১৮,০০০ বারের মতো।

এই সব বজ্র-বিদ্যুৎ-ঝড়কে মানুষ ভয় করে এসেছে সেই আদিকাল থেকে।

আগের দিনের লোকেরা মনে করত, ঝড় আর বজ্র নিশ্চয়ই দেবতাদের কাণ্ডকারখানা। দেবতারা যখন কোন কারণে মানুষের ওপরে অসন্তুষ্ট হন তখনই ঝড়ে ঘড়-বাড়ি ভাঙ্গে। তাদের ক্রুদ্ধ অভিশাপ নিয়ে বজ্র নেমে আসে; মাঠের ওপর যেখানে বজ্র পড়ে সেখানকার ফসলের চারাগুলো পুড়ে কালো হয়ে ওঠে। নানান দেশের পুরাণ আর ধর্মীয় কাহিনীতে ঝড়ের দেবতা, বজ্রের দেবতার কথা পাওয়া যায়। যেমন, ইউরোপের দেবরাজ জুপিটার, বজ্রের দেবতা থর; কিংবা হিন্দুদের দেবরাজ ইন্দ্র, বরুণ।

বজ্ৰ যে কি জিনিস তা এখনও আমাদের দেশে অনেকেই জানে না। কেউ কেউ মনে করে, বিজলি চমকাবার সময় বুঝি ফেরেশতাদের সোনার কোড়ার টুকরো ভেঙ্গে পড়ে পৃথিবীর ওপর। প্রবাদ আছে, কলা গাছের ওপর বাজ পড়লে সেখানে মাটি খুঁড়ে সোনা পাওয়া যায়।

আজ থেকে প্রায় আড়াইশো বছর আগে আমেরিকার বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিন এই বজ্রের রহস্য ভেদ করেন।

সে এক তুমুল ঝড়ো দিন। কিন্তু সেই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেই ফ্র্যাংকলিন তাঁর রেশমী ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়েছেন আকাশে। ঘুড়ির সুতোর মাথায় তিনি লাগিয়েছেন একটা লোহার চাবি। সেই চাবির গায়ে হাত দিয়ে বুঝা গেল, চোখ ধাঁধাঁনো আলোর ঝিলিক দিয়ে আকাশ থেকে কড় কড় করে যে বাজ পড়ে সেটা বিদ্যুৎ ছাড়া আর কিছুই নয়। সঙ্গে সঙ্গে বাজের হাত থেকে বাঁচবার একটা কায়দাও জানা গেল; বাড়ির ওপর উঁচু করে সরু সরু তার বসালে বাজ পড়ার বিজলি সেই তার বেয়ে সহজেই মাটির ভেতরে চলে যেতে পারে।

আলো চলে এক সেকেণ্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার বা এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল বেগে। তাই আকাশের মেঘে বিজলি চমকালে আমরা চোখের পলকে তার আলো দেখতে পাই; কিন্তু কানে তালা লাগানো শব্দটা আমাদের কাছে এসে পৌঁছতে বেশ কিছুক্ষণ সময় নেয়। শব্দ প্রায় তিন সেকেণ্ডে এক কিলোমিটার পথ চলতে পারে। কাজেই বিজলির চমকানি দেখা দেবার পর তার শব্দ শুনতে যে কয় সেকেণ্ড সময় লাগে তাকে তিন দিয়ে ভাগ করলেই জানা যায় মেঘটা পৃথিবী থেকে কত কিলোমিটার উঁচুতে রয়েছে।

বিজলি আজ আর মানুষের কাছে চুম নতুন জিনিস নয়। বিজলিকে মানুষ হরেক রকমের কাজে লাগিয়েছে। মানুষের ঘরে ঘরে জ্বলছে বিজলির আলো, কল-কারখানা চলছে বিজলির জোরে। সারা দেশ জুড়ে থাম পুঁতে বসানো হয়েছে বিজলির তার। কিন্তু কোথাও বিজলির তারের ওপর বাজপড়ল কি সর্বনাশ হল সব আলো দপ, করে নিভে যাবে।

এই বিজলির যুগে আজ অনেকের। বাড়িতেই রেডিও আছে। হয়তো বৃষ্টির সময় দিব্যি আরামে ঘরে বসে। গান-বাজনা শুনছ; কিন্তু যদি বাইরে বিজলি চমকাতে থাকে তাহলে রেডিওতে শুরু হবে উপদ্রব।

কাজেই এই সব বিপদ এড়ানোর জন্যে আকাশের বিজলির কথা ভাল করে জানা দরকার। এই বিশ শতকের গত কয়েক দশকে বিজ্ঞানীদের চেষ্টার ফলে এ বিষয়ে অনেক নতুন কথাই জানা গিয়েছে।

ঝড় কি করে হয়, জান তো? ধর কোন জায়গার ভেজা বাতাস আশেপাশের বাতাসের চেয়ে গরম হয়ে উঠল। তখন এই বাতাস হালকা হয়ে ওপরের দিকে ওঠে, আর ওপরের ফাঁকা জায়গা পেয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ দিকে বাতাস যতই ছড়িয়ে পড়ে ততই সেটা ঠাণ্ডা হয়। সাইকেলের চাকায় পাম্প করে চেপে বাতাস পোরবার সময় বাতাসটা গরম হয়ে ওঠে–পাম্পের গায়ে হাত দিলেই সেটা টের পাবে। এখানে হয় তার উলটো ব্যাপারটা।

বাতাস ঠাণ্ডা হতে থাকলে ওর ভেতরকার জলীয় বাষ্পগুলো জমে গুঁড়ো গুড়ো কুয়াশার কণা হয়, তারপর বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে পৃথিবীর বুকে নেমে আসতে থাকে। বেশি ঠাণ্ডা হলে এই সব বৃষ্টির ফোঁটা জমে শিল হয়ে যায়।

কখনো কখনো ওপর দিকে ওঠা গরম বাতাস আর নিচের দিকে নামা ঠাণ্ডা বাতাসে ঠোকাঠুকি লেগে যে প্রলয় কাণ্ড বাধে সে আর বলবার নয়। আকাশের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা, শিল ঠাণ্ডা আর গরম হাওয়ায় মিলে তুমুল ঘূৰ্ণিনাচন চলতে থাকে–বাতাসের বেগ তাতে ঘণ্টায় দেড়শো কিলোমিটারের ওপর ওঠে কখনো কখনো এই বাতাসের সঙ্গে তিন লক্ষ টন পর্যন্ত পানি ভেসে থাকে! ঝড়ো মেঘের এই প্রলয় নাচন আর লুটোপুটির ফলে বাতাসের ঘষায় ঘষায় মেঘের ফোঁটায় তৈরি হয় ঘর্ষ বিদ্যুৎ। কাঁচের গায়ে রেশম বা শুকনো চুলে চিরুনি ঘষলেও এমনি বিদ্যুৎ তৈরি হয়।

আকাশের বিদ্যুৎ সম্বন্ধে জানার জন্যে বিজ্ঞানীরা নানা রকম পরীক্ষা করেছেন। যেমন ধর, মেঘের ওপরকার বিদ্যুতের অবস্থা জানবার জন্যে তারা সরু তারের সাথে ছোট ছোট বেলুন বেঁধে উড়িয়ে দিলেন। মেঘের বিদ্যুৎ সেই তার বেয়ে নেমে এল মানুষের কাছে। দেখা গেল, ঝড়ো মেঘের মাথার ওপরটা সব সময়েই পজিটিভ বিদ্যুৎ ধর্মী হয়। তলার দিকটা থাকে নেগেটিভ বিদ্যুৎ ধর্মী; তবে তার মাঝে এখানে ওখানে একটু আধটু জায়গায় ওয়েসিসের মতো পজিটিভ বিদ্যুৎ লেগে থাকে। উইলসন নামে একজন বিজ্ঞানী পরীক্ষা করে দেখিয়েছেন, বাজ পড়বার সময় সাধারণত মেঘের গায়ে থাকে নেগেটিভ বিদ্যুৎ আর পৃথিবীর ওপরটা হয় পজিটিভ। নেগেটিভ বিদ্যুৎওলা ঝড়ো মেঘ যেখান দিয়ে উড়ে যায় তার বিদ্যুতের আকর্ষণে পৃথিবীর ওপরকার পজিটিভ বিদ্যুৎ এক ঝাক মৌমাছির মতো সঙ্গে সঙ্গে ছুটতে থাকে।

এক একটা ঝড়ো মেঘে যে পরিমাণ বিজলি জমে, মাপতে গেলে তার পরিমাণ হবে বিরাট। কোন মেঘে যদি প্রত্যেক দশ সেকেণ্ডে একবার করে বিজলি চমকায় তাহলে বুঝতে হবে তাতে দশ লক্ষ কিলোওয়াট শক্তি রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে একটি বড়সড় পাওয়ার হাউস যে পরিমাণ বিজলি তৈরি করে তার সমান।

মেঘ আর পৃথিবীর নেগেটিভ আর পজিটিভ বিদ্যুতের আকর্ষণ যখন খুব বেশি হয়ে দাঁড়ায় তখন মেঘের বিদ্যুৎ পৃথিবীতে নামবার সব চাইতে সহজ পথ খুঁজে বের করার জন্যে সন্ধানী দূত পাঠায়। ছোটখাট রকমের একটা ঝলক নামে পৃথিবীতে, সাপের মতো এঁকেবেকে, ধাপে ধাপে–তার এক একটা ধাপ প্রায় পঞ্চাশ মিটার লম্বা। এতে বাতাস গরম হয়ে ওঠে। আর তার ভেতর দিয়ে সহজেই বিদ্যুৎ চলাচল করতে পারে। তখন আগের বারের চেয়ে অনেক বড় একটা বিদ্যুতের ঝলক পৃথিবী থেকে লাফিয়ে মেঘের ওপর চলে যায়, ঘণ্টায় তার বেগ হয় প্রায় সাড়ে তিন কোটি কিলোমিটার; এইটেই হল আসল বাজ পড়া। এর পরেও সাধারণত একই পথে

ঝলকে ঝলকে এদিক ওদিক আরো বিদ্যুৎ আনাগোনা করে।

যে পথে বাজ পড়ে সেখানকার বাতাস হঠাৎ গরম হয়ে প্রচণ্ড রকম ফেল ওঠে। তারপর এই গরম বাতাস যখন আবার ঠাণ্ডা হয়ে চুপসে যায় তখন চারপাশ থেকে আরো বাতাস ছুটে এসে তার জায়গা দখল করে। বাতাসের এই আলোড়নেই আমরা বাজ পড়ার কানে-তালা লাগানো কড়-কড় শব্দ শুনতে পাই।

বাজ পড়ে শুধু যে মানুষের ঘড়-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় তা নয়। বাজ মানুষের উপকারও করে। বাতাসের পাঁচ ভাগের চার ভাগই তো হল নাইট্রোজেন গ্যাস কজেই প্রত্যেক বার বিজলি চমকাবার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রচুর পরিমাণ নাইট্রোজেন গ্যাস বৃষ্টির পানির সঙ্গে মিশে তৈরি হয় নাইট্রাস অ্যাসিড; তারপর তা বৃষ্টির সঙ্গে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে। এই নাইট্রোজেন সব রকমের গাছপালা ফসলের জন্যে অপরিহার্য। গাছপালা থেকেই মানুষ বা অন্যান্য জন্তু-জানোয়ার এই নাইট্রোজেন নেয়। আবার গাছপালা, ঝরাপাতা, জন্তু-জানোয়ার পচবার ফলে অরত নাইট্রোজেন বেরিয়ে মিশছে বাতাসে।

বাতাসের বেশির ভাগ নাইট্রোজেন হলেও গাছপালা বাতাস থেকে যে নাইট্রোজেন নিতে পারে না–মাটির রসের ভেতর থেকে রাসায়নিক লবণের। আকারে নেয়। আকাশের বিজলি বাতাসের নাইট্রোজেনকে গাছপালার খাদ্য করে মাটির বুকে ফিরিয়ে দেয়। একজন বিজ্ঞানী হিসাব করে বলেছেন, আকাশের বিজলি থেকে বছরে প্রায় দশ কোটি টন নাইট্রাস অ্যাসিড তৈরি হয়। সারা দুনিয়ার সবগুলো সার কারখানা মিলেও গাছপালার জন্যে এত সার তৈরি করে না। এমনি করে ঝড়ো মেঘ প্রকৃতির জীবন-প্রবাহকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

বাজ আর বিজলি সম্পর্কে নানা রকম পরীক্ষা করতে করতে আজকাল বিজ্ঞানীরা পাওয়ার হাউস থেকে বহু দূরে বিজলি বয়ে নিয়ে যায় যেসব তার সেগুলোকে বাজ পড়ার হাত থেকে বাঁচবার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। তাছাড়া এমন সব শক্তিশালী যন্ত্র তৈরি হয়েছে যা দিয়ে আকাশের বিজলির মতো বড় বড় বিজলির ঝলক আজকাল ঘরে বসেই তৈরি করা যায়।

কে বলবে, একদিন হয়তো মানুষ আকাশের বাজকেও আয়ত্ত করার কায়দা শিখে ফেলবে। সেদিন মেঘের বিজলি সরাসরি আমাদের ঘরে ঘরে আলো দেবে, তাপ দেবে, শক্তি দেবে। আর সব চাইতে বড় কথা, ঝড় আর বজ্রের ভয় সেদিন মানুষের আরো অনেক কমে যাবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *