০৯-১০. হত্যাকারী কে?

৯. হত্যাকারী কে?

পোখকে চিনতো না, এমন লোক রিগায় ছিলো না। দিলদরিয়া, হাসিখুশি, শাদাশিধে মানুষ কাঁধে ঝোলা আর হাতে ব্রীফ-কেস নিয়ে সে হন্তদন্ত ছুটছে, আর মুখে সারাক্ষণ খই ফুটছে–এই দৃশ্য দেখতেই লোকে খুব অভ্যস্ত ছিলো। হঠাৎ তার খুন হওয়ার খবরটা তাই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো শহরে সব্বাই খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলো।

উত্তেজনা ছড়িয়েছিলো এমনকী পুলিশের মধ্যেও। পুলিশের বড়কর্তা কর্নেল রাগুয়েনোফ সুষ্ঠু এই খুনের খবরে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও অধীর হয়ে উঠেছিলেন। বিভাগের সবচেয়ে ধুরন্ধর গোয়েন্দাদের লাগিয়ে দিয়ে যত চটপট পারা যায় রহস্য ভেদ করবার জন্য তিনি উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠেছিলেন।

১৬ তারিখ সকালবেলায় এই নিয়েই মেজর ফেরডেরের সঙ্গে তার কথা হচ্ছিলো। প্রাথমিক তদন্তের বিস্তৃত প্রতিবেদন দিয়ে মেজর ফেরডের ওপরওলার নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন। পুরো ব্যাপারটা শুনে কর্নেল বললেন, হুম, তোমার তাহলে ধারণা অন্য যাত্রীটিই খুন করেছে?

সব দেখেশুনে তা-ই তো মনে হয়।

আর সেই সরাইওলা? ক্রোফ-এর হাবভাবে কিছু সন্দেহজনক দ্যাখোনি?

সেও যে খুন করতে পারে, এই সম্ভাবনাটাও আমি একেবারে উড়িয়ে দিইনি– যদিও তার সম্বন্ধে আমরা কখনো কোনো অভিযোগ শুনিনি। কিন্তু সেই রহস্যময় যাত্রীটি যে-ঘরে রাত কাটিয়েছিলো সে-ঘরের জানলায় ও সব দাগটাগগুলো দেখে মনে হয় ক্রোফ-এর এ-ব্যাপারে কোনো হাত নেই। খড়খড়ি আর ছিটকিনি খোলবার জন্য যে- হাতুড়িটা ব্যবহার করা হয়েছিলো সেটাও যখন ও ঘরে পাওয়া গেলো…

হুম। তবু ক্রোফ-এর উপর নজর রেখো।

নিশ্চয়ই রাখবো। দুজনকে সরাইখানায় পাহারায় রেখে এসেছি। তাছাড়া ক্রোফকেও বলেছি, সে যেন কোথাও না-যায় তাকে পরে আরো দরকার হতে পারে।

তাহলে এটা বাইরের কোনো লোকের কাজ বলে তোমার মনে হয় না? সেরাতে ঐ সরাইখানায় যারা ছিলো, তাদেরই কেউ হত্যাকারী বলে তোমার ধারণা?

ততটা নিশ্চয় করে কিছু বলা যায় না। তবে পোখ-এর সঙ্গে অন্য যে-যত্রীটি ছিলো তার বিরুদ্ধে এত প্রমাণ যখন পাওয়া যাচ্ছে, তখন অন্য-কিছু সন্দেহ করাও খুব কঠিন।

তুমি দেখছি মোটামুটি মনঃস্থির করে ফেলেছো?

জজ কেরস্টোফ, ডাক্তার হামিনে আর হের ইয়োহাউজেনেরও তা-ই ধারণা। লোকটি যে-রকমভাবে নিজের পরিচয় গোপন রাখবার চেষ্টা করছিলো, যে-রকম রহস্যময় তার ধরনধারণ, তাতে তাকে সন্দেহ না-করে উপায় কী?

সরাই ছেড়ে যাবার সময় সে কোথায় যাচ্ছে, তা বলেনি?

না।

রিগা থেকে যখন কোচবাক্সে উঠলো, তখন তার গন্তব্য পেরনাউ বলেই তো মনে হয়।

তা হয়। কিন্তু সে শুধু রেফেল অব্দি টিকিট কেটেছিলো।

দু-তিনদিনের মধ্যে পেরনাউতে কোনো অচেনা লোক দেখা যায়নি? তুমি খোঁজ নিয়েছিলে?

নিয়েছিলুম। পুলিশও অবশ্য এখনও খোঁজ করছে, কিন্তু এ-যাবৎ। লোকটার কোনো হদিশ পাওয়া যায়নি।… কোথায় যে সে গেলো! পেরনাউ গিয়েছিলো কি শেষ অব্দি? নাকি অত টাকা নিয়ে বলটিক প্রদেশ ছেড়েই কেটে পড়েছে?

তা সম্ভব। বিশেষ করে কাছেই যখন এত বন্দর আছে, তখন তার পক্ষে এ-তল্লাট ছেড়ে চলে যাওয়া মোটেই কঠিন নয়।

হুঁ, সে সুযোগ যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, বললেন মেজর ফেরডের, কিন্তু, ফিনল্যাণ্ড উপসাগর বা বলটিকের তীরের সমুদ্রে এখন জাহাজই চলছে না। আমি খবর পেয়েছি যে ঠাণ্ডায় সব এমনি জমে আছে যে সম্প্রতি কোনো জাহাজই বন্দর থেকে ছাড়তে পারেনি। কাজেই লোকটা যদি সাগরপাড়ি দিতেই চায়, তাহলে তাকে আরো কয়েকদিন অপেক্ষা করতেই হবে–তা কোনো বন্দরেই হোক বা পেরনাউতেই হোক। এমনকী রেফেলেও হতে পারে।

রিগা হলেই বা বিচিত্র কী? কর্নেল রাগুয়েনোফ যোগ করলেন, এখানে ফিরে আসতেই বা তার বাধা কী? হয়তো তা-ই সে করেছে পুলিশ যাতে পিছু ছেড়ে দেয়, যাতে সে অনেকটা স্বস্তি পেতে পারে, সেদিক থেকে রিগার চেয়ে নিরাপদ জায়গা আর কী আছে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। তবু সাবধানের মার নেই। সব বিষয়েই আমাদের নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। আমি তো জানিয়ে দিয়েছি, বন্দর ছেড়ে যাবার আগে সব জাহাজই যেন ভালো করে তল্লাশ করে নেয়া হয়। সপ্তাহ শেষ হবার আগে বরফ গলবে বলে মনে হয় না–সারা শহর ও বন্দরে ততক্ষণ যেন কড়া নজর রাখা হয়, আমি জানিয়ে দিয়েছি।

মেজর ফেরডেরের সব ব্যবস্থাই মোটামুটি মনঃপূত হলে কর্নেলের। হত্যাকারী কে, সে-সম্বন্ধে তার নিজেরও আসলে কোনো সংশয় ছিলো না। সেই রহস্যময় ও অজ্ঞাত পরিচয় যাত্রীটিই যে হত্যাকারী, তাতে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু কে সে? কী তার পরিচয়? কেউ তার মুখ দ্যাখেনি–না সরাইওলা ক্রোফ, না বাসের কণ্ডাকটার ব্রোক্স- কেউ তাকে স্পষ্ট করে দ্যাখেনি একবারও। এমনকী লোকটার বয়েস কত, সে কি যুবক না প্রৌঢ়, তাও জানা নেই। এ-ক্ষেত্রে গোয়েন্দাদের তিনি কীই-বা নির্দেশ দেবেন? কোন্খানেই বা সন্ধান নিতে বলবেন? কেবল যদি দৈব কখনো সদয় হয়, তাহলেই হয়তো এই জটিল রহস্যের জট ছাড়ানো সম্ভব হবে। যতক্ষণ তা-না হয়, ততক্ষণ অন্ধকার।

+

সেইদিনই সকালবেলা মামলাটার ডাক্তারি প্রতিবেদন নিয়ে ডাক্তার হামিনে নিজে গিয়েছিলেন বিচারপতি কেরস্টোফের আপিসে।

কী? নতুন কোনো সূত্র পাওয়া গেলো? হের কেরস্টোফকে তিনি জিগেশ করলেন।

উঁহু।

কেরস্টোফের আপিশ থেকে বেরোতেই পথে হঠাৎ ফরাশি রাষ্ট্রদূত মঁসিয় দ্যলাপোত্রে সঙ্গে ডাক্তার হামিনের দেখা হয়ে গেলো। এই জটিল ও রহস্যময় মামলাটা নিয়েই কথা হলো দুজনে।

দ্যলাপোর্ৎ বললেন, সেই রহস্যময় যাত্রীটিই যদি হত্যাকারী হয়ে থাকে তাহলে আপনারা যে কী করে তাকে খুঁজে পাবেন, আমি তা ভেবেই পাচ্ছি না…

হ্যাঁ, ভালো কথা, নিকোলেফের কোনো খবর জানেন?

দিমিত্রির খবর? না তো। উনি তো এখানে নেই…

আশ্চর্য, না? তিনদিন হলো দিমিত্রি গেছেন, অথচ এ পর্যন্ত এমনকী তার মেয়েকেও কোনো খবর পাঠাননি।

চলুন না,ডাক্তার বললেন, একবার ওঁদের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি। হয়তো আজকেই ইলকা কোনো চিঠি পেয়ে থাকবে কিংবা নিকোলেই হয়তো ফিরে এসেছেন।

অধ্যাপক নিকোলেফের বাড়িতে গিয়ে কিন্তু তার কোনো খবরই পাওয়া গেলো না। তিনি ফেরেনও নি, কোনো চিঠিও আসেনি; কোথায় গেছেন, তা অব্দি কেউ জানে না; কেন গেছেন, তাও নয়। ইলকা বেচারিকে বড় উদ্বিগ্ন দেখালো। লিভভানিয়ার পথ-ঘাট আজকাল, মোটেই নিরাপদ নয়। কোনো বিপদ-আপদ হয়নি তো পথে তাছাড়া যাবার আগে তাকে বড্ড অস্বাভাবিক, বড্ড চঞ্চল,বড্ড উত্তেজিত দেখাচ্ছিলো। এমনকী তিনি যে যাচ্ছেন, তাও তিনি ইলকাকে বলেননি, কেবল একটা চিরকুট লিখে রেখে গেছেন।

ইলকা বেচারির দুর্ভাবনা দেখে শেষ পর্যন্ত তারা তাকে উলটে সান্ত্বনা ও আশা দিয়ে বেরিয়ে এলেন। মিথ্যে ভাবনা কোরো না, ইলকা। নিশ্চয়ই আজকালের মধ্যেই তোমার বাবা ফিরে আসবেন। এ-কথা ডাক্তার হামিনে মুখে বললেন বটে, কিন্তু কেন যেন তারও মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি কাটার মতো বিঁধছিলো।

+

ঐ একই সময়ে মেজর ফেরডেরের পড়ার ঘরে কিন্তু আরেকটা নতুন খবর এসে পৌঁছেছে। য়েক-এর নেতৃত্বে যে-বাহিনীটি বেরিয়েছিলো, সকালবেলাতেই তারা রিগায় এসে হাজির হয়েছে। ফিরে এসেই সারজেন্ট য়েক বডোকর্তার কাছে তার তদন্তের প্রতিবেদন পাঠিয়ে দিয়ে নিজের আপিশে এসে বসেছিলো। সেইখানেই সে খুনের খবরটা প্রথম জানতে পেলো। এই হত্যারহস্যের চাবিটা যে তারই হাতে ছিলো, এটা আর কারু পক্ষে অনুমান করা অসম্ভব ছিলো, এমনকী য়েক নিজেও বুঝতে পারেনি তার সাক্ষ্য কতটা জরুরি হবে।

মেজর ফেরডের যখন জানতে পেলেন যে ঐ খুনের মামলা সম্বন্ধে সারজেন্ট য়েক-এর কিছু বক্তব্য আছে, তখন তাঁর বিস্ময়ের সীমা রইলো না।

লোখকে কে খুন করেছে, তা তুমি জানো? সত্যি?

নিজের চোখে লোকটাকে দেখেছি।… পোখকে আমি আগে থেকেই চিনতুম রিগায় তাকে কে না চেনে? তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়েছে তেরো তারিখ রাত্তিরে।

কোথায়?

ক্রোফ-এর সরাইখানায়।

তুমি তখন ঐ সরাইতে ছিলে?

হ্যাঁ। পেরনাই ফিরে যাবার আগে এক সহকারীকে নিয়ে খানিকক্ষণের জন্য আমি ঐ সরাইখানায় গিয়েছিলুম।

বেচারা পোখ-এর সঙ্গে তখন তোমার কথা হয়েছিলো?

একটু। পোখ-এর সঙ্গে অন্য যে যাত্রীটি ছিলো, আপনারা যার হদিশ চাচ্ছেন, যাকে হত্যাকারী বলে সন্দেহ হচ্ছে, তাকেও কিন্তু আমি চিনি।

তুমি তাকে চেনো?

হ্যাঁ। আর এই যাত্রীটি যদি সত্যি খুন করে থাকে…

তদন্ত করে যতটুকু জানতে পেরেছি, তাতে আমাদের কোনো সন্দেহই নেই যে ঐ লোকটাই খুনে।

এক্ষুনি তার নাম আপনাকে বলে দিতে পারি কিন্তু আপনি কি তা বিশ্বাস করবেন?

তুমি বললে নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবো।

আমি অবশ্য তাকে স্বচক্ষে দেখেছি। য়েক তাকে আশ্বস্ত করলে, তার সঙ্গে আমার কোনো কথাই হয়নি, তাছাড়া সে তার টুপির ডগা ভুরুর উপর নামিয়ে দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছিলো–কিন্তু চকিতের মধ্যে তাকে দেখেই আমি চিনতে পেরেছিলুম।

কে সে?

অধ্যাপক দিমিত্রি নিকোলেফ।

দিমিত্রি নিকোলেফ! মেজর ফেরডের একেবারে স্তম্ভিত। অসম্ভব– তা হতেই পারে না।

আমি তো বলেইছিলুম যে আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন না।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে লাগলেন মেজর, বিড়বিড় করে বলতে লাগলেন, দিমিত্রি নিকোলেফ!

আগামী পৌরনির্বাচনে প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন দিমিত্রি, লোকে তাকে নির্বাচন করবেই, প্রবল ইয়োহাউজেন পরিবারের তিনি বিরুদ্ধ পক্ষ– জর্মান প্রভুত্বের বিরুদ্ধে স্লাভ জাগরণ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার তিনি মূর্ত প্রতীক– আর তিনি, সেই তিনি, কিনা অসহায়, নিরীহ গোবেচারা পোখ-এর হত্যাকারী!

য়েক-এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মেজর, তার চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে বললেন, তুমি শপথ করে বলছো?

হ্যাঁ, অন্তত সে-রাত্তিরে তিনি রিগায় ছিলেন না।… কিন্তু একটু খোঁজ-খবর করলেই তো সে-সম্বন্ধে জেনে নেয়া যাবে।

এক্ষুনি তার বাড়িতে লোক পাঠাচ্ছি, মেজর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, হের ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনকে আমার আপিশে আসতে খবর দিচ্ছি, তুমি এখানেই থেকো।

নিশ্চয়।

মেজর তক্ষুনি দুজন পুলিশকে ডেকে নির্দেশ দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন। দশ মিনিট যেতে না-যেতেই ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন এসে হাজির। সারজেন্ট য়েক এবার তার সামনেই সব কথা খুলে বললে।

আবারও সারজেন্টকে জিগেশ করেন মেজর, এ কথা তুমি শপথ করে বলতে পারো?

নিশ্চয়ই, সারজেন্ট য়েক-এর গলায় কোনো দ্বিধা নেই।

কিন্তু উনি সম্ভবত রিগা ছেড়ে যাননি,ইয়োহাউজেন আপত্তি তুললেন।

নিশ্চয়ই গেছেন, য়েক বললে, অন্তত চোদ্দ তারিখ রাত্তিরে উনি বাড়ি ছিলেন না, কারণ আমি ওঁকে ক্রোফ-এর সরাইতে দেখেছি নিজের চোখে দেখেছি… ওঁকে চিনতে আমার ভুল হবার কথা নয়…

মেজর ফেরডের বললেন, একটু বসুন, হের ইয়োহাউজেন। আমি ওঁর বাড়িতে লোক পাঠিয়েছি। মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে খবর নিয়ে আসবে।

জানলার ধারে বসে আছেন ইয়োহাউজেন, চুপচাপ ও গম্ভীর, তার মনের মধ্যে আবেগের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। সারজেন্টের কথাই সত্যি হোক, প্রমাণ হোক যে য়েক কোনো ভুল করেনি, এই ইচ্ছা তার একেবারে বুকের ভিতরে তীব্রভাবে হুলুস্থুল বাধাচ্ছে, কিন্তু তবু কেন যেন তার অন্তরাত্মা বলছিলো এ-কথা সত্যি নয়, দিমিত্রি নিকোলেফ তার পরম শত্রু হতে পারেন, কিন্তু হত্যাকারী তিনি নন– খুনে নন, জল্লাদ নন– তাঁর সততা ও মর্যাদা তর্কাতীত।

ইয়োহাউজেনের সংবিৎ ফিরলো সংবাদদাতার কণ্ঠস্বরে : তেরো তারিখ ভোরবেলা দিমিত্রি নিকোলেফ রিগা ছেড়ে চলে গেছেন, কোথায় গেছেন কেউ জানেনা– এখনও তিনি ফিরে আসেননি।

সারজেন্ট য়েক-এর বিবৃতিই তবে সত্যি!

ইয়োহাউজেন যখন পুলিশ দপ্তর থেকে বেরুলেন তখন তিনি যুগপৎ অভিভূত ও উল্লসিত।

বারুদের স্তূপের মধ্যে আগুনের ফুলকির মতো এই ভীষণ খবর দেখতে না দেখতে গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়লো।

তাহলে দিমিত্রি নিকোলেই পোখ-এর হত্যাকারী!

+

ইলকা নিকোলেফের কাছে এ-খবর ভাগ্যিশ পৌঁছোয়নি! ডাক্তার হামিনেই ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন যাতে কোনো গুজব বা জনরব ও বাড়ি না পৌঁছোয়। কিন্তু সন্ধেবেলায় তার বসার ঘরে যখন অভিভূত ও বিমূঢ় মঁসিয় দ্যলাপোর্তের আগমন হলো, তখন তারা পরস্পরের দিকে মুখ তুলেই তাকাতে পারছিলেন না। অ্যাঁ, দিমিত্রি নিকোলেফ নরহন্তা!… অসম্ভব!

কিন্তু ততক্ষণে বেতারে সবখানে খবর পৌঁছে গিয়েছে। সারা তল্লাটের পুলিশ বাহিনীকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে ততক্ষণে। দিমিত্রি নিকোলেফকে দেখবামাত্র যেন গ্রেপ্তার করা হয়।

ষোলো তারিখ বিকেলে এই খবরই গিয়ে পৌঁছেছিল ডোরপাট বিশ্ববিদ্যালয়ে। খবরটা প্রথম জেনেছিলো কার্ল ইয়োহাউজেন– কাজেই প্রকাশ্যে, জাঁ নিকোলেফের সব বন্ধুবান্ধবের সামনে, ওইভাবে চরম আঘাত হানবার সুযোগ সে কিছুতেই হারায়নি।

.

১০. জেরা

দিমিত্রি নিকোলেফ রিগা ফিরে এলেন ১৬ই এপ্রিল রাতে; ফেরবার সময়ও কেউ তাকে চিনতে পারেনি।

অস্বস্তিতে ভুগছিলো বলে ইলকা তখনও ঘুমোয়নি– ঘুমুতে পারেনি। তাও তো বেচারি জানে না কী ভয়ংকর অভিযোগ খড়গের মতো তার বাবার মাথার উপর ঝুলছে! কিন্তু তা না-জানলেও তার দুর্ভাবনার কোনো ইয়ত্তা নেই। সন্ধেবেলা মঁসিয় দ্যালাপোৎ আর ডাক্তার হামিনে যখন খোঁজখবর নিয়ে চলে গেলেন, তখনই ডোরপাট থেকে এক তারবার্তা এসে হাজির; কোনো কারণ উল্লেখ না করেই তাতে এই বার্তা ছিলো যে জাঁ নিকোলেফ বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছুঁড়ে রিগা চলে আসছে কালকেই।

সকালবেলায় ইলকার মনের ভাব অবিশ্যি অনেকটাই কমে গেলো যখন সে সিঁড়িতে বাবার পায়ের শব্দ পেলে। রাত্তিরে যে কখন বাবা এসে পৌঁছেছেন, তা সে জানতেও পারেনি।

মেয়েকে দেখেই নিকোলেফ বললেন, এত দেরি হবে তা আগে বুঝতে পারিনি… যাক ফিরে তো এলুম অবশেষে…

তোমাকে ভারি ক্লান্ত দেখাচ্ছে, বাবা।

তা একটু ক্লান্ত লাগছে সত্যি। এ-বেলা জিরিয়ে নিলেই হবে। বিকেলে আবার জরুরি ক্লাস আছে নিতে হবে।

কাল ক্লাস নিলে হয় না? তোমার ছাত্রদের তো আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো।

না, ইলকা, না। খামকা ওদের ক্লাস না নেবার কোনো মানে হয় না। আমার তো আর অসুখবিসুখ কিছু করেনি। … কেউ এসেছিলো এর মধ্যে খোঁজ নিতে?

না, শুধু মঁসিয় দ্যলাপোর্ৎ আর ডাক্তার হামিনে এসেছিলেন। তোমাকে না-দেখে তাঁরা ভারি অবাক হলেন।

নিকোলেফ একটু ইতস্তত করে বললেন, কেবল তো দু-এক দিনের মামলা… সেই জন্যেই ওঁদের কিছু বলিনি।

তুমি কি ডোরপাট গিয়েছিলে, বাবা? হঠাৎ কালকের তারবার্তাটির কথা মনে পড়ে গেলো ইলকার।

ডোরপাট? নিকোলেফ অবাক হলেন, কেন? হঠাৎ ডোরপাটের কথা কেন?

কাল জাঁ এক তার পাঠিয়েছে– আজকে নাকি রিগা এসে পৌঁছুবে। বাস, এছাড়া তাতে আর কোনো খবর নেই।

জাঁ আসছে? সত্যি, ভারি আশ্চর্য তো! হঠাৎ ফিরে আসছে কেন? কী জানি, হঠাৎ কোনো জরুরি কাজ পড়েছে হয়তো।

নিকোলেফ বুঝতে পারছিলেন তার কন্যা তার আকস্মিক অন্তর্ধান নিয়ে খুবই কৌতূহলী হয়ে আছে। কিন্তু সে সম্বন্ধে আর কোনো উচ্চবাচ্যই তিনি করলেন না। চায়ের টেবিলে বসে অন্যান্য বিষয়ে হালকা কথাবার্তা হলো। তারপর তিনি পড়ার ঘরে চলে গিয়ে ক্লাসের জন্য তৈরি হতে লাগলেন।

আবার যথারীতি শান্ত ও নিশ্চিন্ত ভাবে গৃহকর্ম চলতে লাগলো। কিন্তু এই শান্তি যে ঝড়ের আগেকার স্থিরভীষণ থমথমে ভাব, সেটা ইলকা স্বপ্নেও ভাবতে পারলে না।

ঝড় উঠলো সোয়া-বারোটায়।

কোতোয়ালি থেকে এলো এক পুলিশের লোক, ভৃত্যের হাতে একটি চিঠি তুলে দিয়ে বললো এটা এক্ষুনি কর্তার কাছে পৌঁছে দিতে। নিকোলেফ বাড়ি আছেন কি না তা পর্যন্ত সে জিগেশ করলে না। এমনিতে বাইরে থেকে দেখে বোঝবার জো না থাকলেও আসলে রাত থেকেই এ বাড়ির উপর কড়া পুলিশ পাহারা বসেছিলো। চিঠির বয়ানটা সংক্ষিপ্ত; কোনো ধানাই-পানাই না করে সোজাসুজি তাতে লেখা ছিলো :

অধ্যাপক দিমিত্রি নিকোলেফের কাছে বিচারপতি কেরস্টোফের অনুরোধ, অধ্যাপক নিকোলেফ যেন পত্রপাঠ কেরস্টোফের আপিশে এসে দেখা করেন। বিষয়টা খুবই জরুরি।

নিকোলেফ চিঠি পেয়ে সত্যি খুব অবাক হলেন। কেমন যেন পাংশু হয়ে গেলো তাঁর মুখ, কেমন-একটা অস্থির দুর্ভাবনার ছাপ ফুটে উঠলো চোখেমুখে। একবার ভেবেছিলেন এই পরোয়ানা বা এত্তেলাকে মোটেই পাত্ত দেবেন না; কিন্তু শেষটায় কী ভেবে তলব অনুযায়ী কাজ করলেন তিনি, টপকোট গায়ে চাপিয়ে নিচে নেমে এলেন। বললেন, ইলকা, এক্ষুনি একবার জজ কেরস্টোফের আপিশে যেতে হবে। তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন।

জজ কেরস্টোফ? কেন? হঠাৎ আবার তোমাকে তার কী দরকার?

জানি না, দিমিত্রি নিকোলেফের মুখ কেমন বিবর্ণ দেখালো।

এর সঙ্গে জাঁ-র কোনো সম্বন্ধ নেই তো? ওকে হঠাৎ ডোরপাট ছাড়তে হলো কেন, বুঝতে পারছি না।

জানি না… কিছু তো বুঝতে পারছি না… হতেও পারে, ওর সঙ্গে জাঁ কোনোভাবে জড়িত। যাই হোক, কী ব্যাপার এক্ষুনি জানতে পারবো।

আদালতে পৌঁছনো মাত্র তাঁকে জজ কেরস্টোফের আপিশে নিয়ে যাওয়া হলো। কেরস্টোফের সঙ্গে ঘরে বসে ছিলেন মেজর ফেরডের আর কেরস্টোফের কেরানি। প্রথমে নমস্কার বিনিময় করলেন তাঁরা, তারপর ঘরে কী-রকম একটা বিশ্রী অস্বস্তিকর স্তব্ধতা নেমে এলো। নিকোলেফ চাচ্ছিলেন, কেন তাকে হঠাৎ ডেকে পাঠানো হলো, তা খুলে বলা হোক।

মঁসিয় নিকোলেফ, কেরস্টোফ শুরু করলেন, একটা তদন্তের ব্যাপারে আপনাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি। আপনার কাছ থেকে কতগুলো খবর জানতে চাই।

কী ব্যাপার বলুন তো? নিকোলেফ জিগেশ করেন।

দাঁড়িয়ে কেন, বসুন বসুন।

নিকোলেফ একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন–ঠিক কেরস্টোফের মুখোমুখি। মেজর ফেরডের জানলার কাছেই দাঁড়িয়ে রইলেন। জেরা শুরু হলো।

দিমিত্রি নিকোলেফ, কেরস্টোফ আগেই সাবধান করে দিলেন, প্রশ্ন শুনে চমকে যাবেন না। হয়তো এ-সব প্রশ্ন আপনার কাছে একান্ত ব্যক্তিগত ঠেকবে, কিন্তু ন্যায়বিচারের খাতিরে, এবং আপনার নিজের খাতিরেও, আশা করবো আপনি সব প্রশ্নের খোলাখুলি উত্তর দেবেন….. কোনো কথা চেপে যাবেন না।

নিকোলেফ একদৃষ্টে জজ কেরস্টোফের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সব কথা তার কানে গেছে কি না, বোঝা গেলো না। হাত দুটো ভাঁজ করা, মুখে কোনো কথা নেই, চুপচাপ তিনি শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

কেরস্টোফের সামনে টেবিলের উপর খুনের মামলার সব নথিপত্র। গম্ভীর গলায় তিনি জিগেশ করলেন, আপনি কয়েকদিনের জন্য বাইরে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

কবে রিগা ছেড়েছিলেন?

তেরো তারিখ ভোরবেলায়।

ফিরলেন কবে?

কাল রাত্তিরে–একটা নাগাদ।

একা গিয়েছিলেন? না কি সঙ্গে আর কেউ ছিলো?

একাই গিয়েছিলুম।

রেফেলে যাবার ডাকের গাড়িতে উঠেছিলেন বুঝি?

একটু ইতস্তত করে নিকোলেফ বললেন, হ্যাঁ।

ফিরলেন কীসে?

তেলেগ্যুতে।

কোত্থেকে নিয়েছিলেন তেলেগ্যু?

এখান থেকে পঞ্চাশ ভেস্ট দূরে হবে–রিগার রাস্তায়।

তাহলে, ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে আপনি তেরো তারিখ সকালে রিগা থেকে গিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, সকাল ছটায়।

কোচবাক্সে কি একাই যাত্রী ছিলেন আপনি?

না… আরেকজন যাত্রী ছিলেন।

তাকে আপনি চেনেন?

না, আগে তার কথা কখনও শুনিনি।

কিন্তু এটা নিশ্চয়ই আপনার বুঝতে দেরি হয়নি যে যাত্রীটির নাম পোখ– ইয়োহাউজেনদের ব্যাঙ্কের তিনি হরকরা?”

তা দেরি হয়নি। ভদ্রলোক অবিশ্রাম কথা বলছিলেন কণ্ডাক্টরের সঙ্গে।

ব্যক্তিগত বিষয়েও কথা বলছিলেন?

ব্যক্তিগত বিষয়েই বলাবলি করছিলেন।

কী বলছিলেন তিনি?

যে তিনি ইয়োহাউজেনদের কী-একটা কাজে রেফেল যাচ্ছেন।

রিগায় ফেরবার জন্য অধীর তো হননি ভদ্রলোক?… মানে তার তো বিয়ের কথা ছিলো।

হ্যাঁ। … আসলে আমি ওসব কথাবার্তায় বিশেষ মনোযোগ দিইনি– টুকরো-টুকরোভাবে কথাগুলো আমার কানে আসছিলো। আমার তো আর ওঁর সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল ছিলো না।

এবার মেজর ফেরডের মাঝখানে একটা টিপ্পনী কাটলেন : সত্যি ছিলো না?

একটু অবাক হয়ে ফেরডেরের দিকে তাকালেন নিকোলেফ। মোটেই না। ওঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমার কৌতূহল থাকবে কেন?

হয়তো এই তদন্ত মারফৎ আমরা তা-ই জানবার চেষ্টা করছি, বললেন কেরস্টোফ।

নিকোলেফকে সত্যি ভারি বিমূঢ় ও অসহায় দেখালো।

কেরস্টোফ বললেন, পোখ-এর কাছে একটা ব্রীফ-কেস ছিলো না? ব্যাঙ্কের লোকেরা যাতে টাকাকড়ি রাখে, সে-রকম একটা ব্রীফ-কেস?

হতে পারে, তবে আমি ভালো করে খেয়াল করিনি। আমি এক কোনায় ওভারকোট মুড়ি দিয়ে বসেছিলুম–মাঝে মাঝে টুপিটা মুখের উপর নামিয়ে দিয়ে ঘুমিয়েও পড়ছিলুম। কাজেই কে কী করছে না-করছে, বা কার সঙ্গে কী আছে না-আছে, সে সব মোটেই লক্ষ করিনি।

হ্যাঁ, ব্রোক্সও তা-ই বলেছে। ফেরডের বললেন।

আপনি পোখ-এর সঙ্গে কোনো কথা বলেননি? কেরস্টোফ জিগেশ করলেন।

গাড়ি চলবার সময় আমাদের কোনো কথা হয়নি। … দুর্ঘটনার পরে সরাইখানায় যাবার সময় তার সঙ্গে আমি প্রথম কথা বলি– তাও সরাইয়ে যাবার জন্যই।

তাহলে সাবধানে টুপির ডগায় মুখ ঢেকে সারাদিন আপনি কোচবাক্সের কোনায় বসেছিলেন?

সাবধানে!–এ-কথার মানে? নিকোলেফ কথাটার মর্মার্থ পুরোটা ধরতে না-পারলেও রূঢ় ইঙ্গিতটা তার অগোচর ছিলো না।

অর্থাৎ বর্ণনা থেকে মনে হয় কেউ আপনাকে চিনে ফেলুক, এ-ইচ্ছে আপনার ছিলো না। আবারও এই ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যটি করলেন মেজর ফেরডের।

নিকোলেফ এবার এ-ইঙ্গিতটি অগ্রাহ্য করলেন না। শুধু বললেন, যদি ধরেও নিই যে কেউ আমাকে চিনে ফেলুক এ-ইচ্ছে আমার ছিলো না, তাতে কি কিছু বেআইনি কাজ করা হলো! আমার ধারণা ছিলো পৃথিবীর সবখানেই এমনকী লিভোনিয়াতেও এই অধিকার লোকের আছে।

হ্যাঁ, কোনো সাক্ষীশাবুদ না-রাখার জন্য এটা যে একটা চমৎকার অধিকার তাতে কোনো সন্দেহ নেই, রূঢ়ভাবে বললেন মেজর ফেরডের।

এই বিশ্রী মন্তব্যটি শোনবামাত্র নিকোলেফ কেমন বিবর্ণ হয়ে গেলেন। কী-একটা বলতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন।

কেরস্টোফ বললেন, পোখ যে সেদিন আপনার সহযাত্রী ছিলো, এ-কথা আপনি তাহলে অস্বীকার করছেন না।

না, সেদিন পোখ আমার সঙ্গে কোচবাক্সে ছিলেন।

কেরস্টোফ জেরা চালিয়েই গেলেন : কোচবাক্সটি সেদিন গোড়ার দিকে ভালোই যাচ্ছিলো… কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাই ঘটেনি… দুপুরবেলায় কেবল মধ্যাহ্নভোজের জন্য আধঘণ্টা থেমেছিলো ডাকগাড়ি… তখনও আপনি চাননি যে কেউ আপনাকে চিনে ফেলুক। তারপর আবার ডাকগাড়ি রওনা হলো, আবহাওয়া ক্রমশ খারাপ হতে লাগলো, ঝড়ের মধ্যে এগুনোই কঠিন ঠেকতে লাগলো… সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ দুর্ঘটনাটা ঘটলো… একটা ঘোড়া পড়ে গেলো, গাড়ি গেলো উলটে, ভেঙে গেলো তার…

নিকোলেফ বাধা দিয়ে বললেন, কেন আপনি এ-সম্বন্ধে আমাকে জেরা করছেন, তা কি আমি জানতে পারি?

ন্যায়বিচারের জন্য, মঁসিয় নিকোলেফ। …ব্রোক্স যখন বুঝতে পারলে যে এই ভাঙা গাড়ি নিয়ে পেরনাউ অবধি পৌঁছোনো যাবে না, তখন রাতটা একটা সরাইতে কাটানোই ভালো বলে সাব্যস্ত হলো। দুশো গজ দূরের সরাইটার দিকে প্রথম আপনিই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।

সেদিন সন্ধেবেলায় সরাইটায় প্রথম আমি পদার্পণ করি। তার কথা আগে জানতুমই না।

একটা বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ব্রোক্স ও সহিসের সঙ্গে পেরনাউ–গিয়ে সরাইটাতেই রাত কাটানো ঠিক করেছিলেন আপনি।

ও-রকম দুর্যোগের মধ্যে পথে কষ্ট পাবার চেয়ে সরাইটাতেই রাত কাটানো ভালো বলে মনে হয়েছিলো আমার।

আপনিই পোখকে ঐ সরাইতে রাত কাটাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন?

আমি তাকে কোনো পরামর্শই দিইনি। দুর্ঘটনার ফলে তিনি জখম হয়েছিলেন–পায়ে চোট লেগেছিলো– ও-অবস্থায় ল্যাংচাতে-ল্যাংচাতে তার পেরনাউ যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ভাগ্যিশ সরাইটা কাছে ছিলো…

ভাগ্যিশ! মেজর ফেরডের নিজেকে আর সংযত রাখতে পারলেন না।

দিমিত্রি নিকোলেফ কেবল কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলেন।

কেরস্টোফ কিন্তু পুরো জেরাটা আগেই ছকে রেখেছিলেন। তিনি ছকটা নষ্ট করতে চাচ্ছিলেন না। তাই তক্ষুনি তিনি জিগেশ করলেন, ব্রোক্সরা পেরনাউ রওনা হয়ে যাবার পর আপনারা ভাঙা-ক্রুশে এসে পৌঁছোন, তাই না?

ভাঙা ক্রূশ! সরাইটার নাম যে ভাঙা ক্রূশতা আমি এই প্রথম শুনলুম। পোখকে নিয়ে সরাইতে পৌঁছোবার পর আপনি সরাইওলা ক্রোফের কাছে রাত্রিবাসের জন্য একটা ঘর চাইলেন… পোখও তার জন্য একটা ঘর চেয়েছিলেন… ক্রোফ যখন জিগেশ করলো কিছু খেতে চান কি না, তখন আপনি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। পোখ কিন্তু নৈশভোজনে বসেছিলেন…

আমার খিদে ছিলো না।

পরদিন ভোরবেলায়, কোচবাক্সের লোকজন ফেরবার আগেই, আপনি বেরিয়ে পড়তে চান, ক্রোফকে এ-কথা জানিয়েই আপনি আপনার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েন।

এ-সব অর্থহীন প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি যে তাঁকে ক্লান্ত করে তুলেছে, নিকোলেফ তা গোপন করলেন না। বললেন, হ্যাঁ, তা-ই হয়েছিলো।

খাবারঘরের বাঁদিকের ঘরটা আপনাকে দেয়া হয়েছিলো ঘরটা ছিলো সরাইখানার একেবারে এককোনায়…

আমার পক্ষে তো এসব তথ্য সঠিক জানা সম্ভব নয়… আগেই তো বলেছি। সেদিনই আমি ওখানে প্রথম পদার্পণ করি… তাছাড়া আমরা যখন সরাইটায় পৌঁছোলুম তখন অন্ধকার করে এসেছিলো, আমি যখন ওখান থেকে রওনা হই, তখনও আলো ফোটেনি…

ভাঙচুর সারিয়ে কোচবাক্স চলতে শুরু করা অব্দি আপনি অপেক্ষা করতে চাননি, কেরস্টোফ আবারও প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেন।

যেতে চাচ্ছিলুম পেরনাউ ওখান থেকে মাত্র কয়েক মাইল দূরে, তাই খামকা আমার অপেক্ষা করতে ইচ্ছে হয়নি।

বেশ। সন্ধেবেলাতেই পরিকল্পনাটা আপনার মাথায় এসেছিলো আর সাতসকালেই সেটা আপনি কাজে খাঁটিয়ে ফেললেন।

নিকোলেফ কোনো কথা না-বলে চুপ করে রইলেন।

কেরস্টোফ বললেন, এবার আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে-চাই। আশা করি । তার সদুত্তর দিতে আপনার আপত্তি হবে না…

বলুন।

হঠাৎ হুড়মুড় করে এ-ভাবে যাবার তাড়া পড়লো কেন আপনার? অত গোপনীয়তাই বা কেন ছিলো?

এই প্রথম নিকোলেফকে ইতস্তত করতে দেখা গেলো। ও আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

জানতে পারি কি, কী এমন ব্যক্তিগত…

এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না।

অন্তত এটা কি বলবেন আপনার গন্তব্য কোথায় ছিলো?

এ-সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার নেই।

রেফেল যাবার জন্য ভাড়া দিয়েছিলেন আপনি। কোথায় যেতে চাচ্ছিলেন? রেফেলেই?

কোনো উত্তর নেই।

পেরনাউ যেতে চাচ্ছিলেন বলেই মনে হয়। কারণ কোচবাক্স মেরামত অব্দি আপনি অপেক্ষা করেননি। তবে কি পেরনাউ যেতে চাচ্ছিলেন?

দিমিত্রি নিকোলেফ এবারও চুপ করে রইলেন।

শেষবারের মতো জিগেশ করছি। আপনার যাত্রার উদ্দেশ্য ও গন্তব্য কী ছিলো…

ঠাণ্ডাগলায় নিকোলেফ বললেন, এ-সব জেরার উদ্দেশ্য কী, জানি না। কেনই বা এভাবে আপনার আপিশে আমায় ডেকে এনেছেন, তাও আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে। কিন্তু তবু এতক্ষণ আমি আপনাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই। তাছাড়া আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে যদিও আমি সেদিন যাবার সময় লোকের চোখে পড়তে চাইনি তবুও আপনি জিগেশ করবামাত্র সব স্বীকার করেছি। আপনিও তো বললেন আমাকে কেউ চিনতো না বা চিনতে পারেনি। কাজেই আমি যদি সব অস্বীকার করতুম, তাহলে আপনি প্রমাণ করতেন কী করে যে আমিই সেদিন কোচবাক্সে ছিলুম…

একজন সাক্ষী কিন্তু আছেন, মঁসিয় নিকোলেফ, যিনি আপনাকে ঠিকই চিনতে পেরেছিলেন…

একজন সাক্ষী আছেন?

হ্যাঁ, আপনি এক্ষুনি তার নিজের মুখ থেকে সব কথা জানতে পারবেন। বলে কেরস্টোফ একজন পুলিশকে ডেকে বললেন, সারজেন্ট য়েক-কে পাঠিয়ে দাও।

মুহূর্তের মধ্যে সারজেন্ট য়েক ঘরে ঢুকে তার বড়কর্তাকে অভিবাদন করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।

আপনিই ষষ্ঠ স্কোয়াড-এর সারজেন্ট য়েক?

সারজেন্ট তার পরিচয় দিলে। নিকোলেফ কিন্তু সারজেন্টকে ইতিপূর্বে কোথাও দেখেছেন বলে মনেই করতে পারলেন না।

গত তেরোই এপ্রিল সন্ধেবেলায় আপনি কোথায় ছিলেন? ভাঙা ক্রুশের সরাইখানায়?

হ্যাঁ, পেরনাওয়া থেকে একটা অভিযান সেরে ফিরছিলুম আমি… ফেরবার সময় ঐ সরাইতে ঢুকে খানিকক্ষণ আমরা বিশ্রাম করি। ঘণ্টা দুই ছিলুম ওখানে। তারপর যখন পেরনাউ রওনা হবার জন্য বেরিয়ে পড়বো, এমন সময় সরাইয়ের দরজা খুলে দুই ব্যক্তি এসে ঢোকেন। তারা যে-কোচবাক্সে যাচ্ছিলেন, তা হঠাৎ ভেঙে যাওয়ায় তারা সরাইখানায় আশ্রয় নিতে চাচ্ছিলেন। যাত্রীদের একজন ছিলেন পোখ, তাকে আমি আগে থেকেই চিনতুম। অন্য যাত্রী তাঁর ওভারকোটের কলারে নিজের মুখ ঢেকে রাখতে চাচ্ছিলেন, কেউ যে তাঁকে চিনুক এটা তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো না। এতে সন্দিগ্ধ হয়ে আমি তার পরিচয় পাবার জন্য উৎসুক হয়ে উঠি। তার পরে এক ঝলকের জন্য যখন তার মাথার টুপিটা সরে যায়, তখন তাঁর মুখ দেখতে পাই আমি কারণ আমি সর্বক্ষণ তার দিকেই তাকিয়েছিলুম।

ঐ এক ঝলকেই তাকে চিনতে পেরেছিলেন?

হ্যাঁ। ভদ্রলোককে আমি অনেকবার রিগায় দেখেছি।

এবং তিনি হলেন অধ্যাপক দিমিত্রি নিকোলে?

হ্যাঁ, তিনি এ-ঘরে বসে আছেন এখন, দেখতে পাচ্ছি। এতক্ষণ নিকোলেফ সব কথা চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন। এবার বললেন, সারজেন্ট ঠিকই বলেছেন। উনি সম্ভবত সরাইতেই ছিলেন তখন। তিনি আমার সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে থাকলেও তাঁর সম্বন্ধে কিন্তু আমার কোনো কৌতূহলই ছিলো না। তাছাড়া, আমি তো নিজেই আপনাদের বলেছি যে সে রাতে আমি ঐ সরাইটায় ছিলুম– কাজেই এই সাক্ষীশাবুদের দরকার কেন, তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না।

ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, কেন তা আপনি শিগগিরই জানতে পারবেন, দিমিত্রি নিকোলেফ। হঠাৎ গোপনে আপনাকে যেতে হয়েছিলো কেন, আপনি তাহলে তা বলতে চাচ্ছেন না!

না।

আপনি বুঝতে পারছেন না যে আপনার এই অস্বীকৃতির ফল আপনার পক্ষে ভালো হবে না!

তার মানে?

সে-রাত্রে ঐ সরাইটায় কী হয়েছিলো, তা খুলে বললে অনেক ঝামেলা বাঁচতো। আপনি যদি আপনার গতিবিধির একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেন, তাহলে আর আমাদের এভাবে তদন্ত করতে হতো না।

কেন? সে রাত্রে কী হয়েছিলো?

আপনি জানেন না?

না, এবার নিকোলেফের কণ্ঠস্বরে একটু অস্বস্তি প্রকাশ পেলো, এটা বুঝতে পারছি যে একটা গুরুতর ব্যাপারে আমি বোধহয় জড়িয়ে পড়েছি এবং আপনারা আমাকে সাক্ষ্য দিতে ডেকে এনেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা যে কী, তা-ই তো বুঝতে পারছি না।

সাক্ষ্য দিতে ডেকেছি আপনাকে? না, দিমিত্রি নিকোলেফ, না। আপনাকে ডাকা হয়েছে অভিযুক্ত আসামী হিশেবে!

কীসের অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে?

তেরো তারিখ রাত্তিরে ভাঙা ক্রুশের সরাইখানায় পোখ খুন হয়েছে।

বেচারি খুন হয়েছে!

হ্যাঁ। এবং আমরা প্রমাণ পেয়েছি যে খুনী হচ্ছে তার ভ্রমণ-সঙ্গী–অর্থাৎ আপনি।

আমি! খুনী! দিমিত্রি নিকোলেফ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

আপনি তাহলে অভিযোগ অস্বীকার করছেন? কেরস্টোফও উঠে দাঁড়ালেন আস্তে-আস্তে।

কতগুলো কথা আছে যাদের আর অস্বীকার করতে হয় না শোনবামাত্রই বোঝা যায় তারা সত্যি নয়।

আপনি সতর্ক হয়ে কথা বলবেন…

পাগল! আপনারা নিশ্চয়ই ঠাট্টা করছেন?

আমরা খুব গুরুত্ব দিয়েই কথাটা বলছি…

দিমিত্রির গলার স্বরে তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো, এ বিষয়ে আপনাদের সঙ্গে আমার কোনো তর্ক নেই। কেবল শুনি, কোন্ প্রমাণের বশবর্তী হয়ে আপনারা আমাকে খুনী সাব্যস্ত করেছেন?

আপনি সে-রাতে যে-ঘরে ছিলেন তার জানলার গোবরাটে কতগুলো দাগ দেখে বোঝা গেছে যে জানলা দিয়ে পোখ-এর ঘরে ঢোকবার জন্য আততায়ী জানলাটা ব্যবহার করেছিলো। যে-হাতুড়িটা দিয়ে জানলার খড়খড়ি ভেঙে আততায়ী ঢুকেছিলো, সেটাও আপনার ঘরে পাওয়া গেছে।

হুঁ… এ-সব প্রমাণ থেকে অবিশ্যি সন্দেহ হওয়া বিচিত্র নয়– আপনাদের দোষ নেই। কিন্তু ধরেই নিলুম বাইরের কোনো লোক সে-রাতে খুন করেনি–কিন্তু আমি চলে যাবার পরেও তো খুনটা হতে পারত?

অর্থাৎ আপনি সরাইওলাকে অভিযুক্ত করছেন। কিন্তু তদন্তে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

আমি কাউকেই অভিযুক্ত করছি না, দিমিত্রির গলার স্বরে তাচ্ছিল্যের ভাব সুস্পষ্ট, কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি এই ভেবে যে কেউ কী করে ভাবতে পারলো আমার দ্বারা ও-রকম কোনো হত্যাকাণ্ড সম্ভব!

এবার মেজর ফেরডের বললেন, খুনীর উদ্দেশ্য ছিলো চুরি। ইয়োহাউজেন ব্রাদার্সদের টাকা নিয়ে যাচ্ছিলো পোখ– অথচ এর ব্রীফকেসে কোনো টাকা পাওয়া যায়নি।

তো আমার তাতে কী?

এবার কেরস্টোফ আবার জিগেশ করলেন, দিমিত্রি নিকোলেফ, আপনি এখনও আপনার ভ্রমণের উদ্দেশ্যও খুলে বলবেন না আমাদের?

না।

আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এই অভিযোগ কেমন গুরুতর। অন্য-কেউ হলে এই সাংঘাতিক কাণ্ডের জন্য তাকে আমরা গ্রেফতার করতুম কিন্তু আপনার মতো লোক, যাঁকে দেশশুদ্ধ সবাই শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, তাকে সাধারণ কয়েদির মতো হাজতে পুরে রাখা যায় না। আমি আপাতত আপনার গ্রেফতারি পরোয়ানায় দস্তখৎ দিচ্ছি না… কিন্তু সবসময়েই তৈরি থাকবেন- যাতে তদন্তের এত্তেলা পাঠালেই আপনাকে পাওয়া যায়। আর তদন্তের জন্য মাঝে-মাঝেই আপনাকে আমাদের দরকার হবে।