১১. ঈশিতা ও নীপা

ঈশিতা ও নীপা গাড়ির কাছে উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছিল। সুমিত ও নায়ার ড্রাইভার মোতি সিংকে সঙ্গে নিয়ে ক্রিস্নানের খোঁজে বেরিয়েছিল। মোতি সিং স্থানীয় লোক। এলাকার নাড়িনক্ষত্র চেনে। হাথিয়াফলসের ডান কাঁধের ওপর টিলা পেরিয়ে গেলে নদীর উজানে একটা আদিবাসী বসতি আছে। সেখানে ছবি তুলতে গিয়ে কোনও বিপদে পড়েনি তো ক্রিস্নান?

প্রায় সাড়ে চারটে বাজে। সূর্য ওপারের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে নেমেছে। এখানে ঘন গাছপালার ভেতর ছায়া গাঢ়তর। এলোমেলো বাতাসে অদ্ভুত সব শব্দ।

নীপা এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিল। ঈশিতা বলল, “নীপু! গাড়িতে উঠে বসো বরং। ওরা আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে যদি না ফেরে, আমি গাড়ি ড্রাইভ করে বাংলোয় ফিরব। দিস ইজ টু মাচ! আমার নার্ভের বারোটা বেজে গেছে।”

বলে সে স্টিয়ারিংয়ের সামনে বসল। নীপা সামনের সিটে তার বাঁদিকে বসে বলল, “সত্যি আমার কেমন একটা আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে।”

ঈশিতা একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, “আমারও হচ্ছিল। আসলে নির্জন বনজঙ্গলে এমনটা হয়। তবে তোমার ভয় পাওয়ার কারণ নেই। ভূত-প্রেত হোক, মানুষ হোক, বদমাইসি করতে এলে তার বুকের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেব।”

নীপা আস্তে বলল, “ক্রিস্নানের ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি না!”

 “তখন থেকে লক্ষ্য করছি তুমি ওকে কৃষ্ণা বলছ না!”

নীপা গম্ভীরমুখে বলল, “ক্রিস্নান যেন হঠাৎ আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। তুমি ভেবে দেখ ঈশিতাদি, আমি ওর কতটুকু জানি?”

ঈশিতা একটু চুপ করে থাকার পর মুখে দুষ্টুমির ছাপ ফুটিয়ে বলল, “নীপু! কৃষ্ণা আমাদের আঁতেলটির সঙ্গে কোনও ইমোশনাল অ্যাফেয়ারে জড়িয়ে পড়েনি তো? কেন এ কথা মাথায় এল, শোনো। কাল রাত্তিরে কৃষ্ণা চুপিচুপি বেরিয়েছিল বলে তোমার সন্দেহ হয়েছে। তারপর দেখ, সোমনাথ আমাদের সঙ্গ ছেড়ে কোথায় কেটে পড়ল। এদিকে কৃষ্ণাও কাট করল। দেয়ার মে বি আ এঁদেভু, যেখানে ওরা প্রেম-ট্রেম করছে।”

নীপা চুপ করে থাকল।

 “কী? আমার থিওরি উইক মনে হচ্ছে? বলো! ও নীপু! কথা বলো!”

 আমি বিশ্বাস করি না।”

 “এক্সপ্লেন ইট নীপু!”

 “প্লিজ ঈশিতাদি! আমার মাথা ধরেছে।”

 ঈশিতা একটু হাসল। “যা বাবা! কথা বলে সময় কাটাতে হবে তো?”

কাছাকাছি কোথাও টার্জানের ডাক শোনা গেল। ঈশিতা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। বলল, “রেসকিউ পার্টি ফিরে আসছে। কিন্তু কৃষ্ণাকে তো দেখছি না। এ কী বিপদে পড়া গেল দেখ তো!”

নীপাও নামল। দেখল, জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পায়ে-চলা রাস্তায় ওরা ফিরে আসছে। কৃষ্ণা নেই। নায়ার আগে। তার পেছনে সুমিত। তার পেছনে ড্রাইভার মোতি সিং। নায়ার এসে বলল, “রহস্যজনক অন্তর্ধান!”

সুমিত বলল, “বাঘে তুলে নিয়ে যেতেও পারে। মাইরি ওদিকটায় যা জঙ্গল!”

 ঈশিতা বলল, “বস্তির লোকেরা কী বলল?”

জবাবটা মোতি সিং দিল। “উওলোগ বোলা কি এক মেমসাব ইয়ে নাদিয়াকি কিনার-বরাবর সিধা যাতি থি।”।

নায়ার খাপ্পা হয়ে বলল “নরক্কাতিল পোট্টে! চলো, আমরা সেই ভূগর্ভস্থ মন্দির পর্যটনে যাই।”

ঈশিতা ঘড়ি দেখল।

মোতি সিং বলল, “আভি বহত দের হো গেয়া সাব! আন্ধেরামৈ বহ মুশকিল হোগা।”

নীপা বলল, “আমাদের এখনই বাংলোয় ফেরা উচিত। ক্রিস্নান যদি বাংলোয় না ফিরে থাকে, আরিফদাকে খবর দিতে হবে।”

ঈশিতা শ্বাস ছেড়ে বলল, “অদ্ভুত মেয়ে তো! ঠিক আছে। বাংলোয় ফেরা যাক। পাতালেশ্বরীর মন্দিরে গেলে ইভনিং ভিলার পার্টিতে যাওয়া সম্ভব হবে না। ফিরতে আটটা বেজে যাবে।”

মোতি সিং সায় দিয়ে বলল, “জি মেমসাব! রাস্তাভি বহত খারাব হ্যায়।”

গাড়ি আগের রাস্তায় চলতে থাকল। সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ আর গম্ভীর। পেছনের সিটে এবার নীপা ও ঈশিতার পাশে সুমিত বসেছে। নায়ার সামনে। চড়াই থেকে গাড়ি সমতলে পৌঁছুনোর পর নায়ার পেছনে ঘুরে বলল, “আমার ধারণা, কৃষ্ণার রহস্যজনক অন্তর্ধানের সঙ্গে পান্না নামক সবুজ রত্নের সম্পর্ক আছে।”

সুমিত বিরক্ত হয়ে বলল, “থাম্ ব্যাটা! খালি দাঁতভাঙা কথাবার্তা!”

 নীপা বলল, “নায়ারদা যা বলছে, আমিও তা-ই ভাবছি কিন্তু!”

সুমিত একটু হাসল। “আমার থিওরি অন্যরকম। নীপা যদি রাগ না করে তো, বলতে পারি।”

“রাগ করার কী আছে?” নীপা আস্তে বলল।

 “ব্যাপারটা সিরিয়াস।”

সুমিত ফিসফিস করে বলল, “সোমনাথটা মাইনাস হয়ে গেছে। তারপর কৃষ্ণাও মাইনাস হয়ে গেল। মাইনাসে মাইনাসে প্লাস।” বলেই সে অভ্যাসমতো হাসি মেশানো শব্দটি আওড়াল, “মাইরি!”

“মাইরি!” ঈশিতা তার ঊরুতে একটা থাপ্পড় মারল। “ঠিক এই কথাটাই আমি নীপুকে বোঝাতে চাইছিলুম। ও কনভিন্সড় হল না।”

নীপার গাম্ভীর্য অটল রইল। সে বলল, “এটা রসিকতার ব্যাপার নয়। ঈশিতাদিকে আমি বলেছি। এবার তোমাদেরও বলছি। গত রাত্তিরে ক্রিস্নান চুপিচুপি বাইরে বেরিয়েছিল।”

সুমিত কিছু বলতে যাচ্ছিল। নায়ার তাকে থামিয়ে বলল, “হ্যাঁ। আমি রাত্তিরে কিছু রহস্যজনক শব্দ শুনেছি। তার ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। আমার সিদ্ধান্ত, সে তাড়াহুড়ো করে জুয়েলগুলো বের করে নিয়ে ওই অদ্ভুত হ্যাভারস্যাক আমাদের বাথরুমে পাচার করেছিল। কৃষ্ণা দীর্ঘাঙ্গিনী। আমাদের বাথরুমের লিন্টেন গলিয়ে বাইরে থেকে ওটা ঢোকানো তার পক্ষেই সম্ভব। সে আমাদেরই দায়ী করতে চেয়েছিল।”

বীতশোক মাথা দোলাল। ঈশিতা ভুরু কুঁচকে বলল, “ইজ ইট সো ইমপটান্ট কর্নেল সরকার?” তারপর সে বাঁকা হাসল। “কে জানে বাবা! হয়তো এটাই একটা ভাইটাল ক্লু।”

“ইউ আর রাইট মিসেস ব্যানার্জি।” কর্নেল বীতশোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “অ্যান্ড থ্যাংকস মিঃ ব্যানার্জি! এটা আমার জানার দরকার ছিল। যাই হোক, সুমিতবাবুর জানতে আগ্রহ, খুনি যে একই লোক, তা কী পদ্ধতিতে জানতে পারলুম। আপনারা কেউ একটুকরো কাগজ দিতে পারেন?”

নীপা তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট নোটবই বের করে একটা পাতা ছিঁড়ে দিল। ডটপেনও ছিল। কর্নেল কাগজটাতে কিছু এঁকে টেবিলে রাখলেন। সবাই ঝুঁকে পড়ল।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, “প্লিজ লুক! এ এবং বি দুজন লোক। তাদের মাথার পেছন দিকটা আমি এঁকেছি। কোনাকুনি কালো দাগদুটো ক্ষতচিহ্ন। মর্গের ডাক্তারের স্টেটমেন্টের ভিত্তিতে এই ছবিটা আমার মনে আঁকা ছিল। এখন সেটাই কাগজে এঁকে দেখালুম। লক্ষ করুন দুটো ক্ষতচিহ্নই ডানদিকে প্রায় ৬০ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করেছে। অর্থাৎ বেঁকে রয়েছে খানিকটা। মাথার খুলি যেভাবে ক্র্যাক হয়েছে, সেইভাবেই এঁকেছি। দুটো খুলিরই ক্র্যাকিং লাইন একইরকম। তার মানেটা কী দাঁড়াচ্ছে বুঝতে চেষ্টা করুন।”

সুমিত কাগজটা তুলে নিয়ে দেখার পর কর্নেলের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকাল। “আপনার মাথা আছে স্যার! খুনি একই লোক। নায়ার! দেখছিস? নীপু! দেখ, দেখ।”

নায়ার বলল, “লৌহদণ্ডের আঘাত। বীতশোক বলছিল হত্যার দণ্ডটি ঘটনাস্থলেই পাওয়া গেছে। আমার সিদ্ধান্ত, লৌহদণ্ডে হত্যাকারীর হাতের ছাপ আছে। ফরেনসিক গবেষণাগারে পাঠানো উচিত।”

ঈশিতা বলল, “গণেশের হাতের ছাপ পাওয়া যাবে। শিওর!”

কর্নেল বললেন, “গণেশের দু-দুটো খুনের মোটিভ কী থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন মিসেস ব্যানার্জি?”

ঈশিতা একটু চটে গেল। “সেটা জানেন মিসেস রত্না বোস। তাঁকে জেরা করছেন না কেন আপনারা? মাফিয়ালিডার কেতন সিংয়ের সঙ্গে মিসেস বোসের অবৈধ সম্পর্ক থাকতে পারে।”

বীতশোক স্ত্রীকে দ্রুত থামিয়ে দিল। “লিভ ইট!”

নীপা আস্তে বলল, “আচ্ছা কর্নেল সরকার ক্ষতরেখা বাঁকা কেন? মাথার পেছনে মারলে স্কালের ক্র্যাকিং লাইন সোজা হওয়াই উচিত।”

কর্নেল বললেন, “আপনি বুদ্ধিমতী মিস সেন! ঠিকই ধরছেন। ক্র্যাকিং লাইন বাঁকা কেন? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, লাইন দুটো ডাইনে বেঁকে প্রায় ৬০ ডিগ্রি কোণ সৃষ্টি করল কেন? একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায়। খুনি কোনও কারণে দুটি ক্ষেত্রেই সোজাসুজি আঘাত করতে পারেনি। মার্ডার উইপন মাথার ওপরে কোনও জিনিসে ঠেকে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তাই কাত করে মারতে হয়েছে। প্রথম ক্ষেত্রে সম্ভবত মাথার ওপর ছিল ঝাড়বাতি এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সম্ভবত সিলিং ফ্যান। অথচ ঘটনাস্থলে পাওয়া লোহার রডটা মাত্র আড়াই ফুট।”

নীপা বলল, “কিন্তু স্কালের ক্র্যাকিং লাইন বাঁদিকে না বেঁকে ডানদিকে বেঁকেছে কেন? বাঁদিকে বেঁকে যায়নি কেন? খুনি কি তার ভিকটিমের পেছনে বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আঘাত করেছে? নাকি সে ন্যাটা–লে হ্যাঁনডার?”

“আপনি বুদ্ধিমতী মিস সেন!”

আরিফ এতক্ষণে ফিরে এল। কর্নেলকে বলল, “শ্যামলালের বাড়ি সার্চ করে তার মাকে লেখা বসন্ত হাজরার একটা পোস্টকার্ড পাওয়া গেছে। তবে ডিটেকটিভ ইন্সপেক্টর সতীশ শর্মা আপনার ওপর একটু–” আরিফ হাসল। “আই মিন, আপনার ভাষাতেই বলা চলে, ওঁকে আপনি অনর্থক রেড হেরিংয়ের পেছনে ছুটিয়েছিলেন।”

“হাতের লেখা মেলেনি তো?”

“নাহ।”

 “তা হলে মিঃ শর্মাকে আমি রেড হেরিংয়ের পেছনে ছোটাইনি।”

আরিফ বসল। একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনি কি জানতেন দুটো হাতের লেখা এক নয়?”

কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুটে আগুন ধরিয়ে বললেন, “জানতুম না। জানতে চেয়েছিলুম এবং এবার জানলুম। তাতে আমার থিওরি আরও সলিড হল, ডার্লিং।”

সুমিত খুক করে কাশল। “আচ্ছা স্যার, এই যে আপনি আরিফকে ‘ডার্লিং বলেন, মানে–”ডার্লিং’ কথাটা স্যার কেমন যেন একটু মেয়েলি-মেয়েলি শোনায় আর কী! প্লিজ যদি এক্সপ্লেন করেন?”

কর্নেল প্রায় একটা অট্টহাসি হাসলেন। তারপর বললেন, “অভিধান দেখে নেবেন মিঃ চৌধুরি! নারী-পুরুষ সকলের প্রতি প্রযোজ্য শব্দ। আমি যাদের বেশি ভালবাসি, তাদের ‘ডার্লিং’ বলা আমার অভ্যাস, সম্ভবত আমার মধ্যে কিছু পিকিউলিয়্যারিটি আছে।”

আরিফ হাসল। “বড্ড বেশি-বেশি আছে।”

 কর্নেল হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। “তা আছে বলেই এখন তোমাকে আবার ইভনিং ভিলায় নিয়ে যেতে চাই। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন! ইভনিং ভিলার দু-দুটো হত্যারহস্যের পর্দা উন্মোচন দেখতে যদি আপনাদের কারও আগ্রহ থাকে, আসতে পারেন।”

প্রথমে নীতা উঠে দাঁড়াল। তারপর সুমিত, নায়ার ও ঈশিতা। বীতশোক একটু ইতস্তত করছিল। ঈশিতা রুষ্ট মুখে বলল, “বোকামি কোরো না অশোক! একবার যথেষ্ট বোকামি করেছ। আর নয়।”

বীতশোক উঠে গেল। তার ক্রিমরঙা অ্যাম্বাসাডারে এবার সামনের সিটে ঈশিতা বসল। পেছনে বসল নীপা, সুমিত ও নায়ার। আরিফের জিপকে অনুসরণ করল বীতশোকের গাড়ি। চড়াই থেকে নামার সময় নায়ার বলল, “অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি! শার্লক হোমস বা এরকুল পোয়ারোদের যুগ কবে শেষ হয়ে গেছে। আধুনিক যুগের হত্যাকাণ্ডে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই প্রয়োগ করা উচিত। লৌহদণ্ডে হত্যাকারীর হাতের ছাপ পরীক্ষা না করে সিদ্ধান্তে আসা উচিত নয়।”

ঈশিতা পিছনে ঘুরে বলল, “তা ছাড়া গণেশকে অ্যারেস্ট করা উচিত ছিল। মিসেস বোসকেও জেরা করা উচিত ছিল।”

সুমিত বলল, “মাইরি আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। বুড়ো মহা ঘুঘু। কাকে ফসাবে কে জানে?”

নীপা বিরক্ত হয়ে বলল, “আহ! চুপ করো তো তোমরা। আমার কেমন একটা আনক্যানি ফিলিং হচ্ছে।”

ঈশিতা বলল, “আমারও।”

ইভনিং ভিলার গেটে দুটো পুলিশ ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজন সশস্ত্র কনস্টেবল একটা বেঞ্চে বসে ছিল। আরিফের জিপ দেখামাত্র অ্যাটেশন-এ দাঁড়িয়ে গেল এবং স্যালুট ঠুকল। ভেতর থেকে একজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এলেন। আরিফ বলল, “এভরিথিং অলরাইট মিঃ পাণ্ডে?”

“ইয়েস স্যার!”

“মিঃ পাণ্ডে, কর্নেলসাব মিসেস বোসকি সাথ কুছ জরুরি বাত করনে আয়া। প্লিজ অ্যারেঞ্জ ইট। টেল হার, ইট ইজ ভেরি আর্জেন্ট।”

পুলিশ অফিসার হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গেলেন। কর্নেল নুড়ির ওপর সাবধানে পা ফেলে বাঁদিকের ঘাসে ঢাকা লনে গেলেন। আরিফ তার বন্ধুদের সঙ্গ দিল। হলঘরের দিকে যেতে যেতে সুমিত বলল, “আরিফ! এত পুলিশ পাহারা দেখে মাইরি আমার গা ছমছম করছে! এ বাড়ির লোকগুলোকে নজরবন্দি রাখা হয়েছে। তাই না?”

আরিফ বলল, “মিসেস বোস নিস্ পোলিশ প্রোটেকশন।”

 ঈশিতা চাপা স্বরে বলল, “ন্যাকামি! কেতন সিং থাকতে–”

বীতশোক তাকে থামিয়ে দিল। “স্টপ ইট!”

হলঘরের দরজা খোলা ছিল। পোর্টিকোর নিচে কয়েকটা চেয়ার পেতে কয়েকজন কনস্টেবল বসে ছিল। তারা উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিল। মিঃ পাণ্ডে বললেন, “খবর পাঠিয়েছি স্যার!”

ভেতরে ঢুকেই নায়ার ঝাড়বাতিগুলোর দিকে তাকাল। একটু হেসে বলল, “রত্নম! প্রচুর সবুজ পান্নার অলঙ্কৃত আচ্ছাদন।”

সুমিত বলল, “পরীক্ষা করে দ্যা তো কোনটা ছেঁড়া?”

কর্নেল বললেন, “বেশির ভাগই ছেঁড়া। কারণ ঝাড়ের ঝালরগুলো পুরনো। আপনারা বসুন।”

সবাই কালকের মতো সোফায় বসল। কালো চিতাটা হিংস্র জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে ফায়ারপ্লেসের মাথায়। কর্নেল ও আরিফ পাশাপাশি বসলেন। মিঃ পাণ্ডে বাইরের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। নিঝুম হয়ে আছে পরিবেশ। শুধু দেয়াল ঘড়ির টকটক শব্দ। কিছুক্ষণের জন্য সবাই চুপ। একটি চরম মুহূর্তের জন্য রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষার সময়। তারপর দেয়ালঘড়িতে আটটা বাজল। হলঘরের ভেতর থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়িতে রত্না বোসকে দেখা গেল। তার হাতের চেনে বাঁধা ভয়ঙ্কর একটা বুলডগ। পেছনে গণেশ। গণেশের হাতে কুকুরের চেনটা দিয়ে রত্না নেমে এলেন। গণেশ সিঁড়ির নিচে এসে দাঁড়িয়ে রইল। বুলডগটা তার পাশে পেছনের দুই হাঁটু মুড়ে বসল। রত্নার পরনে সাদা। শাড়ি, সাদা লম্বাহাতা ব্লাউস। বিধবাবেশে আজ তাকে বয়স্কা দেখাচ্ছিল। মুখ থেকে যৌবনের লালিত্য একেবারে মুছে গেছে। চোখের তলায় ছোপ পড়েছে। করজোড়ে নমস্কার করলেন। কর্নেল বললেন, “বসুন রত্না দেবী।”

ফায়ারপ্লেসের কাছে ভেলভেটে মোড়া সিংহাসনগড়নের চেয়ারে বসে রত্না আস্তে বললেন, “বলুন?”

কর্নেল বললেন, “আপনাকে এমন একটা দুঃসময়ে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। তবে আমার ধারণা, আপনার মনোবল অসাধারণ। অন্তত এই শোচনীয় ঘটনার পর আপনি যে-কোনও পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে তৈরি।”

রত্নার চোখ জ্বলে উঠল। “ইজ ইট আ গ্রেটনিং কর্নেল সরকার?”

“দ্যাট ডিপেন্ডস। কর্নেল একটু হাসলেন। “আজ আপনি আমার কাছে জানতে গিয়েছিলেন কে আমাকে হায়ার করেছে। আপনি এ-ও বলেছিলেন, ইভনিং ভিলায় সন্দেহজনক কিছু ঘটছে–আপনার ভাষায় ‘স্মেলিং আ ডেড র‍্যাট সামহোয়্যার। আপনার এই দুটি কথার মধ্যে একটা সম্পর্ক ছিল। নাহ! ‘সম্পর্ক যে ছিল, সে বিষয়ে আপনি আমার সঙ্গে ‘টার্মে’ পৌঁছুতেই চেয়েছিলেন। তাই প্রচুর টাকাও নিয়ে গিয়েছিলেন। এ সব থেকে আমার সিদ্ধান্ত হল–”

“আপনি কী বলতে চান, আমি বুঝতে পারছি না।”

“আমি বলতে চাইছি, আপনি আসলে জানতেন কে আমাকে হায়ার’ করেছে। কিন্তু আপনার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল কেন আমাকে সে ‘হায়ার করেছে, এটাই জানা। অর্থাৎ আমার কাজটা কী? তাই না?”

রত্না তাকিয়ে রইলেন। জবাব দিলেন না।

“রত্না দেবী! আমার কাজটা ছিল আজ এই বাড়িতে ককটেল-ডিনার পার্টিতে যেভাবে হোক উপস্থিত থাকা। কেন তা-ও বলছি। আই ওয়জ টু প্রিভেন্ট আ মার্ডার। কারণ আমার সো-কল্ড ক্লায়েন্ট’ জানতে পেরেছিল, তাকে খুনের চক্রান্ত হচ্ছে এবং কোনও-না-কোনও ছলে খুন করা হবে।”

রত্না দু’হাতে মুখ ঢেকে ভাঙা গলায় বলে উঠলেন, “ও মাই গড! বাট হোয়াই?”

কর্নেল আরিফের দিকে হাত বাড়ালেন। আরিফ খান প্যান্টের পকেট থেকে কী একটা তাকে বের করে দিল। কর্নেল সেটা তুলে ধরে বললেন, “আপনি দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কি না?”

রত্না নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। চোখের কোনায় জলের ফোঁটা। “এটা আপনার স্বামীর পকেটে পাওয়া গেছে। আপনার পূর্বপুরুষের জুয়েলচেস্টের ডুপ্লিকেট চাবি।”

রত্না কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আই ডোন্ট বিলিভ ইট!”

আরিফ বলল, “আমরা অলরেডি এটা পরীক্ষা করে দেখেছি মিসেস বোস! এই চাবি দিয়ে জুয়েলচেস্ট খোলা যায়।”

“বাট হোয়াই? আমার হাজব্যান্ডের তো টাকার অভাব ছিল না!”

আরিফ একটু হেসে বীতশোকের দিকে তাকাল। “মাই ফ্রেন্ড বীতশোক ব্যানার্জি নোজ দিস ওয়েল। কলকাতায় মিঃ বোসের একজন মিসট্রেস আছেন। মিঃ বোস তাকে জুয়েলগুলো উপহার দিতেন। শি ইজ আ ফিল্মস্টার।”

নায়ার গম্ভীর মুখে বলল, “বীতশোকের হস্তক্ষেপ করা উচিত ছিল।”

বীতশোক বলল, “আমি কী করতে পারি? কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর অভ্যাস আমার নেই। তবে আমার কর্তব্য আমি করেছি। মিঃ বোস খুন হওয়ার পর আরিফকে কথাটা জানানো উচিত মনে করেছিলুম। জানিয়ে দিয়েছি।”

কর্নেল বললেন, “আমার সো-কল্ড ক্লায়েন্ট’ ক্রমাগত জুয়েল চুরি টের পেয়েছিলেন। তাই মিঃ বোস তাকে চিরকালের জন্য চুপ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। কারণ এ বাড়িতে গণেশ, মালতী এবং ওই বুলডগ তিন-তিনটে বড় বাধা। তাছাড়া মিসেস বোসেরও সন্দেহ হতে পারে। তাই মিঃ বোস কুখ্যাত কেতন সিংয়ের সঙ্গে চক্রান্ত করেন। ককটেল-ডিনারের আয়োজন হয়। হোমরা চোমরা লোকেরা এমন কি একজন মিনিস্টারও আমন্ত্রিত। অতএব ‘যাক শত্রু পরে-পরে। কেতনের মতো লোক, ধরা যাক মদের নেশায় দৈবাৎ একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলার পর তা সামলানোর। হিম্মতও তারই আছে। এদিকে আমার সো-কল্ড ক্লায়েন্টও এলাকার প্রাক্তন মাফিয়ালিডার। কেতনের সঙ্গে একসময় প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। পরস্পর ঘোর শত্রু, সেটা কে না জানে? পুলিশও জানে। এ-ও জানা কথা, ওই কেতনই। ডাকাতির ছলে–আমার ধারণা, মিঃ বোসেরও হাত থাকতে পারে এর পেছনে, রাজত্ব এবং রাজকন্যা দুই-ই হাতে এসে যাবে–আমার সো-কল্ড ক্লায়েন্টকে অন্ধ অক্ষম করে দিয়েছিল।”

রত্নার ভিজে চোখ আবার জ্বলে উঠল। “কর্নেল সরকার! স্টপ ইট!”

 সবাই নড়ে বসল। নীপা বলল, “রায়সায়েব আপনার ক্লায়েন্ট?”

“সো-কল্ড ক্লায়েন্ট বলেছি।” কর্নেল হাসলেন। কারণ তিনিই আমাকে একটা বেনামী চিঠি লিখে পাঠান। অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করুন। তার কাজিনসিস্টার স্বামীর অত্যন্ত অনুগত। এদিকে মিঃ বোসও এ বাড়ির পূর্ণ কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় এনে ফেলেছেন। তাই রায়সায়েব এ বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করতে পারেননি। ব্যাপারটা এবার তার দিক থেকেই দেখতে হবে। তার একসময়ের কর্মচারী বসন্ত হাজরা প্রায়ই তার কাছে সাহায্য চাইতে আসত। সেই তাকে ককটেল ডিনারের সাংঘাতিক চক্রান্তের কথা জানিয়েছিল।”

 নায়ার বলল, “সে কী করে জানতে পারল?”

আরিফ বলল, “শ্যামলাল ড্রাইভার কেতনের এক চেলা কালুয়ার জিগরি দোস্ত। কালুয়া নেশার ঘোরে তাকে কথাটা জানিয়ে দেয়। তারপর–”

“আমি বলছি।” কর্নেল বললেন। “বসন্ত হাজরা শ্যামলালের বাঙালিমামা। প্রচণ্ড ধূর্ত লোক। তো কথাটা শোনার পর শ্যামলাল ভয় পেয়েছিল। শ্যামলাল কথাটা তার মামার কানে তুলেছিল, যেন ‘আমরিকান সাব’-কে মামা সাবধান করে দেয়। বসন্ত হাজরা সাবধান করে দিয়েছিল প্রাক্তন মনিবকে। তারপর রায়সায়েব আমাকে বেনামী চিঠি লিখে তাকে দিয়ে ডাকে ফেলতে পাঠান। আজকাল খামের মুখে তত আঠা থাকে না। বসন্ত হাজরা চিঠিটা পড়েছিল। তারপর ডাকে ফেলেছিল বটে, কিন্তু এতে তার সামনে অর্থপ্রাপ্তিরও সুযোগ এসেছিল। অদ্ভুত চরিত্রের লোক ছিল বসন্ত হাজরা! সে মিঃ বোসকে এই গোপন তথ্য জানিয়ে নিশ্চয় বখশিস আদায় করেছিল। বোসসায়েব ভাবনায় পড়ে যান। তার সন্দেহ স্বাভাবিকভাবেই পড়ে শ্যামলালের ওপর। তার চাকরি যায়। তারপর মিঃ ব্যানার্জি আসার সঙ্গে সঙ্গে মিঃ বোস তাকে জানান, তার পেছনে প্রাইভেট ডিটেকটিভ লাগানো হয়েছে। হ্যাঁ, আমার থিওরি মজবুত। বেনামী চিঠির হস্তাক্ষর যে বসন্ত হাজরার নয়, তা-ও কিছুক্ষণ আগে জানা গেছে।”

রত্না শ্বাস ছেড়ে বললেন, “কিন্তু দাদা তো লিখতে পারেন না! তার ডানহাত সম্পূর্ণ অবশ।”

“বাঁহাতে লিখেছিলেন। কর্নেল চুরুট ধরালেন। “তো গণেশ আমাদের বলেছে, ইদানীং বড়সায়েবের কাছে ছোটসায়েব অর্থাৎ মিঃ বোস চুপিচুপি কী সব কথা বলতে যেতেন। আসলে মিঃ বোস তার শ্যালককে বোঝানোর চেষ্টা করতেন, ওসব মিথ্যা কথা। মিঃ বোসের উদ্বেগের সঙ্গে সোমনাথবাবু ম্যাকবেথের উদ্বেগের তুলনা করেছিলেন। হি ইজ ইনটেলিজেন্ট। তো ইভনিং ভিলায় এই ব্যাপারটাই মিসেস বোসের কাছে ‘স্মেলিং আ ডেড র‍্যাট সামহোয়্যার। তার গাড়ির ড্রাইভার শ্যামলালের হঠাৎ চাকরি যাওয়াটাও অদ্ভুত মনে হয়েছিল। রত্নাদেবী! আপনি বলেছিলেন, “আই কান্ট এক্সপ্লেন ইট। নাও ইট ইজ এক্সপ্লেনড।”

রত্না আস্তে বললেন, “বাট হোয়াট ডু য়ু ওয়ান্ট টু টেল মি কর্নেল সরকার?”

“নাথিং বাট দা টুথ। সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চাই আপনাকে।”

 “হোয়াটস্ দা ট্রুথ?”

“বসন্ত হাজরা গতকাল সন্ধ্যায় চুপিচুপি রায়সায়েবকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিল। টাকা না দিলে সে বোসসায়েবকে জানিয়ে দেবে যে, রায়সায়েব প্রাইভেট ডিটেকটিভকে গোপনে চিঠি লিখেছেন। কিন্তু আসলে সে অলরেডি তা জানিয়েও দিয়েছে। অথচ এসেছে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করতে। এই বেয়াদবি বরদাস্ত করতে পারেননি রায়সায়েব। তার হাতের ছড়িটিকে লাঠি বলাই উচিত। মুঠোটা প্রায় ইঞ্চি ছয়েক লম্বা রুপো দিয়ে বাঁধানো। বসন্ত হাজরা উঠে পালাতে চেয়েছিল। লাঠির বাঁটটা তার মাথায় পেছনে পড়ে। তারপর রায়সায়েবের খেয়াল হয়, কী ঘটে গেছে। সোমনাথের সিগারেটের প্যাকেটের ভেতরটা ছিঁড়ে আমার নাম-ঠিকানা লিখে হাজরার পকেটের দেশলাইয়ে চালান করেন। যেন হাজরাই চিঠিটা লিখেছিল আমাকে। এটা আত্মরক্ষার চেষ্টা মাত্র। গণেশ! ঠিক বলছি?”

গণেশ মুখ নামাল।

নীপা বলে উঠল, “বাঁ হাত দিয়ে লাঠির আঘাতের জন্যই স্কালের ক্র্যাকিং লাইন ডানদিকে বেঁকে আছে। তাই না? তাছাড়া বাঁহাতেরও অসম্ভব জোর বলতে হবে।”

ঈশিতা বলল, “আনবিলিভেবল! একজন অন্ধ মানুষের পক্ষে।

কর্নেল তার কথার ওপর বললেন, “রায়সায়েব সম্পূর্ণ অন্ধ নন। সম্পূর্ণ অন্ধ এ সব কাজ করতে পারে না, তাছাড়া এই হলঘরের প্রতিটি ইঞ্চি তার। নখদর্পণে। রত্নাদেবীকে জিজ্ঞেস করেছিলুম, হলঘরের আসবাব নতুন করে সাজানো হয়েছে কি না। হয়নি।”

সুমিত বলল, “কিন্তু আপনার থিওরি, বসন্ত হাজরার খুনিই মিঃ বোসের খুনি!”

রত্না ভাঙা গলায় হিংস্র আর্তনাদ করলেন, “গেট আউট! গেট আউট ইউ ফুলস! আমি বুলডগ ছেড়ে দেব, আই ওয়ার্ন ইউ অল।”

“ফেস দা ট্রুথ, রত্নাদেবী!” কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন। “মিঃ বোস জানতেন, এ বাড়িতে যতক্ষণ আপনি উপস্থিত আছেন, ততক্ষণ তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদ। তাই অন্তত আজ ৩১ মার্চ পর্যন্ত আপনি যাতে বাইরে না যেতে পারেন, তার মানে, বাইরে যেতে হলে আপনি গাড়ি চেপেই যাবেন, সেজন্যই লনের রাস্তায় ও-ভাবে নুড়ি বিছানোর ব্যবস্থা করেছিলেন মিঃ বোস। আজ রাতে কেতন সিং রায়সায়েবকে খতম করত। তারপর আপনার গাড়ি বেরুনোর ব্যবস্থা দ্রুত হয়ে যেত। কিন্তু মিঃ বোসের দুর্ভাগ্য, আপনি চলে গেলেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। রায়সায়েব এদিকে তৈরি এবং মরিয়া হয়ে উঠেছেন। কারণ আমি এসে পড়েছি, এ কথা সম্ভবত কেউ জানায়নি তাকে। আমিও তখনও জানি না, চিঠিটা তারই লেখা। তো আপনি চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েই রায়সায়েব ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফোনের লাইন টেনে ছিঁড়ে ফেলেন। এর কারণ অনুমান করা যায়। মিঃ বোস একা বাইরে গেলেই আপনাকে বারবার রিং করতেন। এটা ওঁর ভালবাসার ভান, রত্নাদেবী! মালতী বলেছে, বাইরে গেলে হরবখত’ ছোটসায়েব টেলিফোন করতেন। তবে রায়সায়েব জানতেন, এদিন ফোনে সাড়া না পেলেই বোসসায়েবের কোনও সন্দেহ হতে পারে। ইট ওয়জ আ সর্ট অফ ট্র্যাপ। মিঃ বোস এসে ঠিকই ফাঁদে পড়লেন। গণেশ এবং মালতী তাদের আসল মনিবকে খুনের দায় থেকে বাঁচাতেই একটা লোহার রডে রক্ত মাখিয়ে বাড়ির কাছে ফেলে রেখেছিল। প্রায় এগারো বছর ধরে যে জিনিসটা রায়সায়েব হাতে করে নিয়ে ঘুরছেন, সেটা অর্থাৎ হাতের ছড়ি বা লাঠিটাই তার আত্মরক্ষা কিংবা আক্রমণের মোক্ষম অস্ত্র। কী গণেশ? ঠিক বলছি না?”

গণেশ আবার মুখ নামাল। রত্না নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে কথা শুনছিলেন। ঠোঁট কাঁপছিল। বিড়িবিড় করে বললেন, “ইটস আ টোটাল লাই! গণেশ! তুমি বলো! এসব মিথ্যা। ভীষণ মিথ্যা।”

“ফেস দা হার্ড ট্রুথ, রত্নাদেবী!” কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। “আপনার সামনে এবার নতুন একটা জীবনের সুযোগ এসেছে। টেক ইট অ্যাজ আ চ্যালেঞ্জ। আরিফ! এস, আমরা রায়সায়েবের কাছে যাই।”

ভেতরের দরজার দিকে কর্নেল এগিয়ে যেতেই কেউ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। দ্রুত পদা তুললেন। মালতাঁকে দেখা গেল। সে কান্না জড়ানো গলায় বলল, “আব কিসকা পাস যাতে হেঁ, হায় রাম! বড়াসাব মর গেয়া! জহর খা লিয়া! হায় রাম! মুর্দাকা পাস যানা হ্যায় তো যাইয়ে!” সে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল।

রত্না উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। হঠাৎ শ্বেতপাথরের মূর্তি হয়ে গেলেন। কর্নেল, আরিফ ও মিঃ পাণ্ডে ভেতরে ঢুকে গেলেন। তারপর গেল গণেশ। কুকুরটা তাকে অনুসরণ করল।

বীতশোক একটু ইতস্তত করে ডাকল, “মিসেস বোস!”

“ব্যানার্জি। মিসেস বোস ইজ আ ডেড পার্সন! আমি রত্না রায়। আন্ডারস্ট্যান্ড ইট, ব্যানার্জি!”

“চলুন, দাদাকে দেখবেন।”

 রত্না পা বাড়িয়েই চেয়ারের হাতল আঁকড়ে ধরলেন। তারপর মূৰ্ছিত হয়ে। পড়ে গেলেন কার্পেটের ওপর।…

.

ডাকবাংলোর বারান্দায় বসে কথা বলছিল ওরা। সুমিত, নায়ার, ঈশিতা ও নীপা। বীতশোক ইভনিং ভিলায় আছে। ঈশিতা গাড়ি চালিয়ে এনেছে। ওরা তার আসার অপেক্ষা করছিল। নীপা বলছিল, “আমি যেন জানতুম! কাল সন্ধ্যায় ভদ্রলোককে গাছপালার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে হচ্ছিল, আ পার্ট অফ নেচার। সোমনাথ বলছিল, ওই হাতের ছড়ি বা লাঠিটা দিয়েই উনি নাকি সবকিছু দেখতে পান। আসলে ওটা একটা অন্ধ আদিম শক্তির প্রতীক। তাই না ঈশিতাদি? একজন অন্ধলোকের কাছে তার হাতের ছড়ি বা লাঠিটাই কি শেষ অস্ত্র নয়?”

ঈশিতা বলল, “অ্যাবসার্ড! রায়সায়েব একেবারে অন্ধ হতেই পারে না। একটু আধটু নিশ্চয় দেখতে পেত। ডিটেকটিভদ্রলোক বললেন না?”

দূরে হেডলাইট দেখা যাচ্ছিল। একটু পরে গেটের সামনে এসে আরিফের জিপ থামল। জিপটা ভেতরে ঢুকল না। বীতশোক ও কর্নেলকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল।

সুমিত কর্নেলকে বলল, “কী দেখলেন স্যার?”

কর্নেল চেয়ারে বসে টুপি খুলে টেবিলে রাখলেন। টাকে হাত বুলিয়ে বললেন, “স্লিপিং ক্যাপসুল খেয়ে সুইসাইড করেছেন রায়সায়েব। আসলে সোমনাথবাবুর ওই থিওরিটা ঠিক। আমরা জানি না যে, আমরা কী জানি। আমার মনে ছিল না, ভদ্রলোক আমার পরিচিত। বহুবছর আগে একবার এখানে। বেড়াতে এসে হাওয়াই আড্ডির জঙ্গলে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তখন উনি। কুখ্যাত মাফিয়ালিডার! ওঁকে আমার ভুলে যাওয়ার কারণ সম্ভবত এটাই। ওঁকে আমার নেমকার্ড দিয়েছিলুম মনে পড়ছে।”

নীপা বলল, “কিন্তু সোমনাথ কেন ইভনিং ভিলায় ঢুকল, আমার মাথায় ঢুকছে না।”

কর্নেল একটু হাসলেন। “এগেন দা সেম থিওরি। আজ লাঞ্চের সময় সোমনাথবাবুর হঠাৎ নাকি মনে পড়েছিল, গতকাল সন্ধ্যায় সিগারেটের প্যাকেট আনতে গিয়ে হলঘরের ভেতরের দরজায় ছড়ির ডগা দেখেছিলেন। তাই নিয়ে রায়সায়েবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন। জোর বেঁচে গেছেন।”…