গাড়িটা একটু আগেই থেমে গেল। প্রথম দু-এক মিনিট গাড়ি থেকে কেউ নামল না। ইঞ্জিনের শব্দ হতে লাগল ধক ধক ধক ধক করে। জ্বলতে লাগল। হেডলাইট। তারপর গাড়ি থেকে প্রথমে নামল রাও, তারপর ভীমু, তারপর লর্ড, তার মাথায় একটা ফেট্টি বাঁধা। একেবারে শেষে অংশুমান চৌধুরী।
রাও-এর হাতে রাইফেল, অংশুমান চৌধুরীর হাতে তার লাঠি, ভীমুর হাতেও কী যেন একটা রয়েছে।
রাও জিজ্ঞেস করলেন, এই জায়গাটাই তো ঠিক?
লর্ড বলল, হ্যাঁ, আমার মনে আছে, এ রাস্তা দিয়ে কতবার গেছি। ডান দিকে একটু খুঁজলেই নিশ্চয়ই গাড়িটা পাওয়া যাবে।
কেউ কি সিরিয়াসলি ইনজিওর্ড হয়েছে?
মনে তো হয় না। কাছাকাছি থাকবে ওরা।
অংশুমান চৌধুরী জোরে দুবার নিঃশ্বাস টেনে বললেন, ভীমু এখানে একটা জন্তু-জন্তু গন্ধ পাচ্ছি।
ভীমু বলল, কই না তো স্যার। কিছু তো দেখা যাচ্ছে না!
দেখা না গেলেও গন্ধ পাওয়া যায়। খুব বিচ্ছিরি বোঁটকা গন্ধ।
লর্ড বলল, এইখানেই দুটো ভাল্লুক ছিল, সেই গন্ধ পেতে পারেন। জঙ্গলে এসে কোনও না কোনও জন্তুর গন্ধ পাবেনই! এড়াবেন কী করে?
অংশুমান চৌধুরী বললেন, সে ব্যবস্থাও আমি করে এসেছি। ভীমু আমার লাঠিটা ধর তো?
পকেট থেকে তিনি একটা মুখোশ বার করলেন। সেটা দুহাত দিয়ে টেনে ঠিক করতে করতে বললেন, এটা আমার নিজের তৈরি। জঙ্গলের জন্য স্পেশ্যাল, কোনও গন্ধ আমার নাকে আসবে না। হাওয়া ঘেঁকে আসবে।
অংশুমান চৌধুরী মুখোশটা পরে ফেললেন। সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর মুখটা বদলে গেল, নাকের জায়গাটা এমন অদ্ভুত যেন একজন মানুষের দুটো নাক। সেই মুখোশ পরে এদিক-ওদিক তাকিয়ে তিনি বললেন, এবার রাজা রায়চৌধুরীকে একটু শিক্ষা দিতে হবে। লোকটার বড় বাড় বেড়েছে।
রাও বললেন, অংশুমানবাবু আপনি আর ভীমু এই গাড়িটার কাছে দাঁড়ান, ভাল করে নজর রাখবেন। আমরা অন্য গাড়িটার অবস্থা দেখে আসছি।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, ঠিক আছে, চটপট ঘুরে আসুন।
নিস্তব্ধ রাত, ওদের প্রত্যেকটি কথাই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। গাড়ির হেড লাইটটা জ্বালাই রয়েছে। মুখোশ-পরা অংশুমান চৌধুরীকে মনে হল অন্য গ্রহের মানুষ। হাওয়ায় একবার গাছের পাতার সরসর শব্দ হল। একটা বড় ঝুপসি গাছের মধ্যে কিসের যেন একটা ঝটাপটির আওয়াজ শোনা গেল।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, ভীমু, দেখে আয় তো ওখানে কেউ লুকিয়ে আছে কি না?
ভীমু বলল, না স্যার, মনে হচ্ছে, পাখির বাসায় সাপ ঢুকেছে।
কী করে তুই বুঝলি? পাখির বাসায় সাপ কেন ঢুকতে যাবে, সাপ তো মাটির গর্তে থাকে।
সাপ পাখির ডিম কিংবা বাচ্চা চুরি করে খেতে যায়। সাপেরা চোর হয়? ঠিক আছে, তোর কথা সত্যি কি না দেখা যাক।
অংশুমান চৌধুরী তাঁর লাঠিটা তুলে টিপ করলেন। ঝুপসি গাছটায় এখনও ঝটাপটির শব্দ শোনা যাচ্ছে। অংশুমান চৌধুরীর লাঠির ডগা থেকে কয়েক ঝলক আগুনের শিখা ছুটে গেল সেই দিকে। গুলি নয়, কারণ, কোনও শব্দ নেই, শুধু আগুন। সঙ্গে সঙ্গে সেই গাছের খানিকটা অংশ ঝলসে গেল, আর চিচিচি করে কয়েকটা বাচ্চা পাখির কান্না আর ক্রোয়াঁ ক্রোয়াঁ শব্দে একটা বড় পাখির আর্তনাদ। তারপর বাসা সমেত পাখিগুলো খসে পড়ল মাটিতে।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, যা ভীমু, দেখে আয় ওর মধ্যে সাপ আছে। নাকি?
প্রায় দুশো গজ দূরে, একটা মোটা শিমুলগাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু সব দেখছেন। আস্তে-আস্তে সন্তু আর জোজোও তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল।
কাকাবাবু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে ওদের নিঃশব্দ থাকতে বললেন। তারপর আর-একটা হাতের ইঙ্গিত করে ওদের বোঝালেন পিছিয়ে যেতে। তিনি নিজেও এক-পা এক-পা করে পেছোতে লাগলেন।
বড় রাস্তা ছেড়ে তারা চলে এলেন অনেকখানি বনের গভীরে। কাকাবাবু রিভলভার হাতে নিয়ে মাঝে-মাঝেই ঘুরে দেখছেন চারদিক। হঠাৎ কোনও হিংস্র জানোয়ার সামনে পড়ে যাওয়া আশ্চর্য কিছু নয়।
একটা ফাঁকা জায়গা দেখেও তিনি থামলেন না। সন্তু আর জোজোকে ফিসফিস করে বললেন, ওরা আমাদের খুঁজবে। প্রথমে রাস্তার ওই দিকটায়, যে দিকে গাড়িটার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, সেই দিকেই দেখবে। তারপর এদিকে আসবে। ওদের কাছে ভাল অস্ত্রশস্ত্র আছে। সম্ভবত রাও-এর গাড়ির বুটে কিংবা নারানপুরের ওই বাড়িতে এসব জমা করা ছিল। ওদের সামনাসামনি পড়ে গেলে আমাদের ধরা দিতেই হবে, বুঝলি? সেই জন্য আমাদের আরও অনেকটা ভেতরে চলে যাওয়া দরকার।
এবারে কাকাবাবু টর্চটা মাটির দিকে মুখ করে জ্বালালেন। গোল করে খানিকটা জায়গা দেখে নিয়ে আবার বললেন, বড়-বড় জন্তু-জানোয়ারকে বেশি ভয় নেই, তারা চট করে মানুষকে আক্রমণ করে না, কিন্তু দেখিস, হঠাৎ কোনও সাপের গায়ে পা না পড়ে। আমি আলো দেখাব, তোরা আমার পেছন-পেছন আয়।
আরও প্রায় এক ঘন্টা চলার পর কাকাবাবু থামলেন। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, ওঃ, হাঁপিয়ে গেছি। গাড়ি ছেড়ে ওরা এতটা দূরে আসবে না মনে হয়। এবারে বিশ্রাম নেওয়া যাক।
জঙ্গলের মাঝখানে মাঝেমাঝে হঠাৎ-হঠাৎ খানিকটা ফাঁকা জায়গা দেখা যায়। এই জায়গাটাও সেরকম ফাঁকা, এমনকী সামান্য ঘাসও নেই। এদিক ওদিকে ছড়ানো কয়েকটা পাথর। এক পাশে একটা গাছ ঠিক মাঝখান থেকে ভাঙা, দেখলে মনে হয় হাতিতে ভেঙেছে। আকাশ মেঘলা। চাঁদ বা একটাও তারা দেখা যাচ্ছে না।
কাকাবাবু সেই ফাঁকা জায়গাটার ঠিক মাঝখানে বসে পড়ে বললেন, এখানেই রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাক। তোরা দুজনে শুয়ে পড়, ঘুমিয়ে নে,
আমি পাহারা দিচ্ছি।
সন্তু বলল, ঘুমোবার দরকার নেই। আমরাও জেগে থাকব।
জোজো বলল, হ্যাঁ, আমরাও জেগে থাকব।
কাকাবাবু বললেন, সবাই মিলে জাগার তো কোনও মানে হয় না। না ঘুমিয়ে পারা যাবে না। কাল অনেকখানি হাঁটতে হবে। আমাকেও ঘুমিয়ে নিতে হবে খানিকটা। রাত্তিরটা তোরা ঘুমো, ভোর হওয়ার পর আমিও ঘন্টা দু-এক ঘুমিয়ে নেব।
সন্তু আর জোজো তবু আপত্তি করতে লাগল।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, তোরা শুয়ে থাক। যদি ঘুম আসে তো ঘুমোবি!
একটু পরেই জোজোর নাক দিয়ে পিচ-পিচ শব্দ হতে লাগল। সন্তু তখনও ঘুমোয়নি। হঠাৎ বহু দূরে একটা যেন রাইফেলের গুলির শব্দ হল। সন্তু তখনই উঠে বসল ধড়মড়িয়ে। কাকাবাবু বললেন, ওরা কাকে গুলি করছে?
সন্তু বলল, বোধ হয় সেই ভাল্লুক!
হ্যাঁ, হতে পারে। ভাল্লুক খুব কৌতূহলী প্রাণী, সহজে ওই জায়গা ছেড়ে যাবে না। ওখানেই ঘুর ঘুর করবে।
কাকাবাবু, এদিকে কী যেন ছুটে আসছে।
কাকাবাবু রিভলভার তুলে ডানদিকে ফিরলেন। জঙ্গলের শুকনো পাতার খরখর শব্দ হচ্ছে। কিছু যেন ছুটে আসছে এদিকেই।
কাকাবাবু কান খাড়া করে আওয়াজটা শুনে বললেন, মানুষ নয়, বুনন শুয়োর হতে পারে।
তারপরই তিনি দেখতে পেলেন বনের মধ্যে পাশাপাশি দুজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ। অন্ধকারে যে-কোনও জন্তুর চোখই আগুনের মতন জ্বলে, শিকারিরা ওই চোখের রং দেখে বুঝতে পারে কোনটা কী প্রাণী।
কাকাবাবু বললেন, ও দুটো খরগোশ! দ্যাখ, চোখ কতটা নিচুতে!
সত্যিই দুটো খরগোশ জঙ্গল ছেড়ে চলে এল ফাঁকা জায়গায়। এখানে যে কয়েকজন মানুষ রয়েছে সে জন্য তারা ভ্রূক্ষেপও করল না, ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল অন্য দিকে।
তারপর আর কোনও শব্দ নেই। আরও কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সন্তু শুয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে ঘুম এসে গেল তার চোখে।
একসময় একটা চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে গেল সন্তুর। চোখ মেলেই দেখল, ভোরের আলো ফুটে গেছে। পাখি ডাকছে। আর পাগলের মতো জোজো চিৎকার করছে, মরে গেলুম, মরে গেলুম।
ঘুমের ঘোরে জোজো গড়িয়ে গিয়েছিল খানিকটা দূরে। কাকাবাবু আর সন্তু সেখানে এসে দেখল কাটা পাঁঠার মতন ছটফট করছে জোজো, দুহাতে মাটি চাপড়াতে চাপড়াতে বলছে, বাঁচাও, বাঁচাও, মরে যাচ্ছি, মরে গেলুম।
সন্তু ভাবছে জোজো ঘুমের ঘোরে দুঃস্বপ্ন দেখছে! কাকাবাবু দুহাতে জোজোকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে খানিকটা সরে এসে আবার মাটিতে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ইস, এ যে সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। জোজো, চোখ বুজে থাকো, চোখ খুলো না। ভয় নেই!
সন্তু এবারে দেখতে পেল জোজোর সারা গায়ে অসংখ্য লাল পিঁপড়ে। তার মুখখানা এত পিঁপড়েতে ছেয়ে গেছে যে চেনাই যাচ্ছে না। যেন কোটি কোটি পিঁপড়ে এসে আক্রমণ করেছে জোজোকে।
কাকাবাবু জোজোর জামার বোতাম খুলতে খুলতে বললেন, সন্তু, তুই ওর মুখ থেকে পিঁপড়ে ছাড়া, মাটি থেকে ধুলো নিয়ে ঘসে দে, চোখ দুটো সাবধান।
জামা-প্যান্টের মধ্য দিয়েও পিঁপড়ে ঢুকে গেছে, তাই কাকাবাবু চটপট ওর সব পোশাক খুলে দিলেন। যন্ত্রণায় জোজো মাটিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। তাকে ধরে রাখা যাচ্ছে না।
সন্তু আর কাকাবাবু তাকে জোর করে সেখান থেকে তুলে আবার আর-একটা জায়গায় শোয়ালেন। সেখানে কয়েকটা ইউক্যালিপটাস গাছের পাতা ঝরে পড়ে আছে। সেই শুকনো পাতা ঘষা হতে লাগল তার গায়ে।
এক. সময় সব পিঁপড়ে ছাড়ানো হল বটে, কিন্তু ততক্ষণে জোজোর সারা শরীর ফুলে গেছে। মুখখানা পাকা বাতাবি লেবুর মতন। চেঁচিয়ে গলা ভেঙে গেছে তার। সে ফ্যাসফ্যাস করে নির্জীবভাবে বলতে লাগল, জল, জল!
পিঁপড়ে ছাড়াতে গিয়ে কাকাবাবু আর সন্তুরও কম পরিশ্রম হয়নি। তাঁদেরও জলতেষ্টা পেয়ে গেছে। এখন জল কোথায় পাওয়া যায়!
কাকাবাবু বললেন, জোজোর দোষ নেই, গড়াতে গড়াতে খানিকটা দূরে চলে গেছে তো! ওখানে একটা উঁচু মতন ঢিবি, ওটা লাল পিঁপড়ের বাসা। ঘুমের ঘোরে জোজো ওই ঢিবিটাকে বালিশ বলে জড়িয়ে ধরেছে। ঢিবিটা ভেঙে যেতেই পিলপিল করে পিঁপড়েরা বেরিয়ে এসে ওকে আক্রমণ করেছে।
সন্তু বলল,ওরগাঢ় ঘুম। আমার গায়ে প্রথমে একটা দুটো পিঁপড়ে উঠলেই আমি জেগে যেতুম।
কাকাবাবু বললেন, আমাকেও এর মধ্যে কয়েকটা পিঁপড়ে কামড়ে দিয়েছে, ওইটুকু প্রাণীর কী বিষ, আমার হাত জ্বালা করছে।
সন্তু জোজোর সামনে মুখ ঝুঁকিয়ে বলল, জোজো, জোজো, এখন উঠতে পারবি?
জোজো ফিসফিস করে বলল, আমি চোখ মেলতে পারছি না। আমি কি মরে গেছি?
জোজোর চোখের পাতা দুটো ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।
কাকাবাবু জোজোর প্যান্ট আর শার্ট ঝেড়েকুড়ে দেখে নিলেন তার মধ্যে আর পিঁপড়ে আছে কিনা। তারপর সন্তুকে বললেন, এগুলো পরিয়ে দে। ও যদি হাঁটতে না পারে, ওকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর নীলমূর্তি খুঁজতে যাওয়া হবে না। এখন ছেলেটার চিকিৎসা করানোই সবচেয়ে আগে দরকার।
সন্তু জোজোর পোশাক পরিয়ে দিল। তারপর বলল, জোজো, জোজো, আমি তোর হাত ধরছি, একটু উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা কর।
জোজো বলল, পারছি না। গলা শুকিয়ে গেছে। আমি মরে যাচ্ছি রে, সন্তু!
এরই মধ্যে জোজোর গায়ে সাঙ্ঘাতিক জ্বর এসে গেছে। সে থরথর করে কাঁপছে।
সন্তু বলল, আমি ওকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে পারি। কাকাবাবু, তুমি একটু ধরো..
কাকাবাবু ক্রাচ দুটো রেখে, জোজোকে তুলে দিতে গেলেন সন্তুর কাঁধে। হঠাৎ একটা কুকুরের ডাক শুনে দুজনেই চমকে তাকালেন সামনের দিকে।
ফাঁকা জায়গাটার একধারে, জঙ্গলের প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে তিন জন মানুষ, তাদের খালি গা, পরনে নেংটি, হাতে তীর-ধনুক, আর প্রত্যেকের পাশেই একটা করে কুকুর।