দোকানটা বেকবাগানের মোড়েই। নাম গ্র্যান্ড কিউরিও শপ। খুব একটা বড় নয়, তবে নানারকম বাহারি জিনিসপত্রে ঠাসা। রয়েছে অজস্র ধরনের রঙিন চিনেমাটির পুতুল, পাথরের ছোটখাটো মূৰ্তি, সাবেকি ফুলদানি, খুদে ঝাড়লণ্ঠন। সঙ্গে ফেং-শুই আইটেমও রয়েছে বেশ কিছু। উইন্ডচাইম, লাফিং বুদ্ধা, লাভবার্ডস। কাচের শোকেসের ওপারে, দোকানে ঝোলানো স্ফটিকগুলো ঝকঝক করছে।
বাইরে থেকে দোকানের ভিতরটা দেখছিল টুপুররা। ঢুকবে কি ঢুকবে না ইতস্তত করছিল তিন মূর্তি। দোকানে কোনও ক্রেতা নেই এখন, কাউন্টারে বসে আছেন এক মধ্যবয়সি মানুষ। মাথা নিচু করে লিখছেন কী যেন। সম্ভবত হিসেবটিসেব।
টুপুর একটা বড়সড় শ্বাস ভরে নিল বুকে। কুশলকে বলল, আর দাঁড়িয়ে থেকে কী হবে, আয়, কপাল ঠুকে ঢুকে পড়ি।
তিন মূর্তি কাচের দরজা ঠেলতেই চোখ তুলেছেন ভদ্রলোক। হাসিহাসি মুখে বললেন, কী নেবে ভাই তোমরা?
কুশল গলা ঝেড়ে বলল, আমরা একটু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
কী কথা?
লিয়াংকে দেখিয়ে টুপুর বলল, আমাদের এই বন্ধুর কাকা আপনাদের দোকান থেকে একটা জিনিস কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরশু শনিবারের আগের শনিবার।
কী জিনিস?
সেটা তো আমরা ঠিক জানি না … মানে সেটা জানতেই আসা ..
দু-চার সেকেন্ড ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন ভদ্রলোক। তার পরেই মুখভাব হঠাৎ বদলে গিয়েছে। লিয়াংকে আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে বললেন, তোমারই কাকা মারা গিয়েছেন বুঝি?
লিয়াং মাথা নাড়ল, হ্যাঁ।
পুলিশ তোমাদের কিছু জানায়নি? পুলিশ তো আমার দোকানে এসেছিল, তাদের তো আমি বলে দিয়েছি উনি কী কিনেছিলেন।
এখনও থানা থেকে আমাদের কিছু বলেনি।
ও, ভদ্রলোক একটুক্ষণ কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, তোমার কাকাকে আমি একটা ওয়ালহ্যাঙ্গিং বিক্রি করেছিলাম।
টুপুর বলল, ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা কীরকম ছিল যদি একটু বলেন ..
বড়সড় একটা ক্যালেন্ডারের মতো দেখতে। কাপড়ের। খুবই পুরনো। হলদেটে কাপড়ের উপর কী সব আঁকাজোকা ছিল। আর চিনে ভাষায় লেখাও ছিল কিছু।
কী লেখা ছিল?
সে আমি কী করে বলব? আমি কি চিনে ভাষা পড়তে পারি? সত্যি বলতে কী, ওটা যে চাইনিজ লেখা তা-ও আমি জানতাম না। আমার ধারণা ছিল, ওগুলো ছোট ছোট ছবি। ওই চিনা ভদ্রলোকই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলেন, তাই দেখে আমি বুঝতে পারলাম।
উনি কি আপনাকে বলেছিলেন কী লেখা আছে?
না। শুধু বলেছিলেন, এটা খুব ইন্টারেস্টিং পিস, মনে হচ্ছে আমার রিসার্চের কাজে লাগবে। … ও হ্যাঁ, আর-একটা কথাও বলেছিলেন। ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা কার যেন আঁকা … কী যেন নাম … মো … মো… দুর ছাই, নামটা মনে আসছে না।
পুলিশকে বলতে পেরেছিলেন নামটা?
উহুঁ। শুধু ওই মো-টুকুই মনে আছে।
ও। যদি আপত্তি না থাকে, আর-একটা প্রশ্ন করব? আমরা শুনেছি, আপনি নাকি গোড়ায় ওটা বিক্রি করতে চাননি। কারণটা জানতে পারি?
ভদ্রলোককে এবার বেশ গম্ভীর দেখাল, এ কথা কে বলল তোমাদের?
লিয়াং বলল, আমার কাকাই বাড়িতে গল্প করেছিলেন।
উম আবার কথা বলতে সামান্য সময় নিলেন ভদ্রলোক, সত্যিই ওটা বেচার আমার ইচ্ছে ছিল না। অবশ্য কোনও স্পেসিফিক কারণ নেই। জাস্ট একটা প্রাচীন প্রাচীন লুক আছে বলে দোকানেই সাজিয়ে রেখেছিলাম।
পরে তা হলে ডিসিশন বদল করলেন যে?
ভদ্রলোক বারবার এসে চাইছিলেন…আমিও ভাবলাম, যদি কাজে লাগে তো দিয়েই দিই…
কুশল ফস করে বলে উঠল, তার জন্য আপনি দশ হাজার টাকা দরও হেঁকে বসলেন…
তাতে তোমার কী হে? ভদ্রলোক এবার চটে গেলেন দুম করে, ডেঁপোমি কোরো না। বাচ্চা ছেলে, বাচ্চা ছেলের মতো থাকো। জিনিসটা আমি দশ হাজারে বেচেছি, না দশ লাখে, তার হিসেব আমি তোমায় দেব কেন? যদি বলি জিনিসটা বিনা পয়সায় দিয়ে দিয়েছি, তা হলেও কি তোমার কিছু বলার আছে?
আহা, আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন আঙ্কল? টুপুর তাড়াতাড়ি হাল ধরল, আমার বন্ধু খারাপ সেন্সে কিছু বলেনি। ও শুধু জানতে চাইছিল, দশ হাজার টাকা দাম পেয়েই কি আপনি জিনিসটা বেচতে রাজি হলেন?
আমি এই প্রশ্নের জবাব দেবই না। ভদ্রলোকের গোলগাল মুখখানা থমথম করছে, জিনিসটা বেচে আমি অপরাধী হয়ে গিয়েছি নাকি? একবার পুলিশ এসে জেরা করবে, একবার তোমরা এসে সাড়ে-সতেরেখানা প্রশ্ন হানবে…
প্লিজ আঙ্কল, আপনি অন্যভাবে নেবেন না। আসলে, জিনিসটা কেনার পরেই লিয়াংয়ের কাকা মারা গেলেন তো…
এবং ওয়ালহ্যাঙ্গিংটাও ভ্যানিশ হয়ে গেল…
আই, অ্যাই, তোমরা কী বলতে চাও, অ্যাঁ? ভদ্রলোকের নাকের পাটা ফুলে উঠল, আমার দোকান থেকে কিছু কেনার পর কোনও কাস্টমারের যদি অ্যাকসিডেন্ট হয়, তার জন্য আমি দায়ী? তার কাছ থেকে যদি কিছু খোওয়া যায়, তাতেই বা আমার করার কী আছে? আর তোমাদের আমি এত কৈফিয়তই বা কেন দেব, অ্যাঁ?
কুশল পালটা কিছু বলতে যাচ্ছিল, টুপুর চোখের ইশারায় তাকে থামাল। নিজেও চুপ করে গিয়েছে। নিরীক্ষণ করছে দোকানের মালিককে। ভদ্রলোকের মুখচোখে কেমন যেন অস্থির-অস্থির ভাব। টুপুররা তো এমন কিছু আজেবাজে প্রশ্ন করেনি, অথচ ভদ্রলোক খেপে গেলেন কেন? পুলিশ কি এসে খুব চোটপাট করে গিয়েছে?
দুজন খদ্দের ঢুকেছে দোকানে। স্বামী-স্ত্রী। ভদ্রলোক পলকে সামলে নিয়েছেন নিজেকে। টুপুরদের ছেড়ে তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পটাপট আলো জ্বালিয়ে দিয়েছেন। আরও ঝলমল করে উঠল দোকান। ঘুরে ঘুরে হরেক রকমের উইন্ডচাইম দেখাচ্ছেন। টুটুং, টিংটাং বাজনায় দোকান মুখর। শুধু বাতাসি ঘণ্টাই নয়, একটা হাস্যমুখ বুদ্ধমূর্তিও পছন্দ করল স্বামী-স্ত্রী। দরাদরির কোনও বালাই নেই, করকরে সাতশো টাকা দিয়ে, প্যাকেট বগলদা করে বেরিয়ে গেল দুজনে।
ক্যাশবাক্সে টাকা রাখলেন দোকানের মালিক। মেজাজ ঈষৎ প্ৰসন্ন যেন। তেরচা চোখে বললেন, কী হল, তোমরা এখনও দাঁড়িয়ে আছ যে?
টুপুর মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল, এমনিই। …আপনার মনে কষ্ট দিয়ে ফেললাম, তাই সরি বলার জন্য ওয়েট করছি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। ভদ্রলোকের কাঁচাপাকা গোঁফের ফাঁকে একফালি হাসি উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল। নরম স্বরে লিয়াংকে বললেন, শোনো ভাই, তোমার কাকার মৃত্যুসংবাদে আমি সত্যি খুব দুঃখিত হয়েছি। ওঁর সঙ্গে আমার কতটুকুই বা পরিচয়। দু- চার দিন দোকানে এসেছেন, দুটো-চারটে কথা বলেছেন, ব্যস। তাতেই ভদ্রলোককে আমার বেশ লেগেছিল। শান্ত ধরনের মানুষ… ভেরি লাইকেবল ফেলো।
লিয়াং মৃদু গলায় বলল, আমার কাকাকে সবাই লাইক করত। সেই জন্যই তো ভেবে পাচ্ছি না কে তাঁকে ওভাবে মারল!
আহা, ইচ্ছে করে কেউ মেরে দিয়েছে, এমনটাই বা ভাবছ কেন? ভাল মানুষরা গাড়িচাপা পড়েন না? আর ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা হয়তো এদিক ওদিক পড়ে ছিল, রাস্তার কেউ তুলে নিয়ে গিয়েছে।
কিন্তু ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা নিয়ে কাকার তো বাড়ি ফেরার কথা। তিনি প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে যাবেনই বা কেন?
সেটা তো আমি বলতে পারব না। দ্যাখো, পুলিশের তদন্তে কী বেরোয়।
টুপুর বলল, আঙ্কল, আর-একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
আবার কী প্রশ্ন?
আপনি কি জানতেন ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা খুব মূল্যবান? দশ হাজার টাকা দামও হতে পারে?
বারবার দশ হাজার, দশ হাজার করছ কেন? দাম নিয়ে আমি কোনও কথাই বলব না।
আচ্ছা, আচ্ছা। …আর একটা কোয়েশ্চেন, আঙ্কল। ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা কদিন ধরে আপনার দোকানে ঝুলছিল?
রিসেন্টলিই এনে রেখেছিলাম। দেড়-দুমাস হল।
পেয়েছিলেন কোত্থেকে? ..মানে কারও কাছ থেকে কিনে সাজিয়েছিলেন, নাকি…?
ওটা আমার বাড়িতেই ছিল। বহুকাল ধরে।
কুশল বলে উঠল, আশ্চর্য! বহুকাল ধরে বাড়িতে ছিল… অথচ দেড়-দুমাস আগে দোকানে টাঙিয়েছিলেন… কেমন কেমন শোনাচ্ছে না?
অ্যাই, কী মিন করতে চাইছ তুমি, অ্যাঁ? আমার জিনিস আমি ঘরে রাখি, দোকানে টাঙাই, তাতে তোমাদের কী?
কিছুই না। তবে শেষ পর্যন্ত মোটা টাকায় বেচে দিলেন তো?
চোপ। বেশ করেছি বেচেছি। ভদ্রলোক ঝপ করে ফের তেতে গিয়েছেন, যাও তো, ভাগো তো এবার। একে খদ্দেরটদ্দের নেই, তার উপর কোত্থেকে যত উটকো আপদ এসে…! আউট। আউট।
ভদ্রলোকের হম্বিতম্বির ধাক্কাতেই টুপুররা প্রায় ছিটকে বেরিয়ে এল বাইরে। ফুটপাত থেকেই দেখল ভদ্রলোক এখনও কটমট চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎই পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে কার সঙ্গে যেন কথা বলা শুরু করেছেন। বাতচিত চালাতে চালাতেও দৃষ্টি টুপুরদের দিকে।
টুপুর চাপা গলায় বলল, চল, সরে যাই।
দুচার পা গিয়েও কুশল দাঁড়িয়ে পড়ল। উত্তেজিত গলায় বলল, ভদ্রলোককে ছেড়ে দেওয়া বোধহয় উচিত হল না। আর-একটু বাজানোর দরকার ছিল।
লিয়াং মাথা দুলিয়ে বলল, ইয়েস। লোকটাকে আমার যথেষ্ট সাসপিস মনে হচ্ছে। কাকার অ্যাকসিডেন্টের পিছনে ওর একটা হাত থাকলেও থাকতে পারে।
কুশল মুঠো ঝাঁকিয়ে বলল, অবশ্যই। জিনিসটা বিক্রি করার পরই হয়তো মনে হয়েছে কাজটা ভুল হয়ে গেল। আরও বেশি দামে জিনিসটা বেচা যেত। তাই হয়তো ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা ফের হাতানোর জন্য অ্যাকসিডেন্টটা ঘটিয়েছে।
টুপুর হেসে ফেলল, তার মানে দাঁড়াচ্ছে, জিনিসটা বেচার পরেই ভদ্রলোক লিয়াংয়ের কাকাকে মারতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন?
নিজে যাবেন কেন? লোকও তো লাগাতে পারেন।
বেশ। তাই না হয় হল। কিন্তু লিয়াংয়ের কাকা বাড়ি ফিরে প্রিন্সেপ ঘাটেই বা গেলেন কেন? যাতে কেউ তাঁকে ফাঁকা জায়গায় নিশ্চিন্তে গাড়িচাপা দিতে পারে?
কুশল একটু দমে গেল এবার। বেলা পড়ে এসেছে, সন্ধে নামছে। শহরে। আনমনে একবার আকাশের দিকে তাকাল কুশল। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, তুই আমার আইডিয়াটাকে পাত্তা দিচ্ছি না, টুপুর? আমি কিন্তু এরকম একটা কেস পড়েছি। জুয়েলারির মালিক একটা হিরের নেকলেস বিক্রি করার পর নিজের কাস্টমারকে খুন করিয়ে গয়নাটা আবার নিয়ে নিচ্ছে। কেউ তাকে সন্দেহ করেনি, কিন্তু ডিটেকটিভ ঠিক ধরে ফেলেছিল। মনে রাখবি টুপুর, যাকেই তুই সন্দেহের তালিকার বাইরে রাখবি, সে-ই কিন্তু সম্ভাব্য অপরাধী।
বুঝলাম। কিন্তু প্রিন্সেপ ঘাটে যাওয়াটা..?
কারণটা খুঁজতে হবে। সেটাই তো ডিটেকটিভের কাজ।
টুপুর আর তর্কে গেল না। তবে কিউরিও শপের মালিককেও একেবারে ঝেড়ে ফেলল না চিন্তা থেকে। আরও অনুসন্ধান দরকার। লিয়াং বলছে, তার কাকা অজাতশত্ৰু। তা হলে তাঁকে কেউ মারবে কেন? ওই ওয়ালহ্যাঙ্গিংটাই কি একমাত্র কারণ? ভাল করে খতিয়ে না-দেখে নিশ্চিত হওয়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? লিয়াংদের পরিবারের মধ্যেই কোনও গন্ডগোল নেই তো? কোনও জ্ঞাতিশত্ৰুতা? সম্পত্তি-টম্পত্তির জন্য? কিংবা অন্য কিছু যা টুপুর এখনও জানে না?
চিন্তিত স্বরে টুপুর বলল, মনে হচ্ছে একবার লিয়াংদের বাড়িতে যেতেই হবে।
লিয়াং বলল, কবে যাবে বলো?
দেখি। রাত্তিরে ফোন করে তোমায় জানিয়ে দেব।
কুশল বলল, আমার কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে এই দোকানদার ভদ্রলোকই কোনও ফাউল প্লে করেছে। ভদ্রলোককে ভাল করে চেপে ধরতে পারলেই সত্যিটা বেরিয়ে আসবে।
টুপুর অন্যমনস্কভাবে মাথা নাড়ল, দরকার হলে তা-ও করা যাবে।
.
০৪.
লালবাজার পার হয়ে, বাঁ ফুটপাত ধরে, সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের দিকে একটুখানি হাঁটলেই ছাতাওয়ালা গলি। লিয়াং রাস্তাটার মুখেই দাঁড়িয়ে ছিল, টুপুরদের দেখে হাত তুলল, হাই! তোমরা এত লেট করলে কেন?
কুশল বলল, আর বলিস না, বাড়ি ফিরে স্কুল-ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে টুপুরকে ডাকতে গেলাম… টুপুরও রেডি হল… তারপর বাস.. ট্রাফিক জ্যাম..
ও কে। ও কে। তাড়াতাড়ি চলো। বাবা কিন্তু আর বেশিক্ষণ বাড়ি থাকবেন না।
টুপুর জিজ্ঞেস করল, দোকানে যাবেন বুঝি?
হাঁ। বাবা দুপুরে খেতে আসেন তো, তারপর একটু রেস্টফেস্ট নিয়ে বেরোন। মা ততক্ষণ দোকান সামলান।
তোমাদের দোকানটা কীসের, সেটা কিন্তু জানা হয়নি, লিয়াং।
সরি। আমারই বলা উচিত ছিল। লিয়াং হাঁটা শুরু করেছে। হাঁটতে হাঁটতে বলল, আমাদের লড্রির বিজনেস। মিশন রো-তে। বহু দিনের পুরনো ব্যবসা। আমার ঠাকুরদার বাবা স্টার্ট করেছিলেন।
ওরেব্বাস! তার মানে সত্তর-আশি বছর আগেকার?
হিসেব করলে দেখা যাবে, তারও অনেক অনেক বছর আগের। আমাদের ফ্যামিলি বংশানুক্রমে এই বিজনেস করছে। কবে যে শুরু হয়েছিল, বলা কঠিন। বাবার মুখে শুনেছি, সাংহাইতেও নাকি আমাদের লন্ড্রি ছিল।
কুশল অবাক মুখে বলল, তোরা সাংহাইয়ের লোক? আমার ধারণা ছিল কলকাতার চাইনিজরা সবাই বুঝি ক্যান্টন থেকে এসেছেন।
না রে। আমাদের কমিউনিটিতে নানান জায়গার লোক আছে। কেউ এসেছিল হাক্কা থেকে, কেউ বা হুপে। অবশ্য সংখ্যায় ক্যান্টনের লোকই বেশি।
টুপুর বলল, আমি বোধহয় এই বিষয়ে একটু একটু জানি।
কী রকম?
এই যেমন ধরো, তোমরা চিনারা অনেকেই এ-দেশে এসেও নিজের নিজের বিজনেসই বজায় রেখেছ। তোমাদের এক-এক জায়গার লোকরা এক-একটা ব্যবসায় ওস্তাদ। যেমন ক্যান্টনিরা কাঠের কাজ করেন, কিংবা হোটেল-রেস্টুরেন্ট চালান। আর যত চিনা ডেন্টিস্ট আছেন, তাঁরা সবাই এসেছিলেন হুপে থেকে। আর হাক্কারা, মানে চিনে যাঁদের স্থায়ী বাসস্থান ছিল না, তাঁরা করেন চামড়ার ব্যবসা।
বা, তোমার জি কে তো দারুণ! লিয়াং মুগ্ধ হয়েছে, আমার অবশ্য লন্ড্রিতে বসার একটুও ইচ্ছে নেই। আমি টিচিং লাইনে যাব। আমার কাকার মতো।
কথায় কথায় অনেকটা পথ চলে এসেছে টুপুররা। ছাতাওয়ালা গলি এঁকেবেঁকে চলেছে তো চলেছেই। রাস্তায় এখন বেশ চিনা মুখ দেখা যায়। মোটরসাইকেল হাঁকিয়ে ছুটে গেল দুই চিনা যুবক। হাতে-টানা রিকশায় চড়ে চিনা গৃহিণী কেনাকাটা সেরে ফিরছেন। স্কুল-ইউনিফর্ম পরা একদল চিনা মেয়ে কলকল করতে করতে চলে গেল পাশ দিয়ে। একটা-দুটো স্টেশনারি দোকানও আলো করে বসে আছেন চিনা দোকানদার। অন্যান্য মানুষ দেখা গেলেও পাড়াটা যে চিনাদের, বুঝতে অসুবিধে হয় না।
মূল রাস্তা ছেড়ে একটা গলিতে ঢুকল লিয়াং, সেখান থেকে আর একটা সরু গলি। অবশেষে একখানা পুরনো-পুরনো বাড়ির সামনে এসে থেমেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ওয়েলকাম টু আওয়ার প্লেস। একটু দেখে দেখে এসো। আমাদের এন্ট্রান্সটা কিন্তু অন্ধকার অন্ধকার।
টুপুরের অবশ্য অত অন্ধকার লাগল না। সে থাকে হাতিবাগানে, প্রচুর পুরনো পুরনো বাড়ি তার দেখা। তুলনায় এ বাড়ির ভিতরটায় যথেষ্ট আলো। তবে মাথায় রং-বেরঙের কাচ বসানো দরজা, নকশাদার সবুজ সানশেড লাগানো জানলা, আর বারান্দার স্যান্ডকাস্টিং করা রেলিং ঘোষণা করছে বাড়ির বয়স একশো পেরিয়েছে বহুকাল।
সরু সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে, লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে লিয়াংদের ফ্ল্যাট। বড়সড় ড্রয়িংরুমের সোফায় টুপুরদের বসিয়ে অন্দরে গেল লিয়াং। দিব্যি সাজানো-গোছানো ঘর। টিভি, টেলিফোন, শোকেস, ক্যাবিনেট, কী নেই ড্রয়িংরুমে। পেল্লাই উঁচু সিলিং থেকে লম্বা লম্বা ভঁটি বেয়ে ঝুলছে ফ্যান, রংদার বাহারি ল্যাম্পশেড। দরজা-জানলায় সিল্কের পরদা দেওয়ালে দুখানা বড়বড় বাঁধানো ছবি দৃশ্যমান। একটা ল্যান্ডস্কেপ। সম্ভবত কোনও বিখ্যাত চিনা শিল্পীর মূল ছবির নকল। অন্য ছবিটি সান-ইয়েৎসেনের। শোকেসে বার্বিডলের পাশে চিনামাটির পুতুল, ফুলদানি। টিভির মাথায় ছোট্ট ছোট্ট সফট টয়। একখানা পিতলের উইন্ডচাইমও ঝুলছে ঘরে। ফ্যানের হাওয়া পেয়ে শব্দ বাজিয়ে দুলছে।
টুপুর চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিল ঘরখানা। গৃহসজ্জা সাবেকি ধাঁচের হলেও মোটের উপর রুচিশীল। চৈনিক সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি মিশে আছে কি? নাকি ব্রিটিশ?
কুশল কেমন বেজার মুখে বসে। হঠাৎই চাপা স্বরে বলল, ইস, খ্যাঁটনটা আজ মিস হয়ে গেল রে। আগেরবার যখন এসেছিলাম, আন্টি কত কিছু খাইয়েছিলেন। একদম অরিজিনাল চাইনিজ রান্না।
টুপুর ভুরু কুঁচকে বলল, সাংহাই তো চিনের নর্দার্ন সাইডে। উত্তর চিনের লোকেরা তো সেদ্ধ সেদ্ধ খাবার খায়।
হ্যাঁ, আন্টির রান্নাতেও তেল বেশ কম ছিল। কিন্তু হেভি টেস্টি। রাইস নুডলসের একটা প্রিপারেশান খাইয়েছিলেন, এখনও জিভে লেগে আছে। আর-একটা সুপ … লেটুসটেটুস দিয়ে ..
টুপুর হেসে ফেলল, কী আর করা, আন্টি আজ যখন নেই …
কথার মাঝেই বাবাকে নিয়ে লিয়াংয়ের প্রবেশ। সঙ্গে লিয়াংয়ের বোনও রয়েছে। মেইলি। ভারী মিষ্টি দেখতে মেয়েটা। পুতুল-পুতুল। চেরা চেরা নীলচে চোখ, ফোলা ফোলা ফরসা গাল, চুল টেনে ঝুঁটি করে বাঁধা। কুঁটিতে নীল রঙের এক টুকরো উল লাগানো আছে। লিয়াংয়ের বাবার রং অবশ্য অতটা উজ্জ্বল নয়, হলদেতে তামাটে ছোঁওয়া। টুপুরের ধারণা ছিল, চিনারা ছোটখাটো হয়, লিয়াংয়ের বাবা কিন্তু বেশ লম্বা-চওড়া। পরনে নেভি ব্লু ট্রাউজার আর ঘিয়ে রং বুশশার্ট। লিয়াংয়ের মতো লিয়াংয়ের বাবার হাতেও একটা কালো ব্যান্ড।
টুপুর আর কুশল উঠে বাও করেছিল, লিয়াংয়ের বাধাও মাথা ঝোঁকালেন। ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন, আমি ভেবেছিলাম, তুমি আর-একটু বড় মেয়ে। এখন দেখছি, একেবারেই ছোট। আমাদের লিয়াংয়ের মতো।
টুপুর হাসল, আমাদের তো সেম ক্লাস আল। স্কুলটাই যা আলাদা।
লিয়াং বলছিল, তুমি নাকি খুব সাহসী মেয়ে! তোমার ডিটেকটিভ আন্টির অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করো!
ওই আর কী। করি মাঝে মাঝে।
তোমার কি মনে হয় ঝিয়েনের কেসটা … মানে আমার ভাইয়ের কেন্সটা তোমরা সলভ করতে পারবে?
চেষ্টা তো করব। কিন্তু তার আগে তো আঙ্কল আমাদের জানতে হবে, ওই ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা সত্যি মূল্যবান ছিল কিনা।
নিশ্চয়ই ছিল। নইলে কি ঝিয়েন ওটা কেনার জন্য অত ছটফট করে? লিয়াংয়ের বাবা সোফায় বসলেন, আমার ভাই মোটেই অকারণে দশ হাজার টাকা নষ্ট করার বান্দা ছিল না।
টুপুর বলল, লিয়াং তো কিছুই বলতে পারল না। ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা সম্পর্কে আপনার ভাই আপনাকে কিছু বলেছিলেন কি?
আকাশের পাখি মাটির প্রাণীর সঙ্গে কী কথা বলবে? একে অপরের ভাষা বোঝে কি?
টুপুরের ঠিক বোধগম্য হল না কথাটা। অবাক মুখে লিয়াংয়ের দিকে তাকাচ্ছে।
লিয়াং তাড়াতাড়ি বলে উঠল, পাপা বলতে চাইছেন, তারা দুই ভাই দুটো আলাদা জগতের মানুষ। একজন অনেক উঁচুতে বিচরণ করতেন, আর-একজন আর পাঁচটা মানুষের মতো সাধারণ। কাকার সঙ্গে পাপার তাই কোনও বিষয় নিয়েই বড় একটা আলোচনা হত না।
কথায় কী হেঁয়ালি, বাপস। এই ভাষায় ভদ্রলোক যদি উত্তর দিতে থাকেন, টুপুরকে তো তা হলে চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে ফিরতে হবে।
টুপুর নার্ভাস গলায় বলল, অর্থাৎ ওয়ালহ্যাঙ্গিংটা কেমন ছিল, তা আপনার অজানা। তাই তো?
সেরকমটা হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। লিয়াংয়ের বাবা সোজা হয়ে বসলেন, তবে এই বিষয়টা নিয়ে কেন যেন ঝিয়েন আমার সঙ্গে কিছুটা আলোচনা করেছিল। বলেছিল, ওই এক টুকরো কাপড় নাকি আমাদের জানা ইতিহাসের অনেকটাই বদলে দেবে।
তাই বুঝি? কীভাবে?
তা তো বলতে পারব না। আমি মুখুসুখ্যু মানুষ, ঝিয়েনের মতো পণ্ডিত তো নই। হঠাৎই লিয়াংয়ের বাবার স্বর বুজে এল। ধরা ধরা গলায় বললেন, এত পড়াশোনা … এত জ্ঞান …কী হল শেষ পর্যন্ত? মাটির নীচে যাওয়ার আগে পৃথিবীতে পঞ্চাশটা বসন্তও তো দেখতে পেল না বেচারা।
উনি তো শুনলাম প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গবেষণাও করছিলেন?
হ্যাঁ। ইতিহাসই ছিল ওর নেশা। কত লাইব্রেরিতে যে ছুটে ছুটে বেড়াত। সপ্তাহে তিনদিন আলিপুরের ন্যাশনাল লাইব্রেরি তো বাঁধা। স্কুল ছুটির পর সটান চলে যেত, লাইব্রেরি বন্ধ না-হওয়া অবধি বসে থাকত বই মুখে করে। কত বিদ্বান মানুষদের সঙ্গে যে আলাপ ছিল ওর।
তারাও কি চাইনিজ?
না। বেশির ভাগই বাঙালি। ঝিয়েনের সাবজেক্টেরই লোক। তাদের দুতিন জনের সঙ্গে তো প্ৰায় রাতেই কথা বলত টেলিফোনে।
কুশল গলা ভারী করে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আঙ্কল ঝিয়েন কি তাদের কাছে ওয়ালহ্যাঙ্গিংটার গল্প করেছিলেন?
কী জানি, বলতে পারব না।
তাদের নাম-ধাম কিছু আপনার কাছে আছে?
বোধহয় আছে। ঝিয়েনের ডায়েরিতে। দাঁড়াও দেখছি।
লিয়াংয়ের বাবা উঠে পড়লেন। ভিতরে যেতে গিয়েও ঘুরে তাকিয়ে মেইলিকে কী যেন নির্দেশ দিলেন চিনা ভাষায়। সঙ্গে সঙ্গে মেইলিও দৌড়ে অন্দরে চলে গেল। ফিরেছে ট্রে সাজিয়ে। ট্রে-তে পেষ্ট্রি, কাজু আর দুগ্লাস কোল্ড ড্রিঙ্ক।
টুপুর বলল, কী কাণ্ড! এসবের আবার কী দরকার ছিল?
ছোট্ট করে হাসল মেইলি। উত্তর দিল না।
কুশল তড়িঘড়ি গ্লাস তুলে নিয়েছে। চুমুক দিয়ে লিয়াংকে বলল, আয়, তোরাও একটু শেয়ার কর।
আমরা নেব না রে। স্কুল থেকে এসে থুপকা খেয়েছি।
টুপুর একটা কাজুবাদাম তুলে দাঁতে কাটল। মেইলিকে জিজ্ঞেস করল, তুমি চুলে নীল উল লাগিয়েছ কেন? ফ্যাশন?
পলকে মেইলির মিষ্টি মুখে বিষাদের ছায়া। ঠোঁট কামড়াচ্ছে।
লিয়াং বোনকে একবার দেখে নিয়ে বলল, ওটা আমাদের কাস্টম, তুপুর। ঘনিষ্ঠ কোনও রিলেটিভ মারা গেলে মেয়েরা মাথায় নীল উল বাঁধে। আর ছেলেরা হাতে কালো টেপ। মৃত্যুর ঊনপঞ্চাশ দিন পরে আমরা এই উল আর টেপ খুলে পুড়িয়ে ফেলি।
ও। একটু সময় নিয়ে টুপুর ফের বলল, মেইলিকে কি আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?
মেইলি অল্প ঘাড় নাড়ল।
আঙ্কল ঝিয়েন তো তোমায় খুব ভালবাসতেন। তিনি কি তোমাকে ওয়ালহ্যাঙ্গিংটার ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন?
মেইলি ভার মুখে বলল, না। শুধু একবার বলেছিলেন, ইতিহাসের পাতায় আবার ফু শাংয়ের নাম ফিরে আসবে।
তিনি কে?
একজন অভিযাত্রী। তিনি নাকি প্রায় দেড় হাজার বছর আগে …নাকি তারও অনেক আগে, জাহাজে চড়ে সমুদ্রে-সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতেন।
লিয়াং চোখ বড় বড় করে বলল, কই, বো আমাকে তো বলেনি। .. ওই ওয়ালহ্যাঙ্গিং কি তবে ফু শাংয়েরই ছিল?
মেইলি বলল, তা তো আমি জানি না।
লিয়াংয়ের বাবা ফিরেছেন ঘরে। এক হাতে বাঁধানো ডায়েরি, অন্য হাতে একটা খবরের কাগজ। প্রথমে খবরের কাগজখানাই টুপুরকে বাড়িয়ে দিলেন, লুক, আমাদের এখানকার লোকাল নিউজপেপারে ঝিয়েনের মৃত্যুর খবরটা ডিটেলে বেরিয়েছিল। সঙ্গে ঝিয়েনের ছবিও।
খবরের কাগজখানা হাতে নিয়ে টুপুর হতবাক। অস্ফুটে বলল, চাইনিজ নিউজপেপার? লোকাল?
হাঁ। কলকাতা থেকেই বেরোয়। একটা নয়, দুটো পেপার পাবলিশ হয় চাইনিজ ল্যাঙ্গোয়েজে। অন্যটাতেও ঝিয়েনের অবিচুয়ারি ছিল, কিন্তু ছবি নেই বলে আনলাম না।
টুপুর আর কুশল একসঙ্গে ঝুঁকে দেখল ঝাও ঝিয়েনের ছবিটা। দেখে লিয়াংয়ের বাবা বলেও ভুল হতে পারে। একই রকম গোলগাল মুখ, চওড়া কপাল, ফোলা ফোলা চোখের পাতা। শুধু ভাইয়ের চোখে চশমা আছে, দাদার নেই।
কাগজটাকে একটু উলটেপালটে দেখে রেখে দিল টুপুর। লিয়াংয়ের বাবা ফের বসেছেন সোফায়। গর্বিত গলায় বললেন, আমাদের কমিউনিটিতে ঝিয়েনের খুব কদর ছিল। ওর এই সাডেন চলে যাওয়ায় কলকাতার গোটা চাইনিজ সমাজ বড় দুঃখ পেয়েছে। ওকে সমাধি দেওয়ার দিন… আই মিন লাস্ট থার্সডে… কত মানুষ যে এসেছিল! ঝিয়েনের স্কুলও ছুটি ডিক্লেয়ার করেছিল সেদিন।
লিয়াং বলল, বো-এর ন্যাশনাল লাইব্রেরির বন্ধুরাও এসেছিলেন।
দুজন। লিয়াংয়ের বাবা ডায়েরি খুললেন, এই যে, তাঁদের নাম-ঠিকানা চাইছিলে… লেখা আছে এখানে। চাইনিজে লেখা, তোমরা পড়তে পারবে না, নোট করে নাও। নাম্বার ওয়ান, ডক্টর বাসব সমাদ্দার। ফাইভ বাই টু, আর এন দাস রোড, কলকাতা একত্রিশ। নাম্বার টু, ডক্টর শিবতোষ রায়। টোয়েন্টি ওয়ান বাই থ্রি, সিমলাই পাড়া লেন, কলকাতা টু। …আর-একজনের নামও দেখতে পাচ্ছি। তিনি অবশ্য আসেননি। ডক্টর তরুণ বাসু। এঁর ঠিকানা নেই, ফোন নম্বর আছে…
তিনটে নাম-ঠিকানাই পরিষ্কার করে টুকে নিল টুপুর। ঝাও ঝিয়েনের স্কুল, আর স্কুলের সহকর্মীদের সম্পর্কেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিল। পাড়া-প্রতিবেশীদের সম্পর্কেও। লিখে নিল লিয়াংয়ের বাবা-মার নামও।
আরও কিছুক্ষণ কথা হল টুকটাক। তথ্যভাণ্ডার মোটামুটি সমৃদ্ধ করে উঠে পড়ল টুপুর। লিয়াংয়ের বাবাও বেরোনোর জন্য তৈরি।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে লিয়াংয়ের বাবা বললেন, কী মনে হল? এইসব ইনফরমেশন থেকে কিছু বেরোবে?
দেখি। মাসির সঙ্গে আলোচনা করি। প্রয়োজন হলে মাসিকে নিয়ে আবার আসব।
ইউ আর অলওয়েজ ওয়েলকাম। ঝিয়েনের মৃত্যুরহস্য জানার জন্য আমিও বড় উদগ্রীব হয়ে আছি।
বাড়ির সদরে এসে টুপুর দাঁড়াল ক্ষণেক। মেইলিও এসেছে তাদের সঙ্গে সঙ্গে। মুখ থমথম, দুচোখ ভরে গিয়েছে জলে।
মেয়েটার কাঁধে আলগা চাপ দিল টুপুর, মন খারাপ কোরো না মেইলি। তোমার বো’কে যদি সত্যিই কেউ মেরে থাকে, তাকে আমরা ধরবই। কথা দিলাম।
মেইলির চোখের জল এবার টুপটুপ নেমে এসেছে গালে। ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটা।