গাড়ি থেকে স্যান্ডউইচ-এর প্যাকেট আর চা-ভর্তি ফ্লাস্ক নিয়ে এল ভীমু। নদীর ধারে বালির ওপর একটা ম্যাপ সামনে বিছিয়ে বসে আছেন অংশুমান চৌধুরী। ভীমু কাগজের গেলাসে চা ঢেলে একটা করে দিল সবাইকে।
সবে মাত্র ভোর হয়েছে। শোনা যাচ্ছে নানারকম পাখির ডাক। হাওয়ায় বেশ শীত-শীত ভাব। নদীর ওপারের জঙ্গলে দেখা যাচ্ছে নতুন সূর্যের রেশমিল ছটা।
অংশুমান চৌধুরীর মুখে সেই দুটো নাকওয়ালা-মুখোশ। দুই কানে লাগানো একটা ওয়াকম্যানের মতন যন্ত্র, যাতে বাইরের যে-কোনও আওয়াজের মধ্য থেকে হেঁকে শুধু মানুষের গলার আওয়াজ যায়। পায়ে হাঁটু পর্যন্ত গামবুটের মতো জুতো।
চা ও স্যান্ডউইচ খাওয়ার পর অংশুমান চৌধুরী বললেন, এবার দেখা যাক, রাজা রায়চৌধুরী আর ছেলে দুটো কোন দিকে যেতে পারে। এখানে জঙ্গল বেশি ঘন নয়, দিনের বেলা এখানে ওরা বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারবে না।
লর্ড বলল, আমার মনে হয়, রাস্তার অন্য কোনও গাড়িতে লিফট নিয়ে ওরা এতক্ষণ কোণ্ডাগাঁওতে ফিরে গেছে। রাজা রায়চৌধুরী কলকাতায় ফেরার জন্য খুব ব্যস্ত হয়েছিল।
রাও বললেন, রাজা রায়চৌধুরীকে আর খোঁজাখুঁজি করে লাভ কী? আমাদের নীলমূর্তিটা উদ্ধার করা নিয়ে কথা। আপনিই তো সেটা পারবেন!
রাও-এর দিকে ফিরে কটমট করে তাকিয়ে অংশুমান বললেন, রাজা রায়চৌধুরীকে আমি আগে ন্যাড়া করে তবে ছাড়ব!
কয়েকবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়ার পর তিনি একটু শান্ত হলেন। তারপর আস্তে-আস্তে বললেন, রাজা রায়চৌধুরীকে তোমরা চেনো না, অতি ধুরন্ধর লোক। একবার সে যখন ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে, তখন সহজে হাল ছাড়বে না! রাজা রায়চৌধুরী এখন দুটো ব্যাপার করতে পারে। হয় সে জগদলপুরে গিয়ে পুলিশকে সব কথা জানাবে, তারপর পুলিশবাহিনী নিয়ে এসে আমাদের আটকাবে। কিংবা, সে নিজেই অবুঝমাড়ের দিকে চলে গিয়ে আমাদের আগেই নীলমূর্তিটা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে।
রাও জিজ্ঞেস করলেন, উনি আমাদের আগে ওখানে কী করে পৌঁছবেন? অনেকটা দূর তো!
অংশুমান ম্যাপে আঙুল দেখিয়ে বললেন, এই দ্যাখো নারানপুর, এই দিকে জগদলপুর, আর এই এখানে অবুঝমাঢ়, এখান থেকেও আরও চোদ্দ-পনেরো মাইল যেতে হবে পাহাড়ি রাস্তায়।
লর্ড বলল, রাজা রায়চৌধুরী খোঁড়া লোক, পনেরো মাইল পাহাড়ে উঠতে তার সারাদিন লেগে যাবে! যদি শেষ পর্যন্ত উঠতে পারে!
অংশুমান বললেন, আমি ওকে কোনও ব্যাপারে বিশ্বাস করি না। আমাদের এখন উচিত, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অবুঝমাঢ় পাহাড়ের কাছে পৌঁছে। ঘাঁটি গেড়ে বসে থাকা!
ভীমু বলল, কারা যেন আসছে!
সবাই মুখ তুলে তাকাল। নদীর ওপারের জঙ্গলের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল কয়েকজন লোক। তাদের হাতে একটা করে টাঙ্গি। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু পায়ে-চলা রাস্তা আছে। নদীতে জল কম, অনায়াসে হেঁটে পার হওয়া যায়।
লর্ড বলল, ওরা নিরীহ সাধারণ লোক, জঙ্গলে কাঠ কাটতে এসেছে।
রাও বললেন, ওরা নদী পেরিয়ে এদিকেই আসছে মনে হচ্ছে।
লর্ড বলল, আসুক না, ওরা আমাদের দেখলেও কিছু বলবে না। এখানকার লোকো খুব কম কথা বলে।
অংশুমান চৌধুরীর মুখে একটা দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, এবার তোমাদের একটা এক্সপেরিমেন্ট দেখাচ্ছি। ভীমু, আমার হ্যান্ড ব্যাগটা নিয়ে আয় তো গাড়ি থেকে!
ভীমু দৌড়ে গাড়ি থেকে একটা বেশ মোটাসোটা ব্যাগ নিয়ে এল। অংশুমান সেটা খুলে প্রথমে বেশ বড় সেন্টের শিশির মতন শিশি বার করলেন। তাতে স্প্রে করার ব্যবস্থা আছে। তারপর নিজে যেমন মুখোশ পরে আছেন, সে রকম আরও কয়েকটা মুখোশ বার করে অন্যদের বললেন, এগুলো তোমরা মুখে লাগিয়ে নাও!
লর্ড প্রতিবাদ করে বলল, আমরা মুখোশ পরব কেন? এগুলো বিচ্ছিরি দেখতে।
অংশুমান তাকে ধমক দিয়ে বললেন, যা বলছি করো! সময় নষ্ট করো।
উলটো দিকের লোকগুলো বোধহয় অনেকটা হেঁটে এসেছে। তাই তক্ষুনি নদী পার না হয়ে কয়েকজন বসে জিরোতে লাগল। কয়েকজন নদীর জলে চোখ-মুখ ধুতে শুরু করল। একজন গাছের নিচু ডালে উঠে দোল খেতে লাগল বাচ্চাদের মতন।
অন্যদের মুখোশ লাগানোর পর অংশুমান উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, এই বার দ্যাখো আমার খেলা।
তিনি এগিয়ে গিয়ে নদীর একেবারে ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওপারের লোকগুলো তাঁকে দেখতে পেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অংশুমান হাতের শিশিটা উঁচু করে তুলে ফোঁসফাঁস করে স্প্রে করতে লাগলেন তাদের দিকে।
কয়েকবার মাত্র এই রকম করে তিনি ফিরে এসে আগের জায়গায় বসে পড়ে বললেন, এইবার দ্যাখো মজাটা! কেউ কথা বলল না!
ওপারের লোকগুলো মাথার ওপর হাত তুলে হাই তুলতে লাগল। যারা নদীর জলে নেমেছিল, তারা ওপারে উঠে গিয়ে বসে পড়ল, দুজন শুয়ে পড়ল। অন্যরাও শুয়ে পড়ল একে-একে। যে লোকটা গাছের ডালে দোল খাচ্ছিল, সে ধপাস করে পড়ে গেল নীচে। সামান্য উঁচু থেকে পড়েছে। তার তেমন লাগবার কথা নয়। কিন্তু সে আর উঠে দাঁড়াল না, যেমনভাবে পড়েছিল, সেইরকমভাবেই স্থির হয়ে রইল।
শিউরে উঠে রাও বললেন, ওরা মরে গেল?
অংশুমান কোনও উত্তর না দিয়ে মুচকি-মুচকি হেসে মাথা নাড়তে লাগলেন।
রাও আবার উত্তেজিতভাবে বললেন, আপনি ওদের মেরে ফেললেন? ওরা অতি নিরীহ সাধারণ মানুষ!
অংশুমান বললেন, তোমার কি মাথা খারাপ? আমি কি খুনি? অতগুলো লোককে এমনি-এমনি মেরে ফেলব কেন? ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিলুম!
রাও তবু অবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, আপনি এতদূর থেকে কী একটা স্প্রে করলেন, আর অমনি লোকগুলো সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল; এরকম কোনও ওষুধ আছে নাকি? অসম্ভব!
মিস্টার রাও, বিজ্ঞানের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই। এটা আমার নিজের আবিষ্কার! এই ওষুধ স্প্রে করে আমি একটা গোটা গ্রামের লোককে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি।
মাফ করবেন, মিস্টার চৌধুরী, আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনাকে আমি আগেই বলেছি, আমরা কোনও খুন-জখমের মধ্যে যেতে চাই না।
তোমার যদি বিশ্বাস না হয়, তুমি নদীর ওপারে গিয়ে ওদের দেখে এসো।
লর্ড, আমার সঙ্গে যাবে? একবার দেখে আসতে চাই।
ওরা দুজনে পা থেকে জুতো খুলে নদীতে নামল। নদীর মাঝখানেও হাঁটুর বেশি জল নয়। তবে স্রোতের বেশ শব্দ আছে।
রাও ওদিকের মানুষগুলোর নাকের কাছে হাত নিয়ে গিয়ে দেখল ওদের নিশ্বাস পড়ছে স্বাভাবিকভাবে। হাতের নাড়ি টিপে দেখল, তাও স্বাভাবিক। সবাই সত্যিই ঘুমন্ত। যে-লোকটা গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল, সে নাক ডাকছে।
রাও অস্ফুটভাবে বললেন, আশ্চর্য! আশ্চর্য!
লর্ড বলল, ওই অংশুমান চৌধুরী মোটেই সাধারণ নয়। ওর দিকে তাকালে আমারই মাঝে-মাঝে ভয় করে।
রাও বললেন, দ্যাখো, দ্যাখো, দুটো পাখি পড়ে আছে। এ-দুটোও কি ঘুমিয়ে আছে, না মরে গেছে?
লর্ড বলল, পাখি দুটোকে তুলে নিই, পরে মাংস বেঁধে খাওয়া যাবে।
রাও বললেন, না, না, থাক। শুধু শুধু পাখি মারা আমি পছন্দ করি না!
ওরা আবার ফিরে এল নদীর এ-পারে।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, দেখলে তো? ওরা এখন ঠিক পাঁচ ঘন্টা ঘুমোবে। একেবারে গাঢ় ঘুম। যখন উঠবে, তখন আবার পুরোপুরি চাঙ্গা হয়ে উঠবে। কাজে বেশি উৎসাহ পাবে। এই ঘুমের ওষুধে কোনও ক্ষতি হয় না!
রাও বললেন, আপনি এই ওষুধ বাজারে বিক্রি করলে তো বড় লোক হয়ে যাবেন! এরকম ইনস্ট্যান্ট ঘুমের ওষুধের কথা আমি কখনও শুনিইনি!
অংশুমান চৌধুরী বললেন, আমার কোনও আবিষ্কার আমি বিক্রি করি না। আমার টাকাপয়সার কোনও অভাব তো নেই! এবারে তা হলে রওনা হওয়া যাক।
লর্ড বলল, দুটো গাড়িই নিয়ে যাওয়া হবে?
রাও বললেন, না, শুধু-শুধু দুটো গাড়ি নিয়ে গিয়ে লাভ কী! একটা এখানে রেখে গেলেই তো হয়।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, না, এখানে ফেলে রাখা চলবে না। রাজা রায়চৌধুরী যদি গাড়িটা ব্যবহার করতে চায়, সে রিক আমরা নিতে পারি না। লর্ড তুমি ওই গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে চলো। ওটা আমরা নারানপুরে রেখে যাব। তুমি আগে এগিয়ে পড়ো। আমরা রাও-এর গাড়িতে যাচ্ছি, তোমাকে তুলে নেব। কিছু খাবার দাবার জোগাড় করে নিতে হবে।
রাত্তিরেই লর্ড তার গাড়িটাকে ঠিকঠাক করে নিয়েছিল। সবাই মিলে চলে এল সেই গাড়িটার দিকে। অংশুমান চৌধুরী চোখে একটা কালো চশমা পরে নিয়ে বললেন, কাল যে ভাল্লুকটাকে গুলি করা হয়েছিল, সেটা কী মরেছে?
রাও বললেন, না, আমি শুধু ওকে ভয় দেখাবার জন্য গুলি চালিয়েছিলাম।
ওটা আবার কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে না তো? দিনের বেলা এদিকে আসবে না বোধহয়।
রাও তোমার গাড়িতে আমরা এদিক-ওদিক আর একটু খুঁজে দেখব। যদি রাজা রায়চৌধুরী আর ছেলে দুটিকে পাওয়া যায়। আধ মাইলের মধ্যে ওদের। দেখা গেলেই আমাকে বলবে।
দুটি গাড়িই স্টার্ট দিয়ে চলে এল বড় রাস্তায়। তারপর রাওয়ের গাড়িটা ঢুকে পড়ল রাস্তার উলটো দিকের জঙ্গলে।
তিনটে কুকুর এক সঙ্গে হিংস্রভাবে ডেকে উঠল। তীর-ধনুকওয়ালা মানুষ তিনজন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সন্তুদের দিকে। কাকাবাবু জোজোকে ছেড়ে দিয়ে আস্তে-আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। সন্তুকে বললেন, ভয় পাসনি রে, এরা নিরীহ, শান্ত লোক। এরা আমাদের ক্ষতি করবে না।
তারপর ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে হিন্দিতে বললেন, আমাদের ওই ছেলেটিকে বিষ পিঁপড়ে কামড়েছে, তোমরা এর কিছু ওষুধ জানো?
একজন লোক এগিয়ে গেল জোজোর দিকে। আর একজন কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, ওকে কী করে পিঁপড়ে কামড়াল? তোমরা এখানে শুয়ে ছিলে?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমরা সারারাত এখানেই শুয়ে ছিলাম।
লোকটি মাথা নেড়ে বলল, ও।
কেন যে এই তিনজন অচেনা মানুষ এই জঙ্গলের মধ্যে সারারাত শুয়ে ছিল, তা আর সে জানতে চাইল না। যেন এটা একটা খুব সাধারণ উনা।
কুকুর তিনটে সর্ল্ড আর কাকাবাবুর গায়ের কাছে এসে লাফালাফি করছে। সন্তু কুকুরকে ভয় পায় না, তার নিজেরই একটা কুকুর আছে। কিন্তু এই কুকুরগুলোর কেমন যেন হিংস্র আর জংলি-জংলি ভাব।
কাকাবাবুই বললেন, তোমাদের কুকুর সামলাও তো।
যে-লোকটি জোজোকে পরীক্ষা করে দেখতে গিয়েছিল, জোজো তাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল ভয়ে।
সন্তু বলল, জোজো, জোজো, একটু চুপ করে থাক।
সেই লোকটি মুখ ফিরিয়ে আগে নিজের সঙ্গীদের কী যেন বলল। তাদের। সম্মতি পেয়ে কাকাবাবুকে বলল, এ ছেলেটাকে আমাদের গ্রামে নিয়ে চলুন। আমরা সারিয়ে দেব।
কাকাবাবু বললেন, তাই চল রে, সন্তু!
জোজো তবু ভয় পাচ্ছে। এখন সে আর সন্তুর কাঁধে চড়তে রাজি হল না, নিজেই উঠে দাঁড়াল। সে যে খুবই কষ্ট পাচ্ছে তা বোঝা যায়। তার চোখ দুটো প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। সন্তু ধরে ধরে নিয়ে চলল তাকে।
এই লোক তিনটি বড্ড তাড়াতাড়ি হাঁটে। এদের সঙ্গে তাল মেলানো সন্তুদের পক্ষে মুশকিল। কাকাবাবু ফিসফিস করে বললেন, একটা ব্যাপার কী জানিস, এরা অনায়াসে আট-দশ মাইল হেঁটে যায়, এদের গ্রামটা কত দূর কে জানে।
একটা টিলার কাছে এসে সেই তিনজনের মধ্যে দুজন খুব বিনীতভাবে কাকাবাবুকে বলল যে, তাদের একটু অন্য দিকে যেতে হবে। কাজ আছে। বাকি লোকটি কাকাবাবুদের গ্রামে নিয়ে যাবে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের গ্রামটা কত দূরে?
তৃতীয় লোকটি হাত তুলে এমনভাবে দেখাল, যেন মনে হল খুবই কাছে। এতদূর আসার পর আর ফেরা যায় না। কাছে হোক বা দূরে হোক, যেতেই হবে। কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, চলো, তোমার নাম কী ভাই!
লোকটি বলল, লছমন।
লছমন, তোমরা কি ছত্রিশগড়ী না মুরিয়া?
মুরিয়া। আমাদের গ্রামের নাম ছোটা বাংলা।
বাংলা কথাটা শুনে সন্তু অবাক হয়ে তাকাল কাকাবাবুদের দিকে। কাকাবাবু বললেন, বাংলা হচ্ছে আসলে বাংলো। এদের গ্রামের কাছাকাছি কোথাও বোধহয় সরকারি বাংলো-টাংলো আছে।
আরও প্রায় আধ ঘন্টা হাঁটার পর ওরা পৌঁছল একটা গ্রামে। ছোট-ছোট গোল ঘর, কিন্তু মানুষজন বিশেষ দেখা গেল না। দুচারজন শুধু অতি বুড়োবুড়ি এক-একটা বাড়ির সামনে বসে আছে। অন্য সবাই নিশ্চয়ই কাজ করতে গেছে মাঠে কিংবা জঙ্গলে।
লছমন ওদের একটা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, বড় বাড়িতে নিয়ে এসে বলল, এটা ঘোটুল, ঘোটুল! এখানে তোমরা বসো!
কাকাবাবু বললেন, ও ঘোটুল! বুঝলি সন্তু। এখানে গ্রামের অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েরা রাত্রে এসে থাকে। এদের সমাজের ছেলেমেয়েরা বাবা-মার সঙ্গে থাকে না, বাচ্চা বয়েস থেকেই আলাদা থাকতে শেখে।
ওদের বসিয়ে রেখে লোকটি চলে গেল। খানিক বাদেই সে দুজন থুরথুরে বুড়ো মানুষকে নিয়ে ফিরে এল। সঙ্গে একটা মাটির হাঁড়ি আর এক গাদা ঘাস পাতা। বুড়ো দুজন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল জোজোকে। তারপর সেই ঘাসপাতার মধ্য থেকে বেছে-বেছে কয়েকটা পাতা ছিঁড়ে নিয়ে মাটির হাঁড়ির ভেতরের কী একটা কালো রঙের তরল জিনিসের সঙ্গে মেশাতে লাগল।
আন্দামানের একটা দ্বীপে জারোয়াদের একটা গ্রামে গিয়েছিল সন্তু। সেই গ্রামের ঘরবাড়ি কিংবা মানুষজনের সঙ্গে এই গ্রামটার চেহারা কিংবা মানুষজনের বিশেষ কিছু তফাত নেই। কিন্তু জারোয়ারা হিংস্র, তারা পোশাক পরে না, তাদের দেখলেই ভয় করে। আর এই মুরিয়ারা কিন্তু খুবই ভদ্র। বুড়োেদুটিও এসেই আগে কাকাবাবুকে হাতজোড় করে প্রণাম করেছিল।
কাকাবাবু বললেন, এদের ওষুধে অনেক সময় ম্যাজিকের মতন কাজ হয়। আমার আগের অভিজ্ঞতা আছে। সন্তু, তুই দ্যাখ, আমি একটু ঘুমিয়ে নিই। বড্ড ক্লান্ত লাগছে।
পাশেই একটা চাটাই পাতা আছে। কাকাবাবু তার ওপর শুয়ে পড়লেন। একটু পরেই তাঁর নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে বোঝা গেল যে, ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি।
সন্তু হিন্দি খুব কম জানে, এদের হিন্দিও অন্যরকম। তবু সে আকারে ইঙ্গিতে এদের সঙ্গে কথা চালিয়ে যেতে লাগল। কোনও অসুবিধে হল না। জোজোর সারা গায়ে কাদার মতন ওষুধ লেপে দিয়ে একটা তালপাতার পাখা এনে একজন জোরে জোরে হাওয়া করতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে। জোজোও ঘুমিয়ে পড়ল সেই হাওয়া খেয়ে। সন্তু জেগে বসে রইল একা।
দুপুরবেলা একদঙ্গল লোক দেখতে এল ওদের। লছমন ভাত আর কলাইয়ের ডালও নিয়ে এসেছে। কাকাবাবুকে ডেকে তুলতে হল তখন।
কাকাবাবু উঠেই চোখ কচলাতে কচলাতে বললেন, জোজো কোথায়? জোজোকে দেখে তিনি চিনতেই পারলেন না। চেনা সম্ভবও নয়। জোজোর গায়ে মাখানো পুরু কাদার মতন ওষুধ এখন শুকিয়ে গিয়ে মাটি মাটি রং হয়েছে। জোজোকে এখন দেখাচ্ছে কুমোরটুলির রং-না-করা একটা মাটির মূর্তির মতন।
লছমন জোজোর পাশে বসে পড়ে সেই ওষুধ খুঁটে খুঁটে তুলতে লাগল। খানিকবাদে সব উঠে গেলে জোজোর হাত ধরে বাইরে নিয়ে গিয়ে দু হাঁড়ি জল ঢেলে দিল তার মাথায়। জোজো একটুও আপত্তি করছে না।
ভিজে গায়ে ফিরে এসে সে বলল, এখন বেশ ভাল লাগছে রে, সন্তু। একটুও ব্যথা নেই।
কাকাবাবু বললেন, দেখলি এদের আশ্চর্য চিকিৎসা।
এরপর খেতে বসতে হল ওদের। গরম গরম লাল রঙের ভাত আর কলাইয়ের ডাল অপূর্ব লাগল। জোজো আর সন্তু দুজনেই ভাত খেয়ে নিল অনেকখানি। কাকাবাবু বললেন, একটা করে আলুসেদ্ধ থাকলে আরও ভাল লাগত, কী বল? তবে রাত্তিরে যদি থাকিস, তা হলে এরা শুয়োরের মাংস খাওয়াতে পারে। এরা রাত্তিরেই ভাল করে খায়।
খাওয়া হয়ে গেলে কাকাবাবু তিন-চারজন বয়স্ক লোককে একপাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে নানারকম খোঁজখবর নিতে লাগলেন।
তারপর তিনি মাটিতে উবু হয়ে বসে একটা কাঠি দিয়ে ম্যাপ আঁকতে লাগলেন মাটির ওপরে।
ম্যাপের চর্চা করা কাকাবাবুর শখ। তিনি চোখ বুজে বঙ্গদেশের ম্যাপ এঁকে দিতে পারেন। কিন্তু এখানকার লোকরা ম্যাপ বোঝে না। কাকাবাবু যে
জায়গাটার সন্ধান জানতে চাইছেন, সেটা এরা বুঝতে পারছে না কিছুতেই।
কাকাবাবু এবার একটা ছোট মন্দির আঁকলেন, তারপর তার সামনে একটা লম্বামতন মূর্তি। কাকাবাবু সেটার ওপর আঙুল দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই মন্দিরটা কোথায় বলতে পারো?
তিনজন বৃদ্ধ মাথা নেড়ে হ হ হ হ করতে লাগল। কিন্তু কোথায় যে মন্দিরটা সেটা কিছুই বলতে পারে না।
বাইরে যে কয়েকজন লোক ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল, তাদের মধ্যে একজন লোক এগিয়ে এসে কাকাবাবুর আঁকা ছবিটা দেখল মন দিয়ে। তারপর সে ছবিটার সামনে শুয়ে পড়ে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে বলল, আমি জানি। আমি দেখিয়ে দিতে পারি।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কত দূরে? কতক্ষণ লাগবে যেতে?
লোকটি বলল, এই সামনে একখানা পাহাড়, তার পরের পাহাড়ে।
কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে জোজোকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন হাঁটতে পারবে? আমাদের মনে হয়, বেশি সময় নষ্ট করা উচিত নয়।
জোজো বলল, হ্যাঁ, হাঁটতে পারব।
তা হলে চলল, বেরিয়ে পড়া যাক!
তিনজন বুড়ো তখন কাকাবাবুর হাত চেপে ধরল। তারা কাকাবাবুকে ছাড়তে চায় না। কাকাবাবুকে তারা রাত্তিরটা থেকে যেতে বলছে।
কাকাবাবু কিছু বলতে যেতেই তারা না, না, না, না বলে মাথা নাড়ছে। কাকাবাবু অতি কষ্টে তাদের বোঝালেন যে, এখন একটা বিশেষ কাজে তাঁকে চলে যেতেই হবে, ফেরার সময় তিনি এখানে আসবার চেষ্টা করবেন।
তারপর তিনি লছমনকে একপাশে ডেকে দুখানা কুড়ি টাকার নোট তার হাতে দিতে গেলেন। লছমন সে টাকা কিছুতেই নেবে না। খুব জোরে জোরে মাথা নাড়তে লাগল।
শেষপর্যন্ত কাকাবাবু লজ্জিত হয়ে টাকাটা পকেটে পুরে ফেললেন।
সন্তুদের তিনি বললেন, এরা কীরকম ভদ্র দেখছিস? আমাদের যত্ন করে খাওয়াল, জোজোর চিকিৎসা করল..এরা গরিব হতে পারে কিন্তু খুব আত্মসম্মান জ্ঞান আছে, কিছুতেই পয়সা নিতে চায় না। আবার রাত্তিরে থেকে যেতে বলছে। আমাদের উচিত ছিল, এদের কিছু উপহার দেওয়া, কিন্তু কিছুই তো নেই আমাদের কাছে।
যে-লোকটি মন্দিরের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, তার নাম শিবু। সে লছমনকেও সঙ্গে নিয়ে নিল। আবার শুরু হল হাঁটা।
সামান্য একটা জঙ্গল পার হওয়ার পরেই উঠতে হবে পাহাড়ে। ক্রাচ নিয়ে পাহাড়ে উঠতে কাকাবাবুর খুবই কষ্ট হয়। তবু তিনি দাঁতে দাঁত চেপে উঠতে লাগলেন। ঘাম গড়িয়ে পড়তে লাগল তাঁর কপাল দিয়ে। মাথার ওপর গনগন করছে দুপুরের সূর্য। জঙ্গলের মধ্যে তবু ছায়া-ছায়া ভাব ছিল, এই পাহাড়টা একেবারে ন্যাড়া।
সেই পাহাড়টি পেরিয়ে যাওয়ার পর একটা ছোট নদী পার হতে হল। সে-নদীতে এখন জল প্রায় নেই, বালিই বেশি। সামনেই একটা ছোট পাহাড়, সেটা ছোট-ছোট খাদে ভরা। এখানে ঢেউয়ের মতন একটার পর একটা পাহাড়।
তলা থেকেই দেখা যায়, সেই পাহাড়ের মাঝখানে একটা মন্দিরের চূড়া। শিবু হাত দেখিয়ে বলল, ওই যে!
কাকাবাবু বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। এত কাছে যে মন্দিরটা হবে, তা তিনি আশাই করেননি। আগের গ্রামের বৃদ্ধরা তা হলে বলতে পারল না কেন? তারা কি ছবিটা দেখে বুঝতে পারেনি।
নতুন উৎসাহ নিয়ে কাকাবাবু এবারে উঠতে লাগলেন পাহাড়টায়। মন্দিরটা দেখে সন্তুর ইচ্ছে করছে দৌড়ে আগে আগে উঠে যেতে। কিন্তু কাকাবাবু তাড়াতাড়ি যেতে পারবেন না, জোজো কোনও রকমে তার কাঁধ ধরে ধরে হাঁটছে। বেচারি জোজো পিঁপড়ের কামড় খাওয়ার পর থেকে একেবারে চুপসে গেছে, মুখে আর কোনও কথা নেই।
কপা কপ কপ কপ শব্দ শুনে সন্তু একবার পেছন ফিরে তাকাল। ছোট-ঘোট ঘোড়ায় চেপে চারজন লোক আসছে এদিকে। এখানে একটা পায়ে-চলা পথ আছে, সন্তুরা একপাশে সরে দাঁড়াল। ঘোড়াগুলো তাদের পাশ দিয়ে চলে গেল, লোকগুলো তাদের দিকে কৌতূহলী চোখে তাকাল বটে কিন্তু
কোনও কথা জিজ্ঞেস করল না।
ছোট হলেও এই পাহাড়টা বেশ খাড়ামতন, ঘোড়াগুলোও উঠছে আস্তে-আস্তে। কাকাবাবু খুবই হাঁপিয়ে গেছেন, কিন্তু একবারও থামবার কথা বলছেন না।
মন্দিরটার কাছে পৌঁছতে আরও প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল।
একটা চৌকো মতন পাথরের মন্দির, তাতে সাদা চুনকাম। এমন কিছু পুরনো নয়। কাছাকাছি কোনও গ্রাম নেই, এখানে এরকম একটা মন্দির কে তৈরি করল কে জানে!
কাকাবাবু সামনের চাতালে দাঁড়িয়ে রুমাল বার করে মুখ মুছতে লাগলেন। সন্তু দৌড়ে গেল মন্দিরের ভেতরের মূর্তিটা দেখবার জন্য। ধুতি-পরা একজন লোক পেছন ফিরে বসে আছে মূর্তিটার সামনে। খালি গা, পিঠের ওপর বেশ মোটা একটা পৈতে।
মূর্তিটা প্রায় এক হাত উঁচু, নীলচে রং, ঠিক কোন্ যে ঠাকুর, তা বোঝা গেল। অনেকটা যেন মা-কালীর মূর্তির মতন, কিন্তু জিভ কামড়ানো নয়। পায়ের নীচে মহাদেবও নেই। ধুতি-পরা পুরোহিতটির চেহারা দেখেও এখানকার আদিবাসী মনে হয় না।
কাকাবাবু এবারে আস্তে-আস্তে এসে সন্তুর কাছে দাঁড়ালেন। তারপরই অবাক হয়ে বললেন, আরে, এ মূর্তিটা তো নয়। এ তো অন্য মন্দির!
সন্তু বলল, নীল রং কিন্তু!
কাকাবাবু বললেন, তা হোক, অংশুমান চৌধুরীর কাছে আমি মূর্তিটার একটা কপি দেখেছি। সেটা একেবারে অন্যরকম। আরও লম্বা। সেটা পুরুষের মূর্তি, পায়ে গামবুট। আমরা ভুল জায়গায় এসেছি।
মন্দিরের পুরোহিতটি এবারে মুখ ফিরিয়ে ওদের দিকে খুব অবাকভাবে চেয়ে রইলেন কয়েক পলক। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বললেন, আপনারা কোথা থেকে আসছেন?
বস্তারের জঙ্গলে, একটা ছোট পাহাড়ের ওপর মন্দিরের পুরোহিতকে বাংলায় কথা বলতে শুনে ওরা তিনজনেই অবাক। সন্তু জিজ্ঞেস করেই ফেলল, আপনি বাংলা জানেন? কী করে বাংলা শিখলেন?
পুরোহিতটি ফ্যাকাসেভাবে হেসে বললেন, বাঙালির ছেলে বাংলা জানব না? অবশ্য বাঙালি ছিলাম অনেক আগে, এখন আর নেই।
কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, আপনাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আসুন, মন্দিরের মধ্যে বসে একটু বিশ্রাম করে নিন।
কাকাবাবু ক্রাচ দুটো নামিয়ে রেখে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে পড়ে বললেন, একটু জল খাব।
পুরোহিত মন্দিরের পেছন দিয়ে গিয়ে একটা পেতলের ঘটি ভর্তি জল আনলেন। খুব ঠাণ্ডা জল। ওরা তিনজনেই জল খানিকটা পান করল, আর খানিকটা দিয়ে চোখমুখ ধুয়ে নিল।
জোজো বলল, আর একটু জল খাব।
এবারে পুরোহিত আর এক ঘটি জলের সঙ্গে আনলেন কয়েকটা তিলের নাড়। সেগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন, একটু মিষ্টি খেয়ে তারপর জল খান। নইলে তেষ্টা মিটবে না।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আগে দণ্ডকারণ্যে ছিলেন, তাই না?
পুরোহিত এবারে চমকে গেলেন খানিকটা। কাকাবাবুর মুখের দিকে। একটুক্ষণ অবাকভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনি কী করে বুঝলেন?
কাকাবাবু বললেন, আপনার বাংলার মধ্যে পূর্ববঙ্গের একটা টান আছে। তাই আন্দাজ করা এমন কিছু শক্ত নয়।
পুরোহিত বললেন, আমার নাম ধনঞ্জয় আচার্য। এক সময় দন্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু কলোনিতে ছিলাম। সেখানে কষ্ট ছিল খুব। একদিন মা কালী আমায় স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন, তুই ড়ুমড়ুমি পাহাড়ে যা, সেখানে আমার ভাঙা মন্দির দেখতে পাবি। সেখানে গিয়ে আমার মূর্তি স্থাপন কর, তা হলে তুই উদ্ধার পেয়ে যাবি। ড়ুমড়ুমি পাহাড় কোথায় তা তো চিনতাম না। ক্যাম্প ছেড়ে তবু বেরিয়ে পড়লাম। দিনের পর দিন এই দিকের সব পাহাড়ে ঘুরেছি। কতদিন কিছু খাওয়া জোটেনি, কখনও গাছের ফলমূল খেয়ে কাটিয়েছি। তারপর এই পাহাড়ে এসে ভাঙা মন্দিরের সন্ধান পেলাম। তখন ভেবেছিলাম, এখানে মন্দিরে যদি থেকে যাই, তা হলে খাব কী? এই পাহাড়ের ওপর কে আসবে? তবু রয়ে গেলাম। প্রথম তিনদিন-চারদিন একজন মানুষও আসেনি, আমি একেবারে উপবাস করে কাটিয়েছি। ঠিক করেছিলাম, যদি না খেতে পেয়ে মরতে হয়, তবু এখান থেকে যাব না। তারপর আস্তে-আস্তে লোকেরা কী করে যেন এই মন্দিরের কথা জেনে গেল। এখন অনেকেই আসে।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, দেখছি তো, ঘোড়ায় চড়ে অনেক লোক আসছে।
ধনঞ্জয় আচার্য বললেন, আমি ছাড়া আরও পাঁচজন লোক এখন এই মন্দিরে থাকে। আমি পাহাড় থেকে নীচে নামি না। ওরাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনে। আপনারা এদিকে এলেন কী করে? এ পর্যন্ত এখানে আর কোনও বাঙালি আসেনি।
কাকাবাবু বললেন, আমরাও এদিকে এসেছি একটা মন্দিরের খোঁজে। কাছাকাছি গ্রামের একজন লোক আমাদের পথ দেখিয়ে এখানে নিয়ে এল। কিন্তু আমি খুঁজছি একটা অন্য মন্দির। আপনি বোধহয় আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।
কাকাবাবু তাঁকে গামবুটের মতন জুতো পরা পুরুষ-দেবতার মূর্তিটির কথা বুঝিয়ে বললেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এই মূর্তিটি এই তল্লাটে কোথায় আছে বলতে পারেন?
ধনঞ্জয় আচার্য দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, না, এরকম কোনও মূর্তির কথা আমি শুনিনি। বললাম তো, আমি এই পাহাড় থেকে নীচে নামি না। আপনি বলছেন, জুতো-পরা মূর্তি। এটা আবার কী ঠাকুর?
কাকাবাবু বললেন, তা আমি জানি না। বইয়ে পড়েছি এই মূর্তিটার কথা, সেইজন্যেই সেটা দেখার এত কৌতূহল।
ধনঞ্জয় আচার্য বললেন, দেখি আমার লোকেরা কেউ কিছু সন্ধান দিতে পারে কি না!
তিনি দুজন লোককে ডেকে অনেকক্ষণ ধরে ওখানকার ভাষায় কথা বলতে লাগলেন। সন্তুরা সেই ভাষা এক বর্ণ বুঝতে পারল না।
কাকাবাবু সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, সেবারে নেপাল গিয়ে তুই তো খুব ঘোড়ায় চেপেছিলি। মনে আছে? এখন ঘোড়ায় চাপতে পারবি?
সন্তু বলল, হ্যাঁ, পারব।
জোজো এতক্ষণে খানিকটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সে বলল, আমি খুব ভাল ঘোড়া চালাতে জানি। বাবার সঙ্গে একবার টার্কিতে গিয়ে প্রত্যেকদিন ঘোড়ায় চড়ে কত মাইল যে গেছি!
কাকাবাবু বললেন, বাঃ, তা হলে তো খুব ভাল কথা। ভাবছি, এই পুরুতমশাইয়ের কাছ থেকে দুটো অন্তত ঘোড়া ধার চাইব। এখান থেকে ঘোড়ায় যেতে পারলে অনেক পরিশ্রম বাঁচবে।
কাছেই একটা গাছে কয়েকটা ঘোড়া বাঁধা আছে। সন্তু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল জোজো, আমরা একটু ঘোড়ায় চড়া প্রাকটিস করি। ওদের বললে ওরা নিশ্চয়ই একটু চাপতে দেবে।
জোজো নাক সিঁটকে বলল, এইটুকু ছোট ছোট ঘোড়া, এতে কী চাপব! এগুলো তো গাধা! আমি বিরাট-বিরাট ঘোড়া, যাকে ওয়েলার ঘোড়া বলে, সেই ঘোড়ায় চাপতে পারি!
সন্তু বলল, ওই গাঁট্টাগোট্টা লোকগুলো এই ছোট ঘোড়ায় চেপেই তো ঘুরে বেড়ায়। আমরা কেন পারব না? চল না দেখি!
সন্তু জোজোর হাত ধরে জোর করে টেনে নিয়ে গেল। গাছতলায় যে লোকগুলো দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, আমাদের একটু ঘোড়ায় চাপতে দেবেন?
ওদের সঙ্গে শিবু নামে যে লোকটি এসেছিল, সেও গল্প করছিল এখানকার লোকদের সঙ্গে। সেই শিশু সন্তুদের কথা ভাল করে বুঝিয়ে বলল ওদের।
ওরা সঙ্গে-সঙ্গে রাজি। দুটো ঘোড়া খুলে এনে ওদের সাহায্য করল পিঠে চাপতে। তারপর একজন করে ঘোড়ার দড়ি ধরে হাঁটাতে লাগল ঘোড়াটাকে। ওরা গোল হয়ে খানিকটা জায়গা ঘুরল।
সন্তু বলল, এই ঘোড়াগুলো বেশ শান্ত রে, জোজো। কোনও অসুবিধেই হচ্ছে না।
জোজো ঠোঁট উল্টে অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, বাঃ, এগুলো আবার ঘোড়া নাকি, গাধার অধম। আমি ঘোড়া ছুটিয়েছি, এইট্টি, নাইনটি মাইলস্ স্পিডে! আরব। দেশের আসল ঘোড়া।
সন্তু তার সঙ্গের লোকটিকে বলল, আপনি একবার একটু ছেড়ে দিন না, নিজে নিজে চালাই।
দুজন লোকই ঘোড়ার দড়ি ছেড়ে দিল। জোজো তার ঘোড়ার পেটে একটা লাথি মেরে চেঁচিয়ে বলল, হ্যাট, হ্যাট, হ্যাট…
সঙ্গে সঙ্গে ঘোড়াটা তড়বড়িয়ে ছুটতে শুরু করল, আর জোজো ছিটকে পড়ে গেল তার পিঠ থেকে। তবে সৌভাগ্যবশত সে পড়ল একটা ঝোপের ওপর, তার চোট লাগল না।
তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে জামা ঝাড়তে ঝাড়তে জোজো বলল, দেখলি, দেখলি সন্তু, কীরকম একখানা ড্রাইভ দিলাম? তুই পারবি?
কাকাবাবু মন্দিরের সিঁড়িতে বসে ওদের দেখছেন আর হাসছেন।
এরপর তিনি নিজে যখন ঘোড়ায় চাপবেন, তখন জোজো আর সন্তুও বোধহয় হাসবে। তাঁরও অনেকদিন ঘোড়ায় চড়া অভ্যেস নেই, তা ছাড়া খোঁড়া পা নিয়ে অসুবিধে হবে। কিন্তু ঘোড়া ছাড়া এখানে পায়ে হেঁটে বেশি দূর ঘোরাঘুরি করা সম্ভব নয়।
ধনঞ্জয় আচার্য তাঁর লোকদের সঙ্গে কথা শেষ করে কাকাবাবুর কাছে এসে বললেন, হ্যাঁ, ওদের একজন ওই মূর্তিটার কথা জানে। নিজের চোখে দেখেনি, তবে অন্যদের কাছে শুনেছে। ওর কথা বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু ওখানে আপনার যাওয়ার দরকার নেই।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কেন বলুন তো?
ধনঞ্জয় বললেন, জায়গাটা অনেক দূর। অবুঝমাঢ় পেরিয়ে আরও অনেকখানি। আপনি তিরাংদের নাম শুনেছেন?
কাকাবাবু বললেন, আমি মারিয়া, আর মুরিয়াদের কথা জানি। এই সব জায়গায় আগে একবার ঘুরেছি। কিন্তু তিরাংদের কথা তো শুনিনি।
এদের কথা খুব কম লোকই জানে। মাত্র দুতিনখানা গ্রামে এরা থাকে। এদের একটা গ্রামে এই মূর্তি আছে। সেখানে বাইরের লোক বিশেষ কেউ যায় আসে না।
এরা কি হিংস্র নাকি? বাইরের লোক দেখলে আক্রমণ করতে আসে?
সেরকম কিছু শোনা যায়নি। মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীরা এমনিতে বেশ শান্ত। কিন্তু কোনও কারণে রেগে গেলে তখন আর হিতাহিত-জ্ঞান থাকে না। তখন একেবারে খুন করে ফেলতেও এদের চোখের একটি পাতাও কাঁপে না। আপনি নিজে…মানে…আপনার দুটি পা ঠিক নেই, সঙ্গে দুটি অল্পবয়েসী ছেলে, এই অবস্থায় আপনাদের ওদিকে যাওয়া উচিত হবে না।
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, মুশকিল কী জানেন, আমি যদি যেতে নাও চাই ছেলেদুটি ছাড়বে না। ওরা বড্ড জেদি। জায়গাটা ঠিক কোথায়, আপনি একটু ম্যাপ এঁকে বুঝিয়ে দেবেন?
জেনেশুনে আপনাদের ওই বিপদের মধ্যে পাঠাই কী করে?
কাছাকাছি গিয়ে দেখে আসি অন্তত, সে রকম বিপদ দেখলে ভেতরে ঢুকব। আর একটা কথা, ধনঞ্জয়বাবু আপনার শিষ্যদের তো বেশ কয়েকটা ঘোড়া রয়েছে দেখছি। তার থেকে দুটো ধার নিতে পারি? ঘোড়া ছাড়া অতদূর যাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা ঘোড়াদুটো বাবদ কিছু টাকা জমা রেখে যাব আপনার কাছে।
টাকার কথা উঠছে না, আপনাদের আমি অবিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি মনে শান্তি পাচ্ছি না।
কাকাবাবু তবু বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ধনঞ্জয় আচার্যকে দিয়ে একটা ম্যাপ আঁকিয়ে নিলেন। ওখানে কোনও সাদা কাগজ নেই, মন্দিরের দেওয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছিল, তারই একটা পাতা ছিঁড়ে নেওয়া হল। কলম পাওয়া গেল সন্তুর কাছে।
ধনঞ্জয় আচার্য এককালে একটু-আধটু লেখাপড়া জানতেন, কিন্তু গত পঁচিশ বছর কিছুই লেখেননি, তাই বাংলা অক্ষর লিখতে ভুলে গেছেন। অবুঝমাঢ় লিখতে গিয়ে অ অক্ষরটাই লিখতে পারেন না।
কাকাবাবু বললেন, আপনি জায়গাগুলোর নাম বলুন, আমি লিখে নিচ্ছি।
দেখতে-দেখতে সন্ধে হয়ে এল। মন্দিরের কাছাকাছি জঙ্গলের গাছে অনেক রকম পাখি ডাকছে। একটু দূরে একটা কোনও পাখি খুব জোরে পিয়াও পিঁয়াও করে ডাকছে, গলায় তার সাংঘাতিক জোর।
সন্তু বলল, এটা কী পাখি? এরকম ডাক তো শুনিনি!
জোজো বলল, এটা মোটেই পাখি নয়, এটা ফেউয়ের ডাক। বাঘ বেরুলেই পেছন পেছন ফেউ বেরোয় শুনিনি? আমি খুব ভাল চিনি।
সন্তু বলল, ভ্যাট, ফেউ আবার কী? ফেউ তো আসলে শেয়াল, বাঘ দেখে ভয় পেয়ে শেয়ালের ডাক তখন বদলে যায়। এটা পাখিরই ডাক।
জোজো বলল, তুই কিছু জানিস না। এটা পাখি হতেই পারে না। এটা নির্ঘাত ফেউ।
দুজনে তর্ক করতে করতে এক সময় বাজি ধরে ফেলল। এক বোতল কোল্ড ড্রিংক।
ওরা কাকাবাবু আর ধনঞ্জয় আচার্যর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ওটা কী ডাকছে?
কাকাবাবু উত্তর দেওয়ার আগেই ধনঞ্জয় আচার্য বললেন, ওটা তো ময়ূর। এদিকের জঙ্গলে কিছু ময়ুর আছে।
সন্তু প্রথমে লজ্জা পেল। ময়ূরের ডাক সে আগে অনেক শুনেছে, তার চিনতে পারা উচিত। এখানে ডাকটা খুব জোরে শোনাচ্ছে।
তারপরই সে জোজোকে বলল, তুই হেরে গেছিস! কোল্ড ড্রিংকটা পাওনা রইল। কলকাতায় ফিরে গিয়ে খাওয়াতে হবে কিন্তু!
জোজো বলল,হেরেছি মানে? ময়ূর কি পাখি? আবার তর্ক লাগিয়ে দিল ওরা।
কাকাবাবু ধনঞ্জয় আচার্যকে জিজ্ঞেস করলেন, এই জঙ্গলের মধ্যে মন্দির করেছেন, এখানে বুনো জন্তু-জানোয়ার আসে না?
ধনঞ্জয় আচার্য বললেন, সন্ধের দিকে প্রায়ই হাতি আসে। আজ তো এখানেই থাকছেন আপনারা। হয়তো দেখতে পেয়ে যাবেন।