০১. আস্ত একটা দ্বীপই বিক্রি হবে

দ্য স্কুল ফর রবিনসন্‌স – জুল ভের্ন
অনুবাদ – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়

‘নগদ টাকা ফেলুন দিকি,
আস্ত দ্বীপ এক হচ্ছে বিকি!

‘বিক্রি হবে, মশাই; আস্ত একটা দ্বীপই বিক্রি হবে। সবচেয়ে বেশি দাম যিনি হাঁকবেন, নগদ মূল্যে তাঁর কাছেই বেচা হবে দ্বীপটা,’ঘোষণা করলে ডীন ফেলপৰ্গ। সে হ’লো নিলেমওলা। নিলেমভবনে গিশগিশে ভিড়— এ রকম অদ্ভুত একটা বিক্রি দেখতে কাতারে-কাতারে লোক এসে হাজির হয়েছে; হাজির হওয়াই কেবল নয়— শোরগোলেরও শেষ নেই। আর হুলুস্থূল চ্যাঁচ্যাঁমেচির মধ্যে তার গোল পাটাতনটায় দাঁড়িয়ে জোর গলায় হাঁকছে জিনগ্রাস, ফেলপর্গের শাগরেদ—চীৎকার ছাপিয়েও তার গলা শোনা যাচ্ছে ঘরের এ-কোণ থেকে ও-কোণে।

‘নগদ টাকা ফেলুন দিকি-আস্ত দ্বীপই হচ্ছে বিকি’ রিনরিনে গলা শোনা গেলো জিনগ্রাসের। আর তার চিৎকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ১০ নম্বর স্যাক্রামেনটা স্ট্রিটের নিলেমভবনে ক্রমেই বাড়তে লাগলো লোকসংখ্যা। কেবল যে মারকিন মুলুকের উটা, অরেগন ও ক্যালিফরনিয়ার লোকই এসে এখানে জড়ো হয়েছে, তা-ই নয়-ছ-ভাগের একভাগ লোক আবার ফরাশি। তাছাড়া রয়েছে মেহিকোর লোক, চিনেম্যান, উপকূলের দু-একজন কানুক, এমনকী ট্রিনিটি নদীর তীর থেকে ব্ল্যাক-ফ্লিট, এসভেনট্রেস আর ফ্ল্যাটহেডের দু-একটি ছিটেও সেখানে হাজির।

ক্যালিফরনিয়ার রাজধানী সান ফ্রানসিসকোতেই নিলেমটা হচ্ছিলো। লিমা, সান তিয়াগো, ভালপারাইসো—এদের হঠিয়ে দিয়ে সান ফ্রানসিসকোই আজকাল খুব জমজমাট শহর হ’য়ে উঠেছে—বলা যায় প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে জমকালো বন্দর বলতে এখন এটাকেই বোঝায়। তারিখটা হচ্ছে পনেরোই মে। আবহাওয়া এখনো বেশ কনকনে ঠাণ্ডা। মধ্য-ইয়োরোপে মার্চের শেষ দিকে যে-রকম আবহাওয়া থাকে, মেরুস্রোতের জন্যে মে মাসের গোড়ায় সান ফ্রানসিসকোর আবহাওয়া থাকে ঠিক সে-রকম। কিন্তু এই গিশগিশে ভিড়ে ঠাণ্ডা লাগবে কি, বরং হাঁসফাস শুরু হ’য়ে গেছে।

এটা যেন কেউ না-ভাবে যে এত লোক, সবাই জড়ো হয়েছে কেনবার জন্যে। মোটেই না। বরং বলা যায় প্রত্যেকেই এসেছে মজা দেখতে। এমন পাগল কে আছে যে প্রশান্ত মহাসাগরের একটা আস্ত দ্বীপ কিনে নেবে? টাকা হয়তো অনেকেরই আছে—কিন্তু সরকারের ভিমরতি হয়েছে ব’লে কি তাদেরও ভিমরতি হবে? সবচেয়ে কম দাম যেটা ধরা হয়েছে, তা-ই উঠবে কিনা কে জানে। এমন পাগল কেউ নেই বলেই নিলেমওলার এত হাঁকডাক, ছড়া কাটা কি অলংকারওলা-বাক্য বলা—সবই ব্যর্থ হ’লো। লোকে তার কথা শুনে হাসলে ঠিকই, কিন্তু কেউ যে কিনতে উৎসুক বা উৎসাহিত বোধ করলে তা কিন্তু মনে হ’লো না!

‘বিক্রি হচ্ছে! শস্তায় বিকিয়ে যাচ্ছে—আস্ত একটা দ্বীপ!’ জিনগ্রাস আবার হাঁক পাড়লে।

‘বিকোচ্ছে বটে, কিন্তু কিনছে না কেউ,’ উত্তর দিলে এক আইরিশম্যান— তার পকেটে একটা আস্ত দ্বীপের দাম তো দূরের কথা একটা ছোট্ট নুড়ির দামও আছে কিনা সন্দেহ!

নিলেমওলা হাঁকলে, ‘শস্তায় বিকোচ্ছে—এক একরের দাম ছ-ডলারও হবে না—’

‘তার আটভাগের একভাগ টাকাও ও-জমি থেকে উঠবে কি না সন্দেহ,‘ বললে এক ভারিক্কি দশাসই চাষী—জমিজমার দামদস্তুর সম্বন্ধে সে বেশ ভালোই ওয়াকিবহাল।

‘দ্বীপটার আয়তন হবে প্রায় চৌষট্টি বর্গমাইল—দুশো পঁচিশ হাজার একর জমি পাবেন দ্বীপে মোটমাট!’

‘ভিতরটা কী-রকম সে-জমির? শক্ত? না, নড়বোড়ে?’ জিগেশ করলে এক মেহিকান। মদের দোকানের সে বাঁধা খদ্দের—এই মুহূর্তে তারই ভিতটা নড়বোড়ে ঠেকছিলো।

‘সুন্দর গাছপালায় ভরা দ্বীপ—ঘাসের জমি, পাহাড়, ঝরনা—কী নেই!’

‘টেকসই তো?’ জিগেশ করলে একজন ফরাশি।

‘নিশ্চয়ই। টেকসই তো বটেই!’ ফেলপর্গ অনেকদিন নিলেমের ব্যাবসা চালাচ্ছে—ও-সব টীকা-টিপ্পনী-টিটকারিতে আজকাল আর তার ভুরু কোঁচকায় না।

‘কদ্দিন টিকবে? দু-বছর?’

‘জগৎ যদ্দিন টিকবে, ততদিন!’

‘তাই নাকি!’

‘চমৎকার দ্বীপ—কোনো আমিষখোর জন্তু নেই—নেই কোনো বুনো জানোয়ার বা সরীসৃপ!’

‘পাখি? পাখি নেই?’ জিগেশ করলে এক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে।

‘পোকা-মাকড়? না কি তাও নেই?’ ফোড়ন কাটলে অরেকজন

‘চড়া দাম যিনি হাঁকবেন, তার জন্যেই এই দ্বীপ!’ আবার গোড়া থেকে শুরু করলে ডীন ফেলপর্গ। ‘আসুন, মশাই, আসুন। পকেটে একটু সাহস আনুন! প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে আস্ত একটা ঝকঝকে দ্বীপ—মেরামতের কারবার নেই, ঝক্কিঝামেলা নেই, উর্বর, অব্যবহৃত, সম্ভাবনাপূর্ণ! শস্তায় চ’লে যাচ্ছে—জলের দরে বিকোচ্ছে! ১,১০০,০০০ ডলার দাম ধরা হয়েছে। এগিয়ে আসুন যিনি কিনবেন! কে আগে দাম হাঁকবেন, শুনি? আপনি? ও, মশাই, আপনি—ওই-যে, যিনি কোনায় ব’সে পোর্সেলেনের মান্দারিনের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছেন? দ্বীপ মশাই, আস্ত একখানা দ্বীপ—চমৎকার দ্বীপ!’

‘দিন না হাত বাড়িয়ে এদিকে, উলটেপালটে একবার দেখি,’ যেন কোনো ফুলদানি কিনতে চাচ্ছে, এমনি ভঙ্গিতে বললে একজন।

আর তক্ষুনি নিলেমভবন হো-হো হাস্যে ফেটে পড়লো, কিন্তু আধ ডলার দামও কেউ হাঁকলে না।

হাত বাড়িয়ে দ্বীপটাকে যদিও উলটেপালটে দেখতে দেয়া গেলো না, তবু তার মানচিত্র ছিলো, কৌতূহলী ক্রেতার জন্যে। তাছাড়া ক্যালিফরনিয়ার অগুনতি কাগজ—দৈনিক, অর্ধ-সাপ্তাহিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিকপত্র ছাড়াও অন্যান্য সাময়িকপত্রে বেশ কয়েক মাস ধরেই এই দ্বীপ বিক্রির কথা যাবতীয় তথ্যসমেত বেশ ফলাও ক’রে প্রচারিত হচ্ছিলো। দ্বীপটার নাম স্পেনসার আইল্যান্ড; সান ফ্রানসিসকো উপসাগরের পশ্চিম দক্ষিণ-পশ্চিমে, ক্যালিফরনিয়ার উপকূল থেকে প্রায় ৪৬০ মাইল দূরে দ্বীপটা অবস্থিত; গ্রীনউইচ থেকে হিশেব করলে দ্বীপটার অবস্থান, ৩২°১৫ উত্তর অক্ষাংশে ও ১৪৫°১৮ পশ্চিম দ্রাঘিমায়। আশপাশে কেবল যে কোনো দ্বীপ বা ডাঙা নেই, তা নয়—কোনো জাহাজই তার পাশ দিয়ে যায় না—না কোনো বাণিজ্যপোত, না কোনো সমরতরী;—অথচ স্পেনসার আইল্যান্ড এমনিতে খুব বেশি দূরে নয়—বলতে গেলে প্রায় মারকিন মুলুকের জলেই অবস্থিত। কিন্তু সেখানকার সমুদ্রে নানারকম পরস্পর-বিরোধী তীব্র স্রোত কতগুলো ভীষণ ঘূর্ণির সৃষ্টি করেছে, যার ফলে সব জাহাজই ওখানকার ফেনিয়ে-ওঠা চরকি জলকে সাবধানে এড়িয়ে যায়। অবশ্য কেউ যদি জাগতিক কোলাহল ও ব্যস্তভাব অপছন্দ করে, তাহ’লে এর চেয়ে নিরিবিলি জায়গা আর পাবে কোথায়? কোনো স্বতঃপ্রবৃত্ত রবিনসন ক্রুসোর পক্ষে দ্বীপটা অতীব প্রকৃষ্ট স্থান সন্দেহ নেই—তবে তার জন্যে তাকে অবিশ্যি পকেট উজাড় করে টাকা ঢালতে হবে।

কেউ জিগেশ করতে পারেন, হঠাৎ মারকিন যুক্তরাষ্ট্রই বা কেন দ্বীপটা বেচে ফেলতে চাচ্ছে? খামখেয়াল? না, কোনো রাষ্ট্রই অতটা খেয়ালখুশি নিয়ে কাজ চালাতে পারে না, তা সে মারকিন যুক্তরাষ্ট্রীয়ই হোক বা অন্য কিছুই হোক। আসল কথা হ’লো স্পেনসার আইল্যন্ডটা নৌপথের মধ্যে পড়ে না ব’লে অনেকদিন অকেজো ও পতিত প’ড়ে আছে। সেখানে কোনো উপনিবেশ স্থাপন করার কোনো ব্যবহারিক সুবিধে নেই, সমরবাহিনীর পক্ষেও দ্বীপটা তেমন জরুরি নয়। আর ব্যবসার দিক থেকেও দ্বীপটায় নৌ-চলাচল করার সুবিধে নেই—আমদানি-রপ্তানির মালের মাশুলই উঠবে না। আর দ্বীপান্তর হিসেবেও বিচার বিভাগ তাকে কাজে খাটাতে পারবে না, কারণ মূল উপকূল থেকে সেই অর্থে দ্বীপটা বড্ডই দূরে। কাজেই দ্বীপটা সেই জন্যেই প্রায় স্মরণাতীত কাল থেকেই অব্যবহৃত প’ড়ে ছিলো। কিন্তু মারকিন কংগ্রেসে যেহেতু ব্যবসাদারদের সংখ্যা কম নেই, তাই তারা এবার দ্বীপটা বেচে দেবারই মলব এঁটেছে। শর্ত কেবল একটাই : ক্রেতাকে মারকিন নাগরিক হতে হবে। বেচে দেয়া হচ্ছে ব’লে যে নামমাত্র দর চাওয়া হবে, তাও নয়— সবচেয়ে কম দাম ধার্য হয়েছে ১,১০০,০০০ ডলার। জমিজমা কেনাবেচা করে যে সব প্রতিষ্ঠান, তাদের পক্ষে অবশ্য ওটাকা কিছুই না, যদি ও জমি থেকে কিছুমাত্র লাভের সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এই স্পেনসার আইল্যান্ডের পিছনে অত টাকা ঢালার মানেই হ’লো সব টাকা জলে দেয়া—কেননা ও টাকা উশুল করার কোনো উপায়ই নেই। কাজেই যাদের একটু কাণ্ডজ্ঞান বা সাংসারিক সুবুদ্ধি আছে, তারাই মেরুবলয়ের বরফ ঢাকা কোনো জমির সঙ্গে এই দ্বীপটার কোনোই ব্যবহারিক তফাৎ দেখতে পাবে না। কেননা একদিক থেকে টাকার অঙ্কটা বেশ স্ফীতকায়। এ-রকম শখ বজায় রাখার বা খেয়াল মেটাবার জন্যে লোকের অতীব ধনাঢ্য হওয়া চাই, কারণ শতকরা আধ সেন্ট হারেও এ থেকে কিছু উশুল হবার সম্ভাবনা নেই। তাছাড়া পুরো টাকাটা নগদানগদ বার ক’রে দেয়াটা মারকিন মুলুকের ধনকুবেরদের পক্ষেও খুব একটা তাচ্ছিল্য করার মতো ব্যাপার নয়—বিশেষত ও টাকা ঢালার মানেই হলো যখন মস্ত অপব্যয় করা। টাকা ওড়াবার বা জলে ফেলবার আরো অনেক মুখরোচক উপায় আছে। অথচ কংগ্রেস আবার জেদ ধরে বসেছে এগারোশ হাজার ডলারের এক কানাকড়ি কমেও দ্বীপটা বিক্রি করা হবে না। কাজেই দ্বীপটা যে বিক্রিই হবে না, সেটা এরকম ধরেই নেয়া যায়। ও-রকম খ্যাপা লোক জগতে কটা আছে?

তাছাড়া আরেকটা শর্তও আছে। ও-দ্বীপ যিনি কিনবেন, তিনি কিছুতেই স্পেনসার আইল্যান্ডের রাজা ব’লে নিজেকে ঘোষণা করতে পারবেন না, বরং কোনো প্রজাতন্ত্র ঘোষণা ক’রে তার নির্বাচিত অধ্যক্ষ হ’তে পারেন। মারকিন জলে কোনো রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কংগ্রেস কিছুতেই সহ্য করবে না। আর এই শর্তের জন্য অনেক ক্রোড়পতিই পেছিয়ে গেছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপ ওরফে স্যান্ডউইচ অ্যাইল্যান্ড, মার্কেসাস দ্বীপ প্রভৃতি দ্বীপের মতো স্পেনসার আইল্যান্ডের রাজা হবার গোপন উচ্চাশা যাঁদের ছিলো, এই স্পষ্ট শর্তের পর তাঁদের সব শখ উবে গেছে।

তা, কারণ যা-ই থাক মোদ্দা ব্যাপারটা দাঁড়ালো এই যে জিনগ্রাসের এত হাঁকডাক সত্ত্বেও কিছুক্ষণ কোনো ভাবী ক্রেতারই সাড়া পাওয়া গেলো না। অনর্থক কেবল কালক্ষেপই হচ্ছে, চেঁচিয়ে জিনগ্রাসের গলাই বুঝি ভেঙে গেলো, কিন্তু কোনো উচ্চবাচ্চ্যই হলো না ঘরে। বরং নিলেমওয়ালার হাতুড়ির বাড়ির সঙ্গে তাল রেখে কেবল হাস্যরোল বাড়তে লাগলো লোকের মধ্যে, টিটকিরির পরিমাণ বেড়েই গেলো, হুল্লোড় মোটেই কমলো না। একজন কেবল ঘোষণা করলে যে ইস্টাম্বর কাগজের খরচা সমেত সে দু-ডলার দিয়ে দ্বীপটা কিনতে পারে; শুনে আরেকজন বললে যে ও-দ্বীপটা যাকে গছানো হবে, তার তো ইহকাল পরকাল ঝরঝরে, তাই সরকারেরই উলটে টাকা দেওয়া উচিত।

আর তারই মধ্যে সারাক্ষণ জিনগ্রাস চেঁচিয়ে চলেছে :

‘নগদ টাকা ফেলুন, দিকি,
আস্ত দ্বীপ এক হচ্ছে বিকি!’ *

[জুল ভের্ন-এর আরো-একটি রোমাঞ্চকর উপন্যাস এমনি একটি আন্তর্জাতিক নিলেমের বিবরণ দিয়ে শুরু হয়েছে, পাঠক পড়ে দেখতে পারেন : ‘পারচেজ অভ দি নর্থ পোল!’]

এবং কুত্রাপি কোনো খদ্দেরের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

মার্চেন্ট স্ট্রিটের এক মনোহারি দোকানের মালিক স্টাম্পি জিগেশ করলে, ‘মালভূমি আছে নাকি ওখানে?’

‘আর আগ্নেয়গিরি? একটাও আগ্নেয়গিরি নেই?’ জিগেশ করলে ওকহার্স্ট, মানগোমেরি স্ট্রিটের শুঁড়িখানার মালিক।

‘কোনো আগ্নেয়গিরি নেই। থাকলে কি এত শস্তায় পেতেন ব’লে ভাবছেন?’ উত্তর দিলে ফেলপর্গ।

তক্ষুনি আরেক দফা হাস্যরোল উঠলো সারা ঘরে।

‘বিক্রি হচ্ছে, দ্বীপ—আস্ত একটা দ্বীপ। নির্দিষ্ট দামের কেবল এক সেন্ট বেশি বললেই দ্বীপটা আপনার হ’য়ে যাবে,’ জিনগ্রাস ওদিকে গলা ফাটিয়ে, ফুশফুশ ছিঁড়ে চেঁচিয়েই চলেছে।

কোথাও কোনো সাড়া নেই!

‘কেউ যদি কোনো দাম না-হাঁকেন তো আমরা নিলেম বন্ধ ক’রে দিই। এক দুই!…’

‘বারশো হাজার ডলার!’

রিভলভারের গুলির মতো শব্দ তিনটে ঘরের মধ্যে ফেটে পড়লো। হতবাক ভিড় তাকিয়ে দেখলে, কে এই দুঃসাহসী!

ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, সান ফ্রানসিসকোর উইলিয়াম ডাবলিউ কোল্ডেরুপ।

টাকিনার আর কোল্ডেরুপ
পরস্পরের প্রতি বিরূপ।

উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপ হচ্ছেন এমন ব্যক্তি, যিনি তাঁর ডলার গোনেন কোটির অঙ্কে। তাঁর তুলনায় নাকি ওয়েস্টমিনস্টারের ডিউক, নেভাদার সেনেটার জোনস, রথসচাইল্ড, ফানডেরবিল্ট, নর্দাম্বারল্যাণ্ডের ডিউক নিতান্তই মধ্যবিত্ত। কোল্ডেরুপ কথায়-কথায় লক্ষ টাকা বিলিয়ে দেন, সাধারণ লোক যেখানে এক শিলিং খরচা করতেই মাথা চুলকে একবার ভেবে নেয়।

ক্যালিফরনিয়ার অনেকগুলো খনির মালিক কোল্ডেরুপ। প্রচুর কলকারখানা আছে তাঁর, অনেকগুলো জাহাজের মালিক, ইয়োরোপে ও আমেরিকায় নানা প্রতিষ্ঠানে তাঁর টাকা খাটে। তাঁর টাকা গণিতের হিশেবে বাড়ে না, বাড়ে জ্যামিতিকে প্রগতিতে। লোকে বলে তাঁর যে কত টাকা আছে, তা নাকি তিনি নিজেই জানেন না। কথাটা অবিশ্যি মোটেই ঠিক নয়। শেষ ডলারটুকুর হিশেব পর্যন্ত তিনি জানেন—কিন্তু তা নিয়ে বাইরে জাঁকও দেখান না, দেমাকও করেন না।

এই মুহূর্তে জগতের নানা স্থানে তাঁর সদাগরি প্রতিষ্ঠানের ২০০০টি শাখা রয়েছে, আমেরিকা ইয়োরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৮০,০০০ কর্মচারী তাঁর আপিশে কাজ করে, পত্র বিনিময় হয় অন্তত ৩০০,০০০ লোকের সঙ্গে, আর ৫০০টি জাহাজ জলে ভাসে। কেবল ডাকটিকিট আর রেভিনিউ স্টাম্পেই বছরে অন্তত দশ লাখ ডলার তাঁর খরচ হয়। এককথায় কোল্ডেরুপ হচ্ছেন সান ফ্রানসিসকোর গৌরব ও মহিমা।

সেই কোল্ডেরূপ যখন একটা ডাক দিলেন, তখন তাকে ঠাট্টা বা ইয়ার্কি বলে উড়িয়ে দেয়া যায় না। যেই ভিড়ের ভ্যাবাচাকা ভাবটা একটু ক’মে গেলো, অমনি মুহূর্তের মধ্যে হাসিটিটকিরির বদলে একটা সম্মিলিত ও অস্ফুট প্রশংসাসূচক ধ্বনি উঠলো ঘরের মধ্যে। তার পরেই সব আওয়াজ থেমে গেলো, লোকের চোখ গোল-গোল ও বিস্ফারিত হ’য়ে উঠলো, কানগুলো সব হ’য়ে উঠলো খাড়া ও উৎকর্ণ। কারণ কেউ যদি ইয়ার্কি ক’রেও কোল্ডেরুপের উপরে একটা দর হাঁকে, তাহ’লে যে কী কাণ্ড হবে, সেটা ভেবেই সবাই হঠাৎ এমন চুপ ক’রে গেলো। কিন্তু তা কি সম্ভব? কোল্ডেরুপের উপরে কি কেউ কোনো ডাক দিতে সাহস পাবে?

নিশ্চয়ই না। বিশেষ করে কোল্ডেরুপের মুখের দিকে তাকালেই এটা বোঝা যেতো যে কোনো জিনিশ কিনবেন ব’লে একবার যদি তিনি মনস্থির ক’রে থাকেন তাহলে কারু সাধ্য নেই তাঁকে টলাতে পারে। মস্ত মানুষ কোল্ডেরুপ, দেহের খাঁচাটাই বেশ বড়ো, দশাসই; মস্ত মাথাটি ধড়ের উপর সাবধানে বসানো, কাঁধটা চওড়া, সুগঠিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আঁটোশাটো, ইস্পাতের মতো শক্ত। শান্ত ও দৃঢ় তাঁর দৃষ্টি, সহজে সে-দৃষ্টি নত হয় না; ধূসর তাঁর চুল, সামনেরদিকটা বুরুশ-করা, কিন্তু এমন ঝাঁকড়া-ঝাঁকড়া যে মনে হয় বুঝি-বা কোনো অল্পবয়েসী মানুষ। খাড়া সরল নাক, যেন একটা সমকোণী ত্রিভুজের রেখা। গোঁফ নেই, শ্মশ্রুসম্বল—কিন্তু সে-দাড়ি ইয়াঙ্কি কেতায় ছাঁটা, মস্ত জুলপি; মুক্তোর মতো ঝকঝকে দাঁত। বোঝা যায় কোনো বিষম ঝড়ও এই লোকটাকে নোয়াতে পারবে না। নিলেমে কেউ যদি তাঁর উপরে কোনো ডাক দেয় তো তিনি একবার ক’রে মাথা হেলাবেন, আর অমনি দরটা একশো হাজার ডলার ক’রে বেড়ে যাবে। তাঁর মুখের উপর ডাক দেবে, এমন লোক কেউ নেই।

‘বারশো হাজার ডলার—বারশো হাজার!’ জিনগ্রাস হাঁক দিলে, ‘চ’লে যাচ্ছে— শস্তায়-বারোশো হাজার ডলার!’

শুঁড়িখানার মালিক ওকহার্স্ট ফিশফিশ করে বললে, ওহে, এর উপরে নিরাপদেই আরেকটা হাঁক দিতে পারো—কোল্ডেরুপ কিছুতেই ছেড়ে দেবে না।

মার্চেন্ট স্ট্রিটের মনোহারি দোকানের মালিক বললে, ‘কোল্ডেরুপ জানে যে কেউ তার উপরে কথা কইতে আর সাহস পাবে না।’

পাশ থেকে অমনি কে যেন প্রায় ধমক বললে, ‘শ্ শ্ শ্…চুপ।’ সবাই কানখাড়া ক’রে আছে রুদ্ধশ্বাসে—কী হয় না–হয়, তার টু শব্দটি কেউ গুলিয়ে ফেলতে চায় না। সকলেরই বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হ’য়ে গেছে। উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপ অবিশ্যি দিব্যি আছেন—নিশ্চিন্ত ও নির্বিকার – যেন গোটা ব্যাপারটাতেই তাঁর আর কোনো আকর্ষণ নেই। কিন্তু তাঁর আশপাশে যারা ছিলো, তারা সব্বাই দেখলে তাঁর চোখ দুটো যেন গুলিভরা রিভলভারের মতো তৈরি—টু শব্দ হ’লেই ডলার ছুঁড়তে শুরু করে দেবে।

‘আর কেউ হাঁকবেন?’ জিগেশ করলে ডীন ফেলপৰ্গ।

কেউ কোনো কথা বললে না।

‘চ’লে যাচ্ছে শস্তায়!’ জিনগ্রাস হাঁক দিলে, ‘বারশো হাজার ডলার-এক! বারোশো হাজার ডলার—দুই!’

ডীন ফেলপর্গ বললে, বারোশো হাজার ডলারে আস্ত স্পেনসার আইল্যাণ্ডটাই বিক্রি হ’য়ে যাচ্ছে।…ঠিক জানেন আপনারা, এর উপর আর হাঁকবেন না? ঠিক?

সব্বাই রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা ক’রে আছে। ঠিক শেষ মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি দাম হাঁকবে নাকি কেউ? ফেলপর্গ টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে হাতির দাঁতের হাতুড়িটা তুলে নিলে—এক ঘা, দুই ঘা—তারপরেই নিলেম শেষ হয়ে যাবে।

হাতুড়িটা আস্তে-আস্তে পড়লো টেবিলে; টেবিল ছুঁয়েই আবার উঠে পড়লো পরক্ষণে, যেমন ক’রে অসিযুদ্ধের সময় তলোয়ার চলে, তেমনি বিদ্যুদ্বেগে; তারপর আবার দ্রুতবেগে তা নামতে লাগলো নিচের দিকে।

কিন্তু টেবিলে ঘা দেবার আগেই ভিড়ের মধ্যে তিনটে কথা শোনো গেলো—স্পষ্ট, নির্ভুল ও শান্ত উচ্চারণ :

‘তেরোশো হাজার ডলার!’

গোড়ায় লোকে যেন দর শুনে খাবি খেলে একবার, ‘আহ্!’ তার পরেই সকলের সন্তোষ আর ধরে না—যাক! প্রতিদ্বন্দ্বী একজন তবে দেখা দিয়েছে শেষকালে! ‘আহ্! যুদ্ধ তবে একটা বাধলো সত্যিই! কিন্তু কে সেই বেচাল উজবুক, যে সান ফ্রানসিসকোর কোল্ডেরুপের উপরে কথা বলার সাহস করে?

লোকটি আর কেউ নয়, স্টকটনের জে. আর. টাসকিনার।

জে. আর. টাসকিনার যতটা না ধনী, তার চেয়েও বেশি স্থূলকায় –বড্ড বেশি মোটা ভদ্রলোকটি। তাঁর ওজন হবে ৪৯০ পাউণ্ড। শিকাগোতে সে—বার যখন জগতের সবচেয়ে পৃথুল ব্যক্তির নির্বাচন হয়েছিলো, তখন তিনি অল্পের জন্যে যে প্রথম হননি, তার কারণই হ’লো সেদিন তিনি নৈশভোজ শেষ করার সময় পাননি—তাই প্রথম যে হয়েছিলো তাঁর সঙ্গে তাঁর ওজনের মাত্র বারো পাউণ্ড তফাৎ হয়ে যায়।

এই বিরাট স্তম্ভটি উপবিষ্ট হওয়ার জন্যে বিশেষ মাপে বিশেষ ধরনের চেয়ার প্রস্তুত ক’রে নিয়েছেন—ও—সব বৃহদায়তন আশবাব থাকে সান জোয়াকিম—এর স্টকটনে—তাঁর প্রাসাদোপম অট্টালিকায়। স্টকটন হচ্ছে ক্যালিফরনিয়ার একটি নামজাদা নগর – দক্ষিণাঞ্চলের খনিগুলোর স্নায়ুকেন্দ্র—উত্তরের খনিগুলোর স্নায়ুকেন্দ্র স্যাক্রামেনটোর প্রতিদ্বন্দ্বী।

কেবল যে খনির মালিক ব’লেই টাসকিনারের অগাধ টাকা তা নয়—পেট্রল বেচেই প্রধানত তিনি কুবেরের সম্পত্তি লাভ করেছেন। তা ছাড়া তাশের জুয়োতেও তাঁর বিস্তর আয় হয়—পোকার খেলায় গোটা মারকিন মুলুকে তাঁর জুড়ি নেই।

কিন্তু অত টাকা থাকলে কী হয়, লোকে তাঁকে মোটেই সম্মান করে না। লোকের ধারণা মানুষ হিশেবে টাসকিনার মোটেই শ্রদ্ধার পাত্র নন—বরং আস্ত একটি রাস্কেল। দয়ামায়া ব’লে কোনো পদার্থই নেই তাঁর শরীরে—কতবার যে তিনি তাঁর প্রিয় রিভলভারটি সশব্দে ব্যবহার করেছেন, তার আর ইয়ত্তা নেই।

এই জে. আর. টাসকিনার কোনোদিনই উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপকে পছন্দ করতে পারেননি। প্রথমত অত টাকা আছে ব’লে তাঁকে তিনি খুবই হিংসে করতেন—তাঁর খ্যাতি ও সম্মানও ছিলো তাঁর চক্ষুশূল। তাছাড়া মোটা লোকেরা রোগা লোকদের যে-রকম ঘেন্না বাসে, অপছন্দ করে, কোল্ডেরুপকে সে-রকমই ঘৃণা করতেন টাসকিনার। শুধু এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভাব নিয়েই এর আগেও অনেকবার কোল্ডেরুপকে তিনি উত্ত্যক্ত করেছেন। কোল্ডেরুপ তো এ-ধরনের লোক অনেক ঘেঁটেছেন—সব বারেই অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে তিনি উদাসীন ও নির্বিকার-ভাবে টাসকিনারকে জব্দ করেছেন।

এই তো সেদিন স্যাক্রামেনটোর বিধানসভার নির্বাচনের সময় কোল্ডেরুপ আর টাসকিনারে মস্ত একটা বিরোধ বেধেছিলো। টাসকিনারে সব অপপ্রচার, গালিগালাজ, অর্থব্যয় সত্ত্বেও শেষটায় কোল্ডেরুপই অবশ্য বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন—আর তারই ফলে টাসকিনার এখনও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর মহা খাপ্পা হ’য়ে রয়েছেন। ঘা-টা এখনও পুরোপুরি শুকোয়নি কিনা

কেউ জানে না কেমন ক’রে টাসকিনার খবরটা পেয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর প্রচুর চর আছে চারদিকে। কিন্তু যেই তিনি খবর পেলেন যে কোল্ডেরুপ স্পেনসার আইল্যাণ্ড কিনে নেবেন বলে মনস্থির করেছেন, অমনি কোল্ডেরুপকে জ্বালাতন করবার জন্যে তিনি এসে হাজির হয়েছেন। দ্বীপটি যে কোনো কাজেই লাগবে না, বরং দ্বীপটি কেনবার চেষ্টা করার মানেই হ’লো অহেতুক টাকা ওড়ানো, তা কোল্ডেরুপের সঙ্গে-সঙ্গে টাসকিনারও ভালোই জানতেন। কিন্তু তবু নিলেমের সময় দাম চড়িয়ে দিয়ে কোল্ডেরুপকে তো উত্ত্যক্ত করা হ’লো।

আর সেইজন্যেই এই কৌতূহলী দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে এই নিরেট ৪৯০ পাউণ্ডকে সশরীরে হাজির হ’তে দেখা গেলো। লোকে অবশ্য তাঁকে দেখে গোড়ায় তাঁর মলবটা টের পায়নি। টাসকিনার কেবল অপেক্ষা করছিলেন কোল্ডেরুপ কখন দাম হাঁকেন। নিমীলিত কুৎকুতে নয়নে কোল্ডেরুপের দিকে তাকিয়ে টাসকিনার যখন বুঝতে পারলেন যে দ্বীপটা কুক্ষিগত হ’য়ে গেছে ব’লে কোল্ডেরুপ মোটামুটি নিশ্চিন্ত হ’য়ে গেছেন, তখনই তিনি ফানুশ ফাটালেন :

‘তেরোশো হাজার ডলার!’

এবং তক্ষুনি সব লোক চকিতে ঘুরে গিয়ে অবলোকন করলে কে এই অর্বাচীন কুবেরনন্দন! ‘ও :! মোটা টাসকিনার!’ তাঁকে দেখেই অস্ফুট রব উঠলো নিলেমভবনে।

হ্যাঁ, মোটা টাসকিনারকে মারকিন মুলুকে কে না চেনে। কারটুন – আঁকিয়েদের কল্যাণে তাঁর শ্রীঅঙ্গের প্রতিরূপ বহু খবর-কাগজের পাতাতেও ফুর্তির সঙ্গে নানা সময়ে শোভা পেয়েছে।

এবার কিন্তু টাসকিনারের ৪৯০ পাউণ্ড কারু কৌতূহল উশকে দেয়নি লোকে উত্তেজিত হ’য়ে উঠলো অন্য-একটি মহোৎসবের প্রত্যাশায়। এ-যে একেবারে সরাসরি যুদ্ধে নামলে কোল্ডেরুপের বিপক্ষে! ডলার বনাম ডলারের লড়াই—দুজনেই প্রায় রোদে টাকা শুকোন! কাজেই প্রথম উত্তেজনার শোরটা কেটে যেতেই ঘরে এমন স্তব্ধতা নামলো যে মাকড়শার জাল বোনার শব্দ বোধহয় অনায়াসেই শোনা যেতো।

স্তব্ধতা ভাঙলে ডীন ফেলপর্গের আহ্লাদিত গলা : ‘শস্তায় চ’লে যাচ্ছে স্পেনসার আইল্যাণ্ড—মাত্র তেরোশো হাজার ডলারে!’

উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপ তখন ধীরেসুস্থে ফিরে দাঁড়িয়ে জে. আর. টাসকিনারের ৪৯০ পাউণ্ড অবলোকন করছেন। লোকে স’রে গিয়ে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে তখন জায়গা ক’রে দিয়েছে। সান ফ্রানসিসকোর নামজাদা আর স্টকটনের উচ্চাশা তখন পরস্পরের দিকে নির্বিকার ভঙ্গিতে চোখে-চোখে তাকিয়ে আছেন।

ওইভাবে তাকিয়ে থেকেই কোল্ডেরুপ বললেন, ‘চোদ্দশো হাজার ডলার।’

চোখ না-নামিয়েই টাসকিনার বললেন, ‘পনেরোশো হাজার!‘

‘ষোলোশো হাজার!’

‘সতেরোশো হাজার!’

গ্লাসগোর দুই মাতব্বরের গল্প জানেন? কারখানার চিমনি কে কত উঁচুতে তুলতে পারে ব’লে তারা একবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলো। এঁরা দুজনেই এখনও শূন্যে চিমনি তুলছেন—তবে সে-চিমনি আগাগোড়া সোনায় মোড়া।

কোল্ডেরুপ অবিশ্যি প্রতিবারই দর হাঁকার আগে কয়েক মুহূর্ত সময় নিচ্ছেন—কিন্তু টাসকিনারের হাঁক বোমার মতো ফেটে পড়ছে নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায়।

‘সতেরোশো হাজার ডলার!’ ফেলপর্গ চ্যাচালে, ‘এ কি আবার একটা দাম নাকি? দ্বীপটা খোলামকুচি নাকি যে এত শস্তায় বিক্রি হবে। নাঃ, মশাইরা আরেকটু দর তুলুন!‘

আঠারোশো হাজার ডলার!’ আস্তে বললেন কোল্ডেরুপ।

‘উনিশশো হাজার!’ টাসকিনারের হুংকার উঠলো।

‘কুড়ি লক্ষ ডলার!’ কোল্ডেরুপ এবার যেন না-ভেবেই দুমদাম কথাটা ব’লে ফেললেন। তাঁর মুখটা এতক্ষণে একটু বিবর্ণ দেখাচ্ছে, তবে তিনিও নাছোড়বান্দা, সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নন।

টাসকিনার তো তখন অগ্নিশর্মা। তাঁর মস্ত মুখমণ্ডলের ভাঁটার মতো চোখ দুটো যেন রেলগাড়ির সিগন্যাল-লাল জ্বালিয়ে রেখেছে, কারু ধারে-কাছে ঘেঁষা নিষেধ। কিন্তু ওই লাল লণ্ঠন দেখেই কি মানবেন কোল্ডেরুপ—না কি হুশ-হুশ ক’রে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে তাঁর ইঞ্জিন চালিয়ে দেবেন?

মোটা-মোটা আঙুল দিয়ে সোনার চেনে ঝোলানো বুকপকেটের ক্রনোমিটারটা নাড়তে-নাড়তে টাসকিনার বললেন, ‘কুড়ি লক্ষ চারশো হাজার ডলার!’ ভাবলেন বুঝি এক লম্ফেই এবার প্রতিদ্বন্দ্বীকে পেরিয়ে যাবেন।

অত্যন্ত শান্ত গলায় কোল্ডেরুপ বললেন, ‘সাতাশ লক্ষ! ‘

‘উনত্রিশ লক্ষ!’

‘তিরিশ লক্ষ!’

হ্যাঁ, সান ফ্রানসিসকোর কোল্ডেরুপই ওই শেষ তিরিশ লক্ষ ডলার হেঁকেছেন!

সারা ঘরে হাততালি ফেটে পড়লো—থেমে গেলো, নিলেমওলা হাতুড়ি তুলে টেবিল বাজালে, একবার দু-বার সে দরটা হাঁকলে, তৃতীয়বার হাঁকলেই স্পেনসার আইল্যাণ্ড বিক্রি হ’য়ে যাবে।

তিরিশ লক্ষ ডলারের ওজন ততক্ষণে ৪৯০ পাউণ্ডকে কুপোকাৎ ক’রে দিয়েছিলো। তবু সেই চিৎপাৎ অবস্থা থেকেই চিঁ-চিঁ রব বেরুলো, পঁয়ত্রিশ লক্ষ ডলার!’

‘চল্লিশ লক্ষ!’ তক্ষুনি হাঁকলেন কোল্ডেরুপ। হাঁকলেন না তো, যেন কুড়ুলের শেষ কোপ দিলেন। টাসকিনার আর পারলেন না। হাতুড়ি বাজতে লাগলো-

এবং চল্লিশ লক্ষ ডলারে সান ফ্রানসিসকোর উইলিয়াম ডাবলিউ কোল্ডেরুপ প্রশান্ত মহাসাগরের স্পেনসার আইল্যাণ্ড কিনে নিলেন।

‘এর শোধ আমি নেবোই’, বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে রুষ্টভাবে তাকিয়ে টাসকিনার চ’লে গেলেন অকসিডেণ্টাল হোটেলে; রাগে-ঘৃণায় তাঁর সর্বাঙ্গ রি-রি ক’রে জ্বলছে।

কিন্তু তিন-তিরিক্কে ন-বার উঠলো ‘হিপ হিপ হুরে’ ধ্বনি—আর কানে সেই অভিনন্দন যতক্ষণ ধরে বাজলো তার মধ্যেই কোল্ডেরুপ ফিরে গেলেন মানগোমেরি স্ট্রিটে। উৎসাহের চোটে মারকিনরা ‘ইয়াঙ্কি ডুডল’ গেয়ে তাঁকে অভিনন্দন জানাতে ভুলে গিয়েছিলো।

গডফ্রের জন্য ফিনা
অপেক্ষা করবে কিনা!

উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপ মানগোমেরি স্ট্রিটে তাঁর ম্যানশনে ফিরে এসেছেন তখন। মানগোমেরি স্ট্রিট হচ্ছে সান ফ্রানসিসকোর রিজেন্ট স্ট্রিট, ব্রডওয়ে, বুলভার দ্যে ইতালিয়ঁ। রাস্তাটা গেছে শহরের সমান্তরভাবে—শহর যদি হয় কোনো প্রাণী, তো এটা তার ধমনী—সবসময়েই সেখানে প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়; অগুনতি ট্র্যামের ঘর্ঘর; ঘোড়ায়-টানা খচ্চরে-টানা চার চাকার দু-চাকার গাড়ির ক্যাঁচকোঁচ; ফুটপাথ ধ’রে শশব্যস্ত কর্মচঞ্চল মানুষের জুতোর মশমশ; সরাইখানায় শুঁড়িখানায় সারাক্ষণ লোকের কোলাহল – মানগোমারি স্ট্রিট কখনোই চুপচাপ থাকে না।

সান ফ্রানসিসকোর নবাবসাহেবের ম্যানশনটার বর্ণনা দেবার কোনো দরকার নেই, আশা করি। এত কোটি-কোটি ডলারের সঙ্গে মানিয়েই বিলাস ও ভোগের ব্যবস্থা—যতটা-না রুচির ছাপ দেখা যায়, তার চেয়েও বেশি পাওয়া যায় আরাম। ব্যবহারিক সুবিধের দিকে যতটা নজর, বাড়ির সৌন্দর্যের দিকে তার সিকিভাগও নেই। তা আর কী ক’রে হবে? একেবারে সবকিছুই তো আর মানুষের ভাগ্যে জোটে না। পাঠক শুধু এটুকুই জানুন যে লোক এলে সে-ঘরটায় বসতে দেয়া হয়, যে-ঘরটার তুলনা নেই। কোল্ডেরুপ এসে যখন সেই চমকপ্রদ ঝকঝকে ও মস্ত ঘরটায় ঢুকলেন, সে-ঘরে তখন পিয়ানো বাজছিলো।

‘ভালোই হ’লো!’ কোল্ডেরুপ বললেন, ‘ওরা দুজনেই আছে দেখছি। খাতাঞ্চিকে একটা কথা ব’লে আসি, তারপর একটু আলাপ করে দেখা যাবে এদের সঙ্গে।’

ব’লে তিনি আপিশ ঘরে গিয়ে স্পেনসার আইল্যাণ্ডের তুচ্ছ ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়ে পুরো ব্যাপারটাকেই মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলেন। কতগুলো দলিল-দস্তাবেজ তাঁর ব্যাগে আছে—সেগুলোতে স্ট্যাম্প বসিয়ে মোহর ক’রে দিলেই দ্বীপটা তাঁর হ’য়ে যাবে। এ-বিষয়ে তাঁর দালালকে শুধু পাঁচ-ছ লাইনলিখে জানানো-বাস, সব কাজ শেষ। তারপর কোল্ডেরুপ ওই যুগলের দিকে দৃষ্টি দেবেন—ওদের তাঁর ভালোই লাগে।

হ্যাঁ, ওরা দুজনেই আছে ড্রয়িংরুমে। মেয়েটি ব’সে আছে পিয়ানোয়, ছেলেটি আধ শোয়া ভঙ্গিতে সোফায় হেলান দিয়ে উদাসীনভাবে শুনছে সেই ঝমঝমে সুর।

‘শুনছো তো?’ মেয়েটি জিগেশ করলে।

‘নিশ্চয়ই।’

‘শুনছো তো, কিন্তু ধরতে পেরেছো কোন সুর?’

‘ধরতে পেরেছি কি না! ফিনা, এত চমৎকার ক’রে কোনোদিন তুমি ‘বুড়ো রবিন গ্রে’র সুরটা বাজাওনি।’

‘কিন্তু গডফ্রে, এটা মোটেই ‘বুড়ো রবিন গ্রে’ নয়—এটার নাম হ’লো ‘সুখী মুহূর্ত।’

‘ওঃ, হ্যাঁ! মনে পড়েছে।’ গডফ্রের গলার উদাসীনতাকে না-চেনার কোনো সুযোগই ছিলো না।

ফিনা তার দুটি হাত তুলে আনলে, শূন্যে উদ্যত রইলো হাত দুটি, বুঝি আবার পিয়ানোর চাবির উপর নেমে আসে—কিন্তু না, সে একটু ঘুরে শান্ত চুপচাপ গডফ্রের দিকে তাকালে একটুক্ষণের জন্য। গডফ্রে তার চোখের দিকে তাকাতে সাহস পেলে না, অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো।

ফিনা হলানে হ’লো কোল্ডেরুপের পালিতা কন্যা। মা-বাবা ছিলো না তার—কোল্ডেরুপই তাকে মানুষ করেছেন, শিখিয়েছেন লেখাপড়া, ভাবতে শিখিয়েছেন কোল্ডেরুপের মেয়ে ব’লে, কোল্ডেরুপকে বাবা ব’লে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। ফিনার বয়েস কম, মাত্র ষোলো, ঠিক সাধারণ অর্থে না-হ’লেও সে রূপসী, সোনালি চুল—আর স্বচ্ছ কালো চোখ দুটি দেখে অবশ্য তাকে ষোলো বছরের মেয়ে ব’লে মনে হয় না, মনে হয়ে আরো-একটু বুঝি-বা পক্ক। কাণ্ডজ্ঞান তার যথেষ্টই হয়েছে, সাংসারিক সুবুদ্ধি এতই বেশি যে প্রায় যেন স্বার্থপর মনে হয়—ঠিক ষোলো বছরের তরুণীরা যে-রকম স্বপ্ন দ্যাখে সচরাচর, তা সে কদাচ দ্যাখেনি। যদি-বা দ্যাখে সে ঘুমিয়ে; কোনো জাগরস্বপ্নকে সে প্রশ্রয় দেয় না। এখন সে মোটেই ঘুমিয়ে নেই—এবং এখন ঘুমিয়ে পড়ার কোনো ইচ্ছেও নেই তার।

‘গডফ্রে?’ ফিনা ডাক দিলে।

‘বলো!’ গডফ্রে তাকে জিগেশ করলে।

‘কোথায় আছো তুমি এখন, জানো তো?’

‘কেন? তোমার কাছে—এই ঘরে—

‘মোটেই না! তুমি আমার কাছে নেই গডফ্রে, এই ঘরেও নেই। নিশ্চয়ই অনেক, অনেক দূরে-সমুদ্র পেরিয়েও আরো-দূরে….তাই না?’

প্রায় যেন কলের পুতুলের মতো ফিনা পিয়ানোর চাবিতে একটা ঝমঝমে বিষণ্ণ সুর বাজালে, যার অর্থ কেবল কোল্ডেরুপের এই ভাগ্নেরই কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে।

গডফ্রে মরগান এই রকমই। কোল্ডেরুপের বোনের ছেলে সে—তারও মা-বাবা ছেলেবেলাতেই মারা গেছেন, তার পর থেকে এই মাতুলের কাছে মানুষ—ফিনার মতোই। এবং চরকির মতো ব্যাবসার মধ্যে ঘুরলে কী হয়, কোল্ডেরুপের ইচ্ছে হ’লো এই দুটিতে বিয়ে দেন।

গডফ্রের বয়েস বাইশ পেরিয়েছে। সদ্য পাশ ক’রে বেরিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, হাতে কোনোই কাজকর্ম নেই, কুঁড়েমিতে ঘুণ ধ’রে গেছে দিনগুলোয়। লেখাপড়া শিখে কোনোই লাভ হয়নি তার—কারণ জীবিকার কথা তাকে ভাবতে হয় না।

উপস্থিত বুদ্ধি আছে গডফ্রের। এমনিতে ভদ্র, শান্ত, আভিজাত্যমণ্ডিত — পোশাক- আশাকের জাঁকজমকে তার বিশ্বাস নেই, দেমাকও নেই কোনোরকম।

ফিনাকে সে বিয়ে করবে। দুটিতে এমনিতেই নাকি রাজযোটক, সোনার সঙ্গে সোহাগার মতো মিল—লোকে বলে। তাছাড়া বিয়ের ঘটকালিটা তো করছেন কোল্ডেরুপ স্বয়ং। দুজনেই কোল্ডেরুপের কাছ থেকে অঢেল সম্পদ যৌতুক পাবে। গডফ্রে আর ফিনা পরস্পরকে ভালোবাসে কি না, সে-প্রশ্নই এখানে ওঠে না—কারণ কোল্ডেরুপের ইচ্ছের অন্যথা করবে কে? তাছাড়া এই বিয়েটায় কোল্ডেরুপের টাকাও বেহাত হ’য়ে যাবে না, তাঁর আপনজনের মধ্যেই থেকে যাবে। হিশেবেরও সুবিধে কত। জন্ম থেকেই তাদের নামে খাতাঞ্চিখানায় দুটো খাতায় হিশেব লেখা হ’য়ে আসছে—বিয়ের পরে এদের জন্যে একটা যুগ্ম হিশেবের ব্যবস্থা করলেই অনেক হাঙ্গামা কমে যায়। কোল্ডেরুপের ইচ্ছে বিয়েটা শিগগিরিই যেন হ’য়ে যায়—কিন্তু এখানেই শেষকালে একটা গোল দেখা দিচ্ছে।

গডফ্রের ইদানীং মনে হচ্ছে তার বয়েস এখনও বিয়ে করার মতো হয়নি | এখনও সে ও-রকম দায়িত্বপূর্ণ কাজের যোগ্য হয়নি। কিন্তু এ-বিষয়ে তার কোনো মতই এযাবৎ চাওয়া হয়নি।

মত যদি কেউ চাইতো, তাহ’লে এ-বিষয়ে অনেক কথাই সে বলতে পারতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা সাঙ্গ হ’তে-না-হ’তেই গডফ্রের সব একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছিলো। একঘেয়ে, আর বিরক্তিকর। পারিপার্শ্বিকের কাছ থেকে কিছুই চাইবার নেই তার—অবশ্য এই কারণেই নেই যে কিছু চাইবার আগেই সব সে সহস্রগুণে পেয়ে যায়। কোনো কাজই নেই তার হাতে। অথচ ছেলেবেলা থেকেই তার ইচ্ছে যে বিশ্বভ্রমণে বেরোয়। জগতের মধ্যে একটা জায়গাই সে কেবল চেনে, সেটা হচ্ছে সান ফ্রানসিসকো—এখানেই তার জন্ম, এবং স্বপ্নে ছাড়া মুহূর্তের জন্যও সে এ-জায়গা ছেড়ে কোথাও যায়নি। দু-তিন বার জগৎ ঘুরে এলে কী এমন ক্ষতি—বিশেষ ক’রে সে যখন মারকিন? কিন্তু তাতে আখেরে তার ভালোটাই বা কী হবে? যত দূরেই যাক না কেন, রাস্তায় কি নতুন-কিছু বা অন্যরকম কিছু শিখতে পাবে? আর, কোনো তরুণের শিক্ষা শেষ হ’তে কত কোটি মাইল ঘুরে আসা আবশ্যিক?

অবস্থাটা এখন হচ্ছে এই। এক বছরেরও বেশি সময় ধ’রে গডফ্রে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছে—দেশভ্রমণের বদলে পড়ছে ভ্রমণবৃত্তান্ত—পড়ছে না তো, যেন গোগ্রাসে হজম করছে বইগুলো। মার্কো পোলোর সঙ্গে সে গেছে কুবলাই খানের দরবারে, ক্রিস্তোবাল কোলোনের সঙ্গে আবিষ্কার করেছে আমেরিকা, কাপ্তেন কুকের সঙ্গে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরে, দ্যুমোঁ দুরবিয়র সঙ্গে পৌঁছেছে অবাচীতে। তাকে না-নিয়েই যে-সব ভ্রমণকারীরা যে-সব জায়গায় গেছেন, সব জায়গায় সে অন্তত একবার করে ঘুরে আসতে চায়। কয়েক বছর ধরে বিশ্বভ্রমণের খাতিরে সে মালয়-বোম্বেটেদের কয়েকটা আক্রমণ, অনেকগুলো নৌ-যুদ্ধ, গোটাকয়েক জাহাজডুবি সহ্য করতেও রাজি আছে। কোনো নির্জন দ্বীপে আলেকজাণ্ডার সেলকার্ক কি রবিনসন ক্রুসোর মতো অনায়াসে কয়েক বছর সে কাটিয়ে দিতে রাজি! হ্যাঁ, ক্রুসো, রবিনসন ক্রুসোই সে হ’তে চায়! ডানিয়েল ডিফো বা ইয়োহান হিবস প’ড়েই তার তরুণ কল্পনা এইভাবে উশকে উঠেছে।

আর ঠিক এই সময়ে কিনা তার মামা বিয়ের কথা ভাবছেন? ফিনা ওরফে ভাবী মিসেস মরগানকে নিয়ে কি আর রবিনসন ক্রুসো হওয়া যাবে? একাই যেতে হবে তাকে—ফিনাকে ছেড়েই। নয়তো তার এখন বিয়ে করা চলবে না। বিয়ে মানেই তো শেকল! একবার তার এই খেয়াল মিটে যাবার পর বিয়েটা হ’লে ক্ষতি কী? সে যে চিন-জাপান দূরের কথা, কস্মিনকালে ইয়োরোপেই যায়নি, এতে তার স্ত্রীর কোন লাভটা হ’লো, শুনি?

সেইজন্যেই ফিনার কাছে থেকেও আজকাল গডফ্রে দূরে থাকে, ফিনার কথা শুনতে শুনতে বিমনা হ’য়ে পড়ে, সে যখন বাজায় তখন বধির হয়ে যায়। এবং ফিনা যেহেতু কাণ্ডজ্ঞান ধরে, সেইজন্যেই শিগগিরই পুরো ব্যাপারটা তার চোখে প’ড়ে গেলো।

অবস্থা দেখে সে যে বিরক্ত ও ক্ষুণ্ণ হয়নি, এটা বললে ভুল করা হবে। কিন্তু ব্যবহারিক বুদ্ধি আছে ব’লেই সে মনে-মনে এটা স্থির করেছে যে গডফ্রে যদি তাকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় তো সে বিয়ের আগেই যেন যায়—বিয়ের পরে ওই বাইরের টান তার আর সইবে না।

সেইজন্যেই সে বললে, ‘মোটেই না। গডফ্রে, এখন তুমি আমার কাছে নেই—এখন তুমি আছো দূর সমুদ্রে,…অনেক, অনেক দূরে—’

গডফ্রে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালে। ফিনাকে লক্ষ্য না-ক’রেই পায়চারি করতে শুরু করলে সে, আর তার অন্যমনস্ক তর্জনী পিয়ানোর চাবিতে ঠেকে গেলো। একটা মস্ত তীক্ষ্ণ আওয়াজ উঠলো পিয়ানো থেকে—যেন তার ভাবনারই প্রতিধ্বনি।

ফিনা তার মনের ভাব বুঝতে পেরেছিলো। কিন্তু এ নিয়ে কোনো কথা পাড়ার আগেই দরজা খুলে গেলো।

ঘরে ঢুকলেন কোল্ডেরুপ—যথারীতি নিজের ভাবনাতেই মশগুল। এইমাত্র একটা দায়িত্ব চুকিয়ে এসে আরেকটা কাজে হাত দেবেন বলে ভাবছেন।

‘তাহ’লে এবারে একটা দিন ঠিক ক’রে ফেললেই হয়,’ কোল্ডেরুপ বললেন।

‘দিন? কীসের দিন ঠিক করবে, মামা?’ গডফ্রে যেন আঁৎকে উঠলো।

‘কেন? তোদের বিয়ের তারিখ ঠিক করতে হবে না?’ কোল্ডেরুপ রসিকতা করবার চেষ্টা করলেন, ‘আমার বিয়ের দিন ঠিক করার কথা বলছি, ভেবেছিলি বুঝি?’

‘বিয়ের দিন নয়, বাবা। কবে যাওয়া হবে, তার দিন ঠিক করা হবে, বলো!‘ বললে ফিনা।

‘কবে যাওয়া হবে? মানে?’

‘বাঃ রে, গডফ্রের যাবার দিন!’ বললে ফিনা, ‘বিয়ের আগে ও একটু জগৎটাকে ঘুরে দেখতে চায়!’

‘তুই চ’লে যেতে চাচ্ছিস—তুই?’ কোল্ডেরুপ এমনভাবে হাত বাড়িয়ে ভাগ্নের দিকে এগিয়ে এলেন যেন সে চ’লে যাবার চেষ্টা করলেই খপ ক’রে তাকে চেপে ধরবেন।

‘হ্যাঁ, মামা।’

‘কতদিনের জন্য, শুনি?’

‘দেড় বছর…দু-বছর…সব নির্ভর করবে – ‘

‘কীসের উপর?’

‘যদি তুমি আমাকে যেতে দাও, আর ফিনা আমার জন্য অপেক্ষা করে।’

‘তোর জন্যে অপেক্ষা করবে? বিয়ের কথা শুনেই যে ভাগে, তার জন্য অপেক্ষা?’

‘গডফ্রেকে তুমি যেতে দাও,’ ফিনা ওকালতি করলে, ‘আমি ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছি। আমার বয়েস খুবই কম—কিন্তু গডফ্রে আরো ছেলেমানুষ। ভ্রমণ করলে ওর বয়েস বাড়বে। আমার মনে হয় না তারপর ওর পছন্দ পালটাবে! দেশ-বিদেশ দেখতে চায়—দেখে আসুক। তারপর যদি ঘরে ফিরে আসতে চায় তো আমি তো থাকবোই।’

‘মানে?’ কোল্ডেরুপ তো হতভম্ব, ‘হাতের পাখি ছেড়ে দিতে চাচ্ছিস তুই?’

‘হ্যাঁ, দু-বছরের জন্যে। দু-বছরই তো বললো।’

‘আর ততদিন তুই ওর জন্যে অপেক্ষা করবি?’

‘দু-বছরও যদি ওর জন্যে সবুর করতে না-পারি তো ওকে আমি ভালোবাসি নাকি?’ ব’লে ফিনা গিয়ে আবার বসলো পিয়ানোয়।

গডফ্রে সংকুচিতভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলো, মামা তার মাথাটা ধরে আলোর দিকে ফিরিয়ে তাকে একবার ভালো ক’রে নিরীক্ষণ করলেন। এবং পিয়ানো থেকে বিদায়বেদনা উত্থিত হ’তে লাগলো। কোল্ডেরুপ সোজাসুজি গডফ্রের চোখের দিকে তাকালেন, ‘তুই ঠিক যেতে চাচ্ছিস? সীরিয়াস?’

‘নিশ্চয়ই,’ ফিনা পিয়ানো থেকে ব’লে উঠলো।

‘ফিনাকে বিয়ে করবার আগে তুই ভ্রমণ করতে চাস? ঠিক আছে-তাই যাবি তুই, ভ্রমণেই বেরুবি। কিন্তু যেতে চাস কোথায়?

‘সবখানে।’

‘কবে যেতে চাস?

‘তুমি অনুমতি দিলেই বেরিয়ে পড়ি।’

‘ঠিক আছে,’ ব’লে ভাগ্নের দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে মামা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ‘তাই ভালো—শুভস্য শীঘ্রম্।’

কোল্ডেরুপ গিয়ে পিয়ানোর চাবিতে এমন জোরে চাপ দিলেন যে পিয়ানোটা হঠাৎ ভীষণভাবে কর্কশ ও বেসুরো আর্তনাদ করে উঠলো।

জাহাজের নাম ‘স্বপ্ন’-
ফিরবে সে কি কখনো?

তাঁর নামটা আসলে টি. আর্টলেট, কিন্তু লোকে তাঁকে ডাকতো টাৰ্টলেট ব’লে। টার্টলেট ক্যালিফরনিয়ার নৃত্যের অধ্যাপক। বিয়ে করেননি, বয়েস পঁয়তাল্লিশ। কিন্তু গত প্রায় বারো বছর ধ’রেই এক বয়স্ক মহিলার সঙ্গে তাঁর বিয়ে ঠিক হ’য়ে আছে—ইত্যাদি যত কথাই বলা যাক না কেন, তাঁকে ঠিক স্পষ্ট চেনা যাবে না—তার চেয়ে বরং তাঁর একটা রেখাচিত্রই আঁকা যাক।

‘তাঁর জন্ম হয়েছিলো ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ই জুলাই, রাত সোয়া তিনটের সময়। এখন তাঁর উচ্চতা পাঁচ ফিট দু-ইঞ্চি, আর প্রস্থ সোয়া দুই ফিট। গত বছরে ছ-পাউণ্ড বেড়ে গিয়ে এখন তাঁর ওজন দাঁড়িয়েছে একশো একান্ন পাউণ্ড দুই আউন্স। মাথার আকার চৌকো। কপালের কাছে চুল অতি কম, রঙ ধূসর বাদামি, কপাল চওড়া, মুখ ডিমের মতো গোল ছাঁদের, রঙ ফরশা। চোখের রঙ ধূসর বাদামি, ভুরু আর চোখের পাতার রঙ চেস্টনাট, বাঁকা ভুরুর তলায় চোখগুলো কোটরে-বসা, দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত ভালো। নাকটা মাঝারি আকারের, বাঁ-দিকের নাকের বাঁশিটা একটু ফোলানো। গাল ও কপালের দু-পাশ সমতল ও নির্লোম। কানগুলো মস্ত ও চাপা। মুখটা মাঝারি আকারের, কোনো দাঁতই পোকায় কাটা নয়। ঠোঁটদুটো পাৎলা, নাকের তলায় প্রায় রাজকীয় একটি গোঁফ, চিবুক গোল—এবং শ্মশ্রুমণ্ডিত। স্ফীত গলদেশে একটা ছোট্ট তিল আছে। স্নান করার সময় দেখা যায় তাঁর গায়ের চামড়া শুভ্র ও মসৃণ। জীবনযাত্রা নিয়মবদ্ধ ও শান্তশিষ্ট। স্ফীতকায় নন, নাচেন এবং নাচ শেখান বলেই স্থূলাঙ্গ হ’তে পারেননি তিনি, কিন্তু জন্মাবধি স্বাস্থ্য অটুট রেখেছেন। তাঁর ফুশফুশ ভারি অস্বস্তিপরায়ণ, সেই জন্যে ধূমপানের অভ্যেস করেননি। কফি, মদ, নির্জল সুরা—কিছুই পান করেন না। অর্থাৎ যা-কিছু তাঁর স্নায়ুর পক্ষে পীড়াদায়ক হ’তে পারে, সবই বিষবৎ এড়িয়ে চলেন। হালকা বিয়ার, মেয়েলি সুরা আর জলই কেবল পান করেন সবসময়। এতটা সাবধানি ব’লেই জন্মাবধি তাঁকে কোনো বদ্যি ডাকতে হয়নি। অঙ্গপ্রতঙ্গ ক্ষিপ্র চলে, হাঁটেন দ্রুতবেগে, চরিত্র সহৃদয়, খোলামেলা, কোনো ঘোরপ্যাঁচ নেই। অন্যদের জন্যে এতই ভাবেন যে তাঁকে বলা যায় চূড়ান্ত পরার্থপর—যদি ভাবী স্ত্রী কস্মিন্কালে কোনো কিছুতে হঠাৎ অসুখী হ’য়ে পড়েন, এইজন্যেই এখনও পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হননি।’

অন্তত কেউ যদি তাঁকে জিগেশ করতো, তাহলে নিজের সম্বন্ধে এই তথ্যগুলোই লিপিবদ্ধ করতেন টার্টলেট। সেইজন্যেই এক বিশেষ বয়সের মহিলার কাছে যদিও তিনি বেশ বাঞ্ছিতই ছিলেন, তবু সেই প্রত্যাশিত মিলন এ-যাবৎ ঘ’টে ওঠেনি। অধ্যাপক টার্টলেট এখনও অবিবাহিতই থেকে গেছেন এবং যথারীতি লোকেদের নৃত্য শেখাচ্ছেন।

নৃত্যশিক্ষক হিশেবেই উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপের ম্যানশনে ঢুকেছিলেন টার্টলেট। যত দিন যেতে লাগলো, ততই তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা তাঁকে ত্যাগ করতে লাগলো—এবং শেষটায় সেই ধনাঢ্য প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রের মধ্যে একটি ঘূর্ণমান চাকা হ’য়েই তিনি থেকে গেলেন। কিছু-কিছু বাতিক তাঁর আছে সত্যি, এক কথায় উৎকেন্দ্রিকই বলা যায় তাঁকে, কিন্তু মোটের উপর মানুষটি খুবই সাহসী। সবাই তাঁকে পছন্দ করে। গডফ্রেকে তিনি পছন্দ করেন, ফিনাকেও তিনি পছন্দ করেন, এবং তারাও তাঁকে ভালোই বাসে। জগতে তাঁর উচ্চাশা একটাই—এদের দুজনকে নাচের সব রহস্য শেখাতে হবে, আর সেই জন্যেই এদের পিছন তিনি সহজে ছাড়তে চান না, আঠার মতো জুড়েই থাকেন পিছনে।

এই অধ্যাপক টার্টলেটকেই কোল্ডেরুপ তাঁর ভাগ্নের সহযাত্রী হবার জন্যে বেছে নিলেন। কোল্ডেরুপের ধারণা হয়েছিলো, গডফ্রের ওই চুলবুল ক’রে ওঠার পিছনে টার্টলেটের যৎকিঞ্চিৎ অবদান আছে। সেইজন্যেই তিনি স্থির করেছিলেন যে এরা দুজনে একসঙ্গেই বেরুবে দেশভ্রমণে। আর এ-কথা ঠিক করেই তিনি পরের দিন, মে মাসের ১৬ তারিখে, অধ্যাপক টার্টলেটকে নিজের আপিশে এত্তেলা দিলেন।

কোল্ডেরুপের তলব আসলে অনুরোধই, কিন্তু টার্টলেটের কাছে তা অনড় নির্দেশ। পকেট-বেহালাটা সঙ্গে নিয়ে, সবরকম দুরবস্থার জন্যে তৈরি হ’য়েই, নাচের ভঙ্গিতে টার্টলেট ম্যানশনের সিঁড়ি বেয়ে হালকা পায়ে উঠে গেলেন। একবার কড়া নেড়ে ভিতরে ঢুকলেন টার্টলেট, শরীরটা অর্ধেক হেলানো, কনুইগুলো কি-রকম গোল হ’য়ে আছে, মুখে হাসির রেখা, এবং আড়াআড়িভাবে দুটি পায়ে ভর দিয়ে তৃতীয় একটা ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন টার্টলেট, গোড়ালি দুটো শূন্যে তোলা—সব ভর আসলে পড়েছে পায়ের পাতাতেই। টার্টলেট ছাড়া অন্য-কোনো লোক এ-রকমভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতো না, হুড়মুড় ক’রে আছাড় খেয়ে পড়তো টাল সামলাতে না-পেরে, কিন্তু টার্টলেট দিব্যি লম্বমান হয়েই রইলেন।

‘মিস্টার টার্টলেট’, কোল্ডেরুপ বললেন, ‘আপনাকে একটা খবর দেবো ব’লে ডেকে পাঠিয়েছিলুম—শুনে আপনার হয়তো তাক লেগে যাবে।‘

‘বলুন।’

‘বছর-দেড় বছরের জন্যে আমার ভাগ্নের বিয়েটা স্থগিত রাখতে হচ্ছে। গডফ্রে দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে চায়, ইয়োরোপ আমেরিকার সব দেশগুলোয় একবার ক’রে ঢুঁ মারতে চায়—এবং এই আজব খেয়ালটা তাকে নাকি মেটাতেই হবে।’

‘গডফ্রে তার জন্মভূমির মুখ উজ্জ্বল করবে—সোনার টুকরো ছেলে—’ টার্টলেট শুধু মুখবন্ধ করেছিলেন, কিন্তু কোল্ডেরুপ চট ক’রে তাঁকে থামিয়ে দিলেন, ‘সোনার টুকরো ছেলেটি শুধু দেশের কেন, তার নৃত্যশিক্ষকেরও মুখ উজ্জ্বল করবে।’

টার্টলেট ঠাট্টাটা ঠিক ধরতে পারলেন না, বরং হালকা পায়ে একবার পাক খেয়ে কোমরের দিকটা হেলিয়ে-দেহের বাকি অংশ কেমন ক’রে যেন সটানই রইলো—প্রশংসাটা গ্রহণ করলেন।

কোল্ডেরুপ বলে চললেন, ‘আমি ভেবেছিলুম ছাত্রের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হ’লে আপনার খুবই মন খারাপ করবে।’

‘তা মন খারাপ করবে বৈ কি! তবে দরকার হলে—’

কোল্ডেরুপ তাঁকে থামিয়ে দিলেন। দরকার হবে না। আমি ভেবে দেখেছি যে মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে তাঁর প্রিয় ছাত্রকে সরিয়ে দেয়াটা ভারি হৃদয়হীন নিষ্ঠুরতা হবে। সেইজন্যেই ঠিক করেছি মাস্টারমশাইও যাবেন তাঁর প্রিয় ছাত্রের সঙ্গে—দেশবিদেশ ঘুরে বেড়ালে কেবল যে আমার ভাগ্নেরই সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ হবে, তা নয়—তার যে- মাস্টারমশাই তার মধ্যে সদিচ্ছাকে এমনভাবে জাগিয়ে তুলেছেন, তাঁরও যথাযোগ্য সম্মাননা হবে!’

কথাটা শুনতে-শুনতে এই মস্ত শিশুটি নাচের ভঙ্গিটা একটু পালটে নিয়েছিলেন, আর কোল্ডেরুপের কথার শেষদিকটা তাঁকে এমনি হকচকিয়ে দিয়েছিলো যে নাচের মুদ্রায় বেশ একটা গণ্ডগোলও হয়ে গেলো। কিন্তু টার্টলেট সেদিকে লক্ষ্যও করলেন না।

কস্মিনকালেও তিনি ভাবেননি যে একদিন তাঁকে সান ফ্রানসিসকো, তথা ক্যালিফরনিয়া তথা মারকিন মুলুক ত্যাগ ক’রে মস্ত খোলামেলা সমুদ্দুরে বেরিয়ে পড়তে হবে। ভূগোলবিদ্যার চেয়ে মঞ্চসজ্জাতেই যাঁর কায়মনোবাক্যের আগ্রহ চিরকাল বেশি, এবং রাজধানীর দশমাইল দূরের শহরতলিতেই যে কী আছে, তা যিনি কোনোদিনই তাকিয়েও দ্যাখেননি, তাঁর মগজে কোনোদিনই এ-ভাবনা গজায়নি। আর এখন…এখন কিনা …

ছাত্রটিকে যে-অ্যাডভেনচারে তিনি পাঠাতে চাচ্ছিলেন, তার সব ঝক্কি-ঝামেলাই যে এখন তাঁকেও পোয়াতে হবে, এই ভাবনাতেই তিনি বড্ড কাহিল হ’য়ে পড়লেন। তাঁর চেয়েও নিরেট কোনো মাথা এমন আঘাতে চৌচির হ’য়ে যেতো; পঁয়ত্রিশ বছর ধ’রে মাংসপেশীর অটুট ও নির্ভরযোগ্য সঞ্চালনের পরেও টার্টলেটের মনে হ’লো তাঁর হাত-পায়ের জোড় খুলে যেতে যাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে তাঁর মুখ থেকে যে-দন্তবিকাশটি অদৃশ্য হ’য়ে গিয়েছিলো, তাকে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করতে-করতে ‘ টার্টলেট আমতা-আমতা করলেন, ‘মানে…আমি… সম্ভবত…’

‘আপনি ওর সঙ্গে যাবেন,’ এক কথাতেই কোল্ডেরুপ বুঝিয়ে দিলেন যে এ-বিষয়ে আর-কোনো আলোচনা করতেই তিনি রাজি নন।

এই প্রস্তাবে গররাজি হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না—টার্টলেট স্বপ্নেও অস্বীকৃত হবার কথা ভাবতে পারলেন না। তিনি তো একটা খেয়ালের পুলিন্দা ছাড়া কিছুই নন এই ধনকুবেরের কাছে—এবং তাঁর খেয়াল অনুযায়ীই এখন তাঁকে লাট্টুর মতো জগতের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি ঘুরে মরতে হবে। ‘কবে রওনা হবো?’ নাচের মুদ্রা পালটাতে-পালটাতে টার্টলেট জিগেশ করলেন।

‘এক মাসের মধ্যেই।’

‘আর প্রথমে কোথায় যেতে হবে?’

‘নিউ-জিল্যাণ্ডে,’ বললেন কোল্ডেরুপ, ‘প্রথমে যাবেন প্রশান্ত মহাসাগর ধরে নিউজিল্যাণ্ডে। শুনেছি যে মাওরিদের কনুই নাকি ভারি শক্ত আর বাইরে বেরিয়ে থাকে, অন্যদের পাঁজরে খোঁচা লাগায়—আপনারা গিয়ে তাদের শেখাতে পারবেন কী ক’রে বেমালুম কনুই ভাঁজ ক’রে রাখলে অন্যদের অসুবিধে হয় না!’

কোল্ডেরুপের মাথা হেলাবার ভঙ্গিতেই বোঝা গেলো যে কথাবার্তা শেষ হ’য়ে গেছে। উত্তেজিতভাবে সেই ধনকুবেরের আপিশঘর থেকে বেরিয়ে এলেন টার্টলেট—জীবনে প্রথমবার তাঁর শিল্পবোধ তিনি বিসর্জন দিলেন, পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে ঘুরপাক খেতে-খেতে বেরিয়ে না-এসে তিনি

এই প্রথম গোড়ালির উপর ভর দিয়ে এমনভাবে এগিয়ে এলেন, যাকে মোটেই নাচ বলা চলে না—বলে হাঁটা।

+

উইলিয়াম ডাবলিউ. কোল্ডেরুপের যাকে বলে একটা নৌবহরই ছিলো : ব্যাবসার জন্যেই জাহাজগুলি কিনেছিলেন তিনি—বেশির ভাগই সদাগরি জাহাজ, কোনোটা বাষ্পে চলে, কলের জাহাজ—কোনটা বা মাস্তুলে পাল তুলে দেয়। সেইজন্যেই ঠিক হয়েছিলো যে গডফ্রে তাঁরই একটা জাহাজে ক’রে সাগর পাড়ি দেবে।

কোল্ডেরুপের নির্দেশে ‘ড্রিম’ বা ‘স্বপ্ন’ ব’লে ২০০ অশ্বশক্তিওলা ৬০০ টনের একটি জাহাজ বিশ্বভ্রমড়ের জন্য তৈরি হলো। জাহাজের কাপ্তেনের নাম টারকট; বেশ শক্তপোক্ত নোনাধরা নাবিক টারকট-তিনি একবারও যাননি, জগতে হেন সমুদ্র নেই। হারিকেন, টরন্যাডো, সাইক্লোন, টাইফুনের বন্ধু টারকট, পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অব্দি তিনি নাবিক। বয়েস পঞ্চাশ, এর মধ্যে চল্লিশ বছরই কেটেছে সমুদ্রে। ডাঙায় থাকলেই কেমন তাঁর অস্বস্তি হয়; সমুদ্রের মধ্যে দোদুল্যমান জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে একবার এ-পায়ে আরেকবার ও-পায়ে ভর সামলাতে সামলাতে এক হিশেবে টার্টলেটের চেয়েও ভালো নাচিয়ে হ’য়ে পড়েছেন টারকট।

কাপ্তেন টারকট ছাড়া জাহাজে আছে একজন মেট, একজন এঞ্জিনিয়ার, চারজন বয়লার ঘরের ওস্তাদ, আর বারোজন সেরা মাল্লা–একুনে আঠারোজন লোক। ঘণ্টায় আট মাইলের বেশি যাবার তাড়া না-থাকলে এই ‘স্বপ্ন’ জাহাজটির তুলনা নেই।

কোনো মাল নেবে না এবারে জাহাজটি, যাতে দরকার হলে যে-কোনোখানে ‘স্বপ্ন’কে ডুবিয়ে দিলেও কোনো লোকসান না-হয়—ঠিক ছিলো যে-সব জায়গায় কোল্ডেরুপের ব্যাবসা আছে, সে-সব জায়গায় ঘুরে-ঘুরে সে তদারক করবে।

কোল্ডেরুপ আর কাপ্তেন টারকটের মধ্যে গোপনে একাধিকবার নানা পরামর্শ হ’লো—কী-যে কথাবার্তা হ’লো দুজনের মধ্যে, তা কোনো কাকপক্ষীও টের পেলে না, কেবল অষ্টম দিনের আলোচনার পর টারটকে দেখা গেলো বিড়বিড় ক’রে বকতে, ‘এ-রকম কোনো কাজ যদি কস্মিনকালেও আগে ক’রে থাকি তো পাঁচশো হাজার ডেভি জোন্‌স যেন আমাকে পাতালে চুবিয়ে দেয়!’

সবাই জানলে যে ‘স্বপ্ন’ প্রথমে যাবে নিউ-জিল্যাণ্ডের অকল্যাণ্ডে, অবশ্যি পথে দরকার হ’লে কয়লার জন্যে প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো ডাঙায় বা কোনো চিনে বন্দরে থামা যাবে।

যতক্ষণ-না জাহাজ ছাড়ছে ততক্ষণ কোথায় যাচ্ছে না-যাচ্ছে তাতে গডফ্রের কোনো মাথাব্যথা নেই, আর টার্টলেট তো রোজই সমুদ্রের সহস্র বিপদকে ফেনিয়ে ফাঁপিয়ে দেখে ঘাবড়ে যাচ্ছেন।

যাবার আগে অবিশ্যি গডফ্রে আর ফিনার একটা যুগল ফোটো তোলা হয়েছিলো—বাগদত্ত তো হাজার হোক, কাজেই অনুপস্থিতির সময় ফোটোই হবে মানুষটির প্রতিনিধি। সেইজন্যেই জুন মাসের গোড়ার দিকে একদিন গডফ্রে আর ফিনা মানগোমেরি স্ট্রিটের ফোটোওলা স্টিফেনসন অ্যাণ্ড কম্পানিতে গিয়ে হাজির হয়েছিলো। ঠিক ছিলো, যুগল ছবি ছাড়াও দুজনের আলাদা ক’রে একা ছবি তোলা হবে-ফিনার ছবি ঝুলবে ‘স্বপ্ন’ জাহাজে, গডফ্রের কামরায়; গডফ্রের ছবি টাঙানো হবে ফিনার শোবার ঘরে।

টার্টলেটেরও একটা ছবি তোলার চেষ্টা করা হয়েছিলো—কিন্তু নেগেটিভ থেকে দেখা গেলো টার্টলেটের ছবিটা কি-রকম যেন কুয়াশায় ভরে গেছে। আসলে ক্যামেরাওলাদের সব কথাবার্তা সত্ত্বেও টার্টলেট যেহেতু মুহূর্তের জন্যও স্থির থাকেননি, তাই ছবিটাও ন’ড়ে গিয়েছে। কিছুতেই আর টার্টলেটের কোনো স্থিরচিত্র তোলা গেলো না—এবং টার্টলেটের চলচ্চিত্র যা হ’লো, তা আদৌ দ্রষ্টব্যই হলো না। ফলে শেষ অব্দি তাঁর কোনো প্রতিরূপ বাঁধিয়ে রাখার আশা জলাঞ্জলি দিতে হ’লো।

৯ই জুন, সব তৈরি। ‘স্বপ্ন’ জাহাজ যাবার জন্য চাকা ঘোরাচ্ছে। কাগজপত্তর সব তৈরি, মায় বিমা-কম্পানির রশিদ শুদ্ধু।

যাবার দিনে সকাল বেলায় মানগোমেরি স্ট্রিটের প্রাসাদে মস্ত একটা বিদায়কালীন ছোটোহাজরির ব্যবস্থা হয়েছিলো।

টেবিলে গডফ্রেকে বেশ অস্থির আর উত্তেজিতই দেখালো। ফিনাকে অবশ্য দেখালো যথেষ্ট শান্ত—সে যে চিন্তায় ভাবনায় আদৌ ব্যাকুলবোধ করছে, এমন-কোনো লক্ষণই তার মুখে নেই। আর টার্টলেট সমুদ্রের ভয়ে গেলাশ-গেলাশ শ্যামপেন ওড়ালেন : ভয়ে তিনি তাঁর পকেট-বেহালাটা সঙ্গে আনতে ভুলে গিয়েছিলেন, শেষকালে লোক পাঠিয়ে সেটা তাঁর বাড়ি থেকে আনানো হ’লো।

শেষ বিদায়সম্ভাষণ বলাবলি হ’লো জাহাজের ডেকে, শেষ হাত-ঝাঁকুনি হ’লো জাহাজের সিঁড়িতে, আর তারপরেই এঞ্জিন আওয়াজ ক’রে উঠলো, চাকা দু-তিনটে পাক খেলো, আর শব্দ করে জল ছড়ালো।

‘চলি, ফিনা!’

‘এসো, গডফ্রে।’

‘ভগবান তোমাদের মঙ্গল করুন’, আওয়াজ দিলেন মাতুল।

‘স্বপ্ন’ ছেড়ে দিলে, রুমাল নড়লো জেটি থেকে আর ডেক থেকে। একটু পরেই সান ফ্রানসিসকো উপসাগরের মুখে সুবর্ণদ্বার পেরিয়ে এলো ‘স্বপ্ন’। সামনে প্রশান্ত মহাসাগরের দিগন্ত-ছোঁয়া অকূল চঞ্চল জল খেলা করছে। যেন চিরকালের মতো ‘স্বপ্ন’র পিছনে সুবর্ণদ্বারটি বন্ধ হ’য়ে গেলো।