০৫. রোবটগুলো বাইভার্বালটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল

রোবটগুলো বাইভার্বালটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল। ক্রিনিটি ইঞ্জিনটিকে চালু করার সাথে সাথে তারা হাতের অস্ত্র উপরে তুলে চিৎকার করে বলল, জয়, মহামান্য নিকির জয়।

নিকি হাসি মুখে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল, বিদায়! আবার দেখা হবে তোমাদের সাথে।

রোবটগুলো গম্ভীরমুখে বলল, মহামান্য নিকি দীর্ঘজীবী হোন।

বাইভার্বালটি মাটি থেকে মিটার খানেক উপরে উঠে একটু কাত হয়ে ঘুরে গিয়ে ছুটে যেতে শুরু করে। নিকি মাথা ঘুরিয়ে দেখল রোবটগুলো তাদের অস্ত্র উপরে তুলে আবার চিৎকার করে বলল, জয়, মহামান্য নিকির জয়।

নিকি ক্রিনিটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্রিনিটি, এরা আমাকে সবসময় মহামান্য নিকি কেন বলে?

তাদের কপোট্রনে এটি ইলেকট্রনিকভাবে গেঁথে দেয়া আছে। পাকাপাকিভাবে? সবসময় তাদের মানুষকে সম্মান করতে হয়।

সব রোবটরাই কী এরকম?

না। এটি করা আছে শুধু দ্বিতীয় আর প্রথম মাত্রার রোবটে।

তোমার মাঝে নেই?

আমার মাঝে ওদের মতো হার্ডওয়্যার করা নেই। অন্যভাবে আছে। সিস্টেমে রাখা আছে। আমরাও মানুষকে গুরুত্ব দিই।

আর চতুর্থ মাত্রার রোবট?

তারাও মানুষকে গুরুত্ব দেয় কিন্তু তাদের কপোট্রনের দক্ষতা মানুষের মস্তিষ্কের সমান। তাই তারা সমান সমানভাবে গুরুত্ব দেয়।

আর পঞ্চম মাত্রার রোবট?

পৃথিবীতে পঞ্চম মাত্রার রোবট নেই।

কেন নেই?

তৈরি করা হয় নি। আমি তোমাকে বলেছি তাদের বুদ্ধিমত্তা মানুষের। বুদ্ধিমত্তা থেকে অনেক বেশি হবে তাই ইচ্ছে করে তৈরি করা হয় নি। আমার কি মনে হয় জানো?

কী?

পঞ্চম মাত্রার রোবট মানুষকে মনে হয় সম্মান করবে না। তাদের বুদ্ধিমত্তা যদি মানুষ থেকে বেশি হয় তাহলে তাদের সম্মান করার দরকারও নেই। তুমি কী মিক্কুকে সম্মান কর?

নিকি খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলল, কিন্তু আমি তো মিকুকে অনেক ভালোবাসি। পঞ্চম মাত্রার রোবট মানুষকে ভালোবাসবে না?

মনে হয় ভালোবাসবে। মানুষকে ভালোবাসতে হয়।

 

ক্রিনিটি বাইভার্বালটিকে একটি হ্রদের কাছাকাছি নিয়ে এলো, হ্রদের তীর ঘেঁষে বাইভার্বালটি গর্জন করে ছুটে যেতে থাকে। বাইভার্বালের শব্দ শুনে অসংখ্য পাখি সচকিত হয়ে উড়ে যেতে থাকে। নিকি পাখিগুলোকে দেখতে দেখতে ক্রিনিটিকে জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি ক্রিনিটি?

একটি রোবোনগরীতে।

রোববানগরী কী?

পৃথিবীর সব মানুষ মরে যাবার পরে রোবটেরা পৃথিবীর দায়িত্ব নিয়েছে। তারা নগর তৈরি করেছে। সেই নগরকে বলে রোবোনগরী।

সেখানে কী আছে ক্রিনিটি?

আমি এখনো জানি না। এখানে রোবটদের যে নেটওয়ার্ক আছে সেই নেটওয়ার্কে একটু খোঁজ নিয়েছি। মানুষের শহরে যা যা থাকার কথা মনে হয় তার সবই আছে। সিনেমা হল, আর্ট গ্যালারি, মিউজিক হল, স্টেডিয়াম, দোকানপাট।

সবকিছু রোবটদের জন্যে?

হ্যাঁ। সবকিছু রোবটদের জন্যে।

সেখানে কী আমার মতো কোনো মানুষ আছে?

এখনো জানি না। গেলে বুঝতে পারব। আমার মনে হয় নাই। গেলে। খোঁজ পাব, অন্য কোনো রোবোনগরীতে আছে কি নেই। যতক্ষণ না পাই আমরা খুঁজতে থাকব।

তোমার কি মনে হয় ক্রিনিটি, আমরা কি খুঁজে পাব?

আমার মনে হয় পাব। তুমি যেরকম বেঁচে গিয়েছ সেরকম নিশ্চয়ই আরো কেউ বেঁচে গিয়েছে। তারা নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আছে।

নিকি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আরেকজন মানুষের সাথে দেখা হলে আমি তাকে কী বলব?

আমি তোমাকে বলেছি তোমার সেটি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তখন নিজেই বুঝতে পারবে কী বলতে হবে।

কী মজা হবে তখন, তাই না ক্রিনিটি?

ক্রিনিটি মজা শব্দটি অনুভব করতে পারে না, কিন্তু সে সেটি নিকিকে বুঝতে দিল না।

সন্ধ্যেবেলা রোবোনগরী পৌঁছানোর অনেক আগেই বাইভার্বালের মনিটরে তার উপস্থিতি ধরা পড়ল। সেখানে অনেকগুলো বিন্দু বিন্দু আলো এবং বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গের বিচ্ছুরণ দেখা গেল। নিকি সেদিকে তাকিয়ে বলল, অনেক হইচই হচ্ছে। তাই না ক্রিনিটি?

হ্যাঁ।

সেখানে রোবটগুলো কয় মাত্রার?

বেশিরভাগই চার মাত্রার। হয়তো কিছু তিন মাত্রার।

তারা আমাকে দেখলে কী করবে?

আমি এখনও জানি না। সেজন্যে আমি সাবধান থাকতে চাইছি।

কিভাবে তুমি সাবধান থাকবে?

তোমাকে আমি আগেই নিয়ে যাব না। আমি নিজে গিয়ে আগে দেখে আসি।

আমাকে কোথায় রেখে যাবে?

তোমার জন্যে একটি নিরাপদ আশ্রয় বের করে সেখানে রেখে যাব।

আমি একা একা থাকব?

হ্যাঁ।

আমার একা থাকার ইচ্ছে করছে না।

ক্রিনিটি তার কপোট্রনে মৃদু চাপ অনুভব করল। সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি কী করতে চাও?

আমি তোমার সাথে যেতে চাই।

তোমাকে দেখলেই রোববানগরীতে বিশাল উত্তেজনার সৃষ্টি হবে। সেটি ভালো হবে না খারাপ হবে আমি সেটি এখনো অনুমান করতে পারছি না। আমি তোমাকে নিয়ে কখনো কোনো ঝুঁকি নেব না।

ঠিক আছে আমি তাহলে লুকিয়ে থাকব।

কোথায় লুকিয়ে থাকবে?

এই বাইভার্বালের পিছনে যে বাক্সটা আছে তার ভেতরে। তাহলে কেউ আমাকে দেখতে পাবে না।

ক্রিনিটি বলল, বাক্সটা বেশি বড় না, তুমি কি আরাম করে থাকতে পারবে?

হ্যাঁ পারব। আমি গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে যাব। তুমি কোনো চিন্তা করো না।

ঠিক আছে। ক্রিনিটি বলল, আমার মনে হয়, এটি একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হতে পারে।

কাজেই বাইভার্বালটি থামিয়ে তার পেছনের বাক্সে বেশ খানিকটা জায়গা করে নিয়ে ক্রিনিটি সেখানে নিকিকে শুইয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?

না। এখানে খুব আরামে ঘুমানো যাবে। এখন থেকে প্রত্যেকদিন আমি এখানেই ঘুমাব।

ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও। আমি বাইভার্বালটিকে নিয়ে রোবোনগরীতে ঢুকি।

রোববানগরের গেটে দুটি ভয়ংকর দর্শন রোবট ক্রিনিটির বাইভার্বালটিকে থামাল। একজন জিজ্ঞেস করল, তুমি এই কিম্ভুতকিমাকার জঞ্জাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

এটি কিম্ভুতকিমাকার জঞ্জাল নয়। এটি বাইভার্বাল।

এটি এতো পুরানো যে এটাকে জঞ্জাল বলা যায়। যাই হোক তুমি কোথায় যাচ্ছ?

আমি রোববানগরীর ভেতরে যেতে চাই।

তোমার কী লাইসেন্স আছে?

না। আমার লাইসেন্স নেই। আমি অনেকদূর থেকে এসেছি। আমি আগে কখনো রোবোনগরীতে যাইনি।

সেটি আমি তোমাকে দেখেই বুঝতে পারছি। তোমার কপোট্রন থেকে এখনো প্রাচীন কোডিং রেডিয়েট করছে।

আমি কী করতে পারি?

তোমাকে আমি সাময়িক একটি লাইসেন্স দিচ্ছি, চব্বিশ ঘণ্টার। এর মাঝে তোমাকে স্থায়ী লাইসেন্স করাতে হবে।

ঠিক আছে।

রোবটটি তার কিছু যন্ত্রপাতিতে চাপ দিতেই ক্রিনিটি তার কপোট্রনে কিছু তথ্যেরে অনুপ্রবেশ টের পেল। সে কপোট্রনটিকে দ্রুত ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে ফেলে। তার কপোট্রনে তথ্য ঢুকে গেলে সমস্যা নেই, কিন্তু কোনোভাবে। সেখান থেকে তথ্য বের করে নিলে তারা নিকির তথ্য জেনে নেবে।

ভয়ংকর দর্শন রোবটটি বলল, যাও। তোমার এই লক্করঝক্কর বাইভার্বালটি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে নিও। আমরা কোডিং দিয়ে দিচ্ছি।

ঠিক আছে। তোমার কাছে কি কোনো ইউনিট আছে?

না নেই।

রোবটটি শীষ দেয়ার মতো শব্দ করে বলল, তাহলে তুমি স্ফূর্তি করবে। কেমন করে। রোববানগরীতে এসেছ ফূর্তি না করে চলে যাবে?

আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার ভেতরে স্ফূর্তি করার মডিউল নেই!

রোবোনগরীতে সস্তায় এই মডিউল লাগানো হচ্ছে। লাগিয়ে নিয়ে স্ফূর্তি করতে পারবে। সত্যি কোনো ইউনিট নেই।

না। তবে—

তবে কী?

আমি একটি মানুষ পরিরারের গৃহস্থালি রোবট হিসেবে কাজ করতাম। সেই পরিরারের অব্যবহৃত কিছু ইউনিট আমার কাছে আছে। খুবই কম।

বল কী? এটি তো সোনার খনি। সোনার খনি?

হ্যাঁ। মানুষের হাতের স্পর্শ পাওয়া ইউনিট রীতিমতো মূল্যবান বস্তু। এর একটি বিক্রি করেই তুমি বড়লোক হয়ে যাবে। মানুষের যে কোনো কিছু খুবই মূল্যবান।

ক্রিনিটি নিজের কপোট্রনে একধরনের চাপ অনুভব করল, সে চাপটি কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর বলল, মানুষের যে কোনো কিছুই মূল্যবান?

হ্যাঁ। মানুষের চুল। নখ। ব্যবহারী কাপড়। এমনকি মানুষের আসল ভিড়িও অনেক ইউনিটে বিক্রি হয়। তোমার কাছে কি কিছু আছে?

আমি গৃহস্থালি রোবট হিসেবে কাজ করেছি, কাজেই আমার কাছে কিছু আছে।

চমৎকার। বিক্রি করে তুমি রাতারাতি ধনী হয়ে যাবে। কপোট্রনের আপগ্রেড করে চারমাত্রায় চলে যেতে পারবে। নতুন পৃথিবী উপভোগ কর।

ক্রিনিটি বলল, আমি চেষ্টা করব।

রোবট দুটি সুইচ টিপে দিতেই ঘরঘর শব্দ করে গেটটা খুলে যায়, ক্রিনিটি তার বাইভার্বালটি নিয়ে রোববানগরীর ভেতর ঢুকল।

রাস্তায় নানা আকারের বাইভার্বাল, আধুনিক এবং স্বয়ংক্রিয়। সেগুলোর তুলনায় তার নিজের বাইভার্বালটি রীতিমতো হাস্যকর একটি যন্ত্র। চতুর্থ মাত্রার কিছু রোবট মাথা ঘুরিয়ে সেটি দেখছে। ক্রিনিটি অনুমান করতে পারে হাসার ক্ষমতা থাকা এই রোবটগুলো নিশ্চয়ই তার বাইভার্বালটিকে দেখে মনে মনে হাসছে।

বাইভার্বালটি নির্দিষ্ট জায়গায় পার্ক করে ক্রিনিটি পেছনে বাক্সের ভেতরে উঁকি দিল, নীচু গলায় ডাকল, নিকি?

নিকি ফিসফিস করে বলল, বল ক্রিনিটি।

তুমি বলেছিলে ঘুমাবে।

ঘুম পাচ্ছে না।

না পেলেও চুপ করে শুয়ে থাক। আমি শহরটা ঘুরে দেখে একটু খোঁজ। খবর নিয়ে চলে আসব।

ঠিক আছে।

ক্রিনিটি এদিক সেদিক তাকায়, তার ইলেকট্রনিক সিগন্যাল বিস্তৃত করে। আশপাশে কেউ তাদের লক্ষ করছে না বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর সে হাঁটতে থাকে। দুটো রাস্তা পরেই দেখা যায় সেখানে বিশাল উত্তেজনা। উজ্জ্বল আলো এবং নানা আকারের রোবোটের অনেক ভিড়। তাদের হইচই চেঁচামেচিতে জায়গাটি মুখরিত হয়ে আছে।

ক্রিনিটি সতর্কভাবে হাঁটতে থাকে। সে টের পায় তার কপোট্রনে অনেক তথ্য জোর করে ঢোকার চেষ্টা করছে, বিষয়টিতে সে অভ্যস্ত নয় তাই ফায়ারওয়াল দিয়ে সে নিজের কপোট্রনে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রাখে। আশপাশের ঘরগুলো থেকে তাকে রোবটগুলো ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। সংগীতের একটি দোকান থেকে একট রোবট বলল, এই যে রূপবান! আমার ঘরে এস কিনিস্কির নবম সিম্ফোনি শুনে যাও। আজকে ছাড় দিয়েছি, মাত্র আট ইউনিটে পেয়ে যাবে।

ক্রিনটি বলল, আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। সংগীত উপভোগ করার ক্ষমতা নেই।

তাতে কী আছে। কিনে নিয়ে যাও যখন চতুর্থ মাত্রার কপোট্রন বসবে এখন উপভোগ করবে।

চতুর্থমাত্রার কপেট্রনে আপগ্রেড করার মতো ইউনিট আমার কাছে এখন নেই।

এখন নেই তো কী হয়েছে? ভবিষ্যতে হবে।

ভবিষ্যতে যখন হবে তখন আমি বিবেচনা করব।

সংগীতের দোকানের রোবটটি হতাশার মতো শব্দ করে বলল, এই জন্যে তৃতীয় মাত্রার রোবটকে বলে জংধরা জঞ্জাল।

ক্রিনিটি তাচ্ছিল্যটুকু উপেক্ষা করে এগিয়ে যায়। সামনে একটি ঘরের বাইরে অনেক ধরনের উজ্জ্বল আলো জ্বলছে এবং নিভছে। বাইরে উজ্জ্বল রঙের দুটি রোবট একই সাথে ঠিক একইভাবে তাদের যান্ত্রিক হাত নেড়ে কথা বলছে, এসো, আনন্দের ভুবনে এসো। কপোট্রনে সঠিক তরঙ্গ উপস্থাপনের মাধ্যমে মাদকের আনন্দ। সম্পূর্ণ আইনসিদ্ধ বিনোদন, চলে এসো। চলে এসো সবাই।

অনেক রোবট সেখানে ঢুকছে। ক্রিনিটি কয়েক মুহূর্ত ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল তারপর আবার হাঁটতে শুরু করল।

ভয়ংকর ধরনের কিছু অস্ত্রের দোকান, কোল্ড ফিউসান ব্যাটারির একটি দোকান, তারপর কপোট্রন আপগ্রেডের অনেকগুলো দোকান পার হয়ে ক্রিনিটি আরো এগিয়ে যায়। বাইভার্বালের বড় একটি দোকান সে ঘুরে ঘুরে দেখল, নতুন নতুন ইঞ্জিনগুলো চমকপ্রদ তার বাইভার্বালটি নিয়ে নগররক্ষী রোবটগুলো যে তামাশা করেছে তার একটি কারণ আছে।

বাইভার্বালের দোকান থেকে সে নানাধরনের বিনোদনের আরো কয়েকটি ধর পার হয়ে একটি চিড়িয়াখানা দেখতে পেল অনেক ধরনের পশু সেখানে খা আছে। এরপরে একটি আর্ট গ্যালারি এবং কয়েকটি থিয়েটার। তার ঠিক মুখোমুখি একটি বড় হলঘরের সামনে সে দাঁড়িয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে সে যেটি খুঁজছে ঠিক সেটি পেয়ে গেছে, হলঘরের উপরে নানা রঙের আলোর ঝলকানি, সেখানে বড় বড় করে লেখা, বিস্ময়কর মানবশিশু। দর্শনীয় দশ ইউনিট।

ক্রিনিটি তার পুরানো ইউনিট পরিবর্তন করে অনেকগুলো নতুন ইউনিট পেয়ে গেল। সেখান থেকে দশ ইউনিট ব্যবহার করে সে হলঘরে ঢুকে যায়। ভেতরে আবছা অন্ধকার, অনেকগুলো রোবট সেখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সামনে একটি বড় স্টেজ, সেখানে চতুর্থমাত্রার ছিমছাম একটি রোবট কথা বলছে, বন্ধুগণ পৃথিবীর বিস্ময় হচ্ছে মানব শিশু। তোমাদের সামনে এখনি উপস্থিত হবে সেই বিস্ময়কর মানবশিশু, তোমরা তাকে দেখবে, তার সাথে কথা বলবে, তার গান শুনবে। মাত্র দশ ইউনিটের বিনিময়ে আর কোথাও এই বিনোদন তোমরা খুঁজে পাবে না।

একটি বিচিত্র শব্দ হতে থাকে এবং পেছনের পর্দাটি ধীরে ধীরে সরে গেল, দেখা গেল মঞ্চের মাঝখানে একটি ছোট টুল সেখানে তিন-চার বছরের ছোট একটি শিশু বসে আছে। মঞ্চে তীব্র আলো, সেই আলোতে শিশুটির বড় বড় চোখ খুলে রোবটগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে।

ছিমছাম রোবটটি তার গলায় কৃত্রিম একটি আনন্দের ভান ফুটিয়ে নিয়ে বলল, এই মানব শিশুটির নাম লিশুয়া তার জন্ম দক্ষিণের সমুদ্রতীরে ভাইরাসের কারণে তার পরিরারের সবাই মৃত্যুবরণ করলেও রহস্যময়ভাবে সে। বেঁচে যায়। তাই না লিশুয়া?

লিলুয়া নামের শিশুটি মাথা নাড়ল। ছিমছাম রোবটটি বলল, লিওয়া মানুষের কণ্ঠে কথা বলে শোনাবে—গান গেয়ে শোনাবে। নাচবে, খেলা দেখাবে।

উপস্থিত রোবটগুলোর একজন তখন বলল, হাসি দেখতে চাই। হাসি।

অন্য রোবটগুলো প্রতিধ্বনি করল, বলল, হাসি। হাসি।

ছিমছাম রোবটটি ইতস্তত করে বলল, লিশুয়া একা একা বড় হয়েছে, তাই সে হাসতে ভুলে গেছে। তাই না লিশুয়া?

লিশুয়া মাথা নাড়ল। ছিমছাম রোবটটি বলল, তারপরও সে তোমাদের সামনে হাসার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার আগে সে তোমাদের সাথে কথা বলবে। তোমরা প্রশ্ন কর, লিশুয়া সেই প্রশ্নের উত্তর দেবে। তাইনা লিশুয়া।

লিশুয়া মাথা নাড়ল এবং ক্রিনিটি বুঝতে পারল লিন্ডয়া আসলে সত্যিকারের মানব শিশু নয়। এটি জোড়াতালি দিয়ে মানবশিশুর মতো তৈরি করা একটি নিচু শ্রেণীর রোবট। ক্রিনিটি তখন রোবটদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে যেতে শুরু করে।

ছিমছাম রোবটটি বলল, এই যে! এই যে রূপবান! তুমি চলে যাচ্ছ।

কেন?

ক্রিনিটি বলল, এটি সত্যিকার মানবশিশু নয়।

তুমি কেমন করে জান?

আমি জানি। কারণ আমি একটি গৃহস্থালি রোবট। আমি মানব শিশু দেখেছি।

ছিমছাম রোবটটি বলল, অন্তত লিশুয়ার একটি গান শুনে যাও।

সত্যিকারের মানব শিশু হলে নিশ্চয়ই শুনতাম।

মাত্র দশ ইউনিটে সত্যিকারের মানব শিশুর গান শোনা যায় না।

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি রোবট বলল, লক্ষ ইউনিটেও তুমি সত্যিকারের মানব শিশুর গান শুনতে পারবে না। তার কারণ পৃথিবীতে কোনো মানব শিশু নেই।

জরাজীর্ণ একটি রোবট নিচু গলায় বলল, আছে।

তার কথায় অন্য রোবটেরা কোনো গুরুত্ব দিল না, শুধু ক্রিনিটি রোবটটির দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, কোথায় আছে?

জাতীয় গবেষণাগারে। একটি মেয়ে শিশু আছে।

তুমি কেমন করে জান?

জরাজীর্ণ রোবট টি আরো নীচু গলায় বলল, আমি কেমন করে জানি তুমি কেন সেটি জানতে চাইছ?

ক্রিনিটি বলল, আমি তৃতীয় মাত্রার রোবট। আমার বুদ্ধিমত্তা নিম্নস্তরের। আমি নিজে থেকে একটি তথ্যের সত্য মিথ্যা বুঝতে পারি না। আমাকে যাচাই বাছাই করতে হয়।

রোবটটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ক্রিনিটির দিকে তাকাল। ক্রিনিটি বুঝতে পারল সেটি তার কপোট্রনে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে। ক্রিনিটি ফায়ারওয়ালটি উজ্জীবিত করে রেখে তাকে তার কপোট্রনের ভেতর ঢুকতে দিল না।

রোবটটি এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ করে বলল, যে নিজের কপোট্রনকে ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে রাখে আমি তাকে বিশ্বাস করি না। তুমি নিশ্চয়ই নিরাপত্তা বাহিনীর একজন গুপ্তচর।

ক্রিনিটি বলল, না। আমি গুপ্তচর না।

জরাজীর্ণ রোবটটি গলা উঁচিয়ে বলল, গুপ্তচর। গুপ্তচর।

হঠাৎ করে রোবটদের মাজে একটি হল্লা শুরু হয়ে গেল। মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা ছিমছাম রোবটটা হাত তুলে বলল, থাম। সবাই থাম। কী হয়েছে এখানে?

নিরাপত্তা বাহিনীর একটি গুপ্তচর এখানে ঢুকে গেছে।

ক্রিনিটি বলল, না। আমি গুপ্তচর না।

তাহলে তোমার কপোট্রন ফায়ারওয়াল দিয়ে ঢেকে রেখেছ কেন?

আমি আমার তথ্য সবাইকে দিতে চাই না।

রোবটগুলো আবার হল্লা করতে শুরু করল। মঞ্চে দাঁড়ানো ছিমছাম রোবটটি বলল, চুপ কর। তোমরা সবাই চুপ কর। তা না হলে আমি জ্যামার সিগন্যাল দিয়ে সবার কপোট্রন জ্যাম করে দেব।

কিছু কিছু রোবট তখন একটু শান্ত হয়। ক্রিনিটি রোবটদের ভিড় ঠেলে বের হয়ে যেতে থাকে। জরাজীর্ণ রোবটটি বলল, তুমি কেনো চলে যাচ্ছ?

এখানে থাকার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি সত্যিকার মানব শিশু খুঁজছি। এটি সত্যিকার মানবশিশু নয়।

তুমি সত্যিকার মানবশিশু দিয়ে কী করবে?

আমি গৃহস্থালি রোবট। আমি সবসময় সত্যিকার মানব এবং সত্যিকারে মানব শিশুর সাথে কাজ করেছি। কৃত্রিম মানব এবং কৃত্রিম মানবশিশুতে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

বুঝতে পেরেছি।

কী বুঝতে পেরেছ?

তোমার কপোট্রনে মানব শিশু নিয়ে অনেক তথ্য আছে। সে জন্যে তুমি তোমার কপোট্রন ফায়ার ওয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছে।

ক্রিনিটি তার কপোট্রনে প্রবল একধরনের চাপ অনুভব করে, কিন্তু জরাজীর্ণ রোবটের পরের কথায় তার চাপ দ্রুত কমে আসে। জরাজীর্ণ রোবটটি বলল, আমি এখন বুঝতে পেরেছি তুমি কেন তোমার কপোট্রনটি ফায়ারওয়াল দিয়ে আড়াল করে রেখেছ। সত্যিকারের মানবশিশুর তথ্য অনেক। ইউনিটে বিক্রি হয়। এই তথ্যগুলোকে সবাইকে জানতে দিও না।

ক্রিনিটি বলল, দেব না।

দেখে শুনে বিক্রি করো।

করব।

তৃতীয় মাত্রার রোবটটি হিসেবে তোমার বুদ্ধিমত্তা খারাপ নয়। কিছু ইউনিট পেলে কপোট্রনটি চারমাত্রায় আপগ্রেড করে নিও।

করে নেব।

ভালো কোম্পানি থেকে কপোট্রন কিনবে। কপো-কট কোম্পানিটা ভালো। রক্ষণাবেক্ষণের ভালো প্যাকেজ আছে।

ঠিক আছে।

জরাজীর্ণ রোবটটা উপদেশ দিয়ে আরো কিছু একটি বলতে যাচ্ছিল, ক্রিনিটি তার আগেই জিজ্ঞেস করল, তুমি বলেছ জাতীয় গবেষণাগারে একটি মেয়ে শিশু আছে।

হ্যাঁ বলেছি।

জাতীয় গবেষণাগারটি কোথায়?

নতুন রোবনগরী ইস্পনাতে।

সেটি কোথায়?

বেশি দূরে নয়, এখান থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার পশ্চিমে। নেটওয়ার্কে ইস্পনার অবস্থান দেয়া আছে। বাইভার্বালে কো অর্ডিনেট ঢুকিয়ে নিও।

চুকিয়ে নেব।

জরাজীর্ণ রোবটটি আরো কিছু একটি বলতে চাইছিল কিন্তু ঠিক তখন মঞ্চের কৃত্রিম মানবশিশুটি তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে হাত-পা নেড়ে তীক্ষ্ণ গলায় গান গাইতে শুরু করে। ক্রিনিটির সংগীত অনুভব করার ক্ষমতা নেই। তাই সে বুঝতে পারল না সেটি ভালো না খারাপ। সে অবশ্যি তার চেষ্টাও করল না, রোবটদের ভীড় ঠেলে বের হয়ে এলো।

রোবনগরীর রাজপথ ধরে হেঁটে হেঁটে ক্রিনিটি তার বাইভার্বালের কাছে ফিরে এলো। জায়গাটি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং নিরিবিলি। ক্রিনিটি এদিক সেদিক তাকিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে নিল আশে পাশে কেউ নেই তখন সে বাই ভার্বালের পেছনে গিয়ে ছোট বাক্সটি সাবধানে খুলে উঁকি দেয়, সেখানে নিকির ঘুমিয়ে থাকার কথা। কিন্তু ভেতরে কেউ নেই।

ক্রিনিটি তৃতীয় মাত্রার রোবট তার বিচলিত অথবা আতংকিত হওয়ার ক্ষমতা নেই। তাই সে বিচলিত অথবা আতংকিত হল না। বাইভার্বালের সামনে লাগানো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি খুলে নিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে রেখে বিড়বিড় করে বলল, এখন মনে হচ্ছে অস্ত্র নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটি সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।