শান্তিনিকেতনে অশান্তি – একেনবাবু গোয়েন্দা কাহিনী – সুজন দাসগুপ্ত
৷৷ ১ ৷৷
দেশে ছুটি কাটাতে যাব, যাবার মাত্র সাতদিন বাকি। ঠিক এই সময়ে সুভদ্রামাসির বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে যাবার মোটেই ইচ্ছে ছিল না। কেনাকেটা ছাড়াও যাবার আগে বেশ কিছু কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু সুভদ্রামাসি ছাড়লেন না। শুধু আমি না, একেনবাবু আর প্রমথকে নিয়ে আসা চাই। প্রমথ তো কথাটা শুনে খেঁকিয়ে উঠল, “নিয়ে আসা চাই মানে? তুই আমার গার্জেন নাকি? তোর ইচ্ছে হয় যা, তোর ঐ ডিপ্রেসিং সুভদ্রামাসির বাড়ি আমি যাচ্ছি না।” বলেই গটগট করে ইউনিভার্সিটি চলে গেল।
প্রমথর এই রিয়্যাকশনে আমি আশ্চর্য হইনি। জানি শেষমেষ ও ঠিকই যাবে। প্রমথটা ভোজনরসিক, আর সুভদ্রামাসির কুক সুজাতা দুর্দান্ত রান্না করে বিশেষ করে বাঙালি রান্না। তবে ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে কোনো প্ল্যান থাকলে অন্য কথা। একেনবাবু সুভদ্রামাসিকে চেনেন না, তাও একেনবাবুকে নিয়ে সমস্যা হবে না জানতাম। যে কোনো জায়গায় যেতে উনি এক পায়ে খাড়া। আমায় শুধু জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাডাম কি স্যার ডিপ্রেশনে ভুগছেন?”
“আরে না, প্রমথকে তো চেনেন। তবে হ্যাঁ, ওর জীবনটা একটু স্যাড ঠিকই।”
“কেন স্যার?”
“মা’র কাছে শুনেছি এদেশে পড়াশুনা করতে এসে এক সায়েবকে বিয়ে করেন। ওঁর বাবা-মা সেটা অ্যাকসেপ্ট করেননি। বহুদিন কোনো যোগাযোগ ছিল না দেশের সঙ্গে। তার ওপর নিজের ছেলেপুলে হয়নি। একটা বাচ্চা অ্যাডপ্ট করেছিলেন, সে আবার স্কুলে যাবার পথে অ্যাকসিডেন্টে মারা যায়।”
“মাই গড! কতদিন আগের ঘটনা স্যার?”
“তা অনেক বছর হল, আমার বয়স তখন চোদ্দো-পনেরো।”
“সে তো অনেক বছর আগেকার কথা।”
“তাতে কি, ছেলেমেয়ে হারানোর দুঃখ কখনো যায় নাকি! শুধু তাই নয়, কয়েক বছরের মধ্যে আবার বাবা-মা-স্বামী সবাইকে হারান।”
“কিন্তু স্যার, মা-বাবার সঙ্গে তো যোগাযোগ ছিল না বললেন।”
“ছেলে মারা যাবার পর হয়েছিল। তখন কলকাতাতে স্বামীকে নিয়ে বেড়াতে আসতেন নিয়মিত। ইনফ্যাক্ট তখনই আমি ওঁকে আর রিচার্ডমেসোকে দেখি। রিচার্ডমেসো বেশ ইন্টারেস্টিং লোক ছিলেন, খুব ক্রিপ্টিকালি কথাবার্তা বলতেন।”
“আপনি বলছিলেন স্যার কয়েক বছরের মধ্যে সবাই মারা যান..” একেনবাবু খেই ধরিয়ে দিলেন।
“ও হ্যাঁ, তখন আমি বি.এসসি পড়ছি। বাথরুমে পড়ে মাথা ফেটে মারা গেলেন সুভদ্রামাসির মা। হাসপাতালে থাকার সময়ে রক্তের দরকার রিচার্ডমেসো আর আমি রক্ত দিয়েছিলাম। কিন্তু সুভদ্রামাসির মা’র জ্ঞান আর ফিরল না। এক বছর পেরোতে না পেরোতেই সুভদ্রামাসির বাবা মারা গেলেন একটা সিম্পল অ্যাপেনডিক্স অপারেশনে।”
“হোয়াট ওয়েন্ট রং স্যার?”
“হু নোজ। রিচার্ডমেসোকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম। ওঁর উত্তর টুথ অ্যাস অফটেন ইজ নট নোন। এর পরপরই রিচার্ডমেসোর ক্যানসার ধরা পড়ে। বছর দুই-তিন বেঁচে ছিলেন। তারমধ্যেও কলকাতায় এসেছিলেন শুনেছি, কিন্তু আমি তখন বাইরে পড়তে চলে গেছি।”
“তার মানে স্যার, ম্যাডাম এখন একেবারেই একা।”
“হ্যাঁ, তার ওপর আথ্রাইটিস-এর কোপে গৃহবন্দি। দ্যাটস দ্য স্যাড পার্ট।”
ঐ যাঃ, গল্প শুরু করতে গিয়ে ভুলেই গেছি স্থান-কাল-পাত্রের কথা। স্থান নিউ ইয়র্ক। কাল ২০০২ সাল। আমি বাপি দে, নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ফিজিক্স পড়াচ্ছি বছর দুয়েক হল। প্রমথ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। কেমিস্ট্রিতে পোস্ট ডক করছে একই ইউনিভার্সিটিতে। এই কাহিনীর মুখ্য চরিত্র অবশ্য একেনবাবু। এককালে উনি কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদপ্তরে কাজ করতেন। সেই সময়ে নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন একটা এক্সচেঞ্জ পোগ্রামে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ তখন ম্যানহাটানের মুনস্টোন মিস্ট্রি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিল, একেনবাবু সেটির সমাধান করেন। সেই থেকেই নিউ ইয়র্ক পুলিশের ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট একেনবাবুর গুণমুগ্ধ ভক্ত। অল্প কিছুদিনের জন্য দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। আবার ফিরে এসেছেন। এবার এসেছেন একটা ফুলব্রাইট ফেলোশিপ বাগিয়ে ক্রিমিনোলজির উপর রিসার্চ করবেন। আমার আর প্রমথর সঙ্গে ওয়াশিংটন স্কোয়ারের কাছে একটা থ্রি বেডরুম অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করছেন।
একেনবাবু দেখলে অবশ্য ডিটেকটিভ বলে মনে হবে না। বেঁটেখাটো মোস্ট আনইম্প্রেসিভ চেহারা। জামাকাপড়ের অবস্থাও তথৈবচ। হাবেভাবে মনে হয় একটা স্টেট অফ কনফিউশনের মধ্যে আছেন। মাঝেমধ্যেই উলটোপালটা কথা বলেন। তবে যেটা সবচেয়ে ইরিটেটিং, সেটা হল কথায় কথায় ‘স্যার’ আর ‘ম্যাডাম’ বলা। দেশে হয়তো সেটা চলে, কিন্তু আমেরিকায় নয়। বিটকেল অ্যাকসেন্টের ইংরেজির মধ্যে স্যার আর ম্যাডামের বন্যা বইয়েও উনি যে দিব্যি করে খাচ্ছেন, তাতে অচেনা লোকেরা অবাক হলেও আমরা আর হই না। তলে তলে উনি যে একজন ধুরন্ধর ডিটেকটিভ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ও হ্যাঁ, ফ্রান্সিস্কার পরিচয়টা এখনও দেওয়া হয়নি। ফ্রান্সিস্কা সুইটজারল্যান্ডের মেয়ে, ভারি মিষ্টি চেহারা। কেমিস্ট্রিতে পিএইচডি করছে। সেই সূত্রেই প্রমথর সঙ্গে আলাপ। সে আলাপটা এখন যে পর্যায়ে তাতে ওকে প্রমথর গার্লফ্রেন্ড বলা চলে। প্রমথ অবশ্য গার্লফ্রেন্ড কথাটা শুনলেই ক্ষেপে ওঠে। ‘ফ্রেন্ড বলতে পারিস না, সঙ্গে গার্ল যোগ করতে হবে কেন!’
মেয়েটির চেহারাটাই শুধু মিষ্টি নয়, স্বভাবটাও চমৎকার। কেমিস্ট্রি সাবজেক্ট হলেও মিউজিক এবং আর্টের ব্যাপারেও প্রচুর ইন্টারেস্ট যেটা আমাদের তিনজনের কারোর মধ্যেই তেমন নেই।
একেনবাবুর সঙ্গে সুভদ্রামাসির কথা শেষ হতে না হতেই ফ্রান্সিস্কার ফোন। প্রমথর খোঁজ করছে। প্রমথ ইউনিভার্সিটিতে চলে গেছে বলার পর আমার কি মনে হল, জিজ্ঞেস করলাম উইক-এন্ডে ওর কোনো প্ল্যান আছে কিনা।
“তেমন কিছু নেই।”
“তাহলে চলো না, আমার মায়ের এক বন্ধু সুভদ্রামাসির কাছে যাচ্ছি। তুমি গেলে, প্রমথও যাবে।”
আমি অবশ্য এক্সপেক্ট করিনি ফ্রান্সিস্কা রাজি হবে এভাবে যেতে। ও আমায় জিজ্ঞেস করল, “উনিই তো গান গাইতেন, তাই না?”
সুভদ্রামাসি এক কালে খুবই ভালো গাইতেন– মার কাছেই শুনেছি। কথা প্রসঙ্গে হয়তো সেটা একবার বলেছিলাম। কিন্তু ফ্রান্সিস্কার যে সেটা মনে থাকবে ভাবিনি।
আমি বললাম, “হ্যাঁ।”
“আই উইল কাম।”
ফ্রান্সিস্কার কথা শুনে আমি থ্রিলড। অর্থাৎ প্রমথ ব্যাটাকেও আসতে হবে।
.
৷৷ ২ ৷৷
আমরা বেরোলাম প্রায় আড়াইটে নাগাদ। প্ল্যান ছিল ফ্রান্সিস্কাকে ওর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তুলে নিয়ে যাব। কিন্তু একেবারে শেষ সময়ে সেটা বাতিল করতে হল। শুক্রবার ফ্রান্সিস্কার একটা ইমপর্টেন্ট এক্সপেরিমেন্ট ছিল, যেটা ভন্ডুল হওয়ায় আজকে আবার করতে হচ্ছে! প্রমথ বলল, “ভালোই হল, ইংরেজিতে বকবক করতে হবে না।”
ওটা মুখের কথা, বুঝলাম ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
.
সুভদ্রামাসি থাকেন নিউ জার্সির উত্তর দিকে লেক ভালহাল্লা বলে একটা জায়গায়। আমাদের বাড়ি থেকে মাইল পঁয়ত্রিশ দূরে। নিউ জার্সি যেতে হলে হাডসন নদী পার হতে হয়। ব্রিজ বা টানেল দুটোই নেওয়া যায়। সেবার গিয়েছিলাম লিঙ্কন টানেল দিয়ে। এবার ধরলাম জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজ। কিন্তু এমনই কপাল, পড়লাম জ্যামে। পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল শুধু ব্রিজ পার হতে। তারপর হাইওয়ে আই-৮০ ধরে মন্টভিল শহরে পৌঁছোতেই বাজল প্রায় চারটে। তখনও বেশ কিছুটা পথ বাকি।
লেক ভালহাল্লা মন্টভিল শহরের পাশে একটা পাহাড়ি শহরতলি। পাহাড়ের নীচে ভালহাল্লা লেক। তার পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে গাড়ি যাবার রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে প্রায় আধমাইল গেলে, বাঁদিকে পড়ে সুভদ্রামাসির বাড়ি। এখানকার বাড়িগুলোর চারপাশে অনেকটা করে জায়গা। সামনে অল্প একটু ফুলের বাগান ছাড়া পুরোটাই গাছপালায় ভর্তি। বেশ জঙ্গল জঙ্গল চেহারা। আমি গাছপালা খুব একটা ভালো চিনি না। প্রমথ কিছু চেনে, অন্তত দাবি করে চেনে বলে। আমাদের কয়েকটা গাছ আর ঝোঁপ চেনাল। ওক, উইপিং উইলো, বার্চ, ডগউড, ফরসিথিয়া, আরও বেশ কয়েকটা নাম –এখন আর মনে পড়ছে না।
একেনবাবু দেখলাম একেবারে মুগ্ধ। আমাকে বললেন, “সত্যি স্যার, প্রমথবাবুর এ ব্যাপারে দেখছি অগাধ জ্ঞান। অ্যামেজিং!”
গাছপালা দেখতে দেখতে আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম।
“এই বাড়ি পার হয়ে চলে যাচ্ছিস যে!” প্রমথর চিৎকারে চমক ভাঙল।
“সরি,” বলে গাড়িটা ব্যাক করে, সুভদ্রামাসির ড্রাইভওয়েতে ঢোকালাম।
বেল বাজিয়ে দেখি এক সায়েব দরজা খুলেছে। সেরেছে, বাড়ি ভুল করলাম নাকি! প্রমথ চেঁচিয়ে উঠেছিল বলে, বাড়ির নম্বরটাও দেখিনি। প্রমথও মনে হল একটু হতচকিত। একেনবাবুর মুখ দেখে অবশ্য কিছুই বোঝা যায়না, কারণ উনি সবসময় একটা স্টেট অফ কনফিউসানের মধ্যে থাকেন!
আমাদের অবস্থা দেখে ভদ্রলোক মনে হল যেন একটু অ্যামিউজড। দরজাটা পুরোপুরি খুলে দিয়ে একটু সরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আসুন, উনি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।”
দরজা দিয়ে ঢুকলেই একটা ছোট্ট ফয়ার, আর তার বাঁ পাশে হল বসার ঘর। সুভদ্রামাসি সেখানেই ছিলেন।
“এসো, এসো, এত দেরি হল কেন? আমি তো ভাবলাম তিনটে চারটের মধ্যেই চলে আসবে।”
“সেই ভাবেই বেরিয়েছিলাম, কিন্তু জর্জ ওয়াশিংটন ব্রিজে আজ জ্যাম।”
“সেটাই রোহিত বলল, নিশ্চয় ব্রিজ বা টানেলে আটকা পড়েছ,” সুভদ্রামাসি পরিষ্কার বাংলাতেই বললেন।
“এসো, তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। এ হল রোহিত, রোহিত রয়। এককালে রিচার্ডের রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট ছিল। এখন অবশ্য ও একজন বিগ শট।”
আরে, ইনি তো বাঙালি! শুধু দেখতে সাহেবের মতো আর কথা বলেন ইংরেজিতে।
“একদম বাজে কথা, বিশ্বাস করবেন না,” বলে রোহিত এগিয়ে এসে একে একে আমাদের সবার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলেন। আমি আর প্রমথ নিজেদের পরিচয় দিলাম।
সুভদ্রামাসি বললেন, “এদের একজন ফিজিক্সে ডক্টরেট, আরেকজন কেমিস্ট্রিতে।”
রোহিত চোখ কপালে তুলে বললেন, “আপনারা তো জিনিয়াস! বুঝলেন, ফ্রেশম্যান ইয়ারে ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রি –দুটো সাবজেক্টই ছিল আমার নাইটমেয়ার। কোনোমতে সি মাইনাস পেয়ে পাশ করেছি। এমন কি এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন দেখি, আবার ফিজিক্স কেমিস্ট্রি পরীক্ষা দিতে বসেছি, কিন্তু একটা প্রশ্নও বুঝতে পারছি না –ঘেমে নেয়ে অস্থির।”
“আপনি স্যার ভীষণ ফানি!” একেনবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন।
“দাঁড়ান, দাঁড়ান, আপনিও ফিজিক্স?”
“আর ইউ ম্যাড স্যার! আমার এঁদের মতো ডিগ্রি ফিগ্রি নেই –আমার বিদ্যে বি.এ পর্যন্ত।”
রোহিত কিছু বলার আগেই প্রমথ বলল, “আমাদের একেনবাবু একটু বিনয়ী। উনি ফিজিক্স কেমিস্ট্রির অনেক ঊর্ধে –ক্রিমিনোলজির লোক।”
রোহিত সেটা শুনে খুব উৎসাহিত হলেন, “সত্যি! একদিন তাহলে আপনার সঙ্গে ভালো করে আলাপ করব। ঐ সাবজেক্টের কিছুই জানি না, কিন্তু খুব ফ্যাসিনেশন আছে।”
রোহিতের পরিচয় পরে আরেকটু বিশদ করে পেলাম। মা জার্মান। চেহারাটা মায়ের দিক থেকেই পেয়েছেন। জন্ম জার্মানিতে, তবে বড় হয়েছেন এদেশে। বাঙালির ছেলে হওয়া সত্ত্বেও, বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ ছেলেবেলাতে ছিল না। ভারতবর্ষে প্রথম গেছেন বাবার মৃত্যুর পর, যখন কলেজে পড়তে ঢুকেছেন। পরে অবশ্য অনেকবারই গেছেন। একবার সুভদ্রামাসি আর রিচার্ডমেসোর সঙ্গেও গিয়েছিলেন। অ্যানথ্রপলজিতে আন্ডার গ্রাজুয়েট করে মাস্টার্স করছিলেন, কিন্তু নেশা ছিল ফোটোগ্রাফির। তাই পড়াশুনো ছেড়ে হয়ে গেলেন ফ্রিলান্স ফোটো জার্নালিস্ট। সারা বিশ্ব ঘুরে ঘুরে ছবি তোলেন, আর সেই সম্পর্কে আর্টিকেল লেখেন। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, লাইফ, টাইমস ইত্যাদি বড়ো বড়ো ম্যাগাজিনেও ওঁর তোলা ছবি আর লেখা ছাপা হয়েছে। রোহিত অবশ্য বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। ওঁর ফিয়াসে সেদিনই আসছেন লন্ডন থেকে। তাঁকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে চলে গেলেন।
রোহিত চলে যেতে আমরা সবাই বসার ঘরে আরাম করে বসলাম। সুভদ্রামাসি দেখলাম রোহিতকে খুব স্নেহ করেন। বললেন, “অনেক গুণ ছেলেটার। এই বাড়িটা ওই আমাদের খুঁজে দিয়েছিল। ও অবশ্য বলে আমাদের নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টের উপর লোভ ছিল বলে এই খোঁজাখুঁজিগুলো করেছে। তারপর যখন রিচার্ডের ক্যানসার ধরা পড়েছে তখনও প্রচুর সাহায্য করেছে আমাদের।”
“তোমাদের সেই নিউ ইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্টে উনি থাকেন?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“হ্যাঁ, ওটা কিনেছে। কিন্তু থাকে আর ক’দিন, বাইরে বাইরেই তো ঘুরছে! এই তো আবার থাইল্যান্ড যাচ্ছে –ওখানকার জঙ্গলে গিয়ে ছবি তুলবে। এক্কেবারে মাথার স্থির নেই। একবার এটা করে –একবার ওটা ধরে। যাক, এবার এই বৃটিশ মেয়েটার সঙ্গে ভাব হয়েছে। যদি একটু ঠান্ডা হয়।”
.
সুভদ্রামাসির বসার ঘরটা সত্যিই বিশাল। সিলিংটা খুব উঁচু –যাকে এদেশে বলে ক্যাথিড্রাল সিলিং। সিলিং-এর দুই দিকে দু’টো বড়ো বড়ো স্কাইলাইট। একদিকে বিশাল একটা ফায়ার প্লেস। তার দুপাশে দেয়াল জুড়ে অনেক রকমের মুখোশ। আমি আর প্রমথ অবশ্য এগুলো দেখেছি। একেনবাবু এই প্রথম এলেন। সেগুলোর দিকে উনি বার বার তাকাচ্ছেন দেখে সুভদ্রামাসি বললেন, “এটা ছিল রিচার্ডের শখ। ঘুরে ঘুরে এগুলো সংগ্রহ করেছে।”
একেনবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে মুখোশগুলো দেখতে লাগলেন। তারপর ঘরটা একবার চক্কর দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “আপনার বাড়িটা কিন্তু ম্যাডাম আউট অফ দ্য ওয়ার্লড।”
“আমাকে তুমি মাসিমা ডেকো,” সুভদ্রামাসি বললেন। “কিন্তু বাড়িটা তো এখনও দেখইনি!”
“না না যতটুকু দেখেছি ম্যাডাম, মানে মাসিমা –সত্যি, এরকম জায়গা নিউ ইয়র্কে থেকে কল্পনা করা যায় না।”
“দেখেছেন,” সুভদ্রামাসিকে বলল প্রমথ, “বাপির অ্যাপার্টমেন্টের কিরকম নিন্দা করছেন!”
“আরে ছি ছি স্যার, নিন্দা কখন করলুম? আপনি না স্যার, সত্যি!”
সুভদ্রামাসি সস্নেহে হেসে বললেন, “চলো একেন, তোমাকে বাড়িটা দেখিয়ে দিই।”
“আপনার কষ্ট হবে না তো?”
“আরে একটু কষ্ট হোক। হাঁটা চলা না করলে, পরে আরও কষ্ট হবে। আমাকে বরং ওই লাঠিটা দাও।”
তিন পা-ওয়ালা একটা লাঠি সোফার একপাশে কার্পেটের ওপর শোয়ানো ছিল। একেনবাবু সেটা তুললেন। সুভদ্রামাসিকে সোফা থেকে উঠতে আমি একটু সাহায্য করলাম। দেখলাম লাঠি নিয়ে সুভদ্রামাসি বেশ সহজেই হাঁটতে পারছেন। কিচেনে সুভদ্রামাসির কুক সুজাতা তখনও রান্না করছেন। কেরালার মহিলা, বেঁটে শক্তপোক্ত চেহারা। কোঁকড়া চুল টানটান করে খোঁপায় বাঁধা। মুখটা গোলগাল। তবু কোথায় যেন একটা কাঠিন্য আছে।
“সুজাতাকে তো তোমাদের মনে আছে?” আমরা মাথা নাড়লাম। একেনবাবুর সঙ্গে সুজাতার পরিচয় করিয়ে দিলেন সুভদ্রামাসি। “আমার বহুদিনের সাথি সুজাতা– সুখে দুঃখে সব সময়ে আমার পাশে আছে।”
সুভদ্রামাসি সত্যিই খুব সুইট। সুজাতা ওঁর কুক-কাম-হেল্পার, কিন্তু যতটুকু আমি দেখেছি কথায় / বার্তায় কে মনিব কে কর্মচারী –সেটা বোঝার উপায় নেই।
সুজাতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই আপ্লুত স্বরে একেনবাবু বললেন, “ফুড স্মেলস ভেরি গুড।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
.
কিচেনের সঙ্গে লাগোয়া ব্রেকফাস্টের জায়গা। সেখান থেকে ফ্যামিলি রুমে যাওয়া যায়। বসার ঘর দিয়েও যাওয়া যায়। বসার ঘরটা বাইরের অভ্যাগতদের জন্য। বিশেষ পরিচিতরা ভেতরে ফ্যামিলি রুমেই বসে। সেখানেও একটা ফায়ার প্লেস। ঘরের একদিকে শুধু কাঁচের দেয়াল। সেখান থেকে গাছপালা জঙ্গল দেখা যায়। উলটোদিকের দেয়ালে একটা সুন্দর স্ক্যান্ডেনেভিয়ান স্টাইলের এন্টারটেইনমেন্ট সেন্টার। তার একদম নীচে রয়েছে ডিভিডি প্লেয়ার। মাঝখানে বেশ বড়ো একটা টিভি। একেবারে উপরের তাকে সুদৃশ কাঁচের জারের মধ্যে একটা ছোট্ট নারীমূর্তি –সাইজে ইঞ্চি পাঁচ-ছয়ের মতো হবে। উপরটা সোনার নীচটা রূপোর, খুবই আন-ইউসুয়্যাল!
“আগে তো এটা দেখিনি, উপরটা কি সত্যিই সোনার?” প্রমথ প্রশ্ন করল।
“গোল্ড-প্লেটিং,” সুভদ্রামাসি উত্তর দিলেন। “আগে বেডরুমে ছিল, তাই দেখনি।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কোত্থেকে কিনলে?”
“এর বয়স এক-শো বছরেরও বেশি। আমার দাদুর বাবা তাঁর বৌমা, মানে আমার দিদিমাকে দিয়েছিলেন। তারপর একটু হেসে বললেন, “এটার আবার একটা হিস্ট্রি আছে। মধ্যে এটা একবার চুরিও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে চোরই আবার এটা ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়।”
“বেশ অদ্ভুত চোর! কবে চুরি হয়েছিল?”
“সে আমার জন্মের আগের ঘটনা। এটা থাকত ঠাকুরঘরে –একটা কাঠের বাক্সের মধ্যে। বাক্সটা আরও পুরোনো, আমার দাদুর ঠাকুমার বাক্স! মায়ের যেদিন বিয়ে, সেদিন সকালে দিদিমা ঠাকুর ঘরে গিয়ে দেখেন বাক্সটা উধাও। এই মূর্তিটা ছিল মায়ের ভীষণ প্রিয়। তাই দিদিমা বলেছিলেন মা যখন শ্বশুরবাড়িতে যাবে, তখন এটাও সঙ্গে যাবে। চুরি গেছে শুনলে মা ভীষণ কষ্ট পাবে বলে বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত মাকে কিছু জানাননি দিদিমা। মা শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার পর কয়েকদিন বাদেই তুলো আর কাপড়ে মুড়ে মূর্তিটা কেউ জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরে ফেলে পালিয়ে যায়।”
“ভেরি স্ট্রেঞ্জ ম্যাডাম… মানে মাসিমা,” একেনবাবু বললেন।
“আমার দিদিমা আমায় বলেছিলেন, চোর নিশ্চয় ভেবেছিল, এটা লক্ষ্মীমূর্তি। জাগ্রত লক্ষ্মী চুরি করলে ঘরে অলক্ষ্মী আসে। সেই ভয়েই ফেরৎ দিয়েছিল ওটা।”
“ননসেন্স!” প্রমথ বলল। “আপনি এসব বিশ্বাস করেন?”
“ছেলেবেলায় করতাম, এখন আর করি না। এখন মনে হয় ওটা কোনো প্র্যাকটিক্যাল জোক –চেনাজানা কেউ করেছিল। তবে দাদুর নাকি খুব মন খারাপ হয়েছিল বাক্সটার জন্য। ওটা ছিল দাদুর ঠাকুমার। দাদুর বাবা যখন খুব ছোটো তখন উনি মারা যান। মারা যাবার সময়ে নাকি বলে গিয়েছিলেন, ওটা যেন ছেলেকে দেওয়া হয়।”
ফ্যামিলি রুমের যেদিকে কাঁচের দেওয়াল তার লাগোয়া দেয়ালে একটা নীচু বিল্ট-ইন বইয়ের আলমারি। তার নীচের দুটো তাকই বইয়ে ঠাসা। আলমারির উপরে সুন্দর ফ্রেমে বন্দি দুটো ফোটো, পাশে একটা চামড়া দিয়ে বাঁধানো খাতা, আর তার ওপরে একটা বেশ মোটা ডয়েরি বা নোটবই। চামড়ায় বাঁধানো খাতার উপরে বড়ো করে লেখা “আওয়ার ফ্যামিলি’। ফোটোগ্রাফ দুটোর একটা রিচার্ডমেসোর, অফিসে বসে কাজ করছেন। আরেকটা কম বয়সি একটা ছেলের। অনুমান করলাম সুভদ্রামাসির সেই অ্যাডপ্টেড ছেলে। দেয়ালে বেশ কয়েকটা ফ্যামেলি পোর্ট্রেট টানানো। সুভদ্রামাসির বাবা-মা আর দাদু-দিদিমার ছবি। সুভদ্রামাসির কাছে শুনলাম যে রিচার্ডমেসো নাকি কাঠের কাজ করতে খুব ভালোবাসতেন। উনি নিজেই কাঠের ফ্রেম তৈরি করে ছবিগুলোকে লাগিয়েছেন।
প্রমথ ফিসফিস করে বলল, “রিচার্ডমেসো নিশ্চয় শ্বশুরকে দেখতে পারতেন না।”
আমি অবাক চোখে তাকাতে বলল, “দেখছিস না, দাদু-দিদিমার ছবি বাঁধিয়ে রেখেছেন,
কিন্তু ঠাকুরদা-ঠাকুরমা মিসিং!”
“চুপ কর, ইডিয়ট।” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম।
সুভদ্রামাসির দাদুর ছবিটা ইন্টারেস্টিং। মাথায় পাগড়ি বাঁধা –বেশ রাজকীয় ছবি। সুভদ্রামাসির কাছে শুনলাম যে উনি এবং ওঁর বাবা –দুজনেই মধ্যপ্রদেশে কোনো এক রাজ্যের দেওয়ান ছিলেন। রিচার্ডমেসোর সম্পর্কে আরও একটা জিনিস সুভদ্রামাসির কাছে। জানলাম। কাঠের কাজ ছাড়া রিচার্ডমেসোর আরেকটা ব্যাপারে বিরাট উৎসাহ ছিল –সেটা হল জিনিওলজি। দুই পরিবারের ফ্যামিলি-ট্রি তৈরি করছিলেন তিনি।
‘আওয়ার ফ্যামিলি’ বলে যে বাঁধানো খাতাটার কথা লিখেছি –সেটা হল ওঁর সেই কাজের অসমাপ্ত ফসল।
“কাজটা তো খুব সহজ ব্যাপার নয়,” আমি বললাম।
“ঠিকই বলেছ। আমেরিকা বা ইউরোপে হয়তো একটু সহজ। ওদের চার্চে খোঁজ করলে অনেক খবরই উদ্ধার করা যায়। অবশ্য তার জন্য নানান জায়গায় যেতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে তো সেই সুবিধা নেই। শুনেছি পুরীর পান্ডাদের কাছে কিছু খবর থাকে। যাই হোক, ওটাই ছিল ওর হবি। একজন প্রফেশনাল জিনিওলজিস্টের সাহায্যও মাঝেমধ্যে নিয়েছে। আমি বলতাম শুধু শুধু পয়সা নষ্ট করছ। ও বলত, পয়সা কার জন্য রেখে যাব বলে।” কথাটা বলতে বলতে সুভদ্রামাসির মুখটা কেমন যেন করুণ হয়ে গেল। নিশ্চয় ছেলের কথা মনে পড়ছে।
আমি আলোচনার মোড় ঘোরানোর জন্য খানিকটা অভদ্রের মতোই বলে ফেললাম, “সুভদ্রামাসি, আমার কিন্তু খিদে পেয়ে যাচ্ছে।”
“হ্যাঁ, চলো, সুজাতা নিশ্চয় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”
.
কী খেলাম সেটা বর্ণনা করে পাঠকদের চটিয়ে দিতে চাই না। এটুকু বলতে পারি ওই খাওয়ার জন্য ৩৫ মাইল কেন, আমি ১০০ মাইল যেতেও রাজি।
খাওয়াদাওয়ার পরে সুভদ্রামাসি একটা খাম বার করে আমায় দিলেন। “এটা তোমার মা-কে দিও, খুশি হবে।”
“কী এটা দেখতে পারি?”
“নিশ্চয়।”
খাম থেকে বের হল একটা ব্ল্যাক-এন্ড-হোয়াইট ছবি। দুই কিশোরী গলা জড়াজড়ি করে বসে আছে। তাদের সামনে ছোটো বাক্সের উপর যেটা শোয়ানো, সেটা চিনতে অসুবিধা হল না –কাঁচের জারের মধ্যে রাখা নারীমূর্তিটা।
“এঁরা কারা বললো তো?” সুভদ্রামাসি জিজ্ঞেস করলেন।
“তোমার ছোটোবেলার ছবি?”
“না, আমার মায়ের আর তোমার দিদিমা’র।”
“মাই গড, এত পরিষ্কার ছবি!” আমি সত্যিই একেবারে হতবাক। আমাদের বাড়ির পুরোনো অ্যালবামে মায়ের ছেলেবেলার ছবি আছে। আমার দিদিমার বিয়ের ছবিও আছে। কিন্তু সেগুলোর এত বিবর্ণ চেহারা, এই ছবির সঙ্গে কোনো তুলনাই হয় না। এরকম চমৎকার রেসলুশ্যান, ভালো ক্যামেরা ছাড়া এখনও পাওয়া যায় না।
সুভদ্রামাসি বললেন, “এটা একটা পুরোনো ছবি, আমার কাছে ছিল। রোহিত কাউকে দিয়ে কম্পিউটার আর কীসব ব্যবহার করে এটা করিয়েছে।”
“অ্যামেজিং স্যার, ট্রলি অ্যামেজিং!” ছবিটা হাতে নিয়ে মাথা দোলাতে দোলাতে একেনবাবু বললেন।
“মা সত্যিই ভীষণ খুশি হবে এটা পেয়ে। কবে এটা করালে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তোমাদের যেদিন ফোন করলাম, সেদিনই এটা পেলাম। তখনই ভাবলাম ভালোই হল –তুমি যাচ্ছ, তোমার হাত দিয়েই ছবিটা পাঠিয়ে দেব। একটা চিঠিও আছে ওর মধ্যে –মাকে মনে করে দিও।”
.
আমরা যখন সুভদ্রামাসির বাড়ি থেকে ফিরলাম, তখন রাত প্রায় বারোটা। একেনবাবু ঘুমকাতুরে, এগারোটা বাজতে না বাজতেই বিছানা নেন। সকালে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে সুভদ্রামাসির গল্প হল। ছবিটার কথাও উঠল।
একেনবাবু বললেন, “বুঝলেন স্যার ছবিটা দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ছিল ‘লাইট অফ এশিয়া’র কথা।”
“তার মানে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“মানে হিমাংশু রাইয়ের ফিল্ম ‘লাইট অফ এশিয়া’-র কথা বলছি স্যার। ওই ফিল্মের কতগুলো স্টিল ছবি একটা জার্মান ওয়েবসাইটে কিছুদিন আগে দেখেছিলাম। সেগুলোও ছিল এরকম স্পষ্ট। অথচ স্যার ঐ একই ফিল্মের স্টিল অন্য কোনো বইয়ে দেখুন। সেই ছবিগুলোতে মানুষ বসে আছে না হনুমান –বোঝার উপায় নেই।”
“আপনি মশাই এত ওয়েবসাইট দেখতে শুরু করলেন কবে থেকে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল। “ এমনি তো ভাব দেখান, কম্পিউটার ইন্টারনেট –কিছুই আপনার মাথায় ঢোকে না!”
“সত্যি স্যার, প্রমথবাবু এমন করেন না!” একেনবাবু অনুযোগ-ভরা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। প্রমথকে বললেন, “আমি কি স্যার টেকনোলজির কিছু জানি নাকি? আপনারাই তো যা সার্ফ করতে শিখিয়েছেন। ছবিটা হঠাৎ চোখে পড়েছিল তাই বললাম।”
“গুড, তাহলে শুনুন, ব্যাপারটা কি,” প্রমথ বিজ্ঞের মতো বলল। “এগুলোকে বলা হয় ডিজিটাল এনহ্যান্সিং। এনলার্জড ছবিকে অসংখ্য ছোটো ছোটো বিন্দু বা পিক্সেল দিয়ে ভাগ করে, নানা রকম অ্যালগরিদম ব্যবহার করে সেই বিন্দুগুলোর রং বেশি কালচে বা বেশি সাদা করা হয়। ফলে ছবির রেসলুশন বেড়ে যায়।”
প্রমথর এই বিজ্ঞ বিজ্ঞ কথা আমি অনেক সময়ই বুঝি না। মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় পুরো গুলতাপ্পি চালাচ্ছে। আমি একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে বললাম, “কিছু বুঝলেন মশাই?”
“আবছা আবছা বুঝছি স্যার। উনি বড়ো কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করেন।”
আমি প্রমথকে চ্যালেঞ্জ করলাম, “তুই এত জানলি কোত্থেকে?”
“এটা সবাই জানে। তুই যে জানিস না তোর লজ্জা পাওয়া উচিত। আবার ফিজিক্স। পড়াচ্ছিস!”
একেনবাবুর চিন্তা ইতিমধ্যেই অ্যাজ ইউসুয়্যাল বোঁ করে অন্যদিকে চলে গেছে, “বেশ আছেন স্যার আপনারা, কেমন দুজনে দেশে যাচ্ছেন!”
“তা আপনি গেলেও তো পারেন, আপনার পা কে বেঁধে রেখেছে!” আমি বললাম।
“কী যে বলেন স্যার। এই সময়ে গেলে পনেরো-শো ডলারের ধাক্কা।”
“আপনিও তো মশাই মহা হাড়-কেপ্পন!” প্রমথ বলল, “দাঁও মেরে মোটা অঙ্কের ফুলব্রাইট বাগিয়েছেন –সেখান থেকে পনেরোশো ডলার খসাতে পারেন না।”
“দেখুন স্যার, আমার দিকে অসহায় মুখ করে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন, “প্রমথবাবু খালি আমাকে ফুলব্রাইটের খোঁচা দেন –যেন আমি কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা পাচ্ছি।”
“ওর কথা শুনবেন না,” আমি বললাম। “তাছাড়া আমরা চলে গেলে একজনকে তো অ্যাপার্টমেন্টটা সামলাতে হবে!”
“তাহলে?” একেনবাবু সমর্থন পেয়ে প্রমথকে উদ্দেশ্য করে বললেন।
“তাহলে থাকুন, শুধু শুধু আফশোস করছেন কেন! হ্যাঁ দেখবেন, এটাকে একটা খাটাল বানিয়ে ফেলবেন না। আপনার যেরকম জিনিসপত্র ছত্রাকার করে রাখার হ্যাবিট।”
.
৷৷ ৩ ৷৷
কলকাতায় পৌঁছে ক’দিন এবাড়ি ওবাড়ি দৌড়াদৌড়ি করতে করতে কেটে গেল। আমাদের আত্মীয়-স্বজনের সংখ্যা অল্প নয়। প্রায় দু-বছর বাদে আসছি, তাই মা জোর করে সবার সঙ্গে দেখা করতে নিয়ে গেলেন। পেটপুরে প্রচুর নলেনগুড়ের সন্দেশ, জলভরা, রসগোল্লা, সরভাজা, আর রাবড়ি খেলাম। তারপরেই শুরু হল ঝামেলা। মা সুর ধরলেন, “এবার একেবারে বিয়ে করে আমেরিকায় ফিরে যা।” আমি যত বলছি, আমার বিয়ে করার এখন কোনো ইচ্ছে নেই। মা তত চেপে ধরেন। মা’র ধারণা আমি এবার বিয়ে না করলে কোনো আমেরিকান মেয়েকে বিয়ে করে বসব। “দেখ, আমি ভালো ইংরেজি জানি না, তোর বউয়ের সঙ্গে ইংরেজিতে যেন কথা বলতে না হয়।”
শেষমেষ আমি বলতে বাধ্য হলাম, “তুমি যদি এরকম শুরু কর, তাহলে আমি টিকিট চেঞ্জ করে কালকেই চলে যাব।”
মা খুব কষ্ট পেলেন কথাটা শুনে, কিন্তু এছাড়া মাকে থামানোর আর কোনো উপায় ছিল না। মা বললেন, “ঠিক আছে, ঠিক আছে, আর বলব না।”
কিন্তু হালটা যে ছাড়েননি সেটা বুঝলাম। কারণ একটু বাদেই বললেন, “চল আজ বিকেলে সুলতার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। অনেকদিন যাওয়া হয়নি। তোকেও দেখতে চেয়েছে।”
সুলতামাসির মেয়ে বন্দনা আমার থেকে বছর তিনেকের ছোটো। এক সময়ে সুলতামাসিরা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকতেন। ছেলেবেলায় বন্দনা আর আমি একসঙ্গে অনেক খেলাধুলো করেছি। পরে সুলতামাসিরা যোধপুর পার্কে চলে গেলেও প্রায়ই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হত। হয় আমরা যেতাম অথবা ওঁরা আসতেন।
খেলাধুলোর বয়স পার হবার পর বন্দনার সঙ্গে গল্প-আড্ডা অনেক হয়েছে। ভারী সহজ, স্বচ্ছ মেয়ে। সোজাসুজি কথা বলে। কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা বড় হতে হতে ব্লসম করে। বন্দনা সেরকম। ছোটোবেলায় বোঝা যেত না, কিন্তু বছর তেরো-চোদ্দতেই ও দারুণ রূপসি হয়ে উঠল। যাদবপুরে আমি যখন এম.এসসি পড়ছি, তখন ও ইংলিশ অনার্স নিয়ে বি.এ পড়ছে। আমাদের ক্লাসের একটা ছেলে ওকে খুব জ্বালাচ্ছিল। বন্দনা আমাকে একদিন সেকথা বলাতে আমি বললাম, “তোকে দেখে সবাই পাগল হয়ে যায়, কী করবি বল?”
“কই, তুমি তো পাগল হও না?”
“সে তো তোকে ছোটোবেলা থেকে দেখেছি বলে। ছোটোবেলায় মাথায় দুটো বিনুনি। করে হাঁড়ির মতো একটা মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতিস। সেটা চোখ বুজে একবার ভেবে নিলেই মোহ কেটে যায়!”
সেই শুনে বন্দনা ভীষণ হাসল। “খুব বিচ্ছিরি চেহারা ছিল আমার –তাই না?”
“ভীষণ,” আমি গম্ভীর মুখ করে বললাম।
“তোমারও তো কদম ফুলের মত খাড়া খাড়া চুল ছিল।”
“সে তো এখনও আছে।”
বন্দনা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “নাঃ, এখন আর অতটা নেই।”
হঠাৎ আমার কী যে হল জানি না! বললাম, “বন্দনা, আমার সঙ্গে প্রেম করবি?”
বন্দনার মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল, চোখটা ছলছল করে উঠল। বলল, “তুমি আমার বন্ধু, বাপিদা! তোমাকে হারাতে চাই না।”
সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। “যাঃ, তোর সঙ্গে ফাজলামি করছিলাম।”
আমি জানি বন্দনা বুঝেছিল, সেটা ফাজলামি নয়। আর আমিও বুঝেছিলাম বন্দনার মনের কথা। ও কোনো কথাই কখনো অস্পষ্ট করে বলেনি।
তার কিছুদিন বাদেই আমি আমেরিকায় চলে এলাম। তারপর এক আধবারই দেখা হয়েছে। ও এম.এ পাশ করে মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানিতে ঢুকেছিল। পরে সেটা ছেড়ে দিয়ে শুনেছি একটা বুটিক শপ খুলেছে।
.
অনেকদিন বাদে সুলতামাসিদের বাড়ি গিয়ে আমার ভালোই লাগল। মেসোমশাই সবে রিটায়ার করেছেন। এখন মাথায় ঢুকেছে একটা পোলট্রি ফার্ম করবেন। বেশ কিছু বইপত্র জোগাড় করে পড়ে ফেলেছেন। মেমারি-তে ওঁর দেশের বাড়িতে ফার্মটা করা হবে। সুলতামাসির তাতে প্রবল আপত্তি। মেসোমশাই সত্যিই কতটা ফার্ম করতে চান, না সুলতামাসিকে জ্বালাতে চান –সেটা অবশ্যই একটা প্রশ্ন। কিন্তু চায়ের আড্ডাটা ভালোই জমল।
চা খাওয়ার পর বন্দনা একটু ভিতরে যেতে সুলতামাসি বললেন, “বাপি, আমাদের সবার ইচ্ছে, তোমার আর বন্দনার বিয়ে হোক। কিন্তু তোমরা এযুগের ছেলেমেয়ে –তোমাদের তো আমরা জোর করতে পারব না। বন্দনার বহু সম্বন্ধ এসেছে, কিন্তু ও রাজি হয়নি। আমার ধারণা তোমাকে বিয়ে করতে আপত্তি করবে না। এখন তোমার ওকে পছন্দ হবে কিনা সেটাই প্রশ্ন।”
আমি এরকম সরাসরি প্রস্তাবে যথেষ্ট হতচকিত হলাম। তবে বুঝতে পারলাম যে সুলতামাসি এটা মার সঙ্গে পরামর্শ করেই করেছেন। ওঁরা জানেন না, কিন্তু বন্দনার মনের কথাটা আমি খুব স্পষ্টই জানি। এই অবস্থায় সবচেয়ে সহজ পথটাই আমি নিলাম। বললাম, “সুলতামাসি, মা’কে বলেছি এই মুহূর্তে আমি বিয়ের কথা ভাবছি না।”
“তোমাকে এক্ষুনি আমরা বিয়ে করতে বলছিও না,” সুলতামাসি বললেন।
আমি এবার একটু মুশকিলে পড়লাম।
“দেখো, তোমরা দুজনে কথা বলো। তোমরা যা চাইবে তাই হবে।” বলে সুলতামাসি, মা আর মেসোমশাই অদৃশ্য হলেন।
এইরকম সমস্যায় আমি পড়ব বলে প্রস্তুত হয়ে আসিনি। কি করণীয় ভাবছি, তখন বন্দনা ঘরে ঢুকল।
“একি তুমি একা বসে আছ, আর সবাই কোথায়?”
“আর সবাই আমাকে সমস্যা দিয়ে চলে গেছেন।”
“কী সমস্যা?”
“তোকে বিয়ে করতে চাই কিনা জানতে চান।”
“তুমি কি বললে?” বন্দনার মুখটা ফ্যাকাশে, গলার স্বরেও একটা চাপা উত্তেজনা।
আমি বললাম, “এই মুহূর্তে আমার কাউকে বিয়ে করার প্ল্যান নেই।”
বন্দনা আমার হাত দুটো চেপে ধরল, “থ্যাঙ্ক ইউ।”
“তার মানে?”
“তোমাকে ‘না’ বলতে আমার খুব কষ্ট হত বাপিদা!”
“তুই কি বিয়ে করবি না ঠিক করেছিস?” বন্দনা চুপ করে রইল।
এইবার আমি ধরতে পারলাম। “লাকি ম্যানটা কে?”
বন্দনা লাল হল। “কী করে বুঝলে কেউ আছে, আমারও তো তোমার মতো এখনই বিয়ে না করার প্ল্যান থাকতে পারে।”
“না পারে না, নইলে গালটা টমাটোর লাল হত না। বল, নামটা কি?”
বন্দনা লাজুক মুখে বলল, “প্রভাস মিত্র।”
“কী করেন এই প্রভাস মিত্র?”
“শান্তিনিকেতনে ইংরেজি পড়াচ্ছে।”
“প্তাহলে সমস্যাটা কী?”
“সমস্যাটা কুল-ঠিকুজির। বিশ্বাস করতে পারো?”
“মাই গড! তুই ব্রাহ্মণ আর ও কায়স্থ বলে, না কুষ্ঠি মিলছে না?”
“আরও গভীর। কায়স্থর বাড়িতে মানুষ হওয়া রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া একটা ছেলে।”
“ননসেন্স! ও যে চমৎকার ছেলে –সে তো আমি ওকে না দেখেও বুঝতে পারছি।”
“কী করে?”
“কারণ তুই ওকে পছন্দ করেছিস!”
বন্দনা কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল, “আই মিস ইউ বাপিদা!”
বন্দনা কী মেখেছে জানি না। কিন্তু সেই সুগন্ধের সঙ্গে ওর শরীরের ঘ্রাণ আর নৈকট্য মুহূর্তের জন্য আমাকে আচ্ছন্ন করল। কিন্তু ঘোর কাটিয়ে আমি বললাম, “ভালো কথা, আমি আর প্রমথ কাল শান্তিনিকেতনে যাচ্ছি।”
“সত্যি! তাহলে ওর সঙ্গে দেখা কোরো, খুব খুশি হবে।”
“তুইও চল না।”
“না, মেলার ভীড়ে যেতে আমার ভালো লাগে না। আমি মেলা শেষ হলে যাব।”
সুলতামাসিকে সেদিন কী ভাবে এড়িয়েছিলাম –সেটা এ কাহিনির সঙ্গে যোগ করব না। প্রভাস এই গল্পের সঙ্গে যুক্ত, তাই বন্দনার কথাটা একটু ফলাও করেই বলা হয়ে গেল। শুধু এটুকু বলি যে পরে বন্দনার হয়ে আমিও ওকালতি করলাম সুলতামাসি আর মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। মনে হল যে ওঁরা এবার হাল ছেড়েছেন। ওঁদের ধারণা ছিল, আমি এলে হয়তো একটা কিছু হয়ে যাবে। আমিও ওঁদের মেয়ের সঙ্গে সুর মেলাব– সেটা বোঝেননি। আমার মায়ের উপরও রাগ হল। মা প্রভাস মিত্রের ব্যাপারটা জানতেন না। সব শুনে সুলতামাসির উপরই চটে উঠলেন।
“আচ্ছা, এই ব্যাপারটা জানা সত্ত্বেও, কেন তোর সঙ্গে সম্বন্ধ করার চেষ্টা করছিল?”
আমি মাকে খোঁটা দিলাম, “তোমারও তো সন্দেহ আমি কোনো আমেরিকান মেয়ের সঙ্গে ঘুরছি, কই তুমি তো তাতে হাল ছাড়ছ না!”
“তুই সত্যিই ঘুরছিস?”
মা’র করুণ মুখ দেখে আমার খারাপ লাগল। মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “না, তোমাকে খ্যাপাচ্ছি!”
.
। ৪।
এর আগে আমি বার দুই শান্তিনিকেতনের পৌষমেলায় গেছি। দু’বারই প্রমথর সঙ্গে। পূর্বপল্লীতে প্রমথর বডোেমাসির একটা বাড়ি আছে। বাড়িটা দেখাশোনা করার জন্য একজন লোক আছে। নাম বনমালী। সেই ঘরদোর পরিষ্কার রাখে। কেউ ওখানে গিয়ে থাকলে রান্নাবান্না করে দেয়। এমনিতে প্রায় সারা বছরই বাড়িটা ফাঁকা পড়ে থাকে। কেবল পৌষমেলার সময় বহু লোক সেখানে এসে হাজির হয়। এবার প্রমথ বড়োমাসিকে অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছিল কাউকে ঘর না দিতে। তাতে কাজ কিছুটা হয়েছিল। শুনলাম ওঁর এক বন্ধুর ছেলে আর তার বউ শুধু আসছে। তার মানে আমরা চারজন। বাড়িতে তিনটে ঘর –দুটো বাথরুম। সুতরাং খুব আরামেই থাকা যাবে।
প্রমথ এসি চেয়ার কার বুক করেছিল। এর আগে সেকেন্ড ক্লাসে চেপে গিয়েছি। সিট রিসার্ভ করতাম, কিন্তু লাভ বিশেষ হত না। ডেইলি প্যাসেঞ্জাররা, যারা অনেকে টিকিটও কাটে না, তারা জোর করে এসে ঠেলেঠুলে বসত। এসি চেয়ার কার দেখলাম সেদিক থেকে চমৎকার। ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের জুলুমবাজি নেই। টিকিট চেকার আসে এবং টিকিট চেক করে। সিটগুলোও গদির –বসে আরামই লাগে। মেঝেটা একটু অপরিস্কার। কিন্তু একটু বাদেই একটি বাচ্চা এন্টারপ্রেনার ছোট্ট একটা ঝাড় নিয়ে তার কিছুটা সংস্কার করল। প্রায় সবাই দেখলাম কিছু না কিছু ছেলেটাকে দিল।
প্রমথ মন্তব্য করল, “ভিক্ষে করার থেকে এটা ভালো।”
হয়তো তাই। কিন্তু এতটুকু ছেলে পয়সার জন্য খেলাধুলো না করে কাজ করছে ভাবতে মনটা কেমন জানি করে উঠল। প্রমথকে সেটা বলতেই ও ধাতানি দিল,
“তিন দিনের যোগী ভাতকে বলিস পেস্সাদ। ওসব সায়েবি বোলচাল ছাড় তো। কাজ করে খাচ্ছে –একটা ওয়ার্ক এথিক্স গ্রো করছে। ভিক্ষে করলেও তো মুখ বাঁকাতিস!”
.
গাড়ি চলতে শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি রবীন্দ্রসংগীত শুরু হয়েছে। সাউন্ড সিস্টেমটা অবশ্য খুব একটা ভালো নয়। প্রমথ একটা মোটা গল্পের বই নিয়ে এসেছে, সেটায় মন দিল। আমি একটা খবরের কাগজ কিনেছিলাম হাওড়া স্টেশনে। সেটা খুলে পড়তে গিয়ে নজর পড়ল অন্যপাশে বসা ডিজাইনার সার্ট আর জিন্স পরা এক যাত্রীর দিকে। বিদেশ থেকে অল্পদিন হল এসেছেন বোঝা যায়, মুখে এখনও চকচকে ভাবটা আছে। লম্বা চেহারা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, নাকের নীচে একটা চিলতে গোঁপ। জুতোটাও বেশ ফ্যান্সি। শৌখিন লোক বুঝতে অসুবিধা হয় না। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখটা সরিয়ে নিলাম। হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখলে কী ভাববেন। কিন্তু কেন জানি না পত্রিকা পড়ার ফাঁকে বার বার ভদ্রলোকের দিকে আমার চোখ চলে যাচ্ছিল। ভদ্রলোক বসেছেন জানলার ধারে। কিন্তু বাইরের দিকে না তাকিয়ে মন দিয়ে একটা মোটা চামড়ায় বাঁধানো খাতা থেকে কী জানি পড়ছেন, আর একটা ক্যালকুলেটর দিয়ে নানান হিসেব করছেন।
কিছুক্ষণ বাদে আমায় একবার বাথরুমে যেতে হল। বাথরুমটা বন্ধ, কেউ ওখানে রয়েছে। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, হঠাৎ দেখি পেছনে সেই ভদ্রলোক এসে দাঁড়িয়েছেন। ভদ্রলোকের গলায় সোনার নেকলেসটা আগে নজরে পড়েনি। চেনের নীচে “BS” লেখা লকেট ঝুলছে। নিশ্চয় নামের আদ্যক্ষর। কিন্তু কী ট্রাজেডি –BS দেখলে প্রথমেই মনে আসে Bull shit!
আমি “হ্যালো” বললাম।
উত্তরে উনিও একটু হেসে “হ্যালো” বললেন।
“বাঙালি?” আমি ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলাম।
“না, কিন্তু বাংলা জানি।” উচ্চারণটায় একটু হিন্দি টান আছে।
আমি বললাম, “বাঃ, বাংলা তো আপনি বাঙালিদের মতন বলেন।”
“কলকাতায় বহুদিন ছিলাম।”
“আর এখন?”
“নিউ ইয়র্কে।”
“আরে! আমিও তো নিউ ইয়র্কে থাকি।”
“তাই নাকি! স্মল ওয়ার্লড।”
“পৌষমেলায়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ওয়েল, সর্ট অফ। তবে আমায় আজকেই ফিরে যেতে হবে।”
“সেকি মেলা তো সবে শুরু হচ্ছে!”
“আই হ্যাভ সাম বিজনেস।”
এই সময়ে বাথরুমের লোকটি বেরিয়ে আসায় কথাবার্তা আর হল না। আমি ফিরে আসার বেশ কিছুক্ষণ বাদে ভদ্রলোক ফিরলেন। ফিরেই দেখলাম চোখ বুজে একটা ঘুম লাগিয়েছেন। নামটাও জানা হল না। কিছুক্ষণ জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে চললাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালও করিনি। এসে পর্যন্ত এত হইচই-এর মধ্যে কেটেছে যে জেট ল্যাগটা এখনও ভালো করে কাটেনি। প্রমথর ডাকে ঘুম ভাঙল, তখন বোলপুরে পৌঁছে গেছি!
আমরা যখন প্রমথর বড়োমাসির বাড়ি পৌঁছলাম তখন বেলা প্রায় দুটো। বনমালী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাদের জন্য দুটো সিঙ্গল বেড পাতা ঘর পরিষ্কার করে রেখেছে। সেখানে ব্যাগ রাখতে রাখতে প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “আর যাদের আসার কথা তাঁরা এসেছেন?”
“হ্যাঁ।”
“তাঁরা কোথায়?”
“মেলায় গেছেন। একটু বাদেই ফিরবেন।”
কথা শেষ হতে না হতেই বাইরের থেকে একটা গলা শুনলাম, “এই যে আপনারা এসে গেছেন!”
তাকিয়ে দেখি বেঁটেখাটো ফর্সা নাদুসনুদুস চেহারার এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকেছেন –পেছন পেছন একজন মহিলা। ভদ্রলোকের গলায় জড়ানো একটা মেরুন রঙের মাফলার। গায়ে উলের ফুলহাতার সাদা সোয়েটার। প্যান্টটা সম্ভবতঃ পলিয়েস্টারের, চকচকে কালো। ভদ্রমহিলাও গৌরাঙ্গী। ভদ্রলোকের সমান বা একটু লম্বাই হয়তো হবেন। মুখটা ঢলঢলে। পরনে লালপেড়ে সবুজ শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজ। কপালে লাল রঙের একটা বড়ো গোল টিপ। মহিলাকে সুন্দরী বলা যাবে না –কিন্তু একটা আলগা শ্ৰী আছে।
“নমস্কার, আমি শ্যামল বসু। আমার স্ত্রী রিতা।”
আমরাও উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের পরিচয় দিলাম।
ভদ্রলোক খুব হাসিখুসি। অল্প দুচার কথার পর বললেন, “বুঝলেন, কাল থেকে আপনাদের আসার জন্য দিন গুনছি। একা বৌয়ের সঙ্গে আর কতক্ষণ গল্প করা যায় বলুন!”; প্রমথ রিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার বরের সাহস তো কম নয়!”
“বুঝুন কি রকম লোকের সঙ্গে ঘর করছি!” এক ঝলক হেসে রিতা অদৃশ্য হলেন।
শ্যামলবাবু একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে গলাটা নামিয়ে বললেন, “আপনারা আসবেন বলে মাছ রান্না করেছে ও। অথচ দেখুন, কালকে কত কাকুতি মিনতি করলাম। বললাম, রাত্রে একটু মাছ করবে?” আমায় মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “এসেছ মেলা দেখতে, অত মাছ মাছ করছ কেন; এবার বুঝলেন তো শুধু গল্পের জন্য নয়। আপনারা এসেছেন– খাওয়াদাওয়াটাও ভালো হবে আশা করছি।”
আমি বললাম, “আচ্ছা এটা কেন করছেন! আমরা তো আপনাদের অতিথি নই। সবাই বেড়াতে এসেছি।”
“এসব বলে আমার বউকে বিগড়ে দেবেন না তো। দিব্বি ভালো খাওয়া জুটবে ভাবছিলাম।”
“ মেলা কেমন দেখলেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“চমৎকার। তবে নাকে বেশ ভালো করে রুমাল চেপে ঘুরবেন। জল ছেটাচ্ছে বটে, কিন্তু তাও অসম্ভব ধুলো।”
“ভিড় কিরকম?”
“এখনও খুব দেখলাম না। শুনলাম ভিড় শুরু হবে আজ বিকেল থেকে। সকালে এলেন না–ফাংশানটা মিস করলেন।”
আজ ৭ই পৌষ। নিশ্চয় উপাসনার কথাটা বলছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “কিরকম দেখলেন উপাসনা?”
“নট ব্যাড। তবে ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, আমার মন্ত্র-যন্ত্র বা বাণীর থেকে নাচ-গানই ভালো লাগে বেশি। নাচ লাগালে আরও জমত। কেন যে নাচটা বাদ দেয় বুঝলাম না।”
“ওটা বোধহয় বসন্ত উৎসবের জন্য তুলে রেখেছে।” প্রমথ বলল, “এক সঙ্গে আপনাদের সবকিছু দেখাতে চায় না।”
প্রমথর মন্তব্যে যে শ্লেষটা ছিল, শ্যামলবাবু সেটা বোধহয় ধরতে পারলেন না।
“তাই হয়তো হবে।”
“ওখান থেকে মেলার মাঠে গেলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“হ্যাঁ, দেখলাম সবাই যাচ্ছে, আম্রকুঞ্জের পাশ দিয়ে শালবীথি ধরে সোজা মেলার মাঠ। সাত সকালে গেছি, চা পর্যন্ত খাওয়ার সময় পাইনি। প্রথমেই কালোর দোকানে ঢুকে চা-টা খেয়ে, মেলায় ভালো করে একটা চক্কর মেরে তারপর এসেছি। তা আপনারা কি এই প্রথম আসছেন?”
শ্যামলবাবু সত্যিই গল্প করতে ভালোবাসেন। প্রমথ এক ফাঁকে ফিসফিস করে আমাকে বলল, “একেনবাবুর সঙ্গে এঁর জমত ভালো।”
আমি ভাবছিলাম খাওয়া দাওয়ার পরে কী ভাবে ওঁর কবল থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এমন সময়ে বাইরে থেকে কে যেন আমাদের নাম ধরে ডাকল। আমি বেরিয়ে এসে দেখি চাদর গায়ে ধুতিপাঞ্জাবি পরা একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে।
“আপনি কি বাপিদা?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, আপনি?”
“আমাকে আপনি চেনেন না। আমি প্রভাস মিত্র।”
“কে বলল চিনি না, খুব ভালো করে আপনাকে চিনি।”
প্রভাস আমার বলার ধরন শুনে হেসে ফেলল। “আমাকে তুমি করেই বলবেন। বন্দনা আর আমি একসঙ্গে পড়েছি।”
“বেশ, কিন্তু তুমিও আমাকে তুমি বলবে বন্দনার মতো। ভেতরে এসো, আমার বন্ধু প্রমথর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই।”
প্রভাস শান্তিনিকেতনে পড়ায় শুনে উৎসাহিত শ্যামলবাবু প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, পৌষমেলার সিগ্নিফিকেন্সটা কি বলুন তো?”
প্রভাস বলল, “ভাগ্যিস আপনি বিশ্বভারতীর ইন্টারভিউ বোর্ডে ছিলেন না থাকলে বিপদে পড়তাম।”
“না না, সিরিয়াসলি, এর ব্যাকগ্রাউন্ডটা একটু জানা দরকার।”
“আমি যতদূর শুনেছি, এটা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উইলে ছিল। মহর্ষির মৃত্যুর পর বলেন্দ্রনাথ যখন শান্তিনিকেতনের ভার নেন, তখন এই মেলা চালু করেন। তারপর রবীন্দ্রনাথের আমল থেকে এটা ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে।”
শ্যামলবাবু বুঝলাম খুবই ইমপ্রেসড হয়েছেন প্রভাসের কথা শুনে। বললেন “আপনাকে মশাই একটু সময় দিতে হবে। শান্তিনিকেতনের বাড়িঘরগুলো, এই উত্তরায়ন, উদয়ন, শ্যামলী –এগুলো যদি একটু চিনিয়ে দেন। কাল একটা রিক্সাওয়ালাকে নিয়ে ঘুরলাম। ব্যাটা বলে ও সব জানে। শ্যামলী বলে একটা বাড়ি দেখাল– যেটা দোতলা পাকা বাড়ি। তারপর আমি ধমক দিতে স্বীকার করল, হুগলির ছেলে। হপ্তা দুই হল মামার রিক্সা চালাতে বোলপুরে এসেছে।”
“উত্তরায়ন বাড়িটাও দেখাল নাকি?” প্রমথ প্রশ্ন করল।
এটাই প্রমথর দোষ। কেউ একটা কিছু ভুল কথা বললে –তাঁকে না খুঁচিয়ে পারে না। শ্যামলবাবুর আর দোষ কি, আমিও বহুদিন উত্তরায়নকে একটা বাড়ি বলেই ভাবতাম। শ্যামলবাবু ভালো মনেই উত্তর দিলেন, “দেখিয়েছিল, কিন্তু আমি ওর একটা কথাও বিশ্বাস করি না। কি মশাই, দেখিয়ে দেবেন তো?” প্রভাসকে আরেকবার জিজ্ঞেস করলেন শ্যামলবাবু।
“বেশ তো, আমি তো এখানেই আছি।”
“দুপুরে খেয়েছেন?” শ্যামলবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“আমি সকালে খুব ভালো করে খাই। দুপুরে কিছু খাই না।”
“একদিন না হয় খেলেন। দাঁড়ান,” বলে প্রভাসের আপত্তি সত্বেও শ্যামলবাবু রান্নাঘরে বোধহয় রিতাকে জানাতে গেলেন।
“সত্যি আমি দুপুরে খাই না,” প্রভাস আমার দিকে তাকিয়ে বলল।
“বসো আমাদের সঙ্গে, খেতে হবে না। গল্পটা তো হবে।”
.
। ৫ ।
খাওয়াদাওয়ার পর শ্যামলবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “মেলায় কখন যেতে চান?”
প্রমথ উলটে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের কখন সুবিধা?”
“আমরা খুব ফ্লেক্সিবল। তবে দুপুরে নিশ্চয় আপনারা একটু ঘুমোবেন।”
বাঁচা গেল! মনে মনে ভাবলাম। মুখে বললাম, “সেই ভালো, আপনারা দুজন একটু জিরিয়ে নিন। আমরা ট্রেনে খুব ঘুমিয়েছি।”
“আপনারা কি তাহলে এখন মেলায় যাবেন?”
“মেলায় না। ভাবছি প্রভাসের সঙ্গে শান্তিনিকেতনটা একটু ঘুরে দেখি। তোমার অসুবিধা নেই তো প্রভাস?”
“এতটুকু নয়।”
“এক্সলেন্ট! তাহলে আমরা একটু ঘুরে-টুরে তারপর মেলায় যাব। বিকেলে মেলাতেই আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে।”
শ্যামলবাবু বললেন, “মেলার ঐ ভিড়ে খুঁজে পাবেন?”
“ঠিক খুঁজে নেব, একদম ভাববেন না,” প্রমথ বলল। “না পেলে তো আমরা ফিরেই আসছি। রাত্রে এখানে দেখা হবে।”
শ্যামলবাবু আড্ডাবাজ লোক। মনে হল সঙ্গ হারিয়ে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেন।
.
শ্যামলবাবু আর রিতা শুতে চলে যাওয়ার খানিক বাদেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে পূর্বপল্লীর রাস্তা ধরে রেললাইনের দিকে এগোলাম। রাস্তার বাঁ দিকে এককালে খোয়াই ছিল –মাইলের পর মাইল লালমাটির উঁচু নিচু জমি –মাঝে মধ্যে কয়েকটা করে তালগাছ। সে খোয়াই অবশ্য অদৃশ্য হতে শুরু করেছে আমার জন্মের আগে থেকেই। কিন্তু আগেরবার যখন এসেছি, তখনও কিছু কিছু ফাঁকা জায়গা চোখে পড়ত। এখন শুধু বাড়ি আর বাড়ি। পূর্বপল্লীর পুরোনো বাড়িগুলোর সঙ্গে লাগোয়া জমি থাকত প্রচুর। বিশ্বভারতী ট্রাস্টের জমি দু’বিঘার কমে লিজ দেওয়া হত না। এখন সেসব গেছে। নতুন পূর্বপল্লীতে তিনকাঠা পাঁচকাঠার প্লটও বিক্রি হচ্ছে। গায়ে গায়ে লেগে বাড়ির সারি। শান্তিনিকেতন
পশ্চিমবঙ্গের আরেকটা মফস্বল শহর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
“আপনাদের কোনো তাড়া নেই তো?” প্রভাস প্রশ্ন করল।
প্রভাস আমাকে দুয়েকবার চেষ্টা করে তুমি বললেও প্রায়ই ‘আপনি’-তে ফিরে আসছে। আমি ওকে শোধরাবার চেষ্টা করে হাল ছেড়েছি। যা ওর সুবিধা বলুক।
“না, কেন বলত?”
কাঁধের ঝোলাটা দেখিয়ে প্রভাস বলল, “আমাকে একটা বই ফেরত দিতে হবে অবনপল্লীতে। কাছেই, বেশি সময় লাগবে না।”
“লাগুক না সময়, হাঁটার জন্যই তো বেরোনো। বুঝেছ, একটা জিনিস বেশ লাগছে –বাড়ির এই নামগুলো। বাঙালিরা যে কাব্যপ্রেমিক, সেটা বাড়ির নামগুলো দেখলেই বোঝা যায়।”
“নামগুলো কাব্যিক, প্রমথ বলল। “কিন্তু গুরুদেব দেখলে হার্টফেল করতেন। ‘রূপসী’ না লিখে লিখেছে “রুপসি”!”
প্রভাস মুচকি হেসে বলল, “বানানের পরীক্ষায় এখানকার অনেক কন্ট্রাক্টারই বোধহয় ফেল করবেন।”
“আজকাল ‘রুপসি’ বানানটাই বোধহয় চলে,” আমি বললাম।
“ইডিয়েটের মতো কথা বলিস না, ‘রূপসি’ চলতে পারে, ‘রুপসি’ চলে না।“
“না চললেও এসে যায় না,” প্রভাস বলল। “আফটার অল প্রপার নাউন।”
“তার মানে?”
“ধরুন,আপনার কোনো বন্ধুর নাম সূর্য। তিনি নিজের নামের বানান লিখলেন ‘সুর্য’। এতে আপত্তির কী আছে?”
“কিছুই নেই, শুধু বাংলার বাপের শ্রাদ্ধ, প্রমথ গম্ভীরভাবে বলল।
“না, না, সিরিয়াসলি। বাপিদার বন্ধু তো সত্যি করে সূর্য নন। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি সূর্যকে চিনি কিনা। আমি বলব, নিশ্চয় চিনি। মেঘ না থাকলে সারা দিনই তো চোখে পড়ছে। কিন্তু যদি জিজ্ঞেস করেন, সুর্যকে চিনি কিনা। আমাকে বলতেই হবে চিনি না। কারণ বাপিদার সেই বন্ধুকে আমি সত্যিই চিনি না। এক্ষেত্রে সুর্য হলেন শুধু বাপিদার বন্ধু, সে নামের অন্য অর্থ থাকার কী প্রয়োজন?”
“কথাটা মন্দ বলনি,” আমি বললাম। “এক বাক্যে বাড়ির মালিকদের পাপ খন্ডন।”
“এটা আমার কথা নয়। যাঁর বাড়ি যাচ্ছি, আমাদের মাস্টারমশাই শিশিরবাবুর কথা। ওঁর বাড়ির নাম নীলিন।”
“তাঁর অর্থ কি?”
“নিলীন কথাটার অর্থ আছে, কিন্তু নীলিনের নেই। সেই সূর্য আর সুর্যের ব্যাপার। আমি একদিন ওঁকে বলেছিলাম, “বানানটা কারেক্ট করিয়ে নিন, চোখে বড় লাগে।” তার উত্তরে এই কথাগুলো বলে উনি বলেছিলেন, শান্তিনিকেতনে এই নামে আর দ্বিতীয় বাড়ি পাবে না।”
.
কয়েকমিনিটের মধ্যেই আমরা গন্তব্যস্থলে গিয়ে পৌঁছলাম। ছোট্ট একতলা বাড়ি, সংস্কারের অভাবে একটু জরাজীর্ণ। সামনে বেশ কিছুটা জমি। হঁটের দেয়াল জায়গায় জায়গায় ধ্বসে পড়েছে। সেখান দিয়ে কুকুর ছাগল, এমন কি গরু মহিষও ঢুকে পড়তে পারে। গেটটাও হাট করে খোলা। তার একটা পাল্লার পাশে গাছের অনেক মরা ডাল স্তূপাকৃতি করে রাখা। দেখলে মনে হয় অনেকদিন ধরেই সেগুলো ওখানে পড়ে আছে, সুতরাং গেটটা বোধহয় খোলাই রাখা হয়। এতটা জমি, কিন্তু কয়েকটা বড়ো ইউক্যালিপ্টাস, দুটো পেয়ারা আর একটা খেজুর গাছ ছাড়া আর কিছুই দেখলাম না। একটা পেয়ারা গাছকে আবার উইপোকা ধ্বংস করছে। মরা ডালগুলো হয়তো ওই পেয়ারা গাছেরই।
এমন সময়ে শুনলাম একটা কেউ কেউ আওয়াজ। একটা নেড়ি কুত্তাকে দুটো অল্প বয়সি ছেলে দড়ি দিয়ে বেঁধে বাড়ির পেছন থেকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে এল।
“এই কী হচ্ছে?” বলে প্রভাস একটা বকুনি দিতেই ছেলেদুটো কুকুর ফেলে দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ভোঁ-দৌড়! কুকুরটাও মুক্তি পেয়ে দড়ি সুধুই দ্রুত পালাল।
“মাস্টারমশাই ভালো লোক বলে যে যার খুশি এখানে ঢুকে বদমায়েশি করে!” বিরক্ত হয়ে প্রভাস বলল।
“ওঁর একটা মালি রাখা উচিত,” আমি বললাম।
কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে প্রমথ মন্তব্য করল, “ঠিকই বলেছিস, কয়েকটা ফুল গাছ থাকলে বাড়িটা এত ন্যাড়া লাগত না!”
প্রভাস বোধহয় আমাদের কথায় একটু ব্যথা পেল। বলল, “পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ। একা মানুষ, বইপত্র নিয়েই পড়ে থাকেন।”
বাড়ির দরজার সামনে ছোট্ট বারান্দা। সেখানে বেতের চেয়ারের উপর একটা পত্রিকা পড়ে আছে। প্রমথ সেই চেয়ারে গ্যাঁট হয়ে বসে পত্রিকার পাতা উলটোতে লাগল। প্রভাস কড়া নাড়তে নাড়তে উচ্চস্বরে ডাক দিল, “মাস্টারমশাই!”
কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ এল না।
“ওঁর কাজের লোকটা দু’দিন হল গ্রামে গেছে। উনি আবার কানেও ভালো শোনেন না।” আমাদের উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলে প্রভাস আবার জোর গলায় ডাকল, “মাস্টারমশাই, মাস্টারমশাই।”
উত্তর নেই।
“তাহলে কি কোথাও গেছেন?” প্রভাস আত্মগত ভাবেই কথাটা বলল।
“আমি একটু দেখি,” বলে প্রমথ চেয়ার থেকে উঠে দরজায় একটা ধাক্কা দিতেই একটা কপাট পুরো খুলে গেল।
“ও মাই গড!” প্রমথ এক পা পিছিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। “আই থিঙ্ক হি ইজ ডেড!”
আধখোলা দরজার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম মেঝেতে কেউ পড়ে আছে। শুধু কোমরের নীচটা দেখা যাচ্ছে, উপরটা কপাটের আড়ালে। রক্ত আর রক্ত, সারা জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
কয়েক মুহূর্তের জন্য আমরা হতচকিত হয়ে গেলাম। প্রভাস ভেতরেও ঢুকল না, দৌড়ে পাশের বাড়িতে গিয়ে প্রবল বেগে কড়া নাড়তে শুরু করল। আমিও ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা খুললেন একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক। ধুতিটা লুঙ্গির মতো করে
রা, গায়ে গেঞ্জি, চাদরটা গায়ের একপাশে ঝুলছে –বোধ হয় ঘুমের তোড়জোড় করছিলেন।
“কি ব্যাপার?”
“ডাক্তারবাবু, এক্ষুণি আসুন। মাস্টারমশাই বোধ হয় মারা গেছেন।”
“সেকি!”
ডাক্তারবাবু, সেই অবস্থাতেই ভেতর থেকে একটা ডাক্তারি ব্যাগ আর স্টেথিসস্কোপটা নিয়ে এসে বললেন, “চলুন।”
অন্য কপাটটা খোলা যাচ্ছে না। ডাক্তারবাবু (পরে নাম জেনেছি ডাক্তার অরুণ চৌধুরী) কাঁধটা একটু পাশ করে দরজার ফাঁক দিয়ে গলে ভেতরে গেলেন। আমি, প্রমথ আর প্রভাসও ওঁর পেছন পেছন ঢুকলাম।
প্রভাসের মাস্টারমশাইয়ের দেহটা আড়াআড়িভাবে পড়ে আছে। ঘাড়টা উঁচু হয়ে দরজা আর দেয়ালের কোণে আটকা। ঘাড়টা বোধহয় ভেঙেই গেছে। মাথার পেছনটা নিশ্চয় ফেটেছে, কারণ রক্তের ধারাটা ওখান থেকেই বেরিয়েছে মনে হল। বাঁ-হাতের ঠিক পাশেই একটা তালা চাবি-আটকানো অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে। হাতের লাঠিটা তার একটু দূরে। তালা আর লাঠিটা দেখে মনে হয় বোধহয় বেরচ্ছিলেন বা ঘরে ঢুকছিলেন।
ডাক্তার চৌধুরি হাঁটু গেড়ে বসে বৃদ্ধের বুকে স্টেথিসস্কোপ বসিয়ে গলার পাশের শিরাটা আঙুল দিয়ে টিপে ধরলেন। আহত বা মৃতদের দিকে আমি তাকিয়ে থাকতে পারি না। তাই ঘরের চারিদিকটা একবার দেখলাম। দামী কোনো আসবাবপত্র চোখে পড়ল না। একটা বড়ো তক্তপোশ আর বেতের কয়েকটা চেয়ার। তক্তপোশে অবশ্য বসারও জায়গা নেই স্তূপাকৃত বই সেখানে জড় করে রাখা। দেয়ালের একটা শেলফে মাটির আর কাঠের তৈরি নানান মূর্তি। দু’দিকের দেয়ালে কয়েকটা ছবি। একটা যামিনী রায়ের ধাঁচে আঁকা। আরও হয়তো দেখার মতো কিছু ছিল, কিন্তু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার মানসিক অবস্থা আমার ছিল না।
ডাক্তার চৌধুরী পরীক্ষা শেষ করে বললেন, “প্রাণ নেই, ডেড।”
“উনি কি হঠাৎ পড়ে গিয়ে মারা গেলেন? প্রভাস জিজ্ঞেস করল।
“অসম্ভব নয়। তবে অপঘাতে মৃত্যু, তাড়াতাড়ি পুলিশকে একটা খবর দেওয়া দরকার।”
ডাক্তার চৌধুরী স্টেথিসস্কোপটা গলায় ঝোলাতে ঝোলাতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর কেমন একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন, “আপনারা কখন এলেন এখানে?”
প্রভাসই উত্তর দিল, “এই এক্ষুণি! দেখেই আপনাকে ডাকতে গেছি।”
“গা-টা এখনও পুরো ঠান্ডা হয়নি। অল্প কিছুক্ষণ হল মারা গেছেন। চলুন, আমার বাড়ি থেকেই পুলিশকে ফোন করবেন।”
“আপনি শিওর উনি বেঁচে নেই?” প্রভাস বিশ্বাস করতে পারছে না।
“শিওর।”
আধঘন্টার মধ্যেই একটা জিপে চেপে দু’জন পুলিশ এল। ওঁদের মধ্যে যিনি পদস্থ তিনি বোধহয় সাব-ইনস্পেক্টর র্যাঙ্কের হবেন। আমরা কেন এসেছিলাম, ঠিক কখন এসেছিলাম, ঢুকে কী দেখেছি, ভেতরে ঢুকে কিছু নাড়াচাড়া করেছি কিনা, কোনো সন্দেহজনক শব্দ শুনেছি কিনা, কোনো সন্দেহভাজন কাউকে দেখেছি কিনা –এরকম হাজারও প্রশ্ন করলেন।
প্রমথ আবার সন্দেহভাজন বলতে কী বোঝাচ্ছেন জিজ্ঞেস করাতে সাবইনস্পেক্টর মশাই খুব বিরক্ত হলেন। প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন, “আর কাউকে দেখেছেন আশেপাশে?”
আমি দুটো ছেলের কথা বললাম।
“ছেলেদুটোকে দেখলে চিনতে পারবেন?”
“মনে হয় না, এক ঝলকের জন্য দেখেছি।”
প্রমথ আর প্রভাসও বলল যে ওরা শিওর নয় চিনতে পারবে বলে।
এরমধ্যে থানার ওসি নিজেই এসে হাজির হলেন। ভাগ্যক্রমে প্রভাসকে উনি ভালো করে চিনতেন। নইলে সাব-ইনস্পেক্টর মশাইয়ের কাছে আমাদের আরও অনেক ভোগান্তি হত বলে আমার বিশ্বাস।
বাড়ি ফিরতে প্রায় বিকেল পাঁচটা হল। শ্যামলবাবুরা ইতিমধ্যে মেলায় চলে গেছেন। আমাদের সবার যা মানসিক অবস্থা, তাতে মেলায় গিয়ে আনন্দ করার প্রশ্ন ওঠে না।
“দিনটা কি সুন্দর ভাবে শুরু হয়েছিল, আর কী হয়ে গেল!” বিষণ্ণভাবে বলল প্রভাস।
প্রভাসের মানসিক অবস্থা আমি যথেষ্ট অনুমান করতে পারছিলাম। জীবনে এই প্রথম প্রভাস এইরকম অপঘাত মৃত্যু চোখের সামনে দেখল। আমি আর প্রমথ অবশ্য এইরকম ঘটনার সম্মুখীন আগেও আরেকবার হয়েছি। প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টেই এক রাতের জন্য এক গেস্ট এসে খুন হন! যাই হোক, সে গল্প এখানে নয়। শুধু এটুকুই যোগ করি যে সেই সূত্রেই একেনবাবুর আসল পরিচয় আমরা পেয়েছিলাম।
আমি আর প্রমথ দুজনেই প্রভাসকে বললাম, আমাদের সঙ্গে রাতটা কাটাতে। ঘুম আমাদেরও যে খুব একটা হবে তা নয়। ঘুমোনোর চেষ্টা না করে বরং কিছুক্ষণ গল্পগুজব করলে হয়তো মানসিক দিক থেকে কিছুটা আরাম হবে। প্রভাসকে বেশি বলতে হল না। ও রাজি হয়ে গেল।
বনমালী চা দিয়ে গেল। প্রভাস হঠাৎ বলল, “একটা কথা কি জানেন, উনি যেন মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছিলেন।”
“তার মানে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“বেশ কিছু দিন ধরে যখনই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমাকে দিয়ে নানান লোকের নানান জিনিস ফেরত পাঠিয়েছেন। একদিন বললেন, এই বইটা বিকাশবাবুকে ফেরত দিয়ে এসো। আমাকে বহুদিন আগে দিয়েছিলেন, কিন্তু ফেরত দেওয়া হয়নি।“
বিকাশবাবুও এককালে বিশ্বভারতীতে পড়াতেন –এখন শ্যামবাটিতে থাকেন। তাঁকে যখন বইটা দিলাম, তিনি অবাক! তিনিও ভুলে গিয়েছিলেন বইটার কথা। এমন কিছু দামি বই নয়, কিন্তু মনে করে করে মাস্টারমশাই যেন নিজেকে ঋণমুক্ত করছিলেন! আমাদের এক সহকর্মী মাস্টারমশাইকে একটা লাঠি দিয়েছিল। কিছুই নয় সাদামাটা অতি সাধারণ লাঠি। মাস্টারমশাই হাঁটতে হাঁটতে একদিন হঠাৎ আছাড় খেয়ে পড়ে যান। ওঁর লাঠি নর্দমায় পড়ে যায়। যেখানে পড়েছিলেন তার পাশেই আমার সেই সহকর্মীর বাড়ি। উনি দৌড়ে এসে মাস্টারমশাইকে তোলেন। তারপর ওঁর বাবার একটা লাঠি মাস্টরমশাইকে দেন। সেটা মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে ছিল বেশ কিছুদিন। সহকর্মীর বাবা মারা গেছেন, সেই লাঠির কোনো প্রয়োজনই তাঁর ছিল না। আমাকে বলেছিলেন ‘ওটা মাস্টারমশাইয়ের কাছেই থাক, ওঁর কাজে লাগুক।’
দিন দশেক আগে মাস্টারমশাই আমাকে বললেন, “তুমি আমাকে একটা লাঠি কিনে এনে দিও তো।“
আমি বললাম, “কেন, লাঠিটাতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে?”
মাস্টারমশাই বললেন, “না। কিন্তু লাঠিটা তো আমার নয়। ওটা আমি ফেরত দিতে চাই।“
এছাড়াও প্রায়ই দেখি নিজের বইগুলো ঘাঁটছেন। সেখানে খুঁজছেন অন্য কারো বই ওঁর কাছে আছে কিনা। বেশ কয়েকটা বই আমার হাতে দিয়ে বললেন, “তুমি এগুলো ফেরত দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে পারো?”
বইগুলো যাঁদের তাদের কয়েকজনকে আমি চিনিও। একজন মারাও গেছেন বেশ কিছুদিন হল। আমি সেটা বলতেই বললেন, “তা হোক, ওর ছেলেমেয়েদের কাউকে দিয়ে দিও। আমি সব কিছু ফেরত দিয়ে দিতে চাই।“
আমি একদিন বলেই ফেলেছিলাম, “কবে নিয়েছিলেন বইটা?” মাস্টারমশাইয়ের উত্তর, প্রায় বছর দশেক আগে। আমার ব্যাপার তো জানোই, একসঙ্গে এতগুলো বই পড়ি যে এক-একটা শেষ করতে অনেক সময় লেগে যায়। তারপর যা হয় বইগুলো পড়েই থাকে। যার বই সেও চায় না। আমারও খেয়াল থাকে না।’
“যাঁর কাছ থেকে আপনি বইগুলো ধার নিয়েছিলেন, তাঁদের কাছেও নিশ্চয় আপনার অনেক বই আছে।“
“তা হয়তো আছে, কিন্তু তার সঙ্গে বই ফেরত না দেওয়ার সম্পর্ক কি।“ একটু যেন বিরক্ত হয়েই মাস্টারমশাই আমায় বলেছিলেন।
আমি বলেছিলাম, “না,না, আমি ফেরত দিয়ে দেব। কিন্তু আপনার স্মরণশক্তি দেখে সত্যিই অবাক হচ্ছি। আট দশ বছর আগে বই ধার করেছেন, কিন্তু ঠিক মনে আছে কার কাছে থেকে কোন বই নিয়েছিলেন।“
‘স্মরণশক্তির আবার কি দেখলে। ফেরত দিতে তো ভুলেই গিয়েছিলাম।‘
‘তা হোক, কিন্তু ধার করেছিলেন সেটা তো মনে আছে।
‘তা আমার মনে থাকে, কিন্তু মাঝে মাঝে ভীষণ ভুলও হয়। বছর পাঁচেক আগে এক ভদ্রলোকের সাথে হঠাৎ করে দেখা হল –মানে তিনিই খোঁজ করে আমার কাছে এসেছিলেন। আমার পরিচিত একজনের জামাই। তাকে দেখে হঠাৎ মনে পড়ল, একটা জিনিস আমার ফেরত দেওয়া হয়নি। অথচ যাকে দেবার, সে আর বেঁচে নেই!’
‘তার ছেলেমেয়েরা নেই?’
‘তা আছে। সেটাও ফেরত দিতে হবে। আরও এরকম কত জিনিস হয়তো রয়ে যাচ্ছে। নিজের স্মরণশক্তির উপর এক সময়ে আমার আস্থা ছিল –এখন আর ততটা নেই।”
এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে প্রভাস কিছুক্ষণ চুপ রইল। প্রমথ চুপ, আমিও ঠিক কি বলব ভেবে পেলাম না।
একটু বাদে প্রভাস বলল, “বন্দনা ওঁর ভীষণ ভক্ত ছিল। খবরটা শুনলে ও ডিভাস্টেটেড হয়ে যাবে।”
“এখন না হয় নাই জানালে, ক’দিন বাদেই তো ও আসছে।” আমি বললাম।
“বন্দনা ওঁকে বরাবর দাদুই ডেকেছে। উঃ, কী অদ্ভুত ভাবে চলে গেলেন!”
“হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন,” আমি বললাম। “আগেও তো একবার বললে পড়ে গিয়েছিলেন। এবার পড়েছেন বেকায়দায়।”
“কেন জানি না আমার মন বলছে তা নয়।”
“তুমি কি ভাবছ, মার্ডার?”
“না, না কে এমন নৃশংস কাজ করবে? কেন করবে? একজন সাধু-সজ্জন বৃদ্ধ!”
“হয়তো অ্যাকসিডেন্ট!” প্রমথ মন্তব্য করল।
“অ্যাকসিডেন্ট!”
“কেউ হয়তো কিছু চুরি করতে এসেছিল, উনি হঠাৎ এসে পড়ায়, পালাবার চেষ্টা করছিল, ধাক্কাধাক্কিতে উনি পড়ে গেছেন।”
চিন্তাটা আমার মনেও এসেছিল। প্রভাসের মুখটা হঠাৎ কেমন ফ্যাকাশে লাগল।
“কি হল?” আমি প্রশ্ন করলাম। “ওঁর খিড়কির দরজার খিল ভেঙে গিয়েছিল –ছিটকিনিও নড়বড়ে ছিল। কাজের লোক দেশে চলে গেছে শুনে আমিই গতকাল ওখানে একটা তালা লাগিয়ে দিয়েছিলাম।
ওটা খোলা থাকলে, চোর হলে নিশ্চয় ওখান দিয়ে পালাতে পারত! মাস্টারমশাইয়ের পক্ষে তো কাউকে তাড়া করার প্রশ্ন ওঠে না।”
ওর কথাটা খুবই যুক্তিপূর্ণ। কিন্তু আমি ওকে বললাম, “কি ঘটেছে আমরা তো জানি প্রভাস। তুমি এসব এখন ভাবছ কেন?”