২২. পুলিশ কমিশনার

পুলিশ কমিশনার অসহায়ভাবে হাত নেড়ে বললেন, আমি কী করব?

তাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো বলল, তাহলে কে করবে? তোমাকেই তো করতে হবে। তুমি আমাদের পুলিশ কমিশনার। তুমি না করলে কে করবে?

পুলিশ কমিশনারকে আরো অসহায় দেখায়, কিন্তু আমি তো শুধু পুলিশ কমিশনার। আইন শৃঙ্খলার বিষয়টা দেখি।

এটা তো আইন শৃঙ্খলারই ব্যাপার। নেটওয়ার্ক কাজ করছে না, পুরো শহরের সবকিছু থেমে গেছে। আমরা কোথায় বিদ্যুৎ পাব, কোথায় খাবার পানি পাব, কোথায় খাবার পাব, আমাদের ছেলে মেয়েরা কেমন করে স্কুলে যাবে, কেমন করে লেখাপড়া করবে কিছু জানি না। আমাদের অসুখ হলে কে চিকিৎসা করবে তাও জানি না!

পুলিশ কমিশনার মাথা নাড়ল, বলল, এগুলো তো আমারও প্রশ্ন।

তাহলে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দাও।

তেজি চেহারার একজন মহিলা বলল, মানুষজন কিন্তু ক্ষেপে উঠছে।

কমবয়সী একজন তরুণ বলল, সবাই খুব ভয় পেয়েছে। সারা শহরে আতংক।

বুড়ো মতোন একজন বলল, তোমাকে একটা সিদ্ধান্ত দিতে হবে। বলতে হবে আমরা এখন কী করব।

পুলিশ কমিশনার বলল, আমরা চেষ্টা করছি কেন্দ্রে যোগাযোগ করার জন্যে। কোনো উত্তর পাচ্ছি না।

তেজি চেহারার মহিলাটি বলল, আমরা এসব শুনতে চাই না। তুমি কিছু একটা কর।

পুলিশ অফিসার খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, তাহলে আমরা সবাই এক সাথে বসি। বসে চিন্তা-ভাবনা করে কিছু একটা ঠিক করি।

তুমি যেটা ভালো মনে কর সেটা কর। কিন্তু কিছু একটা কর।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। তাহলে আমরা সবাই আমাদের শহরের হলঘরটাতে বসি?

পুলিশ কমিশনারকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।

তেজি চেহারার মহিলাটি বলল, কিন্তু আমরা সবাইকে খবর দিব কেমন করে? নেটওয়ার্ক নেই।

সবার বাসায় বাসায় যেতে হবে। বাসায় বাসায় গিয়ে বলতে হবে।

বুড়ো মতন মানুষটা বলল, একজন কয়েকজনকে খবর দেবে, তারা প্রত্যেকে আরো কয়েজনকে খবর দেবে এভাবে সবার কাছে খবর পৌঁছানো যাবে।

পুলিশ কমিশনার বলল, হ্যাঁ। সেটাই ভালো। আমি আমার পুলিশ বাহিনীকেও পাঠিয়ে দিই।

 

হলঘরে শহরের সব মানুষ চলে এসেছে। বসার জায়গায় সবাইকে জায়গা দেয়া যায় নি তাই অনেক দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভেতর রীতিমতো গরম, মানুষেরা হাত দিয়ে নিজেদের বাতাস করার চেষ্টা করছে। হলঘরের সামনে উঁচু মঞ্চে পুলিশ কমিশনার দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে মুখে এক ধরনের আতংক। সে হাত তুলতেই সবাই চুপ করে গেল।

পুলিশ অফিসার একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, প্রিয় নগরবাসী এখানে আসার জন্যে সবাইকে ধন্যবাদ। তোমরা সবাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কেন তোমাদেরকে এখানে ডাকা হয়েছে।

সবাই নিঃশব্দে বসে থাকে, সবার মাঝে এক ধরনের চাপা ভয়।

পুলিশ কমিশনার বলল, তোমরা সবাই দেখেছ আমাদের নেটওয়ার্কটি কাজ করছে না। এটি অসম্ভব একটি ব্যাপার—এরকম ভয়ংকর একটি ব্যাপার যে ঘটতে পারে আমরা সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। এখনো আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারছি না। পুলিশ কমিশনার একবার ঢোক গিলে বলল, আমি ভেবেছিলাম এটি একটি ছোট দুর্ঘটনা এবং অত্যন্ত দ্রুত এই সমস্যাটি মিটিয়ে ফেলা হবে। তোমরাও নিশ্চয়ই তাই ভেবেছিলে–আমরা সবাই অপেক্ষা করছিলাম যে নেটওয়ার্কটি চালু হয়ে যাবে। নেটওয়ার্ক না থাকায় আমরা অন্যান্য শহরে খোঁজ নিতে পারছিলাম না, সব যোগাযোগ বন্ধ। তারপরও লোক পাঠিয়ে খোঁজ নিয়েছি এবং যেটুকু সম্ভব জানা গেছে শুধু এখানে নয়, সব জায়গায় নেটওয়ার্ক বন্ধ।

কমবয়সী একটি মেয়ে প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, তাহলে আমাদের কী হবে?

পুলিশ কমিশনার বলল, সেটা নিয়ে কথা বলার জন্যেই তোমাদের সবাইকে ডেকেছি। বিপদে মাথা ঠাণ্ডা রেখে আলোচনা করা যাক।

বয়স্ক একজন মানুষ বলল, আমি একটা বইয়ে পড়েছিলাম প্রাচীন কালে সব শহরে শহর পরিচালনার জন্যে একটি কমিটি থাকত। সেই কমিটির সদস্যরা শহরের ভালো-মন্দ দায়িত্ব নিত। আমরাও কাজ চালানোর জন্যে এরকম একটা কমিটি করতে পারি।

একজন জিজ্ঞেস করল, সেই কমিটির সদস্য কে হবে?

আরেকজন বলল, নেটওয়ার্ক যদি না থাকে তাহলে সেই সদস্যরা কেমন করে কাজ করবে?

কমবয়সী মেয়েটি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কিন্তু তোমরা কেউ কেন সত্যিকারের বিষয়টা নিয়ে কথা বলছ না? নেটওয়ার্কটি কেমন করে বন্ধ হয়ে গেল? আমরা সবসময় জানতাম নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও এই নেটওয়ার্ক ধ্বংস করা যায় না।

সামনের দিকে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, আমি ব্যাপারটা তোমাদের জন্যে ব্যাখ্যা করতে পারি।

সবাই ঘুরে মানুষটির দিকে তাকাল। এই শহরের মানুষ আগে কখনো এই মধ্যবয়স্ক মানুষটিকে দেখেনি। মানুষটির উঁচু চোয়াল এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখগুলো কোটরের ভেতর এবং দেখে মনে হয় সেটা ধিকিধিকি করে জ্বলছে। মানুষটি ওঠে দাঁড়াল এবং লম্বা পা ফেলে মঞ্চে ওঠে পুলিশ কমিশনাররের পাশে দাঁড়াল। তারপর পোশাকের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে লম্বা বেঢপ একটা রিভলবার বের করে আনে। সেটা উপরে তুলে একটা গুলি করতই ঝনঝন শব্দ করে একটা আলো ভেঙ্গে পড়ে হলঘরের খানিকটা অন্ধকার হয়ে যায়। হলঘরে বসে থাকা মানুষগুলো এক সাথে সবাই চিৎকার করে আবার হঠাৎ করে থেমে যায়।

মধ্যবয়স্ক কোটরাগত চোখের মানুষটা রিভলবারটাকে একনজর দেখে বলল, আমার আসলে পুলিশ কমিশনারের কপালে এই গুলিটা করার কথা ছিল কিন্তু রক্তের ছিটে লেগে আমার শার্টটা নোংরা হবে তাই তাঁকে গুলি করি নি।

নেটওয়ার্ক বন্ধ, কাপড় ধুতেও পারব না।

হলঘর বোঝাই মানুষগুলো বিস্ফারিত চোখে মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারা কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমি রবোমানব। এই হলঘরের পিছনে আরো দুজন রবোমানব আছে, তাদের হাতে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে, একটু যদি নাড়াচাড়া করো, আমার কথার অবাধ্য হও তাহলে সবাইকে গুলি করে শেষ করে দেয়া হবে। আমাদের কাছে মানুষ আর ব্যাক্টরিয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

কেউ কোনো কথা বলল না, নিঃশব্দে রবোমানবটির দিকে তাকিয়ে রইল। রবোমানবটি হলঘরের মানুষগুলোর দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, আজ আমার খুব আনন্দের দিন। এতোদিন আমরা মানুষের ভয়ে লুকিয়ে থাকতাম। এখন আমাদের আর লুকিয়ে থাকতে হবে না। আমরা প্রকাশ্যে এসেছি। এই মুহূর্তে পৃথিবীর প্রত্যেকটা শহরে নগরে রবোমানবেরা বের হয়ে তার দায়িত্ব নিচ্ছে। পুরো পৃথিবী এখন রবোমানবদের হাতের মুঠোয়।

বয়স্ক একজন মানুষ বলল, আমি বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারছি না। তুমি বলছ পুরো পৃথিবীটা তোমাদের হাতের মুঠোয়। কিন্তু কেমন করে সেটা তোমাদের হাতের মুঠোয় গিয়েছে?

তার কারণ আমরা পৃথিবীর নেটওয়ার্ক দখল করেছি। যে পৃথিবীর নেটওয়ার্ক দখল করতে পারে সে পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করে।

কিন্তু নেটওয়ার্ক তত বন্ধ। বন্ধ নেটওয়ার্ক দখল করে কী লাভ?

আমরা বন্ধ নেটওয়ার্ক দখল করি নি।

তাহলে নেটওয়ার্ক বন্ধ কেন?

নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণে নেটওয়ার্ক বন্ধ করা হয়েছে।

সেই কারণটা কী?

মধ্যবয়স্ক মানুষটার কোটরাগত চোখ দুটো হঠাৎ যেন জ্বলে ওঠে, সে হিংস্র গলায় বলল, তুমি সীমা অতিক্রম করেছ? আমি তোমার কথায় উত্তর দিতে বাধ্য নই।

কিন্তু আমাদের জানতে হবে।

বেশ। জেনে নাও। বলে রবোমানবটি তার রিভলবার তুলে বুড়ো মানুষটির মাথা লক্ষ্য করে গুলি করল। পুরো হলঘরটিতে গুলির শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে।

বুড়োমানুষের দেহটি ঢলে নিচে পড়ে গেল। রবোমানবটি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের জন্যে এটি একটি উদাহরণ হয়ে রইল। কেউ যদি সীমা অতিক্রম করে তার বেঁচে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই।

কেউ কোনো কথা বলল না।

আমরা পৃথিবী দখল করেছি এই বিষয়টি নিয়ে কারো প্রশ্ন আছে?

এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না।

চমৎকার। রবোমানবটি মুখে সন্তুষ্টির একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, এবার তাহলে সকলে ঘরে ফিরে যাও। কাল সকালে আমাদের পঞ্চাশজন মানুষ দরকার। সুস্থ সবল নীরোগ পঞ্চাশ জন মানুষ। কমবয়সী পঞ্চাশজন মানুষ। নাবী এবং পুরুষ। আজ রাতের মাঝে নেটওয়ার্ক চালু হয়ে যাবে। সেই নেটওয়ার্কে আমরা নির্দেশ পাঠাব।

এবারেও কেউ কোনো কথা বলল না। রবোমানবটির মুখে ক্রুর একটা হাসি ফুটিয়ে বলল, এই পঞ্চাশজনের জীবনকে আমরা মহিমান্বিত করে দেবো। তারা তুচ্ছ মানুষের জীবন পরিত্যাগ করে সত্যিকার রবোমানবের জীবনে পা দেবে।

উপস্থিত সবাই হঠাৎ করে আতংকে শিউরে ওঠে।