হিমাদ্রির সর্বনাশ

হিমাদ্রির সর্বনাশ

 শ্রাবন্তীর চেহারা দেখে শিউরে উঠেছিল হিমাদ্রি। দশ বছর আগে দেখা মোটামুটি স্বাস্থ্যবতী একটি মেয়ের শুটকো মড়া যেন–কোটরগত একজোড়া উজ্জ্বল চোখে অস্বাভাবিক চাউনি। হিমাদ্রিকে চিনতে পেরেছিল অবশ্য। কিন্তু সামান্য দু-একটা কথা বলে ঘরে ঢুকে গিয়েছিল। ও নিচের একটা ঘরে থাকে। মণিয়া থাকে ওর ঘরের বারান্দায়। ওর সঙ্গে রাতে ঘরের ভেতর থাকতে মণিয়ার মতো সাহসী মেয়েও ভয় পায়।

অপালা থাকে একা ওপরে ওর বাবার ঘরে। পাশের দুটো ঘর খালি পড়ে ছিল। ইদানীং একটা ঘরে ইন্দুবাবু থাকছেন। ইন্দুবাবুকে দেখলে কিছুতেই বাঙালি বলে মনে হয় না। হিমাদ্রি ওঁকে দেখে প্রথমে চিনতেই পারেনি। একেবারে ছাতুখোর হিন্দুস্থানীর আদল এসে চেপে বসেছে ভেতো বাঙালির গায়ে। স্বাস্থ্যটিও এখন পুষ্ট ও পেল্লায় হয়েছে। বলছিলেন, ক্লাইমেটের গুণ হে! দেখ না, বিশ বছর আগে এখানে প্রথম যখন এলাম, তখন আমার একটুতে ঠাণ্ডা জ্বর-জ্বালা সর্দিকাশি, তার ওপর ওই অম্বলের রোগ। রুদ্রদা আমার পেছনে লাগল। রোজ টানতে টানতে গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দিত। ভাবতাম কালই পালিয়ে যাব। তো পালাব কেমন করে? সব সময় রুদ্রদার কড়া নজর।

হিমাদ্রি আজও জানে না, ইন্দুবাবুর সঙ্গে রায়চৌধুরীদের সম্পর্কটা কী। জানে না সুনেত্রা বা অপালাও। ঊর্মিও সম্ভবত জানত না। তবে হিমাদ্রি দেখেছে, ইন্দুবাবু বরাবর ওঁদের চাষবাস আর বাড়ির সব কাজকর্ম দেখাশোনা করতেন। রুদ্রবাবুর সঙ্গে ছায়া হয়ে ঘুরতেন।

হিমাদ্রি জানতে চেয়েছিল, রুদ্রবাবু কীভাবে খুন হন। ইন্দুবাবু শ্বাস ফেলে বলেছিলেন, একটু ভুলের জন্য ওই অপঘাত ঘটে গেল। খুকুর ভরের সময় ওর মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে এসেছিল, বুঝলে? …রুদ্র, আজ তোর শেষ দিন! কিন্তু আমরা ওর ব্যাপারটা প্রলাপ বলেই জানতাম। আমল দিইনি।

হিমাদ্রি বলেছিল, তাহলে কি বলতে চাইছেন, সত্যি শ্রাবন্তীদির কোনো দেবীর ভর হয়?

কে জানে! ইন্দুবাবু গম্ভীর হয়ে বলেছিলেন। আগে বিশ্বাস করতাম না। এখন করি।

এমনও তো হতে পারে, শ্রাবন্তীদি ওর বাবা খুন হওয়ার আভাস পেয়েছিল? কিছু দেখেছিল অথবা শুনেছিল কোথাও।

ইন্দুবাবু হেসেছিলেন একটু। মাথা দুলিয়ে বলেছিলেন, নাঃ! তাহলে সরাসরি বলত। সবসময় তো আর দেবী ওর মধ্যে থাকেন না। মাঝেমাঝে হঠাৎ এসে পড়েন, হঠাৎ চলে যান। কাজেই সুস্থ অবস্থায় থাকার সময় কথাটা বলতে বাধা ছিল না। তাছাড়া জন্মদাতা বাবা বলে কথা।

হিমাদ্রি বলেছিল, আচ্ছা ইন্দুজ্যাঠা, এমন তো হতে পারে, শ্রাবন্তীদি ভরওঠা অবস্থায় ওর বাবাকে খুন করেছে! এরকম কেসের কথা আমি সাইকলজির বইতে পড়েছি। তখন সাইকিক পেসেন্ট নিজেই জানে না কী করছে!

ইন্দুবাবু, হো হো করে হেসে উঠেছিলেন। দেখ হে হিমু, তোমাদের ওই সাইকলজি-টাইকলজি কী আমি বুঝি না। কিন্তু এটুকু বুঝি, খুকু একটা আরশোলা দেখলে চেঁচিয়ে এক কাণ্ড করে। তাছাড়া ওকে তো দেখলে! গত তিন-চার মাসেও এমনি দুবলা হয়ে ছিল। কাঠির মতো নড়বড়ে শরীর। কোনরকমে হাঁটাচলা করে বেড়ায়। ঠেলে দিলে আছাড় খায়।

কিন্তু আমি শুনেছি, এক রাত্রে শ্রাবন্তীদি ছুরি হাতে নিয়ে ওর বাবার ঘরের দরজায়–

ইন্দুবাবু নড়ে উঠেছিলেন। ভারি গলায় বলেছিলেন, কে বলেছে তোমাকে?

 ঊর্মির কাছে শুনেছিলাম।

ঊর্মি মিথ্যা বলেছে। ও কী করে জানবে? তখন কি ও ছিল এখানে? অপুকে জিজ্ঞেস করো, কী হয়েছিল। অপু, বল্ তো হিমুকে ব্যাপারটা।

অপাল একটু তফাতে বারান্দার থামে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। সে বিরক্ত হয়ে বলেছিল, খালি ওই কথা!

ইন্দুবাবু আবার জোরে হেসে বলেছিলেন, অপু রুদ্রদার বকাবকি শুনে বেরিয়ে দেখে, খুকু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে। হাতে ছুরি-উরি কিছু নেই। তারপর তো আমি নিচে থেকে তুরন্ত এসে ওকে ধরলাম। ব্যস, ভর হয়ে গেল। আসলে টুকুটা বরাবর ওইরকম। তিলকে তাল করে বসে।

তাহলে কে খুন করল রুদ্রজ্যাঠাকে?

সে তো পুলিশ এনকোয়ারি করে এত্তেলা দিয়েছে আদালতে। রঘুয়া হারামীর নামে হুলিয়া ঝুলছে।

রঘুয়া–মনে সাহুজীর ছেলে রঘুনাথ?

 আবার কে? রঘুয়ার কীর্তি এখানকার লোকের কাছে শুনতে পাবে।… একটু চুপ করে থাকার পর ইন্দুবাবু আস্তে বলেছিলেন ফের, আমাদের বিহারের পুলিশ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের অবস্থা এখন ভাল নয়। সাহুজী টাকা খাইয়ে রেখেছে। কী আর করা যাবে?

হিমাদ্রি বলেছিল, আচ্ছা, তাহলে উঠি ইন্দুজ্যাঠা। বিশ্রাম করুন।

 তুমি থাকছ কয়েকদিন?

 দেখি।

 কাল দুপুরে খেও আমাদের বাড়ি। নাকি এখনও রাগ করে আছ আমাদের ওপর?

কী যে বলেন! ওসব কিছু মনে নেই।

মনে থাকলেও যার জন্য রাগ, সে তো নেই। এসো বাবা হিমু?

আচ্ছা বলে হিমাদ্রি চলে এসেছিল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সুনেত্রাকে বলেছিল, কিছু বোঝা গেল না। ঊর্মি কেন আমাকে মিথ্যা বলবে?

সুনেত্রা ঝাঁঝালো কণ্ঠ স্বরে বলেছিল, টুকু ভারি সতীলক্ষ্মী মেয়ে! ওর মুখে এক কথা, পেটে আর এক কথা।

হঠাৎ ওর ওপর খাপ্পা হলে যে?

টুকু সবসময় উল্টোপাল্টা কথা বলে। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে সুনেত্রা মুখ খুলেছিল ফের। এদিকে আমি এক কাণ্ড করে বসেছি টুকুর কথায়। এখন ভাবছি, ভুল হয়ে গেছে। কেঁকের বশে কর্নেলকে আসতে লিখেছি। খামোকা বুড়ো মানুষটাকে হয়রান করা হবে।

কর্নেল মানে? কী ব্যাপার?

ও। তুমি তো চেন না। তোমার কলকাতার লোক। থাকেন এলিয়ট রোডে। বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভদ্রলোক। ভেরি চার্মিং পার্সোনালিটি। এসে পড়লে দেখবে, কী ওয়ান্ডারফুল আদমি!

ওপরের ঘরে গিয়ে বাকিটা বলেছিল সে। টুকু ওমাসে আমাকে হঠাৎ একটা চিঠি লিখেছিল। চিঠিটা পেয়ে আমি তো তাজ্জব। ওর বাবাকে খুন করার পর এখানে এসে ওর ধারণা হয়েছে, এই খুনের পেছনে ইন্দুকাকার হাত আছে। ইদুকাকা ওদের সব সম্পত্তি হাতানোর চক্রান্ত করেছেন!

অসম্ভব নয়।

 ভ্যাট! তাহলে ইন্দুকাকাকে আরও দু-দুটো খুন করতে হবে জানো? খুকুদি আর অপু বেঁচে আছে না? ওদের যদি কিছু হয়, সেতাপগঞ্জের লোক এমন বুদ্ধু নয় যে ইন্দুকাকার ঘাড়ে সব দোষ পড়বে না! তাছাড়া সম্পত্তি হাতানোর জন্য ওঁর খুন করার কী দরকার? এমনিতেই তো উনি সবকিছুর প্র্যাকটিক্যালি মালিক হয়ে বসে আছেন।

 কর্নেল ভদ্রলোককে আসতে লিখেছ কেন? উনি কী করবেন?

সুনেত্রা ওর দিকে একটু তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। হিমুদা! যা হয়, ভালর জন্যই হয়। দেখছ, কথাটা কিছুতে আমার মাথায় আসেনি? কর্নেল এলে তুমি ওঁকে সব বলবে, যা যা আমাকে বলেছ। তুমি না বললে আমিই বলব।

বিবি!

চুপ রহো জী! সুনেত্রা হেসেছিল। লেট হিম কাম। আনে দো!

 কে তিনি?

 ক্রিমিনোলজিস্ট, প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটার, ন্যাচারালিস্ট, অ্যাডভেঞ্চারার কী নন বলো? মিলিটারিতে ছিলেন একসময়। বাবার কাছে ওঁর কতসব সাংঘাতিক গস্প শুনেছি আর তাজ্জব হয়ে গেছি, জানো? ওয়েট। কাল মর্নিংয়ে ওঁকে পোস্টঅফিস থেকে ট্রাঙ্ক কল করছি। বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে।…

সারারাত হিমাদ্রি অদ্ভুত-অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে কাটিয়েছে। শ্রাবন্তী প্রেতিনী হয়ে ওকে তাড়া করেছে। রুদ্রে রায়চৌধুরীকে হিমাদ্রি খুন করে লাস নিয়ে বিপদে পড়েছে। ঊর্মি নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে হিমাদ্রির সামনে। কিন্তু তার পেছনে মৃগাঙ্ক। তারপর মৃগাঙ্ক আর অপালা ভরা গঙ্গায় সাঁতার কাটতে চলে গেল। ভোরে হিমাদ্রি দেখল, পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে। হাতকড়া পরিয়ে দিতেই ঘুম ভেঙে গেল হিমাদ্রির। তখনও দু হাতের কবজিতে হাতকড়ার ঠাণ্ডা স্পর্শ লেগে আছে যেন।

সকালে সুনেত্রা বলল, যাবে নাকি আমার সঙ্গে?

কোথায়?

 পোস্টঅফিসে।

 থাক। তুমি যাও। আর শোনো, কলকাতার কাগজ যদি পাও, একটা এনো।

কলকাতার কাগজ এখানে পৌঁছুতে বিকেল হয়ে যায়। তবে আগের দিনেরটা পেতে পারি মধুবাবুর কাছে। উনি এজেন্ট।

হিমাদ্রি হাসল। এখনও একই অবস্থা সেতাপগঞ্জের। সেই মধুবাবু!

সুনেত্রা চলে গেলে সে কিছুক্ষণ জানালার ধারে বসে সিগারেট টানতে টানতে গঙ্গা দেখল। তারপর নিচে এল। সুনেত্রার মা সুনয়নী লনের পাশে ফুলবাগানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছু ফলের গাছও আছে। সুনয়নী পেয়ারাগাছে বাদুড়ের অত্যাচারের অভিযোগ করলেন। তারপর একথা-ওকথার শেষে চাপা গলায় বললেন, বসন্তনিবাসে তোমার এবেলা নেমন্তন্ন শুনলাম। আমি বলি কী, তুনি বলে পাঠাও ওদের শরীর খারাপ। কেন নিষেধ করছি জানো হিমু? ও : বাড়ির অন্ন তুমি ছুঁলে তোমার বাবার আত্মা কষ্ট পাবেন। তখন তোমার বয়স কম ছিল। সব জানো না। আমরা জানি। ডাক্তারবাবুর ওপর কী অত্যাচার না করেছিল রুদ্রবাবু! তারই পরিণাম। ভগবান হাতে-নাতে দেখিয়ে দিচ্ছেন! তুমি রিফিউজ করো, হিমু।

হিমাদ্রি একটু হাসল। বলছেন যখন—

বলছি। ধনিয়াকে দিয়ে ইন্দুবাবুকে বলে পাঠাচ্ছি, হিমুর শরীর খারাপ।

হিমাদ্রি অন্যমনস্কভাবে গেট পেরিয়ে খোয়াঢাকা নির্জন রাস্তা ধরে বাজারের মোড়ে গেল। সিগারেট কিনল। সেই সময় সাইকেলরিকশোয় সুনেত্রা ফিরল। হিমাদ্রিকে দেখে সে রিকশো ছেড়ে দিল। তারপর চাপা গলায় বলে উঠল, হিমুদা! বহৎ খতরনাক। কালকের কাগজে তোমার ছবি বেরিয়েছে। শিগগির বাড়ি চলো। টুকুকে মার্ডারের জন্য পুলিশ কাগজে হুলিয়া ছেপে দিয়েছে। ধরে দিলে পাঁচ হাজার টাকা প্রাইজ।

হিমাদ্রির মনে হল, সে শূন্যে নিঃসাড় ভেসে চলেছে।…

.

মন্দিরে এক সন্ন্যাসী

সেতাপগঞ্জের সর্বমঙ্গলা মন্দিরের আটচালায় মাঝেমাঝে সাধু-সন্ন্যাসী এসে ধুনি জ্বালিয়ে বসে থাকেন। নিছক গাঁজার লোভেও ভক্ত জুটতে দেরি হয় না। তারপর খবর পেয়ে পরমতত্ত্বের খোঁজে দু-চারজন, কেউ বা আধিব্যাধি মামলা মোকর্দমার ঝামেলা থেকে উদ্ধারের আশাতেও জুটে যায়।

গাঁজালোভীরা ঘুরঘুর করেছে কাল সন্ধ্যা থেকে। দেখেছে এই সাধুবাবার লাইন অন্যরকম। গাঁজার বদলে নস্যি আর হাঁচি। কখনও যোগাসনে ধ্যানীমূর্তি, কখনও ধুনির আলোয় শাস্ত্রপাঠে নিবিষ্ট। লম্বা খেকুটে চেহারা। মাথায় জটা, মুখে লম্বা দাড়ি, পরনে গেরুয়া কাপড়, গলায় রুদ্রাক্ষ–সবই ঠিক আছে। কিন্তু ইনি চা খান। কাছেই রেলের ফটক। ফটকওয়ালা শিবুয়া গাঁজার লোভেই জুটেছিল। কিন্তু সাধুবাবা তাকে পাঁচটাকার নোট দিয়ে বলেছেন, বেটা! হাম চায় পিয়েগা হরঘড়ি। ঔর রাতমে স্রিফ দো রোটি, থোড়াসা ডাল-উল। ব্যস! ঔর শুনো বেটা, টিশনবাজারসে ডিব্বাভরকে থোড়া সা নস্যি।

শিবুয়া লোকটা ভাল। সে আদিবাসী। তার ছোঁয়া চা-রোটি-ডাল খাবেন সাধুবাবা, এর চেয়ে আনন্দের আর কী থাকতে পারে? হাবভাব দেখে তার মনে হয়েছে, এতদিনে একজন সাচ্চা সাধুর সঙ্গলাভ তার হয়েছে। তার বউটা বাঁজা মেয়ে। এদিক থেকেও একটা আশীর্বাদসহ দাওয়া আশা করছে সে।

সকালে কাঁধে প্রকাণ্ড বোঁচকার মতো ঝোলা ঝুলিয়ে কমণ্ডুল হতে সাধুবাবা গঙ্গাস্নান করে ফেরার সময় ফটকে শিবুয়াকে চা আনতে বলে এসেছিলেন।

আটচালায় আসন করে বসে আছেন, হঠাৎ দেখলেন মন্দিরের ধারে কল্কেফুলের জঙ্গলের ভেতর একটা কেমন চেহারার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চমকে উঠেলেন দিনদুপুরে ভূত দেখছেন ভেবে। ময়লা যেমনতেমন শাড়ি পরনে, খালি পা, মাথায় রুক্ষ একরাশ চুল। রোগা হাড়জিরেজিরে মেয়ে। তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকার পর একটা পাথরে বসে পড়ল সে।

শিবুয়া চা আনলে সাধুবাবা জিগ্যেস করলেন, বেটা! দেখো তো উও লড়কি কৌন?

শিবুয়া হাসল। উও তো খুখুদিদি! মঙ্গলামাইকী ভর হোতি উসকি উপ্পর, সাধুবাবা!

কিধার রহতি উও?

উধার! বহৎ বড়া ঘরকী বেটি, বাবা! উও দেখিয়ে, উও মকান। বাঙালি জমিদারবাবুকা। লেকিন, জমিদারবাবু তো মার্ডার হো গেয়া!

মার্ডার হো গেয়া?

হাঁ সাধুবাবা!

 শিবুয়া উঠে গেল বউয়ের চিলাচানিতে। বউটা বড় হাড়জ্বালানী মেয়ে। একটু কোথাও গিয়ে বসার যো নেই শিবুয়ার।

সাধুবাবা মাটির ভাঁড়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখছিলেন মেয়েটিকে। চা শেষ করে হাত নেড়ে ডাকলেন, এ বেটি! ইধার আ! মেরা পাশ আ যা!

কিন্তু মেয়েটি গ্রাহ্য করল না দেখে উঠে গেলেন কাছে। অমনি সেও উঠে দাঁড়াল। তারপর জঙ্গলে ঢুকে গেল। সাধুবাবাও জঙ্গলে ঢুকলেন। ভারি অদ্ভুত ব্যাপার তো! একবারে অদৃশ্য হয়ে গেল যে! সাধুবাবা ডাকলেন, বেটি! তু কঁহা হ্যায়? মেরা বাত তো শুন্ বেটিয়া!

তারপর জঙ্গল ঠেলে ওপাশে গিয়ে দেখেন, নিচু পাঁচিল ডিঙিয়ে মেয়েটি পোছড়া পাথুরে মাঠটায় গিয়ে পৌঁছুল। সাধুবাবা পাঁচিল ডিঙিয়ে এগিয়ে গেলেন। ডর কাহে বেটি! বাত তো শুন!

এবার মেয়েটি একটি পাথর কুড়িয়ে নিল। সাধুবাবা ভড়কে গেলেন। মেয়েটির চোখদুটি থেকে যেন হিংসা ঠিকরে বেরুচ্ছে।

সাধুবাবা কী করবেন ভাবছিলেন। মেয়েটি হঠাৎ হন হন করে চলতে শুরু করল। তখন উনিও পা বাড়ালেন। কয়েক পা গেছেন, অমনি মেয়েটি ঘুরে হাতের পাথরটা ছুড়ল তার দিকে। অল্পের জন্য মাথা বাঁচল। আর এগোনোর সাহস হল না! বাপস! এ যে একেবারে গোখরো সাপের মতো ফণা তুলেই। আছে।

মেয়েটি যেতে-যেতে মাঝেমাঝে পিছু ফিরে দেখে নিচ্ছে। একটু পরে রাস্তা ডিঙিয়ে গাছপালার ভেতর একটা বাড়ির দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ওই বাড়িটাই তাহলে বসন্তনিবাস। সাধুবাবা আটচালায় ফিরে গুম হয়ে বসলেন পদ্মাসনে। একটু পরে একজন দেহাতী লোক মন্দিরে প্রণাম করতে এল। প্রণাম করে সে সাধুবাবাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। তারপর আটচালার নিচে সাষ্টাঙ্গে আবার একটা প্রণাম ঠুকে করযোড়ে বসে রইল। কিন্তু সাধুবাবা চোখ খুলছেন না দেখে নিরাশ হয়ে সে চলে গেল। সাধুবাবা পিটপিট করে তাকিয়ে গলার ভেতর বলেন, জ্বালাতন! বসন্তনিবাস থেকে কেউ আসছে না। যে এসেছিল, সে তো কাছ ঘেঁসতেই দিল না। দেখা যাক, সারাটা দিন পড়ে। আছে সামনে। অগত্যা রাত্রিবেলা দেখা যাবে।…

.

সাইকিয়াট্রিস্ট ডাঃ ভাদুড়ী

 কিছুক্ষণ আগে সেতাপগঞ্জ থেকে সুনেত্রা ট্রাঙ্ককল করেছে। হিমাদ্রি ওখানে আছে শুনে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছেন কর্নেল। বলেছেন, ওকে বাড়ি থেকে বেরুতে বারণ কোরো। আমি আগামীকাল যে-কোনো সময় পৌঁছচ্ছি। হাতে কিছু জরুরি কাজ আছে। সুনেত্রার চিঠিটা পেঁছুল এর ঘণ্টাখানেক পরে। সমস্ত ব্যাপারটা বড়বেশি জট পাকিয়ে গেল। ঊর্মি নাকি সুনেত্রাকে লিখেছিল, ওর বাবার হত্যাকাণ্ডের পেছনে ইন্দুমাধব ভট্টাচার্যির হাত আছে। থাকা বিচিত্র নয়। কিন্তু হত্যার পদ্ধতি হুবহু এক। এটাই গণ্ডগোল করে ফেলছে সব। ঊর্মির হত্যাকারীর সঙ্গে তার বাবার হত্যাকারীর কোথায় একটা গরমিল।

রুদ্রেন্দুপ্রসাদ রায়চৌধুরির চিঠিটা বের করে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। ..কাউকে বিশ্বাস হয় না, তাই এই চিঠি।… ইন্দু ভটচাযকেও না? তাই তো মানে দাঁড়ায়।

তার চেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার, চিঠিটা এতদিন পরে কে ডাকে দিয়েছিল? ওঁর মেজমেয়ে ঊর্মিও কলকাতার ফ্ল্যাটে একইভাবে খুন হওয়ার ঠিক পরেই কেউ চিঠিটা ডাকে দিয়েছিল। এও একটা পয়েন্ট।

হুঁ, হিতাকাঙ্ক্ষী কেউ। যার কাছে মনে হয়ে থাকবে এর একটা আস্কারা করার দরকার আছে। সে কর্নেল নীলাদ্রি সরকার সম্পর্কে খবর না রাখুক, অন্তত এটুকু জানে রুদ্রেন্দুবাবু যাকে এভাবে চিঠি লিখতে চেয়েছিলেন, তার ওপর ভরসা রাখা যায়। তাই সে চিঠিটা ডাকে দিয়েছে। সে কি ভেবেছে হত্যাকারী একজনই?

ঊর্মির হত্যাকাণ্ড না ঘটলে রুদ্রেন্দুবাবুর চিঠিটা পেয়েই ছুটে যেতেন সেতাপগঞ্জে। ভেবেছিলেন, ঊর্মির হত্যাকাণ্ড থেকে এমন কোনো সূত্র পাবেন, যা রুদ্রেন্দুবাবুর হত্যাকাণ্ড রহস্যের মীমাংসা করে দেবে। কিন্তু কৃতান্ত হালদারের অবাঞ্ছিত টেলিগ্রামটা একটা বাড়তি গেরো পাকিয়ে দিয়েছে।

বারো জুলাই সকালে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা দফতর ট্রাঙ্ককল করে বোম্বের ডিলাইট হোটেলে মৃগাঙ্ক ব্যানার্জিকে তার স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিল। ফোনটা করেছিলেন ইন্সপেক্টর মোহনবাবু। মোহনবাবু কর্নেলকে বলেছেন, মৃগাঙ্কবাবুই ফোনে কথা বলেছেন, তাতে তার সন্দেহ নেই। কেন সন্দেহ নেই, তার স্পষ্ট জবাব মোহনবাবু দিতে পারেননি। শুধু বলেছেন, আই অ্যাম, কনভিড়।

কর্নেল সুনেত্রার চিঠিটা খুললেন আবার। ডানায় হলুদ-লাল ফুটকিওয়ালা প্রজাপতি আর উড-ডাকের লোভ দেখিয়েছে। মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কিন্তু হাতে একটা জরুরি কাজ বাকি। সেটা চুকে গেলেই নিঃসংশয় হবেন ঊর্মির হত্যাকারী সম্পর্কে। বিকেলের মধ্যেই আশা করছেন সেই মূল্যবান তথ্যটা পেয়ে যাবেন।

সুনেত্রার চিঠির একটা অংশে আবার চোখ রাখলেন। ..ঊর্মির দিদির ভর ওঠার ব্যাপারটাও আপনার চিন্তার খোরাক যোগাবে। ভরের সময় ওর চেহারা কী ভীষণ বদলে যায়। একেবারে রাক্ষুসীর মুর্তি। আপনি যে অত সাহসী, আপনিও ভয় পেয়ে যাবেন। আমার মনে হয়, তখন যদি ওর হাতে ছুরি থাকে, খুন করে ফেলবে। তাই ভর উঠলে ও বাড়ির লোকেরা খুব সাবধান হয়ে যায়। কাউকে কাছে যেতে দেয় না। তখন ওকে একজনই সামলাতে পারে। সে দয়াল ঠাকুর। ওবাড়ির রাঁধুনী। দয়ালকে দেখলে শ্রাবন্তীর ভর থেমে যায় নাকি।…

চিঠি দুটো টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রেখে কর্নেল বেরুলেন।

পার্ক স্ট্রিটে একটা প্রকাণ্ড পুরনো বাড়ির দোতলায় ডাঃ অশোক ভাদুড়ীর চেম্বার সুস্থ মন। নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার। ট্যাংরায় ওঁর মেন্টাল ক্লিনিক। এখানে একটা চেম্বার রেখেছেন। সকাল-সন্ধ্যা ঘণ্টাচারেক করে বসেন।

কর্নেলকে দেখে লাফিয়ে উঠলেন। হ্যালো ওল্ড বস! ঘিলু বিগড়ে গেল নাকি?

 গেছে।

ডাঃ ভাদুড়ি হাসিখুশি মানুষ। হো হো করে হাসলেন। আবার কোন পাগল খুনখারাপি করেছে বুঝি? সাবধান কর্নেল! পাগলের পেছনে এ বয়সে আর ছোটাছুটি করবেন না।

কর্নেল বসে বললেন, একটা কথা জানতে এলাম ডাঃ ভাদুড়ি।

কর্নেলের গম্ভীর মুখ দেখে ডাঃ ভাদুড়ী সিরিয়াস হলেন। …বলুন, বলুন।

 এই যে দেবদেবীর ভর-ওঠা ব্যাপারটা কী আসলে?

 আপনি বিজ্ঞ মানুষ, কর্নেল! আপনি আমার মতামত জানতে চাইছেন? ডাঃ ভাদুড়ী হাত বাড়িয়ে বললেন, কৈ, আগে একটি বিখ্যাত চুরুট দিন। এতক্ষণ দুডজন মেন্টাল পেসেন্ট ঘাঁটাঘাঁটি করে ঘিলু জ্যাম হয়ে গেছে। অনেকসময় ধোঁয়া ঘিলুকে চাঙ্গা করে। গ্রামের ওঝারা হিস্টিরিয়ার পেসেন্টের নাকে ঝঝাল ধোঁয়া ঢুকিয়ে দেয়। ব্যস! পেসেন্ট তখন দিব্যি নর্মাল।

চুরুট দিয়ে লাইটারে আগুন ধরিয়ে দিলেন কর্নেল। পকেট থেকে একটা আধপোড়া চুরুট বের করে নিজেও ধরিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ভর ওঠার ব্যাপারটাও কি হিস্টিরিয়া ডাঃ ভাদুড়ী?

আলবাৎ হিস্টিরিয়া। তবে এসব কেস কমন হিস্টিরিয়া নয়। হিস্টেরো এপিলেন্সির ঠিক বিপরীত একটা অবস্থা। এপিলেন্সির ফিটে রোগীর সব লক্ষণই প্রায় শারীরিক প্রক্ষোভ। হিস্টিরিয়ায় শারীরিক প্রক্ষোভের সঙ্গে মানসিক প্রক্ষোভও থাকে। কিন্তু মানসিক প্রক্ষোভের মধ্যে অস্পষ্টভাবে সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণও বজায় থাকে। হিস্টেরো-এপিলেন্সিতে

ভর ওঠার কথা বলুন প্লিজ!

সেই বলতে যাচ্ছি। হিস্টিরিয়া হয় কাদের? যাদের নার্ভ-সিস্টেম দুর্বল, আত্মসচেতন, অনুভূতিপ্রবণ, নিজের প্রাপ্য সম্পর্কে সতর্ক, কল্পনাপ্রবণ, বড় বেশি আশা করে থাকে, অথচ ভেতর-ভেতর ভিতু। এ জন্য মেয়েদের মধ্যেই এর প্রকোপ বেশি। এমন পুরুষ নিশ্চয় অসংখ্য আছে। কিন্তু সমাজ পুরুষশাসিত বলে তাদের ওইসব মানসিক বৃত্তি চরিতার্থ হবার সুযোগ পায়। মেয়েরা পায় না। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলব, কামনা-বাসনার অবদমন ঘটাতে বাধ্য হয় মেয়েরা। দিনের পর দিন অবদমিত কামনা-বাসনা জমতে জমতে একসময় যেন বিস্ফোরণ ঘটে।

প্লিজ, ভর ওঠার ব্যাপারটা…

তাই তো বলছি। কোনো আকস্মিক সাংঘাতিক ঘটনার অভিজ্ঞতা অনেকক্ষেত্রে হিস্টিরিয়ার কারণ হতে পারে। আচমকা প্রচণ্ড ভয় পেয়েও এ অসুখ হতে পারে। আবার প্রচণ্ড শোক বা দুঃখ কোনো কারণে চেপে রাখলেও হতে পারে। তো ভর ওঠার ব্যাপারটা আরও জটিল একটা প্রক্রিয়া। প্রকৃতি মানুষের মনেই একটা ব্যবস্থা রেখেছে। স্বপ্ন দেখার মতোই। হিস্টিরিয়ার একটা পর্যায়ে অবদমনকে অসচেতন মনের একটা স্বতশ্চল প্রক্রিয়া বেরিয়ে যেতে দেয়। অনেকটা মুক্তি ঘটে। স্বপ্নেও একই ব্যাপার ঘটে থাকে। প্রক্ষোভের গ্যাস বেরিয়ে যাওয়া বলতে পারেন। কিন্তু হিস্টিরিয়ায় সেই স্বতশ্চল প্রক্রিয়া সাহায্য নেয় কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে দৃঢ় বিশ্বাসের। যেমন ধরুন, কেউ ভূতপ্রেতে বিশ্বাসী–কেউ দেবদেবীতে বিশ্বাসী। এদের ক্ষেত্রে ভূতপ্রেত বা দেবদেবীই যেন কথা বলে। তার মানে, দমিত প্রক্ষোভের গ্যাস ভূতপ্রেত বা দেবদেবীর কথা হয়ে বেরিয়ে যায়। বুঝলেন তো?

কর্নেল হাসলেন। ঘিলু আরও জ্যাম হয়ে গেল। ধরুন, কোনো মেয়ের মধ্যে দেবীর ভর উঠেছে। ভরের সময় সে কোনো বিপদ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করল। তারপর তা ঠিক ঘটেও গেল। এমন কেন হয়?

ডাঃ ভাদুড়ী ভুরু কুঁচকে বললেন, শোনা কথা বলছেন তো? অমন হতে পারে না।

হয়েছে।

ডাঃ ভাদুড়ী একটু ভেবে নিয়ে বললেন, হলে জানবেন, মেয়েটি আগে কিছু টের পেয়েছিল। কিন্তু কোনো কারণে তা বলতে পারছিল না। চেপে রাখতে বাধ্য হয়েছিল। অর্থাৎ সেই অবদমন।

হিস্টিরিয়াগ্রস্ত পেসেন্ট যা করে, সে সম্পর্কে কি সে সচেতন?

মোটেও না। কী শুনলেন এতক্ষণ? ডাঃ ভাদুড়ী হাসতে লাগলেন। সে যা করে–মারধর, এমন কী খুনোখুনি পর্যন্ত–সবই অবচেতন মানসিক প্রক্রিয়ার ফলাফল। এমন কেস আছে, পেসেন্ট রাতে নিজের জিনিস নিজেই চুরি করে। অবসেসন আর কী! ওই যে কেউ কেউ ঘুমের মধ্যে হাঁটাচলা করে বা ঘর থেকে বেরিয়ে যায়, সেও ওই অবসেসনের একটা সাধারণ প্রক্রিয়া।

অবসেসন প্রক্রিয়ার মধ্যে খুন করাও কি সম্ভব?

মোটেও অসম্ভব নয়। তবে সত্যি যদি তাই করে, জানবেন যাকে খুন করেছে, তার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা আর রাগ লুকিয়ে ছিল অবচেতন মনে।

ওই অবস্থায় তাকে কেউ গাইড করতে পারে না?

শতকরা দুটি বা একটি কেসে দেখা গেছে, কেউ গাইড করেছে। যে গাইড করছে, তার প্রতি পেসেন্টের প্রচণ্ড আতঙ্ক থাকতে পারে, শ্রদ্ধাভক্তি বিশ্বাসও থাকতে পারে। তবে এটা খুব বিপজ্জনক ব্যাপার। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের কাহিনী তো জানেন!

যে গাইড করছে, তারও ক্ষতি করতে পারে বলছেন?

একজ্যাক্টলি। তবে সেটা নির্ভর করছে একটা বিশেষ অবস্থার ওপর। ধরুন, কোনো পেসেন্ট কারও গাইডেন্সে পড়ে অবসেসন প্রক্রিয়ায় কাউকে খুন করল। জ্ঞান হবার পর যদি সে দৈবাৎ জানতে পারে যে সে খুন করেছে, তার মধ্যে। একটা স্বাভাবিক প্রক্ষোভ সৃষ্টি হবে। তখন আবার অবদমন ঘটলে যে তাকে গাইড করেছে, তার বিপদের সম্ভাবনা আছে। কিন্তু কথাটা হল, জানতে পারা– শুধু জানতে পারা নয়, বিশ্বাস হওয়া যে সে সত্যি সত্যি ওই খুনটা করেছে এবং ওই খুনটা করেছে এবং ওই লোকটার কথাতেই করেছে।

ধরুন, এ বির গাইডেন্সে সিকে খুন করল অবসেসন প্রক্রিয়ায়। এ যদি সির অত্যন্ত আপনজন–মনে করা যাক, বাবা হয়, তাহলে?

বির বিপদের সম্ভাবনা প্রচণ্ড।

বি খুব শক্তিমান আর ধূর্ত লোক হলে?

পেসেন্ট বদ্ধ পাগল হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে। ব্যর্থতার অবদমনের ফলে তার নার্ভ সিস্টেম বাকি জীবনের জন্য ভেঙে পড়বে। ডাঃ ভাদুড়ী চোখে ঝিলিক তুললেন এবং চাপা গলায় বললেন, কেসটা কী?

হাসলেন কর্নেল। পরে জানতে পারবেন। বলে উঠে দাঁড়ালেন।

ডাঃ ভাদুড়ী বললেন, ও কী! বসুন। কফি আনতে বললুম না?

আপনার পেসেন্টরা হয়তো ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন!

মোটেও না। নটা অব্দি চেম্বারে থাকি। এখন দশটা বাজে প্রায়। টেবিলের স্লিপগুলোর দিকে তাকালেন ডাঃ ভাদুড়ী। দেখতে দেখতে চড়া গলায় হাঁক দিলেন, ব্যানার্জিবাবু! দেখুন তো, কফি আনতে দেরি হচ্ছে কেন?

পার্টিশানের ওদিক থেকে কেউ বলল, এসে গেছে স্যার।

 ব্যানার্জিবাবু, একটু আসুন তো আপনি।

 কম্পাউন্ডার ব্যানার্জিবাবু চেম্বারে ঢুকলেন। বেঁটে কালো মানুষ। কিন্তু চেহারায় সৌখিনতা রমরম করছে।

মেমসায়েব পেসেন্টের টাকা জমা দিয়ে গেছে?,

না স্যার। আসেই নি আজ।

 দেখছেন কাণ্ড? আপনি ফেরার পথে একবার ফ্রি স্কুল স্ট্রিট হয়ে যান না! অ্যাড্রেস দেওয়া আছে তো?

আছে স্যার।

ঠিক আছে। ওঁকে বলে যান, পরশুর মধ্যে টাকা জমা দিলে পেসেন্ট রাখা যাবে না। দাঁতব্য প্রতিষ্ঠান তো নয়। তার ওপর অমন জটিল কেস।

কফির পট আর দুটো কাপ-প্লেট রেখে কর্নেলকে অবাক চোখে দেখতে দেখতে চলে গেল একটা কমবয়সী ছেলে। কর্নেল একটু হাসলেন আপনমনে। তাকে দেখে কমবয়সীরা কেন অবাক হয় কে জানে? অরিজিতের মতে, জীবন্ত সান্তাক্লজ মনে করে। কে জানে কী ব্যাপার।

কফি ঢেলে ডাঃ ভাদুড়ী বললেন, কর্নেল ভাবছেন কী কঞ্জুস ডাক্তার রে বাবা! তাই না?

না, না। ক্লিনিক চালাতে আপনার খরচের ব্যাপার আছে।

কেস খুব পিকিউলিয়ার বলেই হাফ খরচে ভর্তি করিয়েছি। তাছাড়া আমারও একটা নতুন কেস স্টাডি করা হবে। কিন্তু কী যেন নাম মেমসায়েবের?

ব্যানার্জিবাবু বললেন, মিসেস পেরিয়ার।

 ঠিক আছে। আপনি আসুন ব্যানার্জিবাবু। দেখুন কী বলে মিসেস পেরিয়ার! ডাঃ ভাদুড়ী কফিতে চুমুক দিয়ে ঘুরলেন কর্নেলর দিকে। ব্যানার্জিবাবু চলে গেলে চাপা গলায় বললেন, ভেরি ইন্টারেস্টিং কেস। আমাদের প্রফেশনে কী সব অদ্ভুত-অদ্ভুত মানুষ দেখার অভিজ্ঞতা হয় দেখুন!

কী কেস?

প্যারানইয়াক পেসেন্ট। হাইপোকন্ড্রিয়া থেকে এই স্টেজে এসেছে। অদ্ভুত সিম্পটম। পেসেন্ট দুহাতে নিজের গলা চেপে ধরে হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠে, ও নো নো! তারপর অজ্ঞান হয়ে যায়। জ্ঞান অবস্থাতেও শূন্যদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। কথা বলে না।

গলা চেপে ধরে বললেন?

ডাঃ ভাদুড়ী দুহাতে নিজের গলার সামনের দিকে চেপে ধরে ভঙ্গিটা দেখিয়ে দিলেন। তারপর আগের মতো আস্তে বললেন, মিসস পেরিয়ার রেডলাইট এরিয়ায় থাকে। বুঝতেই পারছেন কী ব্যাপার। পেসেন্টের বয়স তিরিশ-বত্রিশ হবে। চেহারা মোটেও ভাল নয়। নেহাত সেক্সের দায়ে না ঠেকলে কেউ ওর কাছে যেত বলে মনে হয় না। তো ওইরকম অদ্ভুত সিম্পটম! দুটো সিটিং এই চেম্বারেই দিলাম প্রথমে। সাইকো-অ্যানালেসিস পদ্ধতি প্রয়োগ করে ব্যাপারটার খানিকটা আভাস পেয়ে গেলাম। মাসখানেক আগে একটা লোক ওর কাছে এসে অদ্ভুত একটা প্রস্তাব দেয়। সে সেক্সটেক্স চায় না। শুধু এই একটা কাজ সে করবে। রোজ আসবে আর করবে।

কী?

 হাসলেন ডাঃ ভাদুড়ী। এও ধরে নিতে পারেন সেক্সপার্ভার্সান এক ধরনের। এতেও যৌনতৃপ্তি পায় কেউ কেউ। অর্থাৎ ফিজিক্যাল টর্চার! যাকে বলা হয় স্যাডিজম।

লোকটা তার গলা টিপে ধরত বুঝি?

না। শুনুন না! মেয়েটা টাকার লোভে পড়ে রাজি হয়েছিল। কাজটা হল : লোকটা এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলত, দরজা বন্ধ করো। আমি তিনবার নক করলেই খুলে দেবে। তো প্রথম দিন মেয়েটা তাই করল। আর লোকটা দরজা খোলামাত্র মেয়েটার মুখে একটা হাত চেপে নিজের বুকে টেনে নিয়ে কী একটা ঘষে দিল ওর গলায়। তারপর হাসতে হাসতে ছেড়ে দিল। মেয়েটা প্রথম। দিন ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। পরে আর তত ভয় পেত না। জানত তার খদ্দের কী করবে এবং তাকেও কী করতে হবে। এভাবে সপ্তাহখানেক চলার পর একদিন মেয়েটা আবিষ্কার করল, লোকটা এতদিন একটা কাঠের ছুরি ঘসেছে ওর গলায় একদিন একটা সত্যিকার ছুরি দিয়ে ঘসেছে তবে ছুরিটার উল্টো পিঠ দিয়ে। ব্যস, মেয়েটির মনে আতঙ্ক জন্মে গেল। কিন্তু টাকার লোভ বড় লোভ। প্রতিদিন ওই একটা সময় তার মনে একটা ঝড় বয়ে যায়। দরজা খুলে দেয় নক করলে। লোকটা তার মুখ চেপে ধরে। ঠিক একইভাবে ছুরির উল্টো দিকটা গলায় ঘসে দেয়। তারপর ছেড়ে দিয়ে প্রতিশ্রুতিমতো কুড়িটা টাকা দিয়ে চলে যায়। মেয়েটা টাকা মুঠোয় চেপে ক্লান্তভাবে বসে থাকে। শুধু ভাবে, ছুরিটা যদি আগামীদিন তার গলায় উল্টোদিকে না ঘসে ভুল করে সিধে দিকে ঘসে দেয়! বুঝতে পারছেন তো? হাইপোকন্ড্রিয়ার সূচনা এভাবেই হয়।

কর্নেল আস্তে বললেন, কতদিন আগের এ ঘটনা?

একমাস-দেড়মাস আগে। এভাবে তিন সপ্তাহ বা তার বেশি চলার পর মেয়েটার নার্ভ গেল। মুখের ওপর জবাব দিল। তারপর হল কী, লোকটা আর আসে না। কিন্তু যখনই কেউ দরজায় নক করে, ও দুহাতে নিজের গলা চেপে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, ঔ নো নো! তারপর অজ্ঞান হয়ে যায়। মিসেস পেরিয়ার এ সব কিছু জানে না। তার বিশ্বাস, স্বয়ং স্যাটার্ন ওকে ভর করেছে। হাসতে লাগলেন ডাঃ ভাদুড়ী।

নাম কি পেসেন্টের?

 এক মিনিট বলছি। ড্রয়ার থেকে মোটা একটা নোটবই বের করলেন ডাঃ ভাদুড়ী। এতে অদ্ভুত কেস হিস্টরি নোট করে রাখি। .., মিস প্যাটি– প্যাট্রিসিয়া।

আপনার ট্যাংরা মেন্টাল ক্লিনিকে আছে?

 হ্যাঁ। যাবেন একদিন। একটা অভিজ্ঞতা হবে।

 লোকটার কেমন চেহারা বলেনি?

চোখে ঝিলিক দিয়ে হাসলেন ডাঃ ভাদুড়ী। কেন? কোনো রহস্যের গন্ধ পাচ্ছেন নাকি?

হয়তো।

 চেহারার কথা বলেনি। আদায় করতে পারিনি। আপনাকে যা বললাম, ওর অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে আমিই ব্যাপারটা দাঁড় করিয়েছি। তবে ফেথ ফুল ডেসক্রিপশন অফ দা ইনসিডেন্টস।

 আপনি কখন যাবেন ক্লিনিকে?

যাবার সময় হয়ে গেছে কখন।

কর্নেল ঘড়ি দেখে বললেন, আমি আজ একটু ব্যস্ত। নৈলে আপনার সঙ্গে যেতাম। তবে একটা অনুরোধ করব। প্লিজ, এলিয়ট রোড হয়ে আমার বাড়ির পাশ দিয়ে চলুন। এক মিনিট থামবেন। আমি আপনাকে একটা ছবি এনে দেব। আপনি ছবিটা মিস প্যাটিকে দেখাবেন। ওর রিঅ্যাকশনটা আমি জানতে চাই।

ডাঃ ভাদুড়ী অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। দমআটকানো গলায় বললেন, রহস্য ঘনীভূত হলো।….

.

ইন্দু ভটচাযের বিবর্তন

 সুনেত্রা অস্বস্তিতে আড়ষ্ট। হিমাদ্রি সকালেই বাসে চেপে মুঙ্গেরের দিকে কোথায় চলে গেছে। এখন ভয়, যে কোনো সময় পুলিশ না হানা দেয় সুনেত্রাদের বাড়িতে। হয়তো কতলোক জেনে গেছে হিমাদ্রি ফেরারী আসামী এবং সুনেত্রাদের। বাড়িতেই উঠেছিল। আর সবচেয়ে ভয় ইন্দু ভটচাযকে। উনি যদি জানতেন, ঊর্মিকে খুনের দায়ে হিমাদ্রি পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তাহলে কেলেঙ্কারি ঘটে যেত।

তবু সুনেত্রা হিমাদ্রিকে আর দুটো দিন এখানেই লুকিয়ে থাকতে পরামর্শ দিয়েছিল। কলকাতা থেকে কর্নেল এসে গেলে হয়তো হিমাদ্রির আর তত ভয়ের কারণ ছিল না। ওই বুড়ো মানুষটি সম্পর্কে সুনেত্রার বিশ্বাস খুব গভীর। কিন্তু হিমাদ্রি আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পালিয়ে গেল।

সুনয়নী খুব বকাবকি করেছেন মেয়েকে। হিমুটা ছোটবেলা থেকেই ঝামেলা বাধাতে ওস্তাদ। হুট করে ওকে বাড়িতে ডেকে এনে ভাল করেনি সুনেত্রা। তার ওপর চরিত্রহীন বলে বদনাম আছে হিমুর। তার সঙ্গে সুনেত্রার এমন মাখামাখি দেখে নিশ্চয় বাঙালিপাড়া জুড়ে এতক্ষণ ভেতর-ভেতর ঢি ঢি পড়ে গেছে।

সুনয়নীর স্বভাব এই। মায়ের এই বৈপরীত্য দেখতে অভ্যস্ত সুনেত্রা। পাত্তা দেয়নি মাকে। কিন্তু তার অস্বস্তিটা যাচ্ছে না। প্রথম কথা, পুলিশ হয়রানি করতে পারে। দ্বিতীয় কথা, বসন্তনিবাসে ঢোকার মুখ রইল না আর। ও বাড়ির মেয়ের খুনীকে সে ধরিয়ে না দিয়ে পালিয়ে যেতে দিয়েছে কেন?

বিকেলে অস্থির সুনেত্রা বাড়ির পেছনের আগাছাভরা জমিটা পেরিয়ে রেললাইন ডিঙিয়ে নাক বরাবর হেঁটে উঁচু সড়কে উঠল। তারপর গঙ্গার ধারে আকাশিয়া গাছটার তলায় যেতেই চমকে উঠল। অপালা চুপচাপ বসে আছে।

 তাকে দেখে অপালা একবার মুখ ঘোরালো। সুনেত্রা পাশে নগ্ন মাটিতে বসে বলল, এখানে কী করছিস রে অপু? আজ বুঝি তোদের ফার্মে যাসনি?

অপালা মাথা দোলাল। একটু পরে সুনেত্রা আরও অবাক হয়ে টের পেল, অপালা যেন নিরিবিলি বসে কান্নাকাটি করছিল। সুনেত্রা ওর ঘাড়ে হাত রেখে বলল, কী হয়েছে রে?

কিছু না।

সুনেত্রা বুঝতে পারছিল না, হিমাদ্রির ব্যাপারটা অপালা জানে কি না। বলল, উঁহু-নিশ্চয় কিছু হয়েছে। বল না অপু আমাকে? আমি কাউকে বলব না।

অপালা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল হঠাৎ। আমার কেন মরণ হয় না বিবিদি? আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না।

সুনেত্রা ধমক দিল, কাঁদতে লজ্জা করে না পোড়ারমুখী, ধাড়ী লড়কি হয়েছিস! ওই দ্যাখ, লোকেরা তাকাচ্ছে। চোখ মোছ। মুছে ফ্যাল বলছি!

অপালা আস্তে ভাঙা গলায় বলল, আমি সন্ধ্যার ট্রেনে কলকাতায় মামার কাছে চলে যাচ্ছি।

হয়েছে কী, বলবি তো খুলে? ইন্দুকাকা বকেছে?

অপালা চারদিক দেখে নিয়ে চোখ মুছল। তারপর সুনেত্রার একটা হাত ধরে ফিসফিস করে বলে উঠল, তুমিই আমার আসলি দিদি, বিবিদি! তুমি যেন কাউকে বলে দিও না। আমি বাড়ি থেকে ভেগে এসেছি। ছটার ট্রেনে কলকাতা। যাব। মঙ্গলা মাইজির দিব্যি বিবিদি, বোলো না যেন।

বলব না। কেন তুই ভেগে যাচ্ছিস?

অপালা মুখ নামিয়ে আস্তে বলল, ইন্দুকাকা রোজ আমাকে ফার্মে নিয়ে যায় আর আজেবাজে কথা বলে। সে দিন আসবার পথে রতুয়ার টাড়ে সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল। কাল অনেক রাতে আমার ঘরের দরজায় গিয়ে ডাকছিল। আমি দরজা খুলিনি। তখন আমাকে শাসালো।

সুনেত্রা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, তুই কী বলছিস। অপু! ইন্দুকাকা–

অপালা ফুঁসে উঠল। বাবা মার্ডার হবার কিছুদিন পর থেকে ইন্দুকাকা আমার পেছনে লেগেছে। লজ্জায় আমি কাউকে বলতে পারি না, বিবিদি। সময়ে-সময়ে ইচ্ছে করেছে, দিই ওর গলায় ছুরি চালিয়ে। এখন তো বুঝতে পারছি, বাবাকে কে মার্ডার করেছে?

 সুনেত্রা উত্তেজিতভাবে বলল, জানিস? টুকুও সেটা বুঝতে পেরেছিল। আমাকে লিখেছিল সে।

মেজদিকে আমি বলেছিলাম, আমাকে তোমার কাছে নিয়ে গিয়ে রাখো। মেজদি বলেছিল, বড়দি একা পড়ে থাকবে। ওকে সামলাবে কে?

লোকটা–আশ্চর্য, ওকে দেখে মনেও হয় না ভেতর-ভেতর এই। সুনেত্রা সতর্কভাবে চারদিক দেখে নিয়ে বলল। তা তুই তোর মামাকে ইশারায় জানালেও পারতিস?

মামা বিশ্বাস করবে না।

 হ্যাঁ–বিশ্বাস করাও শক্ত।

তুমি জানো? আজ সকালেও আমাকে ফার্মে নিয়ে যেতে চাইছিল। শরীর খারাপ বললাম। তখন গায়ে হাত দিয়ে দেখতে এল। আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। সোজা বলে দিলাম, মামাকে সব লিখে পাঠাচ্ছি।

তখন কী বলল?

 দাঁত বের করে বলল, তোমার মামাই আমাকে সাধছেন তোমাকে বিয়ে করতে!

অসম্ভব। তোর বাবার বয়সী একটা লোক! সুনেত্রা খাপ্পা হয়ে বলল। ওল্ড হ্যাগার্ড! আজ যদি আমার বাবাও বেঁচে থাকতেন রে অপু, দেখতিস ওকে গুলি করে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতেন।

অপালা একটু চুপ করে থাকার পর বলল, আমিও কম নই। আমিই এবার শায়েস্তা করে ফেলতাম ওকে। মারতে মারতে বাড়ি থেকে ভাগিয়ে দিতাম। কিন্তু বড়দির মাথাও তো বিগড়ে দিয়েছে। বড়দি পর্যন্ত ওর দলে।

সুনেত্রা অবাক হয়ে বলল, সে কী রে? খুকুদি ওকে—

কথা কেড়ে অপালা হিসহিস করে বলল, বড়দি ওর কথায় ওঠে বসে। বড়দি কিছুদিন থেকে আমাকে বলছে, আমি তো আর বাঁচব না, অপু। ইন্দুকাকা যা বলবে মেনে চলিস। কক্ষনো ওর অবাধ্য হোসনে। ইন্দুকাকা না থাকলে আজ আমরা ভিখিরি হয়ে যেতাম।

খুকুদি তাই বলছে?

 হ্যাঁ–যখন ভাল থাকে, তখন ওইসব কথা বলে।

 তুই ওকে বলিসনে কেন, লোকটা তোকে

অপালা মুখ নামিয়ে বলল, ছিঃ!

শরম বাজে তোর! নাদান ছোঁকড়ি! সুনেত্রা ঘড়ি দেখল অন্যমনস্কভাবে। তাই চলে যা মামার কাছে। গিয়ে ওঁকে সব খুলে বল। আর আমিও দেখছি, বদমাসটাকে কেমন করে শায়েস্তা করা যায়। পুলিশ খামোকা রঘুয়াকে দায়ী করেছে, এদিকে আসলি খুনী দেবতা সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অপু, টুকুকেও এই ইন্দু ভটচায খুন করে এসেছে জেনে রাখ। স্ট্র্যাটেজি ক্লিয়ার হয়ে গেছে আমার কাছে। তোর বড়দির যা অবস্থা, বেঁচেও না বাঁচার শামিল। টুকু রইল না। বাড়ি আর সম্পত্তির মালিক ছিলি তোরা তিন বোন। এখন যদি তোকে বিয়ে করে ফেলতে পারে, ব্যস! বাচ্চু সিংয়ের মতো লর্ড বনে যাবে ইন্দু ভটচায। হ্যাঁ অপু, ওর মতলব ক্লিয়ার। সে জন্যই তোর বিয়ের চেষ্টা করেনি এতদিন। অন্য কোথাও তোর বিয়ে হলে কী হতে পারত ভেবে দ্যাখ। তোর বর এসে বসন্তনিবাসের মালিক হত। তোদের ফার্মের মালিক হত।…অপু, তুই চলে যা। মামার কাছে। সব কথা খুলে বল ওঁকে। শরম করিসনে।

অপালা বলল, কটা বাজল দেখ তো বিবিদি?

সময় হয়ে গেছে রে! চল, তোকে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি।…

.

মারাত্মক অ্যাডভেঞ্চার

সন্ধ্যায় খানিকটা মেঘ জমেছিল আকাশে। জোরালো বাতাসে এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে গেল। নৈলে বৃষ্টি হত এবং মুশকিলে ফেলত সাধুবাবাকে। মন্দিরতলার পশ্চিমে পোড়া মাঠটাতে বড় বড় পাথর ছড়ানো রয়েছে। পাথরে বসে সাধুবাবা চাঁদ দর্শন করছিলেন মুখ ঘুরিয়ে। নবমীর চাঁদ। মাঝেমাঝে মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, আবার বেরিয়ে পড়ছে। সবে সাড়ে সাতটা বাজে। আর একটু অপেক্ষা করবেন ভাবছিলেন। এখানকার লোকেরা সকাল-সকাল শুয়ে পড়ে যেন। এরই মধ্যে নিঝুম নিশুতি হয়ে গেছে। গাছপালার ফাঁকে জুগজুগ করে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে কোথাও কোথাও। বসন্তনিবাসে দোতলার ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে। আলোটা দেখে উসখুস করছিলেন সাধুবাবা। অলোটা এক রহস্যময়-হাতছানি যেন।

দেবীর ভর ওঠা মেয়েটা আবার বিকেলে মন্দিরতলায় এসেছিল। কিন্তু সাধুবাবাকে দেখামাত্র আবার পাথর হাতে নিয়েছিল। ভয় পেয়ে ওকে ঘটাননি সাধুবাবা। ঘণ্টাখানেক ঠায় বসে থেকে হঠাৎ উঠে চলে গেল হনহন করে। অবেলায় একদঙ্গল লোক জুটেছিল আটচালায়। কেউ ভবঘুরে, কেউ আড্ডাবাজ, কেউ কেউ ধার্মিক। আবার কেউ এসেছিল গাঁজার লোভে। নস্যি দেখে ভড়কে গেল। গঙ্গার দুই তীরে সাধুদের অবাধ এক জগৎ। সেতাপগঞ্জে সাধুরা চোখসওয়া। কিন্তু এই সাধুবাবা ধ্যানে বসেছেন তো বসেই আছেন–হয়তো মৌনীবাবা। তাই শেষপর্যন্ত একে একে নিরাশ হয়ে সবাই কেটে পড়েছিল। তারপর সাতটার মধ্যে শিবুয়া এসে রোটি-ডাল ঔর থোড়াসা সজি দিয়ে গেছে শালপাতায়। মন্দিরতলায় ইঁদারা, টিউবেল সবই আছে। সাধুবাবা জানেন, এখন শিবু ফটকওয়ালা ফটকে আড্ডা জমিয়েছে। ঢোলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তাড়ি বা হাঁড়িয়া গিলছে আর জড়ানো গলায় গান গাইছে একদল লোক।

দিনে বসন্তনিবাসের আনাচে-কানাচে ঘুরে গেছেন সাধুবাবা। পুব আর উত্তর জুড়ে বাগান। চৌহদ্দি ঘিরে ভাঙাচোরা পাঁচিল। মধ্যিখানে প্রকাণ্ড জীর্ণ একটা বাড়ি। সামনের দিকে কয়েকটা মরাই আছে। শিবুয়ার কাছে শুনেছেন, ওখানে একসময় ফুলবাগিচা ছিল। একটা মোটরগাড়িভি ছিল। এখন আর বাড়িটার সে ইজ্জত নেই। এ মুলুকের ক্ষেতিওয়ালা লোকের বাড়ি হয়ে গেছে। ও বাড়ির ছোটি ছোঁকড়িটা তো স্রিফ গাঁওবালি হয়ে উঠেছে।

তর সইছিল না সাধুবাবার। খোয়া ঢাকা নির্জন পথটা ডিঙিয়ে আরেকটা পোড়া এবং আগাছাভরা মাঠ পেরিয়ে বসন্তনিবাসের কাছে পৌঁছে গেলেন। কাঁধে বোঁচকাটা একটু অসুবিধে ঘটিয়েছে। কিন্তু রেখে আসবেনই বা কোথায়? কমণ্ডলুটা ঢুকিয়ে মুশকিল হয়েছে, ওজন যেমন বেড়েছে, তেমনি নড়লেই কেন একটা বিদঘুঁটে শব্দ ঢঙাস্ করে।

আবার মেঘ সরলে চাঁদের আলোয় ভাঙা অংশটা দেখতে পেলেন। উঁকি মেরে দেখলেন, বাগানে কেউ নেই। দোতলার একটা ঘর থেকে খানিকটা আলো তেরচা হয়ে এসে ঘাসের ওপর পড়েছে। কুকুর থাকলে এতক্ষণ সাড়া দিত। অতএব নিশ্চিন্তে ঢোকা যায়।

ওপারে সাবধানে নামলেন। তারপর সেই ফোয়ারার খোঁজে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চললেন সাধুবাবা। জ্যোৎস্না বেশ পরিষ্কার। একটু পরে বাগানের মাঝখানে ফোয়ারা এবং সেই পাথরের মূর্তিটা দেখতে পেলেন। একটু অস্বস্তি হল। এই মূর্তিটা নাকি রাতবিরেতে জ্যান্ত হয়ে বাগানে ঘুরে বেড়ায়।

পাশে একটা মানুষ-সমান উঁচু ঝোপ। ঝোঁপের পাশে বসে পড়লেন সাধুবাবা। তারপর টর্চ বের করে বোঁচকার ভেতর সাবধানে জ্বেলে দেখে নিলেন জ্বলছে। কি না।

মশার উৎপাতে অস্থির। বিহারের মশাগুলো বাঙালি মশাদের চেয়ে তেজী। পরনে মাত্র একটুকরো গেরুয়া কাপড়। খালি গা। ক্রমশ হতাশা ও জ্বালায় নিজের ওপর চটে উঠছিলেন। পাথরের মূর্তিটা জ্যান্ত হতে হতে ফুলে ঢোল হয়ে যাবেন যে!

কতক্ষণ পরে চাঁদটা আবার মেঘে ঢেকে গেল। তারপর হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি। গাছের তলায় যাবার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছেন, সেই সময় ফোয়ারার মূর্তিটার দিক থেকে আবছা কী একটা শব্দ শুনতে পেলেন। কিন্তু কিছু দেখতে পেলেন না। বৃষ্টিটা মিনিটখানেক পরে থেমে গেল। আবার চাঁদ বেরিয়ে পড়ল মেঘের ফাঁকে। তখন বসে পড়লেন আবার।

আবার শব্দটা শোনা গেল। ফোয়ারার মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার ওপাশ থেকেই শব্দটা ভেসে এসেছে। কেউ কিছুঘসছে ঘসঘস করে। থামছে, আবার ঘসছে। ঘস্ ঘস্ ঘস…ঘস্ ঘস…।

ঝোপ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে একটু এগিয়ে ফোয়ারার অন্যপাশে আরেকটা ঝোপে গিয়ে ঢুকলেন সাধুবাবা। এবার দেখলেন, পাথরের কালো মূর্তির পায়ের কাছে কেউ ঘসছে। পরনে শাড়ি, একরাশ খোলা চুল। আবার জ্যোৎস্না ফুটতেই শিউরে উঠলেন সাধুবাবা। সেই মেয়েটাই বটে! একটা লম্বা ছুরিতে শান দিচ্ছে!

এ কী অদ্ভুত রোমহর্ষক ব্যাপার! মাথামুণ্ডু খুঁজে পাচ্ছিলেন না সাধুবাবা। দেখা যাক, ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়।

একটু পরে বাড়ির দোতলার সেই আলো-জ্বলা ঘরের জানালা থেকে কেউ গম্ভীর গলায় ডাকল, খুকু! খুকু! সাড়া না পেয়ে লোকটা সরে গেল জানালা থেকে।

মেয়েটা এবার মূর্তিটার পায়ের কাছে উঠে বসল। তার হাতের ছুরিটা দেখা গেল না আর। কিন্তু ওর হাতে সদ্য শান দেওয়া ছুরিটা নিশ্চয় আছে। শিউরে উঠলেন সাধুবাবা।

তারপর দোতলার ঘরের সেই লোকটাই হবে, খুকু, খুকু বলে ডাকতে ডাকতে বাগানে এগিয়ে এল। তার হাতে জ্বলন্ত টর্চ। সাধুবাবা ঝোপে ঢুকে পড়লেন। উঁকি মেরে দেখতে থাকলেন, লোকটার পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি টর্চের আলো ফেলে মেয়েটাকে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে। আবার ওখানে গিয়ে বসে আছ? ধমক দিল লোকটা। উঠে এস, বলছি। উঠে এস!…কী? কথা কানে যায় না? চাবকে পিঠের ছাল তুলে নেব সেদিনকার মতো।

লোকটা এগিয়ে আসতেই মেয়েটা হি হি হি করে হেসে মূর্তির পায়ের কাছ থেকে নেমে দাঁড়াল। তার হাতের ছুরিটা চকচক করে উঠল। লোকটা চাপা গলায় ধমক দিল ফের, আবার ছুরি নিয়ে বেরিয়েছ? ফেলো, ফেলে দাও বলছি।…ফেললে না? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি মজা! বলে সে মুখ ঘুরিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, শ্যামা! শ্যামা! এদিকে আয় তো শিগগির! চাবুকটা নিয়ে আয়। মেরে ভূত ভাগাচ্ছি হারামজাদী মেয়ের!

অমনি মেয়েটি ছুরি উঁচিয়ে বিকট চিৎকার করে ছুটে গেল লোকটার দিকে। লোকটা দ্রুত সরে না গেলে সাংঘাতিক কাণ্ড হত।

মেয়েটা আবার তাড়া করল ওকে। লোকটা শ্যামা, শ্যামা বলে চাঁচাতে চাঁচাতে বাড়ির দিকে দৌডুল। মেয়েটা আর তাকে অনুসরণ করল না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

একটু পরে বাড়ি থেকে আবার বেরিয়ে এল সেই লোকটা। তার সঙ্গে আরও দুজন লোক আর একটা মেয়ে। সেই লোকটার হাতে চাবুক দেখা যাচ্ছিল। লোকটা চাবুক তুলে সপাৎ করে মারল খুকুকে। খুকু ডুকরে কেঁদে পড়ে গেল। তখন সেই মেয়েটা এসে ওকে ধরে ফেলল। লোকটা চাবুক হাঁকড়ে গর্জাতে থাকল, ছোড় দে মনিয়া! শ্যামা, মাগীকে ধর তো। তারপর দেখছি! দুটোকেই আজ শায়েস্তা করে ভূত ভাগাচ্ছি!

শ্যামা মনিয়াকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। মনিয়া চেঁচিয়ে উঠল, নেমকহারাম! হারামীকাবাচ্চা!

লোকটা সপাং করে চাবুক মারল খুকুকে। খুকু নিঃসাড়। শ্যামা মনিয়াকে ঠেলতে ঠেলতে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল। অন্য লোকটা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। এবার বলল, বাবু! খুব হয়েছে! আর না–আর না। মরে যাবে।

লুঙ্গি-পাঞ্জাবিপরা বাবুটি চাবুক তুলেছিল। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। খুকু উঠে বসেছে। মাথা দোলাতে শুরু করেছে। খোলা চুলগুলো এপাশে-ওপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। খুকু কান্নার সুরে কী বলছে, বোঝা যাচ্ছে না।

বাবু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলল, দয়াল! ওকে নিয়ে এসো তুমি। তারপর বাড়ির দিকে চলে গেল।

দয়াল নামে লোকটা দাঁড়িয়ে রইল খুকুর পিঠের কাছে। সাধুবাবা কাঠ হয়ে বসে আছেন ঝোঁপের ভেতর। একটু পরে শুনলেন, খুকু মাথা দোলাতে দোলাতে বলছে, আমি রুদ্রকে খুন করেছি। ইন্দুকে খুন করব।…সব্বাইকে খুন করব। আমি রক্ত খেয়ে নাচব।…আমি টুকুকে খুন করেছি। অপুকে খুন করব।…আমি সব্বাইর রক্ত খেয়ে নাচব।…আমি শ্যামাকে খুন করব। দয়ালকে খুন করব। সব্বাইকে খুন করব। সব্বাইর রক্ত খেয়ে নাচব।… হি..হি..হি..হি..!

ভুতুড়ে হাসি হাতে হাসতে হঠাৎ সে আবার হিপিয়ে কেঁদে উঠল। তারপর তার শরীরটা বেঁকে আছড়ে পড়ল এবং স্থির হয়ে গেল।

একটু পরে দয়াল ডাকল, খুকু! মা! এবার ওঠ!

খুকুকে সে টেনে ওঠাল। তারপর তার কাধ ধরে বাড়ি নিয়ে গেল। সাধুবাবার এতক্ষণে মনে হল, এতক্ষণ ধরে যে আশ্চর্য নাটকীয় ঘটনা দেখছিলেন, আগাগোড়া সেটা যেন একটা অদ্ভুত স্বপ্ন। দুঃস্বপ্নই বলা যায়।

বসন্তনিবাসে রোজই হয়তো এমন টুকরো টুকরো নাটকীয় ঘটনা ঘটে চলেছে। একটা পুরো নাটকের একটা দৃশ্য খণ্ডিতভাবে দেখা গেল। বাকিটুকু হয়তো বাড়ির ভেতর ঘটছে এতক্ষণ।

কিন্তু এ মুহূর্তে জরুরি হয়ে উঠেছে সেই ছুরিটা খুঁজে বের করা। ওই ছুরি দিয়েই খুকু নামে দেবীর ভর-ওঠা মেয়েটা নিজের বাবা আর বোনকে খুন করেছে। এরপর তার খুনের তালিকায় আরও কয়েকটা নাম আছে। সর্বনাশ! সর্বনাশ! সাধুবাবা মুহুর্মুহু শিউরে উঠছিলেন।

সাবধানে উঠে বাড়ির দিকটা দেখে নিলেন। বাড়িটা অস্বাভাবিক চুপচাপ। দোতলার জানলা থেকে সেই আলোর ফালিটা তেরচা হয়ে বাগানে এসে পড়েছে। সেখানে কেউ নেই দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে সাধুবাবা টর্চ জ্বাললেন। সতর্কভাবে টর্চের আলো পায়ের সামনে ফেলে ছুরিটা খুঁজতে থাকলেন। ওটাই তাহলে আসল মার্ডার উইপন। খুঁজলে এখনও হয়তো দুএকফোঁটা শুকনো রক্তের দাগ মিলতে পারে।

টর্চের আলোয় ঘাসের ভেতর ছুরিটা দেখতে পেয়ে সাধুবাবা সেটা কুড়িয়ে নিতে ঝুঁকেছেন, সেই সময় একঝলক উজ্জ্বল আলো তার ওপর এসে পড়ল। অমনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে দাঁড়ালেন।

যে টর্চ জ্বেলেছিল, সেও থমকে গেছে। রাতবিরেতে বাড়ির বাগানের ভেতর জটাজুটধারী সাধু দেখার আশা সে করেনি। কয়েকসেকেন্ড পরে তার খেয়াল হয়েছে, সাধু যেন ছুরিটাই কুড়োতে হাত বাড়িয়েছিল। ব্যাপারটা গোলমেলে। সে চেঁচিয়ে উঠল, ছোটবাবু! ছোটবাবু! শিগগির আসুন তো!

দোতলায় আলো-জ্বলা জানালা থেকে সাড়া এল, কী রে শ্যামা!

 এক সাধুবাবা ঢুকেছে!

কী ঢুকছে?

 সাধু–সাধুবাবা!

 ধর তো ব্যাটাকে। ধরে রাখ। আমি যাচ্ছি!

শ্যামা এবার সাহস করে তেড়ে এল এবং তার মারমুখী এগিয়ে আসার সামনে আর তিষ্ঠোনেনার মতো নার্ভ রইল না গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদারের। সটান ঘুরে পাঁচিলের সেই ভাঙা জায়গাটার দিকে দৌড়লেন। কিন্তু বয়স হয়েছে। একসময় পুলিশের চাকরিতে এধরনের মারাত্মক অভিজ্ঞতা প্রচুর পরিমাণে অর্জন করলেও এক্ষেত্রে তার ভূমিকাটাই যে বিপরীত! আগে ক্রিমিন্যাল পালাত এবং তার পেছনে পাঁচিল ডিঙিয়েও দৌড়ুতে পারতেন। এখন তাকেই পালাতে হচ্ছে। এবাড়ির ছোটবাবু লোকটার মেজাজ আর রকমসকম যা দেখেছেন একটু আগে, কিছু বলা যায় না। প্রতিমুহূর্তে পিঠে সপাং করে চাবুক পড়ার আশঙ্কা নিয়ে ঝোপঝাড় ভেঙে পাঁচিলের সেই ভাঙা অংশটা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কাঁধের বেঁচকা বিপদ বাধাচ্ছে। সেই সময় চাঁদ ঢেকে আবার কালো মেঘ এবং হাতের টর্চটাও কোনো দুর্বোধ্য কারণে বিগড়ে গেল। গাছপালা ঝোপঝাড়ের ওপর আলো ফেলে শ্যামা চাচাতে দৌড়চ্ছে। ইতিমধ্যে ছোটবাবুও এসে, হাঁকাহাঁকি করছে, চোর! চোর! বাড়িটা শেষপ্রান্তে নিরিবিলি জায়গায় না হলে। এতক্ষণ পাড়ার লোক চারদিক থেকে ঘিরে ফেলত।

ভাঙা পাঁচিলে ওঠার মুহূর্তে শ্যামা পেছন থেকে তার জটা ধরে ফেলল। উপড়ে গেল জটাজুট। তবে কৃতান্তবাবু বেঁচে গেলেন। ওধারে ধপাস করে পড়ে আগাছার ঝোঁপের ভেতর দিয়ে রেললাইনের দিকে দৌডুলেন।

ঠিক দৌড়ুনো নয়–প্রাণের দায়ে পা ফেলা। মাটিটা ভিজে আছে বৃষ্টিতে। আছাড়ও খেলেন। বাষট্টি বছর বয়সেও এই যে এতখানি অ্যাডভেঞ্চার করে ফেললেন, সেটা তিনি পুলিশ ছিলেন বলেই। কেরানিগিরি করলে কি পারতেন? রেলইয়ার্ডে পৌঁছে একটা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ওয়াগনের আড়ালে বসে গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার ছদ্মবেশের বাকি অংশ খুলে বোঁচকা থেকে প্রথমে বের করলেন জুতো, তারপর প্যান্টশার্ট।

একটু পরে সিগারেট ধরিয়ে খিখি করে আপন মনে হাসতে থাকলেন কৃতান্তবাবু। নিজের কীর্তির কথা ভেবেই।

.

টেলিগ্রামের গেরো

আজ সারা দুপুর সারা-বিকেল প্রচণ্ড অস্থিরতায় কাটিয়েছেন কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। সন্ধ্যা অব্দি ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্লডে গাছপালার পরিচর্যা করেছেন আর কানে প্লেনের শব্দ এলেই বাইনোকুলার চোখে রেখে আকাশে দৃষ্টিপাত করেছেন। আকাশে হাল্কা মেঘের ভেতর লুকোচুরি খেলতে-খেলতে আজ কেন যেন সব প্লেনই বিপরীতমুখী! প্রত্যাশিত প্লেনটি আসবে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে। দমদমে মাটি ছোঁবার কথা তিনটে পঞ্চাশে। দুর্ঘটনা ঘটল না তো?

ষষ্ঠী কফি দিতে এসে অবাক হয়ে বলেছিল, কী পাখি বাবামশাই?

তখন কর্নেল হেসে ফেলেছিলেন। মাঝে মাঝে অস্থিরতা তাঁকে বালক করে ফেলে। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের ফ্লাইট নম্বর ২৩১-এ বোয়িং বিমানের পাইলট বদলে যেতেও পারে। অনিন্দ্যর বদলে কোন মালহোত্র কিংবা সিং। আর অনিন্দ্যরও বড্ড ভুলো মন। এইসব ভেবেই মনে অস্থিরতা এত।

রাত আটটায় ফোন করলেন আবার দমদম এয়ারপোর্ট। ইতিপূর্বে দুবারই ফোন করে জেনেছেন, ফ্লাইট লেট। বোম্বে এলাকায় আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ। ফ্লাইট ২৩১ স্থগিত হবার সম্ভাবনা আছে। এতক্ষণে শুনলেন, প্লেনটি টেকঅফ করেছে আধঘণ্টা আগে।

প্রত্যাশিত ফোন এল রাত সওয়া দশটায়। কর্নেল, অনিন্দ্য বলছি। ফ্লাইট সাড়ে ছ ঘণ্টা লেট। যদি না একদঙ্গল ভি আই পি প্যাসেঞ্জার থাকতেন, ফ্লাইট ক্যান্সেল হয়ে যেত।

কর্নেল উত্তেজনা দমন করে বললেন, বুঝতে পেরেছি। খবর বলো, ডার্লিং!

অনিন্দের হাসি ভেসে এল। আমি তো ভাবছিলাম আপনাকে পাব না। কোথায় যেন যাবেন বলেছিলেন আজ?

যাওয়া পিছিয়ে দিয়েছি। যাই হোক, খবর বলো।

 হ্যাঁ, শুনুন। আইটেম বাই আইটেম বলে যাচ্ছি।

কর্নেল ঝটপট কাগজকলম টেনে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ।

 ৯ জুলাই মর্নিং ফ্লাইটের ফ্লাইট নম্বর ২২৭ প্যাসেঞ্জার লিস্টে হেমন্ত বোস নামে এক ভদ্রলোকের নাম আছে। কিন্তু উনি সেদিন দমদম এয়ারপোর্টে চেক ইন করেননি। কোনো খবর দিয়ে বুকিং ক্যান্সেলও করেননি। কাজেই সিট খালি ছিল একটা।

হু–১১ জুলাই?

১১ জুলাই মর্নিং ফ্লাইটে হেমন্ত বোস নামে কোনো যাত্রীর নাম নেই।

মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির নাম আছে তো?

 আছে। উনি চেক ইন করেছিলেন। সিট নম্বর এ-৩৭।

১২ জুলাই?

আমাদের বোম্বে অফিসে ১২ জুলাইয়ের মর্নিং ফ্লাইটে মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির নামে বুকিং করা হয়েছিল ২৬ জুন।

কর্নেল চমকে উঠলেন। ঠিক দেখেছ?

দেখেছি মানে? রেকর্ড চেক করে বলছি। যাই হোক, ১২ জুলাই মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি চেক ইন করেছিলেন। ওর সিট নাম্বার ছিল বি-১৭।

ওই দিনের ওই ফ্লাইটে হেমন্ত বোস নামে কারুর নাম নেই লিস্টে?

না। লিস্টে নেই।

 ওক্কে। হোটেল ডিলাইটে খোঁজ নিয়েছ?

অনিন্দের হাসি শোনা গেল। আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস, কর্নেল। হোটেল ডিলাইটে স্যুট নাম্বার ৭২-এ মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির রিজার্ভেশন ছিল। পৌঁছান ১১ জুলাই বেলা দুটোয়। পরদিন সকাল সাড়ে নটায় চেক আউট করে সোজা এয়ারপোর্টে যান।

চেহারার বর্ণনা কিছু পেয়েছ?

চেষ্টা করেছিলাম। ওদের মনে রাখা সম্ভব নয়। শুধু টেলিফোন অপারেটর বলল, তার মনে আছে, স্যুট নাম্বার ৭২-এ কলকাতা থেকে ট্রাঙ্ককল এসেছিল। বুঝলেন তো? ওদের একটু নাকগলানো স্বভাব–মানে মেয়েদের যা হয়। বলল, বউ মরার খবর এসেছিল। খবর পেয়েই ভদ্রলোক চেক-আউট করেন।

কর্নেল শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, অসংখ্য ধন্যবাদ, ডার্লিং! ওয়েলডান।

আই অ্যাম অলওয়েজ অ্যাট ইওর সার্ভিস, মাই ডিয়ার অল ওল্ড ম্যান! গুডনাইট।

গুডনাইট! কর্নেল শান্তভাবে ফোন রাখলেন। তারপর কাগজে লেখা নোটগুলোর দিকে তাকালেন। হু, সব ঠিক করা ছিল। ১২ জুলাই মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি ফিরে আসবে বলে ২৬ জুন প্লেনের টিকিট কেটে রাখা হয়েছিল বোম্বে থেকে। ওইদিন সকালে যদি গোয়েন্দা ইন্সপেক্টর মোহনবাবু ট্রাঙ্ককল না করতেন, তাও মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি ফিরে আসতেন কলকাতা।

১১ জুলাই রাতে টেলিগ্রাম করেছিল হোটেল ডিলাইট থেকে হেমন্ত বোস। তার মানে, হেমন্ত বোস তখনও জানত না তার মনিবের উদ্দেশ্য কী। মনিবের নামের টিকিটে সে বোম্বে গিয়েছিল। হয়তো কার্গো সম্পর্কে খবর নিয়ে স্বাভাবিক কর্তব্যবোধে জরুরি টেলিগ্রাম করেছিল। হোটেলে মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির নামেই স্যুট বুক করা ছিল। কাজেই তার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি সাজা ছাড়া উপায় ছিল না। ১২ জুলাই সকালে ইন্সপেক্টর মোহনবাবুর ফোন পেয়ে সে চমকে গিয়ে থাকবে। কিন্তু তাহলে একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। ১২ জুলাই মৃগাঙ্কের নামে প্লেনের টিকিট বুক করা ছিল। হেমন্ত যদি জানত একথা, তাহলে আগের রাতে টেলিগ্রাম করল কেন?

কৃতান্ত হালদার সত্যিই একটা অসাধারণ সূত্র হাতে এনে দিয়েছেন। হেমন্ত বোসের টেলিগ্রামটা একটা মূল্যবান ডকুমেন্ট। শিপিং কোম্পানিতে খোঁজ নিলেও নিশ্চয় জানা যাবে হেমন্ত বোসই সেখানে কার্গো সম্পর্কে খবর নিতে গিয়েছিল।

কর্নেল চোখ বুজে দাড়ি টানতে শুরু করলেন।

স্বাভাবিক কর্তব্যবোধেই কি টেলিগ্রামটা করেছিল হেমন্ত বোস? কিন্তু সে তো জানত, ১২ জুলাই তাকে কলকাতা ফিরতে হবে আবার মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি হয়ে। তাহলে কেন সে টেলিগ্রাম করল মৃগাঙ্ক ব্যানার্জির নামে?

হুঁ, টেলিগ্রামটা ছিঁড়ে–শুধু ছিঁড়ে নয়, পুড়িয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন মৃগাঙ্কবাবু। বিব্রত বোধ করেছিলেন কি? ধূর্ত হেমন্ত বোস কি তাকে

কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসলেন। হাত বাড়িয়ে ফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। ডিসি ডিডি অরিজিৎ লাহিড়ী এখন রাত এগারোটায় নিজের ফ্ল্যাটে থাকার সম্ভাবনা।

সাড়া পেলেন সঙ্গে সঙ্গে। কর্নেল বললেন, আশা করি, ঘুম ভাঙাইনি ডার্লিং?

না। গোদারের একটা চিত্রনাট্য পড়ছি। অসাধারণ!

বুঝতে পারছি, তুমি ভবিষ্যতে চাকরি ছেড়ে আর্ট ফিল্ম করবে। পুনা ফিল্ম ইন্সটিটিউটে অর্জিত জ্ঞান-বুদ্ধি কাজে লাগানোর পরিকল্পনা তোমার আছে।

প্রশংসা, না নিন্দা করছেন কে জানে!

 প্রশংসা। তো শোনো

মাই গুডনেস! আপনি সেতাপগঞ্জ যাননি?

যাব। শোনো–কাল এগারোটা নাগাদ একবার সময় করে নাও। তোমাকে নিয়ে একবার বেরুতে চাই। বেশি দূরে নয়। টাংরা অঞ্চলে একটা মেন্টাল ক্লিনিকে।

কী সর্বনাশ! আমার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে আপনি কি সন্দিহান?

ডাঃ অশোক ভাদুড়ী সাইকিয়াট্রিস্টের নাম আশা করি শুনেছ।

 শুনেছি। কিন্তুমাই গড়! আপনি কী বলছেন!

 প্রতিশ্রুতি দিতে পারি, তোমার অভিজ্ঞতাটা হবে অত্যন্ত চমকপ্রদ।

ব্যাপারটা কী খুলে বলুন না প্লিজ! একে তো গোদার গোলমেলেনার্ভের বারোটা বাজিয়ে ছাড়েন ভদ্রলোক, তার ওপর আপনি আরও এককাঠি সরেস। কাল সকালেই ডাঃ ভাদুড়ীর পেসেন্ট করতে চাইছেন আমাকে! ও! হরি!

ডার্লিং, লজিক শাস্ত্রে অবভাসতত্ত্ব বলে একটা টার্ম আছে জান তো? হোয়াট অ্যাপিয়ারস, ইজ নট রিয়্যাল। যাই হোক, আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য।

অরিজিৎ কিছু বলার আগে ফোন রেখে দিলেন কর্নেল। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের পাইলট ক্যাপ্টেন অনিন্দ্য মিত্রের দেওয়া তথ্যগুলোর ওপর আবার চোখ রাখলেন। হুঁ, টেলিগ্রামটা মূল্যবানই বটে।

.

মিস প্যাটির খদ্দের

অরিজিৎ লাহিড়ীর গাড়ি কাটায় কাটায় এগারোটায় এসেছিল। তার মুখে উত্তেজনা ও কৌতূহল থমথম করছিল। কর্নেল তার প্রশ্নের জবাবে শুধু বললেন, তোমাকে একজন মেন্টাল পেসেন্টের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। বাকিটা তুমি ডাঃ ভাদুড়ীর মুখে শুনবে। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়েছেন অরিজিৎ, সেই সময় কেউ চেঁচিয়ে উঠল, কর্নেল স্যার! কর্নেল স্যার!

কর্নেল ঘুরে দেখেন, সবে একটা ট্যাক্সি থেকে নেমে গোয়েন্দা কৃতান্ত হালদার ভাড়া মেটাতে মেটাতে চেরা গলায় ক্রমাগত চ্যাঁচাচ্ছেন, কর্নেল স্যার! কর্নেল স্যার!

কাছে এসে ডিসি ডিডিকে দেখে প্রাক্তন অভ্যাসে খট করে দাঁড়িয়ে সেলাম ঠুকে কৃতান্ত হালদার একগাল হাসলেন। আশাতীত গৌভাগ্য স্যার! দুজনকেই একত্র পেয়ে গেলাম। আর একটু হলেই মিস করতাম।

কর্নেল বললেন, আপনি সেতাপগঞ্জ যাননি?

 সেখান থেকেই তো ফিরছি। কাল রাত নটা দশে ট্রেন ছেড়েছে, হাওড়া পৌঁছুলো দশটায়। উঃ! ছ্যাকরা গাড়িরও অধম।

কর্নেল ছিলেন সামনের দিকে। পেছনের দরজা খুলে দিয়ে বললেন, আসুন!

কৃতান্তবাবু গাড়িতে ঢুকে আরাম করে বসে বললেন, আপনারা কোথায় যাচ্ছেন স্যার?

জবাবটা অরিজিৎ দিলেন। পাগলাগারদে হালদারবাবু! ভেবে দেখুন, কী। করবেন।

খিকখিক করে হাসলেন কৃতান্তবাবু। তা যা বলেছেন স্যার! পাগল করে ছাড়লে ব্যাটারা। বিস্তর ক্রিমিন্যাল ঘেঁটেছি, এমন সাংঘাতিক ক্রিমিন্যাল কখনও দেখিনি!

কার কথা বলছেন হালদারবাবু?

আজ্ঞে, সেতাপগঞ্জের ইন্দু ভট্টাচার্য। আপনি চেনেন কী না জানি না, কর্নেল স্যার চেনেন। উঃ, রোগা মেয়েটাকে আমার চোখের সামনে চাবুক মেরে ফ্ল্যাট করে দিল–চোখে জল এসে যাচ্ছিল স্যার! কিন্তু উপায় ছিল না। তখন আমি বেকায়দায় আছি। সাধুর ছদ্মবেশে। মাথায় জটা, পরনে গেরুয়া একটুকরো বস্ত্র। এদিকে মশার কামড়, বৃষ্টি। বাস্!

কর্নেল ঘুরে তাকালেন কৃতান্তবাবুর দিকে। তখন কৃতান্তবাবু বললেন, হ্যাঁ, গোড়া থেকেই বলছি। সে এক সাংঘাতিক এক্সপিরিয়েন্স বলতে গেলে। গেলাম রহস্যের জট ছাড়াতে–তো আরও জট বেধে গেল। হাল ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম।

কৃতান্ত হালদার সবিস্তারে বলতে শুরু করলেন। ট্যাংরায় ডাঃ ভাদুড়ীর মেন্টাল ক্লিনিকের গেটে তার বিবরণ মোটামুটি শেষ হল। তবে বিশ্লেষণ বাকি থেকে গেল। কথা দিলেন, ফেরার পথে তার বিশ্লেষণ-ভিত্তিক থিওরি তুলে ধরবেন। অরিজিৎ রসিকতা করে বললেন, আপনাকে আমরা এখানে রেখে যাব ভাবছি হালদারবাবু!

কৃতান্ত হালদার মনে বেজায় রুষ্ট। কিন্তু মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, তাহলে তো বেঁচে যাই স্যার! পাগল হওয়ার চেয়ে সুখ নেই।

 তাহলে আপনার ডিটেকটিভ এজেন্সির কী হবে?

কৃতান্তবাবু কী জবাব দিতে যাচ্ছিলেন, ডাঃ ভাদুড়ী অভ্যর্থনা করতে আসায় বাধা পড়ল। মনে মনে যথেষ্ট অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়েই রইলেন কৃতান্ত হালদার। তবে আসার সময় সেতাপগঞ্জ স্টেশনের পাবলিক বুথ থেকে থানায় ফোন করে এসেছেন, রুদ্রে রায়চৌধুরিকে যে ছুরি দিয়ে খুন করা হয়েছিল, সেটা বসন্তনিবাসের বাগানে এখনও পড়ে আছে। শিগগির গেলে সেটা পাওয়া যাবে। আর রুদ্ৰেন্দুবাবুর বড় মেয়েকে জেরা করলেই বেরিয়ে পড়বে আসল কথাটা। নিজের নামধাম বলেননি কৃতান্ত হালদার। শুধু বলেছেন, আমি পুলিশের বন্ধু। দেখা যাক, বিহার ভার্সেস পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের মধ্যে বেধে যায় নাকি। বাধা উচিত। কারণ, মেয়েটা সম্ভবত জানে, একই লোক তার বাবাকে আর বোনকে খুন করেছে। ভর ওঠার সময় আমি খুন করেছি বলছিল বারবার। ওর ওই আমিটা কে, জেরার মুখে বেরিয়ে পড়বেই। আমি নিয়েই যত রহস্য। তবে সে আর যেই হোক, কখনো হিমাদ্রি রায় নয়।…

ডাঃ ভাদুড়ী অফিসে নিয়ে গিয়ে বসালেন। তারপর বললেন, আজ সকাল থেকে পেসেন্টের অবস্থা কিছুটা ভাল। রাতে বিশেষ ডিসটার্ব করেনি। একটু আগে দেখলাম, শুয়ে বই পড়ছে।

অরিজিৎ গম্ভীর। কর্নেল বললেন, ডাঃ ভাদুড়ী, ডি সি সাহেবকে তাহলে ব্যাকগ্রাউন্ডটা শুনিয়ে দিন।

অরিজিৎ তাকালেন। ডাঃ ভাদুড়ী বললেন, কফি আসুক। আপনার রকমসকম তো জানি। কফি না হলে আপনার ব্রেন খোলে না। আর কৈ, একটা বিখ্যাত চুরুট দিন। আমিও ঘিলুকে চাঙ্গা করে নিই।

কফি এসে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। বলা ছিল আগে থেকে। চুরুট টানতে টানতে ডাঃ ভাদুড়ী শুরু করলেন তার এক পেসেন্ট মিস প্যাটির কাহিনী। সবিস্তারে–বেশ খানিকটা রঙ চড়িয়েই।

অরিজিৎ নিষ্পলক তাকিয়ে শুনছিলেন। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। চুমুক দিতে ভুলে গিয়েছিলেন। এবার ঠাণ্ডা কফি গিলে নিয়ে বললেন, কিন্তু লোকটা কে, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না।

ডাঃ ভাদুড়ী বললেন, একমিনিট। এখনও শেষ করিনি।

বলুন।

কর্নেল আমাকে গতকাল একটা ছবি দিয়ে বলেছিলেন, ছবিটা মিস প্যাটিকে দেখিয়ে ওর রিঅ্যাকশন, যেন লক্ষ্য করি। শুনলে অবাক হবেন, ছবি দেখা মাত্র প্যাটি ভায়লেন্ট হয়ে উঠল। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান হলে ফিস ফিস করে বলল, লোকটা আছে, না চলে গেছে?

দেখি ছবিটা।

ড্রয়ার থেকে, ডাঃ ভাদুড়ী ছবিটা বের করে একটু হাসলেন। আপনাকে একটু স্টান্ট দেব স্যার, অপরাধ নেবেন না। প্লিজ, আসুন আমার সঙ্গে। প্যাটিকে আলাদা একটা কেবিনে রেখেছি কাল থেকে। কারণ ভয় ছিল, ছবিটা দেখার পর ওর আরও কিছু রিঅ্যাকশন দফায় দফায় ঘটতে পারে। অন্য পেসেন্টের ক্ষতি করতে পারে।

লম্বা করিডোরের শেষ প্রান্তে একটা ঘরে নিয়ে গেলেন ডাঃ ভাদুড়ী। দরজা বাইরে থেকে লক করা আছে। চাপা গলায় বললেন, বারণ করা ছিল কেউ যেন ভুলেও দরজায় নক না করে। দরকার হলে সাবধানে যেন নিঃশব্দে দরজা খুলে ঢোকে। কিন্তু এবার আমি নক করতে চাই। দেখা যাক, কী ঘটে।

বলে ডাঃ ভাদুড়ী কপাটে তিনবার নক করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে চিৎকার শোনা গেল, নো নো! গো ব্যাক ইউ সোয়াইন! গো ব্যাক! ইউ সন অফ এ বিচ… ডার্টি ডগ… গো ব্যাক অর আই কিল ইউ। তারপর কান্নাজড়ানো গলা–অ্যান্টি! অ্যান্টি! হেল্প মি প্লিজ! হে হে হে! তারপর সব চুপ।

দরজা প্রায় নিঃশব্দে খুলে প্রথমে ঘরে ঢুকলেন ডাঃ ভাদুড়ী। তারপর অরিজিৎ ও কর্নেল। দরজার কাছে ভয়েভয়ে উঁকি মেরে রইলেন কৃতান্তবাবু।

বিছানায় কাত হয়ে পড়ে আছে একটা অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়ে-রোগা লম্বাটে গড়ন। পা দুটো কাঁপছে। দুহাতের নিজের গলাটা আঁকড়ে ধরে আছে। ডাঃ ভাদুড়ী ডাকলেন, মিস প্যাটি! জাস্ট লুক! মিস প্যাটি! ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড, প্লিজ! লুক!

পিঠে হাত রেখে ওকে ঘুরিয়ে চিত করে দিলেন। মিস প্যাটি চোখ পিটপিট করে তাকাল। তারপর উঠে বসল। প্রত্যেকটা মুখের দিকে তাকিয়ে নিয়ে সে যেন আশ্বস্ত হল। তারপর কর্নেলের দিকে তাকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল, ফাদার! সেভ মি ফাদার! আই অ্যাম এ সিনার! ও ফাদার, আই কনফেস!

পেছন থেকে কৃতান্তবাবু ফিসফিসিয়ে উঠলেন, কর্নেলকে পাদ্রীবাবা ভেবেছে। খি খি খি!

অরিজিৎ ঘুরে চোখ কটমটিয়ে তাকালে কৃতান্তবাবু গম্ভীর হলেন। কর্নেল প্যাটির বিছানায় বসে যথার্থ পাদ্রীর ঢঙে ইংরেজিতে বললেন, আমি তোমাকে চার্চে নিয়ে যাব, বাছা! কিছু ভেবো না। আর শোনো, আলাপ করিয়ে দিই। ইনি। হলেন কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের বড়কর্তা। যে লোকটা রোজ এসে তোমার দরজা নক করত আর তুমি দরজা খুললেই তোমার মুখ চেপে ধরে গলায় ছুরির উল্টোপিঠটা ঘসত, তাকে উনি পাকড়াও করে ফেলবেন।

প্যাটি অরিজিৎকে দেখছিল। অরিজিৎ বললেন, হ্যাঁ, তাকে আমরা শিগগির পাকড়াও করছি, মিস প্যাটি!

কর্নেল বললেন, তুমি কি লোকটাকে চিনিয়ে দিতে পারবে, মেয়ে?

প্যাটি আস্তে মাথা দোলাল।

কর্নেল ডাঃ ভাদুড়ীর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে বললেন, তাহলে তুমি এবার বলো, এই ছবির লোকটাই সেই লোক কি না।

প্যাটিকে ছবিটা দেখাতেই সে দুহাতে মুখ ঢেকে চেঁচিয়ে উঠল, ও নো নো! ওকে তোমরা এক্ষুণি জেলে পাঠাও। নৈলে ও আমার শ্বাসনালী কেটে ফেলবে।

কর্নেল একটু হেসে ছবিটা অরিজিতের হাতে হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন, তাহলে এবার আশা করি তুমি শ্রীমতী ঊর্মির খুনীকে গ্রেফতারের হুকুম দেবে, অরিজিৎ!

অরিজিৎ ছবিটা দেখেই চমকে উঠলেন। অন্য কাউকে দেখার আশাই করছিলেন এতক্ষণ। শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে উঠলেন, ও মাই গড! এ যে দেখছি মৃগাঙ্ক ব্যানার্জি! আর সঙ্গে সঙ্গে কৃতান্ত হালদার মাটিছাড়া হয়ে প্রায় চাঁচালেন, আমি জিতে গেছি। আমি জিতে গেছি!

.

 ব্ল্যাকমেলারের শাস্তি

 অফিসঘরে ফিরে এসেছেন সবাই। অরিজিতের মুখ অস্বাভাবিক গম্ভীর। ছবিটা এখনও তার হাতে। ডাঃ ভাদুড়ী আর কৃতান্ত হালদার তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কর্নেল বুঝতে পারছিলেন ডিসি ডিডি খুব ফাঁপরে পড়েছেন। মিনিস্টারের ভাগ্নেকে গ্রেফতারের হুকুম দেওয়া শুধু নয়, এ কেসের মুখ একেবারে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়তো একটু কঠিন। পুলিশ প্রশাসন ঝাঁকুনি খাবে। হিমাদ্রির ছবি ছাপিয়ে পুরস্কার ঘোষণা করে যে হঠকারিতা ঘটানো হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কাগজগুলোও তেড়েমেড়ে আসরে নামবে। অরিজিতের কপালে ঘামের ফোঁটা জমছে।

অরিজিৎ একটা আড়ষ্ট হাত টেবিলের ফোনে রাখলে কর্নেল একটু হেসে বললেন, স্ত্রীর সতীত্বে মৃগাঙ্কের সংশয় ছিল। তাই প্রাইভেট গোয়েন্দা আমাদের এই মিঃ হালদারকে সে স্ত্রীর গতিবিধির খবর নিতে বলেছিল। তারপর নিঃসংশয় হয়ে সে সিদ্ধান্ত করে, একটা ফয়সালা করতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পরে, ডিভোর্সের পথে না গিয়ে সে এই সাংঘাতিক পথে গেল কেন? আসলে এই প্রবণতা নিহিত ছিল তার চরিত্রের ভেতর। সে আজীবন লড়াই করে বড় হয়েছে। তার প্রকৃতি রুক্ষ। ন্যায়-অন্যায় বোধ কম। মামা মন্ত্রী হবার পর স্বভাবত সে বড়লোক হবার সবরকম সুযোগ-সুবিধা লুটে নিতে ছাড়েনি। দুর্নীতির পথে হাঁটতে হাঁটতে একটা পর্যায়ে মানুষের মধ্যে ক্রমশ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য ক্রুরতা জেগে ওঠে। বেপরোয়া হতে থাকে সে। সেই ক্রুরতা আর উদ্ধত সাহসই তাকে অসতী স্ত্রীর প্রতি হিংস্র করে তুলেছিল। সে নিজের হাতে শাস্তি দিতে চেয়েছিল ঊর্মিকে। সেই সময়–গত ১১ এপ্রিল হঠাৎ তার শ্বশুর খুন হয়ে গেলেন। সে ওঁদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে ফেলেছে। অমনি সে ঊর্মিকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিল। বলা যায়, রুদ্ৰেন্দুবাবুর হত্যাকাণ্ড তাকে প্রেরণা যোগাল। হত্যার পদ্ধতি–মোডুস অপারেন্ডি যদি এক হয়, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ঊর্মিদের পারিবারিক ঘটনার সঙ্গে ঊর্মির হত্যাকাণ্ডটাও জড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ বাবার হত্যাকারীই মেয়ের হত্যাকারী সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে গিয়েই সে হিমাদ্রিকে পেয়ে গেল। অথচ সুব্রতের ওপরও তার রাগ ছিল। কারণ কৃতান্তবাবুর কাছে সে জানতে পেরেছিল, সুব্রত তার বউয়ের প্রেমিক। কিন্তু সুব্রতকে জড়াতে গেলে রুদ্রেন্দুবাবুকে খুন করার মোটিভ পাওয়া। যাবে না। মোটিভ শক্ত হওয়া চাই। এদিকে হিমাদ্রির সঙ্গে ঊর্মির প্রণয়ের কথাও সে কৃতান্তবাবুর মারফত জেনে গেছে। সেতাপগঞ্জে যা যা ঘটেছিল তাও তার অজানা নেই। রুদ্রেন্দুবাবু একই কারণে ভিটেছাড়া করেছিলেন হিমাদ্রিদের ফ্যামিলিকে। কাজেই একমাত্র হিমাদ্রির পক্ষেই বাবা ও মেয়েকে হত্যার মোটিভ অত্যন্ত জোরালো। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। নিজের হাতে অসতী স্ত্রীকে শাস্তি দিতে হলে যে নিষ্ঠুর ক্রুরতা থাকা চাই, তা তার আছে। হত্যাপদ্ধতিও একই হবে। তাই সে হাত প্র্যাকটিস করতে চাইল।

কৃতান্ত হালদার বললেন, বুঝে ফেলেছি। ওই অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েটার ওপর দিয়ে হাত প্র্যাকটিস

অরিজিৎ অনুচ্চস্বরে ধমক দিলেন, আঃ! আপনি চুপ করুন তো!

কৃতান্তবাবু ক্ষুব্ধ হয়ে তোক গিয়ে বললেন, বলুন কর্নেল স্যার! প্রথম দিনই আমি বলেছিলাম কি না, মৃগাঙ্কবাবুই খুনী?

কর্নেল বললেন, লোডশেডিং থাকলে দরজা তিনবার নক করা এবং অন্য সময় তিনবার কলিংবেল বাজানো মৃগাঙ্কের অভ্যাস। সেটা রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর কাছে জেনেছি, কিন্তু যেই ঊর্মি দরজা খুলবে, তাকে অমনি নিঃশব্দে এবং কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে খতম করতে হবে শ্বাসনালী কেটে। টু শব্দ করতে দেওয়া হবে না। কারণ পাশের ফ্ল্যাটের একটা কুকুর এবং এক ভদ্রমহিলার বড় নাকগলানো স্বভাব। তাছাড়া উভয়ের কান বড্ড বেশি সজাগ। অতএব হাত প্র্যাকটিশ জরুরি ছিল। সে তখন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের এক বোকাসোকা বারবনিতা মিস প্যাটিকে খুঁজে বের করল।

অরিজিৎ আস্তে বললেন, কিন্তু মৃগাঙ্ক ১১ জুলাই বোম্বেতে ছিল! তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

না। তার নামে প্লেনের টিকিট কাটা হয়েছিল। গিয়েছিল তার প্রতিনিধি হেমন্ত বোস। ১২ জুলাই হোটেল ডিলাইটে যাকে তোমাদের ইন্সপেক্টর মোহনবাবু ট্রাঙ্ককল করে ঊর্মির মৃত্যুসংবাদ দিয়েছিলেন, সে হেমন্ত বোস। কিন্তু হেমন্ত বোস ধুরন্ধর লোক। সে বোম্বে পৌঁছেই একটা টেলিগ্রাম করেছিল মৃগাঙ্ককে। ওটাই তার সেদিন বোম্বেতে থাকার একটা শক্ত এভিডেন্স। সম্ভবত সে ব্যাপারটা টের পেয়েই মৃগাঙ্ককে ব্লাকমেলের ফন্দি এঁটেছিল। টেলিগ্রামটা সে পাঠিয়েছিল তারই সংকেত হিসেবে। চতুর মৃগাঙ্ক বুঝতে পেরেছিল হেমন্তের উদ্দেশ্য।

অরিজিৎ দ্রুত ডায়াল করলেন মৃগাঙ্কের অফিসে। হেমন্তবাবুকে চাইছি! কী? কখন? কী আশ্চর্য! হ্যাঁলা! হ্যালো! হ্যালো!

কর্নেল তাকিয়ে ছিলেন। অরিজিৎ ফোন নামিয়ে রেখে বললেন, হেমন্ত বোস কিছুক্ষণ আগে অফিসের পাঁচতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে।

কৃতান্ত হালদার চেঁচিয়ে উঠলেন, মার্ডার! মার্ডার না হয়ে যায় না!

কর্নেল বললেন, হ্যাঁ–মার্ডার। অরিজিৎ! অরিজিৎ! আর এক মুহূর্তও দেরি নয়। তোমার এবার অনেক জরুরি কাজ এসে গেছে।

অরিজিৎ আবার ফোন তুলে ডায়াল করলেন। এবার লালবাজার সদর দফতরে।