মাস্টার জাকারিয়ুস – জুল ভার্ন
অনুবাদ – মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
১. হিমরাত্রি
জেনিভা হ্রদেরই একেবারে পশ্চিম উপান্তে জেনিভা নগরী। হ্রদের থেকে বেরিয়েছে রোন নদী; নগরীকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে সে; কিন্তু হঠাৎ নগরীর মাঝখানে সে নিজেই আবার দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে–মাঝনদীতে ছোট্ট একটা দ্বীপ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে বলে। শিল্প-বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রগুলিতে অনেক সময়েই এই ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ করা যায়। যাতায়াতের যে-সুবিধে এই চঞ্চল স্রোত উপহার দেয়, প্রথম বাসিন্দারা যে তাতেই যথেষ্ট প্রভাবিত হয়ে পড়ে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিজে থেকেই চলতে থাকে এই রাস্তা, নদীদের পাকল তো এইভাবেই বর্ণনা করেছেন। রোন নদীর বেলায় বলা যায় এ-রাস্তা কেবল চলে না, ছুটে চলে–দৌড়ে চলে।
দ্বীপটা যেন ওই নদীর মধ্যকার মস্ত এক ওলন্দাজ নৌকো। নিয়মিতভাবে নতুন-নতুন বাড়ি-ঘর তৈরি হবার আগে অদ্ভুত ধরনে বাড়ি বানানো হতো এখানে-যেন একটা আরেকটার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তো তারা, বিশৃঙ্খল কিন্তু সুন্দর, এলোমলো অথচ মনোরম। নদীর একেবারে পাড় ঘেঁষে উঠছে বাড়ি, মনে হয় যেন নদীর মধ্যেই তার ভিত, যেন থামের গায়ে কোনোরকমে হেলানো আছে–আর চঞ্চল নদীস্রোতের মধ্যে এলোমেলো সেই বাড়িগুলি যেন হঠাৎ কেমন করে আটকে গেছে, না-হলে তারাও হয়তো ভেসে যেতো দূরে। মস্ত-মস্ত সব থামগুলিকে কোনো অতিকায় কাঁকড়ার দাঁড়া বলে মনে হয়–কালো হয়ে গেছে তারা দিনে-দিনে, আর জল তাদের খেয়ে-খেয়ে গেছে–দেখে অদ্ভুত ও অবাস্তব একটা শিরশিরে অনুভূতি হয়। পুরোনো ভিতের মধ্যে ছোট্ট হলুদ জলের স্রোত খেলা করে অন্ধকারে, যেন কোননা, ঊর্ণনাভের সুতো বেরিয়েছে কেঁপে-কেঁপে, যেন কোনো মস্ত এক-বনের চঞ্চল পাতা তারা–আর জল এই স্তম্ভের অরণ্যে আটকে, বাধা পেয়ে, ধাক্কা খেয়ে, অসীম দুঃখে গর্জে-গর্জে ফেনিয়ে উঠছে।
দ্বীপের বাড়িগুলোর মধ্যে একটি এত পুরোনো ও জীর্ণ যে তাকাবামাত্র প্রথমেই চোখে পড়ে। বুড়ো ঘড়ি-নির্মাতা মাস্টার জাকারিয়ুসের বাড়ি এটা; থাকার মধ্যে আছে তার একমাত্র কন্যা জেরাঁদ; সে ছাড়া ওই বাড়িতে থাকে তার ছাত্র ও সহকারী ওবের তুন, আর পুরোনো দাসী স্কলাস্টিকা।
এই জাকারিয়ুসের সঙ্গে কোনোদিক থেকেই তুলনা চলে এমন কেউ জেনিভায় ছিলো না। কত-যে তার বয়েস, কেউ তা জানেই না। শহরের প্রাচীনতম লোকটি পর্যন্ত এ-কথা বলতে পারবে না কবে থেকে তার কাঁধের উপর লম্বাটে ধরনের তীক্ষ্ণ মাথাটি চঞ্চলভাবে নড়াচড়া করছে কিংবা এটাও কেউ বলতে পারবে না কবে তাকে প্রথম এই শহরের রাস্তায় হাঁটতে দেখা গেছে–লোকে শুধু এটুকুই জানে যে যখন তিনি পথে বেরোন, হাওয়ায় তাঁর সাদা চুল এলোমেলোভাবে ওড়ে। তিনি যেন আদৌ বেঁচেই নেই : শুধু তাঁর ঘড়িগুলির পেনডুলামের মতো সর্বদাই যেন আন্দোলিত হচ্ছেন। ছোটোখাটো অলবডে শরীর তার, সব সময়েই গাঢ় ও গম্ভীর রঙের পোশাক পরেন কালোই বেশির ভাগ সময়। লেয়োনার্দো দা ভিচির ছবির মতো যেন আদ্যোপান্ত কালো রঙেই আঁকা তিনি।
গোটা বাড়িটার মধ্যে যে-ঘরটা সবচেয়ে ভালো আর সুন্দর, সেই ঘরে থাকে জেরাঁদ; ঘুলঘুলির মতো ছোট্ট এক টুকরো জানলা দিয়ে জুরা পর্বতের তুষারঢাকা আশ্চর্য চূড়াটি দেখা যায়। কিন্তু জাকারিয়ুসের শোবার ঘর আর কারখানা যেন জলের গায়ে লাগা গহ্বরের মতো–মেঝেয় পাটাতন ফেলা, তলায় জলের হোত ছলোছলে ঘুরে বেড়ায়।
মনেই পড়ে না কবে থেকে, কিন্তু এটা সত্যি যে খাবার সময় ছাড়া মাস্টার জাকারিয়ুস কখনো তার ঘর থেকে বেরোন না-শুধু মাঝে-মাঝে যখন শহরের বিভিন্ন ঘড়িগুলোকে দম দিতে যেতে হয়, তখন অবশ্য অন্য রকম। সারা সময়ই তিনি তার বেঞ্চির উপর বসে কাটান : আশপাশে ঘড়ির অসংখ্য সূক্ষ্ম ও জটিল যন্ত্রপাতি ছড়িয়ে থাকে–আর এখানে বলা উচিত যে এইসব যন্ত্রের অধিকাংশই তার নিজের আবিষ্কার। আশ্চর্য তার মেধা আর চাতুরী; আলেমান ও ফরাশি দেশে তাঁর কাজের অত্যন্ত সুখ্যাতি। জেনিভার শ্রেষ্ঠ ঘড়িনির্মাতারা অল্প দিনের মধ্যে তার শ্রেষ্ঠতা বুঝতে পেরেছিলো। তিনি যে নগরীর একজন সম্মান, এটা তারা স্পষ্টভাবে বলেছিলো তখন; ঘড়ির যে-অংশটা গতি নিয়ন্ত্রণ করে, তা আবিষ্কার করার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব তার। সত্যি বলতে, সত্যিকার ঘড়ির জন্মই হলো তখন, যখন কয়েক বছর আগে জাকারিয়ুসের প্রতিভা নানা সূক্ষ্ম জিনিশ আবিষ্কার করলো।
অনেকক্ষণ ধরে কঠোর ও একটানা কাজ করার পর আস্তে-আস্তে জাকারিয়ুস তার যন্ত্রপাতি সরিয়ে রাখেন; আতশকাঁচ দিয়ে দেখে-দেখে সূক্ষ্ম ও জটিল যন্ত্রগুলি জুড়ছিলেন তিনি এতক্ষণ–এবার তার লেদ-এর সচল চাকাটা তিনি বন্ধ করে ফ্যালেন; তারপর মেঝের পাটাতনের চোরা দরজাটার পাল্লা তুলে ঝুঁকে দাঁড়ান তিনি; নিচে চোখের তলায় বোন নদীর প্রখর স্রোত আবর্ত তুলে ছুটে যাচ্ছে–ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওইভাবে দাঁড়িয়ে সেই ভিজে ও ঘন বাষ্প নিশ্বাসে টেনে নেন বুকে।
একদিন শীতের রাত্রে স্কলাস্টিকা যথারীতি খাবার-টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিলে : বাড়ির রীতি অনুযায়ী তরুণ যন্ত্রশিল্পী ওবের আর সে দুজনেই প্রভুর সঙ্গে খেতে বসে। জাকারিয়ুসের খাদ্য অত্যন্ত সাবধানে রান্না করা হয় : সে-রাতে কিন্তু সুন্দর নীল রেকাবিতে সাজিয়ে দেয়া খাদ্যবস্তু তিনি স্পর্শই করলেন না। কন্যা জেরদের মিষ্টি কথাগুলির উত্তরে সংক্ষেপে হু-হাঁ করে যাচ্ছিলেন কিংবা কখনো কোনো কথাই বলছিলেন না। জেরাঁদের কথা থেকে বোঝা গেলো যে বাবার এই অদ্ভুত স্তব্ধতা সে স্পষ্ট লক্ষ করেছে। এমনকী স্কলাস্টিকার একঘেয়ে ও অবিরাম বকুনিতে পর্যন্ত তিনি কোনো কান দিলেন না; রোন নদীর অবিশ্রাম কলরোলের সঙ্গে স্কলাস্টিকার মুখরতার যে কোনো তফাৎ তিনি ধরতে পেরেছেন, এটা তার মুখ দেখে মনে হলো না।
চুপচাপ খেয়ে উঠে জাকারিয়ুস কাউকেই শুভরাত্রি না-জানিয়ে তার কুঠুরিতে চলে গেলেন; অন্যদিন খাওয়া-দাওয়ার পর কন্যাকে আলিঙ্গন করে সস্নেহে তার কাপলে চুম্বন করেন তিনিঃ কিন্তু আজ তাও করলেন না, বরং তিনি যখন দরজার বাইরে চলে গেলেন তখন তার ভারি পায়ের তলায় সিঁড়িটা আর্ত গলায় কেবল কারে-কাৎরে উঠলো।
জেরাঁদ, ওবের আর স্কলাস্টিকা–তিনজনেই স্তব্ধ বসে রইলো কিছুক্ষণ। সন্ধে থেকেই আকাশ মেঘলা হয়ে আছে, কেমন বিমর্ষ আর মলিন; কোনোরকমে নিজেদের টেনে-হিঁচড়ে আল্পসের চুড়া পর্যন্ত যেতে পেরেছে যেন ভারি মেঘগুলি–তারপর অবসন্ন হয়ে সেখানেই বসে আছে, কালো ও গম্ভীর; আর বৃষ্টি হবে, এই কথাই জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ভিজে হাওয়া। সুইজারল্যাণ্ডের প্রবল বর্ষণকাল যেন মন খারাপ করিয়ে দেয় কেবল–রাশি ও রাশি বিষাদ যেন ছড়িয়ে দেয় সে চারদিকে। সেই থেকে বাড়ির চারপাশে ভীষণ দখিনা বাতাস গজরাচ্ছে, আর তার তীক্ষ্ণ শিসের মধ্যে যেন ভিড় করে আছে অলুক্ষুণে সব আশঙ্কা।
অবশেষে স্কলাস্টিকাই প্রথমে স্তব্ধতা ভাঙলে। জেরাঁদের দিকে তাকিয়ে বললে, কর্তা আজ ক-দিন থেকেই যেন কেমন হয়ে আছেন। মাতা মেরির নামে শপথ উচ্চারণ করলে সে। খাদ্যে যে তার কোনো স্পৃহা নেই–তা তো স্পষ্ট। বোধহয় অনেক কথা তার ভিতরে ভিড় করে আছে–অথচ সেগুলি যে কী, তা বের করে আনতে গেলে অতি-ধূর্ত কোনো শয়তানও একেবারে হিমশিম খেয়ে যাবে।
গোপন কোনো উদ্বেগ রয়েছে নিশ্চয়ই। অথচ উদ্বেগের কারণ যে কী তা তো কিছুই বুঝতে পারছি না, গভীর উৎকণ্ঠা ও বিষাদ ফুটে উঠলো জেরাঁদের মুখচোখে।
এত মন খারাপ করবেন না, মাদমোয়াজেল, মাস্টার জাকারিয়ুসের স্বভাব তো জানেনই আপনি। তাঁর মনের মধ্যে যে কী আছে, তা কি কোনোদিনই-কেউ টের পেয়েছে? হয়তো আজ অত্যন্ত ক্লান্তি অনুভব করছিলেন, দেখবেন, কাল তার চিহ্নমাত্রও খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনি কষ্ট পেয়েছেন জানলে তখন হয়তো আবার অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে পড়বেন। জেরাদের আশ্চর্য আয়ত চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে বললো ওবের।
ওবের-এর বুদ্ধি বিবেচনা ও সততা জাকারিয়ুসের ভালো লেগেছিলো বলেই তাকেই তিনি প্রথম নিজের হাতে কাজ শেখাতে রাজি হয়েছিলেন–ওবের ছাড়া আর কাউকেই তিনি কখনো তাঁর বিশেষ কর্মপদ্ধতি শেখাতে চাননি। ওবেরের প্রতি এখন জেরার্দ এমনি আসক্ত হয়ে পড়েছে যে তার নিষ্ঠা সম্বন্ধে এখন কোনো প্রশ্নই আর ওঠে না।
জেরাঁদের বয়স আঠারো বছর। গোল ছাঁদের মুখ তারমাদোন্নার মতো সরল আর স্বর্গীয় যেন, যে-স্নিগ্ধা শুচিতা এখনও ব্রিটনিয়ার কোনো-কোনো প্রাচীন রাস্তায়-ঘাটে দৈবাৎ চোখে পড়ে। চোখ দুটিতে ছড়িয়ে আছে অসীম সরলতা। কোনো কবির স্বপ্ন-মাধুরীর প্রতিমা যেন সে, আর তা-ই তাকে ভালো না-বেসে কোনো উপায় নেই। তার পোশাকের রঙ স্নিগ্ধ ও সুকুমার–তাতে কোনো তীব্র কর্কশ চীৎকার নেই; গির্জের রেশমে যে-স্নিগ্ধতার আভা চোখে পড়ে, তেমনি শুভ্র বসনে তার সুডৌল কাঁধখানি ঢাকা। জেনিভায় তো এখনও কালভিনবাদের শুষ্কতা ছড়িয়ে পড়েনি–আর জেরাঁদ যেন তারই মধ্যে কোনো অতীন্দ্রিয় জগৎ খুঁজে পেয়েছে।
লাতিন স্তোত্র পাঠ করে সে রাত্রে আর সকালে; সম্প্রতি আবার ওবের তুনের মধ্যে গোপন মমতা আবিষ্কার করেছে সে–তার প্রতি এই তরুণ যন্ত্রশিল্পীর অনুরাগের প্রবলতা তার আর অজানা নেই। এই বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতার বাড়িটাই যেন ওবেরের সমস্ত জগৎ; নিজের কাজ শেষ হয়ে গেলে জাকারিয়ুসের কারখানা থেকে বেরিয়ে আসে সে, বাকি সময়টা এই তরুণীর কাছেই কাটিয়ে দেয়, পারতপক্ষে বাড়ি ছেড়ে এক পা-ও বেরোয় না।
বুড়ি দাসী স্কলাস্টিকা দেখছিলো সবই, কিন্তু কিছুই বলতো না। দিনকাল যে বড্ড খারাপ হয়ে গেছে, আর গৃহস্থালির টুকিটাকি যে আসলে মোটেই ফ্যালনা নয়–তার যাবতীয় বকবকানি এতেই নিঃশেষ হয়ে যেতো। একবার সে যদি কোনে বিষয়ে বকবক শুরু করে তো তার আর বিরাম নেই, এই তথ্যটা সবাই জানতো বলেই কেউ তাকে আর থামাবার চেষ্টা করতো না। জেনিভায় যে কলের বাজনা-ওলা নস্যিদানি তৈরি হয়, সে যেন তা-ই। একবার চাবি দিলে, হাতুড়ির বাড়ি মেরে কেউ তাকে ভেঙে না-ফেললে, সমস্ত দম ফুরিয়ে না-ফেলে কিছুতেই সে থামবে না।
জেরাঁদকে অমন স্তব্ধ ও বিষণ্ণ হয়ে পড়তে দেখে স্কলাস্টিকা তার পুরোনো কাঠের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে গেলো; মস্ত একটা রুপোর পিলশুজে মস্ত একটা মোমবাতি জ্বেলে পাথরের কুলুঙ্গির মধ্যে গালার তৈরি মেরিমাতার প্রতিমার পাশে বসিয়ে দিলে। গৃহস্থালির অধিষ্ঠাত্রী এই মাদোন্না মূর্তির কাছে নতজানু হয়ে বসাই ছিলো বাড়ির নিয়ম; তিনি যাতে দয়া করে আসন্ন রাত্রিকালে সবাইকে দ্যাখেন, ঘুমুতে যাবার আগে এই প্রার্থনা করতে হয় তার কাছে। জেরাঁদ কিন্তু আজ চুপ করে তার চেয়ারেই বসে রইলো।
বাঃ, স্কলাস্টিকা অবাক হয়ে গেলো, খাওয়া শেষ হয়ে গেছে, শুতে যাবার সময়ও হলো-অত রাত অব্দি জেগে থেকে খামকা চোখকে কষ্ট দিচ্ছো কেন? হায়, মেরি মাতা! এর চেয়ে ঘুমিয়ে থাকা অনেক ভালো–তাহলে অন্তত স্বপ্নে কিছুটা আরাম পাওয়া যাবে। দিনকাল যেমন জঘন্য হয়ে পড়েছে, তাতে সুখশান্তি পাবার কি আর জো আছে আজকাল?
বাবার জন্য ডাক্তার ডাকা উচিত না আমাদের? জিগেস করলো জেরাঁদ।
ডাক্তার! বুড়ী দাসী প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো, ডাক্তার-বদ্যির বড়ো-বড়ো কথাবার্তা আর খেয়ালে কত্তা কি কোনোদিনও কান দিয়েছেন? বরং ঘড়িকে দামি ওষুধ খাওয়াবেন–কিন্তু নিজে? কখনো না!
কী করবো তাহলে? আপন মনেই বললো জেরাঁদ, বিশ্রাম নিচ্ছেন, না কাজ করছেন, কে জানে?
জেরাঁদ, ওবের নরম স্বরে বললে, আপনার বাবা একটু ভাবনায় পড়েছেন, এইমাত্র–আর-কিছুই তাঁর হয়নি।
আপনি জানেন, ওবের, কী সে ভাবনা?
বোধহয় জানি, জেরাঁদ। অন্তত আন্দাজ করতে পারি।
তাহলে বলে ফ্যালো তো চটপট, অত্যন্ত উৎসুকভাবে বলে উঠলো স্কলাস্টিকা। পয়সা বাঁচাবার জন্য মোমবাতিটা সে নিভিয়ে দিলে।
জেরাঁদ, ওবের বললে, দিন কয়েক ধরে অদ্ভুত কতগুলি প্রহেলিকার মতো ব্যাপার ঘটেছে। আপনার বাবা কয়েক বছর ধরে যে-ঘড়িগুলি বানিয়ে বিক্রি করেছিলেন, সব হঠাৎ এক-এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সারাবার জন্য অনেকে ঘড়িগুলি তাঁকে দিয়ে গেছে। অত্যন্ত সাবধানে তিনি ঘড়িগুলি খুলেছেন। স্প্রিং-এ কোনো দোষই নেই, চাকা আর কাঁটাগুলিও ঠিক আছে–তবু আরো সাবধানে ভালো করে দেখেশুনে তিনি আবার জুড়ে দিয়েছেন সেগুলি। কিন্তু তার সমস্ত চেষ্টা সত্ত্বেও একটা ঘড়িও আর চলছে না।
নিশ্চয়ই কোনো শয়তানের কাণ্ড! স্কলাস্টিকা চেঁচিয়ে উঠলো।
এ-কথা কেন বলছো? জেরাঁদ জিগেস করলে। আমার কাছে তো ব্যাপারটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে বোধ হচ্ছে। জগতে তো আর চিরকাল কিছুই থাকে না। মানুষ কি আর অসীমকে স্পর্শ করতে পারে?
কিন্তু তবু এটা ঠিক যে, ওবের বললে, ব্যাপারটা কেবল রহস্যময় নয়, অসাধারণও। ঘড়িগুলি হঠাৎ কেন বিকল হয়ে গেলো, আমিও তার সঙ্গে তা তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোথাও কোনো গোলমাল চোখে পড়েনি। হতাশ হয়ে কতবার যে হাল ছেড়ে দিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
তা এমন-একটা অর্থহীন কাজ করারও চেষ্টা কেন, বাপু? স্কলাস্টিকা বললে, ওই তামার কলটা নিজে থেকেই চলবে, সময় বলে দেবে, জানিয়ে দেবে এমনকী ঘণ্টা মিনিট সেকেণ্ড–তাকে কি স্বাভাবিক বলে? এর চেয়ে আমাদের ছায়া-ঘড়িই ঢের ভালো ছিলো।
যখন শুনবে যে কেন ওই ছায়া-ঘড়ি বের করেছিলো, ওবের বললে, তখন তুমি আর ও-কথা বলবে না।
হা ঈশ্বর! এ আবার কী কথা শোনালে।
তোমার কি মনে হয়, অত্যন্ত সরলভাবে শুধোলে জেরাঁদ, বাবার ঘড়িগুলি যাতে ঠিকমতো চলে, সেজন্য ভগবানের কাছে প্রার্থনা করা উচিত আমাদের?
নিশ্চয়ই,তৎক্ষণাৎ বললে ওবের।
ভালো, কিন্তু এই প্রার্থনায় কোনো ফল হবে না, স্কলাস্টিকা আপন মনে বিড়বিড় করলে, তবে উদ্দেশ্য ভালো বলে ভগবান এদের ক্ষমা করবেন।
আবার জ্বালানো হলো মোমবাতি। স্কলাস্টিকা, জেরাঁদ আর ওবের মেঝেয় নতজানু হয়ে বসলো একসঙ্গে। জেরাঁদ প্রথমে প্রার্থনা করলো রাত্রির জন্য করুণা ও আশিস, প্রার্থনা করলে বন্দী আর পথিক, ভালো আর মন্দ সকলের জন্য, আর সবশেষে তার বাবার এই দুর্ভাগ্যের জন্য সবচেয়ে কাতরভাবে মিনতি জানালো সে।
ভগবানের কাছে সব দুঃখ নিবেদন করে দিলো বলে প্রার্থনার পরে যখন তারা তিনজন উঠে দাঁড়ালো, তখন তাদের মনে বেশ খানিকটা আস্থা জেগে উঠেছে।
ওবের তার নিজের ঘরে চলে গেলো; জেরাঁদ একা জানলার পাশে বসে-বসে কী যেন ভাবতে লাগলো, আর আস্তে-আস্তে রাস্তায় শেষ বাতিগুলো নিভে গেলো; স্কলাস্টিকা প্রথমে চুল্লির নিভু নিভু অঙ্গারে একটু জল ছিটিয়ে দিলে, তারপর দরজার মস্ত খিল দুটি লাগিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে গড়িয়ে পড়লো-আর শয়তানের ভয়েই মরে যাচ্ছে বলে সে স্বপ্ন দেখতে লাগলো পরক্ষণে।
ক্রমেই বাড়তে লাগলো শীতের রাতের বিভীষিকা ও আতঙ্ক। মাঝে-মাঝে নদীর আবর্তের সঙ্গে কঙ্কনে ঝোড়ো হাওয়া এসে মেশে, আর সারা বাড়িটা থরথর করে কেঁপে ওঠে; জেরাঁদ কিন্তু তেমনি ঠায় বসে আছে জানলায়, বিষণ্ণ ও একা–বাবার চিন্তায় মগ্ন ও তন্ময়। ওবেরের কাছ থেকে বিকল ঘড়ির কথা শোনবার পর থেকেই বাবার উদ্বেগ আর অসুখ ক্রমেই অতিকায় আর ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে বলে তার মনে হলো। তার বাবার জীবন যেন কেমন যান্ত্রিক হয়ে গেছে–এবং এ-কথা ভাবতে তার অত্যন্ত কষ্ট হলো বটে, তবু সে অনুভব করলে যে, যে-খুঁটির উপর ভর করে তাঁর জীবন ঘুরে চলতো, তা যেন ক্রমেই জীর্ণ হয়ে পড়ছে–আগের মতো তেমন সহজ ও অনায়াস ভাবটা যেন আর নেই।
হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার ছাদের চিলেকোঠার জানলার পাল্লাটা প্রচণ্ডভাবে দেয়ালে গিয়ে লাগলো। যেন ভীষণ ঘা খেয়ে জেরাঁদ শিউরে তার স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলো, কিন্তু আওয়াজটার উৎস সে ধরতে পারলো না। একটু যখন শিহরন কমলো, ধীরে-ধীরে সে জানলার শার্শি খুলে দিলে। চিরে, ফেটে চুরমার হয়ে গেছে যেন মেঘ, আর মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে আশপাশের বাড়ির ছাতে। জানলা দিয়ে ঝুঁকে সে খড়খড়িটা টেনে দেবার চেষ্টা করলে, কিন্তু হঠাৎ কেমন যেন ভয় করে উঠলো, কেমন যেন একটা ছমছমে ভাব।
মনে হলো বৃষ্টি আর নদীর জলে একাকার হয়ে গেছে চারদিক, যেন প্লাবন শুরু হয়ে গেছে হঠাৎ, জীর্ণ বাড়িটা বুঝি আস্ত ডুবে যাচ্ছে জলে। নড়বোড়ে কাঠ আর পাটাতন কাতর আর্তনাদ করে উঠছে বারেবারে। ভয় পেয়ে সে তার ঘর ছেড়েই বুঝি পালাতো, কিন্তু এমন সময় হঠাৎ জাকারিয়ুসের শোবার ঘরে সে আলোর রেশ দেখতে পেলো। কেনো, কোনো সময় আদিম দেবতাদের গর্জন আমাদের কানে পৌঁছোয় না, বরং তার চেয়ে অনেক মৃদু ও অস্ফুট শব্দ জড়ে মধ্যে অতিকায় হয়ে ওঠে। হঠাৎ যেন কোনো অস্ফুট বিলাপের ধ্বনি তার কানে এসে পৌঁছুলো। জানলাটা বন্ধ করার চেষ্টা করলো সে, কিন্তু পারলো না। ঝোড়ো হাওয়ায় যেন বারেবারে ঠেলে দিচ্ছে তাকে, লুকিয়ে বাড়িতে ঢোকবার সময় চোরকে যেভাবে বাড়ির দরজা-জানলা ঠেলে ফেলে দিতে চায়।
মনে হলো আতঙ্কে সে বুঝি পাগল হয়ে যাবে। এত রাত্রে কী করছেন তার বাবা? দরজা খুললো সে, কিন্তু কবাটটা তার হাত থেকে সরে গেলো। ঝোড়ো হাওয়া তাকে ভীষণ জোরে ধাক্কা দিয়ে ছুঁড়ে ফেললো দেয়ালে। অন্ধকার খাবার ঘরে এসে দাঁড়ালো জেরাঁদ, তারপর কোনোরকমে পা টিপে-টিপে অধমূৰ্ছিত ও বিবর্ণর মতো বাবার কারখানার দিকে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো।
নদীর গর্জনে আর চীকারে আস্ত ঘরটা কেঁপে-কেঁপে উঠছে আর তার মাঝখানে সোজা দাঁড়িয়ে আছে বৃদ্ধ ঘড়িনির্মাতা। কেমন এক জ্যান্ত বিভীষিকার। মতো তাঁর শাদা চুল উড়ছে ঝোড়ো হাওয়ায়; হাত-পা নেড়ে উদ্ভ্রান্তের মতো কথা বলছেন তিনি–যেন তার চোখ-কান নিঃসাড় হয়ে গেছে, কিছুই শুনছেন না বা দেখতে পাচ্ছেন না। জেরাঁদ স্তব্ধ হয়ে চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়ে রইলো।
মৃত্যু! ফাঁকা গলায় বলছেন জাকারিয়ুস, জেরাঁদ শুনতে পেলো। মৃত্যু ছাড়া আর-কিছুই না। নিজের অস্তিত্বটাকেই যখন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছি তখন আর বেঁচে থাকবোই বা কেন? আমি, মাস্টার জাকারিয়ুস, আমিই তো আমার সব ঘড়িগুলোর স্রষ্টা! রুপো, লোহা আর সোনার ওই সব ঘড়ির মধ্যে আমারই প্রাণ তো আমি টুকরো-টুকরো করে বিলিয়ে দিয়েছি–আমার আত্মাকেই দিয়েছি আমি ওদের। একটা করে ওই অভিশপ্ত ঘড়িগুলো থেমে যায় আর মনে হয় বুকের একটা অংশ ছিঁড়ে গেলো, যেন স্পন্দন থেমে যাবে কারণ আমারই হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন তো অমি ভরে দিয়েছি ওদের মধ্যে।
অদ্ভুত এই কথাগুলি বলতে-বলতে বৃদ্ধ বারেবারে তার বেঞ্চির দিকে তাকাচ্ছেন। খোলামেলা ঘড়ির টুকরো-টুকরো কলকজা ছড়িয়ে আছে। বেঞ্চিতে, সারাবার জন্য তিনিই খুলেছেন এই ঘড়িগুলি। স্প্রিংজড়ানো একটা ফঁপা নল তিনি তুলে নিলেন হাতে; তারপর শাঁখের পাকের মতো প্যাচানো ইস্পাতের ইস্কুপ খুললেন তিনি; স্থিতিস্থাপকতার নিয়ম অনুযায়ী স্পিংটা ছড়িয়ে পড়লো না, বরং কোনো ঘুমন্ত গোখরোর মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে হইলো স্তব্ধ ও নিঃসাড়; গ্রন্থিল মনে হলো এই স্প্রিংকে, মৃত ও শৃঙ্খলিত যেন–যেন কোনো অক্ষম ও অসক্ত বৃদ্ধ যার রক্ত অনেক দিন আগেই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছে। রোগা লম্বা আঙুলগুলি দিয়ে জাকারিয়ুস মিথ্যেই স্প্রিংটাকে ছাড়াতে চাইলেন আর দেয়ালে তাঁর এই ব্যর্থ ধস্তাধস্তির ছায়া অতিকায় হয়ে পড়তে লাগলো। কিন্তু ব্যর্থ, ব্যর্থ সব চেষ্টা। রোষে আর যন্ত্রণায় হঠাৎ তীব্র চীৎকার করে উঠে তিনি ক্ষুধিত ও টগবগে রোন নদীর বুকে স্পিংটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
জেরাঁদের পা দুটি যেন মেঝেয় হঠাৎ আটকে গেছে–নিশ্চল সে দাঁড়িয়ে রইলো রুদ্ধশ্বাসে। বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে চাইলো সে, কিন্তু পারলো না। মাথা ঘুরছে তার, অতিকায় সব দুঃস্বপ্ন যেন হানা দিচ্ছে তার মাথায়। হঠাৎ যেন। ছায়ার মধ্যে থেকে কে তার তার কানে ফিশফিশ করে বলে উঠলো, জেরাঁদ! তুমি! এখনো জেগে আছো? তোমার ঘরে যাও, লক্ষ্মীটি। কনে ঠাণ্ডা পড়ছে আজ।
ওবের! জেরাঁদ ফিশফিশ করে উঠলো, তুমি!
তোমার কষ্ট কি আমাকেও কষ্ট দেয় না?
হঠাৎ এই মৃদু কথাগুলি যেন জেরাঁদের বুকে রক্ত ফিরিয়ে দিলো। ওবেরের কাঁধে ভর দিয়ে সে বললে, বাবার নিশ্চয়ই ভয়ংকর কোনো অসুখ করেছে, ওবের। কেবল তুমিই তাকে সারাতে পারো, কারণ মেয়ের সান্ত্বনায় তার এই মানসিক বিশৃঙ্খলা মোটেই কমবে না। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই লোকের ঠাট্টা-বিদ্রুপের পাত্র হয়ে পড়েছেন তিনি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে-করতে, নষ্ট ঘড়িগুলি সারাতে-সারাতে, তুমিই শুধু তার চেতনা ফিরিতে আনতে পারো। ওবের, নিশ্চয়ই তার কথা সত্যি নয়? নিশ্চয়ই ওই ঘড়িগুলির মধ্যে নিজের প্রাণ তিনি পুরে দেননি?
ওবের কোনো কথা বললে না।
বাবার কাজ কি তবে ভগবানের চোখে দোষী? জেরাঁদ ভয়ে কেঁপে উঠলো। বললো ওবের, জানি না। কিন্তু তুমি তোমার ঘরে ফিরে যাও, লক্ষ্মীটি, একটু ঘুমুলে পরে আসা ফিরে পাবে।
আস্তে-আস্তে নিজের ঘরে ফিরে এলো জেরাঁদ, সকাল পর্যন্ত সেখানেই সে বসে রইলো একা ও অতন্দ্র, একবারও চোখের পাতা বুজলো না তার। আর মাস্টার জাকারিয়ুস সারাক্ষণ নিশ্চল ও স্তব্ধভাবে তাকিয়ে-তাকিয়ে দেখতে লাগলেন কেমন করে তার পায়ের তলায় চঞ্চল, ক্ষুব্ধ, রুষ্ট রোন নদী অবিশ্রাম বেগে দিগন্তের দিকে ছুটে যাচ্ছে।