প্রতীজ্ঞা পালন – ১৫

১৫

রামকান্ত বিস্মিত ও আনন্দিত হইয়া ছবিখানি পুনঃপুনঃ দেখিতে লাগিল—হাঁ, এ বিষয়ে আর কোন সন্দেহ নাই—এ সেই স্ত্রীলোকেরই ফটোগ্রাফ—আরও আশ্চর্য্যের বিষয় ছবিখানি তোলা হইয়াছে, যখন এই রমণী তাস খেলিতেছে, বুকের উপর ইস্কাবনের টেক্কাটি লইয়া কি খেলিবে স্মিতমুখে তাহাই ভাবিতেছে। সেই রূপ—সেই সৌন্দৰ্য—এমন কি সেই বেশ—এই বেশই রমণীর রমণীর বাক্সের মধ্যে পাওয়া গিয়াছিল। একি রহস্য! 

ভাগ্যক্রমে এই খনের ব্যাপারের যে সহসা এমন একটা সন্ধান হাতে পাইবে, রামকান্ত তাহা ভাবে নাই; এখন সে আনন্দে একেবারে অষ্টধা হইয়া পড়িল—সে রাত্রে যে লোক তাহার চোখে ধূলি দিয়াছিল, কথা একেবারে ভুলিয়া গেল। ভাবিল, যখন হত স্ত্রীলোকের ছবি এই লোকটার নিকট পাওয়া গিয়াছে, তখন এ নিজে না খুন করিলেও কেখুন করিয়াছে, নিশ্চয় বলিতে পারিবে; অন্ততঃ এ তাহাকে নিশ্চয়ই বশেষরূপে চেনে, নতুবা তাহার ছবি ইহার নিকট পাওয়া যাইবে কেন? যাহা হউক, এই সকল বিষয় অবগত হইবার এখনই সুবিধা—থানায় উপস্থিত হইলে এ সুবিধা আর থাকিবে না। তাহাই রামকান্ত হাস্যমুখে শ্যামকান্তের চোখের উপর সেই ছবিখানি ধরিল। 

শ্যামকান্ত বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তাই ত হে!” 

“চিনিতে পারিয়াছ?” 

“স্পষ্ট চেনা যায়।” 

“তাহা হইলে আর কি—এই ভায়াকে খানিকক্ষণ ঝুলিতে হইবে–এই মাত্ৰ।” 

তাহার পর রামকান্ত হিন্দুস্থানীর দিকে ফিরিয়া গম্ভীরভাবে বলিল, “বাপু হে, তুমি আমাদের চেয়েও ভাল বাঙ্গলা বুঝিতে পার, যাহা বলিলাম, বুঝিলে ত? তোমার অদৃষ্টে যাহা আছে, তাহাও বেশ বুঝিতে পারিতেছ; তুমি কেবল পকেটমারা লোক হইলে বছরখানেক জেল খাটিয়া বাঁচিয়া যাইতে; কিন্তু বাপু—বেশ ত জানিতেছ যে, কি করিয়াছ—ফাঁসী ভিন্ন তোমার গতি নাই।” 

হিন্দুস্থানীর মুখ একটু শুষ্ক হইল বটে, কিন্তু সে কোন কথা কহিল না। তখন রামকান্ত বলিল, “আমি ঠিক পুলিসের লোকের মত নহি—তোমাকে দুই একটা সদুপদেশ দিতেছি, মন দিয়া শুন। তোমার রক্ষা একমাত্র উপায় আছে, সেটা তোমায় বন্ধুভাবে বলিয়া দিতেছি। যদি তুমি এ ব্যাপারে কে কে ছিল, সমস্ত কথা খুলিয়া বল, তাহা হইলে তোমায় সরকারী সাক্ষী করিব, তুমি মাপ পাইবে—ফাঁসী হইতে এই যাত্রায় বাঁচিয়া যাইবে।” 

এবার হিন্দুস্থানী কথা কহিল; বলিল, “খুলিয়া কি বলিব?” 

“তাহা কি জান না বাপু? ‘আমার কথাটা মন দিয়া শুন, এস, সব খুলে বল।” 

“খুলে কি বলিব, আমি যাহা করিতেছিলাম, তাহাতেই ত তোমারা হাতে-নাতে আমাকে ধরিয়াছ—হাঁ, ঐ আমার ব্যবসা, আর খুলিয়া বলিব কি? পকেট মারিলে কেহ ফাঁসী যায় না।”

“বুদ্ধিমানের মত কাজ কর বাপু—গাধা হইয়ো না—পকেট মারিবার কথা হইতেছে না”, বলিয়া রামকান্ত হঠাৎ ছবিখানা হিন্দুস্থানীর সম্মুখে ধরিল; ভাবিয়াছিল, এই স্ত্রীলোকের ছবি দেখিয়া সে শিহরিয়া উঠিবে; কিন্তু সে সেরূপ কোন ভাব দেখাইল না। কেবল যেন একটু বিস্মিত হইল। 

রামকান্ত উৎফুল্লভাবে বলিল, “বাপু হে, ইহাকে চিনিতে পার?” 

হিন্দুস্থানী বলিল, “হাঁ, এরই ত ছবি তোমরা লালদীঘীর মধ্যে টাঙাইয়া রাখিয়াছ?” 

“হাঁ, আর মহাশয় যাহাকে খুন করিয়াছিলেন—আর কেন স্বীকার করিয়া ফেল, ইহাতে তোমার ভাল হইবে।” 

হিন্দুস্থানী অতিশয় বিস্ময়ে চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া বলিল, “আমি–আমি কাহাকে খুন করিয়াছি? আমি ইহাকে জীবনে কখনও দেখি নাই।” 

“বাপু হে, এ কথা কি জজে শুনে; যদি ইহাকে নাই চিনবে, তবে ইহার ছবিখানি সঙ্গে সঙ্গে রাখিয়াছ কেন বাপু?” 

“আমার কাছে এ ছবি ছিল না।” 

“এই পকেট-বইয়ে ছিল।” 

“ও পকেট-বই আমার নয়।” 

“তবে কার?” 

“একটু আগে একজনের পকেট হইতে এখানা লইয়াছিলাম—নিশ্চয়ই তার।” 

রামকান্ত উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। বলিল, “বুদ্ধি আছে, স্বীকার করি–বেশ একটা ফন্দী খাটাইয়াছ বটে; বলিলেই ত হবে না, কখন, কোথায়, কাহার পকেট হইতে এই পকেট-বই লইয়াছ, সব বলিতে হইবে।” 

“এই একটু আগে এখানে সেই লোকটা ছিল, মুখে রুমাল চাপা দিয়া সে ঘুরিতেছিল।” 

রামকান্ত সবিস্ময়ে বলিয়া উঠিল, “ক!” 

রামকান্তের মাথা ঘুরিয়া গেল, তবে ত এসেই লোক—তবে তাহার ভুল হয় নাই, সে তাহাকে আজ এখানে দেখিয়াছিল, তাহারই পকেটে মৃত রমণীর ছবি ছিল, আর সে আজও তাকে ছাড়িয়া দিল; তাহার ন্যায় প্রকান্ড গাধা আর নাই। 

১৬ 

রামকান্ত কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিল, প্রকৃতই সে হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিল; ভাবিল, “এই চোরটা যাহা বলিতেছে, দেখিতেছে, তাহাই ঠিক—আমি-ই গাধা বানিয়েছি—তবুও ইহাকে আরও একটু নাড়াচাড়া করিয়া দেখা কৰ্ত্তব্য। বদমাইসী করিয়া আমার চোখে ধূলি দিবার চেষ্টা করিতেও পারে।” প্রকাশ্যে বলিল, “বাপু হে—আমাকে নিতান্ত বোকা ভাবিয়ো না।”

হিন্দুস্থানী বলিল, “মহাশয় সত্য কথা বলিলাম, বিশ্বাস হয় করুন, না হয় না করুন, আমি সেই ভদ্রলোকের পকেট হইতে এ নোট-বইখানা তুলিয়া লইয়াছিলাম। ইহার ভিতর কি ছিল,দেখিতে সময় পাই নাই।”

সহসা রামকান্ত গাড়ী থামাইতে বলিল; গাড়ী থামিলে শ্যামকান্তকে বলিল, “নামিয়া এস শ্যামকান্ত।” রামকান্তের ভাব বুঝিতে না পারিয়া সে বিস্মিতভাবে নামিয়া পড়িল। 

রামকান্ত পাহারাওয়ালাদ্বয়কে বলিল, “নেমে এস, গাড়ীর ভিতরে গিয়ে বসো, নিয়ে যাও থানায়- আমরা পরে যাইব।” 

চোরসহ গাড়ী চলিয়া গেল। রামকান্ত বলিল, “ভায়া কি সৰ্ব্বনাশ হইয়াছে জান?” 

“না বলিলে কিরূপে জানিব?” 

রামকান্ত বলিতে লাগিল, “খুনী হাতে আসিয়া পালাইল, তোমাকে ভিড়ের ভিতর সেই লোকটারই উপরে নজর রাখিতে বলিয়াছিলাম, এ বেটা চোর, সত্যকথাই বলিয়াছে, এ সত্যসত্যই পকেট-বইখানা তাহার পকেট হইতে তুলিয়া লইয়াছে। দুই-দুইবার লোকটা আমার চোখে ধূলা দিল। এবার বড় সাহেব কি অক্ষয় বাবু জানিতে পারিলে আর আমাকে কাজে রাখিবে না—তাহা হইলে পাঁচটা কাচ্ছাবাচ্ছা নিয়ে মারা যাইব আর কি! আর কেন আমি আত্মহত্যা করিয়াই মরিব।” 

শ্যামকান্ত বলিয়া উঠিল, “পাগল আর কি, যখন তাহাকেই খুনি বলিয়া জানা গিয়াছে, তখন তাহাকে ধরা কঠিন হইবে না; তাহার পকেট-বইখানা আমরা পাইয়াছি, যে স্ত্রীলোক খুন হইয়াছে, তাহার ফটোগ্রফ পাইয়াছি, ঐ যে তুলিয়াছিল, ‘তাহার নাম নিশ্চয়ই ইহাতে আছে।” 

“হাঁ আছে, আর্ট স্টুডিও—তবে যে নিজের রক্ষিতার ফটোগ্রাফ তুলিতে যায়, সে নিজের নাম ধাম বলে না—সম্ভবতঃ স্ত্রীলোকটির নাম ও তাহার বাড়ীর ঠিকানা দিয়াছিল, এ দুই বিষয়ই আমি জানি।” 

“সম্ভব, কিন্তু যাহারা ফটো তুলিয়াছিল, তাহারা এই লোকটাকে নিশ্চয় দেখিয়াছিল।” 

“হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে যে বিশেষ কিছু ফল হইবে তাহা বলা যায় না। যদি পকেট-বইখানায় লোকটার নাম ধাম না লেখা থাকে, তবে আমাকে ভালয় ভালয় নিজে-নিজেই চাকরীতে ইস্তফা দিতে হইবে।” 

“তাহা হইলে নাচিয়া উঠিবার অপেক্ষা প্রথমে পকেট-বইখানা ভাল করিয়া দেখ।” 

রামকান্ত পকেট-বইখানি খুলিল, ইহার দুই দিকে দুইটা মলাটের ভিতরে দুইটা পকেট, ইহার ভিতরে কয়খানা নোট রহিয়াছে। 

রামকান্ত বলিয়া উঠিল, “আর কি,এইবার আমার কাজ শেষ হইল।” 

শ্যামকান্ত বিস্মিতভাবে জিজ্ঞাসা করিল, “কেন হে?” 

“এখন এই নোট-বই লইয়া এখনই আমাকে বড় সাহেবের কাছে যাইতে হইয়াছে, এখনই এ সম্বন্ধে সকল কথা খুলিয়া বলিতে হইবে—আর গোপন করিবার উপায় নাই—লোকটা যে এবারও আমাকে আমার চোখে ধুলা দিয়া পলাইয়াছে, তাহা স্বীকার করিতে হইবে–তাহা হইলে রামকান্তের চাকরীর দফা এই পর্যন্ত রফা হইয়া গেল।” 

“এত হতাশ হইতেছে কেন? খুনী ধরা পড়িবে।” 

রামকান্ত সে কথায় কর্ণপাত না করিয়া নোটগুলি গুনিয়া বলিল, একশত পাঁচখানার নোট—এখনই আমাকে সাহেবের কাছে যাইতে হইল—এ নোট এক মিনিটও আমার কাছে রাখা উচিত নয়—লোকে আমাকে গৰ্দ্দভ বলিয়া জানিবে—তা বরং ভাল, চোর বলিলে মারা যাইব।” 

“তাহা হইলে চল—নোটগুলি সাহেবকে পৌঁছিয়া দেওয়া যাক্।” 

“যদি দুই দিন সময় পাইতাম, তাহা হইলে নিশ্চয়ই ইহাকে ধরিতে পারিতাম—এখন এখনই সব সাহেবকে বলিতে হইবে।” 

এইরূপ বলিতে বলিতে রামকান্ত নোট-বইখানির পাতা উল্টাইতেছিল, সহসা তাহার দৃষ্টি এক স্থানে পড়িল, তৎক্ষণাৎ সে লম্ফ দিয়া উঠিল। দেখিয়াই শ্যামকান্ত বিস্মিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “ব্যাপার কি! রামকান্ত হর্ষোৎফুল্লস্বরে বলিল, “আর ভয় নাই। আজ আর নোট ফেরৎ দিতেছি না—কাল সাহেব ইহার জন্য আমার খোসনাম করিবেন”, বলিয়া রামকান্ত সবলে শ্যামকান্তের হাত ধরিয়া হিড় হিড় করিয়া টানিয়া লইয়া চলিল। 

শ্যামকান্ত ভাবিল, “যথার্থই রামকান্তের মাথাটা হঠাৎ হইয়া গিয়াছে।” 

১৭ 

প্রাতে সুরেন্দ্রনাথ বরাহনগরে সুহাসিনীর সহিত দেখা করিতে গিয়াছিলেন। তিনি সময় পাইলেই যাইতেন। সুহাসিনীর সহিত তাঁহার বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে; কেবল তাঁহার পিতা তাঁহার অকালে বিবাহ দিবেন না বলিয়াই যাহা বিলম্ব; তবে সুহাসিনী বড় হইয়াছে; তাহার জননীর অর্থের অভাব ছিল না, সুহাসিনীর পিতা ব্যবসা করিয়া বিস্তর অর্থ রাখিয়া গিয়াছেন; অন্য কোন আত্মীয়-স্বজন না থাকায় মাতা কন্যার বিবাহে তৎপর হন নাই—তাঁহার একমাত্র কন্যা—তাঁহাকে ছাড়িয়া যাইবে, তিনি কাহাকে লইয়া থাকিবেন? 

তাহার মনোমত পাত্র জুটিতেছিল না, এই জন্য প্রায় পঞ্চদশ বর্ষ বয়স হওয়া সত্ত্বেও সুহাসিনীর বিবাহ হয় নাই। ভাল ভাল শিক্ষয়িত্রী রাখিয়া মাতা কন্যাকে লেখাপড়া শিখাইয়াছিলেন, সৰ্ব্বগুণে গুণবতী করিয়াছিলেন। আর রূপবতী — বিধাতা যেন তাহাকে লাবণ্যধারায় ম্লান করাইয়া দিয়াছিলেন। 

গোবিন্দরামের একমাত্র পুত্র সুরেন্দ্রনাথকে তিনি মনোনীত করিলেন। একটা মোকদ্দমা লইয়া তাঁহার সহিত প্রথম পরিচয়—সেই পর্যন্ত সুরেন্দ্রনাথ তাঁহাদের বাড়ির একজন হইয়া গিয়াছিলেন। 

এখনও বিবাহ হয় নাই বটে, কিন্তু সুহাসিনীর মা সুরেন্দ্রনাথকে জামাই বলিয়া মনে করিতেন; সেই ভাবে তাকে স্নেহ করিতেন। সুহাসিনী ও সুরেন্দ্রনাথে বিশেষ প্রণয় জন্মিয়াছিল—উভয়ে উভয়কে বেশিক্ষণ না দেখিয়া থাকিতে পারিতেন না। 

যেদিন রামকান্ত পকেট-বইখানা পায়, সেইদিন প্রাতে সুহাসিনীর জননী একখানি কাগজ পড়িতেছিলেন; গৃহের একপার্শ্বে একখানা কৌচের উপরে সুরেন্দ্রনাথ বসিয়াছিলেন, আর গৃহদ্বারে বসিয়া সুহাসিনী একখানা উপন্যাসের পাতা উল্টাইতেছিল। পুস্তকে মনঃসংযোগ দুঃসাধ্য। সহসা সুহাসিনীর মা বলিল, “এতদিনে ইহারা খুনীকে ধরিতে পারিবে, এইরূপ আশা পাইয়াছে।” 

সুহাসিনী বলিল, “কোন খুন মা?” 

মা বলিলেন, “কেন সেই খুনের কথা শুনিস নাই? একটা স্ত্রীলোকের মৃতদেহ একটা বাক্সের মধ্যে পাওয়া যায়, আর যে লোক ইহাকে খুন করিয়াছিল, সে-ই সুমাধব বলিয়া একজন জমিদারকেও খুন করিয়াছিল। কেন সুহাস তুই বুঝি কাগজগুলো আজ কাল একেবারে পড়িস না?” 

“হা অদৃষ্ট! সুহাসিনী আগে কাগজ না পড়িয়া থাকিতে পারিত না, আর এখন—এখন তাহার সময় কই? যখন সুরেন্দ্রনাথ থাকেন, তখন ত কথাই নাই; যখন তিনি না থাকেন, তখন সে তাঁহারই কথাই ভাবে। সুহাসিনীর খুনের কথা ভাল লাগিল না, সে সুরেন্দ্রনাথের দিকে চাহিল। 

তাহার মা বলিলেন, “এ কথা তোমার ভাল লাগিল না—একজন নয়, দুই-দুইটা খুন হইল, আর খুনী এখনও ধরা পড়িল না। আমরা দুইটি স্ত্রীলোকে এই বাগানে থাকি।” 

সুহাসিনী বলিল, “আমাদের ভয় কি মা?” 

সুরেন্দ্রনাথও বলিলেন, “আপনাদের ভয় কি। আর খুনীও শীঘ্র ধরা পড়িবে।” 

সুহাসিনীর মা মুখ বিকৃত করিয়া বলিলেন, “তোমাদের পুলিশ যে কোন কাজের নয়, এ কথাও ঠিক।” সুরেন্দ্রনাথ মৃদুহাস্য করিলেন। সুহাসিনীর মার সহিত পুলিস সম্বন্ধে তর্কবিতর্ক করা নিষ্প্রয়োজন ভাবিয়া বলিলেন, “আপনিই ত বলিলেন যে, পুলিস খুনীর সন্ধান পাইয়াছে।” 

“না, একেবারে ধরিতে পারে নাই—মৃতদেহ দুইটা—” জননী আরও কি বলিতে যাইতেছিলেন, সুহাসিনী বাধা দিয়া বলিল, “মা, দোহাই তোমার—এ সব কথা আমার সমুখে বলিয়ো না —খুন! খুনের নামে আমার গা শিহরিয়া উঠে”, বলিয়া সে সুরেন্দ্রর দিকে ফিরিয়া সহাস্যবদনে বলিল, “তোমার বড় ভোলা মন—আমার সে হার কই?” 

“আজ কাজে বড় ব্যস্ত ছিলাম।” 

“ওসব বাজে কথা।”

“কাল দেখিবে—কাল আর আমার ভুল হইবে না।” 

এই সময়ে একজন ভৃত্য আসিয়া বলিল, “একজন লোক সুরেন্দ্রবাবুর সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে।” সুরেন্দ্রনাথ বিস্মিতভাবে বলিলেন, “লোক! কি রকম লোক—কে সে?”

“কাপড়-চোপড়ে সামান্য লোক বলিয়াই বোধ হয়।” 

“ভিখারী বোধ হয়–” 

সুহাসিনী বাধা দিয়া বলিল, “যেই হউক, গিয়া দেখ—কোন লোক বিপদে পড়িয়া বোধ হয়, তোমার কাছে আসিয়াছে—নিশ্চয়ই তোমার বাড়ী গিয়াছিল। সেখানে শুনিয়া এখানে আসিয়াছে—যাও দেখ।” 

ভৃত্য বলিল, “সে ভিখারী নয়, বলে বিশেষ আবশ্যক আছে।” 

সুহাসিনীর মা বলিলেন, “আর একদিন আমার সঙ্গে যে দেখা করিতে আসিয়াছিল, সে ত নয়?”

ভৃত্য বলিল, “না সে নয়, এ আর একজন লোক।” 

সুহাসিনীর মা সুরেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “তবে একবার যাও—দেখ।” 

অগত্যা সুরেন্দ্রনাথ বাহিরের ঘরে আসিলেন, তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সুহাসিনী যে আসিয়াছিল, তাহা জানিতে পারেন নাই। সুহাসিনী দ্বারের পার্শ্বে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। 

সুরেন্দ্রনাথ আগুন্তকের সম্মুখীন হইয়া বলিলেন, “কি চাও?” 

তাহার বেশ সামান্য ব্যক্তি। ন্যায়, হঠাৎ দেখিলে সরকার বলিয়া বোধ হয়—সে মস্তক কণ্ডূয়ন করিতে করিতে বলিল, হাঁ, এই আমি একখানা পকেট-বই কুড়াইয়া পাইয়াছি। তাহাতে—এই—তাহাতে অনেক টাকা আছে।” 

“তার পর।” 

“আমি বড় লোক নই—দেখিতেছেন ত হাল; দেখিলাম, তাহাতে এই বাড়ীর ঠিকানা লেখা আছে—আর—আর-আপনার নামও লেখা আছে।” 

সুরেন্দ্রনাথ একটু ইতস্ততঃ করিয়া বলিলেন, “না, আমার কোন পকেট-বই হারায় নাই—’ “তবে—তবে—হয় ত এই বাড়ীর কর্ত্রী ঠাকুরাণীর হইবে।” 

এই সময়ে দরজার পার্শ্ব হইতে সুহাসিনী শব্দ করিল। তাহার ইচ্ছা যে সুরেন্দ্রনাথকে ডাকে, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ তাহা শুনিয়াও শুনিলেন না। তিনি বলিলেন, “আমার কোন পকেট-বই হারায় নাই—তুমি এখন বিদায় হইতে পার।” 

আগুন্তক নড়িল না, বলিল, “তা—তা—আপনাদের নাম লেখা আছে—অনেক টাকার নোট ইহাতে আছে—” 

(বাধা দিয়া) “না, আমাদের পকেট-বই নয়?” 

সুহাসিনী আর আত্মসম্বরণ করিতে পারিল না—সে ধীরে ধীরে সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ করিল। তাহাকে দেখিয়া সুরেন্দ্রনাথ বিরক্তভাবে বলিলেন, “তুমি এখানে কেন?” 

সুহাসিনী তাহার বিরক্তভাব লক্ষ্য না করিয়া বলিল, “এখানে আর কেহ নাই—আমার বোধ হইতেছে, তোমাকে আমি যে নোটবই-খানা দিয়াছিলাম—সেইখানাই ইনি পাইয়াছেন।” 

আগুন্তক মস্তক কুণ্ডয়ন করিতে করিতে বলিল, “তাহাই নিশ্চয় পাঁচ শত টাকার পাঁচ খানা নোট ছিল।” 

সুহাসিনী সুরেন্দ্রনাথের দিকে ফিরিয়া বলিল, “হাঁ, এখন বুঝিয়াছি,কেন হার আর নাই—নোটশুদ্ধ পকেট বইখানা রাস্তায় ফেলিয়া দিয়াছিলে—এই ভদ্রলোক না পাইলে টাকাগুলো সব যাইত—ইহাকে সন্তুষ্ট কর।” 

আগুন্তক বলিল, “না—না—আমি কিছু চাই না—আপনাদের জিনিস যে ফেরৎ দিতে পারিলাম, ইহাই আমার পরম সৌভাগ্য। মনে রাখিবেন, এই পৰ্য্যন্ত—তবে লালদিঘীতে খুনের ছবিখানি আমি দেখিতে না গেলে–হয় ত আর কেহ এখানা পাইত।” 

কন্যা সেই গৃহে আসিয়াছে দেখিয়া এই সময়ে সুহাসিনীর মাতাও তথায় আসিলেন; বলিলেন “খুনের ছবি কি?” 

“যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, পুলিসে কাল লালদিঘীর ধারে তাহার ছবি লটকাইয়া দিয়াছিল, যদি কেহ তাহাকে চিনিতে পারে। সেখানে ভারি ভিড় হইয়াছিল।” 

সুহাসিনীর মা সুরেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “তুমিও কি সেখানে গিয়েছিলে নাকি?”

সুরেন্দ্রনাথ শুষ্ককণ্ঠে বলিলেন, “হাঁ, সেইপথে যাইতেছিলাম—ভিড় দেখিয়া ব্যাপারটা কি দেখিতে গিয়েছিলাম।” 

আগুন্তক বলিল, “হাঁ, সেইখানেই আমি এই বইখানা কুড়াইয়া পাই—এই লউন—এই খানা ত?” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “এ আমারই পকেট-বই বটে—দাও।” 

“হাঁ, নোট খানা গুনে নিন।” 

“আর গুনিতে হইবে না—ঠিকই আছে”, বলিয়া সুরেন্দ্রনাথ হাত পাতিলেন। 

“তবু দেখে লওয়া ভাল –” 

সুরেন্দ্রনাথ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, “দাও—দাও—ও সব ঠিক আছে—”

“হাঁ আছে, তবুও গুণে নেওয়া ভাল”, বলিয়া আগন্তুক বই ও নোট দিতে উদ্যত হইয়া হাত টানিয়া লইল; বলিল, “আর একখানা–হাঁ, একখানা স্ত্রীলোকের ছবি ইহার ভিতর ছিল—নিশ্চয়ই সেইখানা— সহসা সুহাসিনীর দিকে চাহিয়া বলিল, “ইহারই ছবি।” 

এই বলিয়া আগুন্তক ছবিখানা সুহাসিনীর সম্মুখে ধরিল। 

১৮ 

ছবিখানার উপর দৃষ্টি পড়িবামাত্র সুহাসিনী দেখিয়াছিল যে, সে ছবি তাহার নহে—অন্য এক স্ত্রীলোকের—পরম রূপবতী যুবতী—দেখিবামাত্র সে মুখ ঘুরিয়া লইল। 

সুরেন্দ্রনাথ তাহার—তবে তাঁহার নিকটে অপর স্ত্রীলোকের ছবি কেন? এ কে? কাহার ছবি তিনি তাঁহার সঙ্গে রাখিয়াছিলেন; ইহার কথা তিনি কখনও তাহাকে বলেন নাই—সুহাসিনীর হৃদয় ঈর্ষায় পূর্ণ হইয়া গেল, তাহার নিশ্বাস সঘনে পড়িতে লাগিল—তাহার চক্ষু এক নিমেষে সজল হইয়া এক নিমেষে শুষ্ক হইয়া গেল। কেহ তাহা দেখিবার অবসর পাইল না। সহসা ছবিখানি তাহার সম্মুখে ধরায় সুরেন্দ্রনাথেরও বিশেষ ভাববৈলক্ষণ্য ঘটিল, তঁহার মুখ একেবারে শুকাইয়া নীল হইয়া গিয়াছিল। তাঁহার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখ দিয়াছিল। 

আগুন্তক তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাহা পর্যবেক্ষণ করিতেছিল। সে ধীরে ধীরে বলিল “এখন দেখিতেছি, আমার ভুল হইয়াছে—এ ছবিখানা ইহার নয়।” 

সুরেন্দ্রনাথ রুষ্ট, বিরক্ত ও শশব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “দাও, আর তোমার এখানে অপেক্ষা করিবার উদ্দেশ্য কি?” 

“কিছুই নয়—তবে—তবে—এ ছবিখানা যখন ইহার নয়—তখন বোধ হয়, আপনারও নয়, সুতরাং এখানা আমার কাছে থাক, যাহার ছবি, তাহাকে পাইলে দিব।” 

“না, এখনই আমায় দাও”, বলিয়া সুরেন্দ্রনাথ ক্ষিপ্ত ব্যাঘ্রের ন্যায় লম্ফ দিয়া তাহার হাত হইতে ছবিখানি ছিনাইয়া লইবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু আগুন্তক আগে হইতেই এজন্য সাবধান ছিল, ক্ষিপ্রবেগে ছবিখানি পশ্চাদিকে লইয়া সরিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর ধীরে ধীরে বলিল, “এ ছবিখানা কাহাকে দেখাইতে আপনার এত ভয় কেন? এ কার ছবি দেখি”, বলিয়া ছবিখানা দেখিয়াই সে বলিয়া উঠিল, “তাই ত এ কি!” 

সুহাসিনীর মা তাহাদের ভাব দেখিয়া ভীত ও বিস্মিত হইয়াছিলেন; বলিলেন, “কি হইয়াছে, এ কাহার ছবি?” 

আগুন্তক বলিল, “তাহাই ত ইহা কখনও মনে করে নাই—এ যে–এ–যে স্ত্রীলোক খুন হইয়াছে, তাহারই ছবি।” 

সুহাসিনীর মাথা ঘুরিয়া গেল, তাহার জননীও মহাবিস্ময়ে বিস্ফারিত নয়নে সুরেন্দ্রনাথের দিকে চাহিলেন। সুরেন্দ্রনাথ সংরক্ত নেত্রে গৰ্জ্জিয়া বলিলেন, “যথেষ্ট স্পর্দ্ধা দেওয়া হইয়াছে, আর নয়—এখনই এসব রাখিয়া এখান হইতে চলিয়া যাও—না হইলে—” বলিতে বলিতে হঠাৎ থামিয়া গেলেন। 

আগুন্তক ভয় না পাইয়া বলিল, “না হইলে কি বলুন।” 

সুরেন্দ্রনাথ দৃঢ়স্বরে বলিলেন, “গলা ধরিয়া বাহির করিয়া দিব।” 

আগুন্তক ধীর ভাবে বলিলেন, “ইহা আপনার পক্ষে যুক্তিযুক্ত নয়, তাহা হইলে আমি বরাবর থানায় গিয়া এ সকল জমা দিব। এখন তাহাই আমার কর্ত্তব্য।” 

ক্রোধে সুরেন্দ্রনাথের মুখখানা লাল হইয়া গেল। তিনি বলিলেন, “তাহাতে আমি ভয় করি না, তুমি নিশ্চয়ই এ পকেট-বই আমার পকেট হইতে চুরি করিয়াছিলে। চল থানায়, তোমাকে ধরাইয়া দিব। 

আগন্তুক গম্ভীর ভাবে সংক্ষেপে কহিল, “দিতে পারেন।” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “সামান্যের জন্য আমি পুলিশ হাঙ্গামা করিতে চাই না–যাও, উহাতে যে টাকা আছে, লইয়া যাও—পাঁচশত টাকায় আমায় কিছু যায় আসে না।” 

আগুন্তক কহিল, “সত্য, কিন্তু আমি বিপদে পড়িতে পারি। এখন দেখিতেছি, এসব পুলিশে পৌঁছইয়া দেওয়াই আমার পক্ষে ভাল।” 

সুরেন্দ্রনাথ সভয়ে কহিল, “তাহা হইলে তুমি পুলিশে যাইবে?” 

“হাঁ, তা না গিয়া আর করি কি, আগে নিজেকে বাঁচাইতে হইবে, তাহারা আপনার পকেট-বই নোট সবই ফেরৎ দিবে। যেরূপ দেখিতেছি, তাহাতে আমার সঙ্গেই আপনার যাওয়া ভাল।” 

সুরেন্দ্রনাথের মুখ আরও বিশুষ্ক হইল। তিনি কম্পিত কণ্ঠে বলিলেন, “আমি পুলিশে যাইব কেন? আমার অনেক কাজ—এই সব হাঙ্গামা করিয়া সময় নষ্ট করিতে পারি না। তোমাকে ত বলিলাম, তুমি এ নোট কয়খানা লইতে পার।” 

আগন্তুক বলিয়া উঠিল, “না—না—এমন কথা মুখেও অনিবেন না; টাকার প্রত্যাশায় এত কষ্ট করিয়া এখানা আপনাকে ফেরৎ দিতে আসি নাই—আমি টাকার প্রত্যাশী নই; গরীব লোক বটে, তবে অধর্ম্মের পথে যাই না। আমার মতে আমার সঙ্গে আপনার থানায় যাওয়াই উচিত।” 

“বৃথা –অনর্থক—” সুরেন্দ্রনাথ আরও কি বলিতে যাইতেছিলেন। বাধা দিয়া আগুন্তক কহিল, “যাহা বিবেচনা করেন। আমি চলিলাম।” 

এই বলিয়া আগন্তুক যাইতে উদ্যত হইল। কয়েক পদ গিয়া ফিরিয়া বলিল, “তাই ত—ইহার ভিতর অনেক গোল আছে, ছবিখানার জন্যই যত গোল—পুলিস এই খুনের জন্য আপনার বিষয় আমাকে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিবে; আমি আপনার বিষয় কি জানি—আপনি যখন যাইতেছেন না—কিন্তু তাহারা নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকিয়া পাঠাইবে।” 

এ কথা শুনিয়া সুরেন্দ্রনাথের মুখ একেবারে পাংশুবর্ণ হইয়া গেল; তিনি কি বলিতে গেলেন, মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। 

আগন্তুক ধীরে ধীরে বলিল, “এইজন্যই বলিতেছিলাম যে, আমার সঙ্গে যাওয়াই ভাল।” 

সুহাসিনীর মা এই সকল দেখিয়া-শুনিয়া নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনিও বলিলেন, “যাও সুরেন্দ্রবাবু, তুমি নিজেই গিয়া গোলমাল মিটাইয়া এস।” 

সুরেন্দ্রনাথ এবারও কথা কহিতে পারিলেন না। সুহাসিনীর মা বলিলেন, “এখনই গাড়ী ঠিক করিতে বলিতেছি।” 

আগন্তুক বলিলেন, “আমি একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ীতে আসিয়াছি, ইনি তাহাতেই যাইতে পারেন; আপনাদের গাড়ী জুতিতে দেরি হইবে।” 

সুরেন্দ্রনাথ এবার কথা কহিলেন; “চল, আমি তোমার সঙ্গে যাইতেছি।” সুরেন্দ্রনাথ কাতর ভাবে সতৃষ্ণনয়নে সুহাসিনীর দিকে চাহিলেন। দেখিলেন, তাহার বিশালায়ত চোখ দুটি অশ্রুস্নাত হইয়া ছল্ ছল করিতেছে। দেখিয়া হৃদয়ে বড় বেদনা পাইলেন। 

বুঝিলেন যে, সুহাসিনীও হৃদয়ে বড় ব্যাথা পাইয়াছে। 

তিনি আর কোন কথা না কহিয়া আগন্তুকের সহিত নীরবে গিয়া গাড়ীতে উঠিলেন। তিনি নিজের মানসিক উত্তেজনায় এতই পীড়িত হইয়া পড়িয়াছিলেন যে, আগন্তুক কোচম্যানকে কোথায় যাইতে বলিল, তাহা তিনি শুনিতে পাইলেন না। 

অল্পক্ষণ পরে তিনি বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখিলেন; দেখিলেন যে, গাড়ীখানা একটা জঙ্গলের মধ্যেবর্তী পথ দিয়া যাইতেছে–সে পথে জন মানব নাই। 

আগন্তুক বলিল, ‘এ সব জায়গায় বিশ্বাস নাই—অনায়াসেই মারিয়া ধরিয়া সর্ব্বস্ব কাড়িয়া লইতে পারে।” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “ভয় নাই, আমারে পকেটে রিভলবার আছে।” 

“ভাল, ভাল—তবে দুইটি স্ত্রীলোক—একটি ভাবী স্ত্রী, অপরটি তাঁহারই জননী—এ স্থলেও দেখা করিতে আসিতে হইলে পিস্তল সঙ্গে আনিতে হয়—ভাল—সাবধানের মার নাই; বোধ হয়, সৰ্ব্বদাই অনেক টাকা কড়ি থাকে, কাজেই এ রকম সাবধানে আসিতে হয়। আমাদের এক পয়সাও টেকে নাই—কাজেই এ সব দরকারও হয় না; তবে আজ সঙ্গে পাঁচশত টাকা আছে, তা থাক সে টাকাগুলি আমার নয়। বাবা! পাঁচশত টাকা—এক সঙ্গে কখনও দেখি নাই।” 

“আমার কথা শুনিলে তোমারই লাভ –তোমারই হইত। তোমার বয়স হইয়াছে, কথাটা বুঝিয়া দেখ।”

“আগেও যাহা বলিয়াছি—এখনও তাহাই। রামকান্ত কর্ত্তব্য করিতে পয়সার প্রত্যাশা করে না।” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “রামকান্ত! কর্ত্তব্য কি? কিসের কর্তব্য?” 

“আমার নাম ঐ-ই বটে—ঘরে অনেকগুলি ছেলে মেয়ে—এক রকম দুঃখে-কষ্টে তাহাদের খাওয়াইয়া বাঁচাইয়া রাখিয়াছি—” 

(বাধা দিয়া) “সেই জন্যই ত আমি বলিতেছি, একখানা নোট তুমি লইয়া, না হয়, দুইখানাই লও–আমার টাকার অভাব নাই।” 

“না—না—অমন কথা মুখে আনিবেন না—গরীব বটে—“ 

“তবে থাক্”, বলিয়া সুরেন্দ্রনাথ বিরক্তভাবে অন্যদিকে মুখ ফিরাইলেন; এ লোকটার সঙ্গে আর বকাবকি করিয়া অনর্থক মেজাজ খারাপ করিবেন না, ইহাই স্থির করিলেন। 

কিন্তু রামকান্ত তাহা চাহে না, সে আপনা আপনি বলিল, “এত টাকা হারাইলে আমি তখনই পুলিশে খবর দিতাম।” 

সুরেন্দ্রনাথ কথা কহিলেন না। 

রামকান্ত বলিল, “না, বোধ হয় এই ছবিখানা থাকার জন্য চুপ্ করিয়া গিয়াছিলেন—হ্যাঁ, 

পুলিশের কাণ্ড—বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা।” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “কেন, ছবি পকেটে রাখা কি বে-আইনী?” 

“না, তা নয়—তবে এই ছবিখানা সম্বন্ধে একটু গোলযোগ আছে; যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে—যাহার বিষয় পুলিশ কিছুই তদন্ত করিতে পরিতেছে না—সেইজন্য এ ছবিখানা আপনার কাছে আছে জানিলে—বুঝিতেই পারিতেছেন?” 

সুরেন্দ্রনাথ কোন কথা কহিলেন না। 

রামকান্ত বলিল, “আপনাদের মত বড় লোকের এই সকল হাঙ্গামায় পড়াই লজ্জার কথা; বিশেষতঃ শীঘ্রই আপনার বিবাহ হইবে, তাঁহারাও খুব বড় লোক।” 

সুরেন্দ্রনাথ ভাবিলেন, “এই লোকটা আমাকে হাতে পাইয়া আমার নিকট হইতে কিছু বেশি আদায় করিবার চেষ্টা পাইতেছে—দেখা যাক্, কি বলে।” প্রকাশ্যে বলিলেন, হাঁ তুমি যাহা বলিয়াছ, তাহা ঠিক—এসব গোলযোগের মধ্যে যাইবার আমার ইচ্ছা নাই; এইজন্যই তোমাকে পুলিসে যাইতে বারণ করিতেছিলাম; হয় ত আমার বিবাহেও গোল হইতে পারে—তাহাই তোমাকে বলিতেছিলাম যে, পকেট-বইখানাতে যাহা আছে, তাহা সব তুমি লও।” 

“অবশ্য ছবিখানা নয়?”

“হাঁ, ছবিখানা তোমার কোন উপকারে আসিবে না। আমি নিজে গরীব লোক নই, তাহার পর বিবাহ করিলে আমি আরও অনেক টাকা পাইব; সুতরাং আমার টাকার অভাব নাই; তুমি ছেলে-পিলে লইয়া কষ্ট পাইতেছে—আচ্ছা উহাতে যাহা আছে, তাহার তিন গুণ তোমাকে দিতে প্রস্তুত আছি।” 

“তাহা হইলে দেড় হাজার টাকা—একদম বড়লোক।” 

“হাঁ, টাকা আমার কাছে নাই, আমি ঠিকানা দিয়া যাইতেছি, কাল ছবিখানা লইয়া গেলেই টাকা দিব।”

“তাহা হইলে আপনি কাল আর হাজার টাকা মাত্র আমকে দিবেন; কারণ পাঁচশত টাকা ত এখানেই পাইতেছি।” 

“তুমি কি তবে পুরোপুরি দুই-হাজারই টাকা চাও?” 

“তাই ত দুই হাজার টাকা—ওঃ! মাথার ভিতর গোলমাল হইয়া গেল যে—আচ্ছা মশাই, আমাকে ভাবিতে একটু সময় দিন।” 

রামকান্ত বহুক্ষণ কথা কহে না দেখিয়া সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তাহা হইলে রাজী হইলে, গাড়ী আর পুলিশে লইয়া যাইবার আবশ্যক নাই—আমার বাড়ীতে চল। তুমি বাড়ী দেখিয়া যাইবে কাল আমি সেই টাকা দিব।” 

“হাঁ, এ কথা সবই ঠিক; তবে কথা হইতেছে, ছবিখানার জন্য আমি বিপদে পড়িব।” 

“কেন, তুমি যদি বল ত তোমার সম্মুখেই ছবিখানা ছিঁড়িয়া পুড়াইয়া ফেলি—ও ছবিখানা আমার কোন দরকার নাই।” 

“না, ভাবিয়া দেখিলাম, এই ছবিখানা যে এই পকেট-বইয়ে ছিল, তাহা যখন অনেকে জানিয়াছে, তখন ইহা লইয়া আমি পুলিস হাঙ্গামায় পড়িব। দুঃখিত হইলাম, আপনার এমন সুবিধাজনক প্রস্তাবেও সম্মত হইতে পারিলাম না।” 

সহসা রামকান্তের কপালের উপর এক পিস্তল ধৃত হইল—সুরেন্দ্রনাথ পিস্তল ধরিয়াছেন; বজ্ররবে বলিলেন, “ছবিখানা এখনই দাও—না হইলে এখনই গুলি করিয়া মারিব।” 

রামকান্ত অবিচলিতভাবে বলিলেন, “বাপু হে! নিজেরই কাজটা নিজেই মাটি করিতেছ। কথাটা আগে শোন, তার পর আবশ্যক হয়, আমার মাথার খুলিটা উড়িইয়া দিয়া মজা দেখিয়ো। পিস্তল ছুড়িলে উপকার কিছুই হইবে না—পিস্তলের শব্দ হইবামাত্র কোচম্যান গাড়ী থামাইবে—চারিদিক হইতে লোক জমিবে—আপনি পালাইতে পারিবেন না। পুলিশ আমাকে চেনে—মৃত স্ত্রীলোকের ছবি পাইলে আর একটা খুন অধিকন্তু চাপিবে—বুঝিলেন মশাই?” 

সুরেন্দ্রনাথ আর কোন কথা কহিলেন না। গাড়ীখানা লালবাজারের পুলিশে আসিয়া থামিল। রামকান্ত বলিলেন, “এইবার গাত্রথান করুণ।” 

চারিদেকে পুলিস, পাহারাওয়ালা, সার্জ্জন, ইনস্পেক্টর দেখিয়া তখন সরেন্দ্রনাথের চৈতন্যেদয় হইল। তখন তিনি বুঝিলেন যে, ছবিখানি তাঁহার নিকট থাকায় তাঁহাকে খুনী বলিয়া ইহারা ধরিয়া আনিয়াছে। মনে করিলেন, পালাইতে হইবে; গাড়ীর অপর দ্বার দিয়া পলাইবেন, মনে করিয়া সেইদিকে সরিয়া বসিলেন; কিন্তু দেখিলেন, দরজা জুড়িয়া এক স্থূলকায় জমাদার ‘মূর্তিমান ব্যোমের’ মত দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। 

রামকান্ত বলিলেন, “আসুন, না ধরিয়া নামাইতে হইবে?” 

সুরেন্দ্রনাথ দেখিলেন, পলাইবার আর কোন উপায় নাই—তখন তিনি স্পন্দিতহৃদয়ে কম্পিত পদে গাড়ী হইতে নামিলেন। এবং পকেটের মধ্যে হাত পুরিয়া দিলেন। 

রামকান্ত বলিলেন, “ব্যস্ত হইবেন না, আপনার রিভলবারটি আপনার পকেটে আর নাই—আমি সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছি; আমি বুঝিয়াছিলাম, ঐ ক্ষুদ্র যন্ত্রটি দিয়া আপনি নিজের অনিষ্ট করিতে পারেন, সেইজন্য সরাইয়া রাখিয়াছি। ভাল করি নাই কি?” 

সুরেন্দ্রনাথ কোন কথা কহিলেন না, হতবুদ্ধি হইয়া গিয়াছিলেন। ক্ষণপরে বলিলেন, “আমাকে কোথায় লইয়া যাইতেছ?” 

“বড় সাহেবের কাছে।” 

“তাহা হইলে তুমি — “ 

“ডিটেক্‌টিভ দারোগা—রামকান্ত।” 

সুরেন্দ্রনাথ তাহাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইলেন; রামকান্ত সরিয়া দঁড়াইয়া বলিল, “বাপু হে, গোল করিলে তোমারই অনিষ্ট; আমরা আপনার যথেষ্ট সম্ভ্রম রক্ষা করিতেছি—এখন ভাল মানুষের মত বড় সাহেবের কাছে চলুন।” 

গোলযোগ করা বৃথা ভাবিয়া সুরেন্দ্রনাথ হতাশচিত্তে রামকান্তের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের বড় সাহেবের নিকট চলিলেন। পাছে, তিনি পলাইবার চেষ্টা করেন বলিয়া দুইজন জমাদার তাঁহার পশ্চাতে চলিল। জমাদারের নিকটে তাঁহাকে রাখিয়া রামকান্ত সাহেবের ঘরে প্রবেশ করিলেন। 

সাহেব বলিলেন, “নতুন কিছু আছে?” 

“হুজুর অনেক।” 

“শীঘ্র বল, আমি এখন বড় ব্যস্ত আছি।” 

রামকান্ত পকেট-বই বাহির করিয়া সাহেবের সম্মুখে ধরিল। 

সাহেব বলিলেন, “এ কি?” 

“হজুর দেখুন।” 

“সাহেব বলিয়া উঠিলেন, “সেই মৃত স্ত্রীলোকের ছবি—কোথায় পাইলে?” 

“এই পকেট-বুকে—একজন কাল এই পকেট-বইখানা চুরি করিয়াছিল, সে তখনই ধরা পড়ে।” বাধা দিয়া সাহেব কঠিন কণ্ঠে বলিলেন, “আর এখন তুমি সেই কথা বলিতে আসিয়াছ? তখনই তাহাকে আমার কাছে আনা উচিত ছিল।” 

“ছিল, কিন্তু পকেট-বই যাহার, তাহার সন্ধানে গিয়াছিলাম।” 

“তুমি এবারেও তাহাকে পলাইতে দিয়াছ; তোমার বিষয় আমি অক্ষয়বাবুর কাছে সব শুনিয়াছি; তোমার মত রাস্কেলের পুলিসে চাকরী করা চলিবে না। যত দিন যাইতেছে, তুমি যেন তত ছেলে মানুষ বনিয়া যাইতেছ।” 

“হুজুর, তাহার নাম ঠিকানা আমি পকেট-বইয়ে পাইয়া তাহার সন্ধানে গিয়াছিলাম।” 

“তাহা ত শুনিয়াছি—তাহার বাড়ীতে পাহারা রহিয়াছে কি না?” 

“পাহারার দরকার নাই, তাহাকে সঙ্গে করিয়া আনিয়াছি।” 

“এই সুরেন্দ্রনাথকে?” 

“হাঁ, হুজুর।” 

“তবে ভালই হইয়াছে, তুমি একা এ সকল করিয়াছ?” 

“হাঁ হুজুর, কৃতান্তবাবু এ সম্বন্ধে কিছুই করেন নাই। ইহাকে কি রূপে গ্রেপ্তার করিলে আমায় সব বল।”

“ইহাকে বরাহনগরে একটা বাগান-বাড়ীতে পাইলাম—এই বাড়ীর ঠিকানা এই পকেট-বইখানিতে ছিল। সেখানে সুহাসিনী নামে একটি মেয়ে আছে, তাহার সহিত ইহার বিবাহ হইবার কথা স্থির হইয়া গিয়াছে। সেখানে গিয়া ইহার সহিত দেখা করি, তাহার পর অনেক কৌশলে ইহাকে সঙ্গে আনিয়াছি।” 

“লোকটা যদি দোষী হইত,তাহা হইলে সহজে আসিত না।” 

“দোষী, এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই—এই লোক যে বাগবাজারের সেই খুনের বাড়ীতে আমার চোখে ধূলা দিয়া পলাইয়াছিল, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই। হাহার চেহারা আমার খুব মনে আছে।” 

“তা হইলে তোমাকে দেখিয়া নিশ্চয়ই চিনিতে পারিত।” 

“না, আমাকে চিনিতে পারে নাই। আমি সেদিন ছদ্মবেশ ধারণ করিয়াছিলাম।” 

“আচ্ছা, তাহাকে এইখানে লইয়া এস।” 

১৯ 

রামকান্ত গমনে উদ্যত হইলে সাহেব বলিলেন, “তুমি ইহার জন্য পুরস্কার পাইবে।” 

রামকান্ত বলিলেন, “হুজুর, এ সব আমাদের কর্তব্য কাজ, আপনি সন্তুষ্ট হইলেই আমাদের যথেষ্ট হইল।” 

“এ লোকটার বয়স কত?” 

“বাইশ-তেইশ বৎসর হইবে।” 

“এত টাকার নোট যাহার সঙ্গে থাকে, সে নিশ্চয়ই বড় লোক; সুতরাং বড় বড় উকিল কৌসিলী দিয়া নিজের পক্ষ-সমর্থন করিবে। কৃতান্তবাবু কাজের লোক—সে এ বিষয়ে অনেক সন্ধান করিতে পারিবে। সম্ভবতঃ সে দোষ স্বীকার করিবে—দেখা যাক্।” 

“আমি কি এখানে উপস্থিত থাকিব?” 

“না, আমি একা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিতে চাই।”

“হুজুর, অনুমতি তিনটা বিষয় বলিতে পারি।” 

“বল, তোমার সকল কথা আমি আগে শুনিতে চাই।” 

“প্রথম—সে আমাকে দুই হাজার টাকা ঘুস দিতে চাহিয়াছিল।”

“কি জন্য?” 

“তাহাকে ছাড়িয়া দিলে, আর ছবিখানা ফেরৎ দিলে।” 

“বটে, হাঁ বুঝা যাইতেছে।” 

“তাহার পর সে আমায় গুলি করিবার চেষ্টা করিয়াছিল; তখন তাহাকে উত্তমরূপে বুঝাইয়া দিলাম যে, ইহাতে তাহার উপকার হইবে না তাহাই নিরস্ত হইয়াছিল।” 

“তাহা হইলে এই লোকটাই খুনী।” 

“তাহার পর এখানে গাড়ী হইতে নামিয়া পকেটে পিস্তল খুঁজিতে ছিল—খুব সম্ভব আত্মহত্যা করিত।”

“পিস্তল ইহার কে লইল?” 

“আমি ভাব বুঝিয়া আগেই ইহার পকেট হইতে পিস্তল তুলিয়া লইয়াছিলাম।” 

সাহেব হাসিয়া বলিলেন, তোমার এত বুদ্ধি আছে, তাহা আগে জানিতাম না।”

রামকান্ত পিস্তলটি সাহেবের টেবিলের উপর রাখিলেন। সাহেব বলিলেন, “আমি তোমার উপর বিশেষ সন্তুষ্ট হইয়াছি। যাও তাহাকে এখানে লইয়া এস।” 

পরক্ষণেই সুরেন্দ্রনাথ সাহেবের কাছে নীত হইলেন। রামকান্ত তাঁহাকে সাহেবের সম্মুখে রাখিয়া বাহিরে গেল। সাহেব কিয়ৎক্ষণ সুরেন্দ্রনাথকে নিরীক্ষণ করিলেন; তৎপরে সম্মুখস্থ এখখানি চেয়ার দেখাইয়া দিয়া বলিলেন, “বসুন।” 

সুরেন্দ্রনাথ কোন কথা না কহিয়া বসিলেন। সাহেব কিয়ৎক্ষণ তাঁহাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলেন না; একদৃষ্টে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। অনেকক্ষণ পরে তিনি ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আমার একজন কর্মচারী কেন আপনাকে আমার কাছে আনিয়াছে, তাহা কি আপনি জানেন?” সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “হাঁ, মহাশয়, আশ্চর্য্যের বিষয়, এইরূপ সামান্য প্রমাণে—কেবল সন্দেহের উপর নির্ভর করিয়া আপনার কর্ম্মচারী একজন ভদ্রলোককে গ্রেপ্তার করিয়াছে।” 

সাহেব বলিলেন, “আপনি গ্রেপ্তার হইয়াছেন, মনে করিবেন না, তবে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর, আপনার কাছে একটি হত-স্ত্রীলোকের ছবি পাওয়া গিয়াছে—এ ছবিখানি কোথায় পাইয়াছিলেন, এখানি আপনার কাছে কেন আছে, কতদিন আছে, এ সকল বুঝাইয়া দিলেই আপনি স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইতে পারিবেন।” 

সুরেন্দ্রনাথ অবিচলিতভাব রক্ষা করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা পাইয়া বলিলেন, “আপনি যে এ ভাবে কথা কহিতেছেন, ইহাতে আমি বিশেষ সুখী হইলাম।” 

“আপনি বোধ হয়, শুনিয়াছেন যে, একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছে; কেহ তাহার বুকে ছোরা মারিয়া তাহাকে খুন করিয়াছে। এই স্ত্রীলোক সম্বন্ধে আমরা কোন কথা জানিতে পারি নাই। এই হত স্ত্রীলোকের ছবি আপানার পকেট-বইয়ে পাওয়া গিয়াছে; সুতরাং আপনি এই ছবি কোথায় পাইলেন, কিরূপে পাইলেন, এ সকল কথা আমরা যে আপনাকে জিজ্ঞাসা করিব, ইহা আশ্চর্য্য নয়। যদি আপনি ছবিখানি কাহার নিকট পাইয়া থাকেন, তাহা হইলে তাহার সম্বন্ধে আপনি যাহা জানেন, আমাকে বলিলে আমি বিশেষ বাধিত হইব।” 

“আপনার ভুল হইতেছে—আমি এই স্ত্রীলোককে চিনি না।” 

“আশা করি, একটু বিবেচনা করিয়া কথা বলিবেন। আপনি যাহাকে আদৌ চিনেন না, তাহার ছবি আপনার নিকট কেন আসিবে? তবে হইতে পারে, আপনার কোন বন্ধু এই ছবিখানি আপনাকে দিয়াছিলেন; তাহা হইলে সেই বন্ধুর নাম আমাদের বলিয়া দিলেই সমস্ত গোল চুকিয়া যায়।” 

“কেহ আমাকে এ ছবি দেয় নাই।” 

“তাহা হইলে কেমন করিয়া—” 

“ক্ষমা করিবেন, আপনার লোক নিশ্চয়ই আপনাকে বলিয়াছেন, তাহারা কিরূপে এই পকেট-বইখানি পাইয়াছে।” 

“বলিয়াছে, একজন চোর আপনার পকেট হইতে বইখানি তুলিয়া লইয়াছিল—সে ধরা পড়িয়াছে।”

“হাঁ, তাহাই ঠিক—এই চোরই এ ছবি আমার পকেট-বইয়ে রাখিয়াছিল। আমার পকেট-বইয়ে এ ছবি ছিল না।” 

“হাঁ, আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা সম্ভব কিনা তাহা আপনি ভাবিয়া দেখুন। ইহা কি সম্ভব যে, চোর ছবিখানি আপনার পকেট-বইয়ে রাখিবে? তাহার পর আপনার পকেট হইতে এই বইখানি তুলিয়া লইবার পরেই সে ধরা পড়ে? সুতরাং ইহার ভিতরে ছবিখানি রাখিবার সে আদৌ সময় পায় নাই।” 

“এ বিষয়ে তবে আমি আর কি বলিব? 

“ছবিখানি ভাল করিয়া দেখিয়াছেন?”

“না, ভাল করিয়া দেখি নাই।” 

“দেখুন দেখি, ইহার নীচে কি লেখা আছে।” 

সুরেন্দ্রনাথ দেখিলেন, ছবিখানার নীচে স্ত্রীলোকের হস্তক্ষরে লিখিত রহিয়াছে, “ভুল না আমায়।” মুহুর্ত্তের জন্য সুরেন্দ্রনাথের মুখ শুকাইয়া এতটুকু হইয়া গেল, তাহা সাহেব লক্ষ্য করিলেন। 

সাহেব তাঁহার প্রতি তীক্ষ্ণদৃষ্টি করিয়া বলিলেন, “আপনি কি তবে বলিতে চাহেন, যে স্ত্রীলোকটি খুন হইয়াছে, তাহার ন্যায় সুন্দরী যুবতী একটা কুৎসিত হিন্দুস্থানী চোরের প্রেমে পড়িয়া এই ছবিখানি তাহাকে দিয়াছিল? তাহার পর স্বহস্তে লিখিয়াছে, ‘ভুলোনা আমায়’; বরং কোনটা সম্ভব যে, আপনার ন্যায় সুপুরুষ সুশিক্ষিত যুবককে এই ছবিখানি দিবে?” 

“ইহা কি কেবল অনুমান নহে? এ ছবি আজ আমি প্রথম দেখিয়াছি।” 

“সম্ভব, আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ভাল বিবেচনা করিয়াই বলিতেছেন। আপনি নিশ্চয়ই কেবল কৌতূহলের বশবর্ত্তী হইয়া মৃত স্ত্রীলোকের ছবি লালদীঘিতে দেখিতে গিয়াছিলেন।” 

“ভিড় দেখিয়া কি ব্যাপার দেখিতে গিয়াছিলাম।” 

“ভিড় দেখিলেই কি আপনি ভিড়ের মধ্যে যাইয়া থাকেন?” 

“তাহা ঠিক নয়।” 

“পাঁচশত টাকার নোট পকেটে করিয়া ভিড়ের ভিতরে গেলেন?”

“আমি একছড়া হার কিনিতে যাইতেছিলাম।” 

‘কোন দোকানে?” 

“রাধাবাজারে।” 

“আপনি থাকেন কোথায়?” 

“বহুবাজারে।” 

“তবে রাধাবাজার ছাড়াইয়া লালদীঘিতে আসিয়াছিলেন কেন?”

সুরেন্দ্রনাথ এই প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত হইলেন; বলিলেন, “হাঁ, মনে পড়িয়োছে—জেনারেল পোস্ট অফিসে একখানা জরুরি চিঠি ফেলিতে গিয়াছিলাম।” 

“তখন এরূপ পোষাক আপনার ছিল না।“ 

সুরেন্দ্রনাথ এবার প্রকৃতই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেন; কি বলিলেন—ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। সাহেব বলিলেন, “অস্বীকার করিবেন না, আমার দারোগা আপনাকে লক্ষ্য করিয়াছিল; আপনি একজন গরীব লোকের ন্যায় মলিনবেশে সেখানে গিয়াছিলেন।” 

“হাঁ, তাড়াতাড়ি বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছিলাম, কাপড় ছাড়িতে ভুলিয়া যাই।” 

‘পাঁচশত টাকা দামের হার কিনিতে যাইতেছেন, আর কাপড় ছাড়িতে ভুলিয়া গেলেন?” 

সুরেন্দ্রনাথ কোন উত্তর করিলেন না। কি উত্তর করিবেন? তিনি উকিল—বুঝিলেন, এ অবস্থায় যাহা তিনি বলিবেন, তাহা তাঁহারই বিরুদ্ধে যাইবে। 

সাহেব আবার কিয়ৎক্ষণ তাঁহাকে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দেখিতে লাগিলেন। পরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “মহাশয়, আপনি যে পথ অবলম্বন করিয়াছেন, তাহা যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে আপনি যে কোন কথা স্বীকার করিতেছেন না, তাহার কারণও আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি—আপনি ভদ্রলোক—বড়লোক—পুলিস হাঙ্গামায় মিশিতে ইচ্ছা নাই। তবে ইহাও কি সুশিক্ষিত ভদ্রলোকের কর্তব্য নয় যে, যাহাতে অপরাধী ধরা পড়িয়া উপযুক্ত দন্ড পায়, সে জন্য একটু চেষ্টা করা? সুতরাং আমি আশা করি, আপনি সত্যকথা আর গোপন করবেন না, সমস্ত আমাকে খুলিয়া বলিবেন। 

সুরেন্দ্রনাথ কোন উত্তর করিলেন না। 

সাহেব বলিলেন, “আপনি সতকথা না বলিলে বা গোপন করিলে আপনাকেই আমরা খুনী বলিয়া বিবেচনা করিব।” 

এবার সুরেন্দ্রনাথ কথা কহিলেন; বলিলেন, “আপনাকে আমার কিছু বলিবার নাই। আমি নিদোষী—আপনার যাহা অভিরুচি করিতে পারেন।” 

সাহেব সুরেন্দ্রনাথের এই দৃঢ়তা দেখিয়া কিয়ৎক্ষণ আবার নীরবে রহিলেন। অবশেষে ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার নাম কি?” 

“সুরেন্দ্রনাথ বসু।” 

“আপনি কি করেন?” 

“ওকালতি করি।” 

“ওঃ উকিল! কোথায় ওকালতী করেন?”

“হাইকোর্টে।” 

“আপনি নতূন উকিল হইয়াছেন দেখিতেছি।” 

“হাঁ, এই এক বৎসরমাত্র হইয়াছি।” 

কোথায় আপনি থাকেন?”

“আমি বহুবাজারে থাকি।” 

সাহেব ঘন্টায় আঘাত করিলেন। অমনি রামকান্ত ছুটিয়া আসিল। সাহেব বলিলেন, “অক্ষয়বাবু আছেন?”

“হাঁ, তিনি আছেন।” 

“আসিতে বল।” 

তৎক্ষণাৎ অক্ষয়কুমার আসিলেন। ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে, সাহেব তাঁহাকে সব বুঝাইয়া দিয়া বলিলেন, “ইহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া ইহার বাড়ী খানা তল্লাসী করুন।” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “তাহা হইলে আমি এই খুনের জন্য গ্রেপ্তার হইয়াছি?” 

সাহেব বলিলেন, “না, এখনও হয়েন নাই—তবে আপনি সমস্ত কথা খুলিয়া না বলিলে আমি আপনাকে গ্রেপ্তার করিতে বাধ্য হইব।” 

অক্ষয়কুমার সুরেন্দ্রনাথকে লইয়া গমনে উদ্যত হইলে, সাহেব বলিলেন, “না এ নামের কোন লোককে আমি চিনি না।” 

সুরেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমারের সহিত প্রস্থান করিলেন। 

বাহিরে আসিয়া অক্ষয়কুমার একখানা গাড়ী ভাড়া করিলো। সেই গাড়ীতে উভয়ে উঠিলে অক্ষয়কুমার রামকান্তকে বলিলেন, “তুমিও সঙ্গে এস।” রামকান্ত গাড়ীতে উঠিল। 

তাঁহারা সকলে বহুবাজারে আসিলেন। গাড়ী আসিয়া সুরেন্দ্রনাথের দ্বারে থামিল। 

সুরেন্দ্রনাথের বাড়ীটা ছোট হইলেও বেশ সুসজ্জিত। নীচে সুরেন্দ্রনাথের আফিস ঘর—ভাল টেবিল, চেয়ার, ঘড়ীতে সজ্জিত –দুইটি ভাল আলমারীতে স্বর্ণাক্ষররঞ্জিত আইন পুস্তকাবলী। 

নীচের সমস্ত ঘর দেখিয়া অক্ষয়কুমার, রামকান্ত ও সুরেন্দ্রনাথকে লইয়া উপরে আসিলেন। উপরেও সমস্ত গৃহ তন্ন তন্ন করিয়া দেখা হইল। তখন সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনার সমস্ত দেখা শেষ হইয়াছে?”

অক্ষয়কুমার বলিলেন, “হাঁ, আর কিছু দেখিবার নাই।” 

তিনি ফিরিতেছিলেন, এই সময় রামকান্ত তাঁহার গা টিপিল। অক্ষয়কুমার দাঁড়াইলেন। রামকান্ত একটা ক্ষুদ্র দ্বার দেখাইয়া দিল। 

অক্ষয়কুমার বলিলেন, “এই দ্বারের পশ্চাতে একটা ঘর আছে বলিয়া বোধ হয়।” 

সুরেন্দ্রনাথ যেন একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইলেন; বলিলেন, “একটা ছোট ঘর আছে—বাজে জিনিসপত্র ওখানে আছে—পড়োঘর বলিলেও চলে।” 

“দেখিতে ক্ষতি কি, ইহার দ্বারে চাবী দিয়া রাখিয়াছেন কেন?” 

“এ ঘরে বিশেষ কোন দরকারী জিনিস নাই বলিয়া চাবী দিয়া রাখিয়াছি।” 

“বটে, অ-দরকারী বাজে জিনিসের জন্য লোকে চাবী দিয়া রাখে! কই চাবী একবার দেখি।”

সুরেন্দ্রনাথ কম্পিতহস্তে চাবীটা দিলেন, তাহা অক্ষয়কুমার লক্ষ্য করিলেন; রামকান্তও দেখিল—মনে মনে বলিল, “এখানে এবার তিন নম্বর লাস না বাহিরে হয়।” 

অক্ষয়কুমার চাবী খুলিলেন; রামকান্ত দ্বার ঠেলিয়া খুলিয়া ফেলিল। তাঁহারা গৃহমধ্যে গিয়া দেখিলেন, মোটেই অব্যবহাৰ্য্য দ্রব্য সেখানে নাই—গৃহটি সুন্দর, সুসজ্জিত—মধ্যেস্থলে একখানি টেবিল, ঐ টেবিলের দুইপার্শ্বে দুইখানি সুন্দর চেয়ার-টেবিলের উপর কতকগুলি তাস—দেখিলেই বোধ হয়, দুই ব্যক্তি নিৰ্জ্জনে এই গৃহমধ্যে তাস খেলিতেছিল। 

অক্ষয়কুমার ও রামকান্ত এই সকল দেখিয়া বিশেষ বিস্মিত হইলেন। কিয়ৎক্ষণ উভয়ে নীরবে দঁড়াইয়া রহিলেন। তৎপরে অক্ষয়কুমার তাসগুলি তুলিয়া লইয়া এক একখানি করিয়া দেখিতে লাগিলেন, তন্মধ্যে ইস্কাবনের টেক্কাখানি নাই।