৪. রহস্যময় বাস্তবতা

প্রত্যেকে পান্নাটা পালাক্রমে হাতে নিয়ে একটি রহস্যময় বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টা করছিল। সেই সময় আরিফের জিপ ঢুকল গেটে। জিপ বারান্দার নীচে এসে থামলে নায়ার ছ্যাতরানো গলায় বলে উঠল, “পোড়ি ইয়াকুমু!”

সুমিতের রসিকতার মেজাজ ছিল না। তবু চেষ্টা করল একটু। আড়ষ্ট হেসে বলল, “সড়া অন্ধা’র গল্প হয়ে গেল! ট্র্যান্সলেট করে বল্!”

নায়ার জবাব দিল না। গোঁফে হাত। আরিফ পুলিশ উর্দি পরে এসেছে। চেহারায় এখন সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। হাতে ছোট্ট ব্যাটন। জিপে কয়েকজন পুলিশ বসে আছে। সোমনাথ বলল, “আমি সারেন্ডার করছি। হ্যাঁ–সম্পূর্ণ। নিরস্ত্র অবস্থায়।”

আরিফ খান হাসল। “কী ব্যাপার?”

 ঈশিতা আস্তে বলল, “আমার হাজব্যান্ড কি অ্যারেস্টেড?”

 “কেন?” বলে আরিফ কর্নেলের দিকে তাকাল। “ওটা কী আপনার হাতে?”

কর্নেল বললেন, “পান্না।”

“আমার চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ–” সোমনাথ আবৃত্তি করে বলল, ‘আ কোট ফ্রম রবিঠাকুর। তবে হ্যাঃ! বাপের জন্মে পান্না-টান্না আমি দেখিনি। আমার বাবা শুনেছি মাসিক পঞ্চান্ন টাকার স্কুলটিচার ছিলেন। ইংরিজি কাগজে আমি সপ্তায় একটা হাজার শব্দের ফিচার লিখি। কদাচিৎ মাসে একটা বই রিভিউ। প্রফেশনে হাফগেরস্থ। কাজেই পান্না আমার চেতনা-টেতনার মধ্যে পড়ে না। য়ুরি গেলারের মতো অতীন্দ্রিয় শক্তি ছিল ওই ভদ্রলোকের–রবিঠাকুর! বড় জোর বলা চলে বোধ-হ্যাঃ! মাথার ভিতরে/স্বপ্ন নয় প্রেম নয় কোনো এক বোধ কাজ করে। আ কোট ফ্রম জীবনানন্দ দাশ।”

ঈশিতা ঠোঁট কামড়ে ধরে তাকিয়ে ছিল শূন্যদৃষ্টে। নায়ার গোঁফে হাত দিয়ে ঢেকে গোল চোখে সোমনাথকে দেখছিল। ক্রিস্নান, নীপা, সুমিত রুষ্ট আর বিরক্ত মুখে একবার সোমনাথ একবার আরিফ একবার কর্নেল এবং একবার পুলিশ-জিপটার দিকে তাকাচ্ছিল। পর্যায়ক্রমে।

সোমনাথ সিগারেট ধরানোর জন্য চুপ করলে আরিফ কর্নেলকে বলল “ওটা কি হ্যাভারস্যাক?”

কর্নেল দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “ইউ আর রাইট, ডার্লিং!”

“আপনি ‘হাওয়াই আড্ডির জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছেন তা হলে?” আরিফ হ্যাভারস্যাকটার মাথাটা খুলেই নাকে হাত চাপা দিল। “বিশ্রী দুর্গন্ধ! ভেতরে এসব কী? রঙিন মার্বেল পেপারের কুচি মনে হচ্ছে। কিন্তু এই কুচিগুলো কিছুতেই সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের সময়কার নয়?”

“তা তো নয়ই।”

“পান্নাটা এর মধ্যে ছিল?”

“হুঁ। দৈবাৎ একটা থেকে গিয়েছিল কিংবা–” কর্নেল হাসলেন। “আমেরিক্যান সোলজারদের এই কালো পুরু প্লাস্টিকের হ্যাভারস্যাক আমার খুবই চেনা। বর্মার জঙ্গলে মার্কিন ‘লং রেঞ্জ পেনিট্রেশন গ্রুপ’–এল আর টি পি-কে এগুলো দেওয়া হত। তাদের আগেও একটা গেরিলা গ্রুপ ছিল। সাংকেতিক নাম ‘চিনডিট। যাই হোক, এখানকার সেই মার্কিন ঘাঁটির কদর্য জঙ্গলে আমি ঢুকিনি। এই বাংলোর পেছনে হাথিয়া নদী কিছুক্ষণ আগে এটা আমাকে উপহার দিয়েছে। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হল, কোনও শব্দ করে না। ভাঙলেও নিঃশব্দে ভেঙে যায়।”

সোমনাথ কথা বলার সুযোগ পেল। “তো কেউ আমাকে ফাসাতে চাইছে। আমাদের পুরনো বন্ধু আরিফ খান এখন অফিসিয়ালি অন ডিউটি। কাজেই আমি একটা স্টেটমেন্ট দেব। হাঁ! লিখিতভাবেই দেব। সই করব–সাক্ষীসহ। বাংলা ইংরিজি যে-কোনোও ভাষায়।”

আরিফ ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল, “আপাতত তার দরকার নেই। সংক্ষেপে বলো। বাট প্লিজ! মাইনাস ইওর ম্যানারিজম। কারণ তা উপভোগ্য হলেও আমার হাতে সময় কম। খুব ব্যস্ত আমি।”

সোমনাথ একটু ক্ষুব্ধ হল। “ম্যানারিজম? না না, এটা যথাযথ ইউসেজ নয়। স্টাইল বললেও আপত্তি থাকত না। ‘স্টাইল ইজ দা ম্যান। প্রত্যেকের নিজস্ব ল্যাংগুয়েজ আছে। যার যার, তার তারটা।”

নায়ার বলে উঠল “আওয়ান তুলাইয়া টে!” তার মুখে রাগ ফুঁসছে। জোরে শ্বাস ছাড়ল।

“ধুস্ ‘সড়া অন্ধা’! সুমিত চটে গেল। কর্নেলকে বলল, “আপনিই বলুন স্যার!”

কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। কালো পুরনো হ্যাভারস্যাকটা হাতে নিয়ে বললেন, “চলো! যেতে-যেতে বলছি।”

জিপ উৎরাই শেষ করার সময় কর্নেলের ঘটনার বিবরণ শেষ হয়ে গেল। আরিফ বলল, “ইভনিং ভিলায় এরকম হ্যাভারস্যাক থাকা সম্ভব। আপনাকে ওই অন্ধ ভদ্রলোক সর্বেশ রায়ের কথা বলেছি।”

“আমেরিকান সাব?” কর্নেল হাসলেন। “ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

“একটু প্রব্লেম হতে পারে।” আরিফ চিন্তিতভাবে বলল। “উনি কারও সঙ্গে কথা বলেন না। মেশেন না। গত রাত্তিরে আমি অবশ্য ওঁকে মিট করতে ইনসিস্ট করিনি। মিঃ বোসের মুখে ওঁর সম্পর্কে যেটুকু শুনেছি, দ্যাটস অল।”

“বাইরে বেরোন না উনি?”

“জানি না। জেনে নিতে অসুবিধা নেই। তবে অন্ধ মানুষের পক্ষে কারও সাহায্য ছাড়া পায়ে হেঁটে বেরুনো সম্ভব নয়। বেরুলে নিশ্চয় গাড়িতে।”

“ওঁর গাড়ি আছে জানো কি?”

“ইভনিং ভিলায় দুটো গাড়ি আছে। একটা ভিনটেজ কার। মিঃ বোস ওটা ব্যবহার করেন। লাস্ট কার র‍্যালিতে দেখেছি। এখান থেকে ভায়া জামশেদপুর ক্যালকাটা অ্যান্ড ব্যাক। অন্য গাড়িটা মারুতি। মিসেস বোসই ওটা ব্যবহার করেন। কয়েকবার ওঁকে নিজেও ড্রাইভ করতে দেখেছি। একজন ড্রাইভার অবশ্য আছে। শ্যামলাল নাম। আরিফ কর্নেলের দিকে ঘুরল। শ্যামলাল আপনার ক্লায়েন্ট বসন্ত হাজরার বডি শনাক্ত করেছে।”

“তুমি বলছিলে হাসপাতালের সুইপার রঙ্গিয়া।”

“হ্যাঁ। প্রথমে রঙ্গিয়া। সরি!” আরিফ হাসল। “আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। রঙ্গিয়াই রাত্তিরে বলেছিল, সবজিকাটরা বস্তির শ্যামলালও লোকটাকে চিনতে পারে। কারণ শ্যামলালের মা হাসপাতালে যখন ভর্তি ছিল, বসন্ত হাজরা তার সঙ্গে একদিন বুড়িকে দেখতে গিয়েছিল। পরে বুড়ি মারা যায়। রাত্তিরেই থানায় এস আই সতীশবাবুকে এই দায়িত্ব দিয়েছিলাম। উনি শ্যামলালকে মিট করতে পারেননি। সে রাত্তিরে নাকি ইভিনিং ভিলায় ছিল। মিঃ বোস ইজ আ বিগ গাই, ইউ নো। সকালে সতীশবাবু শ্যামলালকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। মর্গে নিয়ে যান। শ্যামলাল বলেছে, বসন্ত হাজরা ভবঘুরে টাইপ লোক। কখনও কখনও বছরে দু’একবার তার বাড়ি আসত। ফের চলে যেত।”

“শ্যামলালের সঙ্গে তার কী করে আলাপ হল, বলেনি?”

আরিফ গাম্ভীর্যের ভান করে বলল, “মাই ডিয়ার ওল্ড বস! পুলিশ অত ফুলিশ সম্ভবত নয়।”

কর্নেল হাসলেন। “কখনই নয়। তবে আজকাল যা অবস্থা, পুলিশকে ফুলিশ সেজে থাকতে হয়। একদিকে রাম, অন্যদিকে রাবণ। ক্রসফায়ারের মধ্যে পড়ে গেছে। কাজেই মেক আ চয়েস। হয় রাম, নয়তো রাবণ।”

“অসাধারণ বলেছেন।” আরিফের মুখে হাসি ফুটল। “এনিওয়ে, শ্যামলালের মা নাকি বসন্ত হাজরাকে চিনত। কী সূত্রে চিনত, শ্যামলাল জানে না। লোকটা এলে নাকি শ্যামলাল বিরক্ত হত।”

“তুমি বলেছ রঙ্গিয়া চিনত তার স্বামীর বন্ধু হিসেবে।”

“হ্যাঁ। প্রব্লেম হল, রঙ্গিয়ার স্বামী নানকুও বেঁচে নেই এবং রঙ্গিয়া এর বেশি কিছু জানে না।”

“তুমি একজন বুদ্ধিমান ও দক্ষ পুলিশ অফিসার। তুমি ডিটেকটিভ ডিপার্টেও ছিলে।” কর্নেল চোখে বাইনোকুলার তুলে বললেন, “তোমার কি মনে হয়েছে। রঙ্গিয়া সত্য কথা বলছে?”

“বলা কঠিন। আপনি ওর সঙ্গে কথা বলতে পারেন।”

বইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল বললেন, “বাই এনি চান্স, আরিফ, তুমি। চিতাবাঘের পায়ের তলায় এই হ্যাভারস্যাকটা দেখেছিলে কি?”

“লক্ষ করিনি। করলে বলতাম।”

 “এই বুড়ো তোমাকে বের করছে!” কর্নেল স্বভাবমতো অট্টহাসি হাসলেন। “আসলে বাহাত্তুরে ধরেছে আমাকে।”

ইভনিং ভিলার গেটে জিপ থামাল আরিফ। ডানদিক থেকে কর্নেল হ্যাভারস্যাকটা নিয়ে নামলেন। লোহার গরাদ দেওয়া প্রকাণ্ড গেট। আরিফ তার লোকেদের বসে থাকতে বলে গেটের কাছে গেল। বলল, “এখানে রক্তের স্পট ছিল। ধুয়ে ফেলেছে দেখছি। এই তো জল ঢালা হয়েছে।”

কর্নেল বললেন, “ধোয়ার আগে আমি দেখে গেছি। মর্নিংওয়াকে বেরিয়ে এখান দিয়ে সোজা জঙ্গল পেরিয়ে হাথিয়া নদীতে গিয়েছিলুম। নদীর ওপারে। লালঘুঘুর আঁক দেখা উদ্দেশ্য ছিল।”

“আপনার লালঘুঘুর প্রতি আসক্তি আছে শুনেছি।” আরিফ ঘড়ি দেখল। “কিন্তু গেটে দুজন কনস্টেবল থাকার কথা ছিল।”

কর্নেল বললেন, “ওই যে তারা ভেতরে চা খাচ্ছে।”

ইভনিং ভিলার ভেতরটা প্রায় জঙ্গল বলা চলে। একফালি পথ চড়াইয়ে উঠে গিয়ে দোতলা বাড়ির পোর্টকোর তলা দিয়ে ঘুরে একখানে এসে মিলেছে। তাই পোর্টিকোর সামনেকার জায়গাটা তিনকোনা এবং সেখানে ঘন বর্মিবাঁশের জঙ্গল, ও একটা মৃত ফোয়ারা। ফোয়ারার মার্বেল ফাটা। বুনো ঝোঁপ গজিয়ে আছে। ফোয়ারার মাথায় একটা কবন্ধ মূর্তি। নগ্ন নারী। একটা হাত ভাঙা অন্যহাতে কুম্ভ। পোর্টিকোর থাম ঘেঁষে প্রচণ্ড লাল বোগেনভিলিয়া। বাঁদিকে খোলা ঘাসজমিতে দুজন কনস্টেবল চা খাচ্ছিল। কাপ নামিয়ে রেখে হন্তদন্ত ছুটে এসে সেলাম দিল এবং গেট খুলল।

আরিফ বলল, “বোস সাব হ্যায়?”

একজন কনস্টেবল বলল, “জি।” অন্যজন খবর দিতেই দৌড়ে গেল। কিন্তু চড়াইটা তার পক্ষে বিপত্তিকর। এলোমেলো নুড়িপাথরে ভর্তি পথ।

কর্নেল একটু হেসে বললেন, “বোঝা যাচ্ছে কেন মিঃ মুখার্জি রিস্ক নিতে চাননি। তাকে কলকাতা ফিরতে হবে অক্ষত গাড়ি নিয়ে। আরিফ! বড্ড বেশি নুড়ি ফেলা হয়েছে। তাই না? বিশেষ করে ধারালো নুড়ি জিপের পক্ষে অলরাইট। কিন্তু ভিনটেজ কার এবং মারুতির মতো গাড়ির পক্ষে রিস্কি। এখানে-ওখানে গর্তও দেখছি!”

আরিফের সঙ্গে কর্নেল ভেতরে ঢুকে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। আরিফ আস্তে বলল, “আমি ইভনিং ভিলায় কাল বিকেলে প্রথম ঢুকেছি। আমারও অবাক লেগেছিল।”

কর্নেল ঝুঁকে নুড়ি পাথরগুলো দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “খুব সম্প্রতি নতুন করে নুড়িপাথর ফেলা হয়েছে। অথচ এই গর্তগুলো–এ কি ইচ্ছাকৃত? একটা বিপজ্জনক রাস্তা দেখছি।”

আরিফ বলল, “বাঁদিকে এই ঘাসের ওপর রক্তের ছাপ ছিল। ধুয়ে দিয়েছে। বসন্ত হাজরা মার খেয়ে স্বাভাবিকভাবেই নুড়ির ওপর দিয়ে ছুটে যায়নি। ঘাসের। ওপর দিয়ে গিয়েছিল। আসুন, কোথায়-কোথায় রক্ত ছিল দেখাচ্ছি। হ্যাঁ, জল ঢেলে ধুয়ে দিয়েছে। এই দেখুন, ঘাসের নীচে মাটি ভিজে হয়ে আছে।”

সে জায়গাগুলো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে হাঁটছিল। কর্নেল বললেন, “গেটে দারোয়ান থাকে না। এও অদ্ভুত!”

আরিফ বলল, “মিঃ বোস বলছিলেন, দারোয়ান ছুটিতে গিয়ে আসছে না। তাই গণেশ গেটে তালা দিয়ে রাখে। কোনও বিগ গাই বা চেনাজানা কেউ এলে আগে ফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে রাখে। কাল বিকেলে বীতশোক বাংলো থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করল। আমাকেও যেতে বলল। আমারও একটু কৌতূহল ছিল বলতে পারেন।” আরিফ হঠাৎ আস্তে বলল, “জাস্ট পার্সোনাল এনথুসিয়াসিজম। মিঃ বোসের সঙ্গে নানা জায়গায় মিট করেছি। ওঁর মিসেসের সঙ্গেও।” সে হাসল, “ইউ নো বস, আইম আ বিট রোম্যান্টিক।”

“হুঁ!” কর্নেল বাইনোকুলারে পাখি খুঁজছিলেন হাঁটতে হাঁটতে। “বাড়িটা ক্যাসলটাইপ। র‍্যাদার–আ ফ্রেঞ্চ শাতো। দক্ষিণে ফ্রান্সের মোরোতে অবিকল এরকম স্থাপত্য দেখেছি। তো মিঃ দাশগুপ্ত নিশ্চয় এই ঘাসের ওপর দিয়ে যাতায়াত করেছিলেন?”

“সোমনাথ? হ্যাঁ–সেটাই স্বাভাবিক। কাল বিকেলে আমরা সবাই এই ঘাসের ওপর দিয়ে গিয়েছি এবং ফিরে এসেছি।”

কর্নেল আবার দাঁড়ালেন। ডার্লিং! এ যে দেখছি একটা বিশাল ভূসম্পত্তি! আমার ধারণা, তিরিশ একরের বেশি হবে। পুরো একটা টিলা পাহাড়ের মাথা কেটে বাড়িটা তৈরি। বাউন্ডারি ওয়াল জেলখানার মতো উঁচু। আমি নিশ্চিত, এ বাড়ির একটা রীতিমতো ইতিহাস আছে। ইট মে বি সেনসেশন্যাল।” কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে বললেন, “আমেরিকান সাব’ একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ করে চোখে পড়ে না। ক্যামোফ্লাজটা সম্ভবত মার্কিন সেনাদের দেখে শেখা। নেহাত শখ ছাড়া কী বলা যাবে? এইরকম সবুজ ছোপ দেওয়া মেটে রঙের শার্ট, স্যাডো দেওয়া গ্রে প্যান্ট। চোখের কালো চশমা গাছের গাঢ় ছায়ায় মিশে থাকে। ডার্লিং” বাইনোকুলার নামালেন কর্নেল। বললেন, “হি ইজ নট আ ম্যান, জাস্ট অ্যান ইমেজ অব আ ম্যান। আ ফসিলাইজড বডি। লোকটি সত্যি অদ্ভুত।”

আরিফ আস্তে বলল, “মিসেস বোস উত্তরের ব্যালকনির দোতলায়।”

“হু! দেখেছি। প্রকৃত সুন্দরী বলা চলে।”

“বয়স অনুমান করতে পারেন?”

“আমি চিরকুমার, ডার্লিং! তুমি বলো।”

“পঁচিশ থেকে আঠাশের মধ্যে।” আরিফ জোর দিয়ে বলল। “কিন্তু মিঃ বোস ইজ অ্যাবাউট ফর্টিফাইভ টু ফর্টিএইট। আরও বেশি হতেও পারে। বাট হি লুস্ ইয়াং।”

গাড়িবারান্দায় পাঁচটি ধাপ। হলঘরের দরজা খোলা। কর্নেল ও আরিফ বারান্দায় উঠলে ভেতর থেকে কেউ ভারী গলায় বলল, “ওয়েলকাম মিঃ খান।”

আরিফ পরিচয় করিয়ে দিল কর্নেলের সঙ্গে। ফায়ারপ্লেসের কাছে লাল ভেলভেটের গদি আঁটা সিংহাসন-ধাঁচের চেয়ার থেকে উঠে বোসসায়েব হ্যান্ডশেক করে একটু তাকাতে সোফা দেখিয়ে বললেন, “বসুন।”

প্রথম দর্শনেই কর্নেলের মনে হল লোকটি দাম্ভিক। কর্নেল কালো চিতাটার দিকে তাকালেন। বললেন, “ব্ল্যাক প্যান্থার! কী আশ্চর্য!”

 “হ্যাঁ! তবে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। বাই দা বাই, ব্যানার্জি বলছিল, আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ?” বোসসায়েব পাইপে তামাক ভরতে থাকলেন।

“না মিঃ বোস। আমি একজন নেচারিস্ট।”

“আমার লুকোবার কিছু নেই। আপনি যা জানতে চান, জিজ্ঞেস করতে পারেন।” বোসসায়েব লাইটারে পাইপ ধরিয়ে বললেন, “আজ আমি একটু ব্যস্ত। মিঃ খানের খাতিরে কথা দিয়েছি। মেক ইট উইদিন আ ম্যাক্সিমাম অফ টুয়েন্টি মিনিটস।”

“আজ সন্ধ্যায় আপনার ককটেল ডিনার।” কর্নেল ঘরের ভেতরটা দেখতে দেখতে বললেন, “সেটা কি এখানেই হবে?”

“নিশ্চয় না। ওদিকে গেস্টহাউস আছে, লন আছে। ইউ নিড এনাফ স্পেস ফর আ পার্টি।” বোসসায়েব ঠোঁটে পাইপ কামড়ে ধরে বললেন, “ব্যানার্জিকে বলে দিয়েছি, আপনাকে ইনভাইট করবে। দেখা হয়নি তার সঙ্গে? না বললেও কথা নেই। ইউ আর ওয়েলকাম। আমি বলছি। মিঃ খান, ইউ প্লিজ মাস্ট কাম। বেগমসায়েবাকে আনতে ভুলবেন না যেন। ইউ প্রমিজড, আঁ?”

আরিফ বলল, “দেখা যাক,।”

“নো, নো দেখা যাক।” বোসসায়েব একটু ঝুঁকে এলেন। “মিঃ প্রাইভেট ডিটেকটিভ কি রক্ত খুঁজছেন? ধুয়ে ফেলা হয়েছে। কী খুঁজছেন আপনি?”

কর্নেল সোফার তলার দিকে গুঁড়ি মেরে বললেন, “একটা ডটপেন।”

 “হোয়াট?”

 “হু। পেয়ে গেছি।

 “আপনার হাত থেকে পড়ে গেছে আই থিং?”

“নাহ্। এটা আমার নয়। তবে এটা পড়ে থাকার কথা ছিল। পেয়ে গেলুম।” কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ডটপেনটা খুব সাধারণ, কমদামি। কাজেই আপনারও নয়।”

“তা হলে কাল বিকেলে ব্যানার্জির বন্ধুরা কেউ ফেলে গেছে। এক ভদ্রলোক নাকি সিগারেটের প্যাকেট ফেলে গিয়েছিলেন। তাই না মিঃ খান।”

আরিফ মাথা দোলাল। কর্নেল হ্যাভারস্যাকটা সোফায় রেখে কালো চিতাটার কাছে গেলেন। বোসসায়েবের ঠোঁটের কোনায় বাঁকা হাসি ফুটে উঠল। কর্নেল স্টাকরা চিতার সামনের দু পায়ের ফাঁকটা দেখতে দেখতে বললেন, “এখানে একটু একটু রক্ত থেকে গেছে, মিঃ বোস!”

বোসসায়েব ভারী গলায় ডাকলেন, “গণেশ!”

ভেতরের দরজার পর্দা তুলে একজন তাগড়াই চেহারার লোক উঁকি দিয়ে বলল, “চা আসছে স্যার!” তারপর সে সোফায় রাখা হ্যাভারস্যাকটার দিকে তাকিয়ে রইল।

বোসসায়েব ধমক দিলেন। “হাঁ করে কী দেখছিস? ওখানে রক্ত না কী আছে, ধুয়ে দে।”

“কোথায় স্যার?”

 কর্নেল বললেন, “এখানে।”

 গণেশ বিরক্তমুক্ত বলল, “ওখানে রক্ত গেল কী করে?”

 বোসসায়েব গলার ভেতর বললেন, “যে-ভাবে হোক, গেছে। ধুয়ে দে এক্ষুনি।”

গণেশ চলে গেলে কর্নেল এসে সোফায় বসলেন। বললেন, “কাল বিকেলে ওখানে একটা পুরনো মার্কিন মিলিটারি হ্যাভারস্যাক ছিল। কতকটা ড্রাইসেল ব্যাটারির গড়ন। এই যে এইটা। দেখুন তো, চিনতে পারেন নাকি।”

“নাহ।” বোসসায়েব নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে গোঁফের একটা পাশ টানতে টানতে বললেন, “এ ঘরে কত কিছু থাকতে পারে। সো হোয়াট?”

“আপনি কি এমন কোনও জিনিস দেখেছেন? এটা ইভনিং ভিলাতেই থাকার কথা।”

“নাহ্। আমি প্রাইভেট ডিটেকটিভ নই। এভরিহোয়্যার-পোকিংনোজ-টাইপের লোকেরা হয়তো–”

“ইভনিং ভিলায় আপনি কত বছর আছেন মিঃ বোস?”

বোসসায়েবের চোখ আবার নিষ্পলক হয়ে গেল। একটু পরে বললেন, “এ বাড়ি নাইনটিন ফাইভে তৈরি। গেটে দেখে নেবেন।”

আমার প্রশ্নের উত্তর হল না কিন্তু।”

 “সিন্স মাই চাইল্ডহুড, এটুকু বলতে পারি।”

 “বাড়িটা কে তৈরি করেছিলেন জানেন কি?”

বোসসায়েব একটা ভুরু তুলে বাঁকা হেসে বললেন, “আপনি জানেন মনে হচ্ছে? বেশ তো, আপনিই বলুন।”

একটি দেহাতি চেহারার মেয়ে চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। সোফার টেবিলে রেখে বিনীতভাবে বলল, “লালুর বাবা আসবে আখুনি। বুঢ়াসাব আভি ডাকল। হাথ মালিশ করতে গেল।”

বোসসায়েব বললেন, “ঠিক আছে। তুই যা, মিঃ খান! চা নিন।”

 মেয়েটি কর্নেলের দিকে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।

আরিফ চায়ের কাপ নিল। কর্নেল বললেন, “থ্যাংকস্! আমি চা খাই না।”

 “বলুন, আর কী প্রশ্ন আছে? আমি ব্যস্ত।”

“মিঃ রায়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।”

“হি উইল নট অবলাইজ ইউ, কর্নেল–”

 “কর্নেল নীলাদ্রি সরকার।”

“কর্নেল সরকার, মাই ব্রাদার-ইন-ল ডাজ টক।”

 “আশা করি তিনি বোবা নন?”

“ফর ইওর ইনফরমেশন, উনি বোবা। ডাকাতরা ওঁকে শুধু অন্ধ করে দেয়নি, জিভও কেটে নিয়েছিল।”

আরিফ বলল, “ইজ ইট?”

“হ্যাঁ মিঃ খান।” বোসসায়েব হেলান দিলেন। “আমার দুর্ভাগ্য, সে-রাতে আমি কলকাতায় ছিলুম।”

আরিফ বলল, “শুনেছি বছর দশেক আগের ঘটনা এটা?”

 “এগারো বছর।”

কর্নেল বললেন, “তখন কি আপনি ব্যাচেলার ছিলেন?”

বোসসায়েব শুকনো হাসলেন। “হ্যাঁ। আমি বিয়ে করেছি মাত্র তিন বছর আগে।”

কর্নল চুরুট বের করে ধরালেন। “তা হলে মিঃ বোস, আপনার বিয়েরও আট বছর আগে মিঃ রায় এবাড়িতে ছিলেন। সম্ভবত তার কাজিন মিস রত্না রায়ও তার কাছে থাকতেন। এর একটাই মানে হয়, ওঁরা এ বাড়িতে আপনার আশ্রিত ছিলেন। কিন্তু আমার ইনফরমেশন, আপনিই এ বাড়িতে আশ্রিত। ছিলেন। কোনটা ঠিক?”

 “দেখুন মশাই!” বোসসায়েব ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, “কে একজন ভবঘুরে মার খেয়ে এ বাড়িতে শেল্টার নিতে এসে দৈবাৎ মারা পড়েছে। তার সঙ্গে যদি আমাকে জড়ানো হয়, হোক। মিঃ খান আমাকে অ্যারেস্ট করতে পারেন, করুন। যা হবার, কোর্টে হবে। কিন্তু সরি! আপনার এ সব কদর্য প্রশ্নের জবাব দিতে আমি বাধ্য নই। মিঃ খান। দিস ইজ বিয়ন্ড দা লিমিট।”

আরিফ দৃষ্টি নামিয়ে চায়ে চুমুক দিল। কর্নেল বললেন, “আমার শেষ প্রশ্ন মিঃ বোস! দয়া করে উত্তেজিত হবেন না। আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনার বিন্দুমাত্র ক্ষতি করার ইচ্ছা আমার নেই।”

কর্নেলের কণ্ঠস্বরে একটু আবেগ ছিল। বোসসায়েব আস্তে কিন্তু ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, “বলুন! কিন্তু আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করলে জবাব দেব না। নেহাত মিঃ খানের খাতিরে আমি এতগুলো কথা খরচ করেছি।”

“বাড়ির গেট থেকে পোর্টিকো পর্যন্ত রাস্তায় কোনও গাড়ি যাতায়াত করুক, এটা আপনি চান না। কেন?”

“ননসেন্স। এটা অ্যাবসার্ড কোয়েশ্চেন।”

“না মিঃ বোস! অতি সম্প্রতি নতুন করে প্রচুর নুড়ি ফেলা হয়েছে।” কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। “তা ছাড়া এ ধরনের ধারালো নুড়ি কেউ লনের রাস্তায় ফেলে না। এবং অত সব গর্ত! কাজেই আমার ধারণা, আপনি চান না কোনও গাড়ি যাতায়াত করুক।”

আরিফ উঠে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, “জিপ যাতায়াতের অবশ্য অসুবিধা নেই।”

কর্নেল বললেন, “হ্যাঁ। কিন্তু কোনও ভাল গাড়ি–লাক্সারি কার, বিশেষ করে মারুতি, কনটেসা, ওয়েল! ধন্যবাদ মিঃ বোস! আপনি অসন্তুষ্ট হলেও আমি নির্লজ্জের মতো আপনার ককটেল-ডিনারে আসছি। জেন্টলম্যান’স ওয়ার্ড, মিঃ বোস! আপনি নেমন্তন্ন করে ফেলেছেন এবং আমি তা অ্যাকসেপ্ট করেছি।”

বোসসায়েব চুপচাপ বসে রইলেন। আরিফ বলল, “চলি মিঃ বোস! দেখা হবে!”

বোসসায়েব শুধু মাথাটা দোলালেন। বেরিয়ে এসে কর্নেল পোর্টিকোর সামনেকার ফোয়ারার দিকে এগিয়ে গেলেন। ফুট আট-নয়েক চওড়া নুড়ি ঢাকা পথটা পেরিয়ে যেতে হল তাকে। ফোয়ারার গোল মঞ্চের নীচে চারদিকে বৃত্তাকার শুকনো গভীর গর্ত। উঁচু ঘাস, ঝোঁপঝাড় এবং বর্মিবাশের জঙ্গল সেই খুদে প্রাক্তন জলাধারটি ঘিরে রেখেছে। উঁকি মেরে দেখে চলে এলেন কর্নেল। আরিফ বলল, “কিছু থাকার কথা ছিল কি?”

কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “ছিল। কিন্তু নেই। বাই দা বাই, বসন্ত হাজরার পায়ে জুতো ছিল না। তাই তো?”

আরিফ বলল, “সেটা স্বাভাবিক। মার খেয়ে এবং তাড়া খেয়ে পালানো লোকের পক্ষে

বাধা দিয়ে কর্নেল বললেন, “বাইরে রাস্তায় কোথাও তার জুতো পাওনি কিন্তু।”

“হাথিয়াগড়ে প্রচুর ভবঘুরে এবং ভিখিরি আছে। জুতো পড়ে থাকলে কুড়িয়ে নেবার লোকের অভাব নেই।”

 কর্নেল চোখে বাইনোকুলার রেখে বললেন, “ফোয়ারার একধারে ঘাসগুলো বেঁকে ঝুঁকে পড়েছে শুকনো ট্যাংকে। আগামী বর্ষার আগে সেগুলো সোজা হচ্ছে না। ঘাসগুলোর ডাটা ভেঙে গেছে দেখলুম। আরিফ, কেউ কাল বিকেলে ওখানে লুকিয়ে ছিল। ট্যাংকের তলা শুকনো হলেও আবছা ছাপ পড়েছে জুতোর। হ্যাঁ, একজোড়া জুতো ওখানে থাকা উচিত ছিল।”

আরিফ বলল, “হোয়াট অ্যাবাউট দা ডট-পেন?”

কর্নেল হাসলেন। বললেন, “সোমনাথ দাশগুপ্তের চারমিনার প্যাকেটের ভেতরকার কাগজটা ছেঁড়া এবং সেটাই পাওয়া গেছে বসন্ত হাজরার পকেটে দেশলাইয়ের ভেতর রোল করা অবস্থায়। ওতে আমার নাম-ঠিকানা লেখা আছে। বসন্ত হাজরার কাছে তোমরা কোনও ডট-পেন পাওনি। কাজেই একটা ডটপেন দরকার ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সেটা হাত থেকে পড়ে যাওয়ারই কথা।”

“কিন্তু ফোয়ারার তলায় জুতোর ব্যাপারটা কী?”

কর্নেল বললেন, “দ্যাটস অ্যান আইডিয়া। যাই হোক, চলো। রঙ্গিয়া-দর্শনে যাওয়া যাক।”..