৭. সরেজমিন তদন্ত
দু-ঘণ্টা পরে দেখা গেলো খটাখট আওয়াজ তুলে পেরনাউ রোড ধরে একটা কোচবাক্স ছুটে যাচ্ছে; ঘোড়ার গাড়িটা আসলে ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনের; রাস্তার সব কটা আস্তাবলের সঙ্গে ইয়োহাউজেনদের দহরম-মহরম আছে- একেক জায়গায় পৌঁছে ক্লান্ত ঘোড়ার বদলে তেজি ঘোড়া জুতে দিতে তাই আর মোটেই দেরি হয় না; কিন্তু যত জোরেই গাড়ি ছুটুক, রাত্তিরের আগে ওই ভাঙা ক্রুশের সরাইখানায় গিয়ে পৌঁছনো অসম্ভব; সেক্ষেত্রে একটা কোনো আস্তাবলের লাগোয়া বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে সকালে গিয়েই ওই সরাইখানায় পৌঁছনো ভালো।
কোচবাক্সে বসেছিলেন ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেন স্বয়ং–আর ছিলেন মেজর ফেরডের, ডাক্তার হামিনে, বিচারপতি কেরস্টোফ–কেরস্টোফই হচ্ছেন তদন্তকারী বিচারক, আর আছে আদালতের এক কেরানি ও দুটি সাধারণ পুলিশ।
বিচারপতি কেরস্টোফের বয়েস পঞ্চাশ হবে; সহযোগীরা ও জনসাধারণ– সকলেই তাঁর নৈপুণ্য ও কর্মক্ষমতায় অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ও আস্থাবান। কোনো উৎকোচ নেন না বা কর্তৃপক্ষের চাপে বা প্রভাবে টলেন না, কোনো রাজনৈতিক মতবাদের পক্ষপাতী হয়েও বিচারকের কর্তব্য থেকে তিনি কখনো ভ্রষ্ট হন না। বলা যায়, তিনি মনুষ্যবেশী ন্যায়বিচার। চাপা মানুষ, কিছুতেই মুখ খোলেন না।–অর্থাৎ ভাবেন বেশি, বাজে বকেন কম।
ডাক্তার হামিনে যাচ্ছেন পোখ-এর মৃতদেহ পরীক্ষা করে দেখবার জন্যে। ময়নাতদন্তের আগে মৃত্যুর কারণ ও সময় ইত্যাদি তিনি অনুমান করবেন। আগের দিন সন্ধেবেলায় রোজকার মতোই তিনি গিয়েছিলেন অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শোনেন অধ্যাপক বাড়ি নেই। ইলকার কাছ থেকে শুনেছেন যে তার বাবা কোথায় যেন গেছেন- সেদিনই সকালে নাকি অধ্যাপক মেয়েকে জানিয়েছিলেন যে দু-তিনদিনের জন্য তিনি রিগা ছেড়ে যাচ্ছেন। কোথায় গেছেন, তা ইলকা জানে না। হঠাৎ কেন কোথাও যাবার তাড়া পড়লো, তা মোটেই বোঝা গেলো না। তবে তারও আগের দিন সন্ধেবেলায় তাকে অত্যন্ত চিন্তিত ও বিমনা দেখাচ্ছিলো। তবে তাঁর মতো ভারিক্কি মানুষকে এই দুশ্চিন্তার কারণ জিগেশ করবে কে? এখন এই চলন্ত গাড়িতে বসে হঠাৎ অধ্যাপক নিকোলেফের কথা ভেবে ডাক্তার হামিনের বেশ উদ্বেগ হলো।
গাড়ি খুব জোরেই ছুটছে। ঘণ্টা তিনেক আগে বেরুতে পারলে আজকেই তদন্ত শুরু করা যেতো। হাওয়া শুকনো, কিন্তু কনকনে ঠাণ্ডা, আগের রাত্তিরের সেই বিষম দুর্যোগের কোনো চিহ্ন অবিশ্যি এখন আর নেই। তবে রাস্তার যা জীর্ণ দশা, তাতে ঘোড়াগুলোর উপর দিয়ে খুব ধকল যাচ্ছে যা হোক।
সবাই চুপচাপ বসে যে যার ভাবনায় তন্ময়–কেবল মেজর ফেরডের আর ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনের মধ্যে মাঝে-মাঝে ছোটোখাটো বিষয়ে বাণী বিনিময় হচ্ছে। কাল সকালে ভাঙা ক্রুশের সরাইখানায় পৌঁছে কী শোচনীয় হত্যা-রহস্যের মুখোমুখি হবেন, কে জানে!
+
কোচোয়ান, সহিস আর একটা খামারের গাড়ি নিয়ে যথাসময়ে এসেই সরাইখানায় হাজির হয়েছিলো ব্রোক্স, ভেবেছিলো পোখ ও অন্য যাত্রীটি নিশ্চয়ই তখনও কোচবাক্সের মেরামতের জন্য অপেক্ষা করছে।
কিন্তু হাসিখুশি পোখ-এর বদলে তার মৃতদেহ দেখে ব্রোক্সের অবস্থা যে কী-রকম কাহিল ও আতঙ্কিত হয়ে উঠলো, সেটা সহজেই বোঝা যায়। বেচারি বিয়ে করবার জন্য রিগায় ফিরবে বলে কীরকম উগ্রীব হয়েছিলো, কিন্তু তার বদলে কি না এই! তক্ষুনি সহিস কোচোয়ান সব্বাইকে ফেলে রেখে একটা ঘোড়ায় লাফিয়ে উঠে পড়ে ব্রোক্স সোজা চলে যায় পেরনাউতে, পুলিশকে খবর দিতে। পেরনাউ থেকে, খবরটা শোনবামাত্র, তারবার্তায় সব জানানো হয় মেজর ফেরডেরকে, আর কয়েকজন পুলিশ ভাঙা ক্রুশের সরাইখানায় এসে হাজির হয়। ব্রোক্সও কালবিলম্ব না করে ফিরে আসে, কারণ তদন্তকারীরা নিশ্চয়ই তারও এজাহার চাইবে।
১৫ই এপ্রিল অর্থাৎ পরদিন-সকালবেলায় মেজর ফেরডেরদের নিয়ে কোচবাক্স এসে অকুস্থলে পৌঁছনো মাত্র তদন্তের কাজ শুরু হয়ে গেলো। সরাইখানার বাইরে রাস্তার উপরে কড়া পুলিশ পাহারা বসেছে, রান্নাঘরের ওদিকটাতে ঠিক পাইন জঙ্গলের মুখটাতে পুলিশ রয়েছে তাদের উপর আদেশ আছে কাউকেই যেন সরাইখানায় ঢুকতে দেয়া না-হয়। কৌতূহলী চাষী ও কাঠুরেরা চারপাশে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু পুলিশের জন্য ভিতরে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। এ তল্লাটে রাস্তাঘাটে খুনজখম রাহাজানি হয় সত্যি, কিন্তু কোনো সরাইখানায় এ-রকম কোনো হত্যাকাণ্ড সচরাচর ঘটে না।
ক্রোফ দাঁড়িয়েছিলো দরজার কাছেই; মেজর ফেরডেররা পৌঁছুতেই সে তাদের প্রথমেই পোখ-এর মৃতদেহ যে ঘরটায় পড়েছিলো সে-ঘরে নিয়ে গেলো।
মৃতদেহটা দেখেই হের ইয়োহাউজেন আর শোক সংবরণ করতে পারলেন না। হ্যাঁ, পোখই বটে, চব্বিশ ঘণ্টা আগে হিম মৃত্যু তাকে স্পর্শ করেছে, এখন মৃতদেহটা পড়ে আছে শক্ত ও ঠাণ্ডা। ঘুমন্ত অবস্থায় মারা গেছে পোখ, ঘুমের মধ্যেই চোট পেয়েছে। পোখ-এর নির্দেশমতো ক্রোফ তাকে সেদিন সকালবেলায় জাগাতে আসেনি– যখন ব্রোক্স সব সাহায্য নিয়ে এসে হাজির হলো তখনই ব্রোক্সকে সঙ্গে করে এসে সে দরজায় কড়া নাড়ে। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিলো। অনেক ডাকাডাকি সত্ত্বেও কোনো সাড়া না-পেয়ে দুজনেই খুব শঙ্কিত হয়ে উঠে শেষকালে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে, তখনও মৃতদেহটি উষ্ণ ছিলো।
বিছানার পাশেই টেবিলটায় পড়ে আছে পোখ-এর ব্রীফ-কেস, উপরে ব্যাঙ্কের নামের আদ্যক্ষর লেখা; ব্রীফ কেসের শেকলটা মেঝেয় লুটোচ্ছে ভিতরে একটা কানাকড়িও নেই।
প্রথমেই ডাক্তার হামিনে মৃতদেহটা পরীক্ষা করে দেখলেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে বিছানা রক্তে মাখামাখি, এমনকী মেঝেতেও রক্তের ফোঁটা পড়েছে। পোখ-এর পঞ্চম পাঁজরের কাছে, একটু বাঁ দিক ঘেঁষে, একটা জখমের চিহ্ন পাঁচ-ছ ইঞ্চি লম্বা কোনো ধারালো ছোরা ব্যবহার করেছে খুনী, ছোরাটা এত জোরে বসানো হয়েছে যে তক্ষুনি পোখ-এর হৃৎপিণ্ডের ক্রিয়া বিকল হয়ে যায়।
খুনের কারণ বুঝতে কারুরই কোনো দেরি হলো না। সেই ব্রীফ-কেসের শূন্যতাটা যথেষ্ট জাজ্বল্যমান ও বায়।
+
কিন্তু বন্ধ ঘরটার মধ্যে খুনী ঢুকেছিল কী করে? দরজাটা তো বন্ধ ছিলো, ক্রোফ আর ব্রোক্সকে শেষটায় দরজা ভেঙে ঢুকতে হয়েছিলো। তাহলে নিশ্চয়ই রাস্তার ধারের জানলাটা দিয়েই খুনী ঢুকেছে। বালিশের গায়ে রক্তের দাগ দেখে বোঝা গেল ব্রীফ-কেসটা ছিলো বালিশের নিচে সেটার খোঁজ করতে গিয়ে খুনী রক্তমাখা হাতে চারপাশে হাড়েছে আর রক্তের দাগ লেগে গিয়েছে। পনেরো হাজার রুবল বার করে নিয়ে খুনী তারপর ব্রীফ-কেসটা টেবিলে রেখে চলে যায়।
ক্রোফের সামনেই তদন্ত চলছিলো। কেরস্টোফের জেরার জবাবে বেশ বুদ্ধিমান উত্তর দিচ্ছিলো ক্রোফ। তবে তাকে ভালো করে সবকিছু জিগেশ করার আগে চারপাশটা খুঁটিয়ে দেখে নেয়া উচিত। খুনী যদি পালাবার সময় রাস্তায় কোনো সূত্র ফেলে যায়।
ডাক্তার হামিনে, ইয়োহাউজেন, ক্রোফ ও রিগার পুলিশদের নিয়ে মেজর ফেরডের আর বিচারপতি কেরস্টোফ রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। যে-সব চাষী ও কাঠুরে হাঁ করে সব দেখছিলো, তাদের পুলিশ আরো দূরে সরিয়ে দিলে।
প্রথমে ঘরের জানলাটা অন্তত খুঁটিয়ে পরীক্ষা করা হলো। ডান দিকের খড়খড়িটা জীর্ণ ছিলো, কোনো শক্ত কিছু ঢুকিয়ে খড়খড়ি তুলে জোরে হ্যাঁচকা টান মেরে আস্ত ছিটকিনিটাই তুলে নেয়া হয়েছে। তারপর খুনী জানলার একটা শার্সি ভেঙেছে– নিচে কাঁচের টুকরো পড়ে আছে এলোমেলো, তারপর হাত ঢুকিয়ে ভিতরকার খিলটা খুলে ফেলে ভিতরে ঢুকেছিলো আততায়ী– দুষ্কর্মের পরে এই পথ দিয়েই সে চম্পট দিয়েছে।
অজস্র পায়ের ছাপ দেখা গেলো রাস্তায়। ঝড়-বৃষ্টিতে মাটি ভেজা ছিলো, কিন্তু এত লোকের পায়ের ছাপ সেখানে আছে, আর এমনভাবে একটার উপর আরেকটা ছাপ পড়েছে যে পায়ের ছাপ দেখে কোনো কিছুই বোঝা গেল না। পুলিশ আসার আগে নিশ্চয়ই প্রচুর কৌতূহলী লোক ভিড় করেছিলো সরাইয়ের সামনে একা ক্রোফের পক্ষে তাদের দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি!
মেজর ফেরডের আর কেরস্টোফ তারপর গেলেন সেই অজ্ঞাত যাত্রীটি যে ঘরে ছিলো, তার জানলার কাছে। গোড়ায় সন্দেহজনক কিছুই চোখে পড়লো না। খড়খড়ি বন্ধ। কিন্তু ভালো করে তাকিয়ে জানলার গোবরাটে কতগুলো আঁচড়ের চিহ্ন দেখা গেলো, দেয়ালেও কিসের আঁচড় লেগেছে সম্ভবত কেউ ঐ জানলা দিয়ে রাত্তিরে বাইরে বেরিয়েছিলো।
সব্বাই ভিতরে এসে এবার অচেনা যাত্রীটির ঘরে ঢুকে দেখলেন। অন্ধকারে ঢাকা বন্ধ ঘর, মেজর ফেরডের গিয়ে জানলাটা খুলে দিতেই ঘরে আলো এসে ঢুকলো। দুটো কাঠের চেয়ার ঠিক জায়গামতো রয়েছে, বিছানাটা দেখে বোঝা গেলো কেউ তাতে পরশু রাতে শোয়নি, টেবিলের উপর মোমবাতিটার পোড়া টুকরো পড়ে আছে। জানলার গোবরাটে আর দেয়ালে সেই কয়েকটা আঁচড় ছাড়া আর কোনো সূত্রই পাওয়া গেলো না। ঐ আঁচড়গুলো অবিশ্যি খুব জরুরি ও রহস্যময়।
ক্রোফের ঘর, মুরগির খাঁচা, শবজি-বাগান- সবখানেই একবার করে গিয়ে অনুসন্ধান করা হলো। না, বাইরে থেকে কেউ যে রাত্তিরে এই সরাইতে ঢুকেছিলো, এদিকটায় অন্তত তার কোনো ইঙ্গিত নেই। পোখ-এর ঘরের জানলা দিয়েই আততায়ী ঢুকেছিলো, তবে জানলাটা যেহেতু রাস্তার উপর সেইজন্যই বাইরের কারুর পক্ষে ভিতরে ঢোকা একেবারে অসম্ভব ছিলো না।
তারপর সরাইওলাকে জেরা শুরু করলেন কেরস্টোফ। বড়ো ঘরটায় বসলো তদন্ত কমিটি। পাশেই বসলো আদালতের কেরানি। মেজর ফেরডের, ডাক্তার হামিনে ও হের ইয়োহাউজেন– সবাই সরাইওলার এজাহার শোনবার জন্যে উৎসুক হয়ে ছিলেন, তাঁরা পাশেই গোল হয়ে বসলেন। তারপর ক্রোফকে বলা হলো সে যা জানে সব খুলে বলতে।
ধর্মাবতার, ক্রোফ সরাসরি বলতে শুরু করে দিলে, পরশু রাত আটটা নাগাদ দুজন যাত্রী ঝড়ের মধ্যে সরাইখানায় এসে হাজির হয়, রাতটা তারা সরাইতে কাটাতে চায়। গাড়ি উলটে পড়েছিলো না কি তাদের, সেই জন্যে একজনে একটু খোঁড়াচ্ছিলো।
সে-ই হলো পোখ, ইয়োহাউজেন ব্যাঙ্কের কেরানি।
হ্যাঁ… এই পরিচয়ই সে দিয়েছিলো আমাকে।… সব বলেছিলো সে, ঝড়ের পাল্লায় ঘোড়াগুলোর নাজেহাল হওয়া, গাড়ি উলটে পড়া, চোট পাওয়া… সব। পায়ে চোট না-লাগলে সেও কোচবাক্সের পাহারাওয়ালার সঙ্গে পেরনাউ চলে। যেতো, কিন্তু বেচারা… তার বদলে কিনা যম তাকে টান দিলো!… কোচবাক্সের পাহারাওলাকে আমি অবিশ্যি দেখিনি, পরের দিন সকালেই তার ফিরে আসার কথা ছিলো… তা সে এসেও ছিলো…
কেরস্টোফ জিগেশ করলেন, রেফেল যাচ্ছিলো কেন পোখ? কিছু বলেছিলো সে-সম্বন্ধে?
না… আমাকে নৈশভোজের ব্যবস্থা করতে বলেছিলো শুধু, দিব্যি খেলো ভালোমানুষের মতো … খাওয়াদাওয়ার পর ন-টা নাগাদ সে নিজের ঘরে যায়, আর ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।
আর অন্য যাত্রীটি? অন্য যাত্রীটি কেবল রাত কাটাবার জন্য একটা ঘরই চেয়েছিলো, খাবার-দাবার কিছু চায়নি। শুতে যাবার আগে আমাকে কেবল বলেছিলো যে, সে কোচবাক্সের পাহারাওলার ফিরে আসা পর্যন্ত আর অপেক্ষা করবে না, ভোরবেলাতেই চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বে।
সে কে, তা কিছু জানা গেছে?
না, ধর্মাবতার। পোখ বেচারাও তার পরিচয় কিছু জানতো না। খেতে-খেতে সে তার সঙ্গী সম্বন্ধে সব বলেছিলো আমাকে সারা রাস্তায় সে নাকি কুল্লে গোটা দশেক কথা বলেছে, সারাক্ষণ নাকি টুপির তলায় মুখ ঢেকে বসেছিলো …..বোধ হয় কেউ তাকে চিনে ফেলুক এটা তার উদ্দেশ্য ছিলো না। আমিও তর মুখটা দেখতে পাইনি। কী-রকম দেখতে, জিগেশ করলে আমি কিছুই বলতে পারবো না।
ওরা দুজনে যখন আসে, তখন সরাইতে অন্য-কেউ ছিলো?
এখানকার জনাছয়েক চাষী আর কাঠুরে ছিলো। আর ছিলেন সারজেন্ট য়েক আর তার এক অনুচর।
সারজেন্ট য়েক ছিলো নাকি? ইয়োহাউজেন বলে উঠলেন, সে পোখকে চিনতে পারেনি?
পেরেছিলেন নিশ্চয়ই, কারণ পোখ-এর সঙ্গে তিনি একটু আলাপ করেছিলেন।
কেরস্টোফ জিগেশ করলেন, তারপর সবাই চলে গেলো? কখন?
সাড়ে-আটটা নাগাদ। আমি তারপর দরজা বন্ধ করে দিই–খিল তুলে দিয়ে তালা এঁটে দিই।
তাহলে বাইরে থেকে দরজা খোলবার কোনো উপায় ছিলো না?
না, ধর্মাবতার।
ভিতর থেকে চাবি ছাড়া কারু পক্ষে দরজা খোলা সম্ভব ছিলো না?
না!
আর সকালবেলায় দরজাটা সে-রকমই তালা-বন্ধ ছিলো?
হ্যাঁ। অচেনা যাত্রীটি ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় চারটেয় তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে… আমি লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিই…। এক রুবল পাওনা হয়েছিলো, আমার প্রাপ্য সে তক্ষুনি চুকিয়ে দেয়। তখনও তার মুখটা ওভারকোটের কলার আর টুপির ডগা দিয়ে ঢাকা ছিলো- কাজেই মুখটা আর দেখতে পাইনি। দরজা খুলে দিতেই সে চলে গেলো। আমি আবার ভিতর থেকে দরজা এঁটে দিলুম।
কোথায় যাচ্ছে, তা সে কিছু বলেছিলো?
না।
রাত্তিরে কোনো সন্দেহজনক আওয়াজ শুনেছিলে?
উঁহু, কিছু না।
তোমার নিজের ধারণা কী, ক্রোফ? কেরস্টোফ জিগেশ করলেন, যাত্রীটি চলে যাবার আগেই কি পোখ খুন হয়েছিলো?
আমার তো তা-ই মনে হয়।
তা, সে চলে যাবার পর তুমি কী করলে?
আমি আবার নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লুম। তখনও পুরো সকাল হয়নি, আলো ফোটেনি… উঠে করবো কী? তবে আমি আর ঘুমোইনি।
তার মানে চারটে থেকে ছটার মধ্যে পোখ-এর ঘরে কোনো ধস্তাধস্তি বা চাঁচামেচি হলে তুমি ঠিক শুনতে পেতে?
নিশ্চয়ই পেতুম। কারণ আমার ঘরটা বাগানের দিকে ফেরানো হলেও আসলে পোখ-এর ঘরের একেবারে লাগোয়া। কাজেই কোনো ধস্তাধস্তি হলে শুনতে পেতুম বৈকি!
তা ঠিক,বললেন মেজর ফেরডের, কিন্তু পোখ বেচারি ধস্তাধস্তি করারও সময় পায়নি- ঘুমন্ত অবস্থাতেই ছোরার ঘা খেয়েছে।
তবে সব শুনে ওটা স্পষ্ট বোঝা গেলো যে সেই রহস্যময় যাত্রীটি সরাই ছেড়ে চলে যাবার আগেই খুনটা হয়েছিলো। তবে একেবারে নিশ্চিত আর কী করে হওয়া যাবে? কারণ চারটে থেকে পাঁচটা অব্দি একে চারদিক ছিলো অন্ধকার, তার উপর ছিলো বিষম ঝড়। এই দুর্যোগের মধ্যে রাস্তাও নিশ্চয়ই ছিলো ফাঁকা ফলে বাইরে থেকে কেউ যদি ভিতরে ঢুকেও থাকে, তবে তাকে দেখাও সম্ভব ছিলো না, কোনো আওয়াজও শোনা যেতো না।
কেরস্টোফ যা-ই জিগেশ করতে লাগলেন, ক্রোফ তারই সরাসরি উত্তর দিতে লাগলো। তারও উপর যে সন্দেহ পড়তে পারে, এটা সে বোধ হয় একবারও ভাবেনি। সব শুনে যেটা বোঝা গেলো তা এই : আততায়ী এসেছিলো বাইরে থেকে, জানলা ভেঙে ঢুকেছিলো ভিতরে, তারপর পোখকে হত্যা করে পনেরো হাজার রুবল নিয়ে আবার ওই জানলা দিয়েই চম্পট দিয়েছিলো।
খুনের ব্যাপারটা ক্রোফ টের পেলো কী করে, সেটা সে খুলে বললে। সাতটা নাগাদ সে যখন বড়ো হল ঘরটায় টুকিটাকি কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত, ব্রোক্স তখন পেরনাউ থেকে ফিরে এসেছে… দুজনে মিলে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে পোখকে জাগাবার অনেক চেষ্টা করলে … যখন কোনো উত্তরই এলো না, তখন বিপদের আশঙ্কা করে দুজনে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে পড়ে … ঢুকেই দ্যাখে রক্তারক্তি কাণ্ড…
তখন যে পোখ-এর দেহে প্রাণ ছিলো না, তা তুমি হলফ করে বলতে পারবে?
পারবো, ধর্মাবতার। নিশ্বেস পড়ছিলো না। ব্রোক্স আর আমি অনেক চেষ্টা করেছিলুম … কিন্তু বুকের মধ্যে ছোরা ঢুকেছে, আর কি কেউ বাঁচে!
আততায়ী যে-অস্ত্রটা ব্যবহার করেছিলো, সেটা তুমি খুঁজে পাওনি?”
না, ধর্মাবতার। ছোরাটা বোধহয় সে নিয়ে গিয়েছে!
পোখের ঘর যে ভিতর থেকে বন্ধ ছিলো, এটা তুমি হলফ করে বলতে পারবে তো?
হ্যাঁ–খিলও ভোলা ছিলো, তালাও লাগানো ছিলো। ব্রোক্সও তার সাক্ষী আছে। বন্ধ ছিলো বলেই তো দরজাটা ভাঙতে হলো আমাদের।
তারপর ব্রোক্স চলে গেলো?
হ্যাঁ, ধর্মাবতার, আর এক মুহূর্তও সে দাঁড়ায়নি। তক্ষুনি পেরনাউ গিয়ে কর্তৃপক্ষকে খবর দিতে চাচ্ছিলো সে। পেরনাউ থেকে শীগগিরই দুজন পুলিশ চলে আসে।
ব্রোক্স তারপর আর ফেরেনি?
না, তবে আজ সকালে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। ওকেও তো এজাহার দিতে হবে কিনা!
আচ্ছা, হের কেরস্টোফ বললেন, এবার তুমি যেতে পারো, তবে সরাই ছেড়ে কোথাও যেয়ো না। ডাকলেই যেন তোমাকে পাওয়া যায়!
জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবার আগে ক্রোফকে তার পুরো নাম, বয়েস, পেশা ইত্যাদি সব তথ্য জানাতে হয়েছিলো; আদালতের কেরানিটি পুরো প্রশ্নোত্তরটাই টুকে নিয়েছিলো। ক্রোফের এজাহার থেকে যে তথ্যগুলো জানা গেলো, কেরস্টোফ সে-সব জুড়ে-জুড়ে মিলিয়ে দেখছেন, এমন সময় খবর এলো যে ব্রোক্স ফিরে এসেছে। তক্ষুনি তার ডাক পড়লো। ক্রোফের পরেই তার সাক্ষ্যের গুরুত্ব।
ব্রোক্সকেও প্রথমে নাম-ধাম পেশা জিগেশ করা হলো– সেও সব যথাযথ বললে। কোচবাক্সের যাত্রীদের কথা সে বর্ণনা করলে প্রথমে, গাড়ি উলটে যাওয়া, পোখ-এর জখম হওয়া, যাত্রী দুজনের এই সরাইতে রাত কাটাতে আসার কারণ সব সে ঠিকঠাক বললে। দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে রক্তারক্তি দেখার যে-বিবরণ সে দিলে, তা ক্রোফের বিবরণের সঙ্গে মিলে গেলো। তবে ব্রোক্স একটা কথা বললে, যেটা বেশ বিবেচনাযোগ্য। রাস্তায় পোখ নাকি গাড়ির মধ্যে না-ভেবেচিন্তেই তার ব্রীফ-কেসের কথা বলেছিলো– অর্থাৎ তার সঙ্গে যে ব্যাঙ্কের টাকা আছে, এটা সে আদৌ লুকোয়নি।
কোচবাক্সের রহস্যময় যাত্রীটির কথা জিগেশ করতেই ব্রোক্স জানালে, উঁহু, তাকে আমি চিনি না- মুখটাই একবারও ভালো করে দেখতে পাইনি, তো চিনবো কী করে।
ঠিক গাড়ি ছাড়ার সময়ে এসে সে হাজির হয়েছিলো?
মিনিট কয়েক আগেই এসেছিলো।
আগে থেকে আসন সংরক্ষিত করে রেখেছিলো কি?
আজ্ঞে না।
রেফেলে যাচ্ছিলো কি?
রেফেল আব্দি ভাড়া দিয়েছিলো, কেবল এ-কথাই আমি বলতে পারি।
পরের দিন তোমরা কোচবাক্স মেরামত করে ফিরে আসবে, তাই তো ঠিক হয়েছিলো, না?”
হ্যাঁ, ধর্মাবতার। ঠিক ছিলো, পোখ আর সে আবার ওই গাড়িতে করেই যাবে।
অথচ পরদিন ভোরবেলায় সে সরাই থেকে চলে যায়?
হ্যাঁ, ধর্মাবতার। ক্রোফ যখন বললে যে সে চলে গেছে, শুনে আমি ভারি অবাক হয়েছিলুম।
কিন্তু তার এই আচমকা চলে যাওয়া থেকে তোমার কী মনে হয়?
আমি ভেবেছিলুম, তার হয়তো পেরনাউতে কোনো কাজ আছে আর পেরনাউ যেহেতু কাছেই, সেইজন্য হেঁটেই চলে গেছে।
তাই যদি তার উদ্দেশ্য হয় তো গাড়ি ওলটাবার সঙ্গে-সঙ্গেই সে তো চলে। যেত। খামকা এই সরাইতে সে রাত কাটাতে গেলো কেন?
হ্যাঁ, ধর্মাবতার, ব্রোক্স সায় দিলে, আমার কাছেও ব্যাপারটা ভারি আশ্চর্য ঠেকেছিলো।
ব্রোক্সকে আর কিছু জিগেশ করবার ছিলো না বলে তাকে তখনকার মতো ছুটি দেয়া হলো। সে চলে যেতেই মেজর ফেরডের ডাক্তার হামিনেকে জিগেশ করলেন, আপনি কি মৃতদেহটা আবার পরীক্ষা করতে চান?
না মেজর, ডাক্তার জানালেন, আমি জখমের ধরন, ঠিক কোন্ জায়গায় ঘা লেগেছে, কতটা চোট লেগেছে, সব টুকে নিয়েছি।
ছোরারই ঘা তো?
হ্যাঁ।
ইয়োহাউজেন জিগেশ করলেন, তাহলে কি মৃতদেহটা রিগায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে বলবো? সেখানেই তার অন্ত্যেষ্টি হবে কিনা।
কেরস্টোফ মৃতদেহটা নিয়ে যাবার অনুমতি দিলেন।
আমরাও তো তাহলে এখন যেতে পারি? ডাক্তার জিগেশ করলেন।
হ্যাঁ, মেজর বললেন, এখানে তো আর কিছু জিগেশ করার নেই।
যাবার আগে, হের কেরস্টোফ বললেন, আমি আরেকবার পোখের ঘরে যেতে চাই। হয়তো আগের বারে সব আমরা ঠিকমতো লক্ষ করিনি।
ক্রোফকে ডেকে নিয়ে আবার সবাই মিলে পোখের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। কেরস্টোফ ঘরের চুল্লির পাশে পড়ে-থাকা ছাই নেড়েচেড়ে দেখতে চাচ্ছিলেন– যদি সেখানে সন্দেহজনক কিছু পড়ে থাকে। আর সেটা দেখতে গিয়েই চুল্লির পাশের কয়লা ঠাশা হাতুড়িটার দিকে তাঁর নজর পড়লো। তুলে নিয়ে সেটা নেড়েচেড়ে দেখতে গিয়েই আবিষ্কার করা গেলো যে সেটা কী রকম যেন দুমড়ে গেছে, যেন সেটা দিয়ে খুব জোরে কিছু একটা করা হয়েছে। এটা দিয়েই কি চাপ দিয়ে পোখের জানলার খড়খড়ি খোলা হয়েছে? সম্ভবত। বিশেষ করে দেয়ালের গায়ের আঁচড়গুলো দেখে সন্দেহটা আরো জোরালো হয়। সরাইখানা থেকে বেরিয়েই কেরস্টোফ তার সন্দেহটা খুলে বললেন।
খুনটা করতে পারতো মাত্র তিনজনে। বাইরের কোনো লোক, কিংবা সরাইওলা, অথবা সেই রহস্যময় যাত্রীটি… কিন্তু কয়লা ঠাশার হাতুড়িটা দেখবার পর সব সন্দেহ ভঞ্জন হয়ে যায়। পোখের ব্রীফ-কেসে যে প্রচুর টাকা আছে, ঐ যাত্রীটি তা জানতো। রাতে নিজের ঘরের জানলা দিয়ে বেরিয়ে আসে সে, তারপর এই কয়লা ঠাশার হাতুড়িটাকে কীলক হিশেবে ব্যবহার করে পোখের ঘরের জানলা খুলে সে ভেতরে ঢুকে পড়ে। পোখকে খুন করে ব্রীফ-কেস থেকে সব টাকা হাতিয়ে তারপর জানলা দিয়েই সে নিজের ঘরে ফিরে আসে। চারটে বাজতেই চটপট সে সরাই ছেড়ে চলে যায় না, ঐ রহস্যময় যাত্রীটিই যে আততায়ী, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু কে এই রহস্যময় যাত্রী? তাকে শনাক্ত করা যাবে কী করে?
মেজর ফেরডের বললেন, হের কেরস্টোফ যা বললেন হয়তো তা-ই ঘটেছিলো। তবে খুনের মামলায় তদন্ত চালাতে-চালাতে অনেক সময় অপ্রত্যাশিত সব জটিলতা দেখা দেয়। আমি বরং ঐ যাত্রীটির ঘর তালা বন্ধ করে চাবিটা নিয়ে আসি, আর দুটি লোককে ও-ঘরের পাহারায় রেখে দিই। তারা সারাক্ষণ সরাইলও আর ঐ ঘরটার উপর নজর রাখবে।
সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করে সবাই যখন কোচবাক্সে উঠতে যাবেন, ইয়োহাউজেন হঠাৎ কেরস্টোফকে এক পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, আমি কিন্তু আপনাদের একটা কথা বলিনি। আমার মনে হয় কথাটা আপনার জানা উচিত।
বলুন।
চোরাই নোটগুলোর নম্বর আমার কাছে টোকা আছে। দেড়শো নোট ছিলো–সব একশো রুবলের নোট।
আপনি তাহলে নম্বর রেখেছেন?
হ্যাঁ, ব্যাঙ্ক থেকে তা-ই করা হয় সবসময়। বলটিক দেশগুলোয় আর রাশিয়ার সব ব্যাঙ্কে নম্বরগুলো জানিয়ে দিলেই হয়।
তাতে কি আমাদের কিছু সুবিধে হবে?চিন্তিতভাবে বললেন, কেরস্টোফ, হয়তো কথাটা আততায়ীর কানে পৌঁছে যাবে, ভয় পেয়ে সে হয়তো দেশ ছেড়েই কোথাও চলে যাবে… যেখানে নম্বরগুলোর কথা কেউ জানে না, হয়তো সেখানে সে নোটগুলো ভাঙিয়ে ফেলবে। আপনি বরং আপাতত সব চেপে যান, হয়তো টাকা ভাঙাতে গিয়েই সে ধরা পড়ে যাবে!
একটু পরেই সবাইকে নিয়ে কোচবাক্স ছেড়ে দিলো।
.
৮. ডোরপাট বিশ্ববিদ্যালয়ে
১৬ এপ্রিল বিকেলবেলায় লিভোনিয়ার ডোরপাট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে কয়েকজন ছাত্র ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। উত্তেজিতভাবে তকাতর্কি হচ্ছে ছাত্রদের মধ্যে, মশমশে জুতোর শব্দ করতে-করতে তারা পায়চারি করছে, একেকজনের কোমরে চামড়ার বেল্ট, মাথায় ছাত্রদের টুপি।
একজন বলছিলো, আমি বাপু গ্যারান্টি দিতে পারি আজ টাটকা মাছ খেতে পাওয়া যাবে। আ থেকে এসেছে মাছগুলো, কাল রাত্তিরেই ধরা হয়েছে। কুমেলে ভালো করে ধুয়ে নেবার পর মাছগুলো যার কাছে মুখরোচক ঠেকবে না, তার মাথার খুলি বাপু এক্ষুনি ফাটিয়ে দেবো।
বড়ো ছাত্রদের একজন জিগেশ করলে, কী হে জিগফ্রিড, তোমার কী মত?
আমার? জিগফ্রিড উত্তর দিলে, আমি পাখির মাংসের তদারকি করছি—আমি যা খেতে দেবো, তা যার পছন্দ হবে না, সেই মহাশয়কে এই অধমের সঙ্গে একটু লড়তে হবে।
কড়াইশুঁটিওলা মাংস রাঁধছি বাপু, তাজা হ্যাম, তৃতীয় একজন জানালে, কেউ যদি বলে যে এর চেয়ে ভালো রান্না কস্মিনকালে চেখে দেখেছে, তাহলে লজ্জায় মাথা কাটা যাবে। কার্ল, তোমার ভালো লাগবে আশা করি।
চমৎকার! কার্ল বললে, বিশ্ববিদ্যালয় দিবস তাহলে চমৎকার জমছে, বলো! অবিশ্যি ঐ মস্কোপন্থী কোনো স্লাভ থাকলেই সব মাটি হয়ে যাবে।
না, জিগফ্রিড বললে, কোনো মস্কোওলার বুকের পাটা হবে না স্লাভ। পোশাক পরে আসে।
এলে তাকে কেটেকুটে সমান মাপে টেনে নামাতে হবে। স্লাভদের ওই যে সর্দারটা আছে না, সব্বাই যার চেলা, ঐ জাঁ– সে যদি বেশি টাল্লিবাল্লি করে তো তাকে আমি একহাত দেখে নেবো। তোমাদের সবাইকে বলে রাখছি বাপু, শিগগিরই একদিন ওর সঙ্গে আমার হয়ে যাবে। যে-আলেমানদের সে অত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তাদের সামনে একদিন ওকে মাথা নোয়াতেই হবে আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়বার আগেই তার ব্যবস্থা করবো! কার্ল জানালে।
যেমন গুরু, তেমনি চেলা, ওই গোসপোদিনটাও কিছু কম যায় না! জিগফ্রিড বললে।
ও গোসপোদিন-কসপোদিন ছাড়ান দাও। স্লাভ মানে হলো স্লেভ–মানে গোলামের জাত! জার্মানদের সঙ্গে তাদের আবার তুলনা!
কথাবার্তা শুনে বোঝা গেলো যে ওরা বিশ্ববিদ্যালয় দিনের নৈশভোজের জন্য যতটা উৎসুক হয়ে আছে তার চেয়েও বেশি উৎসুক হয়ে আছে কতগুলো স্লাভ ছাত্রের সঙ্গে মারপিট করার জন্য। এই জার্মান ছোকরাদের সর্দার হলো কার্ল, ব্যাঙ্কার ফ্রাঙ্ক ইয়োহাউজেনের ছেলে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এটাই তার শেষ বছর, তারপর রিগায় ফিরে গিয়ে সে বাপের ব্যাবসায় ঢুকে পড়বে। আর যার উপরে তাদের সবচেয়ে জাতক্রোধ সে হলো রিগার অধ্যাপক দিমিত্রি নিকোলেফের ছেলে জাঁ। অনেকদিন থেকেই কার্ল অর জাঁর মধ্যে রেষারেষি চলে আসছে, কেউ কাউকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না। কাদের প্রধান চেলা যেমন জিগফ্রিড, জার শাগরেদও তেমনি এই গোসপোদিন, এস্তোনিয়ার এক সম্পন্ন ঘরের ছেলে। গোসপোদিন এমনিতে খুব হাসিখুশি দিলদরিয়া ছেলে, খেলাধুলোয় গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জুড়ি নেই। জাঁ নিকোলেফ দ্বিতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র, চাপা ভাবুক স্বভাব তার, প্রচণ্ড দায়িত্ববোধ রয়েছে, এতটা কর্তব্যনিষ্ঠ হওয়া এ বয়সে অনেক সময়ে তেমন মানায় না। গোসপোদিনের সঙ্গে তার গলাগলি ভাব। জার্মানদের হাম্বড়া ভাব ও প্রচণ্ড দেমাকি চালচলনের মধ্যে এরাই স্লাভদের আদর্শ ও সম্মান বজায় রাখতে চায় বলেই এদের উপর। কার্ল ও জিগফ্রিডের এত রাগ।
জার্মান ছোকরারা যখন জাঁ আর গোসপোদিনকে শায়েস্তা করার বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য অংশে স্লাভ ছেলেরাও কার্ল ও জাঁর রেষারেষি নিয়ে কথা বলছিলো। কার্লের এই দেমাক, ধরাকে সরাজ্ঞান করা, এ-সব গোসপোদিনের মোটেই পছন্দ নয়, সেজন্যেই সে জাঁকে তাতাবার চেষ্টা করছিলো। যদি তাকে একবার চেতিয়ে তোলা যায়, তাহলে এস্পার-ওস্পার একটা কিছু হয়ে যাবে। কিন্তু জাঁ খুব ঠাণ্ডা মাথার ছেলে, সাত চড়েও রা কাড়ে না। তার সমবোধ খুব টনটনে, কিন্তু অহেতুক ছেলেমানুষি করার পক্ষপাতী সে নয়। এটা সে ঠিক জানে একদিন কার্লের সঙ্গে তার একটা বোঝাঁপড়া হবেই হবে, সেই মুহূর্ত আসন্ন ও অনিবার্য; কিন্তু নিজে থেকে কোনো গণ্ডগোল সে শুরু করতে চায় না। তার একটা কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্কুলের ছেলেদের মতো শাস্তি না দিয়ে ইচ্ছে করলেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কাউকে বিতাড়িত করতে পারেন। জাঁ এমন-কিছু করতে চায় না যেটা তার পড়াশুনোর পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে।
অথচ রিগায় যে ইয়োহাউজেনদের সঙ্গে নিকোলেফদের একটা তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয়েও তার সাড়া পড়েছিলো। আগামী নির্বাচনে যে এঁরা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, এটা ছাত্ররা জানতো। গোসপোদিন গোড়ায় এই প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ছেলেদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে দিতে চাচ্ছিলো না, কিন্তু যখন কার্লদের টিটকিরি ও ব্যঙ্গ সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলো তখন সে জাঁকে উশকে দেবার চেষ্টা করলে।
এমন বিধিয়ে-বিধিয়ে সে কথা বলতে লাগলো যে শোনবামাত্র জাঁর মুখটা লাল হয়ে উঠলো। কিন্তু অনেক করে সে নিজেকে শামলে রাখলে। নতুন কিছু না-ঘটলে সে পুরোপুরি উদাসীন থাকবে বলেই সাব্যস্ত করলে। সে জানে কার্লরা একটা ছল-ছুতো খুঁজছে, যাতে একটুতেই বারুদের স্কুপে আগুন দিয়ে দেওয়া যায়।
কিন্তু জাঁর সমর্থকরা তার এই ঔদাসীন্যকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলো না। ওরা এরকমভাবে অপমান করে চলে যাবে, আর তারা কিছু বলবে না, এটা কি কখনও হয়? কিন্তু আঁকে তারা এতই মান্য করে যে জাঁর মতের বিরুদ্ধে একটা-কিছু করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিলো না। কিন্তু স্লাভরা যদি তোপ দাগা শুরু না করে তো আলেমানরা কি এমনিতেই ছেড়ে দেবে? তারা নিশ্চয়ই এই বিশ্ববিদ্যালয়-দিবসে একটা-কিছু ঝামেলা পাকাবে বলে এক পায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
এই কথা ভেবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একফোঁটাও স্বস্তি ছিলো না। গত কিছুকাল ধরেই রাজনীতিকে বিশেষ করে স্লাভ বনাম টিউটনিক বিসংবাদকে বিশ্ববিদ্যালয়ে চেপে রাখা যাচ্ছে না। বেশির ভাগ ছেলেই পারিবারিক ও সামাজিক চিন্তাভাবনাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। আর তার ফলে আস্ত বিশ্ববিদ্যালয় যেন একটা বারুদের স্কুপ হয়ে আছে একটুতেই বিস্ফোরণ ঘটে যেতে পারে।
কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যর চেয়ে ছাত্রদের উপর জাঁ নিকোলেফের প্রভাব বেশি। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের উৎসব থেকে কার্ল ও তার বন্ধুরা জাঁকে সবান্ধবে বাদ দিতে চাচ্ছিলো, জ যখন কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারলে না, তখন নিজের বন্ধুদের উপর সে নিজের প্রভাব খাটালে, তারা কিছুতেই যেন উৎসবের মধ্যে গোল না বাধায়, গোসপোদিনদের সে এ-বিষয়ে রাজি করালে। ভোজসভায় না ঢুকলেই হয়, এই ছিলো তার বক্তব্য। জার্মান গানের উত্তরে রুশী গান না গেয়ে উঠলেই হলো। তবে যদি তার পরেও তারা অপমান করে বা টিপ্পনী কাটে, তাহলে আলাদা কথা। তারা বরং অন্যখানে গিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাদা উৎসবের উদ্যোগ করে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রতি সম্মান দেখাবে। যতক্ষণ-না অন্য মহল থেকে বড্ড বেশি বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে, অন্তত ততক্ষণ পর্যন্ত এই বিড়ম্বনা থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখবে তারা।
উপাচার্য ভেবেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের উৎসব স্থগিত রাখতে নির্দেশ দেবেন কিন্তু তাতে যদি উপরের মহল থেকে উলটো চাপ আসে, তাহলেই মুশকিল যে ঝামেলাটা বাদ দেবার জন্য অত মাথাব্যথা সেটাই তখন নানা সংঘ ও সমিতির উত্তেজিত বাদপ্রতিবাদে তুলকালাম কাণ্ড শুরু করে দেবে। বিশ্ববিদ্যালয় তো কোনো হাতেখড়ি দেবার স্কুল নয় যে জুজুর ভয় দেখিয়ে ছেলেগুলোকে শামলাতে হবে। কাউকে-কাউকে অবশ্য তাড়িয়ে দেয়া যায় কিন্তু তেমন কঠোর কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করবার আগে সব-কিছু ভালো করে খতিয়ে দেখা উচিত।
ভোজসভার সময় নির্দিষ্ট হয়েছিলো অপরাহু চারটে। ইয়োহাউজেন, জিগফ্রিড ও তার বন্ধুরা ততক্ষণ উঠোনেই ভিড় করে দাঁড়িয়ে গুলতানি করতে লাগলো। বেশির ভাগ ছাত্রই এসে তাদের সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছে যেন নেতার কাছে কিংকর্তব্য তার নির্দেশ চাচ্ছে। এদিকে আবার একটা গুজব ছড়িয়েছিলো যে কর্তৃপক্ষ নাকি উৎসব নিষিদ্ধ করে দিয়েছেন তার ফলে বিভিন্ন দলের মধ্যে বেশ সাড়া পড়ে গিয়েছিলো; সবাই এসে জানতে চাচ্ছিলো কী ব্যাপার জনরব সত্যি কিনা।
জাঁ নিকোলেফ আর তার বন্ধুরা অবশ্য এ-সব গুজব বা হৈ-চৈ-এ মোটেই কান দিচ্ছিলো না। তারা যথারীতি গল্প করতে-করতে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর মাঝে-মাঝে ছোটো-ছোটো উত্তেজিত দলের মুখোমুখি পড়ে যাচ্ছে।
সবাই সবাইকে তাকিয়ে দেখছে, স্পষ্টাস্পষ্টি কোনো কথা হচ্ছে না বটে, কিন্তু চোখের ভঙ্গিতেই অনেকটা বলা হয়ে যাচ্ছে। জাঁ বেশ শান্ত হয়েই আছে কিন্তু চেষ্টা করছে একটা উদাসীন ভঙ্গি আনবার। কিন্তু গোসপোদিনকে শামলাতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। তার চোখে যেন আগুন ভরা নাকি ইস্পাতের ফলার মতোই বুঝি তার চাউনিঃ কার্লকে বুঝি তার চোখের দৃষ্টিতেই একেবারে গেঁথে ফেলবে। মেজাজটাও এমনি তেরিয়া মতো যে লাগে বুঝি একটা হুলুস্থুল! দু-দলের মধ্যে একটা মস্ত ঝামেলা না-পাকিয়ে সে বুঝি থামবে না!
আর এই বিষম অবস্থার মধ্যেই চারটে বেজে গেলো। কার্ল ইয়োহাউজেন তার শাগরেদদের নিয়ে সদলবলে বড়ো হলঘরটার দিকে এগিয়ে গেলো।
একটু পরেই ফাঁকা হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর কেবল রইলো জাঁ নিকোলেফ, গোসপোদিন আর প্রায় জনাপঞ্চাশ স্লাভ ছাত্র। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে যাবে বলেই তারা সেখানে অপেক্ষা করছিলো। কোনো কাজকর্ম ছিল না; কাজেই তারা তক্ষুনি চলে গেলে ভালো করতো। জাঁ নিকোলেফ তাদের এই বিচক্ষণ পরামর্শ দিয়েছিলো কিন্তু তার প্রস্তাবে কেউ রাজি হলে তো! গোসপোদিন ও তার শাগরেদরা যেন মাটিতে শিকড় গজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন চুম্বকের মতো তাদের টান দিচ্ছে। ভোজসভা।
মিনিট কুড়ি কাটলো চুপচাপ। হাঁটাহাঁটি করছে তারা এদিক-ওদিক, মাঝে-মাঝে চত্বরের দিকের জানলাগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে। কেন?… রাগি টিপ্পনী শুনতে, আর উত্তরে চ্যাটাং চ্যাটাং মন্তব্য ছুঁড়ে মারতে? বোধহয় তাই তাদের মতলব!
অতিথিরা আর ভোজসভা শেষ হবার জন্যে অপেক্ষা করলে না, তক্ষুনি গান জুড়ে দিলে, আর পানপাত্র নিয়ে শুভেচ্ছাজ্ঞাপনও শুরু হলো। দু-এক চুমুকেই চট করে মাথায় চড়ে গেলো মদ, তাকিয়ে দেখে বুঝলো যে জানলার বাইরে থেকে জাঁ নিকোলেরা তাদের সব কথাই শুনতে পাবে, অমনি তারা ব্যক্তিগত আক্রমণের স্তরে নেমে এলো।
একবার শেষ চেষ্টা করলে জাঁ। বন্ধুদের বললে, চলো, যাই।
না। গোসপোদিন উত্তর দিলে।
না, কিছুতেই না,অন্যরাও ঐকতানে যোগ দিলে।
আমার কথা শুনবে না তোমরা? ঠিক তো?
ওই জার্মান ছোকরাগুলো কী বলতে চায়, তা আমরা শুনবোই, জাঁ। পুরো ব্যাপারটা যদি আমাদের পছন্দ না-হয় তো আমরা যা করবো তোমাকে তা-ই করতে হবে।
ও-রকম জেদ কোরো না, গোসপোদিন। চলে এসো…
দাঁড়াও না এক মিনিট, গোসপোদিন তাকে বললে, তারপর তুমিও আর যেতে চাইবে না।
হলঘরের মধ্যে তখন হৈ-হল্লা-হট্টগোল চরমে পৌঁছেছে, গেলাশের শব্দ হচ্ছে ঝনঝন, আর হঠাৎ তারই মধ্যে গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে সবাই গান ধরে দিলে সেই পুরোনো গাউডেয়ামুস ইগিটুর গীত–জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর যোট অতিপ্রিয় ও শ্রদ্ধাশীল ঐকতান।
তারপরেই আচমকা সব ছাপিয়ে একটা গলা শোনা গেলো, রিগা, সোনার দেশ, তোমাকে এত সুন্দর করলো কে! লিভোনীয়দের দাসত্ব। হয়তো একদিন আমরা তোমার জন্য কেল্লা খরিদ করবার টাকাকড়ি জোগাড় করতে পারবো আর তপ্ত ইট-পাথরের ওপর বেড়ালনাচ নাচাবো স্লাভদের!
+
রুশী গানটা প্রথমে গলা ছেড়ে ধরলে গোসপোদিন। তারপরে তার বন্ধুরাও একযোগে তাতে গলা মেলালে।
আচম্বিতে দুম করে খুলে গেলো দরজা, প্রায় শ-খানেক ছাত্র হুড়মুড় বেরিয়ে এলো বাইরে। এসেই তারা স্লভদের ঘিরে ধরলে। স্লাভ ছেলেদের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলো জা নিকোলেফ, চেষ্টা করেও কিছুতেই সে বন্ধুদের আর শামলাতে পারছিলো না। কার্ল ইয়োহাউজেন অবিশ্যি ভিতরেই তখনও ঐকতান গাইছে; সে বাইরে বেরোয়নি। কিন্তু মুখোমুখি দাঁড়ালো জিগফ্রিড আর গোসপোদিন।
গোলমাল শুনে স্বয়ং রেক্টর তাড়াহুড়ো করে অকুস্থলে এসে উপস্থিত, সঙ্গে কয়েকজন অধ্যাপকও। অবস্থাটা যাতে আয়ত্তের বাইরে চলে না-যায়, ছেলেগুলোকে যাতে শামলে-শুমলে বুঝিয়ে নিরস্ত করা যায়, সেটাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু হট্টগোলের মধ্যে রেক্টরের গলা শুনবে কে? এ দিকে আলেমান ছাত্রদের সংখ্যা পিলপিল করে বেড়েই যাচ্ছে হলঘর তাদের উগরে দিচ্ছে অনবরত– এই খ্যাপা ও বদরাগি ছেলেদের তিনি কীই বা বোঝাবেন?
সংখ্যায় অনেক কম, কিন্তু অপমান আর শাসানি সইবে না স্লাভরা। জাঁ নিকোলেফ ও তার সঙ্গীরাও দাঁড়িয়ে আছে অকম্পিত।
জিগফ্রিডের হাতে ছিলো মদের গেলাশ– হঠাৎ সে এসে গোসপোদিনের মুখে মদ ছুঁড়ে মারলে।
প্রথম ঘা, কিন্তু আসলে উটের পিঠে শেষ খড়। লাগে বুঝি একটা তুলকালাম কাণ্ড, কিন্তু সব হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলো, কারণ ঠিক সেই মুহূর্তেই সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে কার্ল ইয়োহাউজেন। সবাই সরে গিয়ে তার পথ করে দিলো; যাতে সে নিকোলেফের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াতে পারে।
কার্ল সত্যি-সত্যি কী ভাবছিলো বলা মুশকিল। শান্ত, গম্ভীর মুখে রোষ বা ক্রোধের চিহ্ন নেই, বরং যতই নিকোলেফের দিকে সে এগুচ্ছে ততই তার মুখ ঘৃণায় ভরে যাচ্ছে। না, তার বন্ধুরা ভুল ভাবলে না- নিকোলেফকে চূড়ান্ত অপমান করাই তার উদ্দেশ্য।
ঐ হট্টগোলের পরেই হঠাৎ যে-স্তব্ধতা নেমে এলো, সেটাই অনেক বেশি ভয়ঙ্কর ছিলো আসলে। গোসপোদিন এগিয়ে এসে কার্লের পথ আটকাবার চেষ্টা করলে। জাঁ তাকে টেনে ধরলে, বললে, না, গোসপোদিন, এটা আমার ব্যাপার।
আমাকে তুমি থামাতে পারবে না, গোসপোদিনের সর্বাঙ্গ রাগে জ্বলে যাচ্ছিলো।
ঠাণ্ডা গলায় জাঁ নিকোলেফ বললে, পারবো। তারপর সে গলা চড়িয়ে সবাই যাতে শুনতে পায় এইভাবে বললে, তোমরা কয়েকশো, আমরা পঞ্চাশজনও নই। বেশ, তাহলেও লড়তে এসো। আমরা তোমাদের ঠেকাবো তো বটেই, কিন্তু হেরেও যাবো। অবশ্য হারটাই হবে আমাদের জিৎ, কারণ তোমরা কাপুরুষের মতো কাজ করবে!
উঠলো আবার হৈ-হৈ, কিন্তু কার্ল ইঙ্গিত করতেই সবাই থেমে গেলো। কার্ল বললে, বেশ, আমরা না-হয় কাপুরুষই হলুম। কিন্তু তোমাদের স্লাভদের মধ্যে কেউ কি আছে যে একা লড়বে। আমার সঙ্গে?
আছি, আমরা সবাই আছি। একসঙ্গে চাঁচালে স্লাভ ছেলেরা।
কিন্তু জাঁ নিকোলেফ দু-পা এগিয়ে বললে, আমি আছি। কার্ল যদি চায় ব্যক্তিগতভাবে ব্যাপারটার বোঝাঁপড়া হোক, তো আমিই–
তুমি? কার্লের গলা ঘৃণায় বিকৃত শোনালো।
হ্যাঁ, আমি।
তুমি, তুমি আমার সঙ্গে লড়বে?
হ্যাঁ। এখন যদি তুমি তৈরি না-থাকো তো, কাল। চাইলে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে।
কিন্তু জাঁ নিকোলেফ, কার্ল উত্তর দিলে, তুমি একটা মস্ত ভুল করেছে। আমি তো তোমার সঙ্গে ডুয়েল লড়বো না…
লড়বে না? কেন?
কারণ তার সঙ্গে কে আর লড়তে যাবে বলো যার বাপ হলো একজন কুখ্যাত খুনে ডাকাত!