৫-৬. কুকুরটাকে হারিয়ে

০৫.

কুকুরটাকে হারিয়ে আমি বড্ড বেশি আনমাইন্ডফুল হয়ে গিয়েছি আই জি সাহেব। মাথা সবসময় নৰ্মালি কাজ করছে না।

 তা বলে একটা ইন্টিমেশন পর্যন্ত না দিয়ে দুম করে ঘাটশিলা চলে যাবেন?

এখন টের পাচ্ছি, কাজটা গোখখুরি হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস করুন, এত শোরগোল পড়ে যাবে ভাবিনি। মিছিমিছি আপনাদেরও হয়রানির একশেষ।

চিড়ে ভিজল না। অনিশ্চয় গাল ফুলিয়ে বললেন, জানেন, আর-একটু হলে আপনার কেসটা সি বি আই পর্যন্ত গড়াত?

আমার মতো একজন নগণ্য মানুষের জন্য সি বি আই? সুমন্ত্ৰ সান্যালকে কেমন যেন বিহ্বল দেখাল, আমি এতই সমস্যার সৃষ্টি করে ফেলেছিলাম? ছি ছি ছি, ভাবতেই খুব খারাপ লাগছে। আমি সত্যিই লজ্জিত আই জি সাহেব। আমার ভুলের জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি।

টুপুর একদৃষ্টে ডক্টর সান্যালকে দেখছিল। বিখ্যাত বিজ্ঞানী বলতে যে প্রাজ্ঞ প্রাজ্ঞ ছবি চোখে ভাসে, সুমন্ত্ৰ যেন ঠিক সেই গোত্রের নন। বয়স তো বেশ কম, পঁয়তাল্লিশও হবে কিনা সন্দেহ। রোগা, লম্বা দেহযষ্টির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নাসিকাটিও বেখাপ্পা রকমের খাড়া অনেকটা ধনেশপাখির ঠোঁটের মতো। ব্যাকব্রাশ চুল, চোখে মেটাল ফ্রেমের চশমা, চোয়াড়ে গাল নিখুঁত কামানো। গাত্রবর্ণ ঈষৎ তামাটে। তবে চোখের মণি দুটো কিন্তু দারুণ উজ্জ্বল। এত কালো মণি খুব কমই দেখা যায়।

অনিশ্চয় সামান্য ঠান্ডা হয়েছেন। গুছিয়ে বসে বললেন, তা হঠাৎ ঘাটশিলায় গা ঢাকা দিলেন কেন?

সুমন্ত্ৰ মৃদু হাসলেন, লুকোব কেন? একটা গবেষণা সংক্রান্ত কাজেই …

কাইন্ডলি যদি একটু ডিটেলে বলেন। আমাকে রিপোর্ট তৈরি করতে হবে তো।

আমি তো সকালে একবার এখানকার ও সি-কে বলেছি। শুক্রবার আমার একটা সেমিনার ছিল। ওখানেই হঠাৎ খবর পাই, ঘাটশিলা অঞ্চলের এক স্পেসিফিক উপজাতির লোকেরা স্নেক ভেনমের সঙ্গে কয়েকটা জংলি গাছগাছড়ার রস মিশিয়ে একটা পিকিউলিয়ার মেডিসিন তৈরি করে। যে-কোনও ধরনের আলসার সারাতে ওষুধটা নাকি অব্যর্থ। শুনেই কী যে হল, সেমিনার থেকে সোজা হাওড়া স্টেশন।

সেমিনারটা কোথায় হচ্ছিল জানতে পারি?

ইনস্টিটিউট অফ কেমিক্যাল টেকনোলজির অডিটোরিয়ামে, যাদবপুরে।

কতক্ষণ ছিলেন সেখানে? মানে, যদি আপনার বলতে আপত্তি না থাকে?

আমি অডিটোরিয়াম ছাড়ি অ্যারাউন্ড ফোর।

তার মানে স্টিল এক্সপ্রেস ধরেছিলেন?

 হুঁ।

তার পর বেমালুম ঘাটশিলাতেই রয়ে গেলেন পাঁচ দিন?

প্রপার টাউনে নয়। ইন্টিরিয়রে যেতে হয়েছিল। যদুগোড়ার দিকটায়।

ও। ওখানে আপনার মিসিং হওয়ার খবরটা পেলেন কবে?

পাইনি তো। কাল বাসন্তীতে ফিরে শুনলাম।

তো, কালই তো আপনার থানায় ইনফর্মেশনটা দেওয়া উচিত ছিল।

বড় টায়ার্ড ছিলাম। প্লাস ভাবলাম, এসেই তো পড়েছি। রাতেও খবর দেওয়া যা, সকালেও তাই।

পাৰ্থ ফস করে জিজ্ঞেস করল, তা ঘাটশিলাতে আপনার কাজ হল?

কই আর। চার-পাঁচ রকম ট্রাইবের সঙ্গে কথা বললাম। তারা কেউ ওসব জানেই না। স্রেফ গুজব ধাওয়া করে আমার চার-পাঁচটা দিন চলে গেল। সময়ের কী অপচয়!

মিতিন চুপচাপ শুনছিল। অনেকক্ষণ পর কথা বলল, আপনি তো এখানে একাই থাকেন, তাই না?

হ্যাঁ। আমার স্ত্রী আর মেয়ে স্টেটসেই রয়ে গিয়েছে। বস্টনে। আমার স্ত্রী বস্টন ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিয়ান। মেয়ে স্কুলের শেষ ধাপে।

একটু ব্যক্তিগত হয়ে যায়, তবু একটা প্রশ্ন করব? ওঁদের রেখে আপনি চলে এলেন কেন?

আমার কাজটা আমি আমার দেশের মাটিতেই করতে চাই। পড়াশোনা করতে ওদেশে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু আমার মগজ নিয়ে অন্য একটা দেশ ব্যবসা করবে, এ আমার কখনওই অভিপ্রেত ছিল না। প্রথম সুযোগেই তাই ফিরে এসেছি।

আপনি ভারত সরকারের প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাই না?।

উহুঁ, যুক্ত নয়। প্রকল্পটা আমারই। প্ল্যান, প্রোগ্রাম, এস্টিমেট করে আমিই ইন্ডিয়া গভর্নমেন্টের কাছে অ্যাপ্লাই করেছিলাম। আমার সৌভাগ্য, আমাকে সামান্যতম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। গভর্নমেন্ট আমায় সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সো, মিশিগান ইউনিভার্সিটি ছেড়ে আমি স্ট্রেট এখানে।

কিন্তু আপনার স্ত্রী আর মেয়ে বোধহয় আসতে রাজি হলেন না?

কী আর করা। আমেরিকান লাইফস্টাইলের সঙ্গে ওরা এমনভাবে মিশে গিয়েছে, ওদের পক্ষে আর ইন্ডিয়ায় এসে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। বারদুয়েক ঘুরে গিয়েছে এখানে। তারপর ওই উইকলি ফোন অথবা ই-মেল …।

আপনার লোনলি লাগে না?

কাজের মধ্যে থাকলে নিজেকে একা ভাবার ফুরসত কোথায়?

অনিশ্চয় বললেন, আর-একটা কথা জিজ্ঞেস করব? ভারতবর্ষে এত জায়গা থাকতে সুন্দরবন আপনার পছন্দ হল কেন? স্নেকইনফেস্টেড এলাকা বলে?

সেটা একটা মেজর কারণ বটে। আমার পয়জনাস স্নেকের কন্টিনিউয়াস সাপ্লাই চাই। সেদিক দিয়ে সুন্দরবন তো আইডিয়াল। তা ছাড়া আমি খানিকটা নিরিবিলিও খুঁজছিলাম। নিজের মনে কাজ করব, কেউ ডিস্টার্ব করবে না, কোনওরকম মিডিয়ার উৎপাতও থাকবে না …। কলকাতা ফিরে বাসন্তীর এই বাড়িটার সন্ধানও পেয়ে গেলাম। ঘেরা বাড়ি, অনেকটা জমি, ঠিক যেমনটা আমি চাই। ইচ্ছে হলে ঘন্টাতিনেকের মধ্যে কলকাতাও রিচ করতে পারব, আবার নয়েজি কলকাতা রিচের একটু বাইরেও থাকবে।

কলকাতায় তো মাঝেমাঝেই যান, নাকি?

যাই। মাসে এক-আধবার। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে জার্নালটার্নাল ঘাঁটতে। কিংবা কেমিক্যাল রিএজেন্টের অর্ডার দিতে।

গেলে নিশ্চয়ই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেই ওঠেন?

না। ইউজুয়ালি নাইট হল্ট করি না। স্টে করলে গভর্নমেন্টের গেস্টহাউজেই থাকি। ওই যে, আপনাদের ঢাকুরিয়া লেকের গায়ে।

কেন? আত্মীয়স্বজন বুঝি আপনার পছন্দ নয়?

ঠিক তা নয়। নিয়ার রিলেটিভ কেউ নেই তেমন কলকাতায়।

আপনার ভাই থাকেন না কলকাতায়? নীলাম্বর বলছিল…?

বলছিল বুঝি? সুমন্ত্ৰ আলগা হাসলেন, আমার ভাই প্রপার কলকাতায় কোনও দিনই থাকেনি। আর এখন তো সে চাকরির সূত্রে বাঙ্গালোরে, বলতে বলতে সুমন্ত্ৰ অনিশ্চয়ের দিকে ফিরেছেন, মোটামুটি সবরকম ইনফর্মেশন তো দিয়েই দিলাম। আশা করি, আপনার রিপোর্ট তৈরি করতে আর কোনও অসুবিধে নেই?

অনিশ্চয় তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, আরে না না, ওগুলো তো জাস্ট ম্যাডামের কৌতূহল। আপনার মতো একজন বিজ্ঞানীর সম্পর্কে ডিটেলে জানতে কার না ইচ্ছে করে, বলুন?

নীলাম্বর ফের আপ্যায়নে হাজির। এবার চা। সঙ্গে অমলেট, চানাচুর, সন্দেশ।

পার্থ খুশিখুশি মুখে বলে উঠল, এই দ্যাখো, আবার এসব করতে করতে গেলেন কেন?

সুমন্ত্ৰ স্মিত স্বরে বললেন, আমাকে এটুকু প্ৰায়শ্চিত্ত করার সুযোগও দেবেন না?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে অমলেটে চামচ বসাল পার্থ। অনিশ্চয় কাপ তুলে নিলেন হাতে। চায়ে চুমুক দিচ্ছেন।

হাল্কা সুরে জিজ্ঞেস করলেন অনিশ্চয়, আপনার রজারের শেষ পর্যন্ত কী হল কিছু অনুমান করতে পারলেন?

সুমন্ত্ৰ চোখ থেকে চশমা নামালেন। কাচ ঘষতে ঘষতে বললেন, আবার কুকুরটার কথা মনে করিয়ে দিলেন তো? ওকে ছেড়ে থাকতে আমার কী যে কষ্ট..।

আপনার নাকি সন্দেহ রজারকে মেরে ফেলা হয়েছে?

 না হলে অ্যাদ্দিনে তো একটা ট্রেস পাওয়া যেত, নয় কি?

কে মারতে পারে বলুন তো? লোকাল কোনও রাফিয়ান টাফিয়ান?

হতেও পারে। স্পেসিফিক বলতে পারব না। তবে আমি শিয়োর কুকুরটাকে কেউ মেরেই ফেলেছে।

আপনার উপর কারও রাগটাগ ছিল কি?

আমার উপর? সুমন্ত্ৰ অবাক, আমি থাকি আমার কাজকর্ম নিয়ে..।

বটেই তো। স্যার কারও সাতেপাঁচে থাকেন না…। তা ছাড়া পণ্ডিত মানুষ বলে এখানকার লোকেরা স্যারকে তো খুব শ্রদ্ধাভক্তি করে।

মিতিন পেয়ালাপিরিচ হাতে উঠে পড়েছিল। কাচের আলমারিতে রাখা মোটামোটা বিজ্ঞানের বইগুলো দেখছিল মন দিয়ে। সেখান থেকেই বলল, আচ্ছা ডক্টর সান্যাল, আমরা কি এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে যেতে পারি?

কীরকম?

 আপনার কাজটা তো ক্যান্সারের ওষুধ নিয়ে, তাই না?

হুম।

আপনি তো সাপের বিষ থেকেই…। ব্যাপারটা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে। যদি একটু বুঝিয়ে বলেন…

ক্যান্সার রোগটা সম্পর্কে আপনার কোনও পরিষ্কার ধারণা আছে কি?

অল্পস্বল্প। যত দূর জানি, কারও কারও শরীরে নাকি অংকোজিন বলে এক ধরনের জিন থাকে। সেই জিনই নাকি, কোনও বিশেষ কারণে, কখনও কখনও শরীরের কোনও একটা অংশের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটায়। মানে…

পার্শিয়ালি ঠিক বললেন। তবে কারও কারও নয়, আমাদের প্রত্যেকের দেহেই থাকে প্রোটো-অংকোজিন। সেই প্রোটোঅংকোজিন যখন অংকোজিনে পরিণত হয়, তখনই ক্যান্সারের আশঙ্কা দেখা দেয়। আমি চাইছি ওই প্রসেসটাকেই আটকাতে। অর্থাৎ আমার ওষুধ হবে ক্যান্সারের প্রতিষেধক। কলেরা বা বসন্তর টিকার মতো।

অসাধারণ! পার্থর স্বরে তারিফ, তার মানে ক্যান্সারের চান্সটাই আপনি নিমূল করে দেবেন?

চেষ্টা করছি। প্রিভেনশন ইজ অলওয়েজ বেটার দ্যান কিয়োর।

বটেই তো। মিতিনের চোখেও মুগ্ধতা, কিন্তু স্যার, সাপের বিষ থেকে সত্যিই কি তা বের করা সম্ভব?

কেন নয়? সুমন্ত্ৰ হাসলেন, সাপের বিষ আদতে কী? একগাদা এনজাইম, আর খুব ঘন প্রোটিনের মিক্সচার। আমার কাজের ডিটেলে না গিয়েও আমি বলতে পারি, কোনও কোনও এনজাইমকে সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে পারলে প্রোটো-অংকোজিনকে নষ্ট করে দেওয়া সম্ভব। অন্তত তার অংকোজিন হওয়ার প্রবণতাটাকে তো বিনষ্ট করা যায়। পদ্ধতিটা খুবই জটিল, তবে কিন্তু একেবারে অসম্ভব নয়। কী, বোঝাতে পারলাম?

কিছুটা তো আইডিয়া হলই। কী মজুমদারসাহেব, হল না?

অনিশ্চয় চোখ কুঁচকে শুনছিলেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন, তা তো হল। কিন্তু এবার যে আমাদের উঠতে হয়।

মিতিন উৎসুক মুখে বলল, তার আগে একবার স্যারের ল্যাবরেটরিটা দেখব না?

টুপুরও চাপা উত্তেজনায় ছটফট করছিল। মিনতির সুরে বলল, আমি একটু সাপের ঘর দেখব। প্লিজ।

সুমন্ত্ৰ হাসিটাকে চওড়া করে বললেন, খুব ইচ্ছে হচ্ছে? যাও তবে, নীলাম্বরের সঙ্গে ঘুরে এসো।

অনিশ্চয়ের খুব একটা আগ্রহ নেই দেখার। জীবনে বহু সাপ নাকি দ্যাখা হয়ে গিয়েছে তাঁর। একবার পশ্চিমঘাট পর্বতে এক মরাঠি সাপের ছোবল খেয়েছিলেন। সাপটার নাম শুনলেই মনে হয় বেজায় রাগী। গরগর। তবে বিষটিস ছিল না, এই যা রক্ষে। সুমন্ত্ৰ সান্যালের সঙ্গে সেই সৰ্পদংশনের গল্পে মেতে উঠলেন অনিশ্চয়।

টুপুররা পায়ে পায়ে ল্যাবরেটরিতে এল। বিশাল হলঘর। লম্বা লম্বা টেবিলে অজস্ৰ কাঠের র‍্যাক। টেস্ট টিউব, ব্যুরেট, পিপেট, বিকার, ব্লো-পাইপ, জারে বোঝাই। দেওয়াল জোড়া কাচের আলমারি, ছোট বড় শিশি-বোতল আর পিচবোর্ডের বাক্সে ঠাসা। কত রঙের যে কেমিক্যাল! ঢাউস ঢাউস ফ্রিজ আছে তিনখানা, হাফ ডজন মাইক্রোস্কোপ। কাচে ঢাকা সোনালি বর্ণের ওজন্যও আছে সারসার। আরও হরেক কিসিমের যন্ত্রপাতি। কোনওটা কাচের, কোনওটা বা ইস্পাতের, কোনওটা তামার। মিষ্টি আর কটু গন্ধের এক বিচিত্র মিশেল মম করছে ঘরের বাতাসে। একধারে ছোট্ট পার্টিশন, তার ওপারে কম্পিউটার। রয়েছে একখানা ঢাউস। সেক্রেটারিয়েট টেবিলও। বই, কাগজপত্র আর ফাইলের স্তূপ সেখানে। টেবিলের পিছনে খুদে দরজা, ভিতরে ছোটখাটো একটা গ্যাসপ্ল্যান্টও দ্যাখা যায়। প্ল্যান্ট থেকে পাইপ বেরিয়ে টেবিলের বার্নারগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। বোঝাই যায় বড়সড় কর্মযজ্ঞ চলছে গবেষণাগারে।

ঘুরতে ঘুরতে টুপুর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা নীলাম্বরদাদা, সাপের বিষ কি ফ্রিজে রাখতে হয়?

নীলাম্বর পার্থকে কী যেন দ্যাখাচ্ছিল। ফিরে বলল, অবশ্যই। নইলে বেশিদিন গুণ থাকবে না যে! তবে ফ্রিজে ঢোকানোর আগে স্যার বিষটাকে জমিয়ে ছোট ছোট দানা করে নেন।

ওষুধ বুঝি ওই দানা থেকেই তৈরি হবে?

শুধু কি দানা! কত কী করতে হবে। পরিমাণ মতো জলে দানা গুলতে হবে। তার সঙ্গে নানা কেমিক্যাল মিশবে। তারপর মিক্সচার ফোটাও, ঠান্ডা করো, ঝাঁকাও, সেন্ট্রিফিউজে ঘোরাও, নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ঘড়ি ধরে তাকে থার্মোস্ট্যাটে রাখে… সে ভারী জটিল ব্যাপার।

সব কাজ স্যার একাই করেন?

আমিও হাত লাগাই। সময় মেপে ফোটানো, এটা-ওটা ওজন করে মেশানো, পি এইচ মাপা… স্যার যেভাবে বলেন, সেভাবেই সলিউশন বানাই।

মিতিন জিজ্ঞেস করল, তুমি লেখাপড়া কত দূর করেছ, নীলাম্বর?

আজ্ঞে, সায়েন্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিলাম। সেকেন্ড ডিভিশনে। অভাবের তাড়নায় কলেজে যেতে পারিনি। আমাকে তো স্যার প্রথমে ল্যাবরেটরির জন্যই কাজে নিয়েছিলেন। ঘরের কাজকর্ম, রান্নাবান্না, ওসব তো এখানকার মেয়েলোকেরাই করত। কিন্তু টিকতে চাইত না কেউ।

কেন?

প্রথমত, রজার। তার সঙ্গে সাপের ভয়। ঘনঘন লোক পালানো দেখে আমিই একদিন স্যারকে বললাম, আপনি আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামাবেন না, এই নীলাম্বরই সব সামলে দেবে। ভারী তো দুটো লোকের রান্না আর ঘর ঝাড়পোঁছ! ঘরে অটোমেটিক মেশিন থাকলে ওগুলো আবার কাজ নাকি! স্যার মিক্সি, মাইক্রোওয়েভ আভেন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, বাসন ধোওয়ার যন্ত্র, ইস্ত্ৰি, হিটার, কী না এনেছেন বিদেশ থেকে। কাজের মেয়েরা থাকতে দামি জিনিসগুলো পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল।

কথা শুনতে শুনতেই টুপুরের চোখ গিয়েছে দেওয়ালে, ল্যাবরেটরিতে ফোল্ডিং মই কেন? এখানে মই কী কাজে লাগে?

ওটা নতুন কেনা হয়েছে। রাজমিস্ত্রিরা যখন সারাইটারাই করছিল, তখন, নীলাম্বর ফিক করে হাসল, মই বেয়ে উঠে এবার থেকে স্যার নাকি নিজেই এগজস্ট পরিষ্কার করবেন। খেয়াল!

নীলাম্বরের সঙ্গে বকবক করতে করতে গবেষণাগার ছেড়ে টুপুররা বাড়ির পিছনভাগে। বাঁধানো চাতাল পেরোলে একফালি ঘাসজমি। শুকনো শুকনো মাঠটুকুর প্রান্তে, পাঁচিলের প্রায় লাগোয়া, একখানা পাকা ঘর। মেন বিল্ডিংয়ের মতো পুরনো নয়। সম্ভবত সুমন্ত্ৰ সান্যালেরই বানানো।

ঘরটায় তালা ঝুলছিল। দরজা খুলে নীলাম্বর চাপা স্বরে ডাকল, আসুন। ঢুকেই টুপুরের গা ছমছম। কী স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার রে বাবা। ঘুলঘুলি আর দরজা দিয়ে যেটুকু আলো আসছে, তাতে সবই কেমন আবছা আবছা। ঘরখানা বেশ ঠান্ডাও দেওয়ালময় সারসার কাচের খাঁচা। সাপদের আস্তানা! একটা অস্পষ্ট আওয়াজও শোনা যায় যেন। হিসসস! হিসসস!

 টুপুর ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ওটা কীসের শব্দ গো মিতিনমাসি?

চন্দ্রবোড়া, নীলাম্বরই আগ বাড়িয়ে উত্তর দিল, ওরা সারাক্ষণই এরকম শব্দ করে।

কিন্তু সাপটা কোথায়? এই অন্ধকারে দেখা যাবে?

 নীলাম্বর ঘরের একমাত্র বাতিখানা জ্বেলে দিল। বড় বালবের আলোয় চতুর্দিক এখন মোটামুটি দৃশ্যমান। এই তো সাপগুলো। প্রায় প্রতিটি ঘরেই এক জোড়া করে। কেউ বা কুণ্ডলী পাকিয়ে প্রায় শুয়ে, কেউ শরীর ছেড়ে রেখেছে খড়ের বিছানায়। কোনও কোনও খাঁচায় মাটি লেপা। কোথাও বা বালি। কোনও ঘরে শুধুই পাথর।

মিতিন একখানা কাচের বাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ওই দ্যাখ টুপুর, ওই তোর চন্দ্রবোড়া।

টুপুর স্থির। সত্যিই দেখবার মতো চেহারা। হাততিনেকের বেশি লম্বা নয় বটে, তবে বেশ নধরকান্তি। রং সোনালি আর বাদামির মাঝামাঝি। গায়ে বড়বড় কালচে ছোপ, যেন কোনও শিল্পীর তুলিতে আঁকা। একজন ঘুমাচ্ছে, অন্য জন ঘুরে বেড়াচ্ছে শ্লথ গতিতে। অলস পাহারাদারের মতো। উঁকি দিচ্ছে চেরা জিভ, মিলিয়ে যাচ্ছে পরমুহূর্তে। নীলাম্বর বলল, এরা কিন্তু পুরোদস্তুর জোয়ান। বয়স প্ৰায় আড়াই বছর।

সাপ বাঁচে কত দিন?

ঝোপেঝাড়ে বনেজঙ্গলে নিজের মতো ঘুরে বেড়াতে পারলে বিশ-পঁচিশ বছর। তবে এই বদ্ধ জায়গায় বছর চার-পাঁচের বেশি টেকে না।

আহা রে, বন্দি থাকার দুঃখে আয়ু কমে যায়? টুপুরের সাপগুলোর জন্য ভারী মায়া হল। তবে মানুষের উপকারে লাগছে, এও বড় কম কথা নয়!

চন্দ্রবোড়ার পাশে গোখরোর বাড়ি। দৈর্ঘ্যে চন্দ্রবোড়ার মতোই, তবে এরা বেশ ছিপছিপে। চওড়া মাথা, ফণায় দুটো গোল গোল দাগ। দেখে মনে হয় চশমা পরে আছে। শঙ্খচূড় জুটি তো রাজারানির মেজাজে শুয়ে। চমৎকার স্বাস্থ্য, লম্বাতেও কিছু না হোক ফুটদশেক তো হবে। তুলনায় গেছোবোড়া কিংবা বংকোরাজ নেহাতই খুদে। গেছোবোড়ার রং শ্যামলা। বংকোরাজ বাদামি। চিতিসাপের গাত্রবর্ণ ইস্পাতনীল, সাইজ কেউটে-গোখরোর কাছাকাছি। তবে সবচেয়ে সুন্দর বুঝি শঙ্খিনী। কুচকুচে কালোর উপর চওড়া চওড়া হলদে ড়ুরে। তেল-চকচক চামড়ায় রং ফেন পিছলোচ্ছে। এই গোত্রের সাপ কি আগে চিড়িয়াখানায় দেখেছে টুপুর?

পার্থ আর নীলাম্বরের কথা চলছে টুকটাক। জ্ঞান ভাণ্ডার বাড়াচ্ছে পার্থ।

কোন সাপের বিষ সবচেয়ে মারাত্মক গো নীলাম্বর?

কেউ কারও চেয়ে কম যায় না দাদা। কেউটে, গোখরো, চিতি, চন্দ্রবোড়া, শঙ্খচূড় সবাই তুল্যমূল্য। তবে শঙ্খচূড় সাইজে বড় তো, তাই একবারে বেশি বিষ ঢালতে পারে।

কোন বয়স থেকে বিষ আসে সাপের?

বিষধর সাপ জন্ম থেকেই বিষধর। ছোট অবস্থায় বিষের পরিমাণটা কম থাকে, এই যা।

কেউটে কামড়ালে নাকি ঘুম পায় খুব?

 হাঁ দাদা। আর চন্দ্রবোড়ার বিষে শরীরে জ্বালাপোড়া ধরে। স্যার যখন ইঁদুরদের চন্দ্রবোড়ার বিষ ইঞ্জেকশন দ্যান, ইঁদুরগুলো যা ছটফট করে না।

তোমাদের ইঁদুরগুলো কোথায়?

খাঁচায় আছে। ল্যাবরেটরির ওপাশের ঘরটায়। যাবেন দেখতে?

থাক গে। আমার বউবাজারের প্রেসে যথেষ্ট ধেড়ে ইঁদুর দেখি রোজ। …তা তোমাদের সাপেরা খায় কী?

দুধ, আরশোলা, টিকটিকি, পোকামাকড়। বর্ষাকালে ব্যাং এনে দিই। চিতিসাপের জন্য হেলে সাপও ধরে আনা হয়।

কে দেয় খাবার? তুমি? না স্যার?

আমিই দিই।

 ভয় করে না?

প্রথম প্রথম লাগত। তারপর গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া সাপ যদি ফণা তোলে, তা হলে কীভাবে তাকে ঘায়েল করতে হবে, সে কায়দাও মঙ্গলমেসো আমায় শিখিয়ে দিয়েছে।

তোমার মঙ্গলমেসো কদ্দিন পর পর সাপ দিতে আসেন?

সাপ আর বছরে কটাই বা কেনা হয়! মঙ্গলমেসো তো আসে বিষ বের করতে। মাসে একবার তো বটেই। এ মাসে সময় হয়ে গিয়েছে, আজ কালের মধ্যেই আসবে।

বলো কী? প্রত্যেক মাসে বিষ বের করতে হয়?

হ্যাঁ। বেরিয়ে গেলে আবার এক মাসের মধ্যেই সাপের থলিতে বিষ জমে যায়। এই গরমকালে বিষ পাওয়া যায় পরিমাণে বেশি। তবে শীতের বিষ কিন্তু অনেক অনেক কড়া। স্যার বলেন।

টুপুর হাঁ করে শুনছিল কথাগুলো। মিতিনও। হঠাৎই বাইরে অনিশ্চয়ের গলা, কী হল, আপনারা যাবেন না? এরপর কিন্তু বাড়ি পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত হয়ে যাবে। আমার মানিকচাঁদকে কিন্তু সন্ধের পর তিরিশের বেশি স্পিড তুলতে দেব না।

 সাপের ঘর থেকে বেরিয়ে এল সকলে। নীলাম্বর তালা লাগাচ্ছে দরজায়।

পার্থ হালকা সুরে বলল, দারুণ জিনিস মিস করলেন কিন্তু আই জি সাহেব। এত ভ্যারাইটির বিষধর সাপ চিড়িয়াখানার বাইরে সচরাচর মেলে না।

আমাদের লকআপে মশাই অনেক বেশি ভ্যারাইটির সাপ আসে। অনিশ্চয় পালটা ঠাট্টা জুড়লেন, আমাকে তো শুধু ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ করলে চলবে না। একটা কাজের কাজ সারতে হল। ঝটপট রিপোর্ট বানিয়ে, সুমন্ত্ৰবাবুকে শুনিয়ে, কাউন্টার সাইন করিয়ে, একটা কপি ভদ্রলোকের হাতে ধরিয়ে দিয়েছি। এবার গিয়ে মিনিস্টারের টেবিলে কাগজটা পাঠিয়ে দেব। ব্যস, আমি দায়মুক্ত। শুধু বাসন্তী থানাটাই যা বাকি। ওদের একটু না রগড়ালে ঠিক সুখ হচ্ছে না, বুঝলেন?

চলুন তবে। কেন আর মন খুঁতখুঁত থাকে?

সুমন্ত্ৰ সান্যালের বাড়ি থেকে রওনা দেওয়ার আগে মিতিন জনসংযোগ সেরে নিল। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে তার থার্ড আই-এর ভিজিটিং কার্ড বার করে ধরিয়ে দিল সুমন্ত্রকে! জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকা নীলাম্বরকেও বঞ্চিত করল না।

কার্ডে চোখ বুলিয়ে সুমন্ত্ৰ ভদ্রতা করে বললেন, থাক কাছে। কাজে তো লাগতেও পারে। …আর আই জি সাহেব, আপনার ফোন নম্বরটা….?

আপনার কাছে আছে তো। রজারের ব্যাপারে ফোন করেছিলেন না?

ও হ্যাঁ, তাও তো বটে।

তা হলে ওই কথাই রইল? এবার নিরুদ্দেশ হওয়ার আগে আমাকে একটা ফোন করে যাবেন! হা হা হা।

বেলা পড়ে গিয়েছে। রোদ্দুরের আর ঝাঁঝ নেই তেমন। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে গাছগাছালি। গেটের বাইরে এসে পার্থ বলল, বেড়ে কাটল কিন্তু দিনটা।

সে আর বলতে! অনিশ্চয়ের মেজাজও সরেস, নিষিদ্ধ মাংস ভক্ষণ, অপহৃত বিজ্ঞানীর সশরীরে প্রত্যাবর্তন, বাসন্তী ভ্রমণ…

তারপর ধরুন সৰ্পদর্শন? বলেই পাৰ্থ দাঁড়িয়ে পড়েছে। মিতিন কিছুটা পিছিয়ে, হাতে কী একটা নিয়ে যেন দেখছে চোখ কুঁচকে। পার্থ জিজ্ঞেস করল, ওটা কী?

একটা লোকাল ট্রেনের টিকিট। মল্লিকপুর থেকে ক্যানিং।

কুড়িয়ে পেলে?

মিতিন জবাব দিল না। অন্যমনস্ক মুখে টিকিটটা রেখে দিল ব্যাগে।

.

০৬.

খানিক আগে জোর একটা কালবৈশাখী হয়ে গেল। উথালপাথাল বাতাস, চোখজ্বালানো ধুলোর ঝড়, চিড়িক চিড়িক আকাশচেরা বিদ্যুৎ, কানফাটানো মেঘগর্জন, আর তার পিছুপিছু ঝুমঝমাঝম বৃষ্টি। বেশিক্ষণ নয়, বড়জোর আধঘণ্টা। তাতেই দিনমানের গনগনে তাপ বেবাক উধাও।

বৃষ্টি থামার পরপরই প্রেস থেকে ফিরল পার্থ। দরজা খুলেই টুপুর হেসে খুন। এ কী কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি হয়েছে পার্থমেসোর! ছ্যাদরাব্যাদরা চুল, মাথা বেয়ে জল গড়াচ্ছে, শার্টপ্যান্ট ভিজে লেপটে গেছে গায়ে। পুরো ভেজা কাকের মতো হাল!

টুপুর হাসতে হাসতে বলল, এ মা, এত ভিজলে কেন? কোথাও দাঁড়িয়ে যেতে পারতে।

বলে লাভ নেই টুপুর। মিতিন পিছন থেকে ফোড়ন কাটল, তোর মেসো খুব বীরপুরুষ। বৃষ্টি নামলে রাস্তার মধ্যিখান দিয়ে হাঁটতে ভালবাসে। তারপর বাড়ি ফিরেই হ্যাঁচ্চো হাঁচ্চো। এবং মুড়িসুড়ি দিয়ে বিছানায়।

পাৰ্থ হেসে বলল, আহা, সে সৌভাগ্য কি এবারও হবে? জ্বরে পড়ে সোমবার পর্যন্ত যদি লেটে থাকতে পারি…

তা হলে সেই লিটল ম্যাগাজিনের ছেলেগুলোকে তিন দিন আরও ঠেকিয়ে রাখা যায়, তাই তো?

এই যাঃ! টিকটিকির মাথা ঠিক মতলবটার গন্ধ পেয়ে গিয়েছে। …কী করি বলো, কম্পোজিটারবাবুর আজও পাত্তা নেই। সারাদিন তো তার পথ চেয়ে বসে ছিলাম।

বুঝেছি। যাও, এখন ভাল করে স্নান সেরে নাও। আর কাদামাখা জামাকাপড়গুলো বাথরুমে ফেলে রেখো না। ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দিয়ো দয়া করে।

মিনিটদশেকের মধ্যে পার্থ ফুলবাবুটি হয়ে ডাইনিং টেবিলে হাজির। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, চুলটুল আঁচড়ে। চেয়ারে বসে হাত ঘষতে ঘষতে বলল, বেশ জম্পেশ একটা খাওয়াদাওয়া চলছে মনে হচ্ছে?

ইয়েস। গরমাগরম আলুর চপ, পেঁয়াজি, আর পাফড রাইস। সাহেবের কি মুড়ি চলবে?

সঙ্গে একটা কাঁচা লঙ্কা পাওয়া যাবে কি? আর দো বুঁদ আচারের তেল?

মিল যায়গা।

 ব্যস, সান্ধ্য আসর জমজমাট। এ কথা ও কথা থেকে উঠে এল গতকাল বাসন্তী ভ্রমণের প্রসঙ্গ। টুপুর আপশোস করে বলল, কাল কিন্তু আমাদের একটা জিনিস মিস হয়ে গেল।

পাৰ্থ পেঁয়াজিতে কামড় বসিয়ে বলল, কী রে?

বাসন্তীর চার্চটা। সামনে দিয়ে এলাম গেলাম, অথচ একবার ঢোকা হল না।

কী আর নতুন দেখতিস? বড়জোর কয়েকটা পেন্টিং, তাও তেমন কিছু হয়তো দরের হবে না। আর কিছু রঙিন কাচের কারুকাজ। যা কলকাতার গির্জায় আকছার দেখা যায়। আমাদের এখানে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে যা আছে, তার তুলনায় ও তো নস্যি।

মিতিন বলল, অত হেলাফেলা কোরো না। মনে রেখো, সুন্দরবনের প্রত্যেকটা গির্জারই একটা ইতিহাস আছে। সুন্দরবন একসময় ছিল জলদস্যুদের আড্ডা। পর্তুগিজ হামাদরা জঙ্গলে ঘাঁটি। গেড়ে ওই অঞ্চলের নদীতে নদীতে চরে বেড়াত। যাত্ৰীবোঝাই কিংবা কোনও মাল-ভরতি নৌকো তাদের নজরে এলে আর রক্ষে নেই। সর্বস্ব তো কেড়ে নিতই, সামান্যতম বাধা পেলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিত। এই হার্মাদদের বসতির ধ্বংসাবশেষ এখনও সুন্দরবনের। দ্বীপগুলোতে পাওয়া যায়। এদের উৎপাত একসময় এত বেড়েছিল, দিল্লির মুঘল বাদশাহরা পর্যন্ত ওদের চিট করতে ফৌজ পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল।

পার্থ বলল, তুমি কি বলতে চাও বাসন্তীর চার্চও হার্মাদদের তৈরি?

তা ঠিক জানি না। তবে পর্তুগিজ জলদস্যুরা বেঙ্গলে বেশ কিছু গির্জা বানিয়েছিল। তার মধ্যে একটা তো এখনও বেশ দাপটের সঙ্গে টিকে আছে। ব্যান্ডেল চার্চ। হুগলি নামটাও পর্তুগিজদের দেওয়া। হুগলি শব্দটা এসেছে পর্তুগিজ উগোলিম্ থেকে।

অ্যাই, জ্ঞান মেরো না তো। তার চেয়ে বরং একটা কাজের কাজ করো। চলো, আমরা নেক্সট উইকে একটা সুন্দরবন ট্রিপ মেরে আসি।

গ্র্যান্ড আইডিয়া? টুপুর লাফিয়ে উঠল, আমরা কি গোটা টুরটাই লঞ্চে ঘুরব?

অবশ্যই। সজনেখালিতে রাত্রিবাস, আর দিনভর লঞ্চে টো টো। সুধন্যখালি, বড় চামটা, ছোট চামটা, ভাগবতপুরের কুমির প্রকল্প, নেতি ধোপানির ঘাট… একটা নাইট পাখিরালয়ের টুরিস্ট লজেও থাকতে পারি।

সুধন্যখালিতে মঙ্গল থাকে না? নীলাম্বর দাদার মেসো?

 গুড মেমরি। পার্থ মাথা দোলাল, সুন্দরবনে মানুষ আর জীবজন্তু প্রায় পাশাপাশি বাস করে। যেতে যেতে দেখবি নদীর পারে কুমির রোদ পোয়াচ্ছে, তার খানিক তফাতেই হয়তো লোকে চিংড়িমাছের মীন, মানে বাচ্চা ধরছে।

কপালে থাকলে বাঘও চোখে পড়তে পারে।

সুন্দরবনে বাঘ দেখলে নাকি ফিরে এসে গল্প করার আর চান্স পাওয়া যায় না। পার্থ হ্যাঁ হ্যাঁ হাসল, সুন্দরবনের আসল অ্যাট্রাকশন কিন্তু বাঘ নয় রে টুপুর। ওই জঙ্গলটাই মেন দ্রষ্টব্য। অমন বেঁটেবেঁটে গাছে ভরা ফরেস্ট খুব কম দেখতে পাবি। গাছগুলোর অ্যাভারেজ হাইট দশ-বারো ফিটের বেশি নয়। ম্যানগ্রোভ ট্রি। জল থেকে উঠে এসেছে ডাঙায়। সুন্দরী, হেঁতাল, গরান… সুন্দরী গাছের আড়ালে বাঘ লুকিয়ে থাকে। আর হেঁতালের ডাল হাতে থাকলে সাপ নাকি কাছে ঘেঁসে না।

সুন্দরী গাছের থেকেই জঙ্গলটার নাম সুন্দরবন হয়েছে, না?

এ নিয়ে আরও কিছু মত আছে। পার্থ বিজ্ঞের মতো বলল, তোকে তো বলেইছিলাম, সুন্দরবনের মেন পার্ট পড়ে বাংলাদেশে। ওখানে সুন্দরবন হল বাখরগঞ্জ ডিস্ট্রিক্টে। ওই বাখরগঞ্জ জেলায় এক নদী আছে, নাম সুঞ্জা। নদীটার নাম থেকেই নাকি…

তুমিও তো দেখছি দিব্যি জ্ঞানভাণ্ডার খুলে বসলে?

 এ তো শুধুই উপক্রমণিকা। ভূরিভোজের আগে শাকপাতা। এরপর তো আস্তে আস্তে মেন কোর্সে ঢুকব। সুন্দরবনের ভূগোল ইতিহাস, সেখানকার জীবজন্তুদের স্বভাব…

থামো। কাল তো ফিরেই ভোঁসভোঁস নাক ডাকালে, কোনও কথাই হল না, মিতিন গুছিয়ে বসল, আগে বলো, কাল বিজ্ঞানীর বাড়ি কেমন দেখলে?

দারুণ। চমৎকার মডার্ন ল্যাবরেটরি। কোথাও এতটুকু অগোছালো ভাব নেই। চোখ বোলালেই বোঝা যায় ডক্টর সান্যালের কাজকর্ম খুব সিস্টেমেটিক।

টুপুর ফোড়ন কাটল, স্নেকরুমটার কথাও বলো।

অবশ্যই। এরকম একখানা সাপের আজ্ঞা বানানো কি মুখের কথা! ভদ্রলোক অনেক প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে গবেষণায় নেমেছেন। পাছে লোডশেডিংয়ে কাজে ব্যাঘাত ঘটে তার জন্য সোলার এনার্জির বন্দোবস্তও করা আছে।

উম। আর মানুষটাকে লাগল কেমন?

কাজপাগল। খুবই ডেডিকেটেড। যাকে বলে বিজ্ঞানে নিবেদিতপ্রাণ। দেশকে সত্যি সত্যিই খুব ভালবাসেন। নইলে কেউ বউ-মেয়ে ফেলে আমেরিকা থেকে এসে ওরকম একটা অগা জায়গায় বছরের পর বছর রিসার্চে ড়ুবে থাকতে পারেন?

যাই বলো পার্থমেসো, ডক্টর সান্যাল একটু খ্যাপাও আছেন। না হলে কাউকে কিছু না বলে ওরকম হুট করে কেউ ঘাটশিলা চলে যায়?

প্রকৃত বিজ্ঞানীরা ওরকমই হয় রে টুপুর। নিলস বোরের নাম শুনেছিস? আধুনিক বিজ্ঞানের একটা পিলার। জটিল কোনও সমস্যা মাথায় এলে তিনি রাতদুপুরে আর-এক বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যানের বাড়িতে হানা দিতেন। তারপর সারারাত ধরে অঙ্ক নিয়ে কুস্তি চলত দুজনে। ঘর-সংসার, ইহজগৎ সব তখন তাঁদের মাথা থেকে উধাও। পরমাণু বোমা তৈরির সময়…

ফের গপ্পো জুড়লে? মিতিন থামাল পার্থকে, আমরা সুমন্ত্ৰ সান্যালকে নিয়ে কথা বলছি। নিল্স বোরকে নিয়ে নয়।

তো?

সুমন্ত্ৰ সান্যালের চ্যালাটিকে কেমন লাগল? শ্ৰীমান নীলাম্বর?

ভক্ত হনুমান। স্যারের অত্যন্ত অনুগত। এবং ডক্টর সান্যালের সান্নিধ্যে এসে বেশ কেতাদুরস্ত বনে গিয়েছে। চুলের কায়দাটা দেখেছিলে?

বিশ্বাসী বলেই তো মনে হয়। তাই না?

কথাবার্তা শুনে তো সেরকমই লাগল। তবে বাড়ির পুরো কন্ট্রোলটাই তো ওর হাতে, স্যারের পয়সাকড়ি সরায় কিনা বলতে পারব না।

আলোচনায় ছেদ পড়ল। টেলিফোন ঝংকার তুলেছে। ভুরু কুঁচকে উঠে গেল মিতিন। টেবিলে ফিরল মিনিটপাঁচেক পর। ঈষৎ আনমনা হয়ে।

পার্থ কৌতূহলী মুখে জিজ্ঞেস করল, কার ফোন ছিল?

ভারতী কফি রেখে গিয়েছে টেবিলে। আলগা চুমুক দিয়ে মিতিন বলল, অনিশ্চয়বাবু।

কী সমাচার?

আবার বাসন্তীতে অশান্তি!

তাই নাকি? কী হল?

কাল রাতে ডক্টর সান্যালের বাড়িতে চোর এসেছিল। আজ সকালে নীলাম্বর গিয়ে পুলিশে রিপোর্ট করেছে। বাসন্তী থানা দুপুরেই আই জি সাহেবকে জানিয়েছিল। উনি আমায় এখন নিউজটা কমিউনিকেট করলেন।

ও। কী চুরি গেছে?

যায়নি কিছু। চোরের পায়ের আওয়াজ পেয়েই নীলাম্বরের নাকি ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। সে কে-কে বলে চেঁচিয়ে উঠতেই চোর ভাগলবা।

তেমন সিরিয়াস কিছু নয় তা হলে।

 অনিশ্চয়বাবুরও সেই রকমই মত। তবে উনি কোনও চান্সে যেতে চান না। কাল থেকে পুলিশ গার্ডের বন্দোবস্ত করতে বলেছেন থানাকে। অন্তত রাতে যেন ডক্টর সান্যালের বাড়ির নিরাপত্তা কোনওভাবে না বিঘ্নিত হয়।

ঠিকই করেছেন। ভি আই পি-টি আই পির বাড়িতে একটু পাহারা থাকা ভাল। কোত্থেকে কী ঘটবে, মন্ত্রীমশাই আবার অনিশ্চয়বাবুর প্রাণ অতিষ্ঠ করে তুলবেন।

হুম

বলেই মিতিন পুরোপুরি চুপ। নিঃশব্দে কফি শেষ করে চলে গেল ব্যালকনিতে। ঘুরে এসে অদূরে সোফায় বসেছে। দুমিনিটও সুস্থির থাকল না, উঠে টিভি চালিয়ে একের পর এক চ্যানেল ঘোরাচ্ছে রিমোটে। ঝুপ করে টিভি অফ করে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল বিছানায়। বুমবুম কী একটা বলতে যাচ্ছিল, আহ বলে তাকে থামিয়ে ফের গিয়েছে ব্যালকনিতে।

টুপুরের কেমন যেন লাগছিল। সামান্য একটা খবরে এত চিত্তচাঞ্চল্য কেন জাগল মিতিনমাসির?

পায়ে পায়ে টুপুর ব্যালকনিতে এল। মিতিনমাসি চিন্তায় ড়ুবে থাকলে ডাকতে সাহস হয় না, কোনওক্রমে গলা ঝেড়ে বলল, কী হল গো মিতিনমাসি? এত কী ভাবছ?

দূরমনস্কভাবে মিতিন বলল, কয়েকটা ঘটনাকে সুতো দিয়ে গাঁথার চেষ্টা করছি।

কীরকম?

একটা জলজ্যান্ত ডোবারম্যান ভ্যানিশ হয়ে গেল। তারপর ডক্টর সান্যাল কয়েকদিনের জন্য মিস্টিরিয়াসলি বেপাত্তা হয়ে গেলেন। তিনি ফিরে আসার পরদিনই চোর এল রাত্তিরে। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনও সম্পর্ক নেই তো? আমরা ধরেই নিতে পারি, ডোবারম্যানটাকে কেউ না কেউ মেরে ফেলেছে এবং সরিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ যে বা যারা মেরেছে, তারা চায়নি কুকুরের ডেডবডিটা প্রকাশ্যে পড়ে থাকুক। আর তা নিয়ে একটা ব্যাপক শোরগোল উঠুক। কিন্তু কে সে? নিশ্চয়ই কোনও সাধারণ ছিঁচকে চোর নয়? সে কী চায়?

টুপুর ধন্দমাখা মুখে বলল, কী চাইতে পারে?

এমন নয় তো, ডক্টর সান্যাল অলরেডি ক্যান্সারের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে ফেলেছেন? বিশেষ কোনও কারণে আপাতত খবরটা গোপন রাখতে চান? যদি সত্যিই ফর্মুলা আবিষ্কার হয়ে গিয়ে থাকে, তার মূল্য কিন্তু কম নয়। লাখ ছাপিয়ে দাম কোটি টাকাতেও পৌছোতে পারে, মিতিন দু-এক সেকেন্ড নীরব থেকে হঠাৎই বিড়বিড় করে উঠল, তা হলে কি আর কেউ আবিষ্কারের খবর জেনে ফেলেছে। নীলাম্বর বলছিল তিনটে লোক ডক্টর সান্যালের কাছে এসেছিল। তাদের সঙ্গে ডক্টর সান্যালের ঝগড়াঝাটি হয়। লোক তিনটে কে? তারাই কি কালপ্রিট? লোকগুলো কি লোভ বা ভয় দেখিয়ে ডক্টর সান্যালের কাছ থেকে ফর্মুলা আদায় করতে এসেছিল? সেদিন সুবিধে করতে না পেরে তারপর থেকে কোনও একটা ডেফিনিট ছক কষে এগোচ্ছে তারা? রজারের ইনসিডেন্টটা তাদের ফার্স্ট স্টেপ?

তার মানে তারাই রজারকে মেরেছে?

অসম্ভব নয়। তারা জানে ফর্মুলা হাতানোর জন্য বাড়িতে লুকিয়েচুরিয়ে ঢুকতে গেলে রজারই প্রথম বাধা। সুতরাং নিঃসাড়ে রজারকে হঠিয়ে দেওয়াই শ্রেয়। এবং এভাবে ডক্টর সান্যালকে একটা মোক্ষম শাসানিও দেওয়া গেল।

কিন্তু আবিষ্কারের কথা বাইরের লোক জানবে কী করে?

ঘরের লোক জানালেই জানতে পারে।

 মানে… তুমি বলছ… নীলাম্বর…! টুপুর থতমত খেয়ে গেল, কী করে হয় মিতিনমাসি?

সবই হতে পারে রে টুপুর। লোভ বড় সাংঘাতিক জিনিস। লোভের ফাঁদে পা পড়লে মানুষের হিতাহিতজ্ঞান লোপ পায়। ভুলে যাস না, নীলাম্বর গরিব ঘরের ছেলে। মোটা টাকার টোপ দিলে তার মাথা বিগড়ে যেতেই পারে।

তবু… তবু.. টুপুর তাও মানতে পারছিল না, নীলাম্বর যদি দলে থাকে, তা হলে রজারকে মারার দরকার কী? নীলাম্বর নিজেই তো ফর্মুলাটা পাচার করতে পারে।

নীলাম্বর হয়তো শুধু আবিষ্কারের খবরটুকুই জানে। কিন্তু ফর্মুলাটার হদিশ তার কাছে নেই? কিংবা হয়তো প্রতিষেধক বানানোর প্রসেসটা এমনভাবে কম্পিউটারে ফিড করা আছে, যা উদ্ধার করার বিদ্যে নেই নীলাম্বরের। এবং তার জন্য দরকার অন্য কোনও পাকা মাথা। সেই ধরনের কাউকে বাড়িতে এন্ট্রি দিতেই… বলেই মিতিন ঘাড় নাড়ছে দুদিকে, উহুঁ, এ যুক্তিও ধোপে টেকে না। ডক্টর সান্যাল তো মাঝে কদিন ছিলেন না, ওই সময়ই তো সব তোলপাড় করে খোঁজাখুঁজির কাজটা সারা যেত। তা ছাড়া সে নিজে গিয়ে থানায় মিসিং ডায়েরি লিখিয়েছে। আপত্তিকর তিনটে লোক এসেছিল সে গল্পও যেচে করল আমাদের কাছে…। তারপর ধর, আবিষ্কার যদি হয়ে গিয়েই থাকে, ডক্টর সান্যাল কি সেটা বাড়িতে রেখে বেমালুম চলে যাবেন? তাও আবার এমন এক সময়ে, যখন তিনি রজারকে হারিয়ে যথেষ্ট ইনসিকিয়োর ফিল করছেন। তাহলে কি তিনি ফর্মুলাটা সঙ্গে নিয়েই সেমিনারে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ঘাটশিলা? …উহুঁ, এ থিয়েরিটাও যেন কেমন কেমন লাগছে!

তা হলে?

কোথাও একটা জট পাকিয়ে আছে, বুঝলি। মিতিন মাথা ঝাঁকাল, নাঃ, কাল একবার বাসন্তী ঘুরেই আসি। ডক্টর সান্যাল সত্যিই যদি বিপদে পড়ে থাকেন, তাঁর পাশে তো দাঁড়ানো উচিত।

ঠিকই তো। চলো, আমিও যাব সঙ্গে।

চল, কাল ভোরভোরই বেরিয়ে পড়ি। এবার আর বাসরুট নয়। ভেঙে ভেঙে যাব। ট্রেন ধরে প্রথমে ক্যানিং। সেখান থেকে ভুটভুটিতে ডকের খেয়া। তারপর অটো ধরে সোনাখালি। শেষে পুরন্দর পার হয়ে বাসন্তী। সময়ও কম লাগবে, জার্নিও একটু অন্য রকম হবে।