৪-৬. প্রথম থামা হল আলওয়েতে

প্রথম থামা হল আলওয়েতে। কোচি শহর ছেড়ে পনেরো-বিশ কিলোমিটার গিয়ে। একটা বাজার মতো অঞ্চলের প্রান্তে প্রকাণ্ড উনুনে অতিকায় কড়ায় কী যেন ভাজাভুজি চলছে দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না পার্থ। হেঁকে উঠল, হল্ট।

গাড়ি থেকে নেমে পাৰ্থ পর্যবেক্ষণ করে এল খাদ্যদ্রব্যটি। ঘোষণার ঢঙে বলল, পাকা কলার বেসনফ্রাই। বেগুনি ভেবে খেতে পারো। অর্ডার দেব?

দিতে পারো। মিতিন বলল, খিদে তো পেয়েছেই। এখনও পর্যন্ত কফি ছাড়া তো কিছু পেটে পড়েনি।

সহেলি নাক সিঁটকালেন, তা বলে পাকা কলার বড়া? আলুর চপটপ নেই?

টুপুর বলল, নতুন জিনিস টেস্ট করো না মা। তা ছাড়া কলা তো ভাল জিনিস। হাই ভিটামিন। দ্যাখোনি, টেনিস প্লেয়াররা খেলার ফাঁকে গপগপ কলা খায়।

যুক্তিতে না পেরে সহেলি অসহায় গলায় বললেন, ও পাৰ্থ, তুমি যে বলেছিলে ভাল জায়গায় ব্রেকফার্স্ট করাবে?

কথা সেরকমই ছিল বটে। পরিবহন এজেন্সির টয়োটা কোয়ালিস ছটা বাজার আগেই চলে এসেছিল হোটলে। পার্থ অবনীকে ঘুম থেকে তুলে, বুমবুমকে তৈরি করে, জিনিসপত্র গুছিয়ে সেজেগুজে বেরোতে বেরোতে সাতটা। তখন ব্রেকফাস্টে বসলে আরও কি দেরি হয়ে যেত না!

পার্থ হেসে বলল, আপাতত এটা দিয়েই শুরু হোক না। পথে নয় আবার নয় দাঁড়ানো যাবে।

দু মিনিটে গরমাগরম কলাভাজা হাজির। সঙ্গে কফিও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সহেলি কামড় দিলেন কলাভাজায়। পলকে মুখ হাসিতে ভরে গেল। চিবোচ্ছেন কচর কচর।

অবনীকে বলেন, খাও না, একটু মুখে দিয়ে দ্যাখো।

নতুন বস্তুটি চাখতে অবনী একেবারেই রাজি নন। বললেন, আমার কফিই ঠিক আছে।

 খালি পেটে বারবার কফি খাবে? তোমার ব্যাগে তো বিস্কুট আছে, বার করে নাও না!

আছে বুঝি?

আজ্ঞে হা স্যার। আমি নিজে কাল রাতে দেখেছি।

আমার ব্যাগ কোথায়?

মিতিন বলল, টুপুর, পিছনে দ্যাখতো।

টুপুর আর বুমবুম ব্যাকসিটে। টুপুরের পায়ের কাছে একটা লাল ব্যাগ। সে নিচু হওয়ার আগেই বুমবুম ঝুঁকে পড়ে চেন খুলেছে, এটা তো বাবার ব্যাগ! ক্যামেরা আছে।

অবনীদার ব্যাগ বোধ হয় তা হলে ছাদে।

বেরনোর সময়েই জিনিসপত্র সব গাড়ির মাথায় তুলে ঢাকা দেওয়া হয়েছিল তেরপলে। ঢাকা সরিয়ে ব্যাগটাকে খুঁজল পার্থ। চেঁচিয়ে বলল, ও অবনীদা, আপনার ব্যাগ তো এখানেও নেই!

সে কী? গেল কোথায়? হোটেলে ফেলে এলে নাকি?

ব্যস, শুরু হয়ে গেল দোষারোপের রিলে রেস। অবনী সহেলিকে দুষছেন, সহেলি মিতিনকে, মিতিন পার্থকে। বেরনোর মুখে ডামাডোলের মাঝে অবনীর লাল ব্যাগ যে কাবার্ডেই রয়ে গেছে এ এখন জলের মতো পরিষ্কার।

অবনী হায় হায় করে উঠলেন, কী হবে এখন?

সহেলি তপ্ত স্বরে বললেন, ভালই হয়েছে, আপদ গেছে। যে মানুষ নিজের একটা জিনিসও খেয়াল রাখতে পারে না, তার এরকমই হয়।

কিন্তু ব্যাগ ছাড়া আমার চলবে কী করে? ওতে আমার ছাতা আছে, পাজামা-পাঞ্জাবি আছে, দাড়ি কমানোর সরঞ্জাম আছে…।

ভালই তো হল। রেবতী ইন্টারন্যাশনালের বেয়ারা এখন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, শেভিং সেটে দাড়ি কামিয়ে, ছাতা মাথায় কোচির রাস্তায় হাওয়া খাবে।

টিজ কোরো না। টিজ কোরো না। আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।

কুল, কুল। মিতিন ঝটপট ভ্যানিটিব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন আর রেবতী ইন্টারন্যাশনালের কার্ডটা বের করল। টকটক বোতাম টিপে চলন্ত দূরভাষে ধরল হোটেল ম্যানেজারকে। মিনিট তিনেক কথা বলে হাসিমুখে জানাল, নো চিন্তা। হোটেলের বেয়ারা কাউন্টারে ব্যাগ জমা করে দিয়েছে। ব্যাগ এখন হোটেলের জিন্মায়। ওরা বলে দিল, উদ্বেগের কিছু নেই, আপনারা তো কোচিতে ফিরবেনই, তখন কালেক্ট করে নেবেন।

আমি ততদিন দাড়ি কামাব কী করে? অবনীর গালে হাত। করুণ স্বরে বললেন, এই পাৰ্থ, গাড়ি ঘোরানো যায় না?

খবরদার না। ওই কটা ফালতু জিনিসের জন্য মিছিমিছি তেল পোড়ানোর কোনও প্রয়োজন নেই। সহেলি কড়া গলায় বললেন, পাৰ্থ, উঠে এসো।

কফি কলাভাজার দাম মিটিয়ে গাড়িতে ফিরেছে পার্থ। ছুটল টাটা কোয়ালিস। চলেছে খাড়া পুব মুখে। দেখতে-দেখতে শহরের ছবি মিলিয়ে গিয়ে দুধারে গ্রামীণ দৃশ্য। নতুন ধান বোনা হচ্ছে খেতে, চোখ জুড়নো কচি সবুজ রঙে ছেয়ে আছে চারদিক। গোটা রাজ্যটাই কী সবুজ। বাড়িঘরগুলো ভালভাবে লক্ষ না করলে হঠাৎ যেন পশ্চিমবঙ্গ বলে ভুল হয়।

পার্থ ইংরেজিতে ড্রাইভারকে বলল, একটা ভাল ধাবা দেখে গাড়ি দাঁড় করাও তো দেখি।

হাসিখুশি চেহারার ড্রাইভারটির বয়স বড়জোর সাতাশ-আঠাশ। চকচকে কালো রং, একমাথা ঘন চুল, রোগা হলেও হাড়টাড়গুলো বেশ চওড়া। নাম টমাস ম্যাথু। কেরলীয় ক্ৰিশ্চান। কোচিতেই বাড়ি। ম্যাথু হিন্দি ইংরেজি দুটোই বলতে পারে, তবে ছাড়া-ছাড়া। পাৰ্থর কথায় সচকিত হয়ে সে প্রশ্ন করল, হোয়াট স্যার? হোয়্যার স্টপ?

ধাবা, আই মিন, রোডসাইড ফুডজয়েন্ট। আমরা ব্রেকফার্স্ট করব।

ব্রেকফার্স্ট শব্দটা খুব বুঝেছে ম্যাথু। ঢক করে ঘাড় নাড়ল। গাড়ির গতি বাড়িয়েছে একটু। মিনিট কয়েকের মধ্যে এক জনপদে পৌছে ব্রেক কষেছে। ছোটখাটো একখানা রেস্টুরেন্ট দেখিয়ে বলল, গুড ফুড স্যার। ইডলি-আপ্পান-বড়া সব মিলে গা।

তা এখানেও ঠিক প্ৰাণ ভরে খেতে পারলেন না অবনী-সহেলি। ইডলি চলবে না বলে পুরি-সবজি নিলেন বটে, নতুন ধরনের তরকারির স্বাদ জিভে রুচল না। বিরস মুখে পুরি গিলতে গিলতে আর একবার ব্যাগের শোক উথলে উঠল অবনীর। তাঁর দ্বিতীয় চশমাখানাও নাকি ওই ব্যাগে রাখা ছিল।

শুনে সহেলি বললেন, তোমাদের দাবার বোর্ডটাও নিশ্চয়ই ওখানে?

না দিদি। পার্থ ফিচেল হাসল, কালই ওটা আমার ব্যাগে ভরে রেখেছি।

উদ্ধার করেছ। মিতিন তাড়া লাগাল, এবার চটপট গাত্ৰোত্থান করো তো। এমন ঢিকিয়ে-ঢিকিয়ে চললে মুন্নার পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে।

এর পর আর অবশ্য বেশি দাঁড়াল না গাড়ি। ইদুক্কি ডিস্ট্রিক্ট আসা পর্যন্ত বেশ ভাল গতিতেই ছুটল। তারপর শুরু হয়েছে পাহাড়ি রাস্তা। পথ আর মসৃণ নয়, চড়াই-উতরাই পড়ছে অজস্ৰ। দুপাশে দেখা যায় ছোট-বড় জঙ্গল।

পাহাড় টপকে-টপকে মুন্নার পৌছনোর আগে রাস্তার ধারেই জলপ্রপাত পড়ল একটা ছোট্ট, কিন্তু ঝিমঝিম আওয়াজ তুলে ঝরে পড়ছে ধারা। গাড়ি থামিয়ে হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ল সকলে। জলধারা দেখে বুমবুমের যেন আহ্লাদ আর ধরে না, ম্যাথুর সঙ্গে নেমে গেল একেবারে সামনেটায়। জামা-প্যান্ট ভেজাল প্রাণের সুখে। পিছল পিছল পাথর বেয়ে মিতিন-টুপুরও গেছে ধারার কাছে। ছিটকে আসা জলকণা মাখছে চোখে-মুখে। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে একটু উপর থেকে পার্থ ছবি তুলছে টপাটপ।

ঠিক তখনই নির্জন রাস্তায় এক অ্যাম্বাসাডার। গাড়িটা জলপ্রপাত পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল, ব্যাক করে থামল ঘ্যাচাং। দুটো ষণ্ডা চেহারার লোক বেরিয়ে এসেছে দরজা খুলে। পরনে সাদা লুঙ্গি, সাদা হাফশার্ট। গায়ের রং মেটে-মেটে! একজনের গোঁফ আছে, একজনের মাথায় টাক।

টাকমাথা লোকটা অবনীকে কী যেন বলছে, অবনী জোরেজোরে মাথা নাড়লেন। গুঁফো সোজা গিয়ে দাঁড়াল ছোট্ট ব্রিজটার ওপর। টুপুরদের খানিক দেখে নিয়ে কোমরে হাত রেখে পায়চারি করছে। টাকমাথা গেল গুঁফোর কাছে, কী যেন বলাবলি করল। তারপর পার্থকে দেখতে দেখতে গাড়িতে ফিরে গেছে। রমণীয় নিসর্গে একরাশ কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে হুশ করে মিলিয়ে গেল অ্যাম্বাসান্ডার।

টুপুর এসে অবনীকে জিজ্ঞেস করল, লোকটা তোমায় কী বলছিল গো বাবা?

বুঝলাম না। মলয়ালম।

 মিতিন বলল, মলয়ালম কেন? তামিল-তেলুগুও তো হতে পারে।

নাহ, মলয়ালমই। একটা-দুটো শব্দ চিনতে পেরেছি।

কী রকম?

 যেমন এনথানে। মানে, কী। পয়ভারুকা। মানে, গুড বাই।

কার কাছ থেকে শিখলে? সুনীলদাদা?

অবনী জবাব না দিয়ে হাসলেন।

সঙ্গে সঙ্গে সহেলির ধমক, হেসো না। লোকদুটোকে আমার মোটেই সুবিধের লাগেনি।

অসুবিধেটা কী করেছে?

ওরা ঘুরে এল কেন? দাঁড়ালই বা কেন? গুঁফো কোমরে হাত দিয়ে কী দেখছিল? দৃষ্টি দেখেছিলে লোটার? কী রকম ঢুলুঢুলু? ভিলেনদের মতো?

ব্যস, শুরু হয়ে গেল জল্পনা-কল্পনা। কী মতলব ছিল লোক দুটোর, কেনই বা দেখেশুনে কেটে পড়ল, ছিনতাইয়ের ধান্দা করলে পার্থ ছেড়ে কথা বলত না, খালি হাতেই মোকাবিলা করত, এই সব।

কথাবার্তা চলতে-চলতেই এসে গেছে মুন্নার। সমুদ্রতল থেকে প্রায় পনেরোশো মিটার উঁচুতে মুন্নার সত্যিই এক মনোরম উপত্যকা। চারদিকে ঘন সবুজ পাহাড়, যেদিকে তাকাও পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নরম গালিচার মতো নেমে এসেছে চা-বাগান। এই দুপুরেও একটা ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে আছে মুন্নারের বাতাসে।

সুনীল মুন্নার ক্লাবে থাকার কথা বলে দিয়েছিল। সেইমতে মেন রোড ছেড়ে গাড়ি আরও খানিক উঠল উপরে। আদতে ক্লাব হলেও ভাড়া দেওয়ার জন্য ঘর আছে কয়েকখানা। মূল বিল্ডিং থেকে একটু তফাতে। কটেজের মতো।

ক্লাবের লনে পা রেখে টুপুর উচ্ছ্বসিত, ওয়াও! দ্যাখো মিতিনমাসি, এখান থেকে চারপাশটা একদম পেন্টিংয়ের মতো লাগছে না?

সত্যিই অসাধারণ। মিতিনও দেখছে চোখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে, নীচে পুরো মুন্নার টাউনটা দেখা যাচ্ছে, চারদিকে গোল হয়ে ঘিরে আছে পাহাড়…! আকাশটাও দ্যাখ, মনে হচ্ছে না অনেক নীচে নেমে এসেছে?

বুমবুম বিজ্ঞের মতো বলল, এখানেই কিন্তু আমরা থাকব মা। জায়গাটা দার্জিলিংয়ের চেয়েও বিউটিফুল।

সহেলি সায় দিলেন, বুমবুম ঠিকই বলেছে। দার্জিলিঙে বড় মেঘ এসে পড়ে গায়ে।

অবনীকে নিয়ে পাৰ্থ ঘর দেখতে গিয়েছিল। ঘুরে এসে বলল, রুমের কোয়ালিটি কিন্তু সো-সো। বাথরুমও তেমন সুবিধের নয়। অন্য হোটেল দেখব?

সহেলি বললেন, আর দেখাদেখিতে যেয়ো না পার্থ। এক-দুদিনের তো মামলা.. স্পটটাও খুব সুন্দর…এখানেই ব্যবস্থা করে ফ্যালো।

সামনের কটেজটায় পাশাপাশি দুটো ঘর নেওয়া হল। মিতিনদের ঘরটার আবার এদিক নেই ওদিক আছে। খাট বলতে সাধারণ চৌকি, তার উপরে পাতলা তোশক, ড্রেসিংটেবিল-ট্রেসিংটেবিলেরও বালাই নেই, দেওয়ালে ঝুলছে ফ্রেমে বাঁধানো আয়না, ওদিকে ঘরের সঙ্গে ফাকা অ্যান্টিরুম আছে একটি। বাথরুমের সামনেও ছোট্ট একফালি জায়গা।

মুখ-হাত ধুয়ে, জামাকাপড় বদলে তাজা হয়ে নিল সবাই। ক্লাবে আগে থেকে না বলে রাখলে খাবার পাওয়া যায় না, মধ্যাহ্নভোজের জন্য আবার বেরোতে হবে এক্ষুনি। এমন সময়ে অবনী হঠাৎ ভগ্নদূতের মতো মিতিনদের দরজায়। শুকনো মুখে বললেন, সর্বনাশ হয়ে গেল!

কেন? কী হয়েছে?

একটা গোখখুরি করে ফেলেছি। লাল ব্যাগের পকেটে আমার ক্রেডিট কার্ডটা রেখেছিলাম।

বাক্য শেষ হতে না-হতে হাউমাউ করে উঠেছেন সহেলি, কী হবে এখন? কারও হাতে ওই কার্ড পড়লে সে যদি টাকা তুলে নেয়?

দাঁড়াও, দাঁড়াও। উত্তেজিত হোয়ো না। প্রথম কথা, অবনীদার সিক্রেট কোড না জানলে কেউ টাকা তুলতে পারবে না। সেকেন্ডলি, ও ব্যাগ তো সেফ কাস্টডিতেই আছে। হোটল ম্যানেজারের হেফাজতে।

তা ঠিক। তবু তুমি আর-একবার হোটেলে ফোন করে দাও না মিতিন।

টুপুর বলল, এক কাজ করলে হয় না মিতিনমাসি? তুমি বরং সুনীলদাদাকে জানিয়ে দাও। সুনীলদাদা গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে এলে বাবা-মার টেনশন কমে।

গুড সাজেশান। মিতিন মুচকি হেসে খুদে টেলিফোনটা বের করল। স্ক্রিনে চোখ রেখে হাসি মিলিয়ে গেছে, এই যাহ, নেটওয়ার্ক তো নেই!

তা হলে?

নো প্রবলেম, ল্যান্ড লাইন তো আছে। মিতিন কাঁধে ওড়না ঝুলিয়ে নিল, আয় টুপুর।

কম্পাউন্ডের মাঝের ক্লাববাড়িটা বেশ বড়সড়। সামনে সুদৃশ্য বাগান। ক্লাবের হলঘরে এই দুপুরেও টেটেনিস পেটাচ্ছে দুটো অল্পবয়সি ছেলে, টুং-টাং-টাক আওয়াজ ভাসছে বাতাসে। সরু বারান্দার লাগোয়া অফিসরুমটায় এল মিতিন আর টুপুর। এক মধ্যবয়সি একা বসে ঢুলছিলেন, তাঁর অনুমতি নিয়ে প্রথমে হোটেলে ফোন। হা, ক্রেডিট কার্ড যথাস্থানেই আছে, ব্যাগ চেক করে বললেন হোটেল ম্যানেজার। মিতিনও তাঁকে জানিয়ে দিল সুনীল এলে ব্যাগটা যেন তার হাতে সমৰ্পণ করা হয়।

এবার সুনীলের মোবাইল নম্বর। অফিসে ছিল সুনীল, তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে মিতিনের ভুরু জড়ো হয়েছে হঠাৎ। কান থেকে ফোন যখন সরাল, কপালে স্পষ্ট বিস্ময়ের ছাপ।

টুপুর উৎসুক মুখে জিজ্ঞেস করল, কী হল গো? কী বলল সুনীলদাদা?

একটা খুব খারাপ খবর শোনাল।

 কী?

সিনাগগের টিকিট কাউন্টারের ছেলেটাকে মনে আছে? সেই ভিতু-ভিতু মতো? সতীশ মেননের সামনে এসে যে তোতলাচ্ছিল?

হ্যাঁ।

 ছেলেটা কাল রাতে খুন হয়েছে।

.

০৫.

খাবার টেবিলে বিশেষ কথা বলছিল না মিতিন। যেন একটু অন্যমনস্ক। বেয়ারা টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে, তাকাচ্ছেই না সেদিকে।

চিকেন ফ্রায়েড রাইসের ধূমায়িত পাত্ৰখানা মিতিনকে বাড়িয়ে দিয়ে পাৰ্থ বলল, নাও, শুরু করো।

হুঁ।

তোমাদের জন্য ওই মাছ ভাজাটাও বলে দিয়েছি। ওই যে, কী যেন একটা বিটকেল নাম?

টুপুর বলল, ক্যারিমিন পল্লিচাথু?

বেড়ে মেমারি তো তোর। এবার টেস্ট করে দ্যাখ বাড়ি আর হোটেলের প্রিপারেশানে কতটা তফাত.. আর কিছু নিবি? চিকেন-মাটনের কোনও সাইড ডিশ?

চাইনিজ ফুডের সঙ্গে মোগলাই পাঞ্চ করবে? তা হলে মাটন কড়াই নেওয়া যেতে পারে। নাকি অন্য কিছু বলব, মিতিনমাসি?

চামচ করে প্লেটে ফ্রায়েড রাইস নিচ্ছিল মিতিন। মুখ না তুলেই বলল, তোর মা-বাবাকে জিজ্ঞেস কর।

তোর কী হল বল তো? সহেলি ভুরু কুঁচকোলেন, কোথায় সিনাগগে একটা মার্ডার হয়েছে, তার জন্য তুই উতলা হবি কেন?

উতলা নয়, ভাবছি। ছেলেটা তা হলে গ্রেট স্ক্রল চুরির সঙ্গে জড়িত ছিল?

তাতেই বা তোর কী?

খানিকটা দায় তো আমাদের আছেই দিদি। আমরা যদি গ্রেট স্ক্রল দেখার জন্য বায়না না জুড়তাম, ছেলেটাকে তা হলে মরতে হত না।

এটা তুমি জোর দিয়ে বলতে পারো না। পার্থ প্রতিবাদ জুড়ল, কাল না হলেও নেক্সট শনিবার প্রার্থনার সময়ে চুরি তো আবিষ্কার হতই। তখনও তো ছেলেটা খুন হতে পারত। কিম্বা হয়তো সপ্তাহের মাঝখানেই ছেলেটাকে…। পুলিশ তখন চুল ছিঁড়ত, কেন হল, কেন হল…! পরে চুরিটা জানাজানি হলে হয়তো টের পেত কারণটা। মোদ্দা কথা, যারা ছেলেটাকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে, তারা ওকে সরিয়ে দিতই। আজ না হোক কাল। যাতে জেরার মুখে দুষ্কর্মের পাণ্ডাটির নাম ফাঁস না হয়ে যায়।

খলনায়কটি কে হতে পারে মিতিন? অবনী এক টুকরো শশা মুখে পুরলেন, নিশ্চয়ই জু টাউনেরই কেউ?

আমার তো সাইমন লোকটাকেও সন্দেহ হয়। সহেলি বললেন, রক্ষকই হয়তো ভক্ষক।

জোস হ্যালেগুয়াকেই বা বাদ দিচ্ছেন কেন? কটা চামচে চিলি প্রন গাঁথতে-গাঁথতে পাৰ্থ ফুট কাটল, তাঁর ঘর থেকে চাবির ছাপ তুলে আনা হল, অথচ তিনি কিছুই জানেন না? ব্যাপারটা যেন কেমন-কেমন ঠেকছে না?

যাই বলো, আমার কিন্তু ধারণা সরষের মধ্যে ভূত যদি থাকেই, সে ওই সাইমন। ভদ্রলোক কাল বলছিলেন না, সন্ধেবেলা কাকে যেন মিট করতে যাবেন? দ্যাখো গে যাও, চোরের দলের সর্দারের সঙ্গেই হয়তো আপয়েন্টমেন্ট ছিল! সাইমনের পক্ষেই তো জোস হ্যালেগুয়ার চাবি থেকে ছাপ তোলা সবচেয়ে বেশি সহজ কাজ। নয় কী?

তোমরা কিন্তু গোড়াতেই ভুল করছ। এতক্ষণ পর মুখ খুলেছে। মিতিন, জোস বা সাইমন অপকর্মে জড়িত নন, কিম্বা তাদের কারও সঙ্গে কোনও কালপ্রিটের আঁতাত নেই, একথা আমি জোর দিয়ে বলব না। তবে কিছু কিছু খটকা তো থেকেই যায়।

যেমন?

প্রথম সাইমনকেই ধরে। গ্রেট স্ক্রল হাওয়া হয়ে গেছে জেনেও সাইমন আমাদের গ্রেট স্ক্রল দেখাতে রাজি হলেন কেন? কোনও বাধ্যবাধকতা তো ছিল না, স্বচ্ছন্দে তিনি আমাদের হাঁকিয়ে দিতে পারতেন। আর মিস্টার হ্যালেগুয়া? দেখেছই তো, তিনি কেমন আলাভোলা মানুষ, দরজা সর্বক্ষণই হাট করে খোলা রাখেন। তাঁর বাড়ি থেকে চাবির ছাঁচ তোলা তো নেহাতই ছেলেখেলা। যে কেউ করতে পারে। মিস্টার হ্যালেগুয়ারও যদি চুরির মতলব থাকে, তিনি ড়ুপ্লিকেট চাবি বানাতে যাবেন কেন? আসল চাবিই তো তার কাছে মজুত।

টুপুর বলল, সবাইকে বিভ্রান্তিতে ফেলার জন্য ওটাই হয়তো মিস্টার হ্যালেগুয়ার চাল?

ভুল করছিস। মিস্টার হ্যালেগুয়ার হেফাজতে বহুকাল ধরে দেওয়ালসিন্দুক রয়েছে, গ্রেট স্ক্রল সরানোর হলে তিনি তো কবেই সরাতে পারতেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই বুড়ো বয়সে মিস্টার হ্যালেগুয়ার মতিভ্ৰম হয়েছিল, মোটা টাকার টোপ খেয়ে দুষ্কর্মটিতে তিনি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন… তা হলেও প্রশ্ন থেকে যায়। কাউন্টারের ছেলেটার সঙ্গে তিনি সাঁট করবেন কেন? গ্রেট স্ক্রল হাপিশ করার পক্ষে তিনি একাই কি যথেষ্ট নন?

এমন তো হতে পারে, ছেলেটা ঘটনাচক্রে মিস্টার হ্যালেগুয়াকে গ্রেট স্ক্রল সরাতে দেখে ফেলেছিল?

তা হলে তো তখনই খুন করাতেন। চুরি ধরা পড়া অবধি অপেক্ষা করবেন কেন? অবশ্য যদি ধরেই নিই মিস্টার হ্যালেগুয়া একজন ভয়ংকর মানুষ, যিনি নরহত্যা পর্যন্ত করতে পারেন। ফ্রাঙ্কলি বলছি, বৃদ্ধ পুরোহিতটিকে দেখে আমার কিন্তু মোটই সেরকম মনে হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা, সাইমনের যুক্তিটা তো মিস্টার হ্যালেগুয়ার ক্ষেত্রেও খাটে। জিনিসটা উধাও জেনেও তিনি আমাদের সিনাগগে নিয়ে গেলেন কেন? তাড়াতাড়ি চুরি ধরা পড়ায় তার কী উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে? একমাত্র তোদের সন্দেহের তির তার দিকে যাওয়া ছাড়া?

অর্থাৎ তুমি বলতে চাও সাইমন পেরেজ বা জোস হ্যালেগুয়া চুরিতে নেই?

সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। মিতিন একঢোক জল খেল। ভিনিগারে ভেজানো লঙ্কার কুচি মুখে ফেলে বলল, আগেও বলেছি, এখনও বলছি, নাটের গুরুটি বাইরের কেউ। তবে শুধু যে সাক্ষ্য লোপের জন্য খুনটা হয়েছে, এ আমি পুরোপুরি মানতে পারছি না। চুরি যখন শনিবারই হয়েছে, তখন ছেলেটাকে আরও একটা দিন বাঁচিয়ে রাখার কী অর্থ? নৃশংস লোকটা চোরাই মাল হস্তগত হলেই ছেলেটাকে সাবাড় করবে, এটাই তো স্বাভাবিক ছিল। কেন করেনি সেটাই ভাবছি।

অত ভাবাভাবির দরকারটা কী? সহেলির স্বরে বিরক্তি, এদিকে আমি যে কত বড় বিপদে পড়লাম সে নিয়ে তো কারও হুঁশ নেই!

একসঙ্গে সব কটা চোখ আছড়ে পড়ল সহেলির ওপর, বিপদ? তোমার?

নয়তো কী। টুপুরের বাবা তো ক্রেডিট কার্ড ফেলে এলেন, এখন আমার চলবে কী করে? ওই কার্ডের ভরসাতেই তো বেশি ক্যাশ টাকা সঙ্গে আনিনি!

এই ব্যাপার? পাৰ্থ হো-হো হাসল, আমরা তো আছি। কিনুন না যা খুশি।

ভরসা দিচ্ছ?

সিওর।

আমার কিন্তু ভাল দেখে একটা কথাকলির মুখোশ চাই। সহেলির মুখ হাসিতে ভরে গেল, যেখানেই দেখতে পাব কিনে নেব।

শখের বলিহারি! অবনী কুটুস ফুট কাটলেন, মুখোশ পরে নাচবে নাকি?

এই তো পণ্ডিতির নমুনা! অবনীর দিকে আগুনে দৃষ্টি হানলেন সহেলি, কথাকলি ডান্সাররা মোটেই মুখোশ পরে নাচে না। মাথায় একটা জবরজং মুখোশ চাপায়, আর মুখ এঁকে নেয় মুখোশের ঢঙে। মুখোশ যেটা পাওয়া যায়, সেটা ফর শো। সাজানোর জন্যে।

ফ্ল্যাটের দেওয়ালগুলোর ওপর একটু দয়ামায়া তো করো। তোমার সাজের ভারে ওরা যে এবার খসে পড়বে।

অবনীর বলার ভঙ্গিতে হেসে উঠল গোটা টেবিল। এক লহমায় পরিবেশ ফুরফুরে। ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দেওয়া হল মাটন কড়াই-এর, ক্যারিমিন পল্লিচাথুও এসে গেল, খাচ্ছে সবাই মনোযোগ সহকারে।

মাছভাজা মুখে পুরে বাইরেটা দেখছিল টুপুর। রেস্তোরাঁর কাচের জানলা দিয়ে। ছোট হলেও মুন্নার বেশ জমজমাট শহর। বিশেষত শহরের এই মধ্যমণি অঞ্চলটা। বাড়িঘর দেখে ঠাহর হয় এলাকাটা পুরনো। এদিকটায় দোকানপাট আছে অজস্ৰ, হোটেলের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। সরু একটা নালামতো চলে গেছে শহরের মধ্যিখান দিয়ে। ওটা নালা? না নদী? বর্ষায় ওরই চেহারা হয়তো ফুলেফেঁপে ওঠে! অদূরে চা-বাগানও দৃশ্যমান। এত চা হয় নীলগিরি রেঞ্জে?

ভাবনার মাঝেই কনুইয়ের খোঁচা, আই দিদিভাই দ্যাখ, সেই দুষ্টু লোকগুলো!

কারা?

 ওই যে ফলসের ধারে এসেছিল!

ওমা, তাই তো! সেই দুই মূর্তিমানই তো! ঢুকেছে রেস্তোরায়। হেলেদুলে কোনার টেবিলে গিয়ে বসল। তাকাচ্ছে এপাশ-পাশে। টুপুরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চোয়াল ফাঁক করল গুঁফোটা। সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিয়েছে টুপুর। চাপা গলায় মিতিনকে বলল, কী বিচ্ছিরি ভিলেনের মতো হাসছে দ্যাখো!

আমল দিস না। খা।

 পার্থরও নজর গেছে। বলল, আশ্চর্য, বেছে বেছে এখানেই এল?

সহেলি শঙ্কিত মুখে বললেন, আর এখানে থাকতে হবে না। উঠে পড়ো।

আহ, বাড়াবাড়ি কোরো না। মিতিন মৃদু ধমক দিল, নির্জন জায়গায় যখন অ্যাটাক করেনি, এত লোকের মাঝে কীসের বিপদ?

তবু যেন ঠিক আশ্বস্ত হওয়া গেল না। সকলেই আড়ে-আড়ে দেখছে। তন্দুরি চিকেন নিয়েছে লোকদুটো, তামসিক ভঙ্গিতে কচরকচর চিবোচ্ছে মুরগির ঠ্যাং। টুপুররা যখন বিল মিটিয়ে বেরিয়ে এল, তখন নতুন করে কী যেন অর্ডার করছে দুজনে।

রেস্তোরার উলটো দিকে গাড়ি রেখেছে ম্যাথু। সহেলি সিটে বসে বললেন, ওফ, ভয়ে-ভয়ে বেশি খাওয়া হয়ে গেল। এখন একটা পান পেলে ভাল হত।

খাবেন পান? পার্থ বলল, তবে এখানে বোধ হয় বাংলার পান মিলবে না। দক্ষিণী পান চলবে?

চলবে, চলবে। আমি সাউথ ইন্ডিয়ান পান খেয়েছি। কলকাতাতেও পাওয়া যায়। গোল-গোল করে সাজে, ওপরে একটু নারকোল ছড়িয়ে দেয়…

টুপুর বলল, আমিও একটা সাউথ ইন্ডিয়ান পান খাব।

বুমবুম বলল, আমিও।

আয় তবে।

দোকানে এসে এক প্যাকেট সিগারেট কিনল পাৰ্থ। পান সাজাই ছিল, ভরে নিয়েছে ঠোঙায়। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, তোদের আর কিছু চাই?

বুমবুমের একটাই চাহিদা। চিপস।

টুপুর বলল, গোটাকতক চিকলেট নিতে পারো।

এনিথিং মোর?

নাথিং… আমরা কি এখন হোটলে ফিরছি, পার্থমেসো?

চাইলে খানিক বেড়াতেও পারি। একেবারে সন্ধেবেলা গিয়ে ঢুকব।

এখানে কী কী দ্রষ্টব্য আছে?

 কাছাকাছির মধ্যে সাইট বলতে এরাভিকুলম ন্যাশনাল পার্ক… আনাইমুড়ি পাহাড়.. জানিস তো, আনাইমুড়ি সাউথ ইন্ডিয়ার হাইয়েস্ট পিক। প্রায় দুহাজার সাতশো মিটার উঁচু।

মাত্ৰ? হিমালয়ের চূড়াগুলোর কাছে এ তো নস্যি গো!

কী আর করা, এরা যে আর বাড়েনি। তবে মনে রাখিস, আনাইমুড়ির বয়স কিন্তু হিমালয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

তা ওই বুড়ো পাহাড়ে চড়া যায়?

শুনেছি ট্রেক করতে হয়। অনেকটা সময় লাগে। তোর মা থোড়াই পারবে।…আর-একটা সাইটও আছে কাছেপিঠে। মাটুপেট্টি ড্যাম।

হঠাৎই পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল, দ্যাটস আ ওয়ান্ডারফুল প্লেস। ডোন্ট মিস ইট।

চমকে ঘাড় ঘোরাল টুপুর। এক ভদ্রলোক হাসছেন মিটিমিটি। পরনে জিনস, ডেনিম জ্যাকেট, কাঁধে বিদেশি ক্যামেরা, পায়ে থ্যাবড়া শু। হাইট খুব বেশি নয়, দোহারা চেহারা, মাথায়। আফ্রিকানদের মধ্যে চাপ চাপ কোঁকড়া চুল ও জোড়া ভুরু, গায়ের রং না ফরসা না কালো। দেখে মনে হয় পার্থমেসোরই বয়সি।

হাসি বিস্তৃত করে ভদ্রলোক বললেন, আমি ওল্পো-ওল্পো বাংলা জানে। সুইট ল্যাঙ্গুয়েজ। আর ইউ ফ্ৰম ক্যাল?

পার্থ ইংরেজিতেই জবাব দিল, হা, আমরা কলকাতারই বাসিন্দা। আপনি?

আমি পি কে জি কুরুপ, ঝরঝরে ইংরেজিতে বললেন ভদ্রলোক, থাকি কাসারগড়। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই কাসারগড়ের?

উত্তর কেরলে?

একদম ঠিক। এক সময় কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গে ছিলাম। তখনই আপনাদের ভাষা সামান্য শিখেছি।

 চাকরি সূত্রে গিয়েছিলেন?

আমি কারও গোলামি করি না মশাই। বাপ-ঠাকুরদার চায়ের ব্যবসা আছে, সেটাই একটু-আধটু দেখাশুনো করি আর কী। তবে আসল কাজ বনে-জঙ্গলে টোটো করে বেড়ানো। চোখ টিপলেন পি কে জি কুরুপ, ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি আমার নেশা। সেই সুবাদেই আপনাদের ড়ুয়ার্স রেঞ্জে গেছি। সুন্দরবনেও ঘুরেছি। আহা, ওই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এখনও আমার চোখে ভাসে।… আপনারা নিশ্চয়ই টুরিস্ট?

দু-পাঁচ মিনিটের মধ্যে আলাপ জমে গেল। পাৰ্থর সঙ্গে সঙ্গে রাস্তার এপারে এসে অবনী, মিতিন, সহেলির সঙ্গে পরিচয় করলেন কুরুপ। কাসারগড় থেকে একাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। পালাক্কাড় জেলার সাইলেন্ট ভ্যালিতে নাকি ছিলেন বেশ কয়েক দিন, সবে কালই এসে পৌঁছেছেন মুন্নার। এ জায়গাটা তাঁর ভালই চেনা, বার ছ-সাত এসেছেন, এবার উঠেছেন হোটল ক্রিস্টাল প্যালেসে। ইচ্ছে আছে আরও দু-একটা জঙ্গল ঘুরে ফিরবেন বাড়ি। ব্যাচেলর মানুষ, ঘরের প্রতি তেমন টানও নেই তার। ব্যবসাটাও মূলত দাদা আর ভাই সামলান, তিনি না থাকলেও কারবার ঠিকঠাকই চলে।

কথায় কথায় কুরুপ জিজ্ঞেস করলেন, তা আপনারা উঠেছেন কোথায়?

পার্থই বলল, মুন্নার ক্লাব।

আমিও একবার ওখানে ছিলাম। পজিশনটা খুব সুন্দর। গোটা উপত্যকার চমৎকার ভিউ পাওয়া যায়। কোন ঘরগুলো নিয়েছেন? উপরের? না নীচের?

নীচেই তো পেলাম।

উপরেরটা পেলে আরও উপভোগ করতেন। চারপাশে গাছপালা, নির্জন বেশ একটা জঙ্গল-জঙ্গল এফেক্ট আছে।

আমার দিদির অসুবিধে হত। মিতিন বলে উঠল, ঢাল বেয়ে ওঠানামা করা, তার উপর ভাঙা-ভাঙা পাথরের সিড়ি

আমার গিন্নির একটু ভূতের ভয়ও আছে। অবনী মন্তব্য জুড়লেন, বেশি নির্জনতা উনি পছন্দ করেন না।

নির্জনতাই তো মুন্নারের আসল সৌন্দর্য। এই নির্জনতার টানেই তো আমার বারবার মুন্নার আসা। পুরনো টাউনটা ছেড়ে ফাঁকা-ফাঁকা জায়গায় থাকি। তা আপনারা থাকছেন কদিন?

আজকের রাতটাই। কাল এদিকটা ঘুরেফিরে দেখে পেরিয়ার চলে যাব।

আমিও তো পেরিয়ার যাচ্ছি। তবে কাল খুব ভোরে বেরিয়ে পড়ব। ইদুক্কির জঙ্গল হয়ে সোজা যাব থেকাডি। বলে একটু থামলেন কুরুপ। তারপর বললেন, আজ বিকেলে বেড়ানোর জন্য আপনাদের একটা বিউটিফুল স্পট সাজেস্ট করতে পারি। কাছেই একটা চা-বাগান আছে। দুটো পাহাড়ের মধ্যিখানে লেকের চারপাশ ঘিরে চা-গাছ, দেখে মন ভরে যাবে।

সহেলি ফস করে বললেন, এখানে কোনও মন্দির-টন্দির নেই?

মুন্নার নামটাই তো হয়েছে মুন্নার দেবীর নাম থেকে। এখানে মন্দির থাকবে না? ওই তো, সামনেই। তবে ওই টেম্পল দেখে সুখ নেই। স্থাপত্য সাদামাঠা, তেমন কারুকাজও নেই, সাইজেও ছোট্ট।

তা হোক, তবু একবার মন্দির দর্শন করা উচিত।

কুন্দালে চা-বাগানে কিন্তু অবশ্যই যাবেন। কুরুপ পায়ে-পায়ে এগোলেন খানিক তফাতে রাখা সাদা মারুতির দিকে। গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বললেন, এখন আসি। কপালে থাকলে কাল আবার পেরিয়ারে দেখা হবে। পারলে মুন্নারের গির্জাগুলো দেখে নেবেন। পুরনো আমলের যা সুন্দর-সুন্দর ঝাড়লণ্ঠন আছে।

টুপুরদের হাত নেড়ে, নিজেই গাড়ি চালিয়ে সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন কুরুপ। মারুতির সাদা রং যথেষ্ট ময়লা। বোঝা যায় গাড়ি নিয়ে ভদ্ৰলোক ঘুরছেন খুব, ধোওয়া-মোছা হচ্ছে না বেশ কিছু দিন।

গাড়িটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার পর পার্থ বলল, ভদ্রলোক কিন্তু খুব ইন্টারেস্টিং। পাক্কা বোহেমিয়ান।

সহেলি বললেন, জঙ্গলে-জঙ্গলে ঘুরে মানুষ কী যে আনন্দ পায় কে জানে!

অবনী বললেন, মার্কেটিং করেও যে মানুষের কী পুলক জাগে কে জানে!

এবার কিন্তু তুমি আমায় টিজ করছ?

 টিজ কোথায় করলাম? এক-একটা মানুষের কেমন এক-একটা নেচার, তাই বলছি।

টুকটাক ঠোকাঠুকি চলছে, তার মধ্যেই ম্যাথু গাড়িতে স্টার্ট দিল। পার্থর নির্দেশ মতো চলেছে কুন্দালের পথে। পাহাড়ি রাস্তার দুধারে চা বাগান আর চা-বাগান। বাগিচার মাঝে-মাঝে রেন-ট্রি। সবুজে সবুজে ভারী আরাম হচ্ছিল চোখের।

জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে টুপুর আপ্লুত স্বরে বলে উঠল, এখানকার পাহাড়গুলো সত্যিই আমায় অবাক করেছে মিতিনমাসি। দার্জিলিং আর অসম ছাড়া ভারতের আর কোথাও যে এত চা হতে পারে, এ আমার ধারণায় ছিল না।

এ হল ব্রিটিশদের হাতযশ, বুঝলি। এই কেরলে প্রাচীনকাল থেকে বিদেশি তো কম আসেনি। চিন, মিশর, গ্রিস, রোম, ফিনিশিয়া, আসিরিয়া কোত্থেকে না এসেছে ব্যবসায়ীরা। বাষ্পযান আবিষ্কার হওয়ার পর ইউরোপিয়ানরা আসতে শুরু করল কেরলে। পর্তুগিজ, দিনেমার, ওলন্দাজ, ফরাসি … ব্রিটিশরা এল সবার শেষে। কেরলে প্রথম তারা কলোনি গড়েছিল ষোলোসো চুরাশিতে। ত্ৰিবান্দ্ৰাম, মানে যাকে এখন থিরুবনন্তপুরম বলে, তারই কাছে। আত্তিংগলের রানির দেওয়া জমিতে। পরে এসেও তারাই কিন্তু এ দেশের অধীশ্বর বনে গেল। টিপু সুলতানকে হারাল সতেরোশো বিরানব্বইতে, পেয়ে গেল মালাবার আর কোচি। আর তারপর থেকেই এখানকার মাটিকে তারা কাজে লাগাতে শুরু করল। মশলা তো কেরলে চিরকালই হত, ব্রিটিশরা আনল পাহাড়ে চাষ। কোথাও চা, কোথাও কফি, আর পাহাড় সমুদ্রের মাঝামাঝি অঞ্চলে রবার। নীলগিরি রেঞ্জ জুড়ে শুধুই দেখবি প্ল্যানটেশন আর প্ল্যানটেশন। শুধু কেরল নয়, তামিলনাড়ুরও বেশ খানিকটা আছে এর মধ্যে। এ সবই কিন্তু ব্রিটিশদের অবদান।

অবনী শুনছিলেন মন দিয়ে। বললেন, কেরলের হিস্ট্রিটাই পিকিউলিয়ার। ভারতের এখানেই প্রথম গির্জা, এখানেই প্রথম মসজিদ, এখানেই প্রথম সিনাগগ

পার্থ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, যিশুর ডাইরেক্ট শিষ্য সেন্ট টমাস নাকি কেরলে এসেছিলেন?

হুঁ। মালাবার উপকূলে। সালটা ছিল বাহান্ন এ ডি। কোচির কাছে ক্রাংগানোর বলে একটা বন্দর আছে, সেখানে।

তার মানে খ্রিস্টানরাও এ দেশে দুহাজার বছরের পুরনো?

অবশ্যই। তাই তো বলি এ দেশ হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান কারও একার নয়, সকলের।

এক পাহাড়ি বাঁকে গাড়ি থামিয়েছে ম্যাথু। বাঁয়ে কুন্দালে টি গার্ডেনের বোর্ড। দূরে, খানিক নীচে দেখা যায় এক স্নিগ্ধ শান্ত হ্রদ। নামতে নামতে হ্রদের পাড় অবধি পৌঁছে গেছে চা-বাগান। ম্যাথু মাথা দুলিয়ে বলল, ইউ গো। আই ওয়েট হিয়ার। চড়া রঙের শাড়ি জামা নিজস্ব কায়দায় পরে চা বাগানে কাজ করছে কেরলীয় মেয়েরা। টকাটক দুটো পাতা একটি কুঁড়ি ছিড়ছে গাছ থেকে, রাখছে হাতের ঝুড়িতে। টুপুরদের দেখে মিষ্টি করে হাসল তারা। হাত নাড়ছে। তরতরিয়ে হ্রদের পাড় অবধি নেমে গেল বুমবুম আর টুপুর। হ্রদের কাকচক্ষু জলে ছায়া পড়েছে মেঘের, দৃশ্যটা যে কী নয়নাভিরাম। সহেলি পর্যন্ত স্বীকার করলেন কেরলে। বেড়াতে আসা তার সার্থক হল।

পাহাড়ে অন্ধকার নামে ঝুপ করে, তাই বেশিক্ষণ আর থাকা হল না কুন্দালে। ফিরছে টয়োটা কোয়ালিস। পথে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চা খাওয়া হল একপ্রস্থ। হোটেলে যাওয়ার আগে টুকুস করে মুন্নার দেবীর মন্দিরে ঢু মেরে নিলেন সহেলি। এসবের ফাঁকেই মুন্নারে একটা সুন্দর সন্ধে নেমে গেছে। মুন্নার ক্লাবে যখন পৌঁছল টুপুররা, তখন তো রীতিমতো ঘুটঘুট করছে অন্ধকার।

গাড়ি থেকে নেমে আগে-আগে যাচ্ছিল টুপুর। কেয়ারি করা বাগানের মধ্যিখানের সরু বাঁধানো পথ ধরে। ক্লাবরুমের কাছাকাছি এসে হঠাৎই বুক ধড়াস।

সেই লোকদুটো বসে আছে চেয়ারে। ক্লাবের লম্বা টানা ছায়াছায়া বারান্দায়।

টুপুরকে দেখে তড়াং উঠে দাঁড়াল যুগলে। গুঁফো আর টাকমাথা কোরাসে বলে উঠল, নমস্তে। নমস্তে।

কী কাণ্ড, লোকদুটো এখানেই উঠেছে নাকি!

.

০৬.

সিঙ্গল চৌকিটায় মিতিন যোগব্যায়াম সারছিল। ভুজঙ্গাসন, শলভাসন, ময়ূরাসন, মৎস্যাসন করল মিনিট পনেরো, তারপর শবাসন। তারপর প্রাণায়াম। পালা করে পূরক, কুম্ভক, রেচক। কোনটা কতক্ষণ করবে জানে টুপুর। ওয়ান ইজ টু ফোর ইজ টু টু। চেয়ারে বসে টুপুর ঘড়ি দেখছিল। দশ সেকেন্ড ধরে এক নাক চেপে শ্বাস টানা, চল্লিশ সেকেন্ড দম বন্ধ, তার পর অন্য নাক দিয়ে বিশ সেকেন্ড ধরে ফুসফুস খালি করা। চেষ্টা করে দেখেছে টুপুর, ওই রেচকটা নিয়েই সমস্যা হয়। অতক্ষণ ধরে একটু-একটু করে শ্বাস ফেলা যে কী কঠিন। আবার এ নাক দিয়ে একবার টানতে হবে, তো পরের বার ও নাক দিয়ে। রীতিমতো আয়াসসাধ্য ব্যাপার। তবে মিতিনমাসি করে ভারী সহজ ভাবে। মনে হয় যেন তার কাছে এসব ছেলেখেলা। এর পর চোখ বন্ধ করে দশ মিনিট ধ্যান। মিতিনমাসি বলে এই ধ্যানটা নাকি মস্তিষ্কের জন্য খুব জরুরি। এতে নাকি মনঃসংযোগের ক্ষমতা বাড়ে।

শরীরচর্চা শেষ করে চোখ খুলল মিতিন। হাতের তালু চোখের উপর আলতো বোলাতে-বোলাতে বলল, কী রে, দিদি ভরসন্ধেবেলা ঘুমিয়ে পড়ল নাকি?

আজ্ঞে না। বড় চৌকিতে নিশ্চুপ শুয়ে থাকা সহেলি খরখর করে উঠলেন, আমি শুধু চোখ বুজে ভাবছি তোমাদের আক্কেলের কথা। তুমি এখানে হাত-পা বেঁকাচ্ছ, ওদিকে দুজন দাবা নিয়ে বসে গেছেন মাথার উপর যে খাড়া ঝুলছে, সে খেয়ালটি নেই!

কীসের খাড়া?

দরজা-জানলা সব বন্ধ, তবু গলা অস্বাভাবিক নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে সহেলি বললেন, গুন্ডাদুটো ধাওয়া করে এখানে পর্যন্ত এসে গেল এখন আমরা কী করব?

নাকে সরষের তেল দিয়ে ঘুমোও। অযথা প্যানিক কোরো না। এখনও পর্যন্ত ওরা তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে?

দিতে কতক্ষণ? মিতিন, এখনও সময় আছে, চল, অন্য হোটেলে চলে যাই।

এখন? খেপেছ? তুমি আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ো। মিতিন চৌকি থেকে নেমে গায়ে একখানা শাল জড়িয়ে নিল। দিনেরবেলা টের পাওয়া যায়নি, তবে সূর্য ডোবার পর বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে আবহাওয়া। অ্যান্টিরুমে গিয়ে সুটকেস খুলে বুমবুমের জন্য একটা হাফ সোয়েটার বার করতে করতে বলল, তুইও গায়ে একটা কিছু চাপিয়ে নে টুপুর। চোরা ঠান্ডা একবার লেগে গেলে আর রক্ষে নেই।

 টুপুরেরও একটু শীতশীত করছিল বটে। তবু বলল, ধুত, শাল তো সুটকেসের তলায়। কে এখন টেনে-টেনে বের করবে?

তোদের সুটকেসের চাবি দে। আমি বের করে দিচ্ছি।

সব জিনিসপত্র রাখা হয়েছে এক জায়গায়। এ ঘরের অ্যান্টিরুমে। টুপুর, সহেলি দুজনের জন্যই দুটো গরম চাদর বের করল মিতিন। টুপুরকে বলল, বুমবুমকে ডাক তো। সোয়েটারটা পরিয়ে দিই।

পাশের ঘরে এসে টুপুর থতমত। নিবিষ্ট মনে দাবা খেলছে দুই মহারথী, বুমবুম নেই।

ভুরু কুঁচকে টুপুর জিজ্ঞেস করল, ও মেসো, বুমবুম কোথায়?

 পার্থ বিড়বিড় করে বলল, দাঁড়া, গজটাকে ধরেছে।

অবনী গর্বিত মুখে বললেন, ওটা গেছে ভ্লাদিমির। হাতি বাঁচাতে গেলে তোমায় একটা বোড়ে স্যাক্রিাইস করতে হবে।

অত সোজা নয় গ্যারি। এবার আপনি আমার ঘোড়ার কেরামতি দেখবেন। আড়াই পা লাফিয়ে আপনার নৌকোকে অ্যাইসান চাঁট ঝাড়বে…

টুপুর ব্যাকুল স্বরে বলল, ও বাবা, ও মেসো, খেলাটা একটু থামাও না।

অবনী মুখ তুললেন, কেন?

বুমবুমকে দেখছি না যে!

এই তো ছিল। পাৰ্থ চোখ না তুলে বলল, তোদের ঘরে গেছে বোধ হয়।

না। আমি তো ওঘর থেকেই এলাম।

 তা হলে হয়তো বাথরুমে।

দৌড়ে টয়লেটে উঁকি মেরে এল টুপুর। নাহ, বুমবুম সেখানেও নেই।

ব্যস, হুলুস্থুল বেধে গেল। মিতিন দৌড়ে লনে নেমে অন্ধকারে খুঁজছে এদিক-ওদিক। পার্থ ছুটে গাড়ির কাছটা দেখে এল, অবনী ক্লাবঘর। উঁহু, ক্লাবঘর, লন, রসুইখানা, গাড়ি, বুমবুম কোথাও নেই। ম্যাথু ক্লাবরুমে বসে টিভি দেখছিল, সেও হস্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়েছে খুঁজতে। জনাচার-পাঁচ ভদ্রলোক ছিলেন ক্লাবে, তারাও শশব্যস্ত। উলটো দিকের রুমের তামিল পরিবারটিও দরজা খুলে ঘাবড়ানো মুখে উঁকিঝুঁকি মারছে।

একজন বললেন, বাচ্চা রাস্তায় বেরিয়ে যায়নি তো?

সহেলি হাউমাউ কেঁদে উঠলেন, কক্ষনো না। ওই লোকদুটোই ধরে নিয়ে গেছে। আমি জানতাম আমি জানতাম এরকম কিছু একটা ঘটবে!

কে লোক? কেয়ারটেকার প্রশ্ন করল, কাদের কথা বলছেন?

ওই যে, উপরের ঘরে উঠেছে। সারাদিন ধরে ওরা আমাদের ফলো করছে।

তাই নাকি? লোকদুটো ছেলেধরা?

কথা শেষ হতে না-হতে উপরের কটেজ থেকে দুমদুম দমাদম আওয়াজ। হুড়মুড় করে সবাই ছুটেছে উপরে। গিয়েই চক্ষুস্থির। লোকদুটোর দরজার ল্যাচ বাইরে থেকে টানা, ভিতর থেকে কে যেন ঘা মারছে জোর-জোর।

টুপুর পেঁচিয়ে উঠল, বুমবুম! নিশ্চয়ই বুমবুমকে আটকে রেখে গেছে!

পার্থ গিয়ে ঘ্যাচাং করে খুলে দিল ল্যাচ। সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত দৃশ্য। বোধ হয় দূর থেকে ছুটে এসে দরজায় একটা মরিয়া ধাক্কা মারতে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে খুলে গেছে দ্বার। গুঁফো আর টাকমাথা তীব্র গতিতে শাঁ করে বেরিয়ে এসে আছাড় খেয়ে পড়ল মাটিতে। দুটো অতিকায় মিসাইলের মতো।

কয়েক সেকেন্ডের জন্য লোকদুটো হতভম্ব। তারপর উঠে গায়ের মাটি ঝাড়তে ঝাড়তে তাদের সে কী চিৎকার। তুবড়ি ছুটছে মলয়ালমের। ক্রোধে গরগর করছে, হাত-পা ছুড়ছে …। অতি কষ্টে তাদের শান্ত করল কেয়ারটেকার। ইংরেজি তর্জমাতে জানা গেল লোকদুটো নাকি খেতে বেরিয়েছিল, ফেরার পর কে যেন তাদের ঘর বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। আর বুমবুমকে..? তারা দেখেইনি।

টুপুর নার্ভাস মুখে বলল, তা হলে বুমবুমের কী হল?

মিতিন বলল, দাঁড়া এক সেকেন্ড। দেখছি।

 বলেই ঘরটার পিছনে গিয়ে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে এল বুমবুমকে। বলল, এই যে বাবু। পিছনের জানলায় দাঁড়িয়ে এঁদের দুৰ্গতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। ল্যাচ টানাটাও এঁরই কীর্তি।

বুমবুমের ঘাড় হেঁট। পার্থ লজ্জায় লাল। মিতিন বিনীতভাবে ক্ষমা চাইল লোকদুটোর কাছে। গুঁফো আর টাকমাথা গলল না, রক্তবর্ণ চোখে নিরীক্ষণ করছে বুমবুমকে। টুপুররা নেমে আসার পরও ঘরে ঢুকল না, সম্ভবত আবার যদি ঘরবন্দি হয় এই আশঙ্কায়।

রুমের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বুমবুমের ঘেঁটি পাকড়াল মিতিন। জোর ধমক লাগাল, কেন তুমি ওরকম শয়তানি করলে? কেন?

বুমবুমের মুখ কাচুমাচু। ঢোক গিলে বলল, দুষ্ঠু লোকদুটোকে আমি শাস্তি দিচ্ছিলাম।

 কীসের শাস্তি?

বারে, ওরা যে আমাদের ভয় দেখাচ্ছিল।

 কী ভয় দেখিয়েছে?

মাথা চুলকে বুমবুম বলল, বারে, তোমরাই তো বলছিলে।

ধন্যি সাহস ছেলের! সহেলি কপাল চাপড়াচ্ছেন, হবে না? গোয়েন্দা মাকে দেখে দেখে যা শিখছে …

লোকদুটো কিন্তু বেজায় খেপেছে। অবনী বললেন, একটা বাচ্চার হাতে ওইভাবে হেনস্থা হওয়া …!

সহেলি বললেন, একা পেলে ওরা কিন্তু বুমবুমকে ছিঁড়ে খেয়ে নেবে।

টুপুর বলল, যেভাবে ওরা মুরগি ছিঁড়ে খাচ্ছিল? টুপুরের বলার ধরনে হেসে ফেলল সবাই।

ঘরের হাওয়া লঘু হতেই গুটিগুটি নৌকো গজ সাজিয়ে বসে পড়লেন অবনী। পার্থকে ডাকলেন, কী হল, এসো। তোমার গজ সামলাও।

পার্থও দুহাতে চুল খামচে চোখ গাঁথল দাবার বোর্ডে। বলল, হচ্ছে, হচ্ছে। তাড়া কীসের।

মিতিন চোখ পাকাল, অ্যাই, এক্ষুনি মজে যেয়ো না। আগে কাজের কথাগুলো শেষ করো।

বলো। কান আছে।

রাতে খাওয়াদাওয়ার কী হবে?

বন্দোবস্ত কমপ্লিট। সন্ধেবেলা ঢোকার সময়েই ক্লাবের ক্যান্টিনে বলে দিয়েছি। প্লেন চাপাটি আর চিকেন। সার্ভ করবে কাঁটায় কাঁটায় দশটায়। ঠিক আছে?

আর কাল সকালে?

এখনই সকালের চিন্তা করতে হবে? রাতটুকু কাটতে দাও।

 সকালে কিন্তু সময় পাবে না। আমরা সাতটার মধ্যে বেরোব। তখন নিশ্চয়ই এখানকার ক্যান্টিন খুলবে না?

সম্ভবত না।

তা হলে?

পথে কোথাও খেয়ে নেব।

না। পথে দাঁড়ানো মানে সময় নষ্ট। সব কিছু দেখেটেখে আমাদের কিন্তু বিকেল-বিকেল পেরিয়ার পৌঁছতে হবে। একশো দশ কিলোমিটার রাস্তা, গোটাটাই পাহাড়ি, ঘণ্টা চার-পাঁচ তো লাগবেই।

তো?

পাউরুটি-টাউরুটি এনে রাখো না। মোটামুটি তা হলে একটা হেভি ব্রেকফার্স্ট করে বেরিয়ে পড়ি।

এখন কোথায় পাউরুটি পাবে?

না পাওয়ার তো কিছু হয়নি। সবে তো আটটা বাজে।

বেরোতেই হবে? পাৰ্থর মুখ বেজার, এই বিজন বিভুঁইয়ে রাতের অন্ধকারে।

মিতিন রাগতে গিয়েও হেসে ফেলল। টুপুরকে বলল, তোর মেসো ফেভিকলে সেঁটে গেছে। চল, আমরাই যাই। তোর মা সঙ্গে গেলে গাড়ি নেব, নয়তো পায়দল।

সহেলিও নড়তে ইচ্ছুক নন। টিভি চালিয়েছেন রুমে, এখন কী একটা হিন্দি সিরিয়াল হয়, দেখবেন। অ্যাডভেঞ্চার ক্লান্ত বুমবুমও বসে পড়ল পরদার সামনে। সহেলির গা ঘেঁষে।

আকাশে চাঁদ ওঠেনি এখনও। ঝিকমিক করছে কোটি কোটি তারা। গাঢ় নীল আকাশের মতো মুন্নার শহরটাও সেজেছে আলোর শলমা চুমকিতে। দূরেও পাহাড়ে-পাহাড়ে দেখা যায় ছোট-ছোট আলোর বিন্দু।

দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে হাঁটছিল টুপুর। পাকদণ্ডী ধরে নেমে এল বড় রাস্তায়। টর্চ মিতিনমাসির হাতে। জ্বলছে, নিভছে।

নীচে প্রায় সব দোকানই খোলা। একটা বড়সড় স্টেশনারি দোকান থেকে কালকের রসদ কিনে ফেলল মিতিননা পাউরুটি, মাখন, জ্যাম, কলা, বিস্কুট, চানাচুর। এবং চিপস। ওটি না থাকলে বুমবুম মাথা খেয়ে ফেলবে।

দোকান থেকে বেরিয়েছে দুজনে, সামনে সকালের সেই সাদা মারুতি। ড্রাইভিং সিট থেকে ঘাড় এগিয়ে হাঁকছেন পি কে জি কুরুপ, গুড ইভনিং ম্যাডাম।

মিতিন, টুপুর গাড়ির কাছে গেল। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে মিতিন বলল, ভেরি গুড ইভনিং। আপনি এদিকে কোথায়?

এই একটু দানাপানির খোঁজে বেরিয়েছিলাম। কুরুপ গাড়ি থেকে নেমে এলেন, আপনারা মাত্র দুজন কেন? বাকিরা কোথায়?

রুমে। আমরা একটু সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়েছি।

বাহ। তা আসুন না, গরম-গরম কফি খাই। আপত্তি আছে?

একেবারেই না। চলুন।

দু-চার পা দূরেই ভেজিটেরিয়ান রেস্টুরেন্ট। তেমন শৌখিন নয়, তবে মোটামুটি ছিমছাম। পরিচ্ছন্ন। কফির অর্ডার দিয়ে কুরুপ বসলেন গুছিয়ে। জিজ্ঞেস করলেন, গিয়েছিলেন কুন্দালে?

মিতিনের আগে টুপুরই বলে উঠল, নিশ্চয়ই। দারুণ এনজয় করেছি।

কেরল তো উপভোগ করারই জায়গা। ফ্রম নর্থ টু সাউথ কত যে ঘোরার জায়গা!

আপনাদের নর্থ কেরলেও অনেক সুন্দর-সুন্দর জায়গা আছে?

আছে তো। আমাদের বাড়ি থেকেই মাইল দশেক দূরে বেকাল ফোর্ট। সমুদ্রের পাড়ে ওরকম দুর্গ রীতিমতো দুর্লভ। বেকাল বিচটাও দেখার মতো। তারপর ধরুন কালিকট, আই মিন কোঝিকোড়। ভাস্কো-দা-গামা যেখানে প্রথম ল্যান্ড করেছিলেন।

টুপুর বলল, ভাস্কো-দা-গামা মারা তো গিয়েছিলেন কোচিতে?

 হ্যাঁ। পনেরোশো চব্বিশ সালের পঁচিশে ডিসেম্বর। ফোর্ট কোচিতে।

কোচিতে দুর্গ আছে নাকি? আমরা তো দেখিনি!

মাট্টানচেরি আইল্যান্ডের উত্তর দিকে ছিল দুর্গটা। এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। কাঠের দুর্গ তো, কত কালই বা টেঁকে!

টুপুর আরও অবাক, কাঠের?

ইয়েস মিস। সেই দুর্গের নাম ছিল ম্যানুয়েল কোলাটি। ইংরেজিতে পোর্ট সেন্ট ম্যানুয়েল। তৈরি হয়েছিল পনেরোশো তিন সালে। বানিয়েছিলেন ভাস্কো-দা-গামার বন্ধু পর্তুগিজ অ্যাডমিরাল আলবুকার্ক। এই আলবুকাই কোচিতে পর্তুগিজ কলোনির পত্তন করেন। অবশ্য কোচির প্রথম ভাইসরয় হয়েছিলেন আলমিডা, হয়তো আলবুকাই ভাইসরয় হতেন, কিন্তু তিনি যে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। আবার আলবুকার্ক এসেছিলেন বটে, তবে তিনি আর তখন কর্তৃত্ব পাননি।

এবার মিতিনের আশ্চর্য হওয়ার পালা, আপনার তো দেখছি ইতিহাসে অগাধ ফান্ডা!

ওই একটু-আধটু পড়াশুনো করি আর কি। শখ। কুরুপ কাঁধ ঝাঁকালেন, ইতিহাস আর ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফি, এই নিয়েই তো আছি।

স্টিলের গ্লাসে কফি এসে গেছে। চুমুক দিয়ে মিতিন জিজ্ঞেস করল, ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফির নেশাটা ধরল কী করে?

সে এক গল্প ম্যাডাম। আমার বাবা ছিলেন চ্যাম্পিয়ন শিকারি। ঘুরে ঘুরে কতরকম শিকার যে তিনি করেছেন। তিন জাতের বেড়াল, চার ধরনের ভাল্লুক, সাত রকম হরিণ, আট রকম ছাগল, ভেড়া আর ষাঁড় তিনটে করে ভ্যারাইটির। হরিণের মধ্যে অ্যান্টিলোপও আছে, তার চামড়া ঝুলছে আমাদের বাড়ির দেওয়ালে। অসমে তিনি পাগলা হাতি মেরেছেন, রাজস্থানের রণথম্ভোরে কস্তুরী মৃগ। তা জঙ্গল-পাগল বাবার নেশাটা আমার রক্তেও বর্তেছে। তবে এখন তো আর বন্দুক-টক দিয়ে শিকার। করার জো নেই, তাই আমি ট্রিগারের বদলে শাটার চালাই।

নিশ্চয়ই প্রচুর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাও হয়েছে?

সে আর বলতে। একবার তো বাঘের মুখে পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। ওড়িশার সিমলিপালে একরাশ হরিণকে তাক করছি, একটা বাঘ কোত্থেকে গন্ধ শুকে-কে হাজির। জানেন তো, জীবজন্তুর ঘ্ৰাণশক্তি প্রখর হয়, আর বাঘের তো সাংঘাতিক। নেহাত কভারড জিপে ছিলাম, নইলে সেদিনই আমার ভবলীলা খতম।

মিতিন চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি একাই জঙ্গলে ছবি তুলতে ঢেকেন?

ভাড়াগাড়ি নিলে ড্রাইভার থাকে। তবে কেরলে আমি একাএকাই ঘুরি।

কফি শেষ করে গ্লাস নামালেন কুরুপ। পার্স বের করে দাম মেটালেন। বাইরে এসে মিতিন প্রশ্ন করল, কাল তা হলে আপনার ইদুক্কি যাত্ৰা?

ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে পড়ব। ওখানে এক ধরনের লঙ্গুর আছে, যদি মিলে যায় তো তাদের স্ন্যাপ নেব কয়েকটা।

পাকদণ্ডী অবধি মিতিন-টুপুরকে গাড়িতে এগিয়ে দিলেন কুরুপ। তারপর পেরিয়ারে দেখা হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে বিদায় নিলেন। সাদা মারুতি মিলিয়ে যাওয়ার পর টুপুর বলল, ভদ্রলোক একটু পিকিউলিয়ার টাইপ, তাই না মিতিনমাসি?

কেন?

অনেক কিছু জানেন বটে, তবে ভুলভালও বকেন।

যেমন?

বাঘের ঘ্রাণশক্তি মোটেই প্রখর নয়। বরং বেশ দুর্বলই। অথচ উনি বললেন…

তোড়ের মাথায় মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে হয়তে। কিম্বা ধরেই নিয়েছেন আমরা অজ্ঞ লোক… মিতিন আলগা হাসল, কস্তুরী মৃগ রাজস্থানে নয়, সিকিমে দেখা যায়। অথচ উনি এমন কনফিডেন্টলি বলছিলেন…

কুরুপকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতে করতে রুমে ফিরল মাসিবোনঝি। ঘরে দারুণ উত্তেজনা, এইমাত্ৰ পাৰ্থর ঘোড়া খেয়ে ফেলেছেন অবনী। একটি মাত্র বোড়ে খুইয়ে। নাকের পাটা ফুলছে পাৰ্থর, মুঠো পাকাছে। আর অবনী গুনগুন গান গাইছেন, হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পার করো আমারে..

টুপুর বসে পড়ল পার্থমেসোর পাশে। পাউরুটি-টাউরুটিগুলো রেখে মিতিন আবার বেরোচ্ছিল, টুপুর জিজ্ঞেস করল, চললে কোথায়?

ক্লাবের অফিসরুমে। সুনীলকে একটা ফোন করে আসি।

এত রাতে? কেন?

হোটেল থেকে ব্যাগটা আনল কি না জানতে হবে না?

আমি যাব সঙ্গে?

 থাক। তুই বসে-বসে গজকচ্ছপের লড়াই দ্যাখ!

মিতিন ফিরল মিনিট পনেরো পর। পিছন-পিছন রাতের খানা হাতে ক্লাবের কর্মচারী। রান্না অতি অখাদ্য, তবে খিদের মুখে পড়তে পেল না, দ্যাখ না দ্যাখ সব কটা প্লেট চেটেপুটে সাফ।

নৈশাহার সাঙ্গ হতেই সকলের মন শুই-শুই করছে। সকাল থেকে ঘোরাঘুরি তো কম হয়নি। ঠান্ডাটাও বাড়ছে ক্ৰমশ, ঝটপট কম্বলে সেঁধিয়ে গেলে নিদ্ৰাটাও ভালই জমবে।

.

ভোররাতে বিচিত্ৰ এক স্বপ্ন দেখছিল টুপুর। আরব সাগরের ঢেউ কেটে-কেটে পালতোলা এক বিশাল নৌকো এসে ভিড়ল নারকেল গাছে ছাওয়া ছোট্ট একটা দ্বীপে। নৌকো থেকে নামলেন ইতিহাস বইয়ে দেখা ভাস্কো-দা-গামা। জোস হ্যালেগুয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাচ্ছেন সিনাগগের দিকে। সিনাগগের সামনে থিকথিক করছে পুলিশ, ভাস্কো-দা-গামা থমকে দাঁড়ালেন। কী যেন বলছেন মিস্টার হ্যালেগুয়াকে। কোত্থেকে হঠাৎ পি ভি জর্জ চেঁচিয়ে উঠলেন, মার্ডার মার্ডার!

জর্জের চিৎকারেই টুপুরের ঘুম ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। আচমকা টের পেল কোথায় যেন একটা শব্দ হচ্ছে। কাছেই কোথাও।

অ্যান্টিরুমের দিক থেকে আসছে না আওয়াজটা? একটা সরু আলোও যেন নড়েচড়ে উঠল না?

টুপুর ধড়মড় করে উঠতে যাচ্ছিল, তখনই ফিসফিস মিতিনমাসির গলা, শব্দ করিস না। আমি দেখছি।

পা টিপে-টিপে মিতিন অ্যান্টিরুমে পৌঁছয়নি, অমনি ঝনাৎ করে কী যেন একটা পড়ার আওয়াজ! সঙ্গে ধুপ করে কারও লাফ!

মিতিন চেঁচিয়ে উঠল, যাহ, পালিয়ে গেল!

সহেলিও উঠে পড়েছেন। আলো জ্বলে টুপুরের সঙ্গে তিনিও দৌড়লেন অ্যান্টিরুমে, কী হল রে?

মিতিনের হাতে একটা লম্বা লাঠি। লাঠির ডগায় লোহার আঁকশি বাঁধা। সব মিলিয়ে লগিলগি চেহারা। লাঠিটা ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখতে দেখতে মিতিন বলল, এটা দিয়ে কেউ আমাদের জিনিসপত্র টানার চেষ্টা করছিল। ওই দ্যাখো, পার্থর লাল ব্যাগটা জানলা অবধি নিয়ে গেছে।

এ কী সৰ্বনেশে কাণ্ড! চোর এসেছিল?

তাই তো দেখা যাচ্ছে। পিছনের জানলার হুড়কোটা আগে চাড় দিয়ে খুলেছে, তারপর শিকের ফাঁক দিয়ে লাঠি গলিয়ে দিয়েছিল।

কিন্তু এইটুকু ফাঁক দিয়ে ব্যাগ সুটকেস বের করত কী করে?

শিক ভেঙে ফেলত। সহেলির গলা কাঁপছে, চোরডাকাতের অসাধ্য কিছু আছে!

গরাদ না কেটেও জিনিস হাতানো যায় দিদি। ব্যাগ জানলায় তুলে জামাকাপড় বের করে নেওয়া কী এমন কঠিন?

 টুপুর লাঠিটা হাতে নিয়েছে। খানিক নিরীক্ষণ করে বলল, শেপটা খাটের ছত্রীর মতো না?

হুঁ।

ছোট-ছোট করে কোনায় কী যেন লেখাও আছে! এন… না। না, এইচ। তারপর সি। তারপর পি। দ্যাখো তো ঠিক দেখছি?

রাখ তো এখন গবেষণা। সহেলি ঝাপটে উঠলেন, আগে তোর বাবা আর মেসোকে ডাক। এ ঘরে লুঠতরাজ হয়ে যাচ্ছে, আর বাবুরা পড়ে-পড়ে ঘুমোচ্ছেন!

ঠান্ডা-ঠান্ডা ভোরে পার্থ-অবনীকে জাগায় কার সাধ্যি। বাঙালির সুখনিদ্রা বলে কথা। টুপুর-সহেলির গলা প্রায় ফিরে গেল দুই ভায়রাভাইকে তুলতে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য চোখ রগড়াতে-রগড়াতে কম্বল ছেড়ে বেরিয়েছে তারা। সহেলির মুখে বৃত্তান্ত শুনে ঘুমের রেশটুকু উধাও।

মিতিন টর্চ হাতে চলে গেছে ঘরের পিছনটায়। জানলার নীচে একটু জঙ্গল-জঙ্গল মতো, তার পরে বেঁটে পাঁচিল। ওপারে এবড়োখেবড়ো ঢাল নেমে গেছে পাকদণ্ডী পর্যন্ত।

সকলেই গিয়ে মুখ বাড়িয়ে-বাড়িয়ে ঢালটা দেখছিল। টুপুর বলল, চোরটা এই রাস্তা দিয়ে চম্পট দিয়েছে।

সে আর বলতে। মিতিন ঝুঁকে মাটি পর্যবেক্ষণ করছিল। টর্চের আলো এপাশ-ওপাশ করতে করতে বলল, পায়ের ছাপ রয়েছে। আই মিন জুতোর। দ্যাখ টুপুর, ছাপটা বেশ স্ট্রেঞ্জ টাইপের!

তাই তো! জুতোর ডগা আছে, গোড়ালি নেই। তবে টোয়ের ছাপ কিন্তু বেশ ডিপ।

সহেলি বললেন, আমার মনে হচ্ছে ওই লোকদুটোরই কাজ। ব্যাটারা বুমবুমের হাতে টাইট খেয়েছিল তো, তাই ঝাল মেটাতে শয়তানি করছিল।

মিতিন বলল, যাহ, ও বেচারারা কেন হতে যাবে?

পার্থ সন্দিগ্ধ স্বরে বলল, হতেও তো পারে। দেখে আসব। একবার?

উত্তরের প্রতীক্ষায় না থেকে পা বাড়াল পার্থ। সঙ্গে টুপুরও।

লোকদুটোর দরজায় টর্চ ফেলে দুজনেই চমকেছে জোর। গুঁফো-টাকমাথা ঘরে নেই! তালা ঝুলছে।