একটা গাড়ির আওয়াজে সন্তুর ঘুম ভেঙে গেল। এমনিতেই তার খুব পাতলা ঘুম। তা ছাড়া নতুন কোনও জায়গায় প্রথম রাত্তিরে অন্তত ভাল করে ঘুমই হয় না।
রাত এখন কটা হবে কে জানে! দুটো-তিনটের কম নিশ্চয়ই নয়। সন্তুরা শুতেই গেছে বারোটার পর। পাশের খাটে ঘুমোচ্ছে জোজো। বিছানায় শোওয়া মাত্র সে ঘুমিয়ে পড়ে, এক ঘুমে রাত কাবার করে দেয়।
গাড়ির শব্দটা দূর থেকে এগিয়ে আসছে কাছে। মনে হল, বাংলোটার চার পাশ দিয়ে গাড়িটা একবার ঘুরে এল, তারপর গেটের কাছে থামল।
সঙ্গে-সঙ্গে উঠে বসে ডাকল, জোজো, জোজো!
জোজো উঠল না। সন্তু দু তিনবার ধাক্কা দিল তাকে। বাংলোর দরজায় খটখট করে শব্দ হচ্ছে, একবার কেউ ডেকে উঠল, সন্তু, সন্তু!
কাকাবাবুর গলা চিনতে পেরেই সন্তু তড়াক করে খাট থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দিল।
দরজার সামনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, মাধব রাও, ভীমু আর অংশুমান চৌধুরী, তাদের পেছনে রিভলভার হাতে কাকাবাবু। তাঁর এক বগলে শুধু কাচ। সন্তু সামনের তিনজনকে এড়িয়ে কাকাবাবুর পাশে গিয়ে দারুণ স্বস্তির সঙ্গে বলল, কাকাবাবু! তুমি এসেছ!
কাকাবাবু সন্তুর দিকে না তাকিয়ে আদেশের সুরে বললেন, টর্চটা ফেলে দাও, মাথার ওপর হাত ভোলো!
লর্ড নামের লোকটিও আওয়াজ শুনে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ঘুম চোখে সে প্রথমটা কিছুই বুঝতে পারেনি। কাকাবাবুর কড়া সুরের হুকুম শুনে সে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
কাকাবাবু তার কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, অংশুমান চৌধুরী, আপনার লোককে বলুন, মাথার ওপর হাত তুলতে, আমি বেশি সময় নষ্ট করতে পারব না।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, ওরে লর্ড, হাত তোল। যা বলছে শোন।
কাকাবাবু বললেন, আপনারা সবাই ভেতরে ঢুকুন। সন্তু তুই গিয়ে আলোটা জ্বেলে দে।
বাংলোটার মাঝখানের ঘরটা খাওয়ার ঘর। একটা গোল টেবিল ও চারখানা চেয়ার রয়েছে। কাকাবাবুর ইঙ্গিতে অংশুমান চৌধুরী, ভীমু, মাধব রাও আর লর্ড সেই চেয়ারগুলোতে বসলেন। কাকাবাবু দাঁড়িয়ে রইলেন একদিকের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। রিভলভারটা নামালেন না।
এবার তিনি সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন,তোর বন্ধু কোথায়?
সন্তু বলল, জোজো ঘুমোচ্ছে। ডেকে আনব?
কাকাবাবু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে এরপর লর্ড-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এই ছেলে দুটিকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছ?
লর্ড যেন আকাশ থেকে পড়ল এই কথা শুনে। চোখ বড় বড় করে সে বলল, কিডন্যাপ করব, আমি? কেন? আমি কত কষ্ট করে ছেলে দুটির সঙ্গে-সঙ্গে ছুটছি। যেখানে যেতে চাইছে সেখানেই নিয়ে যাচ্ছি, আর আপনি বলছেন, ওদের কিডন্যাপ করেছি? ওদের কি ধরে রাখা হয়েছে, না বেঁধে রাখা হয়েছে?
কাকাবাবু বললেন, ওদের কলকাতা থেকে এতদূর টেনে আনা হল কেন? আমি সেটা জানতে চাই।
লর্ড সেইরকমই অবাকভাবে বলল, ওদের কলকাতা থেকে টেনে আনা হয়েছে? কী আজব কথা বলছেন মশাই? আমি স্বচক্ষে দেখলুম, ওরা ট্রেন। থেকে নামল, আমার সঙ্গে নিজের ইচ্ছেতে গাড়িতে চাপল, সম্বলপুরে গেল, তারপরেও আমাকে এতদূর পর্যন্ত ছুটিয়ে বেড়াচ্ছে, ওরা নাকি আপনাকেই। খুঁজছে!
এই সময় জোজোকে নিয়ে ফিরে এল সন্তু। লর্ড ওদের দিকে আঙুল তুলে বলল, আপনি ওদেরই জিজ্ঞেস করুন না। একবারও ওদের গায়ে হাত দিয়েছি? একটুও জোর করেছি।
অংশুমান চৌধুরী বললেন, ওদের কেন কলকাতা থেকে আনা হয়েছে। আমি বলছি। জোজোকে এনেছি সন্তুকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। একজন বন্ধু থাকলে আপনার ভাইপো সন্তু একা-একা বোধ করবে না। আর সন্তুকে আনা হয়েছে আপনাকে সাহায্য করবার জন্য। আপনি বাইরে গেলেই এই ছেলেটি আপনার সঙ্গে থাকে, আমি জানি। আমাকে সাহায্য করবার জন্য যেমন ভীমু আছে, আপনাকে সাহায্য করবার জন্যও তেমন আপনার ভাইপো থাকবে, এই আমি চেয়েছিলুম। আমি ফেয়ার কমপিটিশানে বিশ্বাস করি!
কাকাবাবু বিদ্রুপের সঙ্গে হেসে বললেন, চুরির কমপিটিশান, তাও আবার ফেয়ার আর আনফেয়ার! সন্তু, তুই আর তোর বন্ধু জানিস আসল ব্যাপারটা কী?
সন্তু দু দিকে মাথা নাড়ল।
কাকাবাবু বললেন, এখানকার একটা আদিবাসী গ্রামে একটা নীল পাথরের দেবতার মূর্তি আছে। এরা সেটা চুরি করতে চায়। এই অংশুমান চৌধুরী সেই মূর্তিটার একটা নকল বানিয়ে এনেছে। কোনওরকমে সেই আদিবাসীদের গ্রামে গিয়ে নকল মূর্তিটা রেখে আসল মূর্তিটা চুরি করে আনাই এদের মতলব।
মাধব রাও বাধা দিয়ে বললেন, আমি আপত্তি করছি, মিঃ রায়চৌধুরী। আপনি বারবার বলছেন কেন চুরি? ওটা আমরা উদ্ধার করতে চাই, মূর্তিটার আসল মালিক আমরা, আদিবাসীরাই ওটা চুরি করেছে। পুলিশের সাহায্য নিয়ে উদ্ধার করতে গেলে দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে, সেই জন্য আমরা অন্য পথ নিতে চাইছি।
কাকাবাবু বললেন, ওটা যে আপনার বন্ধুর বাড়ি থেকে কোনও এক সময় চুরি হয়েছিল, সেটা আগে প্রমাণ করতে হবে। পুলিশের সাহায্য না নিয়ে গোপনে-গোপনে মূর্তিটা বদলে আসাও এক ধরনের চুরি। আমি তো আপনাদের কোনও সাহায্য করবই না, বরং আপনাদের মতলব যাতে বানচাল হয়ে যায়, আমি সে ব্যবস্থা করব। আমি আজ রাত্তিরেই এখানকার এস. ডি. ও.-কে খবর দেব।
তারপর তিনি সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তোরা এখানে কি গাড়িতে এসেছিস?
সন্তু বলল, হ্যাঁ। ওই লর্ড চালিয়ে এনেছে।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে আর-একটা গাড়ি আছে। ঠিক আছে। ঠিক আছে, আমরা সেই গাড়িতেই, যাব। এক্ষুনি রওনা হতে চাই, সন্তু তুই তৈরি হয়ে নে।
সন্তু বলল, আমি তৈরি। কিন্তু জোজো কী করবে?
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ও কি আমাদের সঙ্গে যেতে চায়?
জোজো একবার তার পিসেমশাইয়ের দিকে তাকাল, একবার কাকাবাবুর দিকে। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, আমি কলকাতায় ফিরে যাব!
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, চলো, বেরিয়ে পড়া যাক। তিনি এগিয়ে এসে রিভলভারটা দোলাতে দোলাতে বললেন, ভীমু, তোমার মনিবকে নিয়ে ওই ঘরটায় ঢুকে পড়ো। মাধব রাও, আপনিও উঠে পড়ন, ওই ঘরের মধ্যে যান। আজকের রাতটা আপনাদের তিনজনকে একসঙ্গে কাটাতে হবে।
মাধব রাও উষ্ণভাবে বললেন, আপনি আমাকেও কেন আটকে রাখতে চান? আমি আপনার কোনও ক্ষতি করিনি, আপনাকে জোর করে এখানে নিয়েও আসিনি।
কাকাবাবু বললেন, মাধব রাও, চাকরি থেকে রিটায়ার করে আপনার নিরিবিলিতে শান্তিতে জীবন কাটানো উচিত ছিল। চোরাই মূর্তির ব্যবসা করতে গেলে তো কোনও না কোনও সময় ধরা পড়তেই হবে!
মাধব রাও রাগ সামলাতে না পেরে হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে তেড়ে এলেন : কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে তাঁর ক্রাচটা তুলে মাধব রাও-এর পেটে খোঁচা দিয়ে আটকালেন। তারপর বললেন, আপনারা দুজনে মিলে আমার মেজাজ খুবই খারাপ করে দিয়েছেন। রাগের মাথায় আমি হঠাৎ গুলি চালিয়ে ফেলতে পারি। প্রাণে মারব না বটে, কিন্তু পা খোঁড়া করে দেব; যান, ওই ঘরের মধ্যে যান?
অংশুমান চৌধুরী কোনও প্রতিবাদ না করে আগেই ঢুকে পড়লেন ঘরের মধ্যে। তাঁর পেছনে পেছনে ভীমু। তারপর মাধব রাও। লর্ডও ঢুকতে যাচ্ছিল, কাকাবাবু তার দিকে হাত তুলে বললেন, তুমি দাঁড়াও! আমার একটা পা ভেঙে যাওয়ার পর থেকে আমি আর গাড়ি চালাতে পারি না। তুমি আমাদের গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে!
অন্য তিনজন ঘরে ঢুকে পড়ার পর কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, ওই দরজায় তালা লাগিয়ে দে। আজকে রাতটা ওখানেই থাক ওরা। এই বাংলোর চৌকিদার কোথায়?
সন্তু বলল, আমরা আর কাউকে দেখিনি। এই বাড়িটা খালিই ছিল।
কাকাবাবু বললেন, হুঁ, আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করা আছে। যাক, ভালই হল। ওরা চ্যাঁচামেচি করলেও এখন এত রাতে কেউ শুনতে পাবে না। কাছাকাছি আর তো কোনও বাড়ি দেখলুম না।
বাংলোর বাইরে এসে, বাইরের দরজাতেও তালা লাগিয়ে ওরা উঠে পড়ল একটা অ্যামবাসাডর গাড়িতে। লর্ডের পাশে কাকাবাবু। পেছনে সন্তু আর জোজো। এমনিতে এত স্মার্ট ছেলে জোজো, কিন্তু এখন তার মুখ দিয়ে একটাও কথা ফুটছে না।
কাকাবাবু লর্ডকে বললেন, আসবার পথে আমি থানায় একটা আলো জ্বলতে দেখেছি। প্রথমে সেখানে চলো, এস. ডি. ও.র বাড়ি খোঁজ করতে হবে।
লর্ড কোনও উত্তর দিল না।
কাকাবাবু বললেন, তোমার ভয় নেই, তোমাকে আমি এখন পুলিশে ধরিয়ে দেব না। তুমি আমাদের সঙ্গেই থাকবে।
এবারে লর্ড বলল, আমি কোনও দোষ করিনি। পুলিশ আমাকে ধরবে কেন?
কাকাবাবু বললেন, বেশ তো, ভাল কথা।
আলো দেখে থানাটা সহজেই চেনা গেল। কিন্তু সেখানে কেউ জেগে নেই। অনেক ডাকাডাকির পর একজনকে তোলা গেল, সে একজন কনস্টেবল। সে ভাল করে কথাই বলতে চায় না। তবে তার কাছ থেকে এইটুকু জানা গেল যে, এস. ডি. ও. কিংবা পুলিশের কোনও বড় অফিসার এখন নারানপুরে নেই। কী একটা জরুরি ডাক পেয়ে তাঁরা জগদলপুর গেছেন। সেখানে আরও বড় বড় অফিসাররা মিটিং করতে এসেছেন।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, জগদলপুরেই যাওয়া যাক তাহলে। বড় অফিসারের সঙ্গে কথা না বললে কোনও কাজ হবে না।
গাড়িটা আরও খানিক দূরে যাওয়ার পর কাকাবাবু লর্ডকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি অংশুমান চৌধুরীর লোক না মাধব রাও-পট্টনায়কদের লোক?
লর্ড বলল, আমি কারও লোক-নই। আমি একজন বেকার। আমার ওপর এই ছেলে দুটির দেখাশুনোর ভার দেওয়া হয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, বেকারের নাম লর্ড। বাঃ, বেশ ভাল তো!
লর্ড বলল, মা বাবা এই নাম দিয়েছেন, আমি তার কী করব?
তোমার জামাকাপড় দেখেও তো বেকার বলে চেনা যায় না। খুব শৌখিন বেকার বলতে হবে। তোমাকে এই কাজের দায়িত্ব কে দিয়েছে?
সেটা বলতে পারব না। নিষেধ আছে।
তোমার কানের মধ্যে রিভলভারের নলটা ঢুকিয়ে দিলেও বলবে না?
দেখুন স্যার, আমি নতুন গাড়ি চালাতে শিখেছি। আপনি এরকম ভয় দেখালে হঠাৎ অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যেতে পারে।
ঠিক আছে, তোমাকে আর ভয় দেখাব না। তুমি শুধু আর একটা কথার উত্তর দাও। যে নীল মূর্তিটার জন্য এতসব কাণ্ড হচ্ছে, এত টাকা খরচ হচ্ছে, সেই নীল মূর্তিটার বিষয়ে তুমি কিছু জানো?
না, কিছুই জানি না। আমি কোনও মূর্তির কথা শুনিনি।
তুমি কি নিবোধ? তোমাকে কেউ বলল, দুটি অচেনা ছেলেকে নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে, আর তুমি অমনি তাই শুরু করে দিলে? একবারও জানতে চাইলে না, কেন, কী ব্যাপার?
আমি ভেবেছিলাম, এটা কিছু একটা প্র্যাকটিক্যাল জোক।
তোমার দেখছি অদ্ভুত সেন্স অব হিউমার! তুমি যে সত্যি কথা বলছ না, তা কিন্তু আমি বুঝতে পারছি। মিথ্যে কথা বলার সময় মানুষের গা থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোয়, আমি সেই গন্ধ পাই।
পেছন দিকে মুখ ফিরিয়ে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু ঘুমিয়ে পড়েছিস?
সন্তু সবই শুনছিল, সে বলল, না।
কাকাবাবু বললেন, আমার একটা খটকা লাগছে। একটা পাথরের মূর্তির জন্য এরা এতখানি ঝুঁকি নিল কেন? মুর্তিটার জন্য এরা তিন লাখ টাকা পুরস্কার দিতে চায়, তা ছাড়াও আরও অনেক খরচ করছে। আদিবাসীদের একটা ঠাকুরের সাধারণ মূর্তির তো এত দাম হতে পারে না।
সন্তু বলল, মূর্তিটা একবার দেখে গেলে হয় না?
কাকাবাবু বললেন, আমি ঠিক সেই কথাই ভাবছি। আমার কলকাতায় ফেরা খুবই দরকার। কিন্তু মূর্তিটা একবার না দেখে যেতেও ইচ্ছে করছে না।
লর্ড এই সময় গাড়ির গতি কমিয়ে দিল। কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?
লর্ড কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, রাস্তার ওপরে…ওরা কারা?
হেড লাইটের আলোয় দেখা গেল রাস্তার মাঝখানে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে মনে হল, দুজন ওভারকোট পরা লোক ঝুঁকে পড়ে রাস্তার ওপরে কী যেন দেখছে। তারপর আর একটু কাছে আসতেই বোঝা গেল, মানুষ নয়, দুটো ভাল্লুক। এই গাড়ির দিকেই মুখ করে আছে।
লর্ড ভয় পেয়ে গাড়িটা ঘোরাতে যেতেই সেটা হুড়হুড়িয়ে গড়িয়ে গেল ডান পাশের একটা খাদে।