ঠাণ্ডা লেগে কাবু

ঠাণ্ডা লেগে কাবু

একটু শীত শীত পড়তে শুরু করেছে কি না করেছে অমনি নীলুর শুরু হয়ে গেল : হ্যাঁ-চ্‌- চো-, হ্যাঁ-চ্‌-চো-! সে হাঁচি আর থামতে চায় না। সারা দিন নাক দিয়ে কেবল পানি গড়ায়। মুছতে মুছতে নাক টষ্ট করছে। হাঁচতে হাঁচতে সারা মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে।

কি ব্যাপার?–না, ঠাণ্ডা লেগেছে। ওর অমনি। একটু ঠাণ্ডা লাগলেই নাকের পানি চোখের পানিতে একাকার হয়। গলায় সেঁক-টেক দিতে হয়। গরম জামা-কাপড় পরে বাড়িতে বসে দু’চারটে বড়ি-টড়ি গিলতে হয়। তারপর হপ্তা খানেক পরে সর্দি থামে।

কিন্তু আবার! শীত চলে গিয়ে একটু আধটু গরম পড়তে শুরু করেছে। আর সবাই হয়তো বলছে : আহা কি মিষ্টি বসন্তের হাওয়া। কিন্তু না, নীলুর শুরু হয়ে যায় সেই ফ্যাঁচ-চো, ফ্যাঁচ-চো। আবার সেই নাকে পানি! বাইরে তো বেরুবার। উপায় নেই। তাই নীলু চোখমুখ ফুলিয়ে ঘরেই বসে থাকে।

এবার কি হল? না, হঠাৎ কি করে নীলুর আবার ঠাণ্ডা লেগে গিয়েছে।

ও–, ভাবছ বুঝি ঠাণ্ডা লাগলেই সর্দি হয়, কিন্তু তাহলে মেরুর দেশের লোকদের তো সারা বছর সর্দি লেগেই থাকত। ওদের নাকের পানির স্রোত আর কিছুতেই ঠেকান যেত না।

কি বললে? ওদের সহ্য হয়ে গিয়েছে? জ্বী না, তা নয়। গরমের দেশ থেকে যারা মেরুর রাজ্যে অভিযানে গিয়েছে, তাদেরও তো ওখানে একদিনও সর্দি লাগেনি। বরং মেরু-অভিযাত্রীরা ওই ঠাণ্ডার রাজ্যে থেকে গরমের দেশে ফিরে এলেই তাদের সর্দিতে পেয়েছে। তবে আমাদেরই বা ঠাণ্ডা লেগে সর্দি হয় কেন?

হ্যাঁ, এইবার এসো। গোলমেলে প্রশ্ন। জবাব পেতে বিজ্ঞানীদের কাছে যেতে হবে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, আসলে শুধু ঠাণ্ডা লাগলেই সর্দি হয় না। সর্দি হয় এক রকম খুদে খুদে জীবাণু থেকে। একটু ঠাণ্ডা স্যাঁতসেঁতে ভাব হলে এই জীবাণুগুলো মানুষের শরীরের আক্রমণ করার বেশি সুবিধে পায়।

হয়তো জিজ্ঞেস করবে ও সর্দি যে জীবাণু থেকে হয় তার প্রমাণ কি? সে প্রমাণও দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। তারা দেখেছেন অথই মহাসমুদ্রের মধ্যে সভ্য জগৎ থেকে দূরে অনেক ছোট ছোট দ্বীপ আছে, যেখানে কখনো কারো সর্দি হয় না। কিন্তু হয়তো দেখা গেল বাইরের কোন দেশ থেকে একটা জাহাজ এসে ভিড়েছে সেখানে। সে জাহাজের কারো বুঝি সামান্য একটু সর্দি ছিল। ব্যস সঙ্গে সঙ্গে সেই সর্দি ছড়িয়ে পড়ল সারাটা দ্বীপ জুড়ে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে সর্দি একটা সংক্রামক ব্যাপার–একজন থেকে আরেক জনের হয়; আর সেটার আসল কারণ হচ্ছে এক রকম জীবাণু। এ জীবাণুও কিন্তু আর আর রোগের মতো সাধারণ জীবাণু নয়। আর সব জীবাণুর চেয়ে এগুলো আকারে অনেক ছোট–এধরনের জীবাণুদের নাম রাখা হয়েছে ‘ভাইরাস (Virus)।

অন্য সব সাধারণ জীবাণুকে অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখা যায়, কিন্তু সর্দির ভাইরাসকে অণুবীক্ষণ দিয়ে দেখবার কোন উপায় নেই। লোকের নাক থেকে তরল সর্দি নিয়ে এমন হুঁকনি দিয়ে হেঁকে ফেলা হয়েছে, যার ভেতর সাধারণ জীবাণু সব আটকা পড়ে যাবে। তারপরও সেই তরল জিনিস মানুষ বা বানরের নাকে দিয়ে দেখা গিয়েছে তাতে তাদের সর্দি লেগে যায়। মানুষ থেকেই বানর, বনমানুষ শিম্পাঞ্জী এদের সর্দি হয়।

আচ্ছা, জীবাণু থেকে যদি সর্দি হয় তবে গরমের দিনে এই জীবাণুগুলো যায় কোথায়?–গরমের দিনেও অল্প কিছু লোকের সর্দি লাগে, তাতেই জীবাণুগুলো সব সময় বাসা বাঁধবার একটা না একটা জায়গা পায়ই। তাছাড়া কিছু লোকের শরীরে সর্দির জীবাণু থাকলেও বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায় না; তারাই জীবাণুগুলোকে বয়ে নিয়ে বেড়ায়।

জীবাণু থেকে সর্দি হয় বলে যে জীবাণু নাকের ভেতর ঢুকলে অমনি সর্দি লাগবে এমন কোন কথা নেই। আবহাওয়া আর পরিবেশের ওপরও অনেকখানি নির্ভর করে। তাছাড়া অনেক সময় একজনের খুব সর্দি, অথচ তার কাছাকাছি থেকেও আরেকজনের হয়ত মোটেই সর্দি লাগল না। এই ব্যাপারগুলোকে বিজ্ঞানীরা আজো পুরোপুরি বুঝতে পারেন নি। এসব ব্যাপার নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।

সর্দি নিয়ে বিজ্ঞানীরা আগে বিশেষ মাথা ঘামান নি। তার কারণ সর্দিতে কাজকর্ম করা মুশকিল হলেও ব্যাপারটাকে লোকে তেমন গায়ে লাগায় না। ডাক্তারের কাছে যদি লোকে সর্দির ওষুধের জন্যে না আসে আর দু’পয়সা রোজগার হয় তাহলে ডাক্তার সর্দি নিয়ে মাথাই বা ঘামাবে কেন?

আজকাল সর্দি সম্বন্ধে নানা রকম গবেষণা হচ্ছে। তবে তার একটা মস্ত বড় অসুবিধে হল ইঁদুর, গিনিপিগ এমনি যে সব জীবের ওপর অন্যান্য রোগের পরীক্ষা হয়, তাদের কারো সর্দি লাগে না। লাগে কেবল মানুষের আর শিম্পাঞ্জী, গরিলা এই সবের। কিন্তু শিম্পাঞ্জী, গরিলা তো আর গবেষণাগারের জন্যে হাজারে হাজারে পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় কেবল মানুষ। কাজেই সর্দি পরীক্ষার জন্যে সরাসরি মানুষকেই গিনিপিগ বানাতে হয়।

বিজ্ঞানীরা এ সব পরীক্ষা থেকে দেখেছেন, একজন সুস্থ মানুষের নাকের কাছে এসে সর্দি ঝাড়লে, কিংবা তার নাকে তরল সর্দির কয়েক ফোঁটা ঢেলে দিলেও মোটামুটি শতকরা পঞ্চাশ জনের সর্দি লাগে–বাকি পঞ্চাশ জনের লাগে না। তাদের কেন লাগে না, সে এক সমস্যা অর্থাৎ মোটামুটি অর্ধেক লোক সামান্য সর্দির আক্রমণকে ঠেকাতে পারে। অবশ্য এই ঠেকানোর ক্ষমতাও যে সব সময় একই রকম থাকবে তার কোন মানে নেই। আজ যার সর্দি হচ্ছে না, হয়তো সাত দিন পরে তারও হবে।

একবার বিলেতে প্রায় দু’হাজার লোককে নিয়ে এমনিভাবে সর্দি লাগানোর একটা পরীক্ষা করা হয়। তাতে দেখা যায় অনেকেরই প্রথম দিনে একটু সর্দির ভাব হলেও সেটা তার পরদিনেই সেরে গিয়েছে। সম্ভবত বেশির ভাগ সর্দি এইভাবে আপনা আপনি দমে যায়। পরীক্ষায় আরো ধরা পড়েছে, সর্দি বয়সের তেমন বাছবিচার করে না। দেখা যায় ১৮ থেকে ৪০ বছরের লোকদের সবারই প্রায় সমানভাবে সর্দি লাগছে।

সর্দির ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করার একটা অসুবিধে হচ্ছে অন্যান্য জীবাণুর মতো একে সহজে চাষ করা যায় না। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন অন্যান্য ভাইরাসের মতো একে মুরগির ডিমের কুসুমে চাষ করতে–কিন্তু এটা এখনও সবক্ষেত্রে সফল হয় নি।

খুব সূক্ষ্ম জালের ভেতর দিয়ে সর্দি হেঁকে দেখা গিয়েছে ৫৭ মিলিমাইক্রন ফাঁকের ভেতর দিয়েও সর্দির জীবাণু পেরিয়ে যেতে পারে–অথচ আর কোন জীবাণু তা পারে না। তাতে মোটামুটি সর্দির জীবাণুর ব্যাস ধরা যায় ৬০ মিলিমাইক্রন –অর্থাৎ প্রায় দেড় লাখ ভাইরাস পাশাপাশি সাজালে তবে তার মাপ হবে এক সেন্টিমিটার। সব সর্দির ভাইরাস আবার এক নয়। বিজ্ঞানীরা নানা মাপের অন্তত বিশ রকমের সর্দির ভাইরাসের খোঁজ পেয়েছেন।

আজকাল নানা রকমের অ্যান্টিবায়টিক ওষুধ বেরোবার ফলে রোগ জীবাণুদের ঘায়েল করা অনেক সহজ হয়ে উঠেছে। অন্যান্য বেশির ভাগ জীবাণুকেই পেনিসিলিন বা স্ট্রেপটোমাইসিন দিয়ে কাবু করা যায়; কিন্তু সর্দির ভাইরাসকে এভাবে মোটেই কাবু করা যায় না। ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাস রক্তের লাল কণার মধ্যে মিশে যায়, সর্দির ভাইরাস তাও যায় না।

ঠিক কতটা ভাইরাস শরীরে ঢুকলে সর্দি লাগবে তা বলার কোন উপায় নেই। তার কারণ এক এক জনের শরীরে সর্দি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা এক এক রকম। তবে পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, কারো নাক থেকে তরল সর্দি নিয়ে তাতে হাজার গুণ পানি মেশাবার পরেও তার কয়েক ফোঁটা আরেকজন সুস্থ লোকের নাকে দিলে তার সর্দি লেগে যায়।

মুখের লালার মধ্যেও সর্দির জীবাণু থাকে। হাঁচি দেবার সময় এই সব জীবাণু ছিটকে বেরিয়ে আসে। হাঁচির কণা বাতাসে অনেকক্ষণ ধরে ভাসতে থাকে। হয়তো কাপড়-চোপড়ে, ঘরের আসবাবপত্রে গিয়ে লাগে। তারপর আবার শুকিয়ে গিয়ে বাতাসে ওড়ে। রুমালে যে সর্দি শুকিয়ে লেগে থাকে, রুমাল ঝাড়লে তাও বাতাসে মিশে যায়। এই সব জীবাণু সুস্থ মানুষের নাকে গেলে তারও সর্দি লাগে।

সর্দি নিয়ে একটা মুশকিল হচ্ছে হাম ইত্যাদি রোগ যেমন একবার হয়ে গেলে একই লোকের সহজে আর হয় না–শরীরে আপনা আপনি একটা প্রতিরোধ শক্তি জন্মে যায়–সর্দির বেলায় সাধারণত তেমনটা হয় না। একবার সর্দি হয়ে সেরে যাবার দু’-এক সপ্তাহ পরেই হঠাৎ আবার সর্দি লেগে যেতে পারে। এর একটা কারণ হয়তো এই যে, হাম, ইনফ্লুয়েঞ্জা এসব রোগের জীবাণু রক্তে গিয়ে মেশে; আমাদের দেহে রোগ ঢোকাবার জন্যে যে সব অ্যান্টিবডি বা প্রতিবীজ জন্মায় সেগুলোও থাকে রক্তে। কিন্তু সর্দির বেলায় জীবাণু থাকে নাকের এবং শ্বাসনালীর শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর ওপরে। রক্তের প্রতিবীজ সেখানে তাদের কাবু করতে পারে না।

সর্দির ব্যাপারটা এমন গোলমেলে বলে, আর এ সম্বন্ধে তেমন ব্যাপক গবেষণা না হওয়ায় সর্দির চিকিৎসাও তেমন ভাল নেই। বাজারে অনেক ওষুধ পাওয়া যায় সর্দির জন্যে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় ধরা পড়েছে, বেশির ভাগ ওষুধ ব্যবহারে যে ক’দিনে সর্দি সারে, সে ওষুধ ব্যবহার না করেও মোটামুটি সেই ক’দিনেই সারে। সাধারণত অনেক সর্দি প্রথম অবস্থায় আপনা আপনি দমে যায়; তার ফলে অনেকের ধারণা হয় বুঝি ওষুধের বদৌলতেই সর্দি কাবু হয়েছে। কোন কোন ওষুধ দিয়ে সর্দির যন্ত্রণা কিছুটা কমানো যায়; কিন্তু এর সত্যিকার ওষুধ আজো বেরোয় নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *