সর্প-রহস্য সুন্দরবনে – মিতিনমাসি – সুচিত্রা ভট্টাচার্য
০১.
বুঝলি টুপুর, মানুষ নামের জীবটা এক্কেবারে ঢ্যাঁড়স, সোফায় বসে ঠ্যাং নাচাতে নাচাতে পার্থ আলগা মন্তব্য ছুড়ে দিল, আমাদের এই গ্রহে মানুষের চেয়ে অপদাৰ্থ জীব আর দুটি মিলবে না।
টুপুর ফোঁস করে উঠল, ইস, বললেই হল! মানুষই জগতের সেরা প্রাণী।
কচু। মানুষ কী পারে? চিতাবাঘ বা হরিণের মতো দৌড়োনোর ক্ষমতা আছে মানুষের নিদেনপক্ষে ঘোড়ার সঙ্গেও কি পাল্লা দিতে পারে? কুকুরের মতো ঘ্রাণশক্তি আছে? বাজপাখির মতো চোখ? বা সাইবেরিয়ান হাঁসদের মতো স্মৃতিশক্তি? কম সে-কম ছ-সাত হাজার মাইল পথ কেমন নিখুঁতভাবে চিনে চিনে ওরা আকাশপথে পাড়ি জমায় ভাব! ঠিক একই জলায় এসে নামে। মানুষ তো দিকই ঠিক রাখতে পারবে না। বাঘ, সিংহ, হাতিদের মতো গায়ে জোর নেই, মাছদের মতো সাঁতার কাটতে পারে না, বিড়ালটিড়ালদের মতো অন্ধকারে দেখতে পায় না …. পিঁপড়ে যে পিঁপড়ে, ওইটুকু একটা প্ৰাণী, তারও কিছু স্পেশাল ক্ষমতা আছে। বৃষ্টির গন্ধ টের পায়, ভূমিকম্প আসছে কিনা আগাম বুঝে ফ্যালে। আর মানুষ? সে সব ব্যাপারেই ক্যালাস। এই যে এত বড় একটা সুনামি হয়ে গেল, মানুষ আগে থেকে কিছুটি টের পেয়েছে?
সুনামির ব্যাপারটা কিন্তু পুরো ঠিক বললে না পার্থমেসো। আন্দামানের অনেক আদিবাসীই কিন্তু ভয়ংকর কিছু ঘটবে আন্দাজ করে পাহাড়টাহাড়ের মাথায় উঠে গিয়েছিল।
সে তো সমুদ্র দূরে সরে যাচ্ছে দেখে ভয় পেয়ে। তাদের পূর্বপুরুষরা বলত, সমুদ্র উলটো দিকে ছুটলেই তোরা চোঁ-চাঁ পালাবি। সেটা মনে রেখেই তারা দৌড় লাগিয়েছে। নিজেদের কোনও ইন্দ্রিয় দিয়ে কি তারা সুনামির পূর্বাভাস পেয়েছিল? পার্থ আয়েশ করে হেলান দিল সোফায়। বুড়ো আঙুল নেড়ে বলল, মানুষের হয়ে তর্ক করিস না টুপুর। গোরুও ইচ্ছেমতো কান নাড়াতে পারে, মানুষের সেটুকু মুরোদও নেই। মানুষ একটা যাচ্ছেতাই রকমের দুর্বল ক্রিচার।
টুপুর কাঁধ ঝাঁকিয়ে চুপ মেরে গেল। কাঁহাতক আর লড়বে পার্থমেসোর সঙ্গে। গত সোমবার থেকে টুপুরের স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে, পরশু বিকেলে তল্পিতল্পা গুছিয়ে টুপুর চলে এসেছে মিতিনমাসির বাড়ি। আর এ বাড়িতে পা রাখা ইস্তক অবিরাম গুণপনা শুনছে নানা জীবজন্তুর, পার্থমেসোর মুখে। কোত্থেকে একখানা ইয়া ঢাউস অ্যানিম্যাল কিংডমের বই জোগাড় করেছে মেসো, সকাল-সন্ধে সেই বইয়ের পাতা ওলটাচ্ছে, সঙ্গে চলেছে লম্বা লম্বা লেকচার। কাল রাতে কুমিরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। কুমির কেমন ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাঁ করে মড়ার মতো পড়ে থাকে, তারপর একগাদা পোকামাকড় মুখের ভিতর জমা হলে কেমন ঝুপ করে চোয়ালটা নামিয়ে দেয় ..। মানুষের নিলে অবশ্য আজই সকালে শুরু হয়েছে, কতক্ষণ চলবে কে জানে!
দুহাতে দুখানা জলখাবারের প্লেট নিয়ে ঘরে ঢুকেছে মিতিন। থালায় নারকেলের চাটনি আর সম্বর সহযোগে মশলা ধোসা। গত পুজোয় কেরল বেড়িয়ে ফেরার পর থেকে এ-বাড়িতে দক্ষিণী আহার চলছে খুব। মিক্সিতে চাল-ডাল বেটে প্রায়ই ইডলি বানানো হচ্ছে, সুজি দিয়ে উপমা, বাজার থেকে রেডিমেড ঘোল কিনে এনে ধোসা। একমাত্ৰ ইডলিতেই যা একটু নাক সিটকোয় পার্থ, তবে খেয়েও নেয়। আর ধোসা-উপমা-উত্থাপম হলে তো কথাই নেই, লুচির মতো উড়ে যায় ঝটপট।
প্লেট দুটো সেন্টার টেবিলে নামাতে নামাতে মিতিন জিজ্ঞেস করল, তোর মেসো এত হাউহাউ করছিল কেন রে টুপুর?
চেঁচাইনি তো। পাৰ্থ প্লেট টেনে নিল, মানুষ যে অন্য প্রাণীর তুলনায় কত ইনফিরিয়র, সেটাই টুপুরকে ব্যাখ্যা করছিলাম।
কী রকম? আমিও একটু শুনি।
এই ধরো হাত-পা, চোখনাক কান অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো মানুষ তো অ্যানিম্যালদের মতো করে ব্যবহার করতে পারে না …
রং। পারে না নয়, করে না। প্রয়োজন হয় না। কারণ, তাদের একটি অঙ্গই বাকি সব অঙ্গের ঘাটতি পুষিয়ে দেয়। মিতিন মাথায় আঙুল ঠুকল, মগজ, মগজ। মগজ বলে বস্তুটি যে মানুষের সকলের চেয়ে স্ট্রং, এ কথাটা কি ভুলে গিয়েছ?
বোকো না। হাতির মাথায় মানুষের চেয়ে ঢের বেশি ঘিলু থাকে। পাৰ্থ সুড়ুৎ করে সম্বরে একটুখানি চুমুক মেরে নিল, একটা বড়সড় হাতির মগজের ওজন জানো? ছকেজি। মানুষের সেখানে বড় জোর দেড় কিংবা পৌনে দুই।
ওভাবে হিসেব হয় না স্যার। দুজনের শরীরের ওজনের অনুপাতটা ধরো। মানুষের ক্ষেত্রে বডি আর ঘিলু পঞ্চাশ ইজ টু এক। অর্থাৎ পঞ্চাশ কেজি মানুষের ঘিলু এক কেজি। আর হাতির বেলায় অনুপাতটা হাজারে এক। তিমি মাছের দশ হাজারে এক। শিম্পাঞ্জির দেড়শোয় এক। গেরিলার পাঁচশোয় এক। তুলনামূলকভাবে কার ঘিলুটা বেশি হল?
ঘিলুই কি সব? তোমার কথা মানতে গেলে তো বলতে হয়, মোটা মানুষের বুদ্ধি বেশি, রোগা মানুষের বুদ্ধি কম?
তা কেন? প্রোপোরশন তো দুজনেরই মোটামুটি সমান। আসলে কে কীভাবে ব্রেনটা ইউজ করবে, তার উপরই নির্ভর করে কে বোকা আর কে চালাক।
মিতিন বসে পড়েছে সোফায়। ভারতী আর-একখানা খাবারের প্লেট ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তার হাতে। ধোসা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ঘুরে তাকাল টুপুরের দিকে, জানিস তো, জীবজগতে একটা প্রাণী আছে, বুদ্ধিতে যে প্রায় মানুষের সমান সমান।
কে? পাৰ্থ ফুট কাটল, বাঁদর?
আজ্ঞে না। ডলফিন। একটা মানুষের সমান ওজনের কোনও ডলফিনের মস্তিষ্কের গ্রে-ম্যাটার মানুষের চেয়ে কম নয়। বরং সামান্য বেশিই। স্রেফ জলে থাকার অপরাধে বেচারারা আগুনের ব্যবহার শিখল না। ফলে মস্তিষ্কটাও মানুষের মতো কাজে লাগল না। ওরা যদি ডাঙায় বাস করত, তা হলে হয়তো ওরাই আজ রাজত্ব করত দুনিয়ায়। আর আমরা হতাম ডলফিনের আজ্ঞাবহ দাস। মানে ওদের পোষা জীব আর কী।
টুপুর বলতে যাচ্ছিল, সে ভারী কিম্ভূত ব্যাপার হত তো তা হলে! তার আগেই টেলিফোনের ঝনঝন। পার্থ হাত বাড়িয়ে ফোনটা ধরতে গিয়েও থেমে গেল হঠাৎ তেরচা চোখে বলল, অ্যাই টুপুর, দাখ তো কে! যদি আমায় খোঁজে, বলে দিবি মেসো এখনও বাজারে।
কেন? মিতিনের চাউনি বক্ৰ হল, কাউকে মাল ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল বুঝি?
আর বোলো না, তিনটে পাগল লিটল ম্যাগাজিন বের করছে। রবীন্দ্রজয়ন্তী সংখ্যা। আমায় ম্যাটার দিল পঁচিশে বৈশাখের পর। অথচ এখন চার বেলা করে আমার প্রেসে এসে তাড়া লাগাচ্ছে। ওদের তাগাদার ভয়ে আমি কাল দুপুর থেকে আর সেই মাড়াইনি। সম্ভবত ওরাই এখন …
ছি ছি, এভাবে পার্টিকে ঝোলাচ্ছ?
আমি কী করব? আমাকেও যে ডিটিপির লোকটা ঝুলিয়ে রেখেছে। কম্পোজ করা ম্যাটার পেলে আমার আর ছাপতে কতক্ষণ। প্লেট বানাব আর মেশিনে চড়াব।
সব তোমার অজুহাত। তুমি মহা কুঁড়ে।
মাসিমেসোর বাদানুবাদের মাঝেই রিসিভার উঠিয়েছে টুপুর, হ্যালো? কে বলছেন?
ওপারে গমগমে কণ্ঠস্বর, ম্যাডাম … আই মিন মিতিন … আই মিন প্রজ্ঞাপারমিতা মুখোপাধ্যায় আছেন কি?
টুপুরের মুখ হাসিতে ভরে গেল, আপনি নিশ্চয়ই অনিশ্চয় আঙ্কল?
তুমি টুপুর? … তাই বলি, ম্যাডামের গলা তো এত সরু সরু নয়! … কেমন আছ? কবে এলে মাসির বাড়ি? গরমের ছুটি পড়ে গেল? এবারও কি ভেকেশনটা মাসির বাড়িই কাটাচ্ছ? নাকি বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যানটান হচ্ছে?
জবাবের প্রতীক্ষায় না থেকে পরেরপর প্রশ্ন হেনে চলেছেন অনিশ্চয়। উত্তর দেওয়ার আগেই পিছলে যাচ্ছে কোশ্চেন।
টুপুর ঢোক গিলে কোনমতে বলল, দেখি। ঠিক নেই কিছু।
তোমার মাসি কোথায়? কী করছেন?
ধোসা খাচ্ছে, বলতে গিয়েও সামলে নিল টুপুর।
অনিশ্চয় অবশ্য থেমে নেই। পরের প্রশ্ন জুড়েছেন, মাসিকে জিজ্ঞেস করো তো, উনি আজ হোল ডে ফ্রি আছেন কিনা?
হাত তিনেক দূরে বসেও অনিশ্চয়ের বাজখাঁই গলা কানে গিয়েছে মিতিনের। ইশারায় বলল, আছি।
উত্তর পেয়েই অনিশ্চয়ের ঘোষণা, মাসিকে ইনফর্ম করে দাও, আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আসছি। দরকার আছে।
ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখে টুপুর নামিয়ে রাখল ফোনটা কী এমন প্রয়োজন পড়ল যে, অনিশ্চয় মজুমদারের মতো উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার স্বয়ং ছুটে আসছেন মিতিনমাসির কাছে? গোয়েন্দা হিসেবে মিতিনমাসির খ্যাতি অবশ্য এখন কম নয়। এই তো গত মাসে ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির এক বড়সড় প্রতারণাচক্ৰকে পাকড়াও করেছে মিতিনমাসি। ভুয়ো ক্লেম দেখিয়ে বিমাসংস্থার লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করত দলটা। সরষের মধ্যে ভূত, অফিসের কিছু কর্মচারীও তাদের সঙ্গে জড়িত ছিল। একজন ডিভিশনাল ম্যানেজারও। খবরের কাগজে ফলাও করে বেরিয়েছিল সংবাদটা। সঙ্গে মিতিনমাসির নামও। পড়াশোনার চাপে সবসময় মিতিনমাসির শাগরেদি করা টুপুরের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে এই ছুটির সময় একটা কেস এসে গেলে ভালই হয়। অন্তত ছুটিটায় একটা রোমাঞ্চ তো থাকে। কিন্তু পুলিশের হোমরাচোমরারা কি প্রাইভেট ডিটেকটিভের হেল্প নেবেন? মনে হয়, অনিশ্চয় মজুমদার অন্য কোন কাজে আসছেন।
মিতিনের আহার শেষ। চোখ সরু করে দেখছিল টুপুরকে। হঠাৎই জিজ্ঞেস করল, কী ভাবছিস?
টুপুর সংবিতে ফিরল, কিছু না তো।
অলস চিন্তায় সময় নষ্ট করিস না। কাজের কাজ করা যা, চটপট গিয়ে আগে স্নানটা সেরে আয়।
এই সাতসকালে স্নান? সবে সওয়া নটা বাজে।
আমাদের বেরোতে হবে টুপুর।
সে কী? অনিশ্চয়বাবু যে আসবেন ..?
অনিশ্চয়বাবুর সঙ্গেই বেরোব। বলেই মিতিনের নজর পার্থর দিকে, আশা করি, তুমিও নিশ্চয়ই আমাদের সঙ্গে যাবে?
কোথায়? পার্থর চোখ বড়বড়।
সেটা অনিশ্চয়বাবু এলেই জানা যাবে।
উনি কি কোথাও যাওয়ার কথা বললেন?
মগজ খেলালে এটুকু আন্দাজ করে নেওয়াই যায়। যখন জিজ্ঞেস করেছেন সারাদিন ফ্রি আছি কিনা, তখন তো তার একটাই অর্থ। ওঁর সঙ্গে কোথাও বেরোতে হবে। নিশ্চয়ই একটা ওয়ার্কিং ডে-তে উনি এখানে আড্ডা মারতে আসছেন না!
হুম, তা বটে।
এবং জায়গাটাও সম্ভবত খুব কাছেপিঠে নয়। নইলে হোল ডের কথা বলতেন না। মিতিন মিটিমিটি হাসছে। চোখ টিপে টুপুরকে বলল, কী গো ঐন্দ্রিলাদেবী, লিটল ম্যাগাজিনের ছেলেগুলোর হাত থেকে ত্রাণ পাওয়ার এমন একটা সুযোগ তোমার মেসো কি ছেড়ে দেবে বলে মনে হয়?
বেড়ে বলেছ তো। পার্থ গাল ছড়িয়ে হাসল, অন্তত একটা দিন তো রক্ষে পাওয়া যাবে। অবশ্য যদি তোমার অনুমানগুলো অভ্রান্ত হয়।
বললাম যে, ব্রেনটাকে খেলাও। যত মস্তিষ্কের এক্সারসাইজ করবে, গ্রে-ম্যাটার তত পরিপুষ্ট হবে।
তাও ভাগ্যি বলোনি যে, পরিমাণে বাড়বে, পার্থ টিপ্পনি কাটল।
উপহাস কোরো না। বাড়তেও পারে। তোমাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, আদিম মানুষের তুলনায় এখন আমাদের মগজ যথেষ্ট ওজনদার। প্রাচীন মানুষের ফসিল পাওয়া গিয়েছে আফ্রিকার রোডেশিয়ায়। এখন যে দেশটার নাম জিম্বাবোয়ে। প্রায় লক্ষ বছর আগেকার মানুষ। তার মগজের ওজন কত ছিল জানো?
পার্থ ঠোঁট ওলটাল, জানি। সওয়া কেজি।
প্রায় ঠিক বলেছ। টু বি এজ্যাক্ট, তেরোশো গ্রাম। অর্থাৎ এখনকার মানুষের ব্রেনের চেয়ে না হোক আড়াইশো-তিনশো গ্রাম কম। এই তফাতটা কিন্তু ঘটেছে মগজ নিয়ে কসরত করার কারণেই। ভবিষ্যতে এই ওজন যে দুকিলোতে পৌঁছোবে না, একথা হলফ করে বলা যায় কি?
বাপস, কী কথা থেকে কী কথা! এখন তোমার মজুমদারসাহেব এলে আমি বাঁচি।
ভারতী চা এনেছে। টুপুর উঠে পড়ল। পাশের ঘরে এসে দেখল, কম্পিউটার অন করে ভিডিও গেমস খেলছে বুমবুম। তার শুধু একটাই খেলা, রোড র্যাশ। সাত-সাতটা মোটরসাইকেলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কী ভয়ংকর গতিতে যে নিজের মোটরসাইকেলটি ছোটায় সে! কি-বোর্ড টিপে-টিপে। শাঁইশুঁই করে একবার বাঁদিকে যায়, তো একবার ডানদিকে। উলটো দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে নিপুণভাবে পাশ কাটায়। সামনে কোনও পথচারী এসে পড়লে, ধাক্কা মেরে বেমালুম শুইয়ে দেয় তাকে। আরও যে কত অ্যাক্সিডেন্ট ঘটাচ্ছে অহরহ! এই হয়তো কোনও ল্যাম্পপোস্টে অঁতো মারল, পরক্ষণে গোত্তা খেল পাশের কোনও বাড়িতে। তাতেও এতটুকু ভ্রুক্ষেপ নেই বুমবুমের। চাবি টিপে কেতরে যাওয়া মোটরসাইকেলকে খাড়া করে ফের দৌড় শুরু। প্রতিদ্বন্দ্বীরা কাছেপিঠে এসে গেলে তাদের আর রক্ষে নেই। বুমবুমের মোটরসাইকেলের চালক ক্যাঁত ক্যাঁত লাথি চালাবে। সত্যি কথা বলতে কী, রেস জেতার চেয়ে ওই লাথি চালানোতেই বুমবুমের আগ্রহ বেশি। গোটা পথটা যে কী তারস্বরে গর্জন করে আটখানা মোটরবাইক! টুপুরের তো পাগল-পাগল লাগে।
টুপুর হালকা ধমক দিল, ভলিউমটা কমা না বুমবুম। কালা হয়ে যাবি যে!
বুমবুম শুনতেই পেল না। এইমাত্র একটা দুর্ঘটনার জন্য পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজিয়ে তাকে ধাওয়া করেছে, প্রাণপণে মোটরসাইকেলের গতি বাড়াচ্ছে সে।
টুপুর গলা চড়াল, কী রে, কথা কানে যাচ্ছে না? খেলা থামিয়ে খেয়ে নে। ধোসা তো চামড়া হয়ে গেল।
এবারও জবাব নেই। চোখ জ্বলছে বুমবুমের। চোয়ালে চোয়াল কষে আঙুল চাপছে কি-বোর্ডে।
কাঁহাতক আর বুমবুমের পিছনে লেগে থাকা যায়! মিতিনমাসির কাছে ঝাড় না খাওয়া অবধি বুমবুমের চৈতন্য ফিরবে না। দুনিয়ায় একমাত্র মা ছাড়া আর সকলকেই উলটো ট্যাঁকে গোঁজে বুমবুম।
খুদে মাসতুতো ভাইটিকে জিভ ভেংচে টুপুর স্নানে ঢুকে গেল। বেরিয়ে সবে আয়নার সামনে চুল আঁচড়াচ্ছে, ডোর বেলে ডিং ডং।
পার্থমেসোর গলা শুনতে পেল টুপুর, সুস্বাগতম মজুমদার সাহেব। অধমদের বাড়িতে বহু দিন পর আপনার পায়ের ধুলো পড়ল।
.
০২.
সোফার হাতলে দুবাহু ছড়িয়ে বসেছেন অনিশ্চয়। তার বিপুল দেহটি সিঙ্গল সোফায় আঁটছে না ভালমতো। কেমন যেন হাঁসফাঁস করছেন। পাখার নীচে বসেও ঘামছেন দরদর। আই পি এসের উর্দি নয়, অনিশ্চয়ের পরনে আজ ক্রিমরঙা ট্রাউজার আর লম্বা লম্বা স্ট্রাইপ টানা মেরুন বুশশার্ট। চওড়া কবজিতে বড়সড় ডায়ালের কোয়ার্টজ ঘড়ি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। নিখুঁত কামানো গাল, সযত্নলালিত ঢেউ খেলানো পুরুষ্টু গোঁফটিতে পাক ধরেছে অল্প অল্প।
মিতিন ঠান্ডা জল এনে সামনে রেখেছিল। এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে পরিতৃপ্ত মুখে অনিশ্চয় বললেন, আঃ, প্রাণ জুড়োল।
মুখোমুখি ছোট সোফায় বসেছে মিতিন। জিজ্ঞেস করল, কী। খাবেন বলুন? চা? না কফি?
মাঝের লম্বা সোফায় পার্থ আর টুপুর। পার্থ ফোড়ন কাটল, সঙ্গে নিশ্চয়ই একটু স্ন্যাক্সও চলবে? এগ পকোড়া, কিংবা পেঁয়াজি?
ওরে বাবা, কিছু না। বাইরে এখনই টেম্পারেচার আটত্রিশ ডিগ্রি চড়ে গিয়েছে। উইথ নাইনটি পারসেন্ট হিউমিডিটি। এখন চাই স্রেফ জল। লিটার-লিটার জল।
মিতিন হেসে বলল, সে যত খুশি খান। একটু শরবত অন্তত বানিয়ে দিই?
বাজারের সিন্থেটিক স্কোয়াশ দিয়ে? রাম কহো। ঘরে বিশুদ্ধ পাতিলেবু আছে?
বেশ তো, নিম্বুপানিই দিচ্ছি। গরমে আপনার যা ডিহাইড্রেশন হচ্ছে, নুন-চিনি-লেবুটাই আপনাকে সুট করবে।
নো চিনি। আমি চিনি ছেড়ে দিয়েছি।
বলেন কী? আই-জি সাহেবের সুগার ধরা পড়ল নাকি?
উহুঁ। বাহান্ন বছর বয়স হল, এবার একটু ক্যালরি কনশাস না হলে চলে? শরীরে একগাদা ফ্যাট জমানো তো কাজের কথা নয়।
বটেই তো বটেই তো, পার্থ মাথা দোলাল। মুচকি হেসে বলল, তবে কিছু মনে করবেন না সাহেব, চোর-ডাকাতদের মুখে ছাই দিয়ে আপনার শরীরস্বাস্থ্যের আর-একটু শ্ৰীবৃদ্ধি ঘটেছে!
ঠাট্টা করছেন? কী সুখেই যে মুটোচ্ছি! অনিশ্চয়ের গলায় খেদ ঝরে পড়ল, রিসেন্টলি প্রোমোশনটা হয়ে কী বাম্বু যে খেলাম! আগে শুধু কলকাতার ক্রিমিনাল নিয়ে নাড়াঘাটা করতাম, এখন পুরো ওয়েস্টবেঙ্গল ঘাড়ে চেপেছে। রাতের ঘুমফুম আমার উবে গেছে মশাই। কী টেনশন, কী টেনশন! সারারাত বিছানায় শুয়ে শুধু দুঃস্বপ্ন দেখি। আশ্চর্য ব্যাপার, টেনশন যত বাড়ছে, ভুঁড়িও তত বাড়ছে!
মিতিন উঠে অন্দরে গিয়েছিল। ভারতীকে শরবত বানানোর নির্দেশ দিয়ে আবার এসে বসেছে।
কেজো গলায় বলল, আজ টেনশন কী নিয়ে? হঠাৎ এই অভাজনের বাড়ি চড়াও হয়েছেন যে বড়?
একটা অড ঝামেলায় ফেঁসে গিয়েছি ম্যাডাম।
কীরকম?
অনিশ্চয় দু-এক সেকেন্ড চুপ। তারপর চোখ পিটপিট করে বললেন, ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যালের নাম শুনেছেন?
বৈজ্ঞানিক সুমন্ত্ৰ সান্যাল? বায়োসায়েন্টিস্ট? মিতিনের ভুরু জড়ো হল, পরশুর নিউজপেপারে যাঁর নিখোঁজ হওয়ার খবর বেরিয়েছিল?
জানতাম আপনার নজর এড়াবে না। ওই সুমন্ত্ৰ সান্যালই আমার জান কয়লা করে দিচ্ছে।
তাকে খুঁজে বের করবার দায়িত্বটা সরাসরি আপনার ঘাড়েই চেপেছে নাকি?
অনিশ্চয় আবার একটুক্ষণ নীরব। তারপর গলাঝাড়া দিয়ে বললেন, ব্যাপারটা তাহলে একটু ডিটেলে বলি। বৈজ্ঞানিক মহাশয়ের উবে যাওয়ার ঘটনাটার একটা উপক্রমণিকা আছে। সেটা অবশ্য এ কেসে রেলেভ্যান্ট হতেও পারে। আবার নাও হতে পারে। সামান্য দম নিলেন অনিশ্চয়, ডক্টর সান্যাল নিঃসন্দেহে একজন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং, তাঁকে আমি চিনতামও না, কস্মিনকালে নামও শুনিনি। তবে একটু পিকিউলিয়ারভাবে হপ্তাদুয়েক আগে ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ঘটে। সরাসরি নয়, ওভার টেলিফোন।
সুমন্ত্ৰ সান্যাল আপনাকে ফোন করেছিলেন? কেন?
ফর আ ভেরি পেটি রিজন। এত সামান্য কারণে কোনও প্রজ্ঞাবান লোক যে গোয়েন্দা বিভাগের আই জি-কে ফোন করতে পারে, বিশ্বাস করা কঠিন। সান্যালমশাইয়ের একটা পোষা ডোবারম্যান ছিল। কুকুরটার দুদিন ধরে ট্রেস নেই। তাতেই উতলা হয়ে ভদ্রলোক …
স্ট্রেঞ্জ! ভদ্রলোক মিসিং হওয়ার আগে আগে কুকুরটা হারিয়ে গেল? মিতিন নড়েচড়ে বসল, আচ্ছা, উনি তো দেখলাম বাসন্তীতে থাকেন? আই মিন, থাকতেন। অত দূর থেকে একটা কুকুরের জন্য আপনাকে …?
পিকিউলিয়ার কি সাধে বলছি। খ্যাপামোরও একটা লিমিট থাকে। ভাবুন আপনি, কোথায় সুন্দরবনের বাসন্তী আইল্যান্ড, আর কোথায় আমার আলিপুরের ভবানী ভবন! বৈজ্ঞানিকমশাই নাকি আগে লোকাল থানায় ডায়েরি করতে গেছিলেন। তারা বোধহয় সেভাবে পাত্তাটাত্তা দেয়নি। ব্যস, অমনই ডিরেক্টরি ঘেঁটে আমার নম্বর বের করে তাঁর সে কী কাকুতিমিনতি! কুকুরটা আমার প্রাণ … কুকুরটা না থাকলে বড্ড হেল্পলেস ফিল করি … মনে হচ্ছে এর পিছনে কোনও ফাউল-প্লে আছে … কাইন্ডলি আপনারা আমার রজারকে উদ্ধার করে দিন …
আপনি কি কোনও স্টেপ নিয়েছিলেন?
দুর, কুকুর খুঁজে বেড়ানো কি আমার কাজ! তবে সেদিন মুখের উপর কিছু বলিনি। যতই হোক, পোষ জীবজন্তুর উপর মানুষের তো একটা আলাদা দুর্বলতা থাকেই। তার উপর একজন বিজ্ঞানী মানুষ … অত করে বলছেন … টেলিফোনেও ওঁর স্বরটা সেদিন ভারী বিচলিত বলে মনে হচ্ছিল … ভদ্ৰলোককে নরম করেই বলেছিলাম, দেখছি কী করা যায়। ইনফ্যাক্ট, বাসন্তী থানার ও সি-কে এনকোয়ারি করার জন্য ইনস্ট্রাকশনও পাঠিয়েছিলাম। তারপর তো হাজার কাজের ভিড়ে ভুলে গিয়েছি। হঠাৎ এই নতুন বিপত্তি। ডক্টর সান্যাল স্বয়ং হাপিশ। দুপুরে খেয়েদেয়ে কলকাতা যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন, তারপর থেকে আর নো ট্রেস।
মিসিং তো হয়েছেন দেখলাম গত শুক্রবার! তাই না?
পুলিশ খবর পেয়েছে সোমবার। আই মিন, থানায় ডায়েরি হওয়ার পর। সেদিনই আমাদের মিসিং পার্স স্কোয়াডে রিপোর্ট এসে যায়। তারাই মিডিয়াকে ঘটনাটা জানিয়েছিল।
দুদিন পর পুলিশে ডায়েরি হল কেন?
কে দেবে খবর! ফ্যামিলি তো এখানে নেই, উনি একাই থাকতেন। সঙ্গে শুধু একটি কাজের লোক। তা সে বোধহয় ভেবেছে, সুমন্ত্ৰবাবু কোথাও আটকা পড়েছেন, তাই এক-দুদিন দেখে নিয়ে …। ক্যালাস আর কী। আগে জানালে আরও আগে ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়ে যেত।
আচ্ছা এমন নয় তো, ডক্টর সান্যাল তার ডোবারম্যানটির শোকেই বিবাগী হয়ে গিয়েছেন? পার্থ পুটুস করে মন্তব্য ছুড়ল, এতক্ষণে হয়তো তিনি হিমালয়ের পথে …
ফাজলামি কোরো না তো। মিতিন থামাল পার্থকে। অনিশ্চয়ের দিকে ফিরে বলল, কিন্তু এর জন্য খোদ আপনি ছোটাছুটি করবেন কেন? আপনার আন্ডারে অফিসারের তো কমতি নেই!
দুঃখের কথা আর কী বলব! অনিশ্চয় ফোঁস করে একটা দেড়মনি শ্বাস ফেললেন, অ্যাকচুয়ালি এ কেস তো হ্যান্ডল করার কথা মিসিং পার্স স্কোয়াডেরই। ওরা রুটিন-তদন্ত শুরুও করেছিল। কিন্তু কাল রাতে হঠাৎ হোম মিনিস্টারের ফোন এই কলুর বলদকে। দিল্লির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যালের অন্তর্ধানে নাকি ঘোরতর উদ্বিগ্ন। ডক্টর সান্যালের গবেষণার সঙ্গে তাদের নাকি কী সব যোগাযোগও আছে। তারা জানিয়েছে, রাজ্য সরকার ইমিডিয়েটলি ডক্টর সান্যালকে খুঁজে বের করতে না পারলে সি বি আই আসরে নামবে। ব্যস, আঁতে ঘা লেগে গিয়েছে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর। এখন তাঁর হুকুম, আমি যেন সশরীরে বাসন্তী ঘুরে এসে তাকে রিপোর্ট দিই এবং সেটা আজই।
হুম। সুমন্ত্ৰ সান্যাল তো তা হলে দেখছি বেশ উঁচুদরের সায়েন্টিস্ট! পার্থ গম্ভীর সুরে বলল, কিন্তু আমরা কখনও এঁর নাম শুনিনি কেন?
আমরা কটা বিজ্ঞানীর খবর রাখি! মিতিন বলল, প্রচারবিমুখ মানুষ হলে তো নাম জানবার সম্ভাবনা আরও কম।
তা ঠিক। পার্থ মাথা দোলাল, ডক্টর সান্যালের রিসার্চ টপিকটা কী ছিল আই জি সাহেব?
ক্যান্সার।
ধ্যাড়ধেড়ে বাসন্তীতে বসে ক্যান্সারের ওপর গবেষণা? স্ট্রেঞ্জ!
শুনে আমিও প্রথমটা অবাক হয়েছিলাম। ইনফ্যাক্ট কৌতূহল নিরসন করতে চিত্তরঞ্জন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারের ডিরেক্টরকে ফোনও করি। তিনিও নামী বিজ্ঞানী। ডক্টর রতনলাল চৌধুরী। রতনবাবুও দেখলাম সুমন্ত্ৰ সান্যালকে বিলক্ষণ চেনেন। ওঁর মুখেই শুনলাম, ডক্টর সান্যালের গবেষণার নেচার নাকি একটু অন্য ধরনের। সাপের বিষ থেকে নাকি ক্যান্সারের ওষুধ বের করার চেষ্টা করছেন সুমন্ত্ৰবাবু। অর্থাৎ তার গবেষণার র মেটিরিয়াল হল সাপ। সম্ভবত সেই কারণেই সুন্দরবনের মতো একটি সর্পসংকুল অঞ্চলকে তিনি বেছে নিয়েছেন।
সাপের বিষ থেকে ক্যান্সারের ওষুধ?
ডিরেক্টরসাহেব তো সেরকমই বললেন। তবে ডিটেলটা উনি জানেন না। এবং এও মনে হল, সুমন্ত্ৰবাবুর গবেষণার ধারায় ডক্টর চৌধুরীর খুব একটা আস্থা নেই। খানিকটা ব্যঙ্গ করেই বললেন, সর্পবিষ থেকে ক্যান্সার ড্রাগ বানানো সম্ভব হলে, ইন্ডিয়ান সায়েন্টিস্টরাই নাকি বিশ বছর আগে বের করে ফেলতেন! সঙ্গে আরও অনেক হাবিজাবি কমেন্ট। আমেরিকার নামী ল্যাবরেটরিতে নোবেল লরিয়েটদের সঙ্গে কাজ করে এসে গর্বে নাকি মাটিতে পা পড়ত না ডক্টর সান্যালের! এখানকার বিজ্ঞানীদের নাকি আমল দিতেন না, কারও সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ রাখতেন না … রতনবাবুর ধারণা, সুমন্ত্ৰবাবুর প্রোজেক্টটা বোধহয় ফেল মেরেছে। আর তাই উনি মুখ লুকোতে কোথাও গা-ঢাকা দিয়েছেন! তলেতলে বন্দোবস্ত করে হয়তো ফের আমেরিকাতেই ভাগলবা।
এভাবে বলে দিলেন? পাৰ্থ চোখ কুঁচকোল, আপনার ওই ডিরেক্টরসাহেবটি তো মনে হচ্ছে মোটেই সুবিধের লোক নন!
অত সহজে দুয়ে-দুয়ে চার কোরো না। মিতিন মাথা নাড়ল, বিজ্ঞানীমহলে নানা ধরনের আকচাআকচি থাকে। চিন্তাভাবনায় না মিললে একজন অন্যজনকে নস্যাৎ করে দেন।
তার মানে প্রফেশনাল জেলাসি?
একরকম তাই। আর এই হিংসে তো সব লাইনেই আছে। বিজ্ঞান, খেলাধুলো, নাচ, গান, শিল্প, সাহিত্য …। এই যে আমি দুটোচারটে কেস সলভ করি, তাতে কি মজুমদারসাহেবের বুকে একটুও কাঁটা ফোটে না বলতে চাও?
অনিশ্চয়ের লেবুর শরবত এসে গিয়েছে। তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিচ্ছিলেন গ্লাসে। আচমকা বিষম খেয়ে গেলেন। খুকখুক কাশছেন। সামলে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ডিরেক্টর রতনলাল চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলে আমি একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছে গিয়েছি। ডক্টর সুমন্ত্ৰ সান্যাল খুব একটা মিশুকে লোক নন। এবং নিরিবিলিতে একাএকা কাজ করাই তার পছন্দ। অর্থাৎ গবেষণার ব্যাপারে একটু সিক্রেটিভ টাইপ।
আজকাল বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই তাই। কেউ নিজের গোপনীয়তা ফাঁস করতে চান না। … তা ডক্টর সান্যাল আমেরিকা থেকে ফিরেছেন কবে? কেনই বা চলে এলেন?
এটা তো জিজ্ঞেস করা হয়নি। তবে ওসব ইনফর্মেশন জোগাড় করা পুলিশের কাছে কোনও ব্যাপারই নয়, শরবত শেষ করে অনিশ্চয় গোঁফ মুছলেন, আগে একবার সরেজমিন তো করে আসি।
যান। অল দ্য বেস্ট।
যদি অসুবিধে না থাকে, আপনিও যেতে পারেন সঙ্গে।
টুপুরের হৃৎপিণ্ড তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। মিতিনমাসির ডিডাকশন কী নিখুঁত! ঠিক ধরে নিয়েছে যেতে হবে কোথাও। সুন্দরবনের বাসন্তী দ্বীপে রহস্য-রোমাঞ্চ মোড়া একটা দিন, নিখোঁজ এক বিজ্ঞানীর অনুসন্ধান … ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। কিন্তু তার মিতিনমাসির মুখ-চোখ হঠাৎ এমন নিস্পৃহ কেন? একটু আগে নিজেই তো বলল …!
অনিশ্চয় আবার জিজ্ঞেস করলেন, কী, যাবেন তো?
মিতিনের স্বর নিরুত্তাপ, আমি গিয়ে কী করব? আপনি তদন্তে ব্যস্ত থাকবেন, আমার উপস্থিতিতে আপনার অসুবিধেই হবে।
অনিশ্চয় যেন এরকম জবাব আশা করেননি। থতমত খেয়ে গিয়েছেন। গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বললেন, আহা, অত ফর্মাল ব্যাপার ভাবছেন কেন? ধরে নিন না, বেড়াতেই যাচ্ছেন। বলতে বলতে পার্থ আর টুপুরকে একবার দেখে নিলেন অনিশ্চয়। হাসিহাসি মুখে বললেন, টুপুরই বা মাসির বাড়ি এসে বসে থাকবে কেন, সেও চলুক। সঙ্গে পার্থবাবুর মত একজন উইটি লোকের কম্পানি পেলে তো আরও ভাল।
মিতিনের স্বর তবু নীরস, ওরা কি যাবে? দেখুন ওদের জিজ্ঞেস করে। পার্থ তো বলছিল প্রেসে কী সব জরুরি কাজ আছে …
কাজ একদিন ভোলা থাক। আজ সকলে আমার সঙ্গে গাড়িতে করে …কী ফাইন একটা ওয়ান ডে ট্রিপ …
মিতিনমাসিটা কী প্যাঁচোয়া রে বাবা! টুপুরের পেট গুলিয়ে হাসি উঠে এল। নিজে থেকে পার্থমেসো আর টুপুরকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব না দিয়ে কেমন কায়দা করে অনিশ্চয়বাবুকে পেড়ে ফেলল। এখন এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে যে, টুপুরদের সঙ্গে পেলে অনিশ্চয় মজুমদার ধন্য হয়ে যাবেন।
অনিশ্চয় পার্থকে বললেন, আপনাদের কেন নিয়ে যেতে চাইছি জানেন? স্পেশ্যালি ম্যাডামকে? আরে মশাই, আমাদের পুলিশের চোখ একটা বাঁধাধরা গতে চলে। তাতে সব কিছুই ধরা পড়ে বটে, তবে ছোটখাটো দু-একটা জিনিস তো নজর এড়িয়ে যায়। আর আমাদের ম্যাডামের অবজারভেশন তো মন্দ নয়, উনি সঙ্গে থাকলে পুলিশি চোখের ঘাটতিটুকু পুষিয়ে যেতে পারে। বলুন, ঠিক কিনা?
একদম ঠিক। সরকারি কাজে সাধ্যমতো সাহায্য করাও তো মিতিনের কর্তব্য।
তা হলে আর বসে কেন? রেডি হয়ে নিন। পৌনে এগারোটা বাজে, আর বেশি লেট করলে বিকেল বিকেল ফিরতে পারব না।
স্নান সেরে তৈরি হতে মিনিট পনেরোর বেশি সময় নিল না পার্থ। টুপুরের তো শুধু ড্রেস বদলানোটুকু বাকি ছিল। মিতিনও প্রস্তুত ঝটপট। বুমবুমকেও যাওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হল, তবে সে মোটেই বেরোতে রাজি নয়। দুপুরে তার প্রাণের বন্ধু কুটুস আসবে, দুজনে পাল্লা দিয়ে খেলবে রোড র্যাশ। দিনভর বুমবুম কী কী করবে, আর কী করবে না, তার একটা লম্বা তালিকা বুমবুমকে শুনিয়ে মিতিন যখন অনিশ্চয়ের গাড়িতে উঠল, ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা সতেরো।
লালবাতি লাগানো চিরাচরিত সাদা অ্যাম্বাসাডর নয়, অনিশ্চয়ের বাহন আজ নেভি-ব্লু টাটা সুমো। নিজে তিনি বসেছেন ড্রাইভারের পাশে, পিছনে টুপুররা ত্রিমূর্তি। বড় রাস্তায় পড়ার মুখে গাড়ির গতি কমাতে হল একটু। সামনে একটা ছোট্ট শোভাযাত্ৰা। এক বৃদ্ধের মৃতদেহ খাটিয়ায় চাপিয়ে খই ছিটোতে ছিটোতে শ্মশানে চলেছে জনাকয়েক মানুষ।
পার্থ হৃষ্ট স্বরে বলল, যাক, আজকের জার্নিটা মনে হচ্ছে ভালই হবে।
টুপুর অবাক হয়ে বলল, কেন?
জানিস না, ডেডবডি দেখে বেরোলে যাত্রা শুভ হয়?
মিতিন মুখ বাঁকাল, থামো তো, যত্ত সব কুসংস্কার?