২.১০ রমণী-হৃদয়

দশম পরিচ্ছেদ – রমণী-হৃদয় 

জয়বন্তের শিরায় শিরায় রক্ত খরপ্রবাহে ছুটিতেছিল, তিনি অতিকষ্টে আত্মসংযম করিতেছিলেন। তিনি বুঝিলেন, এত সাবধানতা সত্ত্বেও কেহ তাঁহার কোট হইতে নোটগুলি চুরি করিয়া তাহার পরিবর্তে খবরের কাগজ রাখিয়া দিয়াছিল। কখন কে এই সর্ব্বনাশ করিল, তিনি অনেক ভাবিয়াও কিছু স্থির করিতে পারিলেন না। 

হরকিষণ দাস ক্রোধে ফুলিতেছিলেন দেখিয়া, তাঁহার কন্যা হিঙ্গন বাঈ তাঁহার পার্শ্বে আসিয়া ধীরে ধীরে মৃদুস্বরে ডাকিল, “বাবা!” 

হরকিষণ দাস ক্রোধে গৰ্জ্জিয়া বলিলেন, “সরে দাঁড়া, ঘরের ভিতরে যা, এখানে তোর থাকিবার আবশ্যকতা নাই।” 

“বাবা!” 

“আমি বলিতেছি, এখান থেকে চলিয়া যা। তুই আমার রক্তে জন্মিয়াছিস, এই রকম তস্করের কাছে থাকিবার তুই উপযুক্ত নহিস, যা ঘরের ভিতরে যা।” 

জয়বন্ত আর নীরব থাকিতে পারিলেন না। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে কহিলেন, “আপনি কি মনে করিতেছেন, আমিই আপনার টাকা চুরি করিয়াছি?” 

জয়বন্তের কন্ঠস্বরে গভীরতর উদ্বেগ বেদনার আঘাত অনুভব করিয়া মুহূর্তের মধ্যে হিঙ্গন বাঈ-এর মুখ ম্লান হইয়া গেল। তাহার নীলোৎপলতুল্য চক্ষু দুটি জলভারে অবনত হইয়া পড়িল। 

হরকিষণ দাস দ্বিগুণ রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “চোর—জুয়াচোর—বদমাইস –”

“আপনি মনে করিতে—” 

“চুপ্ চোর।” 

“আমি আপনার—”

“চোর–চোর।” 

জয়বন্ত আর কোন কথা কহিলেন না, ফিরিলেন। তিনি দরজা পর্যন্ত গেলে হিঙ্গন আত্মহারা হইয়া, ছুটিয়া গিয়া তাঁহার হাত ধরিল। 

জয়বন্ত দাঁড়াইলেন, তাঁহার চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল, তিনি রুদ্ধকন্ঠে বলিলেন, “হিঙ্গন, তুমিও কি আমার কথা অবিশ্বাস করিতেছ?” 

হিঙ্গন বাঈ তাহার স্নিগ্ধকরুণ চক্ষু দুইটি জয়বন্তের মুখের উপরে স্থির রাখিয়া বিচলিতস্বরে কহিল, “না–না–না, আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করি না; নিশ্চয়ই কেহ টাকা চুরি করিয়াছে।” 

“আমি জানি, তুমি অবিশ্বাস করিবে না।” 

“না না—নিশ্চয়ই কেহ টাকা চুরি করিয়াছে।” 

হরকিষণ দাস বলিয়া উঠিলেন, “আমার নিজের মেয়ে আমার কথা শোনে না?” 

হিঙ্গল আবার ডাকিল, “বাবা”। 

হরকিষণ দাস বলিলেন, “ঘরের ভিতরে যা, শীঘ্র যা, এই জুয়াচোরকে আর প্রশ্রয় দিতে আছে।” হিঙ্গন বাঈ মুখ ঈষৎ লাল করিয়া কহিল, “বাবা, আপনি অন্যায় বলিতেছেন।” হরক্যিণ দাস অধীর হইয়া কহিলেন, “আমার নিজের মেয়ে আমার অন্যায় দেখে, আমার নিজের মেয়ের মুখে এই কথা!” ক্রোধে হরকিক্ষণ দাস আর কোন কথা কহিতে পারিলেন না। 

জয়বত্ত হিঙ্গনকে বলিলেন, “তোমার বাবা অনর্থক রাগ করিতেছেন, আমি এখনও চেষ্টা করিলে সে নোট পাইব। সে নোট লইয়া আসিব, তখন তোমায় আমি পাইব—এই জুয়াচোর তখন সাধু হইবে। এখন আর কোন কথা বলিব না—হিঙ্গন, আমি চলিলাম।” 

হিঙ্গন কথা কহিল না, তাহার দুই চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া গেল। সে অবনতমস্তকে দণ্ডায়মান রহিল।

জয়বন্ত বলিলেন, “নোট বোম্বাই সহরে চুরি যায় নাই, আমি এখন বুঝিয়াছি, নোট জাহাজেই খোয়া গিয়াছে; সুতরাং যে চুরি করিয়াছে, সে জাহাজেই আসিয়াছে, এখনও পোর-বন্দরে আছে, ফিরিয়া যাইতে পারে নাই। আমি যেমন করিয়া হয়, তাহাকে ধরিবই ধরিব। হিঙ্গন তুমি আমার কথা বিশ্বাস কর?” 

“আমি কখনও তোমাকে অবিশ্বাস করি নাই।” 

“তাহা হইলেই যথেষ্ট হইল। আজ হউক, আর কাল হউক, আমি ফিরিয়া আসিব, তখন তোমার বাবা বুঝিবেন যে, তিনি আমাকে অন্যায় সন্দেহ করিয়াছেন, আমায় অন্যায় তিরস্কার করিয়াছেন। 

হরকিষণ দাস কি বলিতে যাইতেছিলেন। এবার জয়বন্ত তাঁহাকে কিছু বলিতে দিলেন না, তিনি আঘাতের উপর আঘাত পাইয়া ক্ৰমশঃই উত্তেজিত হইয়া উঠিতেছিলেন; আর সহ্য করিতে না পারিয়া প্রতিবন্ধক দিয়া কহিলেন, “আপনি যথেষ্ট বলিয়াছেন, আর কিছু বলিবার আবশ্যকতা নাই। এ জীবনে এরূপ কটু কথা আমি আর কখনও শুনি নাই। তাহার জন্য আমি আপনার উপরে কিছুমাত্র রাগত হই নাই; বরং আমার নিজের আহাম্মুখীর জন্য আমি দুঃখিত। আমি জানি, যাহা ঘটিয়াছে, তাহাতে আমার উপরে সন্দেহ করা বা এরূপ রাগ প্রকাশ করা অন্যায় নহে। আমার উপরে এখন সন্দেহ হইতেছে, কিন্তু যাহাতে এ সন্দেহ দূর হয়, যাহাতে আপনার টাকা, আপনার হাতে আনিয়া দিতে পারি, আমি তাহা করিবই করিব – তবে আমার নাম জয়বন্ত। তাহার পর ফিরিয়া আসিয়া আপনার সঙ্গে দেখা করিব। যদি না পারি, আর আমি ফিরিব না — এ মুখ এ সংসারে আর কাহাকেও দেখাইব না — ঈশ্বর আমার সহায় হউন – আমার জীবনে এমন ভয়ানক দিন আর কখনও আসে নাই।” 

এই বলিয়া কোট দুটা আবার গায়ে চড়াইয়া, ব্যাগটা তুলিয়া লইয়া জয়বন্ত বিষাদবিদীর্ণ হৃদয়ে বাড়ীর বাহির হইয়া গেলেন। 

তাঁহাকে সেরূপভাবে চলিয়া যাইতে দেখিয়া হিঙ্গনের প্রাণে কি কষ্ট হইল তাহা হিঙ্গনই জানে। হিঙ্গন তাঁহার অনুসরণ করিল। বাটীর বাহিরে আসিয়া দেখে এক বৃক্ষতলে একখণ্ড সুবৃহৎ প্রস্তরের উপরে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে জয়বন্ত বসিয়াছেন। তাঁহার মুখমণ্ডল ভীষণভাব ধারণ করিয়াছে, হিঙ্গন বাঈ পশ্চাদ্দিক হইতে তাঁহার সমীপবর্তিনী হইল। দুই হাতে তাঁহার কন্ঠবেষ্টন করিয়া স্নিগ্ধকরুণস্বরে বলিল, “বল জয়বন্ত, সত্যই কি তুমি আমাদের ত্যাগ করিয়া চলিলে।” 

জয়বন্ত নিরুত্তর। 

হিঙ্গন জয়বন্তকে নীরব দেখিয়া আকুল হইয়া উঠিল। সে উচ্ছ্বসিত রোদনের মধ্যে রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “বাবা অত্যন্ত রাগী বল আমাকে ক্ষমা করিলে; আমি বাবাকে বুঝাইব। যখন সে নোট চুরি গিয়াছে, তখন তাহা আর ফিরিয়া পাইবার সম্ভাবনা খুবই কম ― বল, তুমি নোট না পাইলেও এখানে ফিরিবে।” 

এবার জয়বন্ত বলিলেন, “না হিঙ্গন, নোট না পাইলে আর ফিরিব না — এই পৰ্য্যন্ত — তবে আমি নিশ্চয় বলিতে পারি, সে নোট আমি ঠিকই উদ্ধার করিয়া আনিব, আমার মনে কিছুমাত্র দুরভিসন্ধি নাই –ঈশ্বর অবশ্যই আমার সহায় হইবেন—হিঙ্গন, তুমি বাড়ীর ভিতের যাও— আবার শীঘ্র দেখা হইবে। আমি এখন উঠিলাম।” 

এই বলিয়া জয়বন্ত উঠিলেন; পথের দিকে চলিয়া গেলেন; একবারও পশ্চাদ্দিকে ফিরিয়া চাহিলেন না—চিত্রিত আলেখ্যবৎ হিঙ্গন বাঈ যতক্ষণ জয়বন্তকে দেখা গেল, ততক্ষণ সেইদিকে অশ্রুপ্লাবিতনেত্রে চাহিয়া রহিল। অশ্রুজলে তাহার দৃষ্টি রোধ করিতে লাগিল। চক্ষু মুছিয়া হিঙ্গন আবার চাহিল — জয়বন্ত নাই—অদৃশ্য হইয়াছেন। 

জয়বন্ত যে গাড়ীতে আসিয়াছিলেন, তাহা তখনও বাহিরের পথে দাঁড়াইয়াছিল। তিনি সেই গাড়ীতে উঠিয়া তৎক্ষণাৎ আবার পোর-বন্দরে রওনা হইলেন। 

একাদশ পরিচ্ছেদ – আবার ছদ্মবেশের প্রয়োজন 

সেদিন যখন পুলিস আসিয়া জয়বন্তকে পড়োবাড়ীর গহ্বর হইতে উদ্ধার করিল, তখন মেটা প্ৰথমে উদ্ধশ্বাসে ছুটিয়া পলাইয়াছিল; কিন্তু বাড়ীর বাহিরে আসিয়াই সে দাঁড়াইল। কি ভাবিল, তৎপরে চোরের ন্যায় সংগোপনে আবার সেই বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করিল। 

সেই বাড়ীর সমস্ত গুপ্তপথ তাহার জানা ছিল; সে পা টিপিয়া টিপিয়া, যেখানে পুলিসের লোক দড়ী ফেলিয়া দিয়া জয়বন্তকে টানিয়া তুলিতেছিলেন, তাহারই নিকটে এক জায়গায় অন্ধকারে লুকাইয়া রহিল। 

জয়বন্ত পুলিসকে যাহা বলিলেন, তাহাও সে শুনিল। তখন সে বুঝিল যে, জয়বন্ত তাহাকে একদম বোকা বানাইয়াছে। সে যথার্থ পুলিসের লোক হইলে কখনই পুলিসের লোকের সম্মুখে এরূপ ভাবে কথা কহিত না, নিশ্চয়ই নিজের পরিচয় দিত, তাহার সম্বন্ধেও সকল কথা বলিত। এখন মেটা বুঝিল যে, জয়বন্ত আদৌ পুলিসের লোক নহেন; মিথ্যা সে ভয় পাইয়া পলাইয়াছে। জয়বন্ত তাহারই মত একজন জুয়াচোর, কোন গতিকে এই লাখ টাকার সন্ধান পাইয়া তাহা হস্তগত করিবার চেষ্টায় রহিয়াছে, হয়ত টাকাগুলি হস্তগত করিয়াছে। নিজে ভয় পাইয়া পঞ্চম বর্ষীয় শিশুর মত তাহাকে সকল কথা বলিয়া ফেলিয়াছে, নতুবা জয়বন্ত খুনের কথা বা কোন কথাই জানিতে পারিত না। 

সেই রাত্রেই মেটা বোম্বাই ফিরিল। সে জানিত, পর দিন কখনই জয়বন্ত বোম্বে হইতে পলাইতে পারিবে না। তাঁহার বাসার ঠিকানা সে জানিত। প্রথম দিন এই বাসার ঠিকানা দিয়া জয়বন্ত তাহার নিকটে চাকরী প্রার্থনা করিয়াছিলেন। 

সেই রাত্রে মেটা নিজের বাসায় ফিরিয়া আসিল। অতি কষ্টে রাত্রি কাটাইয়া ভোর হইতে না হইতে ফোর্টে চলিল, তথায় একটা দোকান ছিল, সেই দোকানে থিয়েটরের নানাবিধ সাজ বিক্রয় হইত। ইহারা থিয়েটারের অভিনেতা অভিনেত্রীগণকে ননাবিধ সাজে সাজাইয়া দিয়া থাকে ও পোষাক ভাড়াও দেয়। 

দোকান খুলিবামাত্র মেটা দোকানে গিয়া দোকানদারের সঙ্গে দেখা করিয়া বলিল, “আমি যাহা চাহি, আপনি শুনিয়া বোধ হয়, আশ্চৰ্য্যান্বিত হইবেন। হয় ত আপনাদের দ্বারাও আমার কাজ হইবে না।” 

দোকানদার বলিল, “কি আপনার আবশ্যক?” 

“আমি এমনই ছদ্মবেশ ধরিতে চাহি যে, আমার নিজের ছেলে আমাকে যেন চিনিতে না পারে।”

“আপনার ছেলে?” 

“হাঁ, বলিতে কষ্ট হয়, আমার ছেলে আমার যথা-সর্বস্ব চুরি করিয়া লইয়া পলাইয়াছে। আমি পুলিসে খবর দিতে পারিতেছি না, তাহা হইলে সে জেলে যায়, পিতা হইয়া ছেলেকে কিরূপে জেলে দিব? সেইজন্য ছদ্মবেশে তাহার অনুসন্ধান করিতে চাহি। আমাকে চিনিতে পারিলে সে নিরুদ্দেশ হইবে।” 

“তাহা হইলে আপনি কি করিতে চান?” 

“আপনারা আমার চেহারার এমন পরিবর্ত্তন করিয়া দিন যে, অন্ততঃ তাহা এক সপ্তাহ থাকে। এক সপ্তাহের কমে আমি তাহাকে খুঁজিয়া পাইব না।”

“এক সপ্তাহ?” 

“আপনি কি মনে করেন, এক সপ্তাহ কোন ছদ্মবেশ থাকিবে না? এই দেখুন, আমার সব দাঁত বাঁধান, এটা খুলিয়া লইলে এখনই আপনা হইতেই চেহারার অনেকটা পরিবর্তন হয়”, বলিয়া মেটা মুখ হইতে কৃত্রিম দন্তপংক্তি দুইটি খুলিয়া লইল। 

দোকানদার বলিল, “হাঁ, ইহাতে মুখের অনেক পরিবর্তন হয় মুখটা অনেক গুটাইয়া গিয়াছে, দেখিতেছি।” 

“তাহার পর চুল—” 

“তাহা একেবারে সাদা করিয়া দিতে পারি; কিন্তু সে সাদা আর যাইবে না, পরে কলপ লাগাইতে হইবে।” 

“তাহাতে কোন ক্ষতি নাই, প্রস্তুত আছি।” 

“শরীরের রংটাও অনেক কাল করিয়া দিতে পারি।” 

“সে রং কি পরে উঠিবে?” 

“হাঁ, দিন কত ভাল করিয়া সাবান লাগাইলে ক্রমে উঠিয়া যাইবে।” 

“ভাল, তাহার পর আর কি?” 

“একটু কষ্ট হইবে–” 

“কি কষ্ট, আমি ছেলের জন্য সব কষ্ট সহ্য করিতেই প্রস্তুত আছি।” 

“এই নাকে একটা শোলা গুঁজিয়া দিলে নাকটা মোটা ও চেপ্টা দেখিতে হইবে।” 

“খুব ভাল।” 

“ইহাতে কথার সুরও একটু বদল হইবে। বিশেষতঃ দাঁত না থাকায় কথা ও স্বরেরও পরিবর্তন হইবে।” 

“খুব ভাল।” 

“তাহার পর কোটের নীচে একটা ছোট বালিশ দিয়া কুঁজো হইতেও অনায়াসে পারিবেন।” 

“ইহা আরও ভাল।” 

“ইহার উপরে যদি আপনি একটা খোঁড়া লোকের একজোড়া বাঁকা জুতা পায়ে দেন, তাহা হইলে আপনার ছেলেও আপনাকে চিনিতে পারিবে না। বাঁকা জুতার জন্য আপনার পা-ও আপনা হইতে ঠিক খোঁড়া লোকের মত পড়িবে।” 

“আপনি এখনই আমাকে কি এরূপ করিয়া দিতে পারেন?” 

“এখনই?” 

দরদস্তুর ঠিক হইল। মেটা টাকা দিল, দোকানী তাহাকে ভিতরের ঘরে লইয়া গেল। 

একঘন্টা পরে মেটা যখন সেই দোকান হইতে বাহির হইল, তখন তাহার চেহারা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে, তাহাকে চেনা কাহারই সাধ্যায়ত্ত ছিল না। 

মেটা তথা হইতে বরাবর যে বাড়ীতে জয়বন্ত বাসা লইয়াছিলেন, তথায় আসিল, সেটা ভাড়াটে বাড়ী, বিদেশিগণ আসিয়া এক-একটি ঘর ভাড়া লইয়া বাস করে। মেটার সৌভাগ্যক্রমে জয়বত্তের পার্শ্বের ঘরখানিই খালি ছিল। মেটা তাহা ভাড়া লইল। 

বোম্বের অধিকাংশ বাড়ীর ঘরের ভিতরের প্রাচীর কাষ্ঠনির্ম্মিত, এ বাড়ীরও তাহাই ছিল। পার্শ্ববর্তী প্রকোষ্ঠের সকল বিষয় দেখিবার জন্য মেটা একখানি ছুরি পকেট হইতে বাহির করিয়া সেই কাঠের প্রাচীরে একটা ক্ষুদ্র ছিদ্র করিল। তখন জয়বন্ত বাসায় ছিলেন না। তিনি তখন দন্ত-চিকিৎসক পাটেল সাহেবের সঙ্গে দেখা করিতে গিয়াছিলেন। 

মেটা এখন অনেকটা আশ্বস্ত হইল। সে মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছিল যে, যতক্ষণ না নোটগুলি হস্তগত হয়, ততক্ষণ সে তাঁহার উপরে নজর রাখিবে; প্রয়োজন হয়, তাঁহাকে খুন করিবে। এই নোটের জন্য সে একবার একজনকে অবলীলাক্রমে খুন করিয়াছিল, আবার যে একজনকে খুন করিবে, তাহাতে আশ্চৰ্য্য কি! সুবিধা পাইলেই সে যে এই কাজ করিবে, মনে মনে তাহা স্থির করিয়া, তাহার সমস্ত আয়োজন করিয়া অস্ত্রাদি সঙ্গে রাখিয়াছিল। 

জয়বন্তের গৃহের দরজায় কেবল শিকল দেওয়া আছে, চাবি দেওয়া নাই, ইহা দেখিয়া মেটা বুঝিল যে, নোট যদি জয়বন্ত পাইয়া থাকেন, তবে সঙ্গে সঙ্গে রাখিয়াছেন, এ ঘরে রাখিয়া যান নাই। লাখ টাকার নোট কেহ এরূপভাবে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলিয়া রাখিয়া দেয় না। 

এই সময়ে পাশ্ববর্তী গৃহের নিকট কাহার পদশব্দ হইল। মেটা সত্বর উঠিয়া গিয়া প্রাচীরের ছিদ্রে চক্ষু লাগাইল। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – লক্ষ্য—লক্ষ টাকা 

জয়বন্ত গৃহমধ্যে আসিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন। তৎপরে পকেট হইতে একটা খাম বাহির করিয়া তাহার ভিতর হইতে এক-এক করিয়া একশতখানি নোট সম্মুখে রাখিলেন। নোটগুলি দেখিয়া মেটা উন্মত্তপ্রায় হইল। এই সেই লক্ষ টাকার নোট! 

মেটা ভাবিল, তাহা হইলে এই দুরাত্মা যথার্থই ফাঁকী দিয়া নোটগুলি নিজে হস্তগত করিয়াছে। ভয় পাইয়া তাঁহার নিকটে ডাক্তারকে জাহাজে খুন করিবার কথা স্বীকার করিয়া কি আহাম্মুখীই হইয়াছে। নতুবা এখন অনায়াসে তাঁহার নিকট হইতে নোটগুলি সংগ্রহ করা যাইতে পারিত। এখন তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি খুনী বলিয়া তাহাকে ধরাইয়া দিবেন, সুতরাং সে উপায় আর নাই। মেটা মহাবিভ্রাটে পড়িল। 

মেটা দেখিল, জয়বন্ত নোটগুলিকে একখানি সাদা কাগজে বেশ করিয়া মুড়িয়া একটি বাণ্ডিল করিলেন। কিরূপ আকারের কত বড় বাণ্ডিল মেটা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহা দেখিয়া লইল। তাহার পর সে দেখিল যে, জয়বন্ত কোটের অস্তরের কাপড় কাটিয়া ফেলিয়া নোটের বাণ্ডিলটি কোটের কাপড়ের নীচে রাখিলেন, রাখিয়া সূচ ও সূতা লইয়া তাহা সেলাই করিয়া ফেলিলেন। জয়বন্ত কোটের কাপড়ের নিম্নে নোটগুলি রাখিয়াই নিশ্চিন্ত হইলেন না; তিনি সেই কোটটি পরিলেন। তাহার উপরে আর একটা কোট পরিয়া বোতাম আঁটিয়া দিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি বাহির হইয়া গেলেন; মেটা কিন্তু তাহার ঘর হইতে নড়িল না। ঘন্টাখানেক পরে জয়বন্তজী আবার ফিরিয়া আসিলেন, অমনি মেটা আবার প্রাচীরে রন্ধ্রপথে দৃষ্টিসংযোগ করিল। 

এবার মেটা দেখিল যে, জয়বন্ত জাহাজের একখানা টিকিট লইয়া আসিয়াছেন। মেটা যথাসাধ্য তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সেই টিকিটখানা পড়িবার চেষ্টা পাইতে লাগিল। এবারও সৌভাগ্য তাহার সহায় হইল। টিকিটখানা হাতে করিয়া জয়বন্ত কি লইবার জন্য মেটা যে প্রাচীরে চক্ষু লাগাইয়া বসিয়াছিল, সেইদিকে আসিলেন। সেই অবসরে মেটা টিকিটে জাহাজের নামটা পড়িয়া লইল। আরও দেখিল, জাহাজ কাল প্রাতেই ছাড়িয়া যাইবে। 

এখন কি করা কর্ত্তব্য, মেটা তাহাই ভাবিতে লাগিল। রাত্রে নিশ্চয়ই জয়বন্ত ভিতর হইতে দরজা বন্ধ করিয়া শয়ন করিবেন, তাঁহার গৃহে প্রবেশ করিবার কোন সম্ভাবনা নাই—বিশেষতঃ মেটা দেখিল, জয়বন্তের নিকটে পিস্তল রহিয়াছে; খুব সম্ভব, টাকার জন্য তিনি আজ রাত্রে আদৌ নিদ্রিত হইবেন না। যতক্ষণ তিনি জাহাজে ‘না উঠিতেছেন, ততক্ষণ তিনি নিরাপদ নহেন, নিশ্চয়ই মনে মনে জয়বন্ত ইহাই ভাবিতেছেন, সুতরাং এখানে আজ রাত্রের মধ্যে কোনমতে নোটগুলি হস্তগত করিবার উপায় নাই। 

মেটা ঘর হইতে বাহির হইল। জয়বত্তের ঘরের দরজা তখন খোলা ছিল, জয়বন্ত তাঁহার জিনিষপত্র গুছাইতেছিলেন, মেটার পদশব্দ শুনিয়া একবার তাহার দিকে চাহিলেন; মেটাও তাহাই চাহে, জয়বন্ত তাহাকে কোনরূপ চিনিতে পারেন কি না, তাহাই দেখা তাহার উদ্দেশ্য। জয়বন্ত তাহাকে চিনিতে পারিলেন না, একবারমাত্র তাহার দিকে চাহিয়া স্বকার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন। 

মেটা তখন সত্বর সেই জাহাজের আফিসে গেল। তাহার ইচ্ছা, জয়বন্ত যে কেবিনের টিকিট লইয়াছেন সেই কেবিনের অন্য টিকিটখানি নিজে লইবে; কিন্তু তাহার সে আশা নিষ্ফল হইল। শুনিল, সে কেবিনে অন্য কাহারও যাইবার স্থান নাই। 

মেটা দুঃখিত হইল; কিন্তু উপায় নাই। আগেকার মত এবার এক কেবিনে যাইতে পারিলে জয়বন্তের অবস্থা ডাক্তারের ন্যায় করিতে তার ক্ষণবিলম্ব হইত না; কিন্তু উপায় নাই। তাহাকে বাধ্য হইয়া অন্য কেবিনে যাইতে হইল; যাহা হউক, জাহাজেই একটা উপায় করিয়া নোটগুলি হস্তগত করিতেই হইবে। মনে মনে ইতোমধ্যেই মেটা একটা মতলব স্থির করিয়া ফেলিল। 

সে জাহাজের আফিস হইতে বাহির হইয়া এক বাক্স ভাল চুরুট কিনিল, তৎপরে এক ডাক্তারখানায় গিয়া খানিকটা মরফিয়ার আরকও ক্রয় করিল। এই সকল সংগ্রহ করিয়া সে বাসায় ফিরিয়া আসিল; আসিয়া দেখিল, তখনও জয়বন্ত তাঁহার দ্রব্যাদি বাঁধিতেছেন ও বাড়ীওয়ালার সহিত হিসাব মিটাইতেছেন। 

সে রাত্রে মেটা কিছুই করিবার সুবিধা পাইল না। সে যাহা ভাবিয়াছিল, তাহাই হইল। জয়বন্ত খুব ভাল করিয়া সাবধানে দরজা বন্ধ করিয়া দিলেন; কিন্তু তিনি আলো নিবাইলেন না, বিছানায় বসিয়া একখানা পুস্তক পাঠ করিতে লাগিলেন। মেটা বুঝিল, জয়বন্ত আজ সমস্ত রাত্রি জাগিয়া থাকাই স্থির করিয়াছেন। আজ রাত্রে কোন সুবিধাই হইবে না। 

মেটা রাত্রের মধ্যে দুই-তিনবার উঠিয়া ছিদ্র দিয়া দেখিল, জয়বন্ত সেই একইভাবে বসিয়া বই পড়িতেছেন। রাত্রে আর কিছু হইবে না ভাবিয়া, মেটা শয়ন করিয়া নিদ্রিত হইল। 

অতি প্রাতে মেটা উঠিল। জয়বন্ত গাড়ী ডাকিতে বলিতেছেন শুনিয়া, সে সত্বর বাড়ী হইতে বাহির হইয়া গেল। পথে আসিয়া একখানি গাড়ী ভাড়া করিয়া মেটা সত্বর জাহাজে গিয়া উঠিল। 

জাহাজে তাহার উপস্থিত হইবার পর প্রায় আধঘন্টা পরে জয়বন্ত জাহাজে আসিলেন। মেটার পরিবর্তে তিনি একজন কুব্জখঞ্জ বৃদ্ধ মারাঠী ভদ্রলোককে দেখিলেন। 

রাত্রে মেটা জাহাজের ডেকের উপরে তাঁহার সহিত কথা আরম্ভ করিল; ইহাতেও জয়বন্ত তাহাকে চিনিতে পারিলেন না। মেটা তাঁহাকে একটা চুরুট দিল। 

মেটা পূর্ব্বেই মরফিয়া আরকে চুরুট ভিজাইয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল, চুরুটটা দুই-চারিবার টানিতে-না-টানিতে জয়বন্তের দেহ অবসন্ন হইয়া আসিল, তাঁহার চক্ষু বুজিয়া আসিল, তাঁহার হাত হইতে চুরুট সগলিত হইয়া পড়িয়া গেল। 

মেটা চুরুটটি কুড়াইয়া লইয়া সমুদ্রে ছুড়িয়া ফেলিয়া দিল, তৎপরে জয়বত্তের হাতধরিয়া তাহাকে ধীরে ধীরে তুলিল। জয়বন্ত অৰ্দ্ধনিদ্রিত অবস্থায় মেটার সঙ্গে সঙ্গে চলিলেন। মেটা তাঁহাকে তাঁহার কেবিনে আনিয়া শোয়াইয়া দিল। জয়বন্ত শয়ন করিবামাত্র সংজ্ঞাশূন্য হইলেন। 

তখন মেটা সত্বর উঠিয়া কেবিনের দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। সংজ্ঞাশূন্য জয়বন্তের কোটের বোতাম খুলিয়া ফেলিল; তৎপরে নিজের পকেট হইতে কাঁচি, সূচ, সূতা বাহির করিল, তাহার ব্যস্ত হইবার বা তাড়াতাড়ি করিবার কোন প্রয়োজন ছিল না। সে জানিত, সমস্ত রাত্রের মধ্যে জয়বন্তের চেতনা হইবে না। 

সে কোটের কাপড় কাটিয়া নোটগুলি বাহির করিয়া লইল। সে আগে হইতেই খবরের কাগজ দিয়া একটি বাণ্ডিল করিয়াছিল, কোটের নীচে নোট যেরূপ ছিল, সেইরূপভাবে সেই বাণ্ডিলটি রাখিয়া আবার কোটের কাপড় সেলাই করিয়া দিল। তখন সে জয়বন্তকে সেই অবস্থায় রাখিয়া, কোনদিকে কেহ নাই দেখিয়া, নিজের কেবিনে আসিয়া শয়ন করিল। আজ তাহার মত সুখী কে? সে যে টাকার জন্য এত ভয়াবহ কাজ করিয়াছিল, এতদিনে সেই টাকা তাহার হস্তগত হইয়াছে। আর তাহাকে পায় কে? সে আজ হইতে বড়লোক। হরকিষণ দাস নাই, আর কেহ এ টাকার জন্য গোল করিবে না। এক জয়বন্ত, সে নিজেও টাকা চুরি করিতেছিল, চোরের উপর বাটপাড়ী হইয়াছে, কে চুরি করিয়াছে, জানিতে পারিবে না। আর জানিলেই বা কি? সে তাহার কি করিবে? টাকা হাতে আসিলে কি না হয়? 

সে নিজের কেবিনে আসিয়া নিজের দুই জুতার সুকতলা তুলিয়া তাহার নিম্নে নোটগুলি রাখিয়া দিল। এখানে নোট আছে, কেহই সন্দেহ করিতে পারিবে না। 

পর দিবস প্রাতে জয়বন্ত কেবিনের দরজা খেলা রহিয়াছে দেখিয়া, বিস্মিত হইলেন বটে, কিন্তু কোটের নীচে নোটগুলি ঠিক সেই অবস্থায় আছে দেখিয়া তিনি আশ্বস্ত হইতে পারিলেন। তাঁহার নোট যে চুরি গিয়াছে, সে বিষয়ে তিনি বিন্দুমাত্র সন্দেহ করিলেন না। 

তিনি হিঙ্গনের সঙ্গে মিলিত হইবার জন্য এত ব্যাকুল হইয়াছিলেন যে, তিনি তাঁহার সহযাত্রী কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন না। জাহাজ তীরে লাগিবামাত্র লম্ফ দিয়া নামিলেন, হিঙ্গনের সহিত দেখা করিতে ছুটিলেন। 

তাহার পর যাহা হইয়াছে, বলা হইয়াছে। 

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ – আক্রমণ 

বিষণ্ণ মুখে হতাশাচিত্রে জয়বন্ত পোর-বন্দরে ফিরিলেন। আকাশ হইতে নিমেষমধ্যে তিনি যেন গভীর সাগরগর্ভে নিমগ্ন হইলেন। কত আশা, কত আনন্দ, কত উৎসাহ মুহূর্ত্তের মধ্যে সমস্তই বিলীন হইয়া গেল। আর কি সে নোট তিনি ফিরিয়া পাইবেন? 

হিঙ্গনের সম্মুখে তিনি বলিয়াছিলেন, যেরূপেই হউক, নোট বাহির করিবেনই করিবেন, নোট আনিয়া হরকিষণ দাসকে দিবেন; কিন্তু এখন স্থির হইয়া ভাবিতে সময় পাইয়া বুঝিলেন যে, এ কাজ সহজ নহে। তিনি সন্দেহ করিতেছিলেন যে, মেটা নোট চুরি করিয়াছে; কিন্তু মেটা জাহাজে আসে নাই। 

তিনি নোট হস্তগত হওয়া অবধি সেদিন সমস্ত রাত্রি জাগিয়াছিলেন, তিনি কেবল জাহাজে একবার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন; এমন ঘুম তাঁহার কেন হইয়াছিল, তাহা তিনি বুঝিতে পারেন নাই, এখনও বুঝিতে পারিলেন না, তবে এইটুকু বুঝিলেন, যদি চুরি হইয়া থাকে—চুরি ত নিশ্চয়ই হইয়াছে, তাহা হইলে যখন তিনি জাহাজে দরজা খোলা রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন, সেই সময়েই চুরি হইয়াছে। তবে কে চুরি করিল? তিনি অনেক ভাবিয়াও এ বিষয়ে কিছুই স্থির করিতে পারিলেন না। জয়বন্তের মস্তিষ্ক এখনও বিকৃত—পৃথিবীর সমুদয়ই এখনও তাঁহার কাছে গোলমাল বিশৃঙ্খল। 

কিন্তু তাঁহার সৌভাগ্যক্রমেই হউক বা হিঙ্গনের সৌভাগ্যক্রমেই হউক ভাগ্যলক্ষ্মী তাঁহার প্রতি সুপ্রসন্ন হইলেন। তিনি পোর-বন্দরে উপস্থিত হইয়া তাঁহার পূর্ব্বপরিচিত একটি বন্ধুর বাড়ী যাইতেছিলেন। তথায় কয়েকদিনের জন্য বাস করিবেন, মনে মনে স্থির করিয়াছিলেন। 

সহসা তাঁহার দৃষ্টি একটি লোকের উপরে পড়িল। লোকটি একজন ধনাঢ্য বেনিয়ার গদী হইতে বাহির হইয়া একখানা গাড়ীতে আসিয়া উঠিল। তাহাকে দেখিয়া জয়বন্ত স্তম্ভিত হইয়া দাঁড়াইলেন। তিনি কি করিবেন, কিছু স্থির করিবার পূর্বেই সেই লোকটি গাড়ীসহ দৃষ্টির বহির্ভূত হইয়া গেল। 

জয়বন্ত দেখিলেন, জাহাজে যে তাঁহাকে চুরুট দিয়াছিল, যাহাকে কুঁজো খোঁড়া বৃদ্ধ মনে করিয়াছিলেন, এ সেই লোক; কিন্তু এখন সে ততটা কুঁজো বা খোঁড়া নহে। তখনই তাঁহার মনে হইল যে, এ আর কেহ নহে, মেটা জাহাজে ছদ্মবেশ ধরিয়া তাঁহার চোখে ধুলি দিয়া তাঁহার পকেট হইতে নোট চুরি করিয়াছে। 

হায় হায়, তাহাকে হাতে পাইয়াও ছাড়িয়া দিলাম। অনায়াসে তাহাকে ধরিতে পারিতাম। যাহা হউক, উপায় নাই, যাহা হইয়া গিয়াছে, তাহার জন্য অনুতাপ করিয়া ফল নাই। এখনও সে পোর-বন্দরে আছে, ইহাই আমার পক্ষে যথেষ্ট আজ কখনই বোম্বাই রওনা হইতে পারিবে না, যেমন করিয়া পারি, তাহাকে ধরিতেই হইবে। 

এখানে নিশ্চয়ই ছদ্মবেশী মেটা একখানা নোট ভাঙাইবার জন্য আসিয়াছিল। দেখা যাক, এই লোকের নিকটে কোন সন্ধান পাওয়া যায় কি না। এইরূপ ভাবিয়া জয়বস্তু সেই গদীতে প্রবেশ করিলেন। সেখানে এক ব্যক্তিকে তিনি জিজ্ঞাসিলেন, “আপনিই মালিক?”

“হাঁ, কি প্রয়োজন?” 

“আমি বোম্বাই সহরের একজন ডিটেকটিভ-কৰ্ম্মচারী।” 

“আমার কাছে কি প্রয়োজন?” 

“আমি একটি লোকের অনুসরণে নিযুক্ত আছি, চোরাই নোট তাহার নিকটে আছে, হাজার টাকার এক-একখানা। আপনার কাছে একখানা ভাঙাইয়াছে বুঝি?” 

“না, ভাঙাইতে আসিয়াছিল বটে, আমি বিশেষ সন্ধান না লইয়া বেশি টাকার নোট বদলাই করি না।” জয়বন্ত পকেট হইতে নোট-বই বাহির করিয়া বলিলেন, “এই দেখুন দেখি, সে নোটের নম্বর ইহাতে আছে কি না?” 

মালিক একটা নম্বর দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “এইখানা।” 

“কি নাম বলিয়াছে?” 

“বাইরামজী মেটা—বোম্বাই-এর উকীল।” 

“নোট কি ফেরৎ লইয়া গিয়াছে?” 

“না, আমার কাছে জমা রাখিয়া গিয়াছে। তাহার খরচে বোম্বাইএ টেলিগ্রাফ করিতে বলিয়াছে, সেখানকার ব্যাঙ্ক হইতে উত্তর আসিলেই তাহাকে টাকা দিব।”

“এমন কাজও করিবেন না, এ সব চোরাই নোট, আমার কাছে সংবাদ না পাইয়া কিছুই করিবেন না। আমরা এখনই তাহাকে গ্রেপ্তার করিব। এখানে সে কোথায় আছে, কোন ঠিকানা বলিয়াছে?” 

“হাঁ, ধৰ্ম্মশালায় আছে।” 

“এখন এই পৰ্য্যন্ত।” 

এই বলিয়া জয়বন্ত তাঁহার গদী হইতে বাহির হইয়া একখানা গাড়ী ভাড়া করিলেন; কোচম্যানকে বলিলেন, “তীরের মত চালাইয়া যাও, বক্‌শিস দিয়া খুসী করিব।” 

গাড়ী তীরবেগে ছুটিল। তিনি ধৰ্ম্মশালায় আসিয়া অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন, মেটা এখনও ফিরিয়া আসে নাই। সে কোন ঘরে আছে জানিয়া, জয়বন্ত পার্শ্ববর্ত্তী একটা ঘরে বাসা লইলেন। 

তখন তাঁহার মনের অবস্থা বর্ণনাতীত। তাঁহার হৃদয় এত সবলে স্পন্দিত হইতেছিল যে, যেন তাঁহার বুক ভাঙিয়া যাইবে। আজ কি কার্য্যোদ্ধার করিতে পারিবেন? নোটগুলি কি আবার তাঁহার হাতে ফিরিয়া আসিবে? তিনি কি সেই নোট লইয়া ফিরিতে পারিবেন—ফিরিয়া হিঙ্গনকে দেখিতে পাইবেন? 

যদি মেটা এখানে আর না ফিরিয়া আসে? না নিশ্চয়ই ফিরিবে, তাহার দ্রব্যাদি এখানে রহিয়াছে, এ সকল ফেলিয়া কি সে চলিয়া যাইবে? না-না—সে নিশ্চয়ই আসিবে। বহুক্ষণ ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় জয়বন্ত গৃহমধ্যে লুক্কায়িত থাকিয়া মেটার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন। 

প্রায় সন্ধ্যার সময়ে মেটা ফিরিয়া আসিয়া নিজ কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। জয়বন্ত নীরবে সন্তর্পণে গৃহমধ্য হইতে বহির্গত হইলেন। চারিদিকে চাহিয়া দেখিলেন, নিকটে কেহ নাই, তিনি নিঃশব্দে মেটার গৃহে প্রবেশ করিয়া নিমেষমধ্যে দ্বাররুদ্ধ করিয়া দিলেন; কি হইয়াছে, কে আসিয়াছে, তাহা মেটা বুঝিবার পূর্ব্বেই সিংহ-বিক্রমে জয়বন্ত তাহাকে আক্রমণ করিলেন। দুই হস্তে সবলে তাহার গলা টিপিয়া ধরিলেন। হতাশে, নৈরাশ্যে, ক্ষোভে ক্রোধে জয়বত্তের দেহে এখন সিংহের বল সমাগত। 

মেটা বিস্ফারিতনয়নে তাঁহার মুখের দিকে চাহিল, কিন্তু তাহার দম বন্ধ হইয়া আসিতেছিল, সে একটিও শব্দ করিতে পারিল না। প্রাণপণ চেষ্টায় জয়বন্তের হাত গলা হইতে সরাইবার চেষ্টা করিল; কিন্তু জয়বন্ত আজ উন্মত্ত, তাঁহার শরীরে অসুরের বল, তিনি দেহের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করিয়া মেটার কন্ঠে প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। 

ক্রমে মেটা নিস্তেজ হইয়া আসিল, অবশেষে অবসন্ন হইয়া ভূতলে পড়িয়া গেল। জয়বন্ত ঘৰ্ম্মাক্ত কলেবরে দাঁড়াইয়া উঠিলেন। কাপড় দিয়া কপালের ঘাম মুছিয়া তিনি মেটার বুকে হাত দিয়া দেখিলেন, বুক সবলে ধড়াস ধড়াস্ করিতেছে, তাহা হইলে মরে নাই। তিনি আশ্বস্ত হইলেন। এই নরাধম নরারাক্ষসকে হত্যা করিলেও পাপ নাই, বরং পুণ্য আছে, তিনি নরহত্যা করিতে প্রস্তুত নহেন সে খুনী, তাই বলিয়া তিনি খুনী হইবেন কেন? 

তিনি মেটার জামার বোতামগুলি খুলিয়া ফেলিলেন। তাহার পকেটে এক খামের মধ্যে নোটগুলি পাইলেন। সবগুলিই আছে কেবল একখানা নোট নাই। 

মেটার পকেটে আর এক পয়সাও নাই। জয়বন্ত বুঝিলেন যে, মেটার নিকটে ফিরিয়া যাইবার ভাড়া থাকিলে সে কখনই এখানে একখানা নোট ভাঙাইবার চেষ্টা পাইত না। নিতান্ত বাধ্য হইয়াই সে নোট ভাঙাইতে চেষ্টা পাইয়াছিল। 

জয়বন্ত নোটগুলি নিজের পকেটে পূরিয়া প্রথমে দ্বার ঈষৎ খুলিয়া উঁকি মারিয়া দেখিলেন, কোনদিকে কেহ নাই; তিনি সত্বর সে কক্ষত্যাগ করিলেন। তৎপরে সাবধানে তথা হইতে বাহির হইয়া পড়িলেন। 

এ নোট আর কিছুতেই সঙ্গে রাখা উচিত নহে; কি জানি, যদি আবার চুরি যায়। প্রথমবার যেরূপে তাঁহার নিকট হইতে চুরি গিয়াছিল, তাহাতে কিছুই বিশ্বাস নাই। তিনি ধৰ্ম্মশালা হইতে বাহির হইয়া পোর-বন্দরের সর্ব্বশ্রেষ্ঠ গদীয়ান লালুভাই চবিলদাসের গদীতে উপস্থিত হইলেন। 

চবিলদাসের সহিত দেখা করিয়া জয়বন্ত বলিলেন, “নুনিয়াদের হরকিষণ দাসের নিরনব্বই হাজার টাকার নোট আমি আপনাদের গদীতে তাঁহার নামে জমা দিতে চাহি। আর এ সংবাদ যেন আজ রাত্রেই তাঁহাকে পাঠাইয়া দেওয়া হয়।” 

“এ টাকা তাঁহার?” 

“হাঁ, তাহার এক মামী বোম্বাই সহরে ছিলেন, তিনি মারা যাওয়ায় তাঁহার সমস্ত সম্পত্তি হরকিষণ দাস পাইয়াছেন; আমি সেই টাকা আনিবার জন্য বোম্বাই গিয়াছিলাম।” 

“একেবারে হরকিষণ দাসকে না দিয়া আমাদের গদীতে জমা দিতেছেন কেন?”

“বিশেষ কাজ থাকায় আজ রাত্রে আমি তাঁহার বাড়ী যাইতে পারিব না। এত টাকা সঙ্গে রাখা নিরাপদ নয় বলিয়া আপনাদের গদীতে জমা দিতেছি।” 

“বেশ, আমরা আজ রাত্রেই তাঁহাকে সংবাদ দিব।” 

গদীতে নোট জমা দিয়া নিয়মিত রসিদ লইয়া জয়বন্ত কতক আশ্বস্ত ও নিশ্চিন্ত হইলেন। ভাবিলেন, আর চুরি যাইবার ভয় নাই। গদীতে নোট খোয়া গেলে, এখন লালুভাই চাবিলদাস দায়ী হইবেন। তাঁহার ক্রোড় টাকার অধিক সম্পত্তি। 

পোর-বন্দরের প্রধান উকীল শ্যামজীদাসকে জয়বন্ত চিনিতেন। জয়বন্ত এখন তাঁহার নিকটে চলিলেন, এখনও একখানা নোট বেহাত আছে যেমন–করিয়া হয়, সেখানাও তাহাকে হস্তগত করিতে হইবে। হরকিষণ দাস তাঁহার মক্কেল বলিয়া, শ্যামজী দাস জয়বন্তকে সমাদরে বসাইলেন। 

জয়বন্ত বসিয়া বলিলেন, “হরকিষণ দাসের একটা কাজের জন্যই আপনার কাছে আসিলাম।” 

“কি বলুন, হরকিষণ সাহেবের কাজে আমি সৰ্ব্বদাই নিযুক্ত আছি।” 

“বোধ হয়, আপনি শুনেন নাই যে, বোম্বাই সহরে হরকিষণ দাসের এক মামী ছিলেন।” 

“হাঁ, একটা মোকদ্দমায় এই মামীর কথা একবার শুনিয়াছিলাম।”

“তিনি সম্প্রতি মারা গিয়াছেন।” 

“তাঁহার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হরকিষণ দাস।” 

“বটে। খুব সুখের বিষয়। কত সম্পত্তি ছিল?” 

“সমস্ত বিক্রয় করিয়া লাখ টাকা হইয়াছে।” 

“তিনি সে টাকা পাইয়াছেন।” 

“সেইজন্যই আপনার কাছে আসিয়াছি।” 

“বলুন।” 

“আমি এই টাকা বোম্বাই হইতে আনিবার জন্য যাই, সেখান হইতে একশতখানা হাজার টাকার নোট লইয়া আসিতেছিলাম, কিন্তু জাহাজে এই নোট সমস্তই চুরি যায়। আমি অনেক চেষ্টায় একখানা ছাড়া আর সমস্ত নোটই উদ্ধার করিয়া এখন লালুভাই চবিলদাসের গদীতে জমা করিয়া দিয়াছি—এই তাঁহাদের রসীদ।” 

উকীল মহাশয় তাহা দেখিয়া বলিলেন, “হাঁ, এ ঠিক আছে।” 

‘এখন একখানা নোট সেই চোর ভাঙাইতে চেষ্টা পাইয়াছিল।”

“কোথায়?” 

যেখানে মেটা নোট ভাঙাইতে গিয়াছিল, জয়বন্ত তাহা বলিলেন। সেখানে তিনি যেরূপ বলিয়া আসিয়াছিলেন, তাহাও বলিলেন, “যাহাতে এই চোর নোটখানা আর হস্তগত করিতে না পারে, তাহা আপনাকে করিতে হইবে।” 

“হরকিষণ দাস কি এখানে আসিয়াছেন?” 

“না, তিনি বাড়ীতে আছেন।” 

“এখানে তাঁহার একবার আসা দরকার হইতেছে।” 

“আপনারই তাঁহাকে পত্র লিখুন।” 

“কেন?” 

“তাঁহার বিশ্বাস, আমিই তাঁহার টাকা চুরি করিয়াছি। জাহাজে এই-লাখ টাকাই খোয়া গিয়াছিল; কিন্তু একটু আগে আমি এক হাজার টাকা ব্যতীত আর সমস্ত টাকাই তাঁহার নামে লালুভাই চবিলদাসের গদীতে জমা করিয়া দিয়াছি।” 

“ভালই করিয়াছেন। কিন্তু তিনি না আসিলে এ হাজার টাকা অপরে দাবী করিলে চলিবে না।” 

“তাহা হইলে তাঁহাকে আসিবার জন্য এখনই সংবাদ দিন।” 

“কাজেই, আজ রাত্রে তিনি যাহাতে নোট ফেরৎ না দেন, সে বিষয়ে যাহা করিতে হয়, আমি এখনই 

করিতেছি। কাল সকালে হরকিষণ দাস আসিয়া পৌঁছিলেই তাঁহার নোট তিনি পাইবেন।” 

“দেখিতেছি, তাহা হইলে কাল সকালে আমাকে আপনার নিকটে আসিতে হইবে।”

“নিশ্চয়।” 

“তাহাই আসিব।” 

জয়বন্ত বিদায় হইলেন। তিনি রাত্রে পোর-বন্দরে থাকিবার বন্দোবস্তের জন্য বহির্গত হইলেন। আবার তাঁহার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। হিঙ্গনের সম্মুখে গিয়া আবার উজ্জ্বলমুখে দাঁড়াইতে পারিবেন, এ তাঁহার পক্ষে কম আনন্দ নহে—দশ লক্ষ টাকায় এ আনন্দ নাই—তাঁহার সমস্ত মন আজ পরিপূর্ণ—বিশ্বপৃথিবী, অনন্ত গগন, সমস্ত জগৎ-সংসার তাঁহার কাছে আজ পরিপূর্ণ। 

চতুৰ্দ্দশ পরিচ্ছেদ – পাপের প্রায়শ্চিত্ত 

মেটা মূৰ্চ্ছিতা হইয়াছিল। যখন তাহার জ্ঞান হইল, তখন সে প্রথমে কিছুই স্থির করিতে পারিল না। কেবল কন্ঠে আতিশয় বেদনা অনুভূত হইতেছিল। 

সে হাতের উপরে ভর দিয়া ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল। তখন তাহার জ্ঞানহইল যে, সে পোর-বন্দরের ধর্ম্মশালায় রহিয়াছে। এবং এইখানেই কে সহসা আসিয়া তার গলা টিপিয়া ধরিয়াছিল। তাহার পর তাহার জ্ঞান লোপ পাইয়াছিল। 

সহসা সে লম্ফ দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার নোটের কথা মনে পড়িল, সে উন্মাদের ন্যায় পকেটে হাত পুরিয়া দিল। তৎপরে বিকট চীৎকার করিয়া বসিয়া পড়িল। কি সৰ্ব্বনাশ! পকেটে নোট নাই! 

ক্রোধে সে নিজের পরিধেয় বস্ত্র ছিন্নভিন্ন করিয়া ফেলিল সে প্রকৃতই উন্মাদ হইয়া গেল; এত করিয়াও – হাতে পাইয়াও হারাইলাম, এই কথা যতই তাহার মনে হইতে লাগিল, ততই তাহার মস্তিষ্কের মধ্যে অগ্নি ছুটিতে লাগিল। সে কিয়ৎক্ষণ পাগলের ন্যায় সেই প্রকোষ্ঠের মধ্যে উন্মত্তবেগে ছুটিতে লাগিল। 

ক্রমে তাহার মস্তিষ্ক কতকটা প্রকৃতিস্থ হইল। তখন সে ভাবিতে লাগিল, এখন সে কি করিবে, কি করা তাহার উচিত। পুলিসে সংবাদ দিবে তাহা কি উচিত? তাহা হইলে তাহার সকল কথাই প্রকাশ হইয়া পড়িবে। না তাহা কখনই করা উচিত নহে। নোটগুলি বন্ধ করিয়া দেওয়াই ঠিক; না, তাহা করিবারও উপায় নাই। যাহার নোট তিনি পাইয়াছেন, বলিয়া ব্যাঙ্কে পত্র লেখা হইয়াছে, এখন অন্য কথা লিখিলে অনুসন্ধান আরম্ভ হইবে; অনুসন্ধান আরম্ভ হইলে সকল কথাই প্রকাশ হইয়া পড়িবে। না, ইহা করাও অসম্ভব। তবে কি সকল পরিশ্রম পণ্ড হইল, হাতে নোটগুলি আসিয়াও হারাইল? 

তাহার নিকট হইতে কে নোটগুলি লইল? এ নোটের কথা কেহ জানে না, তবে কে তাহাকে অজ্ঞান করিয়া নোটগুলি লইল? জয়বন্ত যে এ কাজ করিয়াছেন, তাহা তাহার মাথায় একবারও প্রবেশ করিল না। যাহা হউক, এখনও হাজার টাকার একখানা নোট বেনিয়ার কাছে আছে, এখানা সে এখনই হস্তগত করিবে, তাহার পর বাকীগুলির অনুসন্ধান করিবে, সে সম্বন্ধে কি করা উচিত, তাহাও স্থির করিল। 

মেটা তখনই ধৰ্ম্মশালা হইতে বাহির হইয়া বেনিয়ার গদীতে উপস্থিত হইল। তাহাকে দেখিয়া মালিক বলিল, “কি, দেখিতেছি একা ফিরিয়া আসিয়াছ? 

মেটা বলিল, “কেন? আপনাকে ত আগেই বলিয়াছিল, আমার এখানে পরিচিত লোক কেহ নাই।”

“তাই বটে, তবে এখানে তোমার কয়েকজন বন্ধু আছে তাহারা তোমার সঙ্গে দেখা করিবার জন্য বড় ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতেছে?” 

“বন্ধু— সেকি—আমার এখানে কোন বন্ধু নাই! আপনি বোম্বাই হইতে টেলিগ্রামের উত্তর পাইয়াছেন কি?” 

“না, আমি টেলিগ্রাফ করি নাই, আমি বাজে খরচে রাজী নহি।” 

“সে কি?” 

“তুমি চলিয়া গেলেই একজন তোমার বন্ধু তোমার অনুসন্ধানে এখানে আসে—” 

“আমার বন্ধু!” 

“হাঁ, তোমাকে তিনি খুব চেনেন। তিনি বলিলেন, “এইমাত্র তিনি গেলেন; তিনি আমার বন্ধু উকীল মেটা সাহেব।” 

“কি—কি—বলিল?” 

“যাহা বলিলাম, তিনি চোরাই নোটের অনুসন্ধানে আসিয়াছিলেন, তাহাই বলিতেছি যে, তুমি একা আসিয়াছ।” 

“একা!” 

“হাঁ, তিনি বলিলেন যে, তিনি আজই তোমায় অনুগ্রহ করিয়া গ্রেপ্তার করিবেন।”

“গ্রেপ্তার!” 

“হাঁ, চোরের ঐ ব্যস্থাই হয়।” 

“চোর!” 

“হাঁ, চোর বই কি।” 

“ও বদমাইসী আমার সঙ্গে চলিবে না। আমার নোট আমাকে ফেরৎ দাও।” 

“তোমার নোট?” 

“হাঁ, শীঘ্র আমার নোট আমায় ফেরৎ দাও।” 

মালিক ফিরিয়া তাঁহার একজন লোককে বলিলেন, “যাও, এখনই পুলিস ডাকিয়া আন।” 

মেটা ভীতভাবে বলিল, “পুলিস?” 

‘হাঁ গো মহাশয়, পুলিস।” 

“তোমার মলব কি?” 

“ব্যস্ত হইয়ো না, পুলিস যতক্ষণ না আসে, এইখানে অপেক্ষা কর, তাহারা আসিলেই সব ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইয়া দিবে। আমি বুড়ো মানুষ, আর কত বকিব? আর তাহারা এ সকল বিষয় আমাদের অপেক্ষা ভাল করিয়া বুঝাইতে পারে।” 

“এর জন্য তোমাকে রীতিমত শিক্ষা দিব।” 

এই বলিয়া তিন লম্ফে তীরবেগে মেটা তথা হইতে অন্তর্হিত হইল। 

দুইজন কনেষ্টবলকে সেইদিকে আসিতে দেখিয়া মেটা ভয়ে এক ক্ষুদ্র গলির ভিতরে প্রবেশ করিয়া উর্দ্ধশ্বাসে ছুটিতে লাগিল। 

তাহার বাক্স ধৰ্ম্মশালায় রহিয়াছে, আগে সে ধর্ম্মশালার দিকে ছুটিল। সে বুঝিল যে, পুলিস তাহার অনুসরণ করিতেছে, আর ক্ষণবিলম্ব করিলে তাহার আর রক্ষা পাইবার উপায় নাই। সে হাঁপাইতে হাঁপাইতে ধৰ্ম্মশালায় আসিয়া পড়িল। 

সত্বর তাহার বাক্সটি তাহার নিজের বগলে তুলিয়া বাহির হইতেছিল, এই সময়ে সে দেখিল, ধৰ্ম্মশালার দ্বারে একজন পুলিস-ইনস্পেক্টর আর কয়েকজন কনেষ্টবল দণ্ডায়মান। 

বোধ হয়, তখন রাত্রি আটটা, চারিদিকে ঘোর অন্ধকার, এখনও পুলিস তাহাকে দেখিতে পায় নাই, কিন্তু এখনই তাহারা তাহার অনুসন্ধানে বাড়ীর ভিতরে আসিবে, দরজায়ও পাহারা রাখিবে, সুতরাং সে ধরা পড়িবে, তাহার রক্ষা পাইবার আর উপায় নাই। 

সম্মুখের দরজা দিয়া পলাইবার উপায় নাই। মেটা বাক্স ফেলিয়া ব্যাকুলভাবে পলাইবার অন্য কোন পথ আছে কি না দেখিবার জন্য বাড়ীর চারিদিকে ছুটাছুটি করিতে লাগিল। সকল জানালাতেই লৌহগরাদ দেওয়া, বিশেষতঃ সে যেখানে রহিয়াছে, সে উচ্চ একতলা—সিঁড়ী দিয়া পুলিস উঠিতেছে। 

পার্শ্বে একটি অনতুচ্ছ ক্ষুদ্র ছাদ ছিল। উন্মত্তের মত ব্যাকুলভাবে মেটা সেই ছাদে আসিল। মনে করিল, এ ছাদ তত উচ্চ নহে, এখান হইতে লাফাইয়া পড়িয়া পলাইতে পারিবে। কিন্তু এ অবস্থায় কাহারই বিবেচনা করিবার ক্ষমতা থাকে না মেটা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া সেখান হইতে লাফাইয়া পড়িল। 

তৎপরে এক বিকট চীৎকারে চারিদিক প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। যেখানে মেটা লাফাইয়া পড়িয়াছিল, ঠিক সেইখানে একটা ইঁদারা ছিল। অন্ধকারে মেটা তাহা দেখিতে পায় নাই। সে ভাবিয়াছিল, ভূতলে পড়িয়া পলাইতে সক্ষম হইবে, কিন্তু সে ভূতলে না পড়িয়া—ভূগর্ভে গভীর কূপের ভিতরে পড়িল। যখন সে বুঝিল যে, সে কোথায় যাইতেছে—কোথায় পড়িতেছে, তখন এমনই বিকট আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল যে, সেই ভয়াবহ চীৎকারে ধর্ম্মশালার সমস্ত লোকের প্রাণ শিহরিয়া উঠিল। 

পুলিস প্রকৃতপক্ষে তাহাকে ধরিতে আসে নাই, তাহার কথা তাহারা কিছুই জানিত না। কয়দিন পূর্ব্বে ধর্ম্মশালায় একটা চুরি হওয়ায় তাহারা সেই অনুসন্ধান করিতে আসিয়াছিল। পাপাত্মা মেটা ঘটনাচক্রে পাপের উপযুক্ত দণ্ড পাইল। 

শব্দ শুনিয়া সকলে ইদারার নিকটে সমবেত হইল। একটা লোক যে তাহার ভিতরে পড়িয়াছে, তাহা অনুমানে কতক বুঝিল। 

পুলিস অন্যান্য লোক ডাকিতে কনেষ্টবলকে পাঠাইল। অনেক কষ্টে কয়েকজন লোক কূপের ভিতরে নামিয়া গিয়া মেটার মৃতদেহ টানিয়া উপরে তুলিল। 

পাপীর দণ্ড হইল।