অংশুমান চৌধুরী কাকাবাবুর হাত দুটো ধরে টানতে টানতে নিয়ে এলেন জলাশয়টার ধারে। একটা পাতলা গাছের গায়ে কাকাবাবুকে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে তিনি হাঁফাতে লাগলেন। কাকাবাবুর বেশ বলশালী চেহারা, তাঁকে এতটা টেনে আনতে পরিশ্রম কম হয়নি। পরিশ্রান্ত হলেও অংশুমান চৌধুরী তাঁর মুখোশ পরা মাথাটা নাড়াতে লাগলেন বারবার, তাঁর খুব আনন্দ হয়েছে, এতদিন বাদে তাঁর জীবনের একটা বড় সাধ পূর্ণ হতে চলেছে।
নিজের ব্যাগ থেকে তিনি একটা শক্ত দড়ি বার করে কাকাবাবুকে খুব ভাল করে বাঁধলেন সেই গাছটার সঙ্গে। পকেট থেকে বার করে নিলেন রিভলভারটা।
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে, কিন্তু অংশুমান চৌধুরী তা গ্রাহ্য করলেন না। তিনি উবু হয়ে বসে কাকাবাবুর দুগালে দুটি চড় মেরে বললেন, কী রাজা রায়চৌধুরী, এবার?
কাকাবাবুর যে জ্ঞান নেই, তা যেন উনি ভুলেই গেছেন! কাকাবাবুর মাথাটা ঝুঁকে পড়েছে সামনে, চোখ দুটো যেন আঠা দিয়ে আটকানো। সাধারণ ঘুম হলে মুখখানা এরকম অজ্ঞানের মতো দেখায় না।
অংশুমান চৌধুরী কাকাবাবুর চুলের মুঠি ধরে মাথাটাকে সোজা করে বিড়বিড় করে বললেন, মাথা ভর্তি কালো চুল, অ্যাঁ? খুব গর্ব? এবারে বুঝবে ঠ্যালা! সারা জীবনের মতন ন্যাড়া!
পেছনে একটা শব্দ হতেই অংশুমান চৌধুরী চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভীমু এসেছিস?
একটু দুর থেকে ভীমু উত্তর দিল, হ্যাঁ, স্যার?
ভীমু ঘোড়াটাকে থামিয়েছে খানিকটা দূরে একটা ঝোপের আড়ালে। অংশুমান চৌধুরী মুখোশ পরে আছেন বলে ঘোড়ার গন্ধ পাবেন না ভাগ্যিস! ঘোড়াটার পিঠ থেকে সন্তু আর জোজোকে নামিয়ে, সে ঘোড়াটার পিঠে দুবার আদরের চাপড় মেরে বলল, যাঃ যাঃ! বাড়ি যাঃ!
তারপর সে সন্তু আর জোজোকে টানতে টানতে নিয়ে এল অংশুমান চৌধুরীর কাছে।
অংশুমান চৌধুরী বলল, ঠিক আছে। এবারে তুই একটা কাজ কর তো ভীমু! ওই পুকুরটা থেকে খানিকটা জল এনে রাজা রায়চৌধুরীর মাথায় ঢেলে দে। ওর চুলগুলো ভাল করে ভেজাতে হবে।
ভীমু বলল, বৃষ্টিতেই তো মাথা ভিজে গেছে, স্যার!
অংশুমান চৌধুরী ধমক দিয়ে বললেন, যা বলছি, তাই কর।
ভীমু দুতিনবার আঁজলা ভরে জল এনে কাকাবাবুর মাথা ভিজিয়ে দিতে লাগলেন। অংশুমান চৌধুরী নিজের ব্যাগ থেকে একটা ক্ষুর বার করলেন। বাঁ হাতের তেলোয় ক্ষুরটা ঘষতে ঘষতে মনের আনন্দে হাসতে লাগলেন, হ্যাঃ হ্যাঃ হাঃ করে।
তারপর ক্ষুরটা ভীমুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, দে, এবার ব্যাটার মাথাটা কামিয়ে দে ভাল করে!
ভীমু বলল, আমি! স্যার, আমি তো নাপিতের কাজ জানি না! যদি গলাটা কেটে দিতে বলেন তো…
অংশুমান চৌধুরী প্রচণ্ড জোরে চেঁচিয়ে বললেন, চোপ; তোকে বলেছি না খুনজখমের কথা আমার সামনে উচ্চারণ করবি না! আমি যা বলব, শুধু তা-ই করবি। ভিজে চুল কামিয়ে ফেলা অতি সহজ কাজ, এর জন্য নাপিতের কাজ শিখতে হয় না!
ভীমু ক্ষুরটা হাতে নিয়ে প্রথমেই এক পোঁচে কাকাবাবুর একদিকের ঝুলপি উড়িয়ে দিল। এমন জোরে সে ক্ষুরটা টানল যে খানিকটা রক্ত বেরিয়ে এল কাকাবাবুর কানের গোড়ায়।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, দেখিস ব্যাটা, কানটা উড়িয়ে দিস না! তুই কি একটু আস্তে চালাতে পারিস না। আচ্ছা দে, আমাকেই দে!
ক্ষুরটা ফেরত নিয়ে অংশুমান চৌধুরী কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন। তারপর আবার হেসে বললেন, ভীমু, লোকটার জ্ঞান ফিরিয়ে আনেল আরও মজা হবে, তাই না? চোখ প্যাটপ্যাট করে দেখবে যে ওর মাথার চুল শেষ হয়ে যাচ্ছে, ভুরুও কামিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তারপর ওখানে এমন একটা তেল মাখিয়ে দেব যে জীবনেও আর ওর চুল গজাবে না!
ব্যাগ থেকে একটা স্প্রে বোতল বার করে অংশুমান চৌধুরী বললেন, এইবার দ্যাখ মজা। এই ওষুধ দিলে আধ মিনিটের মধ্যে জেগে উঠবে!
ভাল করে কাকাবাবুর মুখের ওপরে সেই ওষুধ স্প্রে করে দিলেন অংশুমান চৌধুরী।
আধ মিনিট কাটবার আগেই সন্তু উঃ উঃ শব্দ করে উঠল। অংশুমান চৌধুরী পেছন ফিরে বললেন, ওঃ হো! ওদের কথা তো ভুলেই গেসলাম! আমার এই জাগরণী ওষুধ এত স্ট্রং যে ওদের নাকে একটুখানি গেলে ওরাও জেগে উঠবে এক্ষুনি। ওদের হাত পা বাঁধা দরকার। নইলে ঝামেলা করতে পারে। আজকালকার বাচ্চারাও এক বিচ্ছু হয়! তোর কাছে দড়ি আছে?
ভীমু বলল, না তো স্যার! ওদের আবার ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিন না?
সেইটাই তো মুশকিল রে! একবার জাগরণ ওষুধ দিয়ে জাগালে আর সহজে ঘুম পাড়ানো যায় না। এটা বেশি স্ট্রং! ঠিক আছে তুই এক কাজ কর, রিভলভারটা হাতে ধরে থাক। ওরা জেগে উঠলে ভয় দেখাবি।
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে চোখ মেলে অংশুমান চৌধুরীর মুখোশ-পরা মুখটা দেখে একটু চমকে উঠে বললেন, কী ব্যাপার?
অংশুমান চৌধুরী থিয়েটারি কায়দায় প্রথমে হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ করে একটা হাসি দিলেন। তারপর বললেন, পরাজয়! পরাজয়! রাজা রায়চৌধুরী, তুমি হেরে গেছ আমার কাছে! তুমি নীল মূর্তি উদ্ধার করতে পারোনি, তুমি আমাকে বাধা দিতে পারোনি, তুমি এখন আমার হাতে বন্দী!
কাকাবাবু মাথাটা ঝাঁকালেন একবার। চোখ রগড়াবার কথা ভাবার পর বুঝলেন তাঁর হাত-পা বাঁধা। তিনি বললেন, আপনি ওরকম একটা মুখোশ পরে আছেন কেন? ওতে আপনাকে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, সে আমাকে যেরকমই দেখাক, ও মুখোশ আমি খুলছি না। কার্য-উদ্ধার করেছি তো!
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আপনার বুদ্ধি আর ক্ষমতা আছে, তা স্বীকার করছি। খুব হেভি ডোজের ক্লোরোফর্ম ছড়িয়ে আপনি গোটা গ্রামের লোকজনদের অজ্ঞান করে ফেলেছেন। এরকম আগে দেখিনি।
তা হলে হার স্বীকার করলে তো, রাজা রায়চৌধুরী? এবারে তোমার শাস্তি হবে! আমার মাথায় চুল নেই, তোমারও চুল থাকবে না। উপরন্তু তোমার ভুরুও থাকবে না। এই দ্যাখো ক্ষুর! মনে আছে সেবারের কথা?
যা মনে আছে। কিন্তু সেবারে আমি আপনার মাথা কামিয়ে দিইনি। দিয়েছিল পাহাড়িরা।
কিন্তু তুমি আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলে! তুমি বাঙালি হয়ে আর একজন বাঙালি বৈজ্ঞানিককে হিংস্র পাহাড়িদের হাতে তুলে দিয়েছিলে!
আপনি সরল পাহাড়িদের ঠকাচ্ছিলেন। যারা মানুষকে ঠকায়, তারা আবার বাঙালি-অবাঙালি কি? তাও আপনাকে আমি একবার সাবধান করে দিয়েছিলাম। আপনি গ্রাহ্য করেননি। বাধ্য হয়েই আপনার বুজরুকি আমাকে ফাঁস করে দিতে হয়েছিল। পাহাড়িরাই আপনাকে শাস্তি দিয়েছে। আপনাকে মারধোর করেনি, শুধু মাথা কামিয়ে গাধার পিঠে উলটো করে চাপিয়ে ছিল।
এবার তোমাকে আমি কী শাস্তি দিই, তা দ্যাখো! রাজা রায়চৌধুরী, তোমার মাথা কামাবার সঙ্গে সঙ্গে তোমার কান দুটোও কেটে ফেললে কেমন হয়? তুমি দুকান কাটা হয়ে ঘুরে বেড়াবে এখন থেকে।
কাকাবাবুর মুখে একটা পাতলা হাসি ফুটে উঠল। তিনি অংশুমান চৌধুরীর চোখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, তা আপনি পারবেন না!
সন্তু আর জোজো পুরোপুরি জেগে ধড়মড় করে উঠে বসল। ভীমু তাদের দিকে রিভলভার উঁচিয়ে বলল, খবরদার, একটুও নড়াচড়া করবে না। নড়লেই গুলি করে মাথার খুলি উড়িয়ে দেব!
জোজো কাঁচুমাচুভাবে বলল, আমি তো তোমাদের দলে। উনি আমার পিসেমশাই! আপন পিসেমশাই!
সন্তু দাঁতে দাঁত চেপে বলল, বিশ্বাসঘাতক!
অংশুমান চৌধুরী এদিকে কান না দিয়ে কাকাবাবুকে বললেন, পারব না মানে? এক্ষুনি কচাৎ কচাৎ করে যদি তোমার দুটো কান উড়িয়ে দিই, তা হলে কে আমাকে বাধা দেবে? তুমি? হে-হে-হে! আমার দিকে ওরকম প্যাটপ্যাট করে তাকালে কী হবে? তুমি আমাকে হিপনোটাইজ করবে নাকি? তুমি কি ম্যানড্রেক! ওসব আমি গ্রাহ্য করি না। আমাকে হিপনোটাইজ করার সাধ্য নেই।
কাকাবাবু বললেন, আমি হিপনোটাইজ করতে জানি না, তাও বলছি, আপনি পারবেন না!
কে বাধা দেবে, কে আমাকে আটকাবে? তোমার হাত-পা বেঁধে রেখেছি, তুমি তা খুলতে পারবে ভেবেছ? তুমি কি জাদুকর হুডিনি না পি সি সরকার?
আমি তাও না! কিন্তু আপনার থেকে আমার অনেকগুলো বেশি অ্যাডভান্টেজ আছে। আমি মুখোশ পরে থাকি না। আমি সাধারণ জীবজন্তু দেখে ভয় পাই না। ঠিকমতন বাঁচতে গেলে চোখ মেলে সব কিছু দেখতে হয়, কান খুলে সব শব্দ শুনতে হয়, নাক দিয়ে নিশ্বাসে সবরকম গন্ধ নিতে হয়। মানুষের চোখ কান-নাক রয়েছে তো এই জন্যই! বাঁচবার জন্য মানুষ প্রত্যেক মুহূর্তে এইগুলো ব্যবহার করে!
তুমি যত খুশি নাক-কান-চোখ ব্যবহার করো, তবু দেখব এই মুহূর্তে কে তোমাকে রক্ষা করে। আগে ভেবেছিলুম, তোমার চুল আর ভুরু কামিয়ে দেব, এখন মনে হচ্ছে, তোমার কান দুটো কেটে দিলে আরও মজা হবে! ইচ্ছে করলে তোমার নাকটাও একটু ছোট করে দিতে পারি।
সন্তু ঠিক করেছে, অংশুমান চৌধুরী ক্ষুরটা দিয়ে কাকাবাবুর কান কাটতে গেলে সে ভীমুর রিভলভার অগ্রাহ্য করেই অংশুমান চৌধুরীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। তারপর যা হয় দেখা যাবে। কিন্তু কাকাবাবুর সঙ্গে তার চোখাচোখি হল, কাকাবাবু সন্তুর মনের কথা বুঝতে পেরেছেন, তিনি দুবার চোখের পলক ফেলে ইঙ্গিতে সন্তুকে এক্ষুনি কিছু করতে নিষেধ করলেন।
কাকাবাবুর মুখে একটুও ভয়ের চিহ্ন নেই, ঠোঁটে হাসি মাখা। তিনি বললেন, অংশুমানবাবু, বাংলায় একটা প্রবাদ আছে আপনি শোনেননি? অতি দর্পে হত লঙ্কা! আপনারও সেই অবস্থা হবে। মাধব রাও আর লর্ড-এর কী হল? তাদেরও আপনি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছেন নাকি?
অংশুমান চৌধুরী বললেন, ওদের কথা থাক, আগে তোমার কী অবস্থা হবে শোনো। আর বেশি সময় নষ্ট করতে চাই না। তোমার মাথা আর ভুরু কামিয়ে, কান দুটো কেটে এইখানে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় রেখে যাব। তারপর তিরাংরা তোমার যা ব্যবস্থা হয় করবে। ছেলেদুটোকে অবশ্য আমি সঙ্গে নিয়ে যাব। আমি বাচ্চাদের শাস্তি দেওয়া পছন্দ করি না। মাধব রাও-দের কী হয়েছে শুনবে? ওরা তিরাংদের নীলমূর্তিটা চেয়েছিল, সেটা ওদের দিয়েছি। মূর্তিটা বহুমূল্য টারকোয়াজ পাথরের। তা ছাড়া হাওয়া ঢুকলে মূর্তিটার মধ্য থেকে বাঁশির মতন শব্দ হয়। আমেরিকার স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউট মিউজিয়াম এই মূর্তিটা পেলে এক মিলিয়ন ডলার দাম দেবে। মূর্তিটা পেয়ে মাধব রাওরা খুশি মনে ফিরে গেছে! হাঃ হাঃ হাঃ, ওরা জানে না যে ওদের মূর্তিটাও নকল। আমি দুটো নকল মূর্তি বানিয়ে এনেছিলুম। একটা বসিয়ে দিয়েছি তিরাংদের মন্দিরে, আর একটা দিয়েছি মাধব রাওদের। আসলটা রয়েছে আমার কাছে! আগামী সপ্তাহেই আমি আমেরিকা চলে যাব।
কাকাবাবু বললেন, আপনার দেখছি, সত্যি বুদ্ধি আছে, এই বুদ্ধি যদি ভাল কাজে লাগাতেন…
অংশুমান চৌধুরী বললেন, এবারে আমার শেষ কাজটা করি। অনেক কথা হয়েছে, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে।
অংশুমান চৌধুরী ক্ষুরটা নিয়ে এগোতেই কাকাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, সন্তু, ঘোড়া।
সন্তু পেছন ফিরে দেখল ওদের ঘোড়াটা কখন যেন ওদের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সে এক লাফ দিল সেদিকে। জোজো সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভীমুর ওপর।
অংশুমান চৌধুরী ঘোড়াটাকে দেখে আঁতকে উঠলেন। ক্ষুরটা ফেলে দিয়ে তিনি তাড়াতাড়ি তাঁর ব্যাগ হাতড়ে বার করতে চেষ্টা করলেন অন্য কোনও অস্ত্র। কিন্তু তার সময় পেলেন না। সন্তু ঘোড়াসুদ্ধ হুড়মুড় করে এসে পড়ল তাঁর ওপর। অংশুমান চৌধুরীর সব কিছু ছিটকে গেল, তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন, না, না, না, আমাকে এ ভাবে মেরো না! ক্ষমা চাইছি।
অংশুমান চৌধুরীকে দলিত মথিত করে ঘোড়াটা চলে গেল খানিকটা দূরে, সন্তু আবার সেটার মুখ ফেরাল। জোজো ততক্ষণে কয়েকটা ঘুষি মেরে ভীমুকে কাবু করে ফেলেছে, সন্তু এক পলক দেখে নিয়ে আবার অংশুমান চৌধুরীর দিকেই ছোটাল ঘোড়াটা।
অংশুমান চৌধুরী কোনওক্রমে উঠে দাঁড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করলেন, পারলেন না, ঘোড়াটার ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলেন জলাশয়টার মধ্য। সেই অবস্থাতেও চেঁচিয়ে বললেন, মরে যাব, আমি সাঁতার জানি না!
ঘোড়ায় চেপে সন্তুর এমন বীরত্ব এসে গেছে যে সে আর ঘোড়া থেকে নামতেই চাইছে না। সে ঘোড়া দাপিয়ে এদিক থেকে ওদিকে ঘুরছে আর চিৎকার করছে, আমরা জিতেছি। আমরা জিতেছি! হুর-রে, আমরা জিতেছি!
জোজো এসে কাকাবাবুর বাঁধন খুলে দিতে লাগল। তার এক হাতে ভীমুর রিভলভার। সেও বেশ সিনেমার নায়কদের মতন ভীমুর দিকে রিভলভারটা উঁচিয়ে বলল, কোনও রকম চালাকি করবার চেষ্টা করেছ কি, একখানা মোটে গুলি, আমার টিপ কী রকম জানো না, একবার ইটালিতে তিন-তিনটে গুণ্ডাকে…
কাকাবাবু বললেন, ওহে, তোমরা অংশুমান চৌধুরীকে আগে জল থেকে তোলো, ভদ্রলোক সাঁতার জানেন না বললেন..
ভীমু হাত জোড় করে বলল, স্যার, আমি কিন্তু রিভলভার দিয়ে ইচ্ছে করে গুলি করিনি। আমি ছোট ছেলেদের মারি না, আমি ঘোড়া খুব ভালবাসি, ঘোড়র গায়েও গুলি করতে পারি না। আমি স্যার খুন জখমের লাইনে নেই!
কাকাবাবু বললেন, তুমি গিয়ে তোমার স্যারকে জল থেকে ভোলো! উনি ড়ুবে যাচ্ছেন যে!
কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙলেন। তারপর সন্তুকে ডেকে বললেন, এই সন্তু, ঘোড়াটার সঙ্গে আমার ক্রাচ দুটো বাঁধা আছে। ওগুলো দে।
সন্তু এবারে কাকাবাবুর কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামল। তার মুখখানা আনন্দে ঝলমল করছে। সে বলল, জোজোটাকে এক সেকেণ্ডের জন্য বিশ্বাসঘাতক মনে হয়েছিল, কিন্তু জোজোও খুব ভাল ফাইট দিয়েছে।
জোজো বলল, আমি ইচ্ছে করেই ওই কথা বলেছিলুম, যাতে আমাকে ওদের দলের মনে করে। ওই ভীমুর রিভলভারটা হাতানোই আমার মতলব ছিল। কী রকম একখানা স্কোয়ার কাট ওর নাকে ঝাড়লুম বল্! এক ঘুষিতেই কাত! এটা মহম্মদ আলীর টেকনিক! কাকাবাবু, এবারে কিন্তু সন্তু আর আমিই আপনাকে বাঁচিয়েছি। আমার পিসেমশাই আর-একটু হলেই আপনার মাথায় ক্ষুর চালিয়ে দিত।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক বলেছ!
ভীমু গিয়ে অংশুমান চৌধুরীকে জল থেকে তুলে এনেছে ততক্ষণে। দুটো নাকওয়ালা মুখখাশটা এখনও ভোলা হয়নি। অংশুমান চৌধুরী খুখু করে কাঁদলেন আর বললেন, গেল, গেল, আমার সব গেল! হতচ্ছাড়া একটা ঘোড়া, কোথা থেকে এল একটা ঘোড়া, ওফ, মরে গেলাম!
কাকাবাবু বললেন, অংশুমানরাবু, এবার মুখোশটা খুলে ফেলুন!
অংশুমান চৌধুরী আর্তকণ্ঠে বললেন, না, না, ওরে বাবা, না, না!
আপনি নিজে থেকে না খুললে জোর করে খুলে দেওয়া হবে! আপনি নিজেকে বলেন বৈজ্ঞানিক, অথচ এই সরল, নিরীহ, আদিবাসীদের গ্রাম থেকে তাদের দেবতার মূর্তি চুরি করতে এসেছিলেন। এটা কি কোনও বৈজ্ঞানিকের কাজ? আপনি আমার হাত-পা বেঁধে রেখেছিলেন, আপনি কাপরুষ। আপনি এ-দেশ থেকে দামি মূর্তি পাচার করে আমেরিকায় বিক্রি করার চেষ্টা করেছিলেন…এই প্রত্যেকটা অপরাধের জন্য আপনাকে শাস্তি পেতে হবে।
কাকাবাবু এগিয়ে এসে একটানে খুলে ফেললেন অংশুমান চৌধুরীর মুখোশ। প্রথমেই ঘোড়াটাকে দেখতে পেয়ে তিনি ওরে বাবা রে ওরে বাবা রেবলে চিৎকার করে চোখ ঢাকলেন, তারপর বললেন, বিশ্রী দুর্গন্ধ, আমি অজ্ঞান হয়ে যাব!
কাকাবাবু বললেন, সন্তু, ঘোড়াটাকে তুই এই ভদ্রলোকের একেবারে কাছে। নিয়ে আয় তো! দেখি উনি কী রকম অজ্ঞান হয়ে যান!
অংশুমান চৌধুরী শুধু ওরে বাবা রে, ওরে বাবা রে বলে চ্যাঁচাতেই। লাগলেন, কিন্তু অজ্ঞান হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না।
কাকাবাবু বললেন, আর কোনও জন্তু-জানোয়ার কিংবা পোকা মাকড় নেই। কাছাকাছি? সেগুলোও ছেড়ে দিতাম ওর গায়ে।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, জোজোকে যেরকম লাল পিঁপড়ে কামড়েছিল, সেই রকম একটা পিঁপড়ের ঢিপি রয়েছে ওইখানে একটা গাছের গোড়ায়!
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি, বাঃ বাঃ, তা হলে তো খুবই ভাল!
কাছেই একটা সন্দেশের খালি কাগজের বাক্স পড়ে আছে, সেটা দেখিয়ে সন্তুকে বললেন, এটাতে করে বেশ কয়েক মুঠো পিঁপড়ে নিয়ে আয় তো?
জোজো রিভলভারটা নিয়ে এদিক-ওদিক ঘোরাচ্ছে, কাকাবাবু তাকে বললেন, এটা আমাকে দাও! আমি এবার অংশুমান চৌধুরীর ব্যাগটা ঘেঁটে দেখি, ওতে আর কী কী সম্পত্তি আছে?
কান্না থামিয়ে অংশুমান চৌধুরী বলে উঠলেন, না, না, আমার ব্যাগে হাত দেবেন না?
হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করে কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, চোপ! আপনার লজ্জা করে না, একটু আগে আমাকে তুমি তুমি করছিলেন, এখন আবার আপনি বলতে শুরু করেছেন। আপনাকে দুখানা থাপ্পড় মারার ইচ্ছে যে আমি কত কষ্টে দমন করছি..
ভীমু ঘোড়াটার গায়ে হাত বুলোচ্ছে আর ঘোড়াটা, অংশুমান চৌধুরীকে ঠেসে ধরে আছে একটা গাছের সঙ্গে। অংশুমান চৌধুরীর তিড়িং তিড়িং নাচ আর কান্না দেখে ঘোড়াটাও বোধহয় মজা পাচ্ছে।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, ওরে ভীমু, ঘোড়াটাকে সরা! তুই আমাকে আগে বলতে পারিসনি যে, ঘোড়াটা এদিকে আসছে? তোর চাকরি যাবে, তোর চাকরি যাবে, তোকে আমি এমন শাস্তি দেব..
ভীমু বলল, আমি আর চাকরির পরোয়া করি না, স্যার! আপনি নিজে আগে বাঁচবেন কি না দেখুন! তারপর তো আমায় শাস্তি দেবেন!
দেখবি, দেখবি, আমার কাছে এখনও এমন ওষুধ আছে!
স্যার, উনি আপনার দিকে রিভলভার তাক করে আছেন কিন্তু!
সন্তু কাগজের বাক্সটা নিয়ে এসে বলল, কাকাবাবু, অনেক পিঁপড়ে এনেছি! মাথায় ঢেলে দেব?
অংশুমান চৌধুরী দুহাতে মাথা চাপা দিয়ে হাহাকার করে বলে উঠলেন, না, না, পিঁপড়ে আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না! খুদে শয়তান! ওরে জোজো, তুই আমার আত্মীয়, তুই আমাকে বাঁচা!
জোজো বলল, ওই পিঁপড়ের কামড় খেয়ে আমি মরে যাচ্ছিলুম আর একটু হলে, আপনার জন্যই তো! এবার আপনি একটু পিঁপড়ের কামড় খেয়ে দেখুন! সন্তু আমার বেস্ট বন্ধু, তার কাকাবাবুর আপনি কান কেটে দিতে যাচ্ছিলেন!
কাকাবাবু বললেন, দে সন্তু, পিঁপড়েগুলো ওঁর ওই ন্যাড়া মাথায় ছড়িয়ে দে!
অংশুমান চৌধুরী যাতে বাধা দিতে না পারেন, সেইজন্য হঠাৎ ভীমুই নিজে থেকে চেপে ধরল তাঁর দুহাত। সন্তু পুরো বাক্সটা খালি করে দিল অংশুমান চৌধুরীর মাথায়।
কাকাবাবু সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, বাঃ, বেশ হয়েছে, এবার তোরা ওর নাচ দ্যাখ!
কাকাবাবু অংশুমান চৌধুরীর ব্যাগটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলেন। রিভলভারটা পাশে নামিয়ে রেখে, ব্যাগটার ভেতর থেকে বার করে আনলেন আসল নীল পাথরের মূর্তিটা।
নকল মূর্তির মতন আসল মূর্তিটা অত চকচকে নয়। গায়ে একটা ধুলোর আস্তরণ। কাকাবাবু পকেট থেকে রুমাল বার করে সেটা ঘষতে লাগলেন। এটা চিনেমাটির নয়, দামি কোনও পাথরের, তাতে সন্দেহ নেই। মূর্তিটা এত ভারী যে, নিরেট পাথরের বলেই মনে হয়, কিন্তু পেছন দিকে দুটো গোল গোল গর্ত। কাকাবাবু একটা গর্তে ফুঁ দিলেন, ঠিক নিটোল বাঁশির মতন শব্দ হল!
কাকাবাবু মূর্তিটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন। অন্তত দুতিন শো বছরের পুরনো মনে হয়। দুপায়ে দুটো পরিষ্কার জুতোর মতন, এইটাই আশ্চর্যের।
হ্যান্ডস আপ?
কাকাবাবু চমকে তাকিয়ে দেখলেন, একটা ঝোপ ঠেলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এসেছে মাধব রাও আর লর্ড। মাধব রাওয়ের হাতে একটা রাইফেল।
কাকাবাবু মূর্তিটা ধরে রেখেই হাতদুটো তুললেন মাথার ওপরে। তাঁর রিভলভারটা পড়ে আছে ব্যাগটার আড়ালে, সেটা এখন আর নেওয়ার উপায় নেই।
মাধব রাও কর্কশ সুরে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, উঠে দাঁড়াও!
লর্ড ছুটে গেল অংশুমান চৌধুরীর দিকে। সন্তুকে এক ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়ে সে দুহাত দিয়ে অংশুমান চৌধুরীর মাথা থেকে পিঁপড়ে ছাড়াতে লাগল।
অংশুমান চৌধুরী হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও! এরা আমাকে নরক যন্ত্রণা দিয়েছে। এই ঘোড়াটাকে সরিয়ে দাও।
লর্ড ঘোড়াটার পেটে একটা লাথি কষাতেই সেটা দৌড় লাগাল প্রাণপণে। তারপর সে অংশুমান চৌধুরীকে বলল, ভাগ্যিস আমাদের ফিরে আসার কথা মনে হল! আপনার দেরি হচ্ছে দেখে মনে হল, আপনার হয়তো কোনও সাহায্য দরকার। খানিকটা উঠে আসার পর আপনার কান্নার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলুম, নিশ্চয়ই আপনি বিপদে পড়েছেন।
অংশুমান চৌধুরী কয়েকবার হেঁচকি তুলে কান্না থামিয়ে বললেন, এবারে আমি রাজা রায়চৌধুরীকে এমন শাস্তি দেব ও জীবনে ভুলবে না! ওর হাত দুটো বেঁধে ফ্যালো। ও ডেঞ্জারাস লোক আর এই ভীমুটা, ও পর্যন্ত বিট্রে করেছে, ওদের দলে ভিড়েছিল, ওকে আমি তিরাংদের হাতে ছেড়ে দিয়ে যাব।
মাধব রাও রাইফেলটা একবার সকলের দিকে ঘুরিয়ে বলল, কেউ,এক পা নড়বে না। যে চালাকির চেষ্টা করবে, সে খোঁড়া হয়ে যাবে। রাজা রায়চৌধুরী তুমি আমার সামনে এগিয়ে এসো। হাতে ওটা কী, তুমি তিরাংদের মন্দির থেকে মূর্তিটা তুলে এনেছ? এই যে আগে তুমি খুব সাধু সেজেছিলে, ওদের মূর্তি চুরি করায় তোমার খুব আপত্তি ছিল..
কাকাবাবু সামান্য হেসে বললেন, মাধব রাও, তুমি এককালে সিভিলিয়ান ছিলে, এখন বন্দুক তুলে লোককে ভয় দেখাচ্ছ? আমি যদি তোমার হুকুম না শুনি। তা হলে কি গুলি করে আমায় মেরে ফেলবে? খুন করতেও তোমার আপত্তি নেই?
মাধব রাও চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, রাজা রায়চৌধুরী, তোমার কাছে আমরা সাহায্য চাইতে গিয়েছিলাম, তুমি আমাদের অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলে। এখন তুমি আমাদের পদে-পদে বাধা দিচ্ছ। মিস্টার অংশুমান চৌধুরী আমাদের দারুণ সাহায্য করেছেন, তুমি তাঁকে..
কাকাবাবু এবার হা হা করে হেসে উঠে বললেন, অংশুমান চৌধুরী তোমাদের সাহায্য করেছেন? তাই নাকি? তোমাদের একটা নকল মূর্তি দিয়ে বিদায় করে দিয়েছিলেন…
অংশুমান চৌধুরী চেঁচিয়ে বলল, মিথ্যে কথা! মিথ্যে কথা! ওর কথায় বিশ্বাস কোরো না?
মাধব রাও বলল, দেখি, ওই মূর্তিটা আমাকে দাও। কাকাবাবু বললেন, এই নাও।
প্রচণ্ড জোরে তিনি মূর্তিটা ছুঁড়ে মারলেন মাধব রাওয়ের রাইফেল-ধরা হাতটার ওপর। রাইফেলটা ছিটকে পড়ে গেল খানিকটা দূরে, ঠকাস করে শব্দ হল। হাতের যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠল মাধব রাও।
লর্ড আর অংশুমান চৌধুরী, অন্যদিক থেকে সন্তু আর জোজোও গেল রাইফেলটা আগে কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য। সেটার কাছে পৌঁছবার আগেই অংশুমান চৌধুরী পেছনে ফিরে সন্তু আর জোজোকে কিল আর লাথি মারতে মারতে চেঁচিয়ে বললেন, লর্ড, লর্ড তুমি রাইফেলটা হাত করো…
লর্ড নিচু হয়ে রাইফেলটা ধরতে যেতেই তার হাতে একটা গুলি এসে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, ওহে লর্ড, ওখান থেকে সরে না গেলে এর পরের গুলিটা তোমার মাথার খুলিতে লাগবে! সন্তু, রাইফেলটা নিয়ে আয় আমার কাছে।
গুলির ধাক্কায় লর্ড পড়ে গেছে মাটিতে, উড়ে গেছে তার বাঁ হাতের দুটো আঙুল। অংশুমান চৌধুরী আতঙ্ক-বিহুল চোখে থমকে গিয়ে বললেন, যাঃ!
রিভলভারটা হাতে নিয়ে, ক্রাচ ছাড়াই কাকাবাবু এক পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এসে দাঁড়ালেন মাধব রাওয়ের কাছে। রাগে তাঁর মুখ থমথম করছে।
মাধব রাওয়ের চোখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে তিনি বললেন, আমার দিকে যারা বন্দুক পিস্তল তোলে, তাদের আমি কোনও না কোনও শাস্তি না দিয়ে ছাড়ি না। তোমাকে আমি কী শাস্তি দেব? একটা হাত ভেঙে দেব মুচড়ে?
মাধব রাও উঠে বসে মাথা হেঁটে করে ফেলল। তার মাথা ভর্তি বাবরি চুল। লর্ড হাতের যন্ত্রণায় মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। তারও মাথায় অনেক চুল।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। অংশুমান চৌধুরী, আপনি আমার মাথা কামাতে চাইছিলেন না? আপনার নাপিত সাজার খুব ইচ্ছে? এবার এই দুজন লোত্রে মাথা ন্যাড়া করে দিন।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, আমি পারব না, আমি পারব না!
কাকাবাবু বললেন, তা হলে আমার মতন আপনিও একটা পা খোঁড়া করতে চান? আপনার সম্পর্কে আমার আর কোনও দয়া-মায়া নেই। আমি তিন গুনব, তার মধ্যে যদি ক্ষুরটা হাতে না নেন…এক, দুই…
অংশুমান চৌধুরী ছুটে গিয়ে মাটি থেকে ক্ষুরটা তুলে নিয়ে রাওয়ের মাথার সামনে গিয়ে বসলেন, তারপর বললেন, জল দিয়ে চুল ভেজাতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, কোনও দরকার নেই। শুরু করুন।
মাধব রাও মুখ তুলে একবার শুধু অংশুমান চৌধুরীর দিকে তাকাল, তারপর বলল, আপনারা যা খুশি করুন।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে মাধব রাও ন্যাড়া হয়ে গেল। ক্ষুরের খোঁচায় তার মাথার খুলির মধ্য দিয়ে একটু একটু করে রক্ত খুঁড়ে বেরুচ্ছে।
কাকাবাবু বললেন, এবারে লর্ডকে ধরুন, তার আগে একটা কথা..তিরাংদের ঘুম ভাঙতে আর কতক্ষণ বাকি আছে?
অংশুমান চৌধুরী হাতের ঘড়ি দেখে বললেন, আরও প্রায় দুঘন্টা।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু, একটা কাজ করতে পারবি? তিরাংদের মন্দিরে গিয়ে ওদের এই মূর্তিটা ফিরিয়ে দিয়ে আসতে পারবি?
সন্তু বলল, হ্যাঁ, দিয়ে আসব।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, ওটা ফিরিয়ে দিচ্ছেন? ওটা খুবই দামি…তিরাংরা ওর মূল্য বোঝে না…ওদের মন্দিরে একটা নকল মূর্তি থাকলেও ক্ষতি নেই।
কাকাবাবু বললেন, চুপ! এখনও চুরি করার শখ মেটেনি? নিজের কাজ করুন। সন্তু, তুই যা। এই আসল মূর্তিটা ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নকলটা নিয়ে চলে আসবি!
জোজো বলল, চল সন্তু, আমিও তোর সঙ্গে যাই!
লর্ড নিজের মাথার চুল বাঁচাবার জন্য মাটিতে আরও জোরে জোরে গড়াগড়ি দিতে লাগল। ভীমু গিয়ে চেপে ধরল তাকে। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে লর্ডের শখের চুলও ছড়িয়ে পড়ল মাটিতে।
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, ঠিক হয়েছে। এবারে আপনি নিজের কান দুটো কেটে ফেলুন তো!
অংশুমান চৌধুরী আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন, অ্যাঁ?
কাকাবাবু বললেন, কেন, আমার কান কাটতে চাইছিলেন, এখন নিজের কান কাটতে আপত্তি কিসের? নিজের হাতে পারবেন না? তা হলে ভীমুকে ক্ষুরটা দিন।
ভীমু সাগ্রহে বলল, দেব স্যার, আমি ওঁর কানদুটো কেটে দেব স্যার? এক মিনিট লাগবে!
অংশুমান চৌধুরী এবারে সটান শুয়ে পড়ে কাকাবাবুর পায়ে হাত দিয়ে বললেন, দয়া করুন, দয়া করুন! আমার কান কাটবেন না। তা হলে আর কোনও দিন মুখ দেখাতে পারব না।
কাকাবাবু পাটা সরিয়ে নিয়ে বললেন, ছিঃ! আমি কি সত্যি-সত্যি আপনার কান কেটে দিতাম? উঠে বসুন, এরপর একটা দরকারি কথা আছে!
মাধব রাও, লর্ড আর অংশুমান চৌধুরীকে তিনি এক লাইন করে বসালেন। তারপর সন্তু আর জোজোকে ফিরে আসতে দেখে তিনি বললেন, এবার আর একটা প্রতিযোগিতা শুরু হবে! এই পাহাড়ের নীচে আপনাদের গাড়িটা আছে না? সেই গাড়িটা চাই। আমরা এখান থেকে রওনা হওয়ার আধঘন্টা পরে আপনারা উঠবেন। তার আগে উঠলে আমি গুলি চালাব। আমি খোঁড়া লোক, আধঘন্টা গ্রেস তো পেতেই পারি, তাই না? তারপরও গিয়ে যদি আপনারা আগে গাড়িটা দখল করতে পারেন, তা হলে আমাদের কিছুই বলার নেই!
সন্তু আর জোজো ফিরে আসতেই তিনি বললেন, রাইফেলটা, অংশুমান চৌধুরীর ব্যাগ এই সব নিয়ে নে। ওরা খুনে-গুণ্ডা, ওদের হাতে কোনও রকম অস্ত্র দেওয়া ঠিক নয়। ভীমু, তুমি ফ্রি। তুমি যেখানে খুশি যেতে পারো। ঘোড়াটা পাওয়া গেলে খুব ভাল হত।
ক্রাচ বগলে নিয়ে কাকাবাবু তিনটি ন্যাড়ামাথার দিকে তাকিয়ে বললেন, গুড বাই!