০৩. কন্ট্রোল রুমে উঁকি দিয়ে

কন্ট্রোল রুমে উঁকি দিয়েই য়ুহী ক্যাপ্টেন ক্রবকে দেখতে পেল। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে মহাকাশযানের সব কয়জন ক্রুয়ের ত্রিমাত্রিক ছবি তাকে দেখানো হয়েছে কিন্তু য়ুহার কারো চেহারাই মনে নেই। মহাকাশযানের ক্যাপ্টেনের কাধে একটা লাল তারা থাকে সেটা তার মনে আছে, কাজেই কন্ট্রোল রুমের মধ্যবয়সী মানুষটা নিশ্চয়ই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন, তার কাঁধে একটা লাল তারা জ্বল জ্বল করছে।

য়ুহা কন্ট্রোল রুমে ঢুকে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের সামনে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ক্ৰবের সামনে একটা হলোগ্রাফিক প্যানেল, সেখানে কোনো একটা অদৃশ্য সুইচকে সে টানাটানি করছিল। য়ুহাকে দেখে ক্যাপ্টেন ক্ৰব হাত নামিয়ে তার দিকে দুই পা এগিয়ে এলো, তুমি নিশ্চয়ই য়ুহা?

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমি য়ুহা।

কবি য়ুহা?।

য়ুহা একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, অনেকে আমাকে তা-ই বলে।

আমার ত্রিশ বৎসরের জীবনে আগে কখনো এ রকম ঘটনা ঘটেনি। একাডেমি থেকে নির্দেশ দিয়েছে একজন কবিকে নিয়ে যেতে। শুধু তা-ই না, সেই নির্দেশে বলা আছে তোমার সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দেয়ার উপযোগী একটা পরিবেশ তৈরি করে দিতে! খুব একটা মজার কথা বলেছে এ রকম ভাব করে ক্যাপ্টেন ক্রুব হা হা করে হাসতে লাগল।

য়ুহা কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। ক্যাপ্টেন ত্রুব হাসি থামিয়ে বলল, একজন কবির জন্যে সৃজনশীল পরিবেশ কী আমার সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই!

য়ুহা বলল, আসলে আমাদের জন্যে আলাদা কোনো পরিবেশের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো পরিবেশই আমাদের জন্যে সৃজনশীল পরিবেশ।

ভালো। খুব ভালো। শুনে নিশ্চিন্ত হলাম।

আমি কি তোমাদের কোনো কাজে সাহায্য করতে পারি?

তোমার পেছনে যদি আমাদের সময় দিতে না হয় সেটাই হবে আমাদের জন্যে একটা রিরাট সাহায্য।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, দিতে হবে না। আমি প্রশিক্ষণটা খুব ভালোভাবে নিয়েছি। তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না আমাকে এগারো জি তে নিয়ে গিয়েছিল, আমি তবু জ্ঞান হারাইনি।

ভালো, খুব ভালো।

য়ুহা একটু ইতস্তত করে বলল, ক্যাপ্টেন ক্ৰব, আমি কি মহাকাশযানটা ঘুরে দেখতে পারি?

অবশই। ক্যাপ্টেন ক্ৰব একটু চিন্তা করে বলল, তোমার সাথে আমি বরং একজন ক্রুকে দিয়ে দিই, প্রথমবার সে তোমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিক।

ক্যাপ্টেন জব তার যোগাযোগ মডিউলের একটা বোতাম টিপতেই নিঃশব্দে একজন ক্রু এসে হাজির হলো। সোনালি চুলের কমবয়সী একটা মেয়ে, তার মুখে এক ধরনের কাঠিন্য। মেয়েটি কোনো কথা না বলে ঘরের এক কোণায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ত্রুব সরাসরি তার দিকে না তাকিয়ে বলল, ক্লিজা, তুমি য়ুহাকে মহাকাশযানটা একটু ঘুরিয়ে দেখাও।

ক্লিডা বলল, দেখাচ্ছি মহামান্য ক্যাপ্টেন। তারপর ঘুরে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, চল, আমার সাথে।

য়ুহা ক্লিডার সাথে ঘর থেকে বের হতে হতে এফ, আমার নাম য়ুহা।

জানি। আমাদের রেকর্ডে তোমার নাম আছে। তুমি নিশ্চয়ই ক্লিডা। হ, আমি কর্পোরাল ক্লিডা।

তার মানে, আমার তোমাকে কর্পোরাল ক্লিডা বলে সম্বােধন করতে হবে? শুধু ক্রিড়া বললে হবে না?

তুমি যেহেতু আমাদের কমান্ডের নও তুমি যা ইচ্ছে তা-ই ডাকতে পার।

আচ্ছা ক্লিভা, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?

কর।

ক্যাপ্টেন ত্রুব যখন তোমাকে ডাকল, আর তুমি যখন এলে তখন এসে তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে। কোনো কথা বললে না! কারণটা কী?

ক্লিডা এমনভাবে য়ুহার দিকে তাকালো যেন সে খুব একটা বিচিত্র কথা বলেছে, ভুরু কুঁচকে বলল, আমি নিজে থেকে কেন ক্যাপ্টেন ক্ৰকে কিছু জিজ্ঞেস করব? ক্যাপ্টেন ক্ৰব আমাকে ডেকেছে, দেখেছে আমি এসেছি।

তার যখন ইচ্ছে করবে তখন সে কথা বলবে।

কিন্তু আমাকে যদি ডাকত আমি ঘরে গিয়েই জিজ্ঞেস করতাম, ক্যাপ্টেন ক্ৰব! তুমি কি আমাকে ডেকেছ?

তুমি সেটা করতে পার, কারণ তুমি কমান্ডের মাঝে নেই। যারা কমান্ডের মাঝে থাকে তাদের কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়।

এটাই তোমাদের নিয়ম? আমি আসলে সেটাই জানতে চাচ্ছিলাম। হ্যাঁ, এটাই নিয়ম।

যুহ বলল, তুমি কিছু মনে করো না ক্লিড়া তোমার কাছে আমার আরও একটা প্রশ্ন।।

বল, কী প্রশ্ন।

তুমি যখন এলে, ক্যাপ্টেন ক্রব যখন তোমার সাথে বলল তখন সে তোমার দিকে না তাকিয়ে কথা বলেছে। আমরা যখন একজন আরেকজনের সাথে কথা বলি তখন তার দিকে তাকাই। আমার মনে হলো, মনে হলো।

কী মনে হলো?

মনে হলো যেন তোমাকে একটু তাচ্ছিল্য করা হলো।

য়ুহার কথা শুনে ক্লিডা একটু অবাক হয়ে তাকালো, বলল, তাচ্ছিল্য?। মোটেও তাচ্ছিল্য করা হয়নি।

নিশ্চয়ই করেনি কিন্তু আমার মনে হলো।

তোমার মনে হওয়াটা ভুল। আমাদের কমান্ডে একেকজন একেক ধাপে থাকে। যারা নিচের ধাপে থাকে তারা সব সময়েই উপরের ধাপের যে আছে তার আদেশ মেনে চলে। এটা শৃঙ্খলার জন্যে প্রয়োজন, শৃঙ্খলা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার জীবনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। আগে কখনো ছিল না, পরেও থাকবে বলে মনে হয় না।

ক্লিডা মুখ শক্ত করে বলল, শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো বড় কাজ করা যায় না।

য়ুহা বলল, বড় কাজ করার জন্যে সবার জন্মও হয় না। অনেকের জন্ম হয় ছোট কাজ করার জন্যে। ছোট আর তুচ্ছ। কিন্তু খুব প্রয়োজনীয়। সবাই যদি বড় কাজ করে তাহলে কেমন করে হবে?

ক্লিডা একবার য়ুহার দিকে তাকালো কিন্তু কোনো কথা বলল না। য়ুহা গলার স্বর পাল্টে বলল, আমাকে একবার মহাকাশযানটা দেখাও।

কোথা থেকে শুরু করতে চাও? ইঞ্জিন। আমি প্রথমে দেখতে চাই মহাকাশযানের ইঞ্জিন।

বেশ। চল তাহলে ইঞ্জিনঘরে যাই। এই মহাকাশযানের ইঞ্জিন দুটো। দুটোই কুরু ইঞ্জিন। এর জ্বালানি হিসেবে বের করা হয় পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ। নিরাপত্তার দিক দিয়ে এই জ্বালানির কোনো তুলনা নেই। বিশাল একটা মহাকাশযানকে এটা অনির্দিষ্ট সময় দশ জি ত্বরণে রাখতে পারে। মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে একটা ব্ল্যাক হোলের কাছে বিপজ্জনকভাবে গিয়ে বের হওয়ার একমাত্র উদাহরণটুকু এই কুরু ইঞ্জিনের।

ক্লিডা শান্ত গলায় কথা বলতে থাকে, য়ুহা এক ধরনের মুগ্ধ চোখে কথাগুলো শোনে। সে আগে কখনোই এ ধরনের কোনো কথা শোনেনি।

 

খাবার টেবিলে ক্যাপ্টেন ত্রুব য়ুহাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি মহাকাশযানটা দেখেছ?

হ্যাঁ দেখেছি।

তোমার কী মনে হয়, যেতে পারবে আমাদের সাথে?।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, অবশ্যই পারব। চমৎকার একটা মহাকাশযান। দেখে মনে হয় এর প্রত্যেকটা স্কু বুঝি অনেঃ যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে।

সেটা তুমি খুব ভুল বলনি।

আমরা কখন রওনা দেব?

চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে। কার্গো পৌঁছানোর সাথে সাথে।

আমাদের কার্গোটা কী?

য়ুহার কথা শুনে খাবার টেবিলের সবাই এক মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। য়ুহা একটা অবাক হয়ে বলল, আমি কি ভুল কিছু জিজ্ঞেস করে ফেলেছি?

বলতে পার। এটা সামরিক মহাকাশযান। এখানে কেউ নিজে থেকে কিছু জানতে চায় না। যার যেটা জানার দরকার তাকে সেটা জানানো হয়।

য়ুহা মুখে হাসি টেনে বলল, আর আমি যদি জিজ্ঞেস না করেই কিছু একটা জেনে যাই, সেটা কি বেআইনি হবে?

ক্যাপ্টেন ক্ৰব তার পানীয়ের গ্লাসটা স্নায়ু উত্তেজক পানীয় দিয়ে ভরতে ভরতে বলল, না সেটা বেআইনি হবে না। তুমি কি কিছু জেনেছ?

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ জেনেছি।

কী জেনেছ?

এই মহাকাশযানের কার্গো হচ্ছে মানুষ। এগারোজন মানুষ।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব চোখ বড় করে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেমন করে সেটা অনুমান করলে?

ক্লিডা যখন আমাকে মহাকাশযানটি দেখাচ্ছিল তখন শীতলঘরে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে এগারোটা ক্রায়োজেনিক ক্যাপসুল চার্জ করা হচ্ছিল। তার মানে নিশ্চয়ই এগারোজন মানুষকে নেয়া হবে।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব তার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, আর কিছু অনুমান করেছ?

হ্যাঁ করেছি।

কী অনুমান করেছ?

য়ুহা পানীয়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, এই এগারোটা মানুষকে তোমরা নিশ্চয়ই খুব ভয় পাও। তা না হলে তাদের ক্রয়োজেনিক ক্যাপসুলে করে কেন নেবে? আমার মতো যাত্রী হিসেবে নিতে পারতে।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব মাথা নাড়ল, বলল, ভালো অনুমান করেছ য়ুহা।

য়ুহা তার পানীয়টুকু এক চুমুকে শেষ করে দিয়ে বলল, আমি মানুষগুলো দেখার জন্যে খুব আগ্রহী হয়ে আছি।

কেন?

আমার মনে হচ্ছে তাদের মাঝে নিশ্চয়ই রহস্য আছে। আমি একজন কবি, মানুষের চরিত্র, তাদের চরিত্রের রহস্য বুঝতে আমার খুব ভালো লাগে।

 

ঘুম থেকে উঠে য়ুহা আবিষ্কার করল মহাকাশযানের ক্রুদের প্রত্যেকের হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সে একটু অবাক হয়ে একজন ক্রুকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের সবার হাতে অস্ত্র কেন? কিছু কি হয়েছে?

মানুষটি বলল, না, কিছু হয়নি। এটা সামরিক মহাকাশযান, আমরা সামরিক মানুষ। আমাদের হাতে অস্ত্র থাকতে হয়।

কিন্তু গতকাল তো ছিল না।

মহাকাশযানের কাজকর্মে প্রতিমুহূর্ত অস্ত্র রাখতে হয় না। সে জন্যে আমরা রাখি না। আজকে অস্ত্র রাখতে হবে।

য়ুহা কৌতূহলী চোখে বলল, বিপজ্জনক মানুষগুলো আসছে বলে?

বলতে পার।

তোমার অস্ত্রটা একটু দেখাবে?

মানুষটি হেসে ফেলল, বলল, এগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক অস্ত্র। না বুঝে কোনো একটা সুইচ স্পর্শ করে কিংবা একটা লিভার টেনে তুমি এখানে প্রলয়কাণ্ড করে ফেলতে পার! তোমার হাতে অস্ত্র দেয়াটা ঠিক হবে না!

তবে—

তবে কী?

একাডেমি থেকে যে চিঠিটা এসেছে সেই চিঠিতে লেখা আছে তোমার সব কৌতূহলকে সম্মান করতে। তুমি যদি ক্যাপ্টেন ক্ৰবের কাছে আবেদন কর, তোমাকে একটা অস্ত্র দেখানো হতে পারে।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে, আমি তাহলে তা-ই করি। ব্যাপারটা মন্দ হয় না। কী বল? কবির হাতে অস্ত্র!

 

ক্যাপ্টেন ত্রুব য়ুহার কথা শুনে একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি অস্ত্র চালানো শিখতে চাও?

আসলে ঠিক চালানো শিখতে চাই তা নয়। একটা সত্যিকারের অস্ত্র হাতে নিয়ে দেখতে চাই। যদি চালানো না শিখি তোমরা তো অস্ত্র হাতে নিতে দেবে না।

সেটা ঠিক। এই অস্ত্রগুলো খুব বিপজ্জনক। কিন্তু অস্ত্র কেন হাতে নিতে চাও?

য়ুহা একটু ইতস্তত করে বলল, তুমি কিছু মনে করো না ক্যাপ্টেন ক্ৰব–আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে একটা অস্ত্র আসলে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে অশুভ জিনিস। তুমি কি চিন্তা করতে পারে, একটা অস্ত্র তৈরি করা হয়েছে মানুষকে হত্যা করার জন্যে। হত্যা! মানুষ কেন মানুষকে হত্যু! করবে? আর সেই হত্যা করার জিনিসটা মানুষ কেন হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে?

ক্যাপ্টেন ক্রব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস পড়েছ কবি য়ুহা? পুরো ইতিহাসটুকুই হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস-

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। পড়েছি। সেজন্যেই বলছি। আমি তাই এই অশুভ জিনিসটা একবার স্পর্শ করে দেখতে চাই।

বেশ। আমি ব্যবস্থা করে দিই। তোমাকে একটা প্রশিক্ষণ দেব, যদি সেটা নিতে পার তোমাকে একটা অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে দেব।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, না, না, আমি অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে চাই না। আমি শুধু একবার স্পর্শ করতে চাই।

সেটা তোমার ইচ্ছা। কিন্তু একাডেমি থেকে তোমাকে যে অনুমতিপত্র দিয়েছে তাতে তুমি নিজের কাছে একটা অস্ত্র রাখতে পার।

য়ুহা মাথা নাড়ল, না। না। আমি অস্ত্র রাখতে চাই না।

ক্যাপ্টেন ক্রব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, সেটা তোমার ইচ্ছা।

 

যে মানুষটি য়ুহাকে অস্ত্র ব্যবহার করা শেখাল তার নাম হিসান। সে প্রথমে য়ুহাকে মহাকাশযানে রাখা সবগুলো অস্ত্র দেখাল, একজন মানুষ কাঁধে করে আস্ত নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যেতে পারে সেটা য়ুহা জানত না, দেখে সে খুব অবাক হলো। একটা মহাকাশযান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যে অন্য একটা মহাকাশযানকে উড়িয়ে দেয়া যায় সেটাও সে জানত না। সাধারণ অস্ত্রগুলো বেশ হালকা এর ভেতরে ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা চালানোর মতো এত বিস্ফোরক কেমন করে থাকে সেটা একটা রহস্য। হিসান ব্যাপারটা য়ুহাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। রুহা ঠিক ভালো করে বুঝতে পারল না।

য়ুহাকে সে অস্ত্রটি ব্যবহার করতে শেখানো হলো সেটি হালকা এবং দেখতে প্রায় খেলনার মতো। কোনো কিছুকে আঘাত করার আগে সেটাকে লেজার রশ্মি দিয়ে লক করে নিতে হয়। ট্রিগার টানার সাথে সেকেন্ডে দশটি বিস্ফোরক ছুটে যায়। লক্ষ্যবস্তুকে ভেদ করে বিস্ফোরিত হয়, কাজেই এর ধ্বংস ক্ষমতা অসাধারণ। ভুল করে কোথাও চাপ দিয়ে হঠাৎ করে যেন কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে না ফেলে সে জন্যে একাধিক সেফটি লক রয়েছে।

মহাকাশযানের ভেতরেই অস্ত্র চালানোর অনুশীলন ঘর রয়েছে। য়ুহাকে সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে হিসান তার হাতে অস্ত্রটা তুলে দিয়ে বলল, নাও। এখন এটা তোমার অস্ত্র। তুমি যতদিন মহাকাশযানে থাকবে তুমি এটা নিজের কাছে রাখতে পারবে।

না। আমি নিজের কাছে রাখতে চাই না। আমি শুধু একবার এটাকে হাতে নিয়ে দেখতে চাই।

নাও, দেখ।

য়ুহা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে দাঁড়াল। সে এখন ইচ্ছে করলেই একটা মানুষকে খুন করে ফেলতে পারবে চিন্তা করেই তার শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। য়ুহা অস্ত্রটা হাতে নেয়, ট্রিগারে আঙুল রেখে সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে একটা সত্যিকার অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

য়ুহা বুক থেকে নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমি কি জান, এই অস্ত্রটা কি কখনো ব্যবহার করা হয়েছে?

হিসান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ হয়েছিল।

কখন, কীভাবে?

বেশ কয়েকবার। একটা বিদ্রোহ বন্ধ করার জন্যে—

কেউ কি মারা গিয়েছিল?

হ্যাঁ। এই অস্ত্রটি দিয়ে প্রায় সতেরোজনকে মা্রা হয়েছিল। সব রেকর্ড করা থাকে, নতুন করে ব্যবহার করার আগে রেকর্ড মুছে দেয়া হয়।

য়ুহা অস্ত্রটি হাতে নিয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে হাতে একটা অস্ত্র ধরে রেখেছে যেটা দিয়ে সতেরো জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। সতেরোটি প্রাণ! হয়তো সতেরোটি পরিরার। সতেরোজন ভালোবাসার মানুষ। য়ুহার শরীরটা কেমন জানি শিউরে ওঠে, সে প্রায় ছটফট করে অস্ত্রটা হিসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, নাও। রেখে দাও।

এটা তোমার নামে ইস্যু করা হয়েছে। তুমি রাখতে পার।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, না, না, আমি রাখতে চাই না।

একটা অস্ত্র আসলে একজনের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন করে দিতে পারে। যখনই তুমি এটা হাতে নেবে তখনই তুমি অনুভব করবে তুমি একজন ভিন্ন মানুষ। অন্য মানুষ থেকে তোমার ক্ষমতা বেশি। তুমি নিজে ভেতরে এক ধরনের নতুন আত্মবিশ্বাস অনুভব করবে। নতুন ক্ষমতা অনুভব করবে।

য়ুহা আবার মাথা নাড়ল, বলল, না। আমার এই আত্মবিশ্বাসের দরকার নেই। ক্ষমতারও দরকার নেই। যে ক্ষমতার অনুভূতির জন্যে হাতে অস্ত্র নিতে হয় আমার সেই অনুভূতির প্রয়োজন নেই।

হিসান হেসে বলল, আমি ভেবেছিলাম, তুমি একজন কবি। সব রকম অভিজ্ঞতাই তোমার কাছে মূল্যবান।

সেটা সত্যি, সব অভিজ্ঞতাই আমার কাছে মূল্যবান। তবে কিছু অভিজ্ঞতা আমি এগিয়ে গিয়ে গ্রহণ করি, কিছু অভিজ্ঞতা থেকে পালিয়ে চলে আসি। হাতে অস্ত্র রাখাটা সে রকম একটা অভিজ্ঞতা।

কেন?

আমার মনে হয় অস্ত্র খুব বুঝি অশুচি একটা জিনিস। মনে হয় এটা হাতে নিলে আমিও বুঝি অশুচি হয়ে যাব।

হিসান তার নিজের অস্ত্রটি হাতবদল করে খুব অবাক হয়ে য়ুহার দিকে তাকিয়ে রইল।

 

য়ুহা যদিও বলেছিল সে কিছুতেই অস্ত্র হাতে নেবে না কিন্তু দেখা গেল সত্যি সত্যি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সে কার্গো বেতে অপেক্ষা করছে। অন্য কিছু দেখুক আর না-ই দেখুক এগারোজন বন্দীকে তার দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে অস্ত্র ছাড়া কারো সেখানে যাবার কথা নয়।

শেষ পর্যন্ত এগারোজন বন্দী হেঁটে হেঁটে কার্গো বে’তে এসেছে তখন য়ুহা অবাক হয়ে আবিষ্কার করল মানুষগুলো নেহায়েতই নিরীহ ধরনের। কয়েকজন মধ্যবয়স্ক, পোড় খাওয়া চেহারা, অন্যরা কমবয়সী। দু-একজন বয়সে প্রায় কিশোর। চারজন নানা বয়সী মেয়ে, এর মাঝে একজনকে আলাদা করে চোখে পড়ে, চেহারার মাঝে এক ধরনের কমনীয়তা রয়েছে, দেখে মনেই হয় না সে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারে। য়ুহা অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন এবকে জিজ্ঞেস করল, এরা সবাই যোদ্ধা?

হ্যাঁ।

এরা সবাই বিদ্রোহী দলের?

হ্যাঁ।

এরা কোথায় ধরা পড়েছে?

একটা স্কাউটশিপ করে বায়োডোম আক্রমণ করতে এসেছিল। অসাধারণ যুদ্ধ করেছে।

যুদ্ধে কি কেউ মারা গেছে?

হ্যাঁ, অনেকে মারা গেছে। এদের মারা গেছে ছয়জন।

এখন এদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

ক্যাপ্টেন ক্রব য়ুহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, বলার নিয়ম নেই।

নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে নেয়া হচ্ছে। তাই না?

সম্ভবত।

মস্তিষ্ক স্ক্যান করে সব তথ্য বের করা হবে?

সম্ভবত।

এরা আর কখনোই মুক্তি পাবে না?

সম্ভবত না।

য়ুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি কি এদের সাথে কথা বলতে পারি?

ক্যাপ্টেন ত্ৰুব য়ুহার দিকে ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস, তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও?

আমি ঠিক জানি না।

তারা তোমার কথার উত্তর দেবে না। শুধু শুধু চেষ্টা করো না।

তবুও, আমি কি তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে পারি?

ক্যাপ্টেন ক্রুব একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে যাও। কিন্তু মনে রেখো আমি তোমাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম।

য়ুহা তখন বন্দীদের দিকে এগিয়ে গেল। এগারোজন বন্দী কার্গো বে-এর খোলা জায়গাটিতে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, য়ুহী একটু এগিয়ে গিয়ে তাদের উদ্দেশ করে বলল, তোমরা কেমন আছ?

মানুষগুলো খানিকটা অবাক হয়ে য়ুহার দিকে তাকালো, কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। য়ুহা আবার জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ তোমরা?

এবারেও কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। য়ুহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি তোমাদের একটা প্রশ্ন করেছি, তোমরা কেমন আছ?

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ পিচিক করে মেঝেতে থুথু ফেলে বলল, আমাদের বিরক্ত করো না, যদি কিছু করার না থাকে তাহলে জাহান্নামে যাও।

য়ুহার চোখে-মুখে বেদনার একটা ছায়া পড়ল, সে বলল, আমি জানি তোমরা এখন খুব দুঃসময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছ, তার মানে এই নয় যে তোমরা অকারণে রূঢ় হবে।

কমবয়সী একজন ব্যঙ্গ করে বলল, আহা হা! সোনামণি মনে কষ্ট পেয়েছে। আস, আস! কাছে অস, তোমার গালে একটা চুমু দিই।

এবারে বন্দীদের সবাই শব্দ করে আনন্দহীন এক ধরনের হাসি হেসে উঠল। য়ুহা আহত গলায় বলল, তোমরা ঠিক বুঝতে পারছ না। আমরা এবং তোমরা একই মানুষ। তোমাদের জন্যে আমাদের সম্মানবোধ থাকবে ঠিক সে রকম আমাদের জন্যে তোমাদের সম্মানবোধ থাকতে হবে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি এবার গলা উঁচিয়ে বলল, তুমি জাহান্নামে যাও ছেলে। দূর হও এখান থেকে।

রুহা আহত দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল, দেখে মনে হয় তার চোখে পানি এসে যাবে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, ঠিক বলতে পারল না। তখন বন্দীদের ভেতরে কমনীয় চেহারার মেয়েটা বলল, ছেলে, তুমি একটা জিনিস মনে হয় ধরতে পারনি।

য়ুহা বলল, আমার নাম য়ুহা।

য়ুহা। তুমি মনে হয় একটা জিনিস–

আমি আমার নাম বলেছি। তোমারও উচিত তোমার পরিচয় দেওয়া।

আমার নাম রায়ীনা।

তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম রায়ীনা।

মেয়েটা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, য়ুহা, তুমি একটা জিনিস এখনো ধরতে পারিনি। আমরা আর তোমরা এক মানুষ নই। তোমাদের সবার ঘাড়ে একটা করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে। তোমরা আর কিছুক্ষণের মাঝে আমাদের সবাইকে শীতলঘরে ঢুকিয়ে ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নিয়ে একটা জড়বস্তুতে পাল্টে দেবে। আমাদের আর কখনো জাগিয়ে তোলা হবে কি না জানি না। যদি জাগিয়ে তোলাও হয় সেটা কত শত বৎসর পরে হবে আমরা সেটা জানি না। কাজেই এই সময়টুকু আমাদের একান্তই নিজস্ব সময়। আমাদের এটা ব্যবহার করতে দাও। যদি তুমি সত্যিই মনে করো আমাদের সম্মান দেখাবে তাহলে আমাদের একলা থাকতে দাও। বুঝেছ?

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। আমি খুবই দুঃখিত–

রায়ীনা কঠিন গলায় বলল, এই শব্দগুলো তোমরা ব্যবহার করো না। তোমরা পেশাদার সৈনিক, তোমার ঘাড়ে অস্ত্র, তোমাদের ঠান্ডা মাথায় শক্র হত্যা করানো শেখানো হয়। আমরা তোমাদের শত্রু, আমাদের জন্যে তোমাদের কোনো দুঃখবোধ নেই। শুধু শুধু কথাগুলো উচ্চারণ করে আমাদের অপমান করো না।

য়ুহা মৃদু গলায় বলল, আসলে আমি পেশাদার সৈনিক না।

তাহলে তুমি কে?

আমি–আমি–আমি একজন—

কী?

য়ুহা প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারল না, বিড়বিড় করে বলল, না, কিছু না। কেউ না। আমি একজন একজন মানুষ। সাধারণ মানুষ।

 

য়ুহা যখন ক্যাপ্টেন ক্রবের কাছে পৌঁছাল তখন ক্যাপ্টেন ক্রব নরম গলায় বলল, এখন বুঝেছ, আমি কেন তোমাকে ওদের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলাম?

হ্যাঁ, বুঝেছি।

তুমি জগৎটাকে যেমন কল্পনা করো জগন্টা সে রকম না। জগৎটা অনেক কঠিন।

য়ুহা নিচু গলায় বলল, বাইরে। শুধু বাইরে জগৎটা কঠিন। ভেতরে সব এক। নিশ্চয়ই সব এক।