৭. বাংলোর গেটের কাছে

বাংলোর গেটের কাছে হল্লা শুনে বীতশোক বারান্দায় বেরিয়ে এল। সবে স্নান করে পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করল। ম্যাথু, চৌকিদার এবং আরও কয়েকজন বাংলো-কর্মী গিয়ে ভিড় করেছে। সোমনাথ কিছু বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু নায়ার তাকে বলতে দিচ্ছে না। সুমিত ম্যাথুকে জেরা করছে। ঈশিতা চৌকিদারকে আঙুল তুলে শাসাচ্ছে। নীপা পাথরের মূর্তি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রিস্নান চঞ্চল হয়ে চক্কর দিচ্ছে এদিকে-সেদিকে। তারপর মুখ তুলে বীতশোককে দেখে সে উত্তেজিতভাবে ডাকল, “অশোকদা! তুমি এস। গুরুতর ঘটনা।”

লনে নেমে বীতশোক বিরক্ত মুখে বলল, “আবার একটা ডেডবডি পড়ে আছে নাকি?”

সোমনাথ বলল, “হ্যাঁ। ঠিক এই কথাটাই আমি বোঝাতে চাইছি। এরা বুঝবে না তো–”

নায়ার তাকে থামিয়ে দিল। “পালাক্রমে মারব। আর একটা কথা বলবে না। তুমি।”

ঈশিতা বলল, “আরিফকে ফোন করো এক্ষুনি। আমার সন্দেহ হচ্ছে, চৌকিদার সব জানে। ওর কথাবার্তা শুনেই বোঝা যাচ্ছে, ওকে দিয়ে কেউ আমাদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে।”

চৌকিদার নাথুরাম বীতশোকের পা ধরতে এল। “হামি কুছু জানে না হুজুর! কুছু সমঝাতে পারছে না।”

ম্যাথু কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে দু’হাত চিতিয়ে বলল, “ফানি থিং! হোয়াই সো মাচ ফাস অ্যাবাউট নাথিং? হোয়াটস রং?”

বীতশোক বলল, “হয়েছেটা কী?”

সুমিত গেটের বাঁদিকের থামে ঢ্যারা চিহ্নটা দেখিয়ে বলল, “দেখছ? মাইরি ঠিক এইরকম ঢ্যারা সেই হ্যাভারস্যাকটার গায়ে আঁকা ছিল। তাই না?”

বীতশোক চটে গিয়ে বলল, “তোদের মাথা সত্যিই খারাপ হয়ে গেছে। ঈশু! চলে এস। নীপা কৃষ্ণা! চলে এস তো। অকারণ সিন ক্রিয়েট করার কোনও মানে হয়? সুমিত! নায়ার! আয়। সোমনাথ একলা যত খুশি আঁতলামি চালিয়ে যাক।”

বীতশোক ম্যাথুকে চলে যেতে ইশারা করল। তারা গম্ভীরমুখে চলে গেল। ঈশিতা চাপা গলায় বলল, “কিন্তু ব্যাপারটা স্মিটিরিয়াস। তুমি পুরো ব্যাকগ্রাউন্ডটা লক্ষ্য করো। আমার ধারণা, কেউ চাইছে না আমারা এই বাংলোয় থাকি।” সে হাতের মুঠো খুলে রঙিন কাগজের কুচিগুলো দেখাল। “দেখতে পাচ্ছ? এমনি কাগজ হ্যাভারস্যাকটার ভেতর ছিল। আমরা ওখানে এগুলো কুড়িয়ে পেলুম। জঙ্গলের ভেতরে পড়ে ছিল। এবার বুঝতে পারছ, কেন মিসটিরিয়াস বলছি?”

বীতশোক কাগজগুলো দেখে বলল, “ঠিক আছে। আরিফকে জানিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু এ জন্য এত হইচই করার কোনও মানে হয় না। বাংলো সুষ্ঠু সবাইকে ডেকে জানাজানি করার দরকার কী ছিল?”

সুমিত বলল, “ঢ্যারাচিহ্নটা কিন্তু রেডসিগনালের মতো। লালরঙের ঢ্যারা।”

বীতশোক হাসল। “এখানে প্রচুর ইটের খোয়া পড়ে আছে। কেউ তাই দিয়ে দাগ টেনেছে। এটুকু তোদের মাথায় আসা উচিত ছিল।”

সোমনাথ বলল, “নায়ার! প্লিজ আমাকে বলতে দাও।”

 নায়ার বলল, “বলো, কিন্তু আমি শুনছি না। সুমিত! তুমি কি এই বুদ্ধিজীবীর অসম্বদ্ধ প্রলাপ শুনতে প্রস্তুত?”

সুমিত বলল, “নাহ্। আমার মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। মাইরি!”

 নায়ার লনে ঢুকে হাঁটতে থাকল। সুমিত তাকে অনুসরণ করল। ঈশিতা বলল, “সুমিত! শোনো! সুমিত ঘুরে দাঁড়াল। ঈশিতা দ্রুত লনে এগিয়ে গেল।

সোমনাথ শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, “তো হ্যাঁঃ! সুমিত ইজ রাইট। আ রেড সিগন্যাল। তবে এটা হল, যাকে বলে সারফেস রিয়্যালিটি। বীতশোক তুমি নিশ্চয় লক্ষ্য করেছ, হাইপাওয়ার বিদ্যুতের ক্ষেত্রে একটা বিপদসংকেত আঁকা থাকে। দুটো আড়াআড়ি হাড় এবং ওপরে একটা মাথার খুলি। এখানে খুলিটা নেই। কিন্তু হাড়ের ব্যাপারটা আছে। তা হলে সারফেস রিয়্যালিটির এ ক্ষেত্রে। আমরা পাচ্ছি দুটো ডাইমেনসন–দুটো মাত্রা। কেমন তো? এবার ইনার রিয়্যালিটিতে আসছি। দুটো হাড়কে দুটো হিউম্যানবডির প্রতীক বলে মনে করা চলে। একটা বডির ওপর আরেকটা বডি পড়ে আছে–আড়াআড়িভাবে। যদি এটা ক্রসচিহ্ন হত, ল্যাংগুয়েজ একেবারে বদলে যেত। নাও রিড দা ল্যাংগুয়েজ। দুটি বডি। হাঃ। হিউম্যান বডি। ডেডবডি। রক্তাক্ত মৃতদেহ। লালরঙ সেটাই বলছে। একটা অলরেডি আমরা দেখেছি। সম্ভবত আবার একটা। দেখতে পাব। তারই সারফেস রিয়্যালিটি হল রেডসিগন্যাল। তো–ডাজ ইট সিগনিফাই এনিথিং? হ্যাঁ। একটা মার্ডার হয়ে গেছে, আরেকটা সম্ভবত হবে। একটা অতীত ঘটনা, অন্যটা অন্যটা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঘটনা। রেখাদুটো যেখানে পরস্পরকে ক্রস করেছে, সেটাই বর্তমান। তার মানে, আমরা এই সিং পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আছি এ মুহূর্তে। অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যবিন্দুতে। বার আমি একটা সিগারেট খাব।”

সে সিগারেট ধরাল। বীতশোক বলল, “আর কিছু বলবি?”

“সোক্রাতেসের কথাটা ঘুরিয়ে বলতে চাই : I do not know that I know.’ সোমনাথ ঢ্যারাচিহ্নটার দিকে তাকাল। “আমি কি কিছু সত্যিই জানি? দ্যাটস দা পয়েন্ট, বুঝলি বীতশোক? আমি খুঁজছি।”

“খোঁজ তুই।” বীতশোক ঘুরে পা বাড়াল। “নীপা! কৃষ্ণা! একটায় গাড়ি আসবে। চলে এস।”

ক্রিস্নান ঘড়ি দেখে বলল, “নীপা! চলো। আমি ক্লান্ত।”

নীপা বলল, “তুমি চলো। আমি এই আঁতেলের সঙ্গে একটু বোঝাপড়া করে নিই।”

বীতশোক ও ক্রিস্নান চলে যাওয়ার পর নীপা আস্তে বলল, “আমি বুঝতে পারছি না, কাল রাত্তির থেকে তোমার ম্যানারিজম এত বেশি বেড়ে গেল কেন? কেন তুমি এত বাড়াবাড়ি করছ?”

“ম্যানারিজম?” সোমনাথ বলল। “নীপু, তুমি বুঝতে পারছ না আমি না জেনে একটা ফাঁদে পা দিয়েছিলুম।”

নীপা বিরক্ত হয়ে বলল, “তোমার মাথায় একটা কিছু ঢুকে গেলে তুমি তা-ই নিয়ে বড্ড বেশি হুলস্থূল বাধাও! আবার কেউ খুন হবে বললে অশোকদাকে। যদি সত্যিই তেমন কিছু ঘটে, তুমিই ফেঁসে যাবে বুঝতে পারছ না? তুমি কেন ওকথা বললে ওর সামনে? তুমি কী করে জানলে আবার কেউ খুন হবে?”

সোমনাথ নীচের দিকে বুকের ওপর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “এ একটা সম্ভাবনা। কেউ সাংকেতিক ভাষায় কিছু বলতে চাইছে এবং হ্যাঁ–আমি তা সম্ভবত বুঝতে পেরেছি। এই কাগজটা তুমি খুঁটিয়ে দেখ। চিন্তা করো। নাও!”

নীপা ওর কাগজ ধরা হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। “তোমার এইসব উদ্ভট ব্যাপার নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে। কেন তুমি–”।

তাকে থামিয়ে দিয়ে সোমনাথ একটু হাসল। “নাহ্। আমার ধারণা নিয়ে আর ওরা হাসাহাসি করবে না। ওরা বুঝে গেছে–হ্যাঁ, যে-যার মতো করেই বুঝেছে, আমি একটা ভাইটাল এবং সেন্সিটিভ পয়েন্ট টাচ্ করেছি। খুব স্পর্শকাতর জায়গায় আমি আঙুল রেখেছি। এই ঢ্যারা। লুক! এবার কী দাঁড়াচ্ছে, দেখ।”

বলে একটুকরো ইটের খোয়া কুড়িয়ে নিল সে। ঢ্যারাচিহ্নটার ওপর একটা মড়ার খুলি এঁকে দিল। তারপর পিছিয়ে এসে বলল, “ওই খুলিটা থাকার কথা ছিল। অথচ আমরা ওটা দেখিনি। কাল সন্ধ্যায় ইভনিং ভিলার হলঘরে ফায়ারপ্লেসের মাথায় একটা স্টাফড় ব্ল্যাক প্যম্বারের পায়ের ফাঁকে নীপু, তুমি আমরা প্রত্যেকটি শব্দের ডাইমেনসান লক্ষ্য করো–হ্যাঁ, একটা রদ্দি হ্যাভারস্যাক এবং তার গায়ে এমনি ঢ্যারা ছিল। সেই ঢ্যরাচিহ্নটা তোমরা সবাই দেখেছ। তার ওপরও ওইরকম খুলি থাকার কথা। কিন্তু ছিল না। কেন ছিল না? বলো–কেন?”

নীপা ঝাঁঝালো স্বরে বলল, “আমি জানি না। তুমি আমার কথা শুনবে কি না বলো?”

“শুনব।” সোমনাথ সিগারেটটা মুঠোয় ধরে টান দিল। “তো হা। যে ঢ্যারাচিহ্ন এঁকেছিল, সে ওপরে খুলি আঁকার সময় পায়নি। সেই মুহূর্তেই কি আমরা গিয়ে পড়েছিলুম? মে বি। আবার এক্ষেত্রেও তা-ই। সে সময় পায়নি। নীপু! আমরা যদি আমাদের ‘লিটল গ্রে সেলস’ এর ওপর একটু নির্ভর করি, আমরাও এরকুল পোয়ারো হতে পারি। জাস্ট আ মিনিট। একটু ধৈর্য ধরে আমার পয়েন্টটা শোনো। সাধারণত ঢ্যারাচিহ্ন কিসের প্রতীক? কিছু নাকচ করা, কিছু ভুল বলে সাব্যস্ত করা। জাস্ট আ নেগেটিভ সাইন। কেমন তো? কিন্তু সেই কমন ঢ্যারাচিহ্ন বেশ কিছুটা লম্বালম্বি থাকে। ঠিক এইরকম।” সে কাগজটার উল্টোপিঠে ক্রিস্নানের কলমটা দিয়ে ঢ্যারা এঁকে নীপাকে দেখাল।

“নীপু! দেখতে পাচ্ছ? গেটে আঁকা ঢ্যারাচিহ্ন এবং হ্যাভারস্যাকের ঢ্যারাচিহ্ন হল এই দু নম্বর সাইন।” সোমনাথ সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ফেলে দিল। “এই এক নম্বর সাইনটা কিন্তু কমন। তুমি টিচার। তুমি ভাল বুঝবে ছাত্রীরা ভুল লিখলে তুমি এক নম্বরি কমন সাইনটাই ব্যবহার করো।”

নায়ারের গম্ভীর গলার ডাক ভেসে এল, “এই বুদ্ধিজীবী! আমরা খেতে যাচ্ছি।”

সোমনাথ গ্রাহ্য করল না। বলল, “দু নম্বর সাইনের স্ট্রাকচার হাইপাওয়ার বিদ্যুতের কিংবা বিষাক্ত কোনও জিনিসের ক্ষেত্রে দেখা যায়–হ্যাঁ! ওপরে একটা খুলিসহ। তা না হলে এমন দুটো রেখা একটা পারফেক্ট ল্যাংগুয়েজ হয়ে উঠতে পারে না। তো এবার ভেবে দেখ, কেন আমি এ নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করছি। নীপু, আমি কি কারও টার্গেট হয়ে পড়েছি? আমি কি নিজের অজ্ঞাতসারে এমন কিছু জানি, যা তাকে বিপদে ফেলতে পারে? আরও স্পষ্ট করা যেতে পারে এই পয়েন্টটা। আমার সিগারেট প্যাকেট ফেলে-আসার সুযোগ নিয়েই কি একটা লোককে মারা হল?”

নীপা শ্বাসপ্রশ্বাসে জড়িয়ে ‘অশোকদা’ বলেই থেমে গেল।

সোমনাথ দ্রুত বলল, “নাহ্। বীতশোকের প্রশ্নই ওঠে না। সে আমার পুরনো বন্ধু। ধরা যাক, তার কোনও গোপন তথ্য আমি জানি, যা তার পক্ষে বিপজ্জনক। কিন্তু সে-জন্য সে হাথিয়াগড়ে আমাকে এনে–নাহ্। আরিফ ইজ হিয়ার। তা ছাড়া বীতশোকই আরিফকে ফোনে জানাল, আমরা এসে গেছি। তুমি চলে এস। হা! আরিফ না থাকলে এ পয়েন্টটা ভাবা চলত।”

নীপা পা বাড়িয়ে বলল, “আমি বলিনি! সব তাতেই তোমার বাড়াবাড়ি করা চাই-ই।”

সোমনাথ তাকে অনুসরণ করে বলল, “তুমি কী বলতে যাচ্ছিলে বলো। আমার জানা দরকার।”

নীপা খুব আস্তে বলল, “গতরাতে অশোকদা বলছিল একটা মরা বেড়াল নিয়ে সোমনাথ মাথা ঘামাচ্ছে কেন?”

সোমনাথ হাসল। “তাহলে আ কোট প্রম বোদলেয়ার : A fine strong gentle cat is prowling/As in his bedroom, in my brain. GOT THEY নীপু? আমার প্রব্লেম হল, এই বোদলেয়ারের বেড়ালই মগজ থেকে বেরিয়ে জীবনানন্দের বেড়াল হয়ে ওঠে। আবার জীবনানন্দের বেড়াল, মগজে ঢুকলে বোদলেয়ারের বেড়াল হয়ে পড়ে। হা! বোধ। বোধের চলাফেরা। মাই গুডনেস!” সোমনাথ থমকে দাঁড়িয়ে চুল খামচে ধরল।

নীপা ঘুরে দাঁড়িয়ে ভুরু কুঁচকে তাকাল।

সোমনাথ বলল, “ইভনিং ভিলায় আমরা কোনও কুকুর দেখিনি। কুকুর থাকলে সে চাঁচাবেই। আমার কি কুকুরের চাঁচানি শুনেছি? নাহ্। তুমি শুনেছ?”

“নাহ্।”

 “এ-ও একটা পয়েন্ট।” সোমনাথ পা বাড়াল। “আসলে বেড়াল শব্দের অনুষঙ্গে কুকুর এসে পড়েছে। কুকুর-বেড়াল। দা কমন টার্ম। কিন্তু কেন ইভনিং ভিলায় কুকুর নেই? থাকা অবশ্যই উচিত ছিল। ওইসব ফ্যামিলিতে কুকুর তো অ্যারিস্টোক্রেসির প্রতীক। কিন্তু কোন কুকুর নেই।”

“ভেতরে কোথাও থাকতে পারে। অত বড় বাড়ি।”

“নীপু! ভারতীয় এরকুল পোয়ারো বলছেন, বাইরের লোকের কাছে কুকুর শো করা এদেশি অ্যারিস্টোক্রেসির কমন লক্ষণ। বিশেষ করে মিঃ বোসের মতো দাম্ভিক হামবড়াই লোককে একটা কুকুর ছাড়া মানায় না। হলঘরের সিঁড়ি দিয়ে যখন লোকটা নামছিল, আমি সিওর ছিলুম, তার পেছনে কুকুরও নামছে। একটু পরে মাদাম বোস নামলেন। তখনও আশা করেছিলুম–এই তো বীতশোক!”

বীতশোক তাদের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “খুঁজে পেলি?”

“বলছি।” সোমনাথ বারান্দায় উঠে বলল, “হ্যাঁ রে! ইভনিং ভিলায় কুকুর পোষে না?”

“কেন?”

 “জানতে ইচ্ছে করছে। কাল আমরা কোনও কুকুরের চ্যাঁচানিও শুনিনি।”

“এক বার চুপিচুপি গিয়ে ঢুকে দেখে আয় না!”

 “আছে?”

“একটা অ্যালসেশিয়ান, একটা ডোবারম্যান পিঞ্চার, একটা টেরিয়ার আর একটা বুলডগ। সন্ধ্যা থেকে ভোর অব্দি ছাড়া থাকে।”

“কিন্তু কাল সন্ধ্যায় ছিল না।”

 “কাল, সন্ধ্যায় আমরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে গেলুম। তাই বেঁধে রেখেছিল।”

 “চ্যাঁচাবে তো! আমরা আউটসাইডার!”

বীতশোক হাসল। “ইভনিং ভিলার কুকুর চাঁচায় না। নিঃশব্দে গলায় কামড় বসায়।”

সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, “এ তুই ঠিক বলছিস না। আইম নট জোকিং –হ্যাঁ! একটা উন্ডেড লোক দিব্যি ঢুকে গেল আমরা চলে আসার পর। হলঘরে গিয়ে মারা পড়ল সে! বিনা প্রতিরোধে!”

বীতশোক হঠাৎ একটু চটে গেল। “তুই ওই দাড়িওয়ালা টিকটিকি ভদ্রলোকের অ্যাসিস্টান্ট হয়ে যা, সোমনাথ! আমার ধারণা, ভদ্রলোকের একজন অ্যাসিস্টান্ট দরকার।”

– “এটা একটা ইমপর্টান্ট প্রশ্ন বীতশোক!”

বীতশোক বিরক্ত হয়ে বলল, “গণেশ অন্য কী কাজে ব্যস্ত ছিল। তাই দরজা আর গেট বন্ধ করতে দেরি হয়েছিল।” বীতশোক আবার হালকা মেজাজে ফিরে এল। “কুকুরগুলো থাকে পেছনের দিকে। ডগহাউসের দরজা খুলতেও দেরি। করেছিল গণেশ। ইতিমধ্যে মালতী হলঘরে কাপ-প্লেট নিতে এসে দেখে দরজা। খোলা। অথচ ঘর অন্ধকার। সে আলো জ্বেলে ডেডবডিটা দেখতে পায়। ক্লিয়ার?”

“এক মিনিট বীতশোক!”

“তুই একটা বদ্ধ পাগল। কেন এসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস?”

 “আমি বলতে চাইছি, গণেশের দেরি করাটা ইচ্ছাকৃত কি না?”

বীতশোক বলল, “স্নান-টান করবি তো করে নিয়ে খেয়েদেয়ে রেডি হ। একটা গাড়ি আসবে। বারোটা পনের বাজে। আমি সাড়ে বারোটায় বেরুব। তোদের সঙ্গ দিতে পারছি না বলে দুঃখিত।”

সে ব্যস্তভাবে করিডরে ঢুকে গেল। নীপা তার ঘরে চলে গেছে। সোমনাথ সোজা ডাইনিংয়ে ঢুকল। সুমিত ও নায়ার খাচ্ছিল। সোমনাথকে দেখে দুজনেই চোখে-চোখে হাসল। সোমনাথ তাদের টেবিলে বসে বলল, “খিদে পেয়েছে। কী কী আইটেম রে?”

নায়ার বলল, “এ সব তোকে দেওয়া হবে না। কারণ তুই বুদ্ধিজীবী। আমরা জানিয়ে দিয়েছি ম্যাথুকে। তোর জন্য কচুসেদ্ধ হচ্ছে। একটু ডাল পেতেও পারিস।”

সুমিত বলল, “এ কী মাইরি! স্নান না করিস, হাত-ফাত ধুয়ে আয়।” সে ফিসফিস করল, “ওয়েস্টার্ন মেয়েছেলের কাগজ-কলম ঘেঁটেছে! এডস হবে কিন্তু।”

নায়ার ফিক করে হাসল।

ঈশিতা স্নান করেছে। কাছে এসে বললু, “কৃষ্ণাকে জোর করে বাথরুমে ঢুকিয়ে শাওয়ার খুলে দিয়ে এলুম। ডেনিশ ভাষায় আমার মুণ্ডুপাত করছে। নীপুকে বললুম, আমার বাথে চলো। মড়াকান্না জুড়ে দিল। কী মেয়ে! স্নান না করে থাকে কী করে? সামারে তো আমি দুবেলা তিনঘণ্টা করে বাথটাবে পড়ে থাকি।”

নায়ার বলল, “এই বুদ্ধিজীবী স্নান করবে না।”

 “সে কী সোমনাথ!” ঈশিতা বলল। “স্নান করবে না কেন?”

সোমনাথ বলল, “আমি সপ্তাহে একদিন স্নান করি। তা-ও কয়েক পেগ ড্রিংক করে নিয়ে। তুমি কি জানো ড্রাংক অবস্থায় মানুষের চামড়া গণ্ডারের চামড়া হয়ে যায়?”

ঈশিতা বলল, “সেজন্যই তোমার ইনসমনিয়া। তোমাকে ঘুমের ওষুধ খেতে হয়। ভেরি ব্যাড সোমনাথ! তুমি রেগুলার স্নান করো। দেখবে চমৎকার ঘুম হচ্ছে।”

একজন বয় এসে বলল, “আপকি খানা ইহা দেঙ্গে মেমসাব?”

“না। ওই টেবিলে দেবে। একটু পরে। ওরা দুজন আসুক। তিনজন একসঙ্গে খাব।”

সুমিত বলল, “মাইরি! মেয়েরা সত্যিই সাম্প্রদায়িক।”

সোমনাথ বলল, “এই যে ভাই! আমারটা এখানে দিয়ে যাও।”

ঈশিতা বলল, “আমরা যে সাম্প্রদায়িক নই, তার প্রমাণ দিতে সোমনাথকে আমাদের টেবিলে বসাব। ওঠ সোমনাথ!”

সুমিত বলল, “ও হাত-ফাত না ধুয়ে খাবে কিন্তু! ওকে বেসিনে ধুয়ে আনো ঈশু। কাল রাত্তিরে নেহাত রক্তের ভয়ে হাত ধুয়েছিল। আমার বিশ্বাস, ব্রেকফাস্টের সময় ও হাত ধোয়নি। তাছাড়া এখন ওর হাতে এডসের ভাইরাস আছে।”

“ধুর ব্যাটা।” নায়ার তাকে থামিয়ে বলল, “তখন না হয় কাঁটাচামচে খেয়েছিস। এখনও কি তাই খাবি নাকি? কী রে!”

“হ্যাঁ! এখনও কাঁটাচামচেই খাব।” সোমনাথ বলল। “তবে আমার আর নড়তে ইচ্ছে করছে না। ঈশু! প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। ও ভাই! জলদি খানা লাও। হাম ভুখিপিঢ়ি হ্যায়।”

 “অ্যাঃ!” নায়ার বিস্ময়সূচক শব্দটা করল। “তুই জানিস ভুখিপিঢ়ি’ বলতে কী বোঝায়। বাংলা সাহিত্যে তোদের যেমন হাংরি জেনারেশন’ ছিল, হিন্দিতে তেমনি–আঁ! বলে কী, হাম ভুখিপিঢ়ি হ্যায়! কী রে!”

ঈশিতা হাসল। “নায়ার, তুমিও কম আঁতেল নও! মাইরি!”

সুমিত বলল, “ভেংচি কাটা হচ্ছে? ওক্কে! আজ পাতালেশ্বরীর মন্দিরে বডি ফেলে দেব।”

“কে কার বডি ফেলে দেয় দেখা যাবে।” বলে ঈশিতা পাশের টেবিলে গেল। ক্রিস্নান ও নীপা এসে গেছে। সোমনাথের টেবিলে খাদ্য এল। সে চামচে খাওয়া শুরু করল। সুমিত ও নায়ারের খাওয়া শেষ। ওরা বেসিনে হাত ধুয়ে লবিতে ঢুকল।

ক্রিস্নান বলল, “সোমনাথ! তুমি একা কেন? এখানে এস।”

ঈশিতা বলল, “ওকে আমরা ত্যাগ করেছি।”

 “কেন?”

 ঈশিতা বলল, “সোমনাথ একজন নোংরা দ্বিপদপ্রাণী। সে স্নান করে না।”

 সোমনাথ বলল, “কৃষ্ণা! তোমার কলম আমার কাছে।”

 ক্রিস্নান হাসল। “তোমাকে উপহার দিলাম। কিন্তু তুমি এখানে এস।”

“ধন্যবাদ। আচ্ছা কৃষ্ণা, গতকাল সন্ধ্যয় আমরা যখন ইভনিং ভিলায় ছিলুম, তখন কী কী অস্বাভাবিক ব্যাপার তোমার চোখে পড়েছিল?”

নীপা বলল, “উত্তর দেবে না কৃষ্ণা। সোমনাথের মাথা খারাপ হয়ে গেছে।”

 ক্রিস্নান একটু হাসল। “না। এসব কথা আমিও চিন্তা করেছি। তাই বলা উচিত। প্রথম, আমাদের গাড়ি বাড়ির মধ্যে গেল না। রাস্তায় ক্ষুদ্র পাথর। কিন্তু হাঁটারও অনুপযুক্ত। দ্বিতীয়, প্রহরী ছিল না। তৃতীয়, যথেষ্ট আলো ছিল না। ভাবলাম, বনের মধ্যে একটা বাড়িতে যাচ্ছি। অশোকদা ডাকল। তখন একটা লোক দেখলাম। চতুর্থ, সেই অন্ধ ভদ্রলোক। প্রাঙ্গণ? প্রাঙ্গণের বনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ভাবলাম, প্রস্তর মূর্তি। এই ঘটনা বেশি অস্বাভাবিক।”

সোমনাথ বলল, “আর কিছু?”

খাদ্য এল টেবিলে। ক্রিস্নান খাদ্যের দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল, “আর কিছু চিন্তা করিনি।”

ঈশিতা চোখে হেসে বলল, “আমাকে জিজ্ঞেস করো!”

 “বলো।” বলে সোমনাথ স্যালাডের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

“মিসেস বোস তোমার যেন কত পরিচিত মনে হচ্ছিল। নীপু, তুমি বলো! অদ্ভুত লাগেনি?”

নীপা কিছু বলল না। সোমনাথ বলল, “এটা কেন অদ্ভুত মনে হল তোমার?”

ঈশিতা বলল, “একজন জাঁদরেল কোটিপতি লোকের তরুণী স্ত্রী। নীপুর চেয়েও বয়সে ছোট। আর তুমি এক চালচুলোহীন বাউণ্ডুলে। হ্যাঁ, বাংলা ইংরেজি দুটোতেই তোমার কী বলব, কিছু পিকিউল্যারিটি আছে। তোমার ওই থেমে-থেমে একটা করে শব্দ উচ্চারণ এবং শেষ শব্দটায় জার্ক। এ সবই অ্যাট্রাকটিভ। কিন্তু সিসেস বোস তো আঁতেল মহিলা নন যে আঁতেলের মর্ম বুঝবেন।”

“তো আমাকে তুমি হ্যাটা করছ!”

“ইশ! কী অভিমান রে!” ঈশিতা চোখ টিপে বলল, “সত্যি বলো না সোমনাথ! এটাই কিন্তু রিয়্যাল মিস্ট্রি।”

“হ্যাঁ! ব্যাখ্যা চাও তো দিতে পারি। চাও কি?”

 “অবশ্যই চাই।”

সোমনাথ মিনিট দু-তিন চুপচাপ খাওয়ার পর একটু জল গিলল। তারপর বলল, “সুমিত দেখেছি একমাত্র তোমার কাছেই স্মার্ট। অন্য মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে নার্ভাস হয়ে পড়ে। তা ছাড়া সে বরাবর ভিতুটাইপ। নায়ার তো মিঃ বোসের সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে বাক্তাল্লা চালিয়ে গেল। কৃষ্ণা ছবি তুলতে ব্যস্ত। এদিকে আরিফ পুলিশ অফিসার। কৃষ্ণা! ভুল বললে ক্ষমা কোরো। হ্যাঁ। কৃষ্ণা আরিফের সঙ্গে ভাব জমাতে চাইছিল। সে বিদেশি মেয়ে। তার পেপারে নাকি গণ্ডগোল আছে–তো নীপু। নীপু তত মিশুক নয়, আমরা জানি। তাছাড়া নীপুর পক্ষে এ ধরনের পরিবেশ পছন্দসই নয়। এটা আমার ধারণা।” সোমনাথ শ্বাস ছেড়ে বলল, “তো হ্যাঁ। দেখলুম ভদ্রমহিলার ‘ইমেজ’ কথা বলতে চায়। কিন্তু কাকেও পাচ্ছে না। বলা চলে নির্বাক ফুলের গাছ। কোথায় যেন পড়েছি, তার মনই তার শরীর। আর হ্যাঁ! ওই সৌন্দর্য! বোদলেয়ারের অসাধারণ সেই লাইনটা মাথায় এসে গেল। “Angel of gaiety have you tasted grief? আমার জানতে ইচ্ছে হল। মাই গুডনেস! সঙ্গে সঙ্গে সাড় এল।”

ঈশিতা বাঁহাতে ভিজে চুল সরিয়ে বলল, “ওই ‘টেস্টেড গ্রিফ’ ব্যাপারটা?”

“ঈশু, সৌন্দর্য আর বিষাদের এই কেমিক্যাল কম্পাউন্ড আমি কখনও দেখিনি।”।

বীতশোক এল। ঘরের চাবি ঈশিতার টেবিলে রেখে বলল, “গেলুম। গাড়ি এস যাবে এখনই। তোমরা ঘুরে এস। ঠিক সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় ইভনিং ভিলায় পৌঁছানো চাই।”

ঈশিতা বলল, “আমি কিন্তু ড্রাইভ করব না। রাস্তাও চিনি না।”

বীতশোক হাসল। “বলা হয় বটে অটোমোবিল। কিন্তু ড্রাইভার ছাড়া গাড়ি নিজে থেকে গড়িয়ে আসবে না। ড্রাইভার থাকবে।”

বীতশোক চলে গেল। তার হাতে ব্রিফকেস এবং পরনে ডিনারস্যুট। সোমনাথ খাওয়া শেষ করে উঠল। বলল, “শোনো ঈশু! আমি কিন্তু তোমাদের সঙ্গে যচ্ছি না। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। তবে হাঃ। ঠিক সাড়ে ছটায় ইভনিং ভিলায় আমাকে দেখতে পাবে।”

ক্রিন বলল, “তুমি কোথায় যাবে?”

সোমনাথ হাসল। “সেটা গোপনীয়। বলা যাবে না।”