২. প্রফেসর গেরহার্টের সঙ্গে

।। ২ ।।

দীপাদেবী সেই বিকেলেই প্রফেসর গেরহার্টের সঙ্গে এলেন। দেখলে বোঝা যায় এককালে খুব সুন্দরী ছিলেন। তবে বয়সের ভাবে সেই সৌন্দর্য অনেকটাই চাপা পড়েছে। তার ওপর নিঃসন্দেহে উনি মানসিক অবসাদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। চোখের নীচে কালি, মুখটা বিষাদময়, নিজেকে যেন টেনে টেনে বয়ে বেড়াচ্ছেন। প্রফেসর সঙ্গে ছিলেন বলে উনি ইংরেজিতেই কথাবার্তা বললেন। কনভেন্টে পড়াশুনা করেছেন নিশ্চয়, আমাদের মতো হোঁচট খাওয়া ইংরেজি নয়। একেনবাবুকে বললেন, “দেখুন এ নিয়ে আমি একেবারেই জলঘোলা করতে চাইছি না। আমার অনেক গিয়েছে। একটা পাথরের টুকরো থাকল না গেল, তাতে কিছু এসে যায় না।”

একেনবাবু বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি পাথরটা খুঁজে বার করি ম্যাডাম, সেটা আপনি চান না?”

“না,” স্পষ্টভাবেই দীপাদেবী বললেন, “যা যাবার তা গেছে।

প্রফেসর গেরহার্ট বিশদ করলেন, “দীপা আর এ নিয়ে খোঁজ খবর করতে চাইছেন না। আমি খুব সরি, আমার প্রথমে মনে হয়েছিল আপনি কেসটা নিলে ওঁর হয়তো আপত্তি হবে না। কিন্তু উনি সত্যিই ব্যাপারটা ভুলে যেতে চান।”

“তাহলে তো স্যার আমাদেরও ভুলে যেতে হয়,” কথাটা বলে একেনবাবু ঘরে গিয়ে গেরহার্ট সাহেবের চেকটা নিয়ে ওঁর হাতে ধরিয়ে দিলেন।

গেরহার্ট সাহেব লজ্জিতভাবে বললেন, “এটা কেন ফেরৎ দিচ্ছেন!”

“সে কি স্যার, আমি তো কোনো কাজই করিনি আপনার জন্য।”

“কিন্তু এতটা সময় দিলেন আমার কথা শুনতে…।”

“কী যে বলেন স্যার!”

.

দীপাদেবীকে নিয়ে প্রফেসর চলে যাবার পর, একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “ভেরি কনফিউজিং।”

“তা তো বটেই, প্রমথ বলল, “তার ওপর ডিপ্রেসিং, ধাঁ করে হাজার ডলার ঘরে এল আবার সাঁ করে বেরিয়ে গেল!”

আমি বললাম, “যাই বলিস, এই বয়সেও ভদ্রমহিলা কিন্তু খুবই সুন্দরী।”

প্রমথ বলল, “শালা, তোর লজ্জা করে না, মায়ের বয়সি মহিলা।”

“ইডিয়টের মতো কথা বলিস না। একটা জেনারেল স্টেটমেন্ট করছি। আর সেই সঙ্গে এও বলছি, ভদ্রমহিলার মস্তিষ্কে একটু ব্যামো আছে।”

আমার ধারণা প্রমথও সেটা বুঝেছে। কিন্তু তর্কের খাতিরে বলল, “এটা কেন বলছিস?”

“কারণ, জিনিস চুরি হয়েছে, পুলিশকে রিপোর্ট করছেন না। একেনবাবুকে ভার দিতে রাজি হয়ে পরে বেঁকে বসেছেন। এতো পিওর ক্ষ্যাপামি।”

“দুটোরই এক্সপ্লানেশন আছে, প্রমথ বলল। “এক নম্বর, উনি দেশ থেকে এসেছেন। দেশে থানা-পুলিশ করা মানে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা। ভালোর থেকে মন্দ বেশি হয়। উনি নিশ্চয় এদেশেও তাই হবে ধরে নিয়েছেন। দ্বিতীয়, একেনবাবুর কেপেবিলিটি সম্পর্কের ওঁর আস্থা থাকার কোনো কারণ নেই। উইথ অল ডিউ রেস্পেক্ট একেনবাবু, আপনার চেহারাটা মোটেই ইমপ্রেসিভ নয়। কতদিন ধরে বলছি পোষাকটা অন্ততঃ একটু ভদ্রস্থ করুন।”

“তুই থামবি!” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম।

একেনবাবু প্রমথর অপমানগুলো গায়েই মাখেন না। বরং বললেন, “প্রমথবাবুর কথাগুলো কিন্তু একেবারে ফ্যালনা নয় স্যার, মানতেই হবে।”

“তুই অত্যন্ত ডিসরেস্পেক্টফুল,” আমি প্রমথকে বললাম।

“ডিসরেস্পেক্টের কী দেখলি? আমি তো একেনবাবুর ক্ষমতাকে অস্বীকার করছি না, ওঁর প্যাকেজিংটা ঠিক নয়। মাল ভালো হলে তো শুধু চলবে না, মার্কেটিংটাও দেখতে হবে। ভালোকথা, কী বুঝছেন একেনবাবু, কেসটা সম্পর্কে?”

“খুবই কনফিউজিং স্যার।”

“কিচ্ছু কনফিউজিং নয়,” প্রমথ কনফিডেন্টলি বলল, “আমার থিওরি শুনবেন?”

“বলুন স্যার।”

“দীপাদেবীর সুপুত্র শুভই এই অশুভ কাজটি করেছে। পাথরটা চড়া দামে কোথাও বেচে মা-কে থানাপুলিশ না করতে বলেছে।”

“ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট স্যার। শুভবাবুকে আমরা সন্দেহের লিস্ট থেকে বাদ দিতে পারি ।”

“ফ্যাঙ্কলি আমি অবাক হব না, যদি আপনার ম্যাডাম দীপাদেবীও এর সঙ্গে জড়িত থাকেন।”

আমি বললাম, “কী সুপিডের মতো কথা বলছিস! গেরহার্ট সাহেব তো ওটা বিক্রি করার বন্দোবস্ত করছিলেন। টাকার জন্য হলে তো সেটা করলেই হত, এত লুকোচুরির কী দরকার?”

“তুই একটা ইডিয়ট,” প্রমথ বলল। “পাথরটা স্মাগলড গুডস। এখানে যে-কোনো মিউজিয়াম কেনার আগে কাগজপত্র, টাইটেল বা ওনারশিপ সার্টিফিকেট, ইত্যাদি দেখতে চাইবে, তখন এক আফগান বা পাকিস্তানী এসে বাড়িতে বয়ে পাথরটা দিয়ে গেছে বললে তো চলবে না!”

একেনবাবু মাথা নেড়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “সত্যি স্যার, প্রমথবাবু আমার ভাত মারবেন।”

“কী করে মারবে?” আমি বললাম, “কেসটা তো আপনি পেলেনই না!”

“তা পেলাম না স্যার,” একেনবাবু ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বললেন, “তবে সত্যিই পাস্টটা বেশ কনফিউজিং।”

“পাস্ট-টা মানে?”

“এই যে স্যার দেবেশবাবু, হরপ্পায় গিয়ে হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে পাথরটা বাক্সে পুরে পালাবার প্ল্যান করছিলেন কেন?”

“পালাবার প্ল্যান! সেটা কোত্থেকে পেলেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“আমার অনুমান স্যার, কারণ ঐ সময় তো ওঁর বাড়ি আসার কথা ছিল না। তার ওপর একটা দামি পাথরের টুকরো নিয়ে! উনি কি রিসার্চ করতে গিয়েছিলেন, না কোনও প্রত্ন চোরের দলে যোগ দিয়ে রাতারাতি বড়োলোক হবার ধান্ধা করছিলেন?”

“বুঝেছি। তার মানে সেটা করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটির শিকার হয়েছিলেন আর সেই দলটাই এখন পাথরটা উদ্ধার করার চেষ্টা করছে।” প্রমথ যোগ করল।

“ঠিক স্যার। সম্ভাবনাটা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

“আপনি তো আচ্ছা লোক মশাই, এক মুহূর্তে একটা গবেষককে ক্রিমিন্যাল বানিয়ে দিলেন। আর প্রমথ, তুইও তাতে তাল দিচ্ছিস!”

“না, না, স্যার, আমরা শুধু সম্ভাবনাগুলো ভাবছি। ভেরি কনফিউজিং।”

.

এসব ঘটে যাবার ক’দিন বাদে হঠাৎ করে ভৈরব মিত্রের সঙ্গে রাস্তায় দেখা। “কী খবর,” বলেই জিজ্ঞেস করলেন, “শুনলাম একেনবাবু নাকি সোনাবৌদির বাড়ির চুরি নিয়ে ইনভেস্টিগেট করছেন?”

“সোনাবৌদি!” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“মানে দীপা রায়, আমি ওঁকে সোনাবৌদিই ডাকি।”

“আপনি ওঁকে চিনলেন কী করে?”

“আরে মশাই, ওঁকে কি আমি এখন চিনি! আমার জ্যাঠতুতো দাদার কলিগ ছিলেন দেবেশদা, মানে সোনাবৌদির স্বামী। আমার থেকে অবশ্য ওঁরা অনেক বড়ো। সোনাবৌদি এককালে যা সুন্দরী ছিলেন না, সুচিত্রা সেনকেও টেক্কা দেবার মতো।”

“এখনও উনি যথেষ্ট সুন্দরী,” আমি বললাম।

“এখন তো দেখছেন শুধু টেন পারসেন্ট, কি তাও নয়,” ভৈরব মিত্র মুখ বাঁকালেন। তারপর গলাটা একটু নিচু করে বললেন, “বিটুইন ইউ এণ্ড মি, কতজন যে ওঁর প্রেমে হাবুডুবু খেয়েছেন গুণে শেষ করা যায় না। উনি অবশ্য কাউকে পাত্তা দেননি। ভার্চুয়াস লেডি। অলওয়েজ টু টু দেবেশদা, প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। বরং দেবেশদাই শুনেছি অন্য মহিলাদের সঙ্গে একটু-আধটু.. বুঝতে পারছেন তো? আচ্ছা ভাবুন তো, এমন সুন্দরী যাঁর স্ত্রী! আরে মশাই বড়োদের কথা ছেড়ে দিন, আমরা ছোটোরাই ওঁর কাছাকাছি ঘুরঘুর করার সুযোগ পেলে ছাড়তাম না। উনি আমাদের কারোর সঙ্গে এসে কথা বললে বর্তে যেতাম, অন্যরা সবাই হিংসায় জ্বলত। কোনো খিদমত খাটতে বললে তো আমরা সেভেন্থ হেভেনে পৌঁছে যেতাম!..”

“তাই নাকি!” ওঁর বাল্য-কাহিনি থামাতে কথার মাঝেই বললাম। কাজ হল না, উনি বলেই চললেন, “শুধু সুন্দরী ছিলেন না, ভালো গাইতেন, নাচতেন, চিত্তরঞ্জন পার্কের কালচারাল অনুষ্ঠানগুলোতে এককালে ওঁকে ছাড়া চলত না। তবে এখানে এসে একেবারে একা হয়ে পড়েছেন। ছেলে তো সারাদিন অফিস করছে। উনি তো ঘরের মধ্যে আটকা। কোথায় যাবেন, কার সঙ্গেই বা বেরোবেন? চেনা-জানারা তো সব দেশে!…”

সোনাবৌদির প্রসঙ্গ হয়তো আরও অনেকক্ষণ চলত। কিন্তু আমার একটু তাড়া ছিল, তাই কথা ঘোরাবার জন্য বললাম, “আপনি কোত্থেকে জানলেন যে একেনবাবুকে উনি চোর ধরতে বলেছেন?”

“আরে সেদিন শুভ ওঁকে নিয়ে আমার দোকানে এসেছিল। একথা সেকথার পর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, একেনবাবুকে আমি চিনি কিনা। আমি বললাম, “চিনি না মানে, উনি একজন ফ্যান্টাস্টিক গোয়েন্দা। ওঁর জন্যেই আমার দোকানে চুরি বন্ধ হয়েছে। তখনই জানলাম একেনবাবুর ব্যাপারটা…।”

আমি কথাটা শেষ করতে দিলাম না। “খবরটা ভুল, একেনবাবু এখন ওঁর কাজটা আর করছেন না।”

“সত্যি!”

“হ্যাঁ, সত্যি।” বলে আমি বিদায় নিলাম।

.

সেই রাতে বাড়িতে ডিনার খেতে খেতে একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন স্যার, গেরহার্ট সাহেব ঠিক খবরই এনেছিলেন, প্রফেসর উড হরপ্পার একজন অথরিটি।”

“আপনি কি এখনও ওই নিয়ে ভাবছেন নাকি? ফ্রি-তে কাজ করা তো আপনার হ্যাবিট নয়!” প্রমথ বলল।

“কী যে বলেন স্যার, গতকাল ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সঙ্গে গল্প করতে করতে গেরহার্ট সাহেবের গল্পটা ওঁকে বলেছিলাম। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের এক বন্ধু স্ট্যানফোর্ডে আছেন, হরপ্পা নিয়ে রিসার্চ করেন। স্টুয়ার্ট সাহেবকে তো আপনারা জানেন। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুকে ফোন। ভদ্রলোক প্রফেসর উডকে খুব ভালো করে চেনেন। যেটা মোস্ট ইন্টারেস্টিং, সেটা হল দেবেশবাবুকেও উনি চেনেন। এক সপ্তাহের মতো দেবেশবাবু ওঁর ডিপার্টমেন্টে ছিলেন। পরে আবার এক সপ্তাহের জন্য আসার কথা ছিল। কিন্তু প্রোগ্রামটা ক্যানসেল করে দেবেশবাবু দেশে ফিরে যান। প্রফেসর উডের ডিপার্টমেন্টেও দেবেশবাবু কাজ করেছেন বললেন। উনি আর প্রফেসর উড অনেকবারই হরপ্পায় গেছেন, দুয়েকবার এক সঙ্গেও।”

“দেবেশবাবু কি ওঁদের সঙ্গে হরপ্পায় গিয়েছিলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“না, ওঁর সঙ্গে যাননি। দেবেশবাবু হরপ্পার উপর কোনো কাজ করেননি। তাই হরপ্পায় গিয়েছিলেন শুনে উনি একটু আশ্চর্যই হলেন।”

.

এইসব নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করছি, তখন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের একটা ফোন। পুরোনো এক কলিগের সঙ্গে দেখা করতে উনি পোকোনো যাচ্ছেন, আমরা যেতে চাই কিনা জানতে। স্টুয়ার্ট সাহেব মাঝেমাঝে আমাদের দুয়েক জায়গায় নিয়ে যান। উনিও একেনবাবুর মতো বকবক করতে ভালোবাসেন, লম্বা ড্রাইভে ওঁর দুয়েকজন শ্রোতার দরকার –এটা অবশ্য প্রমথর কনক্লশন।

একেনবাবু বেড়াতে ভালোবাসেন। আমিও। তারওপর কাল কোনো ক্লাস নেই। সুতরাং না বলার প্রশ্ন ওঠে না। প্রমথ যেতে পারবে না, ল্যাব-এ ওর এক্সপেরিমেন্ট চলছে। আমি বললাম, “যখন যাচ্ছিই, তখন প্রফেসর উডের সঙ্গে দেখা করবেন নাকি?”

“কী হবে স্যার, পাথরটা থাকলে না হয় দেখা করার একটা মানে হত।”

“তা ঠিক।”