প্রতীজ্ঞা পালন – ৩৫

৩৫ 

এদিকে রামকান্তও প্রাতে তাহার জিনিস-পত্রের বাক্স লইয়া বাহির হইয়াছিল। সে তাহার দ্রব্যাদি দুই এক স্থানে দুই-একটা বিক্রয় করিয়া প্রায় বেলা দ্বিপ্রহরের সময়ে শ্যামসুন্দরের বাগান বাড়ীর দ্বারে আসরি উপস্থিত হইল। সেখানে আসিয়া দেখিল, দুরে গোবিন্দরাম যাইতেছেন, রামকান্ত সে সময়ে তাঁহার সহিত দেখা করা যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করিল না। ভাবিল, “গুরুদেব কতদূর কি করিয়াছেন, তাহা সন্ধ্যার সময়ে দেখা হইলেই জানিতে পারা যাইবে।” 

রামকান্ত ধীরে ধীরে বাগানের ভিতরে প্রবেশ করিয়া চাকরদের ঘরের দিকে চলিল। বাড়ীর পশ্চাদভাগে ভৃত্যদের থাকিবার ঘর রামকান্ত সেইদিকে গেল। সেই গৃহের নিকটে আসিয়া কাহকেই দেখিতে পাইল না। সেদিকে কেহ আছে বলিয়া তাহার বোধ হইল না; তথাপি সে তাহার উপস্থিতি জ্ঞাপন করিবার জন্য গলার শব্দ করিল, তৎপরে হস্তস্থ যষ্টি দ্বারা দ্বারে আঘাত করিতে লাগিল। তখন ভিতর হইতে স্ত্রীকণ্ঠে ক্রুদ্ধভাবে কে বলিয়া উঠিল, “কে রে?” 

রামকান্ত বলিল, “ওগো আমি বাক্সওয়ালা, কিছু জিনিস বেচতে এসেছি।” 

সহসা দ্বার খুলিয়া গেল। একটি স্ত্রীলোক বাহিরে আসিল। রামকান্ত এরূপ স্ত্রীমুর্ত্তি আর কখনও দেখে নাই। যদি ডাকিনী বলিয়া সংসারে কিছু থাকে, তাহা হইলে এইখানেই তাহার আবির্ভাব হইয়াছে। মাগীটা কঠোরস্বরে বলিল, “কে তুমি—কি চাও?” রামকান্ত বিনয়নম্রস্বরে বলিল, “আপনি কিছু জিনিস কিনবেন বলে এসেছি, আপনার নাম গ্রামে অনেক শুনিয়াছি—বড় আশা করে এসেছি।” 

মাগীটা তিক্তস্বরে বলিল, “আমরা কিছুই কিনি না—আমাদের কোন জিনিস দরকার নাই।” 

রামকান্ত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইল, এরূপ স্ত্রীলোকের হাতে পড়িতে হইবে, সে তাহা আগে ভাবে নাই। তবে কি সমস্ত কাৰ্য্যই পন্ড হইল? ক্ষণপরে মস্তক মুণ্ডয়ন করিতে করিতে বলিল, “বড়—বলিতেছিলাম— বড়-বড়ই আশা করে—” 

মাগীটা ধমকাইয়া বলিয়া উঠিল, “আরে যা, দূর হ—এখনই—এখনই—” 

রামকান্ত বলিল, “আমি—আমি সব জিনিসই খুব সস্তায় বিক্রী করি, আর আমি জিনিস বেচতে আসি নি—আমার জল-পিপাসায় প্রাণ যায়—একটু জল দিলে প্রাণটা বাঁচে।” 

“এ কি জলছত্র পেয়েছ নাকি?” 

এই দুই প্রহরে, রোদে কাঠ ফাটিতেছে, কোথায় যাই—কাছে কাহারও বাড়ী নাই, আমি পয়সা দিতে রাজি আছি,”বলিয়া রামকান্ত তাহার কোমর হইতে লম্বা থলীটা সশব্দে বাহির করিল। স্ত্রীলোকটি লোলুপনেত্রে সেই থলীর দিকে চাহিল। থলীটা নাড়া পাওয়ায় দুই একবার তন্মধ্যস্থিত টাকাগুলি ঝম ঝম করিয়া উঠিল। স্ত্রীলোকটি বলিল, “হাঁ, প্রায় তিনশত টাকা আছে, যা কিছু বিক্রী হয়ে গেছে, তাই এত টাকা জমেছে; কাল কলিকাতায় গিয়ে আবার গস্ত করে বাহির হইব—আপনাদের এখানে যদি আমাকে আজ রাতটা থাকতে দেন—দেখুন, পায়ের অবস্থা, আর পা চলে না।” 

স্ত্রীলোকটা নিমেষের জন্য কি ভাবিল; তাহার পর বলিল, “আমরা এখানে কাহাকেও থাকতে দিই না—তবে দেখছি, তুমি চলতে পার না।” 

সুবিধা বুঝিয়া রামকান্ত ব্যগ্রভাবে বলিয়া উঠিল, “দেখুন না পায়ের অবস্থা, একবারেই চলতে পারছি না।” 

“দেখেছি।” 

“আর বেচবার মত বেশী কিছু নাই, আজ একটু জিরুতে পারলে শরীরটা অনেক ভাল হবে, তখন সকালেই কলিকাতায় চলে যাব।” 

“ভাল তাই হবে—তবে বাবু যেন তোমাকে দেখতে না পান।” 

“বাবু আবার কে, তিনি কোথায় থাকেন?” 

“তিনি আমাদের মনিব—ঐ বাড়ীতে থাকেন, তিনি বাজে লোকজন মোটে দেখতে পারেন না।”

“বটে, আমি তবে ওদিকে মোটেই যাব না। এখন একটু জল পেলে যে হয়—তৃষ্ণায় প্রাণ যায়।”

“যাও বাপু, ঐ ঘরে গিয়ে বসো—এখনই জল এনে দিই”, বলিয়া মাগীটা হাত নাড়িয়া সম্মুখস্থ একটি ঘর দেখাইয়া দিল। সেটা একটা ভাঙা ঘর, বোধ হয়, এক সময়ে আস্তাবল ছিল। রামকান্ত সেই ঘরের দিকে চলিল। বলা বাহুল্য, সে চক্ষু মুদিত করিয়া যাইতেছিল না—চারিদিকে বিশেষ লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছিল। যাইতে যাইতে রামকান্ত একটা ব্যাপার দেখিয়া বিস্মিত হইল। দেখিল যে, বড় বাড়ীটির ত্রিতলের ছাদে একজন লোক দাঁড়াইয়া একটা দূরবীক্ষণ দিয়া কলিকাতার পথের দিক লক্ষ্য করিয়া দেখিতেছে। দেখিয়া বুঝিয়াছিল যে, এই লোকটা লুকাইয়া দূর হইতে এই উচ্চস্থান হইতে কাহাকে লক্ষ্য করিতেছে। অবশ্যই ইহার গূঢ়তর অভিপ্রায় আছে।” 

রামকান্ত বেশ বুঝিতে পারিল যে, এ বাড়ীতে থাকিতে না পারিলে এখানকার কোন সন্ধান পাইব না, সেইজন্য সে অন্য কিছু আর ভাবিল না; সেই ভাঙা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিল। দেখিল, সেখানে একখানা অর্দ্ধভগ্ন তক্তাপোষ পড়িয়া আছে, তাহার উপর একখানা অর্দ্ধচ্ছিন্ন পুরাতন কম্বল। 

রামকান্ত তাহার বাক্সটা এক পাশে রাখিয়া বিশ্রামের জন্য শুইয়া পড়িল। সকাল হইতে রৌদ্রে ঘুরিয়া সে অত্যন্ত ক্লান্ত হইয়াও পড়িয়াছিল। বিশ্রামেও শান্তি লাভ হইল না, সেই অদ্ভুত প্রকৃতি মাগীটার কথা ভাবিতে লাগিল, মাগীটা তাহাকে প্রথমে দূর দূর করিয়াছিল, তখনই আবার তাহার টাকার থলী দেখিয়া অন্যভাব ধরিল কেন? সে একেবারে তাহাকে এখানে রাত্রিযাপন করিতে অনুমতি দিল, নিশ্চয়ই ইহার কোন মতলব আছে। যাহাই মতলব থাক, রামকান্ত কিয়ৎক্ষণ এই বাড়ীতে থাকিবে বলিয়াই অসিয়াছিল, এত শীঘ্র ও এত সহজে যে, তাহার এ উদ্দেশ্য পূর্ণ হইবে, ইহা সে কখনও ভাবে নাই। 

৩৬ 

কিয়ৎক্ষণ পর সেই মাগী রামকান্তকে জল আনিয়া দিল। তৎপরে বলিল, “এইখানে শুয়ে থাক, বাহিরে যেও না, বাবু দেখলে অনর্থ করবে।” 

রামকান্ত বলিল, “না, আমি বাহিরে যাব না, দরকার কি।” 

রামকান্ত অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত, প্রায় এক ঘটি জল খাইয়া ফেলিল, তৎপরে মুখ বিকৃতি করিয়া বলিল, “জলটা এমন বিস্বাদ কেন? বিশ্রী।” 

সে বলিল, “আমরা কুয়ার জল খাই।” 

“সেইজন্যই এমন?” 

“হাঁ, এই জল ঢেলে দিচ্ছি, ঘটিটা মেজে দাও—তুমি মুসলমান, আমি তোমাকে স্থান দিয়েছি, বাবু জানলে অনর্থ করবে।” 

“এই যে মেজে দিই, তবে সন্ধ্যার সময় কিছু মিষ্টি এনে খাব—আপনাদের কষ্ট পেতে হবে না।”

সে কথার উত্তর না দিয়া স্ত্রীলোকটি চলিয়া গেল। রামকান্ত আবার শুইয়া পড়িল। 

কিয়ৎক্ষণ পরে তাহার বড় ঘুম আসিতে লাগিল। সে মনে মনে বলিল, “কি আপদ! আমি কি এখানে ঘুমাইতে এসেছি? গুরুদেব কি বলিবেন? কোথায় সব সন্ধান লইব, না দুই চোখ ভাঙিয়া ঘুম আসিতেছে।” রামকান্ত দুই হাতে সবলে চক্ষু মার্জিত করিল, তৎপরে কষ্টে চাহিবার চেষ্টা পাইয়া বলিল, “কি মুস্কিল! চোখে যে কম দেখিতেছি।” 

সহসা একটা কথা তাহার মনে পড়িয়া গেল; তখনই সে লম্ফ দিয়া উঠিবার চেষ্টা পাইল; কিন্তু পারিল না। তখন তাঁহার সর্ব্বশরীর অবসন্ন হইয়া আসিতেছিল। 

রামকান্ত বলিয়া উঠিল, “কি ভয়ানক! কি সৰ্ব্বনাশ! মাগী আমাকে জলের সঙ্গে বিষ খাওয়াইয়াছে; ঠিক বিষ নয়, ধুতুরার বীচীর গুঁড়া খাওয়াইয়াছে, আমাকে অজ্ঞান করিবার উদ্দেশ্য—তার পর—তার পর–কি সর্ব্বনাশ, টাকাগুলি চুরি করিয়া লইবে, টাকা যায় যাক, গুরুদেবের কাজ মাটি করিলাম! বিষ হইলেই ভাল ছিল, আমার মরাই উচিত!” 

রামকান্ত উঠিবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা পাইতে লাগিল, কিন্তু ক্রমশঃ তাহার সৰ্ব্বাঙ্গ অবসন্ন হইয়া আসিতেছিল, উঠিতে পারিল না। তখন চিৎকার করিবার চেষ্টা পাইল, কিন্তু তাহার জিহ্বা শুষ্ক ও অবশ হইয়া গিয়াছিল। কথা কহিতেই পারিল না। নীরবে পড়িয়া রহিল। 

কিন্তু তাহার মানসিক শক্তি এ অবস্থায়ও বেশ প্রখর ছিল। সে ক্ষণপরে একবার বেশ শুনিতে পাইল যে, দুইজনে পাশের একটি ঘরে অনুচ্চস্বরে কথা কহিতেছে। কন্ঠস্বরে বেশ বুঝিতে পারিল, সেই দুইজনের একজন পুরুষ—একজন স্ত্রীলোক; স্ত্রীলোকটি সেই আশ্রয়দাত্রী ভয়ঙ্করী, পুরুষটি কে বুঝিতে পারিল না; ভাবিল, যে ব্যক্তি ত্রিতলের ছাদে দূরবীন দেখিতেছিল, সেই-ই হইবে। হয় ত সেই এই বাড়ীর মালিক 

পুরুষ বলিল, “এতক্ষণ তাহার আসা উচিত ছিল। বড় জালাতন করছে।” 

স্ত্রীলোক বলিল, “কাজ শেষ করবে, তার পর গাড়ী করে কলিকাতা থেকে আসবে—দেরি ত হবেই।”

“এবারও যদি না পারে? অপদার্থ অকর্ম্মার কতদিন আশায় আশায় থাকব।” 

“এ আমাদের খাওয়াচ্ছে—এর নিন্দা করো না।” 

“নিন্দা ত করব না, কবে তার টাকা যে পাব, তার কোন ঠিকানা নাই—এই আজ কাল করে কত দিন গেল।” 

“যাক, এক সময়ে পাওয়া ত যাবে –”

“তার পর আমাদেরই—তাদের রেলের উপর রাত্রে শুইয়ে আসতে হবে।” 

“কেন, রেলের আবার কেন?”

“কেন? সকলেই মকে করবে যে, তারা রেল গাড়ী চাপা পড়েছে।” 

“এখান থেকে যত শীঘ্র যেতে পারলে হয়।” 

“কত দিনে দেবে—বেটাকে আমার বিশ্বাস হয় না।”

“না—না—তা ঠিক নয়, দেবে বস কি।” 

“আর দিয়েছে।” 

“আজ ত কিছু হবে।” 

“কি সে?” 

“বাক্সওয়ালার বেটার কাছে তিনশ টাকা আছে।” 

“বটে, তার পর?” 

“জলের সঙ্গে সেই গুঁড়া খাইয়েছি, বেটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।” 

“তবে এই সময়ে—আর দেরি নয়, বেটা এসে পড়লে এ কাজটা ফেঁসে যাবে।” 

“দেখে এসো।” 

“আর দেখে কি হবে, কাজ সেরে দাও।” 

রামকান্ত সকল কথা বেশ শুনিতে পাইল, তাহার টাকা লইবার জন্য সেই মাগীটা নিশ্চয়ই তাহাকে জলের সহিত কিছু খাওয়াইয়াছে—যাহা ভাবিয়াছিল, তাহাই ঘটিল। এখন উপায়? তাহার উঠিবার ক্ষমতা নাই, নড়িবার ক্ষমতা নাই, হাত পা সরাইবারও ক্ষমতা নাই। কি সর্ব্বনাশ! চিৎকার করিায়া কাহাকে ডাকিবে, এমন ক্ষমতাও তাহার নাই। ইহারা কি তাহার প্রাণনাশ করিবে? এতদিনে এই দূরাত্মাদিগের হাতে কি প্রাণটা গেল? এমন বিপদ্ কি কখনও কাহার ঘটিয়াছে? তাহার জ্ঞান আছে, অথচ ক্ষমতা নাই—কি ভয়ানক! অসহায় ভাবে দুরাত্মাদের হাতে মরিতে হইবে। সহসা এই সময়ে কিসের একটা শব্দ হইল। বোধ হইল, যেন কে একটা বড় চাকা ঘুরাইতেছে। রামকান্ত বুঝিতে পারিল, সে যে তক্তাপোষের উপর শয়ন করিয়া আছে, তাহা নড়িতেছে; ক্ষণপরে তক্তোপোশের একদিক, উপর উঠিতে লাগিল। পরক্ষণে তাহার বোধ হইল, যেন তক্তোপোষখানা একেবারে উল্টাইয়া গেল—সে পড়িয়া গেল; কোথায় পড়িল, তাহা বুঝিতে পারিল না;বোধ হইল, যেন আকাশ হইতে নীচের দিকে যাইতেছে। 

৩৭ 

সেই সময়ে তাহার জ্ঞান লোপ পাইল। সে কোমল মৃত্তিকার উপর সবেগে পতিত হইল, তৎপরে তাহার আর কোন জ্ঞান থাকিল না। 

যখন তাহার জ্ঞান হইল, তখন সে দেখিল যে, নরম কদমের উপর মুখ গুঁজড়াইয়া পড়িয়াছে, সৰ্ব্বাঙ্গ কৰ্দ্দমাক্ত হইয়াছে; কিন্তু এখন আগেকার সেই অবসন্নতার অনেক হ্রাস হইয়াছে; ইচ্ছামত হাত পা সঞ্চালন করিতে পারিতেছে, উঠিয়া বসিতেও পারা যায়। মনে মনে বুঝিতে পারিল, অনেকক্ষণ তরল কদমের মধ্যে পড়িয়া থাকায় সেই বিষাক্ত গুঁড়ার প্রকোপটা কমিয়া গিয়াছে এবং এই কদমে আরও একটা উপকার হইয়াছে, উচ্চস্থানে হইতে সে স্খলিত হইয়া পড়িলেও তাহার শরীরে কোন স্থানে তেমন আঘাত লাগে নাই। 

রামকান্ত কতক্ষণ এখানে অজ্ঞান অবস্থায় ছিল, তাহাও স্থির করিতে পারিল না; কোথায় পড়িয়াছে, তাহাও বুঝিতে পারিল না; চারিদিকে অন্ধকার—কিছুই দেখা যায় না। সে আপাততঃ নীরব থাকাই যুক্তি-সঙ্গত মনে করিল। ভাবিল, উপরের তাহারা যদি জানিতে পারে যে, আমি মরি নাই, বাঁচিয়া আছি, তাহা হইলে অন্য উপায়ে আমাকে হত্যা করিবে, সুতরাং কোন শব্দ করা উচিত নয়। রামকান্ত কিয়ৎক্ষণ নীরবে রহিল, সে যে গৃহমধ্যে পতিত হইয়াছিল, তথায় আর কিছু আছে কিনা, তাহাই জানিবার জন্য ব্যগ্র হইল। 

প্রথম হইতেই তাহার মনে হইতেছিল, যেন কি একটা শব্দ গৃহমধ্যে হইতেছে। যেন কাহার নিশ্বাস পড়িতেছিল, অথবা যেন কোন সর্প তথায় বাহিরে হইয়াছে। 

রামকান্ত ভাবিল, “শেষে এই অন্ধকূপের মধ্যে বিখোরে প্রাণটা গেল! আমার আগেই সাবধান হওয়া উচিত ছিল—ইহারা আমাকে যাহা খাইতে দিয়াছিল, তাহা না খাওয়াই উচিত ছিল। আমি গাধা, প্রকান্ড গাধা বলিয়াই ইহাদের সন্দেহ করি নাই। যাহা হউক, বোধ হয় ভোর হইয়াছে, ঘরে একটু একটু আলো আসিতেছে, উপরে তাহা হইলে একটা জানালা কি কোন রকম খোলা জায়েগা আছে, না হইলে আলো আসিবে কোথা থেকে? আলো হইলে কোথায় আছি, দেখিতে পাইব; ইহারা ভাবিয়াছে, আমি মরিয়াছি—এখনও আশা আছে, তবে আশা ছাড়িব কেন?” এই সময়ে অতিশয় বিস্ময়ের সহিত “এ কে!” বলিয়া সত্বর উঠিয়া বসিল। 

রামকান্ত এবার স্পষ্ট মনুষ্যের নিশ্বাসের শব্দ শুনিতে পাইল; তাহার বোধ হইল, সেখানে এক কোণে ছায়ামুর্ত্তির মত যেন কে বসিয়া আছে, তাহারই নিশ্বাসের শব্দ এতক্ষণ শুনিতে পাওয়া যাইতেছিল। 

এখন তাহার সম্পূর্ণ জ্ঞান হইয়াছে, তাহার আর সে অবসন্নতা নাই। মনে পড়িল, তাহার পকেটে দিয়াশালাই আছে, সে সত্বর পকেটে হাত দিল। পকেট হইতে দিয়াশলাই বাহির করিয়া জ্বালিল। 

তখন সেই আলোকে তাহাকে দেখিয়া রামকান্ত অস্ফুট চীৎকার করিয়া উঠিল। সে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া কিয়ৎক্ষণ স্তম্ভিতপ্রায় রহিল। কে? তাহারা যাহাকে অনুসন্ধান করিতেছিল, সেই এখানে এরূপ ভাবে রহিয়াছে, লীলাকেও এই পাষণ্ডগণ এইখানেই লুকাইয়া রাখিয়াছে। 

লীলা তাহাকে চিনিতে পারিল না, ভয়ে এককোনে সরিয়া গেল। রামকান্ত আর একবার দিয়াশলাই জ্বালিল; দেখিল, তাহার আহারের জন্য কতকগুলি মুড়ি, একটা ভাঁড় ও এক কলসী জলও সেখানে রহিয়াছে। রামকান্ত বলিল, “তাহা হইলে এই অন্ধকূপ ইহাদের কয়েদখানা, এখানে আটকাইয়া রাখিবার ব্যবস্থা—এই অন্ধকূপের মধ্যে ফেলিয়া মারিবার ইচ্ছা ইহাদের নয়। এখন তাহা হইলে আটকাইয়া রাখিবে, প্রয়োজন মত ব্যবস্থা করিবে।” 

রাত্রে সেই মাগী ও আর একটা লোক যে কথাবাৰ্ত্তা কহিতেছিল, তাহা এখন তাহার স্পষ্ট মনে পড়িল ইহারা বলিয়াছিল যে, এইখানে কাহাদের হত্যা করিয়া পরে রেল লাইনে ফেলিয়া আসিবে; লোকে ভাবিবে, তাহারা রেলে চাপা পড়িয়াছে। একজন ত লীলা—অপরটি কে? সম্ভবতঃ সে-ই নিজে—না, তাহা হইতে পারে না তাহার মনে পড়িল, ইহারা কাহার প্রতিক্ষা করিতেছিল, কাহাকে এখানে কে লইয়া আসিবে তাহাই বলিতেছিল—সে কে? 

রামকান্তের মনে মুহুর্ত্তের জন্য এই সকল কথা উদিত হইল। সে এ সকল কথা মন হইতে দূর করিয়া ভাবিল, “যাহা হউক, লীলাকে পাইয়াছি, যেমন করিয়া হউক ইহাকে রক্ষা করিতে হইবে, এখন ত স্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, গুরুদেব যাহা ভাবিয়াছেন, তাহাই ঠিক—নরেন্দ্রভূষণবাবুর টাকার জন্যই এ সকল কাণ্ড, বিনোদিনী খুন হইয়াছে, এই টাকার জন্য—লীলাকেও ইহারা খুন করিবার জন্য এখানে আটকাইয়া রাখিয়াছে; সুহাসিনীকেও নিশ্চয়ই এখানে আনিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছিল–হয় ত তাহারা তাহাকে এখানে আনিতেছে—খুব সম্ভব তাহাই। এখন এই মাগী আমার টাকার লোভে আমাকে হত্যা করিতে না চাহিলে আমি এ ঘরে আসিতে পারিতাম না-লীলারও সন্ধান পাইতাম না। যাক্ এখনও যখন আমি মরি নাই, তখন শীঘ্র মরিব না, যেমন করিয়া হউক, এখান হইতে যাইতে হইবে–লীলাকেও রক্ষা করিতে হইবে; তবে কিরূপে যে এখান হইতে বাহির হইতে পারিব, তাহা ত এখন ভাবিয়া পাইতেছি না, দেখা যাক্।” 

৩৮ 

রামকান্ত উঠিয়া লীলার নিকটে আসিল, লীলা ভয় পাইয়া আরও কোণের দিকে সরিয়া গেল। রামকান্ত বলিল, “ভয় করিয়ো না, চিনিতে পারিতেছ না—আমি তোমাকে লইয়া যাইব বলিয়া, তোমার বাবার নিকট হইতে আসিয়াছি।” 

লীলা ব্যাকুলভাবে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কোন কথা কহিল না। রামকান্ত বলিল, “সেই দমদমায় তোমার বাবার সঙ্গে আমাকে দেখিয়াছিলে—মনে পড়ে না?”

এইবার লীলার মনে পড়িল। সে ছুটিয়া রামকান্তের নিকটে আসিয়া দুইহাতে তাহার গলা জড়াইয়া ধরিল। এই সময়ে উর্দ্ধে দ্বার নাড়িবার শব্দ হইল। রামকান্ত লীলার কানে কানে বলিল, “শুয়ে পড়—এরা উপরের দরজা খুলিতেছে—দেখাও, যেন ঘুমাইয়া আছ; আমিও যেন মরিয়া গিয়াছি, এই রকম ভাবে পড়িয়া থাকি।” 

এই বলিয়া রামকান্ত অন্য দিকে গিয়া নিমীলিত নেত্রে শুইয়া পড়িল। 

তাহার শয়নের সঙ্গে সঙ্গে উপর হইতে দড়ি দিয়া একটা লন্ঠত কেহ নীচে ঝুলাইয়া দিল। কেহ উপর হইতে এই লণ্ঠনের আলোক গৃহমধ্যে কি হইতেছে দেখিল; রামকান্তের কথা মত লীলাও ইতিমধ্যে শুইয়া পড়িয়াছিল, সুতরাং উপর হইতে যাহারা লন্ঠন নামাইয়া দিয়াছিল, তাহারা দেখিল যে, একজন লোক ঠিক মড়ার মত পড়িয়া আছে—লীলাও মৃতবৎ শায়িত। উপর হইতে কে বলিল, “ও দুটার কাজ এতক্ষণ শেষ হয়ে গেছে—এখন এটাকেও নামিয়ে দাও।” 

রামকান্ত এক চক্ষু অর্দ্ধউন্মিলীত করিয়া দেখিল, উপর হইতে কাহার দেহ নামিয়া আসিতেছে। দেহটার হাত পা, মুখ কাপড়ে বাঁধা—দড়ী দিয়া ঝুলয়ইয়া দিতেছে। কাহার দেহ সে মৃত না জিবীত, তাহার কিছুই জানিতে পারিল না। 

রামকান্ত উঠিতে সাহস করিল না—নিস্পন্দভাবে পূর্ব্ববৎ পড়িয়া রহিল। পরক্ষণে শব্দে বুঝিল, দেহটা তাহার নিকটেই পড়িয়াছে, লন্ঠন উঠিয়া গিয়াছে, উপরের দরজাও বন্ধ হইয়াছে—বোধ হয়, কাহারা তখন সেই দ্বারের উপরে কোন গুরুতর দ্রব্য রাখিতেছে। এ সাবধানতার প্রয়োজন ছিল না, গৃহতল হইতে এই দ্বার বহু উচ্চে, সুতরাং রামকান্ত বা কাহারও এই দ্বারের নিকটে আসিবার সম্ভবনা ছিল না। 

রামকান্ত কিয়ৎক্ষণ নীরবে পড়িয়া রহিল। সাবধানের মার নাই; ভাবিল, যদি কেহ এখনও উপরে থাকে—কিন্তু অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়াও সে আর কোন শব্দ করিল শুনিতে পাইল না। তখন ভাবিল, “ইহারা ইহারা আমাদের সকলকেই মৃত স্থির করিয়াছে, সুতরাং, আর এখন আসিবে না; বোধ হয় রেল লাইনে মৃতদেহ ফেলিবার আশা ত্যাগ করিয়াছে—যাহা হউক, এখন দেখা যাক, আবার কাহাকে ইহারা এই অন্ধকূপে নামাইয়া দিল।” 

রামকান্ত আবার দিয়াশলাই জ্বালিল। সেই দেহের নিকটস্থ হইয়া দেখিল, কাপড় দিয়া তাহার মুখ বাঁধা, সুতরাং কোন শব্দ করিবার উপায় নাই। হাত ও পা সুদৃঢ়ভাবে রজ্জুদ্বারা আবদ্ধ; রামকান্ত তাহার মুখ ভাল করিয়া দেখিতে পাইল না, তথাপি মনে হইল, এ মুখ যেন পরিচিত, কোথায় সে একবার দেখিয়াছে—তাহার পর সহসা বিদ্যুদ্বিকাশের ন্যায় চকিতে মনে পড়িয়া গেল—এ যে সেই বরাহনগরের সুহাসিনী। 

রামকান্ত কাল বিলম্ব না করিয়া সুহাসিনীর মুখের বন্ধন খুলিয়া দিল; তখন সে দেখিল যে, সুহাসিনী মরে নাই, নিসংজ্ঞ অবস্থায় রহিয়াছে। 

সুহাসিনী ধীরে ধীরে চক্ষুউন্মীলন করিল; অতি মৃদুস্বরে বলিল, “আমি কোথায়?” 

রামকান্ত বলিল, “পাষন্ডগণ তোমাকে আর ঐ ছোট মেয়েটাকে হত্যা করিবার চেষ্টায় আছে—ভয় নাই, আমি তোমাদের রক্ষা করিব।” 

“আপনি কে?” আপনাকে কোথায় দেখিয়াছি বলিয়া বোধ হয়।” 

“এখান হইতে বাহির হইলে সকল বলিব—এখন এইমাত্র জান যে, আমি গোবিন্দরামের লোক।” সুহাসিনী বিস্মিতভাবে বলিল, “গোবিন্দরাম!” 

“হাঁ, সুরেন্দ্রনাথের পিতা; নিশ্চয়ই—ইহারা তাহার নাম করিয়া তোমাকে ভুলাইয়া বাড়ীর বাহির করিয়া আনিয়াছিল।” 

“হাঁ, আপনি ঠিক বলিয়াছেন। আমি ইহাদের কথা বিশ্বাস করিয়া ভাল করি নাই।” 

“বুঝিয়াছি, তাহার পর তোমার হাত পা মুখ বাঁধিয়া এখানে আনিয়াছে।” 

“হাঁ, তাহাই ঠিক।” 

“পাছে এখানে কেহ আ___লিয়া এই দুরাত্মাদের একজন ভূত সাজিয়া বাগানে চারিদিকে বেড়ায়—এ কৃতান্ত ব্যতীত আর কাহারও কাজ নয়।” 

“সে কে?” 

“একবার এখান হইতে বাহির হইতে পারিলে সব বলিব—তবে কিরূপে বাহির হইব, তাহা জানি না, যেমন করিয়া হউক, একটা উপায় করিতেছি।” 

“এই মেয়েটাকে রক্ষা করুন।” 

“ইহাকে যদি রক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলে তোমাকেও রক্ষা করিব—সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও রক্ষা করিব।” 

৩৯ 

রামকান্ত একথা বলিল বটে, কিন্তু কিরূপে যে এ কার্য্যেদ্ধার হইবে, তাহা কিছুই ভাবিয়া স্থির করিতে পারিল না; এবং সুহাসিনীকে তাহার মনের ভাব প্রকাশ করি—করিয়া বলাও যুক্তিসঙ্গত বিবেচনা করিল না। ভাবিল, “আমরা যে মরিয়াছি, তাহা ইহারা কখনই ভাবে নাই। যদি আমি একা হইতাম, তাহা হইলে ইহারা আমার দিকে চাহিত না—আমি এই অন্ধকূপে অনাহারে মরিয়া যাইতাম। তবে ইহারা দুইজন রহিয়াছে, ইহাদের হত্যা করিবার জন্যই এখানে আনিয়াছে, ইহারা বাঁচিয়া থাকিতে নরেন্দ্রভূষণের টাকা হস্তগত হইবে না, সুতরাং ইহাদের শীঘ্রই হত্যা করিবে। তবে কিরূপে হত্যা করিবে—সে হইতেছে কথা।” সহসা তাহার মনে হইল যে, নিশ্চয়ই কৃতান্ত জানে না যে, আমি এখানে আসিয়াছি, এ সেই বদজাত্ মাগীটা আমার টাকাটা লইবার জন্যই আমাকে এখানে ফেলিয়াছে—যাহাই হউক, আর সময় নষ্ট কার কর্তব্য নহে—রামকান্ত উঠিল। তখন বাহিরে বোধ হয়, বেশ বেলা হইয়াছে, গৃহমধ্যে আর তত অন্ধকার নাই। এখন সব বেশ স্পষ্ট দেখা যায়, বিশেষতঃ সে অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকায় অন্ধকারেও বেশ দেখিতে পাইতেছিল। 

রামকান্ত দেখিল, পূর্ব্বে গৃহমধ্যে কেবল কদম ছিল,এখন একটু জল জমিয়াছে। জল দেখিয়া রামকান্তের হৃদয় আরও দমিয়া গেল। 

কি ভয়ানক! নিশ্চয়ই এই গৃহে জোয়ারের জল আসে, তাহাই এখানে এত কদম—ইহারা জলে ডুবাইয়া মারিবার জন্যই তিনজনকে এই গৃহে আটকাইয়া রাখিয়াছে। এখন হইতেই ক্রমশঃ ঘরে চল ঢুকিতেছে। উপরে চাহিয়া রামকান্ত বুঝিতে পারিল যে পূর্ণজোয়ারে এই ঘর জলে পরিপূর্ণ হইয়া যায়, উপর পর্যন্ত জলের দাগ রহিয়াছে, এখন উপায়? 

রামকান্ত মনে মনে বলিল, “বেটারা ভাবিয়াছে যে, আমি পড়িয়া খোঁড়া হইয়াছি, জলে সাঁতার দিতে পারি না—তাহার পর সুহাসিনী, তাহার হাত পা বাঁধা আছে—আর লীলা সে ত সাঁতার জানে না, সুতরাং তিনজনেই জলের মধ্যে থাকিবে। সংসারে বদমাইসগণ যাহা করিতে চাহে, তাহা সকল সময়ে ঘটে না, ইহাই পরমসৌভাগ্য; নতুবা কাহারই নিস্তার ছিল না।” 

গৃহটির চারিদিক দেখিয়াই রামকান্ত মনে মনে একটা বিষয় স্থির করিয়া লইয়াছিল। সে দেখিল, উপরে প্রায় ছাদের নীচে একটা ছোট জানালা আছে, ঐখানে উপস্থিত হইতে পারিলে অনায়াসে বাহির হইতে পারা যায়, কিন্তু জানালাটি অনেক উচ্চে, সেখানে উঠিবার কোন উপায় নাই। ভাবিল, “তবে এক উপায় হইতে পাবে—যখন জোয়ারের জলে ঘর পূর্ণ হইয়া যইেবে, তখন সাঁতার দিয়া ঐ জানালা ধরা যাইতে পারে; জানালার কাঠের গরাদ ভাঙিতে কতক্ষণ? খুব সম্ভব, ঐ জানালাটি গঙ্গার দিকে—না-ই হউক, যে কোনখানে হউক যাইতে পারিব—একবার এই অন্ধকূপ হইতে বাহির হইতে পারিলে দেখা যাইবে—বেটারা রামকান্তকে চিনে নাই।”

রামকান্ত সুহাসিনীর দিকে ফিরিয়া বলিল, “তুমি মা, সাঁতার জান?” 

সুহাসিনী বিস্মিত হইয়া বলিল, “জানি, কেন?” 

রামকান্ত বলিল, “দেখিতেছ না—এই ঘরে জল আসিতেছে।” 

ভয়বিহ্বলা সুহাসিনী ইহা পূর্ব্বে লক্ষ্য করে নাই, এখন পায়ের উপর জল জমিতে দেখিয়া সভয়ে বলিয়া উঠিল, হাঁ, তাই ত!” 

“ভয় নাই, এই জলই আমাদিগকে রক্ষা করিবে।” 

“কেমন করে?” 

“ঐ উপরের জানালাটি ব্যতীত আমাদের এখান হইতে বাহির হইয়া যাইবার কোন উপায় নাই।”

“তবে কি হইবে?” 

“জল ঘরে আসিলে সাঁতার দিয়া আমরা ঐ জানালা ধরিব, গরাদ ভাঙিয়া ইহার গিতর দিয়া বাহির হইতে পারিব।” 

“যদি তাহারা বাহিরে থাকে?” 

“রামকান্তের বয়স হইলেও এখনও বদমাইসদের দুই দশটাকে কাবু করিবার শক্তি রাখে।” 

সুহাসিনী আর কথা কহিল না—রামকান্ত গৃহতলস্থ জল দেখাইয়া দিয়া বলিল, “এখন খুব জোয়ার আসিয়াছে—হু হু করিয়া ঘরে জল আসিতেছে।” সুহাসিনী লীলাকে দেখাইয়া বলিল, “এ মেয়েটি ত সাঁতার দিতে পারিবে না?” 

রামকান্ত লীলার নিকটস্থ বলিল, “কোন চিন্তা নাই আমি ইহার কোলে লইয়া সাঁতার দিব। এ মেয়েটি সম্পর্কে তোমার ভগিনী! এ কাহার কন্যা?”

“গোপালের—এইজন্যই তোমাদের দুইজনকে খুন করিতে চায়।” 

“কে কেন?” 

“সব পরে বলিব, এখন প্রাণে বাঁচিয়া এখান হইতে বাহির হইতে পারিলে হয়।” 

“তবে এই সেই লীলা—আমি সব শুনিয়াছি।” 

‘পরে সমস্তই বলিব—এখন সাঁতার দিতে চেষ্টা কর।” 

এই সময়ে জল প্রায় কটিদেশ পৰ্য্যন্ত উঠিয়াছিল। রামকান্ত লীলাকে ক্রোড়ে তুলিয়া লইল। 

ক্রমে জল আরও বাড়িতে লাগিল। তখন রামকান্ত সুহাসিনীকে সন্তরণ করিবার জন্য ইঙ্গিত করিয়া লীলাকে স্কন্ধে তুলিয়া লইল। তৎপরে সন্তরণ আরম্ভ করিল। সুহাসিনীকে বলিল, “জানালার দিকে এস—কোন ভয় নাই।” 

সুহাসিনীও সন্তরণে সুদক্ষ ছিল, সে-ও রামকান্তের পশ্চাতে পশ্চাতে জানালার দিকে চলিল।