০১. অ্যালাস্কা ক্রুজে

মেলাবেন তিনি মেলাবেন – একেনবাবু গোয়েন্দা কাহিনী – সুজন দাসগুপ্ত

(প্রমথর মতে এটা গোয়েন্দা গল্প নয়, প্রেমকাহিনিও নয়– জগাখিচুরি। অবশ্য প্রমথর অ্যাপ্রুভাল নিয়ে কিছু ছাপতে হলে, আমি একটা গল্পও ছাপতে পারতাম না। তবু খাঁটি রহস্য-সন্ধানী পাঠকদের আগেভাগেই সতর্ক করছি।)

।। ১ ।।

একেনবাবু অ্যালাস্কা ক্রুজে যাবার তিনটে টিকিট পেয়েছেন। পারফেক্ট টাইমিং, ফল সেমিষ্টার শুরু হবার একটু আগে। কী করে টিকিটগুলো পেয়েছেন সে নিয়ে বেশি আলোচনা না করাই ভালো। এটা হল ওঁর একটি আন-অফিসিয়াল কর্মের পুরস্কার। আন অফিসিয়াল, কারণ নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্টের ফেলোশিপের শর্ত অনুসারে ওঁর বাইরের কোনো কাজ করার অনুমতি নেই। কিন্তু একেনবাবুর সুনাম নিউ ইয়র্কের পুলিশমহলে ও নানান প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সিতে বেশ ভালোই ছড়িয়েছে। না চাইলেও এদিক-ওদিক থেকে বছরে কয়েকবার ওঁর ডাক পড়ে। উনি অবশ্য বিনা পারিশ্রমিকেই কাজগুলি করেন। করেন স্রেফ নিজের মগজ খেলানোর তাগিদে।

প্রমথ এই নিয়ে প্রায়ই খোঁচায়। “এইসব ফালতু সার্ভিস না দিয়ে ঘরদোরগুলো তো একটু পরিষ্কার করতে পারেন। আপনার নিজের বেডরুমের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, ওটা তো একটা আস্তাকুঁড়। কিন্তু বাইরের ঘর আর রান্নাঘরটাও তো গোবর বানিয়ে রেখেছেন।”

“আসলে স্যার আমি একটু অগোছালো।” একটু মাথা চুলকে এটাই হল একেনবাবুর স্ট্যান্ডার্ড উত্তর।

“ওসব হেঁদো এক্সকিউজ আপনি বাপিকে (অর্থাৎ আমাকে) দেবেন। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়।”

ঠিক এই সময়ে একেনবাবু তাঁর মোক্ষম অস্ত্রটি ছাড়েন। “ঠিক আছে স্যার, আপনারা বসুন, আমি কফি বানাই।”

“থাক, ওটি করে আর কফিতে অরুচি ধরাবেন না। “ বলে প্রমথ রান্নাঘরে যায়।

এই ব্যাপারটার পুনরাবৃত্তি মাসে অন্ততঃ একবার করে হয়। এইবারও যখন হচ্ছিল, তখন একেনবাবু হাসি হাসি মুখে প্রমথর হাতে টিকিটগুলো ধরিয়ে দিলেন।

“এটা আবার কি?”

“অ্যালাস্কা ক্রুজের টিকিট স্যার।”

প্রমথ ভুরু কুঁচকে একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোত্থেকে পেলেন?”

“এই পেলাম স্যার। আপনি একদিন ক্রুজে যাবার কথা বলেছিলেন, তাই ভাবলাম।”

একেনবাবু ওঁর বক্তব্য শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই প্রমথ বলল, “নিজের গাঁটের পয়সা নিশ্চয় খরচা করেননি। করেছেন বললে, এক্ষুনি আপনাকে বেলভিউয়ে (নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত মেন্টাল হসপিট্যাল) পাঠানোর বন্দোবস্ত করব।”

“কী যে বলেন স্যার, পয়সার কথা আসছে কোত্থেকে, এটা একেবারেই কমপ্লিমেন্টারি।”

প্রমথ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম, “চুপ কর, হু কেয়ার্স ফর দোজ ডিটেইলস। টিকিট পেয়েছিস, চল।”

.

অ্যালাস্কা ক্রুজের এক একটা টিকিটের দাম হাজার ডলারের বেশি। বোঝাই যায় ভালোবেসে কেউ এই তিনটে টিকিট একেনবাবুকে দান করেননি। কিন্তু সে নিয়ে আমার আর প্রমথের মাথাব্যথা কেন হবে! প্রমথ অনেক দিন ধরেই অ্যালাস্কা ক্রুজের কথা বলছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিন-এর ফলে ওখানকার গ্লেশিয়ারগুলো গলতে শুরু করেছে। বছর কুড়ি বাদে হিমবাহের কিছুই নাকি আর অবশিষ্ট থাকবে না! শেষের কথাটা অবশ্য প্রমথর নিজস্ব অভিমত। তবে বরফগুলো যে দ্রুত গতিতে জল হয়ে যাচ্ছে, সেটা তো পত্রপত্রিকায় সবসময়েই পড়ছি। আমার নিজেরও অ্যালাস্কা যাবার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই ছিল। বইয়ে অ্যালাস্কা সম্পর্কে এত পড়েছি। ওখানকার ন্যাচারাল বিউটি নাকি একেবারে ভার্জিন কন্ডিশনে আছে, সভ্যতায় কলুষিত হয়নি। দেখলে ভুলতে পারা যায় না!

আমাদের টিকিট হল প্রিন্সেস ক্রুজ লাইনের। যে জাহাজে আমরা উঠব, সেটার নাম আইল্যান্ড প্রিন্সেস। ক্রুজ শিপ ছাড়বে ক্যানাডার পশ্চিমপ্রান্তে ভ্যানকুভার শহর থেকে। থামবে মোট চার জায়গায়– কেচিকান, স্ক্যাগওয়ে, জুনো আর উইটিয়ার। তারপর

উইটিয়ার থেকে বাসে চড়ে অ্যাঙ্কারেজ এয়ারপোর্ট। প্লেনে ব্যাক টু নিউইয়র্ক মোট পাঁচ দিন। হুইটিয়ার ছাড়া বাকি জায়গাগুলোতে ট্যুর-এর বন্দোবস্ত আছে, কিন্তু তার দামের বহর দেখে একেনবাবু আগেভাগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জাহাজে বসে থাকবেন।

প্রমথ ধমক লাগিয়েছে, “আপনি তো আচ্ছা নোক মশাই, এতদূর গিয়ে বেড়াবেন না? তাহলে যাচ্ছেন কেন?”

কিন্তু একেনবাবু অনড়। তখন ঠিক হল, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা হবে। পোর্টে নেমে দেখব সস্তায় কোথাও যাওয়া যায় কিনা। তেমন হলে আমি আর প্রমথ ঘুরে আসব, একেনবাবু না হয় জাহাজেই থাকবেন।

.

।। ২ ।।

আর সাতদিন বাদে ক্রুজ শুরু হচ্ছে। সামার ভেকেশন চলছে বলে পড়ানোর দায়িত্ব নেই, দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছি। বাইরের ঘরে দেখি একেনবাবু সোফায় বসে পা নাচাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, “বুঝলেন স্যার, প্রমথবাবু বলছিলেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বাংলাদেশ নাকি আমাদের পশ্চিমবঙ্গকে হার মানায়।”

বিশ্বনিন্দুক প্রমথর এটা বলার একমাত্র কারণ আমাকে উত্ত্যক্ত করা। প্রমথ জানে দুই বাংলা নিয়ে নীচের অ্যাপার্টমেন্টের তারেক আলীর সঙ্গে আমার নিয়মিত যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধটা মূলত কালচারাল সাইড –নাটক, গান, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে। প্রমথ মাঝে মাঝে তাতে ইন্ধন জোগায়। একেনবাবুকে কিছু বলা মানে উনি সেটা আমাকে রিপিট করবেন। চেষ্টা হচ্ছে যুদ্ধের নতুন একটা ফ্রন্ট খুলতে।

আমি প্রমথর ফাঁদে পা দিলাম না। বললাম, “হতেই পারে, এ ব্যাপারে তো মানুষের হাত নেই। কিন্তু সে ব্যাটা গেছে কোথায়?”

“ল্যাবে। কী জানি একটা জরুরী কাজ আছে স্যার।” বলে একেনবাবু নিজের ঘরে অদৃশ্য হলেন।

আমি স্টোভ জ্বালাবার চেষ্টা করতে করতে ভাবছিলাম এবার এই প্রাগৈতিহাসিক স্টোভটাকে সার্ভিস করাতে হবে অথবা নতুন স্টোভ কিনতে হবে। আমি বা একেনবাবু কেউই ওটা জ্বালাতে পারি না। পাইলট কাজ করে না, বার্নারগুলোর অর্ধেক প্রায় বুজে গেছে। প্রমথ কিছু একটা করে, যার ফলে ওটা চালু হয়। কিন্তু ঠিক কী করে, সেটা ট্রেড সিক্রেট করে রেখে দিয়েছে! লাইটার দিয়ে ক্লিক ক্লিক করছি আর গ্যাস নবটা ঘোরাচ্ছি। হঠাৎ স্টোভটা দপ করে জ্বলে নিভে গেল! চমকে এক পা পিছিয়ে গেলাম, “হোয়াট দ্য হেল!” এমন সময় শুনি তারেকের গলা, “বাপিদাদা, কোনো সমস্যা?”।

বাইরের দরজা প্রমথ নিশ্চয় খোলা রেখে চলে গিয়েছিল, তারেক কখন ঢুকেছে খেয়ালও করিনি। ক’দিন আগে তারেক আমাকে এক চোট নিয়েছে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করা নিয়ে, যার কনফ্লুশন–বাংলাভাষাকে বাংলাদেশই বাঁচিয়ে রাখবে, পশ্চিমবঙ্গ নয়। সেই থেকে আমি তক্কে তক্কে রয়েছি। কোনও সমস্যা ইংরেজি নয় ঠিকই, কিন্তু এটি ইংরেজি any problem-এর একেবারে আক্ষরিক অনুবাদ। কলকাতায় কেউ ওভাবে কথা বলে না। আমি তারেককে চেপে ধরতেই বলল, “এটা ইংরেজি নয়, এটা বাংলাদেশের বাক্-রীতি। আমরা এরকম করেই কথা বলি ‘সমস্যা নাই’, ‘অসুবিধা নাই, ‘অবশ্যই’। আপনি যদি এর মধ্যে ‘no problem’, certainly’ এসব খোঁজেন তাহলে তো মুশকিল!”

আমি অন্য লাইন ধরলাম। “শোনো তারেক, তুমি তো সেদিন লেকচার ঝেড়ে গেলে আমরা পশ্চিমবঙ্গের লোকেরা বাংলাদেশের বই পড়ি না, সিনেমা দেখি না, ইত্যাদি। গত সপ্তাহে আমি সাতটা বাংলাদেশের নাটক দেখেছি ইউটিউবে, সেখানে তো ইংরেজির ছড়াছড়ি! ‘ফ্রেশ হয়ে নেওয়া’, ‘টেনশন নিও না, ‘ফান করা’, ‘লাভ করি’ ‘ওকে ডান’–এগুলো ইংরেজি নয়? না এগুলোও তোমাদের বাক-রীতি! এই করেই তোমরা বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখছ?”

“কী মুশকিল দাদা, আমি কি বলেছি বাংলাদেশে সবাই বাংলায় কথা বলে? ও কথা থাক, আরেকটা কথাও আমি বলেছিলাম, আমাদের দেশের নায়িকারা খুব সুন্দর দেখতে। সেটা কি এখন মানেন? আপনি তো আগে কাউকে দেখার যোগ্য মনে করেননি!”

“বাজে কথা বলছ, কখনোই সেটা বলিনি। দেখিনি এটুকুই বলেছি।”

“এখন তো প্রমথদাদার কাছে শুনলাম, আপনি নাকি বাংলাদেশের নায়িকাদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন!”

“প্রমথর কোনো কথা তুমি বিশ্বাস কর? তবে এটা ঠিক তোমাদের অনেক সুন্দরী নায়িকা আছে। সে কথা থাক, এই সাত সকালে আমার কাছে নিশ্চয় নায়িকা-সংবাদ নিতে আসনি?”

“তা আসিনি, নাস্তা হয়েছে আপনাদের?”

“দুয়েকটা ইংরেজি শব্দ আমার অনারে ব্যবহার কোরো, ব্রেকফাস্ট বললে বুঝতে সুবিধা হয়।”

“ঠিক আছে দাদা, ব্রেকফাস্ট হয়েছে?”

“না দেখছ তো, স্টোভটাই জ্বালাতে পারছি না। প্রমথটা সকালবেলা অদৃশ্য হয়েছে!”

“তাহলে নীচে চলুন। আমাদের ওখানে খাবেন। একেনবাবু কোথায়, ওঁকেও দরকার।”

একেনবাবু বোধহয় স্টোভ জ্বালানোর ঝামেলা এড়াতে ঘাপটি মেরে শোবার ঘরে বসেছিলেন! নাম শোনামাত্র বেড়িয়ে এসে বললেন, “কেমন আছেন স্যার?”

“ভালো আছি। আপনাদের ডাকতে এলাম, নীচে আসুন একসঙ্গে চা কফি খাওয়া যাবে।”

একেনবাবুকে সতর্ক করলাম আমি, “এটা কিন্তু নিঃশর্ত খাবার অফার নয়, আপনাকে ওর দরকার বলেছে। খাবার পর কিছু অনুরোধ করলে ফেলতে পারবেন না।”

“কী যে বলেন স্যার, আপনিও দেখছি প্রমথবাবুর মতো কথা বলছেন। এই স্যারের সঙ্গে কি আমার সেরকম সম্পর্ক!”

.

।। ৩ ।।

তারেকের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি ওর বন্ধু মামুদ কিচেনে ব্রেকফাস্ট বানাতে ব্যস্ত। একজন শুভ্রকেশ অচেনা বয়স্ক ভদ্রলোক ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে ফোনে কথা বলছেন। বেশভূষা আর চেহারায় বেশ আভিজাত্যের ছাপ। ভদ্রলোককে ডিস্টার্ব না করে সোজা কিচেনে গিয়ে হাজির হলাম। ওদের অ্যাপার্টমেন্টটা খানিকটা আমাদের মতো, তবে টু বেডরুমের। সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেই ডানদিকে কোট-ক্লজেট আর হাফ-বাথ। উলটোদিকে ড্রইং-রুম প্লাস ডাইনিং এরিয়া। ঢাকার হলওয়েটা শেষ হয়েছে কিচেনের সামনে। ডাইনিং এরিয়াতে কিচেনে থেকে যাওয়া যায়। জায়গাটা পুরো খোলা, কোনো দরজা নেই। হলওয়ে দিয়ে কিচেনে পৌঁছবার আগে ডান দিক দিয়ে আড়াআড়ি একটা প্যাসেজ। প্যাসেজে ঢুকলে প্রথমে পড়বে বেডরুমের দরজাগুলো আর শেষ প্রান্তে বড়ো বাথরুমটা।

মামুদ তারেকের সঙ্গে অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করে। আমাদের যেরকম প্রমথ, তারেকের সেরকম মামুদ –রান্নায় ওস্তাদ। তবে একটু মুখচোরা, কথাবার্তা বিশেষ বলে ।

পেঁয়াজ, লঙ্কা টম্যাটো দিয়ে বেশ কয়েকটা ফোলা ফোলা অমলেট একটা বড় ট্রে-তে রাখা। রুটি টোস্ট হচ্ছে। আপাতত মামুদ ব্যস্ত খুব সরু করে কাটা আলু আর পেঁয়াজ ভাজতে। এই বস্তুটি আবার একেনবাবুর অত্যন্ত প্রিয়। সুতরাং ঘুষটা একেবারে মুখে মুখে ধরিয়ে দেবার বন্দোবস্ত হচ্ছে!

আমি মামুদকে জিজ্ঞাসা করলাম, “ব্যাপার কি মামুদ, হঠাৎ এভাবে খাবার নেমন্তন্ন!”

মামুদ একটু লজ্জা পেল। বলল, “খালু এসেছেন… তাই ভাবলাম…।”

তারেক বিশদ করল, “মামুদের খালু ফরেন সার্ভিসে আছেন। ইউ এন-এ মাঝে মাঝে ডেলিগেট হয়ে আসেন। এবার হোটেলে না থেকে দিন দুই আমাদের সঙ্গে থাকবেন।”

উত্তরটা পেলাম, কিন্তু মাথায় তখন অন্য প্রশ্ন, খালু মেসোমশাই না পিসেমশাই? জিজ্ঞেস করতে গেলে খোঁটা খাব, বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ সম্পর্কে খবর রাখি না বলে! এর মধ্যে মামুদের খালু ফোন শেষ করে কিচেনে এসে গেছেন। আমাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “আদাব, আমি আব্দুল রহমান।”

আমি ওঁকে নমস্কার জানিয়ে বললাম, “আমি বাপি।”

তারেক আবার আমার নামের আগে ডক্টর জুড়ে দিয়ে বলল, “বাপিদা ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়ান। আর ইনি হচ্ছেন একেনবাবু, আপনাকে তো এঁর কথা আগেই বলেছি। একজন বিখ্যাত গোয়েন্দা।”

“কী যে বলেন স্যার!” একেনবাবু অনুযোগ ভরা দৃষ্টি নিয়ে তারেকের দিকে তাকালেন। তারপর হাত জোড় করে ঘাড়টাকে একেবারে নুইয়ে রহমান সাহেবকে বললেন। “আদাব স্যার, আদাব। তারেক সাহেব বড্ড বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছেন। বিখ্যাত। টিখ্যাত কিছু নই স্যার, তবে পেটের দায়ে একটু-আধটু গোয়েন্দাগিরি করি, এইটুকুই।”

একেনবাবুর ভাবভঙ্গি দেখে রহমান সাহেবের চোখে কৌতুক। এগিয়ে এসে একেনবাবুর হাতটা দুহাতে ধরে বললেন, “তা তো বুঝলাম, কিন্তু আপনাকে যে আমার একটু দরকার। কাল আপনার কথা শোনামাত্র আমি ওদের বলেছি আপনার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে।”

রহমান সাহেবকে মামুদ বলল, “তোমরা টেবিলে গিয়ে বসো, ব্রেকফাস্ট প্রায় রেডি। আমি আর তারেক এক্ষুণি নিয়ে আসছি।”

যেহেতু দরকারটা আমাকে নয়, আমি কিচেনেই দাঁড়িয়ে থাকার প্ল্যান করছিলাম। কিন্তু একেনবাবু আমার হাত ধরে টান দিলেন, “চলুন স্যার।” তারপর রহমান সাহেবকে বললেন, “বাপিবাবু আর প্রমথবাবু, আমরা সবাই এক টিম।”

রহমান সাহেব সপ্রশ্নে তাকালেন, “প্রমথবাবু!”

“প্রমথ কেমিস্ট্রিতে পোস্ট ডক করছে।” আমি উত্তর দিলাম। “এই মুহূর্তে ও কলেজে।”

“আই সি।” কিচেন থেকে বেরোনোর মুখে একেনবাবুকে আপাদমস্তক আরেকবার দেখে রহমান সাহেব বললেন, “আপনি যে এতবড়ো ডিটেকটিভ, সেটা কিন্তু দেখলে বোঝা যায় না।” বলেই বোধহয় একটু লজ্জা পেলেন।

রহমান সাহেবের কথাটাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। একেনবাবুর চেহারা, বেশভূষা বা কথাবার্তা কোনোটাই গোয়েন্দাসুলভ নয়। আমি একটু মজা করেই রহমান সাহেবকে বললাম, “এই সিম্পল্টন চেহারাটা হল ওঁর একটা মুখোশ।”

“না না সেটা নয়, আসলে আমি ভেবেছিলাম উনি…” কি ভেবেছিলেন সেটা আর বিশদ না করে মামুদকে চেঁচিয়ে বললেন, “আমার কফিতে কিন্তু চিনি দিস না।” তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আসলে আমার বর্ডারলাইন ডায়েবিটিস, একটু সতর্ক থাকি।”

বোঝা যায়, পাক্কা ডিপ্লোম্যাট, কথা ঘোরানোতে খুবই পটু।

ডাইনিং টেবিলে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রহমান সাহেব শুরু করলেন। “ঠিক কোত্থেকে শুরু করব ভাবছি… মাস দুয়েক আগে একটা চিঠি আমাদের গ্রামের বাড়িতে আসে। চিঠিটা নিউ ইয়র্ক থেকে লেখা। লিখেছেন এড ফাউলার নামে একজন। আমরা জয়েন্ট ফ্যামিলি, গ্রামের বাড়িটা সরিকি বাড়ি। বাড়িটা টিকে আছে, কিন্তু কেউই ওখানে থাকে না। চিঠিটা ওখানে পড়েছিল বেশ কিছুদিন।”

“কার নামে চিঠিটা এসেছিল স্যার?”

“কারোর নামে নয়, বাড়ির ঠিকানায়।”

“ভারি ইন্টারেস্টিং স্যার, তারপর?”

“আমি চিঠিটার কথা জানতামও না। বড়োচাচার চোখে চিঠিটা প্রথমে পড়ে। চাচার অনেক বয়স হয়েছে। এমনিতেই নার্ভাস প্রকৃতির লোক, এখন মাথাও ঠিক মতো কাজ করে না। নিজে ভালো ইংরেজি জানেন না, চিঠিটা ইংরেজিতে দেখে বাড়ির আর কাউকে কিছু না জানিয়েই পোস্ট অফিসে গিয়ে পোস্টমাস্টারকে দিয়ে চিঠিটা পড়ান।

আমি নিজে চিঠিটা দেখিনি, বড়োচাচা এরমধ্যেই সেটা হারিয়ে ফেলেছেন! তবে পোস্টমাস্টারের কাছে যা শুনলাম, সাহেবটি জানতে চেয়েছিলেন আমাদের বাড়িতে মকবুল রহমান নামে কেউ থাকতেন কিনা। এ ব্যাপারে কোনো তথ্য থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ওঁকে জানাতে। বিষয়টা আর্জেন্ট এবং অফ আটমোস্ট ইম্পর্টেন্স- এই কথাগুলোই নাকি চিঠিতে ছিল।

মকবুল রহমান আমাদের দেশে একটা কমন নাম, আমাদের আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও বেশ কয়েকজন আছে। ইনফ্যাক্ট, আমার দাদার ছোটোচাচার নামও মকবুল রহমান ছিল।”

“দাদার ছোটো চাচা? আমি সম্পর্কটা ঠিক ধরতে পারলাম না।”

“মানে ঠাকুরদার ছোটো কাকা,” তারেক বিশদ করে দিল।

“এক্সাক্টলি। তা আমার এই গ্রেট গ্র্যান্ড আঙ্কল মকবুল রহমান বাড়ির সঙ্গে ভীষণ ঝগড়াঝাটি করে ইউরোপে চলে গিয়েছিলেন।”

“বলেন কি, অতদিন আগে! কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল স্যার?”

“ডিটেলস কিছু জানি না। তবে সেকালে আর কি নিয়ে ঝগড়া হত, নিশ্চয় পড়াশুনো বা বিয়ে করা নিয়ে। মোটকথা, কাউকে না জানিয়ে জাহাজে চাকরি নিয়ে উনি অদৃশ্য হন। তারপর কোনো যোগাযোগ রাখেননি। শুনেছি সেখানেই তিনি মারা যান, সম্ভবত খুন হন। এগুলো সবই আবছা আবছা খবর, কারণ মুরুব্বিদের হুকুমে ওঁকে নিয়ে বাড়ির কোনো আলোচনাই হত না। যাইহোক, একজন সাহেব মকবুল রহমানের খোঁজ করছেন জেনে, বড়োচাচা উত্তেজিত হয়ে পোস্টমাস্টারকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে একটা উত্তর লিখিয়ে সাহেবকে পাঠান।”

রহমান সাহেবের গল্পে ছেদ পড়ল। মামুদ আর তারেক ব্রেকফাস্ট নিয়ে এসেছে।

“আসুন আগে খেয়ে নেওয়া যাক,” বলে রহমান সাহেব কফির কাপ আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন। তারেক আর মামুদও আমাদের সঙ্গে বসল।

মামুদের বানানো অমলেট মুখে দিলেই গলে যায়। কাঁচা লঙ্কার কুচোগুলো একটু কড়া করে ভেজে অমলেটে দেওয়ায় তাতে চমৎকার একটা কিক্ যোগ হয়েছে। আলু-পেঁয়াজ ভাজাও আজ ফাটাফাটি! আরেকটা প্লেটে সসেজ আর বেকন রয়েছে দেখলাম। হিন্দুদের যেরকম বিফ মুসলমানদের সেরকম পৰ্ক। ভেবেছিলাম রহমান সাহেবের অনারে ওগুলো হয়তো আজ থাকবে না।

মুখে কিছু বলিনি, ওদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রহমান সাহেব একটু হেসে বললেন, “তুমি বোধহয় সসেজ আর বেকন দেখে অবাক হচ্ছ। তাহলে শোনো, আমাদের চোদ্দপুরুষও এসব মানেনি। একঘরে কথাটা শুনেছ তো, আমরা একগ্রামে হয়েছিলাম বহুবছর। আমাদের গ্রামে কেউ বিয়েও দিত না।”

একেনবাবু তাঁর প্রিয় আলু-পেঁয়াজ ভাজা প্রায় ধ্যানমগ্ন হয়ে কিছুক্ষণ খাবার পর বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং।”সেটা ঠিক কোন প্রসঙ্গে বুঝলাম না, বোধ হয় সেই চিঠির প্রসঙ্গেই। কারণ রহমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তারপর বলুন, স্যার, কী জানি বলছিলেন।”

“ও হ্যাঁ,” রহমান সাহেব শুরু করলেন, “এর মধ্যে আমার নিউ ইয়র্কে আসার প্ল্যান ঠিক হয়ে গেছে। ফাউলার সাহেবের চিঠিটা বড়োচাচা হারিয়ে ফেলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু খামটা ছিল। ঢাকা ছাড়ার ঠিক আগের দিন বড়োচাচা আমার বাড়িতে সেই খামটা দিয়ে বললেন, ফাউলার সাহেবের কাছ খোঁজ নিতে সেই আর্জেন্ট ব্যাপারটা মিটে গেছে কিনা! ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’ বলে তো বড়চাচাকে কাটালাম। মুশকিল হল বড়োচাচার মাথায় কিছু চাপলে সেটা যায় না। এখানে এসে পৌঁছনোর দু’দিন বাদেই চাচার ফোন। এই অবস্থায় লোকটার খোঁজ না করে আমার উপায় নেই। সেইজন্যেই আপনাদের খোঁজ করছিলাম।”

আমি রহমান সাহেবের কথাটা বুঝলাম না। নিউ ইয়র্কের ঠিকানা জানা আছে, ধরে নিচ্ছি বাংলাদেশ কনসুলেটে লোকেরও অভাব নেই। এটা এমন কী একটা কঠিন কাজ যার জন্যে একেনবাবুকে লাগবে! ভাগ্যিস প্রমথ সঙ্গে নেই। থাকলে বলত, “আপনি একেনবাবুর বদলে একটা পোস্টম্যানের সাহায্য নিন।

আমার চোখ একটু বিস্ময় লক্ষ্য করে রহমান সাহেব বললেন, “এড ফাউলারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আমাদের ইউ.এন অফিসের একটি ছেলেকে পাঠিয়েছিলাম। ঘন্টা চারেক বাদে ছেলেটা ফিরল। ঠিকানা খুঁজে পেতে নাকি অনেক সমস্যা হয়েছিল। শেষপর্যন্ত পেয়েছিল, কিন্তু ফুটলেস ট্রিপ। ঐ ঠিকানায় এড ফাউলার নামে কোনো লোকই থাকে না।”

এইবার সমস্যাটা বুঝলাম।

একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “ইন্টারেস্টিং, ঠিকানাতে কোনো ভুলচুক হয়নি তো স্যার?”

“না, এই তো ফাউলারের পাঠানো খামটা আমি নিয়ে এসেছি,”বলে পকেট থেকে একটা খাম বার করলেন।

খামটা নানান হাত ঘুরে মলিন হয়ে গেছে। ঠিকানায় লেখা Rahman Residence, Gaibasa, Bangladesh, আর খামের ওপরে বাঁদিকে লেখা Ed Fowler, তার নীচে 38 47 103rd st, Corona, NY 11368।

আমি ঠিকানাটা দেখে বললাম, “করোনা। জায়গাটা তো কুইন্সে।”

“হ্যাঁ, সেটাই ছেলেটার কাছে শুনলাম। বলল, কুইন্সে নাকি ঠিকানা খুঁজে পাওয়া কঠিন।”

“ঠিক কথাই বলেছে,” মামুদ সমর্থন করল। “ম্যানহাটনে নম্বর দিয়ে স্ট্রিট আর অ্যাভেনিউ। কিন্তু কুইন্সে নম্বর দিয়ে স্ট্রিট, রোড, ড্রাইভ, লেন… সবকিছুই হতে পারে।”

মামুদের এই কথার অর্থ আমি বুঝলাম না।

একেনবাবুও বললেন, “কিন্তু স্যার, এখানে লেখা তো আছে স্ট্রিট।”

“তা আছে। কিন্তু ৩৮-৪৭-এর অর্থ কি? ১০৩ স্ট্রিট তো লম্বা রাস্তা।”

“আচ্ছা, এটা কি হতে পারে স্যার, আপনার অফিসের লোকটি ঠিক ঠিকানায় পৌঁছননি?”একেনবাবু রহমান সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন।

“অসম্ভব নয়, এমনিতে অবশ্য ও খুব এফিশিয়েন্ট।”

“আপনি কি চান স্যার আমরা এই ফাউলার সাহেবের খোঁজ করি?”

“সত্যি কথা বলতে কি, যখন আমি মামুদের কাছে শুনলাম আপনার কথা, তখন ভাবলাম যদি ফাউলারকে খুঁজে বার করতে পারেন মন্দ হয় না। কিন্তু এখন আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মনে হচ্ছে, এটা সত্যিই তো এমন কোনো দরকারি ব্যাপার নয়… না জানলেও ক্ষতি নেই।”

“কোনো কিছুই তো জীবনে দরকারি নয় স্যার!”একেনবাবু একেবারে দার্শনিকের বাণী ছাড়লেন। “তবে আপনি চান তো একবার খোঁজ করে দেখতে পারি।”

“দেখবেন! আসলে আপনার সময়ের দাম দেবার ক্ষমতা…। বুঝতেই তো পারছেন বাংলাদেশের সরকারী কর্মচারী…।”

“কী যে বলেন স্যার, আপনি হলেন মামুদ সাহেবের খালু, এটুকু আপনার জন্যে আমরা করব না! এখানে সময়ের দাম দেবার প্রশ্ন উঠছে কেন?”

ভাগ্যিস প্রমথ এখানে নেই। থাকলে একেনবাবুকে ঝাড়ত। বলত, “আপনি নিজে ভালেমানুষি দেখান ফাইন, কিন্তু উঠবেন তো বাপির গাড়িতে… ওর তেলের খরচ আছে না? আর আমাদের সময়ের দাম নেই! তবে একেনবাবু সেটা গায়ে মাখতেন না। আমার দিকে শুধু তাকিয়ে বলতেন, ‘প্রমথবাবু না, সত্যি!’ আর প্রমথ তখন গজগজ করত আমি এর মধ্যে নেই। কিন্তু শেষমেষ ঠিকই আসত।