০৫. রুহান তার ঘরের জানলা দিয়ে

রুহান তার ঘরের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। সামনে বিশাল একটি হদ, সেইদকে ঘিরে গাঢ় সবুজ রঙের বনভূমি। দূরে পর্বতমালা, ধীরে ধীরে তার রং হালকা হয়ে মিলিয়ে গেছে। অপূর্ব এই প্রাকৃতিক দৃশ্যের দিকে রুহান বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে থাকে। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানলাটি তাকে প্রতি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিচ্ছে যে সে আসলে চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী। বাইরের এই নৈসর্গিক সৌন্দর্য কোয়ার্টজের জানলা দিয়ে দেখতে পাবে কিন্তু কখনোই তার অংশ হতে পারবে না। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানলা দিয়ে তাকে এই প্রকৃতি থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।

রুহান একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলল এবং ঠিক তখন তার ঘরের ভেতর খুট করে একটা শব্দ হলো। রুহান মাথা ঘুরিয়ে তাকায় এবং দেখতে পায় তার ঘরের দরজা খুলে একজন কমবয়সী মেয়ে ভেতরে ঢুকছে। তার মুখটি শীর্ণ এবং চোখের নিচে কালি। মেয়েটির চুল উষ্কখুষ্ক এবং চোখ দুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল, প্রায় অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো। রুহান একটু অবাক হয়ে মেয়েটির দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শীর্ণ মেয়েটি কোনো কথা না বলে জ্বলজ্বলে চোখে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল।

রুহান একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, তুমি কি আমার কাছে এসেছ?

মেয়েটি রুহানের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফিসফিস করে বলল, ওমেগা ফাংশনের তৃতীয় সংখ্যাটি কত জান?

মেয়েটি কী বলছে রুহান তার কিছুই বুঝতে পারল না, মাথা নেড়ে বলল, না জানি না।

আমার ধারণা কমপ্লেক্স তলে তার কোনো রুট নেই। তোমার কী ধারণা?

আমি বলতে পারব না।

নেই। নিশ্চয় নেই। ওমেগা ফাংশনের সহগের উপর সেটা নির্ভর করার কথা। শীর্ণ মেয়েটি বিড়বিড় করে কিছু একটা বলতে বলতে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে যেতে শুরু করে এবং তখন রুহান হঠাৎ করে শিউরে ওঠে। মেয়েটার মাথার পেছন থেকে একটা ধাতব ইলেকট্রড বের হয়ে আসছে। তার মস্তিষ্কের ভেতর সেটা প্রবেশ করানো রয়েছে।

শীর্ণ মেয়েটি দুই হাত পাশে ঝুলিয়ে একটি বিচিত্র ভঙ্গিতে করিডোর ধরে হটতে শুরু করে। রুহান মেয়েটিকে ডাকবে কী না বুঝতে পারে না। তার পিছু পিছু হেঁটে হেঁটে সে একটা হলঘরে হাজির হলো। সেখানে আরো বেশ কয়েকজন মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এক নজর দেখেই রুহান বুঝতে পারে তাদের সবার মস্তিষ্কে ইলেকট্রড প্রবেশ করিয়ে রাখা আছে। তাদের দৃষ্টি হয় অস্বাভাবিক উজ্জ্বল না হয় উদভ্রান্তের মতো। তারা সবাই বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথা বলছে। দুই-একজনের একটি হাত হঠাৎ হঠাৎ নড়ে উঠছে, মনে হয় সেটার উপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পুরো দৃশ্যটি এত অস্বাভাবিক যে রুহান স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

হলঘরের এক কোনা থেকে হঠাৎ একজন তার কাছে এগিয়ে আসে, ব্যস্ত গলায় বলল, এনেছ? এনেছ তুমি?

তার কী আনার কথা সে জানে না, সেটা নিয়ে সে কোনো প্রশ্ন না তুলে বলল, না আনি নি।

না আনলে কেমন করে হবে? উপাদানগুলোর পরিমাপ সমান হতে হবে। বিস্ফোরকের ক্ষমতা নির্ভর করে তার উপাদানগুলোর উপর। অক্সিজেন সমৃদ্ধ উপাদান। তুমি যদি না আনো- মানুষটি নিজের মনে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে সরে গেল।

রুহান খুব সাবধানে তার বুকের ভেতর থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দেয়। আর একটু হলে সম্ভবত তারও এখানে এভাবে থাকতে হতো। বুদ্ধিমত্তা। পরীক্ষা করার সময় সে যদি প্রশ্নগুলোর উত্তর ইচ্ছে করে ভুল করে না দিত তাহলে কী তার মস্তিষ্কেও এভাবে ইলেকট্রড বসিয়ে দিত না?

কে যেন তার কাঁধে হালকাভাবে স্পর্শ করে। রুহান মাথা ঘুরিয়ে তাকাল, একজন বয়স্ক মানুষ, চুল ধবধবে সাদা, মুখে বয়সের বলিরেখা। মানুষটি নরম গলায় বলল, তুমি কে? তোমার মাথায় তো ইলেকট্রড নেই, তুমি এখানে কী করছ?

রুহান বলল, আমার নাম রুহান। আমি জানি না আমি এখানে কী করছি।

বয়স্ক মানুষটি হেসে বলল, আমরা আসলে কেউই জানি না আমরা কী করছি। আমাদের জন্মাটাই একটা বড় রহস্য।

রুহান কথাটি সহজ অর্থেই বলেছিল, বৃদ্ধ মানুষটি অনেক ব্যাপক অর্থে দার্শনিকভাবে গ্রহণ করেছে।

বৃদ্ধ মানুষটি তার হাত বাড়িয়ে বলল, আমার নাম কিহি। আমি সক্রেটিসদের দেখাশোনা করি।

রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, কাদের দেখাশোনা করো?

কিহি হাত দিয়ে মস্তিষ্কে ইলেকট্রড বসানো চারপাশের অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোকে দেখিয়ে বলল, এই যে এই ছেলে-মেয়েগুলোকে। এদেরকে এখানে সক্রেটিস বলে।

এরাই তাহলে সেই সক্রেটিস! আমি এদের কথা শুনেছি।

হ্যাঁ। একটি অত্যন্ত নিষ্ঠুর রসিকতা। সক্রেটিস খুব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। এই ছেলে-মেয়েগুলোর মস্তিষ্কে যখন এই ইলেকট্রড দিয়ে ইম্পালস দেয়া হয় তখন এরাও কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞানী হয়ে যায়। সে জন্যে এদেরকে বলে সক্রেটিস।

এদের সবাইকে দেখে মনে হয় এরা অপ্রকৃতস্থ।

হ্যাঁ। এরা অপ্রকৃতস্থ। যখন মস্তিষ্কে ইম্পালস দেয়া হয় তখন এরা কিছুক্ষণের জন্যে স্বাভাবিক হয়। তখন তারা কোনো কোনো বিষয়ে অনেক বড় বিশেষজ্ঞ হয়ে যায়। তারা তখন অনেক বড় বড় সমস্যা সমাধান করতে পারে।

কিন্তু এমনিতে এরা অপ্রকৃতস্থ।

হ্যাঁ, এমনিতে এরা অপ্রকৃতস্থ।

রুহান একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এটি একটি অত্যন্ত বড় ধরনের নিষ্ঠুরতা।

হ্যাঁ। এটি অত্যন্ত বড় একটি নিষ্ঠুরতা।

রুহান কিহির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যদি জান এটি এক ধরনের নিষ্ঠুরতা তাহলে তুমি কেন এ ধরনের কাজ করো? কেন ছেড়েছুড়ে চলে যাও না?

কিহি একটু হাসার চেষ্টা করল কিন্তু সেই হাসিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হলো না। নিচু গলায় বলল, পারলে চলে যেতাম। নিশ্চয় চলে যেতাম। কিন্তু পারছি না।

কেন পারছ না?

যারা আমাকে ধরে এনেছে তারা কী কখনো আমাকে যেতে দেবে?

রুহান ভালো করে কিহির দিকে তাকাল, সে বুঝতে পারে নি এই বৃদ্ধ মানুষটাও তাদের মতো একজন ধরে আনা বন্দী মানুষ। রুহান থতমত খেয়ে বলল, আমি দুঃখিত কিহি। আমি বুঝতে পারি নি। আমি ভেবেছিলাম এখানে বুঝি শুধু কমবয়সী তরুণদের ধরে আনে। আমি ভেবেছিলাম তুমি বুঝি ওদের একজন।

কিহি মাথা নেড়ে বলল, না। আমি ওদের একজন নই। হাত দিয়ে চারপাশের অপ্রকৃতস্থ ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখিয়ে বলল, আমি এদের একজন। এই দুর্ভাগা ছেলে-মেয়েগুলোর দেখাশোনা করি। এদের মতো অসহায় পৃথিবীতে আর একজনও নেই। যতদিন এখানে থাকে আমি তাদের খানিকটা মমতা দিই, ভালোবাসা দিই। অপ্রকৃতস্থ হলেও তারা ভালোবাসা বুঝে। এখন কী মনে হয় জান?

কী?

আমাকে যদি এখন ছেড়েও দেয়। আমি সম্ভবত ওদের ছেড়ে চলে যেতে পারব না।

রুহান কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কিহি অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ অপ্রকৃতস্থ ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার মাথা ঘুরিয়ে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে যারা আসে তাদের সবার মাথাতেই ইলেকট্রড বসানো থাকে। তুমি অন্যরকম, এখানে তোমাকে কেন এনেছে?

রুহান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমার মাথায় ইলেকট্রড নেই–মনে হয় সরাসরি বুলেট বসাবে!

কেন? এরকম কথা কেন বলছ?

আমি একজন খেলোয়াড়।

বৃদ্ধ কিহি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল, খেলোয়াড়? মানুষকে গুলি করার যে খেলা সেই খেলার খেলোয়াড়?

হ্যাঁ। আমাকে ট্রেনিং দেবার জন্যে এনেছে।

কিহি কিছুক্ষণ রুহানের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর নিচু গলায় বলল, আমি জানি না কে বেশি দুর্ভাগা। তুমি নাকি এই সক্রেটিসের সন্তানেরা।

ঠিক এরকম সময় হলঘরের এক কোনায় দুজন উচ্চস্বরে কথা কাটাকাটি শুরু করে দেয়, অন্যেরা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না। কিহি এগিয়ে যায়, শান্ত গলায় বলে, কী হলো? তোমরা দুজন আবার কী নিয়ে ঝগড়া শুরু করলে?

যে দুজন চেচামেচি করছিল তারা প্রায় সাথে সাথে কিহির দিকে তাকিয়ে অপরাধীর মতো একটু হাসার চেষ্টা করে চুপ করে গেল। কিহি ঠিকই বলেছে। এই মানুষগুলো অপ্রকৃতস্থ কিন্তু তারপরেও তারা কিহির মমতাটুকু অনুভব করতে পারে।

রুহান বলল, এরা তোমাকে খুব ভালোবাসে।

হ্যাঁ। কিহি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মাথায় যখন ইলেকট্রড বসায় তখন মস্তিষ্কের কোথায় কী ক্ষতি হয় কে জানে কিন্তু এরা একেবারে শিশুর মতো হয়ে যায়।

ঠিক তখন কোথায় জানি ঘটাং করে একটা শব্দ হলো এবং ঘরঘর শব্দ করে কাছাকাছি একটা দেয়াল সরে যেতে শুরু করল। ঘরের ভেতরে অপ্রকৃতস্থ মানুষগুলোর মধ্যে হঠাৎ কেমন যেন একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, সবাই হুঁটোপুটি করে বড় হলঘরটার এক কোনে গিয়ে একজন আরেকজনকে ধরে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার খোলা অংশটা দিয়ে চারজন মানুষ এসে ঢুকল। তাদের গায়ে নীল রঙের জাম্পস্যুট। ছোট করে ছাটা চুলের একজন মহিলার হাতে একটা ছোট ব্যাগ, সেখান থেকে কিছু যন্ত্রপাতি উঁকি দিচ্ছে। একজন মধ্যবয়স্ক ছোটখাটো মানুষ অন্য দুজন বিশাল দেহী।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি কিহির দিকে তাকিয়ে বলল, কী খবর বুড়ো। তোমার জ্ঞানী শিশুরা কেমন আছে?

কিহি কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মানুষটা হাসি হাসি মুখে বলল, আমাদের দেখে ইঁদুরের ছানার মতো এক কোনায় কেমন জড়ো হয়েছে দেখেছ?

কিহি এবারেও কোনো কথা বলল না।

যন্ত্রপাতির ব্যাগ হাতে ছোট করে ছাটা চুলের মেয়েটি বলল, স্টিমুলেশন দেবার পর এরাই আবার কেমন গুছিয়ে কথা বলতে থাকে! দেখে বিশ্বাস হয় না।

কিহি জিজ্ঞেস করল, কাউকে নেবে?

হ্যাঁ।

কাকে?

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ তার ক্রিস্টাল রিডারটা দেখে বলল, ক্রানাকে।

দূরে জড়াজড়ি করে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর মধ্যে একটা মেয়ে হঠাৎ আতঙ্কের একটা শব্দ করে নিজের মুখ-ঢেকে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। রুহান চিনতে পারল, কিছুক্ষণ আগে এই মেয়েটিই তার ঘরে ঢুকে গিয়েছিল।

মেয়েটির আকুল হয়ে কান্না শুনে নীল জাম্পস্যুট পরা মানুষগুলো এক ধরনের কৌতুক অনুভব করে। তারা নিজেরা একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে হাসতে শুরু করে।

রুহান বলল, এর ভেতরে তোমরা হাসার মতো কী খুঁজে পেলে।

রুহানের কথা শুনে মানুষগুলো কেমন যেন অবাক হয়ে তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। মধ্যবয়স্ক মানুষটা অবাক হয়ে বলল, তুমি কে?

রুহান বলল, আমি এখানে নিজ থেকে আসি নি। তোমরা আমাকে ধরে এনেছ। তোমরা বলো আমি কে?

মানুষটার মুখ পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। থমথমে গলায় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটি বলল, এর নাম রুহান। রুহান আমাদের নতুন খেলোয়াড়।

খে-খেলোয়াড়? মধ্যবয়স্ক মানুষটার পাথরের মতো কঠিন মুখটা দেখতে দেখতে কেমন জানি নরম হয়ে যায়। মুখে একধরনের বিস্ময়ের ভাব ফুটে ওঠে, বিগলিত ভঙ্গিতে বলে, তুমি খেলোয়াড়?

রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমি সেটা শুনেছি। এখনো জানি না।

তোমাকে আমাদের সবার পক্ষ থেকে অভিনন্দন। আমাদের এই ট্রেনিং সেন্টার তোমাকে নিশ্চয়ই একেবারে প্রথম শ্রেণীর একটা খেলোয়াড় বানিয়ে দেবে।

মানুষটির কথার সাথে সাথে অন্যেরাও কেমন জানি বিগলিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে।

রুহান বলল, তোমরা এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। কোন প্রশ্ন?

রুহান নিচু গলায় বলল, তোমাদের দেখে ও তোমাদের কথা শুনে মেয়েটি ভয় পেয়ে কাঁদছে। এর মধ্যে কোন অংশটুকু হাসির?

মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখে অপমানের একটা সূক্ষ্ম ছাপ পড়ল। সে হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভান করে বলল, তুমি সেটা এখন বুঝবে না। এখানে কিছুদিন থাক তাহলে নিজেই বুঝতে পারবে।

রুহান মাথা নেড়ে বলল, মনে হয় না।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা কাঁধ ঝাঁকিয়ে সামনে এগিয়ে যায়, জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে ক্রানা কে?।

আকুল হয়ে কাঁদতে থাকা মেয়েটা আরো জোরে ড়ুকরে কেঁদে উঠল। মানুষটা বলল, তুমি?

মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়ল।

এসো তাহলে। চলে এসো।

মেয়েটা মাথা নাড়ল, সে আসবে না।

না এলে চলবে না। মধ্যবয়স্ক মানুষটার কণ্ঠস্বর কঠোর হয়ে ওঠে, এসো।

মেয়েটা মাথা নেড়ে বলল, না।

মানুষটা এবার পিছনে তাকাল, বিশাল দেহী দুজন মানুষ এবারে এগিয়ে যায়। ক্রানা নামের মেয়েটিকে দুইজন দুই পাশ থেকে ধরে ফেলে তারপর প্রায় শূন্যে তুলে সরিয়ে নিয়ে আসে। ক্রানা হাত পা ছুড়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে কিন্তু সেই কান্নায় মানুষগুলো এতটুকু বিচলিত হয় না।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা কিহির দিকে তাকিয়ে বলল, বুড়ো তুমি আস আমাদের সাথে।

কিহি কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল। রুহান জিজ্ঞেস করল, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে মেয়েটিকে?

সিস্টেম লোড করার জন্যে। ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটা বলল, ক্রিভন থেকে একটা অর্ডার এসেছে। ক্রিভন অনেক বড় যুদ্ধবাজ মানুষ। সে একটা যুদ্ধের এক্সপার্ট কিনতে চায়।

রুহান অবাক হয়ে বলল, এই বাচ্চা মেয়েটা যুদ্ধে এক্সপার্ট?

মহিলাটি হেসে বলল, আমরা যখন সিস্টেম ললাড করে দেব সে এক্সপার্ট হয়ে যাবে। এমনিতে কেউ বুঝবে না কিন্তু যখন স্টিমুলেশন দেবে তখন। বুঝবে।

কেমন করে স্টিমুলেশন দেয়?

মাথার পিছনে ইলেকট্রড লাগানো আছে সেখানে হাই ফ্ৰিকয়েন্সী পালস পাঠাতে হয়।

রুহানের শরীর কেমন যেন গুলিয়ে আসে, সে এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তার বিশ্বাস হতে চায় না একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষ এভাবে ব্যবহার করতে পারে।

মহিলাটি রুহানের বিস্ময়টি ধরতে পারল না, বেশ সহজ গলায় বলল, তুমি দেখতে চাও আমরা কেমন করে সিস্টেম লোড করি?

রুহানের একবার মনে হলো বলে না, সে দেখতে চায় না। কিন্তু কী হলো কে জানে, সে বলল, হ্যাঁ দেখতে চাই।

তাহলে এসো আমাদের সাথে।

পাহাড়ের মতো দুজন মানুষ ক্রানা নামের মেয়েটাকে প্রায় টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, তার পিছু পিছু অন্যেরা হাঁটতে থাকে। রুহান সবার পিছনে পিছনে হেঁটে আসে। সে নিজের ভেতরে কেমন জানি গভীর এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করে।

মাঝারি আকারের একটা ঘরের ঠিক মাঝখানে উঁচু একটা শক্ত টেবিলে ক্রানাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হলো। তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কিছু মনিটর লাগানো হয়েছে। ঘরের এক কোনায় বড় একটা যন্ত্রপাতির প্যানেল সেখানে ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটি যন্ত্রপাতিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মধ্যবয়স্ক মানুষটি। বিশালদেহী মানুষ দুজন দরজার কাছে দুটি টুলে চুপচাপ বসে আছে, তাদের মুখ ভাবলেশহীন, দেখে মনে হয় তাদের চারপাশে কী ঘটছে সেটা তারা জানে না।

কিহি ক্রানার হাত ধরে রেখে ফিসফিস করে তার সাথে কথা বলছে, তাকে শান্তনা দিচ্ছে সাহস দিচ্ছে। ক্রানার চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতস্থ, এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে সে উপরের দিকে তাকিয় আছে।

রুহান কিছুক্ষণ ক্ৰানার দিকে তাকিয়ে রইল, দৃশ্যটি তার কাছে অত্যন্ত নিষ্ঠুর বলে মনে হলো, সে হেঁটে ঘরের এক কোনায় বসানো যন্ত্রপাতিগুলোর কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ছোট করে চুল ছাটা মহিলাটি দক্ষ হাতে বিভিন্ন যন্ত্রপাতিগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, বিজ্ঞান অনেকদূর এগিয়েছিল। আমাদের কপাল খারাপ–পৃথিবীতে এরকম দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে গেল তা না হলে বিজ্ঞান নিশ্চয়ই আরো এগোত।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, উঁহু। প্রকৃতি বাড়াবাড়ি সহ্য করো না। মানুষ বিজ্ঞান নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিল তাই প্রকৃতি এটা বন্ধ করে দিয়েছে।

রুহান একটু অবাক হয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটির মুখের দিকে তাকাল, সে কী সত্যিই এটা বিশ্বাস করে?

মহিলাটি কয়েকটা সুইচ অন করে বলল, আমাদের এই যন্ত্রটা আছে বলে সক্রেটিসদের মাথায় সিস্টেম লোড করতে পারছি। ওদের বিক্রি করে কিছু ইউনিট কামাই করছি। যাদের নেই তারা কী করবে?

মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, তারা আঙুল চুষবে। তারপর হা হা করে হাসতে লাগল যেন খুব বড় একটা রসিকতা করে ফেলেছে।

মহিলাটি মাথা তুলে চারদিকে তাকিয়ে বলল, সবাই রেডি? আমি তাহলে কাজ শুরু করি?

রুহান জিজ্ঞেস করল, এখন কী করবে?

মহিলাটি প্যানেলের একটা স্বচ্ছ খুপরিতে উজ্জ্বল একটা ক্রিস্টাল দেখিয়ে বলল, এই যে এই ক্রিস্টালটাতে পুরো সিস্টেম আছে। আমি ক্রানার ইলেকট্রডের ভিতর দিয়ে এটা মাথার ভেতরে পাঠাব।

তখন কী হবে?

মাথায় নতুন সিনান্স কানেকশন হবে-দরকার হলে তার পুরানো কানেকশন খুলে নেবে।

তাহলে কী হয়?

বলতে পার এই মেয়েটা একটা নতুন মানুষ হয়ে যাবে–আসলে ঠিক মানুষ না। একটা নতুন যন্ত্র।

রুহান বুকের ভেতর নিঃশ্বাস আটকে রেখে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। কী অবলীলায় কী ভয়ঙ্কর একটা কথা বলে দিল।

মহিলাটি একটা সুইচ টিপে দিতেই ঘরের মাঝখানে টেবিলে বেঁধে রাখা ক্ৰানার দেহটা ধনুকের মতো বেঁকে যায়, সে রক্ত শীতল করা কণ্ঠস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে।

রুহান ক্রানার কাছে ছুটে গিয়ে বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় তার শরীর দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে, চোখ দুটো মনে হচ্ছে কোঠর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসবে।

রুহান আর্তস্বরে চিৎকার করে বলল, বন্ধ করো। বন্ধ করো এক্ষুনি!

ছোট করে ছাটা চুলের মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, বন্ধ করব? কী বন্ধ করব?

যেটা করছ সেটা। দেখছ না মেয়েটা যন্ত্রণায় কী করছে?

মহিলাটি মধ্যবয়স্ক মানুষটির দিকে একবার তাকাল তারপর খানিকটা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, যন্ত্রণা ছাড়া মানুষ সিস্টেম লোড করবে কেমন করে? তোমাকে বলেছি না সিনান্স কানেকশান উপড়ে ফেলা হচ্ছে

কতক্ষণ থাকবে এরকম?

এই তো কিছুক্ষণ। ধৈর্য ধরো দেখবে ঠিক হয়ে যাবে।

রুহান আবার ক্রানার কাছে ফিরে গেল, কিহি তার দুই হাত শক্ত করে ধরে তার সাথে নিচু গলায় কথা বলছে, ক্রানা, সোনামণি আমার। একটু ধৈর্য ধরো, একটুখানি সহ্য করো, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই যে দেখ আমি তোমার পাশে আছি, তোমার দিকে তাকিয়ে আছি, তোমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছি। এই দেখ আমি ঈশ্বরের কাছে তোমার জন্যে প্রার্থনা করছি–যেন তোমার সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। ক্রানা সোনামণি আমার

রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল এবং দেখতে পেল খুব ধীরে ধীরে ক্রানার শরীর দুমড়ে মুচড়ে উঠতে উঠতে এক সময় শান্ত হয়ে আসে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সে মুখ হা করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে চোখ খুলে তাকাল। কিহি ক্ৰানার মুখের কাছাকাছি নিজের মুখটি নিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, এখন তোমার কেমন লাগছে ক্ৰানা।

ক্রানা শান্ত দৃষ্টিতে কিহির দিকে তাকিয়ে থেকে নিচু গলায় বলল, আমার ভালো খারাপ কিছুই লাগছে না। সত্যি কথা বলতে কী আমার কোনোরকম অস্তিত্ব আছে বলেই মনে হচ্ছে না।

রুহান একটু অবাক হয়ে ক্ৰানার দিকে তাকাল, মেয়েটি খানিকক্ষণ আগেই পুরোপুরি অপ্রকৃতস্থ ছিল অথচ এখন একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো কথা বলছে। কিহি কানার হাত স্পর্শ করে বলল, তুমি আমাকে চিনতে পারছ ক্ৰানা।

হ্যাঁ। অবশ্যই চিনতে পারছি। তুমি হচ্ছ কিহি। আমাদের সবার প্রিয় কিহি। তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি কে? তাকে দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে।

এ হচ্ছে রুহান।

ক্ৰানা ফিসফিস করে বলল, রুহান রুহান!

ঘরের কোনায় যন্ত্রপাতির প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট করে ছাটা চুলের মেয়েটি গলা উঁচিয়ে ডাকল, বুড়ো।

কিহি মনে হয় এই অবহেলার ডাকটিতে অভ্যস্ত, বেশ সহজভাবেই বলল, বলো।

তুমি কিছুক্ষণ মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারবে? যেন সে সজাগ থাকে?

পারব।

চমৎকার! আমরা তার অবচেতন মনে কাজ করছি।

ঠিক আছে। বলে কিহি আবার ক্রানার উপর ঝুঁকে পড়ল। বলল, তোমার সব কথা মনে আছে কানা?

ক্ৰানা মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। মনে আছে।

তুমি এখন আমাকে চিনতে পারছ ক্ৰানা?

হ্যাঁ। চিনতে পারছি। তুমি কিহি। আমাদের সবার খুব প্রিয় একজন মানুষ তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুহান।

তুমি কী আমার সব কথা বিশ্বাস করবে ক্ৰানা?

করব। নিশ্চয়ই করব।

তাহলে শোন। আমাদের মনে যে দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ-বেদনা হয় সেগুলো হচ্ছে মস্তিষ্কের ভেতরের বিশেষ এক ধরনের পরিস্থিতি।

ক্ৰানা নামের মেয়েটার মুখে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে, সে বলে, আমি জানি। আমার মস্তিষ্কে এখন এরা কিছু একটা করছে এখন আমি সবকিছু বুঝতে পারি।

কিহি গলা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ। এরা তোমার মস্তিষ্কে এক ধরনের স্টিমুলেশন দিচ্ছে। যখন স্টিমুলেশন বন্ধ করে দেবে তখন তুমি আবার আগের মতো হয়ে যাবে। স্টিমুলেশন থাকতে থাকতে আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই যেটা তুমি সবসময় মনে রাখবে।

কী কথা কিহি? আমরা সবাই তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমরা তোমার সব কথা মনে রাখব।

কিহি কানার হাত ধরে নরম গলায় বলল, দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ-বেদনাযন্ত্রণা-সুখ সবকিছুই যদি মস্তিষ্কের বিশেষ একটা অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে কেন আমরা সেটা নিয়ন্ত্রণ করব না? কেন আমরা আমাদের মস্তিষ্কের পরিস্থিতিকে সবসময় আনন্দ কিংবা সুখের পরিস্থিতি করে রাখব না? তাহলে যখন দুঃখ-কষ্ট আর যন্ত্রণা আসবে সেটাও আমাদের কষ্ট দিতে পারবে না!

ক্ৰানা ফিসফিস করে বলল, সেটা আমরা কেমন করে করব?

কিহি ক্ৰানার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি মনে করে নাও পৃথিবীতে কোনো অশুভ কিছু নেই। মনে করো সবাই ভালো। মনে মনে কল্পনা করো পৃথিবীটা খুব সুন্দর একটা জায়গা। এখানে শুধু আনন্দ আর সুখ। ক্রানা তুমি মনে মনে কল্পনা করো যে তুমি খুব খু-উব সুখী একজন মানুষ। তারপর তুমি মনের ভেতরে সেই সুখটা ধরে রাখ। পারবে না?

ক্ৰানা ধীরে ধীরে তার চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ সেভাবে থাকে। তার মুখে এক ধরনের অপার্থিব হাসি ফুটে ওঠে, দেখে মনে হতে থাকে তার ভেতরে এক ধরনের অলৌকিক শান্তি এসে ভর করেছে। চোখ দুটো বন্ধ করে সে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ কিহি। আমি পারছি। আমার ভেতরে এক ধরনের গভীর শান্তি এসেছে। আমার মনে হচ্ছে আমি সবাইকে ক্ষমা করে দিতে পারব। কারো বিরুদ্ধে আমার আর কোনো ক্ষোভ নেই কিহি। আমার ভেতরে আর কোনো আক্রোশ নেই।

ক্রানার হাতে অল্প চাপ দিয়ে কিহি বলল, চমৎকার! এটা তোমার ভেতর ধরে রাখতে পারবে না?

ক্রানা বলল, আমি জানি না। এখন তো আমার মস্তিষ্কের ভেতর স্টিমুলেশন দিচ্ছে তাই কাজটা খুব সহজ। যখন স্টিমুলেশন থাকবে না তখন কী হবে আমি জানি না।

নিজের উপর বিশ্বাস রাখ ক্ৰানা, তুমি পারবে। তোমার কাজটা আরো সহজ করে দিচ্ছি। কিহি তার ডান হাতটা জানার চোখের সামনে ধরে বলল, এই দেখ আমার হাতে একটা ক্রস আঁকা আছে। যখন তুমি মনে মনে সুখ আর আনন্দ আর গভীর এক ধরনের শান্তি অনুভব করছ তখন তুমি এই ক্রসটির দিকে তাকিয়ে থাক। তোমার মস্তিষ্কে তাহলে এর স্মৃতি রয়ে যাবে। ভবিষ্যতে। যখনই তুমি এই ধরনের একটি ক্রস চিহ্ন দেখবে সাথে সাথে তোমার এই গভীর আনন্দ, সুখ আর শান্তির কথা মনে হবে।

কিন্তু আমি কোথায় দেখব এই ক্রস?

দেখবে। অনেক জায়গায় দেখবে। দুটো গাছের ডাল একটার উপর দিয়ে আরেকটা যাবার সময় ক্রস চিহ্ন তৈরি করে। মানুষ কিছু একটা মনে রাখার জন্যে ক্রস চিহ্ন আঁকে। তোমার দুই হাত যখন তোমার কোলের উপর রাখ একটা হাত অন্য হাতের উপর ক্রস তৈরি করে। মানুষ পায়ের উপর পা রেখে বসে। সেটাও ক্রস। তোমার চারপাশে ক্রস, ক্ৰানা। কাজেই তুমি ভুলবে না। কিছুতেই ভুলবে না।

ঠিক আছে।

তুমি তাহলে আমার হাতের চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাক। বুকের ভেতর গভীর আনন্দ, সুখ আর শান্তি অনুভব করতে করতে তাকিয়ে থাক। প্রিয় ক্রানা আমার, সোনামণি, তোমার জন্যে আমাদের সবার গভীর ভালোবাসা। গভীর গভীর ভালোবাসা। .

রুহান এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে কিহি এবং ক্রানার দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে মনে হতে থাকে সে বুঝি কোনো একটি অলৌকিক জাদুমন্ত্রের প্রক্রিয়া দেখছে। কী গভীর আত্মবিশ্বাস নিয়ে কিহি তার প্রত্যেকটা কথা উচ্চারণ করছে। আর কী সহজেই ক্ৰানা তার প্রত্যেকটা শব্দ বিশ্বাস করছে। ক্রানার মুখে গভীর এক ধরনের প্রশান্তির চিহ্ন, দেখে মনে হয় পৃথিবীর কোনো নীচতা, হীনতা কোন ষড়যন্ত্র, কোনো অন্যায়, কোনো অবিচার তাকে বুঝি আর কোনোদিন স্পর্শ করতে পারবে না।

খুব ধীরে ধীরে একসময় ক্ৰানার চোখ বন্ধ হয়ে আসে। গভীর এক ধরনের ঘুমে সে অচেতন হয়ে পড়ে।

ঘরের এক কোনায় প্যানেলের সামনে বসে থাকা ছোট করে ছাটা চুলের মহিলাটি মুখে এক ধরনের সন্তুষ্টির শব্দ করে বলল, চমৎকার! আরো একটা সক্রেটিস রেডি।

মধ্যবয়স্ক মানুষটা বলল, কোনো ঝামেলা ছাড়া শেষ হলো।

মহিলাটি বলল, হ্যাঁ, এর জন্যে আমাদের বুড়োকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত। সে কত কী আজগুবি কথা বলে আর আমাদের বেকুব সক্রেটিসরা তার সব কথা বিশ্বাস করে বসে থাকে।

কিহি বলল, এগুলো আজগুবি কথা না। আমি যেটা বলি সেটা বিশ্বাস করেই বলি। এটা এক ধরনের সম্মোহন।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। মহিলাটি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বলল, আমাদের সক্রেটিসরা যদি শান্তিতে থাকে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। স্টিমুলেশন দেয়ার সময় ঠিক ঠিক তথ্যগুলো দিতে পারলেই হলো।

পাহাড়ের মতো বড় বড় মানুষগুলো এবার উঠে আসে। ক্রানার অবচেতন দেহটা একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে তারা ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, কিহি ঘুমন্ত ক্রানার মুখমণ্ডল আলতোভাবে স্পর্শ করে ফিসফিস করে বলল, বিদায় ক্ৰানা। সোনামণি আমার।

ক্রানাকে নিয়ে বের হয়ে যাবার পর বৃদ্ধ কিহিকে কেমন যেন অসহায় দেখায়। দেখে মনে হয় কেউ বুঝি তার ভেতর থেকে কিছু একটা উপড়ে নিয়ে চলে গেছে।

রুহান নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল। তার বুকের ভেতর বিষণ্ণতাটুকু আরো গভীরভাবে চেপে বসেছে।