৯-১২. কাঁটায় কাঁটায় ভোর পাঁচটা

কাঁটায় কাঁটায় ভোর পাঁচটায় রিসেপশান থেকে ফোন। মিস্টার পি কে জি কুরুপ এসে গেছেন, অপেক্ষা করছেন লাউঞ্জে। বাইরে তখনও ছায়া-ছায়া অন্ধকার।

সঙ্গে-সঙ্গে ধুমধাড়াক্কা লেগে গেল। ওঠ, ওঠ, ওঠ। সাজ, সাজ, সাজ। রাতে আবার এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, কুমিলিতে তাপমাত্রা বেশ নেমে গেছে, সকলেই হালকা দেখে গরম কিছু চড়িয়ে নিল গায়ে। যথাসম্ভব দ্রুত তৈরি হয়ে টুপুররা যখন নীচে এল, ঘড়িতে তখন পাঁচটা পঁয়ত্রিশ।

কুরুপ সামনেটায় পায়চারি করছিলেন। টুপুরদের দেখে ব্যস্তসমস্ত ভাবে বললেন, উই আর অলরেডি লেট। গিয়ে এই ট্রিপ ধরতে না পারলে দেড়-দুঘণ্টা বসে থাকতে হবে।

পার্থ বলল, সরি, সরি। আপনাকে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখেছি।

সরিটরি পরে হবে। এক্ষুনি চলুন।

 ম্যাথুকে বলাই ছিল। কাল রাস্তায় বিচ্ছিরি কাদা লেগেছিল গাড়িতে, এই ভোরেও যত্ন করে ধুয়েমুছে ফেলেছে, বসে গেছে স্টিয়ারিংয়ে। অবনী, সহেলি উঠে পড়লেন চটপট।

মিতিন পার্থকে বলল, তুমি বুমবুমকে নিয়ে দিদি-জামাইবাবুর সঙ্গে এসো, আমি আর টুপুর মিস্টার কুরুপের গাড়িতে যাচ্ছি। উনি একা-একা পাইলট কারের মতো সামনে সামনে যাবেন, এটা মোটেই ভাল দেখায় না।

পার্থ কাঁধ ঝাঁকাল, জো হুকুম।

টুপুর বসল কুরুপের পাশে, মিতিন পিছনের সিটে। আজ সাফারি সুট পরেছেন কুরুপ, ঘিয়ে রঙের। এই ভোরেও তিনি দারুণ ফিটফাট।

গাড়ি স্টার্ট করে কুরুপ বললেন, আশা করি দিনটা আজ ভালই কাটবে।

টুপুর বলল, নিশ্চয়ই।

মিতিন ঝুঁকে কী যেন কুড়োচ্ছিল। রেয়ারভিউ মিররে দেখতে দেখতে কুরুপ জিজ্ঞেস করলেন, কিছু পড়ল ম্যাডাম?

আমার একটা হেয়ার ক্লিপ। পেয়ে গেছি।

একটু একটু করে ফরসা হচ্ছে আকাশ। মেঘ আছে বটে, তবে ভারী কিছু নয়। পাখিরা জাগছে, ভেজা-ভেজা নিৰ্জন রাস্তায় উড়ে বেড়াচ্ছে পিড়িং পিড়িং। অচেনা জায়গায় এমন স্নিগ্ধ ভোর দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।

টুপুর আনমনে বলে উঠল, আজ কি আবার বৃষ্টি হবে?

 কুরুপ বললেন, হতেই পারে। তোমরা ছাতাটাতা নিয়েছ তো?

মার ব্যাগে আছে মনে হয়।

 মাত্র একটা?

 বাবারও ছাতা ছিল। কোচিতে ফেলে এসেছে।

তাই বুঝি? ছাতা কোচিতেই রয়ে গেল?

টুপুর ব্যাগ ফেলে আসার গল্প শুরু করার আগেই মিতিনের উল্লসিত স্বর, ওই দ্যাখ টুপুর, ডান দিকের অৰ্জুন গাছটায় দ্যাখ!

কী গো?

একঝাক টিয়াপাখি। এক সঙ্গে উড়ে এসে বসল। বিউটিফুল।

পেরিয়ারে এরকম অনেক বিউটি দেখতে পাবেন ম্যাডাম। কুরুপ হাসছেন, কত যে তাদের রং, কত রকম বাহার।

টুপুর প্রশ্ন করল, পেরিয়ারে অনেক রকম পাখি আছে বুঝি?

অজস্র। অজস্র। কত বার্ডওয়াচার পেরিয়ারে শুধু পাখি দেখতেই আসে। কমন পাখির মধ্যে ভীমরাজ, পাপিয়া, কাঠঠোকরা, ময়না… তারপর ধরো, ডাহুক, মাছরাঙা, সারস, পানকৌড়ি এসব তো চোখে পড়বেই। এ ছাড়া আছে ইয়া লম্বা ঠোঁট ধনেশ, ছাইরঙা জংলি মুরগি…। তা ছাড়া এখানে নীল রঙের টিয়া দেখতে পাওয়া। যায়। এই প্রজাতির টিয়া এখন প্রায় বিলুপ্ত। তবু পেরিয়ারের জঙ্গলে। এখনও চোখে পড়ে। হঠাৎ কোনওদিন হয়তো এখানেও দেখা যাবে না, কে জানে?

পাখি প্রসঙ্গ থেকে পেরিয়ার হ্রদের গল্পে ঢুকে পড়লেন কুরুপ। পেরিয়ার লেক নাকি প্রাকৃতিক হ্রদ নয়, মানুষের তৈরি। কেরলের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী পেরিয়ারে বন্যা হত প্রতি বছর, ঘরবাড়ি ভেসে গিয়ে নাকাল হত লোকজন। তাই নাকি আঠেরোশো পচানব্বই সালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে নদীতে। আর সেই বাঁধের জল ধরে রাখার জন্য কাটা হয়েছে হ্রদ। এই লেককে ঘিরেই ত্রিবাঙ্কুরের মহারাজা গড়ে তুলেছিলেন পেরিয়ার অভয়ারণ্য। সেই অভয়ারণ্যই এখন কেরলের বৃহত্তম জঙ্গল।

কুরুপের গল্প ফুরোতে না ফুরোতে এসে গেছে থেক্কাডি চেকপোস্ট। পেরিয়ার অরণ্যের প্রবেশদ্বার। গেট পেরনোর পর থেকেই দুপাশে হালকা জল। বিশাল উঁচু-উঁচু গাছ, মধ্যিখান দিয়ে পিচরাস্তা। বৃষ্টির জল মেখে কী চকচক করছে গাছগুলো। পাখপাখালির কিচিরমিচিরকে শান্ত বনভূমি মুখর এখন।

আরও খানিকটা গিয়ে গাড়ি দাঁড় করালেন কুরুপ। টয়োটা কোয়ালিসও থেমেছে পিছনে। এই ভোরেও বেশ কয়েকটা জিপ আর প্রাইভেট কার জঙ্গলেহাজির।

টিকিট কেটে বড়-বড় পাথরের চাতাল বেয়ে, উঁচু-উঁচু ধাপি টপকে অনেকটা দূরে দাড়ানা জলযানটায় গিয়ে উঠল সবাই। এবার আর কোচির ভুলটা করেনি, গোড়াতেই উঠে গেছে দোতলায়। উপরে ভাড়া একটু বেশি, তা হোক, ভাল করে দেখা তো যাবে।

মিনিট পাঁচ-সাতের মধ্যেই ছাড়ল লঞ্চ। আঁকাবাঁকা জলপথে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘণ্টাখানেকের পরিভ্রমণ সেরে লঞ্চ যখন আবার ঘাটে ভিড়ল, টুপুরদের পেটে তখন চনচনে খিদে। লেকের পাড়ে চমৎকার সাজানো-গোছানো রেস্তোরাঁ, নেমেই দুদ্দাড়িয়ে খেতে ছুটল সকলে। ধোসা, ইডলি, পুরি, ব্রেড-ওমলেট সবই মিলবে, যার যা খুশি খাও। কুরুপ নিলেন আপ্পাম, কেরলের নিজস্ব ধোসা। মিতিন আর টুপুর অনিয়ন উত্তাপাম, বাকিরা ডিম-রুটি। গাছে গাছে ঘেরা রেস্তোরাঁর বাইরে হুপহপ ঘুরে বেড়াচ্ছে হনুমানের দল, তাদের দেখতে বারবার ছুটছে বুমবুম। হনুমান কাছাকাছি এলেই পালিয়ে আসছে তড়িঘড়ি। লঞ্চের আরও অনেকে খাচ্ছে রেস্তোরাঁয়, বুমবুমের সাহসের বহর দেখে তারা হেসে খুন।

টুপুর চুপটি করে জঙ্গলটার কথা ভাবছিল। পেরিয়ারের সৌন্দর্যে সে এখনও বিভোর। কী সবুজ, কী সবুজ! সবুজ রং যে এত গাঢ়, এত তীব্র হতে পারে পেরিয়ার না এলে বুঝি জানাই হত নাটুপুরের। জঙ্গলকে ঘিরে সহ্যাদ্রি পাহাড়, খানিক সমতল বেয়ে জঙ্গল ছড়িয়ে গেছে পাহাড়ে পাহাড়ে, হ্রদের পাড়ে দুলকি চালে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাতির পাল, হঠাৎ হঠাৎ উঁকি দিচ্ছে হরিণ, মায়াবী চোখে তাকিয়ে থাকছে লঞ্চের দিকে, জলে পানকৌড়ির আঁক, মাছরাঙা উড়ে এসে ছোঁ মেরে জল থেকে মাছ তুলে নিল, পাহাড়ের গায়ে গম্ভীর দাঁড়িয়ে বাইসন, সকালের রোদে ঝকঝক করছে তাদের শরীর, মাথার ওপর ট্যাঁ-ট্যাঁ ডেকে উঠল নাম না-জানা পাখি– আহা, পেরিয়ার সত্যিই তুলনাহীন। সবচেয়ে বেশি আকর্ষক বুঝি জলে মাথা তুলে থাকা গাছের গুঁড়িগুলো। পার্থমেসো বলছিল, ওগুলো নাকি জঙ্গল কেটে লেক বানানোর স্মৃতিচিহ্ন। একশো বছরেরও উপর গাছের কঙ্কাল জলে রয়ে গেছে, ভাবা যায়?

অবনী কাউন্টার থেকে একখানা ইংরেজি খবরের কাগজ এনে পড়ছিলেন। হঠাৎই উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, এই দ্যাখো, দ্যাখো, কোচির সিনাগগের খবরটা কত বড় করে বেরিয়েছে।

কুরুপ মুখে আপ্পাম পুরছিলেন। থমকে গিয়ে বললেন, কোন খবরটা?

সিনাগগের চুরি।

ওটা তো কালই দেখেছিলাম মুন্নারে।

আরও ডিটেলে বেরিয়েছে আজ। সিনাগগের যে ছেলেটি খুন হয়েছে, তার সম্পর্কেও নিউজ আছে। ছোকরার নাম বিক্ৰমন। খুব নাকি জুয়ার নেশা ছিল ছোকরার, প্রচুর নাকি ধারধোরও করেছে। পুলিশ সাসপেক্ট করছে জুয়ার আড্ডারই কেউ একজন ওকে দিয়ে চুরি করিয়েছিল গ্রেট স্ক্রল টা। জানাজানি হওয়ার পর সেই মেরে দিয়েছে বিক্রমনকে। রিভলভারের গুলিতে মারা গেছে ছেলেটা। ডেডবডি পড়ে ছিল একটা অটোরিকশার সিটে। চিতুর রোডের লাগোয়া কোন গলিতে।

সহেলি বিস্মিত স্বরে বললেন, আমরা চিতুর রোডের হোটলে ছিলাম না?

হুম। ছেলেটারও মনে হয় ওইদিকেই বাড়ি। পুলিশ আরও কিছু ক্লু পেয়েছে। ছেলেটা যে জুয়ার আড্ডায় যেত, ওখানে নাকি এক দাগি ক্রিমিনাল আসত মাঝেমধ্যে। লোকটা নাকি এক সময়ে পেশাদার গাইড ছিল, ফরেনারদের নিয়ে কেরলে টুর করাত। বছর সাত-আট হল প্রফেশান বদলে অ্যান্টিক চোর হয়েছে। একবার চেন্নাইতে ধরা পড়েছিল, মিউজিয়াম থেকে রেয়ার নটরাজ চুরি করতে গিয়ে। অনেককাল সে কেরলের বাইরে ছিল। সম্প্রতি তাকে কোচিতে দেখা গেছে বলে তাকেই সন্দেহ করছে পুলিশ।

 পার্থ জিজ্ঞেস করল, তা তাকে ধরছে না কেন?

নিশ্চয়ই খুঁজে পাচ্ছে না, তাই।

কুরুপ প্রশ্ন করলেন, লোকটার নাম দিয়েছে কাগজে?

অপরাধ জগতে আসার আগে সে ছিল টি জোসেফ। এখন নাকি তার অষ্টোত্তর শত নাম। তামিলনাড়ুতে তিনি সেলভান, অষ্ট্ৰে মুথুস্বামী, কর্নাটকে আয়াপ্পান …

সেলভান নামটা যেন শোনা-শোনা লাগছে। কোনও এক মন্দিরের মূর্তি চুরির কেসে সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে নামটা বোধ হয় কাগজে বেরিয়েছিল। কুরুপের ভুরুতে ভাঁজ, বছর দু-আড়াই আগে।

তার মানে তিনি তা স্বনামধন্য ব্যক্তি! মিতিন বলে উঠল, দু- আড়াই বছর পরেও নামটা যখন লোকের মনে থাকছে!

অবনী বললেন, খবরটা থেকে একটা ইনফরমেশান কিন্তু ক্লিয়ার মিতিন।

কী বলুন তো?

তোমার ডিকশানই ঠিক। সাইমন পেরেজ বা জোস হ্যালেগুয়া কিন্তু এই চুরির সঙ্গে কোনওভাবেই যুক্ত নন। সিনাগগের রাবি বা কেয়ারটেকারকে যে আমরা সন্দেহ করছিলাম তার কোনও ভিত্তি নেই।

কথাটা ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে বলছিলেন অবনী, মর্মার্থ অনুধাবন করে কুরুপও বেশ আশ্চর্য হয়েছেন। বললেন, এক্সকিউজ মি, একটা প্রশ্ন না করে পারছি না। চুরিটা নিয়ে আপনারা এত এক্সাইটেড কেন?

পার্থ বলল, কারণ, চুরিটা প্রায় আমাদের চোখের সামনে ঘটেছে।

অ্যাঁ?

না, চোর আমাদের দেখিয়ে চুরি করেনি। আমরা পরশু, আই মিন রোববার, সিনাগগের কর্তাব্যক্তিদের জপিয়ে-জাপিয়ে গ্ৰেট স্ক্রল দেখতে গেছিলাম এবং তখনই চুরিটা প্রথম ডিটেক্টেড হয়।

হা, কাগজে কাল দেখছিলাম বটে। একদল বাঙালি টুরিস্ট সিনাগগে গিয়েছিলেন, তখনই …. আপনারাই তারা?

ইয়েস স্যার। শুধু মুন্নার মাটুপেট্টি নয়, কোচিতেও আমাদের একটা খটোমটো অভিজ্ঞতা হয়েছে। বলতে বলতে পার্থ থেমে গেল আচমকা। চোখ সরু করে ভাবছে কী যেন, কাটায় গেঁথেও ওমলেট মুখে পুরছে না। তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে। উঠল, আচ্ছা মিতিন, এমন কি হতে পারে …?

মিতিন খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে দেখছিল। চোখ তুলে বলল, কী?

সেদিন সিনাগগে থাকার কারণেই আমরা কোনওভাবে চুরিটার সঙ্গে জড়িয়ে পড়িনি তো? হয়তো আমাদের অজ্ঞাতসারেই? হয়তো তার আফটার এফেক্ট হিসেবেই মুন্নারে চুরির অ্যাটেমপ্ট? মাটুপেট্টির ছিনতাই?

হতে পারে। মিতিন ঠোঁট ওলটাল, না-ও হতে পারে।

তোমার লজিক কী বলছে?

এখনও ওই অ্যাঙ্গেলে ভাবিনি।

ভাবো। ব্রেনটা খাটাও। আমার তো মন বলছে ডালমে কুছ কালা হ্যায়।

কুরুপ উদ্বিগ্ন মুখে বললেন, কেন আপনার ওরকম মনে হচ্ছে মিস্টার মুখার্জি?

ওর কথা বাদ দিন মিস্টার কুরুপ। মিতিন হেসে উঠল, আমার হাজব্যান্ড সবেতেই বিপদের গন্ধ পায়।

কুরুপ মাথা নাড়লেন, ম্যাডাম, আমি তবু বলব সাবধানের মার নেই। বিশেষত মিস্টার মুখার্জির মনে যখন একটা খটকা জেগেছে। আমার তো মনে হয় রাস্তাঘাটে আপনাদের ঘোরাফেরা বেশি না করাই ভাল।

মিতিন আরও জোরে হেসে উঠল, কেন, আপনি তো আছেন সঙ্গে।

তা আছি। কুরুপও হেসে ফেললেন, তবে আমি তো আর আজকের পরে থাকছি না। এখান থেকে আপনারা যাচ্ছেন কোথায়? আলেপ্পি তো?

সেরকমই তো প্ল্যান আছে। কাল সকালে রওনা দিয়ে ভায়া কোট্টায়াম আলেপ্পি। তার পরের দিন কোভালাম, তার পরের দিন কন্যাকুমারিকা।

যেখানেই যান, একটু অ্যালার্ট থাকবেন।

সহেলি কাতর স্বরে বললেন, আপনিও তিনটে দিন আমাদের সঙ্গে থাকুন না মিস্টার কুরুপ। আমার বোন তো মরে গেলেও টুর ক্যানসেল করবে না, আপনি থাকলে আমি অন্তত মনে একটু জোর পাই।

আপনাদের সঙ্গ তো আমার খুব ভালই লাগছে ম্যাডাম। কিন্তু আমাকে যে কাল সকালে পারাম্বিকুলম স্যাংচুয়ারির পথে বেরিয়ে পড়তে হবে। আমার এক পুরনো বন্ধু, তিনিও একজন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার, পারাম্বিকুলমে আমার জন্য ওয়েট করবেন। আমরা দুজনে মিলে কোচিতে একটা এগজিবিশনের প্ল্যান করছি, তার থিম নিয়ে জরুরি আলোচনা আছে।

অতঃপর আর তো অনুরোধ চলে না, সহেলি চুপ মেরে গেলেন। খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল সবাই। কুরুপই বিল মেটাতে যাচ্ছিলেন, পার্থ জোর করে আটকাল তাঁকে।

এবার কুরুপের গাড়িতে মিতিনের বদলে পার্থ। মাইকেল্স ইনে পৌঁছে আপাতত বিদায় নিলেন কুরুপ। টুপুররা এখন বিশ্রাম-টিশ্রাম করুক, তিনি আবার চারটে নাগাদ এসে মশলা বাগান দেখাতে নিয়ে যাবেন।

রুমে এসে মিতিন সহেলিকে বলল, কী দিদি, এখন কী প্ল্যান?

কিছুই না। স্নানটান সারব।

 এমন সুন্দর সকালটা বয়ে যাবে? সবে দশটা বাজে; একটু মেন মার্কেটের দিকে গেলে হত না?

খেপেছিস? শুনলি না, মিস্টার কুরুপ বেরোতে বারণ করলেন। যদি বাজার যেতে হয় তো বিকেলে যাব, যখন ভদ্রলোক সঙ্গে থাকবেন।

আহা, ভদ্রলোকের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, তোমার সঙ্গে দোকানে দোকানে টোটো করবেন! দৃষ্টিকটু বলে তো একটা কথা আছে, না কি?

মোটেই না। মিস্টার কুরুপ অতি সজ্জন মানুষ, তিনি কিছু মনে করবেন না।

টুপুর ফস করে বলল, আমরা এখন ম্যাসাজ করাতে যেতে পারি।

মিতিন বলল, কারেক্ট। সে তো দোরগাড়ায়। ভাল করে ম্যাসাজ নিলে শরীর মন ঝরঝরে হয়ে যাবে। তোর মা-র আশা করি ওখানে যেতে আপত্তি হবে না?

সহেলি যেন ঈষৎ দোলাচলে। বললেন, এত কাছাকাছি কোনও বিপদ নেই, কী বল?

কোথাও বিপদ নেই দিদি। আমি তো আছি, চলে এসো।

বেরনোর সময়ে উলটো দিকের ঘরে একবার উঁকি দিয়ে এল টুপুর। রুমে ঢোকার আগে পার্থমেসো ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে দাবার বোর্ড কিনে এনেছে, দুই মহারথী আবার রণক্ষেত্রে মুখোমুখি। বুমবুম যথারীতি ড়ুবে আছে কার্টুন চ্যানেলে। হাতে চিপসের প্যাকেট।

মালিশাগারে এসে টুপুর-সহেলিকে ঢুকিয়ে দিয়ে মিতিন বলল, তোরা মা-মেয়ে টেবিলে শুয়ে পড়, আমি একটু আসছি।

কোথায় যাচ্ছ?

একটা দরকারি কাজে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এসে পড়ব।

মার্কেটিং করবে?

ওটা তো তোর মা-র ডিপার্টমেন্ট। অন্য কাজ। পরে বলব।

টুপুরের কেমন যেন ধন্দ লাগল। কাল রাত থেকে বেশ রহস্যময়ী হয়ে গেছে মিতিনমাসি। বারবার কেন যেমন অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে। অনেক রাত অবধি কাল দাঁড়িয়েছিল ব্যালকনিতে। আজও লঞ্চে ঘোরার সময়ে উচ্ছাস দেখাচ্ছিল না বড় একটা। ভাবছে কী যেন!

নতুন কোনও বিপদের গন্ধ পাচ্ছে নাকি মিতিনমাসি? বলে না কেন? সবাই ভয় পেয়ে যাবে, তাই? হতে পারে। হতেই পারে।

.

১০.

লতানে গাছের নরম ডালটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিল টুপুর। বড়-বড় পাতার পাশে থোকা-থোকা দানা ঝুলছে। সবুজ-সবুজ। কাটা একেবারেই লিকলিকে। সবুজ দানাগুলো শুকিয়ে কালো হয়ে গেলেই গোলমরিচ। কেরলের কালোসোনা। সেই কোচি থেকেই রাস্তার দুধারে এরকম লতানে গাছ এনতার দেখেছে টুপুর, বড় কোনও গাছের গুঁড়িকে বেড় দিয়ে মাটি থেকে উঠে গেছে। ইস, আগে জানলে এরকম দানাসুষ্ঠু লতা আরও কিছু সংগ্রহ করে রাখা যেত।

কুরুপ আজ দু-দুটো মশলার বাগানে ঘুরিয়েছেন টুপুরদের। একসঙ্গে এত রকম মশলার গাছ দেখা টুপুরের এই প্রথম। শুধু টুপুর কেন, তাদের কে-ই বা দেখেছে আগে! হলুদ লঙ্কা জিরে আদা থেকে শুরু করে সেই ভ্যানিলা গাছ পর্যন্ত। যে গাছের ফল থেকে ভ্যানিলা হয়, তার পাতাতেও কী সুগন্ধ। লম্বা লম্বা সুচোলো পাতাওয়ালা এলাচ গাছের গোড়ায় ছোট্ট-ছোট্ট এলাচ ফলে আছে, লবঙ্গ ফুটে আছে ডালে-ডালে– দেখতে ভারী মজা লাগে। দারচিনি গাছের শুকনো পাতাই যে তেজপাতা, এ তথ্যও তো আজ টুপুরের জ্ঞানভাণ্ডারে জমা হল।

যাওয়া হয়েছিল কফি বাগানেও ঝোপ-ঝোপ কফিগাছ থেকে অনেক কটা ফল ছিঁড়ে এনেছে টুপুর। ওই ফলের বীজ রোস্ট করে, গুঁড়িয়ে, বাড়িতেই কফি তৈরি হয় কিনা দেখবে।

বুমবুমও পাতা জোগাড় করেছে প্ৰাণ ভরে। হলুদগাছের পাতা, আদাপাতা, এলাচপাতা, লবঙ্গপাতা, এমনকী কফি-কোকোর পাতাও। কোনটা কী পাতা গুলিয়ে ফেলছে বারবার। একটা বড়সড় পাতা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, এটা যেন কীসের রে দিদিভাই? হলুদ?

একটু ছিঁড়ে শুকে দ্যাখ না। গন্ধেই মালুম হবে।

এএএ, আমি পাতা ছিড়বই না।

পার্থ বিছানায় শুয়ে ঠ্যাং নাচাচ্ছিল। মশলা বাগান ঘুরে কুমিলির বাজারে যাওয়া হয়েছিল সন্ধেবেলা। দোকানে-দোকানে চক্কর খেয়ে সে এখন ক্লান্ত। অলস ভঙ্গিতে বলল, এত পাতা নিয়ে কী করবি র‍্যা?

কলকাতায় বন্ধুদের দেখাব।

তদ্দিনে তো শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে যাবে!

বইয়ের খাঁজে রেখে দেব। রাংতার মতো। ঠিক থাকবে।

অবনী ব্যালকনিতে চেয়ার নিয়ে জিরোচ্ছিলেন এতক্ষণ। উঠে এসে বললেন, কেরলের মেন-মেন আইটেম আমাদের তা হলে দেখা হয়ে গেল। পাহাড়, লেক, জঙ্গল, মশলাবাগান, কফিবাগান। এখন শুধু কোভালামের সমুদ্রটাই বাকি। আর আলেপ্পিতে নৌকাবিহার।

টুপুর বলল, এখনও রবার প্ল্যানটেশান দেখিনি বাবা।

সে তো কাল আলেপ্পি যাওয়ার পথে কোট্টায়ামের আগে পড়বে। কুরুপ তো বলছিলেন মাইলের পর মাইল জুড়ে রবার বন।

বুমবুম চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, রবার কি গাছে ফলের মতো ঝোলে? পার্থ বলল, তা হলে তো আর চিন্তা ছিল না। তুই যা রবার হারাস বাড়িতে একটা রবারগাছ পুঁতে রোজ একটা করে তোকে রবার ছিঁড়ে দিতাম।

টুপুর বলল, তুই একটা বুন্ধু। রবার গাছের গুঁড়ি চিরে একটা প্লাস্টিক বেঁধে দেওয়া হয়। ওই প্লাস্টিকের থলিতে গাছের রস গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ে, সেই রসই প্রসেস করে বানানো হয় রবার। মনে থাকবে?

সহেলি একগাদা মশলার প্যাকেট কিনেছেন। প্যাকেটগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বললেন, তোমাদের গালগল্প শেষ হবে না? নটা তো বাজল, খেতে যাবে কখন?

অবনী বললেন, দাঁড়াও, মিস্টার কুরুপ আসুন। তাঁকে ডিনারে নেমন্তন্ন করে আমরা আগেভাগে খেতে বসে যাব?

ওমা, তাই তো। আমার খেয়ালই ছিল না, সহেলি জিভ কাটলেন, কখন আসবেন তিনি?

এসে তো পড়ার কথা। কেন যে দেরি করছেন? বলতে-না-বলতেই দরজা ঠেলে, কুরুপ নয়, মিতিনের প্রবেশ। এতক্ষণ অন্য রুমে যোগব্যায়াম সারছিল। মুখটুখ ধুয়ে তরতাজা হয়ে এসেছে।

ঘরে ঢুকে দরজা হাট করে দিল মিতিন। সোজা এসে বসল বিছানায়। ব্যক্তিত্বমাখা স্বরে বলল, কাল আমাদের কটায় রওনা হওয়ার কথা?

তুইই তো বলেছিলি আটটা সাড়ে আটটায় বেরোব। সহেলি জবাব দিলেন, আলেপ্পিতে লাঞ্চ হবে।

প্রোগ্রামটা একটু বদলে যাচ্ছে। আমরা বেরোব কাল সাতটার মধ্যে। এবং আমাদের প্রথম গন্তব্যস্থল কাল আলেপ্পি নয়, কোচি।

কেন?

সব কেনর উত্তর সঙ্গে সঙ্গে হয় না দিদি। কারণটা কাল বিকেলে জানতে পারবে।

কয়েক মুহূর্তের জন্য গোটা ঘর স্তব্ধ। সহেলি, অবনী চোখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। পার্থর দৃষ্টিতে বিস্ময়। টুপুর হতবাক হয়ে দেখছে মিতিনমাসিকে। চেষ্টা করছে মাসিকে পড়ার।

সহেলি কাঁপাকাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আমায় একটা সত্যি কথা বলবি মিতিন? আমাদের সঙ্গে শত্ৰুতাটা করছে কে? মুন্নারের সেই লোকদুটো?

উহুঁ, আর কোনও প্রশ্ন নয়। শুধু কয়েকটা কথা মগজে ভরে রাখো। আমি যা বলব, নির্দ্বিধায় তাই করবে। ভয় পেয়ো না, প্যানিকড হওয়ার কোনও কারণ নেই। সহজভাবে থাক। হাসো, কথা বলো। কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল তোমাদের?

বুমবুম বলল, রবার গাছ। না না, মিস্টার কুরুপ।

হ্যাঁ, ভদ্রলোক তো এসে পড়বেন। চলো , নীচে গিয়ে ততক্ষণ অর্ডার-টর্ডার দিই। পাৰ্থ, নামার আগে দুটো রুমের দরজাই ভাল করে লক করে পকেটে চাবিদুটো নিয়ে এস।

মিতিনের কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিল না কেউ। ক্ষণে ক্ষণে বাচনভঙ্গি বদলাচ্ছে মিতিন। এই হাসি হাসি, তো এই থমথমে। তবে কেউ আর বিশেষ ঘাঁটালও না তাকে। গুটিগুটি নেমে এসেছে রেস্তোরাঁয়।

কুরুপের জন্য বেশিক্ষণ প্রতীক্ষা করতে হল না। টুপুররা মেনুকার্ড খোলার আগেই পৌঁছে গেছেন কুরুপ। লাউঞ্জে তাঁকে দেখতে পেয়েই হাত নেড়ে ডাকল মিতিন, চলে আসুন, আমরা এখানে!

নেভি ব্লু রঙের সুট পরে এসেছেন কুরুপ, গলায় মেরুন টাই। চাপ-চাপ কোঁকড়া চুলে জেল লাগিয়েছেন, ব্যাকব্রাশ করা চুল বেশ পেতে রয়েছে। বসেই রসিকতা করে বললেন, লাস্ট সাপার টুগেদার। হা হা।

দুটো টেবিলে ভাগাভাগি করে বসা হয়েছে। একটাতে মিতিন, টুপুর, পাৰ্থ, আর মিস্টার কুরুপ। হাতপাচেক তফাতে বাকি তিনজন। অবনী ওই টেবিল থেকে উত্তর দিলেন, কিন্তু এখানে জুডাসটি কে? আর আমাদের মধ্যে কেই বা জেসাস ক্রাইস্ট?

তোফা বলেছেন তো? এই জন্যই তো আমি বাঙালিদের এত পছন্দ করি। এই সেন্স অফ হিউমারের জন্য।

পার্থ বলল, তা হলে বাঙালির রসনার কথাও নিশ্চয়ই জানেন?

বিলক্ষণ। বাঙালি খেতে খুব ভালবাসে। কলকাতার মতো এত ভ্যারাইটি খাবারের দোকান আমি আর কোনও মেট্রোপলিসে দেখিনি।

তা হলে এবার খানার অর্ডার প্লেস করি?

নিশ্চয়ই।

দক্ষিণ ভারতীয় নয়, উত্তর ভারতীয়ও নয়, কুরুপের আগ্রহ চিনা খাবারে। আইটেম পছন্দ করল টুপুর। অ্যাসপারাগাস সুপ, লেমন চিকেন, গার্লিক প্রন, মিক্সড চাউমিন, সি ফুড ফ্রায়েড রাইস …।

অর্ডার দানের পর্ব চোকার পর পার্থ আয়েশ করে সিগারেট ধরিয়েছে। প্যাকেটটা দেখিয়ে কুরুপকে বলল, আপনি তো এ রসে বঞ্চিত, তাই না?

এককালে খেতাম দুএকটা। ছেড়ে দিয়েছি।

ভালই করেছেন। পয়সাও বাঁচছে। ফুসফুসও।

মন্তব্যটা মিতিনের। পার্থ তেরচা চোখে মিতিনকে একবার দেখে নিয়ে প্যাকেট পকেটে পুরল। অ্যাশট্রেখানা সামনে টেনে নিয়ে কুরুপকে বলল, আপনার এগেনস্টে আমার কিন্তু একটা অভিযোগ আছে।

কুরুপের চোখ সরু।

অত সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই। পাৰ্থ হো-হো হেসে উঠল,আপনার ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফির কোনও স্যাম্পল কিন্তু আমাদের দেখালেন না!

কুরুপ অপ্ৰস্তুত মুখে বললেন, এক্সট্রিমলি সরি। ফিল্ম তো আমি যেখানে-সেখানে প্রিন্ট করাই না, শুধু ওয়াশটা করিয়ে রাখি। তা আপনাদের ঠিকানাটা দিয়ে দিন না, পাঠিয়ে দেব।

 খেয়ে উঠেই লিখে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, যদি কখনও কলকাতায় আসেন অবশ্যই আমাদের সঙ্গে দেখা করবেন।

সে আর বলতে! কুরুপের ঠোঁটে শিষ্ট হাসি, বাই দ্য বাই, আপনারা কাল কটায় বেরোচ্ছেন?

ভেবেছিলাম বেলায় স্টার্ট করব। কিন্তু আমাদের টুর প্রোগ্রামটা সামান্য বদলে গেছে। মিতিন বলে উঠল, কাল আমরা স্ট্রেট আলেপ্পি যাচ্ছি না।

সে কী? কুরুপ অবাক, কোথায় যাবেন তা হলে?

আমাদের কাল একবার কোচি ফিরতেই হবে। একটা প্রবলেমে পড়ে গেছি।

কী প্রবলেম?

আর বলবেন না, আমাদের এবারের টুরে শুধুই হ্যাজার্ড। আমার হাজব্যান্ডের যে ব্যাগটা মাটুপেট্টিতে ছিনতাই হল, হুবহু একইরকম আর-একটা ব্যাগ ছিল আমার জামাইবাবুর। উনি তো একটু আলাভোলা টাইপ, ব্যাগটা কোচিতে ফেলে এসেছেন। রেবতী ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে। ওই লাল ব্যাগে অনেক টুকিটাকি জিনিসের সঙ্গে জামাইবাবুর ক্রেডিট কার্ডটাও রয়ে গেছে। বোঝেনই তো, আজকাল বেশি ক্যাশ নিয়ে কেউ বেরোয় না, সুতরাং ক্রেডিট কার্ডটা তো

 কী কাণ্ড! ব্যাগ হোটেলই রয়ে গেল? ফেরত পাবেন?

হ্যাঁ। হোটেলে ফোন করে দিয়েছি।

তার মানে সেই রেবতী ইন্টারন্যাশনালে ছুটবেন?

না। জামাইবাবুর এক ছাত্র থাকে কোচিতে, তাকে বলে দেওয়া হয়েছিল, সে ব্যাগটা কালেক্ট করে নিজের জিম্মায় রেখে দিয়েছে। আমরা অবশ্য কোচিতে বেশিক্ষণ স্টে করব না, জামাইবাবুর ছাত্রকে বলা আছে, সে ঠিক বিকেল তিনটেয় ব্যাগ নিয়ে দরবার হল গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে থাকবে। ব্যাগ তুলে নিয়েই আমরা চলে যাব আলেপ্পি।

কাল তিনটেয়? কুরুপকে ঈষৎ চিন্তিত দেখাল, তার মানে কাল আপনাদের গোটা দিনটাই নষ্ট। সন্ধের আগে আলেপ্পি পৌঁছনো হচ্ছে না তা হলে?

কী করা যাবে বলুন? ভুলের খেসারত। ভেবেছিলাম এখান থেকে কোট্টায়াম হয়ে বাঁয়ে আলেপ্পি ঘুরে যাব। এখন ডাইনে উজান কোচি গিয়ে আবার ফেরা। মাঝখান থেকে কন্যাকুমারিকা এবার হয়তো আর হল না।

হুঁ। টুরে একটা দিন চলে যাওয়া মানেই তো প্রোগ্রামের বারোটা।

টুপুর অনেক কষ্টে সংযত রাখল ঠেলে ওঠা বিস্ময়টাকে। পার্থমেসোও মুখটাকে ভাবলেশহীন করে রেখেছে। তবে তারও যে ভিতরে চমক জাগছে, এ টুপুর হলপ করে বলতে পারে। কালই মিতিনমাসির কথা শুনে মনে হল ব্যাগ নিয়ে ভাবাভাবির প্রয়োজন নেই, পার্থমেসোও তো টাকাপয়সায় টান পড়বে না বলে অভয় দিয়ে রেখেছে, আজ কেন মিতিনমাসির গলায় অন্য সুর?

নৈশাহারের পরে আরও কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলেন কুরুপ। ওঠার সময়ে কুরুপ বললেন, কোট্টায়াম রুটে একটা ফাইন হিল রিসর্ট পড়বে। পিরমেড। অলটিচিউড বেশি নয়, তিন হাজার ফিট। তবে সিনিক বিউটি তাকিয়ে দেখার মতো। পারলে ওখানে একটু দাঁড়িয়ে যাবেন।

মিতিন বলল, সেরকম ইচ্ছে একটা আছে বটে। তাই তো সাতটার মধ্যে বেরোচ্ছি। এক-দুঘণ্টা পিরমেডে হল্টও করতে পারি। আপনিও তো সকালেই রওনা দিচ্ছেন?

কাকভোরে। আমার অনেকটা রাস্তা। ইদুক্কি ডিস্ট্রিক্ট পার হয়ে ত্রিচুর ছুঁয়ে সেই পালাক্কাড় জেলা। ঘণ্টাদশেক তো লাগবেই।

উইশ ইউ এ হ্যাপি জার্নি।

সেম টু ইউ। টুরের বাকি দিনগুলো আপনাদের নিশ্চিন্তে কাটুক।

কুরুপকে বিদায় জানিয়ে ঘরে এসে শুরু হল গোছগাছ। সারাদিনে যা-যা বেরিয়েছে, সহেলি একটা-একটা করে তুলছেন। তিন শিশি মালিশের তেল কিনেছিলেন, যত্ন করে মুড়লেন প্লাস্টিকে, চালান করলেন সুটকেসের তলায়।

মিতিন ব্যালকনিতে। চাপা গলায় পার্থর সঙ্গে কী যেন আলোচনা চলছে। টুপুর ব্যালকনিতে আসামাত্র থেমে গেল কথা।

টুপুর আর কৌতূহল ধরে রাখতে পারল না, কেসটা কী বলে তো? কী হয়েছে?

 কীসের কী?

মনে হচ্ছে কোনও গড়বড় আছে?

আছে।

আমরা নিশ্চয়ই শুধু ব্যাগ কালেক্ট করতে কোচি ফিরছি না?

অবশ্যই না।

তা হলে?

মিতিনের ঠোঁটে চিলতে হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল, তোর কী মনে হয়?

আমার মনে হচ্ছে সামথিং রিলেটেড টু সিনাগগ। তুমি বোধ হয় কেসটার কোনও সলিউশান পেয়েছ!

গুড গেস। তোর ব্রেনে গ্রে ম্যাটার বাড়ছে। তা সলিউশানটা যে কী, কিছু আন্দাজ করতে পারছিস?

টুপুর মাথা চুলকোল, নাহ।

ঘরে গিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগখানা নিয়ে এল মিতিন। চেন খুলে ছোট্ট একটা দাবার খুঁটি বের করেছে, এটা কী?

কালো বোড়ে।

দাবা খেলায় বোড়ের পাওয়ার সবচেয়ে কম। আবার ওই বোড়েই কখনও কখনও এগোতে এগোতে মন্ত্রী বনে যায়। তখন কিন্তু তার ক্ষমতা অসীম, একাই কিস্তি মাত করতে পারে। কী বুঝলি?

টুপুর অস্থির হল, কেন হেঁয়ালি করছ মিতিনমাসি? খুলে বলেই না।

উহুঁ, সারারাত শুয়ে-শুয়ে ভাব। শুধু খেয়াল রাখিস, কাল কিন্তু ছটার মধ্যে উঠতে হবে। বলতে বলতে পার্থকেও তাগাদা লাগাল মিতিন, তুমিও আর দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকো না। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ো।

রেলিংয়ে হেলান দিয়ে পাৰ্থ কী যেন ভাবছিল। দূরমনস্ক স্বরে বলল, যাই।

.

১১.

বেরনো হয়েছিল সকাল-সকালই। কিন্তু কোট্টায়ামের দিকে তিনচার কিলোমিটার গিয়েই চমক। দুম করে ম্যাথুকে গাড়ি ঘোরাতে বলল পার্থ, শাঁইশাঁই কুমিলি ফিরে ধরল মুন্নারের পথ। সেদিকেও গেল না বেশি দূর, পুট্টাডি নামের এক ছোট্ট জনপদ পার হওয়ার পরই বাঁদিকের একটা রাস্তায় ঢুকে পড়ল কোয়ালিস।

পার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে মিতিনকে জিজ্ঞেস করল, কী, এই রুট ঠিক আছে? চলবে? নো মুন্নার, নো কোট্টায়াম, মধ্যিখান দিয়ে সুড়ুত গলে যাব।

মিতিন বলল, পারফেক্টলি অল রাইট। তোমার ম্যাপ মুখস্থ করা সাৰ্থক।

অনেকক্ষণ ধরেই সন্দিগ্ধ চোখে পার্থ-মিতিনের কাণ্ডকারখানা লক্ষ করছিলেন অবনী। বলে উঠলেন, তোমরা কী চাইছ বলে তো? একবার এ-রাস্তা, একবার ও-রাস্তা …? আমরা ভায়া কোট্টায়াম যাচ্ছি না কেন?

আপনার শ্যালিকা নতুন রাস্তা এক্সপ্লোর করতে চায় অবনীদা। বলছে বাঁধা রুটে বেড়ানো আর ভাল লাগছে না।

টুপুরের মোটেই বিশ্বাস হল না কথাটা। গাল ফুলিয়ে বলল, পিরমেডও নিশ্চয়ই এ-রুটে পড়বে না?

হয়তো তার চেয়েও বেটার জায়গা দেখতে পাবি। ইদুক্কির জঙ্গল ছুঁয়ে যাব, পেরিয়ার নদী পার হব, পাহাড় অরণ্য কফিবাগান সবই পড়বে পথে এই বা মন্দ কী?

কেন শাক দিয়ে মাছ ঢাকছু পার্থ? অবনী বেশ অপ্রসন্ন, তোমাদের মতলবটা কী একটু ঝেড়ে কাশো তো।

শুনবেনই? ঘাবড়ে যাবেন না তো?

না শুনলেই কি টেনশান কমবে?

আমি বলছি। মিতিন পার্থকে থামাল। শান্ত গলায় বলল, মাটুপেট্টির ঘটনার খলনায়কটিকে আমি পেরিয়ারে দেখেছি অবনীদা।

সে কী রে? সহেলি শিউরে উঠলেন, এমন সাংঘাতিক একটা খবর তুই চেপে রেখেছিস? পুলিশে জানাসনি কেন?

বেড়াতে এসে বারবার ঝুটঝামেলায় যাওয়ার দরকার কী? তার চেয়ে চুপচাপ কেটে পড়াই কি ভাল নয়? তাই বেছে নিলাম একটা অড রুট, যে-পথে টুরিস্টরা সচরাচর আসে না। কোট্টায়ামের রাস্তায় গিয়েও গাড়ি ঘুরিয়ে দেখে নিলাম লোকটা আমাদের ধাওয়া করছে কিনা। লোকটা যদি কোনওভাবে টের পেয়েও থাকে আমরা আজ সকালে পেরিয়ার ছাড়ছি, তা হলেও আগেভাগে গিয়ে পথে কোথাও ওয়েট করে তার লাভ হবে না। ওদিকে যদি বেচারা হাপিত্যেশ করে বসেও থাকে, আমরা এদিক দিয়ে ধাঁ।

ঠিক বলছিস তো রে?

হ্যাঁরে বাবা, হ্যাঁ। মিতিন চোখ ঘোরাল, কী অবনীদা, এবার শাকের আড়ালে মাছ দেখতে পাচ্ছেন তো?

হুম। অবনীর মুখে গালভরা হাসি, জব্বর ঘোড়ার চালটা দিয়েছ কিন্তু।

দাবা খেলা আমিও অল্পস্বল্প জানি অবনীদা।

বটেই তো। তোমায় কি আমি হেলাফেলা করেছি কখনও? তা এবার আমায় আজকের প্রোগ্রামটা একটু খুলে বলো তো?

জানেনই তো, কোচি গিয়ে তিনটের সময় সুনীলের কাছ থেকে ব্যাগ কালেক্ট করব, তারপর যাত্রা টু আলেপ্পি।

জার্নিটা খুব বেশি হয়ে যাবে না? তার চেয়ে আজ রাতটা কোচিতে থেকে কাল সকালে কোভালাম রওনা হতে পারি। আলেপ্পি তো পথেই পড়বে।

দেখা যাক। আগে কোচিতে পৌঁছই তো।

সুনীল কিন্তু কিছুতেই আজ আমাদের ছাড়তে চাইবে না, তুমি দেখে নিয়ো।

টুকিটাকি কথা চলছে। গাড়িতে ফিরে এসেছে আমুদে মেজাজ। গোয়েন্দা বোনের বুদ্ধির প্যাচে সম্ভাব্য শয়তানকে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলা গেছে জেনে সহেলিও নিশ্চিন্ত ম্যাথু টেপ চালিয়ে দিল, বাজছে মলয়ালম গান, তালে তালে মাথা দোলাচ্ছে সবাই। একমাত্র টুপুরের মনটাই যা একটু খচখচ করছিল। মিতিনমাসির যুক্তিগুলো অকাট্য, তবু সে যেন ঠিক পরিপাক করতে পারছে না। মাটুপেট্টির পাজি লোকটাকে কখন দেখল মিতিনমাসি? সে আর মা যখন মালিশ করাচ্ছিল, সেই সময়েই কি দেখেছে রাস্তায়? লোটাকে দেখেও ছেড়ে দেবে, এ তো মিতিনমাসির চরিত্রের সঙ্গে মোটেই মেলে না?

যাই হোক, গানে, গল্পে দিব্যি কেটে গেল রাস্তাটা। পথে একবার মাত্র দাঁড়ানো হল পেরিঙ্গলে, তারপর দেড়টার মধ্যে সোজা কোচি। পেরিঙ্গলেই অল্প-অল্প মেঘ ছিল আকাশে, গাড়ি যখন কোচিতে ঢুকল, মেঘবাহিনী সেখানেও হাজির। জলীয় বাষ্পমাখা বাতাস ঝাপটা মারছে মুখে-চোখে। সমুদ্রের মাথায় ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ ঝলক।

সি-লর্ড জেটির সামনে এসে ঝটাপট সারা হল দুপুরের খাওয়াদাওয়া। সুনীলের সঙ্গে মিনি কথা বলে নিল মোবাইলে। তারপর আড়াইটে নাগাদ সদলবলে দরবার হল গ্রাউন্ড।

পার্কিংয়ে গাড়ি রেখে ঘন সবুজ মাঠটায় বসেছে টুপুররা। মেঘলা দুপুর, অথচ বৃষ্টি নেই, আবহাওয়া ভারী মনোরম। আজ। ছুটির দিন নয়, লোকজনও বড় একটা নেই ময়দানে। দরবার হল সংলগ্ন শিল্প জাদুঘরটিও বন্ধ এখন, খুলবে সেই তিনটের পরে। অনেকটা ফাঁকা জায়গা পেয়ে প্রাণের সুখে ছোটাছুটি শুরু করে দিল বুমবুম।

পার্থ ঘনঘন ঘড়ি দেখছিল। খানিকটা অসহিষ্ণুভাবেই মিতিনকে বলল, তিনটে তো বাজতে যায়, এখনও সুনীলের দেখা নেই কেন?

অবনী বললেন, ব্যস্ত হয়ো না। সুনীল অত্যন্ত পাংচুয়াল, সে কক্ষনো টাইম ফেল করে না।

কথাটুকু খসার যা অপেক্ষা, হঠাৎই টুপুর চেঁচিয়ে উঠেছে, ওই দ্যাখো! ওই দ্যাখো!

চমকে তাকাল সবাই। গর্জন তুলে একটা মোটরবাইক ঢুকছে। গ্রাউন্ডে, আরোহীর কাঁধে অবনীর লাল ব্যাগ! কিন্তু কী আশ্চর্য, আরোহী তো সুনীল নয়!

অবনী উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, কী ব্যাপার? সুনীল অন্য কাউকে পাঠাল নাকি?

ঠিক তক্ষুনি এক ভয়ংকর কাণ্ড। মোটরবাইকের আরোহী সবে সিট থেকে নেমেছে, অমনিই কোথা থেকে এক সাদা মারুতি তীব্র বেগে প্রবেশ করল চত্বরে, লোকটার সামনে এসে ব্ৰেক কষল ঘচাং! পলকে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে গাউগোট্টা চেহারার একটা লোক, আরোহীর বুকে রিভলভার ঠেকিয়ে ছোঁ মেরে কেড়ে নিল ব্যাগটা।

তবে গাড়িতে ফিরতে পারল না। তার আগেই মাঠ ফুড়ে উঠে এসেছে জনা চার-পাঁচ লোক। মাঠেই ছড়িয়েছিটিয়ে বসে ছিল তারা, ছুট্টে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ছিনতাইকারীর উপর। তাদের প্রত্যেকের হাতে উদ্যত রিভলভার। হাওয়া বেগতিক দেখে সাদা মারুতির চালক বিদ্যুৎবেগে গাড়ি ঘোরাল, কিন্তু গেট অবধি গিয়েই তার যাত্রা শেষ। প্রবেশদ্বার আটকে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশবাহিনী।

গোটা ঘটনাটা ঘটতে সময় লাগল বড়জোর কুড়ি সেকেন্ড। টুপুর থ। চিত্রার্পিত। অবনী ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছেন, সহেলি কাঠ, বুমবুমের চোখ বড় বড়।

দৌড়ে মারুতির সামনে গেল মিতিন। চালকের জানলায় গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ইওর গেম ইজ ওভার মিস্টার পি কে জি কুরুপ। অ্যালিয়াস মিস্টার সেলভান। অ্যালিয়াস শ্ৰীমান মুথুস্বামী। কিম্বা মিস্টার আয়াপ্পান। …হায় রে, এত চালাকি করেও সামান্য একটা টোপে আপনি ধরা পড়ে গেলেন? পিরমেডে আজ কটা অবধি ওয়েট করেছিলেন? আমাদের আটকানোর জন্যে? আটটা? নটা? দশটা?

টুপুর আর পার্থও ছুটে এসেছিল। টুপুর দেখল ক্রোধে গনগন করছেন মিস্টার কুরুপ। ভদ্ৰ সভ্য মানুষের মুখোশ-পরা কুরুপের চোখমুখ কী ভীষণ হিংস্ৰ এখন।

পার্থ বলল, কাল রাতে আমাদের ঘাড় ভেঙে প্রচুর খেয়েছ, এখন জেলে বসে লপসি খাও।

শুধু লপসি কেন, গলায় ফাঁসির দড়িও পরতে হতে পারে। সঙ্গে বিক্রমনের খুনটা আছে না?

গেটের বাইরে একটা অ্যাম্বাসার দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে নেমে এসেছেন সতীশ মেনন স্বয়ং। সঙ্গে সুনীল নালিয়াথ।

সতীশ হাত বাড়িয়ে দিলেন মিতিনের দিকে, থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাডাম। আপনার জন্যই এরকম এক কুখ্যাত ক্রিমিনাল আজ ধরা পড়ল।

মিতিন হেসে বলল, আমি তো নিমিত্ত মাত্র। ওদের ধরিয়ে দিল তো আমার জামাইবাবুর লাল ব্যাগ। এনিওয়ে, গ্রেট স্ক্রলটা ব্যাগ থেকে বের করে নিয়েছেন তো?

বিলক্ষণ। ছাতা সমেত।

কুরুপ সাহেবের দোসরটির রিভলভারখানাও যত্ন করে রাখবেন কিন্তু ব্যালিস্টিক রিপোর্টে সম্ভবত প্রমাণ হবে, ওই রিভলভারের গুলিতেই মারা গেছে সিনাগগের কর্মচারীটি।

নিশ্চয়ই রাখব। পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।

মাঠে ঘাপটি মেরে বসে থাকা প্লেন ড্রেসের পুলিশরাই হাতকড়া পরিয়ে ভ্যানে তুলছে কুরুপ আর তার সঙ্গীকে। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে সাঙাতটিকে ভাল করে দেখল টুপুর। মুখ-ভর্তি বসন্তের দাগ।

.

১২.

সন্ধে নেমেছে মাট্টানচেরিতে। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরঝির। জু টাউনের রাস্তা জলে-কাদায় মাখামাখি। তারই মধ্যে জোস হ্যালেগুয়ার ঘর আজ উপচে পড়েছে মানুষের ভিড়ে। টুপুররা ছাড়াও আছে সুনীল, আছেন সতীশ মেনন। মাট্টানচেরি থানা থেকে এসে গেছেন পি ভি জর্জও। বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী ইহুদি পরিবারও উজ্জ্বল মুখে জমা হয়েছে দরজায়। আর এমন একটা দিনে সাইমন পেরেজও যে উপস্থিত থাকবেন এ তো বলাই বাহুল্য।

গ্রেট স্ক্রল ফিরে গেছে সিনাগগের দেওয়ালসিন্দুকে। বিশেষভাবে তৈরি একটি ছাতার বাঁটের গোপন ফাঁকে গোল করে গুটিয়ে রাখা হয়েছিল গ্রেট স্ক্রল । নেহাতই মামুলি চেহারার কালো ছাতা, তবে ডাঁটির নির্দিষ্ট স্থানে চাপ দিলে লম্বা রডটি খুলে যায়। তখন ওই ফাঁপা রডে ক্যালেন্ডারের মতো কিছু ঢুকিয়ে দেওয়া মোটেই কঠিন নয়।

জোস হ্যালেগুয়া ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিলেন অভিনব ছাতাটিকে। সতীশ মেননকে ছাতা ফেরত দিয়ে প্রশ্ন করলেন, কিন্তু ম্যাডাম, অনুমান করলেন কী করে এমন একটি ছাতার মধ্যে আমাদের পবিত্র পেন্টাটিউক রক্ষিত আছে?

স্মিত মুখে মিতিন বলল, সত্যি বলতে কী, আমিও আন্দাজ করতে পারিনি। মিস্টার মেনন যখন এখান থেকে জানালেন ব্যাগে দুটো ছাতা আছে, তখনই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। কারণ ব্যাগে দ্বিতীয় ছাতাটি তো থাকার কথা নয়। তবে হ্যাঁ, পবিত্র লিপিটিকে যে আমাদের ব্যাগেই চালান করা হয়েছিল, এটা আমি কয়েকটা ঘটনা অনুধাবন করে নিশ্চিত হয়ে গেছিলাম।

কী রকম?

অনেকগুলো সুতো পরপর জোড়া দিয়ে। যেমন, চুরির দিন রাত্তিরেই আমার সন্দেহ হয় একটা অটোরিকশা হোটেল অবধি আমাদের ধাওয়া করেছে। আপাতভাবে কোনও কারণ না থাকা সত্ত্বেও। পরদিন মুন্নারের পথ থেকে হোটেলে ফোন করার সময়ে খবর পেলাম ভোরবেলা আমরা বেরনোর পরপরই কেউ একজন আমাদের খুঁজতে এসেছিল। কোচিতে সুনীল ছাড়া আর কে-ই বা আমাদের খোঁজ করতে পারে? কেনই বা করবে? মিস্টার মেনন কোনও কারণে এসেছিলেন কী? তাহলে তো তিনি পরিচয় দিতেন। আর দুজন সদ্যপরিচিত, মিস্টার হ্যালেগুয়া এবং মিস্টার পেরেজেরও তো জানার কথা নয় আমরা কোন হোটেলে উঠেছিলাম! এর পর মুন্নার পৌঁছে সুনীলের সঙ্গে যোগাযোগ করে মারাত্মক সংবাদটি পেলাম। চুরির রাতেই রেবতী ইন্টারন্যাশনালের কাছাকাছি একটি অটোরিকশায় নাকি খুন হয়েছে সিনাগগের কর্মচারীটি। তখনই আমার মনে কেমন খটকা জাগল। তা হলে কি আমাদের ফলো করার সন্দেহটা অমূলক নয়? কিন্তু তখনও বুঝতে পারছি না কেন ফলো করবে! এর পর দুবার আমাদের উপর অ্যাটেমপ্ট হল। প্রথমবার মুন্নার ক্লাবে। দ্বিতীয়বার মাটুপেট্টি ড্যামে। দুবারই আক্রমণকারীর টার্গেট লাল ব্যাগ। প্রথমবার চোর আঁকশি দিয়ে লাল ব্যাগটাই টেনেছিল। আর মাটুপেট্টিতে একটা লোক গাড়ি ভাড়া করে এসে, স্পিডবোটকে পাঁচশো টাকা দিয়ে, ভরদুপুরে একটা প্রায় ফাঁকা লাল ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল। লোকটা আমার হাজব্যান্ডের ক্যামেরাটা স্বচ্ছন্দে টানতে পারত, কিন্তু নেয়নি। তার মানে, হয় সে ভুল করে ছিনতাই করেছে, নয়তো সে লাল ব্যাগটাকেই চেয়েছিল। উইথ দ্য এক্সপেক্টেশান লাল ব্যাগে অনেক মূল্যবান একটা কিছু আছে। এবং লোকটা মোটেই সাধারণ ছিনতাইবাজ নয়, তা হলে সে গাড়ি ভাড়া করে আসত না। হ্যাঁ, গাড়িটা যে ভাড়ার তা আমি একঝলক নেমপ্লেট দেখেই বুঝে গেছি। তখনই আমি ভাবতে শুরু করলাম মূল্যবান জিনিসটি কী হতে পারে? মনে পড়ে গেল সিনাগগে দ্বিতীয়বার ঢোকার সময়ে জামাইবাবুর লাল ব্যাগখানা টিকিট কাউন্টারের ছেলেটির সামনেই রাখা ছিল। এবং আমার হাজব্যান্ডের ব্যাগটি আর জামাইবাবুর ওই ব্যাগ হুবহু এক। এর পর তো দুয়ে-দুয়ে চার করা এমন কিছু কঠিন নয়।

টুপুর বলে উঠল, তার মানে তুমি বলতে চাও মিস্টার কুরুপ আর তার চ্যালা পার্থমেসোর ব্যাগটাকে বাবার ব্যাগ ভেবেই বারবার হাতানোর চেষ্টা করছিল?

অবশ্যই। ওরা তো কেউই কখনও দুটো ব্যাগ এক সঙ্গে দেখেনি। এমনকী সিনাগগের ছেলেটাও না। ওরা জানবে কী করে, তোর বাবা ব্যাগ হোটলে ফেলে এসে ওদের জন্য একটা বিদঘুটে হেঁয়ালি তৈরি করে দিয়েছে?

সতীশ মেনন তারিফের সুরে বললেন, যাই বলুন ম্যাডাম, কুরুপের মতো ক্রিমিনালকে আইডেনটিফাই করাটা কিন্তু একটা মারভেলাস কাজ।

মোটেই না। কুরুপমশাই এত ভুল করেছেন, তাঁকে না ধরতে পারাটাই চরম বোকামি হত। শুনবেন তার গলতিগুলো? ভালমানুষ সেজে যেচে আলাপ করার সময়ে নিজের পরিচয় দিলেন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার বলে। জানালেন তিনি নাকি জঙ্গলে-জঙ্গলে ছবি তুলে বেড়াচ্ছেন। অথচ তার পায়ে সব সময়ে শৌখিন জুতো, যা মোটেই বনেবাদাড়ে ঘোরার উপযুক্ত নয়। হতে পারে তাঁর জঙ্গলের জুতো আর লোকালয়ের জুতো আলাদা, কিন্তু পর পর আরও কয়েকটা গণ্ডগোল যে করে ফেললেন তিনি। মুন্নারে কফির টেবিলে বাঘের ঘ্রাণশক্তি সম্পর্কে যে ভুল মন্তব্য করলেন, তাতেই বোঝা যায় বন্যপ্ৰাণী সম্পর্কে তার কত জ্ঞান! এর সঙ্গে আবার রাজস্থানে কস্তুরীমৃগ? উফ, হরিবল। এর পর লাঠির ডগায় আঁকশি লাগিয়ে মুন্নার ক্লাবে ব্যাগ চুরি করতে পাঠালেন, অথচ খেয়ালই করলেন না, লাঠির গায়ে হোটেল ক্রিস্টাল প্যালেসের চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। লাঠিটি নেহাতই হোটেল ক্রিস্টাল প্যালেসের খাটের একটি ছত্ৰী। পেরিয়ারে তিনি গায়ে পড়ে আমাদের সঙ্গ দিতে রাজি হলেন, তাঁর গাড়িতে পেরিয়ার লেকে যাওয়ার সময়ে স্পষ্ট টের পেয়ে গেলাম তিনি আদৌ ইদুক্কির জঙ্গলে যাননি।

টুপুর ফের জিজ্ঞেস করে বসল, কী করে বুঝলে?

মুন্নারে লোকটা তোকে আর আমাকে গাড়িতে লিফট দিয়েছিল, মনে আছে?

হ্যাঁ, কিন্তু

এই জন্যই তো বলি চোখ-কান খোলা রাখ। মুন্নারেই আমি গাড়ির কিলোমিটারটা দেখে নিয়েছিলাম। এমনিই দেখেছিলাম। চোখে পড়ে গিয়েছিল। মুন্নার টু পেরিয়ার একশো ছ কিলোমিটার মতো রাস্তা। ভায়া ইদুক্কি হলে অন্তত তিরিশ কিলোমিটার বেশি। অথচ পেরিয়ারে দেখলাম কুরুপের গাড়ি চলেছে মাত্র একশো ষোলো কিলোমিটার। এর থেকে কী বোঝা যায়, অ্যাঁ? এত প্রমাণ পাওয়ার পরও লোকটাকে সন্দেহ হবে না? আর পেরিয়ারে ওর গাড়িতে বসে সবচেয়ে মোক্ষম প্রমাণটাও তো আমার মুঠোয় এসে গেল। দাবার ঘুঁটি। যে দাবার সেটটা তোর মেসোর লাল ব্যাগে ছিল তার একটা কালো পন। পেলাম কুরুপের ড্রাইভিং সিটের ঠিক নীচে। সাঙাত ছিনতাই করে আনার পর ব্যাগ হাতড়ে আসল জিনিসটি না পেয়ে পথেই ব্যাগটিকে পরিত্যাগ করেছিল কুরুপ, কিন্তু ঘাঁটাঘাঁটির সময়ে এই বোড়েটি পড়ে যায় গাড়ির ভিতর। গাড়ির ফ্লোর ম্যাটটাও কালো, বোড়েটাও কালো, তাই বেচারার নজরে পড়েনি। ব্যস, তখনই আমার আর বুঝতে বাকি রইল না মাটুপেট্টির ঘটনায় নাটের গুরুটি কে! পেরিয়ারের রেস্টুরেন্টে খবরের কাগজের রিপোর্টটা আরও বেশি নিঃসংশয় করে দিল। কুরুপ যে একজন ভাল গাইড ছিল, সেই পরিচয়ও তো আমরা পদে-পদেই পেয়েছি। পাইনি?

সতীশ মেনন বললেন, আপনার ফোন পাওয়ার পর থেকে আমি কিন্তু খুব চিন্তায় ছিলাম ম্যাডাম। যদিও কুমিলি থানায় ইন্টিমেশান পাঠিয়ে দিয়েছিলাম, তবু লোকটা যা খতরনাক ভয় ছিল পথে না অ্যাক্সিডেন্ট-ফ্যাক্সিডেন্ট কিছু ঘটিয়ে দেয়।

 দুশ্চিন্তা আমারও ছিল মিস্টার মেনন। মিতিন মাথা দোলাল, লোকটাকে চার এগিয়ে দিয়ে আমিও স্বস্তিতে থাকতে পারিনি। বিশেষ করে লোকটা যখন আমাদের পিরমেডে থামার কথা বলল, তখন আরও বেশি সাবধান হয়ে গেলাম।

জর্জ গোঁফে মোচড় দিতে দিতে এতক্ষণ শুনছিলেন সব। হঠাৎ মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, আমি তো আগেই বুঝে গিয়েছিলাম চুরিটা কোনও পাকা মাথার কাজ। এখান থেকে যে অটোটা ছিনতাই হয়েছিল, তার ড্রাইভারকে আমি কষে জেরা করেছিলাম। তার বর্ণনা মতোই তো আর্টিস্ট ছবি আঁকল। মেনন সাহেবও বুঝে গেলেন তিন শয়তানের মধ্যে অন্যতমটি হল টি জোসেফ। দ্য নটোরিয়াস অ্যান্টিক স্মাগলার।

সতীশ বললেন, ঠিক কথা। আমরা ওকেই খুঁজছিলাম। কিন্তু যাই বলুন, জোসেফ কাম কুরুপকে পাকড়াও করার কৃতিত্বটা কিন্তু পুরোপুরি ম্যাডামেরই।

জোস হ্যালেগুয়া বললেন, অবশ্যই। মাট্টানচেরির ইহুদিরা চিরকাল ম্যাডামের কথা স্মরণে রাখবে।

সাইমন পেরেজ বললেন, আমার শুধু খারাপ লাগছে বিক্রমনের জন্যে। লোভে পড়ে কী যে করে ফেলল। বেঘোরে প্রাণ গেল ছেলেটার।

হুম। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমি এখনও ক্লিয়ার হতে পারলাম না সাইমন। জোস দাড়িতে হাত বুলোচ্ছেন, শনিবার চুরি করেও কেন গ্রেট স্ক্রল পাক্কা একটি দিন নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল বিক্রমন? কেন আগেই পাচার করেনি?

আপনার ধারণাটা সঠিক নয় মিস্টার হ্যালেগুয়া। চুরিটা শনিবার হয়নি।

মিতিনের কথায় থতমত খেলেন জোস হ্যালেগুয়া, তবে?

চুরি রবিবারই হয়েছে। আমরা সন্ধেবেলা সিনাগগে ঢোকার জাস্ট আগে। সিনাগগে ভিজিটিং আওয়ার শেষ হওয়ার পরে-পরেই সিকিউরিটি গার্ডদের কাজে সামান্য হলেও ঢিলেমি আসে। সেই সুযোগটাই ব্যবহার করেছিল বিক্ৰমন। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে আমরা এসে পড়ায়, এবং চুরিটাও আবিষ্কার হয়ে যাওয়ায় সে খুব নার্ভাস হয়ে পড়ে। যতই যোক পেশাদার অপরাধী তো নয়, তাই ঘাবড়ে গিয়ে ছাতাখানা তাড়াতাড়ি ঢুকিয়ে দেয় আমাদের ব্যাগে।

সাইমন বললেন, ছাতাখানা হাতে নিয়ে পুলিশের সামনে এলেও তো কেউ বুঝতে পারত না তার ভিতরে কী আছে।

মিতিন বলল, সাহস পায়নি। লোভে পড়ে পাপ কাজ করে ফেলেছিল তো।

জোস বললেন, জিহভা কখনওই অধর্ম বরদাস্ত করেন না। আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সে যে পাপ করেছে তার শাস্তি তো তাকে পেতেই হবে।

মিসেস জোস বললেন, পেন্টাটিউক নিজেই নিজেকে রক্ষা করেছে।

আরও কয়েকটা খুচখাচ কথার পর সতীশ উঠে দাঁড়িয়েছেন। মিতিনকে বললেন, এবার যাবেন তো ম্যাডাম?

ও সিওর। মিতিনের চোখ ঘড়িতে, আটটা বাজে, এবার তো হোটলের সন্ধানে যেতে হয়।

অবনী বললেন, খোঁজাখুঁজির কী দরকার, রেবতী ইন্টারন্যাশনালই তো আছে। কী বলো, সুনীল?

সুনীলের বাসনা স্যারসমেত টুপুররা আজ তার বাড়িতেই থাকুক। মিতিনের কেরামতিতে সে অভিভূত, খোদ ডিটেকটিভের মুখ থেকে সে আরও তদন্তের গল্প শুনতে চায়। অবনী তাকে কোনও মতে ক্ষান্ত করলেন। সুনীলদের ছোট বাড়িতে এতজন মিলে হামলা করার কোনও মানে হয়?

জু টাউনের গলিতেই গাড়ি রেখেছিল ম্যাথু। জোস হ্যালেগুয়া, সাইমন পেরেজসহ উপস্থিত ইহুদিরা এলেন কোয়ালিস পর্যন্ত। মিতিনকে বিদায় জানাতে। ভারী কৃতজ্ঞ ভঙ্গিতে অনুরোধ করলেন আবার মাট্টানচেরিতে আসার জন্যে।

সতীশ মেননের জিপের পিছু পিছু রওনা দিল ম্যাথু। মশলাপট্টি পেরিয়ে এসে পাৰ্থ বলে উঠল, একটা ব্যাপার খেয়াল করেছ? জোস হ্যালেগুয়া কিন্তু প্রমাণ করে দিয়েছেন তিনি একজন সাচ্চা ইহুদি।

কীভাবে?

দু-দুবার ওঁর বাড়িতে এলাম, একবারও চা পর্যন্ত খাওয়ালেন না। কী কিপ্টে, বাপস। অন্তত এবার তো রাবিমশাই আমাদের একটু আপ্যায়ন করতে পারতেন।

পাৰ্থর বলার ঢঙে হো-হো হাসির ফোয়ারা উঠল।