০৭. ক্যাফেটেরিয়াটা বিশাল

।। ৭ ।।

ক্যাফেটেরিয়াটা বিশাল, সবকিছুই ব্যুফে সিস্টেমে। ডেসার্টের টেবিলটা সত্যিই দেখার মতো। হরেক রকমের ফুট-কেক, চীজকেক, ডেনিশ, পাই, চকোলেট চিপস কুকির পাশে আপেল, আঙুর, ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি, কলা ইত্যাদি ফল থরে থরে সাজিয়ে একটা চমৎকার স্ট্যাচু বানানো হয়েছে। ওটা অবশ্য শো-এর জন্য কিন্তু তারপাশে আনারস, তরমুজ, আম, ইত্যাদি অসংখ্য চেনা-অচেনা ফল খাবার জন্য রাখা আছে। এছাড়া নানান দেশের নানান খাবার বিভিন্ন সার্ভিং টেবিলে সাজানো। ভারতীয় খাবারও দেখলাম রয়েছে একটা টেবিলে।

এ ধরণের জায়গায় এলে যা হয়, যা খাওয়া উচিত তার থেকে অনেক বেশি প্লেটে তুলে একটা টেবিল বেছে আমরা বসলাম। আমরা ঢোকার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম ক্যাফেটেরিয়াতে আর কোনও টেবিল খালি নেই। বাইরে কিছু লোকে দাঁড়িয়ে আছে, টেবিল খালি হলে ঢুকবে।

খেতে খেতে গল্প করছি, এমন সময় দেখি টিম একটা ট্রে হাতে বসার জায়গা খুঁজছেন। আমি হাত নেড়ে ডেকে ওঁকে আমাদের টেবিলে বসালাম। টিমের সঙ্গে আলাপ হবার কথা একেনবাবু আর প্রমথকে এর মধ্যেই বলেছি। একজন ভালো রিসোর্স, ক্রুজ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন থাকলে জেনে নেওয়া যাবে। একেনবাবু যখন সঙ্গে আছেন আমাদের তরফ থেকে প্রশ্নের কোনো অভাব হবে না।

টিম সত্যিই একজন গ্র্যান্ড লোক। এই লাইনে প্রচুর অভিজ্ঞতা। প্রমথ যে প্রমথ তার চোখমুখ দেখেও বুঝলাম ও-ও খুবই ইমপ্রেসড। ক্রুজ ডিরেক্টরদের যে কতরকম ঝামেলা পোহাতে হয়, সেটা টিমের মুখে না শুনলে বিশ্বাস করতাম না। ছোটোখাটো এমার্জেন্সি সার্জারি থেকে শুরু করে বাচ্চা ডেলিভারি, চুরি, খুন, জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা–সবরকম সমস্যার মধ্যেই ওঁকে পড়তে হয়েছে। মাঝে মাঝে সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়েও চলে গেছে। এক মহিলা হঠাৎ ওঁর প্রেমে পড়ে গিয়ে ক্রুজের সাতটা দিন ওঁর জীবন হেল করে দিয়েছিলেন হাসতে হাসতে সেই গল্পটা করলেন। হ্যাপিলি ম্যারেড বলেও নিষ্কৃতি পাননি। মহিলাটির ভারসাম্যের খুবই অভাব ছিল। একদিন হঠাৎ ওঁর অফিসে ঢুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে শুরু করেছিলেন! সার্ট খোলারও চেষ্টা করেছিলেন! লাকিলি এক মহিলা সহকর্মী সেখানে থাকায় ব্যাপারটা সামলানো গিয়েছিল।

‘মাই গড!’ আমি বললাম।

“হ্যাঁ এক আধসময়ে এরকম ঘটে। একজন বৃদ্ধা তাঁর নাতির জন্য আমার টুপিটা কিনে নিতে চেয়েছিলেন। আমি বললাম এরকম টুপি আপনি এই জাহাজের একটা দোকানেই পাবেন। বুড়ি তাতে রাজি নন। নাতির নাকি আমার টুপিটাই পছন্দ হয়েছে। তার জন্য তিনি দু’শো ডলার দিতেও রাজি!”

“ভালোই তো হত,” প্রমথ বলল। “দু’শো ডলার পকেটে আসত, আর আপনি ওটা হারিয়ে গেছে বলে রিপোর্ট করতেন। জাহাজের বাইরের ডেকে যা বাতাস, একজনের ক্যাপ তো আমার সামনেই উড়ে গেল!”

“মন্দ বলেননি,” টিম হাসলেন। “তবে দু’শো ডলার তো কিছুই না, মাস কয়েক আগে একজন ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোক এসেছিলেন। উনি আবার ইংরেজি জানেন না। আমার ফ্রেঞ্চ জ্ঞান খুব ভালো নয়, তবে কাজ চালাতে পারি। অফিসে আমার টেবিলে একটা ছোট্ট পাথরের মূর্তি দেখে বললেন, ওটা কিনতে চান। আমি ওঁকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, জাহাজে আমি কোনো কিছু বিক্রি করতে পারি না। তাছাড়া ওটা জন্মসূত্রে পাওয়া আমার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারের কালেকশন, বিক্রি করার প্রশ্ন উঠছে না। ভদ্রলোক মূর্তিটা হাতে তুলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে ডেস্ক থেকে একটা কাগজ তুলে সেখানে লিখলেন ‘অফার এক হাজার ডলার। আমি মাথা নাড়লাম। ভদ্রলোক আবার কাগজটায় কী জানি লিখে এগিয়ে দিলেন। দুটো কোশ্চেন মার্ক –অ্যাড্রেস আর ফোন। আমি কোনো সিক্রেট লোকেশনে থাকি না। তাই ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিলাম। ভদ্রলোক আর কিছু না বলে চলে গেলেন।”

“ইন্টারেস্টিং স্যার,”একেনবাবু বললেন। “আপনার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারের কি অনেক কালেকশন ছিল?”

“অনেক কিনা বলতে পারব না, পাথরের কয়েকটা মূর্তি ছিল। নিজেও নাকি পাথর নিয়ে খুটখাট করতেন। সত্যিকথা বলতে কি, এসব কথা আমি জানতামও না। আমার স্ত্রী-ই বাবার কাছ থেকে শুনেছিলেন। গত বছর বাড়িটা বিক্রির জন্যে যখন মার্কেটে দেওয়া স্থির করেছি, তখন আমার স্ত্রী অ্যাটিকটা পরিষ্কার করান। পুরোনো অনেক জিনিসের মধ্যে একটা ধুলো-ধুসরিত ব্যাগের মধ্যে ওই মূর্তিটাও ছিল। আমার পছন্দ হওয়ায় ক্রুজ সিজন শুরু হবার সময় ওটা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু গল্পটার শেষ এখানে নয়, নিউ ইয়র্কে ফিরে…।”

টিম কথাটা শেষ করতে পারলেন না, এরমধ্যে একজন স্টাফ হন্তদন্ত হয়ে এসে টিমকে ডেকে কী জানি বলল। টিম উঠে পড়ে বললেন, “সরি আমাকে একটু সাহায্য করতে হবে। রিটায়ার করেও নিষ্কৃতি নেই।”

টিম চলে যাবার পর একেনবাবু বললেন, “টুলি অ্যামেজিং ম্যান স্যার, একেবারে ফ্যাসিনেটিং।”

আমরা তখনই ঠিক করে ফেললাম আমাদের ডিনার টেবিলেও টিমকে বসাব। তাতে কোনো অসুবিধা নেই, কারণ টেবিলে চারজন ধরে। কিন্তু একটাই মুশকিল টিম কোন স্টেটরুমে আছেন সেটাই জানা হয়নি। স্টেটরুম? ও হ্যাঁ, ক্রুজ শিপে ক্যাবিনকে বলা হয় স্টেটরুম।

.

।। ৮ ।।

ভ্যানকুবার থেকে ক্রুজ শিপটা প্রথম যাচ্ছে কেচিক্যানে-এ। পথটা দীর্ঘ, পুরো দু-দিন লাগবে। তবে এন্টারটেনমেন্টের এত বন্দোবস্ত –শো, থিয়েটার, এক্সারসাইজ, মিনি গলফ, ক্যাসিনো ভিন্ন ভিন্ন রুচির যাত্রীদের জন্যে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন। কারোর পক্ষেই সময়টা দীর্ঘ বলে মনে হবে না। আর আমাদের মতো কিছু লোক, যারা বই পড়ে বা আরাম কেদারায় সমুদ্র দেখেই খুশি তারা তো আলস্য ভরে খেয়ে বসেই সময় কাটিয়ে দিতে পারবে। একটা দিন তো দেখতে দেখতে কেটে গেছে। পরের দিনের বেশির ভাগ সময়েই আমি ডেকে বসে বই পড়ে কাটালাম, মাঝে মাঝে সমুদ্রের দিকে তাকাচ্ছিলাম। ভাগ্যে থাকলে সেখানে নাকি তিমির দেখা মেলে। একেনবাবু কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন আমার কোনো ধারণাই নেই। প্রমথ ক্যাসিনোতে একবার ব্ল্যাক জ্যাক ট্রাই করে দেখবে বলেছিল। কিন্তু ৪০ ডলারের বেশি খরচা করবে না, আগে থেকেই স্থির করে রেখেছে। একেনবাবু সেখানে যাননি জানি, টাকা পয়সা নিয়ে কোনও রিস্ক উনি নেন না।

হঠাৎ শুনি একেনবাবুর ব্যস্তসমস্ত কণ্ঠস্বর। “একি স্যার, আপনি এখনও এখানে বসে আছেন! আমরা তো ডাইনিং রুমের সামনে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি!…

“আরে সত্যিই তো, সাড়ে ছটা বেজে গেছে! চলুন, চলুন।”

.

ডাইনিং রুমে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট টেবিলে যখন বসেছি, তখন দেখলাম টিম ঘরে ঢুকছেন। ওঁকে দেখা মাত্র প্রমথ পাকড়াও করতে ছুটল। প্রমথ আমাদের টেবিলটি দেখাতে উনি আমাদের দিকে তাকালেন। আমরা হাত নাড়লাম। প্রমথকে কী জানি বললেন। ফিরে এসে প্রমথ বলল, “আসছেন। কয়েকজন কলিগের সঙ্গে খাবেন বলে কথা দিয়েছেন। তবে আমাদের সঙ্গে ডেসার্ট খাবেন বললেন।”

একেনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার ব্যাসারথ কী ধরণের পদবি?”

“আমার কোনো ধারণাই নেই। নাম যখন টিম, নিশ্চয় ক্রিশ্চান। জিজ্ঞেস করুন না, আপনার যখন এতই জানার ইচ্ছে।”

“তা অবশ্য করা যায় স্যার।” মাথা নাড়ালেন একেনবাবু।

খানিকবাদে টিম এলে একেনবাবু বললেন, “আচ্ছা স্যার, আমি আর বাপিবাবু আলোচনা করছিলাম, আপনার পদবিটা খুব আন-ইউয়াল। ইন্ডিয়াতে এই নামের পদবি কোথাও শুনিনি।”

টিম একেনবাবুর প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হেসে বললেন, “আপনি কি ভেবেছিলেন, আমি ইন্ডিয়ান?”

“আপনি ইন্ডিয়ান নন, স্যার!”

“আমরা অরিজিনালি ত্রিনিদাদের লোক, তবে তিন পুরুষ ধরে আমেরিকায় আছি।”

“ত্রিনিদাদের ইতিহাসটা আমি ভালো করে জানি না,” আমি বললাম। “তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেক ক্রিকেট প্লেয়ার ইন্ডিয়ান ডিসেন্টের। আমার এক ছাত্রী ছিল ত্রিনিদাদের মেয়ে –নাম ছিল ক্যারলীন গোবেরধন।”

“নিশ্চয় অরিজিনালি গোবর্ধন ছিল স্যার।”

“তা হতে পারে।”

একেনবাবু উৎসাহ পেয়ে টিমকে বললেন “আপনারা হয়তো ছিলেন বসির- সেটাই বাসারাথ হয়ে গেছে। অথবা বাশার– সেখান থেকেও হওয়া সম্ভব।”

টিম হেসে ফেললেন।

হাবিজাবি অনেক গল্প হল। টিমকে আমাদের সঙ্গে দেখে চমৎকার স্পেশাল কেক আমাদের টেবিলে এল। কেকটা যখন খাচ্ছি টিম বললেন, তিনি কালকেই কেচিক্যানে নেমে যাচ্ছেন। সেখান থেকে প্লেন ধরে বাড়ি। এ যাত্রায় আর দেখা হবে না।

আমরা সবাই বিমর্ষ হলাম। ভারি চমৎকার মানুষ। আমি আমার কার্ডটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, “নিউ ইয়র্কে তো দেখা হতে পারে।”

“হ্যাঁ স্যার,” একেনবাবু বললেন, “সেই মূর্তির গল্পটা তো শেষ হল না?”

“কেন হবে না?” বলে ওঁর একটা কার্ড আমাকে দিলেন। “ফিরে গিয়ে ফোন করবেন। আমার স্ত্রীও খুব খুশি হবেন আপনাদের সঙ্গে পরিচয় হলে।”

অ্যালাস্কা বেড়ানোর কথা আর লিখলে এটা পুরো ভ্রমণ কাহিনি হয়ে যাবে। সেটাও লেখা যায় অবশ্য, কিন্তু এটা লিখছি অন্য কারণে। তাই দিন দশেক বাদে নিউ ইয়র্ক থেকেই গল্পটা আবার শুরু করি।

.

।। ৯ ।।

শুক্রবার বিকেলে একেনবাবু বললেন, “স্যার, কাল দুপুরে আপনারা কী করছেন?”

প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল, “সেটা নির্ভর করছে আপনার কী প্ল্যান তার ওপর।”

“আমার একার কি কোনো প্ল্যান হয় স্যার আপনারা ছাড়া।”

“ভনিতা না করে বলুন না মশাই, বড় কথা বাড়ান।”–“মিস্টার ব্যাসারাথ ফোন করেছিলেন। কিছু না করলে ওঁর বাড়িতে যদি চা খেতে যাই।”

“শুধু চা?”

“চুপ কর তো”, আমি প্রমথকে ধমক দিলাম। “নিশ্চয় যাব, ফোন করে বলে দিন।”

“আমি বলে দিয়েছি, স্যার।”

“তাহলে প্রশ্নটা করলেন কেন,” প্রমথ বলল, “আচ্ছা যা হোক!”

.

দু’টো নাগাদ আমার টিম ব্যাসারাথের বাড়িতে পৌঁছলাম। বাড়িটা ইস্ট হার্লেম অঞ্চলে। আগে আমি এদিকটাতে বেশি আসিনি। অঞ্চলটায় জেন্ট্রিফিকেশন চলছে, যার অর্থ রিনুয়াল এবং রিবিল্ডিং। পুরোনো বাড়িগুলো ভেঙ্গে ফেলে সেখানে গড়া হচ্ছে দামি দামি হাইরাইজ, শপিং সেন্টার, মাল্টি-লেভেল পার্কিং গ্যারেজ, ইত্যাদি। অর্থাৎ গরীবরা সেখান থেকে বিদায় নিচ্ছে, মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্তরা দলে দলে ঢুকছে। ধীরে ধীরে সব বাড়িই ভেঙ্গে ফেলা হবে।

টিমের বাড়ি খুবই পুরোনো, তবে ভেতরটা পুরোনো নয়। বেশ কিছু অংশ রি-মডেলিং হয়েছে। টিমের মুখেই শুনলাম, বাড়ির বয়স দেড়শো বছরেরও বেশি! টিমের ঠাকুরদার বাবা আমেরিকায় পা দিয়ে ওখানেই প্রথম ওঠেন। ওই অঞ্চলে এক সময় বহু কালো আর বাদামি চামড়ার লোক থাকত। এখন সেই সংখ্যা অনেক কমে গেছে। আদি-বাসিন্দা বলতে টিম আর কয়েকজন আছেন। আদি বাসিন্দাদের অন্য কেউই অবশ্য ত্রিনিদাদের লোক নন।

টিমের বাড়িতে একজনের সঙ্গে আলাপ হল, ভদ্রলোক কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, নাম টোনি র‍্যামাডিন। টোনি আমাদেরই বয়সি হবেন। ডেমোগ্রাফি আর সোশ্যাল হিস্ট্রি নিয়ে গবেষণা করেন। আপাতত গবেষণা করছেন নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রকৃতি কী ভাবে পালটাচ্ছে তা নিয়ে। ওঁর কাছেই জানলাম, হার্লেমে প্রথম বসবাস শুরু করে জার্মান অভিবাসী, তারপর একে একে আসতে শুরু করে আইরিশ, ইটালিয়ান আর রাশিয়া থেকে ইহুদীরা। হার্লেমের পূর্বদিকে, ইষ্ট হার্লেমের বহু বাসিন্দাই এসেছিল সাদার্ন ইটালি বা সিসিলি থেকে। সেই কারণেই ইষ্ট নাইনটিয়েথ স্ট্রিট থেকে ওয়ান হান্ড্রেড ফরটি ফার্স্ট স্ট্রিট-এর মধ্যে যে জায়গাটা তার নাম হয়ে গিয়েছিল ইটালিয়ান হার্লেম। আমেরিকায় পা দিয়ে ইটালিয়ানরা প্রথমে এখানেই চলে আসত। কেন তা সহজেই বোঝা যায়। নতুন দেশ, ভাষা অন্য। স্থানীয় লোকেরা নতুন ইমিগ্রান্টদের সুনজরে দেখে না, মনে করে খাবারে ভাগ বসাতে এসেছে। নতুন দেশে স্বজাতীয়দের সঙ্গে থাকাটা শুধু বুদ্ধিমানের কাজ নয়, নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকারও উপায়। এরকমই চলেছিল বহুদিন। এর মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর বেশ কিছু লোক পোর্টারিকো থেকে আসতে শুরু করল। তারা ইটালিয়ান হার্লেমের খুব ছোট্ট একটা অংশে নানান প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আস্তানা গেড়ে বসল। তাদের সংখ্যা যখন বাড়তে শুরু করল, বহু ইটালিয়ান বাড়িঘর বিক্রি করে চলে গেল নিউ জার্সিতে। ধীরে ধীরে ইটালিয়ান হার্লেম হয়ে উঠল স্প্যানিশ হার্লেম।

একেনবাবু দেখলাম মন্ত্রমুগ্ধের শুনছেন। টোনি-র কথা শেষ হলে বললেন, “আচ্ছা স্যার, আপনি তো আমেরিকান নন?”

“কেন, আমার রঙ কালো বলে বলছেন?”টোনি মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন।

“আরে ছি ছি, না না স্যার… আসলে…।”

“আমার জন্ম এদেশে, জন্মসূত্রে আমেরিকান। কিন্তু আমি যখন খুব ছোটো, বাবা-মা আমাকে নিয়ে জ্যামাইকা ফিরে যান। আঠারো বছর বয়সে আবার আমি এদেশে চলে আসি পড়াশুনা করতে। জ্যামাইকাতে বড়ো হয়েছি তাই অ্যাকসেন্টটা আছে। সুতরাং আপনার প্রশ্নের মধ্যে ভুল নেই।”

একেনবাবু তখনও লজ্জা পাচ্ছেন দেখে টোনি বললেন, “আসলে কি জানেন, আমি আমেরিকান হলেও নিজেকে জ্যামাইকান বলেই ভাবি। এই যে ধরুন টিম, এঁরা তো চার পুরুষ ধরে আমেরিকায় আছেন। কিন্তু যদি প্রশ্ন করেন অরিজিনালি কোথাকার লোক, বলবেন ত্রিনিদাদ। আবার দেখুন, আমরা তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের লোক, ইন্ডিয়ার সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ আছে। আমার র‍্যামাডিন নামটা তো এসেছে ভারতীয় রামাধিন থেকে, তাই না? আসলে আমরা গ্লোবাল ভিলেজে আছি।”

“অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং!”

আমি বললাম, “আপনাদের সঙ্গে এদেশের যোগাযোগ তো বহুদিনের… কোথায় জানি পড়েছিলাম…”

“হ্যাঁ, আমেরিকায় এক সময়ে অনেক স্লেভের দরকার ছিল। দাসপ্রথা তো বন্ধ হয়েছে মাত্র শ-দেড়েক বছর হল। ভারতবর্ষ থেকেও কম স্লেভ ব্রিটিশরা আমদানি করেনি। স্লেভ না বলে ইন্ডেঞ্চারড ওয়ার্কার বা বন্ডেড লেবারার বলা হতো –হরে দরে প্রায় একই। তবে ভারতীয়দের পাঠানো হতো ক্যারাবিয়ান অঞ্চলে, এদেশে নয়। তাদের রক্ত আমাদের শরীরে রয়েছে।”

“এদেশে ভারতীয়রা যারা আসত তারা বোধহয় পড়াশুনো করতেই আসত। তারকনাথ দাস বলে একজন বাঙালি তো একশো বছর আগে নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন শুনেছি।” আমি বললাম।

“তাই নাকি!” একটু অবাকই হলেন টোনি। “ভালো কথা, আপনারা কি বাঙালি?”

আমরা তিনজনই প্রায় একসঙ্গে বললাম, “হ্যাঁ।”

“তা হলে আমার বন্ধু বিবেক বল্ডের বইটা পড়ে দেখতে পারেন। এই যেখানে আমরা বসে আছি, সেই জায়গা নিয়েই লেখা –Bengali Harlem and the Lost Histories of South Asian America I”

“এই জায়গাটা মানে? এটা কি বেঙ্গলি হার্লেম ছিল?” আমি সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম।

“না, সেভাবে এর পরিচিতি খাতায় কলমে নেই। কিন্তু বহু বাঙালি জাহাজ থেকে নেমে এখানেই এসে উঠত। এদের বলা হত চিকনদার। এমব্রয়ডারি করা সিল্কের শাল, টেবিলক্লথ, বালিশের জামা, যেগুলোকে তখন বলা হত চিকন, সেগুলো বিক্রি করার জন্য আসত। এখনও তাদের বংশধররা কেউ কেউ এখানে আছে, তবে যেভাবে জায়গাটা পালটাচ্ছে, কতদিন তারা থাকবে সন্দেহ।” এই বলে টিমের দিকে তাকালেন টোনি, “একমাত্র তোমাদের পূর্বপূরুষই এখানে হংস মধ্যে বক যথা হয়ে এসেছিল, তাই না টিম?”

“হয়তো তাই, কিন্তু আমাকে তো এঁরা ভারতীয় বলেই ভেবেছিলেন।”

“সে তো ত্রিনিদাদের অনেক লোককে দেখলেই মনে হবে। এমন কি জ্যামাইকারও।”

“বইয়ের নামটা টুকে নিয়েছেন স্যার।” একেনবাবু আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।

আমার পকেটে একটা পেন আর ছোট্ট ডায়েরি সবসময়েই থাকে। লিখেও নিয়েছি। মনে হল বইটা ইন্টারেস্টিংই হবে।

টোনির অন্য একটা কাজ ছিল। যাবার আগে বললেন, “খুব ভালো লাগল পরিচিত হয়ে। একদিন আসুন না, গল্প করা যাবে। জ্যামাইকান রান্না খাওয়াব।”

“তার আগে ইন্ডিয়ান রান্না হোক, প্রমথ বলল। “আপনারা সবাই আসুন আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে।

“বেশ তাই হবে” বলে টোনি চলে গেলেন।”

টোনি চলে যাবার একটু পরেই একজন বয়স্কা মহিলা ঢুকলেন। টিম পরিচয় করিয়ে দিলেন, “আমার স্ত্রী ক্যাথি।”

বেশ মাদারলি চেহারা। উনি বোধ হয় আমাদের জন্যই বেরিয়েছিলেন। সঙ্গে দেখলাম বেশ সুন্দর একটা ফুট কেক নিয়ে এসেছেন। স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি চা বা কফি দাওনি ওঁদের?”

“তোমার জন্যে অপেক্ষা করছি। টোনিও ছিল, কিন্তু একটা কাজ থাকায় চলে গেল।”

“বড় কাজ ওর!” সস্নেহেই বললেন ক্যাথি। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনাদের কথা ও অনেকবার বলেছে। যেদিন রিটায়ার করল সেদিনই তো দেখা হল আপনাদের সঙ্গে, তাই না?”

“হ্যাঁ ম্যাডাম।” একেনবাবু সসম্ভমে বললেন। “খুব খুশি হয়েছি আপনারা এসেছেন।” কিছুক্ষণের মধ্যেই কফি, কেক, কুকি, ব্রাউনি, ইত্যাদি এল। কোত্থেকে মিসেস ব্যাসারাথ ফুট কেক কিনেছেন জানি না, কিন্তু ওরকম সফট ময়েস্ট ফুট –ঠাসা কেক আমি আগে কখনো খাইনি। একেনবাবুও দেখলাম খুব উপভোগ করছেন। প্রমথ কেকের ভক্ত নয়। ওদিকে গেলই না, একটুকরো ব্রাউনি নিল।

একেনবাবু ক্যাথি ব্যাসারাথকে বললেন, “ম্যাডাম, এরকম অ্যামেজিং কেক আগে কখনো খাইনি।”

ক্যাথি বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ। একটা নতুন কেক শপ খুলেছে। বেশ ভালো কেক করছে।”

“অনেক নতুন নতুন শপিং সেন্টার দেখছি, পুরো এরিয়াটাই মনে হচ্ছে রেনোভেট করা হচ্ছে।”

“ঠিক, আমাদের মত দুয়েকটা পুরোনো বাড়ি ছাড়া, এখানে সবকিছুই নতুন। আর আমাদেরও আসছে যাবার পালা।”

ক্যাথির গলায় একটা বিষণ্ণতার সুর পেলাম।

“ওরই বেশি খারাপ লাগছে,” টিম বললেন, “আমি তো বেশির ভাগ সময় জাহাজেই কাটিয়েছি।”

“আপনারা স্যার চলে যাচ্ছেন এখান থেকে?”

“হ্যাঁ, পরশু রাত্রেই আমরা সেলস-কনট্র্যাক্ট সই করেছি। একমাস বাদে এই বাড়ি ছাড়তে হবে। সেই জন্যই আপনাদের আজ আসতে বললাম। এরপর তো ছোটাছুটি শুরু হবে।”

“আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“ফোর্ট লডারডেল। আমাদের ছেলে ওখানে থাকে, ওখানেই একটা বাড়ি কিনছি। এখানকার তুলনায় বাড়ির দাম সস্তা, শীতও নেই এদিকের মতো। আর ক্যাথিও ওখানকার মেয়ে।”

“সে তো চল্লিশ বছর আগের কথা, ভুলেও গেছি।”

প্রসঙ্গটা হঠাৎ করেই পালটাল। একেনবাবু ড্রয়িং রুমের ওপর রাখা একটা মূর্তি দেখিয়ে প্রশ্ন করলেন, “এটাই কি স্যার সেই মূর্তিটা, যেটা সেই ভদ্রলোক জাহাজে কিনতে চেয়েছিলেন?”

টিম সেদিকে তাকিয়ে বললেন, “না, এটা মেসিজ থেকে কেনা। সে গল্পটা তো সেদিন শেষ করা হয়নি।”

“না স্যার, আজকে কিন্তু বলবেন।”

“ নিশ্চয়, কদুর বলেছিলাম আপনাদের?”

“বলেছিলেন একজন ফ্রেঞ্চম্যান আপনার ফোন নম্বর আর ঠিকানা নিয়েছিলেন।”

“ও হাঁ, মনে পড়েছে। সেই ক্রুজ থেকে ফিরে এসেই ক্যাথিকে বলেছিলাম ওই খ্যাপা ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোকটির কথা। তারপর ওকে ইমপ্রেস করার জন্য বলেছিলাম, আমার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার নিশ্চয় একজন বড়ো স্কাল্পটার ছিলেন, নইলে কেউ হাজার ডলার দিতে চায় ওইটুকু একটা মূর্তির জন্য!’ কথাটা শেষ করে ওঁর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে টিম বললেন, “কি ক্যাথি, মনে আছে?”

“মনে থাকবে না!” ক্যাথি হাসতে হাসতে বললেন। “আর আমি তোমাকে বলেছিলাম, ‘কেউ সেই প্রতিভাটা তখন বুঝতে পারলে ওঁকে আর মনিহারি দোকান খুলতে হতো না!”

“এক্সাক্টলি। ওই নিয়ে আমাদের মধ্যে একটু হাসি ঠাট্টাও হয়েছিল। ক্যাথি বলেছিল –যে-ব্যাগের মধ্যে মূর্তিটা পেয়েছিল সেটা অ্যাটিকেই আছে। আরও দু’টো ছোটো মূর্তি, ছেনি, হাতুরি, ফাইল, কাগজে মোড়া পালা কিছু একটা ভেতরে রয়েছে। তবে ওটাতে এত ঝুল আর ধুলো, সেটা দেখে ওদের ছেলে নাকি পুরো ব্যাগটাই ফেলে দিতে যাচ্ছিল! ‘ভাগ্যিস ফেলেনি, এখন ওই ফ্রেঞ্চ ভদ্রলোককে আরও দুটো মূর্তি গছাতে পারবে!’ আমি হেসেছিলাম, সেই আশাতেই থাকো।

এর দিন দশেক বাদে রিক স্প্রে বলে এক ভদ্রলোকের ফোন! নিজের পরিচয় দিলেন ফ্রেঞ্চ বিজনেসম্যান দানিয়েল ডুবোয়ার আমেরিকান এজেন্ট বলে। ক্রুজ শিপে মিস্টার ডুবোয়া যে স্ট্যাচুটা দেখেছিলেন সেটা নিয়ে কথা বলতে চান।

আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম, কিন্তু বিস্ময়তা চেপে জানতে চাইলাম, “কী কথা?”

ভদ্রলোক বললেন, ফোনে বলতে চান না। আমি যদি কয়েক মিনিট সময় দিই, উনি আমার বাড়ি এসে কথাগুলো বলবেন। এদিকে একটা কাজে এসেছিলেন, আমার বাড়ির খুব কাছেই আছেন। চাইলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে আসতে পারেন।

আমার আবার সেদিন ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট। বললাম, “ঠিক আছে, আসুন, কিন্তু অল্প সময়ই দিতে পারব।”

ভদ্রলোক সত্যিই কয়েক মিনিটের মধ্যেই এলেন। এসেই জিজ্ঞেস করলেন যে স্ট্যাচুটা মিস্টার ডুবোয়া দেখেছিলেন, সেটা আমার কাছে এখনও আছে কিনা।

আমি বললাম, “আছে।”

“মিস্টার ডুবোয়া ওটা কিনতে আগ্রহী। আপনি জাহাজে ছিলেন বলে বিক্রি করার অসুবিধা ছিল। এখন করবেন তো?”

আমি অনেস্ট উত্তর দিলাম, “ওটা বিক্রি করার কথা ভাবিনি। ওটা আমার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারের।”

রিক বললেন, “সেটা বুঝতে পারছি। কিন্তু ওটার সেন্টিমেন্টাল ভ্যালু ছাড়া আর কী আছে? মিস্টার ডুবোয়া এখনও ওটার জন্যে একহাজার ডলার দিতে রাজি।”

আমি একটু চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, “একটা কথা আমায় বলতে পারেন, উনি এই ছোট্ট মূর্তিটার জন্যে এত টাকা কেন দিতে চান?”

রিক বললেন, “মিস্টার দানিয়েল অত্যন্ত বড়োলোক আর ওঁর অনেক খ্যাপা শখ আছে। মূর্তিটা ভালো লেগেছে, কিনবেন, ব্যাস! এক হাজার ডলার ওঁর কাছে নাথিং! আচ্ছা, আপনার গ্রেট গ্রান্ড ফাদারের নামটা কি ছিল বলুন তো?”

“ব্রায়ান ব্যাসারাথ।”

“লিখে রাখি, যদি মিস্টার দানিয়েল জানতে চান।” বলেই চটপট ওঁর ফোনে নামটা লিখে নিলেন। তারপর বললেন, “তাহলে বলুন, ইটস এ ডিল?”

আমি আমার স্ত্রীর দিকে তাকালাম।

রিক লোকটা বেশ ধূর্ত। ক্যাথিকে বলল, “ম্যাম, আপনি রাজি হয়ে যেতে বলুন। আমাকে মিস্টার দানিয়েল দরকার হলে পনেরো-শো ডলার পর্যন্ত দিতে অথরাইজ করেছেন।”

ক্যাথির সন্মতি ছিল, আমিই একটু কিন্তু কিন্তু করছিলাম। যদিও এই বয়েসে একটা স্ট্যাচু আঁকড়ে না ধরে রেখে দেড় হাজার ডলার নেওয়াটা অনেক বেশি বুদ্ধিমানের কাজ। তাও আমি কয়েকদিন সময় চাইলাম রিকের কাছে। রিক খুব সন্তুষ্ট হলেন না। বললেন, “আমার মনে হয় না, মিস্টার দানিয়েল অপেক্ষা করতে রাজি হবেন বলে।” তারপর আর একটা কথা বললেন, যেটা আমার বেশ রূঢ়ই লাগল। বললেন, “আপনি কি জানেন এটা আপনার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদার কোত্থেকে পেয়েছিলেন?”

আমি বললাম, “আমার কোনো ধারণাই নেই।”

রিক স্প্রে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললেন, “তাহলে বিক্রি করলে ভালোই করতেন, অ্যান্টিক থাকলেই সেটা লিগ্যাল পজেশন হয় না।”

ইঙ্গিতটা অত্যন্ত স্পষ্ট। আমি একটু রেগেই বললাম, “আপনি এবার আসতে পারেন।”

এই খবরটা আমাদের পাড়ায় জানাজানি হতে বেশি সময় লাগল না। আমরাই গল্প করতে করতে দুয়েকজনকে বলেছি। কারও কারও ধারণা হল গ্রেট গ্রান্ড ফাদার নিশ্চয় একজন বড় কালেকটর ছিলেন, নইলে ওই ছোট্ট স্ট্যাচুর জন্যে কে পনেরো-শো ডলার দেবে! কেউ কেউ বললেন, আমি একটা বন্ধু এরকম একটা অফার নিইনি বলে। আমাদের এখানে একটা লোকাল নিউজপেপার বেরোয়। তাদের রিপোর্টার বাড়িতে এসে স্ট্যাচুর ছবি তুলে ফলাও করে একটা আর্টিলও লিখে ফেলল। শুধু একটা নয়, আমার গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারের একাধিক কালেকশন যে আমাদের অ্যাটিকে আছে সেটাও ছাপিয়ে দিল! যাইহোক, এর কয়েকদিন বাদে ফোর্ট লডারডেলে গিয়েছিলাম আমাদের নতুন বাড়িটার বায়না করে আসতে। ফিরে এসে দেখি বাড়িতে চুরি হয়েছে। কিন্তু চুরি গেছে শুধু ওই মূর্তিটা। আমার কী জানি খেয়াল হল, অ্যাটিকে উঠে দেখি ধুলোভর্তি ব্যাগটা খোলা। তার ভেতরে ছেনি হাতুরি আর কিছু ছেঁড়া কাগজ পড়ে আছে। ক্যাথি যে মূর্তিদুটোর কথা বলেছিল, তার কোনোটাই নেই।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। এটা কতদিন আগেকার কথা স্যার?”

“তা প্রায় মাস তিনেক হবে।”

“কাউকে আপনার সন্দেহ হয় স্যার?”

“সন্দেহ করতে হলে তো পাড়ার অনেককেই করতে হয়। হয়তো কারোর ধারণা হয়েছে ওগুলোর জন্য হাজার কয়েক ডলার পাওয়া যাবে।”

“হাউ অ্যাবাউট রিক স্পে?” প্রমথ বলল।

“মনে হয় না,” টিম বললেন। “ওটা চুরি হবার দু’দিন পরে রিক স্প্রে আমাকে ফোন করেছিলেন, আমি ওটা বিক্রি করব কিনা জানতে। চুরি হয়ে যাওয়ার কথাটা বিশ্বাসও করলেন না। ভাবটা আমি বিক্রি করব না বলে মিথ্যে কথা বলছি!”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং! “ মাথা নাড়তে নাড়তে একেনবাবু এমন ভাবে বললেন টিম আর ক্যাথি দুজনেই একেনবাবুর দিকে একটু বিস্মিতভাবে তাকালেন।

এবার প্রমথ মুখ খুলল, “পুলিশ কী করছে জানি না, কিন্তু আমাদের একেনবাবু হলেন একজন গোয়েন্দা। উনি হয়তো আপনাদের সাহায্য করতে পারেন।”

ক্যাথি বলে উঠলেন, “সত্যি! আপনি একজন ডিটেকটিভ?”

“হ্যাঁ, ম্যাডাম।”

“আপনি বার করতে পারবেন, কে চুরি করেছে?” টিম প্রশ্ন করলেন।

“কে জানে স্যার, এসব ধরতে পারা খুব কঠিন।.. ওই ব্যাগটা কি আছে?”

“না, পুলিশ ওটা নিয়ে গিয়েছিল। আমার ধারণা ফিঙ্গার প্রিন্ট বা অন্য কোনো ব্লু যদি পাওয়া যায়। কিন্তু দিন পনেরো বাদে আমাদের ফেরৎ দিয়ে যায়। মনে হয় না কিছু পেয়েছিল বলে। আমি আর ক্যাথি তখন নিউ ইয়র্ক ছাড়ব বলে জিনিসপত্র গ্যারাজ সেলে দিয়ে হালকা হবার চেষ্টা করছি। ঐ ব্যাগটা ট্র্যাশব্যানে ফেলে দিই।”

“ওটা থাকলে কি আপনার সুবিধা হতো?” ক্যাথি জিজ্ঞেস করলেন।

“বলা শক্ত ম্যাডাম। তবে পুলিশ তো দেখেইছে, তারা যখন কিছু পায়নি। তারপর একটু থেমে বললেন, “আমার মনে হচ্ছে ম্যাডাম ব্যাপারটা ভুলে যাওয়াই ভালো।”

“টিমও তাই বলে। গ্রেট গ্রান্ডফাদারের সবচেয়ে দামি জিনিসই তো আমরা পেয়েছি… এই বাড়িটা। সেটা কি কম ভাগ্যের কথা!”

আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, ক্যাথি কি বলছেন। টিম অবশ্য বিশদ করলেন, “আমাদের তিন পুরুষ ধরে শুধু এক ছেলে। আমার কোনো বোন ছিল না, বাবারও নয়। ঠাকুরদার দুই বোন ছিল শুনেছি। কিন্তু তাঁদের ভাগ ভাইকে দিয়ে দিয়েছিলেন।

ফ্যামিলি লিনিয়েজটা বেশ আনইউসুয়াল লাগল আমার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনারও তো একই ছেলে?”

“না আমাদের এক মেয়ে আছে। সে তার বর আর ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে।”

আর দু-চার কথার পর আমরা উঠে পড়লাম।

টিম আর ক্যাথি দুজনেই বললেন, আমরা আসায় খুব খুশি হয়েছেন। দেখা হোক আর হোক যোগাযোগ থাকবে।