৫. ঘণ্টা বাজলো
এক-এক করে কত দিন কেটে গেছে। যেন কোনো অতিপ্রাকৃত উত্তেজনা তাকে এসে অধিকার করেছে–তাই রোগশয্যা ছেড়ে কেমন করে যেন উঠেছেন মাস্টার জাকারিয়ুস, আবার কাজে হাত দিয়েছেন তিনি–যেন কোনো অমানুষিক শক্তি পেয়েছেন তিনি কোনোখান থেকে। যেন তার অহংকারই তাকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু জেরাঁদ আর নিজেকে প্রতারিত করলো না–তার পিতার দেহ ও মন চিরকালের মতো কোনো দুঃস্বপ্নের মধ্যে হারিয়ে গেছে, এটা সে অবশেষে মেনে নিলো। পোয্য কিংবা নির্ভরশীলদের কথা মোটেই চিন্তা না-করে জাকারিয়ুস তার শেষ কপদকটুকু পর্যন্ত এক জায়গায় জড়ো করেছেন। কোনো-এক অস্বাভাবিক বল পেয়েছেন যেন তিনি কোত্থেকে–অফুরন্ত যেন তার উৎস : তার হাঁটা-চলায়, কাজ-কর্মে, কথাবার্তায় তা-ই ফুটে বেরোয়–আর সবসময় বিড়বিড় করে অস্ফুট ভাবে কী যে বলেন তিনি–তার সব কথা স্পষ্ট বোঝাও যায় না।
একদিন সকালে জেরাঁদ তার কারখানা ঘরে গিয়ে দ্যাখে যে, তিনি সেখানে নেই। সারাদিন সে তার জন্যে অপেক্ষা করে কাটালো-কিন্তু মাস্টার জাকারিয়ুস আর ফিরে এলেন না। সে বিলাপ করলো সারা দিন, কিন্তু তার বাবা আর ফিরলেন না।
সমস্ত জেনিভা তন্নতন্ন করে খুঁজেও ওবের যখন তাঁকে কোথাও পেলো, তখন এটা অনুমান করা গেলো যে, তিনি শহর ছেড়েই চলে গেছেন।
কিন্তু খুঁজে তাকে বের করতেই হবে, ওবের বিষণ্ণ খবরটা পৌঁছে দিতেই জেরাঁদ কেঁদে উঠলো।
কোথায় যেতে পারেন তিনি? নিজেকে শুধোলো ওবের।
হঠাৎ কোত্থেকে যেন এক প্রেরণা এলো তার মনে। মাস্টার জাকারিয়ুসের শেষ কথাগুলি মনে পড়ে গেলো তার। যে-একটি পুরোনো লোহার ঘড়ি এখনো ফেরত আসেনি, তার প্রাণ নাকি কেবল তার মধ্যেই রয়েছে এখন? নিশ্চয়ই তিনি সেই ঘড়িটারই সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন।
ওবের তার ধারণা খুলে বললো জেরাঁদাকে।
বাবার হিশেবের খাতাটা দেখলেই তো হয়, জেরাঁদ বললো।
তক্ষুনি জাকারিয়ুসের কারখানা-ঘরে গিয়ে ঢুকলো তারা। হিশেবের খাতাটা খোলাই পড়েছিলো একটি বেঞ্চির উপর। বিকল হয়ে গেছে বলে জাকারিয়ুসের তৈরি সবগুলি ঘড়িই ফিরে এসেছিলো, লাল কালি দিয়ে সেগুলি তিনি কেটে রেখেছেন–কেবল একটি বাদে।
মসিঁয় পিত্তোনাচ্চিয়োর কাছে ঘণ্টা আর সচল মূর্তি সমেত একটি লোহার ঘড়ি বিক্রি করা হলো; আন্দেরনাৎ-এ তার বাগানবাড়িতে পাঠানো হয়েছে সেটা।
এটাই হলো সেই আদর্শ ঘড়ি স্কলাস্টিকা যার সম্বন্ধে সোৎসাহে বাত্ময় হয়ে ওঠে।
নিশ্চয়ই বাবা সেখানে গেছেন, বললো জেরাঁদ।
চলো, আমরাও সেখানে যাই, ওবের উত্তর দিলো, হয়তো এখনো তাকে বাঁচানো যাবে!
প্রাণে বাঁচবেন না বটে, অস্ফুট স্বরে বললো জেরাঁদ, কিন্তু অন্তত তার । আত্মা রক্ষা পেতে পারে।
কী সর্বনাশ! জেরাঁদ, আন্দেরনাৎ-এর বাগানবাড়িটা কোথায়, তা জানো? দেনস-দু-মিদির গিরিসংকটে–জেনিভা থেকে যেতে কুড়ি ঘণ্টা লাগে। চলো, আর দেরি নয়, এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে আমাদের।
লেমান্ হ্রদের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে যে-পথটা দিগন্তের দিকে চলে গেছে, সেই দিনই সন্ধ্যাবেলায় স্কলাস্টিকাকে সঙ্গে নিয়ে ওবের আর জেরাঁদ সেই পথে রওনা হয়ে পড়লো। সে-রাত্রে পাঁচ লিগ পথ পেরিয়ে এলো-বেসঁজ বা এরমাস মেঅর-দের বিখ্যাত বাগানবাড়ি–কোথাও তারা থামলো না। অনেক কষ্টে তারা হেঁটেই পেরোলো ভঁজ-এর পাহাড়ি নদী–আর যেখানেই গেলো সেখানেই জাকারিয়ুসের খোঁজ নিলো তারা, এবং একটু পরেই এটা বুঝতে পারলো যে ঠিক পথেই তারা যাচ্ছে, কোনো ভুল করেনি।
পরের দিন ভোরবেলায় তোন পেরিয়ে এভিয়াতে এসে পৌঁছোলো তারা–আর মাত্র বারো লিগ দূরে সুইজারল্যাণ্ডের সীমান্ত। কিন্তু বাগদত্তা এই যুবক-যুবতী এই ভুবন-মোহন সম্ভাবনাটার কথা একবার ভেবেও দেখলো না। সোজা তারা সামনে দিকে এগিয়ে গেলো–যেন কোনো অমানুষিক শক্তি তাদের হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলেছে। ওবেরের হাতে একটি বাঁকা ছড়ি রয়েছে; কখনো জেরাঁদকে, কখনো-বা স্কলাস্টিকাকে হাত ধরে-ধরে নিয়ে যাচ্ছে সে; তারা যাতে কোনোরকমে অবসাদে বা শ্রান্তিতে ভেঙে-না পড়ে, যথেষ্ট চেষ্টা করেছে সে-বিষয়ে। আর তাদের গভীর বেদনা ও অমল প্রত্যাশার কথা নদীর ধারের এই সুন্দর পথটিতে বারে বারে মুখর হয়ে উঠলো। হ্রদের দুই পাড় যেখানে শ্যালেই-এর উচ্চতায় এসে পড়েছে, অবশেষে সেই উঁচু ও সংকীর্ণ মালভূমিতে এসে পৌঁছুলো তারা। তারপর দ্রুত এসে পৌঁছুলো ব্যুভের-এ-রোননদী আর জেনিভা হ্রদের সংগম যেটা।
ব্যুভের চেড়ে আসার সঙ্গে-সঙ্গে হ্রদের পাশ থেকে বেঁকে দূরে চলে গেলো তাদের পথ। আর এই পাহাড়ি পথে তাদের শ্রান্তি ও অবসাদ ক্রমেই বেড়ে যেতে লাগলো। একে-একে তারা পেরিয়ে এলো জনবিরল পাহাড়ি গ্রামগুলি–ফিয়োনাৎস, শেস, আর কলম্বে। তাদের হাঁটুর জোড়া খুলে আসতে চাচ্ছে তখন, গ্রানাইট পাথরের মতো শক্ত ও বন্ধুর পাহাড়ি পথে চলায় বেশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে তাদের পা–কিন্তু তবু মাস্টার জাকারিয়ুসের কোনো সন্ধান নেই কোথাও।
কিন্তু খুঁজে তাকে বের করতেই হবে। তাই তারা কোনো ক্ষুদ্র পল্লি বা মোতা-র প্রমোদবীথিকায় বিশ্রাম নেবার কথা ভাবতে পারলে না। অথচ এই প্রমোদবীথিকাই বিস্তৃত হয়ে দূরের দিকে গেছে এখান থেকে, আর একদা শ্যাভয়-এর মার্গারিৎ এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অবশেষে, অবসাদে তারা যখন অর্ধমৃত সেই সময়ে নোত্র-দাম-দু সেক্স-এর মঠে পৌঁছুলো তারা। দেন-দু মিদির ঠিক তলাতেই এই বীথিকা, রোননদী ঠিক ছশো ফিট উপরে।
রাত করে এসেছে তখন; তিন পথিকের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করে দিলেন যাজক। তখন তাদের আর এক পাও যাবার ক্ষমতা নেই, ফলে এখানে বিশ্রাম নিতে তারা বাধ্যই হলো একরকম।
যাজকটি কিন্তু মাস্টার জাকারিয়ুসের কোনো খবরই দিতে পারলেন না। কী-রকম যেন বিষাদ ভরা এই নিঃসঙ্গ পাহাড়ি পথ–এখানে যদি কোথাও তিনি পড়ে গিয়ে মরেও যান, কেউ তার কোনো খোঁজই পাবে না। বাইরে গভীর অন্ধকার করে এলো, আর হাওয়া যেন ক্ষুধিতের মতো গর্জন করে ফিরলো পাহাড়ের গায়ে-গায়ে-চূড়া থেকে ধস নেমে পড়লো প্রকাণ্ড চীৎকার করে–যেন এই আঁধার রাতে হঠাৎ ক্ষুব্ধ পাহাড়টি তার সুপ্তি ভেঙে জেগে উঠেছে।
যাজকের চুল্লির সামনে কুঁকড়ে বসে ওবের আর জেরাঁদ ধীরে-ধীরে তাঁকে এই করুণ ও শোকার্ত কাহিনীটি খুলে বললো। তুষার ঝরে পড়েছিলো তাদের পোশাকে–এক কোনায় সেগুলি শুকোচ্ছে। আর বাইরে চাঁদের এক রাঙা-ভাঙা টুকরো দেখে ডুকরে কেঁদে উঠছে মঠের কুকুরটি–আর বাইরের ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে সেই বিলাপ যেন অদ্ভুতভাবে মিশে যাচ্ছে।
দম্ভ,আস্তে-আস্তে যাজকটি তার অতিথিদের বললেন, দম্ভই এক দেবতার ধ্বংস ঘটিয়েছিলো একদা। এই ভয়ংকর দেয়ালের গায়েই মানুষের অদৃষ্ট বারে বারে আছড়ে পড়ে মাথা কোটে। দম্ভ কি আর কোনো যুক্তির কথা শোনে! অহংকারের চেয়ে সর্বনেশে অধর্ম আর কিছু নেই, কেননা তার স্বভাবই হচ্ছে কোনো কথায় কর্ণপাত না-করা। তোমার বাবার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া
আর-কিছুই করার নেই।
চারজনে যেই নতজানু হয়ে বসেছে, অমনি বাইরে কুকুরটি হঠাৎ দ্বিগুণ জোরে ডুকরে-উঠলো : কে যেন মঠের দুয়ারে এসে সজোরে ধাক্কা দিচ্ছে।
খোলো, দরজা খোলো-শয়তানের নামে বলছি, দরজা খোলো–
হঠাৎ প্রবল করাঘাতে দরজা খুলে গেলো, আর জীর্ণ বসনপরা বিস্রস্ত ও উদ্ভ্রান্ত কে একজন এসে দাঁড়ালো ঘরের মধ্যে।
বাবা! তুমি! জেরাঁদ চেঁচিয়ে উঠলো।
সত্যি, মাস্টার জাকারিয়ুসই বটে।
কোথায় আছি আমি, জানো? উদ্ভ্রান্ত গলায় বলে উঠলেন জাকারিয়ুস। অসীমের মধ্যে–চিরন্তনতায়। সময় থেমে গেছে–আর কোনোদিনও ঘণ্টা বাজবে না–সমস্ত ঘড়ির কাঁটাগুলি খশে পড়লো!
বাবা! মেয়ের এই করুণ আর্তনাদই বোধকরি বৃদ্ধকে হঠাৎ জীবিতের জগতে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। জেরাঁদ? তুমি এখানে। চেঁচিয়ে উঠলেন জাকারিয়ুস, আর ওবের? তুমিও। ওঃ, বাদত্ত বলে এই পুরোনো গিঞ্জেয় বিয়ে করতে এসেছে তোমরা।
বাবা, তার হাত ধরে অনুনয় করলো জেরাঁদ, ফিরে এসো, আমাদের সঙ্গে জেনিভায় ফিরে এসো তুমি।
হ্যাঁচকা টানে হাত ছিনিয়ে নিলেন জাকারিয়ুস তারপর ক্ষিপ্র গতিতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন; বাইরে তখন অজস্র ধারায় বড়ো-বড়ো তুষার ঝরে পড়ছে।
সন্তানদের ত্যাগ করে যাবেন না, ওবের চীৎকার করে বললো।
কেন ফিরবো? যেন মূর্তিমান বিষাদ কোনো বিষম দূর থেকে কথা বলে উঠলো। যেখানে আমার জীবন আর নেই, যেখানে আমার একটা অংশ চিরকালের মতো সমাহিত হয়ে গেছে, সেখানে আর কীসের জন্য ফিরে আসবো?
কিন্তু আপনার আত্মা? সে তো মরেনি! জানি তার চাকাটা ভালো আছে–তার টিকটিক আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি–
আত্মা তো কোনো অচিৎ পর্দায় নয়–সে অবিনশ্বর, সে চিরন্তন,তীব্র স্বরে বলে উঠলেন যাজক।
হ্যাঁ, ঠিক আমার মহিমার মতো। কিন্তু সে এখন আন্দেরনাৎ-এর প্রমোদবীথিকায় বন্দী হয়ে আছে–আমি তাকে দেখতে চাই আবার মুখোমুখি দেখতে চাই তাকে।
বুকে ক্রুশ আঁকলেন যাজক; স্কলাস্টিকা কেমন নির্জীব হয়ে পড়লো হঠাৎ, ওবের জেরাঁদকে জড়িয়ে ধরলো।
আন্দেরনাৎ-এর সেই কেল্লায় যে থাকে, সে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে–সে অভিশপ্ত–তার উদ্ধারের কোনো উপায়ই নেই। সে ক্রুশকে সম্মান করে না–তার মুক্তি হবে কেমন করে?
বাবা, যেয়ো না ওখানে, যেয়ো না!
আমার আত্মাকে ফিরে চাই আমি। আমার আত্মা তো আমারই–
ধরো ওকে, আটকাও, জেরাঁদ চীৎকার করে উঠলো।
কিন্তু এক লাফে চৌকাঠ ডিঙিয়ে বাইরে চলে গেলেন বৃদ্ধ। রাতের অন্ধকারে কেবল এক অফুরন্ত আর্তনাদ শোনো গেলো : আত্মা, আমার আত্মা, আমার আত্মা…
জেরাঁদ, ওবের আর স্কলাস্টিকা–তিনজনেই তাঁর পিছন-পিছন ছুটলো। দুর্গম এখানকার পথ, কুটিল আর জটিল আর কষ্টকর। আর সেই পথ ধরেই যাচ্ছেন মাস্টার জাকারিয়ুস, যেন কোনো ক্ষিপ্ত ঝড় বয়ে যাচ্ছে, যেন কোনো ভয়ংকার চুম্বক তাকে সবেগে টান দিয়েছে। পরম আক্রোশে তুষার ঝরছে তাদের উপর, শাদা টুকরোগুলি ঝড়ে উড়ে যাচ্ছে শুভ্র হিম অঙ্গারের মতো।
থীবান বাহিনীর ভীষণ সংহারের স্মরণে যে-গির্জেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তার পাশ দিয়ে যাবার সময় তাড়াতাড়ি তারা বুকে ক্রুশ এঁকে দিল। কিন্তু মাস্টার জাকারিয়ুসকে কোথাও দেখা গেলো না।
সেই বন্ধ্যা ভূমিতে অবশেষে অন্ধকারের মধ্যে এফিয়োনাৎস নামে ক্ষুদ্র পল্লিটি জেগে উঠলো। ভীষণ নির্জনতার মধ্যে এই ক্ষুদ্র পল্লিটি দেখে অত্যন্ত কঠোর লোকও কেঁপে উঠতো। বৃদ্ধ কিন্তু ঝড়ের মতো এগিয়ে চললেন দেন-দুমিদির গিরিখাতে, যেখানে তার তীক্ষ্ণ চূড়া আকাশকে ভেদ করে উঠে গেছে, তার গভীরে তিনি ছুটে চললেন উম্মত্তের মতো।
শীগগিরই জীর্ণ, কাতর ও মলিন একটি কেল্লার ধ্বংসস্তূপ দেখা গেলো চুড়ায়, নিচে ধারালো পাথরের টুকরোর মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে পথ চলে গেছে তার উদ্দেশে।
ওই যে–ওই যে আমার আত্মা! ক্ষিপ্তের মতো ছুটতে-ছুটতে আর্তস্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন জাকারিয়ুস।
আন্দেরনাৎ-এর কেল্লাটির ধ্বংসই কেবল তখন আছে। প্রচণ্ড স্থূলাকার স্তম্ভ উঠে গেছে কেল্লার উপর-নড়বোড়ে সেই স্তম্ভটা হাওয়ায় দুলছে কেবল এখন–যে-কোনো মুহূর্তে সমস্ত চুরমার করে কেল্লার ছাতে ভেঙে পড়ে যাবে। গভীরতর কোনো আর্তনাদ যেন কালো পাথরের সেই বিশাল স্তূপে মূর্তি পেয়েছে। কালো-কালো কতগুলি মস্ত হলঘর দাঁড়িয়ে আছে সেই ভগ্নাবশেষের মধ্যে–পাথর কেটে-কেটে খিলেন তৈরি হয়েছিলো একদা, এখন তাতে গর্ত গজিয়েছে অংসখ্য, কুণ্ডলী পাকিয়ে গোখরোরা শুয়ে আছে সেখানে।
জঞ্জাল ভরা এক পরিখার মুখে কেল্লায় যাবার গুপ্তদ্বার। কে যে এই কেল্লায়। থাকে, কেউ তা জানে না। নিশ্চয়ই কোনো আধা-দস্যু আধা-অভিজাত জার্মান ধনপতির প্রমাদবীথিকা ছিলো এটা একদা–পরে কোনো দস্যুদল বা জাল টাকা নির্মাতারা এসে আশ্রয় নিয়েছিলো এখানে-শেষে তাদের এখানেই ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। কিংবদন্তি বলে যে শীতের রাতে স্বয়ং শয়তান এসে তার ভয়ংকর নৃত্যসভা বসায় এই গিরিখাতে–এই ধ্বংসস্তূপের ছায়া যেখানে অতিকায়ভাবে কেঁপে-কেঁপে উঠে সেই ভীষণ নাচে যোগ দেয়।
কিন্তু এই অলুক্ষুণে জনরব জাকারিয়ুসকে একটুও দমাতে পারলো না। গুপ্তদ্বারের কাছে গিয়ে পৌঁছুলেন তিনি–কেউ তাকে কোনো বাধা দিলো না বা নিষেধ করলো না। মস্ত একটা স্তব্ধ মলিন উঠোনে এসে পৌঁছুলেন তিনি–কেউ তাঁকে সেটা পেরিয়ে যেতে নিষেধ করলো না। সেই অধোগামী উঠোন পেরিয়ে লম্বা একটা বারান্দায় এসে পড়লেন জাকরিয়ুস। বড়ো-বড়ো থাম আর খিলেনগুলি যেন দিনের আলোকে নির্বাসন পাঠিয়েছে এখান থেকে। চিরন্তন আঁধারের মধ্যে হাওয়া যেন ভারি হয়ে আছে এখানে। জাকারিয়ুসকে কেউ কোনো বাধা দিলো না। তাঁর একটু পিছনেই আসছে জেরাঁদ, ওবের আর স্কলাস্টিকা।
যেন কোনো অপ্রতিরোধ্য হাত তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, আর তাই বুঝি মাস্টার জাকারিয়ুসের মোটেই পথ ভুল হচ্ছে না; তিনি যেন নিশ্চিত করে জানেন তার পথ, আর তাই এখন ক্ষিপ্র প্রায়ে এগিয়ে যেতে পারছেন। পোকায় কাটা, ঘুণধরা একটা পুরোনো দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি; তাঁর প্রবল করাঘাতে দরজার পাল্লা ভেঙে পড়লো, আর মাথার উপরে পাখা ঝাঁপটে অদ্ভুত বৃত্ত এঁকে উড়তে লাগলো বাদুড় ও চামচিকে।
ঘরটা মস্ত-বিরাট একটা হলঘর আসলে : অন্য ঘরগুলির চেয়ে অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন। খিলেনগুলিতে স্থাপত্যকর্মের নিদর্শন কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে সাপ, কিস্তৃত ও বিকট সব প্রেতমূর্তি, আরো নানা অদ্ভুত অপজীব–বিশৃঙ্খল ও ভয়ংকরভাবে তারা ভিড় করে আছে দেয়ালে। লম্বা সরু কতগুলি ঘুলঘুলির মতো জানলা–পাল্লাগুলি ঝোড়ো হাওয়ায় যেন শিউরে শিউরে উঠছে।
হলঘরটার মাঝখানে পৌঁছে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলেন মাস্টার জাকারিয়ুস। লোহার আংটা দিয়ে দেয়ালের গায়ে টাঙানো আছে সেই ঘড়িটা, যার উপর তার প্রাণ নির্ভর করছে। অতুলনীয় তাঁর এই কীর্তি : প্রাচীন কোনো রোমক মন্দিরের মতো তার গঠন, পেটা লোহার গায়ে ঠেশ দিয়ে আছে সে, ঠেশ দিয়ে আছে তার ভারি ঘণ্টাস্তম্ভ : আর যখন এখানে ঘণ্টা বেজে ওঠে তখন যেন তার ঢং ঢং আওয়াজে প্রার্থনাসভার গানের সুর বেজে ওঠে। এই তার পরমায়ু–এই ঘড়িটা। মন্দিরের দুয়ারের উপরে একটা গোলাপ বসানো, আর তারই মাঝখান থেকে বেরিয়েছে ঘড়ির দুটি কাটা, আর তারই পাপড়িগুলোর চারপাশে বারো ঘণ্টার বারোটি অঙ্ক বসানো–ঘণ্টা যখন বেজে ওঠে, মন্দিরের দুয়ার যেন খুলে যায় মন্ত্রবলে। দরজা আর গোলাপের মাঝখানে, স্কলাস্টিকা যেমন বলেছিলো সেই অনুযায়ী, অনুশসান ফুটে ওঠে তলিপিতে-দিনের বিভিন্ন সময়ে সর্বোবস্থায় আচরণীয় বিভিন্ন অনুশাসন ফুটে ওঠে। একদা সত্যিকার কোনো খ্রিষ্টানের মতো কোনো-এক ঐশী প্রেরণায় আশ্চর্য। এই ঘড়িটি বানিয়েছিলে মাস্টার জাকারিয়ুস, যার প্রতিটি জিনিশ ধর্মপুস্তকের সংহিতা মেনে তৈরি করা হয়েছিলো; প্রার্থনা, স্তব, বিনোদ, নীতিবাক্য, অনুশাসন–সর্বত্রই এক ধর্মীয় যাপন নিষ্ঠা ও শৃঙ্খলার ছাপ : এই ঘড়ির নির্দেশ অনুযায়ী কেউ যদি জীবনযাপন করে, তাহলে তার ত্রাণ অবশ্যম্ভাবী।
উল্লাসে মাস্টার জাকারিয়ুস যেন নেশাতুর হয়ে পড়েছেন। তাড়াতাড়ি তিনি ঘড়িটা দখল করবার জন্য এগিয়ে গেলেন, আর এমনি সময়ে ঠিক যেন তাঁর পাশেই বিকট রোলে কে অট্টহাসি করে উঠলো।
ঘুরে দাঁড়িয়ে, ধোঁয়া-ওঠা এক বাতির আলোয় জাকারিয়ুস দ্যাখেন জেনিভার সেই ভীষণ বামনটি!
তুমি? তুমি এখানে? চীৎকার করে উঠলেন জাকারিয়ুস।
ভয়ে জেরাঁদ যেন কুঁকড়ে গেলো। ওবেরের গা ঘেঁষে দাঁড়ালো সে।
আপনাকে শুভদিন জানাই, মাস্টার জাকারিয়ুস,শয়তানের মতো ভয়ংকর লোকটা বলে উঠলো।
কে? কে তুমি?
সেনর পিত্তোনাচ্চিয়ো–আপনার সেবার জন্য অধীন সর্বদাই প্রস্তুত। আপনার কন্যাকে আমার হাতে তুলে দিতে এসেছেন? আমি যে বলেছিলুম, জেরাঁদের সঙ্গে কিছুতেই ওবেরের বিয়ে হবে না, তা আপনার মনে পড়েছে। তাহলে!
পিত্তোনাচ্চিয়োর দিকে সবেগে ছুটে গেলো ওবের–কিন্তু ছায়ার মতো সে সরে গেলো এক পাশে।
থামো, ওবের! জাকারিয়ুস চেঁচিয়ে উঠলেন।
শুভরাত্রি, বলে পিত্তোনাচ্চিয়ো অদৃশ্য হয়ে গেলো।
বাবা, চলো, এই জঘন্য জায়গাটা থেকে পালিয়ে যাই। কাতরভাবে অনুনয় করলো জেরাঁদ : বাবা!
কিন্তু মাস্টার জাকারিয়ুস আর সে-ঘরে তখন নেই। ভাঙাচোরা বারান্দা দিয়ে তিনি তখন পিত্তোনাচ্চিয়োর ছায়ার পিছনে ছুটেছেন। স্কলাস্টিকা, জেরাঁদ আর ওবের সেই ভীষণ হলঘরে স্তম্ভিতের মতো হতবা দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর একটা পাথরের আসনে চেতনা হারিয়ে পড়ে গেলো জেরাঁদ। স্কলাস্টিকা তার পাশে নতজানু হয়ে বসে প্রার্থনা করতে লাগলো; আর; ওবের দাঁড়িয়ে রইল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অনিমেষ লোচনে তাকিয়ে দেখতে লাগলো তার বাগদত্তাকে। অন্ধকারের মধ্যে মরা আলো ঘুরে বেড়াচ্ছে; মাঝে-মাঝে কেবল বন্য নিশাচরদের আনাগোনায় শিউরে-শিউরে উঠছে স্তব্ধতা, আর সেই মরণ-ঘড়ি যখন ঢং ঢং করে বেজে উঠছে তখন সেই নীরবতা যেন ছিঁড়ে টুকরো-টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
দিনের আলো জেগে উঠতেই সেই ভগ্নস্তূপের চারপাশ ঘিরে ঘুরে-ঘুরে যে-অফুরন্ত সিঁড়ি চলে গেছে, তাতে পা দেবার সাহস পেলো তারা। দুঘণ্টা ধরে তারা ঘুরলো এই সিঁড়ি বেয়ে কিন্তু কোনো জ্যান্ত প্রাণীর সঙ্গে তাদের দেখা হলো না। শুধু দূর থেকে তাদের কাতর ডাকের উত্তরে বিষণ্ণ প্রতিধ্বনি ভেসে এলো। কখনো মনে হয় বুঝি জ্যান্ত কবর হলো তাদের, কারণ সিঁড়ি নেমে গেছে মাটির তলায় একশো ফুট; আবার কখনো সিঁড়ি তাদের যেখানে নিয়ে আসে, ক্ষুধিত গিরিচূড়া তার অনেক নিচে হিংস্রভাবে ওৎ পেতে আছে।
শেষকালে তারা হঠাৎ আবার সেই মস্ত হলঘরটায় এসে পৌঁছুলো– এইখানে ছটফট করে ওই কষ্টের রাতটা কাটিয়েছে তারা। ঘরটা এখন আর ফাঁকা নেই : মাস্টার জাকারিয়ুস আর পিত্তোনাচ্চিয়ো কথা বলছেন সেখানে একজন সোজা ও শক্ত দাঁড়িয়ে আছেন মড়ার মতো, আরেকজন শিকারী জন্তুর মতো, গুটি মেরে বসে আছে এক মারবেল পাথরের টেবিলে।
জেরাঁদকে দেখে তার দিকে এগিয়ে এলেন মাস্টার জাকারিয়ুস, তারপর তার হাত ধরে পিত্তোনাচ্চিয়োর দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বললেন, জেরা, তোমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে দ্যাখো-এঁর সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে।
জেরাদের পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত শিউরে উঠলো।
কখনো না, চেঁচিয়ে উঠলো ওবের, কারণ আপনার মেয়ে আমার বাগদত্তা।
কক্খনো না, জেরাঁদ যেন দূরাগত কোনো প্রতিধ্বনি।
হো-হো করে হেসে উঠলো পিত্তোনাচ্চিনেয়া।
তাহলে কি তুই চাস আমার মৃত্যু হোক!ভাঙা গলায় বৃদ্ধ বলে উঠলেন, ওই দ্যাখ, ওই যে ঘড়িটা, ওরই মধ্যে আমার প্রাণ বন্দী হয়ে আছে। যতগুলো ঘড়ি বানিয়েছিলুম, তার মধ্যে এটাই কেবল এখনও অব্দি বিকল হয়নি। আর এই লোকটা কেবল বলছে যে আপনার মেয়েকে বিয়ে করতে দিলেই ঘড়িটা আপনার হয়ে যাবে।” আর-কোনোদিনও নাকি ঘড়িটায় দম দেবে না সে, এই সে স্থির করেছে। সে-ই এখন ঘড়িটার মালিক, তাই সে ইচ্ছে করলেই ভেঙে ফেলতে পারে এটা–ধ্বংসের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে পারে আমাকে। হায়, জেরাঁদ, শেষকালে তুইও আমাকে ত্যাগ করলি–তুইও আর ভালোবাসিস না আমাকে।
বাবা! যেন কোন মূর্ছা থেকে জেগে উঠলো জেরাঁদ।
তুই যদি একবার জানতিস কী ভীষণ যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে আমাকে, আমার আয়ুর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি কত-কত দূরে। ভাঙা গলায় আবার শুরু করলেন জাকারিয়ুস। হয়তো কেউই আর ঘড়িটার যত্ন নেয় না আজকাল। হয়তো স্প্রিংগুলোয় মরচে ধরে যাচ্ছে, ছিঁড়ে যাবে কোনোদিন হয়তো চাকাগুলো জং ধরে হঠাৎ আটকে যাবে একদিন। কিন্তু একবার যদি আমি একে হাতে পাই তো আমি তার সেবা করতে পারি। দিন-রাত যত্নে অটুট রাখতে পারি তার কলকজা-কারণ কিছুতেই মরা উচিত নয় আমার। আমি জেনিভার মহান ঘড়িনির্মাতা…আমার মৃত্যু তো জগতের সর্বনাশেরই নামান্তর। দ্যাখ দ্যাখ, কেমন ধুকেধুকে এগুচ্ছে কাঁটাগুলো। দেখেছিস, এক্ষুনি পাঁচটার ঘণ্টা পড়বে। ওই শোন, ঘণ্টা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দ্যাখ, কোন অনুশাসন বেরিয়ে আসে ভিতর থেকে।
ঢং-ঢং করে পাঁচটা বেজে উঠলো, আর তার আওয়াজ যেন এক বিষণ্ণ প্রতিধ্বনি তুললো জেরাঁদের হৃদয়ে যার রেশ অনেকক্ষণ থেকে গেলো। তারপরে রক্তের মতো রাঙা অক্ষরে এই অনুশাসন ফুটে উঠলো ঘড়ির মধ্যে :
বিজ্ঞানতরুর ফল তোমাকে অবশ্যই খেতে হবে।
স্তম্ভিতের মতো পরস্পরের দিকে তাকালো ওবের আর জেরাঁদ। কিন্তু কই, ক্যাথলিক ঘড়িনির্মাতার ধর্মীয় অনুশাসন তো এ নয়! নিশ্চয়ই শয়তানের নিশ্বাস পড়েছে এক উপর। কিন্তু জাকারিয়ুস তার দিকে দৃপাতও করলেন না।
শুনছিস, জেরাঁদ? আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস তুই? বাঁচতেই হবে আমাকে, আরো বাঁচতে হবে। এই শোন, আমার নিঃশ্বেসের শব্দ-দ্যাখ, কেমন করে ধমনীয় মধ্যে রক্ত বয়ে যাচ্ছে। না, তুই তোর বাবাকে মারতে পারসি না। যাতে আমি মৃত্যুহীন হয়ে উঠি, যাতে আমি অবিনশ্বর হই, যাতে ঈশ্বরের ক্ষমতা হাতে পাই, সেই জন্যে এই লোকটাকে বিয়ে করতেই হবে তোকে।
এই পাপবাক্য শুনে স্কলাস্টিকা সভয়ে তার বুকে ক্রুশ আঁকলো, আর উল্লসিত পিত্তোনাচ্চিয়ো অট্টরোলে হেসে উঠলো।
আর, একে বিয়ে করলে তুই সুখী হবি, জেরাঁদ। দেখেছিস এর দিকে তাকিয়ে? দ্যাখ, এ আর কেউ নয়–মহাকাল! যদি একে বিয়ে করিস, তবে নির্ভুলভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে তোর জীবন। জেরাঁদ, আমি তোর জনক, আমার কাছ থেকেই তুই প্রাণ পেয়েছিস–তোর বাবাকে তুই সেই প্রাণ ফিরিয়ে দে।
জেরাঁদ, ফিশফিশ করে বলে উঠলো ওবের, তুমি আমার বাগদত্তা।
চেতনা হারিয়ে ফেলতে-ফেলতে বললো জেরাঁদ, কিন্তু তিনি যে আমার বাবা!
পিত্তোনোচ্চিয়ো, জেরাঁদ তোমারই! মাস্টার জাকারিয়ুস বললেন, এবার তোমার কথা রাখো, পিত্তোনাচ্চিয়ো।
এই যে ঘড়ির চাবি, ভীষণ লোকটা উত্তর দিলে।
কুণ্ডলী-খোলা সাপের মতো লম্বা চাবিটা যেন ছিনিয়ে নিলেন জাকারিয়ুস, দৌড়ে গেলেন তিনি ঘড়িটার কাছে, অবিশ্বাস্য দ্রুতবেগে ঘড়িটায় তিনি দম দিতে লাগলেন। স্নায়ুপীড়ন করে কাঁচ-ক্যাচ শব্দ করে উঠলো স্প্রিং। কেবল দমই দিয়ে যাচ্ছেন জাকারিয়ুস, চাবি ঘোরাচ্ছেন তো ঘোরাচ্ছেনই, মুহূর্তের জন্য থামাচ্ছেন না-মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা যেন তার আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। ক্রমশ দ্রুত থেকে দ্রুততরভাবে চাবি ঘোরাতে লাগলেন তিনি, অদ্ভুত মোচড় দিচ্ছেন জোরে-জোরে, আর যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠছে সর্বাঙ্গ–শেষকালে অবসন্ন অবশ হয়ে পড়ে গেলেন তিনি নিচে।
ব্যস, এক শতাব্দী যাবে এবার, এত দম দিয়েছি। চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
হল থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো ওবের-তার মনে হচ্ছে যেন সে পাগল হয়ে গেছে। উন্মত্তের মতো ঘুরলো সে অনেকক্ষণ, তারপর কোনোরকমে এই জঘন্য কেল্লার গোলকধাঁধা থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেলো। খোলা হাওয়ায় এসে যেন বাঁচলো এবার। তাড়াতাড়ি নোত্রদাম-দু সেক্স-এর মঠটায় ফিরে গেলো! এমন হতাশ ও মরিয়ার মতো সে অনুনয় করলে যে শেষকালে সেই যাজক তার সঙ্গে আরেনাৎ-এর কেল্লায় যেতে রাজি হলেন।
এই তীব্র মনস্তাপ ও যন্ত্রণায় জেরাঁদ যদি বিলাপ না-করে থাকে, তাহলে তার কারণই হলো এই যে তার অশ্রুর উৎস একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিলো।
এক মুহূর্তের জন্যও ওই হল ছেড়ে বেরোননি জাকারিয়ুস। বারে-বারে। দৌড়ে গিয়ে কান পেতে সেই পুরোনো ঘড়িটায় টিকটিক শব্দ শুনেছেন তিনি। আর এর মধ্যে ঘণ্টা বেজে উঠেছে ঘড়িতে, আর স্কলাস্টিকার সামনে কোনো অনন্ত বিভীষিকার মতো তার চকচকে ডায়ালে সংহিতা ফুটে উঠেছে :
মানুষকে ঈশ্বরের সমান হতে হবে।
এই পাপ অনুশাসন যে জাকারিয়ুসকে কিছুমাত্র বিচলিত করেনি তাই নয়, নেশাতুরের মতো চেখে চেখে সোল্লাসে পড়েছেন তিনি এই অনুশাসন, দম্ভে তার বুক ভরে গেছে, আর পিত্তোনাচ্চিয়ো তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকেছে সহাস্যে।
ঠিক মধ্যরাতে বিয়ের দলিলে স্বাক্ষর করা হবে বলে ঠিক হয়েছে। জেরাঁদ তো প্রায় যেন নিশ্চেতন কোনো জীব–তার চোখ-কান সব যেন নিঃসাড় হয়ে গেছে–কিছুই তার কানে ঢোকে না–সব ক্ষমতা হারিয়ে সে যেন নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে। আর এই ভারি, দমআটকানো স্তব্ধতা বেহে যাচ্ছে হয় জাকারিয়ুসের দম্ভোক্তিতে, নয়তো পিত্তোনাচ্চিয়োর খুকখুক হাস্যে।
এগারোটার ঘণ্টা পড়লো ঢং-ঢং। শিউরে উঠে মাস্টার জাকারিয়ুস চেঁচিয়ে পড়লেন অনুশাসনটি :
বিজ্ঞানের ক্রীতদাস হয়ে পড়তে হবে মানুষকে : স্বজন, পরিজন, বন্ধু–সকলকে উৎসর্গ করতে হবে তার কাছে।
ঠিক? চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, জগতে বিজ্ঞান ছাড়া আর-কিছুই সত্য নয়।
সাপের মতো ফোঁস-ফোঁস করে কাটাগুলি এগিয়ে যাচ্ছে, আর দোলকটি আরো তীব্র ও ক্ষিপ্রভাবে দুলে যাচ্ছে এদিক-ওদিক, আর একটানা কেবল শব্দ হচ্ছে টিক-টিক-টিক।
কথা বলার কোনো ক্ষমতাই আর নেই জাকারিয়ুসের। পড়ে গেছেন তিনি মেঝেয়, শুষ্ক হয়ে গেছে যেন তার সর্বাঙ্গ, একেবারেই যেন আদ্রতাহীন-আর একটা ঘড়ঘড়ে ভাঙা গলায় তার বুক দিয়ে কেবল এই কথাগুলি বেরিয়ে এলো : জীবন…বিজ্ঞান?
আরো দুটি নতুন দর্শক এসে উপস্থিত হলো : ওবের আর সেই গিঞ্জের যাজক। জাকারিয়ুস মেঝেয় পড়ে আছেন লম্বালম্বি : তার পাশে বসে অবিরাম প্রার্থনা করে চলেছে জেরাঁদ–সে যেন আর বেঁচে নেই, এমনই বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে তাকে।
ঘণ্টা বাজার আগে যে শুষ্ক কর্কশ আওয়াজ জেগে ওঠে, হঠাৎ অতিকায়ভাবে সেই শব্দটা প্রতিধ্বনিত হলো চারদিকে।
লাফিয়ে উঠলেন মাস্টার জাকারিয়ুস!
মধ্যরাত্রি! চেঁচিয়ে বলে উঠলেন তিনি।
তৎক্ষণাৎ যাজকটি সেই পুরোনো ঘড়িটার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন—
এবং মধ্যরাতের ঘন্টা আর বাজলো না।
অপার্থিব এক যন্ত্রণায় আর্ত চীৎকার করে উঠলেন জাকারিয়ুস; বুঝি তার প্রতিধ্বনি তৎক্ষণাৎ শোনা গেলো নরকের দিগন্ত থেকে দিগন্তে; আর তিনি তাকিয়ে দেখলেন ঘড়ির ডায়ালে শেষ অনুশাসন ফুটে উঠলো :
ঈশ্বরের সমান হয়ে ওঠবার চেষ্টা যে করবে, চিরকালের জন্য তাকে রসাতলে যেতে হবে।
একটা যেন বাজ ফেটে পড়লো, এমনি শব্দ করে ফেটে গেলো সেই পুরোনো ঘড়ি–আর ভিতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো স্প্রিংটা, সহস্রবাঁকা ও পেঁচিয়ে-যাওয়া তারটি অদ্ভুতভাবে এঁকে-বেঁকে তালগোল পাকিয়ে গেলো কোনো অতিকায় সাপের কুণ্ডলীর মতো! বিধ্বস্ত সেই মানুষটি দৌড়ে গেলেন তার কাছে, ব্যর্থ চেষ্টা করলেন সেটা কুড়িয়ে নেবার, আর বারেবারে ভাঙা গলায় বলে উঠলেন : আত্মা-আমার আত্মা
জ্যান্ত হয়ে উঠলো যেন সেই তারের কুণ্ডলী : লাফিয়ে লাফিয়ে উঠলো মেঝেয়, একবার এপাশে, একবার ওপাশে, আর তিনি কিছুতেই তার নাগাল পেলেন না।
শেষকালে পিত্তোনাচ্চিয়ো সেটা কুড়িয়ে নিলে, তারপর ভীষণ এক পাপবাক্য উচ্চারণ করে যেন মাটি ভেদ করে কোনো অতল গহ্বরে ঢুকে পড়লো।
চিৎ হয়ে পড়ে গেলেন মাস্টার জাকারিয়ুস। তার দেহে আর প্রাণ নেই।
আন্দোরনাৎ-এর গিরিচূড়াতেই সমাহিত করা হয়েছিলো বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতাকে।
তারপর ওবের আর জেরাঁদ ফিরে এসেছিলো জেনিভায়। ঈশ্বর তাদের দীর্ঘজীবন দিয়েছিলেন : আর যতদিন তারা বেঁচেছিলো এই দিগভ্রান্ত বিজ্ঞানসাধকের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করাটা তারা এর পরে তাদের নিত্যকর্মে পরিণত করেছিলো।