প্রতীজ্ঞা পালন – ২০

২০ 

রামকান্ত ইহা দেখিয়া আনন্দোজ্জ্বল দৃষ্টিতে অক্ষয়কুমরের দিকে চাহিল। অক্ষয়কুমার ভ্রূকুটি করিলেন। তৎপরে তিনি গৃহ হইতে বাহির হইয়া সুরেন্দ্রনাথকে বলিলেন, “এই কি আপনার বাজে জিনিস-পত্ররের ঘর? চলুন।” 

সুরেন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনারা কি আমাকে এই খুনের জন্য গ্রেপ্তার করিলেন?” 

অক্ষয়কুমার বলিলেন, “সাহেবের নিকট চলুন, সকলই জানিতে পারিবেন। 

“আমার বাড়ীতে কি পাহারা রাখিবেন?” 

“নিশ্চয়, আপনি উকিল লোক, আপনাকে সকল কথা বুঝাইয়া বলিতে হইবে না।” 

অগত্যা সুরেন্দ্রনাথ বাধ্য হইয়া অক্ষয়কুমারের সহিত আবার লালবাজারে আসিলেন। প্রথমে অক্ষয়কুমার সাহেবের নিকট গেলেন, পরক্ষণে সুরেন্দ্রনাথের ডাক হইল। 

তিনি উপস্থিত হইলে সাহেব বলিলেন, “এখন কি আপনি দোষ স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছেন?” সুরেন্দ্রনাথ কহিলেন না। 

সাহেব বলিলেন, “আপনি বৃথা আমাদিগকে কষ্ট দিতেছেন।” 

সুরেনন্দ্রনাথ বলিলেন, “আপনারা সম্পূর্ণ ভুল বুঝিতেছেন। কষ্ট আমিই পাইতেছি; এই স্ত্রীলোককে আমি জানি না, কখনও চোখে দেখি নাই—আপনারা বৃথা আমায় ধৃত করিতেছেন।” 

“এ সকল বিচারালয়ে বলিবেন।” 

“তাহা হইলে আপনারা কি আমাকে ধৃত করিলেন?” 

“হাঁ, উপায় নাই।” 

“জামীন দিবেন না?”

“খুনী মোকদ্দমায় কি জামীন হয়? আপনি উকীল, ইহা অবগত আছেন। 

“তাহা হইলে আমার পিতাকে সংবাদ দিতেও কি অনুমতি দিবেন না?” 

“হাঁ, ইহা অবশ্যই দিব—বলুন আপনার পিতার নাম কি? কোথায় তিনি থাকেন?” 

“তাঁহার নাম গোবিন্দরাম চন্দ্র বসু, মাণিকতলায় থাকেন।” 

“আপনার পিতার নাম কি বলিলেন?” 

“গোবিন্দরাম বসু।” 

সাহেব বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, “মাণিকতলায় থাকেন গোবিন্দরাম—যিনি পুলিসে পূর্ব্বে কাজ করিতেন?” 

“হাঁ, তিনিই আমার পিতা।” 

সাহেব অক্ষয়কুমারের দিকে চাহিলেন, “আপনার পিতাকে আমরা সকলেই বিশেষ সম্মান করিয়া থাকি—সুতরাং আপনার এ অবস্থা ঘটায় আমরা সকলেই বিশেষ দুঃখিত হইলাম; তাঁহার বৃদ্ধ বয়সে যে মনোকষ্ট হইল, ইহাতে আমরা সকলেই বিশেষ দুঃখিত—কি করিব উপায় নাই। আমি এখনই তাঁহাকে সংবাদ দিব।” 

সুরেন্দ্রনাথ হাজতে প্রেরিত হইলেন। অক্ষয়কুমার ও রামকান্ত বাহির হইয়া আসিলেন। রামকান্ত দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া দুঃখিত ভাবে বলিল, “এমন জানিলে কে এ কাজে হাত দিত? গোবিন্দরাম আমাকে মানুষ করিয়াছিলেন—আর আমিই তাঁহার ছেলেকে ফাঁসীকাঠে ঝুলাইতে ধরিয়া আনিলাম—ইহা অপেক্ষা আমার মৃত্যু হইল না কেন?”

সেই দিন সন্ধ্যার প্রক্কালে একখানি গাড়ী আসিয়া গোবিন্দরামের বাড়ীর দ্বারে লাগিল। দুইটি স্ত্রীলোক গাড়ী হইতে নামিয়া দ্রুতপদে বাটি মধ্যে প্রবেশ করিলেন। তাঁহাদের দেখিয়া গোবিন্দরাম অগ্রসর হইলেন। আসিয়াছিলেন সুহাসিনী ও সুহসিনীর মা। সুহাসিনীর মা ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “সুরেন্দ্রনাথ এখানে আছে?” তাঁহার ভাব দেখিয়া গোবিন্দরাম বলিলেন, “কেন, সে নিশ্চয়ই আদালত হইতে বাসায় এতক্ষণে ফিরিয়াছে।” 

“তবেই সৰ্ব্বনাশ হইয়াছে!” 

“কেন কি হইয়াছে?” 

“বাসায় সে নাই।” 

“তবে কোন কাজে বাহিরে গিয়াছে—এখনই ফিরিবে।” 

“না, সকালে সে আমাদের বাড়ী গিয়াছিল, তাহার পর আর বাসায় যায় নাই।”

“কে বলিল?” 

“লোক পাঠিইয়াছিলাম।” 

“তা হয় ত অন্য কোন বন্ধুর বাড়ী নিমন্ত্রণ ছিল, সেখান হইতে আদালতে গিয়াছে—আপনি এত ব্যাকুল হইতেছে কেন? সৰ্ব্বনাশ হইয়াছে!” 

“কি হইয়াছে, সকল বলুন।” 

সুহাসিনীর জননী প্রাতে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল, সমস্ত গোবিন্দরামকে বলিলেন। শুনিয়া গোবিন্দরাম বলিলেন, “তাহার সহিত সুরেন্দ্রনাথের যাওয়া উচিত হয় নাই। সে লোকটার চেহারা কেমন?”

“এই সাধারণ লোকের মত।”

“পুলিসের লোক নয় ত?”

“কেমন করিয়া বলিব?” 

এই সময়ে ভৃত্য আসিয়া একখানা কাগজ গোবিন্দরামের হাতে দিল। গোবিন্দরাম কাগজখানি দেখিয়া বলিলেন, “হাঁ, আপনাররা অপেক্ষা করুন, বোধ হয়, এখনই তাহার সংবাদ পাইব। পুলিসের একটি লোক আমার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছেন।” 

এই বলিয়া গোবিন্দরাম তাড়াতাড়ি বাহিরের ঘরে আসিলেন। দেখিলেন, অক্ষয়কুমার আসিয়াছেন। তিনি তাঁহার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তাহা হইলে সত্য সত্যই আমার ছেলে গ্রেপ্তার হইয়াছে?” 

অক্ষয়কুমার বলিলেন, “তাহা হইলে আপনি শুনিয়াছেন?”

“অনুমান মাত্র—কেন ধৃত হইয়াছে জানি না।“ 

অক্ষয়কুমার কি বলিবেন, স্থির করিতে না পারিয়া ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন। 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “বল না—দেখিতেছ না, আমি কত কষ্ট পাইতেছি? সে আমার একমাত্র পুত্র-জীবনের অবলম্বন—কি অপরাধে তোমরা তাহাকে ধৃত করিয়াছ?” 

অক্ষয়কুমার, গোবিন্দরামের প্রাণে আঘাত লাগিবার ভয়ে কিছুই বলিতে পারিলেন না। গোবিন্দরাম বলিলেন, “তবে কি তুমি অক্ষয়, আমাকে বৃথা কষ্ট দিতে আসিয়াছ?” 

অক্ষয়কুমার বলিলেন, “আপনি বাগবাজারের সেই খুনের কথা শুনিয়াছেন?” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “হাঁ, কি হইয়াছে?” 

অক্ষয়কুমার বলিলেন, “সেই খুনের জন্য আপনার পুত্র গ্রেপ্তার হইয়াছেন।” 

গোবিন্দরাম কয়েক মুহুৰ্ত্ত কোন কথা কহিলেন না। অক্ষয়কুমার বুঝিলেন, তিনি প্রাণে নিদারুণ আঘাত পাইয়াছেন। 

কিয়ৎক্ষণ নীরব থাকিয়া গোবিন্দরাম ধীরে ধীরে বলিলেন, “তোমারা তাহার বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই প্ৰমাণ পাইয়াছ।” 

“হাঁ, তিনি ছদ্মবেশে লালদীঘিতে সেই মৃত স্ত্রীলোকের ছবি দেখিতে গয়িছিলেন। সেই খানে একটা চোর তাঁহার পকেট হইতে তাঁহার পকেট-বই তুলিয়া লয়; সেই পকেট-বহির ভিতরে এই মৃত স্ত্রীলোকের ছবি পাওয়া গিয়াছে; তাঁহাকেই আমরা বাগবাজারের বাড়ীতে রাত্রে দেখিয়াছিলাম—আমাকে ছোট ঘরে বন্ধ করিয়া পলাইয়া যান—তাহার পর রামকান্তকে পুলিসের লোক বলিয়া নিজের পরিচয় দিয়া চলিয়া যান, রামকান্ত তাঁহাকে চিনিয়াছে।” 

“আমার পুত্র সব স্বীকার করিয়াছে?” 

“না, তিনি সব অস্বীকার করেন; বলেন ছবি তাঁহার পকেট-বইয়ে ছিল না—সেই চোরটা তাহা রাখিয়াছিল।” 

“এইমাত্র?” 

“না, একখানা চিঠির খাম বাগবাজারে বাড়ীতে আমরা পাইয়াছিলাম, সেখানা তাঁহার হাতে লেখা।”

“ইহাও অনুমান।” 

“না, অনায়াসেই তাহা সপ্রমাণ হইবে। তাহার পর তাঁহার বাসা খানা-তল্লাশী করায় একটা ঘরে কতকগুলি তাস পাওয়া গিয়াছে—তাহার ভিতরে ইস্কাবনের টেক্কাখানি নাই।”

“ইহাও প্রকৃষ্ট প্রমাণ নহে।“ 

“আরও আছে, তিনি রামকান্তকে ছবিখানার জন্য দুই হাজার টাকা ঘুস দিতে চাহিয়াছিলেন; তাহার পর ছবিখানি পাইবার জন্য তাহাকে গুলি করিতেও উদ্যত হইয়াছিলেন, শেষ নিজেও আত্মহত্যা করিতে চেষ্টা করেন।” 

গোবিন্দরাম কোন উত্তর না দিয়া কিয়ৎক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিলেন। অবশেষে ধীরে ধীরে বলিলেন, এরূপ অবস্থায় তাহাকে ধৃত করিয়া যে আপনারা অন্যায় করিয়াছেন, এ কথা আমি বলিতে পারি না; তবে ইহাও বলি, সে নির্দোষী—সুরেন্দ্রনাথ কখনই এরূপ কাজ করিতে পারে না; একথা আমি জোর করিয়া বলিতেছি—আর ইহা আমি সপ্রমাণ করিব।” 

“ভগবান করুন, তাহাই হউক-আমরা এ ব্যাপারে সকলেই দুঃখিত হইয়াছি।” 

“কে তাহাকে গ্রেপ্তার করিয়াছে?”

“রামকান্ত।” 

“ওঃ! সে অনেকদিন আমার সঙ্গে কাজ করিয়াছে, আমি তাহার সহিত দেখা করিয়া সকল শুনিব। কবে বিচার আরম্ভ হইবে?” 

“কাল ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির হইবেন।” 

‘কাল কলিকাতাশুদ্ধ লোক জানিবে, আমার ছেলে খুনী; তাহার বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ হইয়াছে, স্বীকার করি; তবুও আমি বলিতেছি, সে নিদোষী।” 

“ভগবান তাহাই করুন। আমরা সকলে তাহাই চাই।” 

“আমি জানি, তোমরা সকলেই আমাকে সম্মান কর। এখন এই হাবাই কেবল বলিতে পারে, খুনী কে? আমি সাহেবকে যেরূপ যুক্তি দিয়াছিলাম, তাহাতেই বেশ বুঝিতে পারা গিয়াছে এই হাবা এই শহরের লোক নয়। এ হাবা কোথাকার লোক, তাহাই আমাকে প্রথমে অনুসন্ধান করিতে হইবে।” 

“আমরা সে চেষ্টায় আছি।” 

“কৃতান্তকুমার আমার ছেলের ধৃত হওয়া সম্বন্ধে কিছু করিয়াছে?” 

“না, কিছু নয়—বরং তিনি এ কথা শুনিয়া বিশেষ দুঃখিত ও বিস্মিত হইয়াছেন।” 

‘এই পর্যন্ত্য—এখন আমি তাহাকে নির্দোষী সপ্রমাণ করিব—আমি জানি, সে কখনই এরূপ ভয়ানক কাজ করিতে পারে না।”

অক্ষয়কুমার প্রস্থান করিলেন। গোবিন্দরাম প্রত্যাবর্তন করিয়া সুহাসিনীর জননীকে বলিলেন, “ভুলক্রমে সুরেনকে পুলিসে ধরিয়াছে, কোন ভয় নাই—সে শীঘ্রই মুক্তি পাইবে।” 

তাঁহারা কিছু আশ্বস্ত হইয়া গৃহে ফিরিলেন। 

২১ 

সুরেন্দ্রনাথ, গোবিন্দরামের একমাত্র পুত্র। অতি শৈশবে মাতৃহীন হওয়ার পর পিতাই তাঁহাকে মানুষ করিয়াছেন। তাঁহার এরূপ বিপদে পিতা হৃদয়ে যে গুরুতর আঘাত পাইলেন, তাহা বর্ণনাতীত; তবে গোবিন্দরাম নিজ মনোভাব প্রকাশ করিবার লোক ছিলেন না—তাঁহার প্রাণের যাতনা বাহিরে কেহই জানিতে পারিল না। 

সুরেন্দ্রনাথকে পুলিস যে ভুলক্রমে ধৃত করিয়াছে, ইহা তাঁহার দৃঢ় বিশ্বাস; সুরেন কখনও এরূপ ভয়াবহ কাজ করিতে পারে না; তিনি পুলিসের এ ভ্রম দূর করিবেন। প্রথমে তিনি পুত্রের সহিত দেখা করিবার ইচ্ছা করিলেন। ভাবিলেন, “সে পুলিসের কাছে কোন কথা না বলুক, আমার কাছে কিছুই গোপন করিবে না। তাহার মুখে সকল শুনিলেই সব বুঝিতে পারিব—গোলযোগও তখনই মিটিয়া যাইবে।” 

তিনি পরদিবস প্রাতেই পুলিস-কমিসনার সাহেবের সহিত দেখা করিতে চলিলেন। পুলিস-অফিসে আসিয়া প্রথমেই তিনি রামকান্তকে দেখিতে পাইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া রামকান্ত বড় লজ্জিত হইল। এক সময়ে সে গোবিন্দরামকে গুরু বলিয়া কত সম্মান করিয়াছে, আর সে-ই আজ তাঁহার একমাত্র পুত্রকে খুনের দায়ে ধৃত করিল। সে কিরূপে গোবিন্দরামকে মুখ দেখাইবে? 

রামকান্তের মনের অবস্থা বুঝিয়া গোবিন্দরাম তাহাকে আশ্বস্ত করিবার জন্য বলিলেন, “কাল আমার ছেলেকে ধরিয়াছ বলিয়া লজ্জিত হইতেছ? ইহাতে আমি তোমার উপর অসন্তুষ্ট হই নাই; না ধরিলে তোমার কর্তব্য কার্য্যে অবহেলা করিতে—তবে এটাও স্থির, তুমি ভুল বুঝিয়াছ, তাহাতেও তোমার দোষ নাই— তোমার উপরওয়ালারাও তোমারই মত ভুল বুঝিয়াছেন।” 

রামকান্ত বলিল, “আমি আপনাকে কি বলিয়া মুখ দেখাইব, তাহাই ভাবিতেছিলাম—” 

“না— না—ইহাতে লজ্জার বিষয় কি আছে? আমি আমার ছেলের সঙ্গে এখনই দেখা করিব; তাহার পর গোলই মিটিয়া যাইবে। সাহেব কোথায়?” 

“সাহেব আপনার ছেলেকে ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট লইয়া গিয়াছেন—এখনই ফিরিবেন।” 

“এত তাড়াতাড়ি কেন?” 

“চব্বিশ ঘন্টার অধিক ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে না লইয়া গিয়া আসামী কিরূপে রাখিবেন?” 

“হাঁ, সে কথাও ঠিক।” 

“এই যে সাহবে আসিয়াছেন।” গোবিন্দরাম সাহেবের সম্মুখীন হইলে সাহবে সমাদরে তাঁহার কর মৰ্দ্দন করিয়া বলিলেন, “আপনার এ বিপদে আমরা সকলেই বিশেষ দুঃখিত হইয়াছি।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “সকল গোলযোগই মিটিয়া যাইবে—আমার ছেলে এরূপ ভয়ানক কাজ করিতে পারে না—কখন করেও নাই।” 

“আমরা ইহাতেই সকলে সন্তুষ্ট হইব। তবে প্রমান বড় কঠিন—” 

“ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে কি বলিল?” 

“সেই এক কথা—চোর তাহার পকেট-বইয়ে ছবিখানা রাখিয়াছিল।” 

“তাহাই সম্ভব।” 

“না, সম্পূর্ন অসম্ভব, চোর পকেট-বইখানা তুলিয়া লইবার একটু পরেই ধরা পড়ে—সুতরাং সে ছবি কখন পকেট-বইয়ে রাখিবে? সে-ও বলে যে, সে ছবিখানা দেখে নাই—পকেট-বইয়ে যে ছিল, তাহাও জানে না।” 

“আমার ছেলে বলিতেছে যে, মৃত স্ত্রীলোকটিকে সে একেবারেই চিনে না।”

“হাঁ, কিন্তু কাজটা ভাল হইতেছে না, কিছু না বলা—চুপ করিয়া থাকা মানেই একরূপ দোষ স্বীকার করা।” 

“ইহার কোন মানে নাই।”

“অক্ষয়কুমার বাগবাজারের বাড়ীতে রাত্রে লুকাইয়া ছিলেন। সেই বাড়ীতে রাত্রি বারোটার সময় একটি লোক আসে; সে বিনোদিনী নামে এই হত স্ত্রীলোককে ডাকিয়াছিল। কাজেই অক্ষয়কুমার তাঁহার মুখ যদিও তখন দেখিতে পান নাই, তাঁহার কন্ঠস্বর শুনিয়াছিলেন। তিনি বলেন যে, সেই লোকটার কন্ঠস্বর আপনার ছেলের কন্ঠস্বর এক; কেবল ইহাই নহে—রামকান্ত ইহার সহিত কথা কহিয়াছিলেন; সে-ও বলে যে, আপনার ছেলে সেই লোক। তাহার পর এই ছবি—স্ত্রীলোকের বাড়ীতে যে একখানা খাম পাওয়া গিয়াছে, তাহাও আপনার ছেলের হাতের লেখা; সুতরাং এমন প্রমান সত্ত্বেও ইনি বলিতেছেন যে, স্ত্রীলোকটিকে আদৌ চিনেন না—জানেন না—ইহা কি যুক্তিসঙ্গত। সেইখানে একজন মুদী আছে, সে-ও বলিতেছে যে, সুরেন্দ্রনাথ বাবুকে সে দুই-একবার এই বাড়ীতে আসিতে দেখিয়াছে।” 

“আমি কি একবার তাহার সহিত দেখা করিতে পাইব?” 

“হাঁ, তাহা আপনি অবশ্যই পাইবেন, তবে—” 

“বুঝিয়াছি, আপনি উপস্থিত থাকিবেন; তবে একটা অনুরোধ, আপনি পার্শ্বের একটা ঘরে থাকিয়া আমাদের কথাবার্তা শুনিবেন, কারণ প্রকাশ্যভাবে আপনারা কেহ উপস্থিত থাকিলে হয়ত সে কোন কথা বলিবে না।” 

“গোবিন্দরামবাবু, আপনি যাহা করিতে ইচ্ছা করিতেছেন, তাহাতে গুরুতর আশঙ্কার সম্ভবনা আছে, তাহা অবশ্যই আপনি বুছিতেছেন।” 

“হাঁ, তাহা আমি জানি। যদি সে আমার নিকটে দোষ স্বীকার করে—আর আপনি তাহা শুনিতে পান, তাহা হইলে তাহার রক্ষাপাইবার আর কোনই উপায় থাকিবে না; তথাপি জানিয়া-শুনিয়াই আমি এ কাজ করিতেছি, কারণ আমার স্থির বিশ্বাস, আমার পুত্র খুন করে নাই।” 

“এরূপ অবস্থায় আমি আর কি বলিব?” 

“তাঁহার বিরুদ্ধে প্রমাণ কতক কতক সংগ্ৰহ হইয়াছে, স্বীকার করি—তবে তাহার স্বপক্ষে সুবিধাজনক কি কি প্রমাণ আছে, যদি আপনার আপত্তি না থাকে, জানাইলে বিশেষ বাধিত হইব।” 

“তাঁহার স্বপক্ষে আমি বেশী কিছু আমি দেখিতেছি না; তবে সে লোকটা রামকান্তকে একখানা পুলিসের কার্ড দেখাইয়াছিল—আপনার ছেলের নিকটে বা তাঁহার বাড়ীতে এরূপ কোন কার্ড পাওয়া যায় নাই।” 

“হাঁ, এই একটা।” 

“তাহার পর এই হাবা, যদি সে তাঁহাকে চিনিতে না পারে, তাহা হইলে অনেকটা তাঁহার পক্ষে সুবিধা হইবে; আর যদি চিনিতে পারে, তাহা হইলে বুঝিতেই পারিতেছেন।” 

“হাবা ইহাকে চিনিতে পারিবে না—আমার ধ্রুব বিশ্বাস। এখনও আপনারা সেই হাবাকে তাহার সম্মুখে আনেন নাই কেন?”

“আজ বা কাল আনিব। কথা হইতেছে, জেলে দুইজনকে সম্মুখীন করাইব না। এখানে না আদালতে, কি হাকিমের সম্মুখে—কোথায় দেখা করান যুক্তিসঙ্গত, এ বিষয়ে আমি কৃতান্তকুমারের সহিত পরামর্শ করিব, মনে করিয়াছি।” 

“কৃতান্তকুমার! তিনি কি মোকদ্দমায় আছেন?” 

“হাঁ, আপনিই ত তাঁহার কথা বলিয়াছেন।” 

“হাঁ, মনে পড়িয়াছে—তাঁহার সঙ্গে একবার দেখা হয় না?”

“তিনি এখনই এখানে আসিবেন; বেলা হইতেছে চলুন।”

তখন গোবিন্দরাম সাহেবের সহিত হাজতের দিকে চলিলেন। 

২২

গোবিন্দরামকে একটি গৃহমধ্যে রাখিয়া সাহেব অগ্রসর হইলেন। 

সুরেন্দ্রনাথকে একটি সতন্ত্র ঘরে আনা হইল; সেখানে আর যাহারা ছিল, সাহেব সকলকে সরাইয়া দিলেন। তাহার পরে গোবিন্দরামকে সেই ঘরে পাঠাইয়া দিয়া নিজে পার্শ্ববর্তী একটা ঘরে উপস্থিত রহিলেন। তিনি যেখানে দাঁড়ালেন, সেখান হইতে পিতা পুত্রের সমস্ত কথা বেশ স্পষ্ট শুনিতে পাওয়া যাইবে। 

গোবিন্দরাম পুত্রের অবস্থা দেখিয়া নিতান্ত বিচলিত হইয়া পড়িলেন; কিন্তু অতি কষ্টে হৃদয়ের ভাব উপশমিত করিলেন। 

পিতাকে দেখিয়া সুরেন্দ্রনাথের মুখ লজ্জায় ও দুঃখে আরক্তিম হইল। তিনি অবনতমস্তকে নীরবে বসিয়া রহিলেন। মস্তক তুলিয়া পিতার দিকে চাহিয়া দেখেন, এমন সাহস তখন তাহার ছিল না। 

গোবিন্দরাম ধীরে ধীরে বলিলেন, “সুরেন, এখন তুমি পুলিসের লোকের সম্মুখে বা হাকিমের সম্মুখে নও—আমাকে সব খুলিয়া বল; আমার কাছে কোন কথা গোপন করিয়ো না—আমি বুঝিয়াছি, ইহারা ভুল করিয়া তোমাকে এই খুনের মোকদ্দমায় জড়াইতেছে।” 

পুত্রের মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। পুত্র ধীরে ধীরে জড়িতকণ্ঠে বলিলেন, “বাবা, আমার কিছুই বলিবার নাই—যাহা বলিবার ছিল, ইহাদের বলিয়াছি; নিশ্চয়ই আপনি তাহা শুনিয়াছেন।” 

গোবিন্দরাম পুত্রের মুখে এ কথা শুনিবার আশা করেন নাই। তিনি বিস্মিত ও স্তম্ভিত ভাবে পুত্রের নিকট হইতে দুই পদ সরিয়া দাঁড়াইলেন; ক্ষণপরে বলিলেন, “খুনী বলিয়া তুমি ধরা পড়িয়াছ—তোমার বাপের কাছেও এ অবস্থায় কিছু বলিবার নাই? এ কথা মিথ্যাকথা—ঘোর মিথ্যাকথা—ইহা প্রমাণ করিবার চেষ্টা করা কর্ত্তব্য নয়?”

“যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছি—ইহারা কোন কথাই শুনে না।” 

“অবশ্যই শুনিবে, তুমি বাগবাজারের সেই বাড়ীটায় কখনও গিয়াছ?” 

সুরেন্দ্রনাথ নীরবে রহিলেন। 

গোবিন্দরাম ব্যাকুলভাবে বলিলেন, “এ বয়সে আমাকে কষ্ট দেওয়াই কি তোমার ইচ্ছা?” 

সুরেন্দ্রনাথের চক্ষু জলে পূর্ণ হইয়া আসিল। তিনি বাগসংরুদ্ধকণ্ঠে বলিলেন, “বাবা, আমাকে কি করিতে বলেন, আমার যাহা কিছু বলিবার ছিল, বলিয়াছি।” 

“তাহা তুমি বলিতে চাও যে, ছবিখানা সেই চোর তোমার পকেট-বইয়ে রাখিয়াছিল?” 

“হাঁ”। 

“ছদ্মবেশে তুমি সেই মৃত স্ত্রীলোকের ছবি দেখিতে গিয়াছিলে কি জন্য?” 

“ভিড় দেখিয়া গিয়াছিলাম।” 

“তোমার বাসায় যে তাসগুলি পাওয়া গিয়াছে, তন্মধ্যে একখানা নাই—ইস্কাবনের টেক্কাখানি নাই।”

“হারাইয়া গিয়াছিল—সেইজন্য কি আমি খুনী?”

“যে খাম ইহারা পাইয়াছে, তাহাতে তোমার হস্তাক্ষর।” 

“ইহারা ভুল করিতেছে, আমার লেখা নহে; আমার মত বটে।” 

“ইহাদের একজন ইনস্পেক্টর সেই বাড়ীতে তোমার কন্ঠস্বর শুনিয়াছিল—একজন দারোগা তোমাকে দেখিয়াছিল।” 

“ইহারা ভুল করিয়াছে—আমি সেই লোক নহি।”

গোবিন্দরাম কিয়ৎক্ষণ নীরবে থাকিয়া বলিলেন, “তোমাকে সন্দেহ করিবার অনেক প্রমাণ পাইয়াছে, স্বীকার করি; কিন্তু আমি তোমাকে রক্ষা করিব—এই খুনের রহস্য ভেদ করিব। আমি জানি, আমার সুরেন কখনও এরূপ কাজ করিতে পারে না; তুমি বোধ হয়, জান না যে, আমি এক সময়ে—”

“জানি।” 

“কিরূপে জানিলে? আমি তোমায় কখনও বলি নাই।” 

“না, আপনার কাগজ-পত্রের ভিতরে একখানা পুলিসের কার্ড পাইয়াছিলাম।” 

২৩ 

সহসা সম্মুখে বিনামেঘে বজ্রাঘাত হইলেও গোমিন্দরাম বোধ হয়, এতটা বিস্মিত হইতেন না। প্রকৃতই তিনি পুত্রের মুখে কার্ডের কথা শুনিয়া যেন বজ্রাহত হইলেন। তবে—তবে সুরেন্দ্রনাথ আগা গোড়াই মিথ্যাকথা বলিতেছে—তাহা হইলে সে এই কার্ডই সেদিন রামকান্তকে দেখাইয়াছিল—কি ভয়ানক! 

কিয়ৎক্ষণ গোবিন্দরাম কথা কহিতে পারিলেন না। তৎপরে প্রায় রুদ্ধকন্ঠে বলিলেন, “সে কার্ড কি করিয়াছ?” 

“সেইখানেই পুড়াইয়া ফেলিয়াছিলাম।” 

গোবিন্দরাম সবলে নিশ্বাস ফেলিলেন। তৎপরে ধীরে ধীরে বলিলেন, “বোধ হয় তুমি শুনিয়াছ, স্ত্রীলোকটির মৃতদেহ যে বাক্সের ভিতরে পাওয়া গিয়াছে, ঐ বাক্সটা একটা হাবালোক মাথায় করিয়া লইয়া যাইতেছিল; এই হাবা নিশ্চয়ই খুনীকে চেনে। 

“এই হাবাকে আমার সম্মুখে আনিলেই ত হয়; আমি কোন হাবাকে চিনি না।” 

“আমি এ কথা নিশ্চিত জানি, তোমাকে না চিনিতে না পারিলে কাজ অতি সহজ হইয়া আসিবে। যাহাতে আজই হাবাকে তোমার কাছে আনা হয়, তাহা আমি করিব। আমি জানি, আমার ছেলে কখনই এরকম ভয়াবহ কাজ করিতে পারে না। ভয় নাই, তুমি শীঘ্রই মুক্তি পাইবে। সুহাসিনী ও তাহার মা ব্যাকুল হইয়া আমার কাছে কাল ছুটিয়া আসিয়াছিলেন—আমি তাঁহাদের আশ্বস্ত করিব।” 

সুরেন্দ্রনাথ কোন কথা কহিলেন না। গোবিন্দরাম বাহির হইয়া আসিলেন। সাহেবও বাহির হইলেন। গোবিন্দরাম বলিলেন, “সকল শুনিতে পাইয়াছেন?” 

“হাঁ, কিন্তু ইহাতে আপনার ছেলে যে নিদোষী, তাহা প্রমাণ হইতেছে না, বরং তিনি একটা গুরুতর বিষয় স্বীকার করিলেন।” 

“বুঝিয়াছি, কার্ডের বিষয়—কার্ড পুড়াইয়া ফেলিয়াছিল।” 

“হাঁ, ইহা স্বীকার করি—এখন হাবার উপর অনেকটা নির্ভর করিতেছে; হাবা যদি সুরেন্দ্রনাথকে চিনিতে না পারে—” 

“বা চিনিতে পারিল না বলিয়া ভাণ করে, তাহা হইলে কতকটা তাহার পক্ষে যাইবে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই।” 

“তাহা হইলে আজই এই কাজটা করুন।” 

“হাঁ, তাহাই করিব—এই যে কৃতান্তবাবু আসিয়াছেন।” 

কৃতান্তকুমার, গোবিন্দরামকে সসম্মান-সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, “আপনার পুত্রের বিপদের কথা শুনিয়া যার-পর নাই দুঃখিত হইয়াছি। কৰ্ত্তব্যে ব্যাঘাত না পায়, ইহা করিয়া আপনার পুত্রকে নিরপরাধ সপ্রমাণ করিতে আমি প্রাণপণে চেষ্টা করিব।” 

গোবিন্দরাম কৃতান্তের সৌজন্যে বিশেষ মুগ্ধ হইয়া বলিলেন, “আমি জানি, আপনারা সকলেই আমাকে বিশেষ অনুগ্রহ করেন।” 

সাহেবে কৃতান্তকুমারের দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আমি হাবাকে সুরেন্দ্রনাথের সম্মুখে আজই লইতে চাহি; তবে কথা হইতেছে যে, তাহাদের দুইজনকে এখানে আনিব—না জেলে দেখা করাইব—না আদালতে লইয়া যাইব?” 

কৃতান্তকুমার বলিলেন, “যখন অনুগ্রহ করিয়া আমাকে এ কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন, তখন আমি এই দুই একটি বিষয় বিবেচনা করিয়া দিখিতে বলি। শুনিয়াছি, এই হাবা খুব চালাক—আমি ইচ্ছা করিয়াই ইহার সম্মুখে যাই নাই। প্রথমে এ হাবা আমাকে যদি পুলিসের লোক বলিয়া চিনিতে পারে, তাহা হইলে সাবধান হইয়া যাইবে; ইহাকে দিয়া আর কোন কাজ পাইব না।” 

সাহেব বলিলেন, “হাঁ, আপনার প্রস্তাব কি শুনি।” 

কৃতান্তকুমার বলিলেন, “আমি প্রস্তাব করি যে, সুরেন্দ্রবাবুর সঙ্গে তাঁহার বাসায় এই হাবার দেখা করা ঠিক।” 

গোবিন্দরাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন, উদ্দেশ্য কি?” 

কৃতান্তকুমার বলিলেন, “সে যদি বুঝিতে পারে যে, তাহার ন্যায় তাহার মনিব সুরেন্দ্রবাবুও পুলিসে ধরা পড়িয়াছেন, তখন সে আর কিছুই বলিবে না। আরও হাবা হইয়া যাইবে। আর যদি হাবা বুঝিতে পারে যে, পুলিস এবার তাহাকে ছাড়িয়া দিয়াছে, তাহা হইলে সে অনায়াসে আমার সঙ্গে সুরেন্দ্র বাবুর বাড়ী যাইবে। এদিকে আপনারা সুরেন্দ্রবাবুকে তাঁহার বাড়ী লইয়া যাইবেন; সেখানে তাঁহাকে একা দেখিতে পাইলে হাবা আর বজ্জাতি করিবে না। যদি সুরেন্দ্রবাবুকে সে যথার্থই চিনে, তাহা হইলে ধরা পড়িবে; আর যদি না চিনে, তাহাও আমরা বেশ জানিতে পারিব—তখন সুরেন্দ্রবাবু যে নির্দোষী, তাহাতে আর কোন সন্দেহ থাকিবে না।” 

সাহেব চিন্তিতভাবে বলিলেন, “হাঁ, আপনি যাহা বলিতেছেন, তাহা ঠিক—গোবিন্দরাম বাবু কি বলেন?”

গোবিন্দরাম বলিলেন, “কৃতান্তবাবুর প্রস্তাব মন্দ নহে—এ বিষয়ে আর বিলম্ব করা কর্ত্তব্য নয়।”

সাহেব বলিলেন, “দেখিতেছেন যে, যদি কোনরূপে হাবা প্রকাশ করে যে, সে আপনার ছেলেকে চিনে, তাহা হইলে তাঁহার সমূহ বিপদ।” 

গোবিন্দরাম বলিলেন, “তাহা জানি, তবে আমি সুরেন্দ্রর নির্দোষিতা সম্বন্ধে এতই নিশ্চিত আছি যে, আমি ইহাতে ভীত হইতেছি না।” 

সাহেব কৃতান্তবাবুর দিকে চাহিয়া বলিলেন, “আপনি কিরূপ বন্দোবস্ত করিতে চাহেন?” 

“আজ বৈকালে আপনি সুরেন্দ্রবাবুকে তাঁহার বাড়ীতে লইয়া যাইবেন; অক্ষয়বাবুও থাকিবেন— গোবিন্দরাম বাবুও সেইখানে থাকিবেন।” 

“বেশ,আর হাবা সম্বন্ধে?” 

“আমি দূরে একখানা গাড়ীতে থাকিব—হাবাকে জেল হইতে এমনভাবে ছাড়িয়া দিবেন যে, সে যেন বুঝিতে পারে, যথার্থই তাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে—তখন আমি তাহাকে নিকটে আসিতে সঙ্কেত করিব; সে নিশ্চয়ই কে তাহাকে ডাকিতেছে, তাহা দেখিতে আসিবে; আমি তখন তাহাকে বুঝাইতে চেষ্টা করিব যে, আমি তাহার মনিবের লোক; তাহার পর তাহাকে গাড়ীতে তুলিয়া লইয়া সুরেন্দ্রবাবুর বাড়ীতে আনিব।” 

“জেল হইতে ছাড়িয়া দিলে সে না পালায়।” 

“না, পালাইবে কিরূপে? হাজতের সম্মুখে রামকান্ত ও শ্যামকান্ত হাজির থাকিবে; যতক্ষণ না সে আমার গাড়ীতে উঠে, ততক্ষণ তাহারা তাহার উপর দৃষ্টি রাখিবে।” 

“হইা ভাল বন্দোবস্ত—তবে তাহাদের না চিনিতে না পারে।” 

“তাহারা ছদ্মবেশে থাকিবে।” 

“আচ্ছা, এই বন্দোবস্তই ঠিক থাকিল; আমি আর অক্ষয়বাবু সুরেন্দ্রবাবুকে লইয়া তাঁহার বাড়ী যাইব। গোবিন্দরাম বাবু আপনিও সেখানে অবশ্য থাকিবেন।” 

গোবিন্দরাম এতক্ষণ চুপ করিয়া ছিলেন; বলিলেন, “নিশ্চয়ই থাকিব।” 

সাহেব বলিলেন, “আমি এখনই সব বন্দোবস্ত ঠিক করিবার জন্য হুকুম দিতেছি।” 

তখন গোবিন্দরাম অনেকটা আশ্বস্ত চিত্তে গৃহে ফিরিলেন। 

২৪

সন্ধ্যার প্রাক্কালে হাজতের দ্বার হইতে প্রায় দুই শত হস্ত দূরে একখানা গাড়ী দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। ঠিক দ্বারের সম্মুখে পথের অপর পার্শ্বে দুই ব্যাক্তি দাঁড়াইয়া ছিল। তাহারা আর কেউ নহে, পূর্ব্বপরিচিত রামকান্ত ও শ্যামকান্ত। 

রামকান্ত বলিল, এই হাবাটা আমাদের একটা অপঘাত মৃত্যু না ঘটাইয়া ছাড়িবে না, দেখিতেছি। আর আমাদের উপরওয়ালাদেরও মাথা একদম খারাপ হইয়া গিয়াছে, ক্রমাগত হাবাকে জেলে পুরিতেছে—আর ছাড়িয়া দিতেছে—হাবাই না জানি কি মনে ভাবিতেছে।” 

“কি আর বেশী ভাবিবে? যদি সে খুনের বিষয় কিছু জানে, তবে মনে মনে বুঝিতেছে যে, খুনের তদন্ত হইতেছে।” 

“কৰ্ত্তা ত গাড়ীতে আসিয়া বসিয়া আছেন দেখিতেছি—যাহাই বল, উহার সঙ্গে আমার কাজ করিতে মোটেই ইচ্ছা করে না।”

“তুমি ত কৃতান্তবাবুর উপর মোটেই সদয় নও।” 

“এই যে, আবার এইদিকেই মহাপ্রভু আসিতেছেন।” 

সত্যসত্যই কৃতান্তকুমার তাহাদের দিকে আসিতেছিলেন। তিনি নিকটে আসিয়া বলিলেন, “গাড়ী লইয়া এমন ভাবে দাঁড়াইয়া থাকা ভাল নয়। সাহেব আসামী লইয়া এইমাত্র তাহার বাড়ীতে গিয়াছেন। হাবা এখনই বাহির হইয়া আসিবে তোমরা খুব সাবধানে থাক; আমি গাড়ীখানা ঘুরাইয়া এখনই আনিতেছি— কোচম্যানকে বেশ ভাল করিয়া চিনিয়া রাখ।” 

এই বলিয়া তিনি সত্ত্বরপদে চলিয়া গেলেন। এই সময়ে একব্যাক্তি আসিয়া রামকান্তকে জিজ্ঞাসা করিল, “ঐ বাবুটি কে, মহাশয়?” 

রামকান্ত মুখখানা ভয়ানক বিকৃত করিয়া বিরক্তভাবে বলিল, “তোমার বাপু সে কথায় কাজ কি?”

“রাগ করিবেন না, ঐবাবুটি –ঐ রকম একটি বাবু একদিন আমার কাছে গিয়াছিলেন।” 

“কে হে বাপু তুমি—কোথায় থাক?” 

“আমি চন্দননগর স্টেশনে কাজ করি, আমার নাম গোপালচন্দ্র।” 

“আচ্ছা বাপু গোপালচন্দ্র, এখন এখান থেকে সরে পড় দেখি—আমাদের এখন অন্য কাজ আছে।” গোপাল অগত্যা সেস্থান পরিত্যাগ করিল। তখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছিল; তখনও রাস্তায় আলো জ্বালা হয় নাই, সুতরাং অন্ধকারটা বেশ ঘনায়মান হইয়া উঠিতেছিল, সহসা লোকের মুখ চিনিতে পারা যাইতেছিল না। 

রামকান্ত বিরক্ত হইয়া বলিল, “বেটারা করে কি—হাবাটাকে এখনও বাহির করে না কেন।” 

শ্যামকান্ত বলিল, “কৃতান্তবাবুর গাড়ী কই?” 

“ঘুরাইয়া আনিবে বলিল, ওর কান্ডই স্বতন্ত্র।” 

“এই যে গাড়ী আসিয়াছে।” 

এই সময়ে একখানা গাড়ী আসিয়া পূৰ্ব্বস্থানে দাঁড়াইল। 

রামকান্ত বলিল, “সেই গাড়ী ত হে?” 

শ্যামকান্ত বলিল, “তাহা না হইলে আর কাহার গাড়ী ওখানে দাঁড়াইবে।” 

এই সময়ে একজন পাহারাওয়ালা হাবাকে আনিয়া বাহিরে ছাড়িয়া দিল। হাবা রাস্তায় দাঁড়াইয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিল—বোধ হইল, কোথায় কোন দিকে যাইবে, তাহাই সে ভাবিতেছে। সহসা নিকটে একটা বংশীধ্বনি হইল ইহাতে রামকান্ত ও শ্যামকান্ত উভয়েই চমকিত হইয়া চারিদিকে চাহিতে লাগিল, কোনদিক হইতে শব্দ হইল, বুঝিতে পারিল না। 

হাবা বরাবর গাড়ীর দিকে যাইতে লাগিল; তৎপরে সে গাড়ীর সম্মুখে গিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। বোধহয়, ভিতরের লোক তাহাকে কি সঙ্কেত করিল, হাবা তৎক্ষণাৎ গাড়ীতে উঠিয়া পড়িল।

রামকান্ত বলিল, “এত সহজে যে এ কৃতান্তবাবুর গাড়ীতে উঠিবে, তাহা মনে করে নাই—ও দিকে দেখ, ওখানে কতকগুলি গাড়ী জমিয়াছে।” 

যথার্থই এই সময়ে তিন–চারখানা গাড়ী সেখানে জমিয়া গিয়াছিল 

রামকান্ত বলিল, “ঠিক সেই গাড়ীতে উঠিয়াছে ত?” 

শ্যামকান্ত বলিল, “হাঁ, আগে একখানা গাড়ীই দাঁড়াইয়াছিল—এগুলো এখন এল।” 

 একখানা গাড়ী এই সময়ে সবেগে চলিয়া গেল, এবং গাড়ীর ভিতর হইতে কে তাহাদের দিকে হাত নাড়িল। দেখিয়া শ্যামকান্ত বলিল, “আমাদের ছুটি হইয়াছে—এ দেখ কৃতান্ত বাবু হাত নাড়িলেন।” 

“তবে আর কি চল—তামাক খাইয়া বাঁচা যাক।” 

“কি সৰ্ব্বনাশ!” 

রামকান্ত বিস্মিতভাবে বলিল, “ব্যাপার কি!” শ্যামকান্ত দূরস্থ একখানা গাড়ী দেখাইয়া দিল। যেরূপ গাড়ীতে হাবা উঠিয়াছিল, ঠিক সেইরূপ একখানা গাড়ী তথায় দাঁড়াইয়া আছে। তবে কোন গাড়ীতে হাবা গেল? 

রামকান্ত ও শ্যামকান্ত উভয়েই মুখ শুকাইয়া গেল। তাহারা বুঝিল, তাহাদের চোখে ধূলি দিয়া হাবা পলাইয়াছে—তবুও যে গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে—সে গাড়ী যথার্থ কৃতান্ত বাবুর কিনা, ইহা দেখিবার জন্য তাহারা গাড়ীর সম্মুখবর্তী হইল। গাড়ীর ভিতরে স্বয়ং কৃতান্ত কুমার। 

তাহাদের দেখিয়া কৃতান্তকুমার বিরক্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তোমাদের হাজতের দরজায় থাকিতে বলিয়াছি—তবে এখানে আবার কি করিতে আসিয়াছি? ফেরৎ যাও, এখনই হাবা বাহির হইবে।” 

রামকান্ত রুদ্ধকন্ঠে বলিল, “হাবা —সে চলিয়া গিয়াছে—” 

কৃতান্তকুমার মহা ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “চলিয়া গিয়াছে—তোমার মাথা খারাপ হইয়া গিয়াছে—যাও, পাহারায় যাও।” 

রামকান্ত বলিল, “এই মাত্র সে একখানা গাড়ীতে উঠিয়া চলিয়া গিয়াছে।”

কৃতান্তকুমার লম্ফ দিয়া গাড়ী হইতে অবতীর্ণ হইলেন। ক্ষিপ্ত ব্র্যাঘের ন্যায় রামকান্তের গলা টিপিয়া বলিলেন, “পাজি, তুই তাহাকে পলাইতে দিয়াছিস।” 

রামকান্তও রাগত হইয়াছিল, সে কৃতান্তের হাত সরাইয়া দিয়া বলিল, “মশাই, অত গরম ভাল নয়, হাবা যদি পলাইয়া থাকে, তবে সে আমাদের দোষে নয়—আপনার দোষে।” 

কৃতান্তকুমারের মুখ ক্রোধে লাল হইয়া গেল। তিনি কাঁপিতে কাঁপিতে বলিলেন, “আবার এই কথা বলিতে সাহস করিতেছ?” 

রামকান্ত বলিল, “হাঁ,কাজেই, আপনাকে ওখান হইতে গাড়ী লইয়া যাইতে বলেছিল কে? আপনার গাড়ী থাকিলে আর অন্য গাড়ী ওখানে আসিতে পারিত না–আমাদেরও ভুল হইত না।” 

কৃতান্তকুমার বলিলেন, “আমার গাড়ী কোচম্যানকে ভাল করিয়া দেখিয়া রাখিতে বলিয়াছিলাম যে।” শ্যামকান্ত বলিল, “সে ঠিক, একে সন্ধ্যা হইয়াছে, তাহাতে সে গাড়ীখানা ও আপনার এই গাড়ীর মত ঠিক একই রকম দেখিতে।” 

কৃতান্তকুমার বলিলেন, “বুঝিয়াছি, কত টাকা পাইয়া তোমরা এ কাজ করিয়াছ?”

রামকান্ত এত রাগত হইয়া উঠিল যে, কথা কহিতে পারিল না। 

কৃতান্ত কুমার সক্রোধে বলিলেন, “গোবিন্দরাম তোমাদের কত টাকা দিয়াছে?”

এবার রামকান্ত কথা কহিল; বলিল, “গোবিন্দরাম আমাদের টাকা দিবেন কেন?” 

কৃতান্তকুমার বলিলেন, “কেন? ছেলেটিকে বাঁচাইবার জন্য। সে জানিত যে, হাবা তাহার ছেলেকে দেখিলেই চিনিবে—তখন আর তাহার রক্ষা পাইবার উপায় নাই—তাহাই সে হাবাকে সরাইয়াছে। বাপু, এই কৃতান্ত নামধারী লোকটা সব বুঝিতে পারে।” 

রামকান্ত ক্রোধে কাঁপিতেছিল; বলিল, “যদি হইার মধ্যে কোন বদমাইসী থাকে, তবে সে বদমাইসী আপনি করিয়াছেন, না হয় আমরা করিয়াছি—সাহেব তাহার বিচার করিবেন। চলুন, তাঁহার কাছে।” 

“আমিও তোমাদের ছাড়িতেছি না—এখনই গাড়ীতে উঠ।” 

রামকান্ত কোন কথা না কহিয়া গাড়ীতে উঠিল। শ্যামকান্তও তাহার অনুসরণ করিল। কৃতান্তকুমার দুইজনকে সাহেবের কাছে লইয়া চলিনে না।